- বইয়ের নামঃ হুতোমপ্যাঁচার নক্সা
- লেখকের নামঃ কালীপ্রসন্ন সিংহ
- প্রকাশনাঃ আদম প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০. ভূমিকা উপলক্ষে একটা কথা
আজকাল বাঙ্গালী ভাষা আমাদের মত মূৰ্ত্তিমান কবিদলের অনেকেরই উপজীব্য হয়েছে। বেওয়ারিশ লুচীর ময়দা বা তইরি কাদা পেলে যেমন নিষ্কৰ্ম্মা ছেলেমাত্রেই একটা না একটা পুতুল তইরি করে খ্যালা করে, তেমনি বেওয়ারিস বাঙ্গালী ভাষাতে অনেকে যা মনে যায় কচ্চেন; যদি এর কেউ ওয়ারিসান থাকৃত, তা হলে স্কুলবয় ও অসিদের মত গাধাদের দ্বারা নাস্তানাবুদ হতে পেতে না-তা হলে হয়ত এত দিন কত গ্রন্থকার ফাঁসী যেতেন, কেউ বা কয়েদ থাকতেন, সুতরাং এই নজিরেই আমাদের বাঙ্গালী ভাষা দখল করা হয়। কিন্তু এমন নতুন জিনিস নাই যে, আমরা তাতেই লাগি—সকলেই সকল রকম নিয়ে জুড়ে বসেছেন বেশীর ভাগ অ্যাকচেটে, কাজে কাজেই এই নক্সাই অবলম্বন হয়ে পড়লো। কথায় বলে, এক জন বড়মানুষ, তারে প্রত্যহ নতুন নতুন মঙ্করামে দ্যাখাবার জন্য, এক জন ভড় চাকর রেখেছিলেন; সে প্রত্যহ নতুন নতুন ভাঁড়ামো করে বড়মানুষ মহাশয়ের মনোরঞ্জন কত্তো, কিছু দিন যায়, অ্যাকদিন আর সে নতুন ভাঁড়ামো খুঁজে পায় না; শেষে ঠাউরে ঠাউরে এক ঝাঁকা-মুটে ভাড়া করে বড়মানুষ বাবুর কাছে উপস্থিত। বড়মানুষ বাবু তার ভাঁড়কে ঝাঁকা-মুটের ওপর বসে আসতে দ্যাখে কুলন,—“ভাড়, এ কি হে?” ভাঁড় বলে, “ধৰ্মাবতার। আজকের এই এক নতুন!” আমরাও এই নক্সাটি পাঠকদের উপহার দিয়ে ‘এই এক নতুন’ বলে দাঁড়ালেম-এখন আপনাদের স্বেচ্ছামত তিরস্কার বা পুরস্কার করুন।
কি অভিপ্রায়ে এই নক্সা প্রচারিত হলো, নক্সাখানির দু পাত দেখলেই সহৃদয়মাত্রেই তা অনুভব কতে সমর্থ হবেন; কারণ, আমি এই নক্সায় একটি কথাও অলীক বা অমূলক ব্যবহার করি নাই। সত্য বটে, অনেকে নক্সাখানিতে আপনারে আপনি দেখতে পেলেও পেতে পারেন, কিন্তু বাস্তবিক সেটি যে তিনি নন, তা আমার বলা বাহুল্য। তবে কেবল এই মাত্র বলিতে পারি যে, আমি কারেও লক্ষ্য করি না, অথচ সকলেরেই লক্ষ্য করিচি। এখন কি, স্বয়ংও নক্সার মধ্যে থাকতে ভুলি নাই।।
নক্সাখানিকে আমি একদিন আরসি বলে পেস কল্পেও কত্তে পাত্তেম; কারণ পূর্ব্বে জানা ছিল যে, দর্পণে আপনার মুল কদর্য দেখে কোন বুদ্ধিমানই আরসিখানি ভেঙ্গে ফ্যালেন না, বরং যাতে কমে ভালো দেখায়, তারই তদ্বির করে থাকেন। কিন্তু নীলদর্পণের হাঙ্গামা দেখে শুনে—ভয়ানক জানোয়ারদের মুখের কাছে ভরসা বেঁধে আরসি ধত্তে সাহস হয় না; সুতরাং বুড়ো বয়সে সং সেজে রং কত্তে হলো—পূজনীয় পাঠকগণ বেয়াদবী মাপ করবেন।
আশমান।
১৭৮৪ শকাব্দ।
দ্বিতীয়বারের গৌরচন্দ্রিকা
পাঠক। হুতোমের নক্সার প্রথম ভাগ দ্বিতীয়বার মুদ্রিত ও প্রচারিত হলো। যে সময়ে এই বইখানি বাহির হয়, সে সময়ে লেখক একবার স্বপ্নেও প্রত্যাশা করেন নাই যে, এখানি বাঙ্গালী সমাজে সমাদৃত হবে ও দেশের প্রায় সমস্ত লোকে (কেউ লুকিয়ে কেউ প্রকাশ্যে) পড়বেন। যারা সহৃদয়, যারা সৰ্ব্বসময় দেশের প্রিয় কামনা করে থাকেন ও হতভাগ্য বাঙ্গালী-সমাজের উন্নতির নিমিত্ত কায়মনে কামনা করেন, তাহারা হুতোমের নক্সা আদর করে পড়েন, সৰ্ব্বদাই অবকাশ-রঞ্জন করেন। যেগুলো হতভাগা, হুতোমের লক্ষ্য, লক্ষ্মীর বরযাত্র, পাজীর টেক্কা ও বজ্জাতের বাদসা, তারা “দেখি হুতোম আমায় গাল দিয়েছে কি না?” কিংবা “কি গাল দিয়েছে বলেও অন্ততঃ লুকিয়ে পড়েছে; সুদু পড়া কি—অনেকে শুধরেচেন, সমাজের উন্নতি হয়েছে ও প্রকাশ্য বেলেল্লাগিরি, বদমাইসী, বজাতীর অনেক লাঘব হয়েছে। এ কথা বলতে আমাদের আপনা আপনি বড়াই করা হয় বটে, কিন্তু এটি সাধারণের ঘরকন্নার কথা।
পাঠক! কতকগুলি আনাড়ীতে রটান, “হুতোমের নক্সা অতি কদর্য বই; কেবল পরনিন্দা, পরচর্চ্চা, খেউড় ও পচালে পোরা! শুদ্ধ গায়ের জ্বালানিবরিণার্থে কতিপয় ভদ্রলোককে গাল দেওয়া হয়েছে।” এটি বাস্তবিক ঐ মহাপুরুষদের ভ্রম, একবার কেন, শতেক বার মুক্তকণ্ঠে বলবো–ভ্ৰম। হুতোমের তা উদ্দেশ্য নয়, তা অভিসন্ধি নয়, হুতোম ততদূর নীচে নন যে, দাদ তোলার কি গাল দেবার জন্য কলম ধরেন। জাদীশ্বরের প্রসাদে যে কলমে হুতোমের নক্সা প্রসব করেছে, সেই কলমই ভারতবষের নীতিপ্রধান ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের প্রধান উৎকৃষ্ট ইতিহাসের ও বিচিত্র বিচিত্র চিত্তাকর্ষ বিধায়ক, মুমুক্ষু, সংসারী, বিরাগী ও রাজার অনন্য অবলম্বনস্বরূপ গ্রন্থের অনুবাদক; সুতরাং এটা আপনি বিলক্ষণ জানবেন যে, অজাগর ক্ষুধিত হলে আরসুলা খায় না, ও গায়ে পিপড়ে কামড়ালে ডঙ্ক ধরে না। ভুতোমে বর্ণিত বদমাইস ও বাজে দলের সঙ্গে গ্রন্থকারেরও সেই সম্পর্ক।
তবে বলতে পারেন, কেনই বা কলকেতার কতিপয় বাবু হুতোমের লক্ষ্যান্তর্ব্বৰ্ত্তী হলেন; কি দোষে বাগাস্বরবাবুকে, প্যালানাথকে, পদ্মলোচনুকে মজলিসে আনা হলো; কেনই বা ছুঁচো শীল, প্যাঁচা মল্লিকের নাম কল্লে, কোন দোষে অঞ্জনারঞ্জন বাহাদুর ও * * * হুজুর আলী, আর পাঁচটা রাজা-রাজড়া থাকতে আসোরে এলেন? তার উত্তর এই যে, হুতোমের নক্সা বঙ্গসাহিত্যের নূতন গহনা ও সমাজের পক্ষে নূতন হেঁয়ালি। যদি ভাল করে চকে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া না হতো, তা হলে সাধারণে এর মর্ম্ম বহন কত্তে পাত্তেম না ও হুতোমের উদ্দেশ্য বিফল হতো। এমন কি, এত ঘরঘাসা হয়ে এসেও অনেকে আপনারে বা আপনার চিরপরিচিত বন্ধুরে নক্সায় চিনতে পারেন না; ও কি জন্য কোন্ গুণে তাঁদের মজলিসে আনা হলো, পাঠ করবার সময় তাদের সেই গুণ ও দোষগুলি বেমালুম বিস্তৃত হয়ে যান।
* * * মহারাজের মোক্তার মহারাজের জন্যে, মেছোবাজার হতে উৎকৃষ্ট জরীর লপেটা জুতো পাঠান। মহারাজ চিরকাল উড়ে জুতো পায়ে দিয়ে এসেছেন, লপেটা পেয়ে মনে কল্লেন, সেটি পাগড়ীর কলকা; জন্মতিথি দিন মহাসমারোহ করে ঐ লপেটা পাগড়ীর উপর বেঁধে মজলিসে বার দিলেন। সুতরাং পাছে স্বকপোলকল্পিত নায়ক হুতোমের পাঠকের নিতান্ত অপরিচিত হন, এই ভয়ে সমাজের আত্মীয়-অন্তরঙ্গ নিয়ে ও স্বয়ং সং সেজে মজলিসে হাজির হওয়া হয়। বিশেষতঃ “বিদেশে চণ্ডীর কৃপা দেশে কেন নাই!” বাঙ্গালীসমাজে, বিশেষতঃ সহরে যেমন কতকগুলি পাওয়া যায়, কল্পনার অনিয়ত সেবা করে সরস্বতীরও শক্তি নাই যে, তাদের হাতে উৎকৃষ্ট জীবের বর্ণনা করেন।
হুতোমের নক্সার অনুকরণ করে বটতলার ছাপাখানাওয়ালারা প্রায় দুই শত রকমারী চটী বই ছাপান। কেহ বা “হুতোমের উতোর” বলে আপনার মুখ আপনি দেখেন ও দেখান। হনুমান লঙ্কা দগ্ধ করে সাগরবারিতে আপনার মুখ আপনি দেখে জ্ঞাতিমাত্রেরই যাতে এরূপ হয়, তার প্রার্থনা করেছিলেন; উল্লিখিত গ্রন্থকারও সেই দশা ও দরের লোক। কিন্তু কতদূর সফল হলেন, তার ভার পাঠক! তোমার বিবেচনার উপর নির্ভর করে। তবে এটা বলা উচিত যে, পত্র দ্বারা ভিক্ষা করে পরপরীবাদ ও পরনিন্দা প্রকাশ করা ভদ্রলোকের কর্ত্তব্য নয়।
ফলে, “আপনার মুখ আপনি দেখ” গ্রন্থকার হুতোমের বমন অপহরণ করে বামনের চন্দ্রগ্রহণের ন্যায় হুতোমের নক্সার উত্তর দিতে উদ্যত হন ও বই ছাপিয়ে ঐ বই হুতোমের উতোর ব’লে, কতকগুলি ভদ্রলোকের চক্ষে ধূলি দিয়ে বেচেন কিন্তু দুঃখের বিষয় বহুদিন ঐ ব্যবসা চল্লো না; সাতপেয়ে গরু দরিয়াই ঘোড়া ও হোসেন খাঁর জিনির মত ধরা পল্লো, সহৃদয় সমাজ জানতে পাল্লেন যে, গ্রন্থকারের অভিসন্ধি কি? এমন কি, ঐ গ্রন্থকার খোদ হুতোমকেই, তারে সাহায্য কত্তে ও কিঞ্চিৎ ভিক্ষা দিতে প্রার্থনা করেন। সে পত্র এই–
জগদীশ্বরায় নমঃ
মহাশয়! “আপনার মুখ আপনি দেখ” পুস্তকের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত করিয়া, পাঠকসমাজে যে তাহা গ্রহণীয় এবং আদরণীয় হইবে, পূর্ব্বে এত ভরসা করি নাই। এক্ষণে জগদীশ্বরের কৃপায় অনেকানেক পাঠক মহাশয়েরা উক্ত পুস্তকখানি পাঠ করিয়া, “দেশীচার-সংশোধন-পক্ষে পুস্তকখানি উত্তম হইয়াছে” এমত বলিয়াছেন; তাহালেই শ্রম সফল এবং পরম ক্ষাভ বিবেচনা করা হইয়াছে।
প্রথম খণ্ডে “দ্বিতীয় খণ্ড আপনার মুখ আপনি দেখ” প্রকাশিত হইবেক, এমত লিখিত হওয়ায়, অনেকেই তদ্দর্শনে অভিলষিত হইয়াছে, তাহারা পাঠক এবং সাম্প্রদায়িক এই মাত্র। উপস্থিত সহকাৰ্য, পরিশ্রম, অর্থব্যয় এই দেশহিতৈষী পরহিতপরায়ণ মহাশয়-মহোদয়দিগের উৎসাহ এবং সাহায্যপ্রদান ব্যতীত কোন মতে সম্পাদিত হইতে পারে না। আপনার নিঃস্বভাব, ধনব্যয় করিবার ক্ষমতা নাই। এ কারণ, এই মহংকাৰ্য্য মহল্লোকের কৃপাবর্ত্মে না দণ্ডায়মান হইলে, কোন ক্রমেই এ বিষয় সমধি হইবেক না। আর সাধারণ লোকের আশ্রয় গ্রহণ না করিলে এ বিষয় সমাধান হইবার নহে। ধনী, ধীর, স্বদেশীয় ভাষার শবৃদ্ধিকারক এবং দেশের হিতেচ্ছুকই এই মহৎকার্যে উৎসাহদাতা; এ বিধায় মহাশয় ব্যতীত এ বিষয়ের সাহায্যদাতা আর কেহই হইতে পারেন না। আপনার দাতৃত্বতা, পরোপকারিতা ও কৃতজ্ঞতা প্রভৃতির সুযশ-সৌরভ গৌরবে ধরণী সৌরভিলী হইয়াছে; ভারত আপনার যশোরূপ যশ ধারণ করিয়াছে। দেশাচার সংশোধন-পক্ষে মহাশয় বাঙ্গালা ভাষার প্রথম গ্রন্থকৰ্ত্তা, বর্তমানে মহাশয়ের মতানুসারে সকলেরই গ্রস্থ লেখা কর্ত্তব্য বিবেচনা করিয়া আপনার কৃপাবত্মে দণ্ডায়মান হইয়া নিবেদন করিলাম। মহাশয় কিঞ্চিৎ কৃপানেত্রে চাহিয়া সাহায্য প্রদান করিলে সত্ত্বরেই “দ্বিতীয় খণ্ড “আপনার মুখ আপনি দেখ” পুস্তক প্রকাশ করিতে পারি, নিবেদন ইতি, ১২৭৪ সাল, তারিখ ২৩এ জৈষ্ঠ—
দ্বিতীয়বারের গৌরচন্দ্রিকা
পুঃ–লিপিখানিতে ডাক ষ্ট্যাম্প প্রদান করা বিধেয় বিবেচনা করিলাম না। না দেওয়ায় অপরাধ মার্জনা করিবেন। দ্বিতীয়ত, অনুজ্ঞার আশাপথ নিরীক্ষণ করিয়া রহিলাম।
কৃপাবলোকনে, যেরূপ অনুজ্ঞ হইবেক, লিখিয়া বাধিত করিবেন—“কায়ারূপ কারাবাসে, কালে কালে আয়ু নাশে, ভোলা মন ভাবে না ভুলিয়ে। বলি তারে সুবচনে, চলিতে সুজন সনে হেলা করে খেলায় মাতিয়ে॥ সদা প্রমদেতে মত্ত, ত্যজিয়া প্রসঙ্গতত্ত্ব, নিত্য নাচে কুসঙ্গের সনে। তত্ত্ব রস পরিহরি, বৃথা রস পান করি, মনমথ অনুক্ষণ মনে॥ ভারতে তন্নতা করি, অভেদ ভিন্নতা হরি, দেখাইছে মুক্তির সোপান। মন যদি বসি তায়, ত্যজে পাপ-মসি হায়, মুনি মুনি-মুখো গুণ গান।। ভারত বেদের অংশ শ্রবণে কলুষ ধ্বংস, ভারতে ফুরিত পাপ হরে। হরিগুণ সদা কহ, ভারত লইয়া রহ, ভগবত কর আখ্যা নরে।।
হুতোমের চিরপরিচিত রীত্যনুসারে এই ভিক্ষুকের পত্রখানি অপ্রচারিত রাখা কর্ত্তব্য ছিল। কিন্তু কতকগুলি স্কুলবয় ও আনাড়ীতে বাস্তবিকই স্থির করে রেখেছেন যে, “আপনার মুখ আপনি দেখ” ইনি হুতোমের প্রকৃত উত্তর ও বটতলার পাইকারেরাও ঐ কথা বলে হুতোমের নক্সার সঙ্গে ঐ বিচিত্র বইখানি বিক্রী করেন বলেই, ঐ হতভাগ্য ভিক্ষুকের পত্রখানি অবিকল ছাপান গেল- এখন পাঠক! তুমিই ঐ পত্রখানি পাঠ করে জানতে পারবে, হুতোমের নক্সার সঙ্গে “আপনার মুখ আপনি দেখ” প্রকারের কিরূপ সম্পর্ক।
শ্রীতালা হূল ব্ল্যাক ইয়ার ইয়ার,
প্রকাশক
শত্রুঘ্নপুর
১লা এপ্রিল
১.০১ কলিকাতায় চড়ক পার্ব্বণ
“কহই টুনেয়া——
শহর শিখাওয়ে কোতোয়ালি”——-টুনোয়ার টপ্পা।
হে শারদে! কোন দোষে দুষি দাসী ও চরণতলে,
কোন্ অপরাধে ছলিলে দাসীরে দিয়ে এ সন্তান?
এ কুৎসিতে! কোন লাজে সপত্নী-সমাজে পাঠাইব,
হেরিলে মা এ কুরূপে—দুষিবে জগৎ—হাসিবে
সতিনী পোড়া; অপমানে উভরায়ে কাঁদিবে
কুমার সে সময় মনে য্যান থাকে; চির অনুগত লেখনীরে।
১২০২ সাল। কলকাতা সহরের চারদিকেই ঢাকের বাদ্দি শুনা যাচ্চে, চড়কীর পিঠ সড় সড় কচ্চে, কামারেরা বাণ, দশলকি, কাঁটা ও বঁটি প্রস্তুত কচ্চে,–সর্বাঙ্গে গয়না, পায়ের নূপুর, মাতায় জরীর টুপী, কোমোরে চন্দ্রহার আর সেপাইপেড়ে ঢাকাই শাড়ী মালকোচা করে পরা, ছোপানে তারকেশ্বরে গামছা হতে, বিল্বপত্ৰ-বাঁধা সূতা গলায় যত ছুতর, গয়লা, গন্ধবেণে ও কাঁসারীর আনন্দেরর সীমা নাই—“আমাদের বাবুদের বাড়ী গাজন!”
কোম্পানীর বাংলা দখলের কিছু পরে, নন্দকুমারের ফাঁসী হবার কিছু পূর্ব্বে আমাদের বাবুর প্রপিতামহ নিমকের দাওয়ান ছিলেন। সেকালে নিমকীর দাওয়ানীতে বিলক্ষণ দশ টাকা উপায় ছিল; সুতরাং বাবুর প্রপিতামহ পাঁচ বৎসর কৰ্ম্ম করে মৃত্যুকালে প্রায় বিশ লক্ষ টাকা রেখে যান—সেই অবধি বাবুরা বনেদী বড়মানুষ হয়ে পড়েন। বনেদী বড়মানুষ কবলাতে গেলে বাঙ্গালী সমাজে যে সরঞ্জামগুলি আবশ্যক, আমাদের বাবুদের তা সমস্তই সংগ্রহ করা হয়েচে–বাবুদের নিজের একটি দল আছে, কতকগুলি ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত কুলীনের ছেলে, বংশজ, শ্রোত্রিয়, কায়স্থ, বৈদ্য, তেলী, গন্ধবেণে আর কাঁসারী ও ঢাকাই কামার নিতান্ত অনুগত–বাড়ীতে ক্ৰিয়ে-কৰ্ম্ম ফাঁক যায় না, বাৎসরিক কৰ্ম্মেও দলস্থ ব্রাহ্মণদের বিলক্ষণ প্রাপ্তি আছে; আর ভদ্রাসনে এক বিগ্রহ, শালতগ্রামশিলে ও আকব্বরী মোহরপোরা লক্ষ্মীর খুঁচীর নিত্য সেবা হয়ে থাকে।
এদিকে দুলে, বেয়ারা, হাড়ি ও কাওরারা নূপুর পায়ে, উত্তরী সূতা গলায় দিয়ে নিজ নিজ বীর-ব্রতের ও মহত্বের স্তম্ভম্বরূপ বাণ ও দশমকি হাতে করে প্রত্যেক মদের দোকানে, বেশ্যালয়ে, ও লোকের উঠানে ঢাকের ও ঢোলের সঙ্গতে নেচে বেড়াচ্ছে। ঢাকীরা ঢাকের টোয়েতে চামর, পাখীর পালক, ঘণ্টা ও ঘুঙুর বেঁধে পাড়ার পাড়ায় ঢাক বাজিয়ে বাজিয়ে সন্ন্যাসী সংগ্রহ কচ্চে; গুরুমহাশয়ের পাঠশালা বন্ধ হয়ে গিয়েচে–ছেলের গাজনতলাই বাড়ী করে তুলেছে, আহার নাই, নিদ্ৰা নাই, ঢাকের পেচৌনে পেচোনে রোদে রোদে রপ্টে রপ্টে বেড়াচ্ছে; কখন বলে “ভদ্দেশ্বরে শিব মহাদেব” চীৎকারের সঙ্গে যোগ দিচ্চে। কখন ঢাকের টোয়ের চামর ছিঁড়ছে; কখন ঢাকের পেছনটা দুম দুম করে বাজাচ্চে–বাপ মা শশব্যস্ত, একটা না ব্যায়রাম কল্লে হয়!
ক্রমে দিন ঘুনিয়ে এলো, আজ বৈকালে কাঁটা ঝাঁপ। আমাদের বাবুর চার পুরুষের বুড়ো মূল সন্ন্যাসী কাণে বিল্বপত্র খুঁজে, হাতে এক মুটো বিল্বপত্র নিয়ে ধুকতে ধুকতে বৈঠকখানায় উপস্থিত হলো; সে নিজে কাওরা হলেও আজ শিবত্ব পেয়েছে, সুতরাং বাবুকে তারে নমস্কার কত্তে হলো; মূলসন্নাসী এক পা কাদা শুদ্ধ ধোপ ফরাসের উপর দিয়ে গিয়ে বাবুর মাথায় আশীৰ্ব্বাদী ফুল ছোঁয়ালেন,–বাবু তটস্থ!
বৈঠকখানায় মেকাবি ক্লাকে টাং টাং টাং করে পাঁচটা বাজলো, সূর্যের উত্তাপের হ্রাস হয়ে আসতে লাগলো। সহরের বাবুরা ফেটিং, সেলফ ড্রাইভিং বগী ও ব্রাউহ্যামে করে অবস্থাগত ফ্রেণ্ড, ভদ্রলোক বা মোসাহেব সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বেরুলেন; কেউ বাগানে চল্লেন। দুই চারজন সহৃদয় ছাড়া অনেকেরই পেছনে মালভরা মোদাগাড়ী চল্লো; পাছে লোকে জাতে পারে, এই ভয়ে কেউ সে গাড়ীর সহিস-কৌচম্যানকে তকমা নিতে বারণ করে দেছেন। কেউ কেউ লোকাপবাদ তৃণজ্ঞান বেশ্যাবাজী বাহাদুরীর কাজ মনে করেন। বিবিজ্ঞানের সঙ্গে একত্রে বসেই চলেছেন, খাতির নদারং–কুঠিওয়ালারা গহনার ছক্কড়ের ভিতর থেকে উঁকি মেরে দেখে চক্ষু সার্থক কচ্চেন।
এদিকে আমাদের বাবুলের গাজনতলা লোকারণ্য হয়ে উঠলো, ঢাক বাজতে লাগলো, শিবের কাছে মাথা চালা আরম্ভ হলো; সন্ন্যাসীরা উবু হয়ে বসে মাথা ঘোরাচ্ছে, কেহ ভক্তিযোগে হাঁটু গেড়ে উপুড় হয়ে পড়েছে–শিবের বামুন কেবল গঙ্গা জল ছিটুচ্চে। প্রায় আধ ঘণ্টা মাথা চালা হলো, তবু ফুল আর পড়ে না; কি হবে! বাড়ীর ভিতরে খবর গেল, গিন্নীর পরস্পর বিষণ্ণবদনে “কোন অপরাধ হয়ে থাকবে” বলে একেবারে মাথায় হাত দিয়ে রসে পড়লেন—উপস্থিত দর্শকেরা “বোধ হয় মূলসন্ন্যাসী কিছু খেয়ে থাকবে, সন্ন্যাসীর দোষেই এইসব হয়” এই বলে নানাবিধ তর্কবিতর্ক আরম্ভ কল্লে; অবশেষে গুরু-পুরুত ও গিন্নীর ঐক্যমতে বাড়ীর কর্ত্তাবাবুকে বাঁধাই স্থির হলো। একজন অমুদে ব্রাহ্মণ ও চার পাঁচজন সন্ন্যাসী দৌড়ে গিয়ে বাবুর কাছে উপস্থিত হয়ে বল্লে—“মোশায়কে একবার গা ভুলে শিবতলায় যেতে হবে, ফুল তো পড়ে না, সন্ধ্যা হয়।”-–বাবুর ফিটন্ প্রস্তুত, পোষাক পরা, রেশমী-রুমালে বোকো মেখে বেরুচ্ছিলেন—শুনেই অজ্ঞান কিন্তু কি করেন, সাত পুরুষের ক্রিয়ে-কাণ্ড বন্ধ করা হয় না; অগত্যা পায়নাপেলের চাপকান পরে সেই সাজগোজ সমেতই গাজনতলায় চল্লেন—বাবুকে আসতে দেখে দেউড়ীর দারোয়ানেরা আগে আগে সার গেঁথে চল্লো; মোসাহেবেরা বাবুর সমূহ বিপদ মনে করে বিষণ্ণবদনে বাবুর পেচোনে পেচোনে যেতে লাগলো।
গাজনতলায় সজোরে ঢাক-ঢোল বেজে উঠলো, সকলে উচ্চস্বরে “ভদ্দেশ্বরে শিবো মহাদেব” বলে চীৎকার কত্তে লাগলো; বাবু শিবের সম্মুখে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম কল্লেন।—বড় বড় হাতপাখা দুপাশে চলতে লাগলো। বিশেষ কারণ না জানলে অনেকে বোধ কত্তে পারতো যে আজ বাবু বুঝি নরবলি হবেন। অবশেষে বাবুর দু-হতি একত্র করে ফুলের মালা জড়িয়ে দেওহলো, বাবু কাঁদ কাঁদ মুখ করে রেশমী রুমাল গলায় দিয়ে একবারে দাঁড়িয়ে রইলেন, পুরোহিত শিবের কাছে ‘বাবা ফুল দাও, বাবা ফুল দাও’ বারংবার বলতে লাগলো, বাবুর কল্যাণে একঘটি গঙ্গাজল পুনরায় শিবের মাথায় ঢালা হলো, সন্ন্যাসীরা সজোরে মাথা ঘুরুতে লাগলো, আধঘণ্টা এইরূপ কষ্টের পর শিবের মাথা থেকে একবোঝা বিল্বপত্র স’রে পড়লো। সকলের আনন্দের সীমা নাই, ‘বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো’ বলে চীৎকার হতে লাগলো, সকলেই বলে উঠলো “না হবে কে—কেমন বংশ!”
ঢাকের তাল ফিরে গেল। সন্ন্যাসীরা নাচতে নাচতে কাছের পুকুর থেকে পরশু দিনের ফ্যলা কতকগুলি বইচির ডাল ভুলে আনলে। গাজনতলায় বিশ আঁটী বিচালি বিছানো ছিল, কাঁটার ডালগুলো তার উপর রেখে বেতের বাড়ি ঠ্যাঙ্গান হলো; কাঁটাগুলি ক্রমে সব মুখে মুখে বসে গেলে পর পুরুত তার উপর গঙ্গাজল ছড়িয়ে দিলেন, দুইজন সন্ন্যাসী ডবল গামছা বেঁধে তার দুদিকে টানা ধল্লে–সন্ন্যাসীরা ক্রমান্বয়ে তার উপর ঝাঁপ খেয়ে পড়তে লাগলো। উঃ! শিবের কি মাহাত্ম্য! কাঁটা ফুটলে বলবার যো নাই! এদিকে বাজে দর্শকের মধ্যে দু’ একজন কুটেল চোরা-গোপ্তা মাচ্ছেন। অনকে দেবতাদের মত অন্তরীক্ষে রয়েছেন, মনে কচ্চেন, বাজে আদায়ে দেখে নিলুন, কেউ জানতে পাল্লে না। কিন্তু আমরা সব দেখতে পাই। ক্রমে সকলের ঝাঁপ খাওয়া ফুলো; একজন আপনার বিক্রম জানাবার জন্য চিৎ হয়ে উল্টো ছাঁপ খেলে; সজোরে ঢাক বেজে উঠলো। দর্শকেরা কাঁটা নিয়ে টানাটানি কত্তে লাগলেন—গিন্নীরা বলে দিয়েছেন—“ঝাঁপের কাঁটার এমনি গুণ যে, ঘরে রাখলে এ জন্মে বিছানায় ছারপোকা হবে না।”
এদিকে সহরে সন্ধ্যাসূচক কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ থামলো। সকল পথের সমুদয় আলো জ্বলা হয়েছে। ‘বেলফুল’, ‘বরফ’, ‘মালাই’, চীৎকার শুনা যাচ্চে। আবগারীর আইন অনুসারে মদের দোকানের সদর দরজা বন্ধ হয়েছে, অথচ খদ্দের ফিচ্চে না। ক্রমে অন্ধকার গা-ঢাকা হয়ে এলো; এ সময় ইংরাজী জুতো, শান্তিপুরে ডুরে উড়ুনি আর সিমলের ধুতির কল্যাণে–রাস্তায় ছোটলোক ভদ্দরলোক আর চেনবার যো নাই। তুখোড় ইয়ারের দল হাসির গরবা ও ইংরাজী কথার ফরবার সঙ্গে খাতায় খাতায় এর দরজায়, তার দরজায় ঢু মেরে বেড়ে বেড়াচ্ছেন। এঁরী সন্ধ্যা জ্বালা দেখে বেরুলেন আবার ময়দা-পেষা দেখে বাড়ী ফিরবেন। মেছোবাজারের হাঁড়িহাটা, চৌরবাগানের মোড়, যোড়াসাঁকোর পোদ্দারের দোকান, নতুন বাজার, বটতলা, সোণাগাজির গলি ও আহিরীটোলার চৌমাথা লোকারণ্য— কেউ মুখে মাথায় চাদর জড়িয়ে মনে কচ্চেন, কেউ তাঁরে চিনতে পারবে না। আবার অনেকে চেঁচিয়ে কথা কয়ে কেসে হেঁচে লোককে জানান দিচ্ছেন যে, “তিনি সন্ধ্যার পর দুদণ্ড আয়েস করে থাকেন।”
সৌখীন কুঠিওয়ালা মুখে হাতে জল দিয়ে জলযোগ করে সেতারটি নিয়ে বসেছেন। পাশের ঘরের ছোট ছেলেরা চীৎকার করে বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয় পড়ছে। পীল-ইয়ার ছোকরারা উড়তে শিখচে। স্যাকরারা দুর্গাপ্রদীপ সামনে নিয়ে রাংঝাল দিবার উপক্রম করেছে। রাস্তার ধারের দুই একখানা কাপড়, কাঠ-কাটরা ও বাসনের দোকান বন্ধ হয়েছে; রোকেড়ের দোকানদার ও পোদ্দার ও সোনার বেনের তহবিল মিলিয়ে কৈফিয়ং কাটচে। শোভাবাজারের রাজাদের ভাঙ্গা বাজারে মেছুনীরা প্রদীপ হাতে করে ওঁচা পচা মাচ ও লোণা ইলিশ নিয়ে ক্রেতাদের—“ও গামচাকাঁধে, ভাল মাচ নিবি?” “ও খেংরা-গুঁপো মিন্সে, চার আনা দিবি” বলে আদর কচ্ছে—মধ্যে মধ্যে দুই একজন রসিকতা জানবার জন্য মেছুনী ঘেঁটিয়ে বাপান্ত খাচ্চেন। রেস্তহীন গুলিখোর, গেঁজেল ও মাতালেরা লাঠি হাতে করে কাণা সেজে “অন্ধ ব্রাহ্মণকে কিছু দান কর দাতাগণ” বলে ভিক্ষা করে মৌতাতের সম্বল কচ্চে। এমন সময় বাবুদের গাজতলায় সজোরে ঢাক বেজে উঠলো, “বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো।” চীৎকার হতে লাগলো; গোল উঠলো, এবারে ঝুল-সন্ন্যাস। বাড়ীর সামনের মাঠে ভারা টারা বাঁধা শেষ হয়েচে; বাড়ীর ক্ষুদে ক্ষুদে হবু হুজুরের দারোয়ান চাকর ও চাকরাণীর হাত ধরে গাজনতলায় ঘুরঘুর কচ্চেন।
ক্রমে সন্ন্যাসীরা খড়ে আগুন জ্বেলে ভারার নীচে ধল্লে; একজনকে তার উপর পানে পা করে ঝুলিয়ে দিয়ে তার মুখের কাছে অগুনের উপর গুঁড়ো ধুনো ফেলতে লাগলো; ক্রমে একে একে অনেকে ঐ রকম করে দুল্লে, ঝুলসন্ন্যাস সমাপন হলো; আধ ঘণ্টার মধ্যে আবার সহর জুড়লো, পূর্ব্বের মত সেতার বাজতে লাগলো, বেলফুল, বরফ ও মালাই যথামত বিক্রী করবার অবসর পেলে; শুক্রবারের রাত্রি এই রকমে কেটে গেল।
আজ নীলের রাত্তির, তাতে আবার শনিবার। শনিবারের রাত্তিরে সহর বড় গুলজার থাকে। পানের খিলির দোকানে বেলণ্ঠন আর দেয়ালগিরী জ্বলচে। ফুরফুরে হাওয়ার সঙ্গে বেলফু্লের গন্ধ ভুরভুর করে বেরিয়ে যেন সহর মাতিয়ে তুলচে। রাস্তার ধারেই দুই একটা বাড়ীতে খেমটা নাচের তালিম হচ্ছে, অনেকে রাস্তায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে ঘুঙুর ও মন্দির রুণু রুণু শব্দ শুনে স্বর্গসুখ উপভোগ কচ্চেন; কোথাও একটা দাঙ্গা হচ্ছে। কোথাও পাহারাওয়ালা একজন চোর ধরে বেঁধে নে যাচ্চে–তার চারিদিকে চার পাঁচ জন হাসচে আর মজা দেখচে এবং আপনাদের সাবধানতার প্রশংসা কচ্চে; তারা যে এক দিন ঐ রকম দশায় পড়বে, তায় ভ্রুক্ষেপ নাই।।
আজ অমুকের গাজনতলায় চিৎপুরের হর; ওদের মাঠে সিঙ্গির বাগানের পালা; ওদের পাড়ার মেয়ে পাঁচালী। আজ সহরের গাজনতলায় ভারী ধূম-চৌমাথার চৌকীদারদের পোহাবারো। মদের দোকান খোলা না থাকলেও সমস্ত রাত্তির মদ বিক্রী হবে, গাজা অনবরত উড়বে, কেবল কাল সকালে শুবেন যে-“ঘোষেরা পাতকোতলার বড় পেতলের ঘটীটি পাচ্ছে না,” “পালেদের একধামা পেতলের বাসন গেছে” ও “গন্ধবেণেদের সর্ব্বনাশ হয়েছে।” আজ কার সাধ্য নিদ্রা যায়—থেকে থেকে কেবল ঢাকের বাদ্যি, সন্ন্যাসীর হররা ও “বলে ভদ্দেশ্বরে শিবো মহাদেব’ চীৎকার।
এ দিকে গির্জ্জার ঘড়িতে টুং টাং ঢং টুং টাং ঢং করে রাত চারটে বেজে গেল–বারফটকা বাবুরা ঘরমুখো হয়েচে। উড়ে বামুনেরা ময়দার দোকানে ময়দা পিষতে আরম্ভ করেছে। রাস্তার অলোর আর তত তেজ নেই। ফুরফুরে হাওয়া উঠেছে। বেশ্যালয়ের বারাণ্ডার কোকিলেরা ডাকতে আরম্ভ করেছে; দু’ এক কাকের ডাক, কোকিলের আওয়াজ ও রাস্তার বেকার কুকুরগুলোর খেউ ঘেউ রব শোনা যাচ্চে, এখনও মহানগর যেন নিস্তব্ধ ও লোকশূন্য। ক্রমে দেখুন,–“রামের মা চলতে পারে না,” “ওদের ন-বউটা কি বজ্জাত মা” “মাগী হেন জক্কী” প্রভৃতি নানা কথার আন্দোলনে রত দুই এক দল মেয়েমানুষ গঙ্গাস্নান কত্তে বেরিয়েছেন। চিংপুরের কসাইরা মটনচাপের তার নিয়ে চলেছে। পুলিসের সার্জ্জন, দারোগা জমাদার প্রভৃতি গরীবের যমরা রোঁদ সেরে মস্ মস্ করে থানায় ফিরে যাচ্ছেন।
গুড়ুম করে তোপ পড়ে গেল! কাকগুলো কা কা করে বাসা ছেড়ে ওড়বার উজ্জুগ কল্লে। দোকানীরা দোকানের ঝাঁপতাড়া খুলে গন্ধেশ্বরীকে প্রণাম করে, দোকানে গঙ্গাজলের ছড়া দিয়ে, হু কার জল ফিরিয়ে তামকি খাবার উজ্জ্বল কচ্চে। ক্রমে ফরসা হয়ে এলো–মাছের ভারীরা দৌড়ে আসতে লেগেচে–মেছুনীরা ঝগড়া কত্তে কত্তে তার পেছু পেছু দৌড়েচে। বদ্দিবাটির আলু, হাসমানের বেগুন বাজরা বাজরা অসচে, দিশী বিলিতী যমেরা অবস্থা ও রেস্তমত গাড়ী পাল্কী চড়ে ভিজিটে বেরিয়েছেন। জ্বরবিকার, ওলাউঠার প্রাদুর্ভাব না পড়লে এদের মুখে হাসি দেখা যায় না। উলো অঞ্চলে মড়ক হওয়াতে অনেক গো-দাগাও বিলক্ষণ সঙ্গতি করে নেছেন; কলিকাতা সহরেও দু-চার গো-দাগাকে প্রাকটিস কত্তে দেখা যায়, এদের অষুধ চমৎকার; কেউ বলদের মত রোগীর নাক ফুঁড়ে আরাম করে; কেউ শুদ্ধ জল খাইয়ে সারেন। শহুরে কবিরাজেরা আবার এঁদের হতে এককাটি সরেশ; সকল রকম রোগেই সদ্য মৃত্যুশর ব্যবস্থা করে থাকেন–অনেকে চাণক্য-শ্লোক ও দাতাকর্ণের পুঁথি পড়েই চিকিৎসা আরম্ভ করেছেন।
টুলো পূজুরি ভটচাজ্জিরে কাপড় বগলে করে স্নান কত্তে চলেচে; আজ তাদের বড় ত্বরা, যজমানের বাড়ী সকাল সকাল যেতে হবে। আদবুড়ো বেতোরা মর্ণিং-ওয়াকে বেরিয়েছেন। উড়ে বেহারারা দাঁতন হাতে করে স্নান কওে দৌড়েচে। ইংলিশম্যান, হরকরা, ফিনিক্স এক্সচেঞ্জ গেজেট, গ্রাহকদের দরজায় উপস্থিত হয়েছে। হরিণমাংসের মত কোন কোন বাঙ্গালা খবরের কাগজ বাসি না হলে গ্রাহকেরা পান না—ইংরাজী কাগজের সে রকম নয়, গরম গরম ব্রেকফাষ্টের সময় গরম গরম কাগজ পড়াই আবশ্যক। ক্রমে সূৰ্য্য উদয় হলেন।
সেক্সন্-লেখা কেরাণীর মত কলুর ঘানির বলদ বদলী হলো; পাগড়ীবাঁধা দলের প্রথম ইনষ্টলমেন্টে—শিপ-সরকার ও বুকিং ক্লার্ক দেখা দিলেন। কিছু পরেই পরামাণিক ও রিপুকৰ্ম্ম বেরুলেন। আজ গবর্ণমেন্টের অফিস বন্ধ; সুতরাং আমরা ক্লার্ক কেরাণী, বুককিপার ও হেড রাইটারদিগকে দেখতে পেলাম না। আজকাল ইংরাজী লেখাপড়ার আধিক্যে অনেকে নানা রকম বেশ ধরে অফিসে যান- পাগড়ী প্রায় উঠে গেল—দুই এক জন সেকেলে কেরাণীই চিরপরিচিত পাগড়ীর মান রেখেচেন; তারা পেন্সন নিলেই আমরা আর কুঠিওয়ালা বাবুদের মাথায় পাগড়ী দেখতে পাব না; পাগড়ী মাথায় দিলে, আলবার্ট-ফেশনের বাঁকা সিঁথেটি ঢাকা পড়ে, এই এক প্রধান দোষ। রিপুকৰ্ম্ম ও পরামাণিকদের পাগড়ী প্রায় থাকে না থাকে হয়েছে।
দালালের কখনই অব্যাহতি নাই। দালাল সকালে না খেয়েই বেরিয়েছে। হাতে কাজ কিছু নাই, অথচ যে রকমে হোক না, চোটাখোর বেণের ঘরে ও টাকাওয়ালা বাবুদের বাড়ীতে একবার যেতেই হবে। “কার বাড়ী বিক্রী হবে,” “কার বাগানের দরকার,” “কে টাকা ধার করবে,” তারই খবর রাখা দালালের প্রধান কাজ, অনেক চোটাখোর বেণে ও ব্যাভার-বেণে সহুরে বাবু দালাল চাকর রেখে থাকেন; দালালেরা শীকার ধরে আনে—বাবুরা আড়ে গেলেন!
দালালী কাজটা ভাল, “নেপো মারে দইয়ের মতন” এতে বিলক্ষণ গুড় আছে। অনেক ভদ্রলোকের ছেলেকে গাড়ী-ঘোড়ায় চড়ে দালালী কত্তে দেখা যায়। অনেকে “রেস্তহীন মূচ্ছুদি” চার বার “ইন্সলভেট” নিয়ে এখন দালালী ধরেছেন। অনেক পদ্মলোচন দালালীর দৌলতে “কলগেছে থাম” ফেঁদে ফেল্লেন। এরা বর্ণচোরা আঁব, এঁদের চেনা ভার, না পারেন, হেন কর্ম্মই নাই। পেশাদার চোটাখোর বেণে–ও ব্যাভার-বেণে বড়মানুষের ছলনারূপ নদীতে বেঁউতি-জলি পাতা থাকে; দালাল বিশ্বাসের কলসী ধরে গা ভাসান দে জল তাড়া দেন; সুতরাং মনের মত কোটাল হলে চুনোপুঁটিও এড়ায় না।
ক্রুমে গির্জ্জের ঘড়িতে ঢং ঢং ঢং করে সাতটা বেজে গেল। সহরে কাণ পাতা ভার। রাস্তায় লোকারণ্য, চারিদিকে ঢাকের বাদ্যি, ধুনোর ধোঁ, আর মদের দুর্গন্ধ। সন্ন্যাসীরা বাণ, দশলকি, সূতো, শোণ, সাপ, ছিপ, বাঁশ, ফুঁড়ে, একেবারে মোরিয়া হয়ে নাচতে নাচতে কালঘাট থেকে আসছে। বেশ্যালয়ের বারাণ্ডা ইয়ারগোচর ভদ্রলোকে পরিপূর্ণ; সখের দলের পাঁচালী ও হাপ-আখড়াইয়ের দোহার, গুল্গার্ডেনের মেম্বই অধিক— এঁরা গাজন দেখবার জন্য ভোরের বেলা এসে জমেছেন।
এদিকে রকমারি বাবু বুঝে বড়মানুষদের বৈঠকখানা সরগরম হচ্ছে। কেউ সিভিলিজেশনের অনুরোধে চড়ক হেট করেন; কেউ কেউ নিজে ব্রাহ্ম হয়েও— “সাত পুরুষের ক্রিয়াকাণ্ড” বলেই চড়কে অমোদ করেন; বাস্তবিক তিনি এত বড় চটা। কি করেন, বড়দাদা সেজোপিসে বর্তমান– আবার ঠাকুরমার এখনও কাশীপ্রাপ্তি হয় নাই।
অনেকে চড়ক, বাণ ফোঁড়া তলোয়ার ফোঁড়া, দেখতে ভালোবাসেন। প্রতিমা বিসর্জনের দিন পৌত্তূর, ছোট ছেলে ও কোলের মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে ভাসান দেখতে বেরোন। অনেকে বুড়ো মিন্সে হয়েও হীবেবসান টুপী, বুকে জরীর কারচোপের কর্ম্মকরা কাবা ও গলায় মুক্তার মালা, হীরের কষ্ঠ, দু’হাতে দশটা আংটা পরে “খোকা” সেজে বেরুতে লজ্জিত হন না; হয়ত তাঁর প্রথম পক্ষের ছেলের বয়স ষাট বৎসর–ভাগ্নের চুল পেকে গেছে।
অনেক পাড়াগেঁয়ে জমিদার ও রাস্তার মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় পদার্পণ করে থাকেন। নেজামত আদালতে নম্বরওয়ারী ও মৎফরেষ্কার তদ্বির কত্তে হলে, ভবানীপুরেই বাসার ঠিকানা হয়। কলিকাতার হাওয়া পাড়া-গাঁয়ের পক্ষে বড় গরম। পূর্ব্বে পাড়াগেঁয়ে কলিকাতায় এলে লোণা লাগত, এখন লোণা লাগার বদলে আর একটি বড় জিনিস লেগে থাকে—অনেকে তার দরুণ একেবারে আঁতকে পড়েন; ঘাগিগোছের পাল্লায় পড়ে শেষে সর্ব্বস্বান্ত হয়ে বাড়ী যেতে হয়। পাড়াগেঁয়ে দুই এক জন জমিদার প্রায় বারো মাস এইথাতেই কাটান; দুপুরবেলা ফেটিং গাড়ী চড়া, পাঁচালী বা চণ্ডীর গানের ছেলেদের মতন চেহারা, মাথায় ক্রেপের চাদর জড়ান, জন দশ-বারো মোসাহেব সঙ্গে, বাঈজানের ভেড়ুয়ার মত পোষাক, গলায় মুক্তার মালা; দেখলেই চেনা যায়, ইনি একজন বনগাঁর শিয়াল রাজা, বুদ্ধিতে, কাশ্মীরী গাধার বেহদ্দ–বিদ্যায় মূর্ত্তিমান মা! বিসর্জন, বারোইয়ারি, খ্যামটা-নাচ আর ঝুমুরের প্রধান ভক্ত। মধ্যে মধ্যে খুনী মামলার গ্রেপ্তারী ও মহাজনের ডিক্রীর দরুণ গা-ঢাকা দেন। রবিবার, পাল-পার্ব্বণ, বিসর্জন আর স্নানযাত্রায় সেজে-গুজে গাড়ী চোড়ে বেড়ান।
পাড়াগেঁয়ে হলেই যে এই রকম উনাপঁজুরে হবে, এমন কোন কথা নাই। কারণ, দুই-একজন জমিদার মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় এসে বিলক্ষণ প্রতিষ্ঠা ও প্রশংসা নিয়ে যান। তারা সোণাগাছিতে বাস করেও সে রঙ্গে বিব্রত হন না; তাঁদের চালচুল দেখে অনেক সহুরে তাক হয়ে থাকেন। আবার কেউ কাশীপুর, বোঁড়স্যা, ভবানীপুর ও কালীঘাটে বাসা করে চব্বিশ ঘণ্টা সোণাগাছিতেই কাটান! লোকের বাড়ী চড়োয়া হয়ে দাঙ্গা করেন; তার পরদিন প্রিয়তমার হাত ধরে যুগলবেশে জ্যেঠা খুড়া বাবার সঙ্গে পুলিসে হাজির হন, ধারে হাতী কেনেন। পেমেণ্টের সময় ঠ্যাঙ্গাঠাঙ্গী উপস্থিত হয়-পেড়াপীড়ি হলে দেশে সরে পড়েন–সেথায় রামরাজ্য!
জাহাজ থেকে নূতন সেলার নামলেই যেমন পাইকরে ছেঁকে ধরে, সেই রকম পাড়াগেঁয়ে বড়মানুষ সহরে এলেই প্রথমে দালাল-পেস হন। দালাল বাবুর সদর মোক্তারের অনুগ্রহে বাড়ী ভাড়া করা, খ্যামটা নাচের বায়না করা প্রভৃতি রকমওয়ারি কাজের ভার পান ও পলিটীকেল এজেন্টের কাজ করেন। বাবুকে সাতপুকুরের বাগান, এসিয়াটিক সোসাইটির মিউজিয়ম- বালির ব্রিজ,–বাগবাজারের থালের কলের দরজা–রকমওয়ারি বাবুর সাজানো বৈঠকখানা—ও দুইএক নামজাদা বেশ্যার বাড়ী দেখিয়ে বেড়ান। ঝোপ বুঝে কোপ ফেলতে পারলে দালালের বাবুর কাছে বিলক্ষণ প্রতিপত্তি হয়ে পড়ে। কিছুকাল বড় আমোদ যায়, শেষে বাবু টাকার টানাটানিতে বা কৰ্ম্মান্তরে দেশে গেলে দালাল এজেন্টি কৰ্ম্মে মক্রর হয়।
আজকাল সহরে ইংরাজী কেতার বাবুরা দু’টি দল হয়েছেন; প্রথম দল উঁচুকেতা সাহেবের গোবরের গস্ত, দ্বিতীয় “ফিরিঙ্গীর জঘন্য প্রতিরূপ”; প্রথম দলের সকলি ইংরাজী কেতা, টেবিল-চেয়ারের মজলিস, পেয়ালা করা চা, চুরোট, জগে করা জল, ডিকাণ্টরে ব্রাণ্ডি ও কাচের গ্লাসে সোলার ঢাকনি, সালু মোড়া; হরকরা ইংলিশম্যান ও ফিনিক্স সামনে থাকে, পলিটিক্স ও ‘বেষ্ট নিউস অব দি ডে’ নিয়েই সর্ব্বদা আন্দোলন। টেবিলে খান, কমডে হাগেন এবং কাগজে পোঁদ পোঁছেন! এঁরা সহৃদয়তা, দয়া, পরোপকার, নম্রতা প্রভৃতি বিবিধ সদগুণে ভূষিত, কেবল সর্ব্বদাই রোগ, মদ খেয়ে খেয়ে জুজু, স্ত্রীর দাস–উৎসাহ, একতা, উন্নতীচ্ছা একেবার হৃদয় হতে নির্ব্বাসিত হয়েছে; এঁরাই ওল্ড ক্লাস।।
দ্বিতীয়ের মধ্যে—বাগাম্বর মিত্র প্রভৃতি সাপ হতেও ভয়ানক, বাঘের চেয়ে হিংস্র; বলতে গেলে এরা একরকম ভয়ানক জানোয়ার। চোরেরা যেমন চুরি কত্তে গেলে মদ ঠোঁটে দিয়ে গন্ধ করে মাতাল সেজে যায়, এরা সেইরূপ স্বার্থসাধনাৰ্থ স্বদেশের ভাল চেষ্টা করেন। “কেমন করে আপনি বড়লোক হব,” “কেমন করে সকলে পায়ের নীচে থাকবে,” এই এঁদের নিয়ত চেষ্টা—পরের মাথায় কাঁটাল ভেঙ্গে আপনার গোঁফে তেল দেওয়াই এঁদের পলিসী, এঁদের কাছে দাতব্য দূর পরিহার- চার অনার বেশী দান নাই।
সকালবেলা সহরের বড়মানুষদের বৈঠকথানা বড় সরগরম থাকে। কোথাও উকীসের বাড়ীর হেড কেরাণী তীর্থের কাকের মত বসে আছেন। তিন-চারিটি “ইকুটী, দুটি “কমন লা” আদালতে ঝুলচে। কোথাও পাওনাদীর বিল- সরকার উটুনোওয়ালা মহাজন খাত, বিল ও হাতচিঠে নিয়ে তিন-চার মাস হাঁটচে, দেওয়ানজী কেবল আজ না কাল কচ্চেন। ‘শমন’, ‘ওয়ারিন’ ‘উকিলের চিঠি’ ও ‘সফিনে’ বাবুর অলঙ্কার হয়েছে। নিন্দা অপমান তৃণজ্ঞান, প্রত্যেক লোকের চাতুরী, ছলনা মনে করে অন্তর্দ্দাহ হচ্চে। “র্যায়সা দিন নেহি রহেগা” অঙ্কিত আঙ্গটী আঙ্গুলে পরেচেন; কিন্তু কিছুতেই শান্তিলাভ করতে পাচ্চেন না। কোথাও একজন বড়মানুষের ছেলে অল্পবয়সে বিষয় পেয়ে, কান্নেখেকো ঘুঁড়ীর মত ঘুরচেন। পরশুদিন “বউ বউ,” “লুকোচুরি” “ঘোড়ঘোড়া” খেলেচেন, আজ তাঁকে দেওয়ানজীর কূটকচালে খতেনের গোঁজা মিলন ধত্তে হবে, উকীলের বাড়ীর বাবুর পাকা চালে নজর রেখে সরে বসতে হবে, নইলে ওঠসার কিস্তিতেই মাত! ছেলের হাতে ফল দেখলে কাকেরাও ছোঁ মারে, মানুষ তো কোন ছার;—কেউ “স্বর্গীয় কৰ্ত্তার পরম বন্ধু”, কেউ স্বর্গীয় কৰ্ত্তার “মেজোপিসের মামার খুড়োর পিসতুতো ভায়ের মামাতো ভাই” পরিচয় দিয়ে পেস হচ্চেন। “উমেদার”, কন্যাদায় (হয়ত কন্যাদায়ের বিবাহ হয় নাই) নানা রকম লোক এসে জুটেছে, আসল মতলব দ্বৈপয়ানহ্যদে ডোবা রয়েছে, সময়ে আমলে আসবে।
ক্রমে রাস্তায় লোকারণ্য হয়েছে। চৌমাথার বেণের দোকান লোকে পুরে গেছে। নানা রকম রকম বেশ–কারুর কফ ও কলারওয়ালা কামিজ, রূপোর বগলেস আঁটা শাইনিং লেদর; কারো ইণ্ডিয়া রবর আর চায়না কোট; হাতে ইষ্টিক, ক্রেপের চাদর, চুলের গার্ডচেন গলায়; আলবার্ট ফেশানে চুল ফেরানো। কলিকাতা সহর রত্নাকরবিশেষ, : না মেলে এমন জানোয়ারই নাই; রাস্তার দু পাশে অনেক আমোদগেলা মহাশয় দাঁড়িয়েছেন, ছোট আদালতে উকীল, সেক্সন রাইটার, টাকাওয়ালা গন্ধবেণে, তেলী, ঢাকাই কামার আর ফলারে যজমেনে বামুনই অধিক–কারু কোলে দুটি মেয়ে–কারু তিনটে ছেলে।
কোথাও পাদরী সাহেব ঝুড়ি ঝুড়ি বাইবেল বিলুচ্ছেন–কাছে ক্যাটিকৃষ্ট ভায়া—-সুবর্ব্ব চৌকীদারের মত পোষাক—পেনটুলেন, ট্যাংট্যাঙে চাপকান, মাথায় কালো রঙ্গের চোঙ্গাকাটা টুপী। আদালতী সুরে হাত-মুখ নেড়ে খ্রীষ্টধৰ্ম্মের মাহাত্ম্য ব্যক্ত কচ্চেন–হঠাৎ দেখল বোধ হয় যেন পুতুলনাচের নকীব। কতকগুলো ঝাঁকাওয়ালা মুটে, পাঠশালের ছেলে ও ফ্রিওয়ালা একমনে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছ। ক্যাটিকৃষ্ট কি বলচেন, কিছুই বুঝতে পাচ্ছে না। পূর্ব্বে বওয়াটে ছেলেরা বাপ-মার সঙ্গে ঝগড়া করে পশ্চিমে পালিয়ে যেতো, না হয় খ্রীষ্টান হতো; কিন্তু রেলওয়ে হওয়াতে পশ্চিম পালাবার বড় ব্যাঘাত হয়েছে আর দিশী খ্রীষ্টানদের দুর্দশা দেখে খ্রীষ্টান হতে ও ভয় হয়।
চিৎপুরের বড় রাস্তায় মেঘ কল্লে কাদা হয়—ধূলোয় ধূলো; তার মধ্যে ঢাকের গটরার সঙ্গে গাজন বেরিয়েছে। প্রথমে দুটো মুটে একটা বড় পেতলের পেটা ঘড়ি বাঁশ বেঁধে কাঁধে করেছে–কতকগুলো ছেলে মুগুরের বাড়ী বাজাতে বাজাতে চলেছে—তার পেচোনে ‘এলোমেলো নিশানের শ্রেণী। মধ্যে হাড়ীরা দল বেঁধে ঢোলের সঙ্গতে “ভোলা বোম ভোলা বড় রঙ্গিলী, লেংটা ত্রিপুরারি শিরে জটাধারী ভোলার গলে দোলে হাড়ের মালা,” ভজন গাইতে গাইতে চলেছে! তার পেচনে বাবুর অবস্থামত তক্মাওয়ালা দরোয়ান, হরকরা সেপাই। মধ্যে সর্ব্বাঙ্গে ছাই ও খড়ি-মাখা, টিনের সাপের ফণার টুপী মাথায়, শিব ও পার্বতী-সাজা সং। তার পেচনে কতকগুলো সন্ন্যাসী দশলকি ফুঁড়ে ধূনো পোড়াতে পোড়াতে নাচতে নাচতে চলেছে। পাশে বেণের জিবে হাতে বাণ ফুঁড়ে চলেছে। লম্বা লম্বা ছিপ, উপরে শোলার চিংড়িমাছ বাঁধা। সেটকে সেট ঢাকে ড্যানাক ড্যানাক করে রং বাজাচ্চে। পেচনে বাবুর ভাগ্নে, ছোট ভাই বা পিসতুতে ভেয়েরা গাড়ী চড়ে চলেছে—তারা রাত্রি তিনটার সময় উঠেছেন, চোক্ লাল টকটক কচ্চে, মাথা ভবানীপুরে, কালীঘেটে ধূলোয় ভয়ে গিয়েছে। দর্শকেরা হাঁ করে গাজন দেখছেন, মধ্যে মধ্যে বাজনার শব্দে ঘোড়া খেপচে–হুড়মড় করে কেউ দোকানে কেউ থানার উপর পোড়চেন, রৌদ্রে মাথা ফেঁটে যাচ্চে-তথাপি নড়চেন না।
ক্রমে পুলিসের হুকুমত সব গাজন ফিরে গেল। সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট রাস্তায় ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছিলেন, পকেট-ঘড়ি খুলে দেখলেন, সময় উতরে গেছে, অমনি মার্শাল ল জারি হলো, “ঢাক বাজালে থানায় ধরে নিয়ে যাবে” ক্ৰমে দুই-একটা ঢাকে জমাদারের হেতে কোঁৎকা পড়বামাত্রেই সহর নিস্তব্ধ হলো। অনেকে ঢাক ঘাড়ে করে চুপে চুপে বাড়ী এলেন—দর্শকের কুইনের রাজ্যে অভিসম্পাত কত্তে কত্তে ফিরে গেলেন।
সহরটা কিছুকালের মত জুড়লো। বেণোরা বাণ খুলে মদের দোকানে ঢুকলো। সন্ন্যাসিরা ক্লান্ত হয়ে ঘরে গিয়ে হাতপাখায় বাতাস ও হাঁড়ি হাঁড়ি আমানি খেয়ে ফেল্লে। গাজন তলায় শিবের ঘর বন্ধ হলো–এ বছরের মত বণিফোঁড়ার আমোদও ফুরালো। এই রকমে রবিবারটা খেতে দেখতে গেল।
আজ বৎসরের শেষ দিন। যুবত্বকালের এক বৎসর গেল দেখে যুবক-যুবতীরা বিষণ্ণ হলেন। হতভাগ্য কয়েদীর নির্দিষ্ট কালের এক বৎসর কেটে গেল। দেখে আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না। আজ বুড়োটি বিয়ে নিলেন, কাল যুবটি আমাদের উপর প্রভাত হবেন। বুড়ো বৎসরের অধীনে আমরা যেসব কষ্ট ভোগ করেছি, যেসব ক্ষতি স্বীকার করেছি–আগামীর মুখ চেয়ে, আশার মন্ত্রণায়, আমরা সেসব মন থেকে তারই সঙ্গে বিসর্জ্জন দিলেম। ভূতকাল যেন আমাদের ভ্যাংচাতে ভ্যাংচাতে চলে গেলেন বর্তমান বংসর স্কুল মাষ্টারের মত গম্ভীর ভাবে এসে পড়লেন–আমরা ভয়ে হর্ষে তটস্থ ও বিস্মিত! জেলার পুরাণ হাকিম বদলা হলে নীল-প্রজাদের মন যেমন ধুকপুক করে, স্কুলে নতুন ক্লাসে উঠলে নতুন মাষ্টারের মুখ দেখে ছেলেদের বুক যেমন গুরু গুরু করে—মড়ুঞ্চে পোয়াতীর বুড়ো বয়সে ছেলে হলে মনে যেমন মহান সংশয় উপস্থিত হয়, পুরাণর যাওয়াতে নতুনের আসাতে আজ সংসার তেমনি অবস্থায় পড়লেন।
ইংরেজরা নিউইয়ারের বড় আদর করেন। আসামীকে দাঁড়াগুয়া পান দিয়ে বরণ করে ন্যান–নেশার খোয়ারির সঙ্গে পুরাণকে বিদায় দেন। বাঙ্গালীরা বছরটি ভাল রকমেই যা আর খারাবেই শেষ হোক, সজনেখাঁড়া চিবিয়ে, ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধূলো দিয়ে, পুরাণকে বিদায় দেন। কেবল কলসী উচ্ছুগ্গুকর্ত্তারা আর নতুন খাতওলারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন!
আজ চড়ক। সকালে ব্রাহ্মসমাজে ব্রাহ্মরা একমেবাদ্বিতীয় ঈশ্বরের বিধিপূৰ্ব্বক উপাসনা করেচেন—আবার অনেক ব্রাহ্ম কলসী উচ্ছুগ্গু করবেন। এবারে উক্ত সমাজের কোন উপাচার্য্য বড় ধুম করে কালীপূজো করেছিলেন ও বিধবা বিবাহে যাবার প্রায়শ্চিত্ত উপলক্ষে জমিদারের বাড়ী শ্রীবিষ্ণু স্মরণ করে গোবর খেতেও ত্রুটি করেন নি। আজকাল ব্রাহ্মধর্মের মর্ম্ম বোঝা ভার, বাড়ীতে দুর্গোৎসবও হবে আবার ফি বুধবারে সমাজে গিয়ে চক্ষু মুদিত করে মড়াকান্না কাদতে হবে। পরমেশ্বর কি খোট্টা, না মহারাষ্ট্র ব্রাক্ষ্মণ যে, বেন ভাঙ্গা সংস্কৃত পদ ভিন্ন অন্য ভাষায় তারে ডাকূলে তিনি বুঝতে পারবেন না—অডিড় থেকে না ডাকূলে শুতে পাবো না? ক্ৰমে কৃশ্চানী ও ব্রাহ্মধৰ্ম্মের আড়ম্বর এক হবে, তারি যোগাড় হচ্চে।
চড়কগাছ পুকুর থেকে তুলে, মোচ বেন্ধে মাথায় ঘি-কলা দিয়ে খাড়া করা হয়েছে। ক্রমে রোদ্দুরের তেজ পড়ে এলে চড়কতলা লোকারণ্য হয়ে উঠলো। সহরের বাবুরা বড় বড় জুড়ী, ফেটিং ও ষ্টেট ক্যারেজে নানা রকম পোষাক পরে চড়ক দেখতে বেরিয়েছেন; কেউ কাঁসারীদের সঙের মত পাল্কীগাড়ীর ছাদের উপর বসে চলেচেন! ছোটলোক, বড়মানুষ ও হঠাৎবাবুই অধিক।
অ্যাাং যায়, ব্যাং যায়, খলসে বলে আমিও খাই–বামুন-কায়েতরা ক্রমে সভ্য হয়ে উঠলো দেখে সহরে নবশাক, হাড়ীশাক, মুচিশাক মশায়েরাও হামা দিতে আরম্ভ কল্লেন; ক্রমে ছোট জেতের মধ্যেও দ্বিতীয় রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর ও কেশব সেন জন্মাতে লাগলো -সন্ধ্যার পর দু-খানি চাপাটি ও একটু ন্যাবড়ানোর বদলে-ফাউলকারী ও রোল রুটি ইণ্ট্রডিউস হলো। শ্বশুবাড়ী আহার করা মেয়েদের বাঁ-শাক বেঁধান চলিত হলো দেখে বোতলের দোকান, কড়ি গণা, মাকু ঠেলা ও ভালুকের লোমব্যাচা কোলকাতায় থাকতে লজ্জিত হতে লাগলো। সবকামান চৈতনফক্কার জায়গায় আলবার্ট ফেসান ভর্ত্তি হলো। চাবির থলে কাঁধে করে টেনা ধুতি পরে দোকানে যাওয়া আর ভাল দেখায় না; সুতরাং অবস্থাগত জুড়ী, বগী ও ব্রাউহাম বরাদ্দ হলো। এই সঙ্গে সঙ্গে বেকার ও উমেদারি হালোতের দু-একজন ভদ্রলোক, মোসাহেব, তকমা-আরদালী ও হরকরা লেখা যেতে লাগলো। ক্ৰমে কলে-কৌশলে, বেণেতা বেসাতে টাকা খাটিয়ে অতি অল্পদিন মধ্যে কলিকাতা সহরে কতকগুলি ছোটলোক বড় মানুষ হন। রামলীলে, স্নানযাত্রা, চড়ক, বেলুনওড়া, বাজি ও ঘোড়র নাচ এঁরাই রেখেছেন–প্রায় অনেকেরই এক-একটি পাশবালিশ আছে—“যে অজ্ঞে” ও “হুজুর আপনি যা বলচেন, তাই ঠিক” বলবার জন্য দুই এক গণ্ডমূর্খ ববাখুরে ভদ্রসন্তান মাইনে করা নিযুক্ত রয়েছে। শুভ-কর্মে দানের দফায় নবডঙ্কা! কিন্তু প্রতি বৎসরের গার্ডেন ফিষ্টের খরচে চার-পাঁচটা ইউনিভারসিটি ফাউণ্ড হয়।
কলকেতা সহরের অমোদ শীগগির ফুরায় না, বারোইয়ারি-পূজার প্রতিমা পূজা শেষ হলেও বারো দিন ফ্যালা হয় না। চড়কও বাসি, পচা, গলা ও ধসা হয়ে থাকে—সেসব বলতে গেলে পুঁথি বেড়ে যায় ও ক্রমে তেতো হয়ে পড়ে, সুতরাং টাটকা–চড়ক টাটকা-টাটকাই শেষ করা গেল।
এদিকে চড়কতলায় টিনের ঘুরঘুরী, টিনের মুহুরী দেওয়া তল্তাবাশের বাঁশী, হলদে রং-করা বাঁখারির চড়কগাছ, ছেঁড়া ন্যাকড়ার তইরি গুড়িয়া পুতুল, শোলার নানাপ্রকার খেলনা, পেল্লাদে পুতুল, চিত্তির-করা হাড়ি বিক্রী কত্তে বসেছে; “ড্যানাক ডানাক ড্যাডাং ডাং চিংড়িমাছের দুটো ঠ্যাং” ঢাকের বোল বাজচে; গোলাপী খিলির দোনা বিক্রী হচ্ছে। একজন চড়কী পিঠে কাঁটা ফুঁড়ে নাচতে নাচতে এসে চড়কগাছের সঙ্গে কোলাকুলি কল্লে –মৈয়ে করে তাকে উপরে তুলে পাক দেওয়া হতে লাগলো। সকলেই আকাশ পানে চড়কীর পিঠের দিকে চেয়ে রইলেন! চড়কী প্রাণপণে দড়ি ধরে কখন ছেড়ে পা নেড়ে নেড়ে ঘুরতে লাগলো। কেবল “দে পাক দে পাক” শব্দ, কারু সৰ্ব্বনাশ, কারু পৌষমাস। একজনের পিঠ ফুঁড়ে ঘোরান হচ্ছে, হাজার লোক মজা দেখচেন।
পাঠক! চড়কের যথাকিঞ্চিৎ নক্মার সঙ্গে কলিকাতার বর্তমান সমাজের ইন্সাইড জানলে, ক্রমে আমাদের সঙ্গে যত পরিচিত হবে ততই তোমার বহুজ্ঞতার বৃদ্ধি হবে, তাতেই প্রথম কোট করা হয়েছে “সহর শিখাওয়ে কোতোয়ালি।”
১.০২ কলিকাতার বারোইয়ারি-পূজা
“And these what name or title e’er they bear,
—I speak of all–”
Beggars Bush.
সৌখীন চড়ক-পার্ব্বণ শেষ হলো বলেই যে দুঃখে সজনেখাঁড়া কেটে গেলেন। রাস্তার ধূলো ও কাঁকরেরা অস্থির হয়ে বেড়াতে লাগলো। ঢাকীরা ঢাক ফেলে জুতো গড়তে আরম্ভ কল্লে। বাজারে দুধ সস্তা (এতদিন গয়লাদের জল মেশবার অবকাশ ছিল না), গন্ধবেণে ভালুকের রোঁ বেচতে বসে গেলেন। ছুতরেরা গুলদার ঢাকাই-উড়ুনিতে কাঠের কুঁচো বাঁধতে আরম্ভ কল্লে। জন্ম-ফলারে যজমেনে বামুনেরা আদ্যশ্রাদ্ধ, বাৎসরিক সপিণ্ডীকরণ টাকতে লাগলেন—তাই দেখে গরমি আর থাকতে পাল্লেন না; “ঘরে আগুন”, “জল ডোবা” ও “ওলাউঠো” প্রভৃতি নানারকম বেশ ধরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেন।
রাস্তার ধারের ফোড়ের দোকান, পচা নিচু ও আঁবে ভরে গেল। কোথাও একটা কাঁটালের ভুতুড়ির উপর মাছি ভ্যান ভ্যান কচ্চে, কোথাও কতকগুলো আঁবের আটি ছড়ান রয়েছে, ছেলেরা আঁটি ঘষে ভেপু করে বাজাচ্চে। মধ্যে একপলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় চিৎপুরের বড় রাস্তা চুলারের পাতের মত দেখাচ্ছে—কুঠিওয়ালারা জুতা হাতে করে, বেশ্যালয়ের বারাণ্ডার নীচে আর রাস্তার ধারের বেণের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে—আজ ছক্কড়মহলে পোহাবারো।
কলকেতার কেরাঞ্চি গাড়ী বেতো রোগীর পক্ষে বড় উপকারক, গ্যালবানিক শকের কাজ করে। সেকেলে আশমানী দোলদার ছক্কড় যেন হিন্দুধৰ্ম্মের সঙ্গে সঙ্গেই কলকেতা থেকে গা-ঢাকা হয়েছে— কেবল দুই একখান আজও খিদিরপুর, ভবানীপুর, কালীঘাট অর বারাসতের মায়া ত্যাগ কত্তে পারেনি বলেই আমরা কখন কখন দেখতে পাই।
“চার অনা!” “চার অনা!” “লালদীঘি!” “তেরজরী!” “এস গো বাবু ছোট আদালত!” ব’লে গাড়োয়ানেরা সৌখীন সুরে চীৎকার কচ্চে; নববধ্বাগমনের বউয়ের মত দুই এক কুঠিওয়ালা গাড়ীর ভিতর বসে আছে।—সঙ্গী জুটচে না। দুই-একজন গবর্ণমেন্ট অফিসের কেরাণী গাড়োয়ানদের সঙ্গে দরের কষাকড়ি কচ্চেন। অনেকে চ’টে হেঁটেই চলেছেন—গাড়োয়ানের হাসি টিটকিরির সঙ্গে “তবে ঝাঁকামুটেয় যাও, তোমাদের গাড়ী চড়া কৰ্ম্ম নয়।” কমপ্লিমেন্ট দিচ্চে।
দশটা বেজে গেছে। ছেলেরা বই হাতে ক’রে রাস্তায় হো হো কত্তে কত্তে স্কুলে চলেছে। মৌভাতি বুড়োরা তেল মেখে গাছ কাঁধে করে অফিমের দোকান ও গুলীর আড্ডায় জলে। হেটো ব্যাপারীরা বাজারে বেচা-কেনা শেষ করে খালি বাজরা নিয়ে ফিরে যাচ্চে। কলকেতা সহর বড়ই গুলজার—গাড়ীর হরুবা, সহিসের পয়িস পরিস শব্দ, কেঁদো কেঁদো ওয়েলার ও নরম্যাণ্ডির টাপেতে রাস্তা কেঁপে উঠচে—বিনা বাঘাতে রাস্তায় চলা বড় সোজা কৰ্ম্ম নয়।
বীরকৃষ্ণ দার ম্যানেজার কানাইধর দত্ত এক নিমখাসা রকমের ছক্কর ভাড়া করে বারোইয়ারি পূজার বার্ষিক সাধতে বেরিয়েছেন।
বীরকৃষ্ণ দাঁ কেবলচাদ দার পুষ্যিপুত্তর, হাটখোলায় গদী, দশ-বাবোটা খন্দ মালের আড়ত, বেলেঘাটায় কাঠের ও চুণের পাঁচখানা গোলা, নগদ দশ বারো লাখ টাকা দাদন ও চোটায় খাটে। কোম্পানীর কাগজের মধ্যে মধ্যে লেন-দেন হয়ে থাকে; বারো মাস প্রায় সহরেই বাস, কেবল পুজোর সময় দশ-বারো দিনের জন্য বাড়ী যেতে হয়। একখানি বগী, একটি লাল ওয়েলার, একটি রাঁড়, দুটি তেলী মোসাহেব, গড়পারে বাগান ও ছ-ডেড়ে একু ভাউলে ব্যাভার, আয়েস ও উপাসনার জন্যে নিয়ত হাজির।
বীরকৃষ্ণ দাঁ শ্যামবর্ণ, বেটেখেঁটে রকমের মানুষ, নেয়াপাতি রকমের ভুঁড়ি, হাতে সোনার তাগা, কোমরে মোটা সোনার গোট, গলায় একছড়া সোনার দু-নরী হার, আহ্নিকের সময়, খেলবার তাসের মত চ্যাটালো সোনার ইষ্টিকবচ পরে থাকেন, গঙ্গাস্নানটি প্রত্যহ হয়ে থাকে, কপালে কণ্ঠায় ও কানে ফোঁটাও ফাঁক যায় না। দাঁ মহাশয় বাঙ্গালা ও ইংরাজী নামসই কত্তে পারেন ও ইংরেজ খদ্দের আসা যাওয়ায় দু-চারটে ইংরাজী কোম্পানীর কনট্যাক্টে ‘কম’ আইস, ‘গো’ যাও প্রভূতি দুই-একটা ইংরজী কথাও আসে; কিন্তু দাঁ মহাশয়কে বড় কাজকর্ম্ম দেখতে হয় না, কানাইধন দত্তই তার সব কাজকর্ম্ম দেখেন, দাঁ মশায় টানা-পাখায় বাতাস খেয়ে, বগী চড়ে, আর এসরাজ বাজিয়েই কাল কাটান।
বারো জনে একত্র হয়ে কালী বা অন্য দেবতার পূজা করার প্রথা মড়ক হতেই সৃষ্টি হয়—ক্রমে সেই অবধি “মা” ভক্তি ও শ্রদ্ধার অনুরোধে ইয়ারদলে গিয়ে পড়েন। মহাজন, গোলদার, দোকানদার ও হেটোরাই বারোইয়ারি-পূজোর প্রধান উদযোগী। সংবৎসর যার যত মাল বিক্রী ও চালান হয়, মণ পিছু এক কড়া দু কড়া বা পাঁচ কড়ার হিসাবে বারোইয়ারি খাতে জমা হয়ে থাকে, ক্রমে দু-এক বৎসরের দস্তুরি বারোইয়ারি খাতে জমলে মহাজনদের মধ্যে বর্ধিষ্ণু ও ইয়ারগোচের সৌখীন লোকের কাছেই ঐ টাকা জমা হয়। তিনি বারোইয়ারি-পূজের অধ্যক্ষ হন—অন্য চাঁদা আদায় করা, চাঁদার জন্য ঘোরা ও বারোইয়ারি সং ও রং-তামাসার বন্দোবস্ত করা তাঁরই ভার হয়।
এবার ঢাকার বীরকৃষ্ণ দাঁ-ই বারোইয়ারির অধ্যক্ষ হয়েছিলেন, সুতরাং দাঁ মহাশয়ের আমমোক্তার কানাইবন দত্তই বারোইয়ারির বার্ষিক সাবা ও আর আর কাজের ভার পেয়েছিলেন।
দত্তবাবুর গাড়ী রুনু রুনু রুনু ছুনু ছুনু করে নুড়িঘাটা লেনের এক কায়স্থ বড়মানুষের বাড়ীর দরজায় লাগলো। দত্তবাবু তড়াক ক’রে গাড়ী থেকে লাফিয়ে পড়ে দারোয়ানদের কাছে উপস্থিত হলেন। সহরের বড়মানুষের বাড়ীর দরোয়ানের খোদ হুজুর ভিন্ন নদের রাজা এলেও খবর নদারক! “হোরির বক্সিস”, “দুর্গোৎসবের পার্ব্বণী”, “রাখী পূর্ণিমার প্রণামী” দিয়েও মন পাওয়া ভার। দত্তবাবু অনেক ক্লেশের পর চার অন কবলে একজন দারোয়ানকে বাবুকে এংলা দিতে সম্মত কললেন। সহরের অনেক বড়মানুষের কাছে “কর্জ্জ দেওয়া টাকার সুদ” বা তাঁর “পৈতৃক জমিদারী” কিনতে গেলেও বাবুর কাছে এংলা হ’লে হজুরের হুকুম হ’লে, লোক যেতে পায়; কেবল দুই-এক জায়গায় অবারিতদ্বার! এতে বড়মানুষদেরো বড় দোষ নাই, ‘ব্রাহ্মণপণ্ডিত’, উমেদার’, ‘কন্যাদায়’, ‘আইবুড়ো’ ও ‘বিদেশী ব্রাহ্মণ’ ভিক্ষুকদের জ্বালায় সহরে বড়মানুষদের স্থির হওয়া ভার। এদের মধ্যে কে মৌতাতের টানাটানির জ্বালায় বিব্রত, কে যথার্থ দায়গ্রস্ত, এপিডেপিট করলেও তার সিদ্ধান্ত হয় না! দত্তবাবু আর ঘণ্টা দরজায় দাঁড়িয়ে বইলেন; এর মধ্যে দশ-বারোজনকে পরিচয় দিতে হলো, তিনি কিসের জন্য হজুরে এসেছেন। তিনি দুই একটা বেনাড়া রকমের দরোয়ানি ঠাট্টা খেয়ে গরম হচ্ছিলেন, এমন সময় তাঁর চার অলি দাদুনে দরোয়ান ঢিকুতে ঢিকুতে এসে তাঁরে সঙ্গে করে নিয়ে হজুরে পেশ কললে।
পাঠক। বড়মানুষের বাড়ীর দরোয়ানের কথায়, এইখানে আমাদের একটি গল্প মনে পড়ে গেল; সেটি না বলেও থাকা যায় না।
বছর দশ-বারো হলো, এই সংবের বাগবাজার অঞ্চলের একজন ভদ্রলোক তার জন্মতিথি উপলক্ষে গুটিকত ফ্রেণ্ডকে মধ্যাহ্নভোজনের নিমন্তন্ন করেন। জন্মতিথিতে আমোদ করা হিন্দুদের পক্ষে ইংরেজদের কাপি করা প্রথা নয়; আমরা পুরুষপরম্পরা জন্মতিথিতে গুড়-দুধ খেয়ে তিল বুলে, মাছ ছেড়ে, (যার যেমন প্রথা) নতুন কাপড় পরে, প্রদীপ জ্বেলে, শাক্ বাজিয়ে, আইবুড়ো ভাত খাবার মত–কুটুম্ব-বন্ধু বান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে ভোজন করে থাকি। তবে আজকাল সহরের কেউ কেউ জন্মতিথিতে বেতর গোচের অমোদ করে থাকেন। কেউ যেটের কোলে ষাট বৎসরে পদার্পণ করে আপনার জন্মতিথির দিন গ্যাসের আলোর গেট, নাচ ও ইংরেজদের খানা দিয়ে চোহেলের খানা দিয়ে চোহেলের একশেষ করেন; অভিপ্রায়, আপনারা আশীৰ্বাদ করুন, আর ষাট বছর এমনি করে আমোদ কত্তে থাকুন, চুলে ও গোঁফে কলপ দিয়ে জরির জামা ও হীরের কণ্ঠী পরে নাচ দেখতে বসুন—প্রতিমা বির্জন–স্নানযাত্রা ও রথে বাহার দিন। অনেকের জন্মতিথিতে বাগান টের পান যে, আজ বাবুর জন্মতিথি, নেমন্তন্নেদের গা সারতে আফিসে একহপ্তা ছুটি নিতে হয়। আমাদের বাগবাজারের বাবু সে রকমের কোন দিকেই যান নি, কেবল গুটিকতক ফ্রেণ্ডকে ভাল করে খাওয়াবেন, এই তাঁর মতলব ছিল। এদিকে ভোজের দিন নেমন্তন্নেরে এসে একে একে জুটলেন, খাবার-দাবার সকলি প্রস্তুত হয়েছিল, কিন্তু সেদিন সকালে বাদলা হওয়ায় মাছ পাওয়া যায় নি। বাঙ্গালীদের মাছটা প্রধান খাদ্য, সুতরাং কর্ম্মকর্ত্তা মাছের জন্য উড়ই উদ্বিগ্ন হতে লাগলেন; নানা স্থানে মাছের সন্ধানে লোক পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু কোন রকমেই মাছ পাওয়া গেল না।–শেষ একজন জেলে একটা সে দশ-বারো ওজনের রুইমাছ নিয়ে উপস্থিত হলো। মাছ দেখে কৰ্ম্মকর্ত্তার আর খুসীর সীমা রইলো না। জেলে যে দাম বলবে, তাই নিয়ে মাছটি নেওয়া যাবে মনে করে জেলেকে জিজ্ঞাসা কল্লো, “বাপ, এটির দাম কি নেবে? ঠিক বল, তাই দেওয়া যাবে।” জেলে বল্লে, “মশাই! এর দাম বিশ ঘা জুতো।” কৰ্মকর্ত্তা বিশ ঘা জুতো শুনে অবাক হয়ে রইলেন। মনে কল্লেন, জেলে বাদলা পেয়ে মদ খেয়ে মাতাল হয়েছে, নয়ত পাগল। কিন্তু জেলে কোন ক্রমেই বিশ ঘা জুতো ভিন্ন মাছটি দিবে না, এই তার পণ হলো। নিমন্তুন্নে, বাড়ীর কর্তা ও চাকর-বাকরেরা জেলের এ আশ্চর্য্য দাম শুনে তারে কেউ পাগল, কেউ মাতাল বলে ঠাট্টা-মস্করা কত্তে লাগলো; কিন্তু কোন রকমেই জেলের গো ঘুচলো না। শেষে কর্ম্মকর্ত্তা কি করেন, মাছটি নিতেই হবে, আস্তে আস্তে জেলেকে বিশ ঘা জুতো মাত্তে রাজী হলেন, জেলেও অম্লানবদনে পিঠ পেতে দিলে। দশ ঘা জুতো জেলের পিঠে পড়বা মাত্র জেলে “মশাই! একটু থামুন, আমার একজন অংশীদার আছে, বাকী দশ ঘ সেই খাবে, আপনার দরোয়ান–দরজার বসে আছে, তারে ডেকে পাঠান। আমি যখন বাড়ীর ভিতরে মাছ নিয়ে আসছিলেম, তখন মাছের অর্ধেক দাম না দিলে আমারে ঢুকতে দিবে না বলেছিল, সুতরাং আমিও অর্ধেক বখরা দিতে রাজী হয়েছিলেম।” কর্ম্মকর্ত্তা তখন বুঝতে পাললেন, জেলে কিজন্য মাছের দাম বিশ ঘা জুতো চেয়েছিল। দরোয়াজীকে দরজায় বসে আর অধিকক্ষণ জেলের দামের বখরার জন্য প্রতীক্ষা করে থাকতে হলো না; কর্ম্মকর্ত্তা তখনি দরোয়ানজীকে জলের বিশ ঘার অংশ দিলেন। পাঠক বড়মানুষেরা! এই উপন্যাসটি মনে রাখবেন।
হুজুর দেড়হাত উঁচু গদীর উপরে তাকিয়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে, গা আদুর! পাশে মুন্সীমশায় চসমা চোখে দিয়ে পেস্কারের সঙ্গে পরামর্শ কচ্চে—সামনে কতকগুলো খোলা থাতা ও একঝুড়ি চোতা কাগজ, আর একদিকে পাঁচজন ব্রাহ্মণপণ্ডিত বাবুকে “ক্ষণজন্ম”, “যোগভ্রষ্ট” বলে তুষ্ট করবার অবসর খুঁজচেন। গদীর বিশ হাত অন্তরে দুজন বেকার ‘উমেদার’ ও একজন বৃদ্ধ কন্যাদায় কাঁদো কাঁদো মুখ করে ঠিক ‘বেকার’ ও ‘কন্যাদায়’ হালতের পরিচয় দিচ্চেন। মোসাহেবের খালি গায়ে ঘুর-ঘুর কচ্ছে, কেউ হুজুরের কাণে কাণে দু-চার কথা কচ্চেন—হুজুর ময়ূরহীন কার্ত্তিকের মত আড়ষ্ট হয়ে বসে রয়েছেন। দত্তবাবু গিয়ে নমস্কার কললেন।
হুজুর বারোইয়ারি-পূজার বড় ভক্ত,পূজার কদিন দিবারাত্রি বারোইয়ারিতলাতেই কাটান। ভাগ্নে, মোসাহেব, জামাই ও ভগিনীপতি বারোইয়ারির জন্য দিনরাত শশব্যস্ত থাকেন।
দত্তবাবু বারোইয়ারি-বিষয়ক নানা কথা কয়ে হজুরি সবষ্ক্রিপসন হাজার টাকা বিদেয় নিলেন! পেমেন্টের সময় দাওয়ানজী শতকরা দু টাকার হিসাবে দস্তুরী কেটে ন্যান, দত্তজা ঘরপোড়া কাঠের হিসাবে ও দাওয়ানজীকে খুশী রাখবার জন্য তাতে আর কথা কইলেন না। এদিকে বাবু বারোইয়ারি পূজার ক-রাত্রি কোন্ কোন্ রকম পোষাক পরবেন, তার বিবেচনায় বিব্রত হলেন।
কানাইবাবু বারোইয়ারি-বই নিয়ে না খেয়ে বেলা দুটো অবধি নানা স্থানে ঘুরলেন, কোথাও কিছু পেলেন, কোথাও মস্ত টাকা সই মাত্র হলো; (আদায় হবে না, তার ভয় নাই), কোথাও গলা ধাক্কা, তামাসা ও ঠোনাটা-ঠানাটাও সইতে হলো।
বিশ বচ্ছর পূর্ব্বে কলকেতার বারোইয়ারির চাঁদা-সাধারা প্রায় দ্বিতীয় অষ্টমের পেয়াদা ছিলেন–ব্রহ্মোত্তর জমির খাজানা সাধরি মত লোকের উনোনে পা দিয়ে টাকা আদায় কত্তেন, অনেক চোটের কথা কয়ে, বড়মানুষেদের তুষ্ট করে টাকা আদায় কত্তেন।
একবার এক বারোইয়ারি-পাণ্ডারা এক চক্ষু কাণা এক সোণার বেণের কাছে চাঁদা আদায় কত্তে যান। বেণেবাবু বড়ই কৃপণ ছিলেন, “বাবার পরিবারকে” (অর্থাৎ মাকে) ভাত দিতেও কষ্ট বোধ কত্তেন, তামাক খাবার পাতের শুকনো নলগুলি জমিয়ে রাখতেল; একবৎসরের হলে ধোপাকে বিক্রী কত্তেন, তাতেই পরিবারের কাপড় কাচার দাম উসুল হতো। বারোইয়ারি-অধ্যক্ষেরা বেণেবাবুর কাছে চাঁদার বই ধল্লে, তিনি বড়ই রেগে উঠলেন ও কোন মতে এক পয়সাও বারোইয়ারিতে বাজে খরচ কত্তে রাজি হলেন না। বারোইয়ারির অধ্যক্ষের ঠাউরে ঠাউরে দেখলেন, কিন্তু বাবুর বাজে খরচের কিছুই নিদর্শন পেলেন না; তামাক গুলি পাকিয়ে কোম্পানীর কাগজের সঙ্গে বাক্সমধ্যে রাখা হয়—বালিসের ওয়াড়, ছেলেদের পোষাক বেণেবাবু অবকাশমত স্বহস্তেই সেলাই করেন—চাকরদের কাছে (একজন বুড়ো উড়ে মাত্ৰ) তামাকের গুল, মুড়ো খেংরার দিনে দুবার নিকেশ নেওয়া হয়—ধুতি পুরণো হলে বদল দিয়ে বাসন কিনে থাকেন। বেণেবাবুর ত্রিশ লক্ষ টাকার কোম্পানীর কাজ ছিল; এ সওয়ায় সুদ ও চোটায় বিলক্ষণ দশ টাকা আসতো; কিন্তু তার এক পয়সা খরচ কত্তেন না; (পৈতৃক পেসা)। খাঁটি টাকায় মাকু চালিয়ে যা রোজগার কত্তেণ, তাতেই সংসারনির্ব্বাহ হতো; কেবল বাজে খরচের মধ্যে, একটা চক্ষু, কিন্তু চসমায় দুখানি পরকলা বসানো। তাই দেখে, বারোইয়ারির অধ্যক্ষেরা ধরে বলেন, “মশাই! আপনায় বাজে খরচ ধরা পড়েছে, হয় চসমাখানির একখানি পরকলা খুলে ফেলুন, নয় আমাদের কিছু দিন।” বেণেবাবু এ কথায় খুসী হলেন; অনেক কষ্টে দুটি সিকি পর্যন্ত দিতে সম্মত হয়েছিলেন।
আর একবার বারোইয়ারি-পূজোর এক দল অধ্যক্ষ সহরের সিঙ্গিবাবুদের বাড়ী গিয়ে উপস্থিত; সিঙ্গিবাবু সে সময় অফিসে বেরুচ্ছিলেন, অধ্যক্ষেরা চার-পাঁচ জনে তাহাকে ঘিরে ধরে ‘ধরেছি, ধরেছি’ বলে চেঁচাতে লাগলেন। রাস্তায় লোক জমে গেল, সিঙ্গিবাবু অবাক্–ব্যাপারখানা কি? তখন একজন অধ্যক্ষ বল্লেন, “মশায়! আমাদের অমুক জায়গায় বারোইয়ারিপূজোয় মা ভগবতী সিঙ্গির উপর চড়ে কৈলাস থেকে আসছিলেন, পথে সিঙ্গির পা ভেঙ্গে গেছে; সুতরাং তিনি আর আসতে পাচ্ছেন না, সেইখানেই রয়েছেন; আমাদের স্বপ্ন দিয়েছেন যে, যদি আর কোন সিঙ্গির যোগাড় কত্তে পার, তা হলেই আমি যেতে পারি। কিন্তু মহাশয়! আমরা আজ একমাস নানা স্থানে ঘুরে বেড়াচ্চি, কোথাও আর সিঙ্গির দেখা পেলেন না। আজ আপনার দেখা পেয়েচি, কোন মতে ছেড়ে দেবো না–চলুন, যাতে মার আসা হয়, তাই তদ্বির করবেন। সিঙ্গিবাবু অধ্যক্ষদের কথা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে, বারোইয়ারির চাঁদায় বিলক্ষণ দশ টাকা সাহায্য কল্লেন।
এ ভিন্ন বারোইয়ারির চাঁদা-সাধা বিষয়ে নানা উদ্ভট কথা আছে। কিন্তু এখানে সে সকলের উত্থাপন নিষ্প্রয়োজন। পূৰ্ব্বে চুঁচড়োর মত বারোইয়ারি-পূজা আর কোথাও হতো না, “আচাভো’, ‘বোম্বোচাক’ প্রভৃতি সং প্রস্তুত হতে; সহরের ও নানাস্থলের বাবুরা বোট, বজরা, পিনেস ও ভাউলে ভাড়া করে সং দেখতে যেতেন। লোকের এত জনতা হতো যে, কলপাত এক টাকায় একখানি বিক্রী হতো, চোরেরা আণ্ডীল হয়ে যেতো; কিন্তু গরীব, দুঃখী গেরস্তোর হাঁড়ি চড়তো না। গুপ্তিপাড়া, কাঁচড়াপাড়া, শান্তিপুর, উলো প্রভৃতি কলকেতার নিকটবর্তী পল্লীগ্রামে ক’বার বড় ধুম করে বারোইয়ারি-পূজো হয়েছিল। এতে টক্করাটক্করিও বিলক্ষণ চলেছিল। একবার শান্তিপুরওয়ালারা পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে এক বারোইয়ারি-পূজো করেন; সাত বৎসর ধরে তার উজ্জুগ হয়, প্রতিমাখানি ষাট হাত উঁচু হয়েছিল। শেষে বিসর্জ্জনের দিনে প্রত্যেক পুতুল কেটে কেটে বিসর্জ্জন কত্তে হয়েছিল, তাতেই গুপ্তিপাড়াওয়ালার ‘মার’ অপঘাতমৃত্যু উপলক্ষে গণেশের গলায় কাচা বেঁধে এক বারোইয়ারি পূজো করেন, তাতেও বিস্তর টাকা ব্যয় হয়!
এখন আর সে কাল নাই; বাঙ্গালী বউমানুষদের মধ্যে অনেক সভ্য হয়েচেন। গোলাপজল দিয়ে জলশৌচ, ঢাকাই কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে পরা, মুক্তাভস্মের চূণ দিয়ে পান খাওয়া, এখন আর শোনা যায় না। কুকুরের বিয়েয় লাখ টাকা খরচ, যাত্রায় নোট প্যালা, তেল মেখে চার ঘোড়ার গাড়ী চড়ে ভেপু বাজিয়ে স্নান কত্তে যাওয়া, সহরে অতি কম হয়ে পড়েছে। আজ্ঞা হুজুর, উঁচু গদী, কার্ত্তিকের মত বাউরি-কাঁটা চুল, একপাল বরাখুরে মোসাহেব, রক্ষিত বেশ্যা আর পাকান কাছা–জলস্তম্ভ আর ভূমিকম্পের মত—’কখনোর’ পাল্লায় পড়েছে!
কায়স্থ, ব্রাহ্মণ বড়মানুষ (পাড়াগেঁয়ে ভুতেরা ছাড়া প্রায় মাইনে-করা মোসাহেব রাখেন না; কেবল সহরে দু’চার বেণে বড়মানুষই মোসাহেবদের ভাগ্যে সুপ্রসন্ন। বুক-ফোলান, বাঁকা সীঁথি, পইতের গোছা গলায়, কুঁচের মত চক্ষু লাল, কাণে তুলোয় করা আতর (লেখাপড়া সকল রকমই জানেন, কেবল বিস্মৃতিক্রমে বর্ণপরিচয়টি হয় নাই) আমরা খালি বেণে বড় মানুষ বাবুদের মজলিশে দেখতে পাই।
মোসাহেবী পেশা উঠে গেলেই, ‘বারোইয়ারি’, ‘খেমটা’, ‘চেহেল’ ও ‘ফররার’ লাঘব হবে সন্দেহ নাই।
সন্ধ্যা হয় হয় হয়েচে–গয়লারা দুধের হাঁড়া কাঁধে করে দোকামে যাচ্ছে। মেছুনীরা আপনাদের পাটা, বঁটি ও চুবড়ি ধুয়ে প্রদীপ সাজাচ্ছে! গ্যাসের আলো-জ্বালা মুটেরা মৈ কাঁধে করে দৌডুচ্চে, থানার সামনে পাহারাওয়ালাদের প্যারেড (এঁরা লড়াই করবেন, কিন্তু মাতাল দেখে ভয় পান) হয়ে গিয়েছে। ব্যাঙ্কের ভেটো কেরাণীরে ছুটি পেয়েছেন। আজ এ সময়ে বীরকৃষ্ণ দাঁর গদীতে বড় ধূম—বাবোইয়ারির অধ্যক্ষেরা একত্র হয়ে কোন কোন রকম সং হবে, কুমোরকে তারি নমুনা দেখাবেন, কুমোর নমুনো-মত সং তৈয়ের করবে, দাঁ মহাশর ও ম্যানেজার কানাইধন দত্তজা সমুনোর মুখপাত!
ফৌজদুরী বালাখানা থেকে ভাড়া করে এনে, কুড়িটি বেল লণ্ঠন (রং-বেরং—সাদা, গ্রিন, লাল) টাঙ্গান হয়েছে। উঠোনে প্রথমে খড়, তার উপর দরমা, তার উপর মাদরাজি খেরোর জাজিম হাসচে। দাঁড়িপাল্লা, চ্যাটা, কুলো ও চালুনীরে, গণিগব্যাগ ও ছেঁড়া চটের আশপাশ থেকে উঁকি-ঝুঁকি মাচ্চে—আর তারা ঘরজামাই ও অন্নদাস-ভাগ্নের দলে গণ্য।
বীরকৃষ্ণবাবু ধূপছায়া চেলীর জোড় এবং কলার-কপ ও প্লেটওয়ালা (ঝাড়ের গেলাশের মত) কামিজ ও ঢাকাই ট্যার্চ্চা কাজের চাদরে শোভা পাচ্ছে, রুমালখানি কোমরে বাঁধা আছে—সোনা চাবি-শিক্লী, কোঁচা ও কামিজের উপর ঘড়ির চেনের অফিসেয়েটিং হয়েছে।
পাঠক! নবাবী আমল শীতকালের সূর্যের মত অস্ত গেল। মেঘন্তের রৌদ্রের মত ইংরেজদের প্রতাপ বেড়ে উঠলো। বড় বড় বাঁশঝাড় সমূলে উচ্ছন্ন হলো। কঞ্চিতে বংশলোচন জন্মাতে লাগলো। গবো মুন্সী, ছিরে বেণে ও পুঁটে তেলী রাজা হলো। সেপাই পাহারা, আনা-সোটা ও রাজা খেতাপ, ইণ্ডিয়া রবরের জুতো ও শান্তিপুরের ডুরে উড়ুনির মত রাস্তায় পাঁদাড়ে গড়াগড়ি যেতে লাগলো। কৃষ্ণচন্দ্র, রাজবল্পভ, মানসিংহ, নন্দকুমার, জগৎ শেঠ প্রভৃতি বড় বড় ঘর উৎসন্ন যেতে লাগলো, তাই দেখে হিন্দুধৰ্ম্ম, কবির মান, বিদ্যার উৎসাহ, পরোপকার নাটকের অভিনয় দেশ থেকে ছুটে পালালো। হাফ-আখড়াই, ফুল-আখড়াই পাঁচালী ও যাত্রার দলেরা জন্মগ্রহণ কলে, সহরের যুবকদল গোধুরী, ঝকমারী ও পক্ষীর দলে বিভক্ত হলেন। টাকা বংশগৌরবকে ছাপিয়ে উঠলেন। রামা মুদ্দফরাস, কেষ্টা বাগদী, পেঁচো মল্লিক ও ছুঁচো শীল ককেতার কায়েত-বামুনের মুরুব্বী ও সহরের প্রধান হয়ে উঠলো। এ সময়ে হাফ আখড়াই ও ফুল-অখিড়াইয়ের সৃষ্টি ও এই অবধি সহরের বড়মানুষেরা হাফ-আখাড়াইয়ে আমোদ কত্তে লাগলেন। শামবাজার, রামবাজার চক ও সাঁকোর বড় বড় নিষ্কর্মা বাবুর৷ এক এক হাফ-আখড়াই দলের মুরুব্বী হলেন। মোসাহেব, উমেদার, পাড়াস্থ ও দলস্থ গেরস্তগোছ হাড়হাভাতেরা সৌধীন দোহারের দলে মিশলেন। অনেকের হাফ-আখড়াইয়ের পুণ্যে চাকরী জুটে গেল। অনেকে পূজুরী দাদাঠাকুরের অবস্থা হতে একেবারে আমীর হয়ে পড়লেন—কিছুদিনের মধ্যে তকমা বাগান, জুড়ী ও বালাখানা বনে গেল!
আমরা পূর্ব্বে পাঠকদের যে বারোইয়ারি-পূজোর কথা বলে এসেচি, বীরকৃষ্ণ দাঁর উজ্জুগে প্রথম রাত্রি সেই বারোইয়ারিতলায় হাফ-আখড়াই হবে, তার উজ্জুগ হচ্ছে।
ধোপাপুকুর লেনের দুইয়ের নম্বর বাড়ীটিতে হাফ-আখড়াইয়ের দল বসেচে-বীরষ্ণেবাবু বগী চ’ড়ে প্রত্যহ আড্ডায় এসে থাকেন। দোহারেরা কুঠি থেকে এসে হাত-মুখ ধুয়ে জলযোগ করে রাত্রি দশটার পর একত্রে জমায়েৎ হন–ঢাকাই কামার, চাষাধোপা, পুঁটেতেলী ও ফলারে বামুনই অধিক। মুখুয্যেদের ছোটবাবু অধ্যক্ষ। ছোটবাবু ইয়ারের টেক্কা, বেশ্যার কাছে চিড়িয়ার গোলাম ও নেশায় শিবের বাবা! শরীর ডিগ্ডিগে, পুইতে গোচ্ছা ক’রে গলায়, দাঁতে মিশি, প্রায় আধহাত চেটালো কালা ও লালপেড়ে চক্ৰবেড়ের ধুতি পরে থাকেন। দেড়ভরি আফিম, দেড়শ ছিলিম গাঁজা ও একজালা তাড়ী রোজকী মৌতাতের উঠনো বন্দোবস্ত। পাল-পার্ব্বণে ও শনিবারে বেশী মাত্রা চড়ান!
অমাবস্যার রাত্রি–অন্ধকারে ঘুরঘুট্টি–গুড় গুড় করে নড়ছে না, মাটি থেকে যেন আগুনের তাপ বেরুচ্চে, পথিকেরা এক একবার আকাশ-পানে চাচ্ছেন, আর হন্ হন্ করে চলেচেন-কুকুরগুলো খেউ ঘেউ কচ্চে, দোকানীরে ঝাঁপড়া বন্ধ করে ঘরে যাবার উজ্জুগ কচ্চে,–গুডুম করে “নটার” তোপ পড়ে গেল। পোপাপুকুর লেনের দুইয়ের নম্বরের বাড়ী আজ বড়ই ধূম। ঢাকার বীরকৃষ্ণবাবু, চকবাজারের প্যালানাথবাবু, দলপতি বাবুয়ো ও দু-চার গাইয়ে ওস্তাদও আসবেন। গাওনার সুর বড় চমৎকার হয়েছে–দোহারেরাও মিলে ও তালে দোরস্ত।
সময় কারুরই হাত-ধর নয়–নদীর স্রোত্রে মত, বেশ্যার যৌবনের মত ও জীবের পরমায়ুর মত, কারুরই অপেক্ষা করে না! গির্জ্জের ঘড়িতে ঢং ঢং ঢং করে দশটা বেজে গেল, সোঁ সোঁ করে একটা বড় ঝড় উঠলো, রাস্তার ধূলো উড়ে যেন অন্ধকার অরো বাড়িয়ে দিলে–মেঘের কড়মড় কড়মড় ডাক ও বিদ্যুতের চমকানিতে ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলেরা মার কোলে কুণ্ডুলী পাকাতে আরম্ভ কল্লে–মুষলের ধারে ভারী একপসলা বৃষ্টি এলো।
এদিকে দুয়ের নম্বরের বাড়ীতে অনেকে এসে জমতে লাগলেন। অনেকে সকলের অনুরোধে ভিজে ঢ্যাপঢ্যাপে হয়ে এলেন। চারডেলে দেয়ালগিরিতে বাতি জ্বলচে—মজলিস জক জক কচ্চে–পান, কলাপাতের এঁটো নল ও থেলো হুঁকোর কুরুক্ষেত্তর! মুখুয্যেদের ছোটবাবু লোকের খাতির কচ্চেন––‘ওরে’ ‘ওরে’ ক’রে তার গলা চিরে গ্যাচে। তেলী, ঢাকাই কামার ও চাষাধোপা দোহারেরা একপেট ফির্নি মেটো, ঘণ্টো ও আটা-নেবড়ান-লুসে, ফরসা ধুতি-চাদরে ফিট হয়ে বসে আছেন, অনেকের চক্ষু বুজে এসেচে–বাতির আলো জোনাকী-পোকার মত দেখছেন ও এক একবার ঝিমকিনি ভাঙলে মনে কচ্চেন, যেন উড়চি। ঘরটি লোকারণ্য—সকলেই খাতায় খাতায় ঘিরে বসে আছেন—থেকে থেকে ফুক্কুড়ি টপ্পাটা চলচে,—অনেক সেয়ানা ফরমেসে জুতো-জোড়াটি হয় পকেটে, নয় পার নীচে রেখে চেপে বসেচেন;–জুতো এমনি জিনিস যে, দোহারদলের পরস্পরেও বিশ্বাস নাই! চকবাজারের প্যালানাথবাবুর অপেক্ষাতেই গাওনা বন্ধ রয়েছে, তিনি এলেই গাওনা আরম্ভ হবে। দু-একজন ধরতা দোহার প্যালানাথবাবুর আসবার অপেক্ষায় থাকতে বেজার হচ্চেন–দু-একজন “তাই ত” বলে দাদার বোলে বোল দিচ্চে; কিন্তু প্যালানাথবাবু বারোইয়ারির একজন প্রধান ম্যানেজার, সৌখীন ও খোসপোষাকীর হদ্দ ও ইয়ারের প্রাণ! সুতরাং তার অপেক্ষা না কল্লে তাঁর অপমান করা হয়, ঝড়ই হোক, বজ্রাঘাতই হোক আর পৃথিবী কেন রসাতলে যাক না, তাঁর এসব বিষয়ে এমন সখ যে, তিনি অবশ্যই আসবেন।
ধতা দোহার গোবিন্দবাবু বিরক্ত হয়ে নাকিসুরে ‘মনালে বঁদিয়া’ জিক্কুর টপ্পা ধরেছেন;–গাঁজার হুঁকো একবার এ থাকের পাশ মেরে ও থাকে গেল। ঘরের এককোণে হুঁকো থেকে আগুন পড়ে যাওয়ায়, সে দিকের থাকেরা রল্লা করে উঠে দাঁড়িয়ে কোঁচা ও কাপড় ঝাড়চেন ও কেমন করে আগুন পড়লো, প্রত্যেকে তারই পঞ্চাশ রকম ডিপোজিশন দিচ্চেন;—এমন সময় একখান গাড়ী গড় গড় করে এসে দরজায় লাগলো। মুখুয্যেদের ছোটবাবু মজলিস থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, বারাণ্ডায় গিয়ে “প্যালানাথবাবু! প্যালানাথবাবু এলেন” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন;–দোহারদলে হুররে ও রৈ-রৈ পড়ে গেল,–ঢোলে রং বেজে উঠলো। প্যালানাথবাবু উপরে এলেন–শেকহ্যাণ্ড, গুড ইভনীং ও নমস্কারের ভিড় ঢুকতে আধঘণ্টা লাগলো।
চকবাজারের বাবু প্যালানাথ একহারা বেঁটেখেঁটে মানুষ, গত বৎসর পঞ্চাশ পেরিয়েচেন; বাবু বড় হিন্দু–একাদশী-হরিবাসর ও রাধাষ্টমীতে উপোস, উত্থানও নির্জলা করে থাকেন; বাবুর মেজাজ গরিব। সৌখীনের রাজা! ১২১৯ সালে সারবর্ন সাহেবের নিকট তিনমাস মাত্র ইংরেজী লেখাপড়া শিখে ছিলেন, সেই সম্বলেই এতদিন চলচে–সর্ব্বদা পোষাক ও টুপী পরে থাকেন; (টুপীটি এমনি হেলিয়ে হেলিয়ে পরা হয়ে থাকে যে, বাবুর ডান কাণ আছে কি না হঠাৎ সন্দেহ উপস্থিত হয়); লক্ষ্ণৌ ফ্যাশানে (বাইজীর ভেডুয়ার মত) চুড়িদার পায়জামা, রামজামা, কোমরে দোপাটা ও মাথায় বাঁকা টুপী, তাঁর মনোমত পোষাক। বাঈ ও খেমটা মহলে প্যালানাথবাবুর বড় মান! তাদের কোন দায়-দখল পড়লে বাবু আড় হয়ে পড়ে আফোতে তামায করেন, বাঈয়ের অনুরোধে হিন্দুয়ানী মাথায় রেখে কাছা খুলে ফয়তা দেন ও বাবোইয়ারির নামে তযবি পড়েন। মোসলমান-মহলেও বাবুর বিলক্ষণ প্রতিপত্তি! অনেক লক্ষ্ণৌয়ে পাতি ও ইরাণী চাপদাড়ি বাবুর বুজরুকি ও কেরামতের অনিয়ম এনসাফ করে থাকেন! ইংরেজী কেতা বাবুর ভাল লাগে না; মনে করেন, ইংরেজী লেখাপড়া শেখা শুদ্ধ কাজ চালাবার জন্য। মোসলমান-সহবাসে প্রায় দিবারাত্রি থেকে থেকে ঐ কেতাই এঁর বড় পছন্দ! সর্ব্বদাই নবাবী আমলের জাঁকজমক, নবাবী আমীরী ও নবাবী মেজাজের কথা নিয়ে নাড়াচাড়া হয়।
এদিকে দোহারের নতুন সুরের গান ধল্লেন। ধোপাপুকুর রন্ রন্ কত্তে লাগলো; ঘুমন্ত ছেলেরা মার কোলে চমকে উঠলো কুকুরগুলো খেউ খেউ করে উঠলো;–বোধ হতে লাগলো যেন, হাড়ীরে গোটাকতক শূয়ার ঠেঙ্গিয়ে মাচ্চে! গাওনার নতুন সুর শুনে সকলেই বড় খুসী হয়ে ‘সাবাস! বাহবা!’ ও শোভান্তরীর বৃষ্টি কত্তে লাগলেন–দোহারের উৎসাহ পেয়ে দ্বিগুণ চেঁচাতে লাগলো,– সমস্ত দিন পরিশ্রম করে ধোপারা অঘোরে ঘুমুচ্ছিলো, গাওনার বেতরো আওয়াজে চমকে উঠে খোটা ও দড়ি নিয়ে দৌডুলো! রাত্রি দুটো পর্যন্ত গাওনা হয়ে, শেষে সে রাত্রের মত বেদব্যাস বিশ্রাম পেলেন–দোহার, সৌখীন বাবু অধ্যক্ষের অন্ধকারে অতিকষ্টে বাড়ী গিয়ে বিছানার আড় হলেন!
এদিকে বারোইয়ারিতলায় সং গড়া শেষ হয়েচে। একমাস মহাভারতের কথা হচ্ছিলো, কাল তাও শেষ হবে; কথক বেদীর উপর ব’সে বৃষোৎসর্গের ষাঁড়ের মত ও বলিদানের মহিষের মত মাথায় ফুলের মালা জড়িয়ে রসিকতার একশেষ কচ্চেন, মূল পুঁথির পানে চাওয়া মাত্র হচ্চে, বস্তুতঃ যা বলছেন, সকলি কাশীরাম খুড়োর উচ্ছিষ্ট ও কোনটা বা স্বপাক। কথকতা পেশাটা ভাল–দিব্য জলখাবার, দিব্য হাতপাখার বাতাস; কেবল মধ্যে মধ্যে কোন কোন স্থলে আহার বিহারের আনুষঙ্গিক প্রহারটা সইতে হয়, সেইটেই মহান কষ্ট। পূৰ্ব্বে গদাধর শিরোমণি, রামধন তর্কবাগীশ, হলধর, পঞ্চানন প্রভৃতি প্রধান প্রধান কথক ছিলেন; শ্রীধর অল্পবয়সে বিলক্ষণ খ্যাত হন। বর্তমান দলে শাস্ত্রজ্ঞানের অপেক্ষা করেন না, গলাটা সাধা; চাণক্যশ্লোকের দু-আখর পাঠ ও কীর্তন-অঙ্গের দু’টো পদাবলী মুখস্থ করেই, মজুর কত্তে বেরোল ও বেদীতে বসে ব্যাস বধ করেন! কথা শোবার ও সং দেখবার জন্যে লোকের অম্ভব ভিড় হয়েছে–কুমোর, ভাওয়াল ও অধ্যক্ষেরা থেলো হুঁকোয় তামাক খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্চেন ও মিছে মিছে চেঁচিয়ে গলা ভাঙচেন! বাজে লোকের মধ্যে দু-একজন, আপনার আপনার কর্তৃত্ব দেখাবার জন্য, “তফাৎ তফাৎ কচ্চে, অনেকে গোছালো-গোছের মেয়েমানুষ দেখে, সঙের তরজমা করে বোঝাচ্চেন! সংগুলি বর্ধমানের রাজার বাঙ্গালা; মহাভারতের মত; বুঝিয়ে না দিলে মৰ্ম্ম গ্রহণ করা ভার!
কোথাও ভীষ্ম শরশয্যায় পড়েচেল—অর্জ্জুন পাতালে বাণ মেরে ‘ভোগবতী’র জল তুলে খাওয়াচ্চেন। জ্ঞাতির পরাক্রম দেখে, দুর্য্যোধন ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে চেয়ে রয়েচেন। সঙদের মুখে ছাঁচ ও পোষাক সকলেরই এরকম, কেবল ভীষ্ম দুধের মত সাদা, অর্জ্জুন ডেমাটিনের মত কালো ও দুৰ্য্যোধন গ্রীণ।
কোথাও নবরত্নের সভা–বিক্রমাদিত্য বত্রিশ পুতুলের সিংহাসনের উপর আফিমের দালালের মত পোষাক পরে বসে আছেন। কালিদাস, ঘটকর্পর, ঝরাহমিহির প্রভৃতি নবরত্নেরা চারিদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন—রত্নদের সকলেরই একরকম ধুতি, চাদর ও টিকি; হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, যেন একদল অগ্রদানী ক্রিয়াবাড়ী চোকবার জন্য দরোওয়ানের উপাসনা কচ্চে।
কোথাও শ্ৰীমন্ত দক্ষিণ মশানে চৌত্রিশ অক্ষরে ভগবতার স্তব কচ্চেন, কোথাও কোটালেরা ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েচে–শ্ৰীমন্তের শাখার শালের শামলা, হাক ইংরাজী গোছের চাপকান ও পায়জামা পরা; ঠিক যেন একজন হাইকোর্টের প্লীডার প্লীড কচ্চেন! এক জায়গায় রাজসূয় যজ্ঞ হচ্ছে—দেশ দেশান্তরের রাজারা চারিদিকে ঘিরে বসেচেন—মধ্যে ট্যানা-পরা হোতা পোতা বামুনরা অগ্নিকুণ্ডের চারিদিকে বসে হোম কচ্চেন। রাজাদের পোষাক ও চেহারা দেখলে হঠাং বোধ হয়, যেন একদল দরোওয়ান স্যাকরার দোকানে পাহারা দিচ্চে।
কোনখানে রাম রাজা হয়েচেন;–বিভীষণ, জাম্বুবান, হনুমান ও সুগ্রীব প্রভৃতি বানরেরা, সহুরে মুচ্ছুদ্দি বাবুদের মত পোষাক পরে চারিদিকে দাঁড়িয়ে আছেন। লক্ষ্মণ ছাতা ধরেছেন—শত্রুঘ্ন ও ভরত চামর ব্যাঞ্জন কচ্চেন, রামের বাঁদিকে সীতা দেবী; সীতের ট্যার্চ্চা শাড়ী, ঝাঁপটা ও ফিরিঙ্গি খোঁপায় বেহদ্দ বাহার বেরিয়েছে।
“বাইরে কোঁচার পত্তন ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন” সং বড় চমৎকার—বাবুর ট্যাসেল দেওয়া টুপী, পাইনাপোলের চাপকান, পেটি ও সিল্কের রুমাল, গলায় চুলের গার্ডচেন; অথচ থাকবার ঘর নাই, মাসীর বাড়ী অন্ন লুটেন, ঠাকু্রবাড়ী শোন, আর সেনেদের বাড়ী বসবার আড্ডা। পেট ভরে জলখাবার পয়সা নাই, অথচ দেশের রিফরমেশনের জন্য রাত্রে ঘুম হয় না (মশারির অভাবও ঘুম না হবার একটি প্রধান কারণ)। পুলিস, বড় আদালত, টালার নীলেম, ছোট আদালতে দিনের ব্যালা ঘুরে বেড়ান; সন্ধ্যে-ব্যালা ব্রাহ্মসভায়, মিটিং ও ক্লাবে হাঁপ ছাড়েন, গোয়েন্দাগিরি, দালালী, খোসামুদী ও ঠিকে-রাইটরী করে যা পান, ট্যাসল-ওয়ালা টুপী ও পাইনাপোলের চাপকান রিপু কত্তে ও জুতো বুরুসে সব ফুরিয়ে যায়! সুতরাং মিনি মাইনের স্কুলমাষ্টারীও কখন কখন স্বীকার কত্তে হয়।
কোথাও “অসৈরণ সৈতে নারি শিকেয় বসে কুলে মরি” সং;—“অসৈরণ সইতে নারি” মহাশয়, ইয়ং বাঙ্গালীদের টেবিলে খাওয়া, পেণ্টুলেন ও (ভয়ানক গরমিতেও) বনাতের বিলিতী কোট-চাপকনি পরা, (বিলক্ষণ দেখতে পান অথচ) নাকে চসমা, রাত্তিরে থানায় পড়ে ছুঁচো ধরে থান, দিনের বেলা রিফরমেশনের স্পিচ করেন দেখে–শিকেয় ঝুলচেন।
এ সওয়ায় বারোইয়ারিতলায় “ভাল কত্তে পারবো না মন্দ করবো, কি দিবি তা দে,” “বুক ফেটে দরজা,” “ঘুটে পোড়ে গোবর হাসে,” “কাণা পুতের নাম পদ্মলোচন,” “মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়,” “হাড়-হাবাতে মিছরির ছুরি” প্রভৃতি নানাবিধ সং হয়েছে; সে সব আর এখানে উত্থাপন করার অবশ্যক নাই। কিন্তু প্রতিমের দু-পাশে “বকা ধার্ম্মিক” ও “ক্ষুদে নবাবের” সং বড় চমৎকার হয়েছে; বকা ধার্ম্মিকের শরীরটি মুচির কুকুরের মত নুদুর নাদুর–ভুঁড়িটি বিলাতী কুমড়োর মত–মাথা কামান চৈতন ফক্কা ঝুঁটি করে বাঁধা। গলায় মালা ও ঢাকের মত গুটিকতক সোণার মাদুলী—হাতে ইষ্টিকবচ–চুলে ও গোঁফে কলপ দেওয়া–কালাপেড়ে ধুতি, রামজামা ও জরির বাঁকাতাজ; গত বৎসর আশী পেরিয়েছেন–অঙ্গ ত্রিভঙ্গ! কিন্তু প্রাণ হামাগুড়ি দিচ্চে। গেরস্ত-গোচের ভদ্রলোকের মেয়েছেলের পানে আড়চক্ষে চাচ্ছেন—হরিনামের মালার ঝুলিটি ঘুরচ্চেন! ঝুলির ভিতর থেকে গুটিকতক টাকা বেমালূম আওয়াজে লোভ দেখাচ্চে!
ক্ষুদ্র নবাব,–ক্ষুদ্র নবাব দিব্যি দেখতে—দুধে আলতার মত রং–আলবার্ট ফেশানে চুল ফেরানো–চীনের শূয়ারের মত শরীরটি ঘাড়ে-গর্দ্দানে হাতে, লাল রুমাল ও পিচের ইষ্টিক–সিমলের ফিনফিনে ধুতি মালকোঁচা করে পরা–হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, রাজরাজড়ার পৌত্তর; কিছু পরিচয়ে বেরোবে “হৃদে জোলার নাতি!”
বারেইয়ারি প্রতিমাখানি প্রায় বিশ হাত উঁচু–ঘোড়ায় চড়া হাইল্যাণ্ডের গোরা, বিবি, পরী ও নানাবিধ চিড়িয়া, শোলার ফুল ও পদ্ম দিয়ে সাজানো; মধ্যে মা ভগবতী জগদ্ধাত্রী-মুৰ্ত্তি–সিঙ্গি গায় রূপুলি গিলটি ও হাতী সবুজ মকমল দিয়ে মোড়া। ঠাকুরুণের বিবিয়ানা মুখ, রং ও গড়ন আসল ইহুদী ও আরমানী কেতা, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও ইন্দ্র দাঁড়িয়ে যোড়হাত করে স্তব কচ্চেন। প্রতিমের উপরে ছোট ছোট বিলাতী পরীরা ভেপু বাজাচ্চে হাতে বাদশাই নিশেন ও মাঝে খোড়াসিঙ্গিওয়ালা কুইনের ইউনিফরম ও ফ্রেষ্ট!
আজ বাবোইয়ারির প্রথম পূজো, শনিবার—বীরকৃষ্ণ দাঁ, কানাই দত্ত প্যালানাথবাবু ও বীরকৃষ্ণবাবুর ফ্রেণ্ড আহিরীটোলার রাধামাধববাবুরো বেলা তিনটে পর্যন্ত বাবোইয়ারিতলায় হামরাও হয়েছিলেন;–তিনটে বড় বড় অর্ণা মোষ, একশ ভেড়া ও তিন-শ পাটা বলিদান করা হয়েছে; মুল নৈবিদ্যির আগা তোলা মোণ্ডাটি ওজনে দেড়মণ। সহরের রাজা, সিঙ্গি, ঘোষ, দে, মিত্র ও দত্ত প্রভৃতি বড় বড় দলস্থ ফোঁটা-চেলির জোড়, টিকি ও তিলকধারী উর্দ্দীপরা ও তকমাওয়ালা যত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বিদেয় হয়েছে;–‘সুপারীস’, ‘আনাহূতো’, ‘বেদলে’ ও ‘ফলারেরা’ নিমতলার শকুনির মত টেঁকে বসে আছেন। কাঙ্গালী, রেয়ো, অগ্রদানী, ভাট ও ফকির বিস্তর জমেছিল; পাহারওয়ালারাই তাদের বিদেয় দেন, অনেক গরীব গ্রেপ্তার হয়।
ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে এলো–বারোইয়ারিলা লোকারণ্য; সহরের অনেক বাবু গাড়ী চড়ে সং দেখতে এসেছেন—স’ এলে অনেকে তাঁদের দেখচে। ক্রমে মজলিসে দু-একটা ঝাড় জ্বেলে দেওয়া হলো। সঙদের মাথার উপর বেললণ্ঠন বাহার দিতে লাগলো। অধ্যক্ষবাবুরা একে একে জমায়েৎ হতে লাগলেন। নল-করা থেলো হুঁকো হাতে করে ও পান চিবুতে চিবুতে অনেকে চীৎকার ও ‘এটা কর ওটা কর’ ক’রে হুকুম দিচ্চেন। আজ ধোপাপাড়ার ও চকের দলের লড়াই হবে। দেড় মণ গাঁজা, দুই মণ চরস, বড় বড় সাত গামলা দুধ ও বারোখানি বেণের দোকান ঝেঁটিয়ে ছোট বড় মাঝারি এলাচ, কর্পূর দারুচিনি সংগ্রহ করা হয়েছে; মিঠেকড়া ভ্যালসা অম্বুরি ও ইরানি তামাকের গোবর্দ্ধন হয়েচে। এ সওয়ায় বিস্তর অন্তঃশিলে সরঞ্জামও প্রস্তুত আছে;আবশ্যক হলে দেখা দেবে।
সহরে ঢি ঢি হয়ে গেছে, আজ রাত্রে অমুক জায়গায় বারোইয়ারি পূজোর হাফ-আখড়াই হবে। কি ইয়ারগোচের স্কুল বয়, কি বাহাত্তুরে ‘ইনভেলিড’ সকলেই হাফ-আখড়াই শুনতে পাগল। বাজার গরম হয়ে উঠলো। ধোপারা বিলক্ষণ রোজগার কত্তে লাগলো। কোচান-ধুতি, ধোপদস্ত কামিজ ও ডুরে শান্তিপুরে উড়ুনীর এক রাত্রের ভাড়া আট আনা চড়ে উঠলো। চার পুরুষে পাঁচ পুরুষে ক্রেপ ও নেটের চাদরেরা, অকর্ম্মণ্য হয়ে নবাবী আমলে সিন্দুক আশ্রয় করেছিলেন, আজ ভলন্টিয়র হয়ে মাথায় উঠলেন। কালো ফিতের ঘুন্সি ও চাবির শিকলি, হঠাৎ বাবুর মত স্বস্থান পরিত্যাগ করে ঘড়ির চেনের অফিসিয়েটিং হলো–জুতোরা বেশ্যার মত নানা লোকের সেবা কত্তে লাগলো।
বারোইয়ারিতলায় লোকারণ্য হয়ে উঠলো, একদিকে কাঠগড়া ঘেরা মাটির সং–অন্যদিকে নানা রকম পোষাক-পরা কাঠগড়ার ধারে ও মধ্যে জ্যান্ত সং। বড়মানুষের ট্যাসলওয়ালা টুপী চাপকান, পেটি ও ইষ্টিকে চালচিত্রের অসুর হতেও বেয়াড়া দেখাচ্ছেন। প্রধান অধ্যক্ষ বীরকৃষ্ণবাবু লক্কাই লাট্টুর লাটিম মত ঘুরে বেড়াচ্চেন, দু’কস দিয়ে পাজির ছবির রক্তদন্তী রাক্ষসীর মত পানের পিক গড়িয়ে পড়ছে। চাকর, হরকরা, সরকার, কেরাণী ও ম্যানেজারদের নিশ্বেস এ্যালবার অবকাশ নাই।
ঢং ঢং ক’রে গির্জ্জের ঘড়ীতে রাত্রি দুটো বেজে গেল। ধোপাপাড়ার দল ভরপুর নেশায় ভোঁ হয়ে টলতে টলতে আসরে নাবলেন। অন্সেকে আখড়াঘরে (সাজঘরে শুয়ে পড়লেন। বাঙ্গালীর স্বভাবই এই, পরের জিনিস পাতে পড়লে শীগগির হাত বন্ধ হয় না; (পেট সেটি বোঝে না, বড় দুখের বিষয়!) দেড়ঘণ্টা ঢোল, বেহালা, ফুলোট, মোচাং ও সেতারের রং ও সাজ বাজলো, গোড়ার দু’শ বাহবা ও দু-হাজার বেশ দিলেন, শেষে একটি ঠাকরুণ বিষয় গেয়ে, (আমরা গানটি বুঝতে অনেক চেষ্টা কল্লেম, কিন্তু কোনমতে কৃতকার্য্য হতে পাল্লেম না) ধোপাপাড়ার দল উঠে গেল, চকের দল আসরে নাবলেন।
চকের দলেরাও ঐ রকম করে গেয়ে শোভান্তরী, সাবাস ও বাহবা নিয়ে উঠে গেলেন—একঘণ্টার জন্য মজলিস খালি রইলো; চায়নাকোট, ক্রেপের, নেটের ও ডুরে ফুলদার ট্যারচা চাদরো পিঁপড়ের ভাঙ্গা সারের মত ছড়িয়ে পড়লেন। পানের দোকান শূন্য হয়ে গেল। চুরোট তামাক ও চরসের ধুয়ায় এমনি অন্ধকার হয়ে উঠলো যে, সেবাবে “প্রোক্লেমেশনের” উপলক্ষে বাজিতে বা কি ধোঁ হয়েছিল। বড় বড় রিভিউয়ের তোপে তত ধোঁ জন্মে না। আধঘণ্টা প্রতিমেখানি দেখা যায় নি ও পরস্পর চিনে নিতেও কষ্ট বোধ হয়েছিল।
ক্রমে হঠাৎ-বাবুর টাকার মত, বসন্তের কুয়াসার মত ও শরতেব মেঘের মত, ধোঁ দেখতে দেখতে পরিষ্কার হয়ে গেল। দর্শকেরা স্থির হয়ে দাঁড়ালেন, ধোপাপুকুরের দল আসোর নিয়ে বিরহ ধোল্লেন। আধঘণ্টা বিরহ গেয়ে আসোর হতে দলবল সমেত আবার উঠে গেলেন। চকবাজারেরা নাবলেন ও ধোপাপুকুরের দলের বিরহের উতোর দিলেন। গোঁড়ারা রিভিউয়ের সোজারদের মত দুল বেঁধে দু’ থাক হলো। মধ্যস্থেরা গানের চোতা হাতে করে বিবেচনা কত্তে আরম্ভ করেন–একদলে মিত্তির খুঁড়ো, আর একদলে দাদাঠাকুর বাঁধন্দার।।
বিরহের পর চাপা কাঁচা খেউড়; তাতেই হার-জিতের বন্দোবস্ত, বিচারও শেষ; (মধুরেণ সমাপয়েৎ) মারামারিও বাকি থাকবে না।
ভোরের তোপ পড়ে গিয়েছে, পূর্ব্বদিক্ ফরসা হয়েচে, ফুরফুরে হাওয়া উঠেচে-ধোপাপুকুরের দলেরা আসোর নিয়ে খেউড় ধলেন, “সাবাস! ‘বাহবা!’ ‘শোভান্তরী।’ ‘জিতা রও!’ দিতে দিতে গোড়াদের গলা চিরে গেল; এই তামাসা দেখতে যেন সূর্য্যদেব তাড়াতাড়ি উদয় হলেন। বাঙ্গালীরা আজো এমন কুৎসিত আমোদে মত্ত হন ব’লেই যেন—চাঁদ ভদ্রসমাজে মুখ দেখাতে লজ্জিত হলেন। কুমুদিনী মাথা হেঁট কল্লেন! পাখীরা ছি ছি ক’রে চেঁচিয়ে উঠলো! পদ্মিনী পাঁকের মধ্যে থেকে হাসতে লাগলো! ধোপাপুকুরের দল আসের নিয়ে খেউড় গাইলেন; সুতরাং চকের দলকে তার উতোর দিতে হবে। ধোপাপুকুরওয়ালার দেড়ঘণ্টা প্রাণপণে চেঁচিয়ে খেউড়টি গেয়ে থামলে, চকের দলেরা নাবলেন; সাজ বাজতে লাগলো। ওদিকে আখড়াঘরে খেউডের উতোর প্রস্তুত হতে লাগলো;–চকের দলেরা তেজের সহিত উতোর গাইলেন। গোঁড়ারা গবুম হয়ে “আমাদের জিত, আমাদের জিত।” করে চেঁচাচেঁচি কত্তে লাগলেন; (হাতাহাতি ও বাকি রইলো না) এদিকে মধ্যস্থেরাও চকের দলের জিত সাব্যস্ত কল্লেন। দুও! হো! হো! হুর্রে ও হাততালিতে ধোপাপুকুরের দলেরা মাটির চেয়ে অধম হয়ে গেলেন—নেশার খোয়ারি-রাত জাগবার ক্লেশ ও হারের লজ্জায় মুখুয্যেদের ছোটবাবু ও দু-চার ধরুতা দোহার একেবারে এলিয়ে পড়লেন।
চকের দলের ঢোল বেঁধে নিশেন তুলে, গাইতে গাইতে ঘরে চল্লেন-কারু কারু শুধু পা মোজা পায়; জুতো কোথায়, তার খোজ নাই। ওগোড়রা আমোদ কত্তে কত্তে পেছু পেছু চল্লেন-বেলা দশটা বেজে গেল; দর্শকরা হাফ-আখড়াইয়ের মজা ত্বপূর লুটে বাড়ীতে এসে সুত, ঠাণ্ডাই, জোলাপ ও ডাক্তারের যোগাড় দেখতে লাগলেন। ভাড়া করা ও চেয়ে নেওয়া চায়নাকোট, ধুতি, চাদর, জামা ও জুতোর কাজ সেরে, আপনার আপনার মনিববাড়ী ফিরে গেল।
আজ রবিবার। বারোইয়াবিতলায় পাঁচালী ও যাত্রা। রাত্রি দশটার পর অধ্যক্ষেরা এসে জমলেন; এখনো অনেকের ‘চোঁয়া ঢেকুর’ ‘মাথা-ধরা’, ‘গা মাটি মাটি’ সারে নি। পাঁচালী আরম্ভ হয়েচে-প্রথম দল গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী, দ্বিতীয় দল মহীরাবণের পালা ধরেচেন, পাঁচালী ছোট কেতার হাফ-আখড়াই, কেবল ছড়া কাটানো বেশীর ভাগ; সুতরাং রাত্রি একটার মধ্যে পাঁচালী শেষ হয়ে গেল।
যাত্রা। যাত্রার অধিকারীর বয়স ৭৬ বৎসর, বাবরিকাটা চুল, কপালে উল্কী, কাণে মাকড়ি! অধিকারী দূতী সেজে, গুটিবারো বুড়ো বুড়ো ছেলেকে সখী সাজিয়ে আসোরে নাবলেন। প্রথমে কৃষ্ণ খোলের সঙ্গে নাচলেন, তারপর বাসুদেব ও মণিগোঁসাই গান করে গেলেন। সকেষ্ট সখী ও দূতী প্রাণপণে ভোর পর্যন্ত ‘কালো জল খাবো না!’ ‘কালো মেঘ দেখবো না!’ (জামিয়ানা খাটিয়ে দিমু) কালো কাপড় পরবো না!’ ইত্যাদি কথাবার্ত্তায় ও নবীন বিদেশিনীর। গানে লোকেন্দ্র মনোরঞ্জন কল্লেন! থাল, গাড়ু, বড়, ছেঁড়া কাপড়, পুরাণ ___ ও পচা শালের গাদী হয়ে গেল। টাকা, আধুলী, সিকি ও পয়সা পর্যন্ত প্যালা পেলেন! মধ্যে মধ্যে ‘বাবা দে আমার বিয়ে’ ও ‘আমার নাম সুন্দরে জেলে, ধরি মাছ, বাউতি জালে,’ প্রভৃতি রকমওয়ারি সঙের রকমওয়ারি গানেরও অভাব ছিল না। বেলা আটটার সময় যাত্রা ভাঙলো, একজন বাবু, মাতাল, পাত্র টেনে বিলক্ষণ পেকে যাত্রা শুনছিলেন, যাত্রা ভেঙে যাওয়াতে গলায় কাপড় দিয়ে প্রতিমে প্রণাম কত্তে গেলেন, (প্রতিমে হিন্দুশাস্ত্রসম্মত জগদ্ধাত্রী-মূর্ত্তি)। কিন্তু প্রতিমার সিঙ্গি হাতীকে কামড়াচ্ছে দেখে, বাবু মহাত্মার বড় রাগ হলো, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাবু করুণার সুরে–
তারিণী গো মা কেন হাতীর উপর এত আড়ি।
মানুষ মেলে টেটা পেতে তোমায় বেতে হতো হরিণবাড়ী।।
সুর্কি কুটে সারা হতো, তোমার মুকুট যেত গড়াগড়ি।।
পুলিসের বিচারে শেষে সঁপতো তোমায় গ্ৰানযুড়ি।
সিঙ্গি মামা টেরটা পেতেন ছুটতে হতে উকীলবাড়ী।।
গান গেয়ে, প্রণাম করে চলে গেলেন।
সহরের ইতর মাতালদের (মাতালদের বড় ইতর-বিশেষ নাই, মাতাল হলে কি রাজা বাহাদুর, কি পালার বাপ, কি গোবরা প্রায় এক মূর্ত্তিই ধরে থাকেন। ঘরে ধরে রাখার লোক নাই বলেই আমরা নর্দমায়, রাস্তায়, খানায়, গারদে ও মদের দোকানে মাতলামি কত্তে দেখতে পাই। সহরে বড়মানুষ মাতালও কম নাই, শুদ্ধ ঘরে ধরে পুরে রাখবার লোক আছে বলেই তারা বেরিয়ে এখন মাতলামি কত্তে পান না। এদের মধ্যে অনেকে এমন মাতলামি করে থাকেন যে, অন্তরীক্ষ থেকে দেখলে পেটের ভিতর হাত-পা সেঁধিয়ে যায় ও বাঙ্গালী বড়মানুষদের উপর বিজাতীয় ঘৃণা উপস্থিত হয়। ছোটলোক মাতালের ভাগ্যে–চারি আনা জরিমানা–এক রাত্রি গারদে থাকা বা পাহারাওয়ালাদের ঝোলায় শোয়ার হয়ে যাওয়া ও জমাদারের দুই-এক কোঁৎকামাত্র। কিন্তু বাঙ্গালী বড়মানুষ মাতালদের সকল বিষয়ে শ্রেষ্ঠতা। পাখী হয়ে উড়তে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মরা–বাবার প্রতিষ্ঠিত পুকুরে ডোবা, প্রতিমের নকল সিঙ্গি ভেঙ্গে ফেলে আসল সিঙ্গি হয়ে বসা, ঢাকীকে মার সঙ্গে বিসর্জ্জন দেওয়া, ক্যাণ্টনমেণ্ট, ফোর্ট, রেলওয়ে ষ্টেসন ও অবশেষে মদ খেয়ে মাতলামি করে চালান হওয়া, এ সব ত আছে। এ সওয়ায়, করুণা গান, বকসিস ও বক্তৃতার বেহদ্দ ব্যাপার।
একবার সহরের শ্যামবাজার অঞ্চলের এক বনেদী বড়মানুষের বাড়ীতে বিদ্যসুন্দর যাত্রা হচ্চে। বাড়ীর মেজোবাবু পাঁচো ইয়ার নিয়ে শুনতে বসেচেন; সামনে মালিনী ও বিদ্যে “মদন আগুন জ্বলছে দ্বিগুণ, কল্লে কি গুণ ঐ বিদেশী” গান করে মুঠো মুঠো প্যালা পাচ্ছে-বছর ষোল বয়সের দু’টো (ষ্টেডব্রেড) ছোকরা সখী সেজে ঘুরে ঘুরে খেমটা নাচ্চে। মজলিলে রূপের গেলাসে ব্রাণ্ডি চলচে-বাড়ীর টিকটিকি ও শালগ্রাম ঠাকুর পর্যন্ত নেশীয় চুরচুরে ও ভোঁ! যাত্রায় কমে মিলনের মন্ত্রণা, বিদ্যার গর্ভ, রাণীর তিরস্কার, চোর ধরা ও মালিনী যন্ত্রণার পালা এসে পড়লে; কোটাল মালিনীকে বেঁধে মাতে আরম্ভ কল্লে। মালিনী বাবুদের দোহাই দিয়ে কেঁদে বাড়ী সরগরম করে তুল্লে। বাবুর চমক ভেঙ্গে গেল; দেখলেন, কোটাল মালিনীকে মাচ্চে, মালিনী বাবুর দোহাই দিচ্চে; অথচ পার পাচ্ছে না। এতে বাবু বড় রাগত হলেন, “কোন্ বেটার সাধ্যি মালিনীকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যায়,” এই বলে সামনের রূপের গেলাসটি কোটালের রগ তেগে ছুড়ে মাল্লেল; গেলাসটি কোটালের রগে লাগবামাত্র কোটাল ‘বাপ!’ বলে, অমনি ঘুরে পড়লো চারিদিক থেকে লোকেরা হাঁ হাঁ করে এসে কোটালকে ধরাধরি করে নিয়ে গেল। মুখে জলের ছিটে মারা হলো ও অন্য অন্য নানা তদ্বির হলো : কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না—কোটালের-পো এক ঘাতেই পঞ্চত্ব পেলেন।
আর একবার ঠনঠনের ‘র’ ঘোষজাবাবুর বাড়ীতে বিদ্যাসুন্দর যাত্রা হচ্ছিল, বাবু মদ খেয়ে পেকে মজলিসে আড় হয়ে শুয়ে নাক ডাকিয়ে যাত্রা শুনছিলেন। সমস্ত বাত বেহু সেই কেটে গেল, শেষে ভোর ভোর সময়ে দক্ষিণ-মশানে কোটালের হাঙ্গামাতে বাবুর নিদ্রাভঙ্গ হলো; কিন্তু আসোরে কেষ্টোকে না দেখে বাবু বিরক্ত হয়ে “কেষ্ট ল্যাও, কেষ্ট ল্যাও’ বলে ক্ষেপে উঠলেন। অন্য অন্য লোকে অনেক বুঝালেন যে, “ধৰ্ম্ম অবতার। বিদ্যাসুন্দর যাত্রায় কেষ্ট নাই;” কিন্তু বাবু কিছুতেই বুঝলেন না; (কৃষ্ণ তাঁরে–নিতান্ত নির্দয় হয়ে দেখা দিলেন না বিবেচনায়) শেষে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলেন।
আর একবার এক গোস্বামী এক মাতাল বাবুর কাছে বড় নাকাল হয়েছিলেন; সেকথাও না বলে থাকা গেল না। পূর্ব্বে এই সহরে বেনেটোলায় দীপচাঁদ গোস্বামীর অনেকগুলি বড়মানুষ শিষ্য ছিল। বারসিমলের বোসবাবুর প্রভুর প্রধান শিষ্য ছিলেন। একদিন আমতার রামহরিবাবু বোসজাবাবুরে এক পত্র লিখলেন যে, “ভেক নিতে আমার বড় ইচ্ছ, কিন্তু গুটিকতক প্রশ্ন আছে; সেগুলির যতদিন পূরণ না হচ্ছে ততদিন শাক্তই থাকবো।” বোসজী মহাশয় পরম বৈষ্ণব; রামহরিবাবুর পত্র পেয়ে বড় খুসী হলেন ও বৈষ্ণব-ধর্মের উপদেশ ও প্রশ্ন পূরণ করবার জন্যে প্রভু নদেরচাঁদ গোস্বামী মহাশয়কে তার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
রামহরিবাবুর সোণাগাছিতে বাস। দু-চার ইয়ার ও গাইয়ে বাজিয়ে কাছে থাকে; সন্ধ্যার পর বেড়াতে বেরোন—সকালে বাড়ী আসেন, মদও বিলক্ষণ চলে; দু-চারটা নিমখাসাগোচের দাঙ্গার দরুশ, পূলিসেও দুএক মোচলেকা হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যার পর সোণাগাছির বড় জাঁক; প্রতি ঘরে ধূনোয় ধোঁ, শাঁকের শব্দ ও গঙ্গাজলের ছড়ার দরুণ হিন্দুধৰ্ম্ম মর্ত্তিমন্ত হয়ে সোণাগাছি পবিত্র করেন। নদেরচাঁদ গোস্বামী, বোসবাবুর পত্র নিয়ে সন্ধ্যার পর সোণাগাছি ঢুকলেন। গোস্বামীর শরীরটি প্রকাণ্ড, মাথা নেড়া, মধ্যে তরমুজের বোঁটার মত চৈতনফক্কা সর্বাঙ্গে হরিনামের ছাপা, নাকে তিলক ও অদৃষ্টে (কপালে) একধাবড়া চন্দন। হঠাৎ বোধ হয় যেন কাগে হেগে দিয়েছে। গোস্বামীর কলকেতায় জন্ম, কিন্তু কখন সোণাগাছিতে ঢোকেন নাই (শহরের অনেক বেশ্যা সিমলের মা-গোঁসাইয়ের জুরিসডিক্সনের ভেতর)। গোস্বামী অনেক কষ্টে রামহরিবাবুর বাসায় উপস্থিত হলেন।
রামহরিবাবু কুঠী থেকে এসে পাত্র টেনে গোলাপী রকম নেশায় তর হয়ে বসেছিলেন। এক মোসাহেব বায়ার সঙ্গতে ‘অব হজরত যাতে লণ্ডনকো’ গাচ্ছেন, আর একজন মাথায় চাদর দিয়ে বাঈয়ানা নাচের উজ্জ্বগ কচ্ছেন; এমন সময় বোসবাবুর পত্র নিয়ে গোস্বামী মশাই উপস্থিত হলেন। অমন আমদের সময়ে একটা ব্রকোদ (বৃকোদর) গোঁসাইকে দেখলে, কার না রাগ হয়? মজলিসের সকলেই মনে মনে বড় ব্যাজার হয়ে উঠলেন; বোসজার অনুরোধেই কেবল গোস্বামী সে যাত্রা প্রহার হতে পরিত্রাণ পান।
রামহরিবাবু বোসজার পত্র পড়ে গোস্বামী মহাশয়কে আদর করে বসালেন। রামা, বামুনের হুঁকোটি জল ফিরিয়ে তামাক দিলে। (হুঁকোটি বাস্তবিক খাঁ সাহেবের) মোসাহেবদের সঙ্গে তার চোখ টেপাটিপি হয়ে গেল। একজন মোসাহের দৌড়ে কাছে দরজীর দোকান থেকে হয়ে এলেন। এদিকে গাওনা ও ইয়ারকি কিছু সময়ের জন্য পোষ্টপন হলো—শাস্ত্রীয় তর্ক হবার উজ্জুগ হতে লাগলো। গোস্বামী মহাশয় তামাক খেয়ে হুঁকো রেখে নানাপ্রকার শিষ্টাচার কল্লেন; রামহরিবাবুও তাতে বিলক্ষণ ভদ্রতা কল্লেন।
রামহরিবাবু গোস্বামীকে বলেন, “প্রভু! বষ্টমতন্ত্রের কটি বিষয়ে আমার বড় সন্দেহ আছে। আপনাকে মীমাংসা করে দিতে হবে। প্রথম কেষ্টর সঙ্গে রাধিকার মামী সম্পর্ক, তবে কেমন করে কেষ্ট বাধাকে গ্রহণ কল্লেন?”
দ্বিতীয়, “একজন মানুষ (ভাল দেবতাই হলো) যে, ষোলশত স্ত্রীর মনোরথ পূর্ণ করেন, এ কি কথা?”
তৃতীয়, “শুনেছি, কেষ্ট দোলের সময়ে মেড়া পুড়িয়ে খেয়েছিলেন। তবে আমাদের মটনচপ খেতে দোষ কি? আর বষ্টমদের মদ খেতেও বিধি আছে, দেখুন, বলরাম দিনরাত মদ খেতেন, কেষ্টও বিলক্ষণ মাতাল ছিলেন।” প্রশ্ন শুনেই গোস্বামীর পিলে চমকে গেল, তিনি পালাবার পথ দেখতে লাগলেন। এদিকে বাবুর দলের মুচকি হাসি; ইসরা ও রূপোর গেলাসে দাওয়াই চলতে লাগল। গোস্বামী মনের মত উত্তর দিতে পারলেন না বলে, একজন মোসাহেব বলে উঠলো, “হুজুর! কালীই বড়; দেখুন–কালীতে ও কেষ্টতে ‘ক’ পুরুষের অন্তর, কালীর ছেলে যে কার্ত্তিক, তার বাহন ময়ূরের যে ল্যাজ কেষ্টোর মাথার উপর; সুতরাং কালাই বড়।” এ কথায় হাসির তুফান উঠলো, গোস্বামী নিজ স্বভাবগুণে গোঁয়ারতিমোয় গরম হয়ে, পিট্টানের পথ দেখবেন কি, এমন সময় একজন মোসাহেব গোস্বামীর গায়ে টলে পড়ে, তার তিলক ও টিপ জিভ দিয়ে চেটে ফেলে; আর একজন ‘কি কর। কি কর।’ ব’লে টিকিটি কেটে নিলেন। গোস্বামী ক্রমে শ্রাদ্ধ গড়ায় দেখে জুতো ও হরিনামের থলি ফেলে, চোচাদৌড়ে রাস্তায় এসে হাঁপ ছাড়লেন! রামহরিবাবু ও মোসাহেবদের খুসীর সীমা রইলো না। অনেক বড়মানুষ এই রকম আমোদ বড় ভালবাসেন ও অনেক স্থানে প্রায়ই এইরূপ ঘটনা হয়।
কলকেতা সহরে প্রতিদিন নতুন নতুন মাতলামি দেখা যায়; সকলগুলি সৃষ্টিছাড়া ও অদ্ভুত! ঠকবাগানে ধনুকর্ণ মিত্তিরবাবুর বাপ, ন্যাট ড্রাইব মনকিসন কোম্পানীর বাড়ীর মুছুদ্দি ছিলেন, এ সওয়ায় চোটা ও কোম্পানীর কাগজেরও ব্যবসা কত্তেন। ধনুবাবু কালেজে পড়ে, একজামিন পাস করেছেন, লেকচার শোনেন ও মধ্যে মধ্যে ইংরজি কাগজে আর্টিকেল লেখেন। সহরে বাঙ্গালী বড়মানুষের ছেলেদের মধ্যে প্রায় অনেকে বিবেচনায গাধার বেহদ্দ; বুদ্ধিটা এমন সূক্ষ্ম যে, নেই বল্লেও বলা যায়; লেখাপড়া শিখতে আদবে ইচ্ছা নাই, প্রাণ কেবল ইয়ারকির দিকে দৌড়ায়, স্কুল যাওয়া কেবল বাপ-মার ভয়ে অষুদগেলা গোছ! সুতরাং একজামিন্ পাস করবার পূর্ব্বে ধনুকর্ণবাবু চার ছেলের বাপ হয়েছিলেন ও তাঁর প্রথম মেয়েটির বিবাহ পর্যন্ত হয়েছিলো। ধনুকর্ণবাবুর দু-চার স্কুলফ্রেণ্ডও সৰ্ব্বদা আসতেন যেতেন; কখন কখন লুকিয়ে-চুরিয়ে–চরসটা, মজমের বরফ খান, সিদ্ধিটে আসটাও চলতো; ইচ্ছেখানা, এক আদ্দিন শেরিটে, শ্যামপিটারও আস্বাদ নেওয়া হয়। কিন্তু কৰ্ত্তা স্বকলমে রোজগার করে বড়মানুষ হয়েছেন, সুতরাং সকল দিকে চোখ রাখেন ও ছেলেদের উপরেও সৰ্ব্বদা তাই করে থাকেন; সেই দব দবাতেই ইচ্ছেখানায় ব্যাঘাত পড়েছিল।
সমরভেকেশনে কলেজ বন্ধ হয়েছে, স্কুল-মাষ্টারেরা লোকের বাগানে বাগানে মাছ ধরে বেড়াচ্ছেন। পণ্ডিতেরা দেশে গিয়ে লাঙ্গল ধরে চাষবাস আরম্ভ করেচেন; (ইংরেজী ইস্কুলের পণ্ডিত প্রায় ঐ গেছেরি দেখা যায়) ধনুবাবু সন্ধ্যার পর দুই-চার স্কুল-ফ্লেণ্ড নিয়ে পড়বার ঘরে বসে আছেন। এমন সময়ে কলেজের প্যারীবাবু চাদরের ভিতর এক বোতল ব্রাণ্ডি ও একটা শেরি নিয়ে, অতি সন্তর্পণ ঘরের ভিতর ঢুকলেন। প্যারীবাবু ঘরে ঢোকবামাত্রই চারদিকের দোর-জানলা বন্ধ হয়ে গেল; প্রথমে বোতলটি অতি সাবধানে খুলে (বেড়ালে চুরি করে দুধ খাবার মত করে) অত্যন্ত সাবধানে চলতে লাগলো ক্রমে ব্রাণ্ডি অন্তর্ধান হলেন। এদিকে বাবুদের মেজাজও গরম হয়ে উঠলো; দেরি-জানালা খুলে দেওয়া হলো, চেঁচিয়ে হাসি ও গররা চলতে লাগলো। শেষে শেরীও সমীপস্থ হলেন, সুতরাং ইংরেজী ইস্পিচ ও টেবিল চাপড়ানো চল্লো; ভয় লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল। এ দিকে ধনুবাবুর বাপ চণ্ডীমণ্ডপে বসে মালা ফিরুচ্ছিলেন; ছেলেদের ঘরের দিকে হঠাৎ চীৎকার ও রৈ রৈ শব্দ শুনে গিয়ে দেখলেন, বাবু্রা মদ খেয়ে মত্ত হয়ে চীৎকার ও হৈ-হৈ কচ্চেন, সুতরাং বড়ই ব্যাজার হয়ে উঠলেন ও ধনুবাবুকে যাচ্চেতাই বলে গালমন্দ দিতে লাগলেন। কর্ত্তার গালাগালে একজন ফ্রেণ্ড বড়ই চটে উঠলেন ও ধনুও তার সঙ্গে তেড়ে গিয়ে একটা ঘুষো মাল্লেন! কৰ্ত্তার বয়স অধিক হয়েছিল, বিশেষতঃ ঘুষোটি ইয়ং বেঙ্গালি (বাঁদরের বাড়া); ঘুষি খেয়ে কর্ত্তা একেবারে ঘুরে পড়লেন, বাড়ীর অন্য অন্ত পরিবারের হাঁ হাঁ! করে এসে পড়লো। গিন্নী বাড়ীর ভেতর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলেন ও বাবুকে যথোচিত তিরস্কার কত্তে লাগলেন। তিরস্কার, কান্না ও গোলযোগের অবকাশে ফ্রেণ্ডরা পুলিশের ভয়ে সকলেই চম্পট দিলেন। এদিকে বাবুর করুণা উপস্থিত হলে মার কাছে গিয়ে বলেন, “মা, বিদ্দেসাগর বেঁচে থাক, তোমার ভয় কি? ও ওল্ডফুল মরে যাক না কেন, ওকে আমরা চাই নে; এবারে মা এমন বাবা এনে দেবো যে, তুমি, নূতন বাবা ও আমি একত্রে তিনজনে বসে হেলথ ড্রিঙ্ক করবো, ওল্ডফুল মরে যাক, আমি কোয়াইট রিফরমড বাবা চাই।”
রামকালী মুখোপাধ্যায় বাবু সুপ্রিমকোর্টের মিসুয়ার্স, থিক রোগ এণ্ড পিকপকেট উকিল সাহেবদের আফিসে খাতাঞ্জী। অফিসের ফেরত রাধাবাজার হয়ে অসচেন ও দু’ধারি দোকান ফাঁক যাচ্ছে না। পাগড়ীটে এলিয়ে পড়েছে, ধুতি খুলে হুতুলি পুতুলি পাকিয়ে গেছে, পাও বিলক্ষণ টলচে, ক্রমে ঘোড়াসাঁকোর হাড়িহাটায় এসে একেবারে এড়িয়ে পড়লেন, পা যেন খোটা হয়ে গেড়ে গেল, শেষে বিলক্ষণ হবুচবু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠাকুরবাবুদের বাড়ীর একজন চাকর সেই সময়ে মদ খেয়ে টলতে টলতে যাচ্ছিল। রামবাবু তাকে দেখে “আরে ব্যাটা মাতাল” বলে টলে সরে দাঁড়ালেন। চাকর মাতাল থেমে জিজ্ঞাসা কলে, “তুই শালা কে, আমায় মাতাল বল্লি?” রামবাবু বল্লেন, “আমি রাম।” চাকর বল্লে, “আমি তবে রাবণ।“ রামবাবু “তবে যুদ্ধং দেহি” বলে যেমন তারে মাত্তে যাবেন, অমনি নেশার ঝোঁকে ধুপুস করে ধরে গেলেন। চাকর মাতাল তার বুকের উপর চড়ে বসলো। থানার সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট সাহেব সেই সময় থানায় ফিরে যাচ্ছিলেন, চাকর মাতাল কিছু টিকে ছিল, পুলিসের সার্জ্জন দেখে রামবাবুকে ছেড়ে দিয়ে পালাবার উদ্যোগ কল্লে। রামবাবুও সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকে দেখেছিলেন, এখন বাবণকে পালাতে দেখে, ঘৃণা প্রকাশ করে বল্লেন, “ছি বাবা! এখন রামের হনুমানকে দেখে ভয়ে পালালে? ছি!”
রবিবারটা দেখতে দেখতে গেল, আজ সোমবার। শেষ পূজোর আমোদ, চোহেল ও ফররর শেষ, আজ বাঈ, খেমটা, কবি ও কেত্তন।।
বাঈনাচের মজলিস চূড়ান্ত সাজানো হয়েছে, গোপাল মল্লিকের ছেলের ও রাজা বেজেন্দরের কুকুরের বিয়ের মজলিস এর কাছে কোথায় লাগে! চকবাজারের প্যালানাথবাবু বাঈ-মহলের ডাইরেক্টর, সুতরাং বাঈ ও খেমটা নাচের সমুদায় ভার তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল। সহরের নন্নী, নুন্না, মুন্নী, খন্নী ও টন্নী প্রভৃতি ডিগ্রী মেডেল ও সার্টিফিকেটওয়ালা বড় বড় বাজার ও গোপাল, শাম, বিধু, থুতু, মণি ও চুণি প্রভৃতি খেমটাওয়ালীরা, নিজ নিজ তোবড়া-তুবড়ি সঙ্গে করে আসতে লাগলেন। প্যালানাথবাবু সকলকে মা-গোঁসাইয়ের মত সমাদরে রিসিভ কচ্চেন, তাঁদেরও গরবে মাটিতে পা পড়ছে না।
প্যালানাথবাবুর হীরের ওয়াচগাৰ্ডে ঝোলানো আধুলির মত মেকাবী হন্টিঙের কাঁটা ন’টা পেরিয়েছে। মজলিসে বাতির আলো শরতের জ্যোৎস্নাকেও ঠাট্টা কোচ্চে, সারঙ্গের কোঁয়া কোঁয়া ও তবলার মন্দিরের রুণু ঝুনু তালে, “আরে সাঁইয়া মোরারে তেরি মেরা জানিরে” গানের সঙ্গে এক তরফা মজলিস রেখেছে। ছোট ছোট ট্যসল হামামা ও তাজিরা এ কোণ থেকে ও কোণ, ও চৌকি থেকে ও চৌকি করে বেড়াচ্চেন, (অধ্যক্ষদের ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলে ও মেয়েরা) এমন সময়ে একখানা চেটে গুড় গুড় করে বারোইয়ারিতলায় ‘গড সেভ দি কুইন’ লেখা গেটের কাছে থামলো। প্যালানাথবাবু দৌড়ে গেলেন; গাড়ী থেকে জরি ও কিংখাপে মোড়া জড়ির জুতো শুদ্ধ একটা দশমুণী তেলের কূপো এ এক কুটে মোসাহেব নাবলেন; কুপোর গলায় শিকলের মত মোটা চেন, অঙ্গুলে আঠারটা করে ছত্রিশটা আংটী।
প্যালানাথবাবুর একজন মোসাহেব বড়বাজারের পচ্চুবাবু তূলোর ও পিসগুডসের দালাল, বিস্তর টাকা! “বেশ লোক” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন; পচ্চুবাবু মজলিসে ঢুকে মজলিসের বড় প্রশংসা কলে, প্যালানাথবাবুকে ধন্যবাদ দিলেন, উভয়ে কোলা কলি হলো; শেষ পচ্চুবাবু প্রতিমা ও মাথালো মাথালো সঙেদের (যথা—কেষ্ট, বলরাম, হনুমান্ প্রভৃতি) ভক্তিভরে প্রণাম কল্লেন; আর বাঈজীকে সেলাম করে দু’খানি আমেরিকান চৌকি জুড়ে বসলেন। দু’টি হাত, এককুড়ি পানের দোনা, চাবির থোলো ও রুমালের জন্য আপাততঃ কিছুক্ষণের জন্য আর দুখানি চৌকি ইজারা নেওয়া হলো : কুটে মোসাহেব পচ্চুবাবুর পেছন দিকে বলেন, সুতরাং তারে আর কে দেখতে পায়? বড়মানুষের কাছে থাকলে লোকে যে ‘পর্বতের আড়ালে আছ’ বলে থাকে, তাঁর ভাগ্যে ভাই ঠিক ঘটলো।
পচ্চুবাবুর চেহারা দেখে বাঈ অড়ে আড়ে হাসচে, প্যালানাথবাবু আতোর, পান, গোলাব ও তোররা দিয়ে খাতির কচ্চেন, এমন সময় গেটের দিকে গোল উঠলো—প্যালানাথবাবুর মোসাহেব হীরেলাল রাজা অঞ্জনারঞ্জন দেববাহাদুরকে নিয়ে মজলিসে এলেন।
রাজা বাহাদুরের গিল্টিকরা পালা ভরা আশা সকলের নজর পড়ে এমন জায়গায় দাঁড়ালো! অঞ্জনারঞ্জন দেববাহাদুর গৌরবর্ণ, দোহারা–মাথায় খিড়কীদার পাগড়ী—জোড়া পরা–পায়ে জরির লপেটা জুতো, বদমাইসের বাদসা ও ন্যাকার সদ্দার। বাঈ রাজা দেখে কাচবাগে সরে এসে নাচতে লাগলো, “পুজোর সময় পরবস্তি হই যেন” বই তবজী ও শারাঙ্গের। বড় রকমের সেলাম বলে, বাজে লোকেরা সং ও বাঈ ফেলে কোন অপরূপ জানোয়ারদের মত রাজা বাহাদুরকে এক বৃষ্টি দেখতে লাগলেন।
ক্রমে রাত্তিরের সঙ্গে লোকের ভিড় বাড়তে লাগলো, সহরের অনেক বড়মানুষ রকম রকম পোষাক পরে একত্র হলেন, নাচের মজলিস রন্ রন্ কত্তে লাগলো; বীরকৃষ্ণ দাঁর আনন্দের সীমা নাই, নাচের মজলিসের কেতা ও শোভা দেখে আপনা আপনি কৃতার্থ হলেন, তাঁর বাপের শ্রাদ্ধতে বামুন খাইয়েও এমন সন্তুষ্ট হতে পারেন না।
ক্রমে আকাশের তারার মত মাথালো মাথালো বড়মানুষ মজলিস থেকে খসলেন, বুড়োরা সরে গ্যালেন, ইয়ার-গোচের ফচকে বাবুরা ভাল হয়ে বসলেন, বাঈরা বিদেয় হলো—খ্যামটা আসরে নাবলেন।
খ্যামটা বড় চমৎকার নাচ! সহরের বড়মানুষ বাবুরা প্রায় ফি রবিবারে বাগানে দেখে থাকেন। অনেকে ছেলেপুলে, ভাগ্নে ও জামাই নিয়ে একত্রে বসে— খ্যামটার অনুপম রসাস্বাদনে রত হন। কোন কোন বাবুরা স্ত্রীলোকদের উলঙ্গ করে খ্যামটা নাচান—কোনখানে কিস না দিলে প্যালা পায় না–কোথাও বলবার যো নয়!
বারোইয়ারিতলায় খ্যামটা আরম্ভ হলো, যাত্রার যশোদার মত চেহারা দু’জন খ্যামটাওয়ালি ঘুরে কোমর নেড়ে নাচতে লাগলো, খ্যামটাওয়ালারা পেছন থেকে “ফণির মাথার মণি চুরি কল্লি, বুঝি বিদেশে বিঘোরে পরাণ হারালি” গাচ্চে; খ্যামটাওয়ালির ক্রমে নিমন্তুন্নেদের সকলের মুখের কাছে এগিয়ে অগ্গরদানি ভিকিরির মত প্যালা আদায় করে তবে ছাড়লেন! রাত্তির দু’টোর মধ্যেই খ্যামটা বন্ধ হলো—খ্যামটাওয়ালির অধ্যক্ষ হলে যাওয়া-আসা কত্তে লাগলেন, বারোইয়ারিতলা পবিত্র হয়ে গ্যালো।
কবি। রাজা নবকৃষ্ণ কবির বড় পেট্রন ছিলেন। ইংলণ্ডের কুইন এলিজেবেথের আমলে যেমন বড় বড় কবি ও গ্রন্থকর্ত্তা জন্মান, তেমনি তার আমলেও সেই রকম রাম বসু, হরু, নিলু, রামপ্রসাদ ঠাকুর ও জগা প্রভৃতি বড় বড় কবিওয়ালা জন্মায়। তিনি কবি গাওনার মান বাড়ান, তার অনুরোধে ও দেখাদেখি অনেক বড় মানুষ কবিতে মাতলেন! বাগবাজারের পক্ষীর দল এই সময় জন্ম গ্রহণ করে। শিবচন্দ্র ঠাকুর (পক্ষীর দলের সৃষ্টিকর্ত্তা) নবকৃষ্ণর একজন ইয়ার ছিলেন। শিবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বাগবাজারের রিফরমেশনে রামমোহন রায়ের সমতুল্য লোক—তিনি বাগবাজারেদের উড়তে শেখান। সুতরাং কিছুদিন বাগবাজারেরা সহরের টেক্কা হয়ে পড়েন। তাদের একখানি পবলিক আটচালা ছিলো, সেইখানে এসে পাকি হতেন, বুলি ঝাড়তেন ও উড়তেন—এ সওয়ার বোসপাড়ার ভেতরেও দু’চার গাঁজার আড্ডা ছিল। এখন আর পক্ষীর দল নাই, গুখুরি ও ঝক্মারির দলও অন্তর্ধান হয়ে গেছে, পাকিরা বুড়ো হয়ে মরে গেছেন, দু-একটা অধমরা বুড়ো গোচের পক্ষী এখনও দেখা যায়, দল ভাঙ্গা ও টাকার খাক্তিতে মনমরা হয়ে পড়েছে, সুতরাং সন্ধ্যার পর ঝুমুর শুনে থাকেন। আড্ডাটি মিউনিসিপ্যাল কমিশনেররা উঠিয়ে দেছেন, অ্যাখান কেবল তার রুইনমাত্র পড়ে আছে। পূর্ব্বের বড় মানুষেরা এখনকার বড় মানুষের মত ব্রিটিশ ইণ্ডিান এসোসিয়েসন, এড্রুস, মিটিং ও ছাপাখানিক বিব্রত ছিলেন না, প্রায় সকলেরই একটি একটি রাড় ছিল, (এখনও অনেকের আছে) বেলা দুপুরের পর উঠতে, আহ্নিকের আড়ম্বরটাও বড় ছিলো—দুতিন ঘণ্টার কম আহ্নিক শেষ হতো না, তেল মাখতেও ঝাড়া চারঘণ্টা লাগতো —চাকরের তেল মাখানীর শব্দে ভূমিকম্প হতো—বাবু, উলঙ্গ হয়ে তেল মাখতে বসতেন, সেই সময় বিষয়-কৰ্ম্ম দেখা, কাগজ-পত্রে সই ও মোহর চলতো, আঁচাবার সঙ্গে সঙ্গে সূৰ্য্যদেব অস্ত যেতেন। এঁদের মধ্যে জমিদাররা রাত্তির দুটো পর্যন্ত কাছারি কত্তেন; কেউ অমনি গান বাজনা জুড়ে দিতেন। দলাদলির তর্ক কত্তেন ও মোসাহেবদের খোসামুদিতে ফুলে উঠতেন—গাইয়ে বাজিয়ে হলেই বাবুর বড় প্রিয় হতো, বাপান্ত কল্লেও বক্সিস পেতো, কিন্তু ভদ্দরলোক বাড়ী ঢুকতে পেতো না; তার বেলা লাঙ্গী তরওয়ালের পাহারা, আদব কায়দা! কোন কোন বাবু, সমস্ত দিন ঘুমুতেন-সন্ধ্যার পর উঠে কাজকৰ্ম্ম কত্তেন দিন রাত ছিল ও রাত দিন হতো! রামমোহন রায়, গুপিমোহন দেব, গুপিমোহন ঠাকুর, দ্বারিকানাথ ঠাকুর ও জয়কৃষ্ণ সিংহের আমোল অবধি এই সকল প্রথা ক্ৰমে ক্ৰমে অন্তর্ধান হতে আরম্ভ হলো, (বাঙ্গালীর প্রথম খবরের কাগজ) সমাচারচন্দ্রিকা প্রকাশ হতে আরম্ভ হলো। ব্রাহ্মসমাজ স্থাপিত হলো! তার বিপক্ষে ধর্ম্মসভা বসলো, রাজা রাজনারায়ণ কায়স্থের পইতে দিতে উদ্যোগ কল্লেন, সতীদাহ উঠে গেল। হিন্দুকলেজ প্রতিষ্ঠিত হলো। হেয়ার সাহেব প্রকাশ হলেন–ক্রমে সংকৰ্ম্মে বাঙ্গালীর চোখ ফুটে উঠলো।
এদিকে বারোইয়ারিতলায় জামদার কবি আরম্ভ হলো; ভাল্কোর জগা ও নিম্তের রামা ঢোলে ‘মহিম্নস্তব’, ‘গঙ্গাবন্দনা’ ও ‘ভেটকিমাছের তিনখানা কাঁটা’, ‘অগ্গরদ্বীপের গোপীনাথ’, ‘যাবি তো যা যা ছুটে ছুটে যা’ প্রভৃতি বেল বাজাতে লাগলো; কবিওয়ালারা বিষমের ঘরে (পঞ্চমের চার গুণ উঁচু) গান ধল্লেন–
চিতেন।
“বড় বারে বারে এসো ঘরে মকদ্দমা করে ফাঁক!
এইবারে গেরে, তোমার কল্লে সূর্পণখার নাক!”
আস্তাই।
ক্যামন সুখ পেলে কম্বলে শুলে,
ব্ৰহ্মওর দেবত্তর বড় নিতে জোর করে
এখন জারী গ্যাল, ভূর ভাংলো,
তোমার আত্তো জুলুম চলবে না!
পেনেলকোডের আইন গুণে মুখুয্যের পোর ভাংলো জাঁক।
বে-আইনীর দফারফা বদমাইসি হলো খাক্॥
মোহাড়া।
কুইনের খাসে, দেশে, প্রজার দুঃখ রবে না।
মহামহোপাধ্যায় মথুরানাথ মুসড়ে গিয়েচেন।
কংস-ধ্বংসকারী লেটোর, জেলায় এসেছেন।
এখন গুমী গ্রেপ্তারী লাঠি দাঙ্গা ফোর্জ চলবে না।
জমিদারী-কবি শুনে সহুরেরা খুশী হলেন, দু-চার পাড়াগেঁয়ে রায়চৌধুরী, মুন্সী ও রায়বাবুরা মাথা হেঁট কল্লেন, হুজুরী আমমোক্তারেরা চৌক রাঙ্গিয়ে উঠলো, কবিওয়ালার ঢোলের তালে নাচতে লাগলো।
স্ক্যাভেঞ্জরের গাড়ী সার বেঁধে বেরিয়েচে। ম্যাথরের ময়লার গাড়ী ঠেলে সেনের ঘাটে চলেছে। বাউলের ললিত রাগে খরতাল ও খঞ্জনীর সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের সহস্র নাম ও
“ঝুলিতে মালা রেখে, জপলে আর হবে কি।”
কেবল কাঠের মালার ঠকঠকী, সব ফাঁকি!”
লোকের দোয়ারে দোয়ারে গান করে বেড়াচ্চে। কলুভায়া ঘানি জুড়ে দিয়েছেন। ধোপারা কাপড় নিয়ে চলেচে। বোঝাই-করা গরুর গাড়ী কোঁ-কোঁ শব্দে রাস্তা জুড়ে যাচ্ছে। ক্রমে ফরসা হয়ে এলো। বারোইয়াভিলায় কবি বন্ধ হয়ে গেল; ইয়ারগোচের অধ্যক্ষ ও দর্শকেরা বিদেয় হলেন, বুড়ো ও আধবুড়োরা কেত্তনের নামে এলিয়ে পড়লেন; দেশের গোঁসাই, গোঁড়া, বৈরাগী ও বষ্টব একত্র হলো;– সিমলের শাম ও বাগবাজারের নিস্তারিণীর কেত্তন।
সিলের শাম উত্তম কিত্তনী—বয়স অল্প, দেখতে মন্দ নয়—গলাখানি যেন কাঁসি খনখন কচ্চে। কেত্তন আরম্ভ হলো–কিত্তনী “তাথইরা তাথইয়া নাচত ফিরত গোপাল ননী চুরি করি খাঞীছে আরে আরে ননী চুরি করি খাঞীছে তাথইয়া” গান আরম্ভ কল্লে; সকলে মোহিত হয়ে পড়লেন! চারিদিক থেকে হরিবোল ধ্বনি হতে লাগলো, খুলীরে হাঁটু গেড়ে বসে সজোরে খোল বাজাতে লাগলো। কিত্তনী কখন হাঁটু গেছে কখনো দাঁড়িয়ে, মধু-বৃষ্টি কত্তে লাগলেন—হরি-প্রেমে একজন গোঁসাইয়ের দশা লাগলো। গোঁড়ারা তাকে কোলে করে নাচতে লাগলো। আর যেখানে তিনি পড়েছিলেন, জিভ দিয়ে সেইখানেই ধূলো চাটতে লাগলো!
হিন্দুধৰ্ম্মের বাপের পুণ্যে ফাঁকি দেখাবার মত ফিকির আছে, গোঁসাইগিরি সকলের টেক্কা। আমরা জন্মাবচ্ছিন্নে কখন একটি রোগা দুৰ্বল গোঁসাই দেখতে পাই নে! গোঁসাই বল্লেই একটা বিকটাকার, ধুম্বলোচন হবে, ছেলেবেলা অবধি সকলেরই এই চিরপরিচিত সংস্কার। গোঁসাইদের যেরূপ বিয়ারিং পোষ্টে আয়েস ও আহারাদি চলে, বড় বড় বাবুদের পয়সা খরচ করেও সেরূপ জুটে ওঠবার যো নাই। গোঁসাইরা স্বয়ং কেষ্ট ভগবান বলেই, অনেক দুর্লভ বস্তুও অক্লেশে ঘরে বসে পান ও কালীয়দমন, পূতনাবধ, গোবর্ধনধারণ প্রভৃতি কটা বাজে কাজ ছাড়া, বস্ত্রহরণ, মানভঞ্জন, ব্ৰজবিহার প্রভৃতি শ্রীকৃষ্ণের গোছালো গোছালো লীলাগুলি করে থাকেন! পেটভরে মাল্লো ও ক্ষীর লেসেন ও রকমারি শিষ্য দেখে চৈতন্যচরিতামৃতের মতে—
“যিনি গুরু তিনি কৃষ্ণ না ভাবিও আন।
গুরু তুষ্টে কৃষ্ণ তুষ্ট জানিবা প্রমাণ॥”
“প্রেমারাধ্যা রাধাসমা তুমি লো যুবতী।
রাখ লো গুরুর মান যা হয় যুকতি।”
—প্রভৃতি উপদেশ দিয়ে থাকেন। এ সওয়ায় গোঁসাইরা অণ্ডরটেকরের (মুদ্দফরাস) কাজও করে থাকেন–পাঁচসিকে পেলে মন্ত্রও দেন, মড়াও ফেলেন ও বেওয়ারিস বেওয়া ম’লে এরা তার উত্তরাধিকারী হয়ে বসেন। একবার মেদিনীপুরে এক ব্রকোদ গোঁসাই খড় জব্দ হয়েছিলেন। এখানে সে উপকথাটিও বলা আবশ্যক।
পূর্ব্বে মেদিনীপুর অঞ্চলে বৈষ্ণবতন্ত্রে গুরু-প্রসাদি প্রথা প্রচলিত ছিল—নতুন বিবাহ হলে গুরুসেবা না করে স্বামি-সহবাস করবার অনুমতি ছিল না। বেতালপুরের রামেশ্বর চক্রবর্ত্তী পাড়াগাঁ অঞ্চলে একজন বিশিষ্ট লোক! সুবর্ণরেখা নদীর ধারে পাঁচবিঘা আওলাৎ ঘেরা ভদ্রাসন বাড়ী, সকল ঘরগুলি পাকা, কেবল চণ্ডীমণ্ডপ ও দেউড়ির সামনের বৈঠকখানা উলু দিয়ে ছাওয়া। বাড়ীর সামনে দু’টি শিবের মন্দির, একটি শাণ-বাঁধানে পুষ্করিণী, তাতে মাছও বিলক্ষণ ছিল। ক্রিয়েকৰ্ম্মে চক্রবর্ত্তীকে মাছের জন্যে ভাবতে হতো না। এ সওয়ায় ২০০ বিঘা ব্রহ্মোত্তর জমি, চাষের জন্য পাঁচখানা লাঙ্গল, পাঁচজন রাখাল চাকর, পাঁচজোড়া বলদ নিযুক্ত ছিল। চক্রবর্ত্তীর উঠোনে দুটি বড় বড় ধানের মরাই ছিল, গ্রামস্থ ভদ্রলোকমাত্ৰেই চক্রবর্ত্তীকে বিলক্ষণ মান্য কত্তেন ও তার চণ্ডীমণ্ডপে এসে পাশা খেলতেন। চক্রবর্ত্তীর ছেলেপুলে কিছুই ছিল না, কেবল এক কন্যামাত্র; সহরের ব্ৰকভানু চাটুষ্যের ছেলে হরহরি চাটুয্যের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের সময় বর-কনের বয়স ১০/১৫ বছরের বেশী ছিল না, সুতরাং জামাই নিয়ে যাওয়া, কি মেয়ে আনা কিছুদিনের জন্য বন্ধ ছিল। কেবল পাল-পার্ব্বণে পিঠে-সংক্রান্তি ও ষষ্ঠবাটায় তত্ত্ব তাবাস চলতো।
ক্রমে হরহরিবাবু কালেজ ছাড়লেন, এদিকে বয়সও কুড়ি-একুশ হলো, সুতরাং চক্রবর্ত্তী জামাই নেযাবার জন্য স্বয়ং শহরে এসে ব্রকভানুবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ কল্লেন। ব্রকভানুবাবু চক্রবর্ত্তীকে কয়দিন বিলক্ষণ আদরে বাড়ীতে রাখলেন, শেষে উত্তম দিন দেখে হরহরিরে সঙ্গে দিয়ে পাঠালেন। একজন দারোয়ান, একজন সরকার ও একজন চাকর হরহরিবাবুর সঙ্গে গেল।
জামাইবাবু তিন-চার দিনে তোলপুরে পৌঁছিলেন। গাঁয়ে সোর পড়ে গেল, চক্রবর্ত্তীর সহুরে জামাই এসেছে; গাঁয়ের মেয়েরা কাজকর্ম্ম ফেলে ছুটোছুটি জামাই দেখতে এলো! ছোঁড়ারা সহুরে লোক প্রায় দেখে নি, সুতরাং পালে পালে এসে হরহরিবাবুরে ঘিরে বোসলো। …চক্রবর্ত্তীর চণ্ডীমণ্ডপ লোকে রৈ-রৈ করে লাগলো; একদিকে আশপাশ থেকে মেয়েরা উঁকি মাচ্চে; একপাশে কতকগুলো গোডিমওয়ালা ছেলে ন্যাংটা দাঁড়িয়ে রয়েছে; উঠানে বাজে লোক ধরে না। শেষে আমাইবাবুকে জলযোগ করবার জন্য বাড়ীর ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। পূর্ব্বে জলযোগের যোগাড় করা হয়েছে শিড়ে নীচে চারিদিপে চারটি সুপারি দেওয়া হয়েছিল; জামাইবাবু যেমন পিঁড়েয় পা দিয়ে বসতে যাবেন, অমনি পিঁড়ে গড়িয়ে গেল। জামাইবাবু ধুপ করে পড়ে গেলেন শালী-শালাজ-মহলে হাসির গর্রা পড়লো! জলযোগের সকল জিনিসগুলিই ঠাট্টাপোরা। মাটির কালো জাম, ময়দা ও চেলের গুঁড়ির সন্দেশ, কাঠের আক ও বিচালির জলের চিনির পানা, জলের গেলাসে ঢাকুনি দেওয়া আরসুলো ও মাকোড়সা, পানের বাটায় ছুঁচো ও ইঁদুর পোরা। জামাইবাবু অতিকষ্টে ঠাট্টার যন্ত্রণা সহ্য করে বাইরে এলেন। সমবয়সী দু’চার শালা সম্পর্কের জুটে গেল; সহরের গল্প, তামাসা ও রঙ্গেই দিনটি কেটে গেল।
রজনী উপস্থিত—সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে–রাখালেরা বাঁশী বাজাতে বাজাতে গরুর পাল নিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। এক-একটি পরমা সুন্দরী স্ত্রীলোক কলসী কাঁকে করে নদীতে জল নিতে আসচে–লম্পটশিরোমণি কুমুদরঞ্জন যেন তাদের দেখবার জন্যই বাঁশঝাড়ে ও তালগাছের পাশ থেকে উঁকি মাচ্ছেন। ঝিঁঝিপোকা ও ঈইচিংড়িরা প্রাণপণে ডাকচে। ভাম, খটাখ ও ভোঁদড়েরা ভাঙ্গা শিবের মন্দির ও পড়ো বাড়ীতে ঘুরে বেড়াচ্চে। চামচিকে ও বাদুড়েরা খাবার চেষ্টায় বেরিয়েছে; এমন সময় একদল শিয়াল ডেকে উঠলো–এক প্রহর রাত্রি হয়ে গেল। ছেলেরা জামাইবাবুর বাড়ীর ভিতর নিয়ে গেল, পুনরায় নানারকম ঠাট্টা ও আসল খেয়ে–জামাইবাবু নির্দ্দিষ্ট ঘরে শুতে গেলেন।
বিবাহের পর পুনর্ব্বিবাহের সময়েও জামাইবাবু শ্বশুরালয়ে যান নাই। সুতরাং পাঁচ বৎসরের সময় বিবাহকালে বা স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল তখন দুইজনেই বালক-বালিকা ছিলেন। সুতরাং হরহরিবাবুর নিদ্ৰা হবার বিষয় কি? আজ স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হবে, স্ত্রী মান করে থাকলে তিনি কলেজী এডুকেশন ও ব্রহ্মজ্ঞান মাথায় তুলে পায়ে ধরে মান ভাঙবেন এবং এরপর যাতে স্ত্রী লেখাপড়া শিখেন ও চিরহৃদয়তোষিকা হন, তার বিশেষ তদ্বির কত্তে থাকবেন। বাঙ্গালীর স্ত্রীরা কি দ্বিতীয়া “মিস ষ্টো, মিস টমসন ও মিসেস বরকরলি ও লেডী বুলুয়ার লিটন” হতে পারে না? বিলিতী স্ত্রী হতে বরং এরা অনেক অংশে বুদ্ধিমতী ও ধর্ম্মশীলা—তবে কেন বডি দিয়ে, পুতুল খেলে ঝকড়া ও হিংসায় কাল কাটায়? সীতা, সাবিত্রী, সতী, সত্যভামা, শকুন্তলা, কৃষ্ণাও তো এক খনির মণি? তবে এঁরা যে কয়লা হয়ে চিরকাল “ফরনেসে” বন্ধ হয়ে পোড়েন ও পোড়ন, সে কেবল বাপ-মা ও ভাতারবর্গের চেষ্টা ও তদ্বিরের ত্রুটিমাত্র। বাঙ্গালীসমাজের এমনি এক চমৎকার রহস্য যে, প্রায় কোন বংশেই স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে কৃতবিদ্য দেখা যায় না! বিদ্যাসাগরের স্ত্রীর হয়তো বর্ণ পরিচয় হয় নাই; গঙ্গাজলের ছড়া–সাফরিদের মাদুলী ও বালসির চন্নমেত্তো নিয়েই ব্যতিব্যস্ত! এ ভিন্ন জামাইবাবুর মনে নানা রকম খেয়াল উঠলো, ক্রমে সেইসব ভাবতে ভাবতে ও পথের ক্লেশে অঘোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। শেষে বেলা এক প্রহরের সময়ে মেয়েদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল—দেখেন যে, বেলা হয়ে গিয়েছে— তিনি একলা বিছানায় শুয়ে আছেন।
এদিকে চক্রবর্ত্তীর বাড়ীর গিন্নীরা বলাবলি কন্তে লাগলেন যে, “তাই তো গা! জামাই এসেচেন, মেয়েও ষেটের কোলে বছর পোনের হলো, এখন প্রভুকে খবর দেওয়া আবশ্যক।” সুতরাং চক্রবর্ত্তী পাঁজি দেখে উত্তম দিন স্থির করে, প্রভুর বাড়ী খবর দিলে–প্রভু তূরী, খুন্তি ও খোল নিয়ে উপস্থিত হলেন। গুরুপ্রসাদির আয়োজন হতে লাগলো।
হরহরিবাবু প্রকৃত রহস্য কিছুমাত্র জানতো না, গোঁসাই দলবল নিয়ে উপস্থিত, বাড়ীর সকলে শশব্যস্ত! স্ত্রী নূতন কাপড় ও সর্ব্বালঙ্কারে ভূষিত হয়ে বেড়াচ্চে! সুতরাং তিনি এতে নিতান্ত সন্দিগ্ধ হয়ে একজন ছেলেকে জিজ্ঞাসা কল্লেন, “ওহে, আজ বাড়ীতে কিসের ধূম?” ছোকরা বল্লে, “জামাইবাবু, তা জান না, আজ আমাদের গুরুপ্রসাদি হবে।”
“আমাদের গুরুপ্রসাদি হবে” শুনে হরহরিবাবু একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে গেলেন ও কি প্রকারে কুৎসিত গুরুপ্রসাদি হতে স্ত্রী পরিত্রাণ পান, তারি তদ্বিরে ব্যস্ত রইলেন।
কর্ত্তব্যকৰ্ম্মের অনুষ্ঠান কত্তে সাধুরা কোন বাধাই মানেন না বলেই যেন দিনমণি কমলিনীর মনোব্যথায় উপেক্ষা করে অস্ত গেলেন। সন্ধ্যাবধূ শাঁক ঘণ্টা ও ঝিঁঝিঁ পোকার মঙ্গলশব্দের সঙ্গে স্বামীর অপেক্ষা কত্তে লাগলেন। প্রিয়সখী প্রদোষ দূতীপদে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, নিশানাথকে সংবাদ দিতে গেলেন। নববধুর বাসরে অমোদ করবার জন্য তারাদল একে একে উদয় হলেন, কুমুদিনী স্বচ্ছ সরোবরে ফুটলেন—হৃদয়রঞ্জনকে পরকীয় রসাস্বাদনে গমনোদ্যত দেখেও, তাঁর মনে কিছুমাত্র বিরাগ হয় নাই। কারণ, চন্দ্রের সহস্র কুমুদিনী আছে, কিন্তু কুমুদিনীর তিনিই একমাত্র অনন্যগতি! এদিকে নিশানাথ উনয় হলেন—শেয়ালেরা যেন স্তব পাঠ কত্তে লাগলো—ফুলগাছেরা ফুলদল উপহার দিতে লাগলো দেখে আাদে প্রকৃতি সত্য হাসতে লাগলেন।
চক্রবর্ত্তীর বাড়ীর ভিতর বড় ধূম। গোস্বামী বরের মত সজ্জা করে জামাইবাবুর শোবার ঘরে গিয়ে শুলেন। হরহরিবাবুর স্ত্রী নানালঙ্কার পরে ঘরে ঢুকলেন; মেয়েরা ঘরের কপাট ঠেলে দিয়ে ফাঁক থেকে আড়ি পেতে উঁকি মাত্তে লাগলো।
হরহরিবাবু ছোঁড়ার কানে শুনে একগাছি রুল নিয়ে গোস্বামীর ঘরে শোবার পূর্ব্বেই খাটের নীচে লুকিয়ে ছিলেন; এক্ষণে দেখলেন যে, স্ত্রী ঘরে ঢুকে গোস্বামীকে একটি প্রণাম করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো; প্রভু খাটে থেকে উঠে স্ত্রীর হাত ধরে অনেক বুঝিয়ে শেষে বিছানায় নিয়ে গেলেন; কন্যাটি কি করে! বংশপরম্পরাগত “ধৰ্ম্মের অন্যথা কল্লে মহাপাপ” এটি চিত্তগত আছে, সুতরাং আর কোন আপত্তি কল্লে না—শুড় শুড় করে প্রভুর বিছানায় গিয়ে শুলো। প্রভু কন্যার গায়ে হাত দিয়ে বল্লেন, বল “অমি রাধা তুমি শ্যাম”; কন্যাটিও অনুমতিমত “আমি রাধা তুমি শ্যাম” তিনবার বলেচে, এমন সময় হরহরিবাবু আর থাকতে পালেন না, খাটের নীচে থেকে বেরিয়ে এসে “এই কাঁদে বাড়ি বলরাম” বলে রুলসই কত্তে লাগলেন। ঘরের বাইরে ন্যাড়া বষ্টমেরা খোলকত্তাল নিয়ে ছিল— গোস্বামীর রুলসইয়ের চীৎকারে তারা হরিবোল ভেবে দেদার খোল বাজাতে লাগলো। মেয়েরা উলু দিতে লাগলো; কাঁসোর ঘণ্টা শাঁকের শব্দে হুলস্থুল পড়ে গেল। হরহরিবাবু হঠাৎ দরজা খুলে ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ে, একেবারে থানার দারোগার কাছে গিয়ে সমস্ত কথা ভেঙ্গে বল্লেন। দারোগা ভদ্রলোক ছিলেন, (অতি কম পাওয়া যায়); তারে অভয় দিয়ে সেদিন যথা সমাদরে বাসায় রেখে, তার পরদিন বরকন্দাছ মোতায়েন দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। এদিকে সকলের তাক লেগে গেল, ইনি কেমন করে ঘরে গিয়েছিলেন। শেষে সকলে ঘরে গিয়ে দেখে যে, গোস্বামীর দাঁতকপাটি লেগে গেচে, অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে, বিছানায় রক্তের নদী বচ্চে। সেই অবধি গুরুপ্রসাদি উঠে গেল, লোকের চৈতন্য হলো। প্রভুরাও ভয় পেলেন।
আর একবার এক সহুরে গোঁসাই এক বেনের বাড়ী কেষ্টলীলা করে জব্দ হয়েছিলেন, সেটিও এই বেলা বলে নিই।
রামনাথ সেন ও শ্যামনাথ সেন দুই ভাই, সহরে চার পাঁচটা হৌসের মুচ্ছুদ্দি। দিনকতক বাবুদের বড় জ্বলজ্বলা হয়ে উঠেছিল–চৌঘুড়ী, ভেঁপু, মোসাহেব ও অবিদ্যার ছড়াছড়ি। উমেদার, বেকার রেকমেণ্ড চিঠিওয়ালা লোকে বৈঠকখানা থৈ থৈ কত্তো, বাবুরা নিয়ত বাগান, চোহেল ও আমোদেই মত্ত থাকত্তেন, আত্মীয়-কুটুম্ব ও বন্ধুবান্ধবেই বাবুদের কাজকর্ম্ম দেখতেন। একদিন রবিবার বাবুরা বাগানে গিয়েছেন, এই অবকাশে বাড়ীর প্রভু,–খুন্তি, খোল ও ভেঁপু নিয়ে উপস্থিত, বাড়ীর ভিতর খবর গ্যালো। প্রভুকে সমাদরে বাড়ীর ভিতর নিয়ে যাওয়া হলো। প্রভু চৈতন্যচরিতামৃত ও ভাগবতের মতে লীলা দেখালেন। শেষে গোস্বামী বাড়ী ফিরে যান–এমন সময় ছোটবাবু এসে পড়লেন। ছোটবাবুর কিছু সাহেবী মেজাজ, প্রভুকে দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে গেলেন ও অনেক কষ্টে আন্তরিক ভাব গোপন করে জিজ্ঞেসা কল্লেন, “কেমন প্রভু! ভগবানের মতে লীলা দেখান হলো?” প্রভু ভয়ে আমতা আমতা গোছের “আজ্ঞে হাঁ’ করে সেরে দিলেন। ছোটবাবুর একজন মুখোড়া গোছের কায়স্থ মোসাহেব ছিল, সে বল্লে, “হুজুর। গোঁসাই সকল রকম লীলে করে চল্লেন, কিন্তু গোবর্ধনধারণা হয়নি, অনুমতি করেন তো প্রভুকে গোবর্ধন ধারণটাও করিয়ে দেওয়া যায়, সেটাও বাকী থাকে কেন?” ছোটবাবু এতে সম্মত হলেন, শেষে দরওয়ানদের হুকুম দেওয়া হলো–দরজার পাশে একখান দশ-বারো মণ পাথর পড়ে ছিল, জন কতকে ধরে এনে গোস্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে, পাথরের চাপানে গোস্বামীর কোমর ভেঙ্গে গেল। এদিকে বারোইয়ারিতলায় কেত্তন বন্ধ হয়ে গেল, কেত্তনের শেষে একজন বাউল সুর করে এই গানটি পাইলে–
বাউলের সুর
আজব সহর কলকেতা।
রাড়ী বাড়ী জুড়ীগাড়ী মিছে কথার কি কেতা।
হেতা ঘুঁতে পোড়ে গোবর হাসে বলিহারি ঐকতা;
যত বক বিড়ালে ব্রহ্মজ্ঞানী, বদমাইসির ফাঁদ পাতা।
পুঁটে তেলির আশা ছড়ি শুঁড়ী সোনার বেণের কড়ি,
খ্যামটা খানকির খাসা বাড়ী, ভদ্রভাগ্যে গোলপাতা।
হদ্দ হেরি হিন্দুয়ানী, ভিতর ভাঙ্গা ভড়ংখানি,
পথে হেগে চোরাঙ্গানি, লুকোচুরির ফেরগাঁতা।
গিন্টি কাজে পালিশ করা, রাঙ্গা টাকায় তামা ভরা,
হুতোম দাসেস্বরূপ-ভাষে, তফাৎ থাকাই সার কথা।
গানটি শুনে সকলেই খুসী হলেন। বাউলে চার আনার পয়সা বক্সিস পেলে; অনেকে আদর করে গানটি শিখে ও লিখে নিলেন।
বারোইয়ারি পুজো শেষ হলো, প্রতিমখানি আট দিন রাখা হলো, তারপর বিসর্জ্জন করবার আয়োজন হতে লাগলো। আমমোক্তার কানাইধনবাবু পুলিশ হতে পাশ করে আনলেন। চার দল ইংরাজী বাজনা, সাজা তুরুকসোয়ার নিশেন ধরা ফিরিঙ্গি, আশা শোটা ঘড়ী ও পঞ্চাশটা ঢাক একত্র হলো! বাহাদুরী কাঠতোলা চাক একত্র করে, গাড়ীর মত করে, তাতেই প্রতিমে তোলা হলো; অধ্যক্ষের প্রতিমের সঙ্গে সঙ্গে চল্লেন, দু পাশে সংয়ের সার বেঁধে চল্লো। চিৎপুরের বড় রাস্তা লোকারণ্য হয়ে উঠলো; রাঁড়েরা ছাদের ও বারাণ্ডার উপর থেকে রূপোবাঁধানো হুঁকোয় তামাক খেতে খেতে তামাসা দেখতে লাগলো, রাস্তার লোকেরা হাঁ করে চলতী ও দাঁড়ানো প্রতিমে দেখতে লাগলো। হাটখোলা থেকে জোড়াসাঁকো ও মেছোবাজার পর্যন্ত ঘোরা হলো, শেষে গঙ্গাতীরে নিয়ে বিসর্জ্জন করা হয়। অনেক পরিশ্রমে যে বিশ পঁচিশ হাজার টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিলো, আজ তারি শ্ৰাদ্ধ ফুরুলো। বীরকৃষ্ণ দাঁ আর আর অধ্যক্ষের অত্যন্ত বিষণ্ণদনে বাড়ী ফিরে গেলেন। বাবুদের ভিজে কাপড় থাকূলে অনেকেই বিবেচনা কতো যে, বাবুরা মড়া পুড়িয়ে এলেন।
বারোইয়ারি পূজোর সম্বৎসরের মধ্যেই বীরকৃষ্ণ দাঁর বাজার-দেনা চেগে উঠলো, গদী ও আড়ত উঠ গ্যাল, শেষে ইন্সল্ভেট গিয়ে ফরেশডাঙ্গায় গিয়ে বাস করেন; কিছুদিন বাদে হঠাৎ ঘর চাপা পড়ে মরে গেলেন! আমমোক্তার কানাইবন দত্তজা সুপ্রিমকোর্টে জাল সাক্ষ্য দেওয়া অপরাধে, সার রবার্ট পিল সাহেবের বিচারে চৌদ্দ বছরের জন্য ট্রান্সপোর্ট হলেন, তার পরিবারের কিছুকাল অত্যন্ত দুঃখে কাল কাটিয়ে শেষে মুড়িমুড়কির দোকান করে দিনপাত কত্তে লাগলেন; মুড়িঘাটা লেনের হুজুর কোন বিশেষ কারণে বারোইয়ারিপুজোর মধ্যে কাশী গ্যালেন। প্যালানাথবাবু একদিন কতকগুলি বাঈ ও মেয়েমানুষ নিয়ে বোটে করে কোম্পানীর বাগানে বেড়াতে যাচ্ছিলেন; পথে আচমকা একটা ঝড় উঠলো, মাঝিরে অনেক চেষ্টা কল্লে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না, শেষে বোটখানি একেবারে একটা চড়ার উপর উল্টে পড়ে চুরমার হয়ে ডুবে গেল। বাবু বড়মানুষের ছেলে, কখন সাঁতার দেন নাই। সুতরাং জলের টানে কোথায় যে গিয়ে পড়লে তার অদ্যাপি নির্ণয় হয় নাই। মুখুয্যেদের ছোটবাবু ক্রমে ভারি গাঁজাখোর হয়ে পড়লেন, অনবরত গাঁজা টেনে তার যক্ষ্মাকাস জন্মালো, আরাম হবার জন্যে তারকেশ্বরের দাড়ি রাখলেন বাল্সীর চরণামৃত খেলেন, সাফরিদের মাদুলী ধারণ কল্লেন; কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না, শেষে বিবাগী হয়ে কোথায় যে বেরিয়ে গেছেন, আজও তার ঠিকানা হয় নাই। প্রধান দোয়ার গবারাম গাওনা ছেড়ে পৈতৃক পেশা গিল্টি অবলম্বন করে কিছুকাল সংসার চালাচ্ছিলেন, গত পুজোর সময় পক্ষাঘাত রোগে মরেচেন। পচ্চুবাবু, অঞ্জনারঞ্জন দেব বাহাদুর ও আর আর অধ্যক্ষ দোয়ারেরা এখনও বেঁচে আছেন। তাদের যা হবে, তা এর পরে বক্তব্য।
১.০৩ হুজুক
সাধারণে কথায় বলেন, “হুনরে চীন” ও “হুজ্জুতে বাঙ্গাল” কিন্তু হুতুম বলেন “হুজুকে কলকেতা”। হেথা নিত্য নতুন হুজুক, সকল গুলিই সৃষ্টিছাড়া ও আজগুব। কোন কাজকর্ম্ম না থাকলে, “জ্যাঠাকে গঙ্গাযাত্রা” দিতে হয়, সুতরাং দিবারাত্র হুঁকো হাতে করে থেকে গল্প করে, তাস ও বড়ে টিপে, বাতকৰ্ম্ম কত্তে কত্তে, নিষ্কৰ্ম্মা লোকেরা যে আজগুব হুজুক তুলবে, তা বড় বিচিত্র নয়। পাঠক! যতদিন বাঙ্গালীর “বেটর অকুপেসন” না হচ্ছে, যতদিন সামাজিক নিয়ম ও বাঙ্গালীর বর্তমান গাহস্থ্যপ্রণালীর রিফরমেশন না হচ্ছে, ততদিন এই মহান্ দোষের মুলোচ্ছেদের উপায় নাই। ধৰ্ম্মনীতিতে যারা শিক্ষা পান নাই, তারা মিথ্যার যথার্থ অর্থ জানেন না, সুতরাং অক্লেশে আটপৌরে ধুতির মত ব্যবহার কত্তে লজ্জিত বা সঙ্কুচিত হন না।
১.০৫ প্রতাপচাঁদ
আমরা বড় হলেম, হাতে খড়ি হলো। একদিন গুরুমহাশয়ের ভয়ে চাকরদের কাছে লুকিয়ে রয়েছি, এমন সময় চাকরেরা পরস্পর বলাবলি কচ্চে যে “বর্দ্ধমানের রাজা প্রতাপচাঁদ একবার মরেছিলেন, কিন্তু আবার ফিরে এসেছেন। বর্দ্ধমানের রাজত্ব নেবার জন্য নালিশ করেচেন, সহরের তাবৎ বড়মানুষরা তাকে দেখতে যাচ্ছেন–এবার পুরাণবাবুর সর্ব্বনাশ, পুষ্যিপুত্তর নামঞ্জুর হবে।” নতুন জিনিষ হলেই ছেলেদের কৌতূহল বাড়িয়ে দেয়; শুনে অবধি আমরা অনেকেরই কাছে খুঁটরে খুঁটরে রাজা প্রতাপচাঁদের কথা জিজ্ঞাসা কত্তেম। কেউ বলতো, “তিনি একদিন একরাত জলে ডুবে থাকতে পারেন!” কেউ বলতো, “তিনি গুলিতে মরেন নি-রাণী বলেছেন, তিনিই রাজা প্রতাপচাঁদ—ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে লকে কাণ কেটে গিয়েছিল, সেই কাটাতেই তার ভগিনী চিনে ফেল্লেন!” কেউ বল্লে, “তিনি কোন মহাপাপ করেছিলেন, তাই যুধিষ্ঠিরের মত অজ্ঞাতবাসে গিয়েছিলেন, বাস্তবিক তিনি মরেন নি; অম্বিকা কালনায় যখন তাঁরে দাহ কৰ্ত্তে অনা হয় তখন তিনি বাক্সের মধ্যে ছিলেন না, সুদু বাক্স পোড়ান হয়।” সহরে বড় হুজুক পড়ে গেল, প্রতাপচাঁদের কথাই সর্ব্বত্র আন্দোলন হতে লাগলো।
কিছুদিন এই রকমে যায়—একদিন হঠাৎ শুনা গেল, সুপ্রিমকোর্টের বিচারে প্রতাপচাঁদ জাল হয়ে পড়েছেন। সহরের নানাবিধ লোক কেউ সুবিধে কেউ কুবিধে–কেউ বল্লে, “তিনি আসল প্রতাপচাঁদ নন”—কেউ বলে, “ভাগ্যি দ্বারিকানাথ ঠাকুর ছিলেন, তাই জাল প্রুব হলো। তা না হলে পরাণবাবু টেরটা পেতেন।” এদিকে প্রতাপদ জাল সাব্যস্ত হয়ে, বরানগরে বাস কল্লেন। সেথা জরুক হলেন— খানকি ঘুসকি ও গেরস্ত মেয়েদের মেলা লেগে গেল, প্রতাপচাঁদ না পারেন, হেন কৰ্ম্মই নাই। ক্রমে চলতি বাজনার মত প্রতাপচাঁদের কথা আর শোনা যায় না; প্রতাপচাঁদ পুরোণো হলো, আমরাও পাঠশালে ভর্তি হলেম।
১.০৬ মহাপুরুষ
পাঠক! পাঠশালা যমালয় হতেও ভয়ানক—পণ্ডিত ও মাষ্টারকে যেন বাঘ বিবেচনা হচ্ছে। একদিন আমরা স্কুলে একটার সময়ে ঘোড়াঘোড়া খেলচি, এমন সময়ে আমাদের জলতোলা বুড়ো মালী বলে যে, “ভূকৈলেসে রাজাদের বাড়ী একজন মহাপুরুষ এসেছেন, মহাপুরুষ সত্যযুগের মানুষ, গায়ে বড় বড় আশেীদগাছ ও উইয়ের ঢিপি হয়ে গিয়েছে—“চোক বুজে ধ্যান কচ্চেন, ধ্যান ভঙ্গ হয়ে চক্ষু খুলেই সমুদয় ভস্ম করে দেবেন।” শুনে আমাদের বড় ভয় হলো। স্কুলে ছুটি হলে আমরা বাড়ীতে এসেও মহাপুরুষের বিষয় ভাবতে লাগলেম; লাট্টু, ঘুড্ডী, ক্রিকেট, পায়রা পড়ে রইলো—মহাপুরুষ দেখবার ইচ্ছা ক্রমে বলবর্তী হয়ে উঠলো; শেষে আমরা ঠাকুরমার কাছে গেলুম।
আমাদের বুড়ো ঠাকুরমা রোজ রাত্রে শোবার সময় ‘বেঙ্গমা-বেঙ্গুমী’ ‘পায়রা রাজা’ ‘রাজপুত্তর, পাত্তরের পুত্তুর, সওদাগরের পুওর ও কোটালের পুত্তর চার বন্ধু ‘তালপত্তরের খাড়া জাগে ও পক্ষিরাজ ঘোড়া জাগে’ ও ‘সোণার কাটী রূপার কাটী’ প্রভৃতি কত রকম উপকথা কইতেন। কবিকঙ্কণ ও কাশীদাসের পয়ার মুখস্থ আওড়াতে—আমরা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তুম।–হায়, বাল্যকালের সে সুখসময় মরণকালেও স্মরণ থাকবে-–অপরিচিত সংসার—হৃদয়কমল কুসুম হতেও কোমল বোধ হতো, কলেরই বিশ্বাস ছিল, ভূত, পেৎনী ও ঠাকুর দেবতার নামে শরীর লোমাঞ্চ হতো—হৃদয় অনুতাপ ও শোকের নামও জানতো না—অমর বর পেলেও সেই সুকুমার অবস্থা অতিক্রম কত্তে ইচ্ছা হয় না।
শোবার সময়ে ঠাকুরমাকে সেই মালীর মহাপুরুষের কথা বল্লেম—ঠাকুরমা শুনে খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন ও একজন চাকরকে পরদিন সকালে মহাপুরুষের পায়ের ধূলো আনতে বলে দিয়ে, মহাপুরুষের বিষয়ে আরও দু-একঃগর কল্লেন।
ঠাকুরমা বললেন–বছর আশী হলে (ঠাকুরমার তখন নতুন বিয়ে হয়েচে) আমাদের বারাণসী ঘোষ কাশী যাবার সময়ে পথে জঙ্গলের ভিতর ঐ রকম এক মহাপুরুষ দেখেন। সেই মহাপুরুষও ঐ রকম অচৈতন্য হয়ে ধ্যানে ছিলেন। মাঝিরে ধরাধরি করে নৌকায় তুলে আনে। বারাণসী তাকে বড় যত্ন করে নৌকায় রাখলেন। তখন ছাপঘাটীর মোহনায় জল থাকতো না বলে, কাশীযাত্রীরে বাদাবনের ভিতর দিয়ে যেতেন আসতেন; সুতরাং বারাণসীকেও বাদ দিয়ে যেতে হলো। এক দিন বাদাবনের ভিতর দিয়ে গুণ টেনে নৌকা যাচ্ছে, মাঝি ও অন্য অন্য লোকেরা অন্যমনস্ক হয়ে রয়েছে, এমন সময়ে ঠিক ঐ রকম আর একজন মহাপুরুষ নৌকার গলুয়ের কাছে বসে ধ্যানে ছিলেন, এরি মধ্যে ডাঙ্গার মহাপুরুষও হাসতে হাসতে নৌকার উপর এসে নৌকার মহাপুরুষের হাত ধরে নিয়ে জলের উপর দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন, মাঝি ও অন্য অন্য লোকেরা হাঁ করে রইলো! বারাণসী বাদাবন তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন, কিন্তু আর মহাপুরুষদের দেখতে পেলেন না, এরা সব সেকালের মুনিঋষি, কেউ হাজার বৎসর তপিস্যে কচ্চেন, এঁরা মনে কলে সব কত্তে পারেন!
আর একবার ঝিলিপুরের দত্তরা সোঁদরবন আবাদ কত্তে কত্তে ত্রিশ হাত মাটীর ভিতরে এক মহাপুরুষ দেখেছিল। তার গায়ে বড় বড় অশোদগাছের শেকড় জন্মে গিয়েছিল। আর শরীর শুকিয়ে চেলাকাঠের মত হয়েছিল। দত্তরা অনেক পরিশ্রম করে তারে ঝিলিপুরে আনে, মহাপুরুষও প্রায় এক মাস ঝিলিপুরে থাকেন, শেষে একদিন রাত্তিরে তিনি যে কোথায় চলে গেলেন, কেউ তার ঠিকানা কত্তে পাল্পে না!–শুনতে শুনতে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
তার পরদিন সকালে রামা চাকর মহাপুরুষের পায়ের ধুলো এনে উপস্থিত কল্লে; ঠাকুরমা একটি জয়ঢাকের মত মাদুলিতে সেই ধুলো পুরে, আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দিলেন, সুতরাং সেই দিন থেকে আমরা ভূত, পেৎনী, শাঁকচুন্নী ও ব্রহ্মদত্তির হাত থেকে কথঞ্চিৎ নিস্তার পেলেম।
ক্রমে আমরা পাঠশালা ছাড়লেম–কলেজে ভর্ত্তি হলেম–সহাধ্যায়ী দু-চার সমকক্ষ বড়মানুষের ছেলের সঙ্গে আলাপ হলো। একদিন আমরা একটার সময়ে গোলদীঘির মাঠে ফড়িং ধরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় আমাদের কেলাসের পণ্ডিত মহাশয় সেই দিকে বেড়াতে এলেন। পণ্ডিত মহাশয় প্রথমে বড়মানুষের বাড়ীর রাঁধুনী বামুন ছিলেন, এডুকেশন কৌন্সেলের সুক্ষ্ম বিবেচনায়, সেন বাবুর সুপারিসে ও প্রিন্সিপালের কৃপায় পণ্ডিত হয়ে পড়েন। পণ্ডিত মহাশয় পান খেতে বড় ভালবাসতেন, সুতরাং সকলেই তাকে যথাসাধ্য পান দিয়ে তুষ্ট কত্তে ক্রটি কত্তো না; পণ্ডিত মহাশয় মাঠে আসবামাত্র ছেলেরা পান দিতে আরম্ভ কল্লে; আমরাও এক দোনা মিঠে খিলি উপহার দিলেম। পণ্ডিত মহাশয় মিঠে খিলি পছন্দ কত্তে; পান খেয়ে আমাদের নাম ধরে বলেন, “আরে হুতোম! আর শুনচো? ভূকৈলেসের রাজাদের বাড়ী যে একটা মহাপুরুষ ধরে এনেছিলো, ডাক্তার সাহেব তার ধ্যান ভঙ্গ করে দিয়েছেন;–প্রথমে রাজারা তার পায়ে গুল পুরিয়ে দেন, জলে ডুবিয়ে রাখেন, কিছুতেই ধ্যানভঙ্গ হয় নাই। শেষে ডাক্তার সাহেব এক আরক নিয়ে তার নাকের গোড়ায় ধল্লে তার চেতন হলো; এখন সেই মহাপুরুষ লোকের গলা টিপে পয়সা নিচ্ছে, রাজাদের পাখা টেনে বাতাস কচ্চে, যা পাচ্ছে, তাই খাচ্ছে, তার মহাপুরুষত্ব-ভুর ভেঙ্গে গেছে।”
পণ্ডিত মহাশয়ের কথা শুনে আমরা তাক্ হয়ে পড়লেম, মহাপুরুষের উপর যে ভক্তিটুকু ছিল— মরিচবিহীন কর্পূরের মত–পরহীন ইথরের মত একেবারে উবে গেল। ঠাকুরমার মাদুলিটি তার পর দিনই খুলে ফ্যালা হলো; ভূত, শাঁকচুন্নী পেৎনীদের ভয় আবার বেড়ে উঠলো।
১.০৭ লালা রাজাদের বাড়ী দাঙ্গা
আমরা স্কুলে আর এক কেলাস উঠলেম। রাধুনি বামুন পণ্ডিতের হাত এড়ানো গেল। একদিন আমরা পড়া বলতে না পারায় জল খাবার ছুটীর সময়ে গাধার টুপী মাথার দিয়ে, বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে কন্ফাইন্ হয়ে রয়েছি, মাষ্টার মশাই তামাক খাবার ঘরে জল খেতে গেছেন (তাঁর ক্ষিদে বরদাস্ত হয় না, কিন্তু ছেলেদের হয়); একজন বামুন বাবুদের বাড়ীর ছোটবাবুর মুখে শ্যামা পাখীর বোল—“বক্ বকম্ বক বকম্” করে পায়রার ডাক ডেকে বেড়াচ্চেন ও পনি টাট্টু সেজে কদম দেখাচ্ছেন; এমন সময়ে কাশীপুর অঞ্চলের একজন ছোকরা বল্লে, “কাল বৈকালে পাকপাড়ায় লালাবাবুদের (শ্রী বিষ্ণু! আজকাল রাজা) লালা রাজাদের বাড়ী—এক দল গোরা মাতাল হয়ে এসে চার-পাঁচ জন দারোয়ানকে বর্শায় বিঁধে গিয়েছে, রাজারা ভয়ে হাসন হোসেনের মত একটা পুরোণো পাতকোর ভিতর লুকিয়ে প্রাণরক্ষা করেছেন।” (বোধ হয় কেবল গিরগিটের অপ্রতুল ছিল)। আর একজন ছোকরা বলে উঠলো “আরে তা নয়, আমরা দাদার কাছে শুনেছি, রাজাদের বাড়ীর সামনের গাছে একটা কাগ মেরেছিল বলে রাজাদের জমাদার, সাহেবদের মাত্তে এসে”; আর একজন ছোকরা দাঁড়িয়ে উঠে আমাদের মুখের কাছে হাত নেড়ে বল্লে, “আ রে না হে না, ও সব বাজে কথা! আমারও বাড়ী টালাতে, রাজাদের বাড়ীর পেছনে যে সেই বড় পগারটা আছে জান? তার পাশে যে পচা পুকুর সেই আমাদের খিড়কি। রাজাদের এক জন আমলার ভাই ঠিক বানরের মত মুখ; তাই দেখে একজন সাহেব ভেংচে ছিল, তাতে আমলাও ভেংচায়; তাতেই সাহেবরা বন্দুক পিস্তল নিয়ে দলবল সমেত এসে গুলী করে”। এইরূপে অনেক রকম কথা চলেছে, এমন সময়ে মাষ্টার বাবু তামাক খাবার ঘর থেকে এলেন, ছোটবাবুর পনি টাটুর কদম ও ‘বক বকম্’ বন্ধ হয়ে গেল, রাজারা বাঁচলেন—ঢং ঢং করে দুটো বাজলে কেলাস বসে গেল, আমরাও জল খেতে ছুটী পেলেম। আমরা বাড়ী গিয়ে রাজাদের ব্যাপার অনেকের কাছে আরও ভয়ানক রকম শুনলেম; বাঙ্গালা কাগজওয়ালারা, “এক দল গোরা বাজনা বাজিয়ে যাইতেছিল, দলের মধ্যে একজনের জলতৃষ্ণা পেয়েছিল, রাজাদের বাড়ী যেমন জল খেতে যাবে, জমাদার গলা ধাক্কা মারিয়া বাহির করিয়া দেয়, তাহাতে সঙ্গের কর্ণেল গুলী কত্তে হুকুম দেন” প্রভৃতি নানা আজগুবী কথায় কাগজ পোড়াতে লাগলেন। সহরের পূর্ব্বের বাঙ্গালা খবরের কাগজ বড় চমৎকার ছিল, ‘অমুক বাবুর মত দাতা কে!” “অমুক বাবুর মার শ্রাদ্ধে জোর টাকা ব্যয়, (বাবু মুচ্ছুদী মাত্র); “অমুক মাতাল জলে ডুবে মরে গেচে” “অমুক বেশ্রার নত খোয়া গিয়েছে, সন্ধান করে দিতে পাল্লে সম্পাদক তার পুরস্কারস্বরূপ তারে নিজ সহকারী করবেন” প্রভৃতি আল্ত কথাতেই পত্র পুরুতেন; কেউ গাল দিয়ে পয়সা আদায় কত্তেন, কেউ পয়সার প্রত্যাশায় প্রশংসা কত্তেন;–আজকালও অনেক কাগজে চোর গোপ্তান চলে!
শেষে সঠিক শোনা গেল যে, এক জন দরওয়ানকে এক জন ফিরিঙ্গি শিকারী বাকবিতণ্ডায় ঝকড়া করে গুলী করে।
১.০৮ কৃশ্চানি হুজুক
পাক্পাড়ার রাজাদের হাঙ্গামা চুকতে চুকতে হুজুর উঠলো, “রণজিৎসিংহের পুত্র দলিপ–ইসুমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েচেন; তাঁর সঙ্গে সমুদায় শিকেরা কৃষ্ণান হয়েচেন ও ভাটপাড়ার জনকতক ঠাকুরও কৃশ্চান হবেন!” ভাটপাড়ার গুরুগুষ্টিরে প্রকৃত হিন্দু; তাঁরা কৃশ্চান হবেন শুনে, অনেকে চমকে উঠলেন, শেষে ভাটপাড়ার বদলে পাতুরেঘাটার শ্রীযুক্তবাবু প্রসন্নকুমার ঠাকুরের পুত্র বাবু জ্ঞানেন্দ্রমোহন বেরিয়ে পড়লেন। সমধৰ্ম্মা কৃষ্ণমোহন কন্যা উচ্ছুগ্গু করে দিলেন, এয়োরও অভাব রইলো না। সহরে যখন যে পড়ত পড়ে, শীগগির তার শেষ হয় না; সেই হিড়িকে একজন স্কুলমাষ্টার, কালীঘেটে হালদার, একজন বেণে ও কায়স্থ কৃশান দলে বাড়লো–দু-চার জন বড় বড় ঘরের মেয়েমানুষও অন্ধকার থেকে আলোয় এলেন। শেষে অনেকের চালফুঁড়ে আলো বেরতে লাগলো, কেউ বিষয়ে বঞ্চিত হলে, কেউ কেউ অনুতাপ ও দুরবস্থার সেবা কত্তে লাগলেন। কৃশ্চানি হুজুক রাস্তার চলতি লণ্ঠনের মত প্রথমে আসপাশ আলো করে শেষে অন্ধকার করে চলে গেল। আমরাও ক্রমে বড় হয়ে উঠলেম–স্কুল আর ভাল লাগে না!
১.০৯ মিউটীনি
পাঠকগণ! একদিন আমরা মিছেমিছি ঘুরে বেড়াচ্চি, এমন সময় শুনলেম, পশ্চিমের সেপাইরে খেপে উঠেচে, নানা সাহেবকে চাঁই করে ইংরেজদের রাজত্ব নেবে, দিল্লীর ন্যেড়ে চীফ আবার “দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো বা” হবেন ভারি বিপদ! সহরে ক্রমে হুলস্থুল পড়ে গেল, চুনোগলি ও কসাইটোলার মেটে ইদ্রুস পিদ্রু স, গমিস ডিস প্রভৃতি ফিরিঙ্গিরে খাবার লোভে ভলিনটিয়ার হলেন, মাথালো মাথালো বাড়ীতে গোরা পাহারা বসলো, নানা রকম অদ্ভুত হুজুক উঠতে লাগল—আজ দিল্লী গেল—কাল কানপুর হারানো হলো, ক্রমে পাশাখেলার হার কেতের মত ইংরাজেরা উত্তরপশ্চিমের প্রায় সমুদয় অংশেই বেদখল হলেন—বিবি, ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলে ও মেয়েরা মারা গেল, ‘শ্রীবৃদ্ধিকারী’ সাহেবেরা (হিন্দু দেবতা পঞ্চানন্দের মত) বড় ছেলের কিছু কত্তে পাল্লেন না, ছোট ছেলের ঘাড় ভাঙ্গবার উজ্জুগ পেলেন–সেপাইদের রাগ বাঙ্গালীর উপর ঝাড়তে লাগলেন। লর্ড ক্যানিংকে বাঙ্গালীদের অস্ত্র-শস্ত্র (বঁটি ও কাঁটারিমাত্র) কেড়ে নিতে অনুরোধ কল্লেন! বাঙ্গালীরা বড় বড় রাজকৰ্ম্ম না পায়, তারও তদ্বির হতে লাগলো; ডাকঘরের কতকগুলি নেড়ে প্যায়দার অন্ন গেল, নীলকরেরা অনরেরী মেজেষ্টর হয়ে মিউটীনি উপলক্ষ করে (চোর চায় ভাঙ্গা ব্যাড়া) দাদন, গাদন ও শ্যামচাঁদ খেলাতে লাগলেন। শ্যামচাঁদ সামান্নি নন, তাঁর কাছে আইন এগুতে পারে না—সেপাইতো কোন ছার। লক্ষ্ণৌয়ের বাদশাকে কেল্লায় পোরা হলো, গোরারা সময় পেয়ে দু-চার বড় বড় ঘরে লুটতরাজ অরম্ভ কল্লে, মার্শাল ল জারি হলো, যে ছাপা যন্ত্রের কল্যাণে হুতোম নির্ভয়ে এত কথা অক্লেশে কইতে পাচ্ছেন, সে ছাপা-যন্ত্র কি রাজা, কি প্রজা, কি সেপাই পাহারা–কি খেলার ঘর, সকলকে একরকম দেখে, ব্রিটিশকলের সেই চিরপরিচিত ছাপা-যন্ত্রের স্বাধীনতা মিউটীনি উপলক্ষে, কিছুকাল শিকলি পরলেন। বাঙ্গালীরে ক্রমে বেগতিক দেখে গোপাল মল্লিকের বাড়ীতে সভা করে, সাহেবদের বুঝিয়ে দিলেন যে–“যদিও একশ বছর হয়ে গেল, তবু তারা আজও সেই হতভাগা ম্যাড়া বাঙ্গালীই আছেন—বহু দিন ব্রিটিশ সহবাসে, ব্রিটিশ শিক্ষায় ও ব্যবহারে আমেরিকানদের মত হতে পারেন নি। (পারবেন কি না তারও বড় সন্দেহ)। তাঁদের বড়মানুষদের মধ্যে অনেকে তুফানের ভয়ে গঙ্গায় নৌকো চড়েন না—রাত্তিরে প্রস্রাব কৰ্তে উঠতে হলে স্ত্রীর বা চাকর চাকরাণীর হাত ধরে ঘরের বাইরে যান, অন্দরের মধ্যে টেবিল ও পেননাইফ ব্যবহার করে থাকেন; যাঁরা আপনার ছায়া দেখে ভয় পান–তাঁরা যে লড়াই করবেন, এ কথা নিতান্ত অসম্ভব। বলতে কি, কেবল আহার ও গুটিকতক বাছালো বাছালো আচারে তাঁরা ইংরাজদের স্কেচমাত্র করে নিয়েছেন। যদি গভর্ণমেন্টের হুকুম হয়, তা হলে সেগুলিও চেয়ে পরা কাপড়ের মত এখনই ফিরিয়ে দেন—রায় মহাশয়ের মগ বার্চ্চিকে জবাব দেওয়া হয়—বিলিতী বাবুরা ফিরতি ফলারে বসেন ও ঘোষজা গাঁজা ধরেন, আর বাগাম্বর মিত্র বনাতের প্যাণ্টুলন ও বিলিতী বদমাইসি থেকে স্বতন্ত্র হন।
ইংরাজের মাগ, ছেলে ও স্বজাতির শোকে একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, সুতরাং তাতেও ঠাণ্ডা হলেন না–লর্ড ক্যানিংয়ের রিকলের জন্য পার্লিয়ামেণ্টে দরখাস্ত কল্লেন, সহরে হুজুকের একশেষ হয়ে গেল। বিলেত থেকে জাহাজ জাহাজ গোরা আসতে লাগলো—সেই সময়ে বাজারে এই গান উঠলো–
গান
“বিলাত থেকে এলো গোরা,
মাথার পর কুরতি পরা,
পদভরে কাঁপে ধরা, হাইল্যাণ্ডনিবাসী তারা।
টামটিয়া টোপীর মান
হবে এবে খর্ব্বমান,
সুখে দিল্লী দখল হবে,
নানা সাহেব পড়বে ধরা॥”
বাঙ্গালী ঝোপ বুঝে কোপ ফেলতে বড় পটু; খাঁটি হিন্দু (অনেকেই দিনের বেলার খাঁটি হিন্দু) দলে রটিয়ে দিলে যে, “বিধবাবিবাহের আইনই পাশ ও বিধবাবিবাহ হওয়াতেই সেপাইরে খেপেচে। গবর্ণমেণ্ট বিধবাবিবাহের আইন তুলে দিয়েছেন—বিদ্যাসাগরের কৰ্ম্ম গিয়েছে—প্রথম বিধবাবিবাহের বর শিরিশের ফাঁসি হবে।”
কোথাও হুজুক উঠলো, “দলিপ সিংকে কৃশ্চান করাতে, নাগপুরের রাণীদের স্ত্রীধন কেড়ে নেওয়াতে ও লক্ষ্ণৌয়ের বাদশাই যাওয়াতে মিউটীনি হলো।”
নানা মুনির নানা মত! কেউ বল্লেন, সাহেবেরা হিন্দুর ধৰ্ম্মে হাত দেন, তাতেই এই মিউটীনি হয়েচে। তারকেশ্বরের মোহেন্তের রক্ষিতা, কাশীর বিশ্বেশ্বরের পাণ্ডার স্ত্রী ও কালীঘাটের বড় হালদারের বাড়ীর গিন্নীরে স্বপ্নে দেখেচেন, ইংরেজদের রাজত্ব থাকবে না! দুই এক জন ভটচাৰ্য্যি ভবিষ্যৎ পুরান খুলে তারই নজর দেখালেন!
ক্রমে সেপাইয়ের হুজুকের বাড়তি কমে গ্যালো–আজ দিল্লী দখল হলো–নানা পালালেন–জং বাহাদুরের সাহায্যে লক্ষ্ণৌ পাওয়া হলো। মিউটীনি প্রায় সমুদায় সেপাইরে ফাঁসিতে, তোপেতে ও তলওয়ারের মুখেতে শেষ হোলেন—অবশিষ্টেরা ক্যানিংয়ের পলিসিতে ক্ষমা প্রার্থনা করে বেঁচে গ্যালেন।
ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী পুরোণো বছরের মত বিদেয় হলেন—কুইন স্বরাজ্য খাস প্রক্লেম কল্লেন; বাজী, তোপ ও আলোর সঙ্গে মায়াবিনী আশা ‘কুইনের খাসে প্রজার দুঃখ রবে না’ বাড়ী বাড়ী গেয়ে বেড়াতে লাগলেন; গর্ভবতীর যত দিন একটা না হয়ে যায়, তত দিন যেমন ‘ছেলে কি মেয়ে’ লোকের মনে সংশয় থাকে, সংসার কুইনের প্রোক্লেমেশনে সেইরূপ অবস্থায় স্থাপিত হলো।
মিউটীনির হুজুক শেষ হলো–বাঙ্গালীর ফাঁসী-ছেঁড়া অপরাধীর মত সে যাত্রা প্রাণে প্রাণে মান বাঁচালেন; কারু নিরপরাধে প্রাণদণ্ড হলো, কেউ অপরাধী থেকেও জায়গীর পেলেন। অনেক বামুনে-কপাল ফলে উঠলো; যখন যার কপাল ধরে—ইত্যাদি কথার সার্থকতা হলো। রোগ, শোক ও বিপদে যেমন লোকে পতিগত স্ত্রীর মুল্য জানতে পারে, সেইরূপ মিউটীনির উপলক্ষে গবর্ণমেণ্টও বাঙ্গালী শব্দের কথঞ্চিৎ পদার্থ জানতে অবসর পেলেন; ‘শ্রীবৃদ্ধিকারীরা’ আশা ও মানভঙ্গে অন্তরে বিষম জ্বালায় জ্বলিতেছিলেন, এক্ষণে পোড়া চক্ষে বাঙ্গালীদের দেখতে লাগলেন–আমরাও স্কুল ছাড়লেম। আঃ! বাঁচলেম—গায়ে বাতাস লাগলো।
১.১০ মরা-ফেরা
আমরা ছেলেবেলাতেই জ্যাঠার শিরোমণি ছিলেম; স্কুল ছাড়াতে জ্যাঠামি, ভাতের ফ্যানের মতন, উথলে উঠলো; (বোধ হয় পাঠকেরা এই হুতোমপ্যাঁচার নক্সাতেই আমাদের জ্যাঠামির দৌড় বুঝতে পেরে থাকবেন) আমরা প্রলয়-জ্যাঠা হয়ে উঠলেম—কেউ কেউ আদর করে ‘চালাকদাস’ বলে ডাকতে লাগলেন।
ছেলেবেলা থেকেই আমাদের বাঙ্গালা ভাষার উপর বিলক্ষণ ভক্তি ছিল, শেখবারও অনিচ্ছা ছিল না। আমরা পূর্ব্বেই বলেছি যে, আমাদের বুড়ো ঠাকুরমা ঘুমোবার পূর্ব্বেই নানাপ্রকার উপকথা কইতেন। কবিকঙ্কণ, কৃত্তিবাস ও কাশীদাসের পয়ার আওড়াতেন। আমরাও সেইরূপ মুখস্থ করে স্কুলে, বাড়ীতে ও মার কাছে আওড়াতেম–মা শুনে বড় খুসী হতেন ও কখন কখন আমাদের উৎসাহ দেবার জন্যে ফি পয়ার পিছু একটি করে সন্দেশ প্রাইজ দিতেন; অধিক মিষ্টি খেলে তোৎলা হতে হয়, ছেলেবেলায় আমাদের এ সংস্কার ছিল; সুতরাং কিছু আমরা আপনারা খেতুম, কিছু কাগ ও পায়রাদের জন্যে ছাদে ছড়িয়ে দিতুম। আর আমাদের মঞ্জুরী বলে দিব্বি একটি সাদা বেড়াল ছিল, (আহা! কাল সকালে সেটি মরে গ্যাছে—বাচ্চাও নাই) বাকী সে প্রসাদ পেতো। সংস্কৃত শেখাবার জন্যে আমাদের এক জন পণ্ডিত ছিলেন, তিনি আমাদের লেখা-পড়া শেখাবার জন্যে বড় পরিশ্রম কত্তেন। ক্রমে আমরা চার বছরে মুগ্ধবোধ পার হলেম, মাঘের দুই পাত ও রঘুর তিন পাত পড়েই আমাদের জ্যাঠামোর সুত্র হলো; টিকী, ফোঁটা ও রাঙ্গা বনাতওয়ালা টুলো ভট্টাচাৰ্য্য দেখলেই তক্ক কৰ্ত্তে যাই, ছোঁড়াগোচের ঐ রকম বেয়াড়া বেশ দেখতে পেলেই তর্কে হারিয়ে টিকী কেটে নিই; কাগজে প্রস্তাব লিখি–পয়ার লিখতে চেষ্টা করি ও অন্যের লেখা প্রস্তাব থেকে চুরি করে আপনার বলে অহঙ্কার করি—সংস্কৃত কলেজ থেকে দূরে থেকেও ক্রমে আরও ঠিক একজন। সংস্কৃত কলেজের ছোকরা হয়ে পড়লেম; গৌরবলাভেচ্ছা হিন্দুকুশ ও হিমালয় পর্ব্বত থেকেও উঁচু হয়ে উঠলো—কখন বোধ হতে লাগলো, কিছুদিনের মধ্যে আমরা দ্বিতীয় কালিদাস হবো; (ওঃ বিষ্ণু, কালিদাস বড় লম্পট ছিলেন) তা হওয়া হবে না, তবে ব্রিটনের বিখ্যাত পণ্ডিত জনসন? (তিনি বড় গরীবের ছেলে ছিলেন, সেটি বড় অসঙ্গত হয়)। রামমোহন রায়? হাঁ, একদিন রামমোহন রায় হওয়া যায় কিন্তু বিলেতে মত্তে পারবো না।
ক্রমে কি উপায়ে আমাদের পাঁচজনে চিনবে, সেই চেষ্টাই বলবর্তী হলো; তারি সার্থকতার জন্য আমরা বিদ্যোৎসাহী সাজলেম—গ্রন্থকার হয়ে পড়লেম—সম্পাদক হতে ইচ্ছা হলো—সভা কল্লেম—ব্রাহ্ম হলেম-তত্ত্ববোধিনী সভায় যাই—বিধবাবিয়ের দলাদলি করি ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রভৃতি বিখ্যাত দলের লোকদের উপাসনা করি—আন্তরিক ইচ্ছে যে, লোকে জানুক যে, আমরাও ঐ দলের ছোট খাট কেষ্ট বিষ্টুর মধ্যে।
হায়! অল্পবয়সে এক একবার অবিবেচনার দাস হয়ে আমরা যে সকল পাগলামো করেছি, এখন সেইগুলি স্মরণ হলে কান্না ও হাসি পায়; অবিরি এখন যে পাগলামী প্রকাশ কচ্চি, এর জন্য বৃদ্ধবয়সে অনুতাপ তোলা রইলো! মৃত্যু-শয্যার পাশে যবে এইগুলির ভয়ানক ছবি দেখা যাবে, ভয়ে ও লজ্জায় শরীর দাহ কত্তে থাকবে, তখন সেই অনন্য-আশ্রয় পরমেশ্বর ভিন্ন আর জুড়াবার স্থান পাওয়া যাবে না! বাপ-মার কাছে মার খেয়ে ছেলেরা যেমন তাঁদেরই নাম করে, ‘বাবা গো–মা গো, বলে কাঁদে, আমরা তেমনি সেই ঈশ্বরের অজ্ঞা লঙ্ঘননিবন্ধন বিপদে পড়ে তার নাম ধরেই,—পাঠক! তোমায় ভেংচুতে ভেংচুতে ও কলা দেখাতে দেখাতে তরে যাব।
প্রলয় গৰ্ম্মিতে আমরা একদিন মোটা চাদর গায়ে দিয়ে ফিলজফর সেজে বেড়াচ্ছি, এমন সময়ে নদে অঞ্চলের একজন মুহুরি বল্লে যে, “আমাদের দেশে হুজুক উঠেছে, ১৫ই কার্ত্তিক রবিবার দিন দশ বছরের মধ্যের মরা মানুষরা যমালয় থেকে ফিরে আস্বে”—জন্মের মধ্যে কৰ্ম্ম নিমুর চৈত্র মাসে রাসের মত সহরের বেণেবাবুরা সিংহবাহিনী ঠাকরুণের পালায় যেমন ছোট আদালতের দু চার কয়েদী খালাস কবেন, সেই রকম স্বর্গের কোন দেবতা আপনার ছেলের বিবাহ উপলক্ষে যমালয়ের কতকগুলি কয়েদী খালাস করবেন; নদের রামশর্মা অচার্য্যি স্বয়ং গুণে বলেছেন। আমরা এই অপরূপ হুজুক শুনে তাক হয়ে রইলেম! এদিকে সহরেও ক্রমে গোল উঠলো ‘১৫ই কার্ত্তিক মরা ফিরবে।’ বাঙ্গালা খবরের কাগজওয়ালারা কাগজ পুরাবার জিনিস পেলেন—একটি গেরো দিলে পূর্ব্বের গেরোটি যেমন আল্গা হয়ে যায়, বিধবাবিবাহ প্রচার করাতে সহরের ছোট ছোট বিধবাদের বিদ্যাসাগরের প্রতি যে ভক্তিটুকু জন্মেছিল, সেটুকু সেই প্রলয় হুজুকে ঋতুগত থারমোমিটরের পারার মত একেবারে অনেক ডিগ্রী নেবে গিয়ে, বিলক্ষণ টিলে হয়ে পড়লো।
সহরে যেখানে যাই সেইখানেই মরা ফেরবার মিছে হুজুক! আশা নির্ব্বোধ স্ত্রী ও পুরুষদলের প্রিয়সহচরী হলেন। জোচ্চোর ও বদমাইসেরা সময় পেয়ে গোছাল গোছাল জায়গায় মরা ফেরা সেজে যেতে লাগলো; অনেক গেরেস্তোর ধর্ম্ম নষ্ট হলো—অনেকের টাকা ও গয়না গেল। ক্রমে আষাঢ়ান্ত বেলার সন্ধ্যার মত–শোকাতুরের সময়ের মত, ১৫ই কার্ত্তিক নবাবিচালে এসে পড়লেন। দুর্গোৎসবের সময়ে সন্ধিপূজোর ঠিক শুভক্ষণের জন্য পৌত্তলিকেরা যেমন প্রতীক্ষা করে থাকেন, ডাক্তারের জন্য মুমূর্ষ রোগীর আত্মীয়েরা যেমন প্রতীক্ষা করে থাকেন ও স্কুলবয় ও কুঠিওয়ালারা যেমন ছুটীর দিন প্রতীক্ষা করেন—বিধবা ও পুত্রসহোদরবিহীন নির্ব্বোধ পরিবারেরা সেই রকম ১৫ই কার্ত্তিকের অপেক্ষা কবেছিলো। ১৫ই কার্ত্তিকই দিল্লীর লাড্ডু হয়ে পড়লেন—যাঁরা পূর্ব্বে বিশ্বাস করেন নি, ১৫ই কার্ত্তিকের আড়ম্বর ও অনেকের অতুল বিশ্বাস দেখে তাঁরাও দলে মিশলেন। ছেলেবেলা আমাদের একটি চিনের খরগোশ ছিল; আজ বছর অষ্টেক হলো, সেটি মরেচে–ভাঙ্গা পিঁজয়ের মাটী ঝেড়ে ঝুড়ে, তুলো পেড়ে বিছানা টিছানা করে তার অপেক্ষায় রইলেম।
১৫ই কার্ত্তিক মরা ফিরবে কথা ছিল, আজ ১৫ই কার্ত্তিক। অনেকে মরার অপেক্ষায় নিমতলা ও কাশীমিত্রের ঘাটে বসে রইলেন। ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে গেল, রাত্রি দশটা বাজে, মরা ফির্ল না; অনেকে মরার অপেক্ষায় থেকে মড়ার মত হয়ে রাত্তিরে ফিরে এলেন; মরা ফেরার হুজুক থেমে গেল।
১.১১ আমাদের জ্ঞাতি ও নিন্দুকেরা
আমরা ক্রমে বিলক্ষণ বড় হয়ে উঠলেম, দু-চার জন আমাদের অবস্থার হিংসে কত্তে লাগলেন, জ্ঞাতিবর্গের বুকে ঢেঁকি পড়তে লাগলো–আমাদের বিপদে মুচ্কি হাসে ও আমোদ করেন, তাদের এক চোখ কাণা হয়ে গেলে যদি আমাদের দু চক্ষু কাণা হয়, তাতে এক চক্ষু দিতে বিলক্ষণ প্রস্তুত–সতীনের বাটিতে গু গুলে খেতে পারলে তার বাটিটি নষ্ট হয়, স্বয়ং না হয়, গু গুলেই খেলেন! জ্ঞাতি বাবু ও বিবিদেরও সেই রকম ব্যবহার বেরুতে লাগলো। লোকের আঁটকুড়ো হয়ে বনে একা থাকা ভাল, তবু আমাদের মতন জ্ঞাতির সঙ্গে এক ঘর ছেলে পুলে নিয়ে বাস করা কিছু নয়! আমাদের জ্ঞাতিরা দুর্য্যোধনের বাবা–তাদের মেয়েরা কৈকেয়ী ও সুর্পণখা হতেও সরেস! ক্ৰমে এক দল শক্র জন্মালেন, একদল ফ্রেণ্ডও পাওয়া গেল। যাঁরা শক্রর দলে মিশলেন, তাঁরা কেবল আমাদের দোষ ধরে নিন্দে কত্তে আরম্ভ কল্লেন। ফ্রেণ্ডরা সাধ্যমত ডিফেণ্ড কত্তে লাগলেন, শত্তুররা খাওয়া দাওয়া ও শোয়ার সঙ্গে আমাদের নিন্দে করা সংকল্প করেছিলেন, সুতরাং কিছুতেই থামলেন না; আমরাও অনেক সন্ধান করে দেখলুম যে, যদি তাদের কোন কালে অপরাধ করে থাকি, তা হলে অবশ্যই আমাদের উপর চটতে পারেন; কিছুই খুঁজে পেলুম না, বরং সন্ধানে বেরুলো যে, নিন্দুকদলের অনেকের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ পৰ্যন্তও নাই। লোকের সাধ্যমত উপকার করা যেমন কতকগুলির চিরন্তন ব্রত সেইরূপ বিনা দোষে নিন্দা করাও সহরের কতকগুলি লোকের কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম ও ব্রতের মধ্যে গণ্য;—আমরা প্রার্থনা করি, নিন্দুকরা কিছুকাল বেঁচে থাকুন, তা হলেই অনেকে তাদের চিনে নেবেন ও বক্তারা যেমন বকে বকে শেষে ক্লান্ত হয়ে আপনা আপনিই থামেন এরা আপনা আপনি থামবেন। তবে অনেকের এই পো বলেই যা হোক–পেসাদারের কথা নাই।
নানা সাহেব
মরা ফেরা হুজুক থামলে, কিছু দিন নানা সাহেব দশ বারো বার মরে গেলেন, ধরা পড়লেন, আবার রক্তবীজের মত বাঁচলেন। সাতপেয়ে গরু–দরিয়াই ঘোড়া–লক্ষ্ণৌয়ের বাদ্সা—শিবকেষ্টো বাঁড়ু্য্যে–ওয়েলস সাহেব–নীলবানুরে লঙ্কাকাণ্ডে লংএর মেয়াদ–কুমীর, হাঙ্গর ও নেকড়ে বাঘের উৎপাতের মত ইংলিশম্যান ও হরকরা নামক দুখানি নীল কাগজের উৎপত্তি—ব্রাহ্মধর্ম্মপ্রচারক রামমোহন রায়ের স্ত্রীর শ্রাদ্ধে দলাদলির ঘোঁট ও শেষে হঠাৎ অবতারের হুজুক বেড়ে উঠলো।
১.১৩ সাতপেয়ে গরু
সাতপেয়ে গরু বাজারে ঘর ভাড়া কল্লেন, দর্শনী দু পয়সা রেট হলো; গরু রাখবার জন্য অনেক গরু একত্র হলেন। বাকি গরুদের ঘণ্টা বাজিয়ে ডাকা হতে লাগলো, কিছুদিনের মধ্যে সাতপেয়ে গরু বিলক্ষণ দশ টাকা রোজগার করে দেশে গেলেন!
১.১৪ দরিয়াই ঘোড়া
দরিয়াই ঘোড়াও ঐ রকম রোজগার কত্তে লাগলেন; বেশীর মধ্যে বিক্রী হবার জন্যে দু-চার মাথালো মাখালো থামওলা সেপাইপাহারা ও গোরা কোচম্যান (যেখানে অন্দর মহলেও ঘোড়ার সর্ব্বদা সমাগম) ওয়ালা বাড়ীতে গমনাগমন কল্লেন। কে নেবে? লাখ টাকা দর! আমাদের সহরের কোন কোন বড়মানুষের যে ত্রিশ চল্লিশ লাখ টাকা দর, পিঁজরেয় পূরে চিড়িয়াখানায় রাখবারও তাঁরা বিলক্ষণ উপযুক্ত; কিন্তু কৈ? নেবার লোক নাই। এখন কি আর সৌখীন আছে? বাঙ্গালাদেশে চিড়িয়াখানার মধ্যে বর্দ্ধমানের তুল্য চিড়িয়াখানা আর কোথাও নাই—সেথায় তত্ত্ব, বৃত্ন, লস্কার, উল্লুক, ভাল্লুক, প্রভৃতি নানা রকম আজগুবি কেতার জানোয়ার আছে, এমন কি, এক আধটির জোড়া নাই।
১.১৫ লক্ষ্ণৌয়ের বাদসা
দরিয়াই ঘোড়া কিছুদিন সহরে থেকে, শেষে খেতে না পেয়ে দরিয়ায় পালিয়ে গেলেন। লক্ষ্ণৌয়ের বাসা দরিয়াই ঘোড়ার জায়গায় বসলেন—সহরে হুজুক উঠলো, লক্ষ্ণৌয়ের বা মুচিখোলায় এসে বাস করচেন, বিলাতে যাবেন; বাদসার বাইয়ানা পোষাক, পায়ে আলতা।” কেউ বল্লে, “রোগা ছিপছিপে, দিব্বি দেখতে ঠিক যেন একটা অপ্সরা।” কেউ বল্লে, “আরে না, বাদসাটা একটা কূপোর মত মোটা, ঘাড়ে গদ্দানে, গুণের মধ্যে বেশ গাইতে পারে!” কেউ বল্লে, “আঃ।–ও সব বাজে কথা, যে দিন বাদসা পার হন, সে দিন সেই ইষ্টিমারে আমিও পার হয়েছিলেম, বাদশাহ শ্যামবর্ণ, একহারা, নাকে চসমা ঠিক আমাদের মৌলবী সাহেবের মত।” লক্ষ্ণৌয়ে বাদসা কয়েদ থেকে খালাস হয়ে মুচিখোলায় আসায় দিনকতক সহর বড় গুলজার হয়ে উঠলো। চোর বদমাইসেরাও বিলক্ষণ দশ টাকা উপায় করে নিলে; দোকানদারদেরও অনেক ভাঙ্গা পুরোণো জিনিষ বেধড়ক দামে বিক্রী হয়ে গেল; দুই এক খ্যামটাওয়ালী বেগম হয়ে গেলেন! বাদসা মুচিখোলার অৰ্দ্ধেকটা জুড়ে বসলেন। সাপুড়েরা যেমন প্রথম বড় বড় কেউটে সাপ ধরে হাঁড়ির ভেতর পূরে রাখে, ক্রমে তেজ-মরা হয়ে গেলে খেলাতে বার করে, গবর্ণমেণ্টও সেই রকম প্রথমে বাদসাকে কিছু দিন কেল্লায় পূরে রাখলেন, শেষে বিষ-দাত ভেঙ্গে তেজের হ্রাস করে, খেলতে ছেড়ে দিলেন। বাদসা ডম্বরু তালে খেলতে লাগলেন; সহরের রুদ্দর, ভদ্দর, সেখ, খাঁ, দাঁ প্রভৃতি ধড়িবাজ পাইকো মাল সেজে কাঁদুনী গাইতে লাগলেন–বানর ও ছাগলও জুটে গেল।
লক্ষ্ণৌয়ের বাসা জমি নিলেন, দুই এক বড়মানুষ ক্ষ্যাপলা জাল ফেল্লেন—অনেক প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু শেষে জলখানা পর্যন্ত উঠলো না–কেউ বল্লে, “কেঁদো মাছ।” কেউ বল্লে, হয় “রাণা’ নয় ‘খোঁটা’!
১.১৬ শিবকৃষ্ট বন্দ্যোপাধ্যায়
হুজুক রঙ্গে শিবকেষ্ট বাঁড়ুয্যে দেখা দিলেন। বাবু দিন কত বড় বেড়েছিলেন; আজ একে চাবুক মারেন, পাঠান ঠেকিয়ে জুতো মারেন, আজ মেডুয়াবাদী খোট্টা ঠকান, কাল টুপিওয়ালা সাহেব ঠকান-শেষ আপনি ঠকলেন! জালে জড়িয়ে পড়ে বাঙ্গালীর কুলে কালি দিয়ে, চোদ্দবছরের জন্য জিঞ্জির গেলেন। কোন কোন সায়েব পয়সার জন্য না করেন হেন কর্ম্মই নাই; সেটা শিবকেষ্টবাবুর কল্যাণে বেরিয়ে পড়লো–একজন “এম, ডি, এফ, আর, সি, এস” প্রভৃতি বত্রিশ অক্ষরের খেতাবওয়ালা ডাক্তার ঐ দলে ছিলেন।
১.১৭ ছুঁচোর ছেলে বুঁচো
আমাদের সহরে বড়মানুষদের মধ্যে অনেকের অর্গুণ নাই, বর্গুণ আছে। “ভাল কত্তে পারবো মন্দ করবো, কি দিবি তা দে”! যে ভাষা আছে, এঁরা তারই সার্থকতা করেছেন—বাবুরা পরের ঝক্ড়া টাকা দিয়ে কিনে, ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’ হতে চান—অনেকে আড়ি তুলতেও এই পেশা আশ্রয় করেচেন! যদি এমন পেশাদার না থাকতো, তা হলে শিবকেষ্টোর কে কি কত্তে পাত্তো? তিনি কেবল ভাজকে ও ভাইপোকে ঠকিয়ে বিষয়টি আপনি নিতে চেষ্টা করছিলেন বৈ তো নয়। আমাদের কলকেতা সহরের অনেক বড়মানুষ যে, স্ত্রীকে ডাক্তার দিয়ে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেও গায়ে ফুঁ দিয়ে গাড়ী ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছেন, কৈ, আইন তার কাছে কল্কে পায় না কেন? শিবকেষ্টো যেমন জাল করেছিলেন, বোধ হয় সহরের অনেক বড়মানুষের ঘরে ও রকম কত পার হয়ে গ্যাছে ও নিত্যি কত হচ্ছে! সহরের একটি কাশ্মীরী মুখখু বড় মানুষ আক্ষেপ করে বলছিলেন যে, “সহরে আমার মত কত ব্যাটাই আছে, কেবল আমিই ধরা পড়েছিলাম।” শিবকেষ্টোর বিষয়েও ঠিক তাই।
১.১৮ জষ্টিস ওয়েলস
শিবকেষ্টোর মোকদ্দমার মুখে জষ্টিস ওয়েলস নতুন ইণ্ডেণ্ট হন। তাঁর সংস্কার ছিল, বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রায় সকলেই মিথ্যাবাদী ও জালবাজ; সুতরাং মোকদ্দমা করবার সময়ে যখন চার পা তুলে বক্তৃতা কত্তেন, তখন প্রায়ই বলতেন, “বাঙ্গালীরা মিথ্যাবাদী ও বর্বরের জাতি!” এতে বাঙ্গালীরা অবশ্যই বলতে পারেন, “শতকরা দশ জন মিথ্যাবাদী বা বব্বলে হল যে আশী নব্বই জনও মিথ্যাবাদী হবেন, এমন কোন কথা নাই।” চার দিকে অসন্তোষের গুজগাজ পড়ে গেল, বড় দলের মোড়লেরা হাতে কাগজ পেলেন, ‘তেঁই ঘোঁটের’ যত মাথালো মাথালো জায়গায় ঘোঁট পড়ে গেল; শেষে অনেক কষ্টে একটি সভা করে সার চার্লস কাষ্ঠ মহাশয়ের নিকট দরখাস্ত করাই এক প্রকার স্থির হলো। কিন্তু সভা কোথায় হয়, বাঙ্গালীদের তো এক পদও সাধারণের স্থান নাই; টাউনহল সাহেবদের, নিমতলার ছাতখোলা হল গবর্মেন্টের, কাশী মিত্তিরের ঘাটে হল নাই; প্রসন্নকুমার ঠাকুর বাবুর ঘাটের চাঁদনীতে হতে পারে, কিন্তু ঠাকুর বাবুর পাঁচজন সাহেব সুবোর সঙ্গে আলাপ আছে, সুতরাং তাও পাওয়া কঠিন। শেষে রাজা রাধাকান্তের নবরত্নের নাট-মন্দিরই প্রশস্ত বলে সিদ্ধান্ত হলো। কাগজে বিজ্ঞাপন বেরুলো, “অমুক দিন রাজা রাধাকান্ত বাহাদুরের নবরত্নের নাটমন্দিরে ওয়েলস জজের মুখরোগের চিকিৎসা করবার জন্যে সভা করা হবে। ঔষধ সাগরে রয়েছে।”
সহরের অনেক বড় মানুষ—তাঁরা যে বাঙ্গালীর ছেলে, ইটি স্বীকার কত্তে লজ্জিত হন; বাবু চুনোগলির আনড্রু পিদ্রুসের পৌত্তর বল্লে তারা বড় খুশী হন। সুতরাং যাহাতে বাঙ্গালীর শ্রীবৃদ্ধি হয়, মান বাড়ে, সে সকল কাজ থেকে দূরে থাকেন। তদ্বিপরীত নিয়তই স্বজাতির অমঙ্গল চেষ্টা করে থাকেন। রাজা রাধাকান্তের নাটমন্দির ওয়েলসের বিপক্ষে বাঙ্গালীরা সভা করবেন শুনে তারা বড়ই দুঃখিত হলেন; খানা খাবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সময় মনে পড়ে গেল; যাতে ঐ রকম সভা না হয়, কায়মনে তাই চেষ্টা কর্ত্তে লাগলেন। রাজা বাহাদুরের কাছে সুপারিশ পড়লো, রাজা বাহাদুর সত্যব্রত, একবার কথা দিয়েছেন, সুতরাং উঁচুদলের সুপারিশ হলেও সহসা রাজী হলেন না। সুপারিশওয়ালারা জোয়ারের গুয়ের মত সাগরের প্রবল তরঙ্গে ভেসে চল্লো। নিরূপিত দিনে সভা হলো, সহরের লোক রৈ রৈ করে ভেঙ্গে পড়লো, নবরত্নের ভিতরের বিগ্রহ ও নাটমন্দিরের সামনের যোড় হস্ত-করা পাথরের গড়ুরেরও আহ্লাদের সীমা রহিল না। বাঙ্গালীদের যে কথঞ্চিৎ সাহস জন্মেছে, এই সভাতে তার কিছু প্রমাণ পাওয়া গেল। একবল সুপারিশওয়ালা বাবুরা ও সহরের সোণার বেণে বড়মানুষের এই সভায় আসেন নাই; সুপারিশওয়ালাদের থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে গেল! বেণে বাবুরা কোন কাজেই মেশেন না, সুতরাং তাঁদের কথাই নাই। ওয়েলস হুজুকের অনেক অংশে শেষ হলো দশ লক্ষ লোকে সই করে এক দরখাস্ত কাষ্ঠ সাহেবের কাছে প্রদান কল্লেন; সেই অবধি ওয়েলসও ব্রেক হলেন।
১.১৯ টেকচাঁদের পিসি
টেকচাঁদ ঠাকুরের টেপী পিসি ওয়েলসের মুখরোগের তরে মিটিং করা হয়েছে শুনে বল্লেন, “ও মা, আজ কাল সবই ইংরিজি কেতা! আমরা হলে মুড়োমুড়ি নারকেলমুড়ি ও ঠনঠনের নিমকীতে দোরস্ত কত্তেম!” নারকেলমুড়ি বড় উত্তম, ওষুধ, হলওয়েলের বাবা! আমাদের সহরের অনেক বড়মানুষ ও দুই এক জেলার ধিরাজ মহারাজা বাহাদুর নিয়তই রোগভোগ করে থাকেন। দার্জিলিং, সিম্লে, সপাটু, ভাগলপুর ও রাণীগঞ্জে গিয়েও শোধরাতে পারেন না; আর তাদের অনুরোধ করি, নারিকেলমুড়ি ও ঠনঠনের নিমকীটাও ট্রাই করুন! ইমিজিয়েট রিলিফ।
১.২০ পাদ্রি লং ও নীলদর্পণ
নীলকর হাঙ্গামা উঠলো; শোনা গেল, কৃষ্ণনগর, পাবনা, রাজসাই প্রভৃতি নীলজেলার রেয়োতেরা ক্ষেপেছে। কে তাদের ক্ষ্যাপালে? কি উলুই চণ্ডী? না শ্যামচাঁদ? তবে–‘ম্যাজিষ্ট্রেট ইডেনের ইস্তাহারে’ ‘ইণ্ডিগো-কমিশনে’ ‘হরিশে’ ‘লংএ’ ‘ছোট আদালতে’ ‘কন্টাক্টরিতে’ অবশেষে গ্রান্টের রিজাইনমেন্টে রোগ সারতে পারেন? না! কেবল শ্যামচাঁদিরা সল্লে!
নীলকর সাহেবের দ্বিতীয় রিভোলিউসন হবে বিবেচনা করে (ঠাকুঘরে কে? না আমি কলা খাইনি) গভর্ণমেণ্ট তোপ ও গোরা সাহায্য চেয়ে পাঠালেন! রেজিমেণ্টকে রেজিমেণ্ট গোরা, গণ্, বোট ও এম্পেশিয়াল কমিশনর চল্লো;–মফস্বলের জেলে আর নিরপরাধীর জায়গা হয় না, কাগজে হুলথুল পড়ে গেল ও আণ্টর ব্রেড অবতার হয়ে পড়লেন।
প্রজার দুরবস্থা শুনতে ইণ্ডিগো-কমিশন বসলো, ভারতবর্ষীয় খুড়ীর চমকা ভেঙ্গে গেল। (খুড়ী একটু আফিম খান।) বাঙ্গালীর হয়ে ভারতবর্ষীয় খুড়ীর একজন খুড়ো কমিশনর হলেন। কমিশনে কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়লো। সেই সাপের বিষে নীলদর্পণ জন্মালো; তার দারুণ নীলকর-দল হন্নে হয়ে উঠলেন—ছাইগাদা, কচুবন, ও ফ্যানগোঁজলা ছেড়ে দিয়ে ঠাকুর-ঘরে, গিরজেয়, প্যালেসে ও প্রেসে ত্যাগ কল্লেন! শেষে ঐ দলের একটা বড় হঙ্গেরিয়ান হাউণ্ড পাদরী লং সাহেবকে কামড়ে দিলে।
প্যায়দারা পর্যন্ত ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হয়ে মফস্বলে চল্লেন। তুমুল কাণ্ড বেধে উঠলো। বাদাবুনে বাঘ (প্ল্যানটারস এসোসিয়েসন) বেগতিক দেখে নাম বদলে ল্যাণ্ডহোল্ডারস এসোসিয়েশন তুলসীবনে ঢুকলেন। হরিশ মলেন। লংএর মেয়াদ হলো। ওয়েলস্ ধমক খেলেন। গ্রাণ্ট রিজাইন দিলেন—তবু হুকুক মিটলো না। প্রকৃত বাঁদুরে হাঙ্গমে বাজারে নানা রকম গান উঠলো; চাষার ছেলেরা লাঙ্গল ধরে, মূলো মুড়ি খেতে খেতে —
গান
সুর—“হাঃ শালার গরু; তাল টিটকিরি ও ল্যাজমলা।”
উঠলো সে সুখ, ঘটলো অসুখ মনে, এত দিনে।
মহারাণীর পুণ্যে মোরা ছিলাম সুখে এই স্থানে।।
উঠলো খামার ভিটে ধান, গেল মানী লোকের মন,
হ্যানো সোনার বাংলা গান, পোড়ালে নীল হনুমানে।।
গাইতে লাগলো। নীরকরেরা এর উত্তরে ক্যাটল্ট্রেসপস বিল পাস করে, কেউ কোন কোন ছোট আদালতের উকীল জজদের শ্যামপীন খাইয়ে ও ঘরঘ্যাঁস করে, কেউ বা খাজনা বাজিয়ে, খেউরে জিতে কথঞ্চিৎ গায়ের জ্বালা নিবারণ কল্লেন।
নীলবানুরে লঙ্কাকাণ্ডের পালা শেষ হয়ে গেল, মোড়লেরা জিরেন পেলেন; ভারতবর্ষীয় খুড়ী এক মৌতাত চড়িয়ে আরাম কত্তে লাগলেন। কোন কোন আশাসোটাওয়ালা খেতাবী খুড়ো, অনুরেরী চৌকিদারী, তথা ছেলেপুলের আসেসরী ও ডেপুটী ম্যাজেষ্ট্ররীর জন্য সাদা দেবতার উদ্দেশ্যে কঠোর তপস্যায় নিযুক্ত হলেন। তথাস্তু!!
শ্যামচাঁদের অসহ্য টরচরে ভূত পালায়, প্রজারা খেপে উঠবে কোন কথা! মিউটীনি ও ক্লার্ক অ্যাকটের সভাতে তো শ্রীবৃদ্ধিকারীরা চটেই ছিলেন; নীলবানুরে হাঙ্গামে সেইটি বদ্ধমূল হয়ে পড়লো। বড় ঘরে সতীশ হলে, বড় বৌ ও ছোট বৌকে তুষ্ট কর্ত্তে কৰ্ত্তা ও গিন্নীর যেমন হাড় ভাজা ভাজা হয়ে যায়; শ্রীবৃদ্ধিকারী, সুইপিং ক্লাস ও নেটীভ কমিউনিটীকে তুষ্ট কত্তে গিয়ে, ইণ্ডিয়া ও বেঙ্গল গবর্ণমেণ্ট ও সেই রকম অবস্থায় পড়লেন।
১.২১ রমাপ্রসাদ রায়
হুতোমের পাঠক! আমরা আপনাদের পূর্ব্বেই বলে এসেছি যে, সময় কাহারও হাত ধরা নয়, সময় নদীর জলের ন্যায়, বেশ্যার যৌবনের ন্যায়, জীবনের পরমায়ুর ন্যায়; কারুরই অপেক্ষা করে না। দেখতে দেখতে আমরা বড় হচ্চি, দেখতে দেখতে বছর ফিরে যাচ্চে; কিন্তু আমাদের প্রায় মনে পড়ে না যে, ‘কোন্ দিন যে, মত্তে হবে তার স্থিরতা নাই।’ বরং যত বয়স হচ্চে ততই, জীবিতাশা বশবর্তী হচ্চে; শরীর তোয়াজে রাখচি, আরসি ধরে শোননুটীর মত পাকা গোঁপে কলপ দিচ্চি, সিমলের কালাপেন্ডের বেহ বাহারে বঞ্চিত হতে প্রাণ কেঁদে উঠচে। শরীর ত্রিভঙ্গ হয়ে গিয়েছে, চশমা ভিন্ন দেখতে পাইনে, কিন্তু আশা ও তৃষ্ণা তেমনি রয়েচে, বরং ক্রমে বাড়ছে বই কমছে না। এমন কি, অমর বর পেয়ে প্রকৃতির সঙ্গে চিরজীবী হলেও মনের সাধ মেটে কি না সন্দেহ। প্রচণ্ড রৌদ্রক্লান্ত পথিক অভীষ্ট প্রদেশে শীঘ্র পৌঁছিবার জন্য একমনে হন হন করে চলেছেন, এমন সময় হঠাৎ যদি একটা গেঁড়ি-ভাঙ্গা কেউটে রাস্তায় শুয়ে আছে দেখতে পান, তা হলে তিনি যেমন চমকে ওঠেন, এই সংসারে আমরাও কখন কখন মহাবিপদে ঐ রকম অবস্থায় পড়ে থাকি। তখন এই হৃদয়ের চৈতন্য হয়। উল্লিখিত পথিকের হাতে সে সময় এক গাছ মোটা লাঠি থাকলে তিনি যেমন সাপটাকে মেরে পুনরায় চলতে আরম্ভ করেন, আমরাও মহাবিপদে প্রিয়বন্ধুদের পরামর্শ ও সাহায্যের তরে যেতে পারি; কিন্তু যে হতভাগ্যের এ জগতে বন্ধু বলে আহ্বান করবার একজনও নাই, বিপৎপাতে তার কি দুর্দশাই না হয়। তখন তার এ জগতে ঈশ্বরই একমাত্র অনন্যগতি হয়ে পড়েন। ধৰ্ম্মের এমনি বিশুদ্ধ জ্যোতি-এমনি গম্ভীর ভাব যে, তার প্রভা-প্রভাবে ভয়ে ভণ্ডামো, নাস্তিকতা বজ্জাতি সরে পলায়—চারিদিকে স্বর্গীয় বিশুদ্ধ প্রেমের স্রোত বহিতে থাকে—তখন বিপদসাগর জননীর স্নেহময় কোল হতেও কোমল বোধ হয়। হায়! সেই ধন্য, যে নিজ বিপদ সময়ে এই বিমল আনন্দ উপভোগ করবার অবসর পেয়ে, আপনা আপনি ধন্য ও চরিতার্থ হয়েছে। কারণ, প্রবল আঘাতে একবার পাষাণের মর্ম ভেদ কত্তে পাল্লে চিরকালেও মিলিয়ে যায় না।
ক্রমে ক্রমে আমরাও বড় হয়ে উঠলেম–ছলনা কু-আশায় আবৃত, আশার পরিসরশূন্য, সংসার সাগরের ভয়ানক শব্দ শোনা যেতে লাগলো। একদিন আমরা কতকগুলি সমবয়সী একত্র হয়ে, একটা সামান্য বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্ক কচ্চি, এমন সময়ে আমাদের দলের একজন বলে উঠলেন, “আরে আর শুনেছ? রমাপ্রসাদবাবুর মার সপিণ্ডীকরণের বড় ধূম। এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ; সহরের সমস্ত দলে, উদিকে কাশী-কৰ্ণাট পর্য্যন্ত পত্র দেওয়া হবে।” ক্রমে আমরা অনেকের মুখেই শ্রাদ্ধের নানা রকম হুজুক শুনতে লাগলেম। রমাপ্রসাদবাবুর বাপ ব্রাহ্মধর্ম্মপ্রচারক, তিনি স্বয়ং ব্রাহ্মসমাজের ট্রাষ্টি; মার সপিণ্ডীকরণে পৌত্তলিকতার দাস হয়ে শ্রাদ্ধ করবেন শুলে কার না কৌতূহল বাড়ে; সুতরাং আমরা শ্রাদ্ধের আনুপূৰ্ব্বিক নক্সা নিতে লাগলো।
ক্রমে সপিগুনের দিন সংক্ষেপ হয়ে আসতে লাগলো। ক্রিয়াবাড়ীতে স্যা্করা বসে গেল–ফলারে বামুনেরা এপ্রেনটিস নিতে লাগলেন—সংস্কৃত কলেজের ফলারের প্রফেসর রকমারী ফলারের লেকচার দিতে আরম্ভ কল্লেন—বৈদিক ছাত্রেরা ভলমনস নোট লিখে ফেল্লেন। এদিকে চতুষ্পাষ্ঠীওয়ালা ভট্টাচার্য্যের চলিত ও অর্দ্ধ পত্র পেতে লাগলেন। অনাহূত চতুষ্পাঠীহীন ভট্টাচার্য্যের সুপারিশ ও নগদ অর্দ্ধ বিদায়ের জন্য রমাপ্রসাদবাবুর বাড়ী, নিমতলা ও কাশী-মিত্তিরের ঘাট হতেও বাড়িয়ে তুল্লেন–সেথায় বা কটা শুকুনি আছে। এঁদের মধ্যে অনেকের চতুষ্পাঠীতে সংবৎসর ষাঁড় হাগে, সরস্বতী পুজার সময়ে ব্রাহ্মণী ও কোলের মেয়েটি বঙ্গদেশীয় ছাত্র সাজেন, সোলার পদ্ম ও রাংতার সাজওয়ালা ক্ষুদে ক্ষুদে মেটে সরস্বতী অধিষ্ঠান হন; জানিত ভদ্দরলোকদের নেলিয়ে দিয়ে কিছু কিছু পেটে।
ভট্টচার্য্যি মশাইদের ছেলেব্যালা যে কদিন আসল সরস্বতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, তারপর এ জন্মে আর তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় না; কেবল সংবচ্ছর অন্তর একদিন মেটে সরস্বতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ। সেও কেবল, যৎকিঞ্চিৎ কাঞ্চনমূল্যের জন্য।
পাঠকগণ! এই যে উর্দ্দি ও তকমাওয়ালা বিদ্যালঙ্কার, ন্যায়লঙ্কার, বিদ্যাভূষণ ও বিদ্যাবাচস্পতিদের দেখচেন, এঁরা বড় ফ্যালা যান না। এঁরা পয়সা পেলে না করেন, হ্যান কৰ্ম্মই নাই! সংস্কৃত ভাষা এই মহাপুরুষদের হাতে পড়েই ভেবে ভেবে মিলিয়ে যাচ্চেন। পয়সা দিলে বানরওয়ালা নিজ বানরকে নাচায়, পোষাক পরায়, ছাগলের উপর দাঁড় করায়; কিন্তু এর পয়লা পেলে নিজে বানর পর্য্যন্ত সেজে নাচেন! যত ভয়ানক দুষ্কৰ্ম্ম, এই দলের ভিতর থেকে বেরোবে, দায়মালী জেল তন্ন তন্ন কল্লেও তত পাবে না।
আগামী কল্য সপিণ্ডন। আজকাল হিরে দলপতিদের অনকেই কুলপনা-চক্করের দলে পড়েছেন; নামটা ঢাকের মত, কিন্তু ভিতরটা ফাঁকা!–রমাপ্রসাদবাবু হবে প্রধান উকীল, সাহেব সুবোদের বাবুর প্রতি যেরূপ অনুগ্রহ, তাহাতে আর ও কত কি হয়ে পড়বেন; সুতরাং রমাপ্রসাদবাবু দলস্থ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদিগের পত্র দিলে ফিরিয়ে দেওয়াটাও ভাল হয় না, কিন্তু প্রসাদবাবু ও *** প্রভৃতি নানা প্রকার তর্ক-বির্ক চলতে লাগলো। দুই এক টাটকা দলপতি (জোর কলমে মান-অপমানের ভয় নাই) রমাপ্রসাদবাবুর তোয়াক্কা না রেখে আপন দলে আপন প্রোক্লেমেশন দিলেন, প্রোক্লেমেশন দলস্থ ভট্টাচাৰ্য দলে বিতরণ হতে লাগলো। অনেকে দু নৌকায় পা দিয়ে বিষম বিপদে পড়লেন–শানকীর ইয়ারেরা ‘বারে বারে মুরগী তুমি’ দলে ছিলেন, চিরকাল মুখ পুঁচে চলেচে, এইবার মহাবিপদে পড়তে হলো। সুতরাং মিত্তির খুড়ো লিভ নিয়ে হাওয়া খেতে চান। চাটুয্যে শয্যাগত হয়ে পড়েন। দলপতির প্রোক্লেমেশন জুরির শমন ও সফিনে হতেও ভয়ানক হয়ে পড়লো। সে এই–
“শ্রী শ্রীহরি
শরণং।
অসেস শাস্ত্ররত্নাকরপারবরপরম পূজনীয়—
শ্রীল
ভট্টাচাৰ্য মহাশয়গণ–শ্রীচরণেষু।
সেবক শ্রী * চন্দর দাস ঘোষ ধৰ্ম্ম–
সাষ্টাঙ্গে শত সহস্র প্রণীপাত পুরঃসর নিবেদন কার্য্যাণঞ্চাগে শ্ৰীশ্ৰীভট্টাচার্য্য মহাশয়দিগের আশীর্ব্বাদে এ সেবকের প্রাণগতীক কুসল। পরে যে হেতুক ঁরামমোহন রায়ের পুত্র বাবু রমাপ্রসাদ রায় স্বীয় মাতাঠাকুরাণীর একোর্দ্দিষ্ট শ্রাদ্ধে মহাসমারোহ করিতেছে। এই দলের বিখ্যাত কুলীন ও আমার ভগ্নিপতি বাবু ধিনিকৃষ্ট মিত্ৰজা মজকুর সম্যক প্রতিয়মাণ হইয়া জানিয়াছেন যে উক্ত রায় বাবু সহরের সমস্ত দলেই পত্র দিবেন সুতরাং এ দল ও পত্র পাঠাইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। কিন্তু আমাদের শ্রীশ্রী ঁ সভার দলের অনুগত দলের সহিত রায় মজকুবের আহার ব্যাভার চলিত নাই। সুতরাং তিনি পত্র পাঠাইলেও আপনারা তথায় সভাস্থ হইবেন না।
সম্মতঃ
শ্রীহবীস্বর ন্যায়লঙ্কারোপাধীক
কাব্য সভাপণ্ডিতঃ।
শ্রী * চন্দর দাস ঘোষ।
সাং–নুড়িঘাটা।
প্রক্লেমেশন পেয়ে ভট্টচার্য্যি ও ফলারের ডুব মাল্লেন; কেউ কেউ কন্তু নদীর মত অন্তঃশীলে বইতে লাগলেন; ডুবে জল খেলে শিবের বাবার সাধ্যি নাই যে টের পান; তবুও অনেক জায়গায় চৌকি, থানা ও পাহারা বসে গেল। কিছুতেই কেহ কিছু কোত্তে পাল্লেন না; টাকার খুসবো পাঁজ রসুনের গন্ধ চেকে তুল্লে—শ্ৰাদ্ধসভা পবিত্র হয়ে উঠলো। বাগবাজারের মদনমোহন ও শ্রীপাট খড়দর শ্যামসুন্দর পর্য্যন্ত ব্ৰজের রসে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। শ্রাদ্ধের দিন সকাল বেলা রমাপ্রসাদবাবুর বাড়ী লোকারণ্য হয়ে গেলো গাড়ীবারেণ্ডা থেকে বাবুর্চ্চিখানা পর্য্যন্ত ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের ঠেল ধরলো; এমন কি, শ্রীক্ষেত্রে রথযাত্রায় জগন্নাথের চাঁদমুখ দেখতেও এত লোকারণ্য হয় না।
সপিণ্ডনের দিন সকালে রমাপ্রসাদবাবু বারাণসী গরদের জোড় পরে ভক্তি ও শ্রদ্ধার আধার হয়ে পড়লেন। ব্যালার সঙ্গে সভার জনতা বাড়তে লাগলো। এক দিকে রাজভাটেরা সুর করে বল্লালের গুণগরিমা ও আদিশূরের গুণকীর্ত্তন কত্তে লাগলো; একদিকে ভট্টাচার্য্যদের তর্ক লেগে গেল, দু দশ জন ভেরতমুখো কুলীন-দলপতিরা ভয় ও লজ্জায় সোয়ার হয়ে সভাস্থ হতে লাগলেন। দল দল কেত্তন আরম্ভ হলো, খোলের চাঁটিতে ও হরিবোলের শব্দে ডাইনিং রুমের কাচের গ্লাস ও ডিশের যেন ভয়ে কাঁপতে লাগলো; বৈমাত্রভাই ধূম করে মার শ্রাদ্ধ কচ্চেন দেখে জাতিত্বনিবন্ধন হিংসাতেই ব্ৰহ্মধৰ্ম্ম কাঁদতে লাগলেন; দেখে—আমিবিশন হাসতে লাগলেন।
ক্রমে মাল চন্দন ও দানসামগ্রী উচ্ছুগগু হলে সভঙ্গ হলো। কলকেতার ব্রাহ্মণভোজন দেখতে বেশ—হুজুরেরা আঁতুরের ক্ষুদ মেয়েটিকেও বাড়ীতে রেখে ফলার কত্তে আসেন না—যার যে কটি ছেলেপুলে আছে, ফলারের নি সেগুলি বেরোবে! এক এক জন ফল রিমুখো বামুলকে ক্রিয়বাড়ীতে ঢুকতে দেখলে হঠাৎ বোধ হয়, যেন গুরুমশাই পাঠশালা তুলে চলেছেন। কিন্তু বেরোবার সময় বোধ হয়, এক একটা সর্দার ধোপা,লুচি মোণ্ডার মোটটি একটা গাধায় বইতে পারে না। ব্রাহ্মণরা সিকি, দুয়ানি ও আধুলি দক্ষিণা পেয়ে, বিদেয় হলেন, দই-মাখন এঁটো কলাপাত, ভাঙ্গা খুরী ও আঁবের আঁটীর নীলগিরি হয়ে গেল। মাছিরা ভ্যান ভ্যান করে উড়তে লাগলো—কাক ও কুকুরেরা টাঁকতে লাগলো। সামিয়ানায় হাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং জল সপসপানি ও লুচি, মণ্ডা, দই ও আঁবের চপটে একরকম ভেপ্সো গন্ধ বা মাতিয়ে তুলে–সে?হ্ম ক্রিস্মেবীর ফেরত লোক ভিন্ন অন্যে হঠাৎ আঁচতে পারবেন না।
এদিকে বৈকালে রাস্তায় কাঙ্গালী জমতে লাগলো, যত সন্ধতা হতে লাগলো, তই অন্ধকারের সঙ্গে কাঙ্গালী বাড়তে লাগলো। ভারী, কোনদার, উড়ে ও বেহার, রেয়ো ও গুলিখোরেরা কাঙ্গালীর দলে মিশতে লাগলো, জনতার ও! ও! রো! রো। শব্দে বাড়ী প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। রাত্তির সাতটার সময়ে ক ঙ্গালীদের বিদেয় করবার জন্য প্রতিবাসী ও বড় বড় উঠানওরলি লোকেদের বাড়ী পোরা হলো; শ্রাদ্ধের অধ্যক্ষের থলে থলো সিকি, আধুলি, দুয়ানি ও পয়সা নিয়ে দরজায় দাঁড়ালেন; চলতি মশাল, লণ্ঠন ও ‘আও! অও। রাস্তায় রাস্তায় কাঙ্গালী ডেকে বেড়াতে লাগলো; রাত্তির তিনটে পৰ্যন্ত কাঙ্গালী বিদেয় হলো! প্রায় ত্রিশ হাজার কাঙ্গালী জমেছিলো, এর ভিতর অনেকগুলি গর্ভবতী কাঙ্গালীও ছিল, তারা বিদেয়ের সময় প্রসব হয়ে পড়াতে নম্বরে বিস্তর বাড়ে।
কাঙ্গালী বিদেয়ের দিন দলস্থ নবশাখ, কায়স্থ ও বৈদ্যদের জলপান, ফলারে কেউ ফ্যালা যায় না, বামুন ও রেয়োদর মধ্যে যেমন তুখোড় ফুলারে আছে, কায়েত, নবশাক ও বদ্যিদের মধ্যেও ততোধিক। বরং কতক বিষয়ে এদের কাছে সার্টিফিকেটওয়ালা ফলারের কল্কে পায় না।
সহরের কাবু বাড়ী কোন ক্ৰিয়ে-কৰ্ম্ম উপস্থিত হলে বাড়ীয় ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলেরা চাপকান, পায়জামা, টুপি ও পেটি পরে হাতে লাল রুমাল ঝুলিয়ে ঠিক যাত্রার নকীব সেজে, দলস্থ ও আত্মীয় কুটুম্বদের নেমস্তোর কত্তে বেরোন। এর মধ্যে বড় মানুষ বা শাসে-জলে হলে সঙ্গে পেশাদার নেমুন্তন্নে বামুন থাকে। অনেকের বাড়ীর সরকার বা দাদাঠাকুর গোছর পূজারী বামুনেও চলে। নেমন্তন্নে বামুন বা সরকার রামগোছের এক ফর্দ হাতে করে, কানে উডেন পেন্সিল গুঁজে পান চিবুতে চিবুতে নেমেন্তোনো বেরে যান—ছেলেটি কেবল “টু, কাপির” সইয়ের মতন সঙ্গে থাকে।
আজকাল ইংরিজি কেতার প্রাদুর্ভাবে অনেকে সাপ্টা ফলার বা জোজে যেতে “লাইক” করেন না! কেউ ছেলে পুলে পাঠিয়ে সারেন, কেউ স্বয়ং বাগানে যাবার সময়ে ক্রিয়েবাড়ী হয়ে বেড়িয়ে যান। কিছু আহার কত্তে অনুরোধ কল্লে, ভয়ানক রোগের ভাণ করে কাটিয়ে দ্যান; অথচ বাড়ীতে এক ঝোড়া কুম্ভকর্ণের আহার তল পেয়ে যায়–হাতিশালের হাতী ও ঘোড়াশালের ঘোড়া খেয়ে ও পেট ভরে না।
পাঠক! আমরা প্রকৃত ফলার দাম। লোহার সঙ্গে চুম্বকপাথরের যে সম্পর্ক, আমাদের সহিত লুচিরও সেইরূপ। তোমার বাড়ীতে ফলারটা আসটা জলে অনুগ্রহ করে আমাদের ভুলে না; আমরা মুনকে রঘুর ভাই। ফুলারের নাম শুনে, আমরা নরক ও জেলে পৰ্যন্ত যাই। সেবার মৌলুবী হালুম হোসেন খাঁ বাহাদুরের ছেলের সুন্নতে ফলার করে এসেছি। হিন্দুধৰ্ম্ম ছাড়া কাণ্ড বিধবা-বিয়েতে ৪ পাত পাতা গিয়েছে। আর কলকেতার ব্রাহ্মসমাজের জন্মতিথি উপলক্ষে ১১ই মাঘ পোপ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দি ফাষ্টের বাড়ীতে যে বছর বছর একটা অনুক্ষেত্তর হয়, তাতেও প্রসাদ পেয়েচি। লল কথা ঐ ব্রাহ্মভোজের দিন ঠাকুরবাবুর মাঠের মত চণ্ডীমণ্ডপে ব্রাহ্ম ধরে না, কিন্তু প্রতি বুধবারে উপাসনার সময়ে সমাজে ন দশ বারোকে চক্ষু বুজে ঘাড় নাড়তে ও সুর করে সংস্কৃত মজিয়া পড়তে দেখতে পাই। বাকিরা কোথায়? তারা বোধ হয় পোষাকী ব্রাহ্ম। না আমাদের মত যজ্ঞির বিড়াল?
এ সওয়ায় আমাদের ফলারের বিস্তর ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট আছে; যদি ইউনিভার্সিটিতে বি এ, ও বিএলের মত ফলারের ডিগ্রী স্থির হয়, তা হলে, আমরা তার প্রথম ক্যান্ডিডেট।
রমাপ্রসাদবাবুর মার সপিণ্ডনের জলপানে আড়ম্বর খিলক্ষণ হয়েছিল—উপচারও উত্তম রকম অহরণ হয়। সহরের জলপান দেখতে বড় মন্দ নয়; এক তো মধ্যাহ্নভোজন বা জলপান রাত্তির দুই প্রহর পর্য্যন্ত ঠেল মারে; তাতে নানা রকম জানোয়ারের একত্রে সমাগম। যারা আহার কত্তে বসেন, সেগুলির পা, প্রথম ঘোড়ার মত লাল বাঁধান বোধ হবে; ক্রমে সমীচীনরূপে দেখলে বুঝতে পারবেন যে, কর্ম্মকর্ত্তা ও ফলারের সঙ্গীদের প্রতি এমনি বিশ্বাস যে জুতো জোড়াটি খুলে খেতে বসতে ভরসা হয় না।
শেষে কায়স্থের ভোজ মগডম্বরে সম্পন্ন হলো। কুলীনেরা পর্য্যায় মত রুই মাছের মুড়ো মুণ্ডী পেলেন—এক একটা আধবুড়ো আফিমখোর কুলীনের মাছের বুড়ো চিবানো দেখে ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলেরা ভয় পেতে লাগলো। এক এক সুনের পাত গো-ভাগারকে হারিয়ে দিলে! এই প্রকারে প্রায় পেনের দিন সমারোহের পর রমাপ্রসাদের মার সপিণ্ডনের ধুম চুলো-হুজুকদারেরা জিরতে লাগলেন!
যে সকল মহাপুরুষ দলপতিরা সভাস্থ হন নাই, তারা আপনার আপনার দলে ঘোঁট পাড়িয়ে দিলেন–অনেক ভট্টাচাৰ্য বিদেয় নিয়ে ফলার মেরে এসেও শেষে শ্ৰীশ্ৰী ঁধৰ্ম্মসভার উমেদার প্রপৌত্রদের দলের দলপতির কাছে গঙ্গাজল ছুঁয়ে শলিগেরামে সান্নে দিব্বি কোত্তে লাগলেন যে, তিনি অ্যাদ্দিন শহরে আচেন, কিন্তু রমাপ্রসাদ রায় যে কে, তাও তিনি জানেন না; তিনি শুদ্ধ বাবুকেই জানেন। আর তার ঠাকুর (স্বর্গীয় তর্কবাচস্পতি খুড়ো) মরবার সময়ে বলে গিয়েছেন যে, “ধৰ্ম্ম অবতার! আপনার মত লোক অর জগতে নাই।” এ সওয়ায় অনেক শূন্য-উপাধিধারী হজুরেরা ধরা পড়লেন, গোবর খেলেন, শ্রীবিষ্ণু স্মরণ কল্লেন ও ভুরু কামালেন।
কলকেতার প্রথম বিধবা বিবাহের দিন, বালি, উতেরপাড়া, অশ্বিকে ও রাজপুর অঞ্চলের বিস্তর ভট্টাচাৰ্য্য সভাস্থ হন—ফলার ও বিদেয় মাবেন। তার পর ক্রমে গা-ঢাকা হতে আরম্ভ হন; অনেকে গোবর খান, অনেকে সভাস্থ হয়েও বলে, আমি সের্দিন শয্যাগত ছিলাম।
যতদিন এই মহাপুরুষদের প্রাদুর্ভাব থাক্বে, তত দিন বাঙ্গালীর ভদ্রস্থ নাই; গোঁসাইরা হাড়ি মুচি মুফরাস নিয়ে বেঁচে আছেন; এই মহাপুরুষের গোটকক হতভাগা গোমূখ কায়স্থ ব্রাহ্মণ দলপতির জোরে আজও টিকে আছেন, এরা এক এক জন হারামজাদকী ও বজ্জাতীর প্রতিমূর্ত্তি, এদিকে এমনি সজ্জা গজ্জা করে বেড়া যে, হঠাৎ কার সাধ্যি, অন্তরে প্রবেশ করে, হঠাৎ দেখলে বোধ হয়, অতি নিরীহ ভদ্রলোক; বাস্তবিক সে কেবল ভড়ং ও ভণ্ডামম!
১.২২ রসরাজ ও যেমনকৰ্ম্ম তেমনি ফল
রমাপ্রসাদ রায়ের মার সপিণ্ডনে সভাস্থ হওয়ায় কোন কোনখানে তুমূল কাণ্ড বেধে উঠলো–বাবা ছেলের সঙ্গে পৃথক হলেন। মামী ভাগ্নেকে ছাঁট্লেন–-ভাগ্নে মামীর চিরঅন্ন-পালিত হয়েও চিরজন্মের কৃতজ্ঞতায় ছাই দিয়ে, বিলক্ষণ বিপক্ষ হয়ে পড়লেন! আমরা যখন স্কুলে পড়তুম, তখন সহরের এক বড়মানুষ সোণার বেণেদের বাড়ীর শম্ভুবাবু বলে একজন আমাদের ক্লাসফ্রেণ্ড ছিলেন; একদিন তিনি কথায় কথায় বলেন যে “কাল রাত্রে আমি ভাই অমাড় স্ত্রীকে বড় ঠাট্টা কড়েচি, সে আমায় বলে তুমি হনুমান্”; আমি অমনি ভস কড়ে বললুম তোর শ্বশুড় হনুমান!” ভাগ্নেবাবুও সেই রকম ঠাট্টা আরম্ভ কল্লেন। ‘রসরাজ’ কাগজ পুনরায় বেরুলো, খেউড় ও পচালের স্রোত বইতে লাগলো। এরি দেখাদেখি একজ সংস্কৃত কলেজের কৃতবিদ্য ছোকরা ব্রাহ্মধর্ম্ম ও কলেজ-এডুকেশন মাথায় তুলে যেমন কম্ম তেমনি ফুল নামে ‘রসরাজে’র জুড়ি এক পচালপোরা কাগজ বার কল্লেন—’রসরাজ’ ও ‘তেমনি ফলে’ লড়াই বেধে গেল। দুই দলে কৃত্বাস্ত্র ও সেনাসংগ্রহ করে, সমরসাগরে অবতীর্ণ হলেন —স্কুলবয়েরা ভূরি ভূরি নির্ব্বুদ্ধি দলবল সংগ্রহ কয়ে, কুরুপাণ্ডব যুদ্ধ ঘটনার ন্যায় ভিন্ন ভিন্ন দলে মিলিত হলেন। দুর্ঘদ্ধিপরায়ণ ক্যারাণী, কুটেরা ওবাজে লোকেরা সেই কষ্য রস পান করবার জন্য কাক, কবন্ধ ও শৃগাল শকুনির মত, রণস্থল জুড়ে রইলো! ‘রসরাজ’ ও ‘তেমনি ফলের’ ভয়ানক সংগ্রাম চলতে লাগলো—“পীর গোরাচাঁদের ম্যালা ‘পরীর জন্মবিবরণ’ ‘ঘোড়া ভূত’ ও ‘ব্রহ্ম-দৈত্যের কথোপকথন’ প্রভৃতি প্রস্তাবপরিপূর্ণ ‘রসরাজ’ প্রতিদিন পাঁচশ, হাজার, দু হাজার কপি নগদ বিক্রী হতে লাগলো। কিন্তু ‘ব্রাহ্মধৰ্ম্ম’ মাসে একখানাও ধারে বিক্রী হয় কি না সন্দেহ। ‘তিলোত্তমা’ ও ‘সীতার বনবাসের’ খদ্দের নাই। কিছুদিন এই প্রকার লড়াই চলচে, এমন সময়ে গবর্ণমেণ্ট বাদী হয়ে কদর্য্য প্রস্তাব লিখন অপরাধে ‘রসরাজ’ সম্পাদকের নামে পুলিসে নালিশ কল্লেন, ‘যেমন কর্ম্ম’ ও পাছে তেমনি ফল পান, এই ভয়ে গা ঢাকা দিলেন; ‘রসরাজের’ দোয়ার ও খুলীরে মূল গায়েনকে মজলিসে বেধে, ‘চাচা আপন বাঁচা’ কথাটি স্মরণ করে, মেদ্দোষ ও মন্দিরে ফেলে চম্পট দিলো। ভাগ্নেবাবু (ওরফে মিত্তির খুড়ো) সফিনের ভয়ে, অন্দরমহলের পাইখানা আশ্রয় কল্লেন—গিরিবর ক্ষেত্রমোহন বিদ্যারত্ন চামর ও নূপুর নিয়ে সৎসাহিত্য-গ্রন্থাবলী তিন মাসের জন্য হরিণবাড়ী ঢুকলেন। ‘পীর গোরাচাঁদের’ বাকি গীত সেইখানে গাওয়া হলো। পাতরভাঙ্গা হাতুড়ির শব্দ, বেতের পটাং পটাং ও বেড়ীর ঝুমঝুমানি মন্দিরে ও মৃদঙ্গের কাজ কল্লে–কয়েদীরা বাজে লোক সেজে ‘পীরের গীত’ শুয়ন মোহিত হয়ে বাহবা ও পালা দিলে; “খেলেন দই রমাকান্ত, বিকারে ব্যালা গোবর্দ্ধন”। যে ভাষা কথা আছে, ভাগ্নেবাবু (ওরফে মিড়ির খুড়ো) ও রসরাজ-সম্পাদকের সেইটির সার্থকতা হলো; আমরাও ক্রমে বুড়ো হয়ে পড়লেম, চসমা ভিন্ন দেখতে পাইনে।
১.২৩ বুজরুকী
পাঠক! আমাদের হরিভদ্দর খুড়ো কায়স্ত মুখখী কুলীন, দেড় শ’ ছিলিম গাঁজা প্রত্যহ জলযোগ হয়ে থাকে; থাকবার নির্দ্দিষ্ট ঘরবাড়ী নাই, সহরে খান্কীমহলে অনেকের সঙ্গে আলাপ থাকায় শোবার ও খাবার ভাবনা নাই, বরং আদর করে কেউ “বেয়াই” কেউ জামাই” বলে ডাকতো। আমাদের খুড়া ফলার মাত্রেই পার ধূলো দেন ও লুচিটে সন্দেশটা বেঁধে আনতেও কসুর করেন না। এমন কি, তাগে পেলে চলনসই জুতা জোড়াটাও ছেড়ে আসেন না। বলতে কি, আমাদের হরিভদ্দর খুড়ো এক রকম সবলোট গোছের ভদ্দর লোক। খুড়ো উপস্থিত হয়েই এ কথা সে কথার পর বল্লেন যে, “আর শুনেছ, আমাদের সিমলে পাড়ায় এক মহাপুরুষ সন্ন্যাসী এসেছেন তিনি সিদ্ধ, তিনি সোনা তৈরী কত্তে পারেন—লোকের মনের কথা গুণে বলেন, পারাভস্ম খাইয়ে সেদিন গঙ্গাতীরে একটা পচা মড়াকে বাঁচিয়েছেন, ভারি বুজরুক!” কিন্তু আমরা ক’বার ক’টি সন্ন্যাসীর বুজরুকী ধরেচি, গুটিকত ভূতনাচার ভূত উড়িয়ে দিয়েছি, আর আমাদের হাতে একটি জোচ্চোরের জোচ্চুরী বেরিয়ে পড়ে।
যখন হিন্দুধর্ম্ম প্রবল ছিল, লোকে দ্রব্যগুণ কিম্বা ভূতত্ব জানতো না, তখনই এই সকলের মান্য ছিল! আজকাল ইংরেজি লেখা-পড়ার কল্যাণে সে গুড়ে বালি পড়েছে। কিন্তু কলকেতা সহরে না দেখা যায়, এমন জিনিষই নাই; সুতরাং কখন কখন “সোণা-করা” “ছলে-করা” “নিরাহার” “ভূতনাবানো” “চণ্ডসিদ্ধ” প্রভৃতির পেটের দায়ে এসে পড়েন, অনেক জায়গায় বুজরুক দ্যাখান, শেষ কোথাও না কোথাও ধরা পড়ে বিলক্ষণ শিক্ষা পেয়ে যান।
১.২৪ হোসেন খাঁ
বছর চার পাঁচ হলো, এই সহরে হোসেন খাঁ নামে এক মোছলমান বহু কালের পর ঐ রঙ্গে ভয়ানক আড়ম্বরে দেখা দেন—তিনি হজরত জিনিয়াই সিদ্ধ; (পাঠক আরব্য উপন্যাসের আলাদিন ও আশ্চৰ্য্য প্রদীপের কথা স্মরণ করুন)—“মনে করেন, সেই জিনিষই জিনি দ্বারা আনতে পারেন, বাক্সের ভিতর থেকে ঘড়ি, আংটী, টাকা উড়িয়ে দেন, নদীজলে চাবির থলে ফেলে দিলে জিনির দ্বারা তুলে আনান” এই প্রকার অদ্ভুত কৰ্ম্ম কত্তে পারেন।
ক্রমে সহরে সকলেই হোসেন খাঁর কথার আন্দোলন কত্তে লাগলেন—ইংরেজী কেতার বড়দলে হোসেন খার খবর হলো। হোসেন খাঁ আজ রাজা বাহাদুরের বাগানে বাক্সর ভিতর থেকে টাকা উড়িয়ে দিলেন, উইলসনের হোটেল থেকে খাবার উড়িয়ে আনলেন, বোতল বোতল শ্যামপিন, দোনা দোনা গোলাবি ধিলি ও দলিম কিসমিস্ প্রভৃতি হরেক রকম খাবার জিনিষ উপস্থিত কল্লেন। কাল–রায়বাহাদুরের বাড়ীতে কমলালেবু, বেলফুলের মালা বরফ ও আচার আনলেন। যাঁরা পরমেশ্বর মনিতেন না, তাঁরাও হোসেন খাঁকে মানতে লাগলেন! ভাষায় বলে, “পাথরে পূজিলে পাঁচে পীর হয়ে পড়ে;” ক্রমে হোসেন খাঁ বড় বড় কাশ্মীরী উললুক ঠকাতে লাগলেন। অনেক জায়গায় খোরাকি বরাদ্দ হলো। বুজরুকী দেখবার জন্য দেশ-দেশান্তর থেকে লোক আসতে লাগলো। হোসেন খাঁ “প্রিমিয়ম্” বেড়ে গেল। জুচ্চুরি চিরকাল চলে না। “দশ দিন চোরের, এক দিন সেধের”; ক্রমে দুই এক জায়গায় হোসেন খাঁ ধরা পড়তে লাগলেন—কোথাও ঠোনাকা ঠানাকা, কোথাও কানমলা; শেষ প্রহার বাকী রইলো না। যাঁরা তাঁরে পূর্ব্বে দেবতা-নির্ব্বিশেষে আদর করেছিলেন, তাঁরাও দু এক ঘা দিতে বাকী রাখলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই জিনি-সিদ্ধ হোসেন খাঁ পৌত্তলিকের শ্রাদ্ধের দাগ ষাঁড়ের অবস্থায় পড়লেন; যাঁরা আদর করে নিয়ে যান, তারাই দাগী করে বাহির করে দেন, শেষে সরকারী অতিথিশালা আশ্রয় কোল্লেন–হোসেন খাঁ জেলে গেলেন! যিনি পাতাল আশ্রয় কল্লেন!
১.২৫ ভূত-নাবানো
আর একবার যে আমরা ভূতনাবানো দেখেছিলেম, সেও বড় চমৎকার। আমাদের পাড়ার একজনের বড় ভয়ানক রোগ হয়। স্যাকরারা বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন, সুতরাং রোগের চিকিৎসা কত্তে ত্রুটি কল্লে না, ইংরেজ-ডাক্তার বদ্দি ও হাকিমের ম্যালা করে ফেল্লে; প্রায় তিন বৎসর ধরে চিকিৎস হলো, কিন্তু রোগের কেউ কিছু কত্তে পাল্লে না। রোগ ক্রমশঃ বৃদ্ধি হচ্ছে দেখে বাড়ীর মেয়েমহল তুলসী দেওয়া-কালীঘাটে সস্তেন—কালভৈরবে স্তবপাঠ-তুক্তাক—সাফরিদ-নারাণ–বালওড়-বালসী— শোপুর–নুরপুর ও হালুমপুর প্রভৃতি বিখ্যাত জায়গার চন্নামেন্তো ও মাদুলি ধারণ হলো, তারকেশ্বরে হত্যে দিতে লোক গেল-বাড়ীর বড় গিন্নী কালীঘাটে বুক চিরে রক্ত দিতে ও মাথায় ও হাতে ধূনো পোড়াতে গেলেন—শেষে একজন ভূতচালা আনা হয়।
ভূতচালার ভূতের ডাক্তারি পর্য্যন্ত করা আছে। আজকাল দু-এক বাঙ্গালী ডাকতার মধ্যে মধ্যে পেসেণ্টের বাড়ী ভূত সেজে দেখা দেন—চাদরের বদলে দড়ি ও পেরেক সহিত মশারি গায়ে, কখন বা উলঙ্গ হয়েও আসেন, কেবল মন্ত্রের বদলে চার পাঁচ জন রোজায় ধরাধরি করে আনতে হয়। এঁরা কলকেতা মেডিকেল কলেজের এজুকেটেড ভূত। ভূতচালা চণ্ডীমণ্ডপে বাসা পেলেন, ভূত আসবার প্রোগ্রাম স্থির হলো—আজ সন্ধ্যার পরেই ভূত নামবেন, পাড়ায় দু-চার বাড়ীতে খবর দেওয়া হলো—ভূত মনের কথা ও রুগীর ঔষধ বলে দেবে। ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে গেল, কুঠীওয়ালারা ঘরে ফিল্লেন-বারফট্কারা বেরুলেন, বিগ্রহের উত্তরাঢ়ি কায়েতের মত (দর্শন মাত্র) সেতল খেলেন, গীর্জ্জের ঘড়ীতে ঢং ঢং ঢং করে নটা বেজে গেল, গুম করে তোপ পড়লো। ছেলেরা “বোমকালী কলকেতাওয়ালী” বলে হাততালি দে উঠলো,–ভূতনাবানো আসরে নাবলেন!
আমাদের প্রতিবাসী, ভূতনাবানোর কথাপ্রমাণ ও বাড়ীর গিন্নিদের মুখে শুনে ভূতের আহার জন্য আয়োজন কত্তে ত্রুটী করে নাই; বড়বাজারের সমস্ত উত্তমোত্তম মেঠাই; ক্ষীরের নানারকম পেয় ও লেহ্যরা পদার্পণ কল্লেন। বোধ হয়, আমাদের মত প্রকৃত ফলারের দশ জনে তাদের শেষ কত্তে পারে না; রোজা ও তাঁর দুই চেলায় কি করবেন! রোজা ঘরে ঢুকে একটি পিঁড়েয় বসে ঘরের ভিতরে সকলের পরিচয় নিতে লাগলেন—অনেকের আপদমস্তক ঠাউরে দেখে নিলেন—দুই এক জন কলেজ বয় ও মোটা মোটা লাঠিওয়ালারা নিমন্ত্রিতদের প্রতি তাঁর যে বড় ঘৃণা জন্মেছিল, তা তাঁর সে সময়ের চাউনিতেই জানা গেল।
রোজার সঙ্গে দুটি চেলামাত্র, কিন্তু ঘরে প্রায় জন চল্লিশ ভূত দেখবার উমেদার উপস্থিত, সুতরাং ভূত প্রথমে আসতে অস্বীকার করেছিলেন। তদুপলক্ষে রোজাও “কাল ও কৃশ্চানীর” উপলক্ষে একটু বক্তৃতা কোত্তে ভোলেন নাই—শেষে দর্শকদের প্রগাঢ় ভক্তি ও ঘরের আলো নিবিয়ে অন্ধকার করবার সম্মতিতে, রোজা ভূত আন্তে রাজি হলেন–চেলারা খাবার দাবার সাজানো থালা যে সে বসলেন, দরজায় হুড়কো পড়লো, আলো নিবিয়ে দেওয়া হলো; রোজ্য কোশা-কুশী ও আসন নিয়ে শুদ্ধাচারে ভূত ডাকতে বলেন। আমরা ভূতের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বারোইয়ারির গুদোমজাৎ সংগুলির মত অন্ধকারে বসে রইলেম!
পাঠক! আপনার স্মরণ থাকতে পারে, আমরা পূর্ব্বেই বলেছি যে, আমাদের ঠাকুরমা ভূত ও পেতনীর ভয় নিবারণের জন্য একটি ছোট জয়ঢাকের মত মাদুলীতে ভূকৈলেসের মহাপুরুষের পায়ের ধূলো পূরে আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দেন, তা সওয়ায় আমাদের গলায় গুটি বারো রকমারি পদক ও মাদুলী ছিল, দুটি বাঘের নখ ছিল, আর কুমীরের দাঁত, মাছের আঁশ ও গণ্ডারের চামড়াও কোমরের গেটে সাবধানে রাখা হয়। আর হাতে একখানা বাজুর মত কবচ ও তারকেশ্বরের উদ্দেশে সোণার তাগা বাঁধা ছিল। খুব ছেলেবেলা আমাদের একবার বড় ব্যায়রাম হয়, তাতেই আমাদের পায়ে চোরের সিধের বেড়ী পরিয়ে দেওয়া হয় ও মাথায় পঞ্চানন্দের একটি জট থাকে; জট্টি তেল ও ধুলোতে জড়িয়ে গিয়ে রাম ছাগলের গলায় নুন্নশীর মত ঝুলতো! কিন্তু আমরা স্কুলের অবস্থাতেই অল্পবয়সে অ্যাম-বিশেষণের দাস হয়ে ব্রাহ্ম-সমাজে গিয়ে একখানা ছাবান হেডিংওয়ালা কাগজে নাম সই করি; তাতেই শুনলেম যে আমাদের ব্রাহ্ম হওয়া হলো। সুতরাং তারই কিছু পূর্ব্বে স্কুলের পণ্ডিতের মুখে মহাপুরুষের দুর্দশা শুনে পূর্বোক্ত কবচ, মাদুলী প্রভৃতি খুলে ফেলেছিলাম! আজ সেইগুলি আবার স্মরণ হলো, মনে কল্লেম, যদি ভূত নাবানো সত্যই হয়, তা হলে সেগুলি পোরে আসতে পাল্পে ভূতে কিছু কত্তে পারবে না। এই বিবেচনা করে, সেইগুলির তত্ত্ব করে, কিন্তু পাওয়া গেল না—সেগুলি আমাদের পৌত্তরের ভাতের সময়ে একটা চাকর চুরি করে; চুরিটি ধরবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি হয় নি। গিন্নী শনিবারে একটা সুপুরি, পয়সা ও সওয়া কুনকে চেলের মুদে বাঁধেন; ন্যেপীর মা বলে আমাদের বহুকালের এক বুড়ী দাসী ছিল, সে সেই মুদোটি নে জানের বাড়ী যায়, জান গুনে বলে দেয়, “চোর বাড়ীর লোক, বড় কালও নয় সুন্দরও নয়। শামবর্ণ, মানুষটি একহারা, মাজারি গোঁফ, মাথায় টাক থাকতেও পারে”–না থাকতেও পায়ে” জানের গোণাতে আমাদেরও চাকরটিকেই চোর স্থির করে ছাড়িয়ে দেওয়া যায়। সুতরাং সে মাদুলীগুলি পাওয়া গেল না, বরং ভূতের ভয় বেড়ে উঠলো।
ব্রাহ্ম হলেও যে ভুতে ধরবে না, এটিরও নিশ্চয় নাই। সে দিন কলকেতার ব্রাহ্মসমাজের এক জন ডাইরেক্টরের স্ত্রীকে ডাইনে পায়—নানা দেশদেশান্তর থেকে রোজা আনিয়ে কত ঝাড়ান-ঝোড়ান, সরষেপড়া জলপড়া ও লঙ্কাপড়া দিতে ভাল হয়। অনেক ব্রাহ্মের বাড়ীতে ভূতচতুর্দ্দশীর প্রদীপ দিতে দেখা যায়।
এদিকে রোজ খানিকক্ষণ ডাকতে ডাকতে ভূতের আসবার পূর্ব্বলক্ষণ হতে লাগলো। গোহাড়, ঢিল, ইট ও জুতো হাঁড়ি বাড়ীর চতুর্দ্দিকে পড়তে লাগলো। ঘরের ভেতর গুপ গুপ করে কে যেন নাচছে বোধ হতে লাগলো; খানিকক্ষণ এই রকম ভূমিকার পর মড়া করে একটা শব্দ হলো; ভূতের বসবার জন্য ঘরের ভিতর যে পিঁড়েখানা রাখা হয়েছিল, শব্দে বোধ হলো সেইখানি দুচীর হয়ে ভেঙ্গে গেল—রোজা সভয়ে বলে উঠলেন–শ্ৰীযুৎ এয়েচেন।
আমরা ছেলেবেলা আমাদের বুড়ো ঠাকুরমার কাছে শুনেছিলেম যে ভূতে ও পেত্নীতে খোঁনা কথা কয় সেটি আমাদের সংস্কারবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, আজ তার পরীক্ষা হলো। ভূত পিঁড়ে ফাটিয়েই খোঁনা কথা কইতে লাগলেন প্রথমে এসেই কলেজ-বয়দের দলের দুই একজনের নাম ধরে ডাকলেন, তাদের নাস্তিক ও কৃশ্চান বলে ডাক দিলেন। শেষে ভূতত্ত্ব নিবন্ধন ঘাড় ভাঙ্গবার ভয় পৰ্য্যন্ত দেখাতে ত্রুটি করেন নাই। ভূতের খোঁনা কথা ও অপরিচিতের নাম বলাতেই বাড়ীর কর্ত্তা বড় ভয় পেলেন জোড় হাত করে (অন্ধকারে জোড় হাত দেখা অসম্ভব কিন্তু ভূত অন্ধকারে দিব্বি দেখতে পান সুতরাং কর্ম্মকর্ত্তা অন্ধকারেও জোড় হস্তে কথা কয়েছিলেন, এ আমাদের কেবল ভাবে বোধ হলে ক্ষমা চাইলেন, কিন্তু ভূত সর মর্ডাণ্ট ওয়েলসের মত যা ধরেন, তার সমূলচ্ছেদ না করে ছাড়েন না। সুতরাং আমাদের ঘাড় ভঙ্গিবার প্রতিজ্ঞা অন্যথা হলো না, শেষে রোজা ও বুড়ো বুড়ো দর্শক ও বাড়ীওয়ালার অনেক সাধ্যসাধনার পর ভূত মহোদ ষষ্টীবাটায় আগত জামাইয়ের মত, যৎকিঞ্চিৎ জলযোগ কত্তে সম্মত হলেন, আমরাও পালাবার পথ আঁচতে লাগলেম।
লুচির চটকানো চিবানোর চপ চপর ও সাপটা ফলারের হাপুর হুপুর শব্দ থামতে প্রায় আধ ঘণ্টা লাগলো, শেষে ভূত জলযোগ করে গাঁজা ও তামাক খাচ্ছেন, এমন সময়ে পাশ থেকে ওলাউঠো রুগীর বমির ভূমিকাত মত উঁকীর শব্দ শোনা যেতে লাগলো। ক্রমে উঁকীর চোটে ভুতের বাকরোধ হয়ে পড়লো–বমি! হুড় হুড় করে বমি! গৃহস্থ মনে কল্লেন, ভুত মহাশয় বুঝি বমি কচ্চেন; সুতরাং তাড়াতাড়ি আলো জ্বালিয়ে আনালেন! শেষে দেখি কি চেলা ও রোজা খোদই বমি কচ্চেন, ভূত সরে গেচেন। আমরা পূৰ্ব্বে শুনিনে যে, গেরস্তর অগোচরে একজন মেডিকেল কলেজের ছোকরা ভূতের জন্য সংগৃহীত উপচারে ‘টার্টার এমেটিক্’ মিশিয়ে দিয়েছিলেন; রোজা ও চেলারা তাই প্রসাদ পাওয়াতেই তাদের এই দুর্দশা, সুতরাং ভূতনাবানোর উপর আমাদের যে ভক্তি ছিল, সেটুকু উবে গেল! সুতরাং শেষে আমরা এই স্থির কল্লেম যে, ইংরেজি ভুতেদের কাছে দেশী ভূত খবরে আসে না।
এ সওয়ায় আমরা আরও দুস্টারি জায়গায় ভূতনাবানো দেখেচি, পাঠকরাও বিস্তর দেখেছেন, সুতরাং সে সকল এখানে উত্থাপন করা অনাবশ্যক, ভূনানো ও ‘হোসেন খাঁ’ কেবল জুচ্চরী ও হুজুকের আনুষঙ্গিক বলেই আমরা উল্লেখ কল্লেম।
১.২৬ নাক-কাটা বঙ্ক
হরিভদ্দর খুড়োর কথামত–এ সকল প্রলয় জুয়াচুরী জেনেও আমরা এক দিন সন্ধ্যার পর সিমলে পাড়ার বঙ্কবিহারিবাবুর বাড়ীতে গেলুম। বেহারিবাবু উকিলের বাড়ীর হেড কেরাণী—আপনার বুদ্ধি কৌশলেবলেই বাড়ী ঘর-দোর ও বিষয়-আশায় বানিয়ে নিয়েছেন, বাবা মাস ঘাঁতে ঘোঁতে ফেরেন–যে রকমে হোক, কিছু আদায় করাই উদ্দেশ্য।
বঙ্কবেহারিবাবু ছেলেবেলায় মাতামহের অন্নেই প্রতিপালিত হতেন, সুত্রাং তার লেখাপড়া ও শারিরিক তদ্বিরে বিলক্ষণ গাফিলী হয়। একদিন মামার বাড়ী খেলা কত্তে কত্তে তিনি পাতকোর ভিতরে পড়ে যান,—তাতে নাকটি কেটে যায়, সুতরাং সেই অবধি সমবয়সীরা আদর করে “নাককাটা বঙ্কবেহারি” বলেই তারে ডাকতো; শেষে উকীল-বাড়ীতেও তিনি ঐ নামে বিখ্যাত হয়ে পড়েন। বঙ্কবহারিবাবুরা তিন ভাই, তিনি মধ্যম; তাঁর দাদা সেলারদের দালালী কত্তেন, ছোট ভাইয়ের পাইকেরের দোকান ছিল। তিন ভায়েই কাঁচা পয়সা রোজগার করেন, জীবিকাগুলিও রকমারী বটে! সুতরাং নানাপ্রকার বদমায়ের পাল্লায় থাকবে, বড় বিচিত্র নয়–অল্প দিনের মধ্যেই বঙ্কবেহারিবাবুরা সিমলের একঘর বিখ্যাত লোক হয়ে উঠলেন। হঠাৎ কিছু সঙ্গতি হলে, লোকের মেজাজ যেরূপ গরম হয়ে ওঠে, তা পাঠক বুঝতে পারেন; (বিশেষতঃ আমাদের মধ্যে কোন দুই একজন বঙ্কবেহারিবাবুর অবস্থার লোক না হবেন)। ক্রমে বঙ্কবেহারিবাবু ভদ্রলোকের পক্ষে প্রকৃত জোলাপ হয়ে পড়লেন।
হাইকোর্টের অ্যাটর্নীর বাড়ীর পায়দা ও মালী পর্য্যন্ত সকলেই আইনবাজ হয়ে থাকে; সুতরাং বঙ্কবেহারিবাবু যে তুখোড় আইনবাজ হবেন, তা পূর্ব্বেই জানা গিয়েছিলো। আইন আদালতের পরামর্শ, জাল জালিয়াতে তালিমে, ইকুটীর খোচ ও কমলার প্যাঁচে-বঙ্কবেহারিবাবু দ্বিতীয় শুভঙ্কর ছিলেন! ভদ্দর লোকমাত্ৰকেই তাঁর নামে ভয় পেতে হত; তিনি আকাশে ফাঁদ পেতে চাঁদ ধরে দিতে পারেন, হয়কে নয় করেন, নয়কে হয় করেন; এমন কি টেকচাঁদ ঠাকুরের ঠক্ চাচাও, তাঁর কাচে পরামর্শ নিতেন।
আমরা সন্ধ্যার পর বঙ্কবেহারিবাবুর বাড়ীতে পৌঁছিলাম। আমাদের বুড়ো রাম ঘোড়াটির মধ্যে বাতশ্লেষ্মার জ্বর হয়, সুতরাং আমরা গাড়ী চড়ে যেতে পারি নাই। রাস্তা হতে একজন ঝাঁকামুটে ডেকে তার ঝাঁকায় বসেই যাই, তাতে গাড়ীর চেয়ে কিছু বিলম্ব হতে পারে। কিন্তু ঝাঁকামুটে অপেক্ষা পাহারাওয়ালাদের ঝোলায় যাওয়ায় আরাম আছে। দুঃখের বিষয় এই যে, সেটি সব সময়ে ঘটে না। পাঠকেরা অনুগ্রহ করে যদি ঐ ঝোলায় একবার সোয়ার হন, তা হলে জন্মে আর গাড়ী-পাল্কী চড়তে ইচ্ছা হবে না; যাঁরা চড়েছেন, তাঁরাই এর আরাম জানেন—যেন স্প্রীংওয়ালা কৌচ!
আমরা বঙ্কবেহারিবাবুর বাড়ীতে আরো অনেকগুলি ভদ্রলোককে দেখতে পেলেম, তাঁরাও “সোণা করার” বুজরুকী দেখতে সভাস্থ হয়েছিলেন। ক্রমে সকলের পরম্পর আলাপ ও কথাবার্ত্তা থামলে সন্ন্যাসী যে ঘরে ছিলেন, আমাদেরও সেই ঘরে যাবার অনুমতি হলো। সেই ঘরটি বঙ্কুবাবুর বৈঠকখানার লাগাও ছিল, সুতরাং আমরা শুধু পায়েই ঢুকলেম। ঘরটি চারকোণা সমান; মধ্যে সন্ন্যাসী বাগছাল বিছিয়ে বসেচেন; সাম্নে একটি ত্রিশূল পোত হয়েচে, পিতলের বাঘের উপর চড়া মহদেব ও এক বাণলিঙ্গ শিব সাম্নে শোভা পাচ্ছেন; পাশে গাঁজার হুঁকো-সিদ্ধির ঝুলি ও আগুনের মালসা। সন্ন্যাসীর পেছনে দু জন চেলা বসে গাঁজা খাচ্ছে, তার কিছু অন্তরে একটা হাপর, জাল হাতুড়ি ও হামাদিস্তে পড়ে রয়েছে—তারাই সোণা তইরির বাহ্যিক আড়ম্বর।
আমাদের মধ্যে অনেকে, সন্ন্যাসীকে দেখে ভক্তি ও শ্রদ্ধার আধার হয়ে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম কল্লেন; অনেকে নিমগোছের ঘাড় নোয়ালেন, কেউ কেউ আমাদের মত গুরুমশায়ের পাঠশালের ছেলেদের ন্যায় গণ্ডার এণ্ডায় সার দিয়ে গোলে হরিবোলে সাল্লেন-শেষে সন্ন্যাসী ঘাড় নেড়ে সকলকেই বসতে বল্লেন।
যে মহাপুরুষদের কৌশলে হিন্দুধর্মের জন্ম হয়, তারাই ধন্য। এই কন্ধকাঁটা। এই ব্ৰহ্মদত্তি! এই রক্তদন্তী কালী—শেতলা। ছেলেদের কথা দুরে থাকুক, বুড়ো মিলেদেরও ভয় পাইয়ে দেয়। সন্ন্যাসী যে রকম সজ্জা-গজ্জা করে বসেছিলেন, তাতে মানুন বা নাই মানুন, হিন্দু সন্তান মাকেই শেওরাতে হয়েছিল! হায়! কালের কি মহিমা—সে দিন যার পিতামহ যে পাথরকে ঈশ্বরজ্ঞানে প্রণাম করেছে—মুক্তির অনন্যগতি জেনে ভক্তি করেছে, আজ ত্যর পৌত্তর সেই পাথরের ওপোর পা তুলতে শঙ্কিত হচ্চে না। রে বিশ্বাস! তোর অসাধ্য কৰ্ম্ম নাই। যার দাস হয়ে একজনকে প্রাণ সমর্পণ করা যায়, আবার তারই কথায় তারে চিরশত্রু বিবেচনা হয়, এর বাড়া আর আশ্চর্য কি! কোন্ ধৰ্ম্ম সত্য? কিসে ঈশ্বর পাওয়া যায়? তা কে বলতে পারে! সুতরাং পূর্ব্বে যারা ঘোরনদী বজ্রে, জলে, মাটী ও পাথরে ঈশ্বর বলে পূজে গেছে, তারা যে নরকে যাবে, আর আমরা কি বুধবারে ঘণ্টাখানেকের জন্য চক্ষু বুজে ঘাড় নেড়ে কান্না ও গাওনা শুনে, যে স্বর্গে যাব–তারই বা প্রমাণ কি? সহস্র সহস্র বৎসরে শত শত তত্ত্ববিং ও প্রকৃতিজ্ঞ জ্ঞানীরা যারে পাবার উপায় অবধারণে অসমর্থ হলো, আমি যে সামান্য হীনবুদ্ধি হয়ে তাঁর অনুগৃহীত বলে অহঙ্কার ও অভিমান করি, সে কতটা নির্বুদ্ধির কর্ম্ম! ব্রহ্মজ্ঞানী যেমন পৌত্তলিক, কৃশ্চান ও মোছলমানদের অপদার্থ ও অসার বলে জানেন, তারাও ব্রাহ্মদের পাগল ও ভণ্ড বলে স্থির করেন। আজকাল যেখানে যে ধর্মে রাজমুকুট নত হয়, সেখানে সেই ধৰ্ম্মই প্রবল। কালের অব্যর্থ নিয়মে প্রতিদিন সংসারের যেমন পরিবর্তন হচ্চে, ধৰ্ম্ম, সমাজ, রীতি ও নিয়মও এড়াচ্চে না। যে রামমোহন রায় বেদকে মান্য করে তার সুত্রে ব্রাহ্মধৰ্ম্মের শরীর নির্মাণ করেছেন, আজ একশ বছরও হয় নাই, এরই মধ্যে তার শিষেরা সেটি অস্বীকার করেন-ক্ৰমে কৃশ্চানীর ভড়ং ব্রাহ্মধর্মের অলঙ্কার করে তুলেছেন-“আরও কি হয়! এই সকল দেখে শুনেই বুঝি কতকগুলি ভদ্রলোক ঈশ্বরের অস্তিত্বেই বিশ্বাস করেন না। যদি পরমেশ্বররের কিছুমাত্র বিষয়জ্ঞান থাকতো, তা হলে সাধ করে ‘ঘোড়ার ডিম’ ও ‘আকাশকুসুমের’র দলে গণ্য হতেন না। সুতরাং একদিন আমরা তারে একজন কাণ্ডজ্ঞানহীন পাড়াগেঁয়ে জমিদার বলে ডাকতে পারি।
সন্ন্যাসী আমাদের বসতে বলে অন্য কথা তোলবার উপক্রম কচ্চেন, এমন সময়ে বঙ্কুবেহারীবাবু এসে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম কল্লেন—সে দিন বঙ্কুবেহারিবাবু মাথায় একটি জরীর কাবুলী তাজ, গায়ে লাল গাজের একটি পিরহান, “বেচে থাকুক বিদ্দেসাগর চিরজীবী হয়ে’ পেড়ে শান্তিপুরের ধুতি ও ডুরে উড়ুনী মাত্র ব্যবহার করেছিলেন, আর হাতে একখানি লাল রঙ্গের রুমাল ছিল—তাতে রিংসমেত গুটিকত চাবী ঝুলছিল।
বঙ্কবেহারীবাবুর ভূমিকা, মিষ্টি আলাপ, নমস্কার ও স্যেকহ্যাণ্ড চুকলে পর, তার দাদা সন্ন্যাসীকে হিন্দীতে বুঝিয়ে বল্লেন যে, এই সকল ভদ্দর লোকেরা আপনার বুজরুকী ও ক্যারামত দেখতে এসেছেন; প্রার্থনা—অবকাশমত দুই একটা জাহার করেন, তাতে সন্নাসীও কিছু কষ্টের পর রাজী হলেন। ক্রমে বুজরুকীর উপক্রমণিকা আরম্ভ হলো, বঙ্কবেহারীবাবু প্রোগ্র্যাম স্থির কল্লেন, কিছুক্ষণ দেখতে দেখতে প্রথমে ঘটের উপর থেকে একটি জবাফুল তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো। ঘটের উপর থেকে জবাফুল বর্ষাকালের কড়কটে ব্যাঙের মত থপসি করে লাফিয়ে উঠলো, সন্ন্যাসী তার দুহাত তফাতে বসে রয়েচেন—এ দেখলে হঠাং বিস্মিত হতেই হয়। সুতরাং ঘর শুদ্ধ লোক খণিকক্ষণ অবাক হয়ে রইলেন সন্ন্যাসীর গম্ভীরতা ও দর্পভরা মুখখানি তই অহঙ্কারে ফুলে উঠতে লাগলো। এমন সময়ে এক জন চেল এক বোতল মদ এনে উপস্থিত কল্লেদ দুর্ব হয়ে যাবে। পাছে ডবল বোতল বা অন্য কোন জিনিষ বলে দর্শকদের সন্দেহ হয়, তার জন্য সন্ন্যাসী একখানি নতুন সরায় সেই বোতলের সমুদায় মদটুকু ঢেলে ফেল্লেন, ঘর মদের গন্ধে তর্র্ হয়ে গ্যালো–সকলেরই স্থির বিশ্বাস হলো, এ মদ বটে।
সন্ন্যাসী নতুন সরায় মদ ঢেলেই একটি হুঙ্কার ছাড়িলেন, ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলেরা আঁতকে উঠলো, বুড়োদের বুক গুর গুর কত্তে লাগলো; একজন চেলা নিকটে এসে জিজ্ঞাসা কল্লে, “গুরু! এ কটোরেমে ক্যা হয়?” সন্ন্যাসী, “দুধ হো বেটা!” বলে তাতে এক কুশী জল ফেলবামাত্র সরার মদ দুধের মত সাদা হয়ে গেল—আমরাও দেখে শুনে গাধা বনে গেলুম। এইরকম নানা প্রকার বুজরুকী ও কার্দ্দানী প্রকাশ হতে হতে রাত্রি এগারোটা বেজে গেল; সুতরাং সকলের সম্মতিতে বঙ্কবাবুর প্রস্তাবে সে রাত্রের মত বেদব্যাসের বিশ্রাম হলো; আমরা রামরকমের একটা প্রণাম দিয়ে, একটি উল্লুক হয়ে বাড়ীতে এলেম। একে ক্ষুধাও বিলক্ষণ হয়েছিল, তাতে আমাদের বাহন ঝাঁকামুটেটি যে রাৎকাণা, তা পূৰ্ব্বে বলে নাই; সুতরাং তার হাত ধরে গুটি গুটি করে আধ ক্রোশ পথ উজোন ঠেলে তাকে কাঠের দোকানে পৌঁছে রেখে, তবে বাড়ী যাই। দুঃখের বিষয়, আবার সে রাত্রে বেড়ালে আমাদের খাবারগুলি সব খেয়ে গিয়েছিল; দোকানগুলিও বন্ধ হয়ে গ্যাচে। সুতরাং ক্ষুধায় ও পথের কষ্টে আমরা হতভম্ব হয়ে, সে রাত্রি অতিবাহিত করি!
আমরা পূর্ব্বেই বলে এসেছি, “দশ দিন চোরের এক দিন সেধের”। ক্রমে অনেকেই বঙ্কবাবুর বাড়ীর সন্ন্যাসীর কথা আন্দোলন কত্তে লাগলেন, শেষে এক দিন আমরা সন্ন্যাসীর জুচ্চরি ধত্তে স্থির প্রতিজ্ঞ হয়ে, বন্ধুবাবুর বাড়ীতে গেলেম!
পূর্ব্বদিনের মত জবাফুল তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো, এমন সময়ে মেডিকেল কলেজের বাঙ্গালা ক্লাশের একজন বাঙ্গাল ছাত্র লাফিয়ে গিয়ে সন্ন্যাসীর হাত ধরে ফেল্লেন। শেষে হুড়োমুড়িতে বেরুলো জবাফুলটি ঘোড়ার বালুঞ্চি দিয়ে, তাঁর নখের সঙ্গে লাগান ছিল!
সংসারের গতিই এই! একবার অনর্থের একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র বেরুলে, ক্রমে বহুলী হয়ে পড়ে। বালুঞ্চি বাঁধা জবাফুল ধরা পড়তেই, সকলেই একত্র হয়ে সন্ন্যাসীর তোবড়া-তুবড়ি খানা-তল্লাসী কত্তে লাগলেন; একজন ঘুর্ত্তে ঘুৰ্ত্তে ঘরের কোণ থেকে একটা মরা পাঁটা বাহির কল্লেন। সন্ন্যাসী একদিন ছাগল কেটে প্রাণ দান দেন, সেই কাটা ছাগলটি সরাতে না পেরে, ঘরের কোণেই (ফ্লোরওয়ালা মেজে নয়) পুতে রেখেছিলেন, তাড়াতাড়িতে বেমালুম করে মাটী চাপাতে পারেন নাই, পাঁটার একটি সিং বেরিয়েছিল-–সুতরাং একজরে পায় ঠ্যাকাতেই অনুসন্ধানে বেরুলো; সন্ন্যাসী আমাদের সাক্ষাতে যে মদকে দুধ করেছিলেন, সেদিন তারও জাঁক ভেঙ্গে গেল, সেই মজলিসের একজন সব আসিষ্টাণ্ট সার্জ্জন বল্লেন যে, আমেরিকান (মার্কিণ আনীস) নামক মদে জল দেবা মাত্র সাদা দুধের মত হয়ে যায়। এই রকম ধরপাকড়ের পর বেহারীবাবুও সন্ন্যাসীকে অপ্রস্তুত করেন। আমরা রৈ রৈ শব্দে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেলেম, হরিভদ্দর খুড়ো সন্ন্যাসীর পেতলের শিবটি কেড়ে নিলেন, সেটি বিক্রী করে নেপালে চরস কেনেন ও তাঁরও সেইদিন থেকে এই রকম বুজরুক সন্ন্যাসীদের উপর অশ্রদ্ধা হয়।
পূর্ব্বে এই সকল অদৃষ্টচর ব্যাপারের যে রকম প্রাদুর্ভাব ছিল এখন তার অংশে আধগুণও নাই। আমরা সহরে কদিন কটা উৰ্দ্ধবাহু, কটা অবধূত দেখতে পাই? ক্রমে হিন্দুধর্মের সঙ্গে সঙ্গে এ সকল জুয়াচ্চরীরও লাঘব হয়ে অসচে; ক্রেতা ও লাভ ভিন্ন কোন ব্যবসাই স্থায়ী হয় না; সুতরাং উৎসাহদাতা-বিরহেই এই সকল ধৰ্ম্মানুসঙ্গিক প্রবঞ্চনা উঠে যাবে। কিন্তু কলকেতা সহরের এমনি প্রসবক্ষমতা যে এখনও এমন এক একটি মহাপুরুষের জন্ম দিচ্চেন যে, তারা যাতে এই সকল বদমায়েসী চিরদিন থাকে, যাতে হিন্দুধৰ্ম্মের ভড়ং ও ভণ্ডামোর প্রাদুর্ভাব বাড়ে সহস্র সৎকাৰ্য্য পায়ের নীচে ফেলে তার জন্যই শশব্যস্ত! একজনেরা তিন ভাই ছিল, কিন্তু তিনটিই পাগল; একদিন বড় ভাই তার মাকে বলে যে “মা! তোমার গর্ভটি দ্বিতীয় পাগলা গারদ।” সেই রকম একদিন আমরাও কতো সহরকে “রত্নগর্ভা।” বলেও ডাকতে পারি–কলকেতার কি বড় মানুষ, কি মধ্যাবস্থ এক একজন এক একটি রত্ন!! এই দৃষ্টান্তে আমরা বাবু পদ্মলোচনকে মজলিসে হাজির কল্লেম।
১.২৭ পদ্মলোচন দত্ত ওরফে হঠাৎ অবতার
বাবু পদ্মলোচন ওরফে হঠাৎ অবতার ১১১২ সালে তাঁর মাতামহ নাউ-পাড়ামুষুলীর মিত্তিরদের বাড়ী জন্মগ্রহণ করেন। নাউপাড়ামুষুলী গ্রামখানি মন্দ নয়, অনেক কায়স্থ ও ব্রাহ্মণের বাস আছে, গাঁয়ের জমিদার মজফ্ফর খাঁ মোছলমান হয়েও গরু জবাই প্রভৃতি দুঙ্কর্মে বিরত ছিলেন। মোল্লা ও ব্রাহ্মণ উভয়কেই সমান দেখতেন—মানীর মান রাখতেন ও লোকের খাতির ও সেলামাল্কীর গুণা কত্তেন না; ফরাসীতে তিনি বড় লায়েক ছিলেন, বাঙ্গলা ও উর্দুতেও তাঁর দখল ছিল। মজফ্ফর খাঁ গায়ের জমিদার ছিলেন বটে, কিন্তু ধোপা-নাপিত বন্ধ করা, হুঁকা মারা, ঢ্যালা ফালা, বিয়ে ও গ্রাম ভাটীর হুকুম হাকাম ও নিষ্পত্তি করার ভার মিত্তিরবাবুদের উপরই দেওয়া হয়। পূৰ্ব্বে মিত্তিরবাবুদের বড় জলজলাট ছিল মধ্যে পরিবারের অনেকে মরে যাওয়ায় ভাগাভাগী ও বহু গোষ্ঠী নিবন্ধন কিঞ্চিৎ দৈন্যদশা পড়তে হয়েছিল; কিন্তু পূৰ্ব্বোপেক্ষা নিঃস্ব হলেও গ্রামস্থ লোকদের কাছে মানের কিছুমাত্র ব্যত্যয় হয়নি।
পদ্মলোচনের জন্মদিনটি সামান্য লোকের জন্মদিনের মত অমনি যায়নি; সেদিন—হঠাৎ মেঘাড়ম্বর করে সমস্ত দিন অবিশ্রাম বৃষ্টি হয়–একটি সাপ আঁতুড় ঘরের দরজায় সমস্ত রাত্রি বসে ফোঁস ফোঁস করে, আর বাড়ীর একটি পোষা টিয়ে পাখী হঠাৎ মরে গিয়ে দাঁড়ে ঝুলে থাকে। পদ্মলোচনের পিতামহী এ সকল লক্ষণ শুভ নিমিত্ত বিবেচনা করে, বড়ই খুসী হয়ে আপনার পর্বার একখানি লালপেড়ে সড়িী ধাইকে বক্সি, দেন। অভ্যাগত ঢুলি ও বাজন্দরেরাও একটি সিকি আর এক হাঁড়ি নারকেল লাডু পেয়েছিল! ক্রমে মহা আনন্দে আট্কৌড়ে সারা হলো, গায়ের ছেলেরা “আটকৌড়ে বাট্কৌড়ে ছেলে আছে ভাল, ছেলের বাবার দাড়িতে বসে হাগ” বলে কূলো বাজিয়ে আটকড়াই, বাতাসা ও এক এক চকচকে পয়সা নিয়ে, আনন্দে বিদেয় হলো! গোভাগাড় থেকে একটা মরা গরুর মাথা কুড়িয়ে এনে আঁতুড়ঘরের দরজায় রেখে ‘দোরষষ্ঠী’ বলে হলুদ ও দূৰ্ব্বো দিয়ে পুজো করা হলো। ক্রমে ১৫ দিন ২০ দিন, তক মাস সম্পূর্ণ হলে গাঁয়ের পঞ্চাননতলায় ষষ্ঠীর পুজো দিয়ে আঁতুড় ওঠান হয়।
ক্রমে পদ্মলোচন শুক্লতিথিগত চাঁদের মতন বাড়তে লাগলেন! গুলিদাণ্ডা, কপাটী কপাটী, চোর চোর, তেলি হাত পিছলে গেলি প্রভৃতি খেলায় পদ্মলোচন প্রসিদ্ধ হয়ে পড়লেন। পাঁচ বছরে হাতে খড়ি হলো, গুরু মহাশয়ের ভয়ে পদ্মলোচন পুকুরপাড়ে, নল বনে ও বাঁশবাগানে লুকিয়ে থাকেন, পেট কামড়ানি ও গা বমি বমি প্রভৃতি অন্তঃশীলে রোগেরও অভাব রইলো না; ক্রমে কিছুদিন এই রকমে যায়, একদিন পদ্মলোচনের বাপ মলেন, তাঁর মা আগুন খেয়ে গেলেন; ক্রমে মাতামহ, মামা ও মামাতো ভেয়েরাও একে একে অকালে ও সময়ে সল্লেন; সুতরাং মাতামহ মিত্তিরদের ভিটে পুরুষশূন্য প্রায় হলো। জমিজমাগুলি জয়কৃষ্ণের মত জমিদারে কতক গিলে ফেলে, কতক খাজনা না দেওয়ায় বিকিয়ে গেল। সুতরাং পদ্মলোচনকে অতি অল্পবয়সে পেটের জন্যে অদৃষ্ট ও হাতযশের উপর নির্ভর কত্তে হলো। পদ্মলোচন কলকেতায় এসে এক বাসাড়েদের বাসায় পেটভাতে ফাইফরমাস, কাপড় কোঁচানো ও লূচি ভাজা প্রভৃতি কৰ্ম্মে ভর্ত্তি হলেন—অবকাশ মত হাতটাও পাকান হবে—বিশেষতঃ কুঠেলরা লেখা-পড়া শেখাবেন, প্রতিশ্রুত হলেন।
পদ্মলোচন কিছুকাল ঐ নিয়মে বাসাড়েদের মনোরঞ্জন করতে লাগলেন, ক্রমে দু-এক বাবুর অনুগ্রহপাপ্তির প্রত্যশায় মাথালে জায়গায় উমেদারী আর কল্লেন। সহরের যে বড়মানুষের বৈঠকখানায় যাবেন, প্রায় সর্ব্বত্রই লোকারণ্য দেখতে পাবেন; যদি ভিতরকার খবর দ্যান, তা হলে পাওনাদার, মহাজন, উঠনোওয়ালা দোকানদার, উমেদার, আইবুড়ো ও বেকার কুলীনের ছেলে বিস্তর দেখতে পাবেন—পদ্মলোচনও সেই ভিড়ের মধ্যে একটি বাড়লেন; ক্রমে অষ্টপ্রহর ঘণ্টার গরুড়ের মত উমেদারিতে অনবরত এক বৎসর হাঁটাহাঁটা ও হাজিরের পর দুচারখানা সই-সুপারিসও হস্তগত হলো; শেষে এক সদয়হৃদয় মুছুদ্দী আপনার হাউসে ওজোন সরকারী কর্ম্ম দিলেন।
পদ্মলোচন কষ্টভোগের একশেষ করেছিলেন; ভদ্দরলোকের ছেলে হয়েও তাকে কাপড় কোঁচানো, লুচি ভাজা, বাজার করা, জল তোলা প্রভৃতি অপকৃষ্ট কাজ স্বীকার কত্তে হয়েছিল; ক্রমশঃ লুচি ভাজতে ভাজতে ক্রমে লুচি ভাজায় তিনি এমনি তইরি হয়ে উঠলেন যে, তার মত লূচি অনেক মেঠাইওয়ালা বামুনেও ভাজতে পাত্তো না! বাসাড়েরা খুসী হয়ে তারে ‘মেকর’ খেতাব দেয়। সুতরাং সেই দিন থেকে তিনি ‘মেকর পদ্মলোচন দত্ত’ নামে বিখ্যাত হলেন!
ভাষা কথায় বলে “যখন যার কপাল ধরে–যখন পড়তা পড়তে আরম্ভ হয়, তখন ছাইমুটো ধল্লে সোণমুটো হয়ে যায়। ক্রমে পদ্মলোচন দত্তের শুভদৃষ্ট ফলতে আরম্ভ হলো, মুদী অনুগ্রহ করে শিপসরকারী কর্ম্ম দিলেন। সাহেবরাও দত্তজার বিলাকী ও কাজের হুসিয়ারিতে সন্তুষ্ট হতে লাগলেন পদ্মলোচন ততই সাহেবদের সন্তুষ্ট করবার অকসুর খুঁজতে লাগলেন—একমনে সেবা কক্সে ভয়ঙ্কর সাপও সদয় হয়; পুরাণে পাওয়া যায় যে, তপস্যা করে অনেকে হিন্দুদের ভূতের মত ভয়ানক দেবতাগুলোকেও প্রসন্ন করেছে! ক্ৰম সায়েবরা পদ্মলো:নর প্রতি সন্তুষ্ট হয় তার ভাল করার চেষ্টায় রইলন; একদিন হাউসের সদরমেট কর্ম্মে জবাব দিলে সায়েবরা মুছুদ্দীকে অনুরোধ করে পদ্মলোচনকে সেই কর্ম্মে ভর্ত্তি কল্লেন!
পদ্মলোচন শিপসরকার হয়েও বাসড়েদের আশ্রয় পরিত্যাগ করেন নি; কিন্তু সদরমেট হয়ে সেখানে থাকা আর ভাল দেখায় না বলেই, অন্যত্র একটু জায়গা ভাড়া করে একখানি খেলার ঘর প্রস্তুত করে রইলেন। কিন্তু এ অবস্থায় তাঁরে অধিকদিন থাকতে হলো না। তাঁর অদৃষ্ট শীঘ্রই লুচির ফোসকার মত ফুলে উঠলো–বের জল পেলে কনেরা যেমন ফেঁপে ওঠে, তিনিও তেমনি ফাঁপতে লাগলেন। ক্রমে মুচ্ছুদ্দীর সঙ্গে সায়েবদের বড় একটা বনিবনাও না হওয়ায় মুচ্ছুদ্দী কৰ্ম্ম ছেড়ে দিলেন, সুতরাং সায়েবদের অনুগ্রহধর পদ্মলোচন, বিনা ডিপজিটে মুচ্ছুদ্দী হলেন।
টাকায় সকলই করে! পদ্মলোচন মুচ্ছুদ্দী হবামাত্র অবস্থার পরিবর্ত্তন বুঝতে পাল্লেন। তার পরদিন সকালে খেলার ঘর বালাখানাকে ভাংচাতে লাগলো—উমেদার, দালাল, প্যায়দা, গদিওয়ালা ও পাইকার ভরে গেল। কেউ পদ্মলোচনবাবুকে নমস্কার করে হাঁটুগেড়ে জোড়হাত করে কথা কয়, কেউ ‘আপনার সোণার দোত কলম হোক’ ‘লক্ষপতি হোন’ ‘সম্বৎসরের মধ্যে পুওর সন্তান হোক’ অনুগতের হুজুর ভিন্ন গতি নাই’ প্রভৃতি কথায় পদ্মলোচনকে তুঁদুলে পাউরুটী হতেও ফোলাতে লাগলেন–ক্রমে দুরবস্থা দুষ্কর লোচ্চার মত মুখে কাপড় দিয়ে লুকুলেন–অভিমানও অহঙ্কারে ভূষিত হয়ে সৌভাগ্যযুবতী বারাঙ্গনা সেজে তাঁরে আলিঙ্গন কল্লেন, হুজুকদারেরা আজকাল ‘পদ্মলোচনকে পায় কে’ বলে ঢ্যাঁকা পিটে দিলেন, প্রতিধ্বনি রেও বামুন, অগ্রদানী ও গাইয়ে বাজিয়ে সেজে এই কথাটি সর্ব্বত্র ঘোষণা করে বেড়াতে লাগলেন–সহরে ঢি ঢি হয়ে গেল—পদ্মলোচন একজন মস্ত লোক।
কলকেতা সহরে কতকগুলি বেকার জয়কেতু আছেন। যখন যার নতুন বোলবোলাও হয়, তখন তাঁরা সেইখানে মেশেন, তাঁকেই জগতের শ্রেষ্ঠ দেখান ও অনন্যমনে তাঁরই উপাসনা করে, আবার যদি তাঁর চেয়ে কেউ উঁচু হয়ে পড়েন, তবে তাঁরে পরিত্যাগ করে উঁচু দলে জমেন; আমরা ছেলেবেলা বুড়ো ঠাকুরমার কাছে ‘ছাঁদন দড়ি ও গোদা নড়ির’ গল্প শুনেছিলাম, এই মহাপুরুষেরা ঠিক সেই ‘ছাঁদন দড়ি গোদা নড়ি।’ গল্পে আছে, রাজপুত্তুর জিজ্ঞাসা কল্লো, “ছাঁদন দড়ি গোদা নড়ি! এখন তুমি কার?–না আমি যখন যার তখন তার?” তেমনি হতোমপ্যাঁচা বলেন, সহুরে জয়কেতুরাও যখন যার তখন তার!!
জয়কেভু ভদ্দরলোকের ছেলে, অনেকে লেখাপড়াও জানেন; তবে কেউ কেউ মূর্ত্তিমতী মা। এঁদের অধিকাংশই পৌত্তলিক, কুলীন বামুন, কায়স্থ কুলীন, বেকার, পেনশুনে ও ব্রকোদই বিস্তর! বহুকালের পর পদ্মলোচনবাবু কলকেতা সহরে বাবু বলে বিখ্যাত হন। প্রায় বিশ বৎসর হলো সহরের হঠাৎ বাবুর উপসংহার হয়ে যায়, তন্নিবন্ধন ‘জয়কেতু’ ‘মোসাহেব’ ‘ওস্তাদজী’ ‘ভড়জা’ ‘ঘোষজা’ ‘বোসজা’ প্রভৃতি বরাখুরেরা জোয়ারের-বিষ্ঠার মত ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছিলেন, সুতরাং এখন পদ্মলোচনের “তর্পণের কোশায়” জুড়াবার জায়গা পেলেন।
জয়কেতুরা ক্রমে পদ্মলোচনকে ফাঁপিয়ে তুল্লেন, পড়তাও ভাল চল্লো—পদ্মলোচন অ্যাম্বিসনের দাস হলেন, হিতাহিত বিবেচনা দেনদার বাবুদের মত গা ঢাকা হলেন। পদ্মলোচন প্রকৃত হিন্দুর মুখোস পরে সংসার-রঙ্গভূমিতে নাবলেন;–ব্রাহ্মণের পার্দ্ধলো খান–পা চাটেন—দলাদলির ও হিন্দুধর্মের ঘোঁটি করেন—ঠাকরুণ বিষয় ও সখীযংবাদ গাওনার পক্ষে প্রকৃত ব্লটীংপেপার; পদ্মলোচনের দোর্দ্দণ্ড প্রতাপ! বৈঠকখানায় ব্রাহ্মণ অধ্যাপক ধরে না, মিউটিনীর সময়ে গবর্ণমেণ্ট যেমন দোচোখখাত ভলেটীয়ার জুটিয়েছিলেন, পদ্মলোচন বাবু হয়ে সেইরূপ ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত সংগ্রহ কত্তে বাকি রাখলেন না! এসিয়াটিক সোসাইটির মিউজিয়মের মত বিবিধ আশ্চর্য জীব একত্র কল্লেন—বেশীর ভাগ জ্যান্ত!!
বাঙ্গালী বদমায়েস ও দুর্ব্বুদ্ধির হাতে টাকা না থাকলে সংসারের কিছুমাত্র ক্ষতি কত্তে পারে না, বদমায়েশী ও টাকা একত্র হলে হাতী পর্য্যন্ত মারা পড়ে, সেটি বড় সোজা ব্যাপার নয়, শিবকেষ্টো বাঁড়ুয্যে পর্য্যন্ত যাতে মারা যান! পদ্মলোচনও পাঁচজন কুলোকের পরামর্শে বদমায়েসী আরম্ভ কল্লেন—পৃথিবীর লোকের নিন্দা করা, খোঁটা দেওয়া বা টিট্কারী করা তার কাজ হলো; ক্রমে তাতেই তিনি এমনি চোড়ে উঠলেন যে, শেষে আপনাকে আপনি অবতার বলে বিবেচনা কত্তে লাগলেন; পারিষদেরা অবতার, বলে তাঁর স্তব কত্তে লাগলো; বাজে লেকে ‘হঠাৎ অবতার’ খেতাব দিলে-দর্শক ভদ্দর লোকেরা এই সকল দেখে শুনে অবাক হয়ে ক্ল্যাপ দিতে লাগলেন।
পদ্মলোচন যথার্থই মনে মনে ঠাউরেছিলেন যে, তিনি সামান্য মনুষ্য নন, হরি হরি, নয় পীর কিম্বা ইহুদিদের ভাবী মেসায়া!—তারই সফলতা ও সার্থকতার জন্য পদ্মলোচন বুজরুকী পর্য্যন্ত দেখাতে ত্রুটী করেন নাই।
বিলাতী জিজেষ্ক্রাইষ্ট এক টুকরো রুটিতে একশ লোক খাইয়েছিলেন–কানা ও খোঁড়া ফুঁয়ে ভাল কত্তেন! হিন্দু মতের কেষ্টও পূতনা বধ, শকটভঞ্জন প্রভৃতি অলৌকিক কাৰ্য্য করেছিলেন। পদ্মলোচন আপনারে অবতার বলে মানাবার জন্যে সহরে হুজুক তুলে দিলেন যে, “তিনি একদিন বারো জনের খাবার জিনিসে একশ লোক খাইয়ে দিলেন।” কাণ খোঁড়ারা সর্ব্বদাই হবেড়ীর ধ্বজবজ্রাঙ্কুশযুক্ত পদ্মহস্ত পাবার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেন, বুড়ী বুড়ী মাগীরা ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলে নিয়ে ‘হাতবুলানো’ পাইয়ে আনে, পদ্মলোচন এইরূপ নানাবিধ বুজরুকী প্রকাশ কত্তে লাগলেন। এই সকল শুনে চতুষ্পাঠীওয়ালা মহাপুরুষের মড়কের শকুনির মত নাচতে লাগলেন—টাকার এমনি প্রতাপ যে, চন্দ্রকে দেখে রত্নাকর সাগরও কেঁপে ওঠেন—অন্যের কি কথা! ময়রার দোকানে যত রকমারি মাছি, বসন্তি বোলতা আর ভোঁভূয়ে ভোমরা দেখা যায়, বইয়ের দোকানে তার কটা থাকে সেথায় পদার্থহীন উই পোকার—আন্সাড়ে আরুসুলার দল, আর দু একটা গোডিমওয়ালা ফচকে নেংটি ইঁদুর মাত্র।
হঠাৎ টাকা হলে মোজ যে রকম গরম হয়, এক দম গাঁজাতেও সে রকম হয় না, হঠাৎ অবতার হয়েও পদ্মলোচনের আশা নিবৃত্ত হবে তারও সম্ভাবনা কি? কিছু দিনের মধ্যে পদ্মলোচন কলকেতা সহরের একজন প্রধান হিন্দু হয়ে পড়েন তিনি হাই তুল্লে হাজার ভুঁড়ি পড়ে–তিনি হাঁচলে জীব জীব জীব শব্দে ঘর কেঁপে উঠে! ‘ওরে ওরে ওরে!’ ‘হুজুর’ ও ‘যো হুকুমের’, হল্লা পড়ে গেল, ক্রমে সহরের বড় দলে খবর হলো যে, কলকেতার ন্যাচরাল হিষ্টীর দলে একটি নম্বরে বাড়লো।
ক্রমে পদ্মলোচন নানা উপায়ে বিলক্ষণ দশ টাকা উপায় কত্তে লাগলেন, অবস্থার উপযুক্ত একটি নতুন বাড়ী কিনলেন, সহরের বড়মানুষ হলে যে সকল জিনিপত্র ও উপাদানের আবশ্যক, সভাস্থ আত্মীয় ও মোসাহেবের ক্রমশঃ সেই সকল জিনিস সংগ্রহ করে ভাণ্ডার ও উদর পুরে ফেল্লেন; বাবু স্বয়ং পছন্দ করে (আপন চক্ষে সুবর্ণ বর্ষে) একটি অবিদ্যাও রাখলেন।
বেশ্যাবাজীটি আজকাল এ সহরে বাহাদুরীর কাজ ও বড়মানুষের এলবাত পোষাকের মধ্যে গণ্য। অনেক বড়মানুষ বহুকাল হলো মরে গেচেন, কিন্তু তাদের রক্ষিতার বাড়ীগুলি আজও মনুমেন্টের মত তাঁদে স্মরণার্থে রয়েছে—সেই তেতলা কি দোতলা বাড়ীটি ভিন্ন তাদের জীবনে আর এমন কিছু কাজ হয় নি, যা দেখে সাধারণে তাদের স্মরণ করে। কলকেতার অনেক প্রকৃত হিন্দু দলপতি ও রাজারাজড়ারা রাত্রে নিজ বিবাহিত স্ত্রীর মুখ দেখেন না। বাড়ীর প্রধান আমলা, দাওয়ান মুচ্ছুদ্দিরা যেমন হুজুরদের হয়ে বিষয় কৰ্ম্ম দেখেন—স্ত্রীর রক্ষণাবেক্ষণের ভারও তাঁদের উপর আইন মত অর্শায়, সুতরাং তাঁরা ছাড়বেন কেন? এই ভয়ে কোন কোন বুদ্ধিমান স্ত্রীকে বাড়ীর ভিতরের ঘরে পূরে চাবি বন্ধ করে বাইরের বৈঠকথানায় সারা রাত্রি অবিদ্যা নিয়ে আমোদ করেন, তোপ পড়ে গেলে ফরসা হবার পূর্ব্বে গাড়ী বা পাল্কী করে বিবিসাহেব বিদায় হন—বাবু বাড়ীর ভিতর গিয়ে শয়ন করেন।–স্ত্রীও চাবি হতে পরিত্রাণ পান। ছোকরাগোছের কোন কোন বাবুরা বাপ-মার ভয়ে আপনার শোবার ঘরে স্ত্রীকে একাকিনী ফেলে আপনি বেরিয়ে যান; মধ্য রাত্রি কেটে গেলে বাবু আমোদ লুটে ফেরেন ও বাড়ীতে এসে চুপি চুপি শোবার ঘরের দরজায় ঘা মারেন, দরজা খোলা পেলে বাবু শয়ন করেন। বাড়ীর আর কেউই টের পায় না যে, বাবু রাত্রে ঘরে থাকেন না। পাঠকগণ! যারা ছেলে বেলা থেকে “ধৰ্ম্ম যে কার নাম, তা শোনে নি, হিতাহিত বিবেচনার সঙ্গে যাদের সুদূর সম্পর্ক, কতকগুলি হতভাগা মোসাহেবই যাদের হাল” তারা যে এই রকম পশুবৎ কদাচারে রত থাকবে, এ বড় আশ্চাৰ্য নয়! কলকেতা সহর এই মহাপুরুষদের জন্য বেশ্যাসহর হয়ে পড়েছে, এমন পাড়া নাই, যেখানে অন্তত দশ ঘর বেশ্যা নাই, হেয় প্রতি বৎসর বেশ্যার সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে বই কমছে না। এমন কি, এক জন বড়মানুষের বাড়ীর পাশে একটি গৃহস্থের সুন্দরী বউ কি মেয়ে বার কবার যো নাই, তা হলে দশ দিনেই সেই সুন্দরী টাকা ও সুখের লোভে কুলে জলাঞ্জলি দেবে—যত দিন সুন্দরী বাবুর মনস্কামনা পূর্ণ না করবে, তত দিন দেখতে পাবেন, বাবু অষ্ট প্রহর বাড়ীর ছাদের উপর কি বারান্দাতেই আছেন, কখন হাসচেন, কখন টাকার তোড়া নিয়ে ইসারা কোরে দেখাচ্চেন। এ ভিন্ন মোসাহেবদেরও নিস্তার নাই; তাঁরা যত দিন তাঁরে বাবুর কাছে না আনতে পারেন, ততদিন মহাদায়গ্রস্ত হয়ে থাকতে হবে, হয় ত সে কালের নবাবদের মতে “জান বাচ্চা এক গাড়” হবার হুকুম হয়েচে! ক্রমে কলে কৌশলে সেই সাধ্বী স্ত্রী বা কুমারীর ধর্ম্ম নষ্ট করে শেষে তাড়িয়ে দেওয়া হবে—তখন বাজারে কশার করাই তার অনন্যগতি হয়ে পড়ে! শুধুই এই নয় সহরের বড় মানুষেরা অনেকে এমনি লম্পট যে স্ত্রী ও রক্ষিত মেয়েমানুষ-ভোগেও সন্তুষ্ট নন, তাতেও সেই নরাধম রাক্ষসদের কাম-ক্ষুধাও নিবৃত্তি হয় না—শেষে আত্মীয়া যুবতীরাও তার ভোগে লাগে।–এতে কত সতী আত্মহত্যা করে, বিষ খেয়ে এই মহাপাপীদের হাত এড়িয়েছে। আমরা বেশ জানি, অনেক বড়মানুষের বাড়ী মাসে একটি করে প্রাণহত্যা হয় ও রক্তকম্বলের শিকড়, চিতের ডাল ও করবীর ছালের নুন-তেলের মত উঠনো বরাদ্দ আছে। যেখানে হিন্দুধর্মের অধিক ভড়ং, যেখানে দলাদলির অধিক ঘোঁট ও ভদ্দরলোকের অধিক কুৎসা, প্রায় সেখানেই ভিতর বাগে উদোম এলো, কিন্তু বাইরে পাদে গেরো!
হায়! যাদের জন্মগ্রহণে বঙ্গভুমির দুরবস্থা দূর হধা প্রত্যাশা করা যায়, যার প্রভূত ধনের অধিপতি হয়ে স্বজাতি, সমাজ ও বঙ্গভূমির মঙ্গলের জন্য কায়মনে যত্ন নেবে, না সেই মহাপুরুষেরাই সমস্ত ভয়ানক দোষ ও মহাপাপের আকর হয়ে বসে রইলেন; এর বাড়া আর আক্ষেপের বিষয় কি আছে? আজ একশ বৎসর অতীত হলো, ইংরাজের এ দেশে এসেছেন, কিন্তু আমাদের অবস্থার কি পরিবর্ত্তন হয়েছে? সেই নবাবী আমলের বড়মানষী কেতা, সেই পাকান কাচা, সেই কোঁচান চাদর, লপেটা জুতো ও বাবরী চুল আজও দেখা যাচ্চে; বরং গৃহস্থ মধ্যস্থ লোকের মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়, কিন্তু আমাদের হুজুরেরা যেমন, তেমনই রয়েচেন। আমাদের ভরসা ছিল, কেউ হঠাৎ বড়মানুষ হলে রিফাইণ্ড গোচের বড়মানুষীর নজীর হবে, কিন্তু পদ্মলোচনের দৃষ্টান্তে আমাদের সে আশা সমূলে নিৰ্ম্মল হয়ে গেল–পদ্মলোচন আবার কফিনচোরের ব্যাটা ম্যকমারা হয়ে পড়লেন, কফিনচোর মরা লোকের কাপড় চুরি কত্তো মাত্র–অবিদ্যা রেখে অবধি পদ্মলোচন স্ত্রীর সহবাস পরিত্যাগ কল্লেন, স্ত্রী চরে খেতে লাগলেন। পূৰ্ব্ব সহবাস বা তার হাতযশে পদ্মলোচনের গুটি চার ছেলে হয়েছিল; ক্রমে জ্যেষ্ঠটি বড় হয়ে উঠলো, সুতরাং তার বিবাহে বিলক্ষণ ধূমধাম হবার পরামর্শ হতে লাগলো!
ক্রমে বড়বাবুর বিয়ের উজ্জুগ হতে লাগলো; ঘটক ও ঘটকীর বাড়ী বাড়ী মেয়ে দেখে বেড়াতে লাগলেন—“কুলীনের মেয়ে, দেখতে পরমা সুন্দরী হবে, দশ টাকা যোত্তর থাকবে এমনটি শীগগির জুটে ওঠা সোজা কথা নয়। শেষে অনেক বাছা-গোছা ও দেখা-শুনার পর শহরের আগড়োম ভোঁম সিঙ্গির লেনের আত্মারাম মিত্তিরের পৌত্তুরীরই ফুল ফুটলো! আত্মারামবাবু খাস হিন্দু, কাপ্তেনীর কৰ্ম্মে বিলক্ষণ দশ টাকা উপায় করেছিলেন, আত্মারামবাবুর সংসারও রাবণের সংসার বল্লে হয়–সাত সাতটি রোজগেরে ব্যাটা, পরীর মত পাঁচ মেয়ে, আর গড়ে গুটি চল্লিশ পৌত্তুর পৌত্তুরী; এ সওয়ার ভাগ্নে, জামাই কুটুম্বসাক্ষাৎ বাড়ীতে গিজ গিজ করে,–সুতরাং সৰ্বগুণাক্রান্ত আসামি পদ্মলোচনের বেয়াই হবার উপযুক্ত স্থির হলেন। শুভলগ্নে মহা আড়ম্বর করে লগ্নপত্রে বিবাহের দিন স্থির হলো; দলস্থ সমুদায়, ব্রাহ্মণেরা মর্য্যাদামত পত্রের বিদেয় পেলেন, রাজভাট ও ঘটকেরা ধন্যবাদ দিতে চল্লো; বিয়ের ভারী ধূম! সহরে হুজুক উঠলো পদ্মলোচনবাবুর ছেলের বিয়ের পাঁচ লক্ষ টাকা বরাদ্দ–গোপাল মল্লিক ছেলের বিয়েতে খরচ করেছিলেন বটে, কিন্তু এতো নয়।
দিন আসচে দেখতে দেখতেই এসে পড়ে। ক্রমে বিবাহের দিন ঘনিয়ে এলো বিয়েবাড়ীতে নহবৎ বসে গেল। অধ্যক্ষ ভট্টাচার্য্য ও দলস্থদের ঘোঁট বাদন সুরু হলো—ত্রিশ হাজার জোড়া শাল, সোণার লোহা ও ঢাকাই সাড়ী, দু লক্ষ সামাজিক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদলে বিতরণ হলো; বড়মানুষদের বাড়ীতেও ও শাল ও সোণাওয়ালা লোহা, ঢাকাই কাপড়, গেদরা কদ্দক, গোলাব ও আতর, এক এক জোড়া শাল সওগাদ পাঠান হলো! কেউ আদর কবে গ্রহণ কল্লেন, কেউ কেউ বলে পাঠালেন যে, আমরা টুলি বা বাজন্দরে নই যে, শাল নেবো! কিন্তু পদ্মলোচন হঠাৎ অবতার হয়ে শ্রীরামচন্দ্রের মত আত্মবিস্মৃত হয়ে ছিলেন, সুতরাং সে কথা গ্রাহ্য কল্লেন না। পারিষদ, মোসাহেব ও বিবাহেব অধ্যক্ষেরা বলে উঠলেন—বেটার অদৃষ্টে নাই।
এদিকে বিয়েব বাইনাচ আরম্ভ হলো, কোথাও রূপোর বালা লাল কাপড়ের তকমাধরা ও উর্দ্ধী-পরা চাকরেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোথাও অধ্যক্ষেরা গড়ের বাজ্ঞা আনবার পরামর্শ কচ্চেন—কোথাও বরের সজ্জা তইরির জন্য দজ্জিরা একমনে কাজ কচ্চে—চারিদিকেই হৈ হৈ ও রৈ রৈ শব্দ। বাবুর দেওয়া শালে শহরের অর্ধেক লোকেই লালে লাল হয়ে গেল, ঢুলি ও বাজন্দরেরা তো অনেকের বিয়েতেই পুরাণ শাল পেয়ে থাকে, কিন্তু পদ্মলোচনের ছেলের বিয়ের সুন্দর লোকেও শাল পেয়ে লাল হয়ে গেলেন!
১২ই পৌষ শনিবার বিবাহের লগ্ন স্থির হয়েছিল! আজ ১২ই পৌষ, আজ বিবাহ। আমরা পূর্ব্বেই বলেছি যে, সহরে ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল, “পদ্মলোচনের ছেলের বিয়ের পাঁচ লক্ষ টাকা বরাদ্দ।” সুতরাং বিবাহের দিন বৈকাল হতে রাস্তায় ভয়ানক লোকারণ্য হতে লাগলো, পাহারা ওয়ালারা অতি কষ্টে গাড়ীঘোড়া চলবার পথ করে দিতে লাগলো। ক্রমে সন্ধ্যার সময় বর বেরুলো;–প্রথমে কাগজের ও অব্বরের হাতঝাড়, পাঞ্জা ও সিঁড়ি ঝাড় রাস্তার দুপাশে চল্লো। ঐ রেশালার আগে আগে দুটি চলতি নবত ছিল; তার পেছনে গেট–দালান ও কাগজের পাহাড়ের উপর হরপার্ব্বতী, নন্দী, ষাঁড়, ভৃঙ্গী, সাপ ও নানারকম গাছ–তার পেছনে ঘোড়াপঙ্খী, হাতীপঙ্খী, উটপঙ্খী, ময়ূরপঙ্খীগুলির ওপরে বারোজন করে দাঁড়ি, মেয়ে ও পুরুষ সওদাগর সাজা ও দুটি করে ঢোল। তার আশে পাশে তক্তনামার উপর ‘মগের নাচ’ ‘ফিরিঙ্গির নাচ’ প্রভৃতি নানাপ্রকার সাজা সং! তার পশ্চাৎ এক শ’ ঢোল, চল্লিশটি জগঝম্প ও গুটি যাইটেক ঢাক মায় রোষোনচৌকী—শানাই, ভোড় ও ভেপু তার কিছু অন্তরে এক দল নিমখাসা রকমের চুনোগলীর ইংরেজী বাজনা। মধ্যে বাবুর মোসাহেব, ব্রাহ্মণ, পণ্ডিত, পারিষদ, আত্মীয় ও কুটুম্বরা। সকলেরই এক রকম শাল, মাথায় রুমাল জড়ান, হাতে একগাছি ইষ্টিক, হঠাৎ বোধ হয় যেন এক কোম্পানী ডিজার্মড সেপাই! এই দলের দুই ধারে লাল বনাতের খাশ গেলাস ও রূপোর ডাণ্ডিতে রেসমের নিসেনধরা তক্মাপরা মুটে ও ক্ষুদে ক্ষুনে ছোঁড়ারা; মধ্যে খোদ বরকৰ্ত্তা, গুরু-পুরোহিত, বাছালো বাছালো ভূঁড়ে ভূঁড়ে ভটচায্যি ও আত্মীয় অন্তরঙ্গরা; এর পেছনে রাঙ্গামুখোইংরেজী বাজনা, সাজা সায়েব-তুরুক-সওয়ার, বরের ইয়ারবস্ক, খাস দরওয়ানরা, হেড খানসামা ও রূপের সুখাসনখানির চারিদিকে মায় বাতি বেললণ্ঠন, টাঙ্গান, সাম্নে রূপোর দশডেলে বসান ঝাড়, দুই পাশে চামরধরা দুটো ছোঁড়া; শেষে বরের তোরঙ্গ, প্যাটরা, বাড়ীর পরামাণিক, সোনার দানা গলায় বুড়ী বুড়ী গুটীকত দাসী ও বাজে লোক; তার পেছনে বরযাত্রীর গাড়ীয় সার–প্রায় সকলগুলির উপয় এক এক চাকর ডবল বাতিদেওয়া হাত লণ্ঠন ধরে বসে যাচ্চে।
ব্যাণ্ড, ঢাক, ঢোল ও নাগরার শব্দে, লোকের বল্লা ও অধ্যক্ষদের মিছিলের চীৎকারে কলকেতা কাঁপতে লাগলো; অপর পাড়ার লোকেরা তাড়াতাড়ি ছাতে উঠে মনে কল্লে ওদিকে ভয়ানক আগুন লেগে থাকবে। রাস্তার দুধারি বাড়ীর জানালা ও বারাণ্ডা লেকে পুরে গেল। বেশ্যারা “অহা দিব্বি ছেলেটি যেন চাদ!” বলে প্রশংসা কত্তে লাগলো। হুতোমুপচা অন্তরক্ষি থেকে নক্সা নিতে লাগলেন। ক্রমে বর কনের বাড়ী পৌঁছিল। কাকর্ত্তারা তাদর সওষণ করে বরুবাত্তোরদের অভ্যর্থনা কল্লেন–পাড়ার মৌতাতি বুড়ো ও বওয়াটে ছোঁড়ারা গ্রামভটির জন্য বরকর্ত্তাকে ঘিরে দাঁড়ালো –বর সভায় গিয়ে বসলো, ঘটকের ছড়া পড়তে লাগলো, মেয়েরা বার থেকে উঁকি মাত্তে লাগলো, ঘটকের মিত্তিরবাবুর কুলজী আউড়ে দিলে, মিত্তিরবাবু কুলীন, সুতরাং বল্লালী রেজেষ্টারীতে তাঁর বংশাবলী রেজেষ্টারী হয়ে আছে, কেবল দত্তবাবুর বংশাবলীটি বানিয়ে নিতে হয়।
ক্রমে বরযাত্রী ও কন্যাযাত্রীরা সাপ্টা জলপান করে বিদেয় হলেন! বর স্ত্রী-আচারের জন্য বাড়ীর ভিতর গেলেন। ছাদনাতলায় চারিটি কলাগাছের মধ্যে আল্পনা দিয়ে একটি পিঁড়ে রাখা হয়েছিল, বর চোরের মত হয়ে সেইখানে দাঁড়ালে, মেয়েরা দাঁড়া-গুয়া পান বরণডালা, মঙ্গলের ভাঁড়ওয়ালা কুলো ও পিদ্দিম দিয়ে বরণ কল্লেন, শাঁখবাজানো ও উলু উলুর চোটে বড়ি সরগরম হয়ে উঠলো; ক্রমে মায় শ্বাশুড়ী এয়োরা সাতবার বরকে প্রদক্ষিণ কল্লেন–শ্বাশুড়ী বরের হাতে মাকু দিয়ে বল্লেন, “হাতে দিলাম মাকু একবার ভ্যা কর তা বাপু!” বর কলেজ বয়, আড়চোখে এয়োদের পানে তাকাচ্ছিলেন ও মনে মনে লঙ্কা ভাগ কচ্ছিলেন, সুতরাং “মনে মনে কল্লেন” বল্লেন—শালাজেরা কান মলে দিলে, শালীর গালে ঠোনা মাল্লে। শেষে গুড়চাল, __তাক, অষুদ বিষুদ ফুরুলে, উচ্ছুগ্গু করবার জন্য কনেকে দালানে নিয়ে যাওয়া হলো। শাস্ত্রমতে মন্ত্র পড়ে কনে উচ্ছুগ্গু হলেন, পুরুত ও ভট্টাচার্য্যেরা সন্দেশের সরা নিয়ে সল্লেন; বরকে বাসরে নিয়ে যাওয়া হলো। বাসরটিতে আমাদের চূড়ান্ত হয়। আমরা তো অ্যাতো বুড়ো হয়েছি, তবু এখনোও বাসরের আমোদটি মনে পড়লে, মুখ দে লাল পড়ে ও আবার বিয়ে কর্ত্তে ইচ্ছে হয়।
ক্রমে বাসরের অমোদের সঙ্গেই কুমুদিনী অস্ত গেলেন। কমলিনীর হৃদয়রঞ্জন প্রকৃত তেজীয়ান হয়েও যেন তার মানভঞ্জনের জন্যই কোমলভাব ধারণ করে উয়দ হলেন। কমলিনী নাথের তাদৃশ দুর্দ্দশা দেখেই যেন সরোবরের মধ্যে হাসতে লাগলেন; পাখীরা “ছি ছি! কামোন্মত্তদের কিছুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান থাকে না;” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। বায়ু মুচকে মুচকে হাসতে লাগলেন–দেখে ক্রোধে সূৰ্য্যদেব নিজ মূর্ত্তি ধারণ কল্লেন; তাই দেখে পাখীরা ভয়ে দূর-দূরান্তরে পালিয়ে গেল। বিয়েবাড়িতে বাসি বিয়ের উজ্জুগ হতে লাগলো। হলুদ ও তেল মাখিয়ে বরকে কলাতলায় কনের সঙ্গে নাওয়ান এমন হলো, বরণডালায় বরণ ও কতক তুকতাকের পর বর-কনে গাঁটছড়া কিছুক্ষণের পর খুলে দেওয়া হলো।
এদিকে ক্রমে বরযাত্রী ও বরের আত্মীয়-কুটুম্বরা জুটতে লাগলো। বৈকালে পুনরায় সেই রকম মহাসমারোহে বর-কনেকে বাড়ী নে যাওয়া হলো। বরের মা বর-কনেকে বরণ করে ঘরে নিলেন! এক কড়া দুধ দরজার কাছে আগুনের ওপর বসান ছিল, কনেকে সেই দুধের কড়াটি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা কর। হলো “মা! কি দেখচো? বল যে আমার সংসার উৎলে পড়চে দেখছি।” কনেও মনে মনে তাই বল্লেন। এ সওয়ায় পাঁচ গিন্নীতে নানা রকম তুকতাক কল্লে পর বর-কনে জিরুতে পেলেন; বিয়েবাড়ীর কথঞ্চিৎ গোল চুকলো—ঢুলিরা ধেনো মদ খেয়ে আমোদ কত্তে লাগলো। অধ্যক্ষের প্রলয় হিন্দু; সুতরাং একটা একটা অগিতোলা দুর্গোমণ্ডা ও এক ঘটী গঙ্গাজল খেয়ে বিছানায় আড় হলেন-বর কনে আলাদা আলাদা শুলেন–অঞ্জ একত্রে শুতে নাই, বে-বাড়ীর বড়গিন্নীর মতে আজকের রাত–কালরাত্রির।
শীতকালের রাত্রি শীগগির যায় না। এক ঘুম, দু ধুম, আবার প্রস্রাব করে শুলেও বিলক্ষণ এক ঘুম হয়। ক্রমে গুডুম করে তোপ পড়ে গেলো—প্রাতঃস্নানের মেয়েগুলো বকতে বকতে রাস্তা মাথায় করে যাচ্চে—বুড়ো বুড়ো ভটচায্যিরা স্নান করে “মহিম্নঃ পারন্তে” মহিম্নস্তব আ ওড়াতে আওড়াতে চলেছেন। এদিকে পদ্মলোচন অবিদ্যার বাড়ী হতে বাড়ী এলেন; আজ তার নানা কাজ! পদ্মলোচন প্রত্যহ সাত আট্টার সময় বেশ্যালয় থেকে উঠে আসেন, কিন্তু আজ কিছু সকালে আসতে হয়েছিল। সহরের অনেক প্রকৃত হিন্দু বুড়ো বুড়ো দলপতির এক একটি জলপাত্র আছে এ কথা আমরা পূর্ব্বেই বলেচি; এদের মধ্যে কেউ রাত্রি দশটার পর শ্রীমন্দিরে যান একেবারে সকাল বেলা প্রাতঃস্নান করে টিপ, তেলক ও ছাপা কেটে গীতগোবিন্দ ও তসর পরে হরিনাম কত্তে কষ্ট্রে বাড়ী ফেরেন–হঠাৎ লোকে মনে কত্তে পারে শ্ৰীযুত গঙ্গাস্নান করে এলেন। কেউ কেউ বাড়ীতেই প্রিয়তমাকে আনান; সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হলে ভোরের সময় বিদেয় দিয়ে স্নান করে পূজা কত্তে বসেন-যেন রাত্তিরে তিনি নন–পদ্মলোচনও সেই চাল ধরেছিলন।
ক্রমে আত্মীয় কুটুম্বেরাও এসে জমলেন, মমসাহেবরা “হুজুর! কলকেতায় এমন বিয়ে হয় নি–হবে না” বলে বাবুর ল্যাজ ফোলাতে লাগলেন। ক্রমে সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে ফুলশয্যার তত্ত্ব এলো, পদ্মলোচন মহাসমাদরে কনের বাড়ীর চাকর-চাকরাণীদের মহা অভ্যর্থনা কল্লেন, প্রত্যেককে একটি করে টাকা ও একখানি করে কাপড় বিদেয় দিলেন। দলস্থ ও আত্মীয়েরা কিছু কিছু করে অংশ পেলেন। বাকী ঢুলী ও রেশালার লোকেরা বক্সিস পেয়ে, বিদেয় হলো; কোন কোন বাড়ীর গিন্নী সামগ্রী পেয়ে হাঁড়ি পূরে শিকেয় টাঙ্গিয়ে রাখলেন; অধিক অংশ পচে গেল, কতক বেরালে ও ইঁদুরে খেয়ে গেল, তবু গিন্নীরা পেট ভরে খেতে কি কারেও বুক বেধে দিতে পাল্লেন না—বড়মানুষদের বাড়ীর গিন্নীরা প্রায়ই এই রকম হয়ে থাকেন, ঘরে জিনিষ পচে গেলেও লোকের হাতে তুলে দিতে মায়া হয়। শেষে পচে গেলে মহারাণীর খানায় ফেলে দেওয়া হয়, সেও ভাল। কোন কোন বাবুরও এ স্বভাবটি আছে, সহরের এক বড়মানুষের বাড়ীতে দুর্গাপূজার সময়ে নবমীর দিন গুটি ষাইটেক পাঁঠা বলিদান হয়ে থাকে; পুৰ্ব্ব পরম্পরায় সেগুলি সেই দিনেই দলস্থ ও আত্মীয়ের বাড়ী বিতরিত হয়ে আসছে। কিন্তু আজকাল সেই পাঁঠাগুলি নবমীর দিন বলিদান হলেই গুদামজাত হয়; পূজার গোল চুকে গেলে, পূর্ণিমার পর সেইগুলি বাড়ী বাড়ী বিতরণ হয়ে থাকে, সুত্রং ছয় সাত দিনের মরা পচা পাঁঠা কেমন উপাদেয়, তা পাঠক আপনিই বিবেচনা করুন। শেষে গ্রহীতাদের সেই পাঠা বিদেয় কত্তে ঘর হতে পয়সা বার কত্তে হয়! আমরা যে পূর্ব্বে আপনাদের কাছে সহরের সর্দ্দার মূর্খের গল্প করেচি ইনিই তিনি!
এ দিকে ক্রমে বিবাহের গোল চুকে গেল; পদ্মলোচন বিষয়কৰ্ম্ম কত্তে লাগলেন। তিনি নিত্যনৈমিত্তিক দোল দুর্গোৎসব প্রভৃতি বার মাসে তের পার্ব্বণ ফাঁক দিতেন না, ঘেঁটু পূজাতেও চিনির নৈবিদ্য ও সখের যাত্রী বরাদ্দো ছিলো, আপনার বাড়ীতে যে রকম ধূম করে পূজো আচ্ছা করেন, রক্ষিতা মেয়েমানুষ ও অনুগত দশ বারো জন বিশিষ্ট ব্রাহ্মণের বাড়ীতে তেমনি ধূমে পূজো করাতেন। নিজের ছেলের বিবাহের সময়ে তিনি আগে চল্লিশ জন আইবুড়ো বংশজের বিয়ে দিয়ে দেন। ইংরেজি লেখাপড়ার প্রাদুর্ভাবে রামমোহন রায়ের জন্মগ্রহণে ও সত্যের জ্যোতিতে হিন্দুধর্ম্মের যে কিছু দুরবস্থা দাঁড়িয়েছিলো, পদ্মলোচন কায়মনে তার অপনয়নে কৃতসংকল্প হলেন। কিন্তু তিনি, কি তার ছেলেরা দেশের ভালোর জন্য একদিনও উদ্যত হন নি—শুভ কৰ্ম্মে দান দেওয়া দূরে থাকুক, সে বৎসরের উত্তর-পশ্চিমের ভয়ানক দুর্ভিক্ষেও কিছুমাত্র সাহায্য করেন নি, বরং দেশের ভালো করবার জন্য কেউ কোন প্রস্তাব নিয়ে তাঁদের কাছে উপস্থিত হলে তারে কৃশ্চান ও নাস্তিক বলে তাড়িয়ে দিতেন—এক শ বেলেল্লা বামুন ও দু শ মোসাহেব তাঁর অন্নে প্রতিপালিত হতো—তাতেই পদ্মলোচনের বংশ মহা পবিত্র বলে সহরে বিখ্যাত হয়। লেখা-পড়া শেখা বা তার উৎসাহ দেওয়ার পদ্ধতি পদ্মলোচনের বংশে ছিল না, শুদ্ধ নামটা সই কত্তে পাল্লেই বিষয় রক্ষা হবে, এই তাঁদের বংশপরম্পরার স্থির সংস্কার ছিল। সরস্বতী ও সাহিত্য ঐ বংশের সম্পর্ক রাখতেন না! ঊনবিংশতি শতাব্দীতে হিন্দুধৰ্ম্মের জন্য সহরে কোন বড়মানুষ তার মত পরিশ্রম স্বীকার করেন নাই। যে রকম কাল পড়েছে, তাতে আর কেউ যে তাদৃক যত্নবান হন, তারও সম্ভাবনা নাই। তিনি যেমন হিন্দুধর্মের বাহ্যিক গোঁড়া ছিলেন, অন্যান্য সৎকৰ্ম্মেও তার তেমনি বিদ্বেষ ছিল; বিধবাবিবাহের নাম শুনলে তিনি কানে হাত দিতেন, ইংরেজী পড়লে পাছে খানা খেয়ে কৃশ্চান হয়ে যায়, এই ভয়ে তিনি ছেলেগুলিকে ইংরাজী পড়াননি, অথচ বিদ্যাসাগরের উপর ভয়ানক বিদ্বেষ নিবন্ধন সংস্কৃত পড়ানও হয়ে উঠে নাই, বিশেষতঃ শূদ্রের সংস্কৃততে অধিকার নাই, এটিও তাঁর জানা ছিল; সুতরাং পদ্মলোচনের ছেলেগুলিও “বাপকা বেটা সেপাইকা ঘোড়া”র দলেই পড়ে।
কিছুদিন এই রকম অদৃষ্টচর লীলা প্রকাশ করে, আশী বৎসর বয়সে পদ্মলোচন দেহ পরিত্যাগ কল্লেন-মৃত্যুর দশ দিন পূর্ব্বে একদিন হঠাৎ অবতারের সর্বাঙ্গ বেদনা করে। সেই বেদনাই ক্রমে বলবর্তী হয়ে তার শয্যাগত কল্লে–তিনি প্রকৃত হিন্দু, সুতরাং ডাক্তারী চিকিৎসায় ভারী দ্বেষ কত্তেন, বিশেষতঃ তাঁর ছেলেবেলা পর্য্যন্ত সংস্কার ছিল, ডাক্তার অষুধ মাত্রেই মদ মেশান, সুতরাং বিখ্যাত বিখ্যাত কবিরাজ মশাইদের দ্বারা নানা প্রকার চিকিৎসা করান হয়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। শেষে আত্মীয়েরা কবিরাজ মশাইদের সঙ্গে পরামর্শ করে শ্ৰীশ্রী ঁভাগীরথীতটস্থ কল্লেন, সেখানে তিন রাত্তির বাস করে মহাসমারোহে প্রায়শ্চিত্তের পর সজ্ঞানে রাম ও হরিনাম জপ কত্তে কত্তে প্রাণত্যাগ করেন।
পাঠক! আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের সঙ্গে বহু দূর এসেছেন। যে পদ্মলোচন আপনাদের সম্মুখে জন্মালেন, আবার মলেন, শুদ্ধ তাঁর নিজের চরিত্র আপনারা অবগত হলেন এমন নয়, সহরের অনেকের চরিত্র অবগত হলেন। সহরের বড়মানুষদের মধ্যে অনেকেই পদ্মলোচনের জুড়িদার, কেউ কেউ দাদা হতেও সরেস! যে দেশের বড়লোকের চরিত্র এই রকম ভয়ানক, এই রকম বিষময়, সে দেশের উন্নতি প্রার্থনা করা নিরর্থক। যাদের হতে উন্নতি হবে, তাঁরা আজও পশু হতেও অপকৃষ্ট ব্যবহারের সর্ব্বদাই পরিচয় দিয়ে থাকেন তাঁরা ইচ্ছা করে আপনা আপনি বিষময় পথের পথিক হন; তাঁরা যে সকল দুষ্কৰ্ম্ম করেন, তার যথারূপ শাস্তি নরকেও দুষ্প্রাপ্য।
জন্মভূমি-হিতচিকীর্ষুরা আগে এই সকল মহাপুরুষদের চরিত্র সংশোধন করবার যত্ন পান, তখন দেশের অবস্থায় দৃষ্টি করবেন; নতুবা বঙ্গদেশের যা কিছু উন্নতি প্রার্থনায় যত্ন দেবেন, সকলই নিরর্থক হবে।
“আলালের ঘরের দুলাল” লেখক—বাবু, টেকচাঁদ ঠাকুর বলেন, “সহরের মাতাল বহুরূপী;” কিন্তু আমরা বলি, সহরের বড় মানুষের নানারূপী—এক এক বাবু এক এক তরো, আমরা চড়কের নক্সায় সেগুলিই প্রায়ই গড়ে বর্ণন করেচি, এখন ক্রমশঃ তারি বিস্তার বর্ণন করা যাবে-তারি প্রথম উঁচুকে দল খাস হিন্দু; এই হঠাৎ অবতারের নক্সাতেই আপনারা সেই উঁচুকেতার খাস হিন্দুদের চরিত্র জানতে পাল্লেন—এই মহাপুরুষেরাই রিফমেশনের প্রবল প্রতিবাদী, বঙ্গসুখ-সৌভাগ্যের প্রলয় কণ্টক ও সমাজের কীট।
হঠাৎ অবতারের প্রস্তাবে পাঠকদের নিকট আমরাও কথঞ্চিৎ আত্ম-পরিচয় দিয়ে নিয়েছি; আমরা ক্রমে আরো যত ঘনিষ্ঠ হবো, ততই রং ও নক্সার মাঝে মাঝে সং সেজে আসবে;-আপনারা যত পারেন, হাততালি দেবেন ও হাসবেন!
১.২৮ মাহেশের স্নানযাত্রা
গুরুদাস গুঁই সেরুড় কোম্পানীর বাড়ীর মেট মিস্তিরি। তিরশ টাকা মাইনে, সওয়ায় দশ টাকা উপরি রোজগারও আছে। গুরুদাসের চাঁপাতলাঞ্চলে একটি খোলার বাড়ী আছে, পরিবারের মধ্যে বুড়ো মা, বালিকা স্ত্রী ও বিধবা পিসী মাত্র।
গুরুদাস বড় সাখরচে লোক। মা দশ টাকা রোজগার করেন, সকলই খরচ হয়ে যায়। এমন কি, কখন কথন মাস কাবারের পূর্ব্বে গয়না খানা ও জিনিসটে পত্তরটাও বাঁধা পড়ে। বিশেষতঃ আষাঢ় শ্রাবণ মাসে ইলিশ মাছ ওটবার পূর্ব্বে ও ঢ্যালাফ্যালা পার্ব্বণে গুরুদাসের দু মাসের মাইনেই খরচ হয়। ভাদ্রমাসের আনন্দটি বড় ধূমে হইয়া থাকে। আর পিটে-পাৰ্ব্বণেও দশ টাকা খরচ হয়েছিল —ক্রমে স্নানযাত্রা এসে পড়লো। স্নানযাত্রাটি পরবের টেক্কা, তাতে আমোদের চূড়ান্ত হয়ে থাকে। সুতরাং স্নানযাত্রা উপলক্ষে গুরুদাস বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। খাওয়ারও অবকাশ রইল না; ক্রমে আরও পাঁচ ইয়ার জুটে গেল। স্নানযাত্রায় কি কি রকম আমোদ হবে, তাই তদ্বির ও পরামর্শ হতে লাগলো; কেবল দুঃখের বিষয় চাঁপাতলার হলধর বাগ মতিলাল বিশ্বেস ও হারাধন দাস, গুরুদাসের বুজুম্ ফ্রেণ্ড ছিলেন,–কিন্তু কিছুদিন হলো হলধর একটা চুরী মামলায় গেরেপ্তার হয়ে দু বছরের জন্য জেলে গেছেন, মতি বিশ্বাস মদ খেয়ে পাতকোর ভিতরে পড়ে গিয়েছিলেন, তাতেই তার দুটি পা ভেঙ্গে গিয়েছে, আর হারাধন গোটাকতক টাকা বাজার-দেনার জন্য ফরাসডাঙ্গায় সরে গেছেন; সুতরাং এবারে তাঁদের বিবাহে স্নানযাত্রাটা ফাঁক ফাঁক লাগছে কিন্তু তাহলে কি হয়–সংবৎসরের অমোদটা বন্ধ করা কোন ক্রমেই হতে পারে না বলেই নিতান্ত গর্মিতে থেকেও গুরুদাসকে স্নানযাত্রায় যাবার আয়োজন কত্তে হচ্ছে।
এদিকে পাঁচ ইয়ারের পরামর্শে সকল রকম জিনিসের আয়োজন হতে লাগলো-গোপাল দৌড়ে গিয়ে একখানি বজরা ভাড়া করে এলেন। নবীন আতুরী, আনিস, রমও গাজীর ভার নিলেন। ব্রজ ফুলূরী ও বেগুন ভাজার বায়না দিয়ে এলেন–গোলাবী খিলীর দোনা, মোমবাতি ও মিটে-কড়া তামাক ও আর আর জিনিসপত্র গুরুদাস স্বয়ং সংগ্রহ করে রাখলেন।
পূৰ্ব্বে স্নানযাত্রার বড় ধূম ছিল—বড় বড় বাবুরা পিলেস, কলের জাহাজ, বোট ও বজরা ভাড়া করে মাহেশ যেতেন; গঙ্গার বাচখেলা হতো। স্নানযাত্রার পর রাত্তির ধরে খেমটা ও বাইয়ের হাট লেগে যেতো! কিন্তু এখন আর সে আমোদ নাই–সে রাম নাই সে অযোধ্যাও নাই—কেবল ছুতোর, কাঁসারি, কামার ও গন্ধবেণে মশাইরা যা রেখেচেন! মধ্যে মধ্যে ঢাকা অঞ্চলের দু চার জমিদারও স্নানযাত্রার মান রেখে থাকেন; কোন কোন ছোকরাগোছের নতুন বাবুরাও স্নানযাত্রায় আমোদ করেন বটে!
ক্রমে সে দিনটি দেখতে দেখতে এল। ভোর না হতে হতেই গুরুদাসের ইয়াররা সঙ্গে গুজে তইরি হয়ে তাঁর বাড়ীতে উপস্থিত হলেন। গোপাল এক জোড়া লাল রঙ্গের এষ্টকীং (মোজা) পরে দিয়েছিলেন, পেতলের বড় বড় বোতাম দেওয়া সবুজ রঙ্গের একটি কনুই ও গুলদার ঢাকাই উড়ুনী তার গায়ে ছিল; আর একটি বিলিতী পেতলের শিল আংটিও আঙ্গুলে পরেছিলেন—কেবল তাড়াতাড়িতে জুতোজোড়াটি কিনতে পারেন নাই বলেই শুধু পায়ে আসা হয়েছে। নবীনের ফুলদার ঢাকাইখানি বহুকাল বোপর বাড়ী যায় নি, তাতেই যা একটু ময়লা বোধ হচ্ছিলো, নতুবা তার চার আঙ্গুল চাটালো কালাপপড়ে ধোপদস্ত ধুতিখানি সেই দিন মাত্র পাট ভাঙ্গা হয়েছিল-মজাইটিও বিলক্ষণ দেবো ছিল। জরু সম্প্রতি ইয়ার্ডে কৰ্ম্ম হয়েছে, বয়সও অল্প, সুতরাং আজও ভাল কাপড়-চোপড় করে উঠতে পারেন নি, কেবল গত বৎসর পূজার সময়ে তার আই, ন’সিকে নিয়ে, যে ধুতি-চাদর কিনে দেয়, তাই পরে এসেছিলেন; সেগুলি আজো কোরা থাকায় তারে দেখতে বড় মন্দ হয় নি। আরো তাঁর ধুতি চাঁদারর সেট নতুন বল্লেই হয়–বলতে কি তিনি তো বেশীদিন পরেন নি, কেবল পুজোর সময়ে সপ্তমী পূজোর দিন পরে গোকুল দাঁয়ের প্রতিমে দেখতে গিয়েছিলেন—ভাসান দেখতে যাবার সময়ে একবার পরেন অর হাটখোলার যে সেই ভারী বারোইয়ারি পূজো হয়, তাতেই একবার পরে গোপালে উড়ের যাত্রা শুনতে গেছলেন—তা ছাড়া অমনি সিকের উপোর হাঁড়ির মধ্যে তোলাই ছিল।
ইয়ারেরা আসবামাত্র গুরুদাস বিছানা থেকে উঠে দাওয়ায় বসলেন। নবীন, গোপাল ও ব্ৰজ খুঁটি ঠাসান দিয়ে উবু হয়ে বসলেন। গুরুদাসের মা চক্মকী, শোলা, টিকে ও তামাকের মেটে বাক্সটি বার করে দিলেন। নবীন চক্মকী ঠুকে টিকে ধরিয়ে তামাক সাজলেন। ব্রজ পাতকোতলা থেকে হুঁকোটি ফিরিয়ে এনে দিলেন; সকলেরই এক একবার তামাক খাওয়া হলো! গুরুদাস তামাক খেয়ে হাত-মুখ ধুতে গেলেন; এমন সময় ঝম্ ঝম্ করে এক পসলা বৃষ্টি এলো। উঠানের ব্যাংগুলো থপ থপ করে নাপাতে নাপাতে দাওয়ায় উঠতে লাগলো, নবীন, গোপাল, ব্রজ তারই তামাসা দেখতে লাগলেন। নবীন একটা সখের গাওনা জুড়ে দিলেন–
“সখের বেদিনী বলে কে ডাক্লে আমারে।”
বর্ষাকলের বৃষ্টি, মানুষের অবস্থার মত অস্থির! সৰ্ব্বদাই হচ্ছে যাচ্চে তার ঠিকানা নাই। ক্রমে বৃষ্টি থেমে গেল। গুরুদাসও মুখ-হাত ধুয়ে এসেই মারে খাবার দিতে বল্লেন। ঘরে এমন তইরি খাবার কিছুই ছিল না, কেবল পান্তাভাত আর তেঁতুল-দেওয়া মাছ ছিল, তাঁর মা তাই চারিখানি মেটে খোরায় বেড়ে দিলেন; গুরুদাস ও তাঁর ইয়ারেরা তাই বহুমান করে খেলেন।
পূৰ্ব্বে স্থির হয়েছিল রাত্তিরের জোয়ারেই যাওয়া হবে; কিন্তু স্নানযাত্রাটি যে রকম আমাদের পরব, তাতে রাত্তিরের জোয়ারে গেলে স্নানযাত্রার দিন বেলা দুপুরের পর মাহেশ পৌঁছুতে হয়, সুতরাং দিনের জোয়ারে যাওয়াই স্থির হলো।
এদিকে গির্জ্জের ঘড়িতে টুং টাং টুং টাং করে দশটা বেজে গেল। নবীন, ব্রজ, গোপাল ও গুরুদাস খেয়ে দেয়ে পানৃতামাক খেয়ে, তোবড়াতুবড়ী নিয়ে দুর্গা বলে যাত্রা করে বেরুলেন। তাঁর মা একখানি পাখা ও দুটি ধামা কিনে আনতে বল্লেন। তাঁর স্ত্রী পূর্ব্বের রাত্তিরে একটি চিত্তির করা হাঁড়ী, ঘুন্সি ও গুরিয়া পুতুল আনতে বলেছিল আর তার বিধবা পিসীর জন্য একটি খাজা কোয়াওলা কাঁটাল, কানাইবাঁশী কলা ও কুলী বেগুন আনতে প্রতিশ্রুত হয়েছিলেন।
গুরুদাসের পোষাকটিও নিতান্ত মন্দ হয় নি। তিনি একখানি সরেশ গুলদার উড়ুনী গায়ে দিয়েছিলেন, উড়ুনীখানি চল্লিশ টাকার কম নয়—কেবল কাঠের কুচো বাঁধবার দরুণ চার পাঁচ জায়গায় একটু একটু খোচা গেছল; তার গায়ে একটি বিলিতি ঢাকা প্যাটানের পিরাণ, তার ওপর বুলু রঙ্গের একটি রঙ্গের হাপ চাপকান; তিনি “বেঁচে থাকুক বিদ্দেসাগর চিরজীবী হয়ে” পেড়ে এক শান্তিপুরে ফরমেসে ধুতি পরেছিলেন। জুতো জোড়াটিতে রুপোর বক্লস্ দেওয়া ছিল।
ক্রমে গুরুদাস ও ইয়ারেরা প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ঘাটে পৌঁছিলেন। সেথায় কেদার, জগ, হরি ও নারায়ণ তাঁদের জন্য অপেক্ষা করে ছিল; তখন সকলে একত্র হয়ে বজরায় উঠলেন! মাঝীরা শুটকী মাছ, লঙ্কা ও কড়াইয়ের ডাল দিয়ে ভাত খেতে বসেছিল। জোয়ারও আসে নাই, সুতরাং কিছুক্ষণ নৌকা খুলে দেওয়া বন্ধ রইলো।
কিন্তু পাঁচো ইয়ার নৌকায় উঠেই আয়েস জুড়ে দিলেন। গোপাল সন্তর্পণে জবাবির চৌপলের শোলার ছিপিটি খুলে ফেল্লেন। ব্ৰজ এক ছিলেম গাঁজা তইরি কত্তে বসলো—আতুরী ও জবাবীরা চলতে সুরু হলো, ফুলুরি ও বেগুনভাজীরা সেকালের সতী স্ত্রীর মত আতুরীদের সহগমন কত্তে লাগলেন–মেজাজ গরম হয়ে উঠলো—এদিকে নারাণ ও কেদার বাঁয়ার সঙ্গতে—
“হেসে খেলে নাওরে যাদু মনের সুখে।
কে কবে, যাবে শিঙে ফু’কে।
তখন কোথা রবে বাড়ী, কোথা রবে জুড়ি,
তোমার কোথায় রবে ঘড়ি, কে দেয় ট্যাঁকে।
তখন নুড়ো জ্বেলে দিবে ও চাঁদ মুখে॥”
গান জুড়ে দিলেন—ব্রজ গাঁজায় দম মেরে আড়ষ্ট হয়ে জোনাকি পোকা দেখতে লাগলেন; গোপাল ও গুরুদাসের ফুর্ত্তি দেখে কে!
এদিকে সহরেও স্নানযাত্রার যাত্রাদের গরী ধূম পড়ে গেছে। বুড়ী মাগী, কলা বউয়ের মত আধ ঘোমটা দেওয়া ক্ষুদে ক্ষুদে কনে বউ ও বুকের কাপড় খোলা হাঁ-করা ছুড়ীরা রাস্তা যুড়ে স্নানযাত্রা দেখতে চলেচে; এমন কি রাস্তায় গাড়ী পাল্কী চলা ভার! আজ সহরে কেরাঞ্চী গাড়ীর ঘোড়ায় কত ভার টানতে পারে, তার বিবেচনা হবে না, গাড়ীর ভিতর ও পিছনে কত তাংড়াতে পারে, তারই তকরার হচ্চে;—এক একখানি গাড়ীর ভেতর দশজন, ছাতে দুজন, পেছনে এক জন ও কোচবাকসে দুজন, একুনে পোনের জন, এ সওয়ার তিনটি করে আঁতুড়ে ছেলে ফাও! গেরস্তর মেয়েরাও বড় ভাই, শ্বশুর, ভাতার, ভাদ্দর-বউ ও শাশুড়ীতে একত্র হয়ে গেছেন; জগন্নাথের কল্যাণে মাহেশ আজ দ্বিতীয় বৃন্দাবন।
গঙ্গারও আজ চূড়ান্ত বাহার! বোট, বজরা, পিনেস ও কলের জাহাজ গিজগিজ কচ্চে; সকলগুলি থেকেই মাৎলামো, রং, হাসি ও ইয়ারকির গররা উঠচে; কোনটিতে খ্যামটা নাচ হচ্চে, গুটি ত্রিশ মোসাহেব মদে ও নেশায় ভো হয়ে রং কচ্চেন; মধ্যে ঢাকাই জালার মত, পেল্লাদে পুতুলের ও তেলের কুপোর মত শরীর, দাঁতে মিসি, হাতে ইষ্টিকবচ, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, তাতে ছোট ছোট ঢোলের মত গুটি দশ মাদুলী ও কোমরে গোট, ফিনফিনে ধুতিপরা ও পৈতের গোচ্ছা গলায়-মৈমনসিং ও ঢাকা অঞ্চলের জমিদার, সরকারী দাদা ও পাতান কাকাদের সঙ্গে খোকা সেজে ন্যাকামি কচ্চেন। বয়েস ষাট পেরিয়েচে, অথচ ‘রাম’কে ‘আঁম’ ও ‘দাদা’ ‘কাকা’কে ও ‘দাঁদা’ বা ‘কাঁকা’ বলে–এরাই কেউ কেউ রঙ্গপুর অঙ্গলে ‘বিদ্যোৎসাহী’ কবলান। কিন্তু চক্র করে তান্ত্রিক মতে মদ খান ও বেলা চারটে অবধি পুজো করেন। অনেকে জন্মাবচ্ছিন্নে সূর্যোদয় দেখেছেন কি না সন্দেহ।
কোন পিনেসে একদল সহুরে নব্যবাবুর দল চলেচে, ইংরাজী ইস্পিচে লিডনি মরের শ্রাদ্ধ হচ্ছে। গাওনার সুরে জমে যাচ্চে।
কোন্ পান্সিখানিতে একজন তিলকাঞ্চুনে নবশাখবাবু মোসাহেব ও মেয়েমানুষের অভাবে পিসতুতো ভাই, ভাগ্নে ও ছোট ভাইটিকে নিয়ে চলেছেন–বাঁয়া নাই, গোলাবিখিলি নাই, এমন কি একটা থেলে হুঁকোরও অপ্রতুল। অথচ এম্নি সখ যে, পান্সির পাটাতনের তক্তা বাজিয়ে গুন্ গুন্ করে গাইতে গাইতে চলেচেন। যেমন করে হোক্, কায়ক্লেশে শুদ্ধ হওয়াটা চাই!
এ দিকে আমাদের নায়ক গুরুদাসবাবুর বজরায় মাছিদের খাওয়া দাওয়া হয়েছে। দুপুরের নমাজ পড়েই বজরা খুলে দেবে। এমন সময়ে গোপাল গুরু দাসকে লক্ষ্য করে বল্লেন, “দেখ ভাই গুরুদাস! আমাদের আমোদের চূড়ান্ত হয়েছে, একটার জন্যে বড় ফাঁক ফাঁক দেখাচ্ছে, কেবল মেয়ে মানুষ নাই; কিন্তু মেয়েমানুষ না হলে তো স্নানযাত্রায় আমোদ হয় না!” ‘যা বল তা কও’—অমনি কেদার ‘ঠিক বলেচো বাপ! বলে কথার খি ধরে নিলেন; অমনি নারায়ণ বলে উঠলেন, “বাবা, যে নৌকাখানায় তাকাই সকলেই মাল-ভরা, কেবল আমরা ব্যাটারাই নিরিমিষ্ষি! আমরা যেন বাবার পিণ্ডি দিতে গয়া যাচ্চি।”
গুরুদাসের মেজাজ আলি হয়ে গেছে, সুতরাং “বাবা, ঠিক বলেচো! আমিও তাই ভাবছিলেম; ভাই! যত টাকা লাগে, তোমরা তাই দিয়ে একটা মেয়েমানুষ নে এসো, আমি বাবা তাতে পেচপও নই, গুরুদাসের সাদা প্রাণ!” এই বলতে না বলতেই নারাণ, গোপাল, হরি ও ব্রজ নেচে উঠলেন ও মাঝিদের নৌকা খুলতে মানা করে দিয়ে মেয়েমানুষের সন্ধানে বেরুলেন।
এ দিকে গুরুদাস, কেদার ও আর আর ইয়ারেরা চীৎকার করে–
যাবি যাবি যমুনা পারে ও রঙ্গিণী।
কত দেখবি মজা রিষড়ের ঘাটে শামা বামা দোকানী।
কিনে দেবো মাথাঘষা, বারুইপুরে ঘুন্সীখাসা,
উভয়ের পূরাবি আশা, ওলো সোনামণি॥”
গান ধরেচেন, এমন সময় মেকিণ্টশ বরন্ কোম্পানীর ইয়ার্ডের ছুতরেরা এক বোট ভাড়া করে মেয়েমানুষ নিয়ে আমোদ কত্তে কত্তে যাচ্চিল, তারা গুরুদাসকে চিনতে পেরে তাদের নৌকা থেকে
“চুপে থাক থাক রে বেটা কানায়ে ভাগ্নে।
গরু চরাস লাঙ্গল ধরিস, এতে তোর এত মনে॥”
গাইতে গাইতে হুররে ও হরিবোল দিয়ে, সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে গেল। গুরুদাসেরাও দুউও ও হাততালি দিতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর নৌকায় মেয়েমানুষ না থাকাতে সেটি কেমন ফাঁক ফাঁক বোধ হতে লাগলো। এদিকে বোটওয়ালারাও চেপে দুউও ও হাততালি দিয়ে, তার যথার্থ অপ্রস্তুত করে দিয়ে গেল।
গুরুদাস নেশাতেও বিলক্ষণ পেকে উঠেছিলেন। সুতরাং ওর ঠাট্টা করে আগে বেরিয়ে গেল, ইটি তিনি বরদাস্ত কত্তে পানে না। শেষে বিরক্ত হয়ে ইয়ারদের অপেক্ষা না করে টলতে টলতে আপনিই মেয়েমানুষের সন্ধানে বেরুলেন; কেদার ও আর আর ইয়ারেরা–
“আয় আয় মকর গঙ্গাজল।
কাল গোলাপের বিয়ে হবে সৈতে যাব জল।
গোলাপ ফুলের হাতটি ধরে, চলে যাব সোহাগ করে,
ঘোমটার ভিতর খোটা নেচে ঝম্ ঝমাবে মল।”
গান ধরে গুরুদাসের অপেক্ষায় রইলেন।
ঘণ্টাক্ষণেক হলো, গুরুদাস নৌকা হতে গেছেন, এমন সময়ে ব্রজ ও গোপাল ফিরে এলেন। তাঁরা সহরটি তন্ন তন্ন করে খুজে এসেছেন, কিন্তু কোথাও একজন মেয়েমানুষ পেলেন না। তাঁদের জানত সহরের ছুটো গোছের বাচতে বাকী করেন নাই। কেদার এই খবর শুনে একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন (জয়কষ্টো মুখুজ্জে জেলে যাওয়াতে তাঁর প্রজাদের এতো দুঃখ হয় নাই, রাবণের হাতে রামের কাটা মুণ্ড দেখে অশোকবনে সীতে কত বা দুঃখিত হয়েছিলেন?) ও অত্যন্ত দুঃখে এই গান ধরে, গুরুদাসের অপেক্ষায় রইলেন।
হৃৎপিঞ্জরের পাখী উড়ে এলো কার।
ত্বরা করে ধর গো সখি দিয়ে পীরিতের আধার।।
কোন কামিনীর পোষা পাখী, কাহারে দিয়েছে ফাঁকি,
উড়ে এলো দাঁড় ছেড়ে, শিক্লীকাটা ধরা ভার।।
এমন সময়ে গুরুদাসও এসে পড়লেন—গুরুদাস মনে করেছিলেন যে, যদি তিনিই কোন মেয়েমানুষের সন্ধান নাই পেলেন— তাঁর ইয়ারের একটা একটাকে অবশ্যই জুটিয়ে থাক্বে। এদিকে তার ইয়ারৈরা মনে করেছিলেন, যদিও তারাই কোন মেয়েমানুষের সন্ধান কত্তে পাল্লে না, গুরুদাসবাবু আর ছেড়ে আসবেন না। এদিকে শুরুদান নৌকায় এসেই, মেয়েমানুষ না দেখতে পেয়ে, মহা দুঃখিত হয়ে পড়লেন। কিন্তু নেশার এমন অনিৰ্বনীয় ক্ষমতা যে, তাতেও তিনি উৎসাহহীন হলেন না; গুরুদাস পুনরায় ইয়ারদের স্তোক দিয়ে মেয়েমানুষের সন্ধানে বেরুলেন। কিন্তু তিনি কোথায় গেলে পূর্ণমনোরথ হবেন, তা নিজেও জানে না। বোধ হয় তিনি যার অধীন ও আজ্ঞানুবর্তী হয়ে যাচ্চিলেন, কেবল তিনি মাত্র সে কথা বলতে পাতেন। গুরুদাসকে পুনরায় যেতে দেখে, তার ইয়ারেরাও তার পেছনে পেছুনে চল্লেন! কেবল নারায়ণ, ব্ৰজ ও কেদার নৌকায় বসে অত্যন্ত দুঃখেই—
নিশি যায় হায় হায় কি করি উপায়।
শ্যাম বিহনে সখি বুঝি প্রাণ যায়॥
হের হের শশধর অস্তাচলগত সখী
প্রফুল্লিত কমলিনী, কুমুদ মলিনমুখী
আর কি আসিবে কান্ত তুষিতে আমায়॥
গাইতে লাগলেন—মাঝীরা “জুয়ার বই যায়” বলে বারাম্বার ত্যক্ত কত্তে লাগলো, জলও ক্রমশ উড়েনচণ্ডীর টাকার মত জায়গা খালি হয়ে হটে যেতে লাগলো,–ইয়ারদলের অসুখের পরিসীমা রইল না!
গুরুদাস পুনরায় সহরটি প্রদক্ষিণ কল্লেন—সিঁদুরেপটী শোভাবাজারের ও বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরীতলাটাও দেখে গেলেন, কিন্তু কোনখানেই সংগ্রহ কত্তে পাল্লেন না-শেষে আপনার বাড়ীতে ফিরে গেলেন।
আমরা পূর্ব্বেই বলেছি যে, গুরুদাসের এক বিধবা পিসী ছিল। গুরুদাস বাড়ী গিয়ে তার পিসীরে বল্লেন যে, “পিসি! আমাদের একটি কথা রাখতে হবে।” তার পিসী বল্লেন, “বাপু গুরুদাস। কি কথা রাখতে হবে? তুমি একটা কথা বল্লে আমরা কি রাখবো না? আগে বল দেখি কি কথা?” গুরুদাস বল্লেন, “পিসি! যদি তুমি আমাদের সঙ্গে স্নানযাত্রা দেখতে যাও, তা হলে বড় ভাল হয়। দেখ পিসি, সকলে একটি দুটি মেয়েমানুষ নিয়ে স্নালযাত্রায় যাচ্চে, কিন্তু পিসি, শুদুই বা কেমন করে যাওয়া হয়? আমার নিজের জন্য যেন না হলো, কিন্তু পাঁচো ইয়ারের শুধু নিরিমিষ রকমে যেতে মন সচ্চে না—তা পিসি! অমোদ কত্তে কত্তে যাবো, তুমি কেবল বসে যাবে, কার সাদ্দি তোমারে কেউ কিছু বলে।” পিসী এই প্রস্তাব শুনে প্রথমে গাঁইগুঁই কত্তে লাগলেন, কিন্তু মনে মনে যাবার ইচ্ছাটাও ছিল, সুতরাং শেষে গুরুদাস ও ইরারদের নিতান্ত অনুরোধ এড়াতে না পেরে ভাইপোর সঙ্গে স্নানযাত্রায় গেলেন।
ক্রমে পিসীকে সঙ্গে নিয়ে গুরুদাস ঘাটে এসে পৌঁছিলেন; নৌকার ইয়ারের গুরুদাসকে মেয়েমানুষ নিয়ে আসতে দেখে, হুরুরে ও হরিবোল ধ্বনি দিয়ে বাঁয়ায় দামামার ধ্বনি কত্তে লাগলো, শেষে সকলে নৌকোয় উঠেই নৌকো খুলে দিলেন। দাঁড়িরা কোসে ঝপাঝপ দাঁড় বাইতে লাগলো। মাঝি হাল বাগিয়ে ধরে জোরে দেদার ঝিঁকে মাত্তে লাগলো। গুরুদাস ও সমস্ত ইয়ারে–
“ভাসিয়ে প্রেমন্ত্রী হরি যাচ্চ যমুনায়।।
গোপীর কুলে থাকা হলো দায়।
আরে ও! কদমতলায় বসি বাঁকা বাঁশরী বাজায়,
আর মুচকে হেসে নয়ন ঠেরে স্কুলে বউ ভুলায়।।
হরর্ হো! হো! হো!” গাইতে লাগলেন, দেখতে দেখতে নৌকাখানি তীরের মত বেরিয়ে গেল।
বড় বড় যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই আজ দুপুরের জোয়ারে নৌকা ছেড়েছেন। এদিকে জোয়ারও মরে এলো, ভাটার সারানী পড়লো–নোঙ্গর-করা ও খোঁটায় বাঁধা নৌকাগুলির পাছা ফিরে গেল— জেলেরা ডিঙ্গি চড়ে বেঁউতি জাল তুলতে আরম্ভ কল্লে। সুতরাং যিনি যে অবধি গেছেন, তারে সেইখানেই নোঙ্গর কত্তে হলো—তিলকাকুন বাবুদের পান্সি, ডিঙ্গি, বজরা ও বোট বাজার পোট জায়গায়। ভিড়ানো হলো–গয়নার যাত্রীরা কিনের পাশে পাশে লগি মেরে চল্লেন! পেনেটি, কামারহাটি কিম্বা খড়দহে জলপান করে, খেয়া দিয়ে মাহেশ পৌঁছুবেন।
কমে দিনমণি অস্ত গেলেন। অভিসারিণী সন্ধ্যা অন্ধকারের অনুসরণে বেরুলেন। প্রিয়সখী প্রকৃতি প্রিয়কার্যের অবসর বুঝে ফুলদামি উপহার দিয়ে বাসরের নিমন্ত্রণ গ্রহণ কল্লেন। বায়ু মৃদু মৃদু বীজন করে পশে দূর কত্তে লাগলেন; বক ও বালহাঁসেরা শ্রেণী বেঁধে চল্লো, চক্ৰবাকমিথুনের কাল সমর প্রদোষ, সংসারের সুখবর্দ্ধনের জন্য উপস্থিত হলো। হায়! সংসারের এমনি বিচিত্র গতি যে, কোন কোন বিষয় একের অপার দুঃখাবহ হলেও, শতকের সুখাস্পদ হয়ে থাকে।
পাড়াগাঁ অঞ্চলের কোন কোন গাঁয়ের বওয়াটে ছোঁড়ারা যেমন মেয়েদের সাঁজ সকালে ঘাটে যাবার পূর্ব্বে, পথের ধারে পুরণো শিবের মন্দির, ভাঙ্গা কোটা, পুকুরপাড় ও ঝোপে ঝাপে লুকিয়ে থাকে—তেমনি অন্ধকারও এতক্ষণ চাবি দেওয়া ঘরে, পাতকোর ভেতরে ও জলের জালায় লুকিয়ে ছিলেন—এখন শাঁক-ঘণ্টার শব্দে সন্ধ্যার সাড়া পেয়ে বেরুলেন—তার ভয়ানক মূর্ত্তি দেখে রমণীস্বভাবসুলভ শালীনতায় পদ্ম ভয়ে ঘাড় হেঁট করে চক্ষু বুজে রইলেন; কিন্তু ফচকে ছুঁড়ীদের আঁটা ভার—কুমুদিনীর মুখে আর হাসি ধরে না। নোঙ্গোর-করা ও কিনারার নৌকোগুলিতে গঙ্গাও কথনাতীত শোভা পেতে লাগলেন; বোধ হতে লাগলো যেন গঙ্গা গলদেশে দীপমালা ধারণ করে, নাচতে লেগেচেন। বায়ুচালিত ঢেউগুলি তবলা-বাঁয়ায় কাজ কচ্চে–কোনখানে বালির খালের নীচে একখানি পিনেশ নোঙ্গোর করে বসেছেন—রকমারী বেধড়ক চলছে। গঙ্গার চমৎকার শোভায় মৃদু মৃদু হাওয়াতে ও ঢেউয়ের ঈষৎ দোলায়, কারু কারু শ্মশানবৈরাগ্য উপস্থিত হয়েছে, কেউ বা ভাবে মজে পূরবী রাগিণীতে–
“যে যাবার সে যাক সখী আমি তো যাবো না জলে।
যাইতে যমুনাজলে, সে কালা কদম্বতলে,
আঁখি ঠেরে আমায় বলে, মালা দে রাই আমার গলে!”
গান ধরেচেন; কোনখানে এইমাত্র একখানি বোট নোঙ্গের কল্লে–বাবু ছাদে উঠলেন, অমনি আর আর সঙ্গীরাও পেচনে চল্লো; একজন মোসাহেব মাঝীদের জিজ্ঞাসা কল্লেন, “চাচা! জায়গাটার নাম কি?” অমনি বোটের মাঝী হজুরে সেলাম ঠুকে ‘আইগেঁ কাশীপুর কর্তা! এই রতনবাবুর গাট” বলে বক্সিসের উপক্রমণিকা করে রাখলে! বাবুর দল ঘাট শুনে হাঁ করে দেখতে লাগলেন; ঘাটে অনেক বৌ-ঝি গা ধুচ্ছিলো, বাবুদলের চাউনি, হাসি ও রসিকতার ভয়ে ও লজ্জায় জড়সড় হলো, দু একটা পোষ মান্বারও পরিচয় দেখাতে ত্রুটি কল্লে না–মোসাহেব দলে মাহেন্দ্রযোগ উপস্থিত; বাবুর প্রধান ইয়ার রাগ ভেঁজে–
অনুগত অশ্রিত তোমার।
রেখো রে মিনতি আমার।
অন্য ঋণ হলে বাঁচিতাম পলালে,
এ ঋণে না মলে পরিশোধ নাই!
অতএব তার, ভার তোমার,
দেখো রে করো নাকো অবিচার।
গান জুড়ে দিলেন। সন্ধ্যা-আহ্নিকওয়ালা বুড়ো বুড়ো মিন্ষেরা, ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলে, নিষ্কর্মা মাগীরা ঘাটের উপর কাতার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল; বাবুরাও উৎসাহ পেয়ে সকলে মিলে গাইতে লাগিলেন—মড়াখেকো কুকুরগুলো খেউ খেউ করে উঠলো, চরন্তী শোয়ারগুলো ময়লা ফেলে ভয়ে ভোঁৎ ভোঁৎ করে খোঁয়াড়ে পালিয়ে গেল।
কোন বাবুর বজরা বরানগরের পাটের কলের সামনেই নোঙ্গোর করা হয়েচে, গাঁয়ের বওয়াটে ছেলেরা বাবুদের রঙ্গ ও সঙ্গের মেয়েমানুষ দেখে, ছোট ছোট নুড়ি পাথর, কাদা মাটীর চাপ ছুড়ে অমোদ কর্তে লাগলো, সুতরাং সে ধারের খড়খড়েগুলো বন্ধ কত্তে হলো–আরো বা কি হয়।
কোন বাবুর ভাউলেখানি রাসমণির নবরত্নের সামনে নোঙ্গোর করেছে, ভিতরের মেয়েমানুষেরা উঁকী মেরে নবরত্নটি দেখে নিচ্চে।
আমাদের নায়কবাবু গুরুদাস বাগবাজারের পোলের আসে পাশেই আছেন; তাঁদের বাঁয়ার এখনও আওয়াজ শোনা যাচ্চে, আতুরী ও আনীসদের বেশীর ভাগ আনাগোনা হচ্চে-আনীস ও রমেদের মধ্যে যাঁরা গেছলেন, তাঁরাই দুনো হয়ে বেরিয়ে আসছেন। ফুলূরী ও গোলাপী খিলিরা দেবতাদের মত বর দিয়ে অন্তর্ধান হয়েছেন, কারু কারু তপস্যার ফললাভও শুরু হয়েছে–স্নেহময়ী পিসী আঁচল দিয়ে বাতাস কচ্চেন; নৌকাখানি অন্ধকার।
এমন সময়ে ঝম্ ঝম্ করে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি এলো। একটা গোলমেলে হাওয়া উঠলো, নৌকোর পাছাগুলি দুলতে লাগলো—মাঝীরা পাল ও চট মাথায় দিয়ে, বৃষ্টি নিবারণ কত্তে লাগলো; রাত্তির প্রায় দুপুর!
সুখের রাত্রি দেখতে দেখতেই যায়–ক্রমে সুখতারার সিঁতি পরে হাসতে হাসতে ঊষা উদয় হলেন, চাদ তার দিল নিয়ে অমোদ কচ্ছিলেন, হঠাৎ উষারে দেখে, লজ্জায় ম্লান হয়ে কাঁপতে লাগলেন। কুমুদিনী ঘোমটা টেনে দিলেন, পূর্ব্ব দিক ফরসা হয়ে এলো; “জোয়ার আইচে” বলে, মাঝারা নৌকা খুলে দিলে–ক্ৰমে সকল নৌকার সার বেঁধে মাহেশ ও বল্লভপুরে চলো। সকখানিই এখানে রং পোরা, কোন কোনখানিতে গলাভাঙ্গা সুরে–
“এখনো রজনী আছে বল কোথা যাবে রে প্রাণ
কিঞ্চিৎ বিলম্ব কর হো নিশি অবসান।।
যদি নিশি পোহাইত, কোকিলে ঝঙ্কার দিত,
কুমুদী মুদিত হতো শশী যেতে নিজ স্থান।”
শোনা যাচ্চে। কোনখানি কফিমের মত নিঃশব্দ—কোনখানিতে কান্নার শব্দ কোথাও নেশার গোঁ গোঁ ধ্বনি।
যাত্রীদের নৌকো চল্লো, জোয়ারও পেকে এলো, মালীরা জাল ফেলতে আরম্ভ কল্লে–কিনারায় সহরের বড়মানুষের ছেলেদের ট্রকপি ধোপার গাধা দেখা দিলে। ভটচায্যিরা প্রাতঃস্নান কত্তে লাগলেন, মাগী ও মিন্সেরা লজ্জা মাথায় করে কাপড় তুলে হাগতে বসেচে। তরকারীর বজরা সমেত হেটোরা বদ্দিবাটী ও শ্রীরামপুর চল্লো। আড়খেয়ার পাটুনীরে সিকি পয়সায় ও আধ পয়সায় পার কত্তে লাগলো। বদর ও দফর গাজীর ফকীরের ডিঙ্গের চড়ে ভিক্ষে আরম্ভ কল্লে। সূর্য্যদেব উদয় হলেন, দেখে কমলিনী আহ্লাদে ফুটলেন, কিন্তু ইলিশমাছ ধড়ফড়িয়ে মরে গেলেন; হায়! পরশ্রীকাতরদের এই দশাই ঘটে থাকে।
যে সকল বাবুদের খড়দ, পেনিটি, অগিড়পাড়া, কামারহাটী প্রভৃতি গঙ্গাতীর অঞ্চলে বাগান আছে, আজ তাঁদেরও ভারী ধূম। অনেক জয়েগার কাল শনিবার ফলে গেছে, কোথাও আজ শনিবার। কারু কদিনই জমাট বন্দোবস্ত—আয়েস ও চোহেলের হদ্দ! বাগানওয়ালা বাবুদের মধ্যে কারু কারু বাচ খেলাবার জন্য পান্সী তইরি, হাজার টাকার বাচ হবে। এক মাস ধরে নৌকার গতি বাড়াবার জন্য তলায় চরবি ঘষা হচ্চে ও মাঝিদের লাল উর্দ্দী ও আগু পেচুর বাদসাই নিশেন সংগ্রহ হয়েচে-গ্রামস্থ ইয়ার দল, খড়দর বাবুরা ও আর আর ভদ্দরলোক মধ্যস্থ! বোধ হয়, বাদী মহীন্দর নফর-চীনেবাজারের ক্যাবিনেট মেকর—ভারী সৌখীন—সখের সাগর বল্লেই হয়।
এ দিকে কোন যাত্রী মহেশ পৌঁছুলেন, কেউ কেউ নৌকাতেই রইলেন’; দুই একজন ওপরে উঠলেন—মাঠে লোকারণ্য, বেদীমণ্ডপ হতে গঙ্গাতীর পর্য্যন্ত লোকের ঠেল মেরেছে; এর ভিতরেই নানাপ্রকার দোকান বসে গেচে। ভিখিরীরা কাপড় পেতে বসে ভিক্ষা কচ্চে, গায়েনের গাচ্ছে, আনন্দলহরী, একতারা খঞ্জনী ও বাঁয়া নিয়ে বোষ্টমেরা বিলক্ষণ পয়সা কুড়ুচ্চে। লোকের হররা, মাঠের ধূলো ও রোদের তাত একত্র হয়ে, একটি চমৎকার মেওয়া প্রস্তুত করেছে। অনেকে তাই দিল্লীর লাড্ডুর স্বাদে স্বাদ করে সেবা কচ্চেন!
ক্রমে বেলা দুই প্রহর বেজে গেল। সুৰ্য্যের উত্তাপে মাথা পুড়ে যাচ্চে, গামছা, রুমাল, চাদর ও ছাতি ভিজিয়েও পার পাচ্ছে না! জগবন্ধু চাঁদমুখ নিয়ে, বেদীর ওপর বসেচেন; চাঁদমুখ দেখে কুমুদিনীর ফোঁটা চুলোয় যাক, প্রলয়তুফানে জেলেডিঙ্গির তফরা খাওয়ার মত, সমাগত কুমুদিনীদের দুর্দশা দেখে কে!
ক্রমে বেলা প্রায় একটা বেজে গেল। জগন্নাথের আর স্নান হয় না–দশ আনীর জমিদার ‘মহাশয়’ বাবুরা না এলে, জগন্নাথের স্নান হবে না। কিন্তু পচা আদা ঝাল ভরা তাঁদের আর আসা হয় না; ক্রমে যাত্রীরা নিতান্ত ক্লান্ত হয়ে পড়লো, আসপাশের গাছতলা, আমবাগান ও দরজা লোকে ভরে গেল। অনেকের সর্দ্দিগৰ্ম্মি উপস্থিত, কেউ কেউ শিঙ্গে ফোঁকবার যোগাড় কল্লেন; অনেকেই ধুতুরোফুল দেখতে লাগলো। ডাব ও তরমুজে রণক্ষেত্র হয়ে গেল, লোকের রল্লা দ্বিগুণ বেড়ে উঠলো, সকলেই অস্থির। এমন সময় শোনা গেল, বাবুরা এসেচেন। অমনি জগন্নাথের মাথায় কলসী করে জল ঢালা হলো, যাত্রীরাও চরিতার্থ হলেন। চিঁড়ে, দই, মুড়ি, মুড়কি, চাটিমকলা দেদার উঠতে লাগলো। খোসপোষাকী বাবুরা খাওয়া দাওয়া কল্লেন। অনেকের আমোদেই পেট ভরে গেছে, সুতরাং খাওয়া দাওয়া আবশ্যক হলো না। কিছু বিশ্রামের পর তিনটে বেজে গেল। বাচখেলা আরম্ভ হলো–কার নৌকা আগে গিয়ে নিশেন নেয়, এরই তামাসা দেখবার জন্য সকল নৌকোই খুলে দেওয়া হলো। অবশ্যই এক দল জিৎলেন, সকলে জুটে হারের হাত্তালি ও জিতের বাহবা দিলেন। স্নানযাত্রার আমোদ ফুরুলো। সকলে বাড়ীমুখো হলেন; যত বাড়ী কাছে হতে লাগলো, শেষে ততই গৰ্ম্মিবোধ হতে লাগলো। কাশীপুরের চিনির কল, বালির ব্রিজ, কেউ পার হয়ে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ঘাটে উঠলেন, কেউ বাগবাজার ও আহারীটোলার ঘাটে নাবলেন। সকলেরই বিষণ্ণ বদন—ম্লান মুখ; অনেককেই ধরে তুলতে হলো; শেষ চার পাঁচ দিনের পর আমাদের নাগাড় মরে ফিরতি গোলের দরুণ আমরা গুরুদাসবাবুর নৌকোখানা বেচে নিতে পাল্লেম না।
———-
প্রথম ভাগ সমাপ্ত
২.১ রথ
হে সজ্জন, স্বভাবের সুনির্মল পটে,
রসের রঙ্গে,–
চিত্রিনু চরিত্র—দেবী সরস্বতীর রবে।
কৃপাচক্ষে হের একবার; শেষে বিবেচনামতে,
যার যা অধিক আছে তিরস্কার’ কিম্বা ‘পুরস্কার’
দিও তাহা মোরে–বহুমানে লব শির পাতি।
স্নানযাত্রার আমোদ ফুরুলো, গুরুদাস গুঁই গুলদার উঁড়ুনী পরিহার করে পুনরায় চিরপরিচিত র্যাদা ও ঘিস্কাপ ধল্লেন। ক্রমে রথ এসে পড়লো। ফ্যেতো র্যতো পরব প্রলয় বুড়ুটে; এতে ইয়ারকির লেশমাত্র নাই, সুতরাং সহরে রথ-পার্ব্বণে বড় একটা ঘটা নাই; কিন্তু কলিকাতায় কিছুই ফাঁক যাবার নয়। রথের দিন চিৎপুর রোড লোকারণ্য হয়ে উঠলে ছোট ছোট ছেলেরা বার্নীস করা জুতো ও সেপাইপেড়ে ঢাকাই ধুতি পোরে, কোমরে রুমাল বেঁধে চুল ফিরিয়ে চাকর-চাকরাণীদের হাত ধরে, পয়নালার ওপর, পোদ্দারের দোকানে ও বাজারের বারাণ্ডায় রথ দেখতে দাঁড়িয়েছে। আদবইসি মাগীরা খাতায় খাতায় কোরা ও কলপ দেওয়া কাপড় পোরে, রাস্তা জুড়ে চলেচে; মাটীর জগন্নাথ, কাঁটাল, তালপাতের ভেঁপু, পাখা ও শোলার পাখী বেধড়ক বিক্রী হচ্ছে; ছেলেদের দ্যাখাদেখি বুড়ো বুড়ো মিন্ষেরাও তালপাতের ভেপু নিয়ে বাজাচ্চেন, রাস্তায় ভোঁ পোঁ ভোঁ পোঁ শব্দের তুফান উঠেছে। ক্রমে ঘণ্টা, হরিবোল, খোল-খত্তাল ও লোকের গোলের সঙ্গে একখানা রথ এলো। রথের প্রথমে পেটা ঘড়ি, নিশান খুন্তী, ভেড়ং ও নেড়ির কবি, তারপর বৈরাগীদের দু-তিন দল নিমখাসা কেত্তন, তার পেছনে সখের সঙ্কীৰ্ত্তন পাওনা। দোহার-দলের সঙ্গে বড় বড় আটচালার মত গোলপাতার ছাতা ও পাখা চলেচে, আশে-পাশে কৰ্ম্মকর্ত্তারা পরিশ্রম ও গলদঘর্ম–কেউ নিশান ও রেশালার মিলে ব্যতিব্যস্ত, কেউ পাখার বন্দোবস্তে বিব্রত। সখের সঙ্কীর্তনওয়ালারা গোচসই বারাণ্ডার নীচে, চৌমাথায় ও চকের সামনে থেমে থেমে গান করে যাচ্চেন; পেছোনে চোতাদারেরা চেঁচিয়ে হাত নেড়ে গান বলে দিচ্চেন; দোহারের কি গাচ্ছেন, তা তারা ভিন্ন আর কেউ বুঝতে পাচ্ছেন না। দর্শকদের ভিড়ের ভিতর একটা মাতাল ছিল, সে বুথ দর্শন করে ভক্তিভরে মাতলামী সুরে–
“কে মা রথ এলি?
সর্বাঙ্গে পেরেক-মারা চাকা ঘুর-ঘুর ঘুরালি।
মা তোর সামনে দুটো ক্যেটো ঘোড়া,
চুড়োর উপর মুকপোড়া,
চাঁদ চামুরে ঘণ্টা নাড়া,
মধ্যে বনমালী।
মা ভোর চৌদিকে দেবতা আঁকা
লোকের টানে চল্চে চাকা,
আগে পাছে ছাতল পাকা, বেহদ্দ ছেনালী।”
গানটি গেয়ে, “মা রথ! প্রণাম হই মা!” বলে প্রণাম কল্লে। এদিকে রথ হেলতে দুলতে বেরিয়ে গেল; ক্রমে এই রকম দু চারখানা রথ দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে পড়লো–গ্যাস-জ্বালা মুটের মৈ কাঁধে করে দেখা দিলে। পুলিসের পাশের সময় ফুরিয়ে এলো, দর্শকেরাও যে যার ঘরমুখো হলেন।
মাহেশে স্নানযাত্রায় যে প্রকার ধুম হয়, রথে সে প্রকার হয় না বটে; তবু ফেলা যায় না।
এদিকে সোজা ও উলটো রথ ফুরাল। শ্রাবণমাসে ঢ্যাল ফেলা পার্ব্বণ, ভাদ্র মাসের অরন্ধন ও জন্মাষ্টমীর পর অনেক জায়গায় প্রতিমের কাঠামোয় ঘা পড়লো, ক্রমে কুমোররা নায়েক বাড়ী একমেটে দোমেটে ও তেমেটে করে বেড়াতে লাগলো। কোলো বেঙ্গে “ক্রোড় কোঁ ক্রোড় কোঁ” শব্দে আগমনী গাইতে লাগলো; বর্ষা আঁবের আঁটি, কাঁটালের ভূঁতুড়ি ও তালের এঁসো খেয়ে বিদেয় হলেন–দেখতে দেখতে পূজো এলো।
২.২ দুর্গোৎসব
দুর্গোৎসব বাঙ্গালা দেশের পরব, উত্তরপশ্চিম প্রদেশে এর নামগন্ধও নাই; বোধ হয়, রাজা কৃষ্ণচন্দরের আমল হতেই বাঙ্গালায় দুর্গোৎসবের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। পূর্ব্বে রাজা-রাজড়া ও বনেদী বড় মানুষদের বাড়ীতেই কেবল দুর্গোৎসব হত, কিন্তু আজকাল অনেক পুঁটে তেলীকেও প্রতিমা আনতে দেখা যায়; পূৰ্ব্বেকার দুর্গোৎসব ঔএখনকার দুর্গোৎসব অনেক ভিন্ন।
ক্রমে দুর্গোৎসবের দিন সংক্ষেপ হয়ে পড়লো; কৃষ্ণনগরের কারিগরেরা কুমারটুলী ও সিদ্ধেশ্বরীতলা জুড়ে বসে গেল। জায়গায় জায়গায় রং-করা পাটের চুল, তবলকীর মালা, টীন ও পেতলের অসুরের ঢাল-তলওয়ার, নানারঙ্গের ছোবান প্রতিমার কাপড় ঝুলতে লাগলো; দর্জ্জিরা ছেলেদের টুপি, চাপকান ও পেটী নিয়ে দরোজায় দরজায় বেড়াচ্চে; ‘মধু চাই। শাঁকা নেবে গো!’ বোলে ফিরিওয়ালারা ডেকে ডেকে ঘুরছে। ঢাকাই ও শান্তিপুরে কাপুড়ে মহাজন, আতরওয়ালারা ও যাত্রার দালালেরা আহার-নিদ্রে পরিত্যাগ করেচে। কোনখানে কাঁসারীর দোকানে রাশীকৃত মধুপক্কের বাটী, চুমকী ঘটি ও পেতলের থালা ওজন হচ্ছে। ধূপ-ধুনো, বেণে মসলা ও মাখাঘষার একষ্ট্রা দোকান বসে গেছে। কাপড়ে মহাজনেরা দোকানে ডবল পর্দ্দা ফেলেচে; দোকানঘর অন্ধকারপ্রায়, তারি ভিতরে বসে যথার্থ ‘পাই-লাভে’ বউনি হচ্ছে। সিন্দুরচুপড়ী, মোমবাতি, পিঁড়ে ও কুশাসনের অবসর বুঝে দোকানের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার ধারে ‘অ্যাকুডক্টের’ উপর বার দিয়ে বসেচে। বাঙ্গাল ও পাড়াগেঁয়ে চাকরেরা আরসি, ঘুনসি, গিণ্টির গহনা ও বিলাতী মুক্তো একচেটেয় কিনচেন; রবরের জুতো, কনফরটার, ষ্টিক ও ন্যাজওয়ালা পাগড়ী অগুন্তি উঠচে; ঐ সঙ্গে বেলোয়ারি চুড়ী, আঙ্গিয়া, বিলাতী সোনার শীল আংটী ও চুলের গার্ডচেনেরও অসঙ্গত খদ্দের। এত দিন জুতোর দোকান ধূলো ও মাকড়সার জালে পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু পূজোর মোর্সমে বিয়ের কনের মত কেঁপে উঠছে, দোকানের কপাটে কাই দিয়ে নানা রকম রঙ্গিণ কাগজ মারা হয়েচে, ভিতরে চেয়ার পাতা, তার নীচে একটুকরা ছেঁড়া কারপেট। সহরে সকল দোকানেরই, শীতকালের কাগের মত চেহারা ফিরেছে। যত দিন ঘুনিয়ে আসছে, ততই বাজারের কেনা-বেচা বাড়চে; কলকেতা তত গরম হয়ে উঠছে। পল্লীগ্রামের টুলো অধ্যাপকেরা বৃত্তি ও বার্ষিক সাধতে বেরিয়েচেন; রাস্তায় রকম রকম তরবেতর চেহারার ভিড় লেগে গেছে।
কোনখানে খুন, কোনখানে দাঙ্গা, কোথায় সিঁধচুরি, কোনখানে ভট্টাচাৰ্য্য মহাশয়ের কাছ থেকে দু ভরি রূপো গাঁটকাঁটায় কেটে নিয়েছে; কোথাও কোন মাগীর নাক থেকে নথটা ছিঁড়ে নিয়েছে; পাহারাওয়ালারা শশব্যস্ত, পুলিস বদমাইস্ পোরা চোরেরা পূজোর মোর্সমে দেদার কারবার ফালাও কচ্চে। “লাগে তা না লাগে তুক্কো” “কিনি তে হাতী লুটি তো ভাণ্ডার” তাদের জপমন্ত্র হয়েচে; অনেকে পার্ব্বণের পূর্ব্বে শ্রীঘরে ও বাঙ্কুলে বসতি কচ্চে; কারো পুজোয় পাথরে পাঁচ কিল; কারো সৰ্ব্বনাশ। ক্রমে চতুর্থী এসে পড়লো।
এবার অমুক বাবুর নতুন বাড়ীতে পূজার ভারী ধূম! প্রতিপদাদিকল্পের পর ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের বিদায় আরম্ভ হয়েচে, আজও চোকে নাই—ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বাড়ী গিস্গিস্ কচ্চে। বাবু দেড়ফিট উচ্চ গদীর উপর তসর কাপড় পরে বার দিয়ে বসেচেন, দক্ষিণে দেওয়ান টাকা ও সিকি আধুলির তোড়া নিয়ে খাতা খুলে বসেচেন, বামে হবীশ্বর ন্যায়ালঙ্কার সভাপণ্ডিত অনবরত নস্য নিচ্চেন ও নাসা-নিঃসৃত রঙ্গিণ কফজল জাজিমে পুঁচ্চেন। এদিকে জহুরী জড়ওয়া গহনার পুঁটুলী ও ঢাকাই মহাজন ঢাকাই শাড়ীর গাঁট নিয়ে বসেচে। মুন্সি মোশাই, জামাই ও ভাগনেবাবুরা ফর্দ্দ কচ্চেন, সামনে কতকগুলি প্ৰিতিমে-ফেলা দুর্গাদায়গ্রস্ত ব্রাহ্মণ, বাইয়ের দালাল, যাত্রার অধিকারী ও গাইয়ে ভিক্ষুক ‘যে আজ্ঞা’ ‘ধৰ্ম্ম অবতার’ প্রভৃতি প্রিয় বাক্যের উপহার দিচ্চেন; বাবু মধ্যে মধ্যে কীরেও এক আধটা আগমনী গাইবার ফরমান কচ্চেন। কেউ খোসগল্প ও অন্য বড়মানুষের নিন্দাবাদ করে বাবুর মনোরঞ্জনের উপক্রমণিকা কচ্চেন–আসল মতলব দ্বৈপায়ন হ্রদে রয়েচে, উপফুক্ত সময়ে তীরস্থ হবে। আতরওয়ালা, তামাকওয়ালা, দানাওয়ালা ও অন্যান্য পাওনাদার মহাজনেরা বাইরের বারাণ্ডায় ঘুরচে, পূজো যায় তথাচ তাদের হিসেব নিকেস হচ্ছে না। সভাপণ্ডিত মহাশয় সরপটে পিরিলীর বাড়ীর বিদেয় নেওয়া বিধবা-বিবাহের দলের এবং বিপক্ষপক্ষের ব্রাহ্মণদের নাম কাটচেন, অনেকে তার পা ছুঁয়ে দিব্বি গালচেন যে, তাঁরা পিরিলীর বাড়ী চেনেন না; বিধবা-বিয়ের সভায় যাওয়া চুলোয় যাক, গত বৎসর শয্যাগত ছিলেন বল্লেই হয়। কিন্তু বানের মুখের জেলেডিঙ্গীর মত তাদের কথা তল্ হয়ে যাচ্চে, নামকাটাদের পরিবর্তে সভাপণ্ডিত আপনার জামাই, ভাগনে, নাত-জামাই, দোত্তুর ও খুড়তুতো ভেয়েদের নাম হাসিল কচ্চেন; এদিকে নামকাটারা বাবু ও সভাপণ্ডিতকে বাপান্ত করে, পৈতে ছিঁড়ে, গালে চড়িয়ে শাপ দিয়ে উঠে যাচ্চেন। অনেকে উমেদারের অনিয়ত হাজরের পর বাবু কাকেও ‘আজ যাও’ ‘কাল এসো’ ‘হবে না’ ‘এবার এই হলো’ প্রভৃতি অনুজ্ঞায় আপ্যায়িত কচ্চেন–হজুরী সরকারের হেক্মত দেখে কে! সকলেই শশব্যস্ত, পূজার ভারী ধূম!
ক্রমে চতুর্থীর অবসান হলো, পঞ্চমী প্রভাত হলেন—ময়ররা দুর্গোমণ্ডা বা আগাতোলা সন্দেশের ওজন দিতে আরম্ভ কল্লে। পাঁঠার রেজিমেণ্টকে রেজিমেণ্ট বাজারে প্যারেড কত্তে লাগলো, গন্ধবেণেরা মসলা ও মাথাঘষা বেঁধে বেঁধে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। আজ সহরের বড় রাস্তায় চলা ভার, মুটেরা প্রিমিয়মে মোট বইচে; দোকানে খদ্দের বসবার স্থান নাই। পঞ্চমী এইরূপে কেটে গেল। আজ ষষ্ঠী; বাজারের শেষ কেনাবেচা, মহাজনের শেষ তাগাদা—আশার শেষ ভরসা। আমাদের বাবুর বাড়ীরও অপূৰ্ব্ব শোভা; সব চাকর-বাকর নতুন তক্মা, উর্দ্দী ও কাপড় পোরে ঘুরে বেড়াচ্চে, দরজার দুই দিকে পূর্ণকুম্ভ ও আম্রসার দেওয়া হয়েচে; ঢুলীরা মধ্যে মধ্যে বোশনচৌকী ও শানাইয়ের সঙ্গে বাজাচ্চে; জামাই ও ভাগনেবাবুরা নতুন জুতো নতুন কাপড় পোরে ফর্রা দিচ্চেন, বাড়ীর কোন বৈঠকখানায় আগমনী গাওয়া হচ্ছে, কোথাও নতুন তাসজোড়া পর্কান হচ্ছে, সমবয়সী ও ভিক্ষুকের ম্যালা লেগেছে, আতরের উমেদাররা বাবুদের কাছে শিশি হাতে করে সাত দিন ঘুরচে; কিন্তু বাবুদের এমনি অনবকাশ যে, দুফোঁটা আতর দানের অবকাশ হচ্ছে না।
এদিকে সহরের বাজারের মোড়ে ও চৌরাস্তায় চুলী ও বাজান্দারের ভিড়ে সেঁধোনো ভার। রাজপথ লোকারণ্য; মালীরা পথের ধারে পদ্ম, চাঁদমালা, বিল্লিপত্র ও কুচো ফুলের দোকান সাজিয়ে বসেচে। দইয়ের ভার, মণ্ডার খুলী ও লুচি কচুরীর ওড়ায় রাস্তা জুড়ে গেছে; রেয়ো ভাট ও আমাদের মত ফলারেরা মিমো করে নিচ্ছে–কোথা যায়?
ষষ্ঠী সন্ধ্যায় শহরের প্রতিমার অধিবাস হয়ে গেল; কিছুক্ষণ পরে ঢোল ঢাকের শব্দ থামলো। পূজো বাড়ীতে ক্ৰমে ‘আন রে, এটা কি হলো,’ কত্তে কত্তে ষষ্ঠীর শর্ব্বরী অবসন্না হলো; সুখতারা মৃদুপবন আশ্রয় করে উদয় হলেন, পাখীর প্রভাত প্রত্যক্ষ করে ক্রমে ক্রমে বাস পরিত্যাগ কত্তে আরম্ভ কল্লে; সেই সঙ্গে সহরের চারিদিকে বাজনা-বাদ্দি বেজে উঠলো, নবপত্রিকা স্নানের জন্য কর্ম্মকর্ত্তারা শশব্যস্ত হলেন—ভাবুকের ভাবনায় বোধ হতে লাগলো যেন সপ্তমী কোরমাকান নতুন কাপড় পরিধান করে হাসতে হাসতে উপস্থিত হলেন। এদিকে সহরের সকল কলাবউয়ের বাজনা-বাদ্দি করে, স্নান কত্তে বেরুলেন, বাড়ীর ছেলেরা কাঁসর ও ঘড়ী বাজাতে বাজাতে সঙ্গে সঙ্গে চল্লে : এদিকে বা কলাবউয়েরাও স্নানের সরঞ্জামে বেরুলো; আগে আগে কাড়া, নাগরী, ঢোল ও সানাইদারেরা বাজাতে বাজাতে চল্লো; তার পেছনে নতুন কাপড় পোরে আশাশোঁটা হাড়ে বাড়ীর দরোয়ালেরা; তার পশ্চাৎ কলাবউ কোলে পুরোহিত, পুঁথি হাতে তন্ত্রধারক, বাড়ীর আচার্য্য বামন, গুরু ও সভাপণ্ডিত; তার পশ্চাৎ বাবু। বাবুর মস্তকে লাল সাটিনের রূপোর রামছাতা ধরেচে! আশে-পাশে ভাগনে, ভাইপো ও জামাইয়েরা; পশ্চাৎ আমলা ফয়লা ও ঘরজামাইয়ে ভগিনীপতিরা, মোসাহেব ও বাভে চলে তার শেষে নৈবিদ্ধ, লাণ্টন ও পুষ্পপত্রি, শখ, ঘণ্টা ও কুশাসন প্রভৃতি পূজোর সরঞ্জাম মাথায় মালী। এই সকল সরঞ্জামে প্রসন্নকুমার ঠাকুর বাবুর ঘাটে কলাবউ নাওয়াতে চড়েন; ক্রমে ঘাটে পৌঁছিলে কলাবউয়ের পূজো ও আনের অবকাশে হুজুরও গঙ্গার পবিত্র জলে স্নান করে নিয়ে, শুব পাঠ কত্তে কত্তে অনুরূপ বাজনা-বাৰ্দির সঙ্গে বাড়ীমুখো হলেন। পাঠকবর্গ! এ সহরে আজকাল দু-চার এজকেটেড ইয়ংবেঙ্গলও পৌত্তলিকতার দাস হয়ে, পূজো-আচ্ছা করে থাকেন; ব্রাহ্মণভোজনের বদলে কতকগুলি দিলদোস্ত মদে ভাতে প্রসাদ পান; আলাপি ফিমেল ফ্রেণ্ডেরাও নিমন্ত্রিত হয়ে থাকেন। পূজোরো কিছু রিফাইণ্ড কেতা। কারণ, অপর হিন্দুদের বাড়ী নিমন্ত্রিত প্রদত্ত প্রণামী টাকা পুরোহিত-ব্রাহ্মণেরই প্রাপ্য; কিন্তু এদের বাড়ী প্রণামীর টাকা বাবুর অ্যাকাউন্টে ব্যাঙ্কে জমা হয়, প্রতিমের সামনে বিলাতী চরবীর বাতী জ্বলে ও পূজোর দালানে জুতা নিয়ে ওঠবার এলাওয়েন্স থাকে। বিলেত থেকে অর্ডার দিয়ে সাজ আনিয়ে প্রতিমে সাজান হয়–মা দুর্গা মুকুটের পরিবর্তে বনেট পরেন, স্যাণ্ডউইচের শেতল খান, আর কলাবউ গঙ্গাজলের পরিবর্তে কাৎলীকরা গরম জলে স্নান করে থাকেন। শেষে সেই প্রসাদী গরম জলে কর্ম্মকর্ত্তার প্রাতরাশের টী ও কফি প্রস্তুত হয়।
ক্রমে তাবৎ কলাবউয়েরা স্নান করে ঘরে ঢুকলেন। এদিকে পূজো ও আরম্ভ হলো, চণ্ডীমণ্ডপে বারকোসের উপর আগাতোলা মোণ্ডাওয়ালা নৈবিদ্দ সাজান হলো। সঙ্গতি বুঝে চেলীর সাড়ী, চিনির থাল, ঘড়া, চুমকী ঘটী ও সোণার লোহা; নয় ত কোথাও সন্দেশের পরিবর্তে গুড় ও মধুপর্কের বাটীর বদলে থুরী ব্যবস্থা। ক্রমে পূজো শেষ হলো, ভক্তেরা এতক্ষণ অনাহারে থেকে পূজোর শেষে প্রতিমারে পুষ্পাঞ্জলি দিলেন। বাড়ীর গিন্নীরা চণ্ডী শুনে জল খেতে গেলেন, কারো বা নবরাত্রি। আমাদের বাবুর বাড়ীর পূজোও শেষ হলো প্রায়, বলিদানের উদযোগ হচ্ছে; বাবু মায় ষ্টাফ আদুড় গায়ে উঠানে দাঁড়িয়েচেন, কামার কোমর বেঁধে প্রতিমের কাছে থেকে পূজো ও প্রতিষ্ঠা করা খাড়া নিয়ে, কাণে আশীৰ্ব্বাদী ফুল গুঁজে, হাড়কাঠের কাছে উপস্থিত হলো, পাশ থেকে একজন মোসাহেব ‘খুঁটি ছাড়!’ ‘খুঁটি ছাড়!’ বোলে চেঁচিয়ে উঠলেন; গঙ্গাজলের ছড়া দিয়ে পাঠাকে হাড়কাঠে পুরে দিয়ে, খিল এঁটে দেওয়া হলো; একজন পাঠার মুড়ি ও আর একজন ধড়টা টেনে ধল্লে, অমনি কামার “জয় মা! মাগো!” বোলে কোপ তুল্লে; বাবুরাও সেই সঙ্গে “জয় মা! মাগো!” বলে, এতিমের দিকে ফিরে চেঁচাতে লাগলেন, দুপ্ করে কোপ পড়ে গেল—গীজা গীজা গীজা গীজা, নাক টুপ টুপ টুপ, গীজা গীজা গীজা গীজা নাক টুপ টুপ টুপ শব্দে ঢোল, কাড়ানাগর ও ট্যামটেমী বেজে উঠলো; কামার সরাতে সমাংস করে দিলে, পাঁঠার মুড়ির মুখ চেপে ধরে দালানে পাঠানো হলো, এদিকে একজন মোসাহেব সন্তর্পণে খর্পবের সরা আচ্ছাদিত করে প্রতিমের সম্মুখে উপস্থিত কল্লে। বাবুরা বাজনার তরঙ্গের মধ্যে হাততালি দিতে দিতে, ধীরে ধীরে চণ্ডীমণ্ডপে উঠলেন। প্রতিমার সামনে দানের সামগ্রী ও প্রদীপ জ্বেলে দেওয়া হলে আরতি আরম্ভ হলো; বাবু স্বহস্তে ধবল গঙ্গাজল-চামর বীজন কত্তে লাগলেন, ধূপ-ধূনোর ধোঁয়ে বাড়ী অন্ধকার হয়ে গেল। এইরূপ আধঘণ্টা আরতির পর শাঁক বেজে উঠলো—সবাবু সকলে ভুমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে বৈঠকখানায় গেলেন। এদিকে দালানে বামুনেরা নৈবিদ্দ নিয়ে কাড়াকাড়ি কত্তে লাগলো। দেখতে দেখতে সপ্তমী পূজো ফুরালো! ক্রমে নৈবিদ-বিলি, কাঙ্গালীবিদায় ও জলপান বিলানোতেই সে দিনের অবশিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে গেল; বৈকালে চণ্ডীর গানওয়ালারা খানিকক্ষণ আসর জাগিয়ে বিদায় হলো-জঙ্গী স্যাকরা চণ্ডী গানের প্রকৃত ওস্তাদ ছিল। সে মরে যাওয়াতেই আর চণ্ডীর গানের প্রকৃত গায়ক নাই; বিশেষতঃ এক্ষণে শ্রোতাও অতি দুর্লভ হয়েচে।
ক্রমে ছটা বাজলো, দালানের গ্যাসের ঝাড় জেলে দিয়ে প্রতিমার আরতি করে দেওয়া হলো এবং মা দুর্গার শেতলের জলপান ও অন্যান্য সরঞ্জামও সেই সময়ে দালানে সাজিয়ে দেওয়া হলো-মা দুর্গা যত খান বা না থান, লোকে দেখে প্রশংসা কল্লেই বাবুর দশ টাকা খরচের সার্থকতা হবে। এদিকে সন্ধ্যার সঙ্গে দর্শকের ভিড় বাড়তে লাগলো। বাঙ্গাল দোকানদার, ঘুস্কী ও কসবী, ক্ষুদ ক্ষু. ছেলে ও আইসি ছোঁড়া সঙ্গে খাতায় খাতায় প্রতিমে দেখতে আসতে লাগলো। এদিকে নিমন্ত্রিত লোকেরা সেজেগুঁজে এসে টন্যাৎ করে একটা টাকা ফেলে দিয়ে প্রণাম কল্লে, অমনি পুরুত একছড়া ফুলের মালা নেমন্তুন্নের গলায় দিয়ে টাকাটা কুড়িয়ে ট্যাঁকে খুঁজলেন, নেমন্তন্নও হন্ হন্ করে চলে গেলেন। কলকেতা সহরে এই একটি বড় আজগুবি কেতা, অনেকস্থলে নিমন্ত্রিতে ও কর্ম্ম কর্ত্তায় চোরে কামারের মত সাক্ষাৎও হয় না, কোথাও পুরোহিত বলে দেন, “বাবুরা ওপরে; ঐ সিঁড়ি মশাহ যান না। কিন্তু নিমন্ত্রিত যেন চিরপ্রচলিত রীতি অনুসারেই “আজ্ঞে না, আরো পাঁচ জায়গায় যেতে হবে, থাক” বলে টাকাটি দিয়েই অমনি গাড়ীতে ওঠেন; কোথাও যদি কর্ম্মকর্ত্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তবে গিরগিটির মত উভয়ে একবার ঘাড় নাড়ানাড়ি মাত্র হয়ে থাকে—সন্দেশ মেঠাই চুলোয় যাক, পান তামাক মাথায় থাক, প্রায় সর্ব্বত্রই সাদর-সম্ভাষণেরও বিলক্ষণ অপ্রতুল; দুই এক জায়গায় কর্ম্মকর্ত্তা জরির মহল পেতে, সামনে আতরদান, গোলাবপাস সাজিয়ে, পয়সার দোকানের পোদ্দারের মত বসে থাকে। কোন বাড়ীর বৈঠকখানায় চোহেলের রৈ রৈ ও হৈচৈয়ের তুফানে নেমন্তুন্নেদের সেঁদুতে ভরসা হয় না-পাছে কর্ম্মকর্ত্তা তেড়ে কামড়ান। কোথায় দরজা বন্ধ, বৈঠকথানা অন্ধকার, হয় ত বাবু ঘুমুচ্ছেন, নয় বেরিয়ে গেছেন। দালানে জনমানব নাই, নেমনে কার সম্মুখে যে প্রণামী টাকাটি লেবন ও কি করবেন, তা ভেবে স্থির করতে পারেন না; কর্ম্মকর্ত্তার ব্যাভার দেখে এতিমে পর্য্যন্ত অপ্রস্তুত হন, অথচ এ রকম নেমন্তন্ন না কল্লেই নয়। এই দরুণ অনেক ভদ্দরলোক আজকাল আর ‘সামাজিক’ নেমন্তন্নে স্বয়ং যান না, ভাগ্নে বা ছেলেপুলের দ্বারাতেই ক্রিয়েবাড়ীর পুরুতের প্রাপ্য কিম্বা বাবুদের ওৎকরা টাকাটি পাঠিয়ে দেন; কিন্তু আমাদের ছেলেপুলে না থাকায় স্বয়ং গমনে অসমর্থ হওয়ায়। স্থির করেছি, এবার অবধি প্রণামীর টাকার পোষ্টেজ ষ্ট্যাম্প কিনে ডাকে পাঠিয়ে দেব; তেন তেমন আত্মীয়স্থলে (সেফ এরাইভ্যালের জন্য) রেজেষ্টরী করে পাঠান যাবে; যে প্রকারে হোক, টাকাটি পৌঁছান নে বিষয়। অধ্যাপক ভায়ারা এ বিষয়ে অনেক সুবিধা করে দিয়েছেন, পূজো ফুরিয়ে গেলে তাঁরা প্রণামীর টাকাটি আদায় কত্তে স্বয়ং ক্লেশ নিয়ে থাকেন; নেমন্তন্নের পূর্ব্ব হতে পূজোর শেষে তাদের আত্মীয়তা আরও বৃদ্ধি হয়; অনেকের প্রণামী চাইতে আসাই পূজোর প্রুফ।
মনে করুন, আমাদের বাবু বনেদী বড়মানুষ; চাল স্বতন্তর, আরতির পর বেনারসী জোড় পরে সভাসদ সঙ্গে নিয়ে দালানে বার দিলেন; অমনি তক্মপরা বাঁকা দরওয়ানেরা তলওয়ার খুলে পাহারা দিতে লাগলো; হরকরা, হুঁকোবরদার, বিবির বাড়ীর বেহারা মোসাহেবের ঘোড়হস্ত হয়ে দাঁড়ালো, কখন কি ফরমাস হয়! বাবুর সামনে একটা সোণার অলিধোলা, ডাইনে একটা পান্না বসান সি, বায়ে একটা হীরে বসান টোপদার গুড়গুড়ি ও পেছনে একটা মুক্তো বসান পেঁচুয়া পড়লে : বার আঁস্তা কুড়ের কুকুরের মত ইচ্ছা অনুসারে আশে পাশে মুখ দিচ্চেন ও আড়ে আড়ে সামনে বাজেলকর ভিড়ের দিকে দেখচেন-লোক কোনটার কারিগরীর প্রশংসা কচ্চে; যে রকমে হোক লোককে দেখান চাই যে, বাবুর রূপো, সোণার জিনিষ অঢেল, এমন কিছু বসাবার স্থান থাকলে আরও দুটো ফুরসি বা গুড়গুড়ি দেখান যেতো। ক্রমে অনেক অনেক অনাহুত ও নিমন্ত্রিত জড় হতে লাগলেন, বাজে তোকে চু প পুরে গেল, জুতোচোরে সেই লাঙ্গা-তলোয়ারের পাহারার ভিতর থেকেও দুকু জুতো সহিতে কেলে। কচ্ছ জলে থেকেও ডাঙ্গা ডিমে প্রতি যেমন মন রাখে, সেইরূপ অনেকে মনে হলে বাবুর সঙ্গে কথাবার্ত্তার মধ্যেও আপনার জুতোর ওপোরও নজর রেখেছিলেন। কিন্তু উঠবার দেখেন যে, জুতোরাম ভাঙ্গা ডিমের খোলার মত হয় ত একপাটী ছেঁড়া চটি পড়ে আছে।
এদিকে দেখতে দেখতে গুড়ুম করে নটার তোপ পড়ে গেল; ছেলেরা ‘ব্যোমকালী কলকেত্তাওয়ালী’ বোলে চেঁচিয়ে উঠলো। বাবুর বাড়ীর নাচ, সুতরাং বাবু আর অধিকক্ষণ দালানে বোসতে পাল্লেন না, বৈঠকখানায় কাপড় ছাড়তে গেলেন, এদিকে উঠানের সমস্ত গ্যাস জ্বেলে দিয়ে মজলিসের উদ্যোগ হতে লাগলো, ভাগ্নেরা ট্যাসল দেওয়া টুপী ও পেটী পোরে ফোপরদালালী কত্তে লাগলেন। এদিকে দুই-এক জন নাচের মজলিসি নেমন্তন্নে আসতে লাগলেন। মজলিসে তরফা নাবিয়ে নেওয়া হলো। বাবু জরি ও কালাবং এবং নানাবিধ জড়ওয়া গহনায় ভূষিত হয়ে, ঠিক একটি ‘ইজিপশন মমী সেজে’ মজলিসে বাস দিলেন—বাই, সারঙ্গের সঙ্গে গান করে, সভাস্থ সমস্তকে মোহিত কত্তে লাগলেন।
নেমন্তন্নেরা নাচ দেখতে থাকুন, বাবু ফর্রা দিন ও লাল চোখে রাজা উজীর মারুন–পাঠকবর্গ একবার সহরটার শোভা দেখুন, প্রায় সকল বাড়ীতেই নানা প্রকার রং-তামাসা আরম্ভ হয়েচে। লোকেরা খাতায় পাতায় বাড়ী বাড়ী পূজো দেখে বেড়াচ্চে। রাস্তায় বেজায় ভিড়! মারওয়াড়ী খোট্টার পাল, মাগীর খাতা ও ইয়ারের দলে রাস্তা পুরে গেচে। নেমন্তন্নের হাতলণ্ঠনওয়ালা, বড় বড় গাড়ীর সইসেরা প্রলয় শব্দে পইস পইস কচ্চে, অথচ গাড়ী চালাবার বড় বেগতিক। কোথায় সখের কবি হচ্চে; ঢোলের চাটী ও গাওর চীৎকারে নিদ্রাদেবী সে পাড়া থেকে ছুটে পালিয়েছেন; গানের তানে ঘুমন্তো ছেলেরা মার কোলে ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠছে। কোথাও পাঁচালি আরম্ভ হয়েচে, বওয়াটে পিলইয়ার ছোকরারা ভরপুর নেশায় ভো হয়ে ছড়া কাটচেন ও আপনা আপনি বাহবা দিচ্চেন; রাত্রিশেষে শ্রাদ্ধ গড়াবে, অবশেষে পুলিসে দাক্ষিণা দেবে। কোথাও যাত্রা হচ্চে, মণিগোঁসাই সং এসেচে ছেলেরা মণিগোঁসাইয়ের রসিকতায় আহ্লাদে আটখানা হচ্ছে; আশে পাশে চিকের ভিতর মেয়েরা উঁকি মাচ্চে, মজলিসে রামমসাল জ্বলচে; বাজে দশর্কদের বাযুক্রিয়ায় ও মসালের দুর্গন্ধে পূজাবাড়ী তিষ্ঠান ভার! ধুপ-ধুনার গন্ধও হার মেনেচে। কোনখানে পূজোবাড়ীর বাবুরাই খোদ মজলিস রেখেচেন–বৈঠকখানায় পাঁচো ইয়ার জুটে নেউল নাচানো, ব্যাং নাপানো, খ্যামটা ও বিদ্যাসুন্দর আরম্ভ করেচেন; এক একবারের হাসির গর্রায়, শিয়াল ডাকে ও মদন আগুনের তানে–দালনে ভগবতী ভয়ে কাঁপচেন, সিঙ্গি চোরকে কামড়ান পরিত্যাগ করে, ন্যাজ গুটিয়ে পলাবার পথ দেখচে, লক্ষ্মী সরস্বতী শশব্যস্ত। এদিকে সহরের সকল রাস্তাতেই লোকের ভিড়, সকল বাড়ীই আলোময়।
এই প্রকার সপ্তমী, অষ্টমী ও সন্ধিপূজো কেটে গেল; আজ নবমী, আজ পূজোর শেষ দিন। এত দিন লোকের মনে যে আহ্লাদটি জোয়ারের জলের মত বাড়তেছিল, আজ সেইটির একেবারে সারভাটা।
আজ কোথাও ঘোড়া মোষ, কোথাও নব্বইটা পাঁটা, সুপারি আখ, কুমড়ো, মাগুরমাছ ও মরীচ বলিদান হয়েচে; কর্ম্মকর্ত্তা পাত্র টেনে পাঁচোইয়ারে জুটে নবমী গাচ্চেন ও কাদামাটী কচ্চেন; ঢুলীর ঢেলে সঙ্গত হচ্ছে, উঠানে লোকারণ্য, উপর থেকে বাড়ীর মেয়েরা উঁকি মেরে নবমী দেখছেন। কোথাও হোমের ধুমে বাড়ী অন্ধকার হয়ে গেছে; কার সাধ্য প্রবেশ করে-কাঙ্গালী, রেয়োভাট ও ভিক্ষুকের পূজোবাড়ী ঢোকা দূরে থাকুক, দরজা হতে মশাগুলো পর্য্যন্ত ফিরে যাচ্চে। ক্রমে দেখতে দেখতে দিনমণি অস্ত গ্যালেন, পূজোর আমোদ প্রায় সম্বৎসরের মত ফুরালো! ভোরাও ওক্তে ভয়রো রাগিণীতে অনেক বাড়ীতে বিজ্ঞয়া গাওনা হলো; ভক্তের চক্ষে ভগবতীর প্রতিমা পরদিন প্রাতে মলিন মলিন বোধ হতে লাগলো, শেষে বিসর্জ্জনের সমারোহ শুরু হলো—আজ নিরঞ্জন।
ক্রমে দেখতে দেখতে দশটা বেজে গেল; দইকড়মা ভোগ দিয়ে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হলো; আরতির পর বিসর্জ্জনের বাজনা বেজে উঠলো। বামুনবাড়ীর প্রতিমারা সকলেই জলসই। বড়মানুষ ও বাজে জাতির প্রতিমা পুলিসের পাশ মত বাজনা বাদ্দির সঙ্গে বিলৰ্জন হবেন—এ দিকে এ কাজে সে কাজে গির্জ্জার ঘড়ীতে টুং টাং টুং টাং করে বারটা বেজে গেল; সূর্য্যের মৃদুতপ্ত উত্তাপে সহর নিমকি রকম গরম হয়ে উঠলো; এলোমেলো হাওয়ায় রাস্তার ধুলো ও কাঁকর উড়ে অন্ধকার করে তুল্লে। বেকার কুকুরগুলো–দোকানের পাটাতনের নীচে ও খানার ধারে শুয়ে জীব বাহির করে হাঁপাচ্চে, বোঝাই গাড়ীর গরুগুলোর মুখ দে ফ্যানা পড়চে-গাড়োয়ান ভয়ানক চীৎকারে “শালার গরু চলে না” বলে ন্যাজ মোলচে ও পাচলবাড়ি মাচ্চে; কিন্তু গরুর চাল বেগড়াচ্চে না, বোঝাইয়ের ভরে চাকাগুলি কোঁ কোঁ শব্দে রাস্তা মাতিয়ে চলেছে। চড়াই ও কাকগুলো বারান্দা আলম্বে ও নলের নীচে চক্ষু মুদে বসে আছে। ফিরিওয়ালারা ক্রমে ঘরে ফিরে যাচ্চে; রিপুকৰ্ম্ম ও পরামাণিকেরা অনেকক্ষণ হলো ফিরেচে; আলু পটোল! ঘি চাই! ও তামাকওয়ালারা কিছুক্ষণ হলো ফিরে গেছে। ঘোল চাই! মাখন চাই! ভয়সা দই চাই! ও মালাই-দইওয়ালারা কড়ি ও পয়সা গুণতে গুণতে ফিরে যাচ্চে। এখন কেবল মধ্যে মধ্যে পানিফল! কাগোজ বদল! পেয়ালা পিরিচ! ফিরিওয়ালাদের ডাক শোনা যাচ্চে–নৈবিদ্দি-মাথায় পূজোবাড়ীর লোক, পুজুরী বামুন, পটো বাজন্দার ভিন্ন রাস্তায় বাজে লোক নাই, গুপুস করে একটার তোপ পড়ে গেল। ক্রমে অনেক স্থলে ধুমধামে বিসর্জ্জনের উদযোগ হতে লাগলো।
হায়! পৌত্তলিকতা কি শুভ দিনেই এ স্থলে পদার্পণ করেছিল। এতে দেখে শুনে, মনে স্থির জেনেও আমরা তারে পরিত্যাগ কত্তে কত কষ্ট ও অসুবিধা বোধ কচ্চি; ছেলেবেলা যে পুতুল নিয়ে খেলাঘর পেতেছি, বৌ বৌ খেলেছি ও ছেলে-মেয়ের বে দিয়েছি, আবার বড় হয়ে সেই পুতুলকে পরমেশ্বর বলে পুজো কচ্চি, তার পদার্পণে পুলকিত হচ্চি ও তার বিসর্জ্জনে শোকের সীমা থাকচে না–শুধু আমরা কেন, কত কত কৃতবিদ্য বাঙ্গালী সংসারের ও জগদীশ্বরের সমস্ত তত্ত্ব অবগত থেকেও, হয় ত সমাজ, না হয় পরিবার পরিজনের অনুরোধে, পুতুল পুজে আমোদ প্রকাশ করেন, বিসর্জ্জনের সময় কাঁদেন ও কাদা রক্ত মেখে কোলাকুলি করেন; কিন্তু নাস্তিকতায় নাম লিখিয়ে বনে বসে থাকাও ভাল, তবু “জগদীশ্বর একমাত্ৰ” এটি জেনে আবার পুতুলপূজায় আমোদ প্রকাশ করা উচিত নয়।
ক্রমে সহরের বড় রাস্তা চৌমাথা লোকারণ্য হয়ে উঠলো, বেশ্যালয়ের বারাণ্ডা আলাপীতে পূরে গেল; ইংরাজী বাজনা, নিশেন, তুরুকসোয়ার ও সার্জ্জন সঙ্গে প্রতিমার রাস্তায় বাহার দিয়ে বেড়াতে লাগলেন–তখন ‘কার প্রতিমা উত্তম’ ‘কার সাজ ভাল’ ‘কার সরঞ্জাম সরেস’ প্রভৃতির প্রশংসারই প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু হায়! ‘কার ভক্তি সরেস’ কেউ সে বিষয়ের অনুসন্ধান করে না–কর্ম্মকর্ত্তাও তার জন্য বড় কেয়ার করেন না! এদিকে প্রসন্নকুমার বাবুর ঘাট ভদ্দরলোক গোচের দর্শক, ক্ষুদে ক্ষুদে পোষাক পরা ছেলে, মেয়ে ও ইস্কুলবয়ে ভরেরে গেল। কর্ম্মকর্ত্তারা কেউ কেউ প্রতিমে নিয়ে বাচখেলিয়ে বেড়াতে লাগলেন—আমুদে মিনষেরা ও ছোঁড়ারা নৌকার ওপর ঢোলের সঙ্গতে নাচতে লাগলো, সৌখীন বাবুরা খ্যামটা ও বাই সঙ্গে করে বোট, পিনেস ও বজরার ছাতে বার দিয়ে বসলেন—মোসাহেব ও ওস্তাদ চাকরেরা কবির সুরে দু-একটা রংদার গান গাইতে লাগলো।
গান
“বিদায় হও মা ভগবতি। এ সহরে এসো নাকো আর।
দিনে দিনে কলিকাতার মর্ম্ম দেখি চমৎকার।।
জষ্টিসেরা ধৰ্ম্ম-অবতার, কায়মনে কচ্চেন সুবিচার।
এদিকে বুলোর তরে রাজপথেতে চেঁচিয়ে চেয়ে চলা ভার।।
পথে হাগা মোতা চলবে না, লহরের জল তুলতে মানা,
লাইসেন্সটেক্স মাথটচাঁদা, পাইখানায় বাসি ময়লা রবে না।
হেলথ অফিসর, সেতখানার মেজেষ্টর, ইনকমের আসেসর সাল্লে সবারে।
আবার গবর্ণরের গুয়ে দষ্টি, সৃষ্টিছাড়া ব্যবহার।
অসহ্য হতেছে মাগো! অসাধ্য বাস করা আর।।
এই জীয়ন্তে এই ত জ্বালা মাগো!—মলেও শান্তি পাবে না,
মুখাগ্নির দফা রফা কলেতে করবে সৎকার।
হুতোমদাস তাই সহর ছেড়ে আসমানে করেন বিহার॥”
এ দিকে দেখতে দেখতে দিনমণি যেন সম্বৎসরের পূজোর আমোদর সঙ্গে অস্ত গেল। সন্ধ্যাবধ বিচ্ছেদ-বসন পরিধান করে দেখা দিলেন। কর্ম্মকর্ত্তারা প্রতিমা নিরঞ্জন করে, নীলকণ্ঠ শঙ্খচিল উড়িয়ে ‘দাদা গো দিদি গো’ বাজনার সঙ্গে ঘট নিয়ে ঘরমুখো হলেন। বাড়ীতে পৌঁছে চণ্ডীমণ্ডপ পূর্ণঘটকে প্রণাম করে শান্তিজল নিলেন; পরে কাঁচাহলুদ ও ঘটজল খেয়ে পরস্পর কোলাকুলি কল্লেন। অবশেষে কলাপাতে দুর্গানাম লিখে সিদ্ধি খেয়ে বিজয়ার উপসংহার হলো। ক’দিন মহাসমারোহের পর আজ সহরটা খাঁ খাঁ কত্তে লাগলো—পৌত্তলিকের মন বড়ই উদাস হলো, কারণ, যখন লোকের সুখের দিন থাকে, তখন সেটির তত অনুভব কত্তে পারা যায় না, যত সেই সুখের মহিমা, দুঃখের দিনে বোঝা যায়।
২.৩ রামলীলা
দুর্গোৎসব এক বছরের মত ফুরুলো; ঢুলীরা নায়েক বাড়ী বিদেয় হয়ে শুঁড়ির দোকানে রং বাজাচ্চে। ভাড়াকরা ঝাড়েরা মুটের মাথায় বাঁশে ঝুলে টুনু টুনু শব্দে বালাখানায় ফিরে যাচ্চে; যজমেনে বামুনের বাড়ীর নৈবিদ্দির আলো-চাল ও পঞ্চশস্য শুকুচ্চে, ব্রাহ্মণী ছেলে কোলে করে কাটি নিয়ে কাগ তাড়াচ্ছেন। সহরটা থমথমে। বাসাড়েরা আজও বাড়ী হতে ফেরেন নি, অফিস ও ইস্কুল খোলবার আরও চার পাঁচ দিন বিলম্ব আছে।
যে দেশের লোকের যে কালে যে প্রকার হেম্মত থাকে, সে দেশে সে সময় সেই প্রকার কর্ম্মকাণ্ড, আমোদ-প্রমোদ ও কার-কারবার প্রচলিত হয়। দেশের লোকের মনই সমাজে লোকোমোটিবের মত, ব্যবহার কেবল ‘ওয়েদরকর্কের’ কাজ করে। দেখুন, আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা রঙ্গভূমি প্রস্তুত করে মল্লযুদ্ধে আমোদ প্রকাশ কত্তেন, নাটক ত্রোটকের অভিনয় দেখতেন, পরিশুদ্ধ সঙ্গীত ও সাহিত্যে উৎসাহ দিতেন; কিন্তু আজকাল আমরা বারোইয়ারিতলায়, নয় বাড়ীতে, বেদেনীর নাচ ও ‘মদন আগুনের তানে পরিতুষ্ট হচ্ছি; ছোট ছোট ছেলে ও মেয়েদের অনুরোধ উপলক্ষ করে পুতুল নাচ, পাঁচালী ও পচা খেউড়ে আনন্দ প্রকাশ কচ্চি, যাত্রাওয়ালাদের ‘ছকুবাবু ও সুন্দরের সং’ নাবাতে হুকুম দিচ্চি। মল্লযুদ্ধের তামাসা ‘দ্যাখ বুল বুল ফাইট’ ও ‘ম্যাড়ার লড়ায়ে’ পর্যবসিত হয়েচে। আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা পরস্পর লড়াই করেচেন, আজকাল আমরা সর্ব্বদাই পরস্পরের অসাক্ষাতে নিন্দাবাদ করে থাকি; শেষে একপক্ষের ‘খেউড়ে’ জিত ধরাই আছে।
আমাদের এই প্রকার অধঃপতন হবে না কেন? আমরা হামা দিতে আরম্ভ করেই ঝুমঝুমি, চুষী ও শোলার পাখীতে বর্ণপরিচয় করে থাকি। কিছু পরে ঘুড়ি, লাটিম, লুকোচুরি ও বৌ বৌ খেলাই আমাদের যুবত্বের এনট্রান্স-কোর্স হয়; শেখে তাস, পাশা ও বড়ে টিপে মাৎ করে ডিগ্রী নিয়ে বেরুই! সুতরাং ঐগুলি পুরাণে পড়ার মত কেবল চিরকাল আউড়ে আসতে হয়; বেশীর ভাগ বয়সের পরিণামেব সঙ্গে ক্রমশঃ কতকগুলি আনুসঙ্গিক উপসর্গ উপস্থিত হয়।
রামলীলা এদেশের পরব নয়, এটি প্রবল খোট্টাই! কিছুকাল পূর্ব্বে চীনকের সেপাইদের দ্বারা এই রামলীলার সূত্রপাত হয়; পূর্ব্বে তারাই আপনা-আপনি চাঁদা করে চীনকের মাঠে রাম-রাবণের যুদ্ধের অভিনয় কত্তো; কিছু দিন এ রকমে চলে, মধ্যে একেবারে রহিত হয়ে যায়। শেষে বড়বাজারের দু’ চার ধনী খোট্টার উদ্যোগে ১৭৫৭ শকে পুনর্ব্বার রামলীলার আরম্ভ হয়। তদবধি এই বার বৎসর রামলীলার মেলা চলে আসছে। কলকেতায় আর অন্য কোন মেলা নাই বলেই, অনেকে রামলীলায় উপস্থিত হন। এদের মধ্যে নিষ্কৰ্ম্মা বাবু, মাড়োয়ারী খোট্টা, বেশ্যা ও বেণেই অধিক।
পাঠকবর্গ মনে করুন, আপনাদের পাড়ার বনেদী বড়মানুষ ও দলপতি বাবু দেড়ফিট উচ্চ গদির ওপর বার দিয়ে বসেছেন; গদির সামনে বড় বড় বাক্স ও আয়না পড়েছে, বাবুর প্রকাণ্ড আলবোলা প্রতি টানে শরতের মেঘের মত শব্দ কচ্ছে, আর মস্ক ও মূসব্বর মেশান ইরাণী তামাকের খোসবোয় বাড়ী মাত করেচে। গদির কিছু দূরে এক জন খোট্টা সিদ্ধির মাজুম, হজমীগুলি ও পালংতোড় প্রভৃতি ‘কুয়ৎ কি চিজ’ রুমালে বেঁধে বসে আছেন। তিনি লক্ষ্ণৌয়ের এক জন সম্পন্ন জহুরীর পুত্র, এক্ষণে সহরেই বাস; হয়ত বছর কতক হলে আফিমের তেজমন্দি খেলায় সর্ব্বস্বান্ত হয়ে বাবুর অবশ্য-পোষ্য হয়েচেন। মনে করুন, তার অনেক প্রকার হাকিমী ঔষধ জানা আছে। সিদ্ধি সম্পর্কীয় মাজুমও তিনি উত্তম রকমে প্রস্তুত কত্তে পারেন। বিশেষতঃ বিস্তর বাই, কথক ও গানওয়ালীর সহিত পরিচয় থাকায়, আপন হেকমত ও হুনুরীতে আজকাল বাবুর দক্ষিণ হস্ত হয়ে উঠেছেন। এর পাশে ভবানীবাবু ও মিসুয়ার্স আর্টফুল ডজরস উকীল সাহেবের হেডকেরাণী হলধরবাবু। ভবানীবাবু ঐ অঞ্চলের একজন বিখ্যাত লোক, আদালতে ভারী মাইনের চাকরী করেন; এ সওয়ায় অন্তঃশিলে কোম্পানীর কাগজের দালালী, বড় বড় ব্রাজা-রাজড়ার আমমোক্তারী ও মকদ্দমার ম্যানেজারী করা আছে। এমন কি অনেকেই স্বীকার করে থাকেন যে, ভবানীবাবু ধড়িবাজিতে উমিচাঁদ হইতে সরেস ও বিষয়-কর্ম্মে জয়কৃষ্ণ হতে জব্বর। ভবানীবাবুর পার্শ্বস্থ হলধরও কম নন–মনে করুন, হলধর উকীলের বাড়ী মকদ্দমার তদ্বিরে ফের-ফন্দীতে ও জাল-জালিয়াতে প্রকৃত শুভঙ্কর। হলধরের মোচা গোঁফ, মুসকের মত ভুঁড়ি, হাতে ইষ্টিকবচ, কোমরে গোট ও মাদুলি, সরু ফিনফিনে সাদা ধুতি পরিধান, তার ভিতরে একটা কাচ, কপালে টাকার মত একটা রক্তচন্দনের টিপ ও দাঁতে মিসি;—চাদরটা তাল পাকিয়ে কাঁধে ফেলে অনবরত তামাক খাচ্চেন ও গোঁপে তা দিয়ে যেন বুদ্ধি পাকাচ্চেন। এমন সময়ে বাবুর এ মজলিসে ফলহরিবাবু ও রামভদ্দরবাবু উপস্থিত হলেন; ফুলহরি ও রামভদ্দরকে দেখে বাবু সাদরসম্ভাষণে বসালেন, হুঁক্কাবরদার তামাক দিয়ে গেল; বাবুরা শ্রান্তি দূর করে তামাক খেতে খেতে একথা সে কথার পর বল্লেন, “মশাই, আজ রামলীলার ধূম! আজ শুনলেম লক্ষ্মণের শক্তিশেল হবে, বিস্তর বাজী পুড়বে, এখানে আসবার সময়ে দেখলেম, ও পাড়াদ রামবাবুর চৌঘুড়ী গেল। শম্ভুবাবু বগীতে লক্ষ্মীকে নিয়ে যাচ্চেন–আজ বেজায় ভিড়। মশাই যাবেন না?” তখনি ‘ভবানীবাবু’ এই প্রস্তাবের পোষকতা কল্লেন—বাবুও রাজী হলেন—অমনি ‘ওরে! ওরে কোই হ্যায়রে! কোই হ্যায়!’ শব্দ পড়ে গেল আশেপাশে, ‘খোদাবন্দ’ ও ‘আচ্চা যাইয়ে’ প্রতিধ্বনি হতে লাগলো–হরকরাকে হুকুম হলো, বড় ব্রিজকা ও বিলাতি জুড়ি তইরি কত্তে বল শীগগির।
ঠাওরাণ, যেন এ দিকে বাবর ব্রিজকা প্রস্তুত হতে লাগলো, পেয়ারের আদালীরা পাগড়ী ও তকমা পরে আয়নার মুখ দেখচে। বাবু ড্রেসিং রুমে ঢুকে পোষাক পচ্চেন। চার-পাঁচ জন চাকরে পড়ে চল্লিশ রকম প্যাটার্নের ট্যাসিলদেওয়া টুপী, সাটীনের চাপকান, পায়জামা বাছুনি কচ্চে। কোনটা পল্লে বড় ভাল দেখাবে, বাবু মনে মনে এই ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হচ্চেন, হয় ত একটা জামা পরে আবার খুলে ফেল্লেন। একটা টুপী মাথায় দিয়ে আয়নায় মুখ দেখে মনে ধচ্চে না; আবার আর একটা মাথায় দেওয়া হচ্ছে, সেটাও বড় ভাল মানাচ্ছে না। এই অবকাশে একজন মোসাহেবকে জিজ্ঞাসা কচ্চেন, ‘কেমন হে! এটা কি মাথায় দেবো?’ মোসাহেব সব দিক বজায় রেখে, ‘আজ্ঞে পোষাক পল্লে আপনাকে যেমন খোলে, শহরের কোন শালাকে এমন খোলে না’ বল্চেন; বাবু এই অবসরে আর একটা টুপী মাথায় নিয়ে জিজ্ঞাসা কচ্চেন ‘এটা কেমন?’ মোসাহেব ‘আজ্ঞে এমন আর কারো নাই’ বলে বাবুর গৌরব বাড়াচ্চেন ও মধ্যে মধ্যে ‘আপ রুচি খানা ও পর রুচি পিন্না’ বয়েদটা নজীর কচ্চেন। এই প্রকার অনেক তর্কবিতর্ক ও বিবেচনার পর হয়ত একটা বেয়াড়া রকমের পোষাক পরে, শেষে পমেটম ল্যাভেণ্ডার ও আতর মেখে, অংটী চেন ও ইষ্টিক বেচে নিয়ে, দু ঘণ্টার পর বাবু ড্রেসিংরুম হতে বৈঠক খানায় বার হলেন। হলধর, ভবানী, বমিভদ্দর প্রভৃতি বৈঠকখানাস্থ সকলেই আপনাদের কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম বলেই যেন ‘আজ্ঞে পোষাকে আপনাকে বড় খুলেচে’ বলে নানাপ্রকার প্রশংসা কত্তে লাগলেন; কেউ বল্লেন, হুজুর। এ কি গিদ্সনের বাড়ীর তইরি না?’ কেউ ঘড়ির চেন, কেউ আংটী ও ইষ্টিকের অনিয়ত প্রশংসা কত্তে আরম্ভ কল্লেন। মোসাহেবের মধ্যে যাঁহাদের কাপড়-চোপড়গুলি বাবুর ব্রিজকা ও বিলাতী জুড়ির যোগ্য নয়, তারা বাবুর প্রসাদি কাপড় চোপড় পরে কানে আতরের তুলল গুঁজে চেহারা খুলে নিলেন; প্রসাদি কাপড়-চোপড় পরে মোসাহেবদের আর আহ্লাদের সীমা রইলো না। মনে হতে লাগলো, বাড়ীর কাছের উঠনোওয়ালা মুদি মাগী ও চেনা লোকেরা যেন দেখতে পায় আমি কেমন পোষাকে হুজুরের সঙ্গে বেড়াচ্ছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, অনেক মোসাহেব সৰ্ব্বদাই আক্ষেপ করে থাকেন, তারা যখন বাবুদের সঙ্গে বড় বড় গাড়ী ও ভাল কাপড়-চোপড় পরে বেড়ান, তখন কেউ তাঁদের দেখতে পান না, আর গামচা কাঁদে করে বাজার কত্তে কেরুলেই সকলের নজরে পড়েন।
এ দিকে টুং টাং টুং করে মেকাবী ক্লকে পাঁচটা বাজলো, ‘হুজুর গাড়ী হাজির’ বলে হরকরা হুজুরে প্রোক্লেম কল্লে। বাবু মোসাহেবদের সঙ্গে নিয়ে গাড়ীতে উঠলেন—বিলাতী জুড়ি কৌচম্যানের ইঙ্গিতে টপাটপ টপাটপ শব্দে রাস্তা কাঁপিয়ে বাবুকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
এ দিকে চাকরের ‘রাম বাঁচলুম’ বলে কেউ বাবুর মচলন্দে গড়িয়ে পড়লো, কেউ হুজুরের সোনাবাঁধান হুঁকোটা টেনে দেখতে লাগলো–অনেকে বাবুর ব্যবহারের কাপড়চোপড় পরে বেড়াতে বেরুলো; সহরের অনেক বড় মানুষের বাড়ী বাবুদের সাক্ষাতে বড় আঁটাআঁটী থাকে, কিন্তু তাঁদের অসাক্ষাতে বাড়ীর অনেক ভাগ উদোম এলো হয়ে পড়ে।
ক্রমে বাবুর ব্রিজকা চিৎপুর রোডে এসে পড়লো। চিৎপুর রোডে আজ গাড়ী-ঘোড়ার অসম্ভব ভিড়। মাড়ওয়ারী, খোট্টা ও বেশ্যারা খাতায় খাতায় ছক্কড় ও কেরাঞ্চীতে রামলীলা দেখতে চলেচে। যাঁরা যোত্রহীন, তাঁরাও সখের অনুরোধ এড়াতে না পেরে, হেঁটেই চলেচেন, কলকেতা সহরের এই একটি আজব গুণ যে, মজুর হতে লক্ষপতি পৰ্য্যন্ত সকলের মনে সমান সখ। বড় লোকেরা দানসাগরে যাহা নির্ব্বাহ করবেন, সামান্য লোকে ভিক্ষা বা চুরি পর্য্যন্ত স্বীকার করেও কায়ক্লেশে তিলকাঞ্চনে সেটির নকল কত্তে হবে।
আন্দাজ করুন, যেন, এ দিকে ছক্কড় ও বড় বড় গাড়ীর গতিতে রাস্তার ধূলে উড়িয়ে সহর অন্ধকার করে তুল্পে। সূৰ্যদেও সমস্ত দিন কমলিনীর সহবাসে কাটিয়ে পরিশ্রান্ত নাগরেব মত ক্লান্ত হয়ে শ্রান্তি দূর করবার জন্যই যেন অস্তাচল আশ্রয় কল্লেন; প্রিয়সথী প্রদোষরাণীর পিছে পিছে অভিসারিণী সন্ধ্যাবধূ ধীরে ধীরে সতিনী শৰ্বরীর অনুসরণে নির্গত হলেন; রহস্যজ্ঞ অন্ধকার সমস্ত দিন নিভৃতে লুকিয়ে ছিল, এখন পাখীদের সঙ্কেবাক্যে অবসর বুঝে ক্রমশঃ দিকসকল আচ্ছাদিত করে নিশানাথের নিমিত্ত অপূর্ব্ব বিহারস্থল প্রস্তুত কত্তে আরম্ভ কল্লে। এ দিকে বাবুর ব্রিজকা রামলীলার রঙ্গভূমিতে উপস্থিত হলো। রামলীলার বঙ্গভূমি রাজাবাহাদুরের বাগানখানি পূৰ্ব্বে সহরের প্রধান ছিল, কিন্তু কুলপ্রদীপকুমারদের কল্যাণে আজকাল প্রকৃত চিড়িয়াখানা হয়ে উঠেছে। পূৰ্ব্বে রামলীলা ঐ রাজা বৰ্দিনাথ বাহাদুরের বাগানেতেই হতো; গত বৎসর হতে রহিত হয়ে রাজা নরসিংহ বাহাদুরের বাগানে আরম্ভ হয়েচে। নরসিংহ বাহাদুরের ফুলগাছের উপর যার পর নাই সখ ছিল এবং চিরকাল এই ফুলগাছের উপাসনা করেই কাটিয়ে গেছে; সুতরাং তার বাগান যে সহরের শ্রেষ্ঠ হবে, বড় বিচিত্র নয়? এমন কি, অনেকেই স্বীকার করেচেন যে, গাছের পারিপাট্যে রাজা বাহাদুরের বাগান কোম্পানীর বাগান হতে বড় খাট ছিল না; কিন্তু বর্ত্তমান কুমার বাহাদুর পিতার মৃত্যুর মাসেকের মধ্যে বাগানখানি অয়রান করে ফেল্লেন! বড় বড় গাছগুলি উবড়ে বিক্রি করা হলো, রাজা বাহাদুরের পুরাতন জুতো পর্য্যন্ত পড়ে রইলো না, যে প্রকারে হোক টাকা উপার্জন করাই কুমার বাহাদুরের মতে কৰ্তব্য কৰ্ম্ম। সুতরাং শেষে এই শ্রেষ্ঠ বাগান রামলীলার বঙ্গভূমি হয়ে উঠলো, ঘরে বাইরে বানর নাচতে লাগলো। সহরে সোয়োত উঠলো, এবার বদ্দিনাথের বদলে রাজা নরসিংহের বাগানের ‘রামলীলার।’ কিন্তু এবার গাড়ী-ঘোড়র টিকিট! রাজা বন্দিনাথের বাগানের রামলীলার সময়ে টিকিট বিক্রী করা পদ্ধতি ছিল না, রাজা বাহাদুর ও অপর বড়মানুষে বিলক্ষণ দুশ টাকা সাহায্য কত্তেন, তাতেই সমুদয় খরচ কুলিয়ে উঠতে। কিন্তু রাজা বদ্দিনাথ বৃদ্ধাবস্থায় দু-তিন বৎসর হলে দেহত্যাগ করায় রাজকুমার সুবুদ্ধি বাহাদুরের বাগানখানি ভাগ করে নিলেন—মধ্যে দেইজি পাঁচীল পড়লো; সুতরাং অন্য বড় মানুষেরাও রামলীলায় তাদৃশ উৎসাহই দেখালেন না, তাতেই এবার টিকিট করে কনক টাকা তোলা হয়। বলতে কি, কলিকাতা বড় চমৎকার সহর! অনেকেই রং-তামাসায় অপব্যয় কত্তে বিলক্ষণ অগ্রসর, টিকিট সত্ত্বেও রামলীলার বাগান গাড়ী-ঘোড়া ও জনতায় পরিপূর্ণ; লোকের বেজায় ভিড়!
এ দিকে বাবুর ব্রিজক জনতার জন্য অধিক দূর যেতে পাল্লে না, সুতরাং হুজুর দলবলসমেত পায়দলে বেড়ানই সঙ্গত ঠাউরে গাড়ী হতে নেবে বেড়াতে বেড়াতে বঙ্গভূমির শোভা দেখতে লাগলেন।
বঙ্গভূমির গেট হতে রামলীলার রণক্ষেত্র পর্য্যন্ত দুসারি দোকান বসেছে; মধ্যে মধ্যে নাগোরদোলা ঘুরচে-গোলাবি খিলি, খেলেনা, চানাচুর ও চিনের বাদাম প্রভৃতি ফিরিওয়ালাদের চীৎকার উঠছে; ইয়ারের দল খাতায় খাতায় প্যারেড করে বেড়াচ্চে; বেশ্যা, খোট্টা, বাজে লোক ও বেণের দলই বারো আনা। রণক্ষেত্রের চার দিকে বেড়ার ধারে চার পাঁচ থাক গাড়ীর সার; কোন গাড়ীর ওপর একজন সৌখীন ইয়ার দু-চার দোস্ত ও দুই একটি মেয়েমানুষ নিয়ে আমোদ কচ্চেন। কোনখানির ভিতরে চিনেকোট ও চুলের চেনওয়ালা চার জন ইয়ার ও একটি মেয়েমানুষ, কোনখানিতে গুটিকত পিলইয়ার টেক্কা জাঠা ইস্কুলের বই বেচে পয়সা সংগ্রহ করে গোলাবি থিলি ও চরসের মজা লুটচে। কতকগুলি গাড়ীতে নিছক খোট্টা মাড়োয়ারী ও মেড়ুঁয়াবাদী, ককগুলি খোসপোষাকী বাবুতে পূর্ণ।
আমাদের হুজুর এই সকল দেখতে দেখতে থন্নুমলবাবুর হাত ধরে ক্রমে রণক্ষেত্রের দরজায় এসে পৌঁছিলেন—সেথায় বেজায় ভিড়। দশ-বারোজন চৌকীদার অনবরত সপাসপ করে বেত মাচ্চে; দশ জন সার্জ্জন সবলে ঠেলে রয়েছে, তথাপি রাখতে পাচ্চে না, থেকে থেকে “রাজা রামচন্দ্রজীকা জয়!” বলে খোট্টার ও রণক্ষেত্রের মধ্য হতে বানরেরা চেঁচিয়ে উঠচে। সকলেরই ইচ্ছা, রামচন্দ্রের মনোহর রূপ দেখে চরিতার্থ হবে; কিন্তু কার সাধ্য, সহজে রামচন্দ্রের সমীপস্থ হয়।
হুজুর অনেক কষ্টেসৃষ্টে বেড়ার দ্বার পার হয়ে রণক্ষেত্রে প্রবেশ করে বানরের দলে মিশলেন। রণক্ষেত্রের অন্যদিকে লঙ্কা। মনে করুন, সেথায় সাজা রাক্ষসেরা ঘুরে বেড়াচ্চে ও বেড়ার নিকটস্থ মালা গাড়ীর দিকে মুখ নেড়ে হিঁ হিঁ করে ভয় দেখাচ্ছে। সাজা বানরেরা লাফাচ্ছে ও গাছপাথরের বদলে ছেঁড়াকুঁপো ও পাকাটি নিয়ে ছোঁড়াছুড়ি কচ্চে। বাবু এই সকল অদৃষ্টচর ব্যাপার দেখে যার পর নাই পরিতুষ্ট হয়ে বেড়ার পাশে পাশে হাঁ করে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন; আরো দু-চার জন বেণে বড়মানুষ ও ব্যাদড়ী বনেদীবাবুরা ভিতরে এসে বাবুর সঙ্গে জুটে গেলেন। মধ্যে মধ্যে দালাল ও তুলোওয়ালা ইনফুলুয়েনশল রিফর্মড খোট্টার দলের সঙ্গেও বাবুর সেখানে সাক্ষাৎ হতে লাগলো। কেউ ‘রাম রাম’ কেউ ‘আদাব’ কেউ ‘বন্দীগি’ প্রভৃতি সেলীমাল্কির সঙ্গে পানের দোনা উপহার দিয়ে, বাবুর অভ্যর্থনা কত্তে লাগলো; এঁরা অনেকে দুই প্রহরের সময়ে এসেছেন, রাত্রি দশটার পর ভরপেট রামলীলে গিলে বাড়ী ফিরবেন।
রণক্ষেত্রের মধ্যে বাবু ও দু-চার সবস্স্ক্রাইবর বড়মানুষের ছেলেদের বেড়াতে দেখে, ম্যানেজার বা তার আসিষ্টেট দৌড়ে নিকটস্থ হয়ে, পানের দোনা উপহার দিয়ে রণক্ষেত্রের মধ্যস্থ দু-চার কাগজের সঙের তরজমা করে বোঝাতে লাগলেন। কত গাড়ী ও আন্দাজ কত লোক এসেছে, তার একটা মনগড়া মিমো করে দিলেন ও প্রত্যেক বানর ভালুক ও রাক্ষসের সাজগোজের প্রশংসা কত্তেও বিস্মৃত হলেন না। বাবু ও অন্যান্য সকলে “এ দফে বড়ি আচ্ছা হুয়া, আর বরস্ এসি নেহি হুয়া থা” প্রভৃতি কমপ্লিমেণ্ট দিয়ে ম্যানেজারদের আপ্যায়িত কত্তে লাগলেন। এ দিকে বাজীতে আগুন দেওয়া আরম্ভ হলো, ক্রমে চার পাঁচ রকম বাজে কেতার বাজি পুড়ে সেদিন রামলীলা বরখাস্ত হলো। রাম-লক্ষণকে আরতি করে ও ফুলের মালা দিয়ে প্রণাম করে, বাজে লোকেরা জন্ম সফল বিবেচনা করে ঘরমুখো হলো। কেরাঞ্চীর ঘোড়ারা বাতকৰ্ম্ম কত্তে কত্তে বহু কষ্টে গাড়ী নিয়ে প্রস্থান কল্লে। বাবু সেই ভিড়ের ভিতর হতে অতিকষ্টে গাড়ী চিনে নিয়ে সওয়ার হলেন–সেদিনের রামলীলা এই রকমে উপসংহার হলো।
আমাদের এ সকল বিষয়ে বড় সখ, সুতরাং আমরাও একখানি ছ্যাক্ড়াগাড়ীর পিছনে বসে, রামলীলা দেখতে যাচ্চিলাম। গাড়ীখানির ভিতরে একজন ছুতোরবাবু গুটি দুই গেরম্বারী মেয়েমানুষ ও তাঁয় চার পাঁচ জন দোস্ত ছিল; খানিক দূরে যেতে না যেতেই একটা জন্মজেঠা ফচ্কে ছোঁড়া রাস্তা থেকে “গাড়োয়ান পিছু ভারি। গাড়োয়ান পিছু ভারি।” বলে চেঁচিয়ে ওঠায় গাড়োয়ান্ “কে রে শালা।” বলে সপাৎ করে এক চাবুক ঝাড়লে। ভিতর থেকে ‘আরে কে রে, ল্যে বে যাঁ, ল্যে বে যা, চৎকার হতে লাগলো। অগত্যা সেদিন আর যাওয়া হলো না; মনের সখ মনেই রইলো।
শরতের শশধর স্বচ্ছ শ্যামগগনমাঝে নক্ষত্রসমাজে বিরাজ কচ্চেন দেখে, প্রণয়িনী বৃী মনভরে অবগুণ্ঠনবতী হয়ে রয়েছেন। চক্ৰবাদম্পতী কত প্রকার সাধ্যসাধনা কচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে, সপত্নার দুর্দশা দর্শন করে স্বচ্ছ সলিলে কুমুদিনী হাসচে। চাঁদের চির অনুগত চকোর-চকোরী শর্বরীর দুঃখে ঐধিত হয়ে তারে তুড়ে ভৎসনা কচ্চে, ঝিঁঝিপোকা উইচিংড়ারাও চীৎকার করে চকোর-চকোরীর সঙ্গে যোগ দিতেছে; লম্পটশিরোমণির ব্যবহার দেখে প্রকৃতি সতী বিস্মিত হয়ে রয়েছেন; এ সময়ে নিকটস্থ রজনীরঞ্জন বড় অপ্রস্তুত হবেন বলেই যেন পবন বড় বড় গাছতলায় ও ঝোপ-ঝাপের আশে পাশে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে চলেচেন। অভিমানিনী মানবতী রজনীর বিন্দু বিন্দু নয়নজল শিশিরচ্ছলে বনরাজী ও ফুলদামে অভিষিক্ত কচ্চে।
এদিকে বাবুর ব্রিজকা ও বিলাতী জুড়ি টপাপট শব্দে রাস্তা কাঁপয়ে ভদ্রাসনে পৌঁছিল। বাবু ড্রেসিংরুমে কাপড় ছাড়তে গেলেন, সহচরেরা বৈঠকখানায় বসে তামাক খেতে খেতে রামলীলার জাওর কাটতে লাগলেন এবং সকলে মিলে প্রাণ খুলে দু-চার অপর বড়মানুষের নিন্দাবাদ জুড়ে দিলেন। বাবুও কিছু পরে কাপড় চোপড় ছেড়ে মজলিসে বার দিলেন; গুডুম করে নটার তোপ পড়ে গেল।
বোধ হয়, মহিমার্ণব পাঠকবর্গের স্মরণ থাকূতে পারে যে, বাবু রামভদ্দর হুজুরের সঙ্গে রামলীলা দেখতে গিয়েছিলেন। বর্ত্তমানে দু চার বাজে কথার পর বাবু রামভদ্দরবাবুকে দু একটা টপ্পা গাইতে অনুরোধ কল্লেন; রামভদ্দর বাবুর গান বাজনায় বিলক্ষণ সখ, গলাখানিও বড় চমৎকার! যদিও তিনি এ বিষয়ে পেশাদার নন, তথাপি সহরের বড়মানুষমহলে ঐ গুণেই পরিচিত। বিশেষতঃ বাবু রামভদ্দরের আজকাল সময় ভাল, কোম্পানীর কাগজের দালালী ও গাঁতের মাল কেনার দরুণ দশটাকা রোজগার কোচ্ছেন; বাড়ীর নিত্যনৈমিত্তিক দোল-দুর্গোৎসবও ফাঁক যায় না। বাপ-মার শ্রাদ্ধ ও ছেলে মেয়ের বিয়ের সময়ে দশজন ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত বলা আছে। গ্রামস্থ সমস্ত ব্রাহ্মণ প্রায় বাবুর দল, কায়স্থ ও নবশাক ও অনেকগুলি বাবুর অনুগত। কৰ্ম্মকাজের ভিডের দরুণ ভদ্দরবাবুর বারোমাস প্রায় সহরেই বাস; কেবল মধ্যে মধ্যে পাল-পার্ব্বণ ও ছুটিটা আসটায় বাড়ী যাওয়া আছে। ভদ্দরবাবুর সহরের বাদুড়বাগানের বাসাতেও অনেকগুলি ভদ্দরলোকের ছেলেকে অন্ন দেওয়া আছে ও দুচার জন বড়মানুষেও ভদ্দরবাবুরে বিলক্ষণ স্নেহ করে থাকেন। রামভদ্দরবাবু সিমলের রায়বাহাদুরের সোণার কাটি রূপোর কাটি ছিলেন ও অন্যান্য অনেক বড়মানুষেই এঁরে যথেষ্ট স্নেহ করে থাকেন। সুতরাং বাবু অনুরোধ করবামাত্র ভদ্দরবাবু। তানপুরা মিলিয়ে একটি নিজরচিত গান জুড়ে দিলেন, হলধর তবলা-বাঁয়া ঠুকে নিয়ে বোলওয়াট ও ফ্যালওয়াটের সঙ্গে সঙ্গত আরম্ভ কলেন। রামলীলার নক্সা এইখানেই ফুরালো।
২.৪ রেলওয়ে
দুর্গোৎসবের ছুটীতে হাওড়া হতে এলাহাবাদ পর্য্যন্ত রেলওয়ে খুলেছে; রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাল কাল অক্ষরে ছাপানো ইংরাজী বাঙ্গালায় এস্তাহার মারা গেছে। অনেকেই আমোদ করে বেড়াতে যাচ্চেন-তীর্থযাত্রীও বিস্তর। শ্ৰীপাট নিমতলার প্রেমানন্দ দাস বাবাজীও এই অকাশে বারাণসী দর্শন কত্তে কৃতসঙ্কল্প হয়েছিলেন। প্রেমানন্দ বাবাজী শ্রীপাট জোড়াসাঁকোর প্রধান মঠের একজন কেষ্টবিষ্ণুর মধ্যে; বাবাজীর অনেক শিষ্য-সেবক ও বিষয়-আশয়ও প্রচুর ছিল; বাবাজীর শরীর স্কুল ভুঁড়িটি বড় তাকিয়ার মত প্রকাণ্ড; হাত পাগুলিও তদনুরূপ মাংসল ও মেদময়। বাবাজীর বর্ণ কষ্টিপাথরের মত, হুঁকোর খোলের মত ও ধানসিদ্ধ হাঁড়ির মত কুচকুচে কালো। মস্তক কেশহীন করে কামান, মধ্যস্থলে লম্বাচুলের চৈতন্যচুটকি সর্ব্বদা খোঁপার মত বাঁধা থাকতো; বাবাজী বহুকাল কচ্ছ দিয়ে কাপড় পরা পরিহার করেছিলেন, সুতরাং কৌপীনের উপর নানারঙ্গের বহির্বাস ব্যবহার কভেন। সর্ব্বদা সর্ব্বাঙ্গে গোপীমৃত্তিকা মাখা ছিল ও গলায় পদ্মবীচি তুলসী প্রভৃতি নানা প্রকার মালা সৰ্ব্বদা পরে থাকত্তেন। তাতে একটি লাল বাতের বড় বালিসের মত জপমালার থলি পিতলের কড়ায় আবক্ষ ঝুলতে।
বাবাজী একটি ভাল দিন স্থির করে প্রত্যুষেই দৈনন্দিন কাৰ্য্য সমাপন কল্লেন ও তাড়াতাড়ি যথাকথঞ্চি বাড়ীর বিগ্রহের প্রসাদ পেয়ে, দুই শিষ্য ও তল্পিদার ও ছড়িদার সঙ্গে লয়ে, মঠ হতে বেরিয়ে গাড়ীর সন্ধানে চিৎপুররোডে উপস্থিত হলেন। পাঠকবর্গ মনে করুন, যেন স্কুল অফিস খোলবার এখনো বিলম্ব আছে, রামলীলার মেলার এখনো উপসংহার হয়নি। সুতরাং রাস্তায় গহনার কেরাঞ্চী থাকবার সম্ভাবনা কি। বাবাজী অনেক অনুসন্ধান করে শেষে এক গাড়ীর আড্ডায় প্রবেশ করে, অনেক কষা-মাজার পর একজনকে ভাড়া যেতে সম্মত কল্লেন। এদিকে গাড়ী প্রস্তুত হতে লাগলো, বাবাজী তারি অপেক্ষায় এক বেশ্যালয়ের বারাণ্ডার নীচে দাঁড়িয়ে রইলেন।
শ্রীপাট কুমারনগরের জ্ঞানানন্দ বাবাজী প্রেমানন্দ বাবাজীর পরম বন্ধু ছিলেন। তিনিও রেলগাড়ী চড়ে বারাণসী দর্শনে ইচ্ছুক হয়ে, কিছু পূর্ব্বেই বাবাজীর শ্রীপাটে উপস্থিত হয়ে, সেবাদাসীর কাছে শুনলেন যে, বাবাজীও সেই মানসে কিছু পূর্ব্বেই বেরিয়ে গেচেন। সুতরাং এরই অনুসন্ধান কত্তে কত্তে সেইখানেই উভয়ের সাক্ষাৎ হলো। জ্ঞানানন্দ বাবাজী যার পর নাই কৃশ ছিলেন; দশবৎসরের জ্বর ও কাসী রোগ ভোগ করে শরীর শুকিয়ে কঞ্চি ও কাঠির মত পাকিয়ে গেছিল, চক্ষু দুটি কোটরে বসে গেছে, মাংস-মেদের লেশমাত্র শরীরে নাই, কেবল কখন কঙ্কালমাত্রে ঠেকেচে; তায় এক মাথা রুক্ষ তৈলহীন চুল, একখানা মোটা লুই দুপাট করে গায়ে জড়ানো, হাতে একগাছা বেঁউড় বাঁশের বাঁকা লাঠি ও পায়ে একজোড়া জগন্নাথি উড়ে জুতো। অনবরত কালচেন ও গয়ের ফেলচেন এবং মধ্যে মধ্যে শামুক হতে এক এক টিপ নস্য লওয়া হচ্ছে। অনবরত নস্য নিয়ে নাকের নলি এমনি অসাড় হয়ে গেছে যে, নাক দিয়ে অনবরত নস্য ও সর্দ্দিমিশ্রিত কফজল গড়াচ্ছে, কিন্তু তিনি তা টেরও পাচ্চেন না, এমন কি, এর দরুণ তাঁরে ক্রমে থোনা হয়ে পড়তে হয়েছিল এবং আলজিভও খারপ হয়ে যাওয়ায় সর্ব্বদাই ভেটকী মাছের মত হা করে থাকত্তেন। প্রেমানন্দ জ্ঞানানন্দের সাক্ষাৎ পেয়ে বড়ই আদিত হলেন। প্রথমে পরস্পরে কোলাকুলি হলো, শেষে কুশল-প্রশ্নদির পর দুই বন্ধুতে দুই ভেয়ের মত একত্রে বারাণসী দর্শন কত্তে যাওয়াই স্থির কল্লেন!
এদিকে কেরাঞ্চী প্রস্তুত হয়ে বাবাজীদের নিকটস্থ হলে, তল্পিদার তল্পি নিয়ে ছাদে, ছড়িদার ও সেবায়েৎ পেছোনে ও দুই শিষ্য কোচ বক্সে উঠলো। বাবাজীরা দুজনে গাড়ীর মধ্যে প্রবেশ কল্লেন। প্রেমানন্দ গাড়ীতে পদার্পণ করবামাত্র গাড়ীখানি মড় মড় করে উঠলো, সামনের দিকে জ্ঞানানন্দ বসে পড়লেন। উপরের বারাণ্ডায় কতকগুলি বেশ্যা দাঁড়িয়েছিল, তারা বাবাজীকে দেখে পরস্পর “ভাই একটা একগাড়ী গোঁসাই দেখেছিস! মিন্সে যেন কুম্ভকর্ণ!” প্রভৃতি বলাবলি করতে লাগলো। গাড়োয়ান গাড়ীতে উঠে সপাসপ করে চাবুক দিয়ে ঘোড়ায় বাস হ্যাঁচকাতে হ্যাঁচকাতে জিভে ট্যাক্ ট্যাক্ শব্দ করে চাবুক মাথার উপরে ঘোরাতে লাগলো, কিন্তু ঘোড়ার সাধ্য কি যে, এক পা নড়ে! কেবল অনবরত লাথি ছুড়তে লাগলো ও মধ্যে মধ্যে বাতকর্ম্ম করে আসোর জম্কিয়ে দিলে।
পাঠকবর্গের স্মরণ থাকতে পারে যে, আমরা পূর্ব্বেই বলে গেচি, কলিকাতা আজব শহর। ক্রমে রাস্তায় লোক জমে গেল। এই ভিড়ের মধ্যে একটা চীনের বাদামওয়ালা ছোঁড়া বলে উঠলো, ‘ওরে গাড়োয়ান। এক দিকে একটা ধূম্মলোচন ও আর এক দিকে একটা চিম্ড়ে সওয়ারি, আগে পাষাণ ভেঙ্গে নে, তবে চলবে।’ অমনি উপর থেকে বেশ্যারা বলে উঠলো, ‘ওরে এই রোগা মিন্সেটার গলায় গোটাকতক পাথর বেঁধে দে, তা হলে, পাষাণ ভাঙ্গা হবে।’ প্রেমানন্দ এই সকল কথাতে বিরক্ত হয়ে ঘৃণা ও ক্রোধে জ্বলে উঠে, খানিকক্ষণ ঘাড় গুঁজে রইলেন; শেষে ঈষৎ ঘাড় উঁচু করে জ্ঞানানন্দকে বল্লেন, ‘ভায়া! সহরের স্ত্রীলোকগুলা কি ব্যাপিকা দেখেচো’ ও শেষে ‘প্রভো! তোমার ইচ্ছা’ বলে হাই তুল্লেন! জ্ঞানানন্দও হাই তুল্লেন ও দুবার তুড়ি দিয়ে একটিপ নস্য নিয়ে বল্লেন, “ঠিক বলেঁচো দা দাঁ, ওরাঁ ভঁর্তার কাঁছে উঁপদেশ পাঁঞি নাঁঞি, ওঁঞাদের রাঁমা রঁঞ্জিকার পাঁঠ দেঁওঞা উঁচিত।”
প্রেমানন্দ রামারঞ্জিকার নাম শুনে বড়ই পুলকিত হয়ে বল্লেন, ‘ভায়া না হলে মনের কথা কে বলে? রামারঞ্জিকার মত পুঁথি ত্রিজগতে নাই। প্রভো তোমার ইচ্ছা জ্ঞানানন্দ এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে একটিপ নস্য নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে মাথাটা চুল্কে বল্লেন, দাঁ দাঁ, শুঁনেছি বিবিরাঁ নাঁকি রাঁমারঁঞ্জিকা পঁড়ছেঁ। প্রেমানন্দ অমনি আহ্লাদে “আরে ভায়া, রামারঞ্জিকা পুঁথির মত ত্রিজগতে হান পুঁথি নাঞি! প্রভো, তোমার ইচ্ছা।”
এদিকে অনেক কসলতের পর কেরাঞ্চি গুড়িগুড়ি চলতে লাগলেন; তল্পিদারেরা গাড়ীর ছাদে বসে গাঁজা টিপতে লাগলো! মধ্যে শরতের মেঘে এক পসলা ভারি বৃষ্টি আরম্ভ হলো, বাবাজীর গাড়ীর দরজা ঠেলে দিয়ে অন্ধকারে বারোইয়ারির গুদম্জাত সংগুলির মত আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলেন। খানিকক্ষণ এইরূপে নিস্তব্ধ হয়ে থেকে জ্ঞানানন্দ বাবাজী একবার গাড়ীর ফাটলে চক্ষু দিয়ে বৃষ্টি কিরূপ পড়চে তা দেখে নিয়ে একটিপ নস্য নিলেন ও বারদুই কেসে বল্লেন, “দাঁ, দাঁ, এঁকটা সংকীৰ্ত্তন হঁক শুঁধু শুঁধু বসে কাল কাঁটান হচ্ছে ঞন্না।” প্রেমানন্দ সঙ্গীতবিদ্যার বড় ভক্ত ছিলেন, নিজে ভাল গাইতে পারুন আর নাই পারুন, আড়ালে ও নিজ্জনে সৰ্ব্বদা গলাবাজী কত্তেন ও দিবারাত্র গুগুণোনির কামাই ছিল না। এ ছাড়া বাবাজী সঙ্গীতবিষয়ক একখানা বইও ছাপিয়েছেন এবং ঐ সকল গান প্রথম প্রথম দু-এক গোড়ার বাড়ী মজলিস করে গায়ক দিয়ে গাওয়ানো হয়, সুতরাং জ্ঞানানন্দের কথাতে বই প্রফুল্লিত হয়ে মল্লার ভেজে গান ধনে পাঠশালার ছেলেরা যেমন ঘোষবার সময়ে সম্বার পোড়োর সঙ্গে গোলে হরিবোল দিয়ে গণ্ডায় এ বলে সায় দিয়ে যায়, সেই প্রকার জ্ঞানানন্দ প্রেমানন্দের সঙ্গীত শুনে উৎসাহিত হয়ে মধ্যে মধ্যে দুই একটা তান মারতে লাগলেন। ভাঙ্গা ও খোন, আওয়াজের একত্র চাকারে গাড়োয়ান গাড়ী থামিয়ে ফেলে, তল্পিদার তড়াক করে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে দরজা খুলে দেখে যে, বাবাজীর প্রেমোন্মত্ত হয়ে চৎকার করে গান ধরেচেন। রাস্তার ধারে পাহারাওয়ালারা তামাক খেতে খেতে ঢুলতেছিল, গাড়ীর ভেতরের বেতরে আওয়াজে চমকে উঠে কলকে ফেলে দৌড়ে গাড়ীর কাছে উপস্থিত হলো; দোকানদারেরা দোকান থেকে গলা বাড়িয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগলো কিন্তু বাবাজীরা প্রভুপ্রেমগানে এমনি মেতে গিয়েছেন যে, তখনো তান মারা থামে নি। শেষে সহসা গাড়ী থামায় ও লোকের গোলে চৈতন্য হলো ও পাহারাওয়ালাকে দেখে কিঞ্চিং অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। সেই সময় ব্লাস্তা দিয়ে একটা নগদ মুটে ঝাঁকি। কাঁধে করে বেকার চলে যাচ্চিল, এই ব্যাপার দেখে সে থমকে দাঁড়িয়ে ‘পুঙ্গির ভাই গাড়িমদ্দি ক্যালাবতী লাগাইচেন’ বলে চলে গেল। পাহারাওয়ালাকে কল্কে পরিত্যাগ করে আসতে হয়েছিল বলে সেও বাবাজীদের বিচক্ষণ লাঞ্ছনা করে পুনরায় দোকানে গিয়ে বসলো; রেলওয়ে ব্যাগ হাতে একজন সহুরে বাবু অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত গাড়ীর অপেক্ষায় এক দোকানে বসেছিলে, বৃষ্টিতে তার রেলওয়ে টমিসে উপস্থিত হবার বিলক্ষণ ব্যাঘাত কতেছিল, এক্ষণে বাবাদের গাড়োয়ানের সঙ্গে ঐ অবকাশে ভাড়া-চুক্তি করে, হুড়মুড় করে গাড়ীর মধ্যে ঢুকে পড়লেন! এদিকে গাড়োয়ানও গাড়ী হাঁকিয়ে দিলে। তল্পিদার খানিক দৌড়ে দৌড়ে শেষে গাড়ীর পিছনে উঠে পড়লে।
আমাদের নব্যবাবুকে একজন বিখ্যাত লোক বল্লেও বলা যায়; বিশেষতঃ তিনি সহরের নিকটবর্ত্তী একটি প্রসিদ্ধ স্থলে একটি ব্রাহ্মসভা স্থাপন করে, স্বয়ং তার সম্পাদক হয়েছিলেন, এ সওয়ায় সেই গ্রামেই একটি ভারি মাইনের চাকরী ছিল। নববাবু “রিফৰ্ম্মড ক্লাসের টেক্কা ও সমাজের রঙ্গের গোলামহরূপ” ছিলেন। দিবারাত্রি “সামগ্রী” কত্তেন, ও সর্ব্বদাই ভরপূর থাকত্তেন–শনিবার ও রবিবার কিছু বেশী মাত্রায় “কারগো” নিতেন, মধ্যে মধ্যে “বানচাল হওয়ারও বাকি থাকতো না। প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের “ফরণিচর” ও “লাইব্রেরীর” বই কিনতে বাবু ছুটি নিয়ে শহরে এসেছিলেন। ক দিন খোঁড়া ব্রহ্মের সমাজেই প্রকৃতির প্রীতি ও প্রিয়কাৰ্য্য সাধন করে, বিলক্ষণ ব্রহ্মানন্দ লাভ করা হয়। মাতাল বাবু গাড়ীর মধ্যে ঢুকে প্রথমে প্রেমানন্দ বাবাজীর ভুঁড়ির উপর টলে পড়লেন, আবার ধাক্কা পেয়ে জ্ঞানানন্দের মুখের উপর পড়ে পুনরায় প্রেমানন্দের ভুঁড়িতে টলে পড়লেন। বাবাজীরা উভয়ে তটস্থ হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি কত্তে লাগলেন। মাতাল কোথায় বসবেন, তা স্থির কত্তে না পেরে মোছলমানদের গাজীমিয়ার ধ্বজার মত, একবার এ পাশ একবার ও পাশ কত্তে লাগলেন।
বাবাজীরা যাতালবাবুর সঙ্গে, এক খাঁচায় পোয়া বাজ ও পায়রার মত বসবাস করুন ছক্কড়খানি ভরপুর বোঝাইয়ে নবাবী চালে চলুক; তল্পিদারেরা অনবরত গাঁজা ফুঁকতে থাক। এ দিকে বৃষ্টি থেমে যাওয়ায়, সহর আবার পূর্ব্বানুরূপ গুলজার হয়েচে। মধ্যাবস্থ গৃহস্থের বাজার কত্তে বেরিয়েচেন; সঙ্গে চাকর ও চাকরাণীরা ধামা ও চাঙ্গায়ী নিয়ে পেচু পেচু চলেছে, চিৎপুর রোডে মেঘ কল্লে কাদা হয়, সুতরাং কাদার জন্য পথিকদের চলবার বড়ই কষ্ট কচ্চে; কেউ পয়নালার উপর দিয়ে, কেউ খানার বার দিয়ে, জুতো হাতে করে কাপড় তুলে চলেছেন। আলু পটল! ঘি চাই! গুড় ও ঘোল! ফিরিওয়ালারা চীৎকার কত্তে কতে যাচ্চে; পাছে পাছে মেচুনীরা চুপড়ি মাথায় নিয়ে, হাত নেড়ে, হন হন করে ছুটেছে, কার সঙ্গে মেছোর কাঁধে বড় বড় ভেট্কী ও মৌলবীর মত চাঁপদাড়ী ও জামাজোড়া-পরা চিংড়িভরা বাজরা ও ভার। রাজার বাজার, লালাবাবুর বাজার, পোস্তা ও কাপুড়েপটি জনতায় পরিপূর্ণ। দোকানে বিবিধ সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে, দোকানদারেরা ব্যতিব্যস্ত, খদ্দেরদের বেজায় ভিড়। শীতলঠাকুর নিয়ে ডোমের পণ্ডিত মন্দিরার সঙ্গে গান করে ভিক্ষা কচ্চে, খঞ্জনী ও একতারা নিয়ে বষ্টম ও নেড়ানেড়িরা গান কচ্চে; চার পাচজন ‘তিন দিবস আহার হয় নাই’ ‘বিদেশী ব্রাহ্মণকে কিছু দান কর দাতালোক!’ বলে ঘুরচে। অনেকের মৌতাতের সময় উত্তীর্ণ হয়েচে; অন্য কোন উপায় নাই, কিছু উপার্জনও হয় নাই, মদওয়ালাও ধার দেওয়া বন্ধ করেচে, গত কল গায়ের চাদরখানিতে চলেচে–আজ আর সম্বলমাত্র নাই। ম্যাথরেরা ময়লা ফেলে এসে মদের দোকেনে ঢুকে কসে রম টানছে, ও মুদ্দাফরাসদের সঙ্গে উভয়ের অবলম্বিত পেশার কোন্টা উত্তম, তারি তক্বার হচ্ছে। শুঁড়ি মধ্যস্থ হয়ে কখন মুদ্দাফরাশের কাজটাকে ম্যাথরের পেশা হতে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করে, মুদ্দাফরাশকে সন্তুষ্ট কচ্চেন; কখন ম্যাথরের পেশাটাকে শ্রেষ্ঠ বলে মানচেন! ঢুলি, ডোম, কাওয়া ও দুলে বেহারারা কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধের ন্যায় উভয় দলের সহায়তা কচ্চে। হয় ত এমন সময়ে একদল ঝুমুর বা গদাইনাচ আসরে উপস্থিত হবামাত্র, তর্কাগ্নিতে একবারে জল দেওয়া হলো-মদের দোকান বড়ই সরগরম। সহরের দেবতারা পর্য্যন্ত রোজগেরে। কালী ও পঞ্চানন্দ প্রসাদী পাঁঠার ভাগা দিয়ে বসেছেন; অনেক ভদ্দরলোকের বাড়ী উঠনো বরাদ্দ করা আছে; কোথাও রসুই করা মাংসেরও সরবরাহ হয়; খদ্দের দলে মাতাল, বেণে ও বেশ্যাই বারো আনা। আজকাল পাঁঠা বড় দুষ্প্রাপ্য ও অগ্নিমূল্য হওয়ায় কোথাও কোথাও পাঁঠী পর্য্যন্ত বলি হয়; কোন স্থলে পোষা বিড়াল ও কুকুর পর্য্যন্ত কেটে মাংসের ভাগায় মিশাল দেওয়া হয়! যে মুখে বাজারের বসুইকরা মাংস অক্লেশে চলে যায়, সেথায় বিড়াল কুকুর ফেলবার সামগ্রী নয়। জলচর ও খেচরের মধ্যে নৌকা ও ঘুড়ি ও চতুম্পদের মধ্যে কেবল খাট খাওয়া নাই।
পাঠকগণ! এতক্ষণ আপনাদের প্রেমানন্দ ও জ্ঞানানন্দের গাড়ী রেলওয়ে টরমিনসে পৌঁছুলে প্রায় দেখুন! আপনাদের বৈঠকখানার ঘড়ী নটা বাজিয়ে দিয়ে, পুনরায় অবিশ্রান্ত টুকটাক করে চলছে, আপনারা নিয়মাতিরিক্ত পরিশ্রম করে ক্লান্ত হন, চন্দ্র ও সূর্য্য অস্তাচলে আরাম করেন, কিন্তু সময় এক পরিমাণে চলচে, ক্ষণকালের তরে অবসর, অবকাশ বা আরামের অপেক্ষা বা প্রার্থনা করে না। কিন্তু হায়! আমরা কখন কখন এই অমূল্য সময়ের এমনই অপব্যয় করে থাকি, শেষে ভেবে দেখে তার জন্য যে কত তীব্রতর পরিতাপ সহ্য কত্তে হয়, তার ইয়ত্তা করা যায় না।
এদিকে সেই ছক্কড়ের ভিতরে সেই ব্রাহ্মবাবুর শেষে থপ করে জ্ঞানানন্দের কোলে বসে পড়লেন; ব্রাহ্মবাবুর চাপনে জ্ঞানানন্দ মৃতপ্রায় হয়ে গুড়িশুড়ি মেরে গাড়ীর পেনেলসই হয়ে রইলেন; বাবু সরে সামলে বসে খানিক একদৃষ্টে প্রেমানন্দের পানে চেয়ে ফিক করে হেসে, রেলওয়ে ব্যাগটি পায়দানে নাবিয়ে, জ্ঞানানন্দের দিকে একবার কটাক্ষ করে নিয়ে পকেট হতে প্রেসিডেন্সি মেডিকেল হল লেবেল দেওয়া একটি ফায়েল বার করে, শিশির সমুদার আরকটুকু গলায় ঢেলে দিয়ে খানিক মুখ বিকৃত করে, রুমালে মুখ মুচে, জামার জেল হতে দু ডুমে সুপুরি বন্ধ করে চিবুতে লাগলেন। প্রেমানন্দ ও জ্ঞানানন্দ ব্রহ্মবাবুর গাড়ীতে ওঠাতে বড় বিরক্ত হয়েছিলেন এবং উভয়ে আড়ষ্ট হয়ে তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ কত্তেছিলেন, কারণ বাবুর একটি কালো বনাতের পেণ্টুলেন ও চাপকান পরা ছিল। তার উপর একটা নীল মেরিনের চায়নাকোট, মাথায় একটা বিভর হেয়ারের চোঙ্গাকাঁটা ট্যাসল লাগানো ক্যাটিকৃষ্ট ক্যাপ ও গলায় লাল ও হলদে জালবোনা কম্ফর্টার, হাতে একটা কার্পেটের ব্যাগ ও একটা বিলিতী ওকের গাঁট বাহির করা কেঁদো কোঁৎকা, এতদ্ভিন্ন বাবুর সঙ্গে একটা ওয়াচ ছিল, তার নিদর্শন স্বরূপ একটি চাবি ও দুটি শিল চুলের গার্ডচেনে ঝুলচে। হাতের আঙ্গুলে একটি আংটিও পরা ছিল, জ্ঞানানন্দ ঠাউরে ঠাউরে দেখলেন যে, সেটির ওপরে ওঁ তৎ সৎ’ খোদা রয়েছে। ব্রাহ্মবাবু আরকের ঝাঁজ সামলে প্রেসিডেন্সি ডাক্তারখানার লেবেল মারা ফায়েলটা গাড়ী হতে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে দেখলেন, প্রেমানন্দ ও জ্ঞানানন্দ একদৃষ্টে তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ কচ্চেন। সুতরাং কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে একটু মুচকে হেসে জ্ঞানানন্দকে জিজ্ঞাসা কল্লেন, “প্রভু আপনার নাম?” জ্ঞানানন্দবাবুকে তার দিকে ফিরে কথা কবার উদ্যম দেখেই শঙ্কিত হয়েছিলেন, এখন প্রথম একবার একটিপ নস্য নিলেন, শামুকটা বার দুচ্চার টুকলেন, শেষে অতিকষ্টে বল্লেন, “আমার নাম পুঁচ করেচেন ঞ আমার নাম শ্রীজ্ঞানানন্দ দাস দেব, নিবাস শ্ৰীপাট কুমারনগর।” মাতালবাবু নাম শুনে পুনরায় একটু মুচকে হেসে জিজ্ঞাসা কল্লে, “দেব বাবাজীর গমন কোথায় হবে,” জ্ঞানানন্দ এ কথার কি উত্তর দিবেন তা স্থির কত্তে না পেরে প্রেমানন্দের মুখপানে চেয়ে রহিলেন। প্রেমানন্দ জ্ঞানানন্দ হতে চালাক চোস্ত ও ধড়িবাজ লোক; অনেকস্থলে পোড়খাওয়া হয়েচে, সুতরাং এই অবসরে বল্লেন, “বাবু আমরা দুই জনেই গোঁসাইগগাবিন্দ মানুষ। ইচ্ছা, বারাণসী দর্শন করে বৃন্দাবন যাব, বাবুর নাম?” মাতালবাবু পুনরায় কিঞ্চিৎ হাসলেন ও পকেট হতে দু ডুমো সুপুরি মুখে দিয়ে বল্লেন, “আমার নাম কৈলাসমোহন, বাড়ী এইখানেই, কৰ্ম্মস্থানে যাওয়া হচ্ছে।” প্রেমানন্দবাবুর নাম শুনে কিঞ্চিৎ গম্ভীর ভাব ধারণ করে বল্লেন, “ভাল ভাল, উত্তম!” ব্রহ্মবাবু পুনরায় জিজ্ঞাসা কল্লেন, “দেব বাবাজী কি আপনার ভ্রাতা?” এতে প্রেমানন্দ বল্লেন, “হাঁ বাপু, একপ্রকার ভ্রাতা বল্লেও বলা যায়; বিশেষতঃ সহধর্মী; আরো জ্ঞানানন্দ ভায়া বিখ্যাত বংশীয়—পূজ্যপাদ জয়দেব গোস্বামী ওনার পূৰ্ব্বপিতামহ।” মাতালবাবু এই কথায় ফিক করে হাসলেন ও প্রেমানন্দকে জিজ্ঞাসা কল্লেন, “উনি তো জয়দেবের বংশ, প্রভু কার বংশ? বোধ হয়, নিতাই চৈতন্যের স্ববংশীয় হবেন!” এই কথায় রহস্য বিবেচনায় প্রেমানন্দ চুপ করে গোঁ হয়ে বসে রইলেন; মনে মনে যে যার পর নাই বিরক্ত হয়েছিলেন, তা তাঁর মুখ দেখে ব্রাহ্মবাবু জানতে পেরে, অপ্রস্তুত হবার পরিবর্তে বরং মনে মনে আল্লাদিত হয়ে, বাবাজীদের যথাসাধ্য বিরক্ত কত্তে কতনিশ্চয় হয়ে, প্রেমানন্দের দিকে ফিরে বল্লেন, “প্রভু! দিব্বি সেজেচেন। সহসা আপনারে দেখে আমার মনে হচ্ছে, যেন কোথাও যাত্রা হবে, আপনারা সেজে গুঁজে চলেছেন। প্রভু একটি গান করুন দেখি, মধ্যে আপনাদের ভানের ধমকে তো একবার রাস্তায় মহামারী ব্যাপার ঘটে উঠেছিল; দেখা যাক, আবার কি হয়। শুনেচি, প্রভু সাক্ষাৎ তানস্থান।” প্রেমানন্দের সঙ্গে বাবুর এই প্রকার যত কথাবার্ত্তা হচ্ছে, জ্ঞানানন্দ ততই ভয় পাচ্চেন ও মধ্যে মধ্যে গাড়ীর পার্শ্ব দিয়ে দেখছেন, রেলওয়ে টরমিনস কত দূর; শীঘ্র পৌঁছুলে উভয়ের এই ভয়ানক বেল্লিকের হাত হতে পরিত্রাণ হয়।
এদিকে ব্রাহ্মবাবুর কথায় প্রেমানন্দ বড়ই শঙ্কিত হতে লাগলেন; ছেলেবেলা তার মাতাল, ঘোড়া ও সাহেবদের উপর বিজাতীয় স্মৃণা ও ভয় ছিল; তিনি অনেকবার মাতালের ভয়ানক অত্যাচারের গল্প শুনেছিলেন, একবার একজন মাতালবাবু তার কপালের তিলকমাটির হরিমন্দিরটি জিভ দিয়ে চেটে নিয়েছিলো। কিছু দিন হলো—আর এক প্রিয়ত্যি একটা বেতো ঘোড়ার নার্থিতে অসময়ে প্রাণত্যাগ করেন। সুতরাং তিনি অতি বিনীতভাবে বল্লেন, “বাবু! আমরা গোঁসাইগোবিন্দ লোক, সঙ্গীতের আমরা কি ধার ধারি? তবে ‘প্রেমসে কহে রাধাবিনোদ’ হরিভক্তের প্রেমের তারই প্রেমে দুটো সংকীৰ্ত্তন করে মনকে শান্তা করে থাকি।” ক্রমে ব্রাহ্মবাবু সেই ক্ষণমাত্ৰসেবিত আরকের তেজ অনুভব কত্তে লাগলেন, ঘাড়টি দুলতে লাগলো, চক্ষু দুটি পাকলো হয়ে জিভ কথঞ্চিৎ আড় হতে লাগলো; অনেকক্ষণের পর ‘ঠিক বলেচো বাপ!’ বলে গাড়ীর গদী ঠেস দিয়ে হেলে পড়লেন এবং খানিকক্ষণ এই অবস্থায় থেকে পুনরায় উঠে প্রেমানন্দের দিকে ওৎ করে ঝুঁকতে লাগলেন ও শেষে তার হাতটি ধরে বল্লেন, “বাবাজি! আমরা ইয়ার লোক, প্রাণ গড়ের মাঠের মত খোলা! শোনো একটা গাই, আমিও বিস্তর ঢপের গীত জানি; প্রভুর সেবাদাসী আছে তো?” এই কথা বলে হা! হা! হা! হেলে টলে জ্ঞানানন্দের মুখের উপর পড়ে, হাত নেড়ে চীৎকার করে, এই গান ধরলেন,–
চায় মন চিরদিন পূজিতে সেই পুতুলে।
রং-চঙ্গে চক্চকে, সাধে কি ছেলে ভুলে।।
ডাক রাং অভর চিক্মিক্ ঝিক্মিক্ করে।
তায় সোণালী রূপালী চুমকি বসান আলো করে।।
আহ্লাদে পেহ্লাদে কেলে, তামাকখেগো বুড়ো ফেলে।
কও কেমনে রহিব, খেলাঘর কিসে চলে।
চিরপরিচিত প্রণয় সহজে কি ভগ্ন হয়।
থেকে থেকে মন ধায় চোরাসিঙ্গী পাটের চুলে।।
শর্ম্মার সাহস বড়, ভুতের নামে জড়োসড়ো,
ঘরে আছেন গুণবতী গঙ্গাজলে গোবর গুলে।
সঙ্গীত শেষ হবার পূর্ব্বেই কেরাঞ্চী রেলওয়ে টরমিনসে উপস্থিত হলো! ব্রাহ্মবাবু টলতে টলতে গাড়ী থাম্বার পূর্ব্বেই প্রেমানন্দের নাকটা খামচে নিয়ে ও জ্ঞানানন্দের চুলগুলা ধরে, গাভী হতে তড়াক করে লাফিয়ে পড়লেন।
আজ আরমাণি ঘাট লোকারণ্য : গাড়ী-পাল্কীর যেরূপ ভিড়, লোকেরও সেইরূপ রল্লা। বাবাজীর সেই ভিড়ের মধ্যে অতি কষ্টে কেরাঞ্চী হতে অবতীর্ণ হলেন। তল্পিদার ছড়িদার সেবাৎ ও শিষ্যেরা পরস্পরের পদানুরূপ ‘প্রোসেসন’ বেঁধে প্রভুদ্বয়কে মধ্যে করে, শ্রেণী দিয়ে চল্লেন। জ্ঞানানন্দ ও প্রেমানন্দ হাত ধরাধরি করে হেতে দুলতে যাওয়ায় বোধ হতে লাগলো যেন, একটা অরশুলা ও কাঁচাপোকা একত্র হয়ে চলেছে।
টুনুনাং ণ্টাং টুনুনাং ণ্টাং করে রেলওয়ে ষ্টিম ফেরী ময়ূরপঙ্খীর ছাড়বার সঙ্কেত-ঘণ্টা বাজচে, থার্ডক্লাস বুকিং অফিসে লোকের ঠেল মেরেচে; রেলওয়ের চাপরাসীরা সপাসপ বেত মাচ্চে, ধাক্কা দিচ্চে ও গুঁতো লাগাচ্ছে; তথাপি নিবৃত্তি নাই। ‘মশাই শ্রীরামপুর!’ ‘বালি বালি!’ ‘বর্দ্ধমান মশাই।’ ‘আমার বর্দ্ধমানেরটা দিন না,’ ইত্যাদি রূপ শব্দ উঠচে, চারিদিকে কাঠের বেড়াঘেরা, বুকিং ক্লার্ক সন্ধিপূজার অবসরমতে ঝোপ বুঝে কোপ ফেলচেন! কারো টাকা নিয়ে চার আনার টিকিট ও দুই দোয়ানি দেওয়া হচ্ছে, বাকি চাবামাত্র ‘চোপ রও’ ও ‘নিকালো,’ কারো শ্রীরামপুরের দাম নিয়ে বালির টিকিট বেরুচ্চে, কেউ টিকিটের দাম দিয়ে দশ মিনিট চীৎকার কচ্চে, কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র নাই। কর্ত্তা কম্ফটর মাথায় জড়িয়ে ঝড়াক ঝড়াক করে কেবল টিকিটে নম্বর দেবার কল নাড়চেন, সিস দিচ্চেন ও উপরি পয়সা পকেটে ফেলছেন। পাইখানার কাটা দরজার মত ক্ষুদে জানালাটুকুতে অনেকে হুজুরের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না যে, কথা কয়ে আপনার কাজ সারবে! যদি কেহ চীৎকার করে, ক্লার্কবাবুর চিত্তাকর্ষণ কত্তে চেষ্টা করে, তবে তখনি রেলওয়ে পুলিসের পাহারাওয়াল ও জমাদারো গলা টিপে তাড়িয়ে দেবে। এদিকে সেকেণ্ডক্লাস ও গুড্স লগেজ ডিপার্টমেন্টেও এইপ্রকার গোল; সেখানে ক্লার্কবাবুরাও কতক এই প্রকার, কিন্তু এত নয়। ফাষ্টক্লাস সাহেব বিবির স্থলে সেখানে টুঁ শব্দটি নাই, ক্লার্ক রিক্তহস্তে টিকিট বেচতে আসেন ও সেইমুখেই ফিরে যান; পান তামাকের পয়সারও বিলক্ষণ অপ্রতুল থাকে। বাবাজীর নটবরবেশে থার্ডক্লাস বুকিং আফিসের নিকট যাচ্চেন, এমন সময় টনাং ণ্টাং টুনুনাং ণ্টাং শব্দে ঘণ্টা বেজে উঠলো, ফোঁস ফোঁস শব্দে ষ্টিমারের ষ্টিম ছাড়তে লাগলো। লোকেরা রল্লা বেঁধে জ্যেটি দিয়ে ইষ্টিমারে উঠতে লাগলো। “জলদি! চলো চলো!” শব্দে রেলওয়ে পুলিসের লোকেরা হাঁকতে লাগলো। বাবাজীরা অতি কষ্টে সেই ভিড়ের মধ্যে ঢুকে টিকিট চাইলেন। বুকিং ক্লার্ক বাবাজীদের চেহারা দেখে ফিক করে হেসে হাত বাড়িয়ে টাকা চেয়ে টিকিট কাটতে লাগলেন। এদিকে ঝ্যপ ঝ্যপ ঝ্যপ শব্দে ইষ্টিমারের হুইল ঘুরে ছেড়ে দিলে। এদিকে প্রেমানন্দ, “মশাই টিকিটগুলি শীঘ্ৰ দিন, শীঘ্র দিন, ইষ্টিম খুল্লো, ইষ্টিম চল্লো,” বলে চীৎকার কত্তে লাগলেন। কিন্তু কাটাকপাটের হুজুরের ভ্রূক্ষেপ নাই; সিস দিয়ে মদন আগুন জ্বচে দ্বিগুণ কল্লে কি গুণ ঐ বিদেশী গান ধরলেন। ‘মশাই শুনচেন কি? ইষ্টিম খুলে গেল, এর পর গাড়ী পাওয়া ভার হবে, এ কি অত্যাচার মশাই।’ প্রেমানন্দের মুখে বারবার এই কথা শুনে, ক্লার্ক ‘আরে থামো না ঠাকুর’ বলে, এক দাবড়ি দিয়ে অনেকক্ষণের পর কাটাদরজা হতে হাত বাড়িয়ে টিকিটগুলি দিয়ে দরজাটি বন্ধ করে পুনরায় ‘ইচ্ছা হয় যে প্রাণ সঁপে সই হইগে দাসী, মদন আগুন’ গান ধল্লেন। প্রেমানন্দ বল্লেন, ‘মশাই বাকী পয়সা দিন, বলি দরজা দিলেন যে?’ সে কথায় কে ভ্রূক্ষেপ করে? জমাদার ‘ভিড় সাফ করো, নিকালে নিকালো’ বলে ক্লার্ক সেই কাটগড়ার ভিতর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন; রেল-পুলিসের পাহারাওয়ালা ধাক্কা দিয়ে বাবাজীদের দলবলসমেত টর্মিনস হতে বার করে দিলে–প্রেমানন্দ মনে মনে বড়ই রাগত হয়ে মধ্যে মধ্যে ফিরে ফিরে বুকিং অফিসের দিকে চাইতে লাগলেন। এদিকে ক্লার্ক কাটাদরজার ফাটল দিয়ে, মদন আগুনের শেষটুকু গাইতে গাইতে, উঁকি মাত্তে লাগলেন।
বাবাজীরা কি করেন, অগত্যা টরমিনস পরিহার করে, অন্য ঘাটে নৌকার চেষ্টায় বেরুলেন–ভাগ্যক্রমে সেই সময়ে পাশের ঘাটের গহনার ইষ্টিমারখানি খোলে নাই। বাবাজীরা আপনাপন অদৃষ্টকে ধন্যবাদ দিয়া অতিকষ্টে সেই ইষ্টিমারে উঠে পেরিয়ে পড়লেন। গহনার ইষ্টিমারে অসংখ্য লোক ওঠাতে বাবাজীরা লোকের চপটানে ছাপাখানার ‘হটপ্রেসের ফরমার’ মত ও পাটকষা ইঙ্কু কলের গাঁটের মত, জাত সহ্য করে, পারে পড়ে কথঞ্চিৎ আরাম পেলেন এবং নদীতীরে অতি অল্পক্ষণ বিশ্রাম করেই, এষ্টেশনে উপস্থিত হলেন। টুনুনাং টাং টুনুনাং স্টাং শব্দে একবার ঘণ্টা বাজলো। বাবাজীরা একবার ঘণ্টা বাজার উপেক্ষা করার ক্লেশ ভুগে এসেছেন। সুতরাং এবার মুকিয়ে তল্পিতল্পা নিয়ে ট্রেণের অপেক্ষা কত্তে লাগলেন-প্রেমানন্দ ঘাড় বাঁকিয়ে ট্রেণের পথ দেখছেন, জ্ঞানানন্দ নস্য লবার জন্য শামুকটা ট্যাঁক হতে বার করবার সময়ে দেখেন যে, তাঁর টাকার গেঁজেটি নাই; অমনি ‘দাঁদাঁ সর্ব্বনাশ হঁলো। আঁমার গেঁজেটি নাই’ বলে কাঁদতে লাগলেন। প্রেমানন্দ ভায়ার চীৎকার ক্রন্দনে যার পর নাই শোকার্ত্ত হয়ে, চীৎকার করে গোল কত্তে আরম্ভ কল্লেন; কিন্তু রেলওয়ে পুলিসের পাহারাওয়ালা ও জমাদাবেরা ‘চপরাও’, ‘চপরাও’ করে উঠলো; সুতরাং পাছে পুনরায় এষ্টেশন হতে বার করে দেয়, এই ভয়ে আর বড় উচ্চবাচ্য না করে, মনের খেদ মনেই সম্বরণ কল্লেন। জ্ঞানানন্দ মধ্যে মধ্যে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে লাগলেন ও ততই নন্য নিয়ে শামুকটা খালি করে তুল্লেন।
এদিকে হস্ হস্ হস্ করে ট্রেণ টরমিন্সে উপস্থিত হলো, টুনাং ণ্টাং, টুনাং ণ্টাং করে পুনরায় ঘণ্টা বাজলো; লোকেরা বল্লা করে গাড়ী চড়তে লাগলে, থার্ডক্লাসের মধ্যে গার্ড ও দুজন বরকন্দাজের সহায়তায় লোক পোরা হতে লাগলো; ভিতর থেকে ‘আর কোথা আসচো।’ ‘সাহেব আর জায়গা নাই!’ ‘আমার বুঁচকি! ‘আমার বুচকিটা দাও’ ‘ছেলেটি দেখো’, ‘আ মলো মিন্সে! ছেলের ঘাড়ে বসেছিস যে?’ ইত্যাদিরূপ চীৎকার হতে লাগলো, কিন্তু রেলওয়ে কর্ম্মচারীরা বিধিবদ্ধ নিয়মের অনুগত বলেই তাদৃশ চীৎকারে কর্ণপাত কল্লেন না। এক একখানি থার্ডক্লাস কাকড়ার গর্ত্তের আকার ধারণ কল্লে, তথাপিও মধ্যে মধ্যে দু-একজন এষ্টেশনমাষ্টার ও গার্ড গাড়ীর কাছে এসে উঁকি মাচ্চেন—যদি নিশ্বাস ফেলবার স্থান থাকে; তা হলে আরও কতকগুলো যাত্রীকে ভরে দেওয়া হয়। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর যে সকল হতভাগ্য ইংরাজ ব্লাকহোলের যন্ত্রণা হতে জীবিত বেরিয়েছিলেন, তারা এই ইষ্ট ইণ্ডিয়ান কোম্পানীর থার্ডক্লাস দেখলে, একদিন, একদিন এদের এজেন্ট ও লোকোমোটিব সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকে সাহস করে বলতে পাত্তেন যে, “আপনাদের থার্ডক্লাস-যাত্রীদের ক্লেশ ব্লাকহোলবদ্ধ সাহেবদের যন্ত্রণা হতে বড় কম নয়!”
এদিকে প্রেমানন্দ ও জ্ঞানানন্দও দলবল নিয়ে একখানি গাড়ীতে উঠলেন, ধপাধপ গাড়ীর দরজা বন্ধ হতে লাগলো ‘হরকরা চাই মশাই! হরকরা হরকরা-ডেলিনুসার। ডেরিনুস!’ এইরূপ চীৎকার কত্তে কত্তে কাগজ হাতে নেড়েরা ঘুরছে-–“লাবেল! ভাল লাবেল!” এই বলে লাল খেরোর দোবুজান কাঁধে হকার চাচারা বই বেচ্চেন। টুনুনাং ণ্টাং, টুনুনাং ণ্টাং করে পুনরায় ঘণ্টা বাজলো, এষ্টেশনমাষ্টার খুদে সাদা নিশেন হাতে করে মাথায় কার জড়িয়ে বেরুলেন; “অলরাইট বাবু! বলে গার্ড হুজুরের নিকটস্থ হলো ‘অলরাইট গুডমর্ণিঙ স্যার’ বলে এষ্টেশনমাষ্টার নিশেনটা তুল্লেন—এঞ্জিনের দিকে গার্ড হাত তুলে, যাবার সঙ্কেত করে, পকেট হতে খুদে বাঁশীটি নিয়ে সিসের মত শব্দ কল্লে; ঘটাঘট্ ঘটাস্ ঘড় ঘড় ঘটাস্ শব্দে গাড়ী নড়ে উঠে হস্ হস্ হস্ করে বেরিয়ে গেল।
এদিকে বাবাজীরা চাটগাঁ ও চন্দননগরের আমদানী পেরু ও মোরোগের মত থার্ডক্লাসে বদ্ধ হয়ে বিজাতীয় যন্ত্রণাভোগ কত্তে কত্তে চল্লেন—জ্ঞানানন্দ বাবাজীর মুখের কাছে দু’জন পেঁড়োর আয়মাদার আবক্ষ-লম্বিত শ্বেতশ্মশ্রু সহ বিরাজ করায় রোসুনের সৌরভে জয়দেবের বংশধর যার পর নাই বিরক্ত হয়েছিলেন! মধ্যে মধ্যে আয়মাদারের চামরের মত দাড়ি বাতাসে উড়ে জ্ঞানানন্দের মুখে পড়ছে, জ্ঞানানন্দ ঘণীয় মুখ ফেরাবেন কি পেছন দিকে দুজন চীনেম্যান হাতরুমালে খানার ভাত ঝুলিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেমানন্দ গাড়ীতে প্রবেশ করেচেন বটে কিন্তু তখনো পদার্পণ কত্তে পারেন নাই। একটা ধোপর মোটের সঙ্গে ও গাড়ীর পেনেলের সঙ্গে তার ভুঁড়িটি এমনি ঠেস মেরে গেছে যে, গাড়ীতে প্রবেশ করে অবধি তিনি শূন্যেই রয়েচেন! মধ্যে মধ্যে ভুঁড়ি চড়চড় কলে এক একবার কারু কাঁধ ও কারু মাথার ওপোর হাত দিয়ে অবলম্বন কত্তে চেষ্টা কচ্চেন, কিন্তু ওৎ সাবস্ত হয়ে উঠছে না, তার পাশে পাশে এক মাগী একটি কচি ছেলে নিয়ে দাঁড়িয়েছে, বাবাজী হাত ফ্যালবার পূর্ব্বেই মাগী ‘বাবাজী কর কি, আমার ছেলেটি দেখো’ বলে চীৎকার করে উঠচে, অমনি গাড়ীর সমুদায় লোক সেইদিকে দৃষ্টিপাত করায় বাবাজী অপ্রস্তুত হয়ে হাত দুটি জড়োসড়ো করে ধোপার বুঁচকী ও আপনার ভুঁড়ির ওপর লক্ষ্য কচ্চেন —ঘৰ্ম্মে সর্ব্বাঙ্গ ভেসে যাচ্চে। গাড়ীর মধ্যে একদল ‘গঙ্গাভক্তি-তরঙ্গিণী’ যাত্রার দল ছিল, তার মধ্যে একটা ফোচকে ছোঁড়া, ‘বাবাজীর ভুঁড়িটা বুঝি ফেঁসে যায়’ বলে, পাপিয়ার ডাক ডেকে ওঠায় গাড়ীর মধ্যে একটা হাসির গর্রা পড়ে গেল। “প্রভো! তোমার ইচ্ছা” বলে, প্রেমানন্দ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। এদিকে গাড়ী ক্রমে বেগ সম্বরণ করে থামলো, বাইরে ‘বালি! বালি। বালি!’ শব্দ হতে লাগলো।
বালি একটা বিখ্যাত স্থান! টেকচাঁদের বালির বেণীবাবুও বিখ্যাত লোক —“আলালের ঘরের দুলাল” মতিলাল বালি হতেই তরিবত পান; বিশেষতঃ বালির ব্রিজটাও বেশ! বালির যাত্রীরা বালিতে নাবলেন। ধোপা ও গঙ্গাভক্তির দলটা বালিতে নাবায়, প্রেমানন্দও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। দলের ছোঁড়াগুলো নাব্বার সময় প্রেমানন্দের ভুঁড়িতে একটা করে চিমটি কেটে গেল। উত্তরপাড়া বালির লাগোয়া। আজকাল জয়কৃষ্ণের কল্যাণে উত্তরপাড়া বিলক্ষণ বিখ্যাত স্থান। বিশেষতঃ উত্তরপাড়ার মডেল জমিদারের নর্ম্ম্যাল স্কুল প্রায় স্কুলের কোর্সলেকচরের ডিগ্রী ও ডিপ্লোমা-হোল্ডার; শুনতে পাই, গুরুজীর দু-একটি ছাত্র প্রকৃত বেয়াল্লিশকর্ম্মা হয়ে বেরিয়েছেন।
ক্রমে ষ্টেশনের রেলকাটা ঘণ্টা টুং টাং টাং আওয়াজ দিলে অরোহীরা টিকিটঘরের দরজা খুঁজে না পাওয়াতে কুলি, মজুর, চাপরাসী এবং আরোহীদের জিজ্ঞাসা কচ্চেন, “মশায়! টিকিট কোথায় পাওয়া যায়?” তার মধ্যে একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ, বোধহয় কলিকাতার সিঙ্গি মহাশয়দের বাড়ীতে পূজার বার্ষিক এবং একখানি পেতলের থালা মায় চিনি সমেত পাবার প্রত্যাশায়, কলকাতায় আসছিলেন। তিনি বল্লেন, “এই ঘরে টিকিট পাওয়া যায়, তা কি তুমি জান না?” তাদের মধ্যে একটি নব্যবয়স্ক বালক ঠাকুরমার গলার একগাছি দানা এবং দাদা মহাশয়ের আমলের রূপার পুরাতন পৈঁচে, কাণের একটি পাশা ও কতকগুলি টাকা, কাপড়চোপড়, প্রভৃতি খাবার-দাবার, শিশি বোতল ইত্যাদিতে পূর্ণিত একটি ব্যাগ হস্তে দৌড়ে বাড়াচ্ছেন। প্রতুদিগের গাড়ীতে কিঞ্চিৎ স্থান দেখে অতি কুষ্ঠিতভাবে বল্লেন, “দয়াময় যদি অনুগ্রহ করে এই গাড়ীতে আমাকে একটু স্থান দেন?” বেচারীর অবস্থা ও উৎকণ্ঠিত চেহারা দেখিয়া জ্ঞানানন্দ ও প্রেমানন্দ বাবাজী বল্লেন, “বাবু, তুমি এই গাড়ীতে এস।” বালকটি অতি কুষ্ঠিতভাবে জিজ্ঞাসা কল্লেন, “মহাশয়! আপনারা কে এবং কোন বংশ?” তাতে জ্ঞানানন্দ ও প্রেমানন্দ উত্তর কল্লেন, “বাবু, আমরা বৈষ্ণব—নিত্যানন্দবংশ।” এই কথা শ্রবণমাত্র বালকটি গোস্বামী জ্ঞান করে সাষ্টাব্দ হয়ে তাদের পদধূলি নিতে উদ্যত হলেন; কিন্তু গলদেশে পৈতা দেখে বাবাজীরা নিষেধ করে বল্লেন, “হাঁ হাঁ, আমরা বৈষ্ণব, তুমি ব্রাহ্মণ দেখচি।” বালক বল্লে, “আপনারা বৈষ্ণব হউন, তাতে কোন ক্ষতি নেই, আপনাদের আচরণ দেখে আমার এতদূর পর্য্যন্ত ভক্তি জন্মেছিল যে, আপনাদের পদধূলি লই।”
প্রেমানন্দ বল্লেন, “হাঁ-হাঁ-হাঁ বাপু, স্থির হও; বাপু, তুমি কোথায় যাবে, কোন ষ্টেশনে তুমি নাব্বে?”
বালক। “আজ্ঞে আমি জামাই-ষ্টেশনে নাব্বো।”
প্রেমা। “বাপু, জামাই-ষ্টেশন কোন জেলায়?”
বালক। “প্রভু! আপনি এত বড় বিদ্যাদিগগজ, অদ্যাবধি জামাই-ষ্টেশন কাকে বলে জানেন না?”
প্রেমা। “বাপু, আমাদের রেলে গতিবিধি অতি বিরল। কালে-ভদ্রে কখন কখন নবদ্বীপ অঞ্চলে গিয়া থাকি। কুলের মহাপ্রভু পাট এবং শ্রীপাট খড়দহে শ্যামসুন্দরের পাদপদ্ম দর্শন মানসে যাওয়া আসা হয়, এই মাত্র। তবে নূতন রেলগাড়ী খোলাতে বিশ্বনাথ এবং গোবিনজী গোপীনাথের শ্রীপাদপদ্ম দর্শন করবার মনন করেছি। তা এখন কত দূর কি হয়, তা বলিতে পারি না।”
বালক রেলওয়ে হুইশিল ও গাজ মোশন কম দেখিয়া মনে মনে বিবেচনা কল্লে যে, এইবার আমার নিকটবর্ত্তী ষ্টেশনে নামিতে হইবে। পরে বাবাজীদের দিকে চেয়ে একটু মুচকি হেসে বলে, “জামাই-ষ্টেশন কাহাকে বলে এই দেখুন, যেখানে আমি নামিয়া যাইব, অর্থাৎ কোন্নগর ষ্টেশন। এই স্থানে অনেক ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থের পুত্রকন্যার বিবাহ হয় এবং সময়ে সময়ে অনেক অফিসের কর্ম্মচারী জামাইবাবুরা এই ষ্টেশনে অবতীর্ণ হন, সেই কারণে কোন্নগর ষ্টেশনকে জামাই ষ্টেশন বলা হয়।”
ক্রমে গাড়ী প্ল্যাটফরমে এসে পড়লো, চড়কগাছের মত মস্ত বাহাদুরী কাঠের উপরে ডান হাতে বাঁ হাতে তোলা দুখানি তক্তা এবং রেড, গ্রীন, হোয়াইট লাইটের প্ল্যাস দেওয়া ল্যাম্পগুলি যথাস্থানে রাখা হয়েচে। আরোহীরা নামিয়া গেল ও উঠিল। গার্ড একবার ব্রেকভ্যান থেকে নেমে এসে, ষ্টেশনমাষ্টার, বুকিং ক্লার্ক ও সিগনালারের সঙ্গে খানিক হাসি-মস্করা করে, রেলওয়ের চামড়ানির্ম্মিত লেটার ব্যাগ এবং পার্শ্বেল ইত্যাদি সমস্ত ব্রেকভানে তুলে নিয়ে বল্লেন, ‘ওয়েল হাউফার?’ কাল চাপকান পরা, মাথায় কাল টুপিতে “ই, আই, আর” লেখা, নিগুঁপো নাটাগড়ে আমদানী পাড়াগেঁয়ে বাবু ঈষৎ হাস্য করে বল্লেন, “চাপরাসি! ঠিক হয়, ঘণ্টা মারো।” ষ্টেশনমাষ্টারের অর্ডারে রেলকাটা তারে ঝোলান ঘণ্টা একটি লোহার হাতুড়ী দ্বারা আহত হয়ে টং টং টং করে আওয়াজ দিলে। ষ্টেশনমাষ্টার আপন গলার মালাগাছটি লজ্জাসহকারে আপন চাপকানের ভিতর গুঁজতে গুঁজতে অর্ডার দিলেন, ‘অলরাইট।’ সে অপ্রতিভ ভাবটি শুধু চাপানের প্রথমের বোতামটি ছিঁড়িয়া যাওয়ার জন্য ঘটেছিল, নচেৎ মালাগাছটি কেউ দেখতে পেত না। কাটা পোষাকের উপর দৃশ্যমান মালাগাছটি বাবুকে একটু লজ্জা দিচ্ছিল, তাইতে তিনি সেটি লুকোবার চেষ্টায় ছিলেন।
ক্রমে রেলগাড়ী হুস্ হুস্ করে চলতে লাগলো। জ্ঞানানন্দ এবং প্রেমানন্দ বাবাজীদের যেন দোলায় চড়া ছেলের মত নিদ্রা আকর্ষণ হলো; কখনো বা ঘোর, কখনো বা জাগ্রত। এই প্রকার অবস্থায় রেলগাড়ী বরাবর চলে গিয়ে মধ্যবর্ত্তী ছোট ষ্টেশনে অল্পক্ষণ দাঁড়াল; সুতরাং সেখানে বেশী কলরব নেই বলে বাবাজীদের নিদ্রাভঙ্গ হলো না। তারপর যখন গাড়ী বর্দ্ধমানে পৌঁছে, সেই সময় বাবাজীদের নিদ্রা ভাঙ্গে।
বর্দ্ধমান ষ্টেশন অতি প্রশস্ত এবং সেখানে বিস্তর জনতা; সেখানে অনেক লোকজনের আমদানী এবং ধানচাল প্রভৃতি মালামালে বেশী হিড়িক! সুতরাং গাড়ী সেখানে বেশীক্ষণ ধরে। ঐ গোলমালে বাবাজীদের নিদ্রাভঙ্গ হয়ে তখন চৈতন্য হলো। প্রেমানন্দ জ্ঞানানন্দকে বল্লেন, “ভায়া! এ কোথায় আসা গেল?”
জ্ঞানানন্দ চক্ষুরুন্মীলন করিয়া কহিলেন, “দাঁদাঁ, কিছুই বুঝতে পাঁচ্ছি নাঞ।”
“পান চুরুট পান চুরুট ডাব চাই! সীতাভোগ, মিহিদানা চাই, বৰ্দ্ধমেনে খাজা।”
“বর্দ্ধমান–বর্দ্ধমান–বর্দ্ধমান!!”
ইত্যাদিরূপ চীৎকার শুনে প্রেমানন্দ জিজ্ঞাসা কল্লেন, “এটা কোন ষ্টেশন বাবু।”
বিক্ৰীওয়ালা। “মশায়! এটা বর্দ্ধমানরাজ; সীতাভেগ, খাজা, জলপান কিঞ্চিৎ চাই?”
প্রেম। “বাপু, এখানে গঙ্গাজল পাওয়া যায়?”
বিকীওয়ালা। (প্রভুত্ব চেহারা দেখিয়া) “প্রভু, এ স্থানে কি গঙ্গাজল মিলে? এখানে সমস্তই পুকুরের জল ব্যবহার হয়।”
প্রেমা। “আচ্ছা তবে থাক্ বাবু।”
জ্ঞানা। “দাঁদাঁ, শুঁনেছি বঁর্দ্ধমান রাঁজটা অঁতি সুঁন্দর স্থাঁন, রাঁজার কাঁণ্ড কাঁরখানা, ঠাকুরবাঁড়ী দেঁবালয় অঁতিথিশালা প্রঁভৃতি নাঁনারঁকম পুঁণ্যাহ কাৰ্য্য আঁছেঞ এঁবং তাঁহাঁর সঁহিত রাঁজার নিঁজ আঁমোঁদেঁর জন্যে গোঁলাবঁ বাঁগ, পঁশুশালা, কাঁচের ঘর প্রভৃতি নাঁনারকঁম দ্রষ্টব্য জিনিষ আঁছেঞ, এঁবং এঁবং ঞ আরও শুঁনিয়াছি, পূঁর্ব্ব রাঁজাদিগের খোদিঁত অঁতি বিস্তৃত পুষ্করিণী আঁছেঞ। এঁই সঁমস্ত আমাদিঁগের দেঁখা নিঁতান্ত আঁবশ্যকঞ; যঁখনঞ এঁতদূর এসেছি তঁখঁন এঁ জীবনে বোঁধ হঁয় আঁরর হঁবে নাঞ।
প্রেমানন্দ বল্লেন, “ভায়া। যাহাদিগের দর্শন প্রার্থনায় এতদূর কষ্ট করে আসা গেছে, তাঁহাদিগের শ্রীপাদপদ্ম-দর্শনই মোক্ষ। যদি প্রভুর ইচ্চায় বেঁচে থাকা যায়, প্রত্যাগমনের সময়ে সমস্ত দ্রব্য দেখিয়া নয়নের সার্থকতা লাভ করে স্বদেশে যাব।”
রেলওয়ের গাড়ী টুং টাং শব্দে সেখান থেকে ছাড়লো। জ্ঞানানন্দ বাবাজী, কথঞ্চিৎ নিদ্রাভ হওয়াতে খানা আওয়াজে, বেঞ্চির উপর শুয়ে একটি গান ধল্লেন।
গান
“যঁদি গৌঁর কৃঁপা কঁর আঁমায় আঁপনার গুণে।
জঁগাই মাঁধাই উঁদ্ধারিতে স্থাঁন দিঁলে শ্ৰীচঁরণে।
যঁদি প্রঁভু কৃপা কঁরে স্থান না দাঁও রাঙ্গাচঁরণে;
এ নামে কঁলঙ্ক রঁবে তোঁমার এ তিন ভুঁবনে॥”
এরূপ গান কর্তে কর্তে জ্ঞানানন্দ শামুক থেকে একটীপ নস্য নিয়ে ‘দীন দয়াময় প্রভু তোমার ইচ্ছা’ বলে শয়ন কল্লেন। ক্রমে রেলগাড়ী মধ্যবর্ত্তী ছোট ছোট ষ্টেশনে দু’ এক মিনিট থেমে, পূৰ্ব্বকার মত দু’ একজন গরীব রকমের বিক্রীওয়ালা দুটা একটা ডাক দিয়ে চলে গেল। চাপরাশীরা বেলকাটা ঘণ্টায় আওয়াজ দিলে, আরোহী অতি কম। বোধ হয় কোন ষ্টেশনে একজনও হয় না। এইরূপে যেতে যেতে গাড়ী জামালপুরে গিয়ে পৌঁছিলো। পাঠকগণ! জানবেন, এর মধ্যে এমন কোন বিশেষ ষ্টেশন নাই যার বর্ণনা আমরা করি। বাবাজীদের নামবার অবকাশ নাই। ক্রমে গাড়ী জামালপুরে এসে পৌঁছেছে; জামালপুরে গাড়ী অন্ততঃ আধ ঘণ্টা অবস্থান করবে; কারণ জামালপুর ষ্টেশনে ইঞ্জিন, কয়লা, জল ইত্যাদি বদল কত্তে হবে। ইত্যবসরে প্রেমানন্দ ও জ্ঞানানন্দ বাবাজী গাড়ী থেকে অবতীর্ণ হয়ে, একবার ষ্টেশন এবং পাহাড় পর্ব্বত আদির দৃশ্য দর্শন কত্তে গেলেন। গাড়ী অনেকক্ষণ সেখানে থামে। বাবাজীরা ইতস্ততঃ দর্শন করিয়া, গাড়ী ছাড়িয়া যাইবে বলিয়া, তাড়াতাড়ি ষ্টেশনে প্রত্যাগমন করিলেন। আসিয়া দেখিলেন, লালপেড়ে সাড়ীপরা, হাতে একগাছি সাদা শাঁখা একহাতে রুলি একটি স্ত্রীলোক উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতেছে। “ও মা আমার কি হলো, খোকার গলায় মাদুলি কৈ, সম্পূর্ণ কোথায়? ও পিসি। একবার দেখ! মেয়েটা এই যে খোকার হাত ধরে বেড়াচ্ছিল; ও সম্পূর্ণ ও সম্পূর্ণ”—-বলে স্ত্রীলোকটি উচ্চৈস্বরে চীৎকার কত্তে লাগলো। বাবাজীরা আপন কম্পার্টমেন্টে এসে উপস্থিত হয়ে গাড়ীর কাটা দরজা গিয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগলেন। গাড়ীও পূৰ্ব্বেকার মত হস হস করে চলতে লাগলো।
বাবাজীরা যে সকল ইষ্টেশন পার হতে লাগলেন, সেই সকলেরই ইষ্টেশনমাষ্টার, সিগনেলার, বুকিংক্লার্ক ও এপ্রিন্টীসদের এক প্রকার চরিত্র, একপ্রকার মহিমা কেউ মধ্যে মধ্যে অকারণে পুলিসম্যান পুলিসম্যান করে চীৎকার করে, সহসা ভদ্দরলোকের অপমান কত্তে উদ্যত হচ্ছেন। কেউ দুটি গরীব ব্যাওয়ার জীবনসৰ্বস্ব পুটুলিটি নিয়ে টানাটানি কচ্চেন। কোথাও বাঙ্গাল গোচের যাত্রী ও কোমোরে টাকার গেঁজেওয়ালা যাত্রীর টিকিট নিজে পকেটে ফেলে পুনরায় টিকিটের জন্য পেড়াপেড়ি করা হচ্চে–পাশে পুলিসম্যান হাজির। কোন ষ্টেশনের ষ্টেশনমাষ্টার, কম্ফর্টার মাথায় জড়িয়ে চীনে কোটের পকেটে হাত পুরে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্চেন—এপ্রিণ্টীস ও কুলিদের ওপর মিছে কাজের ফরমাস করা হচ্ছে; হঠাৎ হুজুরের কম্যাণ্ডিং আসপেকট দেখে একদিন ‘ইনি কে হে?’ বলে অভ্যাগত লোকে পরস্পর হুইস্পর কত্তে পারে। বলতে কি, হুজুর তো কম লোক নন–দি এষ্টেশন মাষ্টার!
সে সকল মহাত্মারা ছেলে-বেলা কলকেতার চীনে বাজারে “কম স্যার। গুড সপ স্যার। টেক্ টেক্ টেক্ নটেক্ নটেক্ একবার তো সী!” বলে সমস্ত দিন চীৎকার করে থাকেন, যে মহাত্মারা সেলর ও সোলজারদের গাড়ী ভাড়া করে মদের দোকান, ‘এম্পটিহাউস’ সাতপুকুর ও দমদমায় নিয়ে বেড়ান ও ক্লায়েন্টের অবস্থা বুঝে বিনানুমতিতে পকেট হাতড়ান; কাঁচপোকার আরসুলা ধরবার রূপান্তরের মত তাঁদের মধ্যে অনেকেই চেহারা বদলে ‘দি এষ্টেশন মাষ্টার’ হয়ে পড়েছেন, যে সকল ভদ্দরলোক একবার রেলট্রেণে চড়েছেন, যাদের সঙ্গে একবারমাত্ত এই মহাপুরুষরা কন্ট্যাকটে এসেছেন, তাঁরাই এই ভয়ানক কর্ম্মচারীদের নামে সর্ব্বদাই “কমপ্লেন” করে থাকেন। ভদ্দরতা এঁদের নিকটে যেন ‘পুলিসম্যানের’ ভয়েই এগুতে ভয় করেন। শিষ্টাচার ও সরলতার এঁরা নামও শোনেন নাই। কেবল লাল, সাদা, গ্রীন সিগন্যাল, এষ্টেশন, টিকিট ও অত্যাচারই এদের চিরাধ্য বস্তু। ইহাঁরা স্বজাতির অপমান কতেই বিলক্ষণ অগ্রসর ও দক্ষ।
জামালপুর-টানেল পাহাড় ভেদ করে প্রস্তুত একটা রাস্তা; যেমন আমাদিগের দেশে মস্ত খিলানওয়ালা বাড়ীর নিচে দিয়ে অনেকদূর যেতে হয়, টানেল সেই প্রকার। তবে বাড়ীর লম্বা খিলেনপথে জল পড়ে না; এই টানেলের উপরিস্থিত নদ, নদী, বৃষ্টির জল এবং পাহাড়ের ঝরণা প্রভৃতির জল তাহার ভিতর চুয়াইয়া পড়ে, তাহাকেই টানেল কহে। ট্রেণ সেই টানেল অতিক্রম কবার সময়, জ্ঞানানন্দ বল্লেন, “দাঁদাঁ এ কি আশ্চর্য্যঁ দিঁনে রাতঁ। মেঁঘ নাঞি, বৃষ্টি নাঞি, এ অন্ধকারের ভিতর কোঁথায় যাঁচ্চিঞ?”
প্রেমানন্দ বল্লেন “ভাই, এটা আমি কিছু বুঝতে পাচ্ছি না; তবে শুনেছিলাম যে, তিন পাহাড়ের ভিতর দিয়ে একটা রাস্তা আছে। এটা তবে তাই বুঝি! আহা, ইংরাজ বাহাদুরদিগের কি অসীম ক্ষমতা! আমাদের পূর্ব্বেকার রামায়ণ মহাভারত ইত্যাদি গ্রন্থে কথিত আছে, পুষ্পকরথ, এবং নানাপ্রকার অদ্ভুত ব্যাপার, যেমন হনুমানের গন্ধমাদন পৰ্ব্বত আনা, সাগরবন্ধন ইত্যাদি মহা মহা ব্যাপার আছে, তাহা সত্য হইলেও হইতে পারে। কিন্তু এরূপ অদ্ভুত ব্যাপার কদাচ কোথাও শোনাও যায় নাই, দেখাও যায় নাই, ধন্য ইংরাজের বলবুদ্ধি! প্রভু, সকলই তোমার ইচ্ছা। এই বলতে বলতে প্রেমানন্দ পুনরায় নিদ্রায় অভিভূত হলেন। গাড়ী মধ্যবর্ত্তী এষ্টেশনে মাঝে মাঝে থেমে, একেবারে মোগলসরাই এষ্টেশনে এসে পৌঁছুলো। পৌঁছবামাত্রই পুলিসম্যান, টিকিটকলেক্টর, ইঞ্জিনীয়ার প্রভৃতি, ম্যাথর, সুইপার এবং যাঁহারা গাড়ীর সমস্ত তদন্ত করেন, নিকটবর্ত্তী হয়ে, আপন আপা কাৰ্য্যে নিযুক্ত হলেন। বাবাজীরা নিজের পোটলা পুঁটলী নিয়ে, অতি যত্নের সহিত (হুঁকো কলকে ইত্যাদি কোন জিনিষের ভুল না হয়) সমস্ত দ্রব্য নিয়ে প্লাটফরমে নেমে ও রেখে হাঁপ ছাড়লেন। প্রেমানন্দ বল্লেন, “হা প্রভু বিশ্বনাথ! এইবার যদি অদৃষ্টক্রমে আপনার দর্শক পাই। এখনো বলতে পারি নে, যতক্ষণ কাশীধামে পৌঁছে আপনার মস্তকে গঙ্গাজল বিল্বপত্রাদি ছড়াইয়া প্রণিপাত না কত্তে পারি, ততক্ষণ বল্তে পারিনে।”
সেখানে নৌকার মাঝী, মুটে, গঙ্গাপুত্র, পাণ্ডা, পূজারী ইত্যাদি সকলে আপন আপন খাতা সঙ্গে নিয়ে, কলিকাতাবাসী এবং অপরাপর স্থানবাসী বাবুদিগের পিতৃপিতামহাদি চৌদ্দপুরুষের নামস্বাক্ষরিত উইকাটা খাতা (কোনখানা বা সাদা কাগজ, কোনখানা বা হলদে কাগজ, কাহার বা লেখা বোঝা যায়, কাহার বা পড়া যায় না) নিয়ে, বাপ পিতামহের নামধাম জিজ্ঞাসা করে, আপনাপন যজমান সংগ্রহ কচ্চেন।
এদিকে নৌকাওয়ালারা পুটুলি নিয়ে টানাটানি কচ্চে; কাহার পুটুলি এ নৌকা হতে ওদিকে গেছে, কাহার বা অজ্ঞাতসারে কে নিয়ে গেলে টের পাওয়া গেল না। পরে ভাড়ার জন্য নৌকাওয়ালাদের সহিত গেলযোগ কত্তে কত্তে ব্যাসকাশীতে (অর্থাৎ যাকে রামনগর বলে থাকে, কাশীব্র ও-পার, হয় ত সেইখানেতেই) অবস্থিতি কত্ত হলো। অনেক আকিঞ্চন এবং টানাটানির পর একখানি ময়ূরমুখওয়ালা নৌকো পেয়ে, পরমানন্দে জ্ঞানানন্দ ও প্রেমানন্দ সমস্ত দ্রব্যাদি নিয়ে সেই নৌকায় উঠলেন।
নৌকায় আরোহণ করে গঙ্গার জল হস্তে নিয়ে, আপন আপন শিরে ছড়িয়ে, “সৰ্ব্বতীর্থময়ী গঙ্গা। সদ্যদুঃখবিনাশিনী, সুখদা মোক্ষদা গঙ্গা গজৈব পরম গতি। মাতঃ ভাগীরথি?” এই কথা বলে, কাশীর ওপারে প্রস্তরনির্ম্মিত অতি উচ্চ অট্টালিকা এবং ঘাটের সিঁড়ি সকল দর্শন করে, জ্ঞানানন্দ বাবাজী প্রেমানন্দ বাবাজীকে বল্লেন, “দাঁদাঁ! উঃ কতঁ উঁচুঁ বাঁড়ী সকঁলঞ, আরঁ কতঁ প্রশস্তঁ ঘাঁট, কঁলিকাঁতায়ঞ কিঁম্বা অঁন্যান্য দেঁশে দ্যাখাঁ গেঁছে বঁটেঞ কিন্তু এঁরূপ নয়ঞ।”
প্রেমানন্দ বল্লেন, “ভায়া! দেখ পাহাড়ের দেশ, এ স্থলে মৃত্তিকা অতি বিরল; সুতরাং পাথরের বাড়ী, পাথরের ঘাট, পাথরময় কাশী, সমস্তই পাথরের।” এই কথা বলতে বলতে দশাশ্বমেধ ঘাটে নৌকা উত্তীর্ণ হলো; বাবাজীরা নৌকা থেকে অবতীর্ণ হতে না হতে, পুৰ্ব্বেকার মত পূজারী, পাণ্ডা কুলি ও যাত্ৰাওয়ালা প্রভৃতি সকলে নৌকোর নিকটে এসে কেউ পুটুলি টানছে, কেউ বা জিজ্ঞাসা কচ্চে, “মশাই, কোথা থেকে আসা হচ্ছে, আপনি কার যজমান, কার ছেলে, নিবাস কোথায়, পরিচয় দিন, তা হলে আমরা সকলেই জাতে পারব যে, আপনি কার যজমান।”
প্রেমানন্দ বাবাজী বল্লেন, “মহাশয়! আমি অতি অল্প বয়সে পিতৃহীন, সুতরাং আমি জ্ঞাত নই যে, আমার বাপ পিতামহ কখন কাশীতে এসেছিলেন কি না। কারণ, তখন নৌকোতে আসতে হতো এবং আমার কেউ নেই যে, আমাকে বলে দিয়ে থাকবে যে, ফলনা অমুক তুমুক। অতএব আমি আর কিছুই জানি না।”
এই কথা শুনে, দলমধ্যস্থ এক জন অতি বলবান পুরুষ, “তবে এ যজমান আমার, আমি একে সুফল দান করব।” এই কথা বলে, তিনি আপন ঝুলি হতে নারিকেল, আতপ চাল ইত্যাদি বাহির করে, বাবাজীদের হাতে দিয়ে বল্লেন, ‘আপনারা সমস্ত দ্রব্য এইখানে রাখুন’; এবং তাহার সঙ্গী গুণ্ডাদিগকে বল্লেন, “দেখ, খুব খবরদার।” অন্য অন্য পাণ্ডা প্রভৃতি ও পূজারিগণ যেন অতি দীন নেড়ি কুকুরের মত তফাৎ থেকে বিদ্রুপ টিটকিরি ইত্যাদি কত্তে লাগলো; পাণ্ডাজী নিজের গায়ের পাঞ্জাবী আস্তেন জামা এবং পাগড়ীটি গঙ্গাতীরে রেখে বাবাজীদিগকে জলে দাঁড় করিয়ে, যথাযোগ্য মন্ত্রপূত কল্লেন, এবং বল্লেন, “সুফলের দক্ষিণ দিয়ে মণিকর্ণিকার জল স্পর্শ কিম্বা অবগাহন করে চল বাবা বিশ্বনাথজীর পূজা করবে, ষোড়শোপচারে হইবে, না মধ্যবিত্ত?”
বাবাজীরা বল্লেন, “আমরা অতি দীন-হীন গৃহস্থলোক, আমরা কি ষোড়শোপচারে বাবার পূজা কত্তে পারি? এর মধ্যে যেরূপ হয়, সংক্ষেপে বাবার যথাযোগ্য পুজা আপনি আমাদে করিয়ে দিবেন।”
পাণ্ডাজী বল্লেন, “চলো চলো।”
বাবাজীরা আপন আপন তল্পিতল্পা নিয়ে, পাণ্ডাজীর সুশিক্ষিত গুণ্ডাদ্বয় সমভিব্যাহারে বাবার মন্দিরে উপনীত হয়ে, ‘বাবা বিশ্বনাথ’ বলে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত কল্লেন। পাণ্ডাজীর কৃপায় ফুল, বিল্বপত্র, গঙ্গাজল ইত্যাদি সমস্ত দ্রব্যের আয়োজন করা হয়েচে। পাণ্ডাজী, বাবার পুজো করিয়ে, “বাসা কি আমাদের বাড়ীতে লওয়া হবে, না আপন ইচ্ছায় করে নেবে; আচ্ছা আমার সঙ্গে এসো।” এই কথা বলে বাবাজীদের সঙ্গে নিয়ে, একটি দোকানে এসে তিন দিবসের জন্য ঘর ভাড়া করে দিলেন।
বাবাজীরা লুচি এবং মিষ্টান্নভক্ত বেশী, সুতরাং ভাতের প্রত্যাশা রাখেন না। সমস্ত দিন ঘুরে ফিরে, কাশীর সমস্ত দেখে বেড়াতে লাগলেন। একজন যাত্রাওয়ালা বাবাজীদের নূতন চেহারা দেখে এসে বল্লেন, “আপনারা নূতন এসেছেন, বোধ হয় আজ কিম্বা কাল। আপনাদের এখনও কিছু দেখা হয় নাই, আসুন, আমি আপনাদের নিয়ে সমস্ত দেখিয়ে শুনিয়ে দিই। আপনারা কি এই বাড়ীতে থাকেন?” এই কথা বলে যাত্রাওয়ালা নিজ দলস্থ দু’ একটি সঙ্গীকে ইঙ্গিত করে দিয়ে, তাদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেল। “এই দেখুন, বাবা বিশ্বনাথের মন্দি রাজা রণজিৎ সিংহের নিৰ্ম্মিত, এই দেখুন ‘সাণ্ডায়েল’–এই অন্নপূর্ণার মন্দির।”
“এইবার চলুন দুর্গাবাড়ী দর্শন করে আসবেন। দুর্গাবাড়ী এই স্থান হতে কিঞ্চিৎ দূর, অতএব আপনারা পোঁটলা পুঁটলি যা কিছু আছে, সেই সমস্ত সমিভ্যারে নিয়ে চলুন। কারণ, এ স্থানে কার কাছে রেখে যাবেন?”
যাত্রাওয়ালার এইরূপ কথা অনুসারে বাবাজীর। আপন পুটলি এবং জীবনসর্ব্বস্ব হরিনামের ঝুলি এবং মালা যাহার ভিতর খুঁজিলে বোধ হয় একখানি মনোহারির দোকান সমেত অবস্থিতি করে; চাই কি সময়ে দুটা চারটা মিষ্টান্নও পাওয়া যায়। কারণ, যদি হরিনাম কত্তে কত্তে গলা শুকিয়ে উঠে, এক আঁধটি বদনে ফেলে দিয়ে ‘হরেকৃষ্ণ’ বলে জল পান করে থাকে।
যাত্রাওয়ালাদের সঙ্গে বাবার দুর্গাবাড়ী দর্শনে যাত্রা কল্লেন। পরে দুর্গাবাড়ী বানরের উৎপাতে এবং যাত্ৰাওয়ালাকে কৃপাতে বাবাজীদের দুর্দ্দশার কত দূর শেষ হলো, সে কথা আর আমরা অধিক লিখিতে পারলাম না।
।।সম্পূর্ণ।।