এদিকে পাঁচ ইয়ারের পরামর্শে সকল রকম জিনিসের আয়োজন হতে লাগলো-গোপাল দৌড়ে গিয়ে একখানি বজরা ভাড়া করে এলেন। নবীন আতুরী, আনিস, রমও গাজীর ভার নিলেন। ব্রজ ফুলূরী ও বেগুন ভাজার বায়না দিয়ে এলেন–গোলাবী খিলীর দোনা, মোমবাতি ও মিটে-কড়া তামাক ও আর আর জিনিসপত্র গুরুদাস স্বয়ং সংগ্রহ করে রাখলেন।
পূৰ্ব্বে স্নানযাত্রার বড় ধূম ছিল—বড় বড় বাবুরা পিলেস, কলের জাহাজ, বোট ও বজরা ভাড়া করে মাহেশ যেতেন; গঙ্গার বাচখেলা হতো। স্নানযাত্রার পর রাত্তির ধরে খেমটা ও বাইয়ের হাট লেগে যেতো! কিন্তু এখন আর সে আমোদ নাই–সে রাম নাই সে অযোধ্যাও নাই—কেবল ছুতোর, কাঁসারি, কামার ও গন্ধবেণে মশাইরা যা রেখেচেন! মধ্যে মধ্যে ঢাকা অঞ্চলের দু চার জমিদারও স্নানযাত্রার মান রেখে থাকেন; কোন কোন ছোকরাগোছের নতুন বাবুরাও স্নানযাত্রায় আমোদ করেন বটে!
ক্রমে সে দিনটি দেখতে দেখতে এল। ভোর না হতে হতেই গুরুদাসের ইয়াররা সঙ্গে গুজে তইরি হয়ে তাঁর বাড়ীতে উপস্থিত হলেন। গোপাল এক জোড়া লাল রঙ্গের এষ্টকীং (মোজা) পরে দিয়েছিলেন, পেতলের বড় বড় বোতাম দেওয়া সবুজ রঙ্গের একটি কনুই ও গুলদার ঢাকাই উড়ুনী তার গায়ে ছিল; আর একটি বিলিতী পেতলের শিল আংটিও আঙ্গুলে পরেছিলেন—কেবল তাড়াতাড়িতে জুতোজোড়াটি কিনতে পারেন নাই বলেই শুধু পায়ে আসা হয়েছে। নবীনের ফুলদার ঢাকাইখানি বহুকাল বোপর বাড়ী যায় নি, তাতেই যা একটু ময়লা বোধ হচ্ছিলো, নতুবা তার চার আঙ্গুল চাটালো কালাপপড়ে ধোপদস্ত ধুতিখানি সেই দিন মাত্র পাট ভাঙ্গা হয়েছিল-মজাইটিও বিলক্ষণ দেবো ছিল। জরু সম্প্রতি ইয়ার্ডে কৰ্ম্ম হয়েছে, বয়সও অল্প, সুতরাং আজও ভাল কাপড়-চোপড় করে উঠতে পারেন নি, কেবল গত বৎসর পূজার সময়ে তার আই, ন’সিকে নিয়ে, যে ধুতি-চাদর কিনে দেয়, তাই পরে এসেছিলেন; সেগুলি আজো কোরা থাকায় তারে দেখতে বড় মন্দ হয় নি। আরো তাঁর ধুতি চাঁদারর সেট নতুন বল্লেই হয়–বলতে কি তিনি তো বেশীদিন পরেন নি, কেবল পুজোর সময়ে সপ্তমী পূজোর দিন পরে গোকুল দাঁয়ের প্রতিমে দেখতে গিয়েছিলেন—ভাসান দেখতে যাবার সময়ে একবার পরেন অর হাটখোলার যে সেই ভারী বারোইয়ারি পূজো হয়, তাতেই একবার পরে গোপালে উড়ের যাত্রা শুনতে গেছলেন—তা ছাড়া অমনি সিকের উপোর হাঁড়ির মধ্যে তোলাই ছিল।
ইয়ারেরা আসবামাত্র গুরুদাস বিছানা থেকে উঠে দাওয়ায় বসলেন। নবীন, গোপাল ও ব্ৰজ খুঁটি ঠাসান দিয়ে উবু হয়ে বসলেন। গুরুদাসের মা চক্মকী, শোলা, টিকে ও তামাকের মেটে বাক্সটি বার করে দিলেন। নবীন চক্মকী ঠুকে টিকে ধরিয়ে তামাক সাজলেন। ব্রজ পাতকোতলা থেকে হুঁকোটি ফিরিয়ে এনে দিলেন; সকলেরই এক একবার তামাক খাওয়া হলো! গুরুদাস তামাক খেয়ে হাত-মুখ ধুতে গেলেন; এমন সময় ঝম্ ঝম্ করে এক পসলা বৃষ্টি এলো। উঠানের ব্যাংগুলো থপ থপ করে নাপাতে নাপাতে দাওয়ায় উঠতে লাগলো, নবীন, গোপাল, ব্রজ তারই তামাসা দেখতে লাগলেন। নবীন একটা সখের গাওনা জুড়ে দিলেন–
“সখের বেদিনী বলে কে ডাক্লে আমারে।”
বর্ষাকলের বৃষ্টি, মানুষের অবস্থার মত অস্থির! সৰ্ব্বদাই হচ্ছে যাচ্চে তার ঠিকানা নাই। ক্রমে বৃষ্টি থেমে গেল। গুরুদাসও মুখ-হাত ধুয়ে এসেই মারে খাবার দিতে বল্লেন। ঘরে এমন তইরি খাবার কিছুই ছিল না, কেবল পান্তাভাত আর তেঁতুল-দেওয়া মাছ ছিল, তাঁর মা তাই চারিখানি মেটে খোরায় বেড়ে দিলেন; গুরুদাস ও তাঁর ইয়ারেরা তাই বহুমান করে খেলেন।
পূৰ্ব্বে স্থির হয়েছিল রাত্তিরের জোয়ারেই যাওয়া হবে; কিন্তু স্নানযাত্রাটি যে রকম আমাদের পরব, তাতে রাত্তিরের জোয়ারে গেলে স্নানযাত্রার দিন বেলা দুপুরের পর মাহেশ পৌঁছুতে হয়, সুতরাং দিনের জোয়ারে যাওয়াই স্থির হলো।
এদিকে গির্জ্জের ঘড়িতে টুং টাং টুং টাং করে দশটা বেজে গেল। নবীন, ব্রজ, গোপাল ও গুরুদাস খেয়ে দেয়ে পানৃতামাক খেয়ে, তোবড়াতুবড়ী নিয়ে দুর্গা বলে যাত্রা করে বেরুলেন। তাঁর মা একখানি পাখা ও দুটি ধামা কিনে আনতে বল্লেন। তাঁর স্ত্রী পূর্ব্বের রাত্তিরে একটি চিত্তির করা হাঁড়ী, ঘুন্সি ও গুরিয়া পুতুল আনতে বলেছিল আর তার বিধবা পিসীর জন্য একটি খাজা কোয়াওলা কাঁটাল, কানাইবাঁশী কলা ও কুলী বেগুন আনতে প্রতিশ্রুত হয়েছিলেন।
গুরুদাসের পোষাকটিও নিতান্ত মন্দ হয় নি। তিনি একখানি সরেশ গুলদার উড়ুনী গায়ে দিয়েছিলেন, উড়ুনীখানি চল্লিশ টাকার কম নয়—কেবল কাঠের কুচো বাঁধবার দরুণ চার পাঁচ জায়গায় একটু একটু খোচা গেছল; তার গায়ে একটি বিলিতি ঢাকা প্যাটানের পিরাণ, তার ওপর বুলু রঙ্গের একটি রঙ্গের হাপ চাপকান; তিনি “বেঁচে থাকুক বিদ্দেসাগর চিরজীবী হয়ে” পেড়ে এক শান্তিপুরে ফরমেসে ধুতি পরেছিলেন। জুতো জোড়াটিতে রুপোর বক্লস্ দেওয়া ছিল।
ক্রমে গুরুদাস ও ইয়ারেরা প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ঘাটে পৌঁছিলেন। সেথায় কেদার, জগ, হরি ও নারায়ণ তাঁদের জন্য অপেক্ষা করে ছিল; তখন সকলে একত্র হয়ে বজরায় উঠলেন! মাঝীরা শুটকী মাছ, লঙ্কা ও কড়াইয়ের ডাল দিয়ে ভাত খেতে বসেছিল। জোয়ারও আসে নাই, সুতরাং কিছুক্ষণ নৌকা খুলে দেওয়া বন্ধ রইলো।
কিন্তু পাঁচো ইয়ার নৌকায় উঠেই আয়েস জুড়ে দিলেন। গোপাল সন্তর্পণে জবাবির চৌপলের শোলার ছিপিটি খুলে ফেল্লেন। ব্ৰজ এক ছিলেম গাঁজা তইরি কত্তে বসলো—আতুরী ও জবাবীরা চলতে সুরু হলো, ফুলুরি ও বেগুনভাজীরা সেকালের সতী স্ত্রীর মত আতুরীদের সহগমন কত্তে লাগলেন–মেজাজ গরম হয়ে উঠলো—এদিকে নারাণ ও কেদার বাঁয়ার সঙ্গতে—