হৃৎপিঞ্জরের পাখী উড়ে এলো কার।
ত্বরা করে ধর গো সখি দিয়ে পীরিতের আধার।।
কোন কামিনীর পোষা পাখী, কাহারে দিয়েছে ফাঁকি,
উড়ে এলো দাঁড় ছেড়ে, শিক্লীকাটা ধরা ভার।।
এমন সময়ে গুরুদাসও এসে পড়লেন—গুরুদাস মনে করেছিলেন যে, যদি তিনিই কোন মেয়েমানুষের সন্ধান নাই পেলেন— তাঁর ইয়ারের একটা একটাকে অবশ্যই জুটিয়ে থাক্বে। এদিকে তার ইয়ারৈরা মনে করেছিলেন, যদিও তারাই কোন মেয়েমানুষের সন্ধান কত্তে পাল্লে না, গুরুদাসবাবু আর ছেড়ে আসবেন না। এদিকে শুরুদান নৌকায় এসেই, মেয়েমানুষ না দেখতে পেয়ে, মহা দুঃখিত হয়ে পড়লেন। কিন্তু নেশার এমন অনিৰ্বনীয় ক্ষমতা যে, তাতেও তিনি উৎসাহহীন হলেন না; গুরুদাস পুনরায় ইয়ারদের স্তোক দিয়ে মেয়েমানুষের সন্ধানে বেরুলেন। কিন্তু তিনি কোথায় গেলে পূর্ণমনোরথ হবেন, তা নিজেও জানে না। বোধ হয় তিনি যার অধীন ও আজ্ঞানুবর্তী হয়ে যাচ্চিলেন, কেবল তিনি মাত্র সে কথা বলতে পাতেন। গুরুদাসকে পুনরায় যেতে দেখে, তার ইয়ারেরাও তার পেছনে পেছুনে চল্লেন! কেবল নারায়ণ, ব্ৰজ ও কেদার নৌকায় বসে অত্যন্ত দুঃখেই—
নিশি যায় হায় হায় কি করি উপায়।
শ্যাম বিহনে সখি বুঝি প্রাণ যায়॥
হের হের শশধর অস্তাচলগত সখী
প্রফুল্লিত কমলিনী, কুমুদ মলিনমুখী
আর কি আসিবে কান্ত তুষিতে আমায়॥
গাইতে লাগলেন—মাঝীরা “জুয়ার বই যায়” বলে বারাম্বার ত্যক্ত কত্তে লাগলো, জলও ক্রমশ উড়েনচণ্ডীর টাকার মত জায়গা খালি হয়ে হটে যেতে লাগলো,–ইয়ারদলের অসুখের পরিসীমা রইল না!
গুরুদাস পুনরায় সহরটি প্রদক্ষিণ কল্লেন—সিঁদুরেপটী শোভাবাজারের ও বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরীতলাটাও দেখে গেলেন, কিন্তু কোনখানেই সংগ্রহ কত্তে পাল্লেন না-শেষে আপনার বাড়ীতে ফিরে গেলেন।
আমরা পূর্ব্বেই বলেছি যে, গুরুদাসের এক বিধবা পিসী ছিল। গুরুদাস বাড়ী গিয়ে তার পিসীরে বল্লেন যে, “পিসি! আমাদের একটি কথা রাখতে হবে।” তার পিসী বল্লেন, “বাপু গুরুদাস। কি কথা রাখতে হবে? তুমি একটা কথা বল্লে আমরা কি রাখবো না? আগে বল দেখি কি কথা?” গুরুদাস বল্লেন, “পিসি! যদি তুমি আমাদের সঙ্গে স্নানযাত্রা দেখতে যাও, তা হলে বড় ভাল হয়। দেখ পিসি, সকলে একটি দুটি মেয়েমানুষ নিয়ে স্নালযাত্রায় যাচ্চে, কিন্তু পিসি, শুদুই বা কেমন করে যাওয়া হয়? আমার নিজের জন্য যেন না হলো, কিন্তু পাঁচো ইয়ারের শুধু নিরিমিষ রকমে যেতে মন সচ্চে না—তা পিসি! অমোদ কত্তে কত্তে যাবো, তুমি কেবল বসে যাবে, কার সাদ্দি তোমারে কেউ কিছু বলে।” পিসী এই প্রস্তাব শুনে প্রথমে গাঁইগুঁই কত্তে লাগলেন, কিন্তু মনে মনে যাবার ইচ্ছাটাও ছিল, সুতরাং শেষে গুরুদাস ও ইরারদের নিতান্ত অনুরোধ এড়াতে না পেরে ভাইপোর সঙ্গে স্নানযাত্রায় গেলেন।
ক্রমে পিসীকে সঙ্গে নিয়ে গুরুদাস ঘাটে এসে পৌঁছিলেন; নৌকার ইয়ারের গুরুদাসকে মেয়েমানুষ নিয়ে আসতে দেখে, হুরুরে ও হরিবোল ধ্বনি দিয়ে বাঁয়ায় দামামার ধ্বনি কত্তে লাগলো, শেষে সকলে নৌকোয় উঠেই নৌকো খুলে দিলেন। দাঁড়িরা কোসে ঝপাঝপ দাঁড় বাইতে লাগলো। মাঝি হাল বাগিয়ে ধরে জোরে দেদার ঝিঁকে মাত্তে লাগলো। গুরুদাস ও সমস্ত ইয়ারে–
“ভাসিয়ে প্রেমন্ত্রী হরি যাচ্চ যমুনায়।।
গোপীর কুলে থাকা হলো দায়।
আরে ও! কদমতলায় বসি বাঁকা বাঁশরী বাজায়,
আর মুচকে হেসে নয়ন ঠেরে স্কুলে বউ ভুলায়।।
হরর্ হো! হো! হো!” গাইতে লাগলেন, দেখতে দেখতে নৌকাখানি তীরের মত বেরিয়ে গেল।
বড় বড় যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই আজ দুপুরের জোয়ারে নৌকা ছেড়েছেন। এদিকে জোয়ারও মরে এলো, ভাটার সারানী পড়লো–নোঙ্গর-করা ও খোঁটায় বাঁধা নৌকাগুলির পাছা ফিরে গেল— জেলেরা ডিঙ্গি চড়ে বেঁউতি জাল তুলতে আরম্ভ কল্লে। সুতরাং যিনি যে অবধি গেছেন, তারে সেইখানেই নোঙ্গর কত্তে হলো—তিলকাকুন বাবুদের পান্সি, ডিঙ্গি, বজরা ও বোট বাজার পোট জায়গায়। ভিড়ানো হলো–গয়নার যাত্রীরা কিনের পাশে পাশে লগি মেরে চল্লেন! পেনেটি, কামারহাটি কিম্বা খড়দহে জলপান করে, খেয়া দিয়ে মাহেশ পৌঁছুবেন।
কমে দিনমণি অস্ত গেলেন। অভিসারিণী সন্ধ্যা অন্ধকারের অনুসরণে বেরুলেন। প্রিয়সখী প্রকৃতি প্রিয়কার্যের অবসর বুঝে ফুলদামি উপহার দিয়ে বাসরের নিমন্ত্রণ গ্রহণ কল্লেন। বায়ু মৃদু মৃদু বীজন করে পশে দূর কত্তে লাগলেন; বক ও বালহাঁসেরা শ্রেণী বেঁধে চল্লো, চক্ৰবাকমিথুনের কাল সমর প্রদোষ, সংসারের সুখবর্দ্ধনের জন্য উপস্থিত হলো। হায়! সংসারের এমনি বিচিত্র গতি যে, কোন কোন বিষয় একের অপার দুঃখাবহ হলেও, শতকের সুখাস্পদ হয়ে থাকে।
পাড়াগাঁ অঞ্চলের কোন কোন গাঁয়ের বওয়াটে ছোঁড়ারা যেমন মেয়েদের সাঁজ সকালে ঘাটে যাবার পূর্ব্বে, পথের ধারে পুরণো শিবের মন্দির, ভাঙ্গা কোটা, পুকুরপাড় ও ঝোপে ঝাপে লুকিয়ে থাকে—তেমনি অন্ধকারও এতক্ষণ চাবি দেওয়া ঘরে, পাতকোর ভেতরে ও জলের জালায় লুকিয়ে ছিলেন—এখন শাঁক-ঘণ্টার শব্দে সন্ধ্যার সাড়া পেয়ে বেরুলেন—তার ভয়ানক মূর্ত্তি দেখে রমণীস্বভাবসুলভ শালীনতায় পদ্ম ভয়ে ঘাড় হেঁট করে চক্ষু বুজে রইলেন; কিন্তু ফচকে ছুঁড়ীদের আঁটা ভার—কুমুদিনীর মুখে আর হাসি ধরে না। নোঙ্গোর-করা ও কিনারার নৌকোগুলিতে গঙ্গাও কথনাতীত শোভা পেতে লাগলেন; বোধ হতে লাগলো যেন গঙ্গা গলদেশে দীপমালা ধারণ করে, নাচতে লেগেচেন। বায়ুচালিত ঢেউগুলি তবলা-বাঁয়ায় কাজ কচ্চে–কোনখানে বালির খালের নীচে একখানি পিনেশ নোঙ্গোর করে বসেছেন—রকমারী বেধড়ক চলছে। গঙ্গার চমৎকার শোভায় মৃদু মৃদু হাওয়াতে ও ঢেউয়ের ঈষৎ দোলায়, কারু কারু শ্মশানবৈরাগ্য উপস্থিত হয়েছে, কেউ বা ভাবে মজে পূরবী রাগিণীতে–