আবদুল্লাহ কহিল, এখন উপায়?
তাই তো, কী করি!
চল ডাক্তারবাবুর কাছে যাওয়া যাক, দেখি তিনি কী বলেন।
ব্যাপার শুনিয়া ডাক্তারবাবু কহিলেন, কেসের এখনো প্রথম অবস্থা, কোনো খারাপ টার্ন নেয় নি। তবে ভবিষ্যতের জন্যে সাবধান হওয়া দরকার। কেবল ওষুধেও ফল যে না হয়। এমন কথা নয়–ওষুধ আর শুশ্রূষা। কিন্তু ইনজেকশন কয়েকটা দিতে পাল্লে অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যেত।
তাহার পর একটু ভাবিয়া তিনি আবার কহিলেন, এক কাজ কল্লে হয়। আপনারা কেউ দিতে সাহস করবেন?
আবদুল্লাহ্ কহিল, কী, ইনজেকশন?
আবদুল কাদের তাড়াতাড়ি কহিলেন, না, না, তার কাজ নেই…
ডাক্তারবাবু কহিলেন, কেন, ভয় কী? ইনজেকশন দেওয়া অতি সহজ। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
আবদুল্লাহ কহিল, আমাদের হাতে আবার কোনো বেকায়দা না হয়ে পড়ে…
না, না, কিছু হবে না। আপনি বরং আমার হাতেই দিয়ে একবার প্র্যাকটিস করে নেন!
এই বলিয়া ডাক্তারবাবু যন্ত্রপাতি বাহির করিলেন এবং সেগুলি যথারীতি পরিষ্কার করিয়া আবদুল্লাহকে কহিলেন, আসুন, আপনার হাতে একবার ছুঁড়ে দেখিয়ে দি।
আবদুল্লাহর বাহুমূলে হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জের সুচটি ফুটাইয়া দিয়া ডাক্তারবাবু প্রক্রিয়াগুলি বেশ করিয়া বুঝাইয়া দিলেন। তাহার পর সেটি বাহির করিয়া আবার পরিষ্কার করিলেন, এবং নিজের বাহুমূল বাহির করিয়া দিয়া কহিলেন, –এখন দিন দেখি আমাকে একটা ইনজেকশন।
আবদুল্লাহ্ নির্দেশমতো সাবধানে ডাক্তারবাবুর বাহুমূলে রীতিমতো টিংচার-আইওডিন মালিশ করিয়া সুচটি প্রবেশ করাইয়া দিল। তাহার পর যেই নলদণ্ডটি টিপিতে যাইবে, অমনি ডাক্তারবাবু বাধা দিয়া কহিলেন, থাক থাক, ওটা আর এখন টিপে অনর্থক খানিকটা বাতাস ঢুকিয়ে দেবেন না।
আবদুল্লাহ নিরস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ঠিক হয়েছে তো?
ডাক্তারবাবু হাসিয়া কহিলেন, হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে, ওতেই চলবে। তবে আমার হাতে হলে ব্যথাটা কম লাগত।
যাহা হউক, ডাক্তারবাবুর প্রদর্শিত প্রণালীতে যথারীতি সতর্কতা অবলম্বন করিয়া আবদুল্লাহ্ হালিমার বাহুমূলে ইনজেকশন করিয়া দিল।
ঔষধাদি রীতিমতো চলিতে লাগিল। এদিকে সৈয়দ সাহেব এবং সুফী সাহেব উভয়ে পীরসাহেবের আদেশমতো তদবির করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। হালিমার গলায় এবং বাহুতে তাবিজ বাধিয়া দেওয়া হইল, এবং দুই বেলা পীর সাহেবের দোয়া লেখা কাগজ ধুইয়া ধুইয়া খাওয়ানো হইতে লাগিল।
কিন্তু রোগীর শুশ্রূষা যেরূপ হওয়া উচিত সেরূপ হওয়া অসম্ভব হইয়া পড়িল। আবদুল্লাহর মাতা একে রুগ্ণা, বৃদ্ধা; এই রমজানের সময় তিনি আর কতই-বা খাটিতে পারেন! রান্নার কাজ প্রায় সব তাহাকেই করিতে হয়, নইলে রোগীর পথ্য পর্যন্ত প্রস্তুত হয় না। পুলটিস দেওয়া যেরূপ বৃহৎ ব্যাপার তাহাতেই দুই জন লোককে ক্রমাগত নিযুক্ত থাকিতে হয়; কিন্তু লোকাভাবে তাহা রীতিমতো দেওয়া ঘটে না; আবদুল্লাহ একটু বাহিরে গেলে ঔষধ খাওয়াইবারও সময় বহিয়া যায়। আবদুল কাদেরের কাজ অনেক, বেলা দশটা। হইতে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত তাহাকে আপিসে থাকিতে হয়। সালেহার তো জায়নামাজ আর তসবি আছেই; তাহার ওপর সন্ধ্যার পর তারাবির নামাযে খাড়া হইলে আর তাহাকে পাওয়া। যায় না; সুতরাং পরিচর্যা চলিতে পারে না। বাঁদীগুলা তো কেবল চিৎকার করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ জানেই না!
ভাবিয়া চিন্তিয়া আবদুল্লাহ আবদুল খালেকের নিকট পত্র লিখিল।
এদিকে রোগীর অবস্থার আর বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখা যাইতেছে না– কোনোদিন জ্বরের বৃদ্ধি, কোনোদিন কাশির বৃদ্ধি–কিন্তু ডাক্তারবাবু বলিতেছেন, ভয়ের এখনো কোনো কারণ নাই। তবু আর একবার ফুসফুঁসের অবস্থাটা দেখিতে পারিলে ডাক্তারবাবু নিশ্চিন্ত হইতে পারিতেন; কিন্তু তাহার উপায় নাই। তিনি কদিন আর এ বাড়িতে আসেনই নাই; আবদুল্লাহ্ গিয়া অবস্থা জানাইতেছে এবং তিনি শুনিয়া ও টেম্পারেচার-চার্ট দেখিয়া ব্যবস্থা দিতেছেন।
সেদিন শুক্রবার। সুফী সাহেব জুমার নামায পড়িবার জন্য মসজিদে যাইতে চাহিলেন। মসজিদ বলিয়া একটা কিছু বরিহাটীর সদরে নাই। তবে মুসলমান পাড়ায় নিষ্ঠাবান পিয়াদা চাপরাসীরা আকবর আলী সাহেবের নেতৃত্বে চাদা তুলিয়া একটা টিনের জুমা-ঘর প্রস্তুত করিয়া লইয়া আজ কয়েক বৎসর হইতে তাহাতেই জুমা ও ঈদের নামায পড়িয়া। আসিতেছে। সৈয়দ সাহেব পিয়াদা-চাপরাসীদের সঙ্গে নামায পড়িতে যাইবার জন্য মোটেই উৎসুক ছিলেন না; কিন্তু সুফী সাহেবের প্রস্তাবে অমত করিতেও পারিলেন না। সুতরাং তাহাকে বিরস মনেই যাইতে হইল।
জুমা-ঘরে পৌঁছিয়া তাঁহারা দেখিলেন, প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ জন লোক জমিয়াছে। কেহ কালাল-জুমা পড়িতেছে, কেহ-বা পড়া শেষ করিয়া বসিয়া আছে। সৈয়দ সাহেবকে অনেকেই চিনিত, তাহাকে দেখিয়া তাহারা তটস্থ হইয়া তাড়াতাড়ি সরিয়া গিয়া সম্মুখের কাতারে তাঁহাদিগের জন্য স্থান করিয়া দিল। তাহারা অগ্রসর হইয়া কালাল-জুমা পড়িতে আরম্ভ করিলেন। আর আর সকলে পশ্চাতে বসিল, প্রথম কাতারে কেহই বসিতে সাহস করিল না।
কিছুক্ষণ পরে আকবর আলী সাহেবের সহিত একজন পাগড়িওয়ালা মৌলবী এবং আরো কয়েকজন মুসল্লি মসজিদে প্রবেশ করিতে করিতে উপস্থিত সকলকে মৃদুস্বরে সালাম সম্ভাষণ করিল। অনেকেই ঘাড় ফিরাইয়া তাহাদিগকে দেখিল এবং যথারীতি প্রতি-সম্ভাষণ করিল। সৈয়দ সাহেবের কাবলাল-জুমা তখনো শেষ হয় নাই।