পাঁচজন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে একত্রে লোক দুর্দশাগ্রস্ত হইয়া পড়ে, এবং সেই অবস্থায়। কয়েক পুরুষ কাটাইয়া দেয়, তখন তাহাদের কেমন একটা দুর্দশার নেশা লাগিয়া যায়– কিছুতেই সে নেশা ছুটিতে চাহে না। ক্রমে মনে এবং দেহে একটা অবসাদ আসিয়া পড়ে, যাহার গতিকে সংসারের দুঃখ-কষ্ট তাহাদের ধাতে বেশ সহিয়া যায়। ইহা অপেক্ষা অধিক। সুখে সংসারে বাস করা সম্ভব যে হইতে পারে, এরূপ কল্পনা তাহাদের মনেও আসে না, কেননা খোদা না দিলে আসিবে কোথা হইতে? এরূপ অবস্থায় খোদার উপর একপ্রকার সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্ট নির্ভরের মাত্রা কিছু বেশি হইয়া পড়ে, এবং ইহকালের সচ্ছলতার বিনিময়ে। পরকালে বেহেশতের মেওয়া-জাতের ওপর একচেটিয়া অধিকার পাইবার আশায় ধর্মের বাহ্যিক আচার-নিষ্ঠার বাড়াবাড়িও দেখা গিয়া থাকে।
কিন্তু অপরের সুখস্বচ্ছন্দতার প্রতি বাহ্যত ঔদাসীন্য দেখালেও যে ব্যক্তি অক্ষমতা এবং উদ্যমবিহীনতার দরুন নিজের দুর্দশা ঘুচাইতে পারে না, তাহার আচার-নিষ্ঠার অন্তরালেও অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন লোকের প্রতি একটা ঈর্ষার অস্বচ্ছন্দতা তাহার মনের কোণে সঙ্গোপনে। বিরাজ করিতে থাকিবেই, যাহাদের ওপর ব্যক্তিগত অথবা সামাজিকভাবে কোনো প্রকার শাসন-তাড়না চালাইবার সুযোগ বা সম্ভাবনা না থাকে, তাহাদের ওপর সে ঈর্ষা প্রকাশ তো পায়-ই না বরং উহা আবশ্যকমতো নীচ তোষামোদেও পরিণত হইতে পারে; কিন্তু জ্ঞাতি কুটুম্ব প্রভৃতি যাহাদের উপর একটু আধটু ক্ষমতা চলে, তাহাদের মধ্যে যখন কেহ আত্মোন্নতি করিয়া স্বসমাজে সকলের ওপর টেক্কা মারিবার যোগাড় করিয়া তোলে, তখন সেই গুপ্ত ঈর্ষা তাহার সকল প্রচেষ্টাকে নষ্ট করিয়া দিবার জন্য বিকট মূর্তিতে সকলের মনে স্বপ্রকাশ করিয়া বসে। কাজেই যাহারা দল বাধিয়া একবার মজিয়াছে, শত চেষ্টা করিলেও তাহাদের উদ্ধার পাওয়া কঠিন। কয়েকজন লোক জলে ডুবিলে পরস্পর পরস্পরকে জলের ভিতর টানিয়া রাখিতে চেষ্টা করিয়া থাকে।
রসুলপুরের রইগণও কয়েক পুরুষ ধরিয়া দল বাধিয়া ক্রমাগত মজিয়া আসিতেছেন। ইতোমধ্যে হঠাৎ মীর মোহসেন আলি নিজের চেষ্টায় যখন অবস্থা ফিরাইয়া ফেলিলেন, তখন আর কাহারো পক্ষে তাহাকে সুনজরে দেখিবার সম্ভাবনা রহিল না। তিনি সকলের অপ্রিয় হইয়া উঠিলেন–বিশেষত, তিনি যখন সুদ খাইতে আরম্ভ করিলেন তখন সকলে তাহাকে মনে মনে ঘৃণা করিতে লাগিলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে কেহ তাহাকে অবজ্ঞা করিতে সাহস পাইতেন না, বরং মৌখিক শিষ্টাচারের একটু বাড়াবাড়িই দেখাইতেন। তাহা হইলেও, সামাজিকভাবে তাহার সহিত মেলামেশা সকলে যথাসম্ভব এড়াইয়া চলিতেন।
এদিকে মীর সাহেবের ন্যায় গৃহশূন্য নিঃসন্তানের পক্ষে তো গ্রামের ওপর অথবা বাড়ির ওপর কোনো মায়ার বন্ধন ছিল না; তাই তিনি বৎসরের অধিকাংশ সময় বিদেশে বিদেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। ইহাতে তাহার পাটের কারবারেরও সুবিধা হইত এবং বিদেশে লোকের কাছে খাতিরও পাইতেন বেশ। সুতরাং স্বগ্রাম অপেক্ষা বিদেশই তাহার পক্ষে অধিক বাঞ্ছনীয় হইয়া উঠিয়াছিল। মাসেক দু মাস বিদেশে ঘুরিবার পর তিনি বাটী আসিয়া দশ-পনের দিন থাকিতেন, আবার বাহির হইয়া পড়িতেন।
এইরূপে একবার মাস দুই বিদেশ ভ্রমণের পর বাটী আসিয়া মীর সাহেব আবদুল্লাহর একখানি পত্র পাইয়া অবগত হইলেন যে, তাহার সম্বন্ধী খোন্দকার ওলিউল্লাহ্ পরলোকগমন করিয়াছেন। পত্রখানিতে প্রায় এক মাস পূর্বের তারিখ ছিল–মীর সাহেব ভাবিতে লাগিলেন, এতদিন আবদুল্লাহৃদের কোনো খবর না লওয়াটা বড়ই অন্যায় হইয়া গিয়াছে। যদিও আবদুল্লাহর পিতামাতা সুদখোর বলিয়া মীর সাহেবের ওপর নারাজ ছিলেন এবং স্ত্রীর মৃত্যুর পর হইতে মীর সাহেবের সহিত শ্বশুরালয়ের সম্বন্ধ একরূপ উঠিয়া গিয়াছিল, তথাপি তিনি আবদুল্লাহকে অতিশয়। স্নেহ করিতেন এবং কলিকাতায় গেলে একবার তাহার সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া ফিরিতেন না। অবশ্য আবদুল্লাহর সহিত তাহার এই ঘনিষ্ঠতার বিষয় তাহার পিতামাতার নিকট হইতে গোপন রাখা হইয়াছিল; এবং যদিও এক্ষণে মীর সাহেবের গায়ে পড়িয়া খয়েরখাহী দেখাইতে যাওয়াটা আবদুল্লাহর মাতা পছন্দ নাও করিতে পারেন, তথাপি আবদুল্লাহর একটা সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত তিনি মন স্থির করিতে পারিতেছেন না। চিঠি তো সে বাড়ি হইতে প্রায় এক মাস পূর্বে লিখিয়াছে; কিন্তু এখন সে কোথায় আছে, তাহা কী করিয়া জানা যায়? এ অবস্থায় একবার পীরগঞ্জেও যাওয়া কর্তব্য কি না মীর সাহেব তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলেন।
বৈঠকখানার বারান্দায় বসিয়া তিনি মনে মনে এইরূপ আলোচনা করিতেছেন, এমন সময় দেখিতে পাইলেন, একটা লোক ভিজা কাপড়ে হাঁপাইতে হাঁপাইতে তাহারই দিকে আসিতেছে। একটু কাছে আসিলেই তিনি লোকটিকে চিনিতে পারিলেন এবং তৎক্ষণাৎ কী, কী সাদেক গাজী, খবর কী? বলিতে বলিতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। সাদেক একেবারে ছুটিয়া আসিয়া তাহার পা দুটি জড়াইয়া ধরিল, এবং রুদ্ধ নিশ্বাসে কহিতে লাগিল, দোহাই হুজুর, আমাগোরে রক্ষে করেন…
অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হইয়া মীর সাহেব তাহাকে হাত ধরিয়া উঠাইতে গেলেন, কিন্তু সে কিছুতেই তাহার পা ছাড়িয়া উঠিতে চাহিল না, কেবলই বলিতে লাগিল–আমাগোরে বাঁচান, হুজুর, আমাগোরে বাঁচান।