শেখ মুজিব কন, ব্রিটেন স্বাধীন বাংলাদেশরে য্যান স্বীকৃতি দেয়।
হিথ কন, তা তো দিতেই চাই। উপমহাদেশের তিন দেশের সাথেই আমরা সম্পর্ক রাখতে চাই। তয় ভারতীয় সৈন্য…
ভারতীয় সৈন্য আমি যেদিন বলব সেদিনই বাংলাদেশ ছাইড়া চইলা যাইব…জুনের মধ্যে যাইব, মিসেস গান্ধী কইয়া দিছেন…
কেন নয় মার্চ?
আচ্ছা। আমি কইলে তা-ও হইব…
.
শেখ সাহেব ক্ল্যারিজস হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করেন। কালো প্রিন্স কোটের বুকে লাল-সবুজ কোটপিন। হাতে পাইপ। এরিনমোর তামাকের ধোয়ার সুগন্ধ ম-ম করছে। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি মুখ খোলেন :
সাংবাদিক বন্ধুরা,
আজ মুক্তির সীমাহীন আনন্দ আমার দেশের মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে আর কোনো বাধা নেই। এক মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা এ মুক্তি অর্জন করেছি। বাংলাদেশের জনগণের এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় এ লড়াইয়ের চূড়ান্ত অর্জন। আমি যখন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের জন্য এক সেলে বন্দী, তখন এ রাষ্ট্রের জনগণ আমাকে তাদের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছে। আমি ছিলাম ফাঁসির দড়িতে প্রাণদণ্ডের অপেক্ষায়। বাংলাদেশের মানুষের মতো আর কেউ মুক্তির জন্য জীবন আর দুর্ভোগ দিয়ে এত মূল্য দেয়নি। আমার দেশের মানুষের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য আর একটি মুহূর্তের বিলম্বও আমি সইতে পারছি না।
দেশে-বিদেশে থাকা আমার বীর জনতাকে অভিনন্দন জানাই। বিশেষ করে অভিনন্দন জানাই মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি অংশকে, যারা জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে গেছে তাদের বহুলালিত স্বাধীনতার লক্ষ্যে। আর আজ আমি শোক জানাচ্ছি মুক্তির সংগ্রামে প্রাণ হারানো লাখো শহীদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি। সর্বশক্তিমানের কাছে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি।
আমি তিনটি জিনিসে বিশ্বাস করি–গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজতান্ত্রিক ধাচের অর্থনীতি।
ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহারের জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে বলবেন কি না? এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন, আশা করি আমি বলব। আমি এখন পর্যন্ত যতটা বুঝতে পারছি; আর মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর আচরণ যতটা বুঝতে পারছি, নিশ্চিতভাবে তিনি বাংলা থেকে তার সেনা প্রত্যাহার করবেন।
১২৬
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রয়্যাল এয়ারফোর্সের কমেট বিমানের ভেতরটা রাজকীয়। সামনে টেবিল পেতে আরাম করে বসে অফিসের কাজও করা যায়। শেখ মুজিব সেই টেবিলটাকে ব্যবহার করছেন তাঁর পাইপ রাখার জন্য। এরিনমোর তামাকের গন্ধে বিমানের এই জায়গাটা ভোর হয়ে আছে।
প্লেনের সিটে ড. কামাল হোসেনের পাশে বসে হামিদা হোসেন বললেন, শেখ সাহেবের কি কোনো ক্লান্তি নাই? আমার তো ঘুমে হাত-পা ভেঙে আসছে।
ক্লান্তিতে শরীরের রণে ভঙ্গ দেওয়ারই কথা। শেখ মুজিব আর কামাল হোসেন সপরিবার পিন্ডিতে পিআইয়ের বিমানে ওঠেন ৭ জানুয়ারি রাতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানে ওড়া। লন্ডনে অনিশ্চিত অবতরণ। তারপর একটার পর একটা কর্মসূচি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা, একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আসছেন, বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। এমনিতেই মুজিব ভাইয়ের ওজন অনেক কমেছে, তাঁকে কাহিল দেখা যাচ্ছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সেলে নির্জন দিবস-রজনী কাটিয়েছেন তিনি। প্রচণ্ড গরম, তীব্র শীতে কষ্ট পেয়েছেন। ঠিকভাবে খাবার পাননি। তারপরও কী উদ্যম তার!
৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় হিথরো ছাড়ল বিমানটি।
ড. কামাল বললেন, ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন ভারত থেকে বিশেষ বিমান পাঠাবেন। এয়ার ইন্ডিয়ার ভিআইপি উড়োজাহাজ। মুজিব ভাই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে না করে দিয়েছেন।
হামিদা বললেন, কেন?
কামাল বললেন, তিনি পৃথিবীবাসীকে একটা বার্তা দিতে চান। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। কোনো একটা দেশের ওপরে তিনি অতিরিক্ত নির্ভর করে নাই।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, ইন্দিরা গান্ধী যখন শুনলেন, শেখ মুজিব ব্রিটিশ বিমানে ফ্লাই করতে চান, প্রথমে একটু মন খারাপ করছিলেন। কিন্তু শক্ত মহিলা। মনের কথা প্রকাশ করেন না। তিনি বললেন, ঠিকই আছে। এয়ার ইন্ডিয়ার উড়োজাহাজ সিকিউরিটি সমস্যায় পড়তে পারে। ব্রিটিশ বিমানই নিরাপদ হইব।
.
ব্রিটিশ ফরেন সার্ভিসের কর্তা সাদারল্যান্ডকে মুজিব বলে দিয়েছিলেন, এমনভাবে ফ্লাইটের টাইম শিডিউল করুন, যাতে দিল্লিতে সকাল সকাল পৌঁছানো যায়। ওখানে কিছুক্ষণের যাত্রাবিরতি শেষে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা, যাতে দিন থাকতে থাকতে ঢাকায় নামা যায়। শীতকাল। দিন ছোট।
সেভাবেই শিডিউল করা হয়েছে। ৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় দিল্লির উদ্দেশে লন্ডন ত্যাগ। ১০ জানুয়ারি সকালে দিল্লি অবতরণ। দুপুরের মধ্যে ঢাকা।
শেখ মুজিব এখন কথা বলছেন শশাঙ্ক এস ব্যানার্জির সঙ্গে। শেখ মুজিব তাঁকে গতকাল যখন প্রথম দেখেন, তখনই চিনতে পারেন। সেই ষাটের দশকে শেখ মুজিব আর মানিক মিয়া দেখা করেছিলেন ভারতীয় উপহাইকমিশনের কর্মকর্তা শশাঙ্ক ব্যানার্জির সঙ্গে-বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে ভারত কীভাবে সাহায্য করতে পারে, তা আলোচনা করতে।
লন্ডন থেকে শেখ মুজিবের সহযাত্রী হতে ভারতীয় হাইকমিশন থেকে দুজনকে দেওয়া হয়েছে–হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি ভেদ মারওয়া আর শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি।