- বইয়ের নামঃ বিপুলা পৃথিবী
- লেখকের নামঃ আনিসুজ্জামান
- প্রকাশনাঃ দৈনিক প্রথম আলো
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
বিপুলা পৃথিবী
নিবেদন
শেষের বারো পৃষ্ঠা ছাড়া এই লেখাটি ২৩ এপ্রিল ২০০৪ থেকে ৭ নভেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে প্রতি পক্ষে প্রায় নিয়মিত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। বই প্রকাশের সময়ে শেষাংশে কিছু ঘটনার কথা যোগ করে দিয়েছি। লেখাটি প্রথম প্রকাশের দিনে ভূমিকাস্বরূপ ‘পূর্বভাষ’ নামে যা বলা হয়েছিল, তা এরকম:
প্রথমে ভোরের কাগজে কয়েকমাস, তারপর প্রথম আলোয় কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে স্মৃতিকথা লিখেছিলাম কাল নিরবধিনামে। সংশোধিত হয়ে তা গ্রন্থাকারে বেরিয়ে গেছে গত বছর (২০০৩) বইমেলায়। ওটার শুরু হয়েছিল আমার পূর্বপুরুষের কথা দিয়ে, শেষ হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের ঘটনায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্মৃতিকথা লিখেছিলাম ভোরের কাগজে, ধারাবাহিকভাবে, ১৯৯৬ সালে। পরের বছর আমার একাত্তর বই হয়ে বেরিয়ে যায়। এখন প্রবৃত্ত হয়েছি ১৯৭২ থেকে পরবর্তী সময়ের যে-স্মৃতি আমার আছে, তার আলেখ্য রচনা করতে। বন্ধুবান্ধবেরা আমার কাছে দাবি করেছেন তেমন একটি লেখা, নিজের ইচ্ছাও কিছু কম নয়। কেউ কেউ অবশ্য সাবধান করে দিয়েছেন এই বলে যে, যত কাছাকাছি সময়ের কথা বলতে যাবো, তা নিয়ে তর্ক তত প্রবল হবে। এই সাবধানবাণীর সত্যতা আমিও মানি। বিতর্ক এড়াবার একমাত্র উপায় কিছু না-লেখা। না-লিখতে মনটা সায় দিলো না। নিজের সম্পর্কে জানানোটা জরুরি নয়, কিন্তু যা দেখেছি, যা শুনেছি, তার অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ।
আমার ডায়েরি লেখার অভ্যাস নেই, তাই স্মৃতিই আমার প্রধান পুঁজি। ভুল এড়াবার জন্যে বইপত্র দেখার চেষ্টা করবো, তারপরও যে ভুল হবে না, সেকথা বলতে পারিনে। পাঠক শুধরে দিলে ধন্যবাদ জানাবো। একই কারণে বর্ণিত ঘটনার কালক্রমের কিছু হেরফেরও হবে বলে আশঙ্কা করি। তার জন্যে পাঠকের কাছে আগাম ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।
এ-লেখা শুরু করতে যাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধকালীন শরণার্থী-জীবনের অন্তে স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন থেকে। আমার একাত্তরের শেষ কয়েক পৃষ্ঠায় তার বিবরণ আছে। ধারাবাহিকতার খাতিরে এখানে তার সারসংক্ষেপ হাজির করবো মাত্র। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির পরের ঘটনা এখানেই বিবৃত হবে। হয়তো অন্য প্রসঙ্গে কিছু কিছু কথা এর আগে কখনো কোথাও ব্যক্ত করেছি। এই সামান্য পুনরুক্তির জন্যে পাঠকদের প্রশ্রয় ভিক্ষা করি।
.
আমার ইচ্ছে ছিল, বিপুলা পৃথিবী শেষ করি ২০০৭এ এসে। বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করেও যখন দেখা গেল, পরিত্যক্ত সূত্র আর কুড়িয়ে নেওয়া যাচ্ছে না, তখন ঘটনাকালের সমাপ্তি ২০০০এই টানলাম। তার জন্যে যোগ করতে হলো কয়েকটি পৃষ্ঠামাত্র।
পত্রিকায় রচনাটির প্রকাশকালে সেখানে চিঠি লিখে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে টেলিফোন করে আমার ভ্রান্তি অপনোদন অথবা আমার লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করার জন্যে আমি আবদুল মান্নান, আবু তাহের খান, আবুল হোসেন, এম সাইদুজ্জামান, গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া, গোলাম মুস্তাফা, নুরুল হক, ফজিলতুননেসা, মংসিংঞো, শামসুল হোসাইন, শাহেদা জাফর ও সৈয়দ আবুল মকসুদকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। মতিউর রহমান ও সাজ্জাদ শরিফের তাগাদায় গ্রন্থটি প্রকাশ পেতে যাচ্ছে। জাফর আহমদ রাশেদের সশ্রম সহযোগিতা ছাড়া বইটি বর্তমান রূপ পেতে পারতো না। এদের সকলকেই আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। ছবিগুলো নেওয়া হয়েছে নানা সূত্র থেকে, সেসব ক্ষেত্রে আমার ঋণ রয়ে গেল। নির্ঘন্ট তৈরি করেছেন আখতার হুসেন, তাঁকে ধন্যবাদ। প্রথমা প্রকাশনের কর্মী মো. ফারুক আহমেদ, মাসুম আহমেদ, এরফান উদ্দিন আহমদ, শতাব্দী কাদের, মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম ও হুমায়ূন কবীরের আন্তরিক সহযোগিতা অবিস্মরণীয়।
আনিসুজ্জামান
বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ফেব্রুয়ারি ২০১৫
নতুন যুগের ভোরে
১.
দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল–দিনকুড়ি আগরতলায় থেকে ডেরা বেঁধেছিলাম কলকাতায়। বাংলাদেশের মুক্তির ক্ষণ থেকেই দেশে ফিরতে মন চাইছে। পথঘাট এবং পরিস্থিতির বিবেচনায় দেরি করছি দু চারদিন। ২০ তারিখে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করে পরিকল্পনা-কমিশনের সদস্যপদ ত্যাগ করে লেখা আমার চিঠিটা তার হাতে সমর্পণ করলাম। তাতে লিখেছিলাম, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পূর্বপদে ফিরে যেতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য ঢাকায় ফিরে গেলেন ২২ ডিসেম্বরে। কয়েকদিন পর প্রধানমন্ত্রীর পুরোনো দপ্তরের সূত্রে খবর পেলাম, তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন ঢাকায়। ভারতীয় এক কর্মকর্তা ফোনে। জানালেন, পরদিন ঢাকাগামী বিমানে একটা আসন রাখা হয়েছে আমার জন্যে। কলকাতায় পরিবার ফেলে এতদিন পরে একলা দেশে ফিরতে ইচ্ছে হলো না। তাছাড়া ভয়ও ছিল মনে, একা ঢাকায় একবার এসে পড়লে কলকাতায় ফিরে পরিবার নিয়ে আসা অনিশ্চিত হয়ে যাবে; প্রশাসনে একবার জড়িয়ে গেলে তার জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসা কঠিন হবে। তাই মাফ চেয়ে নিলাম।
তার আগে ২৩ ডিসেম্বরে যশোরে গিয়েছিলাম। আমার গাড়িতে অনিল সরকার ও অনিরুদ্ধ রায়, আমার শ্যালক আজিজের গাড়িতে আবদুল আউয়াল ওরফে সুবা ভাই ও অনিরুদ্ধের ভাই চন্দন। সীমান্ত পেরোবার সময়ে কী যে রোমাঞ্চ আমাদের–স্বাধীন বাংলাদেশে পৌঁছে গেলাম! যশোর সার্কিট হাউজে সহজে জায়গা পাওয়া গেল, খাওয়াদাওয়ারও সুব্যবস্থা হলো। আমাদের অতিথিরা খুশি।
যশোরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গেলাম। যতদূর মনে পড়ে, তার দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা (পরে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে নিহত হন)। আমার। পরিচয় দেওয়ায় চিনলেন। আমি যেতে চেয়েছিলাম খুলনায়। তিনি সন্ধ্যার পর দূরপাল্লায় যাত্রা নিষেধ করলেন–কোথায় কখন কী ঘটে, বলা যায় না। তারপর বললেন, তিনি অপেক্ষা করছেন মেজর জলিলকে গ্রেপ্তার করার জন্যে–এই পথেই তার আসার কথা।
চমকে উঠলাম। মাত্র সাতদিন হয় যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি। এরই মধ্যে একজন সেক্টর কমান্ডারকে বন্দি করতে বলা হয়েছে তার অধস্তন সামরিক কর্মকর্তাকে! ক্যাপ্টেন হুদা জানালেন, মেজর জলিল প্রধান সেনাপতির আদেশ অমান্য করায় ১০/১১ তারিখেই এই আদেশ দেওয়া হয়েছে।
রাতটা মন খারাপ করেই কাটলো। পরদিন সকালে একাই খুলনা গিয়ে মেজোবুদের সকলের সঙ্গে দেখা করে এলাম। যুদ্ধের ক মাসের মধ্যে বড়ো ভাগ্নিটির বিয়ে হয়ে গেছে–তার বাড়িও ঘুরে এলাম।
খুলনায় নতুন জেলা প্রশাসক কামাল সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা হলে দুটি অভিযোগ শুনতে পেলাম। একটি মেজর জলিল ও তার মুষ্টিমেয় সহযোদ্ধার বিরুদ্ধে অবাঙালিদের সম্পত্তি লুঠপাট ও অবাঙালি মেয়েদের প্রতি অত্যাচারের, অপরটি ভারতীয় সেনাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সম্পদ-অপহরণের। জানলাম, বিষয় দুটি সম্পর্কে তিনি সরাসরি অবহিত করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এড়িয়ে একজন ডিসির পক্ষে দেশের ও বিদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এরকম চিঠি লেখা শৃঙ্খলাভঙ্গের শামিল বিবেচিত হয়েছিল এবং পরে এ-নিয়ে অনেক গোলযোগ হয়েছিল।
আমার কিন্তু হতবাক ও হতোদ্যম হওয়ার পালা! এসব আবার কী আরম্ভ হলো! খুলনা থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম যশোরে, তারপর সবাইকে নিয়ে একটু রাত করেই পৌঁছোলাম কলকাতায়।
ফেরার প্রস্তুতি নিতে আরো কটি দিন কেটে গেল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপকুমার চক্রবর্তী স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বললেন, দেশে ফিরে যাচ্ছেন–হাতে কিছু টাকাপয়সা রাখা দরকার। সমিতি যে-সামান্য টাকা দিতে পারে, আপনাকে তা নিতে বলতে পারি না। ভাই, এই হাজার পাঁচেক টাকা ঋণ হিসেবে নিন, পরে একসময়ে পাঠিয়ে দেবেন।’ এই বলে হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন।
এ-রকম পরিস্থিতিতে অভিভূত না হয়ে পারে, এমন কে আছে! টাকাটা সমিতিরই ছিল, কিন্তু তিনি ধার দিয়েছিলেন নিজের দায়িত্বে। বোধহয় জুন মাসের দিকে, দিলীপদা ঢাকায় এলে, এই ঋণ পরিশোধ করেছিলাম।
৫ জানুয়ারি সকালে আজিজ ও আমি যার যার গাড়িতে পরিবার নিয়ে কলকাতা থেকে রওনা হলাম খুলনায়।
সীমান্ত পেরিয়েই একবার থামলাম। গাড়ি থেকে নেমে বেবী ও আমি দেশের ধুলোমাটি নিলাম দুহাত ভরে।
যে-পথে যাচ্ছি, তার দুপাশের বাড়িঘরে গোলাগুলির চিহ্ন; ভাঙা পুল; বিকল্প পথ; পাকিস্তানিদের তৈরি বাঙ্কার; ভারতীয় বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছোটোখাটো ছাউনি। লোকজন কিছু কিছু ফিরছে তখনো; বিধ্বস্ত ঘরের পাশে তুলছে নতুন আশ্রয়; দোকানপাট সাজাচ্ছে নতুন করে। ফুলতলার কাছে পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত একটি ট্যাংক পড়ে আছে। সেদিকে কেউ কেউ কৌতূহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে মাত্র।
খুলনায় বোনের বাড়িতে দুদিন কাটিয়ে ৮ তারিখে আবার দুই গাড়ির বহর ঢাকার পথে। এবারে মেজো দুলাভাই আছেন আমার গাড়িতে। ঢাকার পথ অনেক বেশি দুর্গম মনে হলো। ভাঙা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচ দিয়ে ফেরিতে নদী পার হলাম। কোথাও নৌকা জুড়ে পন্টুনের মতো করা হয়েছে, তার ওপর দিয়ে গাড়ি পার করার ব্যবস্থা। কোথাও ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে মজুররা কাজ করছে তখনো, ইট জোগাচ্ছে গাড়ির চাকার নিচে। জায়গায়-জায়গায় অনেকক্ষণ দেরি হচ্ছে–বেশ ভিড় জমে যাচ্ছে। যেসব জায়গায় এমন ভিড়, সেখানে দোকানও খুলে বসেছে কেউ কেউ। দোকানে রেডিও বেজে চলেছে সর্বক্ষণ।
তখনো সন্ধ্যা হয়নি। এইরকম অপেক্ষায় আছি অনেকে। হঠাৎ জনতার মধ্যে চাঞ্চল্য, উল্লাস, ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি।
কী হয়েছে? বেতারের সংবাদ : বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে তিনি রওনা হয়েছেন অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। সেই মুহূর্তে কী যে আনন্দ আমাদের! সকলে সকলকে জড়িয়ে ধরছেন, কেউ জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, কেউ কেঁদে ফেলছেন। অনতিবিলম্বে সেই অনির্দিষ্ট গন্তব্যেরও খোঁজ পাওয়া গেল : লন্ডন।
৮ জানুয়ারি যখন ঢাকায় এসে পৌঁছোলাম, তখন রাত অনেক হয়েছে। প্রথমে গেলাম স্বামীবাগেশ্বশুরবাড়িতে। আমার শ্বশুর আবদুল ওয়াহাবকে দেখলাম, কেমন যেন বদলে গেছেন এই ক মাসে। আশ্চর্য নয় যে, ১৯৭১-এর দিনগুলো সম্পর্কে যে-বই তিনি লিখেছিলেন, তার নাম দিয়েছিলেন ওয়ান ম্যান’স অ্যাগনি (ঢাকা, ১৯৭২) : এটি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর শহীদ অনুজ আবদুল আহাদকে। ভাইয়ের সম্পর্কে যতটাসম্ভব খোঁজখবর করছেন তিনি তখনো। জানেন, তিনি নেই, তবু আশা ছাড়তে পারেন না।
আজিজরা রয়ে গেল স্বামীবাগে। সেখানেই খবর পেলাম, আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু ও সহকর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক, গিয়াসউদ্দিন আহমদের শার্ট দেখে তার লাশের খানিকটা শনাক্ত করা গেছে এবং পরদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-প্রাঙ্গণে তা সমাধিস্থ হবে।
স্বামীবাগ থেকে এলাম ঠাটারিবাজারে–পিতৃগৃহে। দেখি, একতলা লোকে লোকারণ্য। পাড়ার বেশ কয়েকটি এবং পাড়ার বাইরের একটি অবাঙালি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে আমাদের বাড়িতে। আমরা ফিরে এসেছি জেনে, মনে হয়, তাদের দুশ্চিন্তা কিছু বেড়েছিল।
এই ন মাসের অনেকটা সময় আমার ছোটোভাই আখতারকে পালিয়ে থাকতে হয়। আখতারের একটা ছোটো প্রেস ছিল বাড়ির নিচতলায়। নির্বাচনের সময় থেকে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কমিটি সেই প্রেসে অনেক কিছু ছাপিয়েছিল। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হলেও, অনেকের মতো, আখতারও ওই সময়টায় এবং অসহযোগ আন্দোলনের কালে ঝুঁকেছিল আওয়ামী লীগের দিকে। এপ্রিলের ১ তারিখে তার প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই পাড়ার কিছু অবাঙালি লোকজন তার বিরুদ্ধে লেগে যায়। এলাকার মুরুব্বি হিসেবে আব্বা তাদের কোপানল এড়াতে সমর্থ হলেও আখতারকে পালিয়ে যেতে হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সে বাড়ি ফিরে আসে।
আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল এক পূজামণ্ডপ। তার পাশের বাড়িটা বিহারিদের। সে-বাড়ির সকলেই আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কিন্তু আখতারেরই প্রায় সমবয়সী, সে-বাড়ির বড়ো ছেলে, মাহবুব ১৬ ডিসেম্বরের পরে ভয়ে পালিয়ে যায়। তার মা নিরুদ্দিষ্ট পুত্রের জন্যে কেবল অশ্রুবিসর্জন করেন।
আব্বার সঙ্গে দেখা হলো এক বছর পরে। আখতারের ছেলেকে প্রথম দেখলাম তার ন মাস বয়সে। আব্বা বললেন, স্বাধীন বাংলা বেতার-কেন্দ্র থেকে যেদিন তিনি শোনেন যে, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাকারী বাংলাদেশের শিক্ষক প্রতিনিধিদলে আমি ছিলাম, সেদিন নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে ভয় না পেয়ে তাঁর বরঞ্চ খুব গর্ব হয়েছিল এই ভেবে যে, তার ছেলে দেশের জন্যে কিছু করছে। আব্বার বয়স তখন ৭৪। আমাদের বাড়ির মধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যেরা যে গুলি চালিয়েছিল, সেই গুলিতে আহত আব্বার কমপাউনডার এরফান যে এখনো পঙ্গু, প্রতিবেশীদের একজনকে পাকিস্তানি সেনারা যে গুলি করে রাস্তায় ফেলে রেখে তার লাশ সরাতে নিষেধ করেছিল, তারপর বাঙালিরা সকলেই যে পাড়া ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, আব্বা এসব বৃত্তান্ত জানালেন।
৯ তারিখ সকালে এলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-প্রাঙ্গণে। অনেক বন্ধু ও সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হলো : বাংলার রফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সমাজবিজ্ঞানের সাদউদ্দিন, গণিতের শহীদুল্লাহ্। আমাদের বন্ধু ও গিয়াসউদ্দিনের ভগ্নিপতি নুরুল হক তো ছিলেনই, আরেক বন্ধু মসিহুর রহমানও ছিল। যাদের লাশ কিংবা মরদেহের অংশবিশেষ পাওয়া গিয়েছিল, তাদের জানাজা হলো, তারপর মসজিদ-প্রাঙ্গণে গোর হলো। আমার দুই শিক্ষক মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি। সহকর্মী আনোয়ার পাশা, রাশীদুল হাসান ও আবুল খায়েরের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। সবকিছুর শেষে প্রায় সবাই যখন চলে গেলেন, তখন আমি গিয়াসের কবরের পাশে বসে পড়ে কেঁদে ফেলি। বন্ধুরা কেউ কেউ আমাকে ধরে উঠিয়ে নিয়ে যান।
ওই সন্ধ্যায়ই দেখা করতে যাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তখন বোধহয় তিনি দেশের সবচাইতে ব্যস্ত মানুষ–সেই ব্যস্ততার মধ্যেও কথা হলো। আমি আগে আসিনি বলে অনুযোগ করলেন না, তবে তার বিচিত্র অনুভূতির কিছুটা তুলে ধরলেন আমার কাছে : দেশের সমস্যার বিপুলতা, পুনর্বাসন প্রয়াসের প্রাথমিক সাফল্য, বেআইনি অস্ত্রের ভয়, দেশের মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার বৈপরীত্য, প্রশাসন ও দলের মধ্যে তাঁর অনভিপ্রেত কাজ, বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে স্বস্তি, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উৎকণ্ঠা ও সংশয়।
আমি নিজেই দেখলাম, অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে কতোজন, নবাবপুরে-ঠাটারিবাজারে দোকানপাট লুঠ হচ্ছে–পুলিশের সাহায্য চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। থানা বলছে, পাঠাবার মতো পুলিশ নেই সেখানে। কয়েকদিন পরে গিয়েছিলাম বেগম সুফিয়া কামালের বাড়িতে। তাঁদের লনে বসে কামাল ফুপা ও আমি কথা বলছি–এমন সময়ে পাশের বাড়িতে হইচই। ফুপা ও আমি এক দৌড়ে সেখানে হাজির হলাম। দেখি, কয়েকজন অস্ত্রধারী তাদের বাড়ির জিনিসপত্র লুঠ করছে। তারা দাবি করলো, তারা মুক্তিযোদ্ধা। আমি ফুপার পরিচয় দিয়ে ভাবলাম, কাজ হবে। কিছুই হলো না। তারা আমাদের বাধা-নিষেধ অনুনয়-বিনয় কিছুই মানল না। ওই বাড়ির বাসিন্দারা পুরোপুরি না হলেও অংশত অবাঙালি ছিলেন। অতএব তাদের সম্পত্তি লুঠ করার অধিকার অর্জন করেছে তথাকথিত ওই মুক্তিযোদ্ধারা। যখন আমি তাদেরকে বললাম আমার সঙ্গে নিকটবর্তী মুক্তিযোদ্ধা-ক্যাম্পে যেতে, তারা বললো, আমাদের কাজ আমরা করছি, আপনি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন।
আমাদের বাড়ির আশ্রয়প্রার্থীরা সময় ও সুযোগমতো চলে যেতে শুরু করলেন। মাহবুবের মা আমার সাহায্যে যেতে চান মিরপুরে–আত্মীয়ের বাড়িতে। বিহারি-অধ্যুষিত অঞ্চলে আমার যাওয়াটা বাড়ির কারো অভিপ্রেত নয়। তবু কথা দিলাম, পরদিন নিয়ে যাবো।
১০ তারিখে সূর্যোদয় হলো অনেক প্রত্যাশা নিয়ে। এদিনে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন। প্রথমে ভেবেছিলাম, বিমানবন্দরের দিকে যাবো। পরে ভাবলাম, বেতারেই বরঞ্চ শুনি তাঁর প্রত্যাবর্তনের ধারাভাষ্য, তারপর যাবো তার জনসভায়। তাই করলাম। ৭ মার্চ ঢাকায় ছিলাম না, কিন্তু ১০ জানুয়ারির মতো বড়ো সমাবেশ আমি কখনো দেখিনি। বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম দূর থেকে। তিনি যেন এই ক মাসে খানিকটা কৃশ হয়েছেন, কিন্তু কণ্ঠের তেজ বিন্দুমাত্র কমেনি। বক্তৃতায় তিনি জানিয়ে দিলেন ভুট্টোকে : কোনো বন্ধন নয় আর পাকিস্তানের সঙ্গে; বাংলাদেশ স্বাধীন, এর রাষ্ট্রীয় নীতি-ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র।
জনসভায় এত লোক, কিন্তু কোনো বিশৃঙ্খলা নেই কোথাও। সভাশেষে শেরওয়ানি-টুপি-পরা এক ভদ্রলোককে কিছু ছেলে ঘিরে ধরেছিল–পরিচয় জানতে চায়, তার প্রমাণ চায়। শেষ অবধি অবশ্য বিনা গোলযোগেই ছেড়ে দিলো তাকে। এত মানুষের সুশৃঙ্খল আচরণ দেখে ভরসা হলো, আমরা ব্যর্থ হবো না, এত ত্যাগ বিফল হবে না।
রাত একটু গম্ভীর হলে মাহবুবের মা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের আমার গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে চললাম মিরপুরের দিকে। ওই রাতে তরুণ অস্ত্রধারীদের অধিকাংশই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনে আনন্দ-উল্লাসে ব্যস্ত। পাড়ায় তাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। এই সুযোগে আশ্রয়প্রার্থীদের নিয়ে নিরাপদে বের হওয়া গেল। মিরপুরের কাছাকাছি গিয়ে সকল ইন্দ্রিয় সজাগ করে রাখলাম, নিজের নিরাপত্তার চিন্তা মনে এলো। এক জায়গায় ভারতীয় সেনারা গাড়ি থামিয়ে গন্তব্য জানতে চাইলেন। ব্যাখ্যা করলাম। তারা আমাকে যেতে দিলেন, তবে বড়ো রাস্তা ছেড়ে ভেতরে যেতে নিষেধ করলেন। বড়ো রাস্তার ওপরেই যাত্রীদের নামিয়ে দিলাম। আর ভেতরে ঢুকতে সাহস হচ্ছিল না, ওঁরাও ব্যাপারটা বুঝলেন বলে মনে হলো।
বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি, দোতলার বারান্দায় ওই মধ্যরাত্রিতে উৎকণ্ঠিতচিত্তে আব্বা এবং আর সবাই দাঁড়িয়ে–আমার নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায়।
পরদিন ড. কামাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের সঙ্গে দেখা করতে ছুটলাম ধানমন্ডিতে জিয়াউল হকের (টুলু) বাড়িতে। বন্দিদশা থেকে কামাল মুক্তি পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভের একদিন পরে, তবে লন্ডন হয়ে ঢাকায় ফিরেছেন একই সঙ্গে। টুলু ভাইয়ের বাড়িতে কামাল ছিলেন না, তবু লোকে লোকারণ্য। এক ফাঁকে হামিদার সঙ্গে কুশলবিনিময় করে চলে এলাম।
ফাঁকে ফাঁকে যাচ্ছি শহীদ শিক্ষক ও সহকর্মীদের বাড়িতে, দেখা করছি মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, রাশীদুল হাসান, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সারের পরিবারের সঙ্গে। যখন ফিরে আসছি তাদের কাছ থেকে, দেশটাকে স্বজনহারানো শ্মশান বলেই মনে হচ্ছে।
২.
জানুয়ারির ১১ তারিখ সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখনই জানলাম, পরদিন বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন, জিজ্ঞাসা করায় তাজউদ্দীন বললেন, কালই জানতে পারবেন।
সংসদীয় পদ্ধতির সরকার যেখানে আমাদের অভীষ্ট, সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রী হওয়াই স্বাভাবিক ও সংগত। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকলে পাকিস্তানের সূচনাকালের মতো মন্ত্রিসভার চেয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রভাব ও ক্ষমতা থেকে যেত বেশি, তা সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুকূল হতো না। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তারই উচিত হাল ধরা। তাজউদ্দীন নানা গুণে গুণান্বিত মানুষ, কিন্তু বাংলাদেশের। অগুনতি সমস্যার মোকাবেলায় তিনি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেতেন না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তখন সর্বদলীয় সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। তার উল্লেখ না করেই তাজউদ্দীন ঘোষণা দেন যে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত, সর্বদলীয় উপদেষ্টা-পরিষদ স্বাধীনতালাভের পরেও বহাল থাকবে। উপদেষ্টা-পরিষদের কোনো নির্বাহী ক্ষমতা ছিল না, তাই তাঁদের বহাল থাকার বিষয়টা সর্বদলীয় সরকার গঠনের আহ্বান যাঁরা জানাচ্ছিলেন তাঁদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু দেখা গেল, আওয়ামী লীগের তরুণ কোনো নেতা, প্রধানমন্ত্রীর অজান্তেই, সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়ে বসলেন। এতে পরিস্থিতি ঘোলাটে হলো মাত্র। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল দলের প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সরকার গঠিত হতে পারত, কিন্তু আওয়ামী লীগের বাইরের কেউই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন না। সংসদীয় গণতন্ত্রের হিসেবে বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য, আবার মুক্তিযুদ্ধকে বিপ্লব হিসেবে গণ্য করলে ওই প্রশ্ন গৌণ হয়ে যায়। তবে এ কথা তো সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই জনসাধারণের নির্বাচিত দল বলেই আওয়ামী লীগের দেশ শাসনভারলাভের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছিল।
ওদিকে মুজিব বাহিনী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নেতারা বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁরা মুজিব বাহিনীর অস্তিত্ব বজায় রাখবেন এবং অস্ত্র বা গোলাবারুদ সমর্পণ করবেন না। তাজউদ্দীন যদিও তার আগেই বলেছিলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্র করার প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে মুজিব বাহিনীর ওই ঘোষণা তাঁর সরকারের প্রতি বিরূপতার প্রকাশ বলেই মনে হয়েছিল। মন্ত্রিসভার দু দফা সম্প্রসারণ ঘটেছে–পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব খন্দকার মোশতাক আহমাদের কাছ থেকে নিয়ে দেওয়া হয়েছে আবদুস সামাদ আজাদকে, তাতে মোশতাক খুশি হননি।
যুদ্ধাপরাধীদের আর তাদের দোসরদের বিচারের দাবি প্রবল হচ্ছে, সরকারের তরফ থেকেও তেমন বিচারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন কোনো কোনো মন্ত্রী। বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার পরে কলকাতায় বসে এ-বিষয়ে তাজউদ্দীন আমাকে যা বলেছিলেন, আমার মনে পড়ছে সেসব কথা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে আর ভারতকে চাপ দিচ্ছে যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দিয়ে উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে। যুদ্ধবন্দিদের বিচারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইচ্ছুক নয়, ভারতও উৎসাহী নয়। এই অবস্থায় কার জোরে আপনি বিচার করবেন? আর মূল অপরাধীদের বিচার করতে না পারলে তাদের সহযোগীদের বিচারের প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যেতে বাধ্য। সেদিন আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম, তবু আশা ছাড়িনি যে, যুদ্ধাপরাধী ও দালালদের বিচার হবে।
পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার জন্যেও সরকারের ওপর চাপের সৃষ্টি হচ্ছে। সিভিল সার্ভিসের সাবেক সদস্য, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি, আহমদ ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে এ-বিষয়ে নানা উদযোগ নিতে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, কাজটা সহজ হবে না। বাঙালিদের আটকে রেখে পাকিস্তান দর-কষাকষি করবে যুদ্ধবন্দিদের ছাড়িয়ে নিতে।
শোনা যাচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগীদের অনেকে আশ্রয় নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে–সেখান থেকে মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করবে বলে। তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনী। মিলিতভাবে অভিযানও চালিয়েছে সে-অঞ্চলে।
১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তাজউদ্দীনের সঙ্গে এত বিষয়ে আমার কথা হয়নি। তিনি বঙ্গভবনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমার সঙ্গে কথা সেরে যেই তিনি বেরিয়ে এলেন, অমনি বহু লোক তাঁকে ঘিরে ধরল–সবারই কিছু না কিছু আরজি আছে। প্রথমে বিনীতভাবে, শেষে রাগতস্বরে তিনি বললেন, রাষ্ট্রপতি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন–সময়মতো তাঁর কাছে না গিয়ে আমি আপনাদের। কথা শুনব, এই কি আপনারা আশা করেন?’ যিনি বলছিলেন এবং যাদের বলছিলেন, উভয় পক্ষের প্রতিই আমি সহানুভূতি বোধ করছিলাম।
৩.
পরদিন বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ নিলেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হলেন রাষ্ট্রপতি।
এবারে বঙ্গবন্ধু সকল মুক্তিযোদ্ধাকে আহ্বান জানালেন অস্ত্র সমর্পণ করতে। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন বাহিনী, মুজিব বাহিনী, ছাত্র ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধারা, মায়া গ্রুপ–একে একে অস্ত্র সমর্পণ করলো নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শুনেছিলাম, মুক্তিবাহিনীর মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের অনুসারীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে–শেষোক্তরা সমাজতন্ত্রের যত অনুরাগী, প্রথমোক্তরা তত নয়। তবে অস্ত্র সমর্পণ করলেন তারা একজোট হয়ে। সেদিনই নতুন স্লোগান শোনা গেল : মুজিববাদ জিন্দাবাদ। মুজিববাদ বলতে যে কী বোঝায়, তা আমার জানা ছিল না; দেখা গেল, অনেকেরই জানা নেই। কিন্তু পরবর্তীকালে কথাটা খুব চালু হয়ে যায়, এমনকি, মুজিব বাহিনীর তরুণ নেতারা মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে দ্বিতীয়বার সংগ্রামের আহ্বানও জানিয়েছিলেন। সরকারি পর্যায়ে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঘোষিত তিন নীতিকে দেশের লক্ষ্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী, বড় একটা রাষ্ট্রায়ত্ত খাত গঠিত হতে চলেছে, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তা পরিচালনার মতো দক্ষ ও নির্লোভ জনশক্তি আমাদের আছে কি না সে-সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেকে। আমি আশা করছি, দেশপ্রেম দিয়ে সব সংকট পার হওয়া যাবে।
১৩ তারিখে দুপুরে বাড়ি ফিরে শুনি, বাংলা একাডেমি থেকে কয়েকবার আমার খোঁজ করা হয়েছিল। কারণ জানতে পরিচালক কবীর চৌধুরীকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে আমার সোনার বাংলা’–এটা স্থির হয়ে গেছে, তবে গানটির কয় চরণ জাতীয় সংগীতরূপে গৃহীত হবে, সেই পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল বাংলা একাডেমির কাছে। পরামর্শের জন্যে তিনি ডেকেছিলেন কয়েকজনকে, আমাকেও যুক্ত করতে চেয়েছিলেন তার সঙ্গে। তাঁরা সুপারিশ করেছেন, গানটির প্রথম দশ চরণ জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হোক। আমি বললাম, যথার্থ হয়েছে। কিন্তু মনে আফসোস রয়ে গেল, এত বড়ো একটা সিদ্ধান্তের অংশভাগী হওয়া থেকে বঞ্চিত হলাম। ওইদিনই নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংগীত বিষয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়, সেই সঙ্গে রণসংগীত নির্ণীত হয় ‘চল্ চল্ চল্। তার আগে, জানুয়ারির ৪ তারিখে, বাংলাদেশের মানচিত্র-অঙ্কিত পতাকার বদলে সবুজ জমিনের ওপরে লাল সূর্য আঁকা নতুন জাতীয় পতাকার নকশা গৃহীত হয়। মন্ত্রিসভায়। যতদূর জানি, নকশাটা করেছিলেন কামরুল হাসান।
একবার চট্টগ্রামে যেতে হয়। ১৭ বা ১৮ তারিখের সকালে, এক গাড়িতে উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক আর পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শামসুল হক এবং আমার গাড়িতে রেজিস্ট্রার মুহম্মদ খলিলুর রহমান আর আমি রওনা হলাম। অসংখ্য রাস্তাঘাট, পুল ও কালভার্ট ভাঙা–বিকল্প পথ ধরে এগোতে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। প্রথমে এক জায়গায় থামতেই দেখি সামনের গাড়িতে খান শামসুর রহমান ওরফে জনসন এবং আবদুল বারেক চৌধুরী ওরফে এবিসি। অপেক্ষমাণ অবস্থায় গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করা ছাড়া করণীয় কিছু ছিল না। সারাপথ শামসুর রহমান আশপাশের পরিবর্তমান ভূচিত্রের কথা বলে গেলেন। তাঁর মুখে সেদিন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভূগোলের যে-পরিচয় লাভ করেছিলাম, তা ছিল এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
চট্টগ্রামে ফেরাটা ছিল খুব আবেগময় ব্যাপার। আমরা ক্যাম্পাসে পৌঁছেছিলাম প্রত্যাশিত সময়ের অনেক পরে। তখনো অধ্যাপক থেকে পিয়ন পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করছেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাবেন বলে। আমরা উঠলাম উপাচার্যের বাসভবনে। ওই বাড়িতেই ক্যাম্পাসের সর্বশেষ রাত কাটিয়েছিলাম ড. মল্লিক ও আমি। আমার আবাসের অনেক কিছু লুষ্ঠিত হয়ে গেছে। কাপড়-চোপড়, হাঁড়ি-বাসন, বিছানা-বালিশ গেছে–তবে লুটেরারা একটি কফি সেট এবং তিনটি প্লেট (বোধহয় আমার, বেবীর ও রুচির জন্যে) রেখে গেছে। বইপত্র কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে মেঝেতে, কিন্তু আসবাবপত্র সব আছে, রেফ্রিজারেটর অক্ষত, কেবল গ্যারাজের ওপরের ঘরে সাত্তারের চৌকিটা নেই। কিছু লুঠপাট যে নিম্নশ্রেণির কর্মচারীরা করেছে, সে-খবর পাওয়া গেল, এমনকি চৌকিটা কে নিয়েছে তাও জানা গেল। সে অবশ্য বললো, পাছে লুঠ হয়ে যায়, তাই নিজের কাছে নিয়ে রেখেছে, আমি বললেই ফেরত দিয়ে যাবে। আমি বলেছিলাম, তবে চৌকি ফেরত পাইনি। তার নতুন মালিক পরে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা হয়েছিল।
তার চেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা একটা শুনলাম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল দেশে ফিরে ক্যাম্পাসের একটি অংশে জায়গা করে নেয় বিজয়লাভের দিন দুই পরে। তখন তাঁদের সমাদরের লেশমাত্র অভাব হয়নি। কয়েকদিন পরে দলটি যখন ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায় তখন ট্রাকে করে নিয়ে যায় কয়েকটি শ্রেণিকক্ষের আসবাবপত্র, টাইপরাইটার এবং ফিল্ড টেলিফোন-মার্কা আমাদের কয়েকটি টেলিফোন সেট। বিবরণ শুনে আমি যৎপরোনাস্তি লজ্জিত হই। যিনি এই দলের অধিকর্তা ছিলেন, পরে তিনি বেশ পদোন্নতি লাভ করেছিলেন এবং সময়ের আগে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছিলেন।
একটি ট্রাজিক ঘটনার কথাও এ-সময়ে জানতে পারি। আমার অনুপস্থিতিতে এ এফ রহমান হলের প্রোভোস্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন ইতিহাস বিভাগের রিডার ড. জাকিউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে ক্যাম্পাসে বাড়ির সামনে পায়চারি করার সময়ে তিনি আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং ১৩ দিন পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রী ও শিশুপুত্র তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসে আছেন। ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বারবার স্বামীর হয়ে আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে লাগলেন–আমার অবর্তমানে প্রোভোস্টের পদটি তিনি গ্রহণ করেছিলেন বলে। আমি বারবার তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করি যে, এটি একটি প্রশাসনিক ব্যাপার, কাউকে না কাউকে ওই দায়িত্ব পালন করতে হতো, এবং তা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু আমার মুখ থেকে ‘ক্ষমা করেছি’ না শোনা পর্যন্ত ভদ্রমহিলা ক্ষান্ত হলেন না। আমি আর কখনো এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি।
আমরা চট্টগ্রামে পৌঁছোবার পরদিন বিকেলে মুসলিম ইনসটিটিউট হলে আমাদের–‘বাংলার সংগ্রামী বুদ্ধিজীবীদের’–বীরোচিত সংবর্ধনা। আয়োজন করেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু)–যার সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই শহীদ হয়েছিল। বক্তৃতায় যেসব অতিশয়োক্তি করা হয়েছিল, তা অপ্রত্যাশিত ছিল না কিন্তু জনসমাগমের ব্যাপকতা এবং আবেগ ও আন্তরিকতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের মাত্রা আমাদের প্রত্যাশার অতীত ছিল।
মুসলিম ইনসটিটিউটে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন শহীদ নূতনচন্দ্র সিংহের কনিষ্ঠ পুত্র প্রফুল্ল সিংহ। এই ক মাসে তার পৃথিবী সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সেই ধাক্কা সামলাচ্ছেন তিনি–এখন সবই আবার তাকে নতুন করে শুরু করতে হবে। সভার শেষে লোকজনের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে লক্ষ করলাম, আমার মামাতো ভাই সৈয়দ কামরুজ্জামান এবং বন্ধু আবদুল আলী ও মীর মোজাম্মেল হোসেন দাঁড়িয়ে আছেন। দ্রুত তাদের কাছে গেলাম এবং কামরু ভাইয়ের গাড়িতে করে বাটালি হিলে রেলওয়ে কোয়ার্টার্সে এসে পৌঁছোলাম। একই বাড়ির একতলায় আলীর এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ এ জেড এম আবদুল আলিমের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে দোতলায় মোজাম্মেলের বাড়িতে উঠলাম। সেখানে তাঁর মা থাকতেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই ভেতর থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিসেস আতাউর রহমান।
আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত এবং মোজাম্মেলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু আতাউর রহমান ছিলেন রেলওয়ের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে তার ভূমিকা ছিল সক্রিয় এবং জনসংযোগ বিভাগের লোক হওয়ায় সবার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও ছিল কিছু বেশি। চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে চলে গেলে রেলের অবাঙালি কর্মীরা তাঁর প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। আতাউর তখন আত্মগোপন করেন এবং অফিসে যোগদান করার সরকারি নির্দেশ জারি হওয়ার পরেও কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেননি। এক পীরসাহেব আতাউরের স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, অফিসে যোগ দিলে আতাউরের কোনো ক্ষতি হবে না। অফিসে যাওয়ার পরপরই পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে নিয়ে যায়–তিনি আর ফিরে আসেননি। শুনেছি, টাকাপয়সা-গয়নাগাটি নিয়ে আরো কাউকে কাউকে পীরসাহেব এরকম পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং তাঁদের সবার একই পরিণতি ঘটেছিল। এখন এক ছেলে, এক মেয়ে এবং একরাশ মনস্তাপ নিয়ে আতাউরের স্ত্রী দিশেহারা। তাঁকে আমি কিছুই বলে উঠতে পারছিলাম না।
চট্টগ্রামে গিয়ে মনে হলো, পূর্বপদে ফিরে আসার তেমন আগ্রহ যেন ড. মল্লিকের নেই। তার কয়েক দিন পরে তিনি শিক্ষাসচিব হিসেবে যোগ দেওয়ায় তাই অবাক হইনি, যদিও মনে হয়েছিল যে, ওটি তাঁর পক্ষে উপযুক্ত পদ নয়। তবে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তাঁকে এই নিয়োগ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। সদ্যস্বাধীন দেশে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসে তার চিন্তা ও অভিজ্ঞতা দেশের কাজে লাগবে বলে এবং সেই আহ্বান ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভবপর ছিল না তাঁর পক্ষে। নতুন ভূমিকায় তাঁকে দেখলাম ২২ জানুয়ারিতে শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীর দপ্তরে আহূত এক সভায়। শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার আগেই বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ইউসুফ আলী যে-নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছিলেন, সে-কথাটা এখানে বলে নিই। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে শিক্ষাবিষয়ে আমি যে কয়েকটি কাগজ তৈরি করেছিলাম, তার একটিতে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যে যে-ক্লাসে পড়ত, ১৯৭২ সালের ১ মার্চে তাকে আবার সেখান থেকে পড়াশোনা শুরু করতে হবে; এই একটি বছর জাতীয় ক্ষতি হিসেবে পরিগণিত হবে; এবং সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়ঃসীমা এক বছর বাড়িয়ে। দেওয়া হবে। কিন্তু মন্ত্রিসভায় এ-প্রস্তাব বিবেচিত হওয়ার আগেই জাতীয় পরিষদ-সদস্য ইউসুফ আলী এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণউন্নতি দেওয়া হলো, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যে যেখানে পড়ত, ১৯৭২ সালে তার পরবর্তী শ্রেণিতে সে উন্নীত হবে। এই ঘোষণার বিষয়ে তিনি যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করেননি, সে-কথা আমি তাজউদ্দীনের কাছ থেকে জেনেছিলাম। বলা বাহুল্য, ঘোষণাটি ছাত্রদের কাছে খুব জনপ্রিয়। হয়েছিল এবং তা প্রত্যাহার করার মতো সাহস সরকারের হয়নি। এতে যে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে কী সর্বনাশ হলো, অনেকে তা ভেবে দেখেননি। এই কারণে ইউসুফ আলীর প্রতি মনটা বিমুখ হয়ে থাকলেও তাঁর আহ্বানে তাঁর দপ্তরে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা সম্পর্কে আলোচনা করতে। শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাসচিব ছাড়া তাতে উপস্থিত ছিলেন মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, মুহম্মদ এনামুল হক, আবুল ফজল, কবীর চৌধুরী, সৈয়দ আলী আহসান ও মযহারুল ইসলাম, আর ছিলাম আমি। সেখানে সুপারিশ করা হয় যে, দেশে একই পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে এবং একই মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হবে, আর এসব বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ প্রণয়নের জন্য সরকার একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করবেন। বাংলা ভাষায় উচ্চ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা যে তখনই চালু করা সম্ভব, এ-সম্পর্কে সবচেয়ে দ্বিধাহীন ছিলেন কুদরাত-এ-খুদা। তবে অভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতি-প্রবর্তনের প্রশ্নে আবুল ফজল একমত হলেন না, তিনি চাইলেন, সংস্কার করে হলেও মাদ্রাসা শিক্ষার স্বতন্ত্র ধারাটি অব্যাহত রাখতে। তিনি মনে করছিলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় বোধহয় সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষাকে একীভূত করার প্রস্তাব উঠেছে। আমরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, শিক্ষাগত বিবেচনায়ই এটি কাম্য, তিনি তা মানলেন না। কয়েক দিন পরে দৈনিক বাংলায় মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মাদ্রাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্যরক্ষার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন।
২৭ জানুয়ারি আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে। নতুন পরিস্থিতিতে সংস্কৃতির রূপরেখা প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছিল এর লক্ষ্য। এতে সভাপতিত্ব করেছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল আর অংশ নিয়েছিলেন ঢাকার অধিকাংশ সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সভায় একটি কমিটি গঠিত হয় সুফিয়া কামালকে আহ্বায়ক এবং কামরুল হাসান, খান সারওয়ার মুরশিদ, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, জহির রায়হান, সৈয়দ হাসান ইমাম, ডা. সারোয়ার আলী ও আমাকে সদস্য করে। এই উদযোগে একটা বড়ো ভূমিকা ছিল বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের।
২৯ তারিখে এই কমিটির আহ্বানে আরেকটি সভা আয়োজিত হয় বিএমএ ভবনে। উদ্দেশ্য, বিশদ আলোচনা এবং আরো বড়ো করে মতবিনিময়। সকালবেলায় বোরহান আমাকে ফোন করে জানালো, বিকেলের সভায় জহির আসতে চাইছে না, তুমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলো। ফোন করতেই জহিরকে পেয়ে গেলাম। আমি তাকে সভায় আসতে বলি, সে আসতে পারবে না বলে মিনতি করে। শেষে জানায়, নিরুদ্দিষ্ট অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সার-সম্পর্কিত একটা খবর পেয়েছে সে, তার সূত্র ধরে সে অনুসন্ধানে যাচ্ছে, ফিরে এসে সবটা বলবে আমাকে।
নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের সভা হয়ে গেল, জহিরের কোনো খবর নেই। পরদিন খোঁজ নিয়ে শুনি, সঙ্গীদের ফিরিয়ে দিয়ে জহির একাই ঢুকে গেছে মিরপুরের কোনো বাড়ির মধ্যে। সেখানে গোলাগুলি হয়েছে–আমাদের পুলিশ ও সেনা সদস্য জখম হয়েছে, কিন্তু জহির ফিরে আসেনি। কী সর্বনাশ! এমন খবর তো কাগজেও পড়িনি! না, ইচ্ছে করেই খবর দিতে দেওয়া হয়নি; এখনো চেষ্টা চলছে শহীদুল্লা কায়সারকে না পাওয়া গেলেও জহির রায়হানকে উদ্ধার করার।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জহির সরকারকে আহ্বান জানিয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কে তদন্ত কমিশন গঠন করতে। সরকার কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় সে নিজেই গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছিল নিজেকে আহ্বায়ক করে। গুছিয়ে কাজ করার মতো মানসিক অবস্থা তার তখন ছিল না। দাদার অন্তর্ধানে সে একেবারে উদ্ভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। সরকারের বিরুদ্ধেও তার যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল–কিছুটা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নানা ঘটনায়, কিছুটা বুদ্ধিজীবী-হত্যার তদন্তে সরকারের উদযোগহীনতায়। তাই সে একা একাই যতটা সম্ভব করতে চেয়েছিল এবং তা করতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে গেল।
৪.
স্বাধীনতালাভের আনন্দের মধ্যেও নানা ক্ষেত্রে মানুষে-মানুষে সম্পর্কে এক ধরনের জটিলতা ও উত্তেজনা দেখা দিলো। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যারা বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন, তারা দেশে ফিরে যখন প্রশাসনের হাল ধরলেন, তখন অনেক সময়ে দেশে কর্মরত তাঁদের জ্যেষ্ঠ বা সমসাময়িক কর্মকর্তাদের তারা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেটা কারা কীভাবে মেনে নিয়েছিলেন, তা বলা শক্ত, তবে মুজিবনগর-প্রত্যাগত কর্মকর্তাদের অনেকে সহকর্মীদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। প্রশাসনে পাকিস্তান সরকারের সোৎসাহী সমর্থক কেউ কেউ ছিলেন, সন্দেহ নেই, কিন্তু অন্যদের থেকে তাঁদের স্বতন্ত্র করে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াটা সহজ ছিল না। কাগজে দেখলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে খেতাব নেওয়ার দায়ে বেশ কয়েকজন কর্ম থেকে অপসারিত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন, ড. এরফান আলী, অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কয়েকদিনে, চট্টগ্রামে সর্বতোভাবে আমাদের সাহায্য করেছিলেন। এই তালিকায় আরো কেউ কেউ ছিলেন যাঁদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতার অভিযোগ ছিল না। আবার সত্যি যাঁরা সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে বহাল তবিয়তে কাজেই থেকে গিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন, এমন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী চিহ্নিত করার জন্যে পরে সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই কমিটিতে ছিলেন সাবেক পিএসপি এ বি এম সফদার। সফদার পাকিস্তানের প্রতি অনুগত কর্মকর্তা বলে সাধারণ্যে পরিচিত ছিলেন। বেতার-টেলিভিশনের শিল্পীদের মধ্যে পাকিস্তানের সহযোগী খুঁজে বের করতে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল, নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন তার প্রধান। তাঁর রিপোর্টের ভিত্তিতে পরে কিছু শিল্পীকে বেতার-টেলিভিশনে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণে অনেকের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছিল, অনেক প্রকৃত সহযোগী টাকাপয়সা দিয়ে বা প্রভাব খাঁটিয়ে অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছিলেন।
এভাবে, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে মানুষ যেন নানাভাগে বিভক্ত হতে শুরু করেছিল। মুজিবনগর-প্রত্যাগতদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছিল অন্যদের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, শুনেছি, আমাদের দুজন সহকর্মীর ব্যবহারে তাঁদের ব্যক্তিগত বন্ধুরাও আহত বোধ করেছিলেন। সরকারবিরোধীরা এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি। সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকা প্রথম পাতায় একটি রিপোর্টের ব্যানার হেডিং দিয়েছিল : সিক্সটি ফাইভ মিলিয়ন কোলাবরেটরস্। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি লোক বাদে আর-সবাই পাকিস্তানিদের সহযোগী। বলা বাহুল্য, এমন মনোভাব কারো ছিল না, কিন্তু অবস্থা এমন হয়েছিল যে, ওই শিরোনাম অনেকের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কর্তাদের নির্দেশে বুলবুল ললিতকলা একাডেমীকে ঢাকা সেনানিবাসে কয়েকটি নৃত্যগীতানুষ্ঠানে অংশ নিতে হয়। এখন সেই দায়িত্ব এসে পড়ল তার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহমদ হোসেনের ওপরে। মুক্তিযোদ্ধা ও সংগীতশিল্পী মোরাদ আলী অভিযোগ আনে আহমদের বিরুদ্ধে এবং তাদের দুজনকে নিয়ে আমি দিনতিনেক বৈঠক করি। শেষ পর্যন্ত স্থির হয়, বাফার সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে আহমদ ইস্তফা দেবে। ব্যাপারটা আহমদের জন্যে গভীর দুঃখের কারণ হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এতজন শিক্ষক-কর্মকর্তা শহীদ হয়েছেন, অনেকে কারাভোগ করেছেন, পাকিস্তান-সমর্থকেরা বেশ দাপটও দেখিয়েছেন–ফলে উত্তেজনটা সেখানে ছিল কিছু বেশি। অনেকেই আশা করছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণ করলে এসব বিষয়ে প্রত্যাশিত সুরাহা হবে।
জানুয়ারি মাসের শেষদিকে সৈয়দ আলী আহসান আমাকে বললেন, শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী চান আমাকে বাংলা একাডেমির পরিচালক নিযুক্ত করতে। আমি সম্মত কি না, তা জেনে নেওয়ার ভার দিয়েছেন তিনি আলী আহসান সাহেবকে। আমি নির্দ্বিধায় বললাম, শিক্ষকতার বাইরে কিছু করার ইচ্ছে আমার নেই, বোধহয় যোগ্যতাও নেই; সুতরাং শিক্ষামন্ত্রীকে তাঁর প্রস্তাবের জন্যে ধন্যবাদ জানানো ছাড়া আমার করণীয় নেই, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই ফিরে যাবো।
ফেব্রুয়ারি মাসে কিছু আগে-পরে সব বিশ্ববিদ্যালয় খুলে গেল। তার আগে নতুন উপাচার্য নিযুক্ত হলেন–ঢাকায় মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, রাজশাহীতে খান সারওয়ার মুরশিদ, জাহাঙ্গীরনগরে সৈয়দ আলী আহসান, চট্টগ্রামে এম ইন্নাছ আলী। সৈয়দ আলী আহসান জাহাঙ্গীরনগরে চলে আসায় কর্মে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষরূপে আমি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরী শহীদ হয়েছেন–ওই পদে কে নিয়োগলাভ করবেন, তা নিয়ে কিছুটা জটিলতা দেখা দিলো। কর্মে জ্যেষ্ঠতার দিক দিয়ে বিভাগে মুনীর চৌধুরীর পরে ছিলেন কাজী দীন মুহম্মদ–পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার দায়ে তিনি কারারুদ্ধ। তাঁর পরে ছিলেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী–তিনিও শহীদ হয়েছেন। তাঁর পরে ছিলেন আহমদ শরীফ–অতএব অধ্যক্ষের পদটি স্বাভাবিকভাবে তারই। প্রাপ্য ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি বিভাগের কাজে যোগ দিয়েছিলেন, তাও আবার পাকিস্তানের দালাল এক রাজনীতিবিদের সঙ্গে এসে–এই নিয়ে একটা প্রচারণা-অভিযান চললো তার বিরুদ্ধে। জ্যেষ্ঠতায় আহমদ শরীফের পরে ছিল নীলিমা ইব্রাহিমের স্থান। তিনি যদিও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাঁর এক জামাতা ছিল ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ-দলীয় সদস্য অর্থাৎ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য। এই সূত্রে ক্ষমতাসীন দলের অনেকের সঙ্গে তার সম্ভাব গড়ে উঠেছিল। বিভাগের জনকয়েক শিক্ষকও তাঁর পক্ষে কাজ করতে নামলেন। ফলে, নীলিমা ইব্রাহিম অধ্যক্ষ হলেন। আহমদ শরীফ ব্যাপারটিকে দেখলেন ব্যক্তিগতভাবে তাঁর প্রতি সরকারের বিরূপতা বলে। অচিরেই তিনি আত্মপ্রকাশ করলেন সরকারের কঠোর সমালোচকরূপে। বাংলা বিভাগে তাঁর ও নীলিমা ইব্রাহিমের অনুসারীরা কার্যত দুটি দলে ভাগ হয়ে রইলেন বহুদিন পর্যন্ত।
৫.
চট্টগ্রামে এসে নতুন করে সংসার পাততে হলো। হাঁড়িকুড়ি বাসনকোশন সব কিনতে হবে। নিউ মার্কেটে টি-সেট কিনতে গেছি, অনুপম সেন কোত্থেকে আবির্ভূত হয়ে বাধা দিলেন। বললেন, তার প্রতিবেশী তার দুটি টি-সেট রক্ষা করেছেন, তার একটা উনি আমাকেই দান করবেন। খুব যে আপত্তি করেছিলাম, তা মনে হয় না। অনুপমের দেওয়া সেই চায়ের পাত্র বহুদিন আমাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মানবসম্পদের হানি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়নি–তাই এখানে উত্তেজনা ছিল অপেক্ষাকৃত কম। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের দর্শনের অধ্যাপক অবনীমোহন দত্তকে চট্টগ্রাম শহরে সেনাবাহিনী হত্যা করেছিল। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক, সেই হিসেবে আমাদের একমাত্র শহীদ শিক্ষক। আমাদের কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে জেলেও যেতে হয়নি। তবু দেখা গেল, অনেক সহকর্মী এসে বলছেন, এই ক মাসে শিক্ষকদের মধ্যে কারা বেতারে কথিকা পড়েছিলেন, কারা পাকিস্তান কাউনসিলে সেমিনার-সিম্পোজিয়মে বক্তৃতা করেছিলেন, কারা কাগজে বিবৃতি দিয়েছিলেন–আর এসব কথিকা-বক্তৃতা-বিবৃতিতে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার আহ্বান জানানো হয়েছিল। আমি তাঁদের বলেছি, দেখুন, দেশে থেকে গেলে হয়তো আমিও অমন কিছু করতে বাধ্য হতাম। সরাসরি পাকিস্তান সরকার বা সেনাবাহিনীকে সাহায্য না করে থাকলে কিংবা তাদের কোনো কাজের ফলে অন্য কেউ নির্যাতিত না হয়ে থাকলে এসব বিষয় নিয়ে আন্দোলন না করাই ভালো। অভিযোগকারীরা ক্ষুণ্ণ মনে চলে গেছেন। একই মর্মে স্বনামে-বেনামে লিখিত অভিযোগপত্র পেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, তার প্রতিলিপি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের তিনজনের কাছেও পাঠানো হয়েছিল : পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শামসুল হক, গণিত বিভাগের অধ্যক্ষ রশিদুল হক আর আমার কাছে–মুক্তিযুদ্ধকালে আমরা তিনজনই ছিলাম ভারতে শরণার্থী।
তবে অন্য একটি বিষয়ে কিছু করা উচিত বলে আমাদের মনে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ন মাসে অনেক শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগলাভ করেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে কেউ কেউ নিযুক্ত হন ডা. মালেক-মন্ত্রিসভার কোনো কোনো সদস্য থেকে শুরু করে আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের মুসলিম লীগ-দলীয় চেয়ারম্যানের (স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তিনি নিহত হন) লিখিত সুপারিশে। অনেক ক্ষেত্রে, নির্দিষ্ট পদটি বিজ্ঞাপিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে, সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকেরা যথারীতি আবেদনও করেছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নির্বাচনী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হওয়ায় যারা দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন তারা আর সাক্ষাৎকারে উপস্থিত থাকার সুযোগ পাননি, ফলে প্রতিযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের কনিষ্ঠেরা প্রার্থিত পদ লাভ করে তাদের ডিঙিয়ে গিয়েছিলেন। উপাচার্য ইন্নাছ আলী মুক্তিযুদ্ধকালীন সব নিয়োগ পরীক্ষা করে দেখে এ-বিষয়ে সুপারিশ করার জন্যে মোহাম্মদ শামসুল হক, রশিদুল হক আর আমাকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। আমরা সব কাগজপত্র দেখে মতামত দিই যে, রাজনৈতিক সুপারিশের জোরে যেসব নিয়োগদান করা হয়েছিল, তা বাতিল করা হোক; মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচক কমিটির সভায় যেসব আবেদনকারী উপস্থিত হতে পারেননি, তাঁদেরকে আবার ডাকা হোক এবং ওইসব পদে নিয়োগের ব্যাপারে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক; একটি বিভাগে পাকিস্তান প্রত্যাগত একজন পণ্ডিত ব্যক্তিকে নিয়োগদান করা হয়েছিল, সেই নিয়োগ বহাল রাখা হোক।
ওইসব সুপারিশ যখন সিন্ডিকেটে বিবেচিত হতে যাচ্ছে, তখন মহা আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি শামসুজ্জামান হীরা ছিল চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নেরও সভাপতি। তার নেতৃত্বে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা সিন্ডিকেটের সভা ঘেরাও করে বসলো। তাদের একটিই দাবি : মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর নিয়োগ বাতিল করা চলবে না। আমাদের সুপারিশের বিবেচনা বন্ধ রেখে উপাচার্য পরে ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করলেন, শেষ পর্যন্ত আরেকটি সিন্ডিকেট-সভায় তার মতামত দিলেন : আমাদের সুপারিশ যুক্তিসংগত হলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেলায় তা প্রয়োগ করা সম্ভবপর নয়। আমরা মনে করলাম, এক যাত্রায় পৃথক ফল হওয়াও সংগত নয়। যদি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সুপারিশ কার্যকর না হয়, তাহলে শিক্ষক-কর্মকর্তা কিংবা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তা কার্যকর করা সংগত হবে না। সুতরাং আমরা নিজেদের সুপারিশ নথিবদ্ধ হয়ে থাকতে দিলাম।
আরেকটি বিষয়ে আমি বিচলিত হয়েছিলাম। আমি এ এফ রহমান হলের প্রোভোস্টের দায়িত্ব আবার গ্রহণ করেছি। ছাত্রেরাই তখনো হলের মেসের ব্যবস্থাপনায় থাকে। একদিন কিছুসংখ্যক ছাত্র আমার বাড়িতে এসে দেখা করে বললো, তারা হলের মেসে গরুর গোশত খাওয়ার ব্যবস্থা করতে চায়। হলটি যেহেতু সকল সম্প্রদায়ের ছাত্রদের জন্যে উন্মুক্ত এবং পাকিস্তান-আমলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আবাসিক হলে গোমাংস-সরবরাহের ব্যবস্থার কথা কখনো ওঠেনি, সুতরাং এ-দাবিতে বিস্মিত হলাম এবং তাদেরকে সেকথা বললাম। বিষয়টি ভেবেচিন্তে পরে আবার আলোচনা করবো বলে তাদের বিদায় দিলাম। দিন দুই পরে হলের অফিসে বসেই আলোচনা হলো। দেখলাম, যারা দাবি করছে, তারা বেশ সংগঠিত এবং ব্যাপারটি কেবল বিশেষ খাদ্যপ্রীতি থেকে উদ্ভূত হয়নি। হাউজ-টিউটর এবং আরো কিছু ছাত্রের সঙ্গে আলোচনা হলো।
মেসের ব্যবস্থাপনা যেহেতু ছাত্রদের হাতে, তাই তাদের মতের প্রতিকূলে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া চলে না। ঘটনাক্রমে দেখা গেল, কিছু মুসলমান ছাত্র গোমাংস খাওয়ার পক্ষপাতী নয়। তখন দুটি মেস চালু করার সিদ্ধান্ত হলো : একটিতে গোমাংস চলবে, অন্যটিতে তা থাকবে না।
৬.
ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখে রাষ্ট্রীয় সফরে বঙ্গবন্ধু গেলেন কলকাতায়। সেখানে। তিনি অভূতপূর্ব সংবর্ধনা পেলেন। কলকাতার জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে জাতীয়তাবাদ কথাটা যোগ করলেন তিনি। এই সফরের সময়েই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে আলোচনাক্রমে স্থির হয় যে, ২৫ মার্চের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবে। ১৯৭১ সালে যারা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, ইতোমধ্যে তাঁদের অনেকেই আবার এই সেনাদের প্রত্যাবর্তনের জন্যে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছিলেন। আবার অনেকে মনে করলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পুরোপুরি গঠিত না হয়ে থাকলেও, ভারতীয় সৈন্যদের স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তাকে স্বচ্ছ করে তুলবে।
ফিরতি সফরে ইন্দিরা গান্ধি ঢাকায় এলেন ২৭ মার্চে। ঢাকায় তার নাগরিক সংবর্ধনাও জমকালো হয়েছিল। রেসকোর্সে বড়ো মঞ্চ তৈরি হলো, বিশাল জনসভা হলো। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে অল্পসংখ্যক সংস্কৃতিকর্মীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বঙ্গভবনে। ইন্দিরা গান্ধি বেশ সলজ্জভাবে কথা বলছিলেন ও চলাফেরা করছিলেন। আমার অনুরোধে আমন্ত্রিতদের পক্ষ থেকে কবীর চৌধুরী ভাষণ দিলেন–সংক্ষিপ্ত, মনোজ্ঞ ও উদীপ্ত। ইন্দিরাও জবাবে সুন্দর বললেন। তার এই সফরের সময়েই ভারত বাংলাদেশের মধ্যে ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি হয়। এই চুক্তি নিয়ে যত সমালোচনা হয়েছিল, চুক্তি তার সামান্য ভাগও কার্যকর হয়নি।
তার আগে একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এসেছিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা একাডেমিতে বিকেলে যে-সভা হলো, তাতে নির্ধারিত কর্মসূচির বাইরেই বক্তৃতা করলেন এম এ জি ওসমানী, কে এম সফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, মীর শওকত আলী, সি আর দত্ত প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা-কর্মকর্তা। জনসাধারণের তুমুল হর্ষধ্বনি আর স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রকাশে মনে হচ্ছিল, আমরা সবাই এক হয়ে গেছি, এক হয়ে আছি, এক হয়েই থাকবো।
৭.
ড. কামাল হোসেন এত্তেলা পাঠালেন : বাংলাদেশের সংবিধান-রচনার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। তিনি খসড়া তৈরি করবেন ইংরেজিতে, আমাকে তার বাংলা করে দিতে হবে, শেষ পর্যন্ত বাংলাটাই গৃহীত হবে প্রামাণ্য ভাষ্য বলে। বললাম, একা পারবো না, একটা দল চাই। তিনি বললেন, আপনি লোক বেছে নিন।
প্রথমেই যার কথা আমার মনে হয়েছিল, সে নেয়ামাল বাসির। সে আমার আবাল্য বন্ধু, বাংলা-উর্দু-ফারসিতে তার অগাধ অধিকার, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সে ছিল দোভাষী, ওই পরিষদের দপ্তর ঢাকায় চলে আসার পরে হয়েছে সহকারী বিতর্ক-সম্পাদক। ভাষাজ্ঞানের সঙ্গে সংসদীয় বিষয়ে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সংবিধান-রচনায় কাজে আসবে। নেয়ামালকে প্রস্তাবটা দিতেই সে রাজি হয়ে গেল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আর কাকে সঙ্গে পাওয়া যায়? সে তার এক সহকর্মীর কথা বললো, ভদ্রলোকের নাম বোধহয় এ কে এম শামসুদ্দীন। স্থির হলো, আমরা তিনজনে মিলে কাজটা করবো।
মনে পড়ে, আইনমন্ত্রীর দপ্তরে এক দুপুরে কামাল আর আমি মুখোমুখি বসে। প্যাডের কাগজে খসখস করে কামাল লিখতে শুরু করলেন সংবিধানের প্রস্তাবনা! এক স্লিপ লেখা হলে সাদা কাগজের সঙ্গে সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি অনুবাদ করতে শুরু করলাম। একটা অনাস্বাদিত শিহরণ জাগলো দেহে-মনে : এই আমার স্বাধীন দেশ, তার সংবিধান-রচনার কাজে হাত দিয়েছি।
কামালকে বললাম, অনুবাদটা মাজাঘষা করতে হবে, বাড়ি নিয়ে যাই। তিনি বললেন, মূলটারও কিছু উন্নতি ঘটাতে হবে, কাল আবার বসবো একসঙ্গে।
১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসলো। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে যারা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই এর সদস্য। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ শহীদ হয়েছেন; পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে জহিরুদ্দীন, ফয়জুল হক, ওবায়দুল্লাহ মজুমদার, এস বি জামানের মতো কয়েকজন দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন–তাঁরা আর সদস্য নন গণপরিষদের। তাও চার শতাধিক সদস্য। গণপরিষদের অধিবেশনের শুরুতেই কয়েকটি কমিটি গঠিত হলো, তার মধ্যে শাসনতন্ত্র কমিটি’ একটি। আইন ও সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী কামাল হোসেন তার সভাপতি, আর সদস্য ৩৩ জন। তারা হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমাদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, আব্দুর রহিম, আবদুর রউফ, মোহাম্মদ লুতফর রহমান, আবদুল মমিন তালুকদার, আবু সাইয়িদ, মোহাম্মদ বয়তুল্লাহ, আমীরউল ইসলাম, বাদল রশীদ, খোন্দকার আবদুল হাফিজ, নূরুল ইসলাম মনজুর, শওকত আলী খান, হুমায়ূন খালিদ, আছাদুজ্জমান খান, এ কে মোশারাফ হোসেন আকন্দ, আবদুল মমিন, শামসুদ্দীন মোল্লা, আবদুর রহমান, ফকির শাহাবুদ্দীন আহমদ, আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী, খোরশেদ আলম, সিরাজুল হক, দেওয়ান আবুল আব্বাছ, হাফেজ হাবীবুর রহমান, আবদুর রশীদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, নূরুল ইছলাম চৌধুরী, মোহাম্মদ খালেদ, রাজিয়া বাণু ও ডা. ক্ষিতীশচন্দ্র মণ্ডল। রাজিয়া বাণু ছিলেন একমাত্র মহিলা সদস্য, আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন বিরোধী দলীয় একমাত্র সদস্য–তিনি তখন ছিলেন মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে। শাসনতন্ত্র কমিটির প্রথম বৈঠক হয়েছিল ১৭ এপ্রিলে।
সংবিধানের কাজে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে পনেরো দিন আমি ঢাকায় থেকেছি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাশে পুরো সময়টাই কাটিয়েছি ঢাকায়। এক-আধবার ছাড়া সড়কপথে নিজেই গাড়ি চালিয়ে সপরিবারে আসা-যাওয়া করেছি। গণপরিষদ-ভবনে–পরে যা রূপান্তরিত হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে–আমাকে একটা কক্ষ বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেখানেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেটেছে। কখনো বেশি রাত হয়ে গেলে কামালের বাড়ির বসার ঘরে শুয়ে বাকি রাত যাপন করেছি, সকালে সে বাড়িতেই নাশতা করে দ্রুত চলে এসেছি গণপরিষদে।
কমিটির বৈঠকে কামালের ইংরেজি ভাষ্য এবং আমাদের অনুবাদ গণপরিষদের সচিবালয়ের মারফত বি জি প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়ে উপস্থাপিত হতো। কমিটির সদস্য না হয়েও আমি প্রতি বৈঠকে উপস্থিত থেকেছি, অনেক সদস্যের উপস্থিতির হার তুলনায় অনেক কম ছিল। মন্ত্রীদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক আহমাদ ও এইচ এম কামারুজ্জামান খুব কমই আসতেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ আসতেন মাঝে মাঝে। তাজউদ্দীন যেদিন আসতেন, সেদিন আলোচনায় যোগ দিতেন সাগ্রহে। কোনো কমিটিতেই সব সদস্য অংশ নেন না–এটিও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
সংবিধানের বিষয়ে পরামর্শ দিতে বঙ্গবন্ধু দুবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন কামালকে–সঙ্গে আমিও ছিলাম। তাঁর প্রথম বক্তব্য ছিল রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সংযোগ ছিন্ন করার একটা বিধান থাকতে হবে সংবিধানে। ১২ অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে কিছুটা বলা হয়েছিল, তবে বঙ্গবন্ধু যা চেয়েছিলেন, তা সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্ত অংশে রূপ পেয়েছিল। দ্বিতীয়বারে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান-আমলে সরকার অস্থিতিশীল হয়েছিল মূলত পরিষদ-সদস্যদের দলবদলের ফলে কিংবা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে দলের বিপক্ষে ভোটদানের ফলে। এটা বন্ধ করা দরকার। নির্বাচিত সদস্য যদি দলের কোনো সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হন কিংবা কোনো ক্ষেত্রে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তাহলে তার পদত্যাগ করা উচিত হবে কিংবা তার সদস্যপদ চলে যাবে–এমন একটা নিয়ম করা দরকার। তবে এমন ক্ষেত্রে তিনি উপনির্বাচনে বা পরবর্তী কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হবার অযোগ্য হবেন না, সে-ব্যবস্থাও থাকতে হবে। এই অভিপ্রায়ই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে প্রকাশ পেয়েছিল।
১২ অনুচ্ছেদের বিধান নিয়ে শাসনতন্ত্র কমিটিতে বেশ বিতর্ক হয়েছিল। চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সম্পাদক মোহাম্মদ খালেদ এবং আরো দু-একজন সদস্য কথাটা উঠিয়েছিলেন। তারা বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছিলেন যে, মুসলমান হিসেবে তারা এক অখণ্ড জীবনবিধানের অধীন–সেখানে ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করা চলে না, তাদের রাজনৈতিক জীবনও ধর্মবিশ্বাস দ্বারা। পরিচালিত। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, বাংলাদেশকে তারা ধর্মীয় রাষ্ট্ররূপে দেখতে চান। বাংলাদেশে পালিত ধর্মের মধ্যে রাষ্ট্র কোনো পক্ষপাত করুক কিংবা ধর্মীয় কারণে নাগরিকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য ঘটুক, তা তাঁদের অভিপ্রায় নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিষয়ে–যেমন, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে–তাঁরা ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারাই পরিচালিত হতে চান। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অধিকাংশের মত তারা মেনে নিয়েছিলেন।
তর্ক প্রবল হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্তকরণের প্রশ্নে। এতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আছাদুজ্জামান খান। ৪২ অনুচ্ছেদে ক্ষতিপূরণ দিয়ে বা না দিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষে সম্পত্তি অধিগ্রহণের বিধান করা হয়েছিল এবং সেই বিধানের আওতায় প্রণীত আইনে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই বলে বা ক্ষতিপূরণ অপর্যাপ্ত হয়েছে বলে তেমন আইনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছিল। এ-বিষয়ে যারা আপত্তি তুলেছিলেন, তাঁরা বলেছিলেন যে, বিনা ক্ষতিপূরণে সম্পত্তির অধিগ্রহণ মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী; তাছাড়া নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে রাষ্ট্র যদি সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে, তাহলে সম্পত্তির মালিকের আদালতে সুবিচার প্রার্থনা করার অধিকারও থাকা দরকার–এই অধিকারও তার মৌলিক অধিকার বলে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত মেনে না নিয়ে কমিটিতে তারা ভিন্নমতপোষক লিখিত মন্তব্য দিয়েছিলেন কার্যবিবরণীর অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে। পরবর্তীকালে, মনে হয়, কামাল বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে এসব সদস্যকে বুঝিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করা থেকে তাঁদের বিরত করেছিলেন।
সংবিধান-রচনার কাজে সাহায্য হবে মনে করে বিচারপতি এফ কে এম মুনীমকে আইন-সচিব নিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি মনে করেছিলেন যে, প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগ অংশে যেসব বিধান করা হচ্ছে, তাতে উচ্চমেধাসম্পন্ন ব্যক্তিরা প্রজাতন্ত্রের কর্মে যোগ দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এবং পাকিস্তানে সিভিল সার্ভিসের সদস্যেরা যেমন জ্যোতির্ময় ছিলেন, আমাদের সিভিল সার্ভিস সে-তুলনায় হীনপ্রভ হয়ে পড়বে। কামাল তাঁকে বলেছিলেন যে, উচ্চমেধাসম্পন্নেরা সিভিল সার্ভিসে যোগ না দিয়ে পেশাগত জীবনে গেলে দেশ বেশি উপকৃত হবে।
কামাল খসড়া তৈরি করে যাচ্ছিলেন আর আমরা অনুবাদ করে যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে বাংলা ভাষ্যের প্রয়োজনে কামাল তার ইংরেজি বাক্য বা তার বিন্যাস পরিবর্তন করতেন। নেয়ামালের পটুত্ব খুব কাজে এসেছিল। শব্দের উদ্ভাবনে তার নৈপুণ্য ছিল। ওমবুড়সম্যানের প্রতিশব্দ ন্যায়পাল তারই তৈরি। তবে তার মধ্যে এক ধরনের রক্ষণশীলতা ছিল। যেমন, ইংরেজিতে বহুবচন থাকলে বাংলায় সে বহুবচনই ব্যবহার করবে; মূলে যদি পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্স থাকে, তাহলে অনুবাদে সে সংসদ-বিষয়াবলি করবে, কিছুতেই সংসদ-বিষয়ক করতে রাজি হবে না। সে বারবার বলতো, দেখো, এক জায়গায় গিয়ে তুমি হয়তো দেখবে, বাংলায়ও বহুবচন ব্যবহার না করে উপায় নেই, তখন কী হবে? ইংরেজির বহুবচন বাংলায় কোথাও একবচন করবো, আবার কোথাও বহুবচন করবো, এতে সংগতি থাকে না। তবে সংবিধানে সে আরো বাংলা পারিভাষিক শব্দ ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিল, আমিও ছিলাম। কিন্তু শাসনতন্ত্র কমিটিতে আমি সেগুলোর অনুমোদন নিতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। শাসনতন্ত্রের বদলে সংবিধান শব্দটা গ্রহণ করাতেই আমাকে বেগ পেতে হয়েছিল। তা যখন গৃহীত হলো, তখন কমিটিও পরিচিত হলো সংবিধান প্রণয়ন কমিটি বলে। স্পিকারের প্রতিশব্দ হিসেবে কেউ অধ্যক্ষ মেনে নিতে চাইলেন না। একজন বললেন, ওতে মফস্বল কলেজের অধ্যক্ষ মনে হয়। তিনি নিজেই মফস্বল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, তুমুল হাস্যরোল আর করতালির মধ্য দিয়ে তার কথা প্রায় সকলেই অনুমোদন করেছিলেন। সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরে এর ভাষার আলোচনায় আবুল মনসুর আহমদ ইত্তেফাঁকে লিখেছিলেন, পার্লামেন্টারি ডিমোক্রেসির কনসেপ্টটাই পাশ্চাত্যের, তাই ইংরেজি পরিভাষা ব্যবহার করলে দোষ হতো না, বরঞ্চ জাতীয় সংসদ না বলে পার্লামেন্ট কিংবা রাষ্ট্রপতি না বলে প্রেসিডেন্ট বলাই আমাদের উচিত ছিল। আমরা যতদূর পারি, একই ইংরেজি শব্দের জন্যে একই বাংলা শব্দ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলাম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিপ্রেক্ষিত-অনুযায়ী অবশ্য ভিন্ন শব্দ প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম।
কামাল হোসেন এক পর্যায়ে স্থির করলেন, তার ইংরেজি খসড়ার চূড়ান্ত রূপদানের জন্যে একজন পেশাদার আইনি খসড়া-প্রণেতার-ইংরেজিতে যাকে legislative draftsman বলা হয়, তেমন একজনের–সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। দেশে তেমন কেউ ছিলেন না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রাইভেট মেম্বারস বিল তৈরি করতো একটি আইনি প্রতিষ্ঠান। তার এক সদস্যকে এই কাজে নিযুক্ত করা হলো কমনওয়েলথ সচিবালয়ের সৌজন্যে। রবার্ট গাথরি ছিলেন একজন আইরিশ আইনজীবী। ভালো মানুষ এবং স্বভাবত পরিশ্রমী। তবে আমাদের দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তেমন ধারণা তার ছিল না। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ শুনে কামাল যখন ৩৮ অনুচ্ছেদের সঙ্গে একটা শর্ত জুড়ে দিলেন, তখন গাথরি আমাকে বললেন, ‘ইট’স স্টিফলিং দি অপপাজিশন’। পাকিস্তান-আমলে ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহার সম্পর্কে আমি তাঁকে অবহিত করলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ধর্মের নামে কেমন সব অত্যাচার হয়েছে, তাও জানালাম, কিন্তু তাতে তাঁর মনের দ্বিধা কাটেনি। তবে যেহেতু তাঁকে একটা বিশেষ পেশাগত কাজ করতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, সে-কাজটি তিনি যত্নের সঙ্গেই করে গেলেন। বাংলা পাঠের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। তাই তিনি আমাকে একাধিকবার বলেছিলেন যে, ইংরেজি ভাষ্যের বাংলা রূপান্তরে অসুবিধে হলে আমি যেন তাঁকে জানাই, তিনি তা পুনর্লিখন করে দেবেন। এক-আধবার তেমন। করেও দিয়েছিলেন।
সংবিধান-রচনার প্রথম পর্যায় থেকেই সকল রাজনৈতিক দলের এবং অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রস্তাব, পরামর্শ বা মতামত চাওয়া হয়েছিল, পাওয়াও গিয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিল এবং তা নিয়ে তার নেতাদের সঙ্গে কামাল আলাপও করেছিলেন। বিচার বিভাগের অংশটা প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে দেখানো হয়েছিল। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে একটি সুপ্রিম কোর্ট-গঠনের ধারণা তার ভালো লাগেনি; তিনি চেয়েছিলেন, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট আলাদা থাকবে। বাংলা ভাষ্যে জাস্টিস শব্দের বাংলা করা হয়েছিল বিচারপতি, কিন্তু যেখানে সুপ্রিম কোর্টের জাজ বলা হয়েছে, সেখানে আমরা বিচারক করেছিলাম। বিচারপতি সায়েম চাইলেন, বাংলায় উভয় ক্ষেত্রেই বিচারপতি শব্দের প্রয়োগ করা হোক। আমি তাকে বললাম, জাজ ও জাস্টিস শব্দের পার্থক্যরক্ষার খাতিরে যথাক্রমে বিচারক ও বিচারপতি করা হয়েছে এবং সে-পার্থক্য থাকা দরকার। তিনি বললেন, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা সর্বত্র বিচারপতি বলে। পরিচিত, তুমি তাদের মর্যাদা কমাতে চাও? আমি আর তর্ক করিনি, তবে তাঁর কথা মেনেও নিইনি। কিন্তু তার অপ্রসন্নতা দূর হয়নি। বহুকাল পরেও তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না, তুমি বিচারপতিকে বিচারক করে দিয়েছে।’ তার সঙ্গে আমাদের দূরসম্পর্কের একটা আত্মীয়তাসূত্র ছিল, তিনি আমাকে আবাল্য দেখে আসছেন, সুতরাং আমাকে তিরস্কার করার অধিকার তাঁর ছিল। সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ এবং আরো কারো কারো সঙ্গেও সংবিধানের খসড়া নিয়ে কামাল হোসেন আলাপ করেছিলেন।
সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির সদস্য নন, মন্ত্রিসভার এমন সদস্যদের সঙ্গেও সংবিধানের খসড়া নিয়ে একদিন বৈঠক হয়েছিল। তাতে মহম্মদ আতাউল গনী ওসমানী উপস্থিত ছিলেন, তিনি তখন মন্ত্রী। ৪৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ও কর্তব্য যেখানে নির্দেশ করা হয়েছে, সেখানে তিনি যোগ করার প্রস্তাব দিলেন যে, রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাকে কমিশন করবেন অর্থাৎ কর্মভার দেবেন। কামালের এতে প্রবল আপত্তি। তিনি বললেন, এটি রাষ্ট্রপতির নিত্যনৈমিত্তিক নির্বাহী দায়িত্বের অন্তর্গত এবং তা সংবিধানে লিপিবদ্ধ হওয়ার মতো বিষয় হতে পারে না। ওসমানী খুব ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়লেন, ইংরেজিতে বললেন, রাজার স্বাক্ষরিত একটা পার্চমেন্টই তো একজন সেনা কর্মকর্তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি–এটার প্রেরণায়ই সে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিতে যায়। আমাদের দেশেও তো রাষ্ট্রপ্রধান এই কাজটি করেন, ভবিষ্যতেও করবেন। সংবিধানে তা লিখতে আপত্তি কেন? দেশের জন্যে যারা প্রাণ দিতে প্রস্তুত, ওতে তাদের মর্যাদা একটু বৃদ্ধি পাবে মাত্র। পরে কারো কাছ থেকে সমর্থন না পেয়ে ওসমানী চুপ করে গেলেন। এক সময়ে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘প্রফেসর, আপনি সশস্ত্রবাহিনী, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এসব শব্দ ব্যবহার করেছেন, বাহিনী ছাড়া ফোর্সেস বোঝাতে আর কোনো বাংলা শব্দ নেই?’ আমি একটু বিচলিতই হলাম। বললাম, এগুলো বাংলায় বহুব্যবহৃত শব্দ–এর বিকল্পের কথা ভাবিনি।’ এবার উনি আসল কথাটি বললেন, ‘লালবাহিনী নীলবাহিনী শুনতে শুনতে এখন কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। এদের যদি বাহিনী বলা হয়, তবে আর্মড ফোর্সেসকে সশস্ত্রবাহিনী বললে তাদের অপমান করা হবে।’ লালবাহিনী ছিল শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগের একটি সংগঠন–অঙ্গসংগঠন ঠিক নয়, কিন্তু তার নেতা আবদুল মান্নানের প্রচণ্ড দাপট ছিল। গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, এক লক্ষ সদস্য নিয়ে লালবাহিনী গড়ে তোলা হবে। লালবাহিনী তখনই এখানে-ওখানে অন্যায় কর্তৃত্ব ফলাতে শুরু করেছিল।
সংবিধানের যে-মূল কপিতে গণপরিষদের সদস্যেরা স্বাক্ষরদান করবেন, কামাল চেয়েছিলেন, তা বাংলা হস্তাক্ষরে লিখিত হবে এবং দেশীয় ধাচে অলংকৃত হবে। হাতে লেখার জন্যে আমি এ কে এম আবদুর রউফের নাম প্রস্তাব করলাম। রউফ এক সময়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন প্রশিক্ষণ নিতে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি দেশের কাজে লেগে পড়েন, স্বাধীনতালাভের পরে লন্ডনে আমাদের হাই কমিশনে কর্মরত ছিলেন। তাঁকে সেখান থেকে আনাতে হবে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, অলংকরণের দায়িত্ব জয়নুল আবেদিন নেবেন। কামাল বললেন, রউফের বিষয়টি আবেদিন সাহেবকে জিজ্ঞেস করে নিলে ভালো হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে এক সকালে জয়নুল আবেদিন এলেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। তার সঙ্গে হাশেম খান, জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায়চৌধুরী, আবুল বারক আলভী প্রমুখ কয়েকজন শিল্পী ছিলেন। তিনি বললেন, পুস্তানিতে নকশি কাঁথার অলংকরণ থাকবে, শিল্পীরা প্রতি পৃষ্ঠার চারপাশ অলংকৃত করে দেবেন। রউফের নাম তিনি অনুমোদন করলেন, ওই অলংকৃত পাতার মধ্যে তার হস্তাক্ষরে সংবিধানের পাঠ লিখিত হবে। পরে তাই হয়েছিল। অলংকরণ করেছিলেন হাশেম খান, জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায়চৌধুরী ও আবুল বারক আলভী। রউফ বহু পরিশ্রম করে পুরো সংবিধান হাতে লিখেছিলেন। তাঁর লেখা প্রতি পৃষ্ঠা আমি দেখে দিয়েছিলাম, একটা বর্ণলোপের জন্যে তাঁকে গোটা পাতা নতুন করে লিখতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এই হাতে-লেখা কপিতে সদস্যেরা (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্রনারায়ণ লারমা ছাড়া–এ-প্রসঙ্গে পরে বলব) স্বাক্ষর করেছিলেন এবং বি জি প্রেসে তার পাঁচ শ কপি ছাপিয়ে চামড়ার বাঁধাই করা হয়েছিল। চর্মশিল্পের কাজ করেছিলেন শাহ সৈয়দ আবু শফি। তিনি বেবীর দূরসম্পর্কের মামা, চামড়ার কাজ শিখেছিলেন শ্রীনিকেতনে। চর্মশিল্পী হিসেবে তাকে আবিষ্কার করেছিলেন হামিদা হোসেন–দারিদ্র্য ও দুর্ভাগ্যপীড়িত জীবনে তিনি যতটুকু কর্মসংস্থান ও সম্মানলাভ করতে পেরেছিলেন, তাও সম্ভবপর হয়েছিল হামিদার জন্যে।
৮.
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাবার কথা চলছে। ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, সরকারি নীতিনির্ধারক–সকলেই চাইছেন, এ-ক্ষেত্রে একটা দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হোক। সেই যে জানুয়ারি মাসে শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তরে একটা সভা হয়েছিল আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে, তখনই কথা হয়েছিল, যতশীঘ্ৰসম্ভব একটা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হবে। কিন্তু তা আর হয়ে উঠছে। না। শিক্ষাসচিব ড. এ আর মল্লিক কয়েক সপ্তাহ কাজ করে ভারতে আমাদের হাই কমিশনার নিযুক্ত হয়ে দিল্লি চলে গেলেন মার্চ মাসে (ইন্দিরা গান্ধির বাংলাদেশ সফরকালে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন), নতুন সচিব হলেন এ এন এম ইউসুফ। শিক্ষা কমিশনের বিষয়ে সরকারের উচ্চবাচ্য নেই। ওদিকে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ দাবি করেছে, শিক্ষা কমিশনে ছাত্র-প্রতিনিধি থাকতে হবে। শোনা যায়, সরকার এ-দাবি মানতে পারছে না, আবার ছাত্রসমাজকে অসন্তুষ্ট করেও কমিশন-গঠনের ঘোষণা দিতে পারছে না।
এর মধ্যে মাদ্রাসা-শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আকস্মিকভাবেই যেন হইচই পড়ে গেল। এপ্রিল মাসের শেষদিকে মুদাররেসিনের এক প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মাদ্রাসা-শিক্ষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁদের উদবেগের কথা জানালেন। বঙ্গবন্ধু তাঁদের এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, মাদ্রাসা-শিক্ষা বিলোপ করা হবে না, প্রয়োজনীয় কারিগরি বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা যোগ করে মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিতে কিছু রদবদল করা হবে মাত্র। বঙ্গবন্ধু আরো বললেন যে, সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রেরা যাতে কুরআন-হাদিস সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানলাভ করে, তারও ব্যবস্থা করা হবে। এ-রকম নীতিগত ঘোষণা তিনি হঠাৎ করে কেন দিলেন, তা ভেবে পেলাম না। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে তো একই ভাষামাধ্যমে একই পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা-প্রবর্তনের বিষয়ে একটা মতৈক্য হয়েছিল। পরে শুনলাম–সত্যমিথ্যা জানিনা–মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ মাদ্রাসা-শিক্ষকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের ব্যবস্থা করেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে বোঝান যে, মাদ্রাসা-শিক্ষাব্যবস্থা বহাল রাখতে হবে, নইলে দেশের গ্রামাঞ্চলে এমন প্রতিক্রিয়া হবে যে, সরকার সামাল দিতে পারবেন না। মাদ্রাসা-শিক্ষা বহাল রাখতে যে বড়োরকম তৎপরতা চলছে, তা বোঝা গেল কয়েকদিন পরে মওলানা ভাসানীর এক বক্তৃতায়। তিনি সরকারকে সম্বোধন করে বললেন, চারমাস হয় দেশ স্বাধীন হয়েছে; সরকার, তুমি মাদ্রাসা-শিক্ষার কিছু করো নাই। ব্রিটিশ সরকার এদেশের মানুষের ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, আর বাংলাদেশ সরকার সে-ব্যবস্থা চালু রাখতে পারবে না? আমাদের ধর্মীয় শিক্ষার ভার আমাদের সরকারকেই বহন করতে হবে। কয়েকদিনের মধ্যে আবার মওলানা ভাসানী অবিলম্বে মাদ্রাসা-শিক্ষা চালু করার দাবি জানালেন এবং ন্যাপ ও সিপিবি যে ধর্ম মানে না, দেশবাসীকে তাও জানিয়ে দিলেন (এই বক্তৃতাতেই তিনি সেই বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন : ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে আমি বন্দি ছিলাম’)। শিক্ষা কমিশন গঠনের আগেই শিক্ষানীতি সম্পর্কে যে রাজনৈতিক চাপের সৃষ্টি হতে শুরু হয়েছে, এ-বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ রইল না।
মে মাসের মাঝামাঝি সংবাদপত্র থেকে জানা গেল যে, সরকার শিক্ষা কমিশন গঠন করেছে। ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা তার সভাপতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. সুরাত আলী খান সহ সভাপতি এবং অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সদস্য-সচিব। আর কোনো সদস্যের নাম প্রকাশ করা হয়নি। লোকপরম্পরায় শুনছি, আমিও একজন সদস্য, কিন্তু আমার কিছু জানা নেই। বোঝা যায়, শিক্ষা কমিশন নিয়ে সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে এবং ওই সংক্ষিপ্ত সংবাদ প্রকাশের পরে কমিশনে ছাত্র-প্রতিনিধি নেওয়ার দাবি প্রবল হওয়ায়, অনুমান করা যায় যে, এই বিষয়টি রয়েছে টানাপোড়েনের মূলে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলো ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই। কমিশনের গঠন নিম্নরূপ :
সভাপতি : ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা; সহ-সভাপতি : ড. সুরাত আলী খান; সদস্য-সচিব : অধ্যাপক কবীর চৌধুরী; পূর্ণকালীন সদস্য : অধ্যাপক এম ইউ আহমদ (অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, পূর্ব পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন) ও জনাব মাহমুদ মোকাররম হোসেন (অধ্যক্ষ, কে বি এম কলেজ, দিনাজপুর); খণ্ডকালীন সদস্য : জনাব আব্দুর রাজ্জাক (অধ্যক্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়); অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী (অধ্যক্ষ, ফলিত রসায়ন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়); ড. আবদুল হক (গণপরিষদ সদস্য এবং প্রাক্তন অধ্যক্ষ, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়); ড. আনিসুজ্জামান (অধ্যক্ষ, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়); ড. স্বদেশরঞ্জন বসু (গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন-অর্থনীতি ইনসটিটিউট, ঢাকা); ডা. নূরুল ইসলাম (পরিচালক, স্নাতকোত্তর চিকিৎসা ইনসটিটিউট, ঢাকা); ড. এম শামসুল ইসলাম (অধ্যক্ষ, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ); ড. আ মু জহুরুল হক (অধ্যক্ষ, তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়); অধ্যাপক সিরাজুল হক (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়); শ্ৰীমতী বাসন্তী গুহঠাকুরতা (প্রধান শিক্ষয়িত্রী, মনিজা রহমান বালিকা বিদ্যালয়, ঢাকা); অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান (অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ); ড. মযহারুল ইসলাম (মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি); ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন (পরিচালক, শিক্ষা-সম্প্রসারণ কেন্দ্র, ঢাকা); ড. মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ (অধ্যক্ষ, বাণিজ্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়); শ্রীমতী হেনা দাস (প্রধান শিক্ষয়িত্রী, নারায়ণগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়), জনাব আশরাফউদ্দীন খান (সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি)।
কমিশন তো গঠিত হলো, কিন্তু এর কাজ আর শুরু হয় না। অথচ ছ মাসের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট এবং এক বছরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দেওয়ার কথা। শোনা গেল, প্রধানমন্ত্রী কমিশন উদ্ববাধন করবেন, কিন্তু তিনি সময় করে উঠতে পারছেন না। মনে হলো, যে-টানাপোড়েনের কথা আগে ভেবেছি, সে-কারণেই বোধহয় অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে না। কমিশনে ছাত্র-প্রতিনিধি গ্রহণের অব্যাহত দাবির মুখে শিক্ষামন্ত্রী একদিন ঘোষণা করলেন যে, শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট ছাত্রসমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে সরকার তা অনুমোদন করবে না। গ্রহণযোগ্য হওয়া না-হওয়ার যৌক্তিক ভিত্তির কথা কেউ মুখে আনলেন না।
অবশেষে ১৯৭২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন উদ্ববাধন করলেন। তিনি খুব আবেগময় বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সমাজতান্ত্রিক সমাজগঠনের স্বপ্নের কথা বলেছিলেন এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেন তেমন সমাজের উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করতে সমর্থ হয়, সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। বক্তৃতা শেষ করে তিনি জানতে চাইলেন, আমাদের কারো কিছু বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য আছে কি না। প্রথমটায় আমি চুপ করে ছিলাম, কিন্তু কেউ কিছু বলছেন না দেখে উঠে দাঁড়ালাম। আমি বললাম, আমার একটি প্রশ্ন ও একটি দাবি আছে। প্রথম কথা, সরকার শিক্ষাখাতে জাতীয় আয়ের কত শতাংশ বরাদ্দ করতে পারবেন, তা যদি আমরা জানতে পারি, তাহলে আমাদের পক্ষে শিক্ষানীতি তৈরি করা সহজ হয়। দ্বিতীয় কথা, শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ছাত্রসমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে কমিশনের রিপোর্ট সরকার গ্রহণ করবে না। কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করা বা প্রত্যাখ্যান করার অধিকার সরকারের আছে। কিন্তু আমরা এই প্রতিশ্রুতি চাই যে, আমাদের রিপোর্ট–তাতে দ্বিমতপোষক মন্তব্য থাকলে সেসব সুদ্ধ–জনসাধারণ্যে প্রকাশ করা হবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, টাকাপয়সার কথা আপনারা ভাববেন না। দেশের জন্য যেটা ভালো মনে করবেন, তেমন শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ করবেন। আমি ধার করে হোক, ভিক্ষা করে হোক, টাকা জোগাড় করব। অর্থের অভাবে উপযুক্ত শিক্ষা যদি মানুষ না পায়, তাহলে তো সে স্বাধীনতার ফললাভ থেকেই বঞ্চিত হবে। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের ভূমিকায়–যা আমরা সই করেছি–কিন্তু তাঁর সেদিনের এ কথাগুলো নেই, বরং তার মুখে যা বসানো হয়েছে, তা তিনি তখন বলেননিঃ আমাদের সীমিত সম্পদের কথা স্মরণ রেখে কমিশন এমন এক দীর্ঘমেয়াদী রূপরেখা প্রণয়ন করবেন যা শিক্ষাক্ষেত্রে সার্থক ও সুদূরপ্রসারী সংস্কার সাধনে সাহায্য করবে। এই অসংগতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেও কমিশনে আমি কোনো ফল পাইনি। শুনেছি, কমিশন যখন প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করতে যায় (সেদিন আমি উপস্থিত ছিলাম না), তখন সীমিত সম্পদের কথা উঠেছিল।
আমার দ্বিতীয় বক্তব্যের জবাবে বঙ্গবন্ধু সহাস্যে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার এমন এক সরকার যার কিছুই গোপন থাকে না। এমনকী যে-বিষয় গোপন থাকা উচিত, তাও প্রকাশ পেয়ে যায়। সুতরাং রিপোর্ট প্রকাশের বিষয়ে আপনারা চিন্তা করবেন না।’ আমি আবার উঠে বললাম, ‘না, সেরকম প্রকাশের কথা নয়, সরকারিভাবে ছেপে প্রকাশ করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু একটু অধৈর্য হয়েই বললেন, ‘হবে, হবে, মুদ্রিতরূপে হবে।’
চা খাওয়ার সময়ে বঙ্গবন্ধু আমাকে ডাকলেন, জানতে চাইলেন, আমি এখন কী করছি। আমি একটু অবাক হয়ে দ্রুত জানালাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। তিনি বললেন, আমি বলছি, চট্টগ্রামে কী করছ? ঢাকায় অনেক কাজ পড়ে আছে–ঢাকায় চলে এসো।’ আমি আমতা আমতা করছি দেখে তিনি বললেন, আমি চাই, বাংলায় অনেক কাজ হোক। আমাদের রাষ্ট্রদূতরা যেসব ক্রিডেনশিয়াল দেয় বিদেশে, আমি চাই, সেসব বাংলায় লেখা হবে। তাছাড়া আরো অনেক কাগজপত্র বাংলায় হতে হবে। কনসটিটিউশনের কাজ শেষ হলে এসব কাজে তোমাকে হাত দিতে হবে। এই বলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে তাঁর কাছে ডেকে আনালেন। তাঁকে বললেন, ‘সার, আনিসুজ্জামানকে আমার দরকার। আপনি ওকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করুন।’ মুজাফফর আহমদ চৌধুরী বললেন, ‘আমি ওঁকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেই আনতে চাই। মাঝখানে আমি শুধু ক্ষীণকণ্ঠে বলতে পারলাম, চট্টগ্রামে থেকেও তো আমি সংবিধানের কাজ করছি, বাজেট ও প্ল্যানিংয়ের কাজে সাহায্য করছি।’ কথাটা ওখানেই শেষ হলো।
এরপরে গ্রিন রোডের একটা বাড়িতে শিক্ষা কমিশনের কাজ শুরু হয়। কমিশনের কার্যকালে এর গঠনে যে-পরিবর্তন ঘটে, এখানে তারও উল্লেখ করা দরকার। অধ্যাপক মোহাম্মদ ফেরদাউস খান পূর্ণকালীন সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের মার্চে, সে-বছর জুলাই মাসে কবীর চৌধুরী শিক্ষা-সচিব নিযুক্ত হলে ফেরদাউস খান কমিশনের সদস্য-সচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের মে মাসের শেষে সুরাত আলী খানের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। সে-বছর জুনে অধ্যাপক মোহাম্মদ নূরুস সাফা (ঢাকার উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান) এবং নভেম্বরে পাকিস্তান-প্রত্যাগত অধ্যাপক এম এ সাত্তার (সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের প্রাক্তন কারিগরি শিক্ষা পরিচালক) পূর্ণকালীন সদস্য নিযুক্ত হন। আমার এক সময়ে মনে হয়েছিল যে, শিক্ষা বিভাগের যেসব কর্মকর্তাকে সরকার অন্য কোথাও নিয়োগদান করতে পারছে না, শিক্ষা কমিশনই তাদের একমাত্র ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। শিক্ষা কমিশনের কর্মকর্তাদের বেলায় বোধহয় একথা আরো সত্য। কমিশনের কর্মকাল জুড়েই বোধহয় পরিচালক ও সহ-পরিচালক নিযুক্ত হয়ে চলেছিলেন, একজন সহ-পরিচালক নিযুক্ত হন আমাদের রিপোর্ট জমা দেওয়ার একমাস আগে–যখন লেখালিখির সব কাজ শেষ হয়ে গেছে। খণ্ডকালীন সদস্যদের মধ্যে ফজলুল হালিম চৌধুরী ও আবদুল্লাহ আল-মুতী শেষ পর্যন্ত কাজ করতে পারেননি। তাদের জায়গায় নিয়োগ পেয়েছিলেন যথাক্রমে শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্রের নতুন পরিচালক মুহম্মদ নূরুল হক। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক দু-একটি সভায় যোগদান করার পর আর আসেননি, এমনকী রিপোর্টে স্বাক্ষরও দেননি। স্বদেশ বসু, মযহারুল ইসলাম এবং এম এ সাত্তারও রিপোর্ট স্বাক্ষর করেননি।
শিক্ষা কমিশন নানা বিষয়ে অনুধ্যান কমিটি গঠন করেছিল এবং তাতে খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞদের জড়িত করেছিল। এঁদের মধ্যে অনেকে আগ্রহ করে কাজ করেছিলেন, অনেকে ছিলেন উদাসীন। কেউ কেউ আমাকে বলেছিলেন, কমিটির সদস্যেরা সব কাজ করে দেবে, আর কৃতিত্বের ভাগ নিয়ে যাবেন কমিশনের সদস্যেরা–দিস ইজ নট ফেয়ার। শিক্ষা কমিশনের খণ্ডকালীন সদস্যের কাজ করা ছাড়াও ছাত্রকল্যাণ ও জাতীয় সেবা-সম্পর্কিত অনুধ্যান কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়েছিল। সেখানেও এক তৃতীয়াংশ সদস্যের কোনো ভূমিকা ছিল না।
শিক্ষা কমিশন জনসাধারণের কাছ থেকেই উল্লেখযোগ্য সাড়া পায়নি। আমরা একটা প্রশ্নমালা তৈরি করেছিলাম, তা পাঠানো হয়েছিল ৯,৫৫১ জনের কাছে, জবাব পাওয়া গিয়েছিল ২,৮৬৯ জনের কাছ থেকে অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশেরও কম প্রাপকের কাছ থেকে। আনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি সাড়া দিয়েছিলেন মাদ্রাসার সুপারিটেনডেন্টরা-৩০৩ জনের মধ্যে ১৫৯ জন। সবচেয়ে উদাসীন ছিলেন গণপরিষদের সদস্যেরা–৩১৫ জনের কাছে প্রশ্নমালা পাঠানো হয়, ২৯ জন মাত্র জবাব দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অধ্যাপক এবং ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকদের ৩০৩ জনের মধ্যে জবাব পাওয়া গিয়েছিল ৮৯ জনের কাছ থেকে। ছাত্র-সংসদ ও ছাত্র সংস্থার কাছে প্রেরিত ২১০টি প্রশ্নমালার মধ্যে জবাবসুদ্ধ ফিরে এসেছিল চারটি মাত্র। তবে সে চারটিই যত্নের সঙ্গে লিখিত হয়েছিল।
কমিশনের সুপারিশের কথা যখন বলব, তখন এর কাজের কথা আরো বলতে হবে। এত রকম প্রতিকূলতার মধ্যেও শিক্ষা কমিশন যতটুকু করতে পেরেছিল, তাকে শ্লাঘনীয় বলতে আমার এতটুকু দ্বিধা নেই। এর মূলে কুদরাত এ-খুদার নেতৃত্ব বড়ো ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁর নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও কষ্টস্বীকারের তুলনা হয় না।
৯.
স্বাধীনতালাভের পরে ছাত্রনেতাদের, বিশেষ করে, ছাত্রলীগের নেতাদের প্রভাব খুব বেড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনো জাতীয় নেতার প্রতি তখন তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশ পায়নি এবং সরকারের বাইরে একটা বড়ো সমান্তরাল শক্তিকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রয়াস তাদের কাজকর্ম ও কথাবার্তায় ধরা পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদুস মাখন আর ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ সাধারণ্যে পরিগণিত হয়ে ওঠে চার খলিফা বলে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে তাদের অবস্থান দূরে থাকায় সে ভাবমূর্তিকে মালিন্য স্পর্শ করে না। বোধহয় এপ্রিল মাসেই ছাত্র ইউনিয়ন প্রস্তাব দেয় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলে একটি ছাত্রসংগঠন গড়ে তোলার। পঞ্চাশের দশকে একবার এরকম প্রচেষ্টা হয়েছিল, তাও কমিউনিস্ট পার্টির নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে। এরকম সিদ্ধান্তের ফলেই তখন জহির রায়হান ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছিল যাতে ঐক্যপ্রয়াসে ওই সংগঠনের ভেতর থেকে সমর্থন পাওয়া যায়। সেবারের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল মূলত ছাত্রলীগের মনোভাবের। জন্যে। এবারও ছাত্র ইউনিয়নের ঐক্যের আহ্বান ছাত্রলীগ ফিরিয়ে দেয়।
কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যা ঘটে, তা ছাত্রলীগের মধ্যে বিভেদ। এ-বিভেদের অঙ্কুর, মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময়েই উদ্গত হয়েছিল। এখন, ১৯৭২ সালের গোড়ায়, নূরে আলম সিদ্দিকী ও মাখন একদিকে, আর রব ও শাহজাহান সিরাজ অপরদিকে নিজেদের অনুসারীদের নিয়ে ভাগ হয়ে গেল। ছাত্রলীগে থেকেই প্রথমোক্তরা গঠন করলো স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, তাদের লক্ষ্য। দেশে মুজিববাদের প্রতিষ্ঠা; শেষোক্তরা পরিচয় দিলো জয় বাংলা বাহিনী বলে, তাদের উদ্দেশ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রমতে দেশকে গড়ে তোলা। একটু-একটু করে দু-দলের মতপার্থক্য সবার কাছে ধরা পড়তে লাগলো। প্রথমদিকে উভয় পক্ষই ছিল বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদপ্রার্থী। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরা তো একসময়ে বঙ্গবন্ধুকে আহ্বান জানালো দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করতে, সর্বদলীয় বিপ্লবী সরকার গঠন করতে এবং গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে একক দায়িত্বে দেশকে সংবিধান দিতে। এ আহ্বান, আর যাই হোক, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রসূত ছিল না। শ্রমিক লীগের একাংশ অন্তত এই প্রস্তাব সমর্থন করে; তার মানে, সেখানেও দ্বিধাবিভক্তির সূচনা হয়। ছাত্রলীগের অপর পক্ষ এই বক্তব্যের প্রবল বিরোধিতা করে। জুলাই মাসে ছাত্রলীগের দুই অংশ একই সময়ে দুটি সম্মেলন করে। নূরে আলম-মাখনরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, রব-শাহজাহানেরা পল্টনে। উভয় পক্ষের আমন্ত্রণ পেলেও বঙ্গবন্ধু প্রথমটিতে যোগ দেন প্রধান অতিথি হয়ে আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতারাও সেখানে গেলেন। এখন ভাগাভাগি এমন পর্যায়ে চলে গেল যে, অপর পক্ষ ঘোষণা করে দিলো, বর্তমান সরকারকে উৎখাত করাই তাদের আশু লক্ষ্য। কোথায় ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগের মিলনের স্বপ্ন আর কোথায় ছাত্রলীগের দ্বিধাবিভক্তি, সংঘর্ষ, হানাহানি, রক্তপাত!
এর আগে দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ও হল সংসদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন জয়ী হয়, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সহ-সভাপতি এবং মাহবুব জামান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। প্রকৌশল ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র ইউনিয়ন সাফল্যলাভ করে। ক্যাম্পাসে কয়েকদিন ধরে উপর্যুপরি গোলাগুলির কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন স্থগিত রাখতে হয়। আমাদের ধারণা হয়, ছাত্রলীগের কর্মীরাই ওরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। সেখানে নির্বাচন হয় মাসখানেক পরে, কিন্তু তা নির্বিঘ্ন হয়নি।
উত্তেজনাটা আগে থেকেই তৈরি হচ্ছিল। আমি তখন এ এফ রহমান হলের প্রোভোষ্ট। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময়ে আমি হল অফিসে উপস্থিত ছিলাম। হল সংসদের নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার ছিলেন হাউজ টিউটর রণধীর বড়ুয়া। তিনি আমাদের বিভাগেই পালির শিক্ষক ছিলেন। অত্যন্ত মৃদু স্বভাবের সজ্জন মানুষ, খুবই কর্মনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী। একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে সকল শিক্ষকের নাম ও শিক্ষাগত যোগ্যতার একটা ফর্দ পাঠাতে হয়েছিল। রণধীর বড়ুয়া একটা কাগজে লিখে দিয়েছেন, তিনি পালিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ। আমি তাকে বললাম, রণধীরবাবু, আপনার না একটা আমেরিকান এম এড ডিগ্রি আছে? উনি বিব্রত হয়ে পালটা জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেটাও লিখে দেবো?’ এহেন মানুষকে এই দুর্দিনে এমন ঝামেলা সইতে হলো, কেননা, হাউজ টিউটরদের মধ্যে তিনিই সিনিয়র। মনোনয়ন বাছাই শেষ করে রণধীরবাবু একটু ভীতভাবে আমার কক্ষে প্রবেশ করলেন। বললেন, ‘ছাত্রলীগের ক্রীড়া-সম্পাদকের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছি তাতে ক্যান্ডিডেটের সই নেই বলে, কিন্তু ওরা মানতে চাইছে না। মানতে না চাইবার কোলাহল অফিসঘরে বসেই আমি শুনতে পাচ্ছিলাম; ব্যাপারটা যে কী, তা বুঝতে পারিনি। রণধীরবাবুকে বললাম, আপনি ওদের বলুন, আপনার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হল সংসদের সভাপতির (অর্থাৎ প্রোভোস্টের) কাছে আপিল করতে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আমি দেবো।’ খবর পেতে থাকলাম, ছাত্রলীগ-নেতারা ওই মনোনয়নপত্রই বৈধ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছে; প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র ইউনিয়ন-প্রার্থীর কাছ থেকে তারা এই মর্মে একটা চিঠি আদায় করেছে যে, অপর প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করলে তার কোনো আপত্তি থাকবে না। এবারে ঘর থেকে আমাকে বেরোতেই হলো। ছাত্রদের বললাম, ‘রিটার্নিং অফিসার যথারীতি কাজ করেছেন, তোমরা তাঁর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিয়মমাফিক আমার কাছে আপিল করতে পারো, শেষ সিদ্ধান্ত আমার। তারা আমাকে বললো যে, তারা সহযোগিতা ও বন্ধুত্বমূলক প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে নির্বাচন করতে চাইছে; মানুষমাত্রের ভুল হয়, প্রার্থী খেলাধুলা যত বোঝে, নিয়মকানুন তত বোঝে না; বেচারা একটা সই করতে ভুলে গেছে, এর বেশি তো কিছু নয়; তার নমিনেশন পেপার ভ্যালিড ঘোষণা করলে প্রতিপক্ষের যেখানে আপত্তি থাকবে না, সেখানে রিটার্নিং অফিসার শুধু শুধু আমলাতান্ত্রিক মনোভাব দেখাচ্ছেন; নিয়ম মানুষের জন্যে, না নিয়মের জন্যে মানুষ? আমি বললাম, ‘তোমরা ওঁকে ওঁর মতো কাজ করতে দাও–আমার কাছে আপিল করলেই কেবল বিষয়টা নিয়ে তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি, তার আগে নয়। আমার কথায় কোলাহল কমলো না, কিন্তু রিটার্নিং অফিসারের ওপরে চাপ কমলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রার্থী আপিল করলো। রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্ত বহাল রেখে আমি আপিলের মীমাংসা করলাম। সংক্ষুব্ধ ছাত্রেরা আমাকে তাদের আবেদন পুনর্বিবেচনা করতে বললো। আমি যখন তাতে সম্মত হলাম না, তখন হইচই বাড়লো মাত্র। হলের দারোয়ান ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিলো যে, অদূরে কয়েকজন অস্ত্রধারী অপেক্ষা করছে, আমি যেন হল থেকে বের না হই। হাউজ টিউটররা আমাকে ঘিরে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে রইলেন। এর মধ্যে উৎকণ্ঠিত হয়ে উপাচার্য ফোন করলেন, তাঁর কানেও কী সব কথা পৌঁছেছে। আমি তাকে বললাম, একটু পরে তার অফিসে এসে সব জানাবো। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর সকলের মতের বিরুদ্ধে আমি বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার আরদালি গাড়ি চালাতো। তাকে প্রস্তুত থাকতে খবর দিয়ে আমি অফিস থেকে বারান্দায় পা দিলাম। আমাকে কেউ বাধা দিলো না বটে, কিন্তু এত ছাত্র আমার সামনে-পেছনে চলতে থাকলো যে গাড়িতে ওঠা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। আমি ছাত্রদের বললাম, ‘তোমরা সারারাত আমাকে বসিয়ে রাখতে পারো, কিন্তু সিদ্ধান্ত পালটাবে না। ভাইস-চান্সেলর আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন, আমি তার কাছে যাবো, তোমরা আমার পথ ছেড়ে দেবে। এতক্ষণে নেতৃস্থানীয় কজন ছাত্র এসে আমার বেরোবার পথ করে দিলো, তবে তারাও জানাতে কসুর করলো না যে, পুরো ব্যাপারটায় তারা দুঃখিত হয়েছে।
উপাচার্যকে পরিস্থিতি জানালাম। তিনি সত্যিই উদবিগ্ন। কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে দুটি গাড়িতে আমার গাড়ির সামনে-পেছনে দিয়ে ঘুরপথে তিনি আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা হলো প্রশাসন-ভবনের নিচে বাণিজ্য বিভাগের শ্রেণিকক্ষে। প্রত্যেক ঘরে তিনটি করে ব্যালট-বাক্স–কেন্দ্রীয় সংসদের, আলাওল হল সংসদের এবং এ এফ রহমান হল সংসদের। দুই হলের ছাত্রছাত্রীদের ভাগ করে বিভিন্ন কক্ষে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা। সবকিছু ভালো মতোই চললো। দুপুরে বাড়ি গেছি খেতে। একটু পরে খবর এলো, কয়েকজন অস্ত্রধারী ভোটকক্ষে ঢুকে একটা ব্যালট-বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। দ্রুত অকুস্থলে ফিরে এলাম। দেখা গেল, আলাওল হল সংসদের একটা ব্যালট বাক্স নেই। সহকর্মীরা বললেন, এ এফ রহমান হলের বাক্স নিতে ভুল করে আলাওল হলের বাক্স নিয়ে গেছে। আলাওল হলে ছাত্রলীগের বিজয় সুনিশ্চিত, এ এফ রহমান হলে পরাজয়ের আশঙ্কা, অতএব। আমি যখন বাণিজ্য বিভাগের কাছে পৌঁছোলাম, তখন দেখি, এক নিষ্ঠাবান কর্মী মাথার ওপরে বন্বন্ করে লাঠি ঘোরাচ্ছে–কাউকে আঘাত করছে না–তবে লাঠির আওতার মধ্যে কেউ যেতেও পারছে না। আমাকে দেখে সে বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে অভিবাদন করলো : লাঠির গতি কমিয়ে সেটাই কপালের মাঝখানে ধরে মাথা একটু নত করলো। তাকে কিছু বলার আগেই, ঘটনার হোতা বলে সন্দেহ করা হয়েছিল এমন এক ছাত্রনেতা কোত্থেকে আবির্ভূত হয়ে বললো, ভোট দিয়ে সে হলে গিয়েছিল একটু বিশ্রাম নিতে, এই অভাবিত ঘটনার বিবরণ শুনে এখনই দৌড়ে আসছে; সে একেবারেই বিমূঢ়, তবে শিক্ষকরা যা বলবেন তা করতে সে এবং তার দল প্রস্তুত।
আলাওল হলের নির্বাচন স্থগিত করা হলো, তবে কেন্দ্রের ও আমার হলের নির্বাচনের কাজ চলতে থাকলো। ভোটগণনায় দেখা গেল, কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন (শামসুজ্জামান হীরা সহ-সভাপতি), এ এফ রহমান হলে ছাত্রলীগ (গোলাম জিলানী সহ-সভাপতি, নূরনবী সাধারণ সম্পাদক)। উপাচার্য নির্দেশ দিলেন আমাকে, নির্বাচনের ফল যেন ঘোষণা না করি। তাঁর সঙ্গে প্রোভোস্ট, প্রক্টর ও কয়েকজন শিক্ষকের বৈঠকে স্থির হলো, আলাওল হলের ভোটগ্রহণের বিষয়টা স্থির না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সংসদ ও হল সংসদের নির্বাচনের ফল দেওয়া হবে না। আমি এটা সংগত মনে করলাম না, কিন্তু সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম।
এদিকে ছাত্র ইউনিয়নের বিজয়ী প্রার্থীরা সংসদের দায়িত্ব নিতে উন্মুখ, ওদিকে ছাত্রলীগ যদিও আলাওল হলের নির্বাচনের পরে ফলপ্রকাশের পক্ষপাতী তবু আমার হলে যারা নির্বাচিত হয়েছে, তারা হাসি-হাসি মুখ করে রোজ একবার দেখা করে। দু-তিন দিন পরে আমি উপাচার্যকে বললাম, সংসদ নির্বাচনের ফল ঘোষণা না করার মতো কোনো আইনগত কর্তৃত্ব আমার আছে বলে মনে করি না, তাই তিনি অনুমতি দিলে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করতে চাই। অধ্যাপক ইন্নাছ আলী আমার কথাটা বুঝলেন। সম্পূর্ণ সন্তুষ্টচিত্তে না হলেও তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তাহলে আমিও চাকসুর রেজাল্ট অ্যানাউন্স করে দেই।
আমার খুব মজা লেগেছিল যখন একজন প্রবীণ শিক্ষক আমাকে বললেন যে, এ এফ রহমান হলের নির্বাচনে ছাত্রলীগের বিজয় একেবারেই অপ্রত্যাশিত, কেননা, তিনি ওটাকে ছাত্র ইউনিয়নের ঘাটি বলে মনে করতেন। বুঝলাম, তিনি ভেবেছেন, আমি বেছে বেছে ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থকদের হলে নিয়েছি।
নিজের উদ্যোগে আসলে আমি মাত্র কয়েকজন ছাত্রকে আমার হলে নিয়ে এসেছিলাম। এদের সবাই অনার্স পরীক্ষায় খুব ভালো করেছিল, কিন্তু আলাওল হলের একটা বর্ধিত অংশে এরা থাকছিল একটু কষ্টে। আমি তাদের বলেছিলাম, এ এফ রহমান হলে তারা বদলি নিয়ে এলে আমি তাদের সিংগল সিট দিতে পিরবো। তারা এসেছিল। তাছাড়া, ৬০ শতাংশ সিট আমি বরাদ্দ করেছিলাম মেধার ভিত্তিতে, প্রার্থীদের তালিকা তাদের দেখার জন্য উন্মুক্ত রেখেছিলাম; আমাদের হিসাবে কোনো ভুল আছে কি না, তা তারা দেখতে পারতো এবং আর কতজনের পর একজনের পালা আসবে, তাও জানতে পারতো। ৪০ শতাংশ সিট রেখেছিলাম বিভাগের অধ্যক্ষের সুপারিশে ভর্তি করার জন্যে। দূরদূরান্ত থেকে আগত কিংবা বিশেষ বিবেচনা করার যোগ্য প্রার্থীরা বিভাগের মাধ্যমে এভাবে সুযোগ পেতে পারতো। অনেক বিভাগের অধ্যক্ষ অবশ্য এ-ব্যবস্থায় খুশি হননি, তারা এটা বাড়তি ঝামেলা মনে করেছিলেন। তবে আমি যে নিজস্ব বিবেচনার জন্যে কিছু হাতে রাখিনি, তা ছিল স্পষ্ট। তাতে অনেক বন্ধু ও পরিচিতজনের অনুরোধ রাখতে পারিনি, তাঁরা দুঃখিত হয়েছিলেন। এরপরও যারা মনে করেছিলেন, বিশেষ কোনো ছাত্র-সংগঠনের প্রতি আমি পক্ষপাত করেছি, এ-বিষয়ে প্রমাণ বা যুক্তির চেয়ে তাঁদের বিশ্বাসই ছিল বড়ো।
১০.
শিক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ ইউসুফ আলীর সঙ্গে অধ্যাপক মযহারুল ইসলামের বন্ধুত্ব ছিল। মযহারুল ইসলাম তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বাংলা একাডেমি ও কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড একীভূত করতে। বিষয়টি বিবেচনার জন্যে সরকার একটি কমিটি গঠন করে। বাংলা একাডেমির পরিচালক (কবীর চৌধুরী), ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ (যথাক্রমে নীলিমা ইব্রাহিম, মযহারুল ইসলাম ও আমি), শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আ. কা. মো. যাকারিয়া) এর অন্তর্ভুক্ত। বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের গ্রিন রোডের বাড়িতে দুদিন সভা হলো। প্রথম সভায় উপস্থিত হয়ে দেখি, দুই প্রতিষ্ঠান একীভূত করার। উদ্দেশ্যে আইনের একটি খসড়া আমাদের বিবেচনা করতে দেওয়া হয়েছে। কবীর চৌধুরী ও আমি আপত্তি করলাম। আমরা বললাম, বিষয়টির নীতিগত দিক আলোচনা করার আগে আইনের খসড়া দেখবো কেন? দুটি প্রতিষ্ঠানের চরিত্র দুরকম–দুটিকে এক করা সংগত কি না, আগে তো তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। একজন বললেন, দুটো প্রতিষ্ঠান এক হোক, এটা বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা। কবীর চৌধুরী বললেন, বঙ্গবন্ধুকে যথাযথ পরামর্শ দেওয়া আমাদের কর্তব্য। যাকারিয়া বললেন, ‘একত্রীকরণের বিষয় একরকম স্থির হয়ে গেছে, আপনারা এই খসড়ায় কিছু পরিবর্তন আনতে চান কি না দেখুন।’ আমি বললাম, আমরা আইনজ্ঞ নই, আইনের খসড়া দেখে কী করবো? আমি মনে করি, দুটি প্রতিষ্ঠান। স্বতন্ত্র থাকাই সংগত। যাকারিয়া মৃদু হাসলেন।
আমি দ্বিতীয় সভায় আর গেলাম না। সুতরাং কোনো সুপারিশে স্বাক্ষর করিনি। তাতে অবশ্য কিছু আসে যায়নি। বাংলা একাডেমির সঙ্গে বাংলা উন্নয়ন বোর্ড এক হয়ে গেল। এতদিন বাংলা একাডেমির একজন পরিচালক ছিলেন, এবারে একজন মহাপরিচালক ও কয়েকজন পরিচালকের পদের সৃষ্টি হলো। মযহারুল ইসলাম মহাপরিচালক হলেন। মিলিত বাংলা একাডেমিতে পূর্বতন দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে কে কার চেয়ে কর্মে জ্যেষ্ঠ, এই সমস্যার সমাধান হতে অনেকদিন লেগে গেল। সংবাদপত্রে খবর বের হলো, এই দ্বন্দ্বে বাংলা একাডেমিতে কাজকর্ম সব বন্ধ হয়ে আছে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়নের ভার দেওয়া হলো বাংলা একাডেমিকে। তার জন্যে অনেক অস্থায়ী নিয়োগের ব্যবস্থা হলো। এই প্রকল্পের জন্যে যে-কমিটি গঠিত হলো, কপালগুণে আমি তারও সদস্য। সব সভায় আসতে পারি না, এলেও সবকিছু বুঝতে পারি না। এক সভায় কমিটির আরেক সদস্য সিকান্দার আবু জাফর ক্রুদ্ধ হয়ে মহাপরিচালককে (তিনিই প্রকল্প-পরিচালক) কীসব বললেন, আর জানালেন, তাকে বঙ্গবন্ধু সদস্য করেছেন এখানে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি না দেখতে। মাঝপথে সভা শেষ হলো। জাফর ভাই তাঁর গাড়ির গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে একটা ছোটো বোতল বের করে তার গর্ভস্থ পানীয় গলায়। ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘শোন, যা উচিত মনে করবি, তা বলবি। মাস্টার বলে খাতির করবি না, বাপকেও উচিত কথা বলতে ছাড়বি না।’
১১.
অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ অধ্যাপক হননি। ১৯৩৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন লেকচারার ক্লাস টু পদে। ক্লাস ওয়ান আর ক্লাস টু লেকচারার পদ যখন মিশে লেকচারার হয়ে গেল, তখন তিনি লেকচারার হলেন। তারপর যখন সিনিয়র লেকচারার নামে নতুন শ্রেণির পদ সৃষ্ট হলো। ১৯৬৫ সালে, তখন আমাদের সঙ্গে তিনিও হয়ে গেলেন সিনিয়র লেকচারার। স্বাধীনতার পরে সিনিয়র লেকচারারের নাম বদলে হলো অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরী উপাচার্য নিযুক্ত হওয়ায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সর্বজ্যেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে রাজ্জাক সাহেব হলেন বিভাগের অধ্যক্ষ।
আব্দুর রাজ্জাক কখনো উচ্চপদে নিয়োগলাভের আবেদন করেননি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ কে জে নিউম্যান একবার রিডার পদে খালিদ বিন সাইদের নিয়োগে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাজ্জাক সাহেবকে ওই পদের প্রার্থী হতে বলেছিলেন এবং এও বলেছিলেন যে, তাঁর প্রার্থিতা তিনি সমর্থন করবেন। রাজ্জাক সাহেব বলেছিলেন, খালিদ বিন সাইদের পিএইচডি আছে, আমার নেই; তুমি তার বদলে আমাকে সমর্থন করতে চাও–তার মানে তুমি লোক সুবিধার নও। তাঁদের দুজনের বিরোধের বোধহয় শুরু এইখানে। মুজাফফর আহমদ চৌধুরী উপাচার্য হয়ে রাজ্জাক সাহেবকে অধ্যাপক করার একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার প্রবল আপত্তি দেখে শেষে নিরত হন।
আমি একবার রাজ্জাক সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ডিগ্রিকে তিনি অত মূল্য দেন কেন? কত মেধাহীন মানুষও তো পিএইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করে থাকে। তিনি বলেছিলেন, তা করে, কিন্তু অন্য কোনো নির্ভরযোগ্য মানদণ্ডের অভাবে ওই কাগজগুলোকে মূল্য দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। অন্যথায় সিদ্ধান্ত খেয়ালখুশিমাফিক হয়ে পড়বে।
মুজাফফর আহমদ চৌধুরী গুরুর প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ১৯৭২ সালে আব্দুর রাজ্জাক কেবল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যক্ষ হলেন না, সিন্ডিকেটের সদস্য হলেন, অনেকগুলো বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপকপদে নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য হলেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা সম্পর্কে তিনি অনেককাল ধরেই ভাবনাচিন্তা করে এসেছেন। যেমন, এখানে প্রশাসনিক পদ কমানো উচিত, নিজস্ব প্রকৌশল বিভাগ না রেখে তার কাজের দায়িত্ব চুক্তির ভিত্তিতে বাইরের প্রতিষ্ঠানকে দিলে আর্থিক সাশ্রয় হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বাড়ানো দরকার। উপাচার্যকে যে তিনি এসব বিষয়ে পরামর্শ দিতেন, তা সবাই জানতো। এসব পরামর্শ বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেননি উপাচার্য, কিন্তু তাতেও রাজ্জাক সাহেবের প্রতি অনেকের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি।
তিনি আরো চেয়েছিলেন যে, পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক কারণে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ত্যাগ করেছিলেন বা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের ফিরিয়ে আনা হোক। সরদার ফজলুল করিম দর্শনের শিক্ষক ছিলেন, তাঁকে তিনি নিয়ে এলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। এ-নিয়ে কিছু সমালোচনা হলো, কিন্তু তা সামান্যই। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সমাজতত্ত্ব বিভাগ থেকে কর্মচ্যুত হয়েছিল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে। তার ডিগ্রি ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, সেখানেই তাকে ফিরিয়ে আনা হলো। সে একটু বেশি বাধার সম্মুখীন হয়েছিল এই অর্থে যে, এক তরুণ শিক্ষক তাকে পিস্তল দেখিয়ে অনুরোধ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ না দিতে। বদরুদ্দীন উমর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কর্ম ত্যাগ করেছিলেন তাঁকে নিয়ে তাঁর ভাইস চ্যান্সেলরের ওপরে গভর্নর তথা চান্সেলর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করায়। রাজ্জাক সাহেব তাকেও বিভাগে আনতে চাইলেন–এতে যে উমরের আগ্রহ ছিল, তা নয়। এবারে কাগজে লেখালেখি শুরু হলো যে, একজন নকশালপন্থী ব্যক্তিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। অথচ একই কাগজে অন্য প্রসঙ্গে রাজ্জাক সাহেবকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষাকারী কিংবা সিআইএর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলেও অভিহিত করা হয়।
আমার প্রতি স্নেহবশত রাজ্জাক সাহেব চাইলেন, আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসি। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে বাংলা বিভাগে অধ্যাপক-পদপূরণের লক্ষ্যে বিজ্ঞপ্তি বের হলো। সার আমাকে দরখাস্ত করতে বললেন। আমি বললাম, আমি চট্টগ্রামে গেছি এখনো তিন বছর হয়নি–এখন ঢাকায় আবার চাকরির আবেদন করলে অস্থিরচিত্ততার পরিচয় দেওয়া হবে মাত্র। আমি দরখাস্ত না করায় রাজ্জাক সাহেব পরামর্শ দিলেন, নির্বাচকমণ্ডলীর সভায় উপাচার্য যেন আমার নামটাও বিবেচনা করতে বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-অনুযায়ী আবেদনকারীদের বাইরেও কারো বিষয় নির্বাচকমণ্ডলীকে বিবেচনা করতে বলার অধিকার উপাচার্যের ছিল।
ওদিকে হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে দেখি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অস্থায়ী অধ্যাপক-পদ বিজ্ঞাপিত হয়েছে। আমি বিভাগের অধ্যক্ষ, অথচ কিছুই জানি না। গেলাম উপাচার্যের কাছে। বললাম, আর কিছুকাল পরে পদটি বিজ্ঞাপিত হলে বোধহয় ভালো হতো। ইন্নাছ আলী আমার কথা বুঝলেন। বললেন, কেন, পদ যখন খালি হয়েছে, তখন বিজ্ঞাপিত হওয়াই ভালো, আপনি অবশ্যই আবেদন করবেন। সৈয়দ আলী আহসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে চলে যাওয়ায় ওই পদটি অস্থায়ীভাবে শূন্য হয়। যথারীতি আবেদন করলাম। আরো দুজন প্রার্থী ছিলেন। নিয়োগ আমিই পেলাম। একই সঙ্গে মোহাম্মদ আলী হলেন ইংরেজির স্থায়ী অধ্যাপক। আমরা যেদিন নিয়োগপত্র পাই, সেদিনই নতুন পদে যোগ দিতে পারতাম। কিন্তু সপ্তাহের ওই দিনটি শুভকাজের অনুকূল নয় বিবেচনা করে মোহাম্মদ আলী আমাকে অনুরোধ করলেন পরদিন যোগ দিতে। সেদিন আমি যোগ দিলে তার চেয়ে একদিনের জ্যেষ্ঠ হয়ে যেতাম, তবে আমি স্থিতাবস্থা রক্ষার পক্ষে। তাই পরদিন, ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট অধ্যাপক-পদে যোগ দিলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সচিব একদিন আমাকে পাকড়াও করে বললেন, ‘ভিসি আপনার একটা সিভি চেয়েছেন, এই সপ্তাহেই দিয়ে যাবেন। কদিন পরে আমার জীবন তার হাতেই সমর্পণ করলাম। তিনি পাকা লোক, জানতে চাইলেন, ওতে আমার স্বাক্ষর আছে কি না। উত্তর শুনে বললেন, এখনই স্বাক্ষর করে দিয়ে যান।
অক্টোবর মাসের কোনো এক সময়ে নির্বাচকমণ্ডলীর সভা বসলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নীলিমা ইব্রাহিম ও আহমদ শরীফ, রাজশাহী থেকে কাজী আবদুল মান্নান, সরকারি কলেজ থেকে আলাউদ্দিন আল আজাদ। তার ওপর উপাচার্য আমার জীবনবৃত্তান্ত উপস্থাপন। করেছেন। আবদুর রাজ্জাকের মুখে শুনলাম, আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
অন্যেরাও নিশ্চয় এমনই শুনেছিলেন। তার প্রতিক্রিয়া হলো প্রবল। একদল ছাত্র অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উপাচার্যের বাড়ি চড়াও হলো, নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাকের ফুলার রোডের বাসায় গিয়েও তার খোঁজ করলো। নির্বাচকমণ্ডলীর আরেকজন সদস্য সৈয়দ আলী আহসানকে ফোন করে গালমন্দ করলো কেউ কেউ, জানতে চাইলো, আমি কেন আমার স্ত্রীকে বিধবা করতে চাই। আমাকে অনেকে পরামর্শ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে দূরে থাকতে। এদিকে অ্যাকাডেমিক কাউনসিলের সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অধ্যাপকের আরো ২৪টি পদ সৃষ্টি হলো, তার মধ্যে একটি বাংলায়। বাংলা বিভাগে অধ্যাপকের দুটি পদে দুজন নিয়োগ পাবেন–এরকম সম্ভাবনায়ও ক্ষোভ প্রশমিত হলো না–বাড়লো হয়তো। বিভাগে ছাত্রদের আনুষ্ঠানিক সভায় ‘একজন প্রভাবশালী সহকারী অধ্যাপকের প্রিয় পাত্রকে’ ‘পেছন দরজা দিয়ে নিয়োগের চেষ্টার প্রতিবাদ করা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে স্বজনপ্রীতি, অবৈধ নীতি ইত্যাদি পরিত্যাগ করার আহ্বান জানানো হলো, অন্যথায় সচেতন ছাত্রসমাজ যে চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, সে-সংকল্পও ব্যক্ত হলো। উপাচার্য প্রমাদ গুনলেন। রাজ্জাক সাহেবের অনুরোধ ছাড়াও, তিনি নিজে থেকেই আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনতে চেয়েছিলেন। অল্প কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী যে আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসতে বলেছিলেন তাঁকে, তাও তাঁর মনে। ছিল। এখন দেখলেন, ছাত্রলীগের মধ্যম সারির নেতারাই আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে চায় না। অবস্থা এমন হলো যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অধ্যাপক-নিয়োগের নীতিমালা ব্যাখ্যা করার দাবি জানালো। তাদের পর্যবেক্ষণ : ‘বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নোংরা রাজনীতি শুরু হয়েছে। …কেউ কেউ ব্যক্তিগত পদোন্নতি ইত্যাদির আকাঙ্ক্ষায় দলাদলি করার চেষ্টা করছেন। তারা ছাত্রদেরকেও তাদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। কর্তৃপক্ষও কোন প্রকার দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করছেন না, বরং দলাদলির সুযোগ করে দিচ্ছেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সাধারণ ছাত্রদের নামে মুদ্রিত একটি প্রচারপত্র এ-সময়ে বিতরণ করা হলো। তার ভাষা বেশ অগ্নিগর্ভ। মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, মীর্জা নূরুল হুদা, আব্দুর রাজ্জাক ও সৈয়দ আলী আহসান তার আক্রমণের লক্ষ্য–আমি তো আছিই। এবারে আমি বিচলিত না হয়ে পারলাম না। আমার কারণে আমার শ্রদ্ধেয় মানুষেরা এভাবে অপমানিত হবেন, তা আমার কাছে খুবই খারাপ লাগতে লাগলো। ভাবলাম, যথেষ্ট হয়েছে, এবারে জনসমক্ষে একটি বিবৃতি দিয়ে বলা দরকার যে, এই প্রতিযোগিতায় আমি আর নেই। মুজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে আমার অভিপ্রায় টেলিফোনে জানালাম। স্বভাবতই উনি ক্ষুণ্ণ হলেন, আমি মাফ চাইলাম। উনি বললেন, ‘ইট ইজ ইওর ডিসিশন, আফটার অল, তবে, প্লিজ, সারের সঙ্গে কথা বলে নেবেন বিফোর ইউ গো পাবলিক।’ সৈয়দ আলী আহসানকে ফোন করলাম–ওঁর কথাও প্রায় তাই। এদিকে রাজ্জাক সাহেবকে বাড়িতে ধরতে পারছি না। একবার গিয়ে পেলাম ওঁর অব্যবহিত কনিষ্ঠ আবদুল খালেককে। তিনি বাড়িতেই বেশির ভাগ থাকেন–ছাত্রদের রোষের ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি আমার সঙ্গে একমত। তবে কারণটা একটু ভিন্ন : আপনার সারের বউ-বাচ্চা নাই, দুনিয়াদারির খবর নাই–তার কথা আলাদা। আপনে ক্যান এই রিস্কের মধ্যে যাইবেন? যা দিনকাল, বলা যায় না।’
সেদিন নভেম্বরের ২ তারিখ। আমাদের অগ্রজস্থানীয় বন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক, জয়নুল আবেদীন দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা গেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-প্রাঙ্গণে বাদ আসর জানাজা। গণপরিষদ ভবন থেকে সেখানে এলাম এবং যেমন ভেবেছিলাম, রাজ্জাক সাহেবকেও পেয়ে গেলাম। জানাজার পরে সারুকে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ উনি। জানতে চাইলেন, গাড়ি আছে? হাঁ-সূচক উত্তর শুনে বললেন, ‘তবে কামালের বাড়ি চলেন। যেতে যেতে আমার কথাটা বললাম। বিবৃতির খসড়া আমার পকেটে ছিল, কামাল হোসেনের বাড়িতে গিয়ে সেটা ওঁর হাতে দিলাম। হামিদাও আমার অভিপ্রায় সমর্থন করলেন। বিবৃতিতে কোন শব্দের প্রয়োগ জুতসই হয়েছে, সেটাই সার বললেন আমাকে; আমার কী করণীয়, সে-বিষয়ে কিছুই বললেন না। জিজ্ঞাসা করলাম, এটা প্রেসে পাঠিয়ে দিই?’ সার বললেন, ‘আপনি তো মন ঠিক কইরাই কাগজটা লিখছেন। আমি সে-রাতেই দৈনিক বাংলা, সংবাদ ও পূর্বদেশে প্রকাশের জন্যে বিবৃতিটা পাঠিয়ে দিলাম। অন্য কোনো কাগজে বেরিয়েছিল কি না, মনে নেই, তবে পূর্বদেশে তা পরদিন ছাপা হয়েছিল। আমার পক্ষে তাই ছিল যথেষ্ট, কেননা আক্রমণাত্মক বিষয়গুলো মূলত পূর্বদেশেই পত্রস্থ হয়েছিল।
আমার বিবৃতিটি ছিল এরকম:
গত দুদিনে কোন কোন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে এবং একটি মুদ্রিত প্রচারপত্রে স্বনামে ও অনামে আমি উল্লিখিত হয়েছি। এ থেকে বোঝা যায় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে বাংলা বিভাগের অধ্যাপকপদ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারেন ভেবে অনেকে বিচলিত বোধ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন পদের জন্য আমি আবেদন করিনি, সেখান থেকে কোন নিয়োগও লাভ করিনি। এই অবস্থায় স্বাভাবিক নিয়মে এ প্রসঙ্গে আমার কিছু বলার কথা নয়। কিন্তু মুদ্রিত বিষয়বস্তুর ভাষার তীব্রতা ও ভাবের গভীরতা এমন পর্যায়ের যে, আমি এই স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে বাধ্য হচ্ছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের ছাত্র, শিক্ষক ও হিতৈষীদের আমি এই বলে আশ্বস্ত করতে চাই যে, অদূরভবিষ্যতে এরকম নিয়োগগ্রহণের কোনো পরিকল্পনা আমার নেই। আশা করি যে, এই বিবৃতির পরে চরিত্রহননের পালা সাঙ্গ হবে।
এই বিবৃতি দিয়ে আত্মসম্মান রক্ষা করতে পেরেছিলাম কি না জানি না, কিন্তু আমার জন্যে গুরুজনদের সম্মানহানি রোধ করতে পারিনি। সেদিক দিয়ে ওই বিবৃতির সঙ্গে আমার স্বার্থপরতা জড়িত হয়েছিল। তবে উপাচার্যের জন্যে তা একটু স্বস্তিকরও হয়ে থাকতে পারে। তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যাপকের দুই পদে নীলিমা ইব্রাহিম ও আহমদ শরীফকে নিয়োগ দিতে পেরেছিলেন। নভেম্বর মাসেই তারা নতুন পদে যোগ দিয়েছিলেন। ততদিনে শুনেছি, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে তৃতীয় একটি অধ্যাপকের পদও বাংলা বিভাগে সৃষ্টি করা হয়েছিল। তা হতে হতে অবশ্য আমি আর দৃশ্যপটে ছিলাম না।
এই ঘটনা থেকে আরো কিছু ধূলিরাশি সঞ্চারিত হয়েছিল। সেবারে বাংলা বিভাগে এমএ শেষ পর্বের পরীক্ষা কমিটির বহিরাগত সদস্য ছিলাম আমি। সংবিধানের কাজে তখন ঢাকায় ছিলাম। পথে এক ছাত্রের সঙ্গে দেখা। কুশলাদি বিনিময়ের পরে তার কাছে জানলাম, পরদিন এম এ পরীক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা। আমি কিছুই জানতে পারিনি। রাতে ওই কমিটির এক সদস্যকে ফোন। করলাম। তিনি বললেন, তোমার চিঠি বোধহয় চট্টগ্রামে গিয়ে পড়ে আছে, কাল সকালে চলে এসো।’ তাঁরা সবাই জানতেন, আমি ঢাকায় আছি এবং কোথায় আছি। কেউ যোগাযোগ করার চেষ্টা করেননি আমার সঙ্গে। পরে চট্টগ্রামে ফিরে। গিয়েও কোনো চিঠি পাইনি। সেই সদস্যের মৌখিক আমন্ত্রণ পেয়ে বললাম, ‘সকালে পারবো না, লাঞ্চের পর পৌঁছতে পারি।’ তিনি বললেন, পরীক্ষা তো দুদিন ধরে চলবে, তুমি এক বেলা থাকতে না পারলেও আমরা ম্যানেজ করে নেবো। ম্যানেজ করেছিলেন ঠিকই। আমি গিয়ে দেখলাম, ইতস্ততবিক্ষিপ্তভাবে অনেক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া হয়ে গেছে; সকালে-বিকেলে বা পরদিন যাদের পরীক্ষা দেওয়ার কথা, তাদের মধ্যেও অনেকে পরীক্ষা দিয়ে গেছে এবং ভালো নম্বর পেয়েছে। শুনলাম, নানারকম অসুবিধের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে এরা আসতে পারবে না, তাই এই ব্যবস্থা। এরকম বিবেচনা সব সময়েই করা হয়। তবে সাধারণত একসঙ্গে এতজনের অসুবিধে ঘটে না। আমি বোধহয় শুধু বলেছিলাম, ‘ভালো ছাত্রেরা সবাই দেখছি আগে পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছে। পরদিন দু-বেলা পরীক্ষা। মধ্যাহ্নবিরতির সময়ে যে-যার বাড়িতে খেতে চলে। গেলেন, আমার এতদিনের বন্ধু, হিতৈষী ও সহকর্মীরা কেউ জানতে চাইলেন না, আমি খাবো কি না কিংবা কোথায় খাবো।
চট্টগ্রামে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন বহিরাগত পরীক্ষক। পরীক্ষার আগের দিনও তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল, তিনি আসবেন এবং আমার বাড়িতে থাকবেন। আমি নিজেই গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরে গেছি ওঁকে আনতে। উনি আসেননি। শহরে এসে ফোন করে শুনি, উনি সুস্থ নেই। সেদিন সকালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে পরীক্ষা। বহিরাগত পরীক্ষক ছাড়া মৌখিক পরীক্ষা হয় না। সেখান থেকে ফোনে পরীক্ষা-নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং উপাচার্যের অনুমতি নিয়ে সেই কলেজেরই এক শিক্ষককে বহিরাগত পরীক্ষকের জায়গায় অভিষিক্ত করে পরীক্ষা নিলাম।
সমস্ত ঘটনার দুটি পাদটীকা আছে। যেসব ছাত্র ১৯৭২ সালে আমার নিয়োগের বিরোধিতা করে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল, অনেক বছর পর তাদের অন্তত দুজন আমার কাছে নিজেদের আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়েছিল এবং অন্তত আরো দুজন তাদের ব্যবহারের দ্বারা বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, তারা অনুতপ্ত।
পরবর্তীকালে রাজ্জাক সাহেব কখনো এই ঘটনা নিয়ে আমাকে কিছু বলেননি।
১২.
বাংলাদেশের সংবিধান-প্রসঙ্গে বাকি কথা বলার সময় হয়ে গেছে। সংবিধান প্রণয়নকালীন বিভিন্ন পর্যায়ের খসড়া, বিল আকারে উপস্থাপিত সংবিধানের পাঠ এবং সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টের যে-কপি নিজের কাছে রেখেছিলাম, সৌভাগ্যক্রমে তা পেয়ে গেলাম। এর ফলে অনেক কথা এসবের ওপর নির্ভর করে বলা যাবে এবং স্মৃতিনির্ভর দু-একটা বলা কথাও এই সুযোগে সংশোধন করে নেওয়া যাবে।
সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির বৈঠক বসে একাদিক্রমে ১৭ থেকে ২৯ এপ্রিল, ১০ থেকে ২৫ মে, ৩ থেকে ১০ জুন, ১০ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর এবং ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর। মোট ৮৫ দিন। তৃতীয় দফার বৈঠকে অর্থাৎ ১০ জুনে সংবিধানের একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া অনুমোদিত হয়। পূর্ণাঙ্গ মানে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে পূর্ণাঙ্গ। তারপরে বাকি রয়ে যায় ইংরেজি ভাষ্যের আইনি দিক এবং বাংলা ভাষ্যের ভাষাগত দিকের উন্নতিসাধন।
১৩ জুন কামাল হোসেন ভারত হয়ে ইংল্যান্ডে রওনা হন। উভয় দেশেই সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমাদের প্রস্তাবিত সংবিধানের মূল কাঠামো সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেন। আলোচনা যে হয়েছে, সে-খবর কাগজে বের হয়, যদিও তার মর্মবস্তু কী, তা প্রকাশিত হয়নি। এতেই দেশে রটে গেল যে, ভারত সরকারকে দিয়ে সংবিধানের খসড়া অনুমোদন করিয়ে আনতে কামাল হোসেন দিল্লি গেছেন–বিলেত যাওয়াটা আসলে কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে এই যাত্রায় লন্ডনে গিয়েই আইনি খসড়া-প্রণেতা রবার্ট গাথরিকে আমাদের সংবিধান-রচনায় সহায়তাদানের জন্যে নিয়োগ করে আসেন কামাল।
আমরা তিনজন যে ভাষান্তরের কাজ করছিলাম, তার একটা আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। আমার পরামর্শে খসড়া-প্রণয়ন কমিটিকে দিয়ে কামাল একটি ভাষা-বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করিয়ে নিয়েছিলেন–ইংরেজির সঙ্গে বাংলা পাঠ মিলিয়ে এই কমিটি ভাষাগত উন্নতিসাধনের প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে। এই কমিটি গঠিত হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মযহারুল ইসলাম ও আমাকে নিয়ে, আমি ছিলাম কমিটির আহ্বায়ক। ৩ থেকে ২০ জুলাইয়ের মধ্যে ১১টি বৈঠক করে (শেষ চারটিতে মযহারুল ইসলাম থাকতে পারেননি) বাংলা পাঠ সম্পর্কে এই কমিটি সুপারিশ প্রদান করে ১৯ আগস্টে।
তখনো ইংরেজি ভাষ্য চূড়ান্ত হয়নি। গাথরি তার কাজ মোটামুটি শেষ করেন সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখের দিকে। তিনি অবশ্য যখন যতটুকু সম্পন্ন করছিলেন, তা দিয়ে যাচ্ছিলেন আমাকে। তবু তাঁর পরিমার্জিত ভাষ্য-অনুযায়ী বাংলা পাঠ পরিবর্তন করতে হয়েছিল আমাদের। সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির চতুর্থ বৈঠকে মূলত বাংলা পাঠ এবং পঞ্চম বৈঠকে মূলত গাথরির পরিমার্জিত পাঠ চূড়ান্ত করা হয়।
১২ অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে বিল-আকারে খসড়া সংবিধান উপস্থাপিত হলো এবং সেই সঙ্গে সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টও পেশ করা হলো। কমিটির ছ জন সদস্যের ভিন্নমতসূচক মন্তব্য রিপোর্টে যুক্ত হয়। এঁদের মধ্যে আ ক মোশাররফ হোসেন আকন্দ সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে ‘সর্বশক্তিমান পরম করুণাময় ও দয়াময়ের নামে’ কথাগুলো যুক্ত করার প্রস্তাব করেন। ৪২ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে তিনি আপত্তি করেন এবং ৭০ অনুচ্ছেদ বর্জন করতে চান। ৪২ ও ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বড়োরকম আপত্তি করেন। আছাদুজ্জামান খান। তিনি নিজেকে সমাজতন্ত্র কায়েমের বিরোধী নন বলে অভিহিত করে বলেন যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার মৌলিক অধিকার, তার রক্ষাকবচ থাকতে হবে এবং কারো সম্পত্তি রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করলে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৭০ অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করে আবদুল মুস্তাকীম চৌধুরী বলেন যে, সাধারণ আইনদ্বারা সাময়িকভাবে এই বিধান রাখা যেতে পারে, এটি সংবিধানের অংশ হওয়া উচিত নয়, সংবিধানে রাখতে চাইলে তা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে উপস্থিত করতে হবে। তিনি চতুর্থ তফসিলে পরবর্তী নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ জ্ঞাপন করার প্রস্তাব করেন। ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে সবচেয়ে কড়া ভাষায় আপত্তি জানান হাফেজ হাবিবুর রহমান–তাঁর মতে, এতে দলীয় একনায়কত্বের ও দলীয় নেতার একনায়কত্বের সৃষ্টি হবে। তাঁর একটি বড়ো প্রস্তাব ছিল দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের–একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটে নিম্নপরিষদ ষাটজন সদস্যবিশিষ্ট উচ্চপরিষদ গঠন করবে, অর্থবিল উত্থাপনের একক অধিকার থাকবে নিম্নপরিষদের, বাকি সব বিষয়ে দুই পরিষদের থাকবে সমান ক্ষমতা, কোনো বিল সম্পর্কে দুই পরিষদের মতানৈক্য ঘটলে দুই পরিষদের যুক্ত বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিষয়ের মীমাংসা হবে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রায় পুরো সংবিধান সম্পর্কেই দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি থেকে তিনি চার নীতি বাদ দিতে চেয়েছিলেন প্রস্তাবনার পুনরুক্তি হয় বলে; মূলনীতিগুলো যে আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়, তাতে তিনি আপত্তি করেছিলেন; মৌলিক অধিকারের মধ্যে শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল পরিচালনা ও ধর্মঘটের অধিকার যোগ করতে চেয়েছিলেন; প্রত্যেক নাগরিকের সীমিত পরিমাণ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তি অর্জন, ধারণ বা বিলিব্যবস্থার অধিকার থাকবে, তবে সম্পদের সামাজিকীকরণের প্রয়োজনে ক্রমান্বয়ে সমুদয় সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত করা যাবে, এমন বিধান সংযোজন করতে চেয়েছিলেন; তিনি মহিলাদের জন্যে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন, তা নারীপুরুষের সমকক্ষতার ধারণার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ বলে; তিনি সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছরের জায়গায় চার বছর করতে চেয়েছিলেন; আইনজীবীদের মধ্য থেকে বিচারক নিয়োগের বিরোধী ছিলেন তিনি; সংবিধান প্রবর্তনের দিন থেকে মন্ত্রিসভা ভেঙে যাবে এবং ন্যাপ, আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি আর নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে–এই সরকারই নির্বাচন পরিচালনা করবেন, এমন একটি বিধান সংযোজন করতে চেয়েছিলেন। পেছন ফিরে মনে হয়, সুরঞ্জিতের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাব ছিল, বাংলাদেশের সকল উপজাতীয় জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক বিকাশের উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণ এবং তফসিলি সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণের জন্যে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করা। ক্ষিতীশচন্দ্র মণ্ডল তফসিলি সম্প্রদায়, তফসিলি উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির নাগরিকদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের উন্নতিবিধানের ব্যবস্থা সন্নিবেশ করতে চেয়েছিলেন রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিতে।
সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির কাছে গণপরিষদের বাইরে থেকে নানা ধরনের পরামর্শ-সংবলিত ৯৮টি স্মারকলিপি এসেছিল। সদস্যদের বিবেচনার জন্যে তা যথারীতি বিলি করা হয়েছিল।
গণপরিষদে সংবিধান-বিল উত্থাপিত হলে সংশোধনীর প্রস্তাব আসে ১৩৪টি, তার মধ্যে আওয়ামী লীগ-দলীয় সাংসদদের ৬০টি এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের একটি সংশোধনী গৃহীত হয়। ৭০ অনুচ্ছেদ শেষ পর্যন্ত সংশোধিত হয়। খসড়ায় যেখানে বলা হয়েছিল যে, দল থেকে পদত্যাগ করলে কিংবা বহিষ্কৃত হলে সেই দলের মনোনয়নলাভকারী সংসদ-সদস্য সংসদে তার সদস্যপদ হারাবেন, সেখানে সংশোধিত অনুচ্ছেদে বলা হলো, দল থেকে পদত্যাগ করলে বা দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তিনি সদস্যপদ হারাবেন। এই অনুচ্ছেদক্রমে প্রদত্ত কোনো আদেশ বা গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে আদালত প্রশ্ন করবেন না, মূলের এই বিধানও বাদ পড়ল।
একটা বড়োরকম পরিবর্তন এলো ৬ অনুচ্ছেদে। সংবিধান-বিলে এতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে। সরকারদলীয় সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া সংশোধনী এনে এর পরে যোগ করতে চাইলেন : বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালী বলিয়া পরিচিত হইবেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ-সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বললেন যে, পার্বত্য এলাকার অধিবাসীরা বাঙালি নয়; বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তারা নিজেদের বাংলাদেশি বলে বিবেচনা করে, কিন্তু তাদের কখনো বাঙালি বলে অভিহিত করা হয়নি; এই সংশোধনী গ্রহণ করলে চাকমা জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু সংসদ-সদস্যদেরা এক কথায় সংশোধনীটি সমর্থন করলেন, এটি গৃহীত হলো, মানবেন্দ্র লারমা প্রতিবাদে সংসদ-কক্ষ ত্যাগ করলেন।
পাহাড়ি জনসমষ্টির স্বাতন্ত্রের বিষয়টি সেদিন আমরা বুঝতে পারিনি। মানবেন্দ্র লারমাও সেদিন পাহাড়ি ও চাকমা প্রায় সমার্থক করে ফেলেছিলেন, অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর উল্লেখ করেননি। ২৪ বছর ধরে বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণ ঘটছিল; মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। পাকিস্তান আমলে পাহাড়িরা কখনো নিজেদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার কথা বলেনি। মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িদের কিছুসংখ্যক অংশগ্রহণ করেছিল–মিজো জাতিসত্তার সংগ্রাম তাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাহাড়িদের প্রথাগত নেতৃত্ব ছিল পাকিস্তান সরকারের মিত্র। তখনো রাঙামাটির রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ-বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত। বাংলাদেশ-বিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী স্বাধীনতার পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আশ্রয় নেয় এবং তাদের বিতাড়ন করতে সেখানে দুবার অভিযান পরিচালিত হয়–একবার ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য নিয়ে। এই অবস্থায় ১৯৭২ সালের জুন মাসে মানবেন্দ্র লারমার নেতৃত্বে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংহতি দল গঠিত হয়, সেটাও অনেকে ভালোভাবে দেখেনি।
পাহাড়িদের নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র যে সেদিন আমরা উপলব্ধি করতে সমর্থ হইনি, এ ছিল নিজেদের বড়োরকম এক ব্যর্থতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে প্রেরণা পেয়েও যে পাহাড়ি জাতীয়তাবোধের বা চাকমা জাতীয়তাবোধের সূচনা হতে পারে, এ-কথা একবারও আমাদের মনে হয়নি। নিজেদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাফল্যে আমরা তখন বেশিদূর দেখতে পারছি না, মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরে অন্য কোনো জাতীয়তাবোধ স্বীকার করতে পারছি না, বরঞ্চ তাকে সন্দেহের চোখে দেখছি। ৬ অনুচ্ছেদের ওই ছোট্ট সংশোধনীকে উপলক্ষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতিত্বের সঙ্গে পাহাড়িদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার যে-বিরোধ সেদিন সূচিত হলো, তার ফল কত সুদূরপ্রসারী হয়েছিল, তা এখন আমরা জানি।
এখানে একটি কথা বলা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। খসড়া সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টে যারা ভিন্নমতসূচক মন্তব্য যুক্ত করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এবং গণপরিষদে সংবিধান বিল উত্থাপনের পরে যারা সংশোধনী এনেছিলেন, তাঁদের অনেকেই কিন্তু নেয়ামাল বাসির বা আমাকে দিয়ে তাদের বক্তব্য বা সংশোধনীর ভাষা পরিমার্জনা করে নিয়েছিলেন। এতে কামাল হোসেন বা আর কেউ কিছু মনে করেননি। সেই উদারতার বাতাবরণ কখন যেন হারিয়ে গেল। হাফিজ হাবিবুর রহমান যে তখন প্রকাশ্যে দলীয় একনায়কত্বের ও দলীয় নেতার একনায়কত্বের সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, সে-কথাটাও মনে রাখার যোগ্য।
সংবিধান বিলের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বেশ দীর্ঘ ও তীব্র বক্তৃতা দিতেন। বঙ্গবন্ধু একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি সুরঞ্জিতের বক্তব্য শুনছি কি না। গণপরিষদের অধিবেশন চলাকালে আমি প্রায়ই সদস্যদের পেছনে আমলাদের সারিতে বসতাম–কোনো প্রশ্নে আইনমন্ত্রীর সাহায্য প্রয়োজন হলে সেখান থেকেই চিরকুট চালাচালি করতাম। তবে সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকতে পারতাম না। গণপরিষদ-ভবনে আমাকে যে-কক্ষটি বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেখানে বসে বিতর্ক শোনার ব্যবস্থা ছিল, শুনতামও। বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নের উত্তরে বললাম, মাঝে মাঝে শুনি। তিনি হেসে বললেন, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান। গণপরিষদে কনস্টিটিউশন নিয়ে আমি যেসব কথা বলেছি, সেসব কথাই এখন। সুরঞ্জিত আমাকে শোনাচ্ছে। তখনকার হাউজের ডিবেট পড়ে দেখো।
৪ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হলো। পাকিস্তানের সংবিধান তৈরি করতে লেগেছিল প্রায় নয় বছর, আমরা তা এক বছরের মধ্যেই পারলাম। এতে আত্মসন্তুষ্টির কারণ ছিল বই কী! একটা ভালো সংবিধান-রচনার জন্যে কামাল হোসেন দেশ-বিদেশের প্রশংসা পেয়েছিলেন, লর্ড ডেনিং তো উচ্ছ্বসিত ভাষায় একটি চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতালাভের পরে নিজেদের যে ঐক্য নষ্ট হতে শুরু করেছিল, সংবিধান-রচনার সাফল্যও সে-ঐক্য রক্ষা করতে পারল না। গণপরিষদে সংবিধান বিল উপস্থাপনের ঠিক আগে মওলানা ভাসানী দাবি করলেন, গণপরিষদে উত্থাপনের আগে, জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করে সেখানে সংবিধানের খসড়া আলোচনা করতে হবে। একই সময়ে আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজ বিবৃতি দিয়ে দাবি করলো, সংবিধান গণভোটে দিতে হবে। গণপরিষদে যখন খসড়া সংবিধানের আলোচনা চলছে, তখন, ২৩ অক্টোবরে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠা ঘটলো। আত্মপ্রকাশের মুহূর্তেই এটি হয়ে দাঁড়ালো বৃহত্তম বিরোধী দল। কাদের প্রেরণায় এবং কোন লক্ষ্যে এই নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠলো, এ-নিয়ে অনেক কানাঘুষো শোনা গেল। সরকার কী বুঝলো, জানিনা, কিন্তু মনে হয়, একটা শক্ত অবস্থান নিলো অর্থাৎ সহনশীলতার মাত্রা কমলো।
এদিকে সংবিধানে বলে দেওয়া হলো যে, সংবিধানের একটি নির্ভরযোগ্য বাংলা পাঠ ও একটি নির্ভরযোগ্য ইংরেজি পাঠ থাকবে এবং উভয় পাঠের মধ্যে বিরোধ ঘটলে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে। এতে একইসঙ্গে গৌরব ও দায়িত্বের বোধ জেগেছিল আমার, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভীতি ও শঙ্কার ভাবও যে জাগেনি, তাও নয়।
১৩.
নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো ১৯৭২ সালের ২৪ মে। উদ্যোগটা সম্পূর্ণতই বাংলাদেশ সরকারের। কলকাতা থেকে যাকে তারা সঙ্গে করে নিয়ে এলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় ছিল আমাদের বন্ধু মোস্তফা সারোয়ার। বিমানবন্দরে এবং তার জন্য বরাদ্দ বাড়িতে বিপুল জনসমাগম হয়েছিল। পরদিন তাঁর জয়ন্তীও পালিত হয়েছিল জাঁকজমকের সঙ্গে। সরকারিভাবে কথাটা না বলা হলেও সবাই জানত যে, তিনি পাকাপাকিভাবেই এখানে থেকে যাবেন। তবু দ্রুত তাকে দেখার জন্যে মানুষের ছিল অদম্য উৎসাহ। সে-যাত্ৰা আমি তাকে দেখতে যেতে পারিনি। বস্তুতপক্ষে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম বেশ দেরিতে, তাও বেশিক্ষণ থাকিনি–আমার খুব অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল। যদিও কলকাতায় অসুস্থ কবিকে দেখতে গিয়েছি একাধিকবার, এবারে খারাপ লাগছিল বেশি। সে কি আমার অনুভূতি আগের চেয়ে তীক্ষ্ণ হয়েছে বলে, না তাঁকে দেখার কৌতূহল আগেই মিটে গিয়েছিল বলে? কলকাতায় একবার দেখেছি তাকে একান্তে–পারিবারিক পরিমণ্ডলে, আরেকবার বহুজনের মধ্যে–জন্মোৎসবের উদ্দীপনায়। এবারে উপলক্ষ ছাড়াই অনেক অনুরাগীর দলভুক্ত হয়ে তাঁকে দেখলাম। এখানে তার প্রাণধারণের উপকরণ উন্নত হয়েছে বটে, কিন্তু পারিবারিক পরিবেশ-রচনার প্রয়াস তত সফল হয়নি। পরে তাঁর জন্মদিনে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তার সম্পর্কে কিছু বলার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কিন্তু যেভাবে সেদিন গাড়ি থেকে টেনে-হিঁচড়ে তাঁকে বাংলা একাডেমির সভামঞ্চে তোলা হয়েছিল, তা দেখার বেদনায় আমার সৌভাগ্যলাভের আনন্দ ম্লান হয়ে গিয়েছিল। সে-কথা যথাস্থানে।
১৪.
১৯৭২ সালের ৬ জুন। গণপরিষদ ভবনে বসে কাজ করছি। টেলিফোনে খবর পেলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের শিক্ষক, কবি হুমায়ূন কবির আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হুমায়ূন আমার সরাসরি ছাত্র ছিল। তার সাহিত্যচর্চা ও সমাজচিন্তা এবং মন ও মননের যেটুকু পরিচয় পেয়েছিলাম, তাতে আমি প্রীত হই। বইপত্র ঘটতে ও নিয়ে যেতে সে প্রায় আমার বাসায় আসত এবং সে-উপলক্ষে নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হতো। পরে তার কোনো আচরণে আমি বিরক্ত হয়েছিলাম এবং সেও তা টের পেয়েছিল। ফলে আমার সঙ্গে তার একটা দূরত্ব রচিত হয়। আমি যে-বছর চট্টগ্রামে চলে যাই–১৯৬৯ সালে–সে-বছরে সে এম এ পাশ করে। তারপর বাংলা একাডেমির বৃত্তি নিয়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে গবেষণায় প্রবৃত্ত হয়। সে বিয়ে করেছিল তার সহাধ্যায়ী, আমার প্রিয় ছাত্রী, সুলতানা রেবুকে। আমি চট্টগ্রামে থাকায় এ-সময়টায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেয়।
হুমায়ূনের নিহত হওয়ার খবর পেয়ে তার বাড়ি যেতে চাইলাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এমন কাউকে পাওয়া গেল না।
পরে শুনতে পাই, হুমায়ূন ছিল পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির একজন নেতা। সিরাজ শিকদারের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় সে দল থেকে সরে আসে। এ সময়েই, ১৯৭২ সালের গোড়ায়, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ম গ্রহণ করে। তার পূর্বতন রাজনৈতিক সহকর্মীরা তা অনুমোদন করেনি। দলের জন্যে সে বিপজ্জনক বিবেচিত হয়। তাকে বাড়ির বাইরে ডেকে নিয়ে গুলি করে অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী।
হুমায়ূনের মৃত্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে যে-শোকসভা হয়, তাতে যোগ দিয়েছিলাম। বিভাগের সহকর্মীদের সঙ্গে তখন আমার সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ। তাঁদের অনুরোধে হুমায়ূন সম্পর্কে আমিও দু-চারটি কথা বলি। তার অপমৃত্যুতে আমি প্রকৃতই গভীর শোক উপলব্ধি করেছিলাম।
১৫.
তাজউদ্দীন আহমদ আহ্বান জানালেন, তাঁর বাজেট-বক্তৃতা-প্রণয়নে সাহায্য করতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলাম। বিমানবন্দর থেকে অর্থমন্ত্রীর একান্ত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরী আমাকে সরাসরি নিয়ে গেলেন রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা ‘পদ্মা’য়। বাজেট পেশ না হওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে আর বের হওয়া যাবে না। যে-তিন বছর তাজউদ্দীন বাজেট দিয়েছিলেন, সে-তিন বছরই আমি একবার করে সরকারি অতিথি হয়েছিলাম।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট-বক্তৃতার একটা খসড়া মন্ত্রণালয় থেকে করে দেওয়া হতো। প্রথম বছরে খসড়াটা ছিল ইংরেজিতে, পরের দুবার ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর তার বাংলা ভাষ্য তৈরি করে রেখেছিল। আমি প্রথমবার সেটা অনুবাদ করেছি, পরের দুবার বাংলা ভাষ্য খানিকটা সরল করেছি। তারপর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন এবং পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নূরুল ইসলাম একযোগে এসে তাতে কিছু যোগ-বিয়োগ করেছেন। আমি অন্যত্র বলেছি, বাংলা ও ইংরেজি দুটো ভাষাই তাজউদ্দীন খুব ভালো জানতেন। বাক্যগঠনে ও শব্দপ্রয়োগে একটু খুঁতখুঁতেই ছিলেন তিনি। জুতসই শব্দ না পাওয়া পর্যন্ত কিংবা মনমতো বাক্য গঠন না হওয়া পর্যন্ত তিনি পরবর্তী বাক্যে যেতে চাইতেন না। বিষয় ও ভাষা উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর মনোযোগ ছিল সম্পূর্ণ। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতেন, মাঝে মাঝে বাংলা প্রতিশব্দের দুরূহতা সম্পর্কে নালিশ করতেন। আমার কাজ সম্পূর্ণ হলে ড. কামাল হোসেন বাজেট-বক্তৃতার ইংরেজি পাঠ তৈরি করতেন–খানিকটা মন্ত্রণালয়ের আদি খসড়ার সাহায্যে, বাকিটা তাজউদ্দীন, নূরুল ইসলাম ও আমার সঙ্গে আলোচনা করে। নূরুল ইসলাম একবার হাসতে হাসতে তাজউদ্দীনকে বলেছিলেন, আমরা এত ঘুরপথে যাই কেন? প্রথমে মিনিস্ট্রির ড্রাফট, তারপর ড. আনিসুজ্জামানের বাংলা, তারপর আমাদের সংশোধন, সবশেষে ড. কামাল হোসেনের ইংরেজি। প্রসেসটা আরেকটু ডাইরেক্ট করলে হয় না?
১৯৭২ সালে আমাদের জাতীয় সংসদ ছিল না। গণপরিষদে বাজেট উত্থাপনের কথা নয়। তাই বাংলাদেশের প্রথম বাজেট উপস্থাপিত হয়েছিল বেতার-টেলিভিশনে, পরে সংবাদ-সম্মেলনে যথারীতি এ-সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। প্রথম বাজেট-বক্তৃতায় তিনি এজন্য দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন এবং আশা পোষণ করেছিলেন যে, এরপর থেকে জনপ্রতিনিধিদের সামনেই বাজেট পেশ করা হবে। সে আশা বাস্তবে রূপ নিয়েছিল।
১৯৭২ সালের বাজেট-বক্তৃতার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল রাষ্ট্রায়ত্তকরণ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বিশেষ বিশেষ শিল্প ও বাণিজ্যের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের প্রতিশ্রুতি ছিল। তাছাড়া ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফায় এবং তার আগে-পরে নানা দলের ইশতেহারে কিংবা নানারকম সম্মেলনের প্রস্তাবে ব্যাংক, বীমা, চা ও পাট শিল্প প্রভৃতি রাষ্ট্রায়ত্তকরণের দাবি ছিল। এ নিয়ে বড় একটা আপত্তিও শোনা যায়নি। কিন্তু ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে যখন প্রধান প্রধান শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত হলো, তখন ‘গেল গেল’ রব পড়ে গেল এবং এই ব্যবস্থাগ্রহণের মধ্যে ভারতের স্বার্থ বা ইঙ্গিত আবিষ্কৃত হলো। সমালোচনা প্রবল হয় বাঙালি মালিকানাধীন শিল্প অধিগ্রহণ করায়। কিন্তু ব্যাংক-ব্যবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত করলে বাঙালি পরিচালনাধীন ব্যাংক তার থেকে বাদ দেওয়া কিংবা পাটশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করলে বাঙালি মালিকানাধীন পাটশিল্প তার আয়ত্তের বাইরে রাখা তো সম্ভবপর ছিল না। রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের বেশির ভাগই ছিল পাকিস্তান আমলের সরকারি উদ্যোগ এবং পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি–এক-চতুর্থাংশেরও কম ছিল বাঙালি উদ্যোক্তাদের সম্পদ। এসব কথা তখন আমরা আলোচনা করেছিলাম, সব যে বাজেট-বক্তৃতার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তা নয়।
আরো একটি কথা সেদিন আলোচনায় এসেছিল। সমালোচকদের একটি বক্তব্য ছিল এই যে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চালানোর মতো দক্ষ জনশক্তি সরকারের নেই। তাজউদ্দীন ও নূরুল ইসলাম উভয়েই মনে করতেন যে, বেসরকারি অবস্থায় প্রতিষ্ঠান চালানোর মতো দক্ষ ব্যক্তি যদি দেশে থেকে থাকেন, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করলে তাদের সাহায্যেই তা চালানো যেতে পারবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে যদি বিদেশি বিশেষজ্ঞ আনাবার প্রয়োজন হয়, সরকারও তাহলে সে-কাজটি করতে পারে। এই নীতিই বাস্তবে অনুসৃত হয়েছিল। ফল হয়তো আশানুরূপ হয়নি। তার অনেক কারণও ছিল।
পরে শুনেছি, রাষ্ট্রায়ত্তকরণের বিষয়ে মন্ত্রিসভায় মতানৈক্য ছিল, কিন্তু এটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অতএব পালনীয়, বঙ্গবন্ধুর এই যুক্তি খণ্ডন করা যায়নি। মুজিববাদ সম্পর্কে প্রশ্ন করায় বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রীয় চার নীতিতে বিশ্বাসী, আবার আলাদা করে বলেছিলেন, তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। সমাজতন্ত্র বলতে তিনি ঠিক কী বুঝতেন, আমরা তা কখনো স্পষ্টভাবে জানতে পারিনি। তবে এক ধরনের সমতাভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন তিনি দেখতেন। শিল্প-বাণিজ্যের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের পাশাপাশি ভূমি সংস্কারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১০০ বিঘা হবে জমির ব্যক্তিগত মালিকানার সীমা, খাসমহলের জমি ভূমিহীনদের বিতরণ করা হবে। এসবের কিছু কিছু কার্যকরতার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু জমির ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মধ্য থেকেই বাধা ছিল অনেক বেশি, কেননা তার সংস্কার ঘটলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন, তাঁদের মধ্যে ওই দলেরই লোকজন ছিলেন অধিক। তাই রাষ্ট্রায়ত্তকরণ শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে এবং তার পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ছোটো ও মাঝারি ধরনের শিল্প বাণিজ্যের উদযোগ রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত হয়। উৎসাহিত করার এই নীতির কথা প্রথম বাজেট-বক্তৃতায় ছিল।
এখানে একটি শোনা কথা বলি–কাগজপত্র যাচাই করে নিতে পারলে ভালো হতো। ১৯৭০-৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তানের বাজেটে মাদ্রাসা শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রণীত ১৯৭১-৭২ সালের বাজেটে তা বৃদ্ধি করা হয়। ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটের খসড়া প্রণয়নের সময়ে মাদ্রাসা শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ১৯৭০-৭১ সালের স্তরে ফিরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। পরে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, অব্যবহিত পূর্ববর্তী অর্থবছরের বরাদ্দের চেয়ে তা কমানো যাবে না। সুতরাং যথাপূর্বং তথাপরং।
বাজেট-বক্তৃতা-রচনায় সাহায্য করতে গিয়ে তখন একটি বিষয় উপলব্ধি করি। তা হলো, পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের আমলাদের বিরোধ। পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা কিংবা অনেক কর্মকর্তার সচিবের পদমর্যাদা এবং তাঁদের সার্বিক কর্তৃত্ব উচ্চপদস্থ বেসরকারি আমলাদের পছন্দ ছিল না। ভেতরে হয়তো আর কিছু ছিল। মহীউদ্দীন খান আলমগীর তখন সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক, তার শিক্ষক নূরুল ইসলাম আমার সামনেই তাকে বলেছিলেন, সিভিল সার্ভিস বনাম পরিকল্পনা কমিশনের অকারণ এই বিরোধ মীমাংসার জন্যে উদযোগ নিতে পারো না? তিনি তাদের সমিতির সভাপতি সৈয়দ আবুল খায়েরের সঙ্গে এ-বিষয়ে আলোচনায় বসতে রাজি।
বাংলাদেশ সার্বিক সমস্যার মধ্য দিয়ে পথ চলছিল। বড় বড় সমস্যার মধ্যে কত ছোটো ছোটো সমস্যা লুকিয়ে থাকে, বাইরে থেকে তা বোঝা যায় না।
প্রথম বাজেট-বক্তৃতার কাজ শেষ হওয়ার পরে নূরুল ইসলাম আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাংলা ভাষ্য দেখে দেওয়ার। অবশ্য এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনই পুরো পরিকল্পনার বাংলা ভাষ্য তৈরি করে দেন। একাধিক হাতের রচনা হওয়ায় তাতে অল্পস্বল্প অসংগতি থেকে যায়। চট্টগ্রামে বসেই আমি পাণ্ডুলিপি দেখে দিই। খুব বেশি যে কিছু করেছিলাম, তা নয় সময়ও ছিল খুব সংকীর্ণ। তবু ওই দলিলের সঙ্গে আমার একটা সংযোগ ছিল, তা ভাবতে ভালো লাগে।
এখানে আরেকটি উদ্যোগের কথা বলে রাখি। বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখার দুই কর্মী স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ব্যাংকের ফরম বাংলায় অনুবাদ করতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। এজন্যে কোনো পারিশ্রমিক তারা পেতেন না। প্রতি রোববার তারা আমাকে তাদের অনুবাদ দিয়ে যেতেন, পরের রোববারে নিয়ে যেতেন। শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-ক্যম্পাসে আসা-যাওয়ার জন্যে কেবল তারা অফিসের গাড়ি ব্যবহার করতে পারতেন। আমাকে যে-কোনো সম্মানী দেওয়া যাচ্ছে না, তা নিয়ে তাঁদের কুণ্ঠার অবধি ছিল না। তারা যে-মনোভাব থেকে কাজে নেমেছিলেন, সেই মনোভাব থেকে আমিও তাদের সহযোগিতা করেছিলাম। আমার পরামর্শ যদি তাঁদের কাজে লেগে থাকে, তবে তাদের কাছ থেকে আমিও কিছু শিখেছিলাম। তবে প্রকৃতই মুগ্ধ হয়েছিলাম তাদের নিষ্ঠায়।
১৬.
১৯৭২ সালের ২৭ আগস্ট ঢাকায় অধ্যাপক এ এফ এম নূরুল ইসলামের ক্লিনিকে আমার পুত্রের জন্ম হয়। সবাই খুশি। ওর নাম আনন্দ রাখায় আমার আব্বা বেশ সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি কলকাতার সিটি স্কুলের ছাত্র ছিলেন, সেই সূত্রে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রথম সভাপতি এবং ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আনন্দমোহন বসুর প্রতি তাঁর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল। তিনি বললেন, র্যাংলারের নামে ওর নাম রেখেছ, বড় হয়ে বিদ্বান হবে। বিদ্যার প্রতি আনন্দের যে বিশেষ অনুরাগ হয়েছে, তা নয়, তবে ওর সব পরীক্ষার ফলাফল ভালো এবং এ-পর্যন্ত সে তিনটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছে–একটি বিদেশি। তবে তা নামমাহাত্মের ফল নয় নিশ্চয়।
১৭.
বাংলাদেশের জন্যে ১৯৭৩ সালের সূচনাটা ভালো হয়নি। ১ জানুয়ারি ঢাকায় ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে, প্রাণহানি ঘটে।
যখন মনে হয়েছিল ভিয়েতনামের যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে, প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হতে যাচ্ছে শান্তিপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, তখনই ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহ বোমাবর্ষণ করে উত্তর ভিয়েতনামে। তারই প্রবল প্রতিবাদ হয়েছিল বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সরকারও এই বোমা হামলার নিন্দা করেছিলেন। সবাইকে জানিয়েই বিক্ষোভ মিছিল আয়োজিত হয় ঢাকায়। তার নেতৃত্বে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা। পুরানা পল্টনের দিক থেকে তোপখানা রোড ধরে মিছিল অগ্রসর হয়। প্রেস ক্লাবের উলটোদিকে ছিল ইউ এস আই এসের দপ্তর। বিক্ষোভকারীরা ইট-পাটকেল ছুঁড়েছিল সেই দপ্তর লক্ষ করে। তখনই পুলিশ গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন। বিভাগের ছাত্র মতিউল ইসলাম এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র মীর্জা কাদের। আহত হয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংসদের সহ-সভাপতি আবুল কাসেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আমিরুল ইসলাম ও ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ফরিদ হোসেন, কোনো স্কুলের ছাত্র পরাগ, দৈনিক বাংলার আলোকচিত্রী রফিকুর রহমান এবং হয়তো আরো কয়েকজন। স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রথম গুলি চলল মিছিলে। আমরা হতবাক, বিমূঢ়। ঘটনাক্রমে আমি সেদিন ঢাকায়। দিভ্রান্তের মতো একবার অকুস্থলে যাই, একবার যাই কামাল হোসেনের বাড়িতে। কামাল শোকার্ত ও ক্ষুব্ধ। তিনিও বলতে পারেন না, গুলি চালানোর নির্দেশ কে দিয়েছিলেন। কেউ আমলাদের দোষ দেয়। কিন্তু আমলাদের এত সাহস হবে, তা বিশ্বাস হয় না। প্রধানমন্ত্রী নাকি জানতেন না। তাহলে অন্তত মন্ত্রী-পর্যায়ে কেউ না কেউ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা বা ম্যাজিস্ট্রেটকে।
গুলি চলে বারোটা-সাড়ে বারোটায়। সারা শহরের মানুষ বিক্ষুব্ধ। বিকেল নাগাদ দৈনিক বাংলা এই খবর দিয়ে বের করে টেলিগ্রাম। খবর, প্রতিক্রিয়া আর ছবি। সরকারি ভাষ্য তখনো পাওয়া যায়নি। পরদিনের সংবাদপত্রে তা বেরিয়েছিল। সেই গতানুগতিক ব্যাখ্যা। বিদেশি দূতাবাসের দপ্তর রক্ষা করতে, আক্রান্ত পুলিশ আত্মরক্ষা করতে নিরুপায় হয়ে গুলি ছুঁড়েছে। বঙ্গবন্ধু দুঃখ প্রকাশ করলেন, বিচারবিভাগীয় তদন্তের আশ্বাস দিলেন। কিন্তু তখনই যে তদন্তের ভার কোনো বিচারপতিকে দেওয়া হয়েছিল, এমন মনে পড়ে না।
প্রতিবাদে সি পি বি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন হরতাল আহ্বান করে ৩ জানুয়ারিতে। মওলানা ভাসানী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল নিন্দাজ্ঞাপন করেন। ৩ তারিখে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উলটোদিকের গোল চত্বরে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয় (ফলকটি এখনো আছে, অনাদরে ধুলো সঞ্চয় করেছে বছরের পর বছর ধরে; তবু আছে, এই যা)। শিল্পী-সাহিত্যিকদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদসভা আহ্বান করেন সুফিয়া কামাল, জসীমউদ্দীন, রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, কামরুল হাসান, (স্থপতি) মাজহারুল ইসলাম, সরদার ফজলুল করিম, সজীদা খাতুন, জাহেদুর রহিম, সৈয়দ হাসান ইমাম, কায়সুল হক, আলী আকসাদ, আবদুল হালিম, বজলুর রহমান (আপসো), সাইফুদ্দৌলা (ছায়ানট), ইকরাম আহমদ (উদীচী), আরিফুল হক (আমরা কজন)। এঁদের আহ্বানে সমাবেশ হয়, মিছিল হয়।
প্রথমে মনে হয়েছিল, সরকার নিজের ভুল ধরতে পেরেছে। মন্ত্রীরা কেউ কেউ নিহতদের পরিবারকে সহানুভূতি জানাতে গেলেন, দুঃখপ্রকাশ করে বিবৃতি দিলেন। তারপরই সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতা, যুবনেতা, ছাত্রনেতাদের কণ্ঠে নিঃসৃত হলে কঠোর ভাষায় সাবধানবাণী। তারা জানালেন, বঙ্গবন্ধুর কুৎসা জাতি সহ্য করবে না, এই ঘটনাকে উপলক্ষ করে কাউকে ফায়দা লুঠ করার সুযোগ দেওয়া হবে না, চক্রান্ত বরদাশত করা হবে না। হাসান হাফিজুর রহমান তখন দৈনিক বাংলার সম্পাদক, তোয়াব খান তার নির্বাহী সম্পাদক। সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা প্রশাসনযন্ত্রের ঘটানো ঘটনার নিন্দা করে টেলিগ্রাম বের করেছে, তা গণ্য হলো শোচনীয় বলে এবং তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব গিয়ে পড়ল ওই দুজনের ওপরে। ৬ তারিখে উভয়েই দৈনিক বাংলা থেকে অপসৃত হলেন। নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী নিযুক্ত হলেন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রশাসক। পত্রিকার সব বিভাগের কর্মীরা প্রতিবাদ করলেন, তাঁদের প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ওই আদেশ প্রত্যাহারের আবেদন জানালেন। বঙ্গবন্ধু তাদের অনুরোধ বিবেচনার আশ্বাস দিলেন, কিন্তু হুকুম নড়ল না। তোয়াবকে নেওয়া হলো সরকারে আর খানিকটা দেরি করে হাসানকে পাঠানো হলো মস্কোতে, আমাদের দূতাবাসে প্রেস কাউনসেলর করে।
১৮.
সেই যে বিনা পরীক্ষায় পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত করে দেওয়া হলো। ছাত্রছাত্রীদের, তার ফল আমরা অচিরেই ভোগ করতে শুরু করলাম। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসেই ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে দাবি উঠলো সিলেবাস কমানোর। উঠবে নাই বা কেন? আগের ক্লাসের পড়া যে শেখেনি, পরীক্ষাগারে নির্ধারিত পরীক্ষা করেনি, পরের ক্লাসের পড়া কিংবা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক পরীক্ষা তার কাছে তো দুরূহ মনে হবেই। এর প্রতিকার না-পড়া বিষয় জেনে নেওয়া নয়–সেই সময় ও সুযোগ কারো নেই–প্রতিকার আরো না-শেখা। অতএব, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করার আন্দোলন শুরু হলো। প্রথম-প্রথম কেউ গা করেননি এতে, কিন্তু দেখা গেল ছাত্রেরা না-শেখার পণ করেছে। মাস ছয়েক পরে ছাত্র হিতৈষী শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্থির করলো, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্যসূচি অর্ধেক করে দেওয়া হবে। জয়ধ্বনি করতে করতে আন্দোলনকারী ছাত্রেরা ক্লাসে ফিরে গেল। ওদিকে গণপরীক্ষার ফলও সেবার হলো খুব সন্তোষজনক। অত উচ্চহারে পাশ এর আগে আর দেখা যায়নি, কারণ পরীক্ষার্থীরা বেশ স্বাধীনভাবে পরীক্ষা দিয়েছে।
১৯৭০ সালে একবার ডিগ্রি পরীক্ষা কেমন চলছে, তা দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে আমরা কজন শিক্ষক গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রে। আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পরীক্ষার্থীরা আমাদের কাজকর্মে এতই ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে, অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার শাহেদ লতিফের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এবারো ওই কাজে অভিজ্ঞতা ভালো হলো না। ভিক্টোরিয়া কলেজের বাংলার শিক্ষক আলী আসগর ভুইয়া যে-গল্প শুনিয়েছিলেন, তা-ই ছিল এবারকার সেরা সঞ্চয়। পরীক্ষার খাতায় যে-রচনা লিখেছে এক পরীক্ষার্থী–সম্ভবত সে পরীক্ষার্থিনী–তার শেষ বাক্য ছিল : তুমি লিখিয়া সুফিয়াকে দিবে। অর্থাৎ বাইরে থেকে যিনি নকল সরবরাহ করেছিলেন, তিনি। প্রচুরতম লোকের প্রভূততম হিতসাধনের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই কাগজটি যাতে আরো একজন পায়, তার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম প্রাপক সেই নির্দেশ প্রেরিত রচনার অংশ বিবেচনা করে সেটাসুদ্ধ লিখে দিয়েছে। দ্বিতীয় গল্পটি ছিল এক পরীক্ষার্থীকে নিয়ে, যে পরীক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে শৌচাগারে গেছে সেখানে রেখে-আসা বইপত্র দেখে আসতে। তত্ত্বাবধায়ক তা টের পেয়ে পিয়ন পাঠিয়েছেন তাকে ধরে আনতে। দরজায় ধাক্কা দিয়ে ব্যর্থ হয়ে পিয়ন ফিরে এলো। তত্ত্বাবধায়ক তাকে দিয়ে এবারে বলে পাঠালেন, পরীক্ষার্থী বেরিয়ে না এলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছেলেটি গজগজ করতে করতে বেরিয়ে এলো : গোলমালে-গোলমালে সারা বছরটা কেটে গেল, এখন যে একটু পড়াশোনা করে পরীক্ষা দেবো–তারও উপায় নেই।
সকল শিক্ষক অবশ্য ওই তত্ত্বাবধায়কের মতো নিষ্ঠুর ছিলেন না। অনেকেই, ছাত্রদের ভাষায়, বেশ সহযোগিতা করেছেন পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে।
আমরা যখন অন্যের ঘর সামলাতে ব্যস্ত, তখন যে আগুন লেগেছে নিজের ঘরেই, তা বুঝতে একটু দেরি হয়েছিল। টের পেলাম যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রেরা দাবি করে বসলো, এম এ ফাইনালে তারা লিখিত পরীক্ষা দেবে না, মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে তাদের ফল নির্ণয় করতে হবে। আমাদের শিরে বজ্রাঘাত। শিক্ষকেরা এ-দাবি মানবেন না, পরীক্ষার্থীরাও ছাড়বে না। আবেদন নিবেদন শেষ হলে শুরু হলো সংগ্রামের পালা। উপাচার্যের দপ্তরে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা পর্যবসিত হয় ঘেরাওয়ে। আমরা না-খেয়েদেয়ে সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাই, ছাত্রেরা পালা করে খেয়েদেয়ে এসে আমাদের ঘেরাও করে রাখে, কটুকাটব্য করে, স্লোগান দেয়। একসময়ে তারা পাহারা উঠিয়ে নেয়। আবার আলোচনা, আবার ঘেরাও। উত্তাপ বাড়তে থাকে। শেষে উপাচার্য ইন্নাছ আলী নিজেই সিদ্ধান্ত নেন : লিখিত পরীক্ষা হবে, তবে সে-পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হবে না; যারা লিখিত পরীক্ষা দেবে না, তারা কেবল মৌখিক পরীক্ষা দেবে। অর্থাৎ কেউ লিখিত ও মৌখিক দুটো পরীক্ষা দিয়ে, আর কেউ শুধু মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে, এম এ ডিগ্রি অর্জন করবে। ডিপ্লোমায় কোনো পার্থক্য থাকবে না, তবে নম্বরপত্রী দেখলে তফাৎটা বোঝা যাবে।
আমি এই ব্যবস্থা মেনে নিতে পারলাম না। অমন পরীক্ষার সঙ্গে কোনো সংস্রব রাখবো না বলে ছুটি নিয়ে সপরিবারে কলকাতায় চলে গেলাম। বিভাগের দায়িত্ব বর্তালো ড. মোহাম্মদ আবদুল আউয়ালের ওপরে। তিনিই অন্য সহকর্মীদের সাহায্যে পরীক্ষা নিলেন। বেশির ভাগই শুধু মৌখিক পরীক্ষা দিলো। তার একটা কারণ, লিখিত পরীক্ষা না-দেওয়ার জন্যে পরীক্ষার্থীদের ওপর আন্দোলনকারীদের চাপ। একজন ভালো ছাত্র–তার অন্য গুণও ছিল–সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার করেছিল। তার প্রতি স্নেহ ও সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে আমি তার আনুকূল্য করতে পারিনি–করিনি বললেই ঠিক বলা হয়। সেজন্যে আমার মনে আজো দুঃখ আছে, কিন্তু আবারো ওই অবস্থায় পড়লে আমি ঠিক ওই আচরণই করতাম।
আমার কলকাতায় যাওয়ার আগে, ৭ মার্চ, দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। আমাদের ভোটকেন্দ্র ক্যাম্পাসের সন্নিহিত এলাকায়। দুই গাড়ি করে আমরা একসঙ্গে ভোট দিতে গেলাম–উপাচার্য ইন্নাছ আলী, রেজিস্ট্রার মুহম্মদ খলিলুর রহমান, ইংরেজি বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী আর আমি। স্বাধীন দেশে এই প্রথম ভোট দিতে যাচ্ছি–মনের মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সে-উৎসাহ দপ করে নিভে গেল। জানলাম, আমাদের ভোট দেওয়া হয়ে গেছে।
আমাদের এলাকায় সরকারদলীয় প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। নিজের ভোটটা আমি তাকেই দিতাম। তিনি এমনিতেই জিততেন। তবে উৎসাহী রাজনৈতিক কর্মীরা সে-আশার ওপর ভর করে নিশ্চেষ্ট থাকতে চায়নি।
পরীক্ষা না দিয়ে পাশ করতে চাওয়া আর ভোট না দিতে দিয়ে নিজেদের প্রার্থীকে পাশ করাতে চাওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য আমি দেখতে পাইনি।
এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৯৩টি। প্রায় দশটা আসনের ফলাফলের যথার্থতা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন ছিল।
১৯.
শেষবার কলকাতায় এসেছিলাম শরণার্থী হিসেবে, এবার এলাম স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে। একটু গর্ববোধ তো ছিলই। আগের মতো এবারেও উঠলাম ছোটোফুপুর বাড়ি। মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধুরা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চান। বলি, সমস্যা পর্বতপ্রমাণ, মন্দ অনেক কিছু ঘটছে, কিন্তু ইতিবাচক ব্যাপারও যা হচ্ছে, তা থেকে আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে।
১৯৭১-এ বেবী প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত সে কোনো বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে যাবে না। আমি একবার নাটক দেখতে গিয়েছিলাম, তাকে নিতে পারিনি। এবারে সে জানালো, সে নাটক দেখতে যাবে এবং আমাকে তখন ঘরে বসে বাচ্চাদের সামলাতে হবে। তাই হলো। একাদিক্রমে সে চারটি নাটক দেখে খুশি হয়ে ফিরেছিল : টিনের তলোয়ার, শের আফগান, পাগলা ঘোড়া, তিন পয়সার পালা।
এবার কলকাতা সফর ছিল পুনর্মিলনের আনন্দে পরিপূর্ণ, ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতাপ্রকাশের সুযোগ তাতে ছিল। আড়াই সপ্তাহ কলকাতায় আনন্দময় সময় কাটিয়ে যথাস্থানে ফিরে এলাম।
২০.
অধ্যাপক ড্যানিয়েল থরনার জাতিতে মার্কিন, কিন্তু সত্তরের দশকে তিনি ছিলেন সোরবোনের ইকোল প্রাতিক দেজৎ ইতুদের দিরেক্তর দেতুদ। এই অর্থনীতিবিদ ছিলেন আমাদের অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক মুশারফ হোসেন ও ড. স্বদেশরঞ্জন বসুর বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি নূরুল ইসলামের স্ত্রী ও সন্তানদের বাংলাদেশের বাইরে নিতে সাহায্য করেছিলেন, তাছাড়া নিজে প্যারিস থেকে কলকাতায় এসেছিলেন বন্ধুবান্ধবদের খোঁজখবর করতে। তখনই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। ১৯৭৩ সালে স্বদেশ বসু যখন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের পরিচালক, তখন তাঁর কাছে জানতে পারি, সে-বছরেই প্যারিসে ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ওরিয়েন্টালিস্টের দ্বিশতবর্ষপূর্তি উদ্যাপিত হবে এবং ড্যানিয়েলের ইচ্ছা, আমি তাতে যোগ দিই। আমি এই প্রস্তাবে একটু অবাকই হই, তবে সাগ্রহে সম্মতি দিই। যথাসময়ে আমন্ত্রণপত্র এবং টিকিট এসে গেল এবং আমি ফরাসি জাতীয় দিবসে ঢাকা থেকে রওনা হলাম–তবে দিল্লিতে। সেখানে আমাদের হাই কমিশনার ড. এ আর মল্লিকের বাড়িতে একদিন থেকে যাত্রা করলাম বোম্বাইয়ে, সেখান থেকে। সোজা প্যারিস।
ঢাকা বিমানবন্দরে এসে দেখলাম, অধ্যাপক আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালক ড. এম এ গফুর সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে কংগ্রেসে যোগ দিতে যাচ্ছেন। বোম্বাইতে পেলাম ভারতীয় প্রতিনিধিদলের পশ্চিমবঙ্গীয় সদস্যদের ইতিহাসবিদ ড. বরুণ দে, ড. অনিরুদ্ধ রায়, ড. হিতেশরঞ্জন সান্যাল, ড. কল্যাণকুমার দাশগুপ্ত এবং সাহিত্যিক ও তুলনামূলক সাহিত্যবিশারদ ড. নবনীতা দেবসেনকে। বিমানভ্রমণ আনন্দে কাটল। প্যারিসে আমাদের কারো থাকবার জায়গা নির্দিষ্ট নেই। কংগ্রেস-উপলক্ষে সারা দুনিয়া। থেকে লোক এসেছে–থাকার জায়গা সুলভ নয়। নগরটা অনিরুদ্ধের নখদর্পণে–সুতরাং সে-ই ভরসা। দুই ট্যাকসি করে বঙ্গসন্তানেরা জায়গা খুঁজতে বেরোলাম। অনিরুদ্ধ প্রথমে হবিবুল্লাহ্ ও গফুরের ব্যবস্থা করলো, তারপর অদূরে আমাদের দুজনের। হোটেলে ওঠার পর টের পাওয়া গেল, জায়গা পাওয়ার আনন্দে ট্যাকসি থেকে মালপত্র নামানো হলেও ডিউটি ফ্রি থেকে কেনা পানীয় নামানো হয়নি। বরুণ দে খুব আশায় ভর করে এখানে-ওখানে ফোন করলেন, কিন্তু অনিরুদ্ধ বলতে লাগলো, প্যারিসের ট্যাকসি-চালকেরা বেকুব নয় যে, অমন জিনিস সেধে ঘরে পৌঁছে দেবে।
কংগ্রেস যেখানে পরদিন শুরু হবে, সেখানে ড্যানিয়েলের দেখা পাওয়া গেল। তার হাতে হাতখানেক লম্বা একটা তার। ওটা দিয়ে কী করছেন, জানতে চাওয়ায় বললেন, তাঁর ইচ্ছে, কংগ্রেসের সেক্রেটারির গলায় ওই তার পেঁচিয়ে তাকে হত্যা করা। আমি বললাম, কংগ্রেস হয়ে যাওয়ার পর আমরা যে-যার বাড়ি চলে গেলে কাজটা করলে ভালো হয়। ড্যানিয়েল বললেন, যাক, তুমি অন্তত কাজটা ভালো হয় বললে। আমি বললাম, ওটা একটা কথার কথা–ভদ্রলোককে আমি চিনিই না, তার ভালোমন্দের কী জানি! ড্যানিয়েল বললেন, লোকটা আমার সঙ্গে প্রথম থেকে শত্রুতা করছে। যা হোক, তুমি কিন্তু একটা অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছ–প্রোগ্রাম দেখে নিও। আমি বললাম, সেকি! বাংলাদেশ থেকে সভাপতি চাইলে প্রফেসর হবিবুল্লাহকে করো–আমি নগণ্য লোক, আমাকে কেন? তিনি বললেন, ওই সেক্রেটারি ব্যাটার সঙ্গে ঝগড়া করে তোমাকে সভাপতি বানিয়েছি; এখন তুমি যদি দোনামনা করো, তাহলে এই তার তোমার গলায় পরাব।
এত বড় সম্মান তখন পর্যন্ত আমার ভাগ্যে জোটেনি। ওই অধিবেশনে অনিরুদ্ধ, হিতেশ আর কল্যাণ প্রবন্ধ পড়েছিলেন, অন্যান্য দেশ থেকে আরো তিনজন কৃতবিদ্য ব্যক্তি প্রবন্ধ পেশ করেছিলেন। প্রবন্ধপাঠের সময় বেঁধে দিয়েছিলাম কিন্তু পাবনা-বিদ্রোহ সম্বন্ধে লেখা পড়তে গিয়ে কল্যাণ সময় ঠিক রাখতে পারছিলেন না। আমি তাকে ইংরেজিতে বলি শেষ করতে, বাংলায় বলি পড়ে যেতে। কল্যাণ পরে বলেছিলেন, আমার সহৃদয়তায় তিনি কৃতার্থ হয়েছিলেন। আমার একেবারে সামনের বেঞ্চে ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব বসে ছিলেন। তিনি, মনে হয়, এই চালাকি ধরে ফেলে মৃদু মৃদু হাসছিলেন। প্রবন্ধপাঠে এত সময় চলে গেল যে, সভাপতির ভাষণ দেওয়ার সুযোগ আর রইল না। দু মিনিট ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে অধিবেশন শেষ করে দিলাম। যাদের খিদে পেয়েছিল, তারা আমার কাণ্ডজ্ঞানের প্রশংসা করলেন।
সম্মেলনের প্রথম দিনে এক সিঁড়ির মুখে দেখা হয়ে গিয়েছিল অধ্যাপক আহমদ হাসান দানীর সঙ্গে। তিনি তখন পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন, পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে এসেছেন সম্মেলনে যোগ দিতে। আমাকে দেখেই আমার নাম ধরে ডেকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর সানয়নে জানতে চাইলেন, মুনীরকে নাকি ওরা মেরে ফেলেছে? আমার জবাব শুনে অধোবদনে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের খোঁজখবর নিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছিলেন, সে-বন্ধন বুঝি কাটেনি। বাংলাদেশের তিনি যে অকৃত্রিম বন্ধু, তা তাঁর কথায় ও ভঙ্গিতে স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছিল।
পরের দিন এসে পৌঁছোলেন নীহাররঞ্জন রায়–সোভিয়েত ইউনিয়নে কী একটা সভা ছিল, তা শেষ করে। বিমানবন্দর থেকে প্রায় সোজা এসেই তিনি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করতে বসলেন। তাঁর প্রিয় ছাত্রী অমিতা রায়চৌধুরী সেখানে প্রবন্ধ পড়েছিলেন। কী অপূর্ব ভাষণ দিয়েছিলেন নীহাররঞ্জন–সকলেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলাম।
অধিবেশনে যোগ দিয়ে কূল পাইনে। একসঙ্গে সাত-আটটা অধিবেশন চলছে কয়েকটা বাড়ি মিলিয়ে। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি এসেছেন, যাদের কথা শোনার ইচ্ছে, তাদের সকলের কথা শোনাও সম্ভব হয়নি। ড. ফিলিওজার বক্তৃতা শুনতে চেয়েছিলাম–তিনি মূলত চিকিৎসক, ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে কৌতূহল থেকে পরে ভারততত্ত্ববিদ হয়েছিলেন। তাঁর বক্তৃতা শোনা হয়নি, সে-দুঃখ তাঁকে জানাতে তিনি এমন সদাশয়তার সঙ্গে কথা বললেন যে, এবারে আমার কৃতার্থ হওয়ার পালা।
পশ্চিমবঙ্গীয়দের সঙ্গেই সময় কাটাই বেশি, তাই কেউ কেউ আমাকেও পশ্চিমবঙ্গীয় ঠাহর করলেন। আমাদের সঙ্গে প্রায়ই যোগ দেন কলকাতার প্রত্নতত্ত্ববিদ অমিতা রায়চৌধুরী, দিল্লির ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার আর ভূগোলবিদ ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভাইস-চান্সেলর মুনিস রাজা। মুনিস রাজার একটা ফুসফুস কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাই চড়াইয়ে উঠতে তার কষ্ট হয়, একটুতেই হাঁপিয়ে পড়েন। আমার হাঁটার অভ্যাস কম, আমি ধীরে ধীরে হেঁটে তাঁকে সঙ্গ দিই।
অনিরুদ্ধের পরামর্শমতো নিজে নিজেই খানিক ঘুরে বেড়াই–লুভ দেখতে একাই গিয়েছিলাম। এসব জায়গায় দলেবলে গিয়ে লাভ নেই। সেখানে ভেনাস দ্য মিলো এবং মোনালিসাকে দেখার আকাঙ্ক্ষা বহুদিন মনে সঞ্চিত ছিল। টুরিস্টের মতোই দেখতে যাই ইফেল টাওয়ার, আর্ক দ্য ব্রায়াম্ফ, নেপোলিয়নের সমাধি। পিগেল এলাকাও ঘুরে আসি এক চক্কর। প্যারিস–বিশেষত রাতের আলোকিত প্যারিস-বড়ো সুন্দর লাগে। এক সকালে সদলে বেরিয়েছি–খবরের কাগজের হেডলাইন, আফগানিস্তানে বাদশাহ জহির শাহ ক্ষমতাচ্যুত। বরুণ বললেন, আশা করি, কাজটা আমাদের (অর্থাৎ ভারত সরকারের) নয়। তার খানিক পরই ফুটপাথে বসে কফিপানরত এক ভদ্রলোককে দেখে বরুণ তাঁকে সম্ভাষণ করলেন, প্রায় একই সঙ্গে তিনিও দরাজগলায় বরুণ এবং তাঁর সঙ্গীদের স্বাগত জানালেন। আমরা কফি খেতে বসে গেলাম। বরুণ পরিচয় করিয়ে দিলেন, ভদ্রলোকের নাম আনোয়ার আবদেল-মালেক, জাতে মিশরীয়, তখন তার বয়স পঞ্চাশ হবে। মিশরের জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল আন্দোলনে তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। জামাল আবদেল নাসের যখন বামপন্থীদের দমন করতে শুরু করেন, তখন তিনি পালিয়ে চলে আসেন প্যারিসে। সেখানে সি এন আর এস নামে পরিচিত প্যারিসের একটি বড় প্রতিষ্ঠানে তিনি গবেষণা-অধ্যাপক। পরে আনোয়ারের প্যারিসের অ্যার্টমেন্টে নাসেরের বাধানো ছবি দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি না নাসেরের দ্বারা নির্যাতিত? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, আমার প্রতি তিনি অন্যায় করেছেন, কিন্তু মিশরের জন্যে যা করেছেন, তার জন্যে তাঁর প্রতি সকল মিশরীয়ের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আনোয়ার আবদেল-মালেকের সঙ্গে প্যারিসের ফুটপাথের কাফেতে সেদিন আমার বেশ ভাব হয়ে গেল এবং গত তিরিশ বছরে আমাদের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
আমরা দল বেঁধে চলি, প্রয়োজন হলে একটু আলাদা হই। যেমন, নবনীতা সাহায্য করেছিল একটা মুলিনেকস ফুড প্রসেসর এবং একটা সনি টেপরেকর্ডার কিনতে। টেপরেকর্ডারে তার কণ্ঠস্বরই প্রথমে ধারণ করা হয়েছিল। আবার, রাতে খাওয়ার জায়গা সাধারণত অনিরুদ্ধই বেছে দিত। প্যারিস ছাড়ার আগের রাতে স মিশেল অঞ্চলে এক রেস্তোরাঁয় খেয়েদেয়ে বেরিয়ে কিছুদূর আসার পর টের পেলাম, আমার মানিব্যাগ ফেলে এসেছি সেখানে। কেউ আমার সঙ্গে ফিরে যেতে রাজি হলো না–অনিরুদ্ধও নয়। নিজে নিজে খুঁজতে গিয়ে কেবলই ঘুরলাম অনর্থক, হোটেলে ফিরে আসতেও ঝামেলা হলো। পরদিন ফেরার পথে বিমানবন্দরে এসে জিনিসপত্র কেনা বাবদ যে-কর দিয়েছিলাম, তা ফেরত পেলাম। পথে প্লেনে একটু ঝাঁকুনি খেতে হলো। হিতেশ বললেন, গাড়োয়ান বড় এবড়ো-খেবড়ো পথ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।
ইলেকট্রনিক জিনিস নিয়ে আসছি বলে ভারতীয় কাস্টমসের ভয়ে ছিলাম। প্লেনে বসে মুনিস রাজা বললেন, কোনো অসুবিধে হবে না। জানতে চাইলাম, কেমন করে বলছেন একথা? তিনি বললেন, দেখো, পরীক্ষার হলে গেলে আমরা যেমন বুঝতে পারি কে নকল করছে, কাস্টমসের লোকও তেমনি বুঝতে পারে কে স্মাগল করছে। তাঁর কথা ঠিক হয়েছিল। দিল্লিতে কাস্টমসের জিম্মায় জিনিসগুলো রাখতেও আমি তৈরি ছিলাম। ওঁরাই রাজি হলেন না। বললেন, যাওয়ার সময়ে এগুলো সংগ্রহ করতে আপনার অসুবিধে হতে পারে। আপনি সঙ্গে নিয়ে যান, তবে এগুলো দেশে নিয়ে যাবেন নিশ্চিতভাবে, এই অনুরোধ।
দিল্লিতে আবার মল্লিক-দম্পতির সহৃদয় আতিথ্যগ্রহণ। তারপর ঘরে ফেরা।
২১.
হঠাৎ করে আমন্ত্রণ পেলাম ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মস্কোতে অনুষ্ঠেয় বিশ্বশান্তি-তরঙ্গে (ওয়র্লড পিস ওয়েভ) যোগ দেওয়ার আর তার আগে বাংলাদেশ আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের দলভুক্ত হয়ে হাঙ্গেরি যাওয়ার। আমার পাসপোর্টে ভ্রমণযোগ্য দেশের তালিকায় হাঙ্গেরির নাম ছিল না। সেটা–এবং সেই সঙ্গে আরো কয়েকটি দেশের নাম-যুক্ত করে এরোফ্লোতের বিমানে ঢাকা থেকে রওনা হলাম। সফরসঙ্গী বাংলাদেশ আপসোর সাধারণ সম্পাদক ডা. এ এইচ সাইদুর রহমান, ওই সংগঠনের ডা. সারোয়ার আলী, বাংলাদেশ কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার বাদল রশীদ এম পি এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নিরোদ নাগ (তিনি এভাবেই নিজের নাম লিখতেন)-ছাত্রজীবনে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি। সারোয়ার আলীকে তার বাল্যকাল থেকে জানি, সাইদুর রহমান অনেকদিনের পরিচিত; বাদল রশীদের সঙ্গে নতুন পরিচয়–দেখলাম, অতি সজ্জন মানুষ, দোষের মধ্যে এই যে, তার উচ্চারণে হাঙ্গেরি হাংরি হয়ে যায়।
তাসখন্দে যাত্রাবিরতির পরে মস্কো পৌঁছোলাম। বিমানবন্দরে খুব ভিড়। ইমিগ্রেশনের লোকজনের সঙ্গে একদল যাত্রী ঝগড়া করছে। যাত্রীদের মধ্যে এক-আধজন ইংরেজি জানে। তাদের কাছ থেকে জানলাম, ওরা এসেছে চিলি থেকে। সেখানে প্রেসিডেন্ট আয়েন্দে সদ্য নিহত হয়েছেন সামরিক অভ্যুত্থানে। এরা কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। তাদের পাসপোর্ট আছে, ভিসা নেই। ভিসা ছাড়া ইমিগ্রেশন এদের ঢুকতে দেবে না সোভিয়েত ইউনিয়নে। এরা বলে, চিলিতে কী হচ্ছে, তা জানো না তোমরা? আমরা তো টুরিস্ট নই–রিফিউজি। ডাকো তোমাদের বড়ো কর্তাকে–সে কী বলে, শুনি। আমাদের ঢুকতে না দিলে চিলিতেই ফিরে যাবো মরতে, তার আগে সমাজতান্ত্রিক ভ্রাতৃত্ববোধের শেষটা দেখে যেতে চাই।
বিষয়টা নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই আমাদের ডাক এসে গেল। হেথ ইমিগ্রেশন পেরিয়ে আমরা পথপ্রদর্শকের সাহায্যে হোটেলে এসে উঠলাম। সেখানেই চারটি খেয়ে ঘুম–কোথাও আর বের হইনি। মস্কোতে প্রচণ্ড ঠান্ডা।
পরদিন সাতসকালে দরজায় আঘাত। এক তরুণী কঠোর মূর্তি ধারণ করে আদেশ দিচ্ছে–এয়ারপোর্ট, এয়ারপোর্ট। বললাম, আমাদের প্লেন তো দুপুরবেলায়, এখন কেন বিমানবন্দরে যেতে হবে? তরুণী বিরক্তমুখে ‘নো ইংলিশ–এয়ারপোর্ট’ বলে আর কাউকে সাহায্য করতে অন্তর্হিত হয়ে গেল।
আমাদের সকলের টিকিটেই বুদাপেস্টের ফ্লাইটের সময় দেওয়া আছে দুপুরের। হয় এরোফ্লোতের ঢাকা অফিস ভুল সময় দিয়েছে, নয় আমাদের অভিভাবিকারা নিস্তার পেতে চাইছে আমাদের থেকে। যতদ্রুতসম্ভব তৈরি হয়ে লাউজে এসে বসলাম এবং তখনই আবিষ্কার করলাম যে, আমার হেল্থ সার্টিফিকেটটা পাওয়া যাচ্ছে না। রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে আরেকবার ঘরে খুঁজলাম, কোনো লাভ হলো না। নিচে নামতেই দেখি, এয়ারপোর্টের বাস রওনা দিচ্ছে। তাড়াতাড়ি তাতে উঠে পড়লাম। খানিক যাওয়ার পরে বোধোদয় হলো যে, ঘরে হেল্থ সার্টিফিকেট খুঁজতে গিয়ে এবারে ওভারকোটটাও ফেলে এসেছি–হয় ঘরে, নয়তো লাউজে। বাসের নিয়ন্ত্রককে বলে কিছু বোঝাতে পারলাম না।
মস্কো থেকে বুদাপেস্টে এলাম হাঙ্গেরির মালিভ এয়ারলাইনসে। আমাদের অঞ্চলে চলাচলকারী এরোফ্লোতের চেয়ে তা অনেকগুণে উন্নত। খাওয়া দাওয়া ও যাত্রীসেবাও ভালো। তবে হেল্থ কার্ড হারিয়ে আমার কিছুই ভালো লাগছিল না।
বুদাপেস্ট বিমানবন্দরে আমি একটাই যুক্তি দেখাই, গতকাল হেলথ সার্টিফিকেট দেখিয়েই তো মস্কোতে ঢুকেছিলাম–তোমরা মস্কো বিমানবন্দরে খোঁজ করলেই তার প্রমাণ পাবে। কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। যারা আমাদের নিতে এসেছিলেন, তারাও বললেন, ও-কথায় কাজ হবে না। আর অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মস্কোর শীতে তুমি কোট ছাড়া বাইরে পা দিলে কী করে!
কয়েক মিনিটের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স এসে গেল এবং আমি তাতে বসে কোয়ারান্টাইনে চললাম।
২২.
কোয়ারান্টাইনে যেখানে আমাকে রাখা হলো, সেটি একটা লম্বামতো দালান। সেখানে একপ্রান্তের একটা ঘরে আমাকে ঢুকিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া। হলো। ঘরের একপাশে কাঁচের জানলার মতো–খোলা যায় না, কিন্তু তা দিয়ে হাসপাতালের অপর প্রান্তের ঘরগুলো দেখা যায়। দরজার উলটো দিকের দেওয়ালে একটা ছোটো কাঠ লাগানো-বাইরে থেকে সেটা খুলে খাবারের ট্রে। তার মধ্য দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ছেলেবেলায় পশু-হাসপাতাল দেখেছিলাম–সেখানে কুকুরদের এমনি করে খাবার দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।
খানিক পরে ডাক্তার এলেন–ভিয়েতনামি, পরিষ্কার ইংরেজি বলেন। বললেন, তোমার বিষয়টা জেনেছি। কী করব বলো, তোমাকে আবার ইনজেকশন নিতে হবে, তাতে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। দুদিন পরে তুমি ছাড়া পাবে। কিছু মনে কোরো না, একটা কথা জানতে চাই–হোটেলের বাইরে পা দিয়ে মস্কোর ঠাণ্ডায় তুমি কোটের অভাব অনুভব করোনি?
সন্ধে নাগাদ আমি অস্থির হয়ে উঠি। না আছে কিছু পড়ার, না আছে কিছু দেখার, না আছে কিছু শোনার, না আছে কথা বলার সুযোগ। সারোয়ার আলীকে চিরকুট পাঠাই, আমার আর কিছুই দেখার সাধ নেই–আমাকে ঢাকায় ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করো। সে আমার এমন অস্থিরতা বা ব্যাকুলতা আশা করেনি।
পরের দিন সকালে কাঁচের জানলায় টোকা। পাশের ঘরের বন্দি ইশারা দিচ্ছে, দাড়ি কামাবে, আমার কাছে আয়না আছে কি না?
আমি আয়না ধরলাম এ পাশে, ওপাশে সে দাড়ি কামাতে লাগলো। বললো, সে পেশায় অ্যাডভোকেট, রোমে থাকে। ইতালির দক্ষিণে কী মহামারী হচ্ছে, আর সেজন্যে তার মতো রোমবাসীকে ধরে এরা কোয়ারান্টাইনে পাঠিয়েছে। এদের ভূগোলজ্ঞান নেই, তারও বুদাপেস্টে পেশাগত দায়িত্বপালনের আর ইচ্ছে নেই। সে এখন রোমে ফিরে যেতে চায়। এই বলে সে জানতে চাইলো, আমি ইতালি গেছি কি না।
আমি যাইনি শুনে সে বললো, তাহলে আমার অতিথি হয়ে রোমে চলো। ইতালি ধ্বংস হওয়ার আগে দেশটা একবার দেখা উচিত।
জানতে চাইলাম, ইতালি ধ্বংস হবে কেন?
বললো, আমরা সবাই মিলে দেশটা ধ্বংস করতে খুব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
খানিক পরে ডাক্তার এলেন। বললেন, মস্কোর হোটেলের লাউজে তোমার কোট পাওয়া গেছে। আর তার পকেটে পাওয়া গেছে তোমার হেল্থ সার্টিফিকেট। সন্ধে নাগাদ ওগুলো বুদাপেস্টে পৌঁছে যাবে। এখন তুমি দুটো হেল্থ সার্টিফিকেটের মালিক–কাল সকালে আমাদেরটাও তৈরি হয়ে যাবে।
বুঝলাম, মস্কো বিমানবন্দরে জ্যাকেটের পকেট থেকে হেলথ কার্ড বের করে দেখিয়ে ভুলে সেটা ভরে ফেলেছিলাম ওভারকোটের পকেটে। সেখানে কিছু রাখি না বলে আর খোঁজ করিনি। নিজেকে ধিক্কার দিলাম।
এবারে বুদাপেস্টের আরামদায়ক হোটেলে।
বুদাপেস্ট শহরটি অতি মনোরম। দানিউব নদীর একধারে বুদা, অন্যতীরে পেস্ট। নদীর ওপরে বড়ো একটা সেতু দুটি অংশকে যুক্ত করে বুদাপেস্ট বানিয়েছে। একটা দিক পাহাড়ি, বিভিন্ন উচ্চতায় ঘরবাড়ির অবস্থান, আলোকিত হলে তা দেখতে খুব ভালো লাগে। অন্যদিকটা সমতল, তবু সেখানেও রয়েছে। অনেক দর্শনীয় বস্তু। এদের ইতিহাস পুরোনো–তারই ছাপ রয়েছে মধ্যযুগীয় দুর্গ ও গির্জা থেকে আধুনিককালের পার্লামেন্ট ভবনের নির্মাণে।
আমরা আপসোর নিমন্ত্রণে গেলেও প্রকৃতপক্ষে সরকারি অতিথি। যিনি আমাদের দেখাশোনার জন্যে নিযুক্ত, তিনি খুবই আন্তরিক। ইংরেজি অত ভালো বলেন না বলে একজন তরুণী দোভাষী রেখেছেন সঙ্গে। সে-মেয়েটি ইংরেজি ভালো জানে, প্রয়োজনের বাইরে একটি কথাও বলে না, হাসতেও চায় না। সে কর্তব্যবোধে চালিত, আত্মসম্মানরক্ষায় সদা-সতর্ক। দুপুরবেলায় আমরা একসঙ্গে খাই–আমাদের অভিভাবক, দোভাষী ও গাড়িচালকসহ। রাতে মেয়েটি কিছুতেই খাবে না আমাদের সঙ্গে, বাড়ি চলে যাবে। তার এহেন সংকল্পের কারণ জানতে আমি পীড়াপীড়ি করায় সে তিক্ততার সঙ্গে বলেছিল, তুমি কি ভাবো, এত ভালো খাবার সামর্থ্য আমার আছে? দিনের বেলায় নিরুপায় হয়ে তোমাদের সঙ্গে খাই, রাতে বরঞ্চ ঘরে গিয়ে যা থাকে, তা খেলেই ভালো লাগে। আমি বলি, মুখবদলের জন্যেও তো এক-আধদিন ভালো খাওয়া চলে। সে বলে, না, যা আমার সতত অপ্রাপনীয়, এক-আধদিনের জন্যে তা পেতে চাই না।
হোটেলে একটা রাজসিক খাওয়া খেয়েছিলাম–অন্য টেবিলে কাউকে তা খেতে দেখে জিনিসটার নাম জেনে নিয়ে পরদিন ফরমাশ করেছিলাম। এই খাবার পরিবেশনকারী অসিচালকের পোশাকে সজ্জিত হয়ে আসে। হাতে খোলা তলোয়ার–তাতে টুকরো টুকরো গোমাংস গাঁথা। টেবিলের কাছে এসে ফরমাশকারীর অনুমতি নিয়ে অল্প ওয়াইন ঢেলে দেয় ওপর থেকে। মাংসখণ্ডগুলো ভিজিয়ে দিয়ে ওয়াইন এসে জমা হয় তরবারির হাতলের কাছে একটা বাঁকানো জায়গায়। তারপর তার সহকারী দেশলাইয়ের একটা বড়ো কাঠি জ্বালিয়ে সেই বাঁকানো জায়গায় ধরে। মুহূর্তে ওই হাতল থেকে তরবারির অন্য প্রান্ত পর্যন্ত একটা অগ্নিশিখা জ্বলে উঠে মুহূর্তেই নিভে যায় খাবার ঘরের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারপর তলোয়ারটা উলটো করে ধরে পরিবেশনকারী। গোশতের টুকরোগুলো ঢেলে দেয় প্লেটে। খাবারটা খুব ভালো, ততোধিক ভালো তার পরিবেশনের কায়দা।
হাঙ্গেরি মদ-প্রস্তুতকারক দেশ। যেখানে ওয়াইন তৈরি হয়, সেখানে যাওয়া গেল। আঙুরভর্তি বড়ো বড়ো কাঠের গামলায় একেক দল সুসজ্জিত মেয়ে রবারের গাম-বুট পায়ে তালে-তালে আঙুর পিষছে। মনে হয়, তারা কাজ করছে না, নাচছে। এ-দৃশ্য বড়ো মনোহর। শেষ পর্যন্ত এই শ্রমের ফসল যা দাঁড়ায়, তাও সুস্বাদু।
বুদাপেস্টে যেখানেই কথাবার্তা বলতে যাই, সেখানেই টোস্টের+অর্থাৎ যার পারিভাষিক নাম আমরা দিয়েছি স্বাস্থ্যপান, তার ব্যবস্থা। যত অল্প পরিমাণই। হোক, সকাল দশটার সময়ে মদ্যপান পোষায় না। তবু সৌজন্যের খাতিরে পানপাত্র ঠোঁটে ছোঁয়াতে হয়। এরকম এক আলোচনার সময়ে আমাদের নিমন্ত্রণকর্তা বললেন, হাঙ্গেরির এক নম্বর সমস্যা জনসংখ্যার হ্রাস। বিবাহবিচ্ছেদের হারে আমাদের জায়গা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই। বিকেলে বিয়ে। হয়েছে, পরদিন সকালে ছাড়াছাড়ি, এমন আকছার ঘটে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি না পেয়ে নিশ্চল থাকলেও হতো, কমে যাওয়াতেই সমস্যা।
আমি বলি, জনসংখ্যার এই সমস্যার সমাধানে আমরা সাহায্য করতে পারি–বলো তো বাংলাদেশ থেকে তোক পাঠিয়ে দিই।
এক অ্যানিম্যাল-ফার্মে গেলাম। খামারে ঢুকে ওভারশু পরতে হলো। হাত ধুতে হলো ওষুধ দিয়ে, তারপর পরতে হলো গ্লাভস। মাথায় টুপি, নাকে মাস্ক বাঁধতে হলো। তবে শুয়োরশাবকদের সঙ্গে দেখা। বললাম, মানুষের বাচ্চা দেখতেও আমরা এত কষ্ট করি না।
আমাদের অভিভাবক জানতে চেয়েছিলেন, আমরা বিশেষ কিছু দেখতে চাই কি না। আমি বললাম, লেক বালাতন দেখতে চাই–তার তীরে এক স্বাস্থ্যনিবাসে আমাদের কবি একটি কাব্যের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন। শুনে তিনি অবাক হন। খোঁজখবর নিয়ে বলেন, ওখানে এক ভারতীয় কবির স্মারক আছে–বাংলাদেশের কবির কথা তো কেউ জানে না। বলি, তিনি রবীন্দ্রনাথ, ভারতের কবি, আমাদেরও কবি, এই দুই দেশের জাতীয় সংগীতই তাঁর রচনা। শুনে তিনি আরো অবাক হন।
বালাতন হ্রদের তীরে যাই। রবীন্দ্রনাথ যে-বাড়িতে বসে লেখন কাব্যের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন–তার হাতের লেখা দিয়েই বইটি বেরিয়েছিল–সে বাড়ি দেখি। বাড়ির সামনে তিনি একটি গাছ লাগিয়েছিলেন–সেটি তখন বেশ বড়ো। সেখানে তাঁর একটি স্মারক আছে।
কবির কথায় আমাদের অভিভাবক বলেন হাঙ্গেরির জাতীয় কবি সান্দর পেতোফির (হাঙ্গেরীয়রা বলে পেতোফি সান্দর) কথা। তিনি শুধু কবি নন, ওদের জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্গাতা। ১৮৪৮ সালে হাঙ্গেরির বিপ্লবে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সান্দর তাঁদের একজন। কবি হিসেবে তিনি খুব উঁচুদরের–বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্ভারের মধ্যে গণ্য হয় তাঁর কাব্য। অথচ তাঁর কবিতা ও গান ওদেশে খুবই জনপ্রিয়। আশ্চর্য নয় যে, সান্দর বলতে পেরেছিলেন, জনপ্রিয় কবিতাই হলো আসল কবিতা। হাঙ্গেরির কাগুঁজে মুদ্রায় তার প্রতিকৃতি আছে। আমাদের অভিভাবক তাঁর মূর্তির কাছে নিয়ে যান আমাদের, তাঁর সুমুদ্রিত কাব্যগ্রন্থ উপহার দেন, প্লাস্টার অফ প্যারিসে তৈরি তাঁর মুখাবয়ব দান করেন।
বালাতন হ্রদ থেকে ফেরার পথে আমি লেখন থেকে দু-চরণের একটি কবিতা উদ্ধৃত করেছিলাম :
বিদেশে অচেনা ফুল পথিক কবিরে ডেকে কহে–
‘যে-দেশ আমার, কবি, সেই দেশ তোমারো কি নহে?’
এর একটা অক্ষম অনুবাদ করেছিলাম ইংরেজিতে। তা শুনেই ওঁরা বলেন, ভারি চমৎকার, এই উপলক্ষে খুবই মানানসই।
বিদায় নেওয়ার আগে আমাদের অভিভাবক, দোভাষী ও গাড়িচালককে আমরা সামান্য উপহার দিয়েছিলাম। অন্যেরা খুশি হয়ে তা নিয়েছিলেন, দোভাষী অস্বস্তির সঙ্গে। মনে হয়, কেবল অসৌজন্য হওয়ার ভয়ে সে তা নিতে অস্বীকার করতে পারেনি।
২৩.
বুদাপেস্ট থেকে মস্কোতে নির্বিঘ্নে ফেরা গেল। এবারে স্থান হলো হোটেল রসিয়ায়। হোটেলটি যেমন বিশাল, তেমনি মানসম্পন্ন। বিশ্ব শান্তি তরঙ্গের জন্যে ততদিনে নানা দেশ থেকে প্রতিনিধি এসে এখানে জড়ো হয়েছেন। আমাদের দেশ থেকে অনেকে গেছেন : আলী আকসাদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, নীলিমা ইব্রাহিম, শেখ ফজলুল হক মনি, শামসুজ্জোহা, ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরীর কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। আমরা হোটেলের যে-তলায় থাকি, তার দায়িত্বে যে-মহিলা, তিনি করিডোরের এক প্রান্তে চেয়ার ও ডেস্ক নিয়ে বসেন। আলী আকসাদ এক সকালবেলায় তাঁর কাছে গিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বলেন, মাসিমা, জুতোর বুরুশ হবে?’ হাত দিয়ে ব্রাশ করার ভঙ্গি দেখে মহিলা সম্মতিসূচক ধ্বনি করে আকসাদকে একটা শু-ব্রাশ দেন। আকসাদ এবারে একটা হাতে গোলাকার ভঙ্গি করে বাংলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘কালি হবে না?’ মহিলা মাথা নেড়ে কালি বের করে দেন। আকসাদ বলেন, ইংরেজি আমার ভাষা নয়, এ-মহিলাও তা ঠিকমতো বোঝে কি না সন্দেহ। কষ্ট করে ইংরেজি বলতে যাব কেন? ইশারা বুঝতে পারলে আমার বাংলা আর ওর রুশিতেই কাজ চলবে।’ খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস একদিন খুশি হয়ে এসে খবর দেন : রুশরা তাঁর মুজিববাদ বইটির ৫০ কপি কিনতে যাচ্ছে। আমি বলি, ইলিয়াস ভাই, আপনি যদি মার্কসবাদ সম্পর্কে লিখতেন, এরা হয়তো এক কপিও কিনতো না। এক রাতে পানাহার সেরে ফেরার পথে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী লিস্ট থেকে বেরোতে গিয়ে পড়ে যান মেঝেতে, নীলিমা ইব্রাহিম তাঁর বিরক্তি চেপে রাখতে পারেন না–হ্যাঁলিম চৌধুরীর সঙ্গে তার ভাগ পান শামসুজ্জোহাও, কিছু না বলে তিনি কেবল চেয়ে থাকেন তিরস্কারকারীর দিকে। শেখ মণি আমার ছাত্র–তাই সরাসরি মশকরা করতে পারে না, অন্যকে ইশারা করে আমাকে একটু বেশি পানীয় ঢেলে দিতে, তবে রঙ্গ দেখার বাসনা তার পূরণ হয় না। আমরা টের পাই, আমাদের সবার মধ্যে শেখ মণিকেই বেশি খাতির করছে সোভিয়েত-কর্তৃপক্ষ। মস্কোর এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে বুঝি, তার ধারণা–এবং নিশ্চয় আরো অনেকের–যে, মণি আসলে কমিউনিস্ট এবং বাংলাদেশে যদি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তার নেতৃত্বেই হবে। ঢাকায় রুশ দূতাবাসের অতি সজ্জন কাউনসেলরকে দেখি মণির সেবায় সদাব্যস্ত। মস্কোর নানাজন আসেন মণির সঙ্গে দেখা করতে-কাউনসেলর দোভাষীর কাজ করেন, হাবেভাবে মনে হয়, দর্শনপ্রার্থীরা সকলেই কমিউনিস্ট পার্টির বিশিষ্ট জন।
যে-সুদর্শন যুবাটি আমাদের কয়েকজনের দোভাষীর কাজ করতো, সে বোধহয় ইয়ং কমিউনিস্ট লিগের সদস্য ছিল। ছেলেটি বুদ্ধিমান, সপ্রতিভ, রসিক এবং সেবায় অকুণ্ঠ। তার যত পরিহাস ছিল, তা গ্রামবাসী, চাষাভুষো আর কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের নিয়ে। ঠিক আদর্শ কমিউনিস্টসুলভ ব্যাপার নয়, তবে খুব উপভোগ্য। ব্রেজনেভ সম্পর্কে সেই গল্পটা তার কাছেই প্রথম শুনিঃ ব্রেজনেভ নিজের বক্তৃতা সম্পর্কে মতামত চেয়েছেন পার্টির হোমরা-চোমরাদের কাছে। সবাই একবাক্যে প্রশংসা করছেন। ব্রেজনেভ বলেন, না, আমি মন-রাখা কথা শুনতে চাই না, সত্যি কথা শুনতে চাই। সকলে মুশকিলে পড়েন, কী বলবেন এখন! শেষে একজন সাহসে ভর দিয়ে বলেন, কমরেড, বক্তৃতা তো আপনার খুব ভালো হয়, তবে কিনা– –তবে কী?–তবে কিনা একটু লম্বা হয়ে যায়। তাহলে বক্তৃতা কতক্ষণের হওয়া উচিত? ব্রেজনেভের প্রতিক্রিয়ায়। লোকটির সাহস বেড়ে যায়, বলেন, বড়োজোর পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ব্রেজনেভ তার বক্তৃতা-লেখককে বলে দিলেন, বক্তৃতা যেন পঁয়তাল্লিশ মিনিটের চেয়ে বেশিক্ষণের না হয়।’তথাস্তু। এরপরের বার বক্তৃতা দেওয়ার পরে তিনি আবার জানতে চাইলেন, কেমন হয়েছে? সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগলো। শুধু সেই সাহসী লোকটি বললো, একটু বেশি লম্বা লম্বা? কতক্ষণ হয়েছে?–পাক্কা দেড় ঘণ্টা!–ডাকো বক্তৃতা-লেখককে। সে ঢোঁক গিলতে গিলতে বললো, হুজুর, আমি তো পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বক্তৃতাই লিখে দিয়েছিলাম, কিন্তু আপনি কার্বন-কপিসুদ্ধ পড়ে দিয়েছেন।
এক বিকেলে প্যাট্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশীয় ছাত্রদের সমাবেশ। রেক্টর স্ট্যানিস সভাপতিত্ব করবেন, ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ থেকে একজন করে বক্তৃতা দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার অপরাধে বাংলাদেশ থেকে বক্তা নির্বাচিত হলাম আমি। পাকিস্তান থেকে নির্ধারিত বক্তা তাহেরা মজহার আলি। তিনি অসাধারণ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি ছাত্রদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাদের ভূমিকা কী ছিল। বলেছিলেন, যারা পাকিস্তানে ছিল, তাদের অনেকের কাছেই বহির্বিশ্বের প্রচারমাধ্যম ছিল দুরধিগম্য, কিন্তু তোমরা যারা দেশের বাইরে ছিলে, তারা তো বাংলাদেশের বিভীষিকার খবর পেতে, তোমরা কি বিবেকের দংশন অনুভব করো নি? তোমরা কি যথেষ্ট প্রতিবাদ করেছিলে? নিজের নিজের পরিবারকে জানিয়েছিলে, কী হচ্ছে সেখানে? দেখো, আমি লাহোরে বিভিন্ন পার্টিতে সুশিক্ষিত সুসজ্জিত মহিলাদের বলতে শুনেছি, পূর্ব বাংলায় মেয়েদের ওপর যা হচ্ছে, তা ঠিকই হচ্ছে–ওতে বাঙালিদের রক্তশোধন হবে। এদেরকে শিক্ষিত বলতে, ভদ্রমহিলা বলতে, মানুষ বলতে আমার বাধে। তোমরা সোভিয়েত ইউনিয়নে এসেছে–আশা করি, খালি ডিগ্রি অর্জন করতে নয়, মানুষ হতে, মানুষের প্রতি সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা নিতে। তা করতে কতটুকু সমর্থ হলে, সেটা বোঝা যাবে তোমাদের আচরণ থেকে।
প্যাট্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে পুলিশ আমাদের ট্যাকসি থামালো। ড্রাইভার চললো পুলিশের পিছু পিছু–কোথায়, কে জানে! দোভাষী বললো, পুলিশ এক রুবল নেবে ওর কাছ থেকে। এবারে আমার চমকাবার পালা। বললাম, বলো কী? তোমাদের দেশেও পুলিশ ঘুস খায়? আমার কথায় দোভাষী যে কতটা কৌতুকবোধ করেছে, তা তার হাসি থেকে বোঝা গেল। আমি কিন্তু বিষণ্ণ না হয়ে পারলাম না। সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে আমার ধারণা চিড় খেলো।
সম্মেলন আরম্ভ হতে হতে শুনলাম, সাখারভ একটি আবেদন প্রচার করেছেন, তাতে সোভিয়েত ইউনিয়নে মানবাধিকার-প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়েছে। সাখারভ কৃতী বিজ্ঞানী, পরমাণুর শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্যে অনেক দিন ধরে অভিযান চালাচ্ছেন, কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণের জন্যে দেশের ভেতরে থেকেই আন্দোলন করছেন। তখনই শোনা যাচ্ছিল, তিনি নোবেল পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন–তবে তা বোধহয় পদার্থবিজ্ঞানে নয়, শান্তির ক্ষেত্রে। তাঁর এই আবেদনজ্ঞাপনের আশু লক্ষ ছিল যে আমাদের বিশ্ব শান্তি তরঙ্গ, তাতে সন্দেহ নেই। এর ফলে আয়োজকদের মধ্যে, বিশেষ করে সোভিয়েত কর্মকর্তাদের মধ্যে, কিছুটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলা বিশারদ গ্লাতুক দানিলচুককে জিজ্ঞেস করে কিছু জানতে পারলাম না–সাখারভ কিংবা সরকারি ভাবাদর্শের অন্য কোনো সমালোচকের প্রতি তার সহানুভূতি নেই। অন্যের কাছে শুনলাম, সাখারভ স্বগৃহেই আছেন, খানিকটা নজরবন্দির মতো, সেখান থেকেই বিবৃতিটা দিয়েছেন–মূলত বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে।
২৪.
বিশ্ব শান্তি তরঙ্গ-উপলক্ষে মস্কোতে আয়োজিত সম্মেলনে অনেকগুলো কমিশন গঠিত হয়েছিল এবং একাধিক কমিশন একসঙ্গে বসেছিল। আমি যে-কমিশনে ছিলাম, সেখানে সাখারভের উল্লেখ না করে তাঁর মূল বক্তব্যের প্রসঙ্গটা উঠেছিল পরোক্ষে। আমি বোধহয় বলেছিলাম, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে আমরা অস্ত্র নিয়ে ও না নিয়ে সংগ্রাম করেছি। তবে আমরাও জানি, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা কতটা জরুরি। আবার শুধু জীবনধারণের উপকরণগুলো পেলেও মানুষের চলে না, তার রাজনৈতিক অধিকারগুলোও পূরণ হওয়া চাই। এসবের মধ্যে একটা সমন্বয় ঘটা দরকার। আমার বক্তব্যে আমাদেরই কেউ কেউ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন–কেন আমি জোরালোভাবে সমাজতন্ত্র-বিরোধীদের আক্রমণ করলাম না। তবে, সৌজন্যের খাতিরে কি না জানি না, অন্তত দুই সোভিয়েত কর্মকর্তা আমার কাছে প্রশংসাসূচক কিছু বলেছিলেন আমাকে বিস্মিত করেই।
আমার সঙ্গে এই কমিশনে যাঁরা বসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মহাশূন্যে প্রথম মহিলা ভালেনতিনা তেরেশকোভা। আমি কখনো কারো স্বাক্ষর যাচনা করিনি, এবারে করলাম আমার ছেলেমেয়েদের জন্যে তাঁর স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে ইচ্ছে হলো। ভদ্রমহিলা ইংরেজি জানেন না, কিন্তু আমি কী চাই, তা সহজেই বুঝলেন এবং নির্দ্বিধায় দান করলেন।
এসব সম্মেলনে যেমন হয়, এক সময়ে উৎসাহে ভাটা পড়ে, ক্লান্তিবোধ হয়, এবং একাকী বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে হয়। ঠিক তখনই সারোয়ার আলী জানালো, যে-অধিবেশনটা আমি ফাঁকি দেবো ভেবেছিলাম, তাতে ব্রেজনেভের বক্তৃতা দেওয়ার সম্ভাবনা। সত্যিই সে-অধিবেশনে ব্রেজনেভ এলেন এবং বক্তৃতা দিলেন। তার বক্তৃতায় মনোমুগ্ধকর কিছু ছিল না, বরঞ্চ সেই তুলনায় বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্রের বক্তৃতা ছিল অনেক চিত্তাকর্ষক, তবু পৃথিবীর দুই মহাশক্তিধরের একজনের ভাষণ সামনাসামনি শোনার একটা রোমাঞ্চ ছিল বই কী!
সম্মেলনে ভারত ও পাকিস্তান থেকে কিছু পরিচিত মুখ এসেছিলেন–তাহেরা মাজহার ছাড়া এখন মনে করতে পারছি শুধু সুচিত্রা মিত্রের কথা। চিত্ত বিশ্বাসের সঙ্গে সেখানেই প্রথম আলাপ হয়েছিল।
মস্কোতে তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত খান শামসুর রহমান। তার সঙ্গে আলাপ হলেও গল্পসল্প হয়নি। আমাদের ইকনমিক মিনিস্টার গোলাম কিবরিয়া একদিন হোটেলে এলেন–আমার ঘরে এ জি স্টকের মেমোয়ার্স অফ ঢাকা ইউনিভার্সিটি বইটা দেখে তিনি আগ্রহান্বিত হওয়ায় সেটা তাঁকে উপহার দিলাম। মস্কোতে আমাদের এডুকেশন কাউনসেলর আবদুলাহ আল-মুতী এবং প্রেস কাউনসেলর হাসান হাফিজুর রহমান। দুজনে একই বাড়ির দুই ফ্ল্যাটে থাকেন। আলাদা করে দুজনের বাড়িই যেতে হলো। আমার আগ্রহাতিশয্যে সম্মেলনের উদ্যযাক্তাদের একজন আমার জন্যে বলশয় থিয়েটারের অতি দুষ্প্রাপ্য টিকিট। জোগাড় করেছিলেন। যে-সন্ধ্যায় বলশয়ে যাওয়ার কথা, সেই সন্ধ্যায় হাসান। তার ঘরে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি যখন বললাম, বলশয় থিয়েটারে যাবো, হাসান জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে আমার চেয়ে বলশয় বড়ো হলো? এ প্রশ্নের পরে আর বলশয়ে যাওয়া যায় না।
হাসানের সঙ্গে বেরিয়ে মস্কোর এক শুল্কমুক্ত বিপণিতে গিয়েছিলাম। সেখানে তা ডলার শপ নামে পরিচিত–বিদেশিরাই সেখান থেকে জিনিসপত্র কিনতে পারে মার্কিন ডলার বা পাউন্ড স্টার্লিং দিয়ে। আমি একটা টাই কিনেছিলাম। দোকানের বাইরে দু-একজন কাঁচের দরজা দিয়ে ঔৎসুক্যভরে জিনিসপত্র দেখছে। হাসান বললেন, ‘ওরা লুব্ধদৃষ্টিতে জিনিস দেখছে, আর আমাদের দেখছে ঘৃণার চোখে। জানতে চাই, ঘৃণার দৃষ্টিতে কেন? জবাব পাই, ওদের দেশে যে-দোকানে ওদের প্রবেশের অধিকার নেই, শুধু ডলারের জোরে সেখানে ঢুকে আমরা কেনাকাটা করছি–ওরা ঘৃণা করবে না কেন?
এখানে অতি আধুনিক আরামদায়ক চায়কা গাড়ি চড়েন রাষ্ট্র ও পার্টির আমলারা। সেসব গাড়ি যখন পথ দিয়ে যায়, তখন যে-দৃষ্টিতে সাধারণ লোক সেদিকে তাকায়, শুনতে পাই, তাও প্রসন্নতার নয়।
মস্কোয় যা দর্শনীয়, তার কিছু কিছু দেখা হলো। ক্রেমলিন শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির স্থাপত্যকর্ম আকর্ষণীয়–ওই নকশার মোট চারটি ভবন আছে মস্কোয়। লেনিনের শব যেখানে রাখা রয়েছে, সেখানে বহু মানুষের সুশৃঙখল উপস্থিতি এবং নীরব শ্রদ্ধানিবেদন আপ্লুত করার মতো। লেনিনের মরদেহ যে এতদিন ধরে রেখে দেওয়া সম্ভবপর হয়েছে, তার কৃতিত্ব দাবি করেন সমাজতন্ত্রী বিজ্ঞানীরা। নাৎসি সৈন্যেরা মস্কোর উপকণ্ঠে পৌঁছে, যে-জায়গায় প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পর্যদস্ত হয়, সেখানে খুব সরল একটি স্মারক আছে–দুটি কাঠ কোনাকুনি করে রেখে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার প্রতীক–সেখানে গিয়ে মাতৃভূমি-রক্ষার জন্যে অসংখ্য মানুষের আত্মাহুতির কথা আপনা থেকেই মনে জাগে।
দোকানপাটও কিছু ঘুরলাম। একটি বিশাল দোকান আছে–সেখানে বাচ্চাদের সবরকম জিনিস বিক্রি হয়। সেখান থেকে সেই বিখ্যাত রুশ পুতুল কিনলাম–একটার মধ্যে আরেকটা, এই করে মোট বারোটা। আরো একটি বিশাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর–অনেক জিনিসেরই চাকচিক্য কম, তার পাশ্চাত্য রকমফেরের তুলনায়, কিন্তু দামও অবিশ্বাস্যরকম কম। মস্কোর রাস্তা দিয়ে বড়ো বড়ো ট্রাক-ভ্যানে বাড়িঘরের প্রি-ফ্যাবরিকেটেড অংশসব নিয়ে যেতে দেখলাম একাধিক দিন। শহরতলিতে কোথাও আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে–এসব জুড়ে অল্পসময়ে বাড়ি তৈরি হয়ে যাবে। মস্কোর মেট্টো চড়লাম–তখন লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড বা প্যারিসের মেট্রোর চেয়ে মস্কোর পাতালরেল ও তার। স্টেশনগুলো বেশি পরিষ্কার ও সুন্দর।
আমাদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হলো লেনিনগ্রাদে। মস্কো থেকে রাতের ট্রেন, ঘুমিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। দোভাষী যুবকটি আর ওই ট্রেনের টিকিট পেলো না। সে বললো, পরের ট্রেনে আসছি–আপনারা রেলগাড়ি থেমে নেমে প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে থাকবেন, আমি খুঁজে নেবো আপনাদের, পনেরো মিনিটের বেশি লাগবে না। সত্যি তাই হলো। মস্কো ও লেনিনগ্রাদের মধ্যে এত সহজে যাতায়াত করা যায়, এত ঘনঘন ট্রেন যায় দিনরাত্রি এবং তা খুবই সময়মতো পৌঁছোয়–তাতে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। আমার প্রশংসার কথা শুনে স্মিতহাসি হেসে আবদুল্লাহ আল-মুতী বলেছিলেন, তবে মস্কো থেকে লেনিনগ্রাদে চিঠি পৌঁছতে পাঁচ দিন লাগে। আমি আবারো বিস্মিত হই।
লেনিনগ্রাদে প্রথম দেখলাম আর্মিতাজ। এককালে সেটা ছিল রাজপ্রাসাদ, এখন চিত্রশালা। জার আমলের সংগ্রহ বেশি, পরে কিছু যোগ করা হয়েছে–তাতে সোভিয়েত শিল্পীদের কাজের প্রাধান্য। ইমপ্রেশনিস্টদের এত ছবি সেখানে সযত্নে রক্ষিত, আমার তা জানা ছিল না। সংগ্রহ দেখে শেষ করা যায় না, হাতে সময় কম, তাই সবটা দেখার আশা ছাড়তে হলো।
রাতে গেলাম নাটক দেখতে। ব্যঙ্গরসাত্মক কমেডি। দর্শকেরা বেশ উপভোগ করছে, বোঝা গেল। আমার কাছে তেমন ভালো লাগেনি। মনে হলো, কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে র্যাবলের কালে ফিরে গেছি। সেকালের রচনার পুনরভিনয় হলে ক্ষতি ছিল না, কিন্তু এটি প্রায় সমকালীন রচনা, তার মধ্যে নতুন কোনো উদ্ভাবন নেই।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নিহতদের সমাধিস্থল অতি যত্ন করে, সুন্দর করে রাখা। একদিকে লাল ফৌজের সদস্যদের কবর, অন্যদিকে বেসামরিক লোকজনের। যুদ্ধের অপূরণীয় ক্ষতির একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সুসজ্জিত সেনাদল নিহতদের শ্রদ্ধা জানিয়ে যাচ্ছে সামরিক কায়দায়, বেসামরিক পোশাকেও আসছে অনেকে। একটি শিশু বা কিশোরের সমাধির ওপরে দুটো চকোলেট-বার আর একটি লাল গোলাপ রেখে এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন তার সামনে–দু-চোখ বয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কত বছর হলো যুদ্ধ শেষ হয়েছে, তার ক্ষত এখনো বহন করে চলেছেন তিনি। তা দেখে আমার অন্তর থেকে উচ্চকিত হলো একটি প্রার্থনা : আমার সন্তানের মাথায় যেন এমনি করে বোমা না পড়ে কখনো।
দেশে ফেরার সময়ে মস্কো থেকে তিবলিসির পথে এরোফ্লোতের বিমান পড়ল মহা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায়। ক্রমাগত ডাইনে-বায়ে ওপর-নিচে করতে লাগলো, উলটে যায়-যায় অবস্থা। আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেলাম। এমনকী, কেবিন-ত্রুদের মুখেও আশ্বাসের কোনো লেশ ছিল না। শুধু সারোয়ার আলী বললো, ভয় পাবেন না। এই ফ্লাইটে এদের জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা যাচ্ছে। পাইলট জানে, তাদের কিছু হলে ওকে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠাবে কর্তৃপক্ষ। যেমন করেই হোক ও যাত্রীদের প্রাণ বাঁচাবে।’
মৃত্যুভয়ের মধ্যেও যে হাসা সম্ভবপর, তা সেদিনই প্রথম জানলাম।
২৫.
১৯৭২ সালেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শামসুল হক এবং রসায়ন বিভাগের অধ্যক্ষ সৈয়দ জহির হায়দার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলেন। তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হলেন যথাক্রমে ড. এখলাসউদ্দীন আহমদ ও ড. শামসুদ্দীন আহমদ। অর্থনীতি বিভাগের অধ্যক্ষ এস এম আতহার অন্যত্র চাকরি নিয়ে চলে গেলেন, তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সদ্য প্রত্যাগত ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিছুকাল পরে উপাচার্য ইন্নাছ আলীও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে নিজের পদে ফিরে গেলেন। চট্টগ্রামে তাঁর ভালো লাগছিল না, এখানকার দু-একটি ঘটনায় তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন–যদিও তাঁর সঙ্গে কেউ অসদাচরণ করেনি। উপাচার্যের পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্যে তাঁকে রীতিমতো চেষ্টা করতে হয়েছিল। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন অধ্যাপক আবুল ফজল।
আমি অধ্যাপকপদে নিযুক্তিলাভ করায় রিডারের পদটি শূন্য হলো। সে জায়গায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালকে আনবার কথা ভাবলাম। একবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকনিয়োগ সংক্রান্ত কাজে গিয়ে দেখে এসেছিলাম, তিনি ভালো নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং রাজশাহী বেতারকেন্দ্র থেকে তাঁকে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কথিকা নিয়মিত প্রচার করায়। আবু হেনার ক্ষুরধার জিহ্বাগ্র থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে-বাক্যধারা নির্গলিত হতো, তাতে অনেকের ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ ঘটতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে আনলেন পাকিস্তানের হয়ে দালালির অভিযোগ। উপাচার্য খান সারওয়ার মুরশিদ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি, ফলে আবু হেনার প্রতিপক্ষ অন্যত্র অভিযোগ করে ফল পাওয়ার চেষ্টা করলেন। আবু হেনার জন্যে সমস্ত পরিবেশটি খুব অস্বস্তিকর হয়ে পড়েছিল। তার সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝলাম যে, চট্টগ্রামে আসতে তাঁর বাধা নেই। আমি পদটি বিজ্ঞাপিত করার ব্যবস্থা করলাম। ঠিক এমনি সময়ে তিনি গ্রেপ্তার হলেন। রাজশাহীতে অধ্যাপক সারওয়ার মুরশিদের এবং ঢাকায় আবু হেনার ভগ্নিপতি, বঙ্গবন্ধুর অশেষ আস্থাভাজন, বিশিষ্ট সাংবাদিক কে জি মুস্তাফার চেষ্টায় আবু হেনা ছাড়া পেলেন। আমি তাঁকে আবেদনপত্র পাঠালাম, তিনি যথারীতি আবেদন করলেন। সাক্ষাৎকারের দিনে আমি নিজে বিমানবন্দর থেকে তাঁকে নিয়ে এলাম এবং সাক্ষাৎকার-শেষে আবার ওই পর্যন্ত তাকে পৌঁছে দিলাম। আরো একজন প্রার্থী ছিলেন বটে, কিন্তু আবু হেনার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রকৃতপক্ষে কেউ ছিলেন না। আবু হেনার আশঙ্কা ছিল, নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য ড. মুহম্মদ এনামুল হক কোনো কারণে হয়তো তার নিয়োগের বিরোধিতা। করবেন। এনামুল হক তা করেন নি–হয়তো উপাচার্য ও আমার আগ্রহের কথা জেনে। তবে নির্বাচকমণ্ডলীর সভায় আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আবু হেনার যোগ্যতার বিষয়ে তো সন্দেহ নেই, তবে কোথাও সে বেশিদিন থাকতে পারে না। তুমি তাকে আনতে চাও, আনো, কিন্তু কিছুদিন পরে সে হয়তো আবার এখান থেকে ঢাকায় যেতে ব্যগ্র হয়ে উঠবে। সর্বসম্মতিক্রমেই আবু হেনাকে নিয়োগদানের সুপারিশ করা হয়ে গেল। তবে আমার সহকর্মীদের মধ্যে যারা কর্মে জ্যেষ্ঠ, তাঁদের কেউ কেউ যে এতে খুশি হননি, সে কথা আমি পরে বুঝেছিলাম। আর ঢাকা ও রাজশাহীতে যারা আবু হেনার প্রতি বিরূপ ছিলেন, চট্টগ্রামে তাঁর নিয়োগে তারাও আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
আমি নিজের মতো করে বিভাগ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলাম। অধ্যক্ষ হয়েই আমি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যাতে কারো কারো পক্ষে অসুখী হওয়ার কারণ ঘটেছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরদিন আমাদের ছাত্রপ্রতিম একজন অ্যাডহক নিয়োগ নিয়ে লেকচারার পদে যোগ দেয়। তার চাকরি যাতে পাকা হয়, তা দেখতে আমাদের এক সহকর্মী। অনুরোধ করলো আমাকে। আমি বললাম, এমন যুদ্ধের মধ্যে যে-চাকরিতে যোগ দেয়, তার বিবেচনাশক্তির ওপরে আমার আস্থা নেই। পদ বিজ্ঞাপিত হবে, তাকে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আসতে হবে। আমি তার প্রার্থিতা সমর্থন করবো, এমন আশ্বাস না পেয়ে সে বিভাগে আসা বন্ধ করে দেয় এবং পরে ওই পদ বিজ্ঞাপিত হলে সে আবেদনও করেনি। ১৯৭০ সালের এম এ পরীক্ষায় ছ জন প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল–তার মধ্যে মাহবুবুল হক ছিল একজন। আমি তাকে আবেদন করতে বলেছিলাম। তবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে তখন আগ্রহী হয়নি। তার সঙ্গে প্রথম শ্রেণি পাওয়া। আরেকজন ছিল শিপ্রা রক্ষিত–সে গহিরা কলেজে শিক্ষকতা করছিল। সে আবেদন করে এবং নিয়োগলাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিভাগের গবেষণা-সহায়ক মাহবুব তালুকদার বাংলাদেশ সরকারের কর্মে যোগ দিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সে আর চট্টগ্রামে ফিরে আসেনি–ঢাকায় সরকারি চাকরিতে স্থায়ী হয়েছিল। এতে আমাদের বিভাগের পিয়ন আলম মন্তব্য করেছিল যে, মাহবুব সার খুব চালাক–ঢাকায় সরকারি চাকরি পেয়েছে; আমাদের সার (অর্থাৎ আমি) চালাক নয়–আগের চাকরিতেই চট্টগ্রামে ফিরে এসেছে। মাহবুবের শূন্যপদে নিয়েছিলাম খায়রুল বশরকে-রশীদ আল ফারুকী ছদ্মনামে তার তখন দুটি বই বেরিয়েছে। পরে সে লেকচারার পদে উন্নীত হওয়ায় গবেষণা-সহায়ক পদে ভূঁইয়া ইকবাল যোগ দেয়।
১৯৭২ সালে ঢাকায় ঘন ঘন আসতে হওয়ায় এ এফ রহমান হলের প্রোভোস্ট হিসেবে নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারিনি। আবহাওয়াজনিত কারণে ঢাকা-চট্টগ্রামের ফ্লাইট বাতিল হওয়ার ফলে যেদিন হল ছাত্র-সংসদের অভিষেক-অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারলাম না, সেদিন আমার খুবই খারাপ লেগেছিল। যদিও আমি ওই পদ ত্যাগ করতে চেয়েছিলাম, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আমাকে ছাড়তে চাননি ইন্নাছ আলী। ১৯৭২ সালের শেষদিকে প্রোভোস্ট হিসেবে আমার দু-বছরের কার্যকাল শেষ হওয়ার আগে উপাচার্যকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছিলাম আমার নিয়োগের মেয়াদ বৃদ্ধি না করতে। উপাচার্য সে অনুরোধ রেখেছিলেন।
২৬.
এপ্রিলের শেষে বাংলাদেশের এক অকৃত্রিম বন্ধু আঁদ্রে মালরো ঢাকায় এলেন। মালরো বিশিষ্ট সাহিত্যিক, দু-দুবার মন্ত্রী হয়েছেন ফ্রান্সে। তিনি সংস্কৃতিমন্ত্রী থাকতে প্যারিসের সব ঘরবাড়ির বাহ্যরূপটা ঘষে-মেজে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তা সত্যি বাহ্য। বিশের দশকে তিনি চীনের বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িত করেছিলেন, তিরিশের দশকে আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে যোগ দিয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রজাতন্ত্রীদের পক্ষে লড়াই করেছেন, চল্লিশের দশকে মাতৃভূমি রক্ষায় যুদ্ধ করেছেন হিটলারের জার্মানির বিরুদ্ধে। চীনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন, স্পেনের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি, জার্মান কমিউনিস্টদের নাৎসি-প্রতিরোধ নিয়ে আরেকটি। তিনি এসব বিষয়কে বিশেষ বিশেষ দেশের রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে অতটা দেখেননি, যতটা দেখেছেন ভাগ্যের সঙ্গে মানুষের প্রতিনিয়ত সংগ্রামের অধ্যায়রূপে। শিল্প সম্পর্কে তাঁর লেখায়ও দেখা যায়, শিল্পকলাকে তিনি দেখছেন মহতের পথে মানুষের যাত্রা বলে। তাঁর স্মৃতিকথাও অসাধারণ রচনা বলে স্বীকৃত।
এহেন মালরো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঘোষণা করেছিলেন, স্পেনের গৃহযুদ্ধকালের মতো আবার আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবীরূপে তিনি লড়তে চান আমাদের হয়ে। তখন তাঁর বয়স ৭০। তার এই ঘোষণা বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগিয়েছিল। সেই কথা মনে রেখেই বাংলাদেশ সরকার তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এই সফরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ-বিষয়ে উপাচার্য খান সারওয়ার মুরশিদের উদ্যোগ ছিল প্রধান। মালরো এ সম্মান স্বীকার করতে সম্মত হন। এবারের সফরের একটি উদ্দেশ্য ছিল তা গ্রহণ করা। বাংলাদেশে মালরোর অবস্থানকালে তার সার্বক্ষণিক সহচর ছিলেন মাহমুদ শাহ্ কোরেশী।
রাষ্ট্রীয় অতিথি-ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন তাকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করেন। তাতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন লেখক-শিল্পী। জসীমউদ্দীন ছিলেন আমাদের নেতৃস্থানীয়। নৈশভোজের আগে মালরোর সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। তখন মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠল, সেইসঙ্গে এ দেশের সাহিত্য-শিল্পের প্রসঙ্গ এবং অনিবার্যভাবে রবীন্দ্রনাথের বিষয়। উল্লেখযোগ্য যে, রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিক উদ্যাপনের জন্যে গঠিত ফরাসি জাতীয় সমিতির সভাপতি ছিলেন মালরো। ঢাকায় সে-সন্ধ্যায় মালরো বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির আঁদ্রে জিদকৃত ফরাসি অনুবাদ পড়ে তিনি চমৎকৃত হয়েছিলেন বটে, তবে রবীন্দ্রনাথের যে-রচনাটি তাকে সত্যি সত্যি নাড়া দিয়েছিল, তা ঘরে-বাইরে। মালরো ইংরেজিতে কথা বলছিলেন, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসটির নাম বলেন দি হোম অ্যান্ড দি ওয়ার্ল্ড। অনেকে সেটা ধরতে পারেননি, জসীমউদদীন আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চান, কোন উপন্যাসের কথা বলছেন মালরো। বলি, ঘরে-বাইরে। মালরোর প্রশংসায় আমি একটু বিস্মিত হই। এর আগে পৃথীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ফরাসীদের চোখে রবীন্দ্রনাথ (কলকাতা, ১৯৬৩) বইতে ঘরে-বাইরে সম্পর্কে লুই জিলের আলোচনা পড়েছিলাম। তাতে উপন্যাসটির প্রশংসা ছিল না, সৌজন্যস্বরূপ যতটা বলতে হয়, তার অবশ্য অভাব হয়নি। কিন্তু মালরো, দেখলাম, বলছেন, আধুনিক জীবন ও রাজনীতির যে-সংকটের কথা আছে ওই উপন্যাসে, যৌবনকালে তাঁর মনে হয়েছিল, তা সর্বজনীন এবং সে-ধারণা পালটাবার কোনো কারণ পরে তার ঘটেনি।
ঢাকায় এসে মালরো বলেছিলেন, স্বাধীনতার জন্যে বাংলাদেশে যত রক্তপাত হয়েছে, বিশ্বের আর কোথাও তা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকার প্রশংসা করেছিলেন তিনি, ছাত্রদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, একইরকম নিষ্ঠার সঙ্গে তারা যেন দেশের পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করে। রাজশাহী ছাড়াও তিনি চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। সেখানে আবুল ফজলের সভাপতিত্বে তাঁকে দেওয়া হয় নাগরিক-সংবর্ধনা। স্বদেশে ফিরে যাওয়ার আগে মালরো বলে গিয়েছিলেন, পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি হওয়া উচিত। প্রতিহিংসার মনোভাব থেকে পাকিস্তান যদি সেখানে আটকে-পড়া বাঙালিদের বিচার করতে চায়, সেটা হবে তাদের পক্ষে নির্বুদ্ধিতার শামিল।
পাকিস্তান অবশ্য আটক বাঙালিদের বিচার করতে পারেনি। আর মাস ছয়েকের মধ্যেই তারা ফিরে আসতে আরম্ভ করেছিলেন। অবশ্য তার আগে অনেকেই পালিয়ে আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। তবে আমরাও তখন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে সমর্থ হইনি।
২৭.
ইতিহাস পরিষদের তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলন হলো ঢাকায়, মে মাসে। এটাই বোধহয় ছিল পরিষদের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ সম্মেলন। রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সম্মেলন উদ্বোধন করেন, অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরী, মূল সভাপতি মুহম্মদ এনামুল হক। সারা দেশ থেকে শ দুয়েক প্রতিনিধি এসেছিলেন, ভারত থেকে ২৮ জন, পূর্ব জার্মানি থেকে দুজন, অস্ট্রেলিয়া থেকে একজন। ঢাকা জাদুঘরে আয়োজিত বিশেষ প্রদর্শনী উদ্ববাধন করেন কামাল হোসেন। তিনদিনব্যাপী এই সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন এ এল ব্যাশাম, দীনেশচন্দ্র সরকার, পরমাত্মা শরণ ও আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ। প্রবন্ধ পাঠ করেন দীনেশচন্দ্র সরকার, জিয়াউদ্দীন দেশাই, কমলাকান্ত গুপ্ত, অরুণ দাশগুপ্ত, অনিরুদ্ধ রায়, সৈয়দ মুর্তজা আলী, সৈয়দ ইমামুদ্দীন, অমলেন্দু দে, এম এল দাশ, ভূপেন কানুনগো, সালাউদ্দীন আহমদ, রজতানন্দ দাশগুপ্ত, হান্স পিয়াজা, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ, বাদলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সনকুমার সাহা, আলী আনোয়ার ও যতীন সরকার (তিনি অবশ্য অনুপস্থিত ছিলেন)। বিশেষ ভাষণ দেন নীহাররঞ্জন রায়। অতিথিদের পক্ষ থেকে সমাপনী অধিবেশনে বক্তৃতা করেন এ এল ব্যাশাম, গুনটার সনটাইমার ও রমিলা থাপার।
সম্মেলনে যোগ দিতে পারিনি বলে আমার খুব আফসোস হয়েছিল। তবে আমার বন্ধু অনিরুদ্ধ রায় সম্মেলনশেষে রমিলা থাপার ও অধ্যাপক গ্রোভারকে নিয়ে চট্টগ্রামে আমার বাড়িতে বেড়াতে আসে। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ঘুরে বেড়ানো ও আড্ডা দেওয়া। অনিরুদ্ধ বলেই রেখেছিল, কোথাও যেন কোনো বক্তৃতার আয়োজন না করি, আমি সেই ইচ্ছে মেনে নিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকে বোধহয় তাতে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। ইতিহাসবিদ আসছেন, অথচ ইতিহাস বিভাগে যাবেন না এবং থাকবেন বাংলার শিক্ষকের বাড়িতে, এটা তাদের পছন্দ হয়নি। অনিরুদ্ধ তো বন্ধুই, রমিলার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারাভিযান চালাতে দিল্লিতে যাই এবং জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে বক্তৃতা করি। গ্রোভার দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। তাঁর এক ভাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে ১৯৭১ সালে পূর্ব রণাঙ্গনে অংশ নিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে তাই তাঁর বিশেষ ঔৎসুক্য ছিল। ওঁদের নিয়ে আমার যুদ্ধফেরত ফোক্সওয়াগনে করে গেলাম কাপ্তাই ও রাঙামাটিতে। ওঁরা খুব উপভোগ করেছিলেন। ক্যাম্পাসের নিরিবিলি আবহাওয়া এবং আমার বাড়ির অনানুষ্ঠানিক পরিবেশ ওঁদের ভালো লেগেছিল। এক সন্ধ্যায় বাড়ির লনে বসে গল্প করছি। আমার প্রতিবেশী শিল্পী রশিদ চৌধুরী এসে পানীয়ের একটা বোতল আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনার অতিথিরা হয়তো এটা পছন্দ করবেন।’ রশিদ বসলেনও না, সকলের সঙ্গে সৌজন্য-বিনিময় করে চলে গেলেন। আমার অতিথিদের জন্যে তার এমন উদ্বেগ দেখে আপ্লুত না হয়ে পারিনি।
অতিথিদের নিয়ে গিয়েছিলাম ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল করিমের বাড়িতে। চা খেতে খেতে তাঁদের সাম্প্রতিক গবেষণা নিয়ে আলাপ করলেন–অনেকটাই আনুষ্ঠানিক, তবে সৌজন্যপূর্ণ। মুশকিলে ফেললেন ওই বিভাগেরই এক শিক্ষিকা–তিনি একবেলা রমিলাকে খাওয়াবেনই, অথচ রমিলা একেবারেই রাজি নয় খেতে। শেষ পর্যন্ত রফা হলো, শহরে তাঁর বাড়িতে চা খাব। অতি সুসজ্জিত ভবন, চায়ের আয়োজন রাজসিক, ভদ্রমহিলার আন্তরিকতাও অকৃপণ, তবে সেখানে দেখা দিল এক বিব্রতকর পরিস্থিতি। নিমন্ত্রণকত্রী দাবি করছেন, তিনি রমিলার বই পড়েছেন, অথচ সে বইয়ের নাম মনে করতে পারছেন না। রমিলার লেখা যে-বইটা সহজে পড়া সম্ভবপর–পেলিক্যান পেপারব্যাক বলে–আমি তার নাম মনে করিয়ে দিই, কিন্তু বাংলার ছাত্রের কাছ থেকে ইতিহাসের বইয়ের নাম নিতে তিনি রাজি হন না। ‘না, না’ বলে তিনি অন্য নাম ভাবতে থাকেন, বলেও ফেলেন বোধহয় এক-আধটা, তবে তা লাগসই হয় না। ফেরার পথে রমিলা ক্ষোভের সঙ্গে বলে, আমার নামটি ছাড়া তোমার সহকর্মীর কোনো ধারণাই নেই আমার। সম্পর্কে, তবু কেন যে খাওয়াবার জন্যে এত জোর করলেন–!’ সবটা লঘু করতে বললাম, ‘ওই নাম-মাহাত্ম্যের কারণেই, নইলে কি ডিনার না খেয়ে ফিরতে পারতে!’
২৮.
বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। স্থির হয়েছিল, পরবর্তী এশীয় শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ঢাকায় এবং পদকটা প্রদান করা হবে সেখানে। ১৯৭৩ সালের মে মাসে দুদিনব্যাপী এই সম্মেলন আয়োজিত হলো। ইতিহাস সম্মেলনের সময়ে মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক দাবিপূরণের লক্ষ্যে অনশন করেছিলেন, এবারে বিদেশি প্রতিনিধিরা যেদিন আসতে আরম্ভ করলেন, বাম রাজনৈতিক দলগুলো সেদিন ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলো। হোটেল পূর্বাণীর সামনে ছোটো চত্বরটায় ভিয়েতনাম-মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছিল, কারা জানি সেটাও ভেঙে দিল। সবটা নিয়ে কিছুটা উত্তেজনাও দেখা দিয়েছিল। তবে শেরে বাংলা নগরে বেশ বড়ো করেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। বাংলাদেশের বাইরে প্রতিনিধি এসেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, লাওস, কম্বোডিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, মঙ্গোলিয়া, জাপান, ইরাক, সিরিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন, ওমান, জর্দান, প্যালেস্টাইন, মিসর, দক্ষিণ আফ্রিকা, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, গায়েনা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া থেকে। বিশিষ্টজনের মধ্যে ছিলেন ডিন রিড, মিসেস চেডি জাগান ও কৃষ্ণ মেনন, বিশ্বশান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র তো ছিলেনই। রমেশ চন্দ্রই বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক পরিয়ে দেন। সকলেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে কথা বলেছিলেন। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতি, তকালীন কৃষিমন্ত্রী, আবদুস সামাদ আজাদ। সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের দাবি জানানো হয়েছিল। সম্মেলনটি সত্যিই আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছিল এবং আমাদের মনে এর রেশ লেগে ছিল বেশ কিছুদিন ধরে।
২৯.
শহর থেকে দূরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অপেক্ষাকৃত নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হতো অতিথির আগমনে। চাঞ্চল্যটা পারিবারিক পরিমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ থাকতো যদি না অতিথি সামাজিকভাবে সুপরিচিত হতেন। ১৯৭৩ সালের শেষে আমার বাসায় সপরিবারে কামাল হোসেনের আগমনে তাই গোটা ক্যাম্পাসেই মৃদু তরঙ্গ বয়ে গিয়েছিল। কামাল তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কর্মজীবনের কোলাহলের বাইরে নিজের এবং বন্ধুর পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোই ছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু এত ব্যস্ত মানুষ যে কেবল বেড়াতে আসবেন এই পাড়াগাঁয়ে–তা অনেকের বিশ্বাস হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই, আমি কোন পদ অধিকার করতে যাচ্ছি, সে-সম্পর্কে জল্পনা ছিল সহকর্মীদের মধ্যে। এবারে তাঁরা নিশ্চিত ধারণা করলেন যে, আমি রাষ্ট্রদূত হতে যাচ্ছি। কেউ কেউ বোধহয়, কোন দেশে যাচ্ছি, তাও স্থির করে ফেলেছিলেন। আমি বলেছিলাম, কাউকে রাষ্ট্রদূত বানাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তার বাড়ি যেতে হয় না। সে-কথায় বেশি কাজ হয়নি।
হামিদা বরাবরই অনাড়ম্বর জীবনযাপনের পক্ষপাতী। তিনি কামালকে বলেই নিয়েছিলেন যে, বেড়াতে যদি যেতে হয়, তাহলে মন্ত্রিত্বের আনুষঙ্গিক অলংকার অফিসে ফেলে রেখেই যেতে হবে। কামালও জেলা-প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন, এটা একেবারেই বেসরকারি সফর। কিন্তু প্রশাসনের তো একটা দায়িত্ব আছে মন্ত্রীকে নিরাপত্তা দেওয়ার। সুতরাং মন্ত্রী মহোদয় সন্ধ্যার পরে নিরাপত্তা রক্ষী পরিবেষ্টিত হয়েই পৌঁছালেন আমার বাড়িতে। আর সঙ্গে সঙ্গেই রক্ষাকর্তাকে বলে দিলেন, যান, আপনারা এখন ফিরে যান। রক্ষীপ্রধান মুখ খুলতে গিয়ে সামলে নিলেন। খানিক পরে আমার কাজের ছেলে এসে আমাকে খবর দিলো, কেউ একজন কথা বলতে চায় আমার সঙ্গে। বেরিয়ে দেখি, সেই পুলিশ কর্মকর্তা। কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘মিনিস্টার সাহেব আমাদের বিদায় দিলেন; কিন্তু সার, ওঁর সিকিউরিটির দায়িত্ব আমার–আমি কী করে চলে যাই! আপনার গ্যারাজের ওপরের ঘরটায় যদি রাতটা আমাদের থাকতে দেন, তাহলে সারও জানতে পারবেন না, আমাদেরও ডিউটি দেওয়া হবে। আমরা আপনাদের কোনোরকম বিরক্ত করবো না। সেই ব্যবস্থাই করা গেল।
সহকর্মীদের কেউ ফোনে খবর দিয়ে, কেউ কিছু না জানিয়েই, মান্যবর অতিথির সঙ্গে সৌজন্য-সাক্ষাৎ করতে এলেন এবং কিছু আবশ্যক রাজনৈতিক প্রশ্ন ও কিছু অনাবশ্যক ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে তাঁকে বিব্রত করে তুললেন। যাঁরা দর্শন দিতে এলেন, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অতিথির কথা বলার সুযোগ সীমিত হয়ে এলো। কেউ তাঁকে প্রশ্ন করলে আরেকজন তার উত্তর দেন; কেউ প্রশ্ন করতে গেলে তাঁকে থামিয়ে আরেকজন নিজের মতামত শোনাবার তাগিদ অনুভব করেন। তারপর এক সময়ে কারো খেয়াল হয়, অতিথির খাওয়া দাওয়ার পালা তো এখনো বাকি। উঠতে উঠতে আরো কিছুক্ষণ যায়।
কামাল যতই বলুন না কেন ব্যক্তিগত সফর, রাজনীতি কি পেছন ছাড়ে রাজনীতিবিদের? পরদিন জনসভায় তাঁকে বক্তৃতা করতে হলে চট্টগ্রাম শহরে। তার পরদিন সকালবেলায় আমরা কাপ্তাই রওনা হলাম। ব্যবসায়ী ইসলাম খার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত একটা ঢাউস গাড়ি প্রশাসন চেয়ে নিয়েছিল–তাতে আমরা সপরিবারে। আর ডি সি-পুলের পতাকাশোভিত সংকীর্ণপরিসর ও কান্তিহীন গাড়িতে মন্ত্রীর পরিবার। কাপ্তাইতে ওয়াপদার রেস্ট হাউজে থাকার ব্যবস্থা উত্তম, খাওয়ার ব্যবস্থা তার চেয়েও ভালো। কামাল একবার সখেদে বললেন হামিদাকে, ‘আমি অল্প খেয়েও মোটা হয়ে যাই, আর আনিসকে দেখো, এত খেয়েও তার গায়ে কিছু লাগে না। কাপ্তাই-অবস্থান খুব উপভোগ করেছিলাম আমরা। কামালের বড়ো মেয়ে সারা রুচির চেয়ে বয়সে কিছু ছোটো; দীনা আর শুচি একেবারেই সমবয়সী-কামালের ভাষায়, সিক্সটিনাইন মডেল। ওরা খুব মিলেমিশে খেলাধুলা করে কাটালো। এখানে অতিথি-অভ্যাগতের ভিড় ছিল না। আমরা দেশের হাল-হকিকত আর বন্ধু-বান্ধবদের বিষয়ে আলাপ করে দিনাতিপাত করলাম।
হঠাৎ করে বেতারের খবরে শুনলাম, রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পদত্যাগ করেছেন এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার মোহাম্মদউল্লাহ্ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছেন। কামালের সঙ্গে কথা বলে ধারণা হলো, আবু সাঈদ চৌধুরী যে পদত্যাগ করবেন কিংবা তাকে যে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে, তা তিনি জানতেন; তবে কে যে তার স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন, তা তখনো তার অজানা। আবু সাঈদ চৌধুরী সম্পর্কে আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধ ছিল–বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে-ভূমিকা তিনি পালন করেছিলেন, তা শ্লাঘার যোগ্য। তাই তাঁর বিদায়ে খুব খারাপ লাগলো। স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করছেন তা সাংবিধানিক বিধানের কারণে। তাও বললাম, লোকটার বরাত বটে! আওয়ামী লীগের দপ্তর-সম্পাদক থেকে ডেপুটি স্পিকার হলেন। কেউ ভাবেনি, উনি স্পিকার হবেন; হঠাৎ করে শাহ আবদুল হামিদের মৃত্যুতে সেই পদ লাভ করলেন। এখন আবার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। ভাগ্যবিধাতা নিশ্চয় আমার কথা শুনে হেসেছিলেন। কেননা মাসখানেক পরে তিনি রাষ্ট্রপতির স্থায়ী আসনে অভিষিক্ত হন।
তবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীও আমাকে হতাশ করলেন। অল্পকাল ব্যবধানে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে তিনি জেনেভায় গেলেন। তারপর ইউরোপ ও আফ্রিকার নানা দেশে দৌত্যকর্ম করলেন। যিনি রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেছেন, তিনি আবার অন্য পদে নিয়োগগ্রহণ করবেন কেন? তখন কি আর জানতাম যে, তিনি এবং তাঁর সাক্ষাৎ উত্তরাধিকারী পরে মন্ত্রিত্ব নেবেন?
যাহোক, কাপ্তাইয়ের আনন্দিত দিনগুলির শেষে ক্যাম্পাসে ফিরে এলাম। পরদিন রাতে–এবারে ট্রেনে করে–অতিথিরা ঢাকায় ফিরে গেলেন। রেলের সেলুন দেখে তো রুচি-শুচি বেজায় খুশি, প্রলুব্ধও বটে। বলে, এমন গাড়ি করে আমরা ঢাকায় যেতে পারি না? যতক্ষণ পারলো, তারা সারা-দীনার সঙ্গে একবার বিছানায়, একবার চেয়ারে বসে নিলো।
৩০.
বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সাহিত্য-সম্মেলন আয়োজন করলো বাংলা একাডেমি ১৯৭৪ সালের ১৪ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আটদিন ধরে। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যুবার্ষিকী, ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুবার্ষিকী। মনে হয়, এ দিনগুলো এড়িয়ে ২১ থেকে ২৮ পর্যন্ত সম্মেলন করলে ভালো হতো। আয়োজনটা অবশ্য হয়েছিল বিশাল। অভ্যর্থনা পরিষদের। সভাপতি মযহারুল ইসলাম এবং সম্পাদক রাহাত খান ব্যবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি রাখেননি। ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, হাঙ্গেরি, পূর্ব জার্মানি, রুমানিয়া, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম–এসব দেশের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভারতীয় প্রতিনিধিদলের। তাঁর সঙ্গে ছিলেন। অজিতকুমার ঘোষ, আশুতোষ ভট্টাচার্য, গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জগন্নাথ চক্রবর্তী, জীবেন্দ্র সিংহরায়, দুলাল চৌধুরী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বাণী রায়, বিনয় সরকার, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ সেন, মনোজ বসু, মন্মথ রায়, রমা চৌধুরী, লীলা রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সবিতাব্রত দত্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও হরপ্রসাদ মিত্র। আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষও ছিলেন সেইসঙ্গে।
সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, মূল সভাপতি ছিলেন জসীমউদ্দীন, বিশেষ অতিথি শিক্ষা ও সংস্কৃতিমন্ত্রী মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। তিনটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল। মোহাম্মদ সাইদুরের সংগ্রহ নিয়ে লোকশিল্পের প্রদর্শনী, উদ্ববাধন করেন জয়নুল আবেদিন। তাছাড়া, মুরাল প্রদর্শনী উদ্ববাধন করেন আবদুল মতিন চৌধুরী এবং গ্রন্থ প্রদর্শনী উদবোধন করেন আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ্। নৃত্যগীতবাদ্যনাট্যের কোনো-না-কোনো অনুষ্ঠান হয়েছিল প্রতি সন্ধ্যায়।
জসীমউদ্দীনের ভাষণে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছিল। তিনি বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন; কাগজ ও মুদ্রণের ব্যয় এবং বিজ্ঞাপনের উচ্চহার যে ভালো প্রকাশনার অন্তরায় সে কথা বলেছিলেন; ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বইপত্রের অবাধ আদানপ্রদানের প্রস্তাব এনেছিলেন; বাংলাদেশে রবীন্দ্ররচনাবলি মুদ্রণের বিষয়ে বিশ্বভারতীর অনুমতি ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগ দাবি করেছিলেন।
সম্মেলন বিভক্ত হয়েছিল অনেকগুলি শাখা-অধিবেশনে এবং কয়েকটি সাধারণ অধিবেশনে। আবুল ফজল, শওকত ওসমান, আবদুল গনি হাজারী, কাজী মোতাহার হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান ও কবীর চৌধুরী সাধারণ অধিবেশনে এবং মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, রোকনুজ্জামান খান, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, রণেশ দাশগুপ্ত, মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, কাজী আবদুল মান্নান, সৈয়দ মুর্তজা আলী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, নীলিমা ইব্রাহিম, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আবদুল আহাদ, কামরুল হাসান ও আমি শাখা-অধিবেশনে সভাপতিত্ব করি। কবিতাপাঠের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন সুফিয়া কামাল এবং সমাপ্তি-অধিবেশনে ম্যহারুল ইসলাম। আমি একটি সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিয়েছিলাম, আর বাংলাদেশের গবেষণা-সাহিত্য শাখা-অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলাম। ওই অধিবেশনে প্রবন্ধ পড়েছিলেন সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, আর আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ। আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন আ কা মো যাকারিয়া, মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল, মুহম্মদ আবদুর রহীম, মাহমুদ শাহ কোরেশী, নেয়ামাল বাসির, আব্দুর রাজ্জাক ও মনিরুজ্জামান। সভাপতির ভাষণের সূচনায় আমি সেই গল্পটি বলেছিলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরে আমাদের এক সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি বিদেশে গিয়ে সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা কীভাবে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। তখন শ্রোতাদের একজন উঠে বললেন, আপনাদের দেশ যে একেবারে বুদ্ধিজীবীশূন্য হয়ে গেছে, আপনার কথা শুনে সে-সম্পর্কে আমাদের সম্পূর্ণ প্রত্যয় জন্মেছে। আমি বলেছিলাম, সেই শূন্যতার সুযোগে সভাপতির আসনটি আমার দখলে এসেছে। মনোজ বসু আমার কথা খুব উপভোগ করেছিলেন।
এই সম্মেলনে অন্নদাশঙ্কর রায়, আশুতোষ ভট্টাচার্য, মনোজ বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিনয় সরকার, বাণী রায়–এঁদের সঙ্গে পুরনো পরিচয় ঝালিয়ে নেওয়া গেল। নতুন পরিচয় হলো লীলা রায়, রমা চৌধুরী, হরপ্রসাদ মিত্র–এঁদের সঙ্গে। বাণী রায় অনিরুদ্ধের পিসিমা–সেই সুবাদে তাঁকে চট্টগ্রামে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। শুনলাম, হরপ্রসাদ মিত্র চট্টগ্রামে আসবেন–তাঁকে আমন্ত্রণ জানালাম আমাদের বিভাগে বক্তৃতা দিতে।
সাহিত্য-সম্মেলনের মাঝখানেই খবর পাওয়া গেল, আমাদের পররাষ্ট্র-সচিব এনায়েত করিম ১৬ ফেব্রুয়ারিতে ইন্তেকাল করেছেন। অফিসেই ছিলেন, সেখানে হৃদযন্ত্র আক্রান্ত হয় তৃতীয়বারের মতো। ১৯৫৯ সালে আমার পিএইচ ডি গবেষণার কাজে কলকাতায় গিয়ে তারই আশ্রয়ে ছিলাম। তারপরেও অনেকবার দেখা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত অবস্থায় যখন পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন, তখনো তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন। তবু বাংলাদেশের স্বাধীনতা-অর্জনের পর পররাষ্ট্র সচিব হয়ে শারীরিক অসামর্থ্য অগ্রাহ্য করে আপ্রাণ সেবা করেছেন দেশের। তার স্ত্রী হুসনা করিম অতি চমৎকার মানুষ। খবর পেয়ে দৌড়ে গেলাম তাঁদের ধানমন্ডির বাসায়। এনায়েত করিমের দাফন হয়ে গেছে ততক্ষণ। হুসনা ভাবির সঙ্গে দেখা করে ফিরে এলাম। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার ছিল না।
এদিকে অনেক কিছু ঘটছিল দেশে। জানুয়ারি মাসে যখন আওয়ামী লীগের কাউনসিল-অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তখন বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন, তিনি দলীয় প্রধানের দায়িত্বে আর থাকবেন না। সেই সিদ্ধান্ত-অনুযায়ী এ এইচ এম কামারুজ্জামান দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। তার ফলে তিনি আবার মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এটাও ঘটে সাহিত্য-সম্মেলন চলাকালে। আমরা অনেকেই এতে খুশি হই, দল আর সরকারের মধ্যে একটা সীমারেখা টানা হচ্ছে বলে। তবে এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সর্বব্যাপী ভূমিকায় পার্থক্য ঘটে না। দল ও সরকারের ভেদ কিছুটা তাত্ত্বিক হয়ে পড়ে।
সাহিত্য-সম্মেলন শেষ হলো একুশে ফেব্রুয়ারিতে। তার পরদিনই পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিলো বাংলাদেশকে। আর ২৩ তারিখেই ইসলামি রাষ্ট্র-সংস্থার সম্মেলনে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধু উড়ে গেলেন। লাহোরে। আমরা তো ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে ইসলামি দেশ হিসেবে দেখিনি, দেখার পক্ষপাতীও নই। কিন্তু কয়েকদিন ধরেই শুনছিলাম, অনেক বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক চাইছিলেন বাংলাদেশ এই সম্মেলনে যোগ দিক। সরকারের পক্ষ থেকে নাকি বলা হয়েছিল যে, তার আগে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি পেতে হবে। ও আই সির প্রভাবশালী সদস্যদের চাপে পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। লাহোর বিমানবন্দরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাদকেরা আমার সোনার বাংলা বাজিয়ে অভ্যর্থনা জানায় শেখ মুজিবকে, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল টিক্কা খান তাঁকে অভিবাদন জানান। এইসব দরকষাকষির বিষয়ে ভারতকে কিছুটা অন্ধকারে রাখে বাংলাদেশ, যদিও আমার সন্দেহ, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাদের সরকারকে পরিস্থিতি অবহিত করতে কার্পণ্য করেনি। ভারতের প্রভাববলয় থেকে আমরা যে স্বাধীন, তা প্রমাণ করতে যথাসাধ্য করছিলেন আমাদের কূটনীতিকেরা–হয়তো রাষ্ট্রের কর্ণধারেরাও। আমাদের মনে হলো, তারই ফলে, পাকিস্তানের স্বীকৃতির বিনিময়ে ও আই সির সদস্যপদ নিলো ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। তবে যখন ভাবি, ভারতও এক সময়ে। ও আই সির সদস্যপদপ্রার্থী ছিল যদিও তাকে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়, তখন আমাদের সরকারের কাজ আর বিস্ময়কর মনে হয় না। কূটনীতিতে বোধহয় সবই চলে।
আমি চট্টগ্রামে ফিরে যাওয়ার দু-একদিনের মধ্যেই বাণী রায় এলেন। বিমানবন্দরে তাঁকে আনতে গেলাম। দ্রুতপদে বিমান থেকে নেমে তিনি আমার সন্নিকটবর্তী হয়ে বললেন, ‘হরপ্রসাদ মিত্রও এই ফ্লাইটে এসেছেন, তবে তাঁকে আপনার কিছু বলার দরকার নেই। তারা দুজনেই প্রায় সমবয়সী। বাণী রায় কবি; ছোটোগল্প, উপন্যাস ও নাটকেও তিনি সিদ্ধহস্ত। হরপ্রসাদ মিত্র খ্যাতনামা। কবি ও সমালোচক, প্রেসিডেন্সি কলেজের বাংলার অধ্যাপক। যৌবনকালে রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প সম্পর্কে লেখা তাঁর প্রবন্ধ পড়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ খুব আপ্লুত হয়েছিলেন। আমি যখন এম এ পড়ি, তখন তাঁর পিএইচ ডি অভিসন্দর্ভের মুদ্রিতরূপ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা ও কাব্যরূপ পড়েছি পরীক্ষাপাশের জন্যে। তিনি চট্টগ্রামে আসবেন জেনে তাকে আমাদের বিভাগে বক্তৃতা করতে আমন্ত্রণও জানিয়ে এসেছি ঢাকায়। এখন বাণী রায়ের কথা শুনে তাঁকে অবজ্ঞা করি কী করে এবং কেনই বা! আমি আমতা-আমতা করছি, তখন বিমান থেকে নেমে হরপ্রসাদ মিত্র হাত নাড়ছেন আমার উদ্দেশে। বাণী রায়কে বললাম, ‘পিসি, উনি এসে পড়েছেন। একসঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া তো যাক, তারপর যা হয় হবে। যেহেতু গাড়ি আমিই চালাই, হরপ্রসাদ বসলেন আমার পাশে, বাণী রায় পেছনে বসলেন আর বিশেষ শব্দ করলেন না। মনে হলো, হরপ্রসাদ ব্যাপারটা খানিক আঁচ করতে পেরেছিলেন। ওঁদেরকে বিভাগে নিয়ে গিয়ে বক্তৃতা করালাম, তারপর তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলেন, বাড়ি যাওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন না। বাণী রায় এবারে খুশি হয়ে আমার সঙ্গে চললেন।
খেতে খেতে বাণী রায় জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কিসের ডাল?’ বেবী চটপট উত্তর দিলো, মাধবীলতার ডাল। আমাদের খাবার টেবিলের পাশে জানলা, সে জানলার ওপারে মাধবীলতার গাছ। তার একটা ডাল বেঁকে ওই জানলা ঘেঁষে আছে। বাণী রায় জানতে চেয়েছিলেন, যে-ডাল তাঁকে খেতে দেওয়া হয়েছে, সেটা কী। আর বেবী ধরে নিয়েছিল, জানলার ধারে উঁকি দিচ্ছে যে-ডাল, তিনি তার পরিচয় জানতে চাইছেন। বেবীর জবাব শুনে বাণী রায় অস্ফুটস্বরে বলতে লাগলেন, জীবনে কত ডাল খেলুম, কখনো মাধবীলতার ডাল তো শুনিনি। তাঁর এই উক্তি শুনে বেবীর চৈতন্যোদয় হলো। তখন সে ডাল এবং ডালের ভেদনিরূপণতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে প্রবৃত্ত হলো।
কলকাতায় ফিরে গিয়ে ভ্রাতুস্পুত্র অনিরুদ্ধের কাছে আমাদের আতিথেয়তার প্রশংসা করেছিলেন বাণী রায়। হরপ্রসাদ মিত্রের সঙ্গে আমার আর জীবনে দেখা হয়নি।
৩১.
চট্টগ্রামে আসার পরে গবেষণার কাজে আমার কোনো অগ্রগতি ঘটেনি। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার প্রস্তাবিত প্রবন্ধের জন্যে অনেকখানি শ্রম ও সময় দিয়েছিলাম। সেটা যথাসময়ে শেষ করতে পারলাম না, পরে আর তাতে হাত দেওয়ার তাগাদাও অনুভব করিনি। তাছাড়া, অন্যের বইয়ের ভূমিকা লিখেছি, স্মারকগ্রন্থের জন্যে প্রবন্ধ লিখেছি, খানিক গবেষণামূলক-খানিক সাধারণ পাঠযোগ্য শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখেছি মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুতে। কিন্তু প্রকৃত গবেষণার কাজে হাত দিতে পারিনি। সময় যে বৃথা ক্ষেপণ করেছি, তাও নয়। সংবিধান বা অন্যান্য যেসব কাজ করেছি বাংলার প্রয়োগ নিয়ে, সেও তো আমার কাজ। শিক্ষা কমিশনের জন্যে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মে যে-সময় দিয়েছি তাও তো অকাজে নয়। তবু অনুভব করেছি, অন্যান্য দায়িত্ব থেকে সরে এসে গবেষণায় ফেরা দরকার।
মনের মধ্যে একটা কাজের পরিকল্পনাও ছিল। সুশীলকুমার দে-র হিস্ট্রি অফ বেঙ্গলি লিটারেচর ইন দি নাইনটিথ সেঞ্চুরি (কলকাতা, ১৯১৯) বইতে পুরোনো বাংলা গদ্য সম্পর্কে একটি পরিশিষ্ট আছে। সেটা পড়ে মনে হয়েছিল, এ-বিষয়ে কিছু কাজ করার সুযোগ রয়েছে। সুকুমার সেনের বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য (কলকাতা, ১৯৩৪) থেকেও সে-ধারণার সমর্থন পাই। স্থির করি, ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের, অর্থাৎ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ-প্রতিষ্ঠার আগের, বাংলা গদ্য নিয়ে। গবেষণা করব। কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমিক স্টাফ ফেলোশিপের জন্যে যখন আবেদন চাওয়া হলো ১৯৭৩ সালে, তখন সেই প্রস্তাব দিয়ে দরখাস্ত করে দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোনয়ন পেতে দেরি হলো না।
এর মধ্যে বিভাগ থেকে এক দুপুরে বাড়ি ফিরছি গাড়ি চালিয়ে। পথের মধ্যে দেখি সেনাবাহিনীর কয়েকজন জওয়ান দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে একজন হাত দেখিয়ে গাড়ি থামালো। তারপর এগিয়ে এসে বাঙালি উচ্চারণ-ভঙ্গিতে জানতে চাইলো, ‘কিধার জাতা হ্যায়?’ বাংলাদেশের সৈনিকের মুখে উর্দুতে এমন প্রশ্ন শুনে ভয়ানক বিরক্ত হলাম। তবে বিরক্তি চেপে রেখে বললাম, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–এখানে কোয়ার্টারে থাকি, বাসায় যাচ্ছি। সে এবারে আমার ফোকসওয়াগেনের পেছন দিকে গিয়ে বললো, ‘ডিব্বা খুলো।’ বললাম, ‘ওখানে ইনজিন–আপনি সামনে দেখুন।’ সে কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে সামনে পেছনে-মধ্যে সব দেখে আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিলো।
ঘরে ফিরে রেজিস্ট্রারকে ফোন করলাম। তার কাছ থেকে জানলাম, দেশে যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, তাদের ধরতে এবং বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করতে বেসামরিক প্রশাসনকে সাহায্য করার জন্যে সামরিক বাহিনী নিয়োজিত হয়েছে। একজন কর্নেলের নেতৃত্বে একদল সৈন্যকে মোতায়েন করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়-এলাকায়। সামরিক-কর্তৃপক্ষের অনুরোধে বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসন তাদের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সেনাবাহিনী ছাত্রদের হলগুলি অনুসন্ধান করে তেমন কিছু পায়নি। কিন্তু ক্যাম্পাসের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও গ্রেনেড বা গোলাগুলি পেয়েছে। দু-চারজন ছাত্র ও কর্মচারীকে নিয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত সেনাবাহিনীর ইন্টারোগেশন সেন্টারে। সন্ধে নাগাদ শোনা গেল, আমাদের সহকারী মেডিক্যাল অফিসার ডা. আখতারুজ্জামানকে আটক করা হয়েছে। আখতারুজ্জামান একই সঙ্গে সফল চিকিৎসক ও ভালো মানুষ। সুতরাং তার জন্যে আমরা অনেকেই উৎকণ্ঠিত হলাম। উপাচার্যকে তার শহরের বাসভবনে ফোন করে আমাদের উদবেগের কথা জানালাম। তিনি বললেন, রেজিস্ট্রারকে তিনি খোঁজ নিতে বলছেন এখনই, আর পরদিন সকালে অফিসে এসে তিনি। নিজেই এ-বিষয়ে কথা বলবেন।
রেজিস্ট্রারের খোঁজখবরে কোনো কাজ হলো না। পরদিন উপাচার্যের দপ্তরে আমরা অনেকে সমবেত হলাম। কর্নেল কুদ্স এলেন–তিনি প্রকৌশলী, কথাবার্তায়ও কুশলী। বললেন, তাঁদের কাছে খবর আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যামবুলেন্সে অস্ত্রশস্ত্র আনা হয়েছে ক্যাম্পাসে এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা তাতে শহর ও ক্যাম্পাসে যাতায়াত করেছে। ওই চিকিৎসককে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার, প্রয়োজনের এক মুহূর্ত বেশি তাকে আটক রাখা হবে না। না, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আটক করা হয়েছে মাত্র। আনুষ্ঠানিক ভাষা ব্যবহার করলে বলতে হবে, আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি আমাদের কাজে সাহায্য করছেন।
সেদিন শোনা গেল, ইন্টারোগেশন সেন্টারে আটক ব্যক্তিদের কাউকে কাউকে শারীরিক নির্যাতন করা হচ্ছে। কর্নেল কুদুসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বললেন, আমাদের কাজ আমাদের করতে দিন। তবে নিশ্চিত থাকুন, বেআইনি কিছু করা হচ্ছে না, আবার কেউ আইন-বিরোধী কিছু করে থাকলে তাকেও ছাড়া হবে না। আটক ব্যক্তি কিছু কিছু ছাড়া পেতে লাগলো। তাদের কাছ থেকে সেনা-কর্তৃপক্ষ এই মর্মে লিখিত ঘোষণা নিয়ে রাখলো যে, তাদের প্রতি কোনো শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি–যাদের প্রতি নির্দয় আচরণ করা হয়েছিল, তারাও এরকম প্রত্যয়ন করলো। ডা. আখতারুজ্জামান ছাড়া পেলে। আমাদের ধারণা হয়, তিনি এই শেষ দলভুক্ত।
আমরা আবার উপাচার্যের কাছে গেলাম। তিনি খবর দিলে কর্নেল কুদুস এলেন। আমিই বললাম, ‘দেখুন, আমরা জানতে পেরেছি, যাদের নির্যাতন করা হয়েছে, তাদেরকেও আপনারা লিখে দিতে বাধ্য করছেন যে, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়নি। এটা কী ধরনের কথা?’ কর্নেল বললেন, ‘আমি এই চার। দেয়ালের মধ্যে আপনাদের বলছি, তবে বাইরে স্বীকার করবো না, প্রকৃত তথ্য বের করার জন্য উই হ্যাভ অ্যাপ্লায়েড থার্ড ডিগ্রি টু সাম ইনডিভিজুয়ালস, বাট ফর আওয়ার সেফটি, যাতে কেউ আমাদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় না নিতে পারে, উই আর অবটেনিং ফ্রম দেম এ স্টেটমেন্ট টু দি ইফেক্ট দ্যাট দে ওয়্যার নট ট্রিটেড হার্শলি। প্রফেসর সাহেব, আমি বুঝতে পারছি, আপনার খারাপ লাগছে, বাট দিস ইজ দি রিয়্যালিটি–নিজেদের প্রটেকশনের জন্য পুলিশ এটা করে, প্রয়োজন হলে আমরা করি। আপনি কি মনে করেন যে, আমরা জিজ্ঞাসা করলেই কেউ সত্যি কথা বলবে? সত্যি কথা বলাতে হয়, তার জন্য জোর খাটাতে হয়। কিন্তু আইনত জোর খাটানো যায় না, তাই তাদের কাছ থেকে ওসব লিখিয়ে নিতে হয়।
আমরা এরপর উপাচার্যকে পীড়াপীড়ি করলাম, সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার জন্যে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করতে। একটু ভেবে নিয়ে আবুল ফজল টেলিফোন করলেন বঙ্গবন্ধুকে। আমরা বিভাগীয় অধ্যক্ষ যারা উপস্থিত ছিলাম–যতদূর মনে পড়ে, ইংরেজির মোহাম্মদ আলী, বাংলার আমি, অর্থনীতির মুহাম্মদ ইউনূস, পদার্থবিজ্ঞানের এখলাসউদ্দীন আহমদ, গণিতের ফজলী হোসেন, পরিসংখ্যানের এম জি মোস্তফা, হিসাববিজ্ঞানের আলী ইমদাদ খান, ব্যবস্থাপনার শামসুজ্জোহা-তাদের সকলের নাম বললেন। জানালেন, পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেনাবাহিনীর প্রত্যাহার চাইছি এবং তিনি আমাদের সঙ্গে একমত। উপাচার্যের অনুরোধ বিবেচনা করবেন বলে প্রধানমন্ত্রী কথা দিলেন। পরদিন সেনাবাহিনীর কাউকে আর ক্যাম্পাসে দেখা গেল না।
৩২.
প্যারিস থেকে আনোয়ার আবদেল-মালেক চিঠি লিখলেন। ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে ‘ইনইকুয়ালিটি সম্পর্কে সেমিনার হবে। তার আয়োজক ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন আমাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। আমি যেন অবশ্যই যাই।
এতদিন বামপন্থার সঙ্গে জড়িত আছি, বিষয়টি আমার নয় বলতে দ্বিধা হয়। আবার বিষয়টি সম্পর্কে যেমন বিশেষ জ্ঞান থাকলে অ্যাকাডেমিক সেমিনারে অংশ নেওয়া যায়, তা আমার নেই, এটা ভেবেও সংকোচ হয়। আনোয়ার আবদেল-মালেককে তা-ই লিখলাম, তবে তার আদেশ শিরোধার্য করতে আমি প্রস্তুত, সেকথা জানালাম। বললাম, তার সঙ্গে দেখা হবে, এই সম্ভাবনাও আমাকে টানছে। তিনি লিখলেন, তিনি যাচ্ছেন না, তবে আমাকে যেতে হবে এবং বিশিষ্টজনদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে আসতে হবে।
ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর চিঠিতে জানলাম, কুবেক সেন্টার অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস এবং ইন্টারন্যাশনাল সোসিওলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনের ন্যাশনাল মুভমেন্টস অ্যান্ড ইম্পিরিয়ালিজম-সম্পর্কিত রিসার্চ কমিশনের যৌথ উদযোগে ১৯৭৪ সালের মে মাসের মধ্যভাগে মন্ট্রিয়লে ওয়ার্লড ইনইকুয়ালিটি শীর্ষক একটি কলোকিয়াম অনুষ্ঠিত হবে। তাতে সংস্কৃতি-বিষয়ে একটি অধিবেশন। থাকবে। ব্রাজিলের এক বিশিষ্টজন যে-প্রবন্ধ পড়বেন সেখানে, তার কপি আমাকে আগাম পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমার দায়িত্ব, ওই প্রবন্ধ সম্পর্কে সুচিন্তিত আলোচনা করা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, একটা অবলম্বন পাওয়া গেল।
কিন্তু প্রবন্ধটি শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছোলো না। ঝাড়া হাত-পা নিয়ে রওনা হলাম। লন্ডনে যাত্রাবিরতি, থাকার ব্যবস্থা হিথরো বিমানবন্দর-এলাকার একটি হোটেলে। সেখানে স্যুটকেস রেখে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের শিল্পীবন্ধু এ কে এম আবদুর রউফ বাংলাদেশ হাই কমিশনে দ্বিতীয় সচিব। তাঁর সঙ্গে ব্যবস্থা করে এলাম, মন্ট্রিয়ল থেকে ফেরার পথে লন্ডনে তাঁর বাড়িতে সপ্তাহখানেক থাকবো। আমার ভাগ্নে ডা. মামুন ফেরদৌসীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম না। আমাদের সহকর্মী আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন তখন নাফিল্ড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ নিয়ে গবেষণা করছেন লন্ডনে এবং সপরিবারে থাকছেন সেখানে। তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করে এলাম।
ফেরার পথে কিংস ক্রসে টিউব-লাইন বদলাতে হবে। সেকথা যখন খেয়াল হলো, তখন কিংস ক্রস ছাড়িয়ে গেছি। অ্যানজেলে নেমে ফিরতি ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলাম প্ল্যাটফর্মে। এক শ্বেতাঙ্গিনী হাতে সিগারেট নিয়ে আমার কাছে আগুনের সন্ধান করলো। লাইটার দিয়ে তার সিগারেট ধরিয়ে দিলাম। সেই অবকাশে সে জানতে চাইলো, আমার বান্ধবী চাই কি না। সবিনয়ে বললাম, এখন নয়। তরুণীর কোনো ভাবান্তর দেখলাম না। আমি কোত্থেকে এসেছি, কোথায় যাচ্ছি, জিজ্ঞেস করলো। যথাযথ উত্তর দিলাম। হোটেলের নাম শুনে বললো, ওদিকটায় খুব যাওয়ার ইচ্ছা, কখনো যাওয়া হয়নি। বললাম, আশা করি, তোমার মনোবাঞ্ছ অচিরে পূর্ণ হবে। সে বললো, কেউ না নিয়ে। গেলে হবে না, একা-একা যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের হয়রানিতে পড়তে হয়। তার কথার জবাব না দিয়ে এবারে আমি জানতে চাইলাম, খদ্দেরের কাছে সে কত দাবি করে। মেয়েটি বললো, দশ পাউন্ড পেলে খুশি হই, তবে অবস্থাভেদে কম নিয়েও সন্তুষ্ট থাকি। এর মধ্যে ট্রেন এসে গেল। আমরা একই কামরায় উঠলাম এবং পরের স্টেশনে বিনা বাক্যবিনিময়ে আমি নেমে গেলাম।
অধ্যাপক মুশারফ হোসেন তার বন্ধু, পরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব এবং পূর্ব তিমুরে জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি, ইয়েন মার্টিনকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন আমার হাতে। ইয়েন যখন ঢাকায় ফোর্ড ফাউন্ডেশনে কাজ করতেন, তখন তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। ১৯৭১ সালে তিনি কর্মরত ছিলেন করাচিতে। পূর্ব বাংলায় তার পরিচিতজনের খবর নিতে তিনি ব্যাংকক হয়ে কলকাতায় আসেন সম্পূর্ণ নিজের উদযোগে। তখন আমরা কথা বলতে বলতে এবং নিঃশব্দে রাস্তায় অনেকক্ষণ পায়চারি করেছিলাম একসঙ্গে। ইয়েন এখন লন্ডনে, ব্রিটিশ লেবার পার্টির কাজে স্বনিয়োজিত। রাতে হোটেল থেকে ফোন করে তাঁকে পেলাম। তিনি বললেন, মন্ট্রিয়ল থেকে আমি যেদিন ফিরব, সেদিন তিনি বিমানবন্দর থেকে আমাকে নিয়ে পৌঁছে দেবেন গন্তব্যে, তখন কথা হবে, চিঠিটাও নেবেন।
মন্ট্রিয়ল রওনা হওয়ার সময়ে দেখি, এয়ার কানাডার কম্পিউটার কাজ করছে না। অতএব, যে যেখানে পারো বসে যাও। ধূমপান করা চলে, এমন এলাকায় আসন পেলাম না। ফলে, আমার আসন থেকে খানিক হেঁটে গিয়ে ধূমপায়ীদের এলাকায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অভ্যাসের দাসত্ব করতে হলো। এক বয়স্ক শ্বেতাঙ্গেরও একই অবস্থা। তিনি খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, যখন কম্পিউটার ছিল না, তখন এরা হাতে লিখে যেভাবে আসন বণ্টন করতে পারতো, যন্ত্র খারাপ হলে সেটা করতে পারবে না কেন? আমার মনে হয়, যন্ত্র এদের দক্ষতা বাড়াচ্ছে না, বরঞ্চ অলস করে দিচ্ছে।
মন্ট্রিয়লের হোটেলে পৌঁছোলাম বিকেলবেলায়। আমার আলোচ্য প্রবন্ধ তখনো হাতে পেলাম না। নিজেকে দোভাষী পরিচয় দিয়ে একটি মেয়ে এসে বললো, ব্রাজিলিয়ান অংশগ্রহণকারী প্রবন্ধটি লিখেছেন পর্তুগিজে; সে একটা টেপ-রেকর্ডারে তা মুখে মুখে অনুবাদ করে দেবে; রাতে টেপ শুনে আমার মন্তব্য তৈরি করতে হবে। তারা দুঃখিত, কিন্তু এখন লিখিত অনুবাদ প্রস্তুত করার সময় নেই। রাতে একবার টেপ শুনে কিছু কথা টুকে রাখলাম, ভোরবেলা আরেক দফা কসরত করলাম। সেদিন সকালের অধিবেশনে ওই প্রবন্ধ-পাঠ এবং আমার মৌখিক আলোচনা। পরে দোভাষী আমাকে বলেছিল, প্রবন্ধ-উপস্থাপনের সময়ে ভদ্রলোক বেশ কিছু কথা বাদ দিয়েছেন, নতুন দু-একটি কথা যোগ করেছেন। আগে টেপে অনুবাদ শোনায় আমি আর ওঁর তাৎক্ষণিক উপস্থাপনের অনুবাদে মনোযোগ দিইনি। ফলে, দোভাষীর মতে, প্রবন্ধে ও আলোচনায় কিছু গরমিল রয়ে গেছিল। প্রবন্ধের সঙ্গে আমার মন্তব্যের যোগ যেখানে শ্রোতারা খুঁজে পাননি, সেসব জায়গা হয়তো তারা আমার মৌলিক বক্তব্য বলে ধরে নিয়েছিলেন। যারা আমার আলোচনায় প্রীত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন সিক্স ভিলেজেস অফ বেঙ্গল (কলকাতা, ১৯৪৪)-খ্যাত রামকৃষ্ণ মুখার্জি। তিনি তখন কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটে ডিসটিংগুইশড সাইনটিস্ট পদের অধিকারী এবং সম্ভবত ওই কলোকিয়ামের সবচেয়ে প্রবীণ অংশগ্রহণকারী। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমাকে তার পক্ষপুটের আশ্রয়ে নিয়েছিলেন। আমাকে দেওয়া তাঁর একটি পরামর্শ ছিল এই : ‘এদের আমন্ত্রণে আসবে এবং এদের কষে গাল দেবে, তবেই এদের সমাদর পাবে। এই ডাকসাইটে সমাজবিজ্ঞানী সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা ছিল। এই সেমিনারে যোগ দেওয়ায় আমার সবচেয়ে লাভ হয়েছিল সেই থেকে অবিরাম ধরে তাঁর। আনুকূল্য পাওয়া।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলাম বলে ওই কলোকিয়ামে আমি কিছু বাড়তি সমাদর পেয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ভালো আলাপ হয়েছিল সংস্কৃতি বিষয়ক অধিবেশনের আর দুই অংশগ্রহণকারীর। একজন দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাসিত কবি ডেনিস ব্রুটাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক। অপরজন মোহাম্মদ সালাহ স’ফিয়া–তিউনিসিয়ার মানুষ, কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব পড়ান। এঁদের সৌজন্য মনে রাখার মতো। সালাহ্ সফিয়ার সঙ্গে পরবর্তীকালে আমার আরেকবার দেখা হয়েছিল–তাঁর হৃদয়ের উত্তাপ তখনো অনুভব করেছি।
ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন যে কত বড়ো পণ্ডিত, তা আমার জানা ছিল না, তাঁর ‘ওয়র্লড-সিস্টেমে’র তত্ত্বের সঙ্গেও আমার পরিচয় ছিল না। তার তত্ত্ব অনুসরণ করে লিখিত এবং অন্য অধিবেশনে উপস্থাপিত একটি প্রবন্ধের প্রসঙ্গে আমি যখন জানতে চাইলাম, ‘ওয়র্লড-সিসটেন্স’ না বলে ‘ওয়ার্লড সিসটেম’ বলা হচ্ছে কেন, তখন নিজের অজ্ঞতাই জাহির করা হয়েছিল। ওয়ালারস্টাইনের তত্ত্ব-অনুযায়ী সারা পৃথিবী এক অর্থনীতির অধীন। আমি যেহেতু পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রকে দুই পৃথক ব্যবস্থা বলে গণ্য করতাম, তাই জানতে চেয়েছিলাম, বিশ্ব-ব্যবস্থা কি এক না একাধিক? ওয়ালারস্টাইনের তত্ত্ব সম্পর্কে আরো না জেনে আমার কিছু বলা ঠিক হয়নি। এমনকী, রামকৃষ্ণ মুখার্জিও পরে বললেন, ‘ও-প্রশ্ন না করলেই পারতে। সকালে তুমি এত ভালো বললে!’ অর্থাৎ নিজেকে ডুবিয়েছি। আসলে গোটা কলোকিয়ামই পরিচালিত হয়েছিল ওয়ালারস্টাইনের তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, ব্যাপারটা আমি আগে বুঝিনি।
ওয়ালারস্টাইনের ব্যবহারে অবশ্য কোনো তারতম্য দেখিনি। এই কলোকিয়ামের প্রবন্ধগুলি সংগ্রহ করে যখন ওয়ার্লর্ড ইনইকুয়ালিটি (মন্ট্রিয়ল, ১৯৭৫) নামে বই বের হয়, তখন একটি দীর্ঘ চিঠিতে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে, ব্রাজিলের সেই প্রবন্ধটি তত সন্তোষজনক বিবেচিত না হওয়ায় তা মুদ্রিত হয়নি এবং মূল প্রবন্ধ মুদ্রিত না হওয়ার কারণে আমার আলোচনাও বইতে স্থান পায়নি–আমি যেন কিছু মনে না করি। পরে তিনি ফার্ডিনান্ড ব্রডেল সেন্টারের পরিচালক হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলে দীর্ঘকাল ওই সেন্টারের কাগজপত্র আমাকে পাঠাতেন। তাছাড়া, আনোয়ার আবদেল মালেক আয়োজিত অন্য একটি সেমিনারে তাঁর সঙ্গে আমিও অংশগ্রহণ করি। সেখানেও তিনি খুব সহৃদয় আচরণ করেছিলেন।
ওই কলোকিয়ামে উপস্থিত দুই বাঙালি শ্রোতা আমার খুব সমাদর করেছিলেন এবং একজন নিজের গাড়িতে করে মন্ট্রিয়ল শহর ঘুরে দেখিয়েছিলেন।
৩৩.
মন্ট্রিয়লে সেমিনার শেষ করেই আমি লন্ডনে ফিরে এলাম। ইয়েন মার্টিন হিথরো থেকে আমাকে নিয়ে চললেন এ কে এম আবদুর রউফের বাড়িতে। তার আগে মুশারফ হোসেনের চিঠি পড়ে বললেন, মুশারফ তোমাকে কিছু পাউন্ড দিতে বলেছে–এটা তুমি আগে জানালে আমি এখানেই তা দেওয়ার ব্যবস্থা করতাম। ঠিক আছে, কাল দেওয়া যাবে। চিঠিতে মুশারফ কী লিখেছেন, তা আমার আদৌ জানা ছিল না, সুতরাং ইয়েনকে কিছু জানাবার সুযোগই ছিল না। মুশারফ হোসেন যে বিদেশ-বিভুঁইয়ে আমাকে অর্থসাহায্য করার কথা ভেবেছেন, তাও অপ্রত্যাশিত ছিল।
রউফের বাড়ি পৌঁছে কলিং বেল টিপে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। একটা টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করলাম। ফোন বাজছে, কেউ ধরে না। ইয়েনের প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল, বাড়ির নম্বর ভুল হয়েছে কি না, টেলিফোনে সাড়া না পেয়ে বললেন, কিছু একটা হয়েছে–ওরা কেউ বাড়ি নেই। আমি খুব লজ্জিত হয়ে বললাম, দুঃখিত। তুমি আমাকে একটা শস্তা হোটেল বা গেস্ট হাউজে নিয়ে চলো। ইয়েন বললেন, তুমি আমার বাড়ি চলো। আমি খুব অগোছালো থাকি, তোমার অসুবিধে হবে। তবে তোমাকে হোটেলে নেওয়ার চেয়ে নিজের বাড়িতে নেওয়া ভালো। আমার মৃদু আপত্তি কোনো কাজে এলো না। ইয়েন থাকতেন এসেক্সে। দক্ষিণ-পশ্চিমে বিমানবন্দর থেকে আমাকে নিয়ে উত্তরে রউফের বাড়ি হয়ে পুবে নিজের বাড়িতে ফিরতে হলো বেচারাকে। সরাসরি বাড়িতে নেওয়া অনেক সহজ হতো।
সকালবেলা ইয়েনের বাড়িতে খেয়ে, তাঁর কাছ থেকে পাউন্ড নিয়ে, আলমগীর সিরাজুদ্দীনের বাড়িতে স্যুটকেস রেখে, গেলাম আমাদের হাই কমিশনে। সেখানে রউফ নেই, তাঁর হদিস ঠিকমতো পেলাম না। মামুনের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারিনি। আলমগীর বললেন, তাঁদের নাফিল্ডের ফ্ল্যাটে অতিথি রাখার নিয়ম নেই। তবে তাঁর পাকিস্তানি শ্যালক বন্ধুদের নিয়ে যে-ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে, সেখানে রাত কাটাতে পারি। সেখানেই গেলাম। গভীর রাতে ঘরের দরজায় করাঘাত। আশ্রয়দাতা জানালো, আমার খোঁজে কে যেন এসেছে। নিচে নেমে দেখি, মামুন। সেই দণ্ডেই আসমা সিরাজুদ্দীনের ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে মামুনের গাড়িতে উঠে পড়লাম। তার কাছ থেকে জানা গেল, রউফের পুরো পরিবার খাদ্যের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ভাবি কোনোমতে টেলিফোনের কাছে এসে এমারজেন্সির নম্বর ডায়াল করেন। তারপর অ্যামবুলেন্স এসে বাড়ির পাঁচজনকেই নিয়ে যায় হাসপাতালে। আজই বন্ড দিয়ে তারা বিকেলে ঘরে ফিরেছেন–তাও আমার জন্যে। মামুনকে বলেছেন, আমাকে খুঁজে বের করে তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে। মামুন প্রায় গোয়েন্দার মতো অনুসন্ধান চালিয়ে আমাকে ধরতে পেরেছে।
রউফের বাড়িতে তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর অপরিসীম যত্নে এক সপ্তাহ আনন্দে কাটানো গেল। তার মধ্যে এক সন্ধ্যায় আবু রুশদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ। তিনি বাংলাদেশ হাই কমিশনে এডুকেশন কাউনসেলর। বেশ বড়োসড়ো পার্টির আয়োজন করেছেন, তবে তা নারীচরিত্র-বর্জিত। প্রধান অতিথি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে সৈয়দ হোসেন, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, তবে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি হওয়ার সূত্রে পদমর্যাদা যতটা দাবি করে, তার প্রভাব তার চেয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। সিভিল সার্ভিসের দুই জ্যোতিষ্ক–মনোয়ারুল ইসলাম ও সৈয়দ শামীম আহসান–উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা তিনজন সম্ভবত কোনো সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকা থেকে এসেছিলেন। আলমগীর সিরাজুদ্দীন আর আমি ছিলাম। আরো কয়েকজন ছিলেন। সৈয়দ হোসেন সদ্যপরিচিতদের প্রত্যেকের কাছেই জানতে চাইছিলেন, কে কেন কতদিন বিদেশে আছেন এবং কবে দেশে ফিরে যাবেন। তার কণ্ঠের দৃঢ়তাহেতু মনে হচ্ছিল, তিনি ধমক দিয়ে কথা বলছেন–সেটা আমার ভালো লাগেনি। আবু রুশদ যখন এরপর তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কী পান করবেন, তখনো তিনি অনাবশ্যক জোরের সঙ্গে বললেন, ‘সফট ড্রিংক, অফ কোর্স। তারপর যাকেই জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনিই বলেন, কোমল পানীয় খাবেন; এমনকী যার সুরাসক্তির খ্যাতি আছে, তিনিও বলেন, হালকা কিছু খাবেন। তাঁদের কথায় গৃহকর্তা বিব্রত হতে থাকলেন, কেননা, মনে হলো, তার প্রশ্নটাই ছিল অনাবশ্যক ও অনুচিত। সুতরাং আমি যখন বললাম, শক্তমতো কিছু খাবো, তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি একটা ককটেল বানিয়েছিলেন। আমাকে দিলেন, নিজে নিলেন, এবং বললেন, ‘আনিসুজ্জামান সাহেব, খান, কারো পরোয়া করবেন না।’
বেপরোয়া খেতে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম এবং সেটা কারো অগোচর রইলো না। নিজে কুণ্ঠিত হলাম এবং গৃহকর্তাকেও বিব্রত করলাম। শামীম আহসান পকেট থেকে কী-একটা বড়ি বের করে খেতে দিলেন। আমি খেতে চাইছিলাম না, তিনি বললেন, এটা আপনার খাওয়া দরকার। খেলাম। শেষে লজ্জিতমুখে ও অবনতমস্তকে বসে রইলাম চুপ করে। ওই অবস্থায় ঘুম পেতে লাগল। তারপর এক সময়ে আলমগীর এবং আমি বিদায় নিয়ে পদব্রজে টিউব স্টেশনে চললাম। একই ট্রেনে উঠে আমি নেমে গেলাম অদূরে। রউফের বাড়িতে বাকি পথ হেঁটেই ফিরলাম।
এর মধ্যে বেবীর পাঠানো খবর এলো : আমাকে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমিক স্টাফ ফেলোশিপ মনজুর করার চিঠি চট্টগ্রামে পৌঁছে গেছে। সুতরাং অ্যাসোসিয়েশন অফ কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিজে গিয়ে আলাপ করে এলাম। সেখানে কমনওয়েলথ বৃত্তির দায়িত্বে ছিলেন রেবেকা জেমস-মহিলা অতি সদাশয়। সত্যিকার উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম তার কাছে আর পেলাম বহুরকম প্রয়োজনীয় পরামর্শ। তাঁর সহকারী ক্যাথির সঙ্গে পরিচয় হলো–খুব হাসিখুশি মেয়েটি। তার পদবি এখন মনে নেই, তবে অল্পকাল পরে বিয়ে করে সে ক্যাথলিন রবার্টস নামে পরিচিত হয়েছিল। আমার কাজের ক্ষেত্র নির্বাচন করেছিলাম লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (সোয়াস)। সেখানকার বাংলার প্রফেসর টি ডব্লিউ ক্লার্ক কিছুকাল হলো গত হয়েছেন। এখন বাংলা পড়ান ড. তারাপদ মুখোপাধ্যায় এবং বাংলা ও ওড়িয়া পড়ান ড. জে ভি বোলটন–উভয়েই লেকচারার। সুতরাং আমার গবেষণাকর্মে কোনো উপদেষ্টা নিযুক্ত হননি, তবে আমাকে যুক্ত করা হয়েছে ইন্ডিয়া, পাকিস্তান ও সিলোন বিভাগের প্রধান এবং সংস্কৃতের প্রফেসর জে সি রাইটের সঙ্গে। সোয়াসে গিয়ে প্রফেসর রাইটকে পেলাম না, বোলটনও লন্ডনের বাইরে, কিন্তু তারাপদ মুখোপাধ্যায়কে পাওয়া গেল। তিনি আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। আমার শিক্ষক শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। সেকথা বললেন, অনেকের খবরাখবর নিলেন। আমাকে নিয়ে লাইব্রেরি দেখাতে গেলেন। সেখানে সহকারী গ্রন্থাগারিক ডোগরা অনুরোধ করলেন, যখন সোয়াসে যোগ দিতে আসবো, তখন যেন বাংলাদেশ থেকে বই কিনে নিয়ে আসি যতটা পারি। ওঁরা আমাকে তার মূল্য এখানে পরিশোধ করে দেবেন।
খুশিমনে লন্ডন থেকে রওনা হলাম। দিল্লিতে ড. মল্লিকের বাড়িতে থাকলাম দুদিন। ভাবির আতিথেয়তার তুলনা হয় না। তারপর থাই এয়ারওয়েজযোগে ঢাকায় আসার পালা। ঢাকায় নামবার সময় হয়ে গেছে, তখনো দেখি বিমানটির উচ্চতার কিছু লাঘব হচ্ছে না। এয়ারহোস্টেসকে ডেকে জানতে চাইলাম, কী ব্যাপার। সে একটু দেরি করে ফিরে বললো, ক্যাপ্টেন জানাবেন। আমি তো বুঝে গেছি যা বোঝার। তার বেশ খানিকক্ষণ পরে ক্যাপ্টেন ঘোষণা করলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ঢাকায় অবতরণ করা সম্ভবপর হলো না। আমরা সোজা ব্যাংকক যাচ্ছি। সেখান থেকে পরদিন যাত্রীদের ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা যাবে। আমার পকেটে তখন ৪০ ব্রিটিশ পেনি এবং বাংলাদেশের ৫০ টাকা আছে মাত্র।
ব্যাংককের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়টা ভালো হয়নি। সেই ১৯৭৪ সালে ব্যাংকক আজকের মতো উন্নত হয়নি। তার ওপর এতজন যাত্রী একসঙ্গে চলতে প্রতিপদে বিলম্ব হতে লাগল। বিমানবন্দর থেকে গাদাগাদি করে বাসে যাওয়া হলো হোটেল এশিয়ায়। কর্তৃপক্ষ বললো, একেক ঘরে দুজন যাত্রীকে থাকতে হবে–সবাইকে আলাদা ঘর দেওয়ার মতো প্রচুর ঘর খালি নেই। তবে আমরা সকলে ঢাকায় ফোন করে খবর দেওয়ার সুবিধে পাবো।
যার সঙ্গে আমাকে ঘর ভাগ করতে হলো, সে একজন গ্রিক নাবিক। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে সে জাহাজ ধরবে। মাঝখানে বিনা পয়সায় ব্যাংককে আসতে পেরে সে খুশি। তার ইচ্ছে হলো, একটু ফুর্তি করবে। খানিক পরে এক হাড়-জিরজিরে স্বদেশিকে ধরে নিয়ে এসে সে বললো, ও খানিক রাত আমার বিছানায় ঘুমাবে, আমি ফিরে এলে আবার নিজের ঘরে চলে যাবে। আমি দরজায় করাঘাত করলে ও খুলে দেবে, তবে ও ঘুমিয়ে গেলে তুমি খুলে দিও একটু কষ্ট করে। আমি কোনো কথাই বললাম না।
হাড়-জিরজিরে বোধহয় একেবারেই ইংরেজি বলে না। বিনা বাক্যব্যয়ে সে বিছানায় চলে গেল এবং মৃদু নাক ডাকতে আরম্ভ করলো। আমাকে জাগিয়ে রাখতে সেই শব্দই যথেষ্ট। খানিক পরে দরজায় টোকা। আমি খুললাম। গ্রিক নাবিক ফিরে এসেছে স্যুটকেস থেকে কিছু একটা নিতে। প্রচুর দুঃখপ্রকাশ করে সে বিদায় নিলো। খানিক পরে আবার টোকা। দরজা খুলে দেখি, শুধু তোয়ালে পরা একটি থাই মেয়ে পাশের ঘরের দরজায় আঘাত করছে। আবার টোকা। এবারে করিডোরে কেউ নেই। অনেক পরে গ্রিক নাবিকের প্রত্যাবর্তন এবং হাড়-জিরজিরের প্রস্থান। আশা করলাম, এবার শান্তিতে ঘুমোতে পারব, কিন্তু মেজাজ খিঁচিয়ে গেছে বলেই বোধহয় ঘুম আর এলো না।
পরদিন ঘটনাবর্জিত ভ্রমণ এবং ঢাকা-প্রত্যাবর্তন।
৩৪.
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পরে আবু হেনা মোস্তফা কামাল থাকছিলেন আমার সঙ্গেই। তাতে আমাদের খুব আনন্দ হচ্ছিল, তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও সরসতা সবসময়ে একটা উপভোগ্য পরিবেশ রচনা করে চলত। তবে দুপুরবেলায় তাঁর অভ্যস্ত বিশ্রাম ঠিকমতো নেওয়া হতো না। দিবানিদ্রাকালে তার বাড়ি যেমন সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে থাকত, আমাদের বাড়িতে। ততখানি হতো না। একবার কোনো এক অবকাশে রাজশাহীতে রওনা হওয়ার সময়ে তিনি আমার ছেলেমেয়েদের বিদায়-সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন এই বলে : ‘চাচা, আমি চললাম, এখন আপনারা যত খুশি আওয়াজ করতে পারেন।’ আমার ছেলেমেয়েদের প্রত্যেককেই তিনি আপনি করে বলতেন।
স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় একটা বাসা বরাদ্দ পাওয়ার জন্যে আবু হেনা ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। উপাচার্য আবুল ফজল একদিন আমাকে। ডেকে বললেন, ‘পাহাড়ের ওপরে একটা বাড়ি খালি হয়েছে। তুমি যদি সেটায় যেতে সম্মত হও, তাহলে তোমার বাসাটা আবু হেনাকে দিতে পারি। পাহাড়ের ওপরে উপাচার্যের বাসভবন-সংলগ্ন একটি দোতলা বাড়িতে রেজিস্ট্রার থাকতেন, অদূরে আরো দুটি বাড়ি ছিল অধ্যাপকদের জন্যে। একটিতে থাকতেন। ইতিহাসের আবদুল করিম। সব শেষেরটিতে প্রথমে সৈয়দ আলী আহসান, তারপরে মোহাম্মদ শামসুল হক। বাড়িটি চমৎকার। তবে গাড়ি ছাড়া সেখানে যাতায়াত করা মুশকিল। মেয়েদের পায়ে হেঁটেই স্কুলে যেতে হবে। সামান্য কিছুর প্রয়োজন হলে হয় নিজেকে গাড়ি নিয়ে ছুটতে হবে, নইলে কাউকে পায়দল ছোটাতে হবে।
দুশ্চিন্তার আরো একটি কারণ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়িসংক্রান্ত নিয়মাবলি প্রণয়নের জন্যে উপাচার্য একটি কমিটি তৈরি করেছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীকে সভাপতি করে। সেই কমিটির সুপারিশে বলা হয়, তিন মাসের বেশি সময়ের জন্যে কেউ ক্যাম্পাসের বাইরে চলে গেলে তাকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে (অবশ্য পরের বছরে মোহাম্মদ আলীর যখন বিদেশে যাওয়ার সময় হয়, তখন এই মেয়াদ বাড়িয়ে এক বছর করা হয়েছিল, কিন্তু সে পরের কথা)। কিছুকাল পরে সপরিবারে বিলেত যাবো বলে আশা করছি। এখন একবার বাড়ি বদলাবো, তারপর তখন আবার বাঁধাছাদা করে বাড়ি ছাড়া–চাপটা বেবীর ওপরে অতিরিক্ত হয়ে যাবে। তবু, আমি বাড়ি বদলালে আবু হেনা বাড়ি পাবেন এবং পরিবার নিয়ে আসতে পারবেন, একথা ভেবে বেবী সম্মতি দিলো। সমতলে যে-বাড়িতে ছিলাম, তার একটি স্মৃতি অবিস্মরণীয়। সেখানে এক দুর্ঘটনায় গরম পানিতে আনন্দের পিঠ পুড়ে গিয়েছিল এবং জখমটা হয়েছিল মারাত্মক। চিকিৎসকদের ক্লান্তিহীন প্রয়াসে সে ভালো হয়ে ওঠে। সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শ্রেণির মানুষের যে-সহমর্মিতার পরিচয় পাই, তা ভোলবার নয়। আবাসিক এলাকার মসজিদে আমার যাতায়াত ছিল না, অথচ আমার সন্তানের আরোগ্যকামনায় সেখানে বিশেষ মোনাজাত হয়েছিল–তাতে আমি খুবই অভিভূত হয়েছিলাম।
পাহাড়ের বাড়িতে গিয়ে আমি একটা গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখতে পেরেছিলাম অনেকদিন পরে। চর্যাগীতির সমাজচিত্র’ নামে এই লেখাটি আমাদের বিভাগীয় সমিতির এক সেমিনারে পড়েছিলাম অধ্যাপক আবদুল করিমের সভাপতিত্বে। সেটি প্রকাশিত হয়েছিল আমাদের বিভাগীয় গবেষণাপত্র পাণ্ডুলিপিতে, পরে তা আমার স্বরূপের সন্ধানে (ঢাকা, ১৯৭৬) বইতে স্থান পায়।
এ-সময়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষকমণ্ডলীর শক্তি বেশ বৃদ্ধি পেলো। মোহাম্মদ আবদুল কাইউম লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি করে ফিরে এলেন। আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ ফিরলেন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে–অল্পকাল পরে তার এম এ ডিগ্রিলাভের খবর এলো। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষকদের হিসেব নিলে আমাদের স্থানটা বেশ গৌরবজনক হবে।
এর মধ্যে মাহমুদ শাহ কোরেশীকে অধ্যক্ষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা বিভাগ খোলা হয়েছে। প্রথমে তার শিক্ষকসংখ্যা দুই-ফরাসিতে কোরেশী, রুশ ভাষায় প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের ড. শফিক হায়দার চৌধুরী–উভয়েই খণ্ডকাল শিক্ষক। কেবল খণ্ডকাল-শিক্ষক নিয়ে বিভাগ প্রতিষ্ঠার আর দৃষ্টান্ত আছে কি না, আমার জানা নেই। নিজের বিবেচনায় উপাচার্য যা করেছেন, তাতে আমাদের কী বলার থাকতে পারে! পরে বাংলা বিভাগে কর্মরত পালির শিক্ষক রণধীর বড়ুয়া এবং সংস্কৃতের শিক্ষক ভুবনমোহন অধিকারীকে ওই বিভাগে বদলি করা হয়। আমি একবার কোনো কাজে ঢাকায় এসেছিলাম, ফিরে গিয়ে শুনি, নির্বাহী আদেশে এই দুই সহকর্মীকে বদলি করা হয়েছে। তা হোক, কিন্তু উপাচার্য যে সৌজন্যের খাতিরেও তাঁদের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে এ-বিষয়ে আমার কোনো মতামত চাইলেন না, তাতে আমি একটু ক্ষুব্ধ না হয়ে পারলাম না। মনে হয় এই স্বাভাবিক নিয়ম পালন না করার পরামর্শ উপাচার্যকে কেউ দিয়েছিলেন।
অথচ অধ্যাপক আবুল ফজলের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ভালো। সামাজিক-সাংস্কৃতিক বহু কাজে একযোগে শরিক আমরা। রশিদ চৌধুরী যখন উদ্যাগ নিলেন চট্টগ্রামে একটা আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্যে, তখন স্থানীয় বিশিষ্টজনদের জড়ো করা হয় সাহিত্য-নিকেতনে। সেখানে আমিও ছিলাম। চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্যে যে-কমিটি হয়, তাতে আমারও নাম থাকে। তাছাড়া, আরো কতরকম সভা-সমিতিতে আবুল ফজলের সহচর ছিলাম আমি। তিনি সবসময়েই আমাকে হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করেছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সম্পর্ক মোটের উপর আনুষ্ঠানিক পর্যায়েই রয়ে গিয়েছিল। সেই আনুষ্ঠানিকতারও হানি যে কখনো কখনো হয়েছে, তার দৃষ্টান্ত দিয়েছি। তবে আমার বিশ্বাস, তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কখনো ক্ষুণ্ণ হয়নি। আমি বরাবরই তাঁর স্নেহলাভ করেছি।
৩৫.
শিক্ষা-কমিশনের কাজ শেষ হয়ে এলো। ১৯৭৩ সালের জুন মাসে কমিশন। একটি অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করে এবং চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্যে সময় চেয়ে নেয়। এখন সেই চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার সময় এসে গেল।
ত্রিশ বছর পেছনের দিকে তাকিয়ে আমি এখনো মনে করি, এই কমিশন একটি ভালো রিপোর্ট দিতে পেরেছিল। এর কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়তো বাহুল্য হবে না। আমরা জোর দিয়েছিলাম সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার ওপরে এবং প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ থেকে বাড়িয়ে আট বছর পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেইসঙ্গে এই যুগান্তকারী সুপারিশ করা হয়েছিল যে, আট বছরের এই প্রাথমিক শিক্ষায় সর্বক্ষেত্রে–স্কুলে ও মাদ্রাসায়–অভিন্ন পাঠ্যসূচি অনুসরণ করা হবে। এ-বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষকদের সম্মত করতে বেগ পেতে হয়েছিল, কিন্তু কুদরাত-এ-খুদা তা করতে সমর্থ হয়েছিলেন তাঁর অসীম ধৈর্য ও প্রবল প্রত্যয়ের কারণে। মাদ্রাসায়–এবং সেইসঙ্গে (সংস্কৃত) টোল ও পালি টোলে–এই অভিন্ন পাঠ্যসূচি এক ও অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি হতে পারত। মাদ্রাসা-বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এর বিনিময়ে একটা ছাড় আদায় করে নিয়েছিলেন, তা হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মশিক্ষার বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা। আদিতে আমরা নীতিশিক্ষার সুযোগ রেখেছিলাম। ধর্মশিক্ষার পণ্ডিতেরা যখন ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে চান, তখন আমি আপত্তি করি। আমার সঙ্গে আরো কেউ কেউ মতৈক্য পোষণ করেছিলেন। কুদরাত-এ-খুদা যদিও আমাদের বুঝিয়েছিলেন, ধর্মশিক্ষার বিকল্পে নীতিশিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে, তবু আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, বিকল্প থাকলে নীতি আর পড়ানো হবে না, ধর্মশিক্ষাই দেওয়া হবে এবং অনেক জায়গায় ইসলাম ছাড়া। অন্য ধর্মশিক্ষার সুযোগ থাকবে না, অমুসলমান ছাত্রকেও ইসলাম ধর্মশিক্ষা নিতে হবে। তারপরও কুদরাত-এ-খুদা বলেছিলেন, মাদ্রাসায় যদি বাংলা মাধ্যম ও অভিন্ন পাঠ্যসূচি অবলম্বন করা হয়, তাহলে যে-লাভ হবে, সেই তুলনায় ধর্মশিক্ষার প্রবর্তন হবে অল্প ছাড়।
প্রাথমিক স্তরের পরে বৃত্তিমূলক শিক্ষা হিসেবে ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। মাদ্রাসার ছাত্রেরা ইচ্ছে করলে এটাও নিতে পারবে এবং উচ্চতর স্তরে ধর্ম বা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব শিক্ষালাভের সুযোগ তাদের থাকবে। আরো কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল যাতে মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষার ভেদ কমিয়ে আনা যায়। মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে যারা জড়িত, এই সুপারিশ তাঁরা যে মেনেছিলেন, তাতে কমিশনের সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সিরাজুল হকের ইতিবাচক ভূমিকা ছিল।
বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপরে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল কমিশনের রিপোর্টে। দেশে শিল্পের বিকাশ কত দ্রুত ও ব্যাপক হতে পারবে, তার কোনো ইঙ্গিত ছিল না। ফলে কৃষিভিত্তিক বৃত্তিশিক্ষার কথা ভাবা হয়েছিল। শিক্ষক-শিক্ষণকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্যারামেডিক তৈরির একটা পরিকল্পনাও ছিল। এছাড়া, এমন সব বৃত্তিশিক্ষার প্রস্তাব ছিল যা লাভ করলে স্বনিয়োজিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকত। শিক্ষাখাতে জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ নিয়োগ করার পরামর্শ ছিল এবং পরে তা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রদের বেতন বাড়াবার প্রস্তাব ছিল।
রিপোর্টের হতাশাব্যঞ্জক দিক ছিল নারীশিক্ষার বিষয়ে ভাবনায়। তখনো আমরা মেয়েদের উপযোগী শিক্ষার কথা ভেবেছি, দৈনন্দিন সাংসারিক জীবনে কোন শিক্ষা তাদের কাজে আসবে, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছি।
সংবিধানে যে অভিন্ন পদ্ধতির শিক্ষার কথা বলা হয়েছিল, তা পুরোপুরি অর্জনের সম্ভাবনা এই রিপোর্টে দেখা যায়নি। তবে এই রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়িত করার পরে অল্পকালের মধ্যে শিক্ষা-পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করার সুপারিশ করা হয়েছিল। নিজেদের সুপারিশকে আমরা অজর, অমর, অক্ষয় বলে দেখিনি।
৩৬.
১৯৭৪ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর কাছে আমরা শিক্ষা কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করতে গেলাম। সভাকক্ষে এসে আসনগ্রহণের পরে তিনি আমার দিকে। তাকিয়ে বললেন, সভার পরে আমি যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করে যাই।
সভার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো। তখন দেশের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে যে-অর্থের প্রয়োজন হবে, তার সংস্থান কীভাবে হবে, তার মনে সে-চিন্তাও দেখা দিয়েছে। আমি যখন তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, তখন সেখানে শিক্ষামন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমরা নাকি এমন রিপোর্ট লিখেছ যা ইমপ্লিমেন্ট করতে আমার পুরো বাজেট চলে যাবে। আমি জানতে চাইলাম, আপনি কি ইন্টারিম রিপোর্ট পড়েছেন? তিনি বললেন, ‘রিপোর্ট পড়ার সময় কই আমার! সেক্রেটারিরা আমাকে যা বলেছে, আমি তার ভিত্তিতে বলছি।’ আমি বললাম, আপনার কি মনে পড়ে, কমিশন উদবোধন করার সময়ে আমি অর্থ-সংস্থানের বিষয় জিজ্ঞেস করেছিলাম। আপনি বলেছিলেন, টাকা-পয়সার বিষয়ে আমরা যেন চিন্তা না করি। তবু আমরা চিন্তা করেছি। আপনাকে একটা উদাহরণ দিই। সব স্কুলে ভালো লাইব্রেরি থাকা উচিত। তবু বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে আমরা বলেছি, ইউনিয়ন-পর্যায়ে একটা ভালো লাইব্রেরি থাকবে। সেখান থেকে স্কুলগুলো বই লেনদেন করবে। আদর্শ অবস্থার কথা ভাবলে আমরা অন্যরকম বলতাম।
তিনি একটু ভাবলেন। আমি সেই অবকাশে জানতে চাইলাম, তিনি কেমন আছেন। কিছুকাল আগে তিনি মস্কোতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর দেশে প্রত্যাবর্তনের পরে আমার সঙ্গে এই প্রথম দেখা। আমার প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, তিনি খুব ভালো নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে মস্কো থেকে চলে এলেন কেন? তিনি বললেন, আমি এমন একজন প্রধানমন্ত্রী যাকে ভাইস চান্সেলর ঘেরাও হলে তাঁকে উদ্ধার করতে যেতে হয়। মস্কোতে থাকতে খবর পেলাম, সূর্য সেন হলে সাতজন ছাত্র খুন হয়েছে। তখন চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখে চলে এলাম। বললাম, আপনি বিশ্রাম নিন না কেন? এখানে না পারেন, সপ্তাহান্তে ঢাকার বাইরে কোথাও চলে যান। তিনি বললেন, দেশে কোথাও গিয়ে বিশ্রাম হবে না। যেখানে যাবো, সেখানেই লোকজন ভিড় করবে। বললাম, ‘লোকজনকে দেখা দেবেন না। এবার তার চোখে পানি এসে গেল। বললেন, ‘লোককে খেতে দিতে পারি না, পরতে দিতে পারি না, দেখাও যদি না দিতে পারি, তাহলে আমার আর থাকলে কী?’ আমি এবারে অপ্রস্তুত হলাম।
এবারে তিনি কাজের কথা পাড়লেন। কবীর চৌধুরী শিক্ষা-সচিবের দায়িত্ব ছাড়তে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা, একজন শিক্ষাবিদকে এই পদে নিয়োগ দেবেন। তাঁর অন্যতম দায়িত্ব হবে শিক্ষা-কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া। রিপোর্টের বিষয়টা আমার ভালো জানা আছে। তিনি আমাকে শিক্ষা-সচিবের দায়িত্ব দিতে চান এবং অবিলম্বে।
শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। আমি আঁতকে উঠলাম। বললাম, প্রশাসনিক কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।
বঙ্গবন্ধু বললেন, বুঝেছি, তুমি সি এস পিদের অসহযোগিতার ভয় করছ! তুমি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসতে পারবে–আমি সে-ব্যবস্থা করে দেবো।
আমি প্রমাদ গনলাম। বললাম, আমি মাস্টারি করে এসেছি, তা-ই করতে চাই। সচিব হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। ও-কাজ পারবো না।’
বঙ্গবন্ধু একটু চুপ করে থাকলেন। বললেন, আমার চারপাশে চোর-ডাকাত ভিড় করে আছে। আস্থা রাখতে পারি এমন সৎ লোক চাই কাজের জন্য। তাই তোমাকে বলছি। চোরদের থেকে রেহাই পেতে চাই।’
আমি একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। বললাম, ‘লোকে তো তাই বলে, আপনার চারপাশে অনেক অসৎ লোক, আপনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না।
এবারে তিনি রাগ করলেন। বললেন, ‘কে বলে আমি ব্যবস্থা নেই না? কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের এক বিশিষ্ট মহিলা-কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাঁর নাম করে বললেন, ‘ওকে আমি এক্সপেল করিনি? কত কাল ধরে সে আওয়ামী লীগ করে এসেছে। তাকে যেদিন এক্সপেল করি, সে রাতে আমি ঠিকমতো ঘুমোতে পারিনি। ওর চেহারা, ওর মা-বাপের চেহারা, ওর ভাইবোনের চেহারা বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।
এরকম কোনো সময়ে শিক্ষামন্ত্রী উঠে পড়লেন। তিনি লন্ডন যাচ্ছেন–তাঁকে বিমানবন্দরে যেতে হবে। পরে শুনেছিলাম, লন্ডনে আমাদের দূতাবাসের কাউকে কাউকে তিনি বলেছিলেন, আমি শিক্ষা-সচিব হতে যাচ্ছি।
আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, ‘লন্ডনে গবেষণার জন্যে আমি বৃত্তি পেয়েছি। আমাকে এই কাজটি করতে দিন। ফিরে এসে আমি সরকারি কাজে যথাসাধ্য সাহায্য করবো।’
বঙ্গবন্ধু তবু বললেন, তখুনি ‘না’ না বলে ভাববার সময় নিতে। তাঁর প্রেস সেক্রেটারি তোয়াব খানকে বলে দিলেন, পরদিন এই সময়ে আমি আবার তার সঙ্গে দেখা করতে আসবো–সে যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে রাখে।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বেরিয়ে আমি সোজা এলাম অর্থমন্ত্রীর তাজউদ্দীন আহমদের দপ্তরে। সেখানে অর্থসচিব মতিউল ইসলাম ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে আমি তাজউদ্দীনকে আদ্যোপান্ত জানালাম। অনুরোধ করলাম, তিনি। যেন বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়ে আমাকে উদ্ধার করেন।
তাজউদ্দীন বললেন, তিনি সেদিনই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। কথাচ্ছলে বঙ্গবন্ধু যদি বিষয়টা উল্লেখ করেন, তাহলে তিনি হয়তো তাঁকে নিরস্ত করতে পারবেন। তবে কথা না তুললে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তিনি কিছু বলবেন না। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কথা তোলার সম্ভাবনাই বেশি।
সত্যি তা-ই হয়েছিল। তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, আমাকে শিক্ষা সচিব করলে একজন ভালো শিক্ষক হারিয়ে মন্দ প্রশাসক পাওয়া যাবে–তাতে লাভ কী?
পরদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি জানতে চাইলেন, আমি মত পালটেছি কি না। আমি হাসলাম। বললাম, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুযোগটা ছাড়তে চাই না। আপনি যদি অনুমতি দেন।
তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে। তবে কথা দিয়ে যাও, ফিরে এসে চট্টগ্রামে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে যাবে। তখন আমি যা বলব, তা কিন্তু শুনতে হবে।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। যা কখনো করিনি, এরপর আমি তাই করলাম। বঙ্গবন্ধুর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম।
তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘বিদেশ থেকে ফিরেই দেখা করবে আমার সঙ্গে। তারপর অস্ফুটস্বরে বললেন, ততদিনে আমাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখবে কি না, কে জানে!
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কিন্তু তিনি গলা এত নামিয়ে প্রায় স্বগতোক্তির মতো কথাটা বলেছিলেন। তাই আর কিছু বলতে চাইলাম না। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
সেই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।
৩৭.
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এলেন। ১৯৭৪ সালের ২৭ জুনে। এর আগে ভুট্টো ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৭১ সালের মার্চে–সে-বছরের পূর্বাপর তার যে-ভূমিকা তা বিস্মরণযোগ্য ছিল না। ভুট্টোর আগমন–অন্তত আমার মনে–সে-তিক্ত স্মৃতিই জাগিয়ে তুলেছিল।
আমি অবশ্য ঢাকায় ছিলাম না, ছিলাম চট্টগ্রামে। খবরের কাগজে পড়েছিলাম, বিমানবন্দর থেকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পর্যন্ত রাস্তার দু ধারে ভিড় করে মানুষ তাঁকে সংবর্ধনা জানিয়েছে। লোকমুখেও শুনেছিলাম, বাংলাদেশের নাগরিকেরা তাঁর ও তাঁর দেশের নামে জয়ধ্বনি দিয়েছে, তার উদ্দেশে পুষ্পবৃষ্টি করেছে। অবাক হয়েছিলাম, জানতে চেয়েছিলাম, কারা এই উল্লসিত জনসমষ্টি?
বঙ্গবন্ধু অবশ্য বক্তৃতায় বলেছিলেন ভুট্টোকে–ধ্বংসস্তূপের ওপরে দাঁড়িয়ে তিনি অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন অতিথিকে। বলেছিলেন, প্রতিশোধের বা প্রতিহিংসার মনোভাব থেকে তিনি একাত্তরের ঘটনার স্মৃতিচারণ করছেন না, কিন্তু সে দিনগুলো ভুলে যাওয়া যায় না। বাংলাদেশের লক্ষ্য যে পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলা–সেকথা তিনি বলেছিলেন। আর বলেছিলেন, নিষ্পত্তির উপায় হলো দু-দেশের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো মীমাংসা করে ফেলা।
যতদূর মনে পড়ে, ১৯৭১এর ঘটনাবলির জন্যে ভুট্টো অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু যারা তার কথা শুনেছিলেন, তাঁদের মনে হয়েছিল, এবং ঠাণ্ডা ছাপানো বিবরণ পড়ে আমাদেরও মনে হয়েছিল, সে-অনুশোচনা আন্তরিক নয়, আনুষ্ঠানিক ছিল মাত্র। ভুট্টো বরঞ্চ বলছিলেন, সেই মর্মান্তিক ঘটনার ইতি হোক এখানেই। আর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের জের ধরে বলেছিলেন, তিনি চান উভয় দেশের মধ্যে শর্তহীনভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলতে।
শর্তহীনতার কথা থেকে ভুট্টো আর নড়েননি। বক্তৃতায় বা সরকারি আলোচনায় কিংবা সাংবাদিক সম্মেলনে যতবার ১৯৭১ সালের নৃশংসতার কথা উঠেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা উঠেছে, পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনার কথা উঠেছে, আটকে-পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা উঠেছে, ভুট্টো ততবারই সেসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন, বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। তবে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন যে, পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে যা তাঁর কর্তব্য ছিল, একাত্তরে তিনি তা-ই করেছিলেন।
জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে ভুট্টো চরম অসৌজন্য প্রদর্শন করেছিলেন। রংচঙে পোশাকে ও বেমানান ক্যাপে সজ্জিত হয়ে তিনি গিয়েছিলেন সেখানে। চাঁদ সদাগর যেমন বা হাতে ফুল দিয়ে মনসাকে পুজো করেছিলেন, প্রায় তেমনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে পুষ্পস্তবক দিয়েছিলেন স্মৃতিসৌধে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার আগেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন ফিরে আসার জন্যে–বোধহয় আমাদের চিফ অব প্রোটোকলই শিষ্টাচার বিসর্জন দিয়ে হাতে ধরে ঘুরিয়ে বিদেশী অতিথিকে আবার নিজের জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরও তিনি ওই স্থান ত্যাগ করার জন্য খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অভ্যাগতদের মন্তব্যের খাতায় তিনি কিছু লিখতে অস্বীকার করেছিলেন, বাংলাদেশ বেতারের প্রতিনিধির কাছেও কোনো মন্তব্য করতে স্বীকৃত হননি।
তবে ভুট্টো যখন স্মৃতিসৌধে যান, তখন তাঁর বিরুদ্ধে কিছুসংখ্যক লোক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল। তাঁর সমালোচনা করে একটা প্রচারপত্রও বিলি করা হয় এ-সময়ে।
দু-পক্ষের আলোচনা সম্পর্কে যে-সরকারি বিবরণ বেরিয়েছিল, তাতে উভয়পক্ষের কোনো মতৈক্যের উল্লেখ ছিল না। তবে পত্রিকার ভাষ্যমতে, আলোচনা ব্যর্থ হয়েছিল। এই সফরকালে ভুট্টোর আচরণ আমার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েছিল।
৩৮.
দেশের অবস্থা বেশি ভালো লাগছে না। এদিকে-ওদিকে খাদ্যাভাব দেখা দিচ্ছে। তার মধ্যে জাতীয় সংসদে পাশ হয়ে গেল বিশেষ ক্ষমতা আইন। ইংরেজিতে যাকে বলে ড্রেকোনিয়ান ল–এই আইনটি ঠিক তেমন। অথচ জাসদ-দলীয় ও স্বতন্ত্র সদস্যেরা মিলিয়ে মোট পাঁচজন মাত্র তার প্রতিবাদ করলেন। এই আইনে আমাদের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হলো–অথচ সে-সম্পর্কে সরকারদলীয় কোনো সদস্য মুখ খুললেন না। আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধরের কথায় মনে হলো, এই আইন পাশ করে তিনি বড় ধরনের কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
ওদিকে বিদেশ সফরের ওপরে সরকার বাধানিষেধ আরোপ করেছে। এখন বিদেশযাত্রার জন্যে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাড়পত্র ছাড়াও সরকারের অনুমতি সংগ্রহ করতে হবে। অধ্যাপকদের ক্ষেত্রে অনুমতি দেবেন প্রধানমন্ত্রী। ফাইলটা তাঁর চোখে পড়লে অনুমতি পাবো, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু বিষয়টা তাঁর নজরে আনছে কে? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিঠি এসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে, নথিভুক্ত হয়ে সেসব কাগজ গেছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। মন্ত্রণালয় থেকে জানলাম, ফাইল পড়ে আছে সেখানে। একদিন গেলাম সেখানে। যেতেই তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কেন গেছি সেখানে, জানতে চাইল তোফায়েল। আশ্বাস দিলো, সে দেখবে বিষয়টা।
দেশ ছাড়ার আগে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার। সেপ্টেম্বরের একেবারে গোড়ায় গেলাম তার কাছে। তিনি তখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন মাসকালব্যাপী বিদেশ সফরের। অনেকক্ষণ কথা হলো। বললেন, তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, অক্টোবরে দেশে ফিরে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করবেন।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বললেন এই কারণে যে, পদত্যাগের কথা আগেও তিনি ভেবেছিলেন। মনে আছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্পকালের মধ্যেই তিনি হতাশা ব্যক্ত করতে শুরু করেছিলেন। প্রশাসনের বিষয়ে কিছু হতাশা ছিল, তবে রাজনৈতিক কারণেই তার হতাশা ছিল বেশি। সেই ৭২ সালেই-তখনো বাজেট দেওয়ার সময় আসেনি–তাঁর বাসভবনের অফিসঘরে বসে এক সন্ধ্যায় কথা বলছিলাম। টেবিলের ওপরে রাখা একটা ফাইলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, এটা তার জন্যে এক উভয়সংকট। বিদেশ থেকে সার আমদানি করতে হবে। নানা কারণে তাঁর মতে, অকারণেই–উদ্যোগ নিতে দেরি হয়ে গেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। এখন প্রস্তাব এসেছে, আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান না করেই, গত বছর যারা সার সরবরাহ করেছিল, সেই প্রতিষ্ঠানকেই কার্যাদেশ দেওয়া হোক। তিনি বললেন, ‘প্রস্তাবে সম্মত হওয়া মানে আমার পক্ষে নিয়মভঙ্গ করা, সম্ভবত দুর্নীতিতে সাহায্য করা; আর টেন্ডার আহ্বান করতে বলা মানে সময়মতো সার-সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়া। যেটাই করি, সেটাই অসংগত হবে। এইভাবে দেশ চালানো যায় না।
তবে রাজনৈতিক হতাশা ছিল প্রগাঢ়। তার একটা দুঃখ ছিল এই যে, মুক্তিযুদ্ধের ন মাসের কথা বঙ্গবন্ধু কখনো তার কাছে জানতে চাননি। দলের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ যে চলছিল, সে-কথা তাজউদ্দীন প্রথম থেকেই জানতেন। তাঁর মনে হয়েছিল, একদিকে খন্দকার মোশতাক আহমাদ, অন্যদিকে শেখ ফজলুল হক মনি তাঁর বিপক্ষে কাজ করছেন, বঙ্গবন্ধুকেও নানা কথা বলছেন তাঁরা। আমি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা না করলে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তিনি কিছু বলবেন না। আমি জানতে চাইলাম, এই অবস্থা যদি চলতে থাকে, তবে পরিণামে কী হবে? তিনি একটু উদাস কণ্ঠে বললেন, ‘জানি না।’ তাঁর সুরে কিন্তু ঔদাসীন্য ছিল না, অভিমান ছিল।
১৯৭৩ সালের গোড়ার দিকে এক সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে গিয়েছিলাম। বারান্দায় দেখা হলো আরহাম আহমদ সিদ্দিকীর সঙ্গে–তাজউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠতা। তাঁর সঙ্গে কুশলবিনিময়ের পরে আমি ভেতরে ঢুকলাম। তাজউদ্দীন প্রথমেই বললেন, মন্ত্রিসভা ও দল থেকে তিনি পদত্যাগ করবেন বলে ভাবছেন। আমি জানতে চাইলাম, তারপর তিনি কী করবেন? তিনি বললেন, দেখা যাক। জিজ্ঞেস করলাম, রাজনীতি ছেড়ে দেবেন?’ খানিকটা ম্লান হাসি হেসে বললেন, তা পারব না। প্রশ্ন করলাম, তিনি কি অন্য দলে যোগ দেবেন? জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ তিনি পেয়েছেন বলে কানাঘুষো ছিল–সেকথা স্বীকার করলেন তিনি, কিন্তু তাতে যে যাবেন না, তাও স্পষ্ট বললেন। বললাম, তাহলে তো তার বিকল্প নতুন দল গড়া–তিনি কি তা ভাবছেন? তাজউদ্দীন একটু চুপ করে রইলেন, কিন্তু মনে হলো সেটাই তাঁর অভিপ্রায়। জানতে চাইলাম, তিনি যদি আওয়ামী লীগ ছাড়েন, তাহলে দলের কতজন তাঁর অনুবর্তী হবেন? তিনি একটা আনুমানিক সংখ্যা বললেন। বললাম, তাজউদ্দীন ভাই, আজ আপনি অর্থমন্ত্রী। অনেকে নানা কাজে আসেন আপনার কাছে–নানাভাবে আপনাকে সমর্থন করে যান। যেদিন আপনি আর ক্ষমতায় থাকবেন না, সেদিন এদের অধিকাংশকে আপনার ধারেকাছে পাবেন না। আমি জানি, আপনার অকৃত্রিম বন্ধু ও অনুরাগী আছেন অনেকে-তারা আপনার পাশে থাকবেন। যতজন সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ ছাড়বেন বলে আপনি ভাবছেন, তার দশ ভাগের এক ভাগ হয়তো পাবেন আপনার সঙ্গে। এটা আমার অনুমান–প্রকৃত অবস্থা আমার চেয়ে আপনি ভালো বুঝবেন। যদি মনে করেন, দল ছাড়লে দেশের লাভ হবে, আপনার রাজনৈতিক জীবনের উপকার হবে, তবে তা করুন। নইলে দলের ভেতরে থেকে রাজনৈতিক লড়াই করুন। তিনি চুপ করে থাকলেন। আমার কথা তার মনঃপূত না হলেও তিনি ফেলে দেননি।
তার বাড়িতে নানা সময়ে নানাজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতো। একবার ওপরের বারান্দায় ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখলাম, গাজী গোলাম মোস্তফা বসে আছেন। গাজী শাহাবুদ্দীনের কাকা হিসেবে ১৯৪৯ সাল থেকে তিনি আমারও মানিক কাকা। তিনি তখন রেডক্রসের চেয়ারম্যান–দেশজুড়ে তাঁর নিন্দাবাদ। আমি তাঁর মধ্যে ক্ষমতার দর্প দেখিনি, দুর্নীতির কথা বলতে পারব না। তাজউদ্দীনের সঙ্গে তিনি খুবই সৌজন্যপরায়ণ ছিলেন। আরেক সন্ধ্যায় দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপেক্ষাকৃত এক তরুণ শিক্ষক বেরিয়ে আসছেন তাজউদ্দীন আহমদের ড্রয়িংরুম থেকে। ভেতরে ঢুকে তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চাইলাম, ওই ব্যক্তি তার বাড়িতে কেন? তিনি একটু বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, ‘ও তো আমাদের অনেক পুরোনো কর্মী–আপনি চেনেন না ওকে? বললাম, ‘চিনি বলেই তো জিজ্ঞেস করছি। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে সম্প্রতি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে যারা গোলযোগ করেছিল–এ তাদের মধ্যে একজন।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের যোগদানে বাধা দিতে তাকে পিস্তল। দেখিয়েছিল। তাজউদ্দীন আরো বিস্মিত, তাঁর চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছায়া। বললেন, এ হতে পারে না, আপনি ভুল শুনেছেন। বললাম, আপনিই না বলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর নিকটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতে চান না, বিশ্বাস করেন না। আপনিও তো তাই করছেন। তিনি চুপ করে গেলেন, বেদনার্তচিত্তে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় একা এলে আমি উঠতাম কাকরাইলে আমার বড়বোনের বাড়িতে। অনেক সময়ে নিরিবিলিতে কথা বলার জন্যে সন্ধ্যার পরে তাজউদ্দীন সেখানে চলে আসতেন। আমার সৌভাগ্য, আমার প্রতি তিনি আস্থা রাখতেন। তাঁর সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতার কারণে আমি তরুণ প্রজন্মের অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলাম না।
আগের কথায় ফিরে যাই। আড়াই বছরের মন্ত্রিত্বের বেশির ভাগ সময় তাজউদ্দীনের কেটেছিল দ্বিধাদ্বন্দ্বে, সংশয়ের দোলায়, অনুকূল পরিবেশের অভাবে। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে গৃহীত সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর মনে হয়েছিল, আমরা গণতন্ত্র চর্চা করছি না, সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হতে পারছি না। এখন, ৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে এসে, তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন–অনেক হয়েছে, আর নয়। এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে তাকে নিরুৎসাহিত করার মতো কোনো কথা আমি আর এবারে বলিনি। আমি তাঁকে জানালাম, সেপ্টেম্বরের শেষে সপরিবারে আমি লন্ডন রওনা হচ্ছি। তিনি বললেন, অক্টোবরে তিনি লন্ডন হয়ে ফিরবেন–তখন যেন সেখানে দেখা করি।
তাজউদ্দীনের সফরসূচিতে এবারে অনেকগুলি দেশ ভ্রমণের কথা ছিল। প্রথমে তিনি যাবেন বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নে, তারপর কানাডায়, সর্বশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই প্রথম তিনি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করতে তাঁদের দরবারে যাচ্ছেন। বৈদেশিক সাহায্য–বিশেষ করে মার্কিন সাহায্য–গ্রহণ করার বিষয়ে তাজউদ্দীনের অনীহার কথা সর্বজনবিদিত ছিল। বিশ্বব্যাংকের প্রতিও তার মনোভাব অনুকূল ছিল না এবং তার প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারাকে মার্কিন প্রশাসনের একটা বড় খুঁটি জ্ঞান করে তিনি বেশ অপছন্দ করতেন। বাংলাদেশে ম্যাকনামারা যখন প্রথম বেসরকারি সফরে আসেন, বোধহয় ১৯৭২ সালে, তখন তার সঙ্গে তিনি সৌজন্যপ্রকাশেও কুণ্ঠিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে যে-আলোচনা হয়েছিল ঢাকায়, শুনেছি, সেখানেও তাজউদ্দীনের অনাগ্রহ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে, সমাজতন্ত্রের প্রতি তাজউদ্দীনের পক্ষপাতের কথা জেনেও ম্যাকনামারা নাকি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য সম্পর্কে শ্লেষাত্মক মন্তব্য করতে ছাড়েননি। এখন সমাজতান্ত্রিক দেশ সফরশেষে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে তাকে বাধ্য হয়ে বিশ্বব্যাংকের আনুকূল্য চাইতে হবে। এই সম্ভাবনা যে তিনি খুব উপভোগ করছিলেন, তা নয়; কিন্তু দেশের পরিস্থিতি–বিশেষ করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি–যেদিকে যাচ্ছে তাতে তার সামনে বিকল্প পথও খোলা ছিল না।
তাজউদ্দীনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন আমার বারেবারে ১৯৭১-এর দিনগুলি মনে পড়ছিল।
৩৯.
যেহেতু যুক্তরাজ্যে এক বছর মেয়াদি ভিসার জন্যে আবেদন করবে, তার একটি আবশ্যকীয় শর্ত ছিল ব্রিটিশ হাই কমিশন-মননানীত প্যানেলের একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে সন্তোষজনক মেডিক্যাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা। আমার স্ত্রীপুত্রকন্যার জন্যেও একই শর্ত প্রযোজ্য। প্যানেলের প্রথম নাম ছিল ড. ব্যাসেটের–তিনি জাতে ইংরেজ, বহুকাল ঢাকায় আছেন। তাঁর কাছেই গেলাম। তিনি আমার ভ্রমণের উদ্দেশ্য জিজ্ঞাসা করায় বললাম, গবেষণা। তিনি খানিকটা উত্তেজনার সঙ্গে বললেন, কিসের গবেষণা! ব্রিটিশ করদাতাদের অর্থে, আমার পয়সায়, তুমি বিলেত যাবে গবেষণা করতে! আমি থতমত খেয়ে বললাম, ব্যাপারটা ওরকমই। তিনি বললেন, আর তোমার পরিবার? বললাম, তারা আমার সঙ্গে থাকবে সেখানে। তিনি বললেন, আমি তোমাকে পরীক্ষা করবো, তোমার পরিবারের সদস্যদের করবো না। আমার মুখে কথা জোগালো না। তিনি একটা ছাপা কাগজে কয়েকটা ঘরে দাগ দিয়ে বললেন, এই পরীক্ষাগুলো করিয়ে নিয়ে এসো, তারপর তোমার শারীরিক পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেবো। তাঁর সহকারীকে ডাক্তারের ফি বাবদ এক শ টাকা দিয়ে বললাম, আমি আর এখানে ফিরে আসছি। পরে ওই প্যানেলভুক্ত একজন স্বদেশি চিকিৎসকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ভিসা সংগ্রহ করি।
ড. ব্যাসেট কেন অমন অপমানজনক আচরণ করেছিলেন, তা রহস্যাবৃত রয়ে গেল। এক বছর পর দেশে ফিরে শুনেছিলাম, একদল ইংরেজ নার্স তাঁর বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের নালিশ করেছিল ব্রিটিশ হাই কমিশনে। তারই জের ধরে ড. ব্যাসেটকে ঢাকায় তাঁর প্র্যাকটিস গুটিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হয়।
এর পরের অধ্যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাড়ি ছেড়ে দেওয়া–অর্ধেক মালপত্র আমার ভাগ্নি সেলির নাসিরাবাদের বাসায় রেখে দেওয়া; অর্ধেক রেলযোগে ঢাকায় এনে শ্বশুরবাড়িতে ফেলা। সোয়াসের গ্রন্থাগারের জন্যে ঢাকায় বই কেনা এবং শিপিং ট্রাংক কিনে তাতে বোঝাই করা। সবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়া এবং চূড়ান্ত গোছগাছ করা।
এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপকের সেই পূরণ-না-হওয়া পদটি বিজ্ঞাপিত হয়েছে। মোহাম্মদ আবু জাফর বিভাগের আরো কয়েকজন তরুণ শিক্ষককে নিয়ে স্বামীবাগে আমার শ্বশুরবাড়িতে–যেখানে আমি থাকছিলাম, সেখানে–এসে হাজির। তাদের ইচ্ছা, আমি যেন এবারে পদপ্রার্থী হই। আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, কাগজে বিবৃতি দিয়ে আমি সকলকে আশ্বস্ত করেছি যে, ‘অদূরভবিষ্যতে এ রকম নিয়োগগ্রহণের কোনো পরিকল্পনা আমার নেই।’ এরপর দু বছরও হয়নি–ভবিষ্যৎ এখনো দূরস্থিত হয়নি।
আমাকে অবাক করে দিয়ে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানও এক সন্ধ্যায় সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। বললেন, ‘পদটি আপনার জন্যে সৃষ্ট হয়েছিল–আপনারই প্রাপ্য। এখন আপনি আবেদন করবেন কি না? সবিনয়ে বললাম, না।’ তিনি বললেন, ‘আপনি আবেদন করলে আমি করবো না, তবে আপনি যদি আবেদন না করেন, তাহলে আমি করবো।’ রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পে ফটিক চক্রবর্তী যেমন কলকাতা যাওয়ার আগে তার ছিপ ঘুড়ি লাটাই সমস্তই ছোটোভাই মাখনকে পুত্রপৌত্রাদিক্রমে ভোগদখল করার সম্পূর্ণ অধিকার দিয়েছিল, আমিও তেমনি লন্ডন যাওয়ার প্রাক্কালে অনুজপ্রতিম মনিরুজ্জামানকে পুত্রপৌত্রাদিক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপকপদে আবেদন করার সম্পূর্ণ অধিকার দিয়ে দিলাম।
২৪ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজযোগে স্ত্রীপুত্র ও দুই কন্যা নিয়ে রওনা হলাম। চার সপ্তাহ আগে আনন্দের বয়স দু বছর পূর্ণ হওয়ায় তার জন্যেও একটা আধমূল্যের টিকিট কাটা হয়েছে। ফলে আমরা পাঁচটি আসন দখল করতে পেরেছি। তখনো ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ প্রচুর খাওয়াতো–ছেলেমেয়েরা কেউই অতটা খেতে পারেনি। বিমানবালারা যখন খাবারের ট্রে সরিয়ে নিয়ে যায়, রুচি তখন জানতে চেয়েছিল, উদ্বৃত্ত খাবার তারা কী করবে। বেবী যখন বললো, ফেলে দেবে, তখন সে ছলছল চোখে বলেছিল, ‘কত লোকে খেতে পায় না–তাদের দেয় না কেন?’
রুচির বয়স তখন দশ। দেশে অন্নাভাবের বিষয়টা সে যে লোকালয় থেকে অত দূরে বাস করেও টের পেয়েছিল, তা আগে জানতে পারিনি।
ওই একই ফ্লাইটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগের ড. মুনিবুর রহমান চৌধুরী একই বৃত্তি নিয়ে সপরিবারে বিলেত যান। আমরা যেদিন রওনা হই, তার ঠিক এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। আর আমাদের যাত্রার পরদিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দেন। বাংলায়। সেই প্রথম অমন আন্তর্জাতিক সভামঞ্চে বাংলা ভাষা উচ্চারিত হয়েছিল।
অস্তাচলের পানে
১.
১৯৭৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে লন্ডনে পৌঁছোনো গেল। হিথরো বিমানবন্দরে আমাদের নিতে এলো আমার ভাগ্নে মামুন এবং, বেবীর সম্পর্কে নানা কিন্তু বয়সে ছোটো, হায়দার। ওরা অনেক শীতবস্ত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। তার সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল বেবীর।
লন্ডনের দক্ষিণ-পশ্চিমে কলিয়ার্স উড অঞ্চলে মামুন আমাদের জন্যে বাড়ি ভাড়া করে রেখেছিল। ২০ ক্লাইভ রোডের বাড়িতে দোতলায় আড়াইটে শোবার ঘর, টয়লেট ও বাথরুম। নিচে বসার ঘর, খাবার ঘর ও রান্নাঘর। পেছনে একটু খালি জমি। হিটিংয়ের ব্যবস্থাটা একটু বৈচিত্র্যপূর্ণ : কোনো ঘরে ইলেকট্রিক হিটার, কোনো ঘরে প্যারাফিন দিয়ে হিটার চালাতে হয়, কোথাও গরম পানি দিয়ে স্বয়ংচালিত তাপবিকিরণের ব্যবস্থা। টেলিফোন সংযোগ আছে, গ্যাস বিদ্যুৎ রয়েছে। বাড়ির মালিক চট্টগ্রামের এক ভদ্রলোক। স্বামী-স্ত্রী মিলে ‘মেঘনা’ নামে একটা গ্রোসারি চালান বালহামে। ভাড়া কম নিয়েছেন। বলেছেন, দেশের লোক বলে এবং একমাত্র ভাড়াটে বলে আমার কাছ থেকে সপ্তাহে তিন পাউন্ড কম নেবেন, কিন্তু কেউ জানতে চাইলে আমাকে বলতে হবে পুরো ভাড়ার পরিমাণ। বলা যায়, মিথ্যে কথা বলার মজুরি বাবদ সপ্তাহে তিন পাউন্ড পেতাম।
আমরা যখন প্রবেশ করলাম, বাড়িটা তখনো অগোছালো। মালিক এবং মামুন মিলে যতটা পারেন, করেছেন তবে আরো অনেক পরিষ্কার করা প্রয়োজন। সে-কাজ আপাতত মুলতুবি রাখতে হবে। কেননা, পরদিনই মামুন আমাদের সবাইকে নিয়ে গাড়ি করে ওয়েসে বেড়াতে যাবে। গ্ল্যামোরগান অঞ্চলে মার্থার টিডফিল বলে একটা জায়গায় আশরাফ ও নাদিরা নামে এক চিকিৎসক-দম্পতি বাস করেন। আমাদের ভাগ্নে-বউ মীরা। সেখানে এর মধ্যে পৌঁছে গেছে। তার অবকাশের দিনগুলো মামুন সেখানে কাটাবে–সঙ্গে করে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। ব্যবস্থাটা যে আমাদের মনঃপূত হয়েছিল তা নয়, তবে মামুনের সঙ্গে ভালোবাসাটা উভয়পক্ষে এত প্রগাঢ় যে আমরা আর না বলতে পারিনি।
সকালে উঠে দেখা গেল, বেবীর জ্বর। জ্বরগায়েই সে যাত্রা শুরু করলো। পথের দুধারে দেবালয় দেখা হলো না তার এবং পথের প্রান্তে পৌঁছেও সুস্থ হতে একটু সময় লাগলো। মার্থার টিডফিল মনোরম জায়গা-ধারেকাছে কয়লাখনি আছে, কিন্তু পরিবেশে দূষণ নেই। গৃহকর্তা-গৃহকত্রী প্রচুর সমাদর করলেন, মামুনও আমাদের দিকে নজর রাখলো এবং এদিক-ওদিক বেড়াতে নিয়ে গেল। দিন তিনেক পরে লন্ডন-প্রত্যাবর্তন।
ফিরে এসে এবারে ঘরবাড়ি গোছানো, কিছু কাপড়চোপড় হাঁড়িবাসন কেনা, আমার একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা এবং জেনারেল ফিজিশিয়ানের কাছে রেজিস্ট্রিভুক্ত হওয়া। আমরা সবাই পাড়ার সাহেব-ডাক্তারের খাতায় নাম লেখালাম, বেবী চাইলো বাঙালি ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে। সে একটু দূরে গিয়ে মামুনের এক পরিচিত চিকিৎসকের কাছে রেজিস্ট্রি করলো। সাহেব ডাক্তার একটু গোলেই পড়েছিলেন তার ফলে। বললেন, তুমি এবং তোমার তিন সন্তানের নাম দেখা যাচ্ছে আমার তালিকায়–ওদের মা কোথায়?
অ্যাসোসিয়েশন অফ কমনওয়েথ ইউনিভার্সিটিজের পক্ষ থেকে আমাদের স্প্রেংগার মনোজ্ঞ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আরো কেউ কেউ কিছু বলেছিলেন–কিন্তু তা বোধহয় আমার মনে দাগ কাটেনি। বক্তৃতার আগে ছিল পানপর্ব, পরে ভোজনপর্ব। পানপর্বের সময়ে ঘুরতে ঘুরতে রেবেকা জেমসের সঙ্গে দেখা হলো–আমাকে দেখে তিনি প্রীতি প্রকাশ করলেন। একটু পরে দেখি, ক্যাথি কারো সঙ্গে কথা বলছে। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে একটু অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে আমাকে সম্বোধন করলো এবং তারপর কেবল আমার সঙ্গেই কথা বলতে থাকলো। ফলে তার সঙ্গী ভদ্রলোক সরে গেলেন। সেই সন্ধ্যায় এবং তার পরে একাধিক দিন ক্যাথি আমাকে বলেছিল যে, তার কাছে তখন আমাকে মনে হয়েছিল ঈশ্বরপ্রেরিত তারণকর্তা। ভদ্রলোকের অখণ্ড ও অতিরিক্ত মনোযোগ সে কিছুতেই এড়াতে পারছিল না, যদিও তার সঙ্গে তার আলাপ হয় মাত্র ওই সন্ধ্যায়ই। কাজেই আমি কাছে যেতেই আমাকে আঁকড়ে ধরে সে পরিত্রাণের পথ খুঁজলো। এই ঘটনা নিয়ে আমরা অনেক হাসাহাসি করেছি।
আমাদের যাতায়াত ও বৃত্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে থাকার ব্যবস্থা ছিল ব্রিটিশ কাউনসিলের নিয়ন্ত্রণে। আমাদের আচরণীয় ও অনাচরণীয় কী, তা বোঝাতে একটা অধিবেশন হলো। কমনওয়েলথ ও ব্রিটিশ কাউনসিলের অন্যান্য বৃত্তি নিয়ে যারা গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ–প্রথমবার বিদেশের মাটিতে পা দিয়েছেন। অ্যাকাডেমিক স্টাফ ফেলোশিপ পাওয়া আমরা কজন শুধু একটু অভিজ্ঞ। সুতরাং অনেক সামান্য কথা শুনতে হলো এবং অনেকরকম ফরম হাতে পাওয়া গেল–তার মধ্যে ঘরবাড়ির উদ্দেশ, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুপারিশ সংবলিত কাগজ–এসবও ছিল। সভার শেষে আমি যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে একটা কাগজে আমার ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণ লিখে দিয়েছিলাম, ভদ্রমহিলা বিস্মিত ও পুলকিত হয়ে বললেন, ‘আহ্, সবাই যদি তোমার মতো স্বনির্ভর হতো!’
একটা বড়ো কাজ বাকি রইলো–রুচি-শুচিকে স্কুলে ভর্তি করা। শুচি এই প্রথম স্কুলে যাবে। তার ব্যবস্থা সহজেই হয়ে গেল। বয়সের হিসেবে রুচিকে যেতে হবে মিডল স্কুলে। আমাদের বাড়ির কাছেই আছে আলফিয়া মিডল স্কুল–কিন্তু সেখানে ওর ক্লাসে সিট খালি নেই। কদিন ঘোরাঘুরির পরে বরা অফ মর্ডেনের শিক্ষা-কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা জানালাম। তারা একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত তরুণী বললো, আলফিয়ায় তারা চেষ্টা করছে, সেখানে ভর্তি করা না গেলে রুচিকে যেতে হবে একটু দূরের স্কুলে। তবে শিক্ষা কর্তৃপক্ষের বাস আছে–তাতে করে সে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে পারবে। তবু রুচির এবং আমাদের কিছুটা অসুবিধে হবে। তা স্বীকার করতে আমরা প্রস্তুত কি না? আমি বললাম, তাই সই। মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম। কদিন পরে সে ফোন করে জানালো, সুসংবাদ আছে, আলফিয়ায় তোমার মেয়ের ভর্তির ব্যবস্থা করা গেছে–কালকের মধ্যেই সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে হবে। পরদিন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আমি তখনই স্কুলে ছুটলাম।
স্কুল থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে, আমরা যেন বাড়িতে ওদের সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা না বলে সর্বদা ইংরেজি বলি। বুঝতে পারি, তাতে ওদের ইংরেজি শেখার সুবিধে হবে। রুচিকে আবার দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্কুলে ফরাসি নিতে হয়েছে। ফলে নানা ভাষার চাপ বা দ্বন্দ্ব যত কম হয় তত মঙ্গল। কিন্তু বাড়িতে বাংলা না-বলার কথা আমরা ভাবতে পারলাম না। ঠিক করলাম, ওদের সঙ্গে একযোগে বাংলা-ইংরেজি বলব। যদি ইংরেজি বাক্য ব্যবহার করি, সঙ্গে সঙ্গে তার বাংলাটা বলব; আর যদি বাংলায় কিছু বলি, তবে তার ইংরেজি অনুবাদও করে দেবো একসঙ্গে। ব্যবস্থাটা বোধহয় মন্দ হয়নি। মাঝে পড়ে আনন্দ, দেখি, টেলিভিশন থেকে, আশপাশ থেকে, বোনদের কাছ থেকে ইংরেজি শিখে নিচ্ছে। একবার বোধহয় কেউ একটা দুষ্কর্ম করেছিল। কে করেছিল, অনুসন্ধান করায় আনন্দকে বলতে শুনলাম, শি ডিড ইট–আই ডিডন্ট ডু ইট। আনন্দের বয়স তখন আড়াই হয়েছে কী হয়নি।
শি মানে শুচি। সে স্কুলে পৌঁছে মায়ের হাত ছেড়ে ক্লাস-টিচার মিসেস বোরেটের হাত ধরতো। দিনের শেষে আবার তার হাত ছেড়ে মায়ের হাত। ভদ্রমহিলা ধৈর্য ধরে শুচির আবদার মেনে চলতেন। শুচি স্কুলে ছবি আঁকতে ভালোবাসততা এবং ভালো ছবি আঁকতো। ওর শিক্ষয়িত্রী তাতে খুব প্রীত ছিলেন।
দেশের মতো বিদেশেও সংসারের সব দায়িত্ব ছিল বেবীর। সকালবেলায় আমাদের নাশতা খাইয়ে ছেলেমেয়েদের তৈরি করে কখনো তিনজনকে নিয়ে, কখনো মেয়ে দুজনকে নিয়ে আলাদা আলাদা স্কুলে পৌঁছোনো। বিকেলে আবার আনন্দকে প্র্যামে ঠেলে নিয়ে মেয়েদের স্কুল থেকে আনা। মাঝে বাজার-সওদা করা, রান্নাবান্না সারা, কাপড়চোপড় ধোওয়া, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা। তবে তাতে তার আনন্দের ঘাটতি হতো না।
২.
ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্রিটেনে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে পরে, ব্রিটেনের মধ্যেও ইংল্যান্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ঘটে কিছুটা দেরিতে। অকসফোর্ড বারো শতকে আর কেমব্রিজ তেরো শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই তুলনায় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় একেবারেই শিশু–এর সূচনা ১৮২৮ সালে, তবে রাজকীয় সনদ পেতে আরো সাত বছর লেগে যায়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কিন্তু লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করেছিল একাধিক বিষয়ে। প্রথমত, এর দ্বার উন্মুক্ত হয় সকল সম্প্রদায়ের ছাত্র-ছাত্রীর জন্যে; দ্বিতীয়ত, পাঠ্যবিষয় থেকে এখানে ধর্মতত্ত্ব বাদ পড়ে। তাছাড়া গির্জার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এর পরিচালনায় অংশগ্রহণের অধিকার থেকেও বঞ্চিত হন। এসব সিদ্ধান্ত এমনই আলোড়নের সৃষ্টি করে যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়-প্রতিষ্ঠায় অনেক বাধা দেওয়া হয়েছিল। তাতে সফল না হওয়ায় এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিহিত করা হয় ‘গাওয়ার স্ট্রিটের নিরীশ্বর প্রতিষ্ঠান’ বলে, আর সমকালীন এক ব্যঙ্গ-কবিতায় লেখা হয় :
Birbeck, and Brougham, and Gregory,
And other Wicked People,
Had laid a Plan to undermine
The Church, if not the Steeple!
The London University!
O what a shocking notion;
To think of teaching anything
But Church and State devotion!
অন্যপক্ষে, পাঠ্যবিষয় হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম প্রবর্তিত হয় ইংরেজি সাহিত্য এবং আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ছাড়াও নানান আধুনিক ভারতীয় ভাষা। পরে এশিয়া ও আফ্রিকার ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি–এসব অধ্যয়নের জন্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড অ্যাফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) পত্তন হয়। আমি এই সোয়াসেই যুক্ত থাকতে যাচ্ছি।
প্রথম দিনে ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড সিলোন বিভাগের প্রধান প্রফেসর রাইট আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন এবং সংস্কৃতের অধ্যাপকরূপে সম্প্রতি প্রদত্ত তাঁর উদ্ববাধনী বক্তৃতার একটি কপি উপহার দিলেন। সোয়াসে যা যা করার দরকার–সিনিয়র কমনরুম ব্যবহারের সুযোগ, লাইব্রেরি কার্ডের ব্যবস্থা–এসব করে দিলেন এবং আমাকে যে একটা ঘর বরাদ্দ করতে পারছেন, তার জন্যে দুঃখপ্রকাশ করলেন। নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরু-উপলক্ষে সেদিন সন্ধ্যায় শিক্ষকদের একটা পার্টি ছিল। রাইট তাতে আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন। তাঁর কথামতো আমি তাঁর সঙ্গেই পার্টিতে গেলাম এবং তিনি নিজেই অন্তত বিশ-পঁচিশ জন শিক্ষকের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই পার্টিতেই হিন্দির শিক্ষক ড. পাণ্ডের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল–আমি যখন শিকাগোতে ছিলাম, তখন তিনি সেখানে হিন্দির লেকচারার ছিলেন। উর্দু ও পাঞ্জাবির শিক্ষক ড. রাসেলের সঙ্গে সেখানে পরিচয় হয়–ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতার দক্ষ অনুবাদক হিসেবে তিনি সুনাম অর্জন করেছিলেন। অর্থনীতির রিডার ড. কে এন [কীর্তিনারায়ণ] চৌধুরীকেও সেখানে। পেলাম–তিনি নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মধ্যম পুত্র। যেহেতু রাইট আমাকে বলে কয়ে পার্টিতে নিয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গে করে, আমি লক্ষ রাখছিলাম, উনি কখন পার্টি ছেড়ে যান। উনি বেরোবার উপক্রম করতে আমিও তার সঙ্গে যোগ দিলাম। মনে হয়, এতে তিনি খুশি হয়েছিলেন। রাইট মানুষ ভালো, তবে তাঁর মধ্যে আনুষ্ঠানিকতার একটা ব্যাপার ছিল। আনিস বলা দূরে থাক, তিনি আমাকে আনিসুজ্জামান বলেও ডাকতেন না, সব সময়ে প্রফেসর আনিসুজ্জামান। বলে সম্বোধন করতেন। আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে কি না সে-বিষয়ে জানতে চাইতেন, কিন্তু আমার কাজের অগ্রগতি সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করতেন না। ফলে তাঁর সঙ্গে আন্তরিক কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি।
সকালে প্রফেসর রাইটের কক্ষ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের ঘরে। আগের বার যখন তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তিনি অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর স্ত্রীর জন্যে কালো জমিনের একটা জামদানি শাড়ি নিয়ে যেতে। আমার শ্যালিকা নাজু তার পরিচিত কারিগর দিয়ে তা বানিয়ে দিয়েছিল। সেটা সমর্পণ করা গেল তাঁর হাতে। স্থির হলো, দুপুরে সিনিয়র কমনরুমে একসঙ্গে যাবো, সন্ধ্যার পার্টিতেও আবার মিলিত হবো। তিনি সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন লাইব্রেরিয়ান বি সি ব্লুমফিল্ডের কাছে। ব্লুমফিল্ড সদাশয় ব্যক্তি। মুখে প্রায় সর্বদা হাসি লেগে আছে এবং সে-হাসি প্রায়ই কৌতুকের। সোয়াসের লাইব্রেরির জন্যে আমি বই নিয়ে গেছি বলে তিনি অনেক ধন্যবাদ জানালেন। ড. বোলটন সে-বছরটায় ছুটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও প্রধানত ওড়িশায় এসেছিলেন গবেষণা ও দেখাসাক্ষাতের কাজে–তাই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হলো না।
তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের অফিসকক্ষের অদূরে রাজেশ্বরী দত্তের অফিসঘর। তিনি সোয়াসে সংগীতের প্রভাষক। শিকাগো ছাড়ার পর তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি, কিন্তু তিনি চিনতে পারলেন ঠিকই। পরে জেনেছিলাম, প্রফেসর রাইটের কাছ থেকে তিনি শুনেছিলেন যে, আমি সোয়াসে আসছি। সোয়াসে আমার অফিসঘর থাকবে না জেনে তিনি বললেন, ‘বোলটন তো এ-বছরটা থাকবে না। ওর ঘরটা তোমায় দেয় না কেন?’ বললাম, ‘শুনেছি, বিষয়টা বিবেচনা করা হয়েছিল, কিন্তু তাঁর অসুবিধে সৃষ্টি না করার সিদ্ধান্ত হয়। রাজেশ্বরী যুক্তিটা মানতে চাইলেন না। সন্ধ্যার পার্টিতে তাঁর সঙ্গেও সাক্ষাৎ হলো।
সোয়াসে প্রথম দিনটা আমার বেশ ভালো কাটলো।
৩.
আমার গবেষণার উপকরণ সোয়াসের লাইব্রেরিতে তেমন ছিল না। তবে অন্যান্য বিষয়ে পড়ালেখার জন্যে এ-গ্রন্থাগার আমার বেশ কাজে এসেছিল। আমি কাজ করেছিলাম ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে এবং প্রধানত ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। আগেরবার যেখানে কাজ করেছিলাম, ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরি তখনো সেখানেই অর্থাৎ মিউজিয়ম-ভবনেই ছিল। কিন্তু আগের জায়গা থেকে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি উঠে এসেছিল ব্ল্যাকফ্রায়ার্স রোডে–ওল্ড ভিক ও ইয়ং ভিক থিয়েটারের কাছে। ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে প্রথমে যে-কার্ড করেছিলাম ১৯৬৫ সালে, তার সূত্র ওঁরা খুঁজে বের করলেন এবং সেটারই নবায়ন হলো। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে অবশ্য নতুন করে কার্ড করতে হলো।
প্রথম দু-একদিনে এসব কাজ সারলাম। তারপর গেলাম বুশ হাউজে-বিবিসি বাংলা বিভাগে। জন ক্ল্যাপহাম সেখানে অধিকর্তা–একদা পাদরি ছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে অনেককাল বাস করেছেন। তার পরে আসেন কমল বোস। সৈয়দ শামসুল হক বলতেন, বুশ হাউসের ভিত্তির কাজ করার সময়ে রাজমিস্ত্রি দেখলো একটা লম্বা ছায়া পড়েছে ইটের ওপর–ফিরে তাকিয়ে সে যাকে দেখতে পেলো, তিনিই কমল বোস। তার পরে আছেন সিরাজুর রহমান–আমাদের সিরাজ ভাই–আমার অনেকদিনের পরিচিত। তারপর শ্যামল লোধ, নূরুল ইসলাম, দীপংকর ঘোষ, সৈয়দ শামসুল হক। চাকুরে না। হয়েও প্রোগ্রাম করতে আসেন অনেকে-নাজির আহমদ, নূরুস সাফা, নরেশ ব্যানার্জি, ঝর্ণা গোরলে, শফিক রেহমান, তালেয়া রেহমান, ওয়ালী আশরাফ, মানসী বড়ুয়া, আরো কেউ কেউ। সিরাজ ভাই আমাকেও সেই দলে ভিড়িয়ে দিলেন।
৪.
মাসাধিককাল বিদেশ সফরশেষে দেশে ফেরার পথে তাজউদ্দীন আহমদ লন্ডনে এলেন অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। খবর পেয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম হোটেলে। অনেক লোকজন ছিলেন সেখানে। আমরা তার শয়নকক্ষে গিয়ে বসলাম, কিন্তু সেখানেও কেউ কেউ ঢুকে পড়লেন। তাজউদ্দীন কথা বললেন। একটু ছাড়া-ছাড়াভাবে, যেন কিছুটা অন্যমনস্ক। বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বব্যাংকের কাছে তিনি খাদ্যসাহায্য চেয়েছেন, বন্যা-নিয়ন্ত্রণে ও অধিকতর সার-উৎপাদনে অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্যে তাদের সহযোগিতা কামনা করেছেন। এই মুহূর্তে খাদ্যপরিস্থিতি নিয়ে তিনি বেশি চিন্তিত। সরকারি লঙ্গরখানা খোলা হয়ে থাকলেও মানুষ অনাহারে মরছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো নয়। তবে তাঁর সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা এই নিয়ে যে, স্বনির্ভর হওয়ার পথে আমরা এগোতে পারছি না। রাজনৈতিক সহনশীলতারও বড়ো অভাব। মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত। ওয়াশিংটন থেকে দেশে ফিরেই তিনি ইস্তফা দেবেন।
তাজউদ্দীনের কাছ থেকে ফিরলাম একটু বিচলিত হয়েই। কিন্তু তাকে নিয়ে আরো বিষণ্ণতা আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। তিনি যে মন্ত্রিত্ব ছাড়বেন, সেকথা বোধহয় বেশি লোককে বলে ফেলেছিলেন। ফলে দেশে ফেরার কয়েকদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে লিখিত নির্দেশ পেলেন পদত্যাগ। করবার। অক্টোবরের শেষেই তিনি পদত্যাগপত্র পেশ করলেন, কেবল স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্বত্যাগের সম্মানটুকু থেকে বঞ্চিত হলেন। আমরা যারা ঘটনাধারার সঙ্গে পরিচিত, তারা জানি, তাজউদ্দীন যথার্থই ইস্তফা দিয়েছিলেন। কিন্তু পাথুরে প্রমাণ রয়ে গেল যে, তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এমনকী, কী ভাষায় তিনি পদত্যাগপত্র লিখবেন, তাও স্থির করার সুযোগ পাননি। এই অসম্মান তার প্রাপ্য ছিল না।
লন্ডনের ওই সাক্ষাঙ্কারই ছিল তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা।
৫.
লন্ডনে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সৈয়দ আবদুস সুলতান আমার পূর্বপরিচিত–রাজনীতি ও ওকালতির পাশাপাশি তিনি সাহিত্যচর্চা করেন, আমার আব্বার সঙ্গে তাঁর আলাপ ছিল কলকাতা থেকে, তার এক মেয়ে ও এক ছেলের আমি সরাসরি শিক্ষক। ছেলেটি তার সঙ্গেই তখন লন্ডনে ছিল, ওয়েস্ট এন্ডের একটি সিনেমায় আশারের–দর্শকদের আসন দেখিয়ে দেওয়ার–কাজ নিয়েছিল। তাতে তার বাবার খুব আপত্তি–হাই কমিশনারের ছেলে হবে থিয়েটারের আশার! ফিরোজ বলে, আপনারা না শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে রচনা লিখতে শিখিয়েছেন! নিজের যোগ্যতায় যে কাজ পাই, তাই করে খাবো। বাবার ঘাড়ে বসে খাওয়ার চেয়ে তো ভালো। হাই কমিশনার একদিন বেবীকে ও আমাকে তার বাসভবনে দাওয়াত করে খাইয়েছিলেন–সেদিন অবশ্য ফিরোজ ছিল না। তিনি থাকতেন পাটনিতে, বেশ বড়ো একটা বাড়িতে। তা নিয়ে লন্ডনের বাঙালিরা সমালোচনা করতো এই বলে যে, আমাদের মতো দরিদ্র দেশের হাই কমিশনারের পক্ষে অমন বাড়িতে থাকা বিলাসিতা। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
ডেপুটি হাই কমিশনার ছিলেন ফারুক চৌধুরী–বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে আমার এক ক্লাস ওপরে পড়তেন। আগের মতোই হাশিখুশি দিলখোলা আছেন। আমার সহপাঠী নূরুল মোমেন খান ওরফে মিহির ছিল কাউনসেলর। সেকেন্ড সেক্রেটারি এ কে এম আবদুর রউফের কথা আগেই বলেছি–তার সৌজন্যে মাঝেমাঝে শুল্কমুক্ত পানীয় ও সিগারেট সংগ্রহ করা যেতো। সব মিলিয়ে লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনের পরিবেশ আমার জন্যে বেশ অনুকূল ছিল।
অক্টোবর বা নভেম্বরে হাই কমিশনের মাধ্যমে কামাল হোসেনের চিঠি পেলাম–ইউনেসকো সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে প্যারিসে যাওয়ার জন্যে আমি যেন প্রস্তুতি নিই।
ব্যাপারটা এরকম। ইউনেসকোর সাধারণ পরিষদে প্রথমবারের জন্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল যাবে। নেতৃত্ব দেবেন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী। দেশের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনা করে সদস্যসংখ্যা কম রাখা হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন প্রস্তাব করলেন, প্রতিনিধিদলে আমাকে সদস্য রাখা হোক–আমি লন্ডনে আছি, সেখান থেকে আমাকে প্যারিসে পাঠাতে সরকারের খরচা কম পড়বে। আসলে ব্যয়সংকোচটা বড়ো কথা নয়, আমাকে দলে অন্তর্ভুক্ত করার অজুহাত মাত্র, তবে সিদ্ধান্তগ্রহণকারীদের কাছে তা গ্রাহ্য হয়েছিল।
আমার পক্ষে তখন যুক্তরাজ্যের বাইরে যেতে হলে আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বৃত্তিদাতাদের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন, কেননা বৃত্তির একটা শর্ত ছিল এই যে, বৃত্তিভোগকালে ওই গবেষণার কাজ ছাড়া আমি অন্য কিছু করবো না। এখন একটা দরখাস্ত করলাম–আমাকে কয়েকদিনের ছুটি দেওয়া হোক বিনাবৃত্তিতে, আমি ইউনেসকোর সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেবো, ফিরে এসে আবার গবেষণার কাজ ধরবো। দরখাস্ত নিয়ে প্রথমে গেলাম প্রফেসর রাইটের কাছে। এমন আবদারের জন্যে তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না–কী করবেন, কী লিখবেন, কিছুই ভেবে পাচ্ছিলেন না। শেষে অ্যাসোসিয়েশন অফ কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিজের অফিসে রেবেকা জেমসকে ফোন করে জানালেন তার বিপত্তির কথা। তারপর আমাকে বললেন, আবেদনপত্রটা আমি ফরোয়ার্ড করে দিই ওদের কাছে, কেমন? অর্থাৎ সুপারিশ করার কাজটা এড়িয়ে গেলেন। আমি তখন আবেদনপত্র নিয়ে গেলাম মিসেস জেমসের কাছে। তিনি মৃদু হেসে বললেন, মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে তুমি একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ-নইলে সরকার তোমাকে ইউনেসকোতে পাঠাতে চাইবে কেন? তবে বৃত্তির যা শর্ত, তাতে তোমাকে ব্রিটেনের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া শক্ত–তাও এমন কাজে যার সঙ্গে তোমার গবেষণার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তুমি যেতে পারলে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুশিই হবো-আর কিছু না হোক, তোমার একটা অভিজ্ঞতা হবে বলে। তাছাড়া, প্যারিস–ও, সেখানে আগে গেছো? তা হোক–ওটা এমন শহর যেখানে বারবার যাওয়া যায়। তোমার আবেদনপত্রটা নিয়ে আমি সেক্রেটারির কাছে যাই–দেখি, কর্তা কী বলেন!
খানিক পর ফিরে এসে বললেন, সেক্রেটারি তো তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দিলেন না। কাগজটা রেখে দিলেন। তুমি আমাকে পরশু সকালে একবার ফোন করবে? কী স্থির হয়, তোমাকে জানাবো। তোমাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেললাম বলে দুঃখিত।
তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে এলাম। যথাসময়ে ফোন করলাম। তিনি বললেন, আজ কি তুমি সারাদিনের মধ্যে একবার আসতে পারো? সেক্রেটারি কথা বলতে চান তোমার সঙ্গে।
ই ই টেম্পল উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করে আমাকে বসতে বললেন, তবে আমার প্রার্থনায় তিনি যে বিরক্ত হয়েছেন, তা আমার অগোচর রইলো না। তিনি বললেন, বৃত্তির শর্ত সম্পর্কে তোমাকে তো আরেকবার বলার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আমরা চাই না, আমাদের বৃত্তিভোগী কেউ রাজনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ুক। আমি একটু চমকে উঠে বললাম, রাজনৈতিক কাজ আবার কোথায়? জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ হলেও না হয় বুঝতাম–আমি তো যেতে চাইছি ইউনেসকোর সাধারণ পরিষদে–সেটা তো শিক্ষাসংস্কৃতিমূলক কাজ। ভদ্রলোক ঈষৎ হাসির ভঙ্গি করলেন। বললেন, জাতিসংঘে এবং তার সকল অঙ্গ সংগঠনেই রাজনীতি আছে–দল আছে, গোষ্ঠী আছে; মত আছে, মতান্তর আছে; তদবির আছে, ভোটাভুটি আছে; প্রতিযোগিতা আছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে; পক্ষ আছে, বিপক্ষ আছে। আমাদের বৃত্তিভোগীরা তার সঙ্গে যুক্ত হবে, সেটা কেউ চাইবে না। তোমার সরকারকে তুমি বুঝিয়ে বোলো, এইখানে তোমার গবেষণার সময়টায় তারা যেন তোমাকে নিশ্চিন্ত থাকতে দেয়। সেটা তোমার পক্ষে ভালো, আমাদের পক্ষেও সুবিধেজনক।
আমি পালাতে পারলে বাঁচি। সেখান থেকে সরাসরি আমাদের হাই কমিশনে এসে কামালকে বার্তা পাঠালাম–আমি যাওয়ার অনুমতি পাচ্ছি না, বিকল্প প্রতিনিধি মনোনীত করুন।
৬.
ব্রিটিশ কাউনসিল থেকে একদিন কাজ সেরে বেরিয়ে আসছি। দেখা হয়ে গেল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ড. রশিদুল হকের সঙ্গে। তিনি আমার আগের বছরে একই বৃত্তি নিয়ে এখানে এসেছিলেন। এখন ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, ফিরে যাওয়ার কথা তিনি ভাবছেন না।
কারণটা বুঝতে আমার বিলম্ব হয়নি। বিষয়টি সংক্ষেপে বললে বোঝা যাবে কি না জানি না, কিন্তু সবিস্তারে বললে হয়তো পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। রশিদুল হক যখন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সপরিবারে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন তাঁর ভগ্নিপতি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা আতাউর রহমান কিছুটা দেরিতে হলেও পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালে বিদেশ থেকে তিনি তাঁর জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেন রশিদুল হকের কাছে। বাড়িতে স্থান সংকুলান হবে না জেনে রশিদুল হক সেগুলো রাখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের কেন্দ্রীয় গুদামে। হঠাৎ ছাত্রলীগের কিছু কর্মীর নেতৃত্বে একদল ছাত্র এক রাতে এইসব জিনিসপত্র নিয়ে এমন হই-হাঙ্গামার সৃষ্টি করে যে, রশিদুল হক বিস্মিত, অপদস্থ ও বিমূঢ় হয়ে যান। এ ঘটনায় তার প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়। তিনি যে চট্টগ্রামে ফিরতে চাননি, আমার বিশ্বাস, সেটিই ছিল তার প্রধান কারণ। কিছুকালের মধ্যে তিনি লিবিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ নিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে সরাসরি চলে যান। তার বহু বছর বাদে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
লন্ডনে রশিদুল হকের সঙ্গে কথা বলে আমি যখন তাঁর মনোভাব আঁচ করতে পারি, তখন গভীর দুঃখ পেয়েছিলাম। তাঁর মতো দেশপ্রেমিক ও কৃতী অধ্যাপক মনের দুঃখেই যে দেশে ফিরতে চাইলেন না, সে-ক্ষতি তাঁর একার নয়।
ক্রিসমাসের অবকাশে লিডসে গেলাম সবাই মিলে। আবদুল মোমেন ও রোজীর বাড়িতে ওঠা গেল। মোমেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করতেন। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তিনি লিডসে এসেছিলেন উচ্চশিক্ষা নিতে। মুক্তিযুদ্ধের কাজে নিজেকে জড়িত করায় তার পড়াশোনার কিছু ব্যাঘাত ঘটেছিল এবং আমরা যখন বিলেতে যাই তখনো তার রেশ কাটেনি। লিডসে আমাদের বন্ধু ওসমান জামাল ও মঞ্জু থাকতেন। জামালও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরা সামান্য কিছু আগে-পরে কাটিরহাট-রামগড়-আগরতলা হয়ে কলকাতায় পৌঁছেই। জামাল একসময়ে লিডসে একটি স্কুলে পড়াতেন। কলকাতা থেকে তিনি সে-কাজে ফিরে যান। পরে মঞ্জু তার সঙ্গে যোগ দেন এবং তারা লিডসেই পাকাপাকিভাবে রয়ে যান। এই দুই পরিবারের বাইরে লিসে গিয়ে দেখা পেলাম কুদুস ও রেশমা, বেণু ও শাহীন এবং ইকবাল ও সাকীর। তাছাড়া আমারই মতো লন্ডন থেকে গেছেন সিভিল সার্ভিসের কামাল সিদ্দিকী–তিনিও তখন সোয়াসে পিএইচ ডি ডিগ্রির জন্যে গবেষণা করছেন। তার বোন পড়ে লিডসে–তার কাছেই গেছেন তিনি। বাঙালি আড্ডার জন্যে ও-ই যথেষ্ট সমাগম। বাঙালি আড্ডায় যেমন হয়, রাজনীতিই চলে আসে আলোচনার কেন্দ্রে।
সরকারি কর্মকর্তা হলেও কামাল সিদ্দিকীর রাজনৈতিক সত্তা প্রবল। তিনি বাংলাদেশ সরকারের কঠোর সমালোচক–প্রবল বিরোধী বললেই ঠিক বলা হয়। সমাজতন্ত্রে নিবেদিতপ্রাণ মোমেনও সরকারের সমালোচক, তবে কামালের মতো অত তীব্র নন। জামাল প্রকৃতিগতভাবেই মৃদুভাষী ও মৃদুকণ্ঠ–তিনি সর্বদিক দেখতে অভ্যস্ত, এবং শুনতে অধিক আগ্রহী। সরকারের দোষত্রুটি কিছু দেখতে পেলেও আমি মোটামুটি তাকে সমর্থন করছি। এই অবস্থায় কামাল সিদ্দিকীর উত্তেজনা কিছু বাড়ে।
একরাতে এমনি উত্তেজিত আলোচনার মুখে আনন্দ আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে আড্ডারত মহিলাদের খবর দিলো, ও ঘরে ‘গোমলাল’ লেগে গেছে। কামালের বোন হেসেই অস্থির। সে আনন্দকে দেখে বলতো, ‘একেবারে মেজো ভাই’ অর্থাৎ কামাল সিদ্দিকী। আনন্দের চোখদুটো বড়ো, চুলও ছিল লম্বা–কোথাও তাদের সাদৃশ্য থেকে থাকবে।
দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উত্তেজিত হওয়ার–অন্তত ভাবিত হওয়ার–যথেষ্ট কারণ ছিল। প্রথম ছিল দুর্ভিক্ষাবস্থা। এ-নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার অবধি ছিল না। বাংলাদেশে খাদ্যাভাব নিয়ে একটি ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তৈরি তথ্যচিত্র আমরা দেখলাম টেলিভিশনে। লঙ্গরখানার ছবি–আনজুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়িতে লাশ নিয়ে যাচ্ছে–তার ছবি। এক বৃদ্ধা লাঠিতে ভর করে কোনোমতে লঙ্গরখানায় যাচ্ছেন। যে-বাঙালি ছেলেটি দোভাষীর কাজ করছে, সে তাকে জিজ্ঞাসা করলো, তার কী অসুবিধে। বৃদ্ধা বললেন, বাতের কষ্ট। ছেলেটি ইংরেজি করে বললো, ভাতের অভাব। পরিবর্তনটা ইচ্ছাকৃত। আমি বললাম, এটা অসংগত, বিকৃতি। কামাল তাতেই খুশি–টেলিভিশনের শ্রোতারা বেশির ভাগ তো ইংরেজিটাই মানবে।
খাদ্য-পরিস্থিতি ছাড়াও রক্ষীবাহিনী নিয়ে বিতর্ক আছে। তার ওপর রাজনৈতিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে পড়েছিল। ডিসেম্বরের শেষে সারা দেশে জারি হয় জরুরি অবস্থা, মৌলিক অধিকার স্থগিত হয়ে যায়। আমার খালি মনে হয়, মাত্র দু বছর আগে যে-সংবিধান রচিত হলো এত কষ্টে ও এত যত্নে, কী হলো তার হাল!
লিডস থেকে ফিরে আসতে আসতে জরুরি ক্ষমতা আইন ঘোষিত হলো। সেই আইনবলে সভা, সমাবেশ, ধর্মঘট নিষিদ্ধ হয়ে গেল। তার আগে পুলিশের হাতে আটক অবস্থায় সিরাজ শিকদার নিহত হলেন। সংসদে এই ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এমন উক্তি করলেন যা মানবিক নয়!
আমি কখনোই সিরাজ শিকদারের রাজনীতির সমর্থক ছিলাম না। শ্রেণিসংগ্রামের নামে তাঁর দলীয় কর্মীদের হাতে অনেক নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, বহু পরিবার ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু বিনাবিচারে পুলিশের গুলিতে কারো মৃত্যু কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। সংসদে বঙ্গবন্ধু যা বললেন এবং যেভাবে বললেন, তাঁর মতো সংগ্রামী রাজনীতিকের ও দরদি মানুষের তা উপযুক্ত হয়নি। আমার মন খারাপ হয়ে গেল।
৭.
১৯৭৫ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি মন্ত্রিত্ব থেকে ছুটি নিয়ে কামাল হোসেন অক্সফোর্ডে চলে এলেন অল সোলস কলেজের ফেলো হয়ে। সঙ্গে তার পরিবারের সকলে। প্রথম সুযোগেই আমরা সবাই মিলে অক্সফোর্ডে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করে এলাম। তখন জানলাম, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. নূরুল ইসলাম সরকার থেকে পদত্যাগ করে সেন্ট অ্যান্থনিজ কলেজে যোগ দিয়েছেন ফেলো হয়ে।
সেদিন রোববার ছিল। আমি একাই লন্ডন থেকে গেছি অক্সফোর্ডে। কামালের বাড়িতে নূরুল ইসলামকে পেলাম। খানিকক্ষণ পরে এক বাঙালি ছাত্র এসে খবর দিল বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার এবং একটিমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু একইসঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও বাকশালের সভাপতির পদ গ্রহণ করেছেন। শুনে আমি খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়লাম। নূরুল ইসলাম আমাকে বললেন, ‘অত চিন্তার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে কোনো ব্যবস্থাই ঠিকমতো চলে না। দেখবেন, আপনি যেরকম একদলীয় ব্যবস্থার কথা ভেবে দুশ্চিন্তা করছেন, আসলে ব্যাপারটা সেরকম হবে না। কামালের প্রতিক্রিয়া থেকে ধারণা হলো, এমন যে কিছু একটা হতে যাচ্ছে, তা তিনি জানতেন। আমার এখন প্রত্যয় হলো যে, এই ধরনের অবস্থা থেকে নিজেকে বিযুক্ত রাখতেই তিনি লেখাপড়ার জগতে ফিরে এসেছেন।
আমার মনে পড়ল, আমার বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের সহপাঠী, সিভিল সার্ভিসের সদস্য, সদ্য পাকিস্তান-প্রত্যাগত ড. আবদুস সাত্তার একদিন ঢাকায় কামালের বাড়িতে বসে তানজানিয়ার আদর্শে বাংলাদেশে একদলীয় সরকারপদ্ধতি প্রবর্তনের পক্ষে খুব যুক্তি দিচ্ছিলেন। কামাল তাঁকে এসব কথা বলতে নিষেধ করেন এবং এক পর্যায়ে তার বাড়ি থেকে সাত্তারকে চলে যেতে প্রায় বাধ্য করেন। তবে এতে একদলীয় রাষ্ট্রের পক্ষে সাত্তারের অভিযান ব্যাহত হয়নি। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু আমার সামনে একাধিকবার বলেছেন, আমি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র দুইই চাই একসঙ্গে। তবে যদি সমাজতন্ত্রের জন্যে গণতন্ত্র ছাড়তে হয়, তাহলে আমি তা-ই করবো। একবার একজন সংসদ-সদস্য যুগোস্লাভিয়া থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর কাছে সে-দেশের খুব সুখ্যাতি করছিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘টিটোকে তো আর বিরোধী দল কি লালবাহিনী সামলাতে হয় না? তখন বোধহয় লালবাহিনী একদিন ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু। আমাকে বললেন, ‘কোথাও সরকারি দলের অঙ্গসংগঠন সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মঘট ডাকে, এমন শুনেছ?’ (বাকশাল-গঠনের ঠিক আগে জরুরি ক্ষমতা আইনে শ্রমিক লীগের সভাপতি ও লালবাহিনীর প্রধান, সংসদ-সদস্য আবদুল মান্নানকে গ্রেপ্তার করা হয়।) বঙ্গবন্ধুর এসব কথার তাৎপর্য এখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল।
লন্ডনে ফিরে এসে আবদুল গাফফার চৌধুরীকে ফোন করলাম। বাকশালের প্রতিষ্ঠায় তিনি আমারই মতো উদবিগ্ন। পরে অবশ্য তাঁর মত পালটে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি প্রকাশ্যেই বাকশালের সমর্থনে লিখেছেন ও বলেছেন। আমি তখনো ভেবেছি এবং এখনো মনে করি, বাকশাল গঠন করাটা ভুল হয়েছিল।
চতুর্থ সংশোধনীর বিরোধিতা করে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। বাকশালে যোগ না দেওয়ায় পরে সংসদ-সদস্যপদ হারান আবদুল্লাহ সরকার ও মইনুদ্দীন আহমদ মানিক। কিন্তু জনে জনে দলে দলে নানা পেশার নানা বয়সের নানা দলের লোক একাকী কিংবা শোভাযাত্রা করে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। মেজর-জেনারেল জিয়াউর রহমানসহ সশস্ত্র বাহিনীর কাউকে কাউকেও বাকশালে যুক্ত করা হয়েছিল। তখন যারা সোৎসাহে বাকশালে যোগ দেন, বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরে তারা অনেকে তেমনি উৎসাহের সঙ্গে বাকশালের নিন্দা করেছিলেন।
৮.
সোয়াসের লাইব্রেরিতে কাজ করতেন আমার শিক্ষক সৈয়দ আলী আশরাফের শ্যালিকা। তিনি একদিন আমার কাছে জানতে চাইলেন, বাংলাদেশে নাকি আজান দেওয়া বন্ধ এবং মসজিদে গিয়ে নাকি নামাজ পড়া যায় না? অপপ্রচার কতদূর গড়াতে পারে এবং তাতে মানুষ কতটা আস্থা স্থাপন করতে পারে, সে-কথা ভেবে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাকে বললাম, এটা সর্বৈব মিথ্যে প্রচারণা–ওর সত্যতা তাঁদের ভাইজানের–অর্থাৎ সৈয়দ আলী আহসানের কাছ থেকেই তারা জেনে নিতে পারেন। মনে হলো, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আলী আহসান ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে তার ওপরে তাদের আস্থা বিচলিত হয়েছে।
ওদিকে আমার এক ছাত্রী একদিন বাসায় এলো পরামর্শ নিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সে ঢাকা বেতারে খবর পড়তো। তাতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই তার কিছু সমস্যা দেখা দেয় এবং কোনোরকমে একটা পাসপোর্ট সংগ্রহ করে সে শিশুসন্তান নিয়ে বিলেতে চলে আসে। লন্ডনে সে একটি অফিসে কাজ পেয়েছিল, সেসঙ্গে তার প্রচলিত নাম পালটে ভালো নামের একাংশ ব্যবহার করে বিবিসির বাংলা বিভাগে বেতার-অনুষ্ঠান করতো। এখন তার এদেশে থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে, তবে সে দেশে ফিরতে চায় না। বিলেতে থেকে যাওয়ার যে সহজ উপায় তার সামনে খোলা আছে, তা হলো একজন ব্রিটিশ নাগরিককে টাকা পয়সা দিয়ে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে দেখানো-বিয়ে করা। উপার্জনের উপায় হিসেবে অনেক ব্রিটিশ নর-নারী এমন করে থাকে। কিন্তু আমার ছাত্রীর ভয় হলো, এই মিথ্যে বিয়ের পাত্র যদি হঠাৎ করে তার কাছে দাম্পত্য সম্পর্ক দাবি করে, তাহলে কী হবে? আমি এত অল্পদিন হয় ওদেশে গেছি এবং এসব বিষয়ে এত কম জানি যে, তাকে কোনো পথ বাতলাতে পারলাম না। পরে, মনে হয়, তাকে এরকম ঝুঁকির মধ্যে যেতে হয়নি, ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে সে বিলেতে থাকার সময় বাড়াতে পেরেছিল। বিবিসিতেও তার আসা-যাওয়া অনেকদিন অব্যাহত ছিল।
বিবিসিতে আমিও নিয়মিত অনুষ্ঠান করতে লাগলাম। সাম্প্রতিক ঘটনার অনুষ্ঠান প্রবাহ, সংস্কৃতি, শিল্প ও বিজ্ঞান–এসবে। এরমধ্যে প্রবাহের কাজটা ছিল তাৎক্ষণিক অনুবাদের, বাকি সব বাড়িতে বসে তৈরি করা যেতো। প্রবাহের কাজটা হতো দুপুরবেলায়–তা প্রচার হতো সরাসরি।
তখন লাইব্রেরি থেকে বুশ হাউসে চলে যেতে হতো। দুপুরের খাওয়াটা সারা হতো ওই বাড়ির ক্যান্টিনে। বাকি সব অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং হতো বিকেলে বা সন্ধ্যায়। তখন লাইব্রেরির পাঠ শেষ করে এসে কাজটা করা যেতো। সেসঙ্গে বুশ হাউসের নিচের তলায় বিবিসি ক্লাবে তুমুল আড্ডা দেওয়া যেতো। সিরাজুর রহমান ও শ্যামল লোধ খুবই আড্ডাবাজ মানুষ–তাদের উপস্থিতি ছিল প্রত্যহ। মানুষকে কাছে টানার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল সিরাজুর রহমানের, আপ্যায়ন করতেও তিনি ছিলেন অকৃপণ। নূরুল ইসলাম ও দীপঙ্কর ঘোষও প্রায় আসতেন। অনুষ্ঠান থাকলে তো বটেই, অনুষ্ঠান না থাকলেও নাজির আহমদ সেখানে আসতেন আর তাঁর অফুরন্ত ভান্ডার থেকে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কথা বলে আসর জমিয়ে রাখতেন। আমার মতো আর যারা বাইরে থেকে অনুষ্ঠান। করতে আসতেন–শফিক রেহমান, তালেয়া রেহমান, নূরুস সাফা, নরেশ চক্রবর্তী–এই আড্ডায় তাদের যোগদানও ছিল অনিবার্য। আচ্ছাটি খুবই উপভোগ্য হতো, আমার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে সত্যিই অনুকূল। মাঝে মাঝে বিবিসি ক্লাব থেকে শ্যামল লোধের সঙ্গে বেরিয়ে বাসে চেপে আসতাম ওয়াটারলু। স্টেশনে। শ্যামল থাকতেন লন্ডনের একটু বাইরে–ওয়াটারলু থেকে তিনি বাড়ি যাওয়ার ট্রেন ধরতেন, আমিও সেখান থেকে টিউব ধরে বাড়ি ফিরতাম। কোনোদিন উদ্দিষ্ট ট্রেন না ধরতে পারলে কিংবা ট্রেনের দেরি থাকলে স্টেশনেরই কোনো বারে বসে শ্যামল আরেক পাইন্ট বিটার খেয়ে নিতেন। তাঁর ট্রেন না আসা পর্যন্ত আমি তাকে সঙ্গ দিতাম।
প্রবাহের কাজ করতাম বলে বাংলা বিভাগের সাপ্তাহিক রোস্টারে আমার নাম মুদ্রিত হতো। আমার ছাত্র, লন্ডনের সাপ্তাহিক জনমতের সম্পাদক এ টি এম ওয়ালী আশরাফ একদিন খানিকটা ইতস্তত করে বলেই ফেললো যে, রোস্টারে এভাবে নাম থাকাটা আমার অধ্যাপক পদমর্যাদার পক্ষে হানিকর বলে তার মনে হয়–আমি যেন বিষয়টা ভেবে দেখি। ওয়ালী আশরাফ নিজেও বিবিসিতে অনুষ্ঠান করতো। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়াটা আমার পক্ষে অসম্মানজনক বলে তার মনে হয় কি না। সে বললো, অনুষ্ঠান করতে কোনো বাধা নেই, কিন্তু আর দশজনের সঙ্গে বার ও সময় উল্লেখ করে কর্তব্যতালিকায় যেভাবে আমার নাম দেওয়া হয়, তাতে আমাকে বিবিসির চাকুরে বলে মনে হয়। আমি বললাম, কাজটা যদি অসম্মানজনক হয়, তাহলে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিয়মকানুন বা আনুষ্ঠানিকতা মানতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ওয়ালী আমার যুক্তি যে মানলো তা নয়, তবে চুপ করে গেল। তার কথাও আমি স্বীকার করিনি, কিন্তু আমার সুনাম ও সম্মানরক্ষায় তার এই উদ্বেগ আমার মন স্পর্শ করেছিল। তার অনুরোধে কিছুদিন আমি জনমতে লিখতে আরম্ভ করেছিলাম, তবে তা বেশিদিন চালাতে পারিনি। সেসব লেখার সম্মানী সে নিয়মিত পাঠিয়ে দিতো। বৃত্তির অতিরিক্ত কিছু উপার্জন যে আমার প্রয়োজন, তা সে বুঝেছিল।
৯.
ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে আমার গবেষণার উপকরণ ছিল অপেক্ষাকৃত কম, তাই সেখানকার কাজ আগে শেষ করতে চাইলাম। আঠারো শতক থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিত্যনতুন যেসব আইন প্রণয়ন করছিল, তার বাংলা মুদ্রিত অনুবাদ সেখানে রক্ষিত ছিল। একেবারে আন্দাজের ওপর ভর করে ওয়ারেন হেস্টিংসের ব্যক্তিগত কাগজপত্রের সংগ্রহ খুঁজতে আরম্ভ করলাম এবং সত্যিই তার মধ্যে বাংলা হস্তাক্ষরে কাগজ পেয়ে গেলাম। লন্ডনে যখন হেস্টিংসের অভিশংসন হচ্ছিল, তখন বড় মানুষ ও সওদাগর ও আশরাফ ও ভদ্রলোক কলিকাতা শহরের বাসীসকল’ হেস্টিংসের পক্ষসমর্থন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডাইরেক্টরদের কাছে বাংলা ভাষায় এক আবেদনপত্র–এখনকার ভাষায়, স্মারকলিপি–পাঠিয়েছিলেন, তার একাধিক নকল পাওয়া গেল। ওই লাইব্রেরিতে টোকাটুকি যা করার করলাম, বেশকিছু কাগজপত্রের ফটোকপিও সংগ্রহ করলাম। যেদিন ফটোকপি পেলাম, সেদিন এই ভেবে লাইব্রেরি থেকে বের হলাম যে, আপাতত এখানে আর না এলেও চলবে।
বাড়ি ফেরার পথে সেইদিনই টিউবে আমার ব্রিফকেস ফেলে এলাম। আমার যত টোকা, যত ফটোকপি, ঠিকানা ও টেলিফোন-নম্বরের বই, চেকবই, এটাসেটা–সবই তার মধ্যে। কী করে যে ব্রিফকেস ছাড়া গাড়ি থেকে নামলাম, সেটা ভেবে অবাক হই এবং নিজেকে ধিক্কার দিই। যখন টের পেলাম, তখনো অবশ্য ট্রেনটা দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে বলে কোনো লাভ হলো না। পরদিন যথারীতি লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডে ফরম পূরণ করে হারানোর খবর জানালাম। কিমাশ্চর্যতঃপরম! আমাদের ডাক এলেই ওপর থেকে শব্দ পেয়ে আনন্দ এক দৌড়ে নিচে চলে যেতো চিঠিপত্র আনতে। একদিন সে একতলা থেকেই চেঁচাতে আরম্ভ করলো, তোমার ব্যাগ পাওয়া গেছে।’ খোলা ডাকে যে-চিঠি এসেছিল, তাতে ছড়ি-ছাতা-ব্যাগের ছবি ছিল, তা দেখেই সে অনুমান করে নিয়েছে। সেই চিঠি নিয়ে যখন লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডের জায়গায় পৌঁছোলাম, ব্রিফকেস সমর্পণ করে বয়স্ক অ্যাটেনডেন্ট সন্দেহ প্রকাশ করলেন, আমার তালিকার সব জিনিস তাতে আছে কি না। আসলে সবই ছিল, কিছুই খোয়া যায়নি। ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন বিলেতে যান, তখন সেখানে পৌঁছে ইংরেজি গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপিসমেত একটা পোর্টম্যানটো ব্যাগ ব্রিটিশ রেলে ফেলে এসেছিলেন রথীন্দ্রনাথ–সেটিও লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড থেকে পাওয়া গিয়েছিল।
ব্রিফকেস ফেরত পাওয়ার আগেই কাজ শুরু করে দিয়েছি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। ১৯৬৫ সালে সেখানে যখন কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলাম, তখন। লাইব্রেরিটা ছিল হোয়াইটহলের কাছে। এখন তা উঠে এসেছে ব্ল্যাকফ্রায়ার্সে। ওয়াটারলু স্টেশনে নেমে–সেটা আমার বাসস্থানের অপেক্ষাকৃত সন্নিকটে–ওল্ড ভিক-ইয়ং ভিক পেরিয়ে সেখানে পৌঁছোতে হয়, বেশি হাঁটতে হয় না। এখানকার পরিবেশ ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরির মতো নৈর্ব্যক্তিক নয়। পৃথিবীর নানান দেশ থেকে নানান বিষয়ে গবেষকেরা ছোটেন মিউজিয়ম লাইব্রেরিতে। পরস্পরের আগ্রহের ক্ষেত্রের ভিন্নতাহেতু একজনের সঙ্গে আরেকজনের বন্ধুতা হয় না সহজে। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির বেশির ভাগ পাঠক গবেষণা করেন। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা নিয়ে–চীন বা ইরান, ইরাক বা মিশর নিয়ে কাজ করেন, এমন গবেষকও আছেন, তবে তাদের সংখ্যা কম। অনেকে একই দেশ থেকে বা একই প্রতিষ্ঠান থেকে পূর্বপরিচয় নিয়ে আসেন, গবেষণার ক্ষেত্র সম্পর্কে পারস্পরিক কৌতূহলের কারণে অনেকের মধ্যে নতুন বন্ধুত্ব হয়। লাইব্রেরির কর্মকর্তা ও গবেষকদের মধ্যেও সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে অল্পকালে। আমি তো ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহীর অনেককে পেলাম, কলকাতা-দিল্লি-কলম্বোরও কাউকে কাউকে। দু-চারজন ইংরেজ পণ্ডিতের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল এবং লাইব্রেরির কর্মকর্তাদের কারো কারো সঙ্গেও ভাব হয়ে গেল।
প্রতিভা বিশ্বাস ছিলেন উত্তর ভারতীয় আধুনিক ভাষার বইপত্রের দায়িত্বে। আমার দু-একটি বই যে লাইব্রেরির সংগ্রহে আছে, এ-কথা তিনি উৎফুল্ল হয়ে। জানালেন। অল্পবয়সে বিধবা হয়ে বেশ সংগ্রাম করে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন ভদ্রমহিলা। এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বেশ হাসি-হাসি মুখ, তবু মনে হয় সদাই একটা চিন্তা লেগে আছে তার মনে। পদমর্যাদায় তার ওপরে মাইকেল ও’কিফ–সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃত বই ও পাণ্ডুলিপির সহকারী সংরক্ষক। তার সঙ্গে সহজে সখ্য হয়ে গেল। কিছু না জেনেই পরে একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তালিকায় নেই, এমন বাংলা কাগজপত্র লাইব্রেরির কোথাও গচ্ছিত আছে কি না। সে বললো, আছে কিছু, তবে সেসব যে কী, তা আমার জানা নেই, লাইব্রেরির আর কেউ জানে না। আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। বললাম, সেগুলো একবার দেখা যায় না? সে বললো, জানাব। তারপর একদিন আমাকে ডেকে নিয়ে গেল স্ট্যাকে। সেখানে একটা শেলফের একেবারে নিচের তাকে বেশকিছু কাগজপত্র, সুতোয় গাঁথা খাতার মতো। এমন গোটাদুই খাতা পড়ার ঘরে এনে দেখার ব্যবস্থা হলো। খানিক পরীক্ষার পরে বুঝতে পারলাম, এসব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা কুঠির দৈনন্দিন চিঠিপত্র। ঢাকা কুঠি কাপড়ের ব্যবসা করতো। ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরার কয়েকটি জায়গায় ছিল কোম্পানির আড়ং। সেসব আড়ংয়ের গোমস্তারা তাঁতিদের ফরমাশ ও দাদন দিয়ে কাপড় তৈরি করিয়ে নিতো। ফরমাশ আসততা লন্ডন থেকে কলকাতায়, কলকাতা থেকে ঢাকায়, ঢাকা থেকে এসব আড়ংয়ে, আড়ং থেকে তাঁতিদের কাছে। তাঁতিরা কাপড় বুনে দিলে তা যাচাই-বাছাই হয়ে উলটো পথে লন্ডনে পৌঁছোতো। চিঠিগুলো কুঠি ও আড়ংয়ের মধ্যে চালাচালি হয়েছিল। বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটা অধ্যায় স্পষ্ট হয় এসব চিঠিপত্রের সাহায্যে। এর ভাষা ও রীতিও উল্লেখযোগ্য। আমি কিছু চিঠি হাতে নকল করে নিতে থাকলাম–কেননা এগুলো ফটোকপি করা যাবে না।
এই অবস্থায় মাইকেল একদিন বললো, তুমি কি এই কাগজপত্রের একটা তালিকা করে দেবে–সামান্য কিছু বিবরণ দিয়ে? আমি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম। খাতাগুলোতে ওদের রীতি-অনুযায়ী ডাক-নম্বর বসালাম। বিবরণীতে কাগজের মাপ-জোক, ধরন, প্রেরক ও প্রাপকের নামধাম, পৃষ্ঠা সংখ্যা ইত্যাদি দেওয়া গেল। নিজে হাতে টাইপ করে একটা বাইন্ডার লাগিয়ে A Handlist of Uncatalogued Bengali Manuscripts in the India Office Library and Records নাম দিয়ে তালিকাটা মাইকেলকে দিলাম। সে খুব খুশি হয়ে বললো, এটা বরঞ্চ তুমি আমাদের ডাইরেক্টরের হাতে দাও–আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করছি! মিস জোন ল্যানকাস্টার ডাকসাইটে গ্রন্থাগারিক–সহকর্মীরা তাঁকে একটু বেশিই সমীহ করতেন। তার হাতে যখন তালিকাটি সমর্পণ করলাম, তিনি যথেষ্ট সন্তোষ ও সৌজন্য প্রদর্শন করলেন। বললেন, তার দেখা হয়ে গেলে ওটা ক্যাটালগ-হলে অন্যান্য তালিকা গ্রন্থের সঙ্গে স্থান পাবে। এটা আমার জন্যেও ছিল আশাতীত পুরস্কার।
১০.
এর আগে উল্লেখযোগ্য দুটি ঘটনা ঘটেছে।
১৯৭১ সালে দিল্লিতে যে-দুই বিশিষ্ট ইতিহাসবিদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে, তাঁরা দুজনেই তখন ইংল্যান্ডে। তপন রায়চৌধুরী আছেন অক্সফোর্ডে। তিনি নাফিল্ড কলেজে আলোচনাচক্রের আয়োজন করছেন ১৯৭৫ সালের গ্রীষ্মকালে। আমাকে আদেশ দিলেন একটি লিখিত প্রবন্ধ পড়তে। খেটেখুটে একটা লেখা দাঁড় করলাম, Towards a redefinition of identity: East Bengal, 1947-71 নামে। সেটা সেখানে পড়া হলো। সমাগম হয়েছিল বেশ ভালো। আমার প্রবন্ধটা দীর্ঘ হওয়ায় এবং সবটা পড়তে বাধা না পাওয়ায় পুরো সময়ই লেগে গেল। ফলে প্রশ্নোত্তর পর্বের আর অবকাশ রইলো না। একদিকে বেঁচে গেলাম, অন্যদিকে অন্যের দৃষ্টির আলোক থেকে বঞ্চিত হলাম। তবে যারা আমাকে মতামত জানাতে এলেন, তাঁরা সবাই ভালো বললেন। সেটা কতটা সৌজন্যবশত বলা, আর কতটা তাঁদের সত্য অনুভূতির প্রকাশ, বলতে পারবো না।
রণজিৎ গুহ অধ্যাপনা করছিলেন সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। অক্সফোর্ড বনেদি, সাসেক্স নবীন-যুদ্ধোত্তর রেডব্রিক ইউনিভার্সিটিগুলির একটি। এর অবস্থান রবীন্দ্রনাথের প্রথম যৌবনের স্মৃতিধন্য ব্রাইটনে-বড় সুন্দর জায়গা। রণজিৎ গুহের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তার ও তার স্ত্রীর আতিথ্য গ্রহণ করতে হলো। অধ্যাপক তখন সাবঅলটার্ন হিস্ট্রির তত্ত্ব ও সংগঠন নিয়ে ব্যস্ত। নীলদর্পণ নিয়ে সদ্য চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছেন Journal of Peasant Studies নামে গবেষণা-পত্রিকায়। প্রবন্ধের একটি রিপ্রিন্ট আমাকে দিয়ে বললেন, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ আফ্রিকান অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সেমিনারে একটি প্রবন্ধ পড়তে হবে। তার ইচ্ছে, উনিশ-বিশ শতকের বাঙালি মুসলিম লেখকদের চিন্তাধারা সম্পর্কে আমি লিখি, তবে ইচ্ছে করলে অন্য বিষয়েও লিখতে পারি। তার প্রস্তাবিত বিষয়ে লেখা আমার পক্ষেও সহজ। The World of the Bengali Muslim Writers in the Nineteenth Century (1870-1920) নামে একটি প্রবন্ধ সেখানে পাঠ করলাম। সামান্য আলোচনা হলো। সভাভঙ্গের পরে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও কর্মী বিপ্লব দাশগুপ্ত ও তার স্ত্রী এগিয়ে এসে পরিচয় দিলেন। বিপ্লব দাশগুপ্ত বললেন, প্রবন্ধের নাম শুনে তার সন্দেহ হয়েছিল, লেখাটায় সাম্প্রদায়িকতার রেশ থাকতে পারে। তিনি তেমন মনে করেই তা শুনতে এসেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলেন, তার আশঙ্কা অমূলক।
পরে রণজিৎদাকে আমাদের সংলাপের কথা বললাম। তিনি বেশ চটলেন। বললেন, এই হলো তোমাদের বামপন্থী বুদ্ধিজীবী। নাম শুনে, ভেতরে না ঢুকে, একটা ধারণা করে ফেললেন!
নীলদর্পণ নিয়ে লেখা তাঁর প্রবন্ধ সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন রণজিৎদা। বললাম মনে হচ্ছে, দীনবন্ধু মার্কসবাদ কেন জানলেন না, তা নিয়ে আপনি ক্ষুব্ধ।’ রণজিৎ গুহ বললেন, ‘বটেই তো। নীলদর্পণ লেখার আগেই কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো এবং মার্কসের অন্য লেখা বেরিয়ে গেছে। কলকাতায়ও তা পাওয়া যেত। উনি পড়েননি কেন?’ এটা বোধহয় কৌতুকের ছলে বলা। তবে ওই প্রবন্ধে তার একটা প্রতিপাদ্য ছিল এই যে, সংকটের সময়ে কোন পক্ষ নেবেন, মধ্যবিত্ত তা স্থির করতে পারে না, ফলে তার ধ্বংস হয়ে পড়ে অনিবার্য। এই কথা, নাটকের বসু-পরিবার এবং নাট্যকার সম্পর্কে সমানভাবে প্রযোজ্য।
পরে আমার ওই ইংরেজি বক্তৃতাদুটির বাংলা ভাষ্য প্রকাশ করেছিলাম স্বরূপের সন্ধানে (ঢাকা, ১৯৭৬) বইতে। মূল ইংরেজি লেখা আরো পরে সংকলিত হয় আমার Creativity, Reality and Identity (ঢাকা, ১৯৯৩) গ্রন্থে। তপন রায়চৌধুরী ও রণজিৎ গুহের উদযোগ ছাড়া এ-দুটি কখনো লেখা হতো না।
১১.
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগের শিক্ষক গিয়াসউদ্দীন উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ১৯৭০ সালে যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলেন। তিনি ঠিক রাজনৈতিক লোক ছিলেন না, কিন্তু মনেপ্রাণে পাকিস্তানপন্থী ছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি কাজ করেছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে। ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আর দেশে ফেরেননি। কষ্টেসৃষ্টে বিলেতে প্রবাসজীবন যাপন করছিলেন। আর চট্টগ্রামে তার স্ত্রী চমন আরা পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে দিনাতিপাত করছিলেন আরো কষ্টে। ভদ্রমহিলা ছিলেন বেবীর সহপাঠিনী। তাঁর পরিবারের জন্য আমাদের অনেকেরই সহানুভূতি ছিল। আমি যখন লন্ডনে যাই, তখন সহকর্মীদের কেউ কেউ আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, আমি যেন গিয়াসউদ্দীনকে দেশে ফিরে আসতে প্রণোদিত করি। তিনি যেহেতু বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য স্বীকার করেননি, তাঁর পক্ষে। পাসপোর্ট সংগ্রহ করাও ছিল কঠিন। উপাচার্য আবুল ফজল স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমাদের হাই কমিশনার সৈয়দ আবদুস সুলতানকে একটি আধা-দাপ্তরিক চিঠি লিখে আমার হাতে দিলেন। তাতে তিনি অনুরোধ জানিয়েছিলেন, গিয়াসউদ্দীনের স্বদেশ-প্রত্যাবর্তনে হাই কমিশনার যেন ব্যক্তিগত উদযোগ নেন। আমাকেও বলে দিলেন, সৈয়দ আবদুস সুলতানকে যেন আমিও ব্যক্তিগতভাবে সব বিষয়টা বুঝিয়ে বলি।
লন্ডনে আমি পৌঁছোবার কিছুকাল পরে গিয়াসউদ্দীনের সঙ্গে দেখা হলো। তারপর তিনি দিনক্ষণ ঠিক করে আমাদের বাসায় এলেন। তাঁর ভয়, দেশে ফিরলে তিনি গ্রেপ্তার হবেন এবং তাঁকে জেল খাটতে হবে। আমি তাকে বললাম যে, সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হওয়ায় সে-ভয় নেই; তাছাড়া, উপাচার্য স্বয়ং তাঁর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন, তিনি যাতে পাসপোর্ট পেতে পারেন সেজন্যে উপাচার্য চিঠি দিয়েছেন হাই কমিশনারকে, এবং এমন একজন প্রভাবশালী উপাচার্যের সাহায্য পেলে অনেক বাধাবিপত্তি তিনি পার হতে পারবেন। এতে গিয়াসউদ্দীন আরো ভয় পেলেন। তার মনে হলো যে, পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে তাঁকে কোনোমতে দেশে নিয়ে ফেলার পরিকল্পনা। নইলে তার মতো একজন সহকারী অধ্যাপকের জন্যে উপাচার্যের এত উৎকণ্ঠা কেন! যদিও তিনি আমাকে বললেন, ‘ভেবে দেখি’, কিন্তু আমি বুঝে গেলাম যে, তিনি দেশে ফিরবেন না। পরিবারের বিষয়ে তিনি তেমন উদৃবিগ্ন ছিলেন না। তাঁর ভরসা মুখ্যত আল্লাহর উপরে এবং গৌণত শ্বশুরকুলের উপরে। অতএব তিনি যেমন ছিলেন, তেমনি রয়ে গেলেন–আমার সঙ্গেও আর কোনো যোগাযোগ রাখলেন না।
পরে, ১৯৭৬ সালের দিকে, গিয়াসউদ্দীন দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মে যোগ দেন। শুনেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন, এই দাবিতে তিনি দু বছরের অ্যান্টি-ডেটেড সিনিয়রিটি দাবি করেছিলেন। প্রমাণস্বরূপ নাকি মুক্তিযুদ্ধের জন্যে সংগৃহীত বিলেতের কোনো তহবিলে দু পাউন্ড চাঁদা দেওয়ার একটা রসিদের ফটোকপি দাখিল করেছিলেন। তবে এটা আমার শোনাকথা মাত্র।
১২.
দেশে রাষ্ট্রপতি-পদ্ধতির মন্ত্রিসভা গঠিত হয়ে গেছে জানুয়ারিতে। মন্ত্রীদের নামের ঘোষিত তালিকায় কামাল হোসেনের নাম ছিল, কিন্তু তিনি তখন অক্সফোর্ডে। দেশে গিয়ে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার জন্যে তার কাছে তাগাদা আসতে থাকল। বঙ্গবন্ধুও ব্যক্তিগত পত্র দিলেন। কামাল এসব চিঠির জবাবে ইংরেজিতে খসড়া তৈরি করে রাখেন, আমি অক্সফোর্ডে গেলে তার বাংলা করে দিই, তিনি তা কপি করে পাঠিয়ে দেন স্বাক্ষর দিয়ে। কামাল অক্সফোর্ডে তাঁর। দায়িত্বের কথা বলেন, মন্ত্রিত্ব থেকে আপাতত অব্যাহতি চান, রাজনীতিতে পুনরায় যোগ দেওয়ার জন্যে সময় প্রার্থনা করেন। আমরা দেশের পরিস্থিতি আলোচনা করি, হামিদা মৃদু হেসে বলেন, কনশেন্স-টকের সময় এক ঘণ্টা–তারপর সবার সঙ্গে বসে সময় কাটাতে হবে।
কামালের কাছে একবার গিয়ে জানতে পারলাম, জার্মানির কোনো এক পত্রিকায় ঢাকায় দেওয়া ফজলুল হক মনির সাক্ষাঙ্কার প্রকাশিত হয়েছে। তাতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে কামালের সম্পর্কে কিছু মন্তব্য আছে। তিনি যে জাতীয় কর্তব্য পালন না করে বিদেশে বসে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করছেন, তা নিয়ে কটাক্ষ আছে, কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক কথা, বাংলাদেশের প্রতি কামালের আনুগত্যে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে একথাও বলা হয়েছে যে, ১৯৭১ সালে বাকশালের তিন সম্পাদকের একজন–এমনিতেই প্রতাপশালী, তার ওপরে আনুষ্ঠানিক পদ অলংকৃত করে রয়েছে।
স্বভাবতই কামাল খুব ব্যথিত হলেন। কেন তিনি এই আকস্মিক আক্রমণের লক্ষ্য হলেন, এ-প্রশ্ন নিশ্চয় তাঁর মনে উঠে থাকবে। কিন্তু তার চেয়ে প্রবল হলো এই জিজ্ঞাসা যে, এই আক্রমণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আদৌ ওয়াকিবহাল কি না। এই প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কী করা উচিত, এ-প্রশ্নও দেখা দিলো। শেষ অবধি তিনি স্থির করলেন, ওই সাক্ষাৎকার সম্পর্কে তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন না, তবে বঙ্গবন্ধুকে তার ক্ষোভের কথা জানাবেন।
অক্সফোর্ড থেকে ফিরে আসার পরদিন সকালে বি বি সি-তে গিয়েছি। জন ক্ল্যাপহাম আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, আজকের অনুষ্ঠানের কোনো কাজ আপনাকে করতে হবে না, আমার হাতে একটা স্পেশাল রিপোর্ট আছে–এটির বাংলা অনুবাদ করে দিতে হবে। কাগজটা হাতে নিয়ে দেখি, কামাল সম্পর্কে সেই জার্মান পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের বি বি সি-র নিজস্ব ইংরেজি অনুবাদ। আমি বাংলা ভাষ্য তৈরি করে দিলাম–পরে সেটা কী কাজে লাগানো হয়েছিল, তা আমার জানা নেই। তবে খুব সম্ভব, বিষয়টি নিয়ে কামালের মন্তব্য চাওয়া হয়েছিল, তার জন্যে অবশ্য বাংলা অনুবাদের প্রয়োজন ছিল না।
কামাল অবশেষে স্থির করলেন, মার্চ মাসের মধ্যভাগে একাই দেশে ফিরবেন এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাইবেন। হামিদা এবং আমি দুজনেই বললাম, দেশে ফিরে এলে তাকে শপথ নিয়ে মন্ত্রিত্ব করতে হবে–কেননা, এতকাল ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব তারই জন্যে রেখে দেওয়া আছে। কামাল আশা প্রকাশ করলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়ে তিনি আবার অক্সফোর্ডে ফিরে আসতে পারবেন, তবে তার এ-কথায় আস্থার জোর পাওয়া গেল না।
কামাল ঢাকায় ফিরলেন এবং অচিরেই মন্ত্রিত্বের শপথ নিলেন। তাঁর অক্সফোর্ডে প্রত্যাবর্তন আপাতত অনিশ্চিত হয়ে রইল। সারা-দীনা সেখানে স্কুলে যাচ্ছে, হামিদা সংসার চালাচ্ছেন। একবার সারাকে ডাক্তার দেখাবার প্রয়োজন হলো। হামিদা নিজেই ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে লন্ডনে নিয়ে এলেন তাকে। প্যাডিংটন স্টেশন থেকে তাদের নিয়ে আমি এলাম হার্লি স্ট্রিটে। সেখানে বসে থাকতে থাকতে দেখি, এ কে এম আবদুর রউফ এসেছেন একই ডাক্তারের কাছে। কাজ সারা হয়ে গেলে, হামিদার আপত্তি সত্ত্বেও, রউফ আমাদের সকলকে পৌঁছে দিলেন গোলডার্স গ্রিনে, কামালের একমাত্র বোন আহমদীর বাড়িতে। সেখানে কামালের মা-ও তখন থাকছেন। আমরা কীভাবে সেখানে পৌঁছলাম, তিনি তা জানতে চাইলেন। রউফকে দেখিয়ে বললাম, এঁর গাড়িতে। তিনি খুশি হলেন না। বললেন, তোমার বন্ধু কেমন মিনিস্টার–একটা গাড়িও পায় না। বউ-বাচ্চা টিউবে করে ঘোরে। আমি মা–কোথাও যেতে হলে অন্যের ভরসায় থাকতে হয়!’ আমি হেসে বললাম, কামাল বেশি শক্ত মন্ত্রী নয়।’ আরেকবার ও-বাড়িতেই গেছি কী এক উপলক্ষে। কামাল তখন আমেরিকায়। তার মা বললেন, তোমার বন্ধু বিলেত-আমেরিকা এ-পাড়া ও-পাড়া বানিয়ে ফেললো। কখন কোথায় থাকে, আমিই তার হদিস পাই না!’
কামাল ঢাকায়–এমন অবস্থায় হামিদার পক্ষেও সন্তানদের নিয়ে বেশিদিন অক্সফোর্ডে থাকা সম্ভবপর হলো না। ওঁরাও ফিরে গেলেন দেশে।
১৩.
প্রায় এই সময়েই খবর পেলাম, আব্বা অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী। বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেন দৌড়ঝাঁপ করে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং ডা. নূরুল ইসলামকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। পৃথক পৃথকভাবে উভয়ের একই সিদ্ধান্ত–ফুসফুসের ক্যানসার এবং সেটা অনেকখানি পরিণত। ডা. নূরুল ইসলাম আরো জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সহযাত্রী হয়ে তিনিও কমনওয়েলথ সম্মেলনে যাচ্ছেন কিংসটনে; যখন তাঁরা হিথরো বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করবেন, তখন যদি আমি ভিআইপি লাউঞ্জে ফোন করে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি, তাহলে নিজমুখেই আব্বার অবস্থা আমাকে জানাবেন।
আর তিন মাস পর আব্বার ৭৮ বছর পূর্ণ হবে। আমি তাঁকে খুব-একটা অসুস্থ হতে দেখিনি। এবার এমনি রোগাক্রান্ত হলেন যে, তাঁর প্র্যাকটিস বন্ধ করে দিতে হলো, ষাট বছরের ধূমপানের নেশা ছাড়তে হলো!
২৬ এপ্রিল হিথরো বিমানবন্দরে টেলিফোনে ডা. নূরুল ইসলামকে ধরলাম। নিজের দেশের বিমানবন্দরে এভাবে কাউকে পাকড়াও করতে পারতাম কি না সন্দেহ। নূরুল ইসলাম কেবল বললেন, আপনার আব্বাকে দেখতে চাইলে আপনাকে অক্টোবরের মধ্যে ফিরে আসতে হবে। বললাম, আমি আগস্টেই ফিরবো। উনি বললেন, ‘সেই ভালো।’
ক্যানসারের চিকিৎসা করেন। তিনি আবার বিখ্যাত চিত্রাভিনেত্রী সুমিত্রা দেবীর বোন। তারাপদ বললেন, আপনার বাবার চিকিৎসা-সংক্রান্ত কাগজপত্র একবার এমাকে দেখাতে পারেন। ও কিছু পরামর্শ দিতে পারে, কিংবা পরামর্শ নেওয়ার জন্য অন্য ডাক্তারের কথা বলতে পারে আপনাকে।
বড়ো দুলাভাইকে লিখলাম, আব্বার এক্স-রে প্লেট এবং অন্যান্য কাগজপত্র কামাল হোসেনের দপ্তরে পৌঁছে দিতে। কামালকে লিখলাম, সেসব আমাকে পৌঁছোবার ব্যবস্থা করে দিতে। কামাল সবকিছু ব্যাগে পাঠালেন হাই কমিশনে। নূরুল মোমেনের ফোন পেয়ে সেগুলো নিয়ে এলাম। এমা মুখার্জি তখন লন্ডনের বাইরে কাজ করেন। ট্রেনে করে গেলাম তাঁর কাছে। তিনি মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করলেন এবং কাগজপত্র সব দেখে বললেন, রোগটা অ্যাডভান্সড স্টেজে পৌঁছে গেছে, এখন কিছু করার সুযোগ নেই।
মেনেই নিতে হবে। এখন শুধু দিনক্ষণ গনা। শেষ দেখার অপেক্ষা মাত্র।
১৪.
রাজেশ্বরী দত্তের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালো, কিন্তু তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কী নিয়ে যেন বিরোধ আছে তাঁর। তারাপদ কখনো এ-বিষয়ে আমাকে কিছু বলেননি, কিন্তু রাজেশ্বরী একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার সঙ্গে তারাপদর বুঝি খুব ভাব!’ তাঁর প্রশ্ন শুনেই খটকা লাগলো, সুতরাং সতর্কতার। সঙ্গে জবাব দিলাম, না, ভাব বেশি নয়, তবে একই ক্ষেত্রের লোক তো, তাই একসঙ্গে ওঠাবসা আছে।’ রাজেশ্বরী বললেন, ‘তোমার চিঠিপত্র দেখি ওর দরজার বাইরে গেঁথে রাখে–অফিসে রাখে না।’ বললাম, এটা সেক্রেটারির কাজ। পাছে আমি এসে ওকে না পাই, বাইরে রাখা সুবিধে মনে করে।’ বোঝাই গেল, আমার উত্তরে উনি সন্তুষ্ট হলেন না।
তবু ওঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেন। বিকেলবেলায় কাজ সেরে সোয়াস থেকে ওঁর গাড়িতে চেপে গেলাম ওঁর চমৎকার ফ্ল্যাটে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্বকণ্ঠের আবৃত্তির টেপ চালিয়ে দিলেন। ওঁর জন্যে পানীয়ের একটা বোতল নিয়ে গিয়েছিলাম–সেটা খুললেন। খানিক পরে আমাকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে এক চীনা টেক অ্যাওয়ে থেকে খাবার কিনে আনলেন। ওঁর ঘরে বসে ভোজনপর্ব সারা হলো। খেতে খেতে গল্প। সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে টুকিটাকি, নিজের জীবনের বেশ কিছু কথা। জানতে চাইলেন, বাংলাদেশে সুধীন্দ্রনাথ। সম্পর্কে আগ্রহ কেমন, কেউ লিখেছে নাকি কিছু তার বিষয়ে। বাংলায় এম এ ক্লাসে তাঁর কবিতা পাঠ্য শুনে খুব খুশি হলেন। আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘কালো সূর্যের নিচে ব্যুৎসব’ প্রবন্ধটির উল্লেখ করতেই হেসে বললেন, ‘এ তো সুধীনের লেখার মতোই কঠিন মনে হচ্ছে।’
রাজেশ্বরী তাঁর জীবনের পাঞ্জাব-পর্বের কিছু গল্প বললেন, আমি আরো একটু জানতে চাইলাম। তারপর বললেন শান্তিনিকেতন-পর্বের কথা, থেমে গেলেন সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয়ের কথায় এসে। শুনতে ভালো লাগছিল। বললাম, ‘আপনি স্মৃতিকথা লেখেন না কেন? অকপটে উত্তর দিলেন, আমি তো লিখতে পারি না। তাছাড়া কার আগ্রহ হবে এসব কথায়?’ বললাম, আপনার ভক্ত অনেক আছেন। আর আপনার জীবনকথা তো খুব কৌতূহলোদ্দীপক। কেমন করে পাঞ্জাব থেকে বাংলায় এসে আপনি রবীন্দ্র-সংগীতের একজন প্রধান শিল্পী হয়ে গেলেন, এটা জানতে অনেকেরই আগ্রহ হবে। আপনি রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য, সুধীন্দ্রনাথের সহধর্মিণী, কতবছর ইউরোপ-আমেরিকা করলেন–এসব বিষয়েও আপনার বলার অনেক থাকবে। উনি স্বীকার করলেন সে-কথা, তবু বললেন, ‘আমাকে দিয়ে লেখা হবে না। বললাম, আপনি যদি মুখে বলে যান, আমি লিখে নিতে পারি, পরে আপনি অনুমোদন করলে তা ছাপা যেতে পারে। উনি আমার হাতে মৃদু চাপ দিলেন, বললেন, তুমি আমার গান শুনতে চেয়েছিলে-।’ টেপ ছেড়ে দিলেন, কথা বন্ধ হলো। একসময়ে বিদায় নিলাম, তার আগে ওঁর ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখালেন।
এর কদিন পরে তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের অফিসকক্ষে গেছি। উনি খুব খুশি হয়ে বললেন, ভালো হয়েছে, আপনি এসেছেন। নিমাই আসছে, একসঙ্গে লাঞ্চ করা যাবে।’ নিমাই মানে নিমাই চট্টোপাধ্যায়। ১৯৫৬ সালে শান্তিনিকেতনে যে সাহিত্যমেলা হয়েছিল, তার প্রধান সংগঠক–তাতে কাজী মোতাহার হোসেন, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, শামসুর রাহমান ও কায়সুল হক যোগ দিয়েছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লেখকেরা সম্মেলনের গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন। নিমাই চট্টোপাধ্যায় বহুকাল ধরে লন্ডন-প্রবাসী। ১৯৬৯ সালে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক যখন লন্ডনে ছিলেন, তখন নিমাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উনি খুব প্রীত হন। ফলে, তার পাঁচ বছর পর নিমাইয়ের সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হলো, তখন আমরা উভয়েই উভয়ের সম্পর্কে কিছু জানি। নিমাই মাঝে মাঝে বি বি সি বাংলা বিভাগে সংস্কৃতি-বিষয়ে অনুষ্ঠান করতে আসতেন। সেই সূত্রেই যোগাযোগটা হলো। ব্রাইটনে নিমাইয়ের একটা বাড়ি ছিল–ফলে সেখানেও তাকে মাঝে মাঝে যেতে হতো। ফলে রণজিৎ গুহের সান্নিধ্যেও তাঁকে পেয়েছিলাম একাধিকবার। নিমাইয়ের বাড়িতেও গেছি–তার স্ত্রী জয়া চমৎকার সঙ্গী।
সেই দুপুরে খোশমেজাজে আমরা তিনজনেই সোয়াসের সিনিয়র কমনরুমে চললাম লাঞ্চ খেতে। প্রথমে তারাপদ, তারপর নিমাই, শেষে আমি। এক হাতে দরজা খুলেই বন্ধ করে দিলেন তারাপদ, বললেন-রেজো। রেজো মানে যে রাজেশ্বরী দত্ত, সেটা আমি যেন কীভাবে বুঝে গেলাম, কিন্তু তাতে পালাবার কী কারণ আছে, তা বুঝিনি। তবে এটা বুঝলাম যে, তারাপদ ও নিমাই বিদারণ রেখার একদিকে এবং রাজেশ্বরী অন্যদিকে এবং সেই রেখাঁটি অনতিক্রম্য। সোয়াস থেকে বেরিয়ে আমরা সিনেট হাউজে গিয়ে খেলাম।
বেশ কয়েকদিন পরে রাজেশ্বরী দত্তের আহ্বান এলো, তার ফ্ল্যাটে সন্ধ্যা কাটাবার জন্যে। আমি এককথায় রাজি। আগেরবারের মতো শেষ বিকেলে সোয়াস থেকে যাত্রা। ফ্ল্যাটে ঢুকে কোট ইত্যাদি যথাস্থানে রেখে ওঁর বসার ঘরে প্রবেশ করলাম। উনি কাউচে না বসে কার্পেটে আসন নিলেন। আমি জ্যাকেটটা কাউচে রেখে ওঁর মুখোমুখি বসলাম। রাজেশ্বরী একটা মাইল্ড ব্র্যান্ডের সিগারেট খেতেন–তার একটা ধরিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সেদিন তোমরা অমন করলে কেন?
প্রশ্নটা আমার বুকে সজোর ধাক্কা দিলো। সেদিন এবং অমন কী, আমি বুঝে ফেলেছি। তবু, আশা করেছি, উনি টের পাননি। জানতে চাইলাম, কী, কবে? রাজেশ্বরী বললেন, ‘সেদিন লাঞ্চের সময়ে, আমাকে দেখে তুমি, তারাপদ, নিমাই দরজা থেকে ফিরে এলে। তার গলা ধরে এলো, চোখে উদ্গত অশ্রু। তিনি বললেন, ‘ওরা যাহোক, তোমাকে আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম, এখন দেখছি, তুমিও ওই দলে–কিন্তু কেন, আমার সঙ্গে এমন করবে কেন?
আমি তার হাঁটুর ওপরে একটা হাত রাখলাম, কিছু বলতে পারলাম না।
একটু পরে বলতে গেলাম, আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন।
রাজেশ্বরী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, না, আমি ভুল বুঝিনি। আসলে তোমরা আমাকে অ্যাকসেপ্ট করো না–বোধহয় আমি অবাঙালি বলে।
বললাম, আপনি বাঙালি না অবাঙালি, এ-প্রশ্ন কারো মাথায় ঢুকবে না।
উনি বলে চললেন, ‘হ্যাঁ, সেজন্যই তুমি আমাকে মেমোয়ার্স লেখার কথা বলছিলে, আমার পাঞ্জাবি ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে প্রশ্ন করছিলে। আমি তখন বুঝিনি, এখন স্পষ্টই বুঝছি–তোমরা আমাকে অন্য কিছু প্রতিপন্ন করার জন্য ব্যস্ত। পুরু চশমার ভেতর দিয়ে অশ্রু দেখতে পাচ্ছি।
জীবনে কখনো এত বিব্রত হইনি। ওঁকে কথা বলতে দিলাম; ওঁর হাঁটুর ওপরে যেমন হাত রেখেছিলাম, সেটা তেমনি রইলো। তাতে মিনতি ছিল।
খানিক পরে জানতে চাইলাম, ‘খাবার আনতে যাবেন না?
করুণ হাসি হেসে বললেন, ‘চলো।’
সেই টেক-অ্যাওয়ে চীনা রেস্তোরাঁ। এবারে খাবারের দামটা আমি দিলাম। রাজেশ্বরী বাধা দিলেন না। ম্লান হাসি হাসলেন।
ওঁর ফ্ল্যাটে এসে খাওয়া-দাওয়া সারলাম। বেশি কথা হলো না। বিদায় নিয়ে ফিরলাম। যখন উনি দরজা খুলে দিলেন, তখনো মনে হলো ওঁর দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়নি। সারা পথ আমার মনের মধ্যে কাঁটা বিঁধতে লাগলো। কেন জানি না, সোয়াসে আর ওঁর অফিসঘরে ঢুকিনি। ওঁর বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছে শুধু একদিন ওঁর পছন্দের পানীয় রেখে এসেছিলাম। উনি পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রাপ্তিস্বীকার করেননি।
রাজেশ্বরী দত্তের সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি। এর পরের বার কলকাতায় এসে তিনি মারা যান। কী একটা সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন বলে শুনেছি।
তার আগে আমিই ক্ষতবিক্ষত হয়েছি দুর্ঘটনায়–যে-দুর্ঘটনার ওপরে আমার হাত ছিল না।
১৫.
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবুল ফজলের লেখা চিঠি পেলাম :
পরম প্রীতিভাজন।
আনিস, তোমার বন্ধু আর আত্মীয়দের কাছ থেকে তোমার খবর পেয়ে ও নিয়ে থাকি। সেদিন ঢাকায় আহমদ হোসেনের সঙ্গে দেখা হলো, জানালেন সম্প্রতি তিনি তোমার চিঠি পেয়েছেন এবং তুমি ভালো আছো।
ইতিমধ্যে তুমি বোধ করি খবর পেয়েছ সৈয়দ আলী আহসান সাহেব আমাদের বাংলা বিভাগে তার সাবেক পদে যোগ দিয়েছেন। জাহাগীর নগরে তিনি কিছু স্বার্থ আর বিদ্বেষবাদী রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন। তার শরীরও অনেকদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। তাকে শান্তি আর নিরাপত্তা দেওয়া আমি আমার নৈতিক কর্তব্য বলেই মনে করেছি। তাই সর্বান্তকরণে আমি তাঁর আগমন আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানকে স্বাগত জানিয়েছি। তার জন্য আমি সঙ্গে সঙ্গেই রশীদুল হক সাহেবের বাড়িটিও বরাদ্দ করে দিয়েছি।
যেদিন তিনি কাজে যোগ দিয়েছেন সেদিন থেকে, অধ্যাপকের (Professor) দ্বিতীয় যে পদটি রয়েছে তাতে তোমাকে নিয়োগ করেছি। আমার বিশ্বাস এতে তোমার পদ, মাইনে এবং সিনিয়রিটির কিছুমাত্র ক্ষতি হবে না। আমাদের এ সিদ্ধান্তের প্রতি তোমার সমর্থন আছে। জানতে পারলে আমি নিশ্চিন্ত বোধ করবো। তোমার নিজের যদি কোন দ্বিধা বা এ সম্পর্কে পরামর্শ থাকে তা অসংকোচে আমাকে জানাবে।
তোমার প্রতি আমার স্নেহ আর ঔৎসুক্য এ বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে নয়। আশা করি সর্বাংগীণ কুশলে আছো। তোমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের প্রতি আমার আন্তরিক স্নেহ।
শুভার্থী
আবুল ফজল
১৯৭২ সালে সৈয়দ আলী আহসানের ছুটিজনিত শূন্যপদে আমি অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগলাভ করেছিলাম। তারপরে বাংলা বিভাগে দ্বিতীয় একটি অধ্যাপক-পদসৃষ্টির উদযোগ নিয়েছিলেন উপাচার্য, তবে আমি লন্ডনে রওনা হওয়া অবধি সে-উদযোগ ফলপ্রসূ হয়নি। ওই পদটি যে সৃষ্ট হয়েছে, তা আমার জানা ছিল না। উপাচার্যের এই চিঠি পেয়ে তাই আমি যেমন স্বস্তি পেয়েছিলাম, তেমনি তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ বোধ করেছিলাম।
নবনীতা দেবসেন সে-সময়ে লন্ডনে এসেছিল। আবুল ফজলের চিঠিটা তাকে দেখালাম। সে বললো, ‘কী ভাগ্য তোমার! এমন ভাইস-চান্সেলরের সঙ্গে কাজ করো। আমাদের ভাইস-চান্সেলররা কোনো টিচারের জন্য এত ভাবনা-চিন্তা করে না, তাদের সে সময় নেই।’
সেমিনার-কনফারেন্স নিয়ে সারা দুনিয়া চষে বেড়ায় নবনীতা। অমনই কিছু একটা নিয়ে সে এসেছে এখানে। তার কাজের শেষে তুমুল আড্ডা হলো। সে আমার বাড়িতে এলো তার বন্ধু ডা. অমেয়া দেবাকে নিয়ে। অমেয়া লন্ডনে জেনারেল ফিজিশিয়ান–শুনেছিলাম, নবনীতার মতো অমেয়া নামটিও রবীন্দ্রনাথের দেওয়া, তবে তার ডাকনাম বুলুই অধিক ব্যবহৃত হতো। পরে তার সঙ্গে আমার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়।
সেদিন বুলুর গাড়িতে চড়ে আমরা তিনজন ইতস্তত ঘুরে বেড়ালাম, বইয়ের দোকানে ঢু দিলাম, ওয়েস্ট এন্ডের রেস্টুরেন্টে খেলাম। খেতে খেতে হঠাৎ নবনীতার খেয়াল হলো, সিনেমা দেখবে। সিনেমা দেখতে দেখতে পরদিনের করণীয় সম্পর্কে পরিকল্পনা করা গেল। এমনি করে সময়টা খুব ভালো কাটলো।
কলকাতায় ফেরার আগে একগাদা বই আমাকে দিয়ে নবনীতা বললো, তুমি এগুলো অমর্ত্যর অফিসে পৌঁছে দিয়ে বোলো আমাকে মেইল করে দিতে।
অমর্ত্য সেন তখন লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকসে অধ্যাপনা করেন। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় যৎসামান্য। যতটুকু বুঝতে পারলাম, বইপত্রের বিষয়ে নবনীতা তাঁকে কিছুই বলেনি, বলার প্রয়োজনও বোধ করছে না। আমি এগুলো বয়ে তার অফিসে নিয়ে যাবো–তারপর না দুজনেই বিব্রত হই!
আমার ইতস্তত ভাব দেখে নবনীতা অবাক হলো। তারপর সমাধান দিলো, ‘তোমার যদি কিন্তু কিন্তু লাগে তাহলে আজিজকে দিয়ে বোলো, সে যেন অমর্ত্যকে বলে এগুলো পাঠিয়ে দিতে।’
আজিজ মানে ড. আজিজুর রহমান খান–অমর্ত্য সেনের প্রিয় ছাত্র এবং এল এস ই-র শিক্ষক। আর দ্বিধা করা নিষ্ফল। বইগুলো রেখে দিলাম। পরে আজিজের অফিসে নিয়ে গিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করলাম। আজিজ মুদৃ হেসে বললেন, ‘বইগুলো থাক আমার কাছে, কিছু একটা করতে হবে।’ তিনি পরে তা কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, তবে অমর্ত্যকে কিছু বলেছিলেন কি না সন্দেহ।
১৬.
সেই ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ দুটি ব্যাপার ঘটলো–বলা যেতে পারে, আমার চোখের সামনে, অর্থাৎ টেলিভিশনে আমি তা প্রত্যক্ষ করলাম।
একটি হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা সাধারণ বাজারে যুক্তরাজ্যের যোগদান। এডওয়ার্ড হিথের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে কাজটা প্রায় হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারপর ক্ষমতায় এলেন হারল্ড উইলসন। এই প্রশ্নে দেশে, এমনকী, দুই বড়ো রাজনৈতিক দলের মধ্যেই মতান্তর ছিল। সুতরাং উইলসন গণভোটের আয়োজন করলেন। কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো না এই বিষয়ে, নিজের বিবেক অনুযায়ী প্রচারণার স্বাধীনতা সবাইকে দেওয়া হলো। আমরা দেখলাম, মন্ত্রিসভার কোনো সদস্য একপক্ষে, আরেকজন অন্যপক্ষে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। উইলসন নিজে কোনো পক্ষ নিলেন না। পরে যারা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি গঠন করেছিলেন, লেবার পার্টির সেসব নেতা–রয় জেনকিনস, ডেভিড ওয়েন, শার্লি উইলিয়মস–ইউরোপে যোগদানের পক্ষে, সম্ভবত ইয়েন হিলিও সেইসঙ্গে, প্রচারণায় নামলেন। আবার মাইকেল ফুট তো প্রচণ্ডভাবে তার বিরোধিতা করলেন, তার সঙ্গে রইলেন টোনি বেন এবং জুনিয়র মিনিস্টার জুডিথ হার্ট। ইউরোপে যোগদানের পক্ষে কনজারভেটিক পার্টির নেতা এডওয়ার্ড হিথের বক্তৃতা যেমন ছিল খুব যুক্তিপূর্ণ ও পরিচ্ছন্ন, তেমনি তার বিরুদ্ধে প্রবল আবেগময় ভাষণ দিতেন ওই দলেরই পার্লামেন্ট-সদস্য ইনোক পাওয়েল। বর্ণবাদী বলে পাওয়েলকে পছন্দ করতাম না, কিন্তু তার ইউরোপ-বিরোধী বক্তৃতা ভালো লাগত। মাইকেল ফুটও খুব আবেগের সঙ্গে নিজের কথা বলতেন, তবে নিজের দলের মধ্যে ইউরোপের পক্ষে অত সমর্থন দেখে তিনি যে খানিকটা হতাশ হয়েছিলেন, সেটা বোঝা যেতো। টোনি বেন তো হারজিতের পরোয়া না করেই সংগ্রাম করে যেতেন। রয় জেনকিনসের ভাষণ আমার ভালো লাগত না, যেমন ভালো লাগত ইউরোপের সমর্থনে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলা মার্গারেট থ্যাচারের বক্তৃতা।
গণভোটে ইউরোপে যোগদানের সিদ্ধান্তই নেওয়া হলো। সিদ্ধান্ত যাই হোক, পুরো ব্যাপারটা এমন সুরুচিসম্পন্ন হলো যে তার তারিফ না করে পারা যায় না। পরমতসহিষ্ণুতার এক অসাধারণ নিদর্শনের সাক্ষ্য হয়ে রইলাম। সোয়াসে ছাত্রদের কমনরুমেও উত্তেজিত আলোচনা হতে দেখেছি কিন্তু সবটাই যুক্তিতর্ক-অধ্যয়ন-চিন্তনের বিষয় ছিল, গায়ের জোরের নয়। ফলাফল মেনে নেওয়ার ব্যাপারেও সেই একই মনোভাবের প্রকাশ দেখলাম।
ওদিকে ভিয়েতনামের যুদ্ধ বাঞ্ছিত পরিণামের দিকে চলেছে। ১৯৭৩ সালে প্যারিস শান্তিচুক্তির পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহার করতে শুরু করে, কিন্তু দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট থিউ একাই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে তার সেনাবাহিনীর পরাজয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। অনর্থক যুদ্ধ চলে তারপরও। যুদ্ধের শেষ দেখতে দক্ষিণ ভিয়েতনামে জড়ো হন নানা দেশের সাংবাদিক, আলোকচিত্রী, চিত্রনির্মাতা। বিবিসি বা আইটি এনের যে-সংবাদপাঠককে আজ টেলিভিশনে দেখলাম, দু-দিন পর দেখি তিনি নমপেন বা হুয়া বা সায়গন থেকে সরাসরি খবর দিচ্ছেন। এপ্রিলের ৩০ তারিখে সায়গনের পতন হলো–থিউ পালিয়ে গেলেন তাইওয়ানে, আমি টেলিভিশন সেটের সামনে ঠাই বসে রইলাম। এগারো বছরের যুদ্ধের অবসান–সোজা কথা নয়। সব শেষ হওয়ার পরে মনে হলো, ঢাকায় থাকলে আরো না কত আনন্দ করতে পারতাম! ভিয়েতনামের পক্ষে বিজয়-মিছিলে নিশ্চয় শরিক হতাম।
এ-সম্পর্কে অবশ্য কিছুদিন পর এক ভিন্ন ধরনের গল্প বললেন আমার শিক্ষক আবদুল ওয়াজেদ খান চৌধুরী। খুলনা জেলা স্কুলে তিনি যখন প্রধান শিক্ষক, তখন আমি তার ছাত্র ছিলাম। আমাদের পারিবারিক যোগাযোগ ছিল, তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল আমার বন্ধু মসিহুর রহমান তাঁর মেয়ে রেহানাকে বিয়ে করায়। তবে এই যোগাযোগের বাইরেই তিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার ছেলে মোরশেদ চৌধুরীর কাছে যাচ্ছেন চিকিৎসা করাতে–মোরশেদ ওয়াশিংটন ডিসিতে আমাদের দূতাবাসে অর্থনৈতিক কাউনসেলর। তার গ্রুপের রক্ত দুষ্প্রাপ্য বলে নিজের রক্তও চার ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছেন সঙ্গে। লন্ডনে যাত্রাবিরতি করতে হবে। ঢাকায় স্বজনেরা তাঁকে পরামর্শ। দিয়েছিল লন্ডনে আত্মীয়-বাড়িতে উঠতে। তিনি বলেন, এয়ারলাইনসের ব্যবস্থায় থাকবেন, আর যদি কারো বাড়ি উঠতে হয়, তাহলে আনিসের বাড়িতে উঠবেন। হিথরো বিমানবন্দরের কাছেই হোটেলে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে–এই হোটেলেই আমি একবার ছিলাম। হোটেল থেকে ফোন করেছেন আমাকে–আমি তখন বাড়ি নেই। ঘরে ফিরে যোগাযোগ করে ঠিক করলাম, পরদিন সকালেই আমি পৌঁছে যাবো ওঁর হোটেলে, তারপর উনি বিমানবন্দরে রওনা হলে ফিরবো।
গিয়ে দেখি, ঘরে বসে ব্রেকফাস্ট করেছেন তিনি তার থেকে কিছু খাবার জমিয়ে রেখেছেন আমার জন্যে। যত বলি, ‘আমি খেয়ে এসেছি, এখন খাবো না’, উনি সেকথা কানে নেন না। শেষে কিছু একটা মুখে দিয়ে খাবারের ট্রে দরজার বাইরে রেখে এলাম। ইত্যবসরে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তিনি খুলে দেবেন মনে করে একটু অপেক্ষা করলাম, শেষে দরজায় টোকা দিলাম। এখন তার গলা শুনতে পেলাম, ঘরের চাবি না নিয়ে বের হলে, এখন ঢুকবে কী করে!’ বললাম, ‘সার, আপনি খুলে দিন।’ তিনি বললেন, তাই তো, আমি তো ভিতরেই আছি। দরজা খুলে দিলেন।
আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা হলো। উনি একটা উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা করেছেন, লেখা শেষ হলে আমাকে পাঠাবেন–আমি যেন ভূমিকা লিখে দিই। অবশ্য শরীরের যা অবস্থা–সেই সুযোগ পাবেন কি না কে জানে! তখন ওঁর বয়স ৭৪ বছর, শরীর ভালো থাকছে না। নিজের অসুস্থতা ও চিকিৎসা। নিয়ে কিছু কৌতুককর কথা বললেন।
দেশের অবস্থাও ভালো নয় তাঁর মতে। সেই প্রসঙ্গেই গল্পটা করলেন। ভিয়েতনামের মুক্তি-উপলক্ষে বিজয়-মিছিল বেরিয়েছে ঢাকার রাস্তায়। পাশ দিয়ে যেতে যেতে রিকশাওয়ালা জানতে চাইছে আরোহীর কাছে : ‘কী হইছে ভিয়েতনামে?’
: ‘ভিয়েতনাম স্বাধীন হয়েছে।’
: ‘স্বাধীন হইছে? তাইলেই সারছে।’
১৭.
কমনওয়েলথ দিবস-উপলক্ষে ব্রিটেনের রানি এক বা একাধিক দিনে গার্ডেন পার্টি দেন তার প্রাসাদে। সেখানে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর লন্ডন–বাসী। অথবা প্রবাসী কিছু নাগরিককে আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রিতদের নাম সংগৃহীত হয় সেসব দেশের হাই কমিশন থেকে। এই সুবাদে সস্ত্রীক আমন্ত্রিত হলাম।
প্রথমে এলো সেন্ট জেমস প্যালেসে লর্ড চেম্বারলেনের দপ্তর থেকে টেলিফোন–নির্দিষ্ট দিনক্ষণে উপস্থিত থাকতে পারবো কি না। কারণ এই আমন্ত্রণগ্রহণ বা আমন্ত্রণগ্রহণে অপারগতাজ্ঞাপনের বিধি নেই। যেতে পারলেই আমন্ত্রণপত্র আসে–সেইসঙ্গে আসে কাপড়ে সাটার জন্যে আমন্ত্রিতদের নামলেখা ছোটো কার্ড। কোনো কারণে যেতে অপারগ হলে সেই ছোটো কার্ড সেন্ট জেমস প্যালেসে ফেরত পাঠিয়ে দিতে হয় লর্ড চেম্বারলেনের অফিসে।
আমন্ত্রণপত্র এলো। নির্দিষ্ট দিনে ফোন করে ট্যাকসি ডাকলাম, বললাম, মলে যাবো। ট্যাকসিতে ওঠার সময়ে ড্রাইভারের হাতে প্যালেসের স্টিকার দিয়ে বললাম, এটা লাগিয়ে নিন।
ড্রাইভার হাসলেন। বললেন, ট্যাকসি ডাকার সময়ে প্যালেসের কথা বলেন নি কেন?
বললাম, আপনারা ভাবতে পারতেন, কেউ মশকরা করছে, নাও আসতে পারতেন।
ড্রাইভারের হাসি আকর্ণ বিস্তৃত হলো। বললেন, আমিও কখনো বাকিংহাম প্যালেসের ভেতরে যাওয়ার সুযোগ পাইনি। আজ আপনাদের সুবাদে যাওয়া যাবে।
প্যালেসের চত্বরে গিয়ে ট্যাকসি ছাড়লাম। প্রাসাদের একতলা পেরিয়ে উদ্যানে পৌঁছোনো গেল। নানা দেশের লোকে ভরে গেছে জায়গাটা। কারো কারো সঙ্গে আলাপ শুরু করতেই রানি এসে পড়লেন, সঙ্গে প্রিন্স ফিলিপ।
একটু একটু বৃষ্টি আরম্ভ হলো। রানি নিজেই ছাতা খুললেন। আলাপ করলেন অনেকের সঙ্গে। প্রিন্স ফিলিপও কথাবার্তা বললেন।
বৃষ্টি ছাড়ল। চা-পান শেষ করে প্রত্যাবর্তন।
পুসিক্যাটের মতো রানির সঙ্গে দেখা করতে আমরা লন্ডনে যাইনি। দৈবাৎ দেখা হয়ে গেল।
১৮.
খুব সম্ভব নিমাই চট্টোপাধ্যায় আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ডেভিড চেভিটের। সে ইতালীয় বংশোদ্ভূত, যদিও তার জন্ম লন্ডনে, বয়সে আমার কয়েক বছরের ছোটো। আবাল্য তার অনুরাগ ছিল চিত্রাঙ্কনে, কাজেই লন্ডনের বিখ্যাত স্লেড স্কুল অফ ফাইন আর্টে সে ভর্তি হয়েছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে সে শিল্প ও শিল্পের ইতিহাস পড়িয়েছিল কয়েক বছর, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্সট্রা-মুরাল ডিপার্টমেন্টে খণ্ডকাল শিক্ষকতাও করেছিল। এক সময়ে সে ঠিক করে যে, লেখালিখিতেই সে সার্বক্ষণিক মনোযোগ দেবে। আমার সঙ্গে যখন তার আলাপ, তখন তার এই অবস্থা।
স্লেডের ছাত্রাবস্থায় রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিক উপলক্ষে লন্ডনে আয়োজিত রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার প্রদর্শনী দেখে ডেভিড খুব অভিভূত হয়। তার মনে হয়, এই চিত্রকর এবং তাঁর শিল্পকর্ম ভালো করে বুঝতে হলে তাঁর সাহিত্যকর্ম পাঠ। করতে হবে এবং তা অনুবাদে নয়, মূল ভাষায়। সে বাংলা শিখতে লেগে গেল। এবং কিছুকাল পরে রবীন্দ্রনাথ এবং তিরিশের কবিদের কবিতা অনুবাদ করতে শুরু করে দিলো। এর মধ্যে তার মন ঘুরে গিয়েছে পুরোপুরি সাহিত্যের দিকে, কবিতা লিখতেও আরম্ভ করেছে। ভাষাশিক্ষায় ডেভিডের স্বাভাবিক পটুত্ব ছিল। আমার সঙ্গে পরিচয়কালে সে ইংরেজি, ইতালীয়, ফরাসি, স্প্যানিশ, সংস্কৃত, বাংলা, ফারসি, তুর্কি জানতো। তার স্ত্রী ফউজিয়া মালয়েশিয়ার মেয়ে বলে মালয় ভাষাও খানিকটা শিখেছিল, যদিও তা জানতো বলে সে স্বীকার করতো না। একাধিক ভাষার কবিতা সে অনুবাদ করেছিল, বিশেষ করে, অক্টেভিও পাজের কবিতা। বিলেতের খ্যাতনামা প্রকাশনা-সংস্থা জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন লিমিটেড তার সম্পাদিত একটি বই প্রকাশ করে : The Shell and the Rain (লন্ডন, ১৯৭৩), এর উপ-শিরোনাম ছিল Poems from New India-তাতে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয়। চক্রবর্তী, সমর সেন, নরেশ গুহ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় দত্ত ও তারাপদ রায়ের কবিতার অনুবাদ ছিল নানাজনের করা, আর ছিল এ কে রামানুজন, নিসিম ইজিকিয়েল, আর পার্থসারথী, অরুণ কোসাটকার, তিলোত্তমা রাজন ও শনমুঘা সুব্বিয়ার মূলত ইংরেজি কবিতা, তামিল থেকে অনুবাদ দু-চারটি।
এটি যে ভারতীয় কবিতার প্রতিনিধিত্বমূলক সংকলন নয়, এই ঘোষণা দিয়েই বইটি শুরু হয়েছিল। সর্বতোভাবেই এটি ডেভিডের পড়া এবং ভালো লাগা কবিতার একটা নির্বাচিত সংগ্রহ। একথা বলতে সাহসের দরকার হয়, কেননা সে কে এমন যার ভালো-লাগার কবিতা পাঠযোগ্য বিবেচনা করবে পাঠক? ডেভিডের সে-সাহস ছিল। নিজের অনুবাদ সে এই সংকলনভুক্ত করেনি, কিন্তু দীর্ঘ একটি ভূমিকা লিখেছিল প্রধানত রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গৌণত আধুনিক বাংলা কবিতা-বিষয়েই, এবং এই ভূমিকাকে সে এই সংকলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করেছিল।
বইটি আমাকে উপহার দিয়ে ডেভিড মন্তব্য চেয়েছিল। আমার মনে প্রশ্ন ছিল–’নিউ ইন্ডিয়া সম্পর্কে, কবিতার নির্বাচন সম্পর্কে, বাংলা বইপত্রের মূল নাম না দিয়ে তার ইংরেজি অনুবাদ দেওয়া সম্পর্কে (যেমন, সবুজ পত্র না লিখে গ্রিন লিফ লেখা), কাজী নজরুল ইসলামের নামের প্রতিবর্ণীকরণ সম্পর্কে। ততদিনে আমাদের পরিচয় কিছু এগিয়েছে, যে-রাতে ফউজিয়াকে হাসপাতালে সেবিকার দায়িত্বপালন করতে হতো না, তেমন সময়ে তার রান্নার সুস্বাদ গ্রহণ করেছি। ডেভিড আমার দু-একটা আপত্তি গ্রাহ্য করেছে, প্রশংসাকে সৌজন্য বলে বিবেচনা করেছে, এবং প্রবলভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছে। একেবারে গল্পে-গল্পে ডেভিড যখন সংস্কৃতের সঙ্গে ফারসির, ফারসির সঙ্গে তুর্কির, ফরাসির সঙ্গে ইংরেজির এবং ইংরেজির সঙ্গে বাংলা কবিতার তুলনা করতো, তখন তা আমি মুগ্ধ হয়েই শুনেছি। পরে যে তার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেললাম, সে-ক্ষতি আমারই।
১৯.
স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ থেকে সে-বছর বোল্টন ছুটি নিয়েছেন, সুতরাং বাংলার ছাত্র মানেই তখন তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র। সংখ্যায় দুজন, উভয়েই ইংরেজ। তরুণীটি বাংলা শিখছে প্রাথমিক পর্যায়ে, তারাপদর কথায় মনে হলো, বেচারি হিমশিম খাচ্ছে বেশ। তরুণ সুদর্শন, দীর্ঘদেহী, আত্মপ্রত্যয়ী। নাম উইলিয়াম রাদিচে, পিএইচ ডি করছে মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য নিয়ে–অনুবাদ ও টীকাভাষ্য। অনুবাদ শুনে বোধহয় আমার ভ্রু কুঞ্চিত হয়েছিল, তারাপদ বললেন, ছেলেটি কবিও, তার মাও সাহিত্যচর্চা করেন, মায়ের দিক থেকে বোধহয় ইতালীয় বংশোদ্ভূত। রাদিচের সঙ্গে আমার দু-তিনবার দেখা হয়েছিল। স্বল্পক্ষণের আলাপেই প্রীত হয়েছিলাম। পরবর্তীকালে কবি হিসেবে, রবীন্দ্রনাথের গদ্যপদ্যের অনুবাদক হিসেবে, সাহিত্যসমালোচক হিসেবে তিনি যে এত সফল হবেন, তা তখন বোঝা যায়নি। তারাপদ দুঃখ করেছিলেন এই বলে যে, এমন ভালো ছেলেরও চাকরি-বাকরির কোনো ভবিষ্যৎ নেই ইংল্যান্ডে। ঘটনাপ্রবাহে তার আশঙ্কা মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। এখন তারাপদ নেই, বোল্টন নেই, রাদিচেই বাংলার ধ্বজা ধরে আছেন সোয়াসে এবং সারা যুক্তরাজ্যেই। জগতের বিদ্বজ্জনসভায় তিনি সর্বত্র সমাদৃত।
প্রফেসর রাইট একবার আমাকে নৈশভোজে নিয়ে গেলেন এক রেস্টুরেন্টে। বিভাগের আরো কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন সেখানে, কিন্তু বাংলার তারাপদ মুখোপাধ্যায় বা হিন্দির এস এম পাণ্ডে ছিলেন না। উপস্থিত শিক্ষকদের মধ্যে উর্দুর রাসেলের কথা বিশেষভাবে মনে আছে। তার চেয়েও বেশি মনে আছে নিজের এক ব্যর্থতার কথা। সোয়াস থেকে রেস্টুরেন্টে হেঁটে যাওয়ার পথে রাইট আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘সৌরেন্দ্র’ বলে কি কোনো শব্দ আছে, নাকি তা ‘সুরেন্দ্র’র বিকার? যখন বললাম, ও-দুটো পৃথক শব্দ, তখন তিনি তার অর্থ ও ব্যুৎপত্তি জানতে চাইলেন। সৌরের সোজা ইংরেজি ‘সোলার কথাটা কিছুতেই আর মনে এলো না। আমি বলি বিশ্বজগৎ, সূর্যসম্পর্কিত, ইত্যাদি ইত্যাদি। রেস্টুরেন্টে বসে রাইট তাঁর সহকর্মীদের একজনকে জানালেন, প্রফেসর আনিসুজ্জামান বলছেন, সৌরেন্দ্র একটি পৃথক শব্দ। তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়লেন, তাই নাকি? কী অর্থ তার? ব্যুৎপত্তি কী? আমি একইরকম উত্তর করি। বুঝতে পারি, বিষয়টা নিয়ে আগে কোনো আলোচনা হয়েছে, কিন্তু অভিধান না দেখে এতক্ষণ পরে আমাকে সাক্ষী মানা কেন? রাতের খাওয়াটাই নষ্ট হয়ে গেল। বিল দেওয়ার সময়ে বুঝলাম, ভোজটি সমবায়ী উদ্যাগের ফল, কিন্তু আমি যখন নিজের ভাগ দিতে চাইলাম, রাইট শশব্যস্ত হয়ে বললেন, না, না, তুমি আমাদের অতিথি। বিদায় নিয়ে মন খারাপ করেই ফিরতি পথে রওনা হলাম। টিউব ছাড়ার সময়ে ধাক্কা দেওয়ামাত্রই ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল ‘সসালার’। কিন্তু গল্পগুচ্ছের পোস্টমাস্টারের মতো ততক্ষণে আমারও নৌকার পালে বাতাস লেগেছে। পরদিন তারাপদর কাছে খেদের সঙ্গে সবটা বললাম, উনি পাত্তাই দিলেন না।
২০.
রাজেশ্বরী দত্তের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির পরে পারতপক্ষে সোয়াসে আর দুপুরে খেতাম না। তাছাড়া কাজ করছি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। তার উলটো দিকের ফুটপাতেই স্যান্ডউইচের এক দোকান। যে-দম্পতি সেটা চালান, তারা খুব সম্ভব ইতালীয় বংশোদ্ভূত। ওই দোকানে বসে খাওয়া যায়–তবে বসার জায়গা অল্প এবং দুপুরে বেজায় ভিড়। অনেকে খাবার কিনে লাইব্রেরির দোতলার একটা ঘরে–লাউঞ্জ বা কমনরুম যাই বলি না কেন, সেখানে–চলে আসতেন। ওই কক্ষে তখনো ধূমপান করা চলতো, পরে সে সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। যারা সঙ্গে করে খাবার নিয়ে আসতেন বাড়ি থেকে, তারাই এই ঘরটা বিশেষ করে ব্যবহার করতেন। বেলা তিনটের দিকে স্যান্ডউইচের দোকানটায় আরেক দফা আসা হতো–চা-কফি খেতে। আড্ডা দেওয়ার জন্যে এ-সময়টা ছিল প্রশস্ত। সেই আড্ডায় কিন্তু লেখাপড়াসংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে যেতো।
কাছাকাছি আরো দুটি জায়গায় খাওয়া চলতো। ইয়ং ভিক থিয়েটারে একটা কফিশপ ছিল। সেখানে খাবারের দাম একটু বেশি। ঘরে-তৈরি খাবারও সেখানে পাওয়া যেতো–সেসবের দাম আরেকটু বেশি, তবে তা খেতে সত্যিই ভালো। একটা গ্রিক রেস্টুরেন্ট ছিল–তার কেবাব-ইন-পিটা ছিল খুবই সুস্বাদু। সপ্তাহে একদিন হয়তো সেখানে খাওয়া যেতো, কেননা তার সবকিছুই ছিল মহার্ঘ, আর খাবার পরিবেশন করা হতো বলে মূল্যের অতিরিক্ত বকশিসও দিতে হতো। অনতিদূরে দুদিকে দুটি পাব ছিল–কিন্তু পাব-লাঞ্চ তখনো তেমন জুতসই ঠেকেনি, সোয়াসের কাছে এক পাবে তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দিন। দুই খেয়েছি মাত্র–সেখানে তাই যাওয়া হতো না।
গ্রীষ্মবকাশের সময়ে দেশবিদেশের নানা গবেষক এসে জুটতেন ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়াটা ছিল উপরি পাওনার মতো। এমনি করেই সেবারে দেখা হয়ে গেল আমার পুরোনো বন্ধু, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক, রোনাল্ড বি ইনডেনের সঙ্গে। সে ভালো বাংলা রপ্ত করেছিল এবং বাঙালিদের সঙ্গে সবসময়ে বাংলায় কথা বলতো। আমি সর্বদা টিউবে যাতায়াত করতাম, আর রন যতটা পারে টিউব এড়িয়ে চলতো। আমাকে বলতো, তুমি তো কেবল শেয়ালের গর্ত দিয়ে চলাফেরা। করো; লন্ডনের ওপরটা, তার আকাশটা, কখনো দেখেছ? আমাদের বাড়িতে এসে একবার সে জানতে চেয়েছিল, বেবীকে নিয়ে থিয়েটারে গেছি কি না। বেবী বলেছিল, বাচ্চাদের রেখে একসঙ্গে দুজনের যাওয়া অসুবিধে।’ রন বললো, ‘আপনি আনিসের সঙ্গে থিয়েটারে যাবেন–আমাকে একটু আগে জানাবেন, আমি এসে বাচ্চাদের দেখবো।’ এর উত্তরে বেবীকে হাসতে দেখে সে বললো, ‘ভাবছেন, ওদের রাখতে পারবো না? আমার এক ভাগ্নে আছে–মহা বদমাশ। সে পর্যন্ত আমার কাছে ঠিকমতো থাকে, আর আপনার ছেলেমেয়েরা তো দেখছি। খুবই লক্ষ্মী। ওদের আমি ঠিকই সামলাতে পারবো।’ রনকে আমরা খাটাইনি, তবে তার এমন করে স্বেচ্ছাসেবা দিতে চাওয়া আমাদের খুব ভালো লেগেছিল।
রন তখন তার দ্বিতীয় বই Kinship in Bengal নিয়ে কাজ করছিল। খসড়াটা আমাকে পড়তে দিয়ে মতামত চাইলো। বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রচলিত আত্মীয়তাবাচক শব্দগুলি সংগ্রহ করলো আমার থেকে। বাঙালি আত্মীয়তাবাচক শব্দের বাহুল্য ও পার্থক্য নিয়ে যদিও সে অনেকসময়ে হাসাহাসি করতো-মামাতো বোনের স্বামীর ভাগ্নেকে কী বলে’-জাতীয় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতো–তবু বেশ ধৈর্যসহকারে সে তার তালিকা তৈরি করেছিল।
রনের বিবেচনাশক্তি ও সৌজন্য–দুই ছিল অসাধারণ। একবার আমাদের বাসায় রাতে খেতে ডেকেছিলাম ব্রিটিশ কাউনসিলের যে-মহিলা আমাদের দেখশোনা করতেন, তাঁকে, অ্যাসোসিয়েশন অফ কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটির রেবেকা জেমস, আমার ব্রিটিশ বন্ধু ইয়েন মার্টিন ও রন ইনডেনকে। ক্যাথি রবার্টসকেও ডাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে ও তার স্বামী সেই সপ্তাহান্তে লন্ডনের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করে বসে আছে। অনেককাল আগে ক্যাথিকে লাঞ্চ খাইয়েছিলাম রেস্টুরেন্টে–সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সে বলে, ‘এই তো সেদিন খাওয়ালে। আমি বলি, ‘সে কি আর সেদিন! সে তো তোমার বিয়ের আগের ঘটনা। ওরা দাওয়াতে থাকতে পারলো না, রেবেকা জেমসও শেষ পর্যন্ত আসতে পারলেন না। বাকিরা এলেন।
তখনো আমার পানীয় নির্বাচনের জ্ঞান ও পরিবেশনের নৈপুণ্য–দুয়েরই অভাব ছিল। ওয়াইনের ব্যবস্থাই করিনি; শুল্কমুক্ত স্কচ ছিল আর পাড়ার দোকান থেকে কয়েক ক্যান বিয়ার এনে রেখেছিলাম, বড়ো বোতলে কোমল পানীয়। পানি খাওয়ার বড়ো গ্লাস ছিল কয়েকটা, তাতে বিয়ার দেওয়া চলতো। ছটা ওয়াইন গ্লাস ছিল–বি বি সি ক্লাবে প্রায়ই ওয়াইন গ্লাসে হুইস্কি দিতে দেখেছি, সেটা যে বিধেয় নয়, তা বুঝিনি। দেখা গেল, কেউই কোনো পানীয় নিচ্ছেন না। শেষ পর্যন্ত কেবল রনই ‘তুমি নাও’ বলে এক ক্যান বিয়ার ঢেলে নিলো। পরে মনে হয়েছিল, ব্যবস্থার অপ্রতুলতা টের পেয়ে পরে যদি আমি লজ্জিত হই, সেজন্যেই সে তা করেছিল।
আগে বলেছি, ইয়েন মার্টিন লেবার পার্টিতে সক্রিয় ছিল। ওই দলের মধ্যেই সে ছিল বাম মার্গের। ব্রিটিশ কাউনসিলের ভদ্রমহিলা কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থক না হলেও তুলনায় রক্ষণশীল। ব্রিটেনের অর্থনীতির আলোচনা উঠে যাওয়ায় কথাটা বোঝা গেল। আমি ইচ্ছে করেই আবহাওয়াটা লঘু করতে চাইলাম। বললাম, সোয়াসের এক ছাত্র বলছিল, তার বাবার পাবলিক হাউজ খুব ভালো চলছে। ভদ্রমহিলা তখন ব্রিটেনের অর্থনীতি সম্পর্কে আমার। পর্যবেক্ষণ কী, তা জানতে চাইলেন। আমি বিপদে পড়ে গেলাম। বললাম, এত অল্প সময়ে এত সামান্য দেখে মতামত দেওয়া যায় না। আর একটা পাব ভালো চলছে বলে অর্থনীতিও মজবুত বলা চলে না। সবটা সামাল দিলোরন। সে ধীরে ধীরে পুরো আলোচনাটাই বিতর্কের বাইরে নিয়ে গেল।
তবে যেসব বিষয়ে রনের নিজস্ব চিন্তাভাবনা ছিল, সেসব বিষয়ে মতপ্রকাশে তার দ্বিধা ছিল না।
২১.
লন্ডনে বেবীর চাচির সঙ্গে সাক্ষাৎকার ছিল একটি স্মরণীয় ঘটনা। তবে সেটা বলার আগে চাচির পরিচয়টা ঠিকমতো তুলে ধরা দরকার।
বেবীর একমাত্র চাচা আবদুল আহাদ ছিলেন সলিসিটর, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় অর ডিগন্যাম অ্যান্ড কোম্পানি নামের আইন ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। এদেশে শিল্পোদ্যাগের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন এবং সেই সুবাদে পাকিস্তান চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইনডাস্ট্রিজের সভাপতি হয়েছিলেন, একাধিকবার পাকিস্তানের বাণিজ্য-প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিদেশে। তিনি প্রথমে বিয়ে করেন হুসনা শেখকে। চাচির বাবা ছিলেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের লোক, চল্লিশের দশকে কলকাতার নিউ মার্কেটের সুপারিন্টেনডেন্ট ছিলেন। চাচা ও চাচির পরিচয় হয় কলকাতায়, পরে তারা বিয়ে করে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন, এখানে তাঁদের দুই মেয়ের জন্ম হয়। বেবীর সব ভাইবোনকে চাচা-চাচি খুব ভালোবাসতেন, বিয়ের পরে আমিও তাদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছি। চাচির সঙ্গে আমাদের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাংলা শিখতে গিয়ে তিনি বর্ণমালায় হোঁচট খেতেন এবং আমার কাছে প্রতিকার চাইতেন। ষাটের দশকের শেষদিকে চাচা-চাচির বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে মেয়েদের নিয়ে চাচি চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। চাচা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদক ও সাহিত্য-সমালোচক এবং Poems from East Bengal (করাচি, ১৯৫৪) গ্রন্থের সম্পাদক ইউসুফ জামাল বেগম ওরফে ড. ফয়জুননেসা ওরফে রোজী মুসাকে–তার প্রথম স্বামী মুহম্মদ হোসেন ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। চাচার দ্বিতীয় বিয়ের পরও চাচি বলতে আমরা হুসনা শেখকেই বুঝতাম এবং নতুন চাচিকে উল্লেখ করতাম রোজী চাচি বলে। আইনব্যবসার সূত্রে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে চাচার ঘনিষ্ঠতা ছিল, তার সূত্রে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও তার অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। এ কে এম আহসান ও সানাউল হকের মতো আমলা এবং শওকত ওসমান ও সিকান্দার আবু জাফরের মতো সাহিত্যিকের সঙ্গেও চাচার বন্ধুত্ব ছিল। পরে জেনেছি, আওয়ামী লীগকে তিনি নিয়মিত অর্থসাহায্য করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়-এ সময়কার কোনো কথা তিনি নিকটজনের কাছেও প্রকাশ করেননি। তারপর আবার অফিস থেকে নিয়ে গিয়ে তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে রাখা হয় এবং, যতটুকু জানা যায়, সেখানেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
হুসনা চাচির বোন লন্ডনে বাস করতেন সপরিবারে। তার কাছ থেকে একদিন খবর পাওয়া গেল যে, চাচি লন্ডনের এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কালবিলম্ব না করে বেবী ও আমি তাঁকে দেখতে গেলাম। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বেবী ও চাচির সে কী কান্না! বহুবছরে, বিশেষত, চাচার মৃত্যুর পর সেই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎকার। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বোনের বাসায় গেলেন চাচি। তারপর দুই বোন মিলে সারাটা দিন কাটাতে এলেন আমাদের বাসায়। আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থেকে আমি তাঁদের নিয়ে এলাম, আবার দিনশেষে সেখানেই বিদায় দিলাম! চাচির আচরণ থেকে কারো বোঝার উপায় ছিল না। যে, যে-স্বামীর সঙ্গে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন, তাঁরই ভ্রাতুস্পুত্রীর সঙ্গে তিনি সময় কাটাচ্ছেন।
বইপত্রে পড়েছি, হুসনা শেখ পরে হয়েছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর তৃতীয় স্ত্রী। এ-সম্পর্কে আমাদের প্রত্যক্ষ কোনো জ্ঞান নেই। তবে চাচির বড়ো মেয়ের বিয়েতে যোগ দিতে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি যখন করাচি গিয়েছিলেন, চাচি তাদের বিমানবন্দরে নিতে এবং পৌঁছোতে এসেছিলেন–তখন তাঁরা যে-আমার শ্বশুরের অপ্রত্যাশিত অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন, তাতে ধারণা হয়েছিল যে, সরকারের ওপরমহলে চাচির নিশ্চয় খুব প্রভাব আছে। আমার শুধু মনে হয়, ঘটনাটি সত্য হলে বলতে হবে, এই হতভাগ্য মহিলার দুই স্বামীই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। ভুট্টোর পতনের পরে চাচিকে অনেকদিন পাকিস্তান ছেড়ে থাকতে হয়েছিল, এ-কথা সত্যি।
চাচির সঙ্গে এখনো আমাদের একটা পরোক্ষ যোগ আছে। তার মেয়েদের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে, পারস্পরিক খোঁজখবরই নেওয়া হয়েছে বেশি।
২২.
লন্ডনে আমাদের সামাজিক জীবন আবর্তিত হতো মূলত প্রবাসী আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের কেন্দ্র করে। সপ্তাহান্তে একটি দিন ঘরবাড়ি গোছানো এবং আরেকটি দিন বেশির ভাগ অন্যত্র খেতে গিয়ে, কখনো অতিথি সৎকার করে কেটে যেতো। আমার ভাগ্নে মামুন এবং ভাগ্নে-বউ মীরা ভিন্ন ভিন্ন জায়গার হাসপাতালে চিকিৎসা করতো। সময় পেলে তারা কখনো একসঙ্গে, প্রায়ই একা একজন, আমাদের কাছে চলে আসততা। একবার ছুটির দিনে বিনা এত্তেলায়। মীরা চলে এসেছে–তখন আমাদের খাওয়াদাওয়ার পালা শেষ। আমি এক দৌড়ে পাড়ার চীনা রেস্তোরাঁ থেকে খাবার নিয়ে এলাম তার জন্যে। পরিবেশন করতে গিয়ে শুনলাম, সে এসব খাবে না, কেননা চীনা খাবারে অভক্ষ্য থাকে। এতক্ষণ ধরে ঘরেও কিছু বানাবার চেষ্টা হয়নি বাইরের খাবারের ভরসায়। মীরার প্রত্যাখ্যানের পরে যথাসম্ভব দ্রুত কিছু তৈরি করা হলো বটে, কিন্তু সব। মিলিয়ে দেরি হয়ে গেল অনেক।
আরেকবার এরকম বিব্রত হয়েছিলাম মনসুর ভাইদের নিয়ে। মনসুর ভাই সম্পর্কে বেবীর নানা, কিন্তু তাঁকে আমরা ভাই ডাকি। তিনি এসেছেন দুই মেয়ে নিয়ে। তার শ্যালক হায়দার ও তার স্ত্রী হুসনা এবং ওদের ছোটো দুই মেয়ে রুনা-রুমাও আছে। খেতে খেতে মনসুর ভাই বললেন বেবীকে, ‘গরুর গোসতটা খুব ভালো কোত্থেকে এনেছ?’ বেবী বললো, ‘পাড়ার বুচারের কাছ থেকে।’ অমনি মনসুর ভাই খাওয়া বন্ধ করে দিলেন, হাত সরিয়ে নিলেন প্লেট থেকে। আমরা দুঃখপ্রকাশ করি, তার খাওয়ার যোগ্য এটা-ওটা এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু তিনি আর খেতে পারেন না, তার খাওয়ার রুচি চলে গেছে। আমরা বিব্রত হই, এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তিরিশ বছর আগে লন্ডনে হালাল গোশত এত সুলভ ছিল না-খুঁজে-পেতে আনতে হতো ইহুদির দোকান থেকে। খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে আমার সম্পর্কে মীরা হতাশ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বেবীকে সে খুব জোর দিয়ে বলতো, রুচি-শুচির স্কুলে যেন বলে দেওয়া হয় খাওয়ার বিধিনিষেধ সম্পর্কে–দুপুরবেলায় ওরা তো স্কুল ডিনার খায়!
মনসুর ভাইয়ের বাড়িতে আমরা খেতে গেছি, আমার বন্ধু মোহাম্মদ আলীর বোন নার্গিস ও তার স্বামী শাহাদাঁতের আতিথ্যস্বীকার করেছি, গেছি রউফদের ঘরে। বেশি খাওয়া হতো হুসনা-হায়দার দম্পতির এবং আমার ছাত্রী মর্জিনা ও তার স্বামী শাহাবুদ্দীনের বাড়িতে। এদের প্রায় সকলের সঙ্গেই মামুনদের ভালো যোগাযোগ ছিল। মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে মামুনরাও হতো তাদের অতিথি। মর্জিনাদের ওখানে গেলে চেষ্টা হতো খাওয়াদাওয়া সেরে তিন পরিবার মিলে কোনো পার্কে যাওয়ার। ছবি তোলার শখ ছিল শাহাবুদ্দীনের। তিনি অজস্র ছবি তুলতেন আমাদের–বিশেষ করে আনন্দের। মর্জিনার সন্তানদের তখনো জন্ম হয়নি–তাদের বাৎসল্যের সবটাই লাভ করেছিল আনন্দ। ছবি ছাড়া শাহাবুদ্দীনের যে-সংগ্রহ দেখে আমি খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম, তা হলো ১৯৭১ সালের লন্ডনের ইংরেজি সংবাদপত্রের–কী না যত্ন করে তিনি তা রক্ষা করতেন! এতবার বাড়ি-বদলের পরেও এখনো সে-সংগ্রহ তিনি সযত্নে ধরে রেখেছেন।
হাসি-হাসি মুখ করে বেড়াতে আসততা টুলু-বেবীর ফুপাতো ভাই। ডাকনাম-ব্যবহারে তার ভারি আপত্তি, পরিচয় করিয়ে দিতে হবে কাজী কামালউদ্দীন বলে, অন্তত কামাল বলে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়, তার নিবন্ধে, সোনালী ব্যাংকের লন্ডন শাখায় দশ পাউন্ড দিয়ে একটা হিসাব খুলেছিলাম, তা কোনোদিন পরিচালনা করা হয়নি। মাঝে মাঝে মনে হয়, সুদসুদ্ধ ওই দশ পাউন্ড টুলুর থেকে আদায় করে নিই, কিন্তু সে–এবং পরে আমার শালাজ–যে-সার্ভিস দিয়েছে, তার চার্জ অনেক হবে ভেবে পিছিয়ে পড়ি।
আমার মামাতো বোন হালিমার ছেলে সাদেক আমাদের সঙ্গে থাকতে এলে সবাই খুব আনন্দ পেতো। একটা ব্রিটিশ বৃত্তি নিয়ে সে স্কুলে পড়তো সে-দেশে। ছুটির সময়ে সে আপেল তুলতে যেতো কিছু রোজগার করতে। তারই মধ্যে সময় বাঁচিয়ে সে চলে আসততা আমাদের কাছে এবং এসে কতো না সাহায্য করতো বেবীর কাজে। সকালে-বিকেলে বাচ্চাদের স্কুলে নেওয়া এবং সেখান থেকে আনা, তাদের সঙ্গে সময় দেওয়া, রান্নাঘরে বেবীকে সহায়তা করা–এসব তো ছিলই। রাতে খেয়েদেয়ে বাসনকোশন হাঁড়িকুড়ি ভিজিয়ে রাখা থাকতো–সকালে আমাদের ঘুম থেকে ওঠার আগেই দেখা যেতো, সাদেক সব নিজের হাতে ধুয়ে পরিষ্কার করে রেখেছে। তার স্বভাব এমনই মিষ্টি যে, সে কাছে থাকলেই ভালো লাগতো। সে ছিল আপনের চেয়ে অধিক।
কিছুকাল পর মামুন একদিন বললো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রাক্তন সহকর্মী ডা. মাসুদুর রহমানের বাসস্থানের খুব দরকার হয়ে পড়েছে হঠাই। দোতলার ছোটো ঘরটা মাসুদ ও স্নিগ্ধাকে দিলে ভালো হয়। মাসুদ যখন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে প্যাথলজি বিভাগে কর্মরত ছিলেন, তখন এক গভীর রাতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল অফিসার ডা. কে এম আখতারুজ্জামান তাঁকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গেছিলেন ল্যাবরেটরিতে রুচির রক্তপরীক্ষার জন্যে এবং সে-পরীক্ষার ফলাফল তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মুখে মুখে জানিয়েছিলেন–লিখে দেওয়ারও সময় পাননি, তাতেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল যে রুচি অ্যাপেনডিসাইটিসে আক্রান্ত। তাকে তদ্দণ্ডেই হাসপাতালে ভর্তি করে পরদিন সকালে তার অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। স্নিগ্ধাও ডাক্তার–দিনাজপুরের বামপন্থী নেতা, তেভাগা-আন্দোলনের মহানায়ক, বরদা চক্রবর্তীর কন্যা। আমরা প্রথমে ধরে নিয়েছিলাম, তাঁরা অতিথি হিসেবে কয়েকদিন থেকে অন্যত্র বাসস্থান খুঁজে নেবেন। পরে ওই একটি ঘরেই তারা অনেকদিন রয়ে গেলেন বাড়িভাড়া ভাগ করে নিয়ে এবং যথেষ্ট বিবেচনাশক্তির পরিচয় দিয়ে।
লন্ডনের বাইরে একাধিকবার যাওয়া হয়েছিল লিডসে–আবদুল মোমেন ও ওসমান জামালদের টানে। সেখানে অন্য বন্ধুদের সমাগম হতো–তার কথা কিছু কিছু আগে বলেছি। কামাল হোসেনদের কারণে অক্সফোর্ডে বেশ ঘন ঘনই যাওয়া হতো। সেখানে কামাল হোসেন, তপন রায়চৌধুরী এবং তাঁর অধীনে গবেষণারত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহকর্মী রফিউদ্দীন আহমদকে আমি আখ্যা দিয়েছিলাম বরিশালের ত্রিভুজ বলে। অচিরেই ড. নূরুল ইসলাম অক্সফোর্ডে এসে যোগ দেওয়ায় পরিচিতের গণ্ডি একটু বাড়লো। ইতিহাসের তরুণ গবেষক গওহর রিজভির সঙ্গে আমার হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাছাড়া আইন-অধ্যয়নরত আরেক তরুণ তওফিক নওয়াজ ছিলেন এবং, সময়ের ভুল না হলে, আবুল হাসান চৌধুরী ওরফে কায়সারও।
অকস্ফোর্ডের কথায় একটা ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। আমরা যখন লন্ডনে তখন বেনজির ভুট্টো অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সেক্রেটারি। তার উদ্যোগে, পাকিস্তান সরকারের সক্রিয় প্রয়াসে, এবং পাকিস্তানের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন বিদ্বজ্জন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সমর্থনে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে অক্সফোর্ডের সম্মানসূচক ডিলিট দেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপিত হলো। ভুট্টো অক্সফোর্ডের প্রাক্তন ছাত্র–এখন একটি দেশের প্রেসিডেন্ট, সুতরাং এ মর্যাদা তাঁর প্রাপ্য, এ যুক্তি এক পক্ষের। প্রফেসর গমব্রিকের নেতৃত্বে অক্সফোর্ডের অধ্যাপকদের এক বড়ো অংশ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন–১৯৭১ সালে তাঁর গণতন্ত্রবিরোধী আচরণের এবং বাংলাদেশের গণহত্যায় তার ভূমিকার কারণে। তাঁরা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন। কামাল হোসেন এবং তপন রায়চৌধুরী ভুট্টোবিরোধী আন্দোলনে যথেষ্ট শক্তি ও সময় ব্যয় করেছিলেন। পাকিস্তানি শিবির থেকে এমনও বলা হয়েছিল যে, ভুট্টোবিরোধী প্রচারণা চালাতেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অক্সফোর্ডে এসে অ্যাকাডেমিক সাজ পরেছেন। শেষ পর্যন্ত ভোটাভুটিতে ভুট্টোকে ডিগ্রি দেওয়ার প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেল।
আগের কথায় ফিরে যাই। আমাদের সামাজিক মেলামেশার কথা বলছিলাম। সপরিবারে আমাদের আরেকটি যাওয়ার জায়গা ছিল কেন্ট–অর্থনীতিবিদ আজিজুর রহমান খান সেখানে থাকতেন, আর থাকতো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের বন্ধু ওবায়েদ জায়গীরদার। ওবায়েদের বাড়িতে একবার দেখা হয়ে গিয়েছিল সার আজিজুল হকের পুত্র ক্যাপ্টেন আহসানুল হকের সঙ্গে। তিনি আমার শ্বশুরকে জানতেন বলে বেবীর সঙ্গে অনেক গল্প করেছিলেন এবং রুচির সঙ্গেও আলাপে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন।
আমার বিলেত-যাত্রার আগে রশিদ চৌধুরী একদিন তার দুটি ট্যাপেস্ট্রি মুড়ে নিয়ে এসে আমার হাতে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘সপরিবারে বিদেশ-বিভুয়ে যাচ্ছেন–টাকা-পয়সার দরকার হবে। কিছু মনে করবেন না, এ-ট্যাপেস্ট্রি দুটি ওবায়েদকে দেবেন, ও বিক্রি করে আপনাকে টাকা পৌঁছে দেবে।’ রশিদের এই বদান্যতায় আমি এত অভিভূত হয়েছিলাম যে, অনুভূত কুণ্ঠাও প্রকাশ করতে পারিনি। লন্ডনে যাওয়ার পরে ওবায়েদ জায়গীরদার একদিন আমার বাড়ি থেকে ট্যাপেস্ট্রিগুলো নিয়ে গিয়েছিল এবং বেশ কিছুকাল পরে বাড়ি এসে ১০০ পাউন্ড দিয়ে গিয়েছিল। পরে মূল্যের পরিমাণ শুনে রশিদ বলেছিলেন, তিনি আরেকটু বেশি অর্থাগম প্রত্যাশা করেছিলেন; আমি তাকে জানিয়েছিলাম, ওবায়েদ বলেছিল, ছবি বিক্রির বাজার এখন ভালো নয়। বেশি হোক, কম হোক, অর্থটা যে কাজে এসেছিল, তা বলা বাহুল্য এবং সব ব্যাপারটার পেছনে রশিদের যে ভাবনাটুকু কাজ করেছিল, তার দাম ছবির নগদ মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি।
আর-দশজন পর্যটকের মতো লন্ডনের যা দর্শনীয়, তার যতটা পারা যায়, সপরিবারে দেখা হয়েছিল ধীরে ধীরে। বরাবরের মতো কেনাকাটা যা করার বেবীই করেছে। আমি নিজের জিনিসপত্র কিছু কিনেছি, আর দরজি দিয়ে একটা কালো স্যুট বানিয়েছি। বেবী আর আমি হারডসের দোকান দেখতে গিয়েছিলাম একসঙ্গে–আমি কিনেছিলাম একটা টাই, আর সে একটা তোয়ালে। এই ছিল বিলাসিতার সীমা। সিনেমা-থিয়েটারে একসঙ্গে গেছি, তবে খুব বেশি নয়, আমি একাই গেছি বেশি। বাঙালিদের কিছু অনুষ্ঠানে আমরা একসঙ্গে গেছি। কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটে সেবার বাংলা নববর্ষ উদ্যাপিত হয়েছিল সাড়ম্বরে। সেখানে সপরিবারে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। বইয়ের দোকানে নিজে যথেষ্ট গেছি–লন্ডনে তো বটেই, অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজেও, এর মধ্যে কেমব্রিজের বইয়ের দোকানই আমাকে আকর্ষণ করেছে অধিক। লন্ডনের পুরোনো বইয়ের দোকান বরঞ্চ হতাশই করেছে। ফয়েলসে ততদিনে পুরোনো বইয়ের জায়গা নিতে শুরু করে দিয়েছে নতুন বই।
সপরিবারে আসা-যাওয়ার পথে একবার বিপদেই পড়েছিলাম। টিউবে সবাই উঠতে-না-উঠতেই গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। অনতিতরুণ দুই শ্বেতাঙ্গ নিজেদের সর্বশরীর ও সর্বশক্তি দিয়ে দরজা আগলে থাকায় কনডাক্টর-গার্ড আবার দরজা খুলতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং সেই সুযোগে যারা গাড়িতে উঠতে পারিনি, তারা উঠে পড়েছিলাম। আমাদের উদ্ধারকারীদের ধন্যবাদ দিতে একজন তিন সন্তানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিল, ‘তোমার দু-হাত ভরা ছিল।’ আরেকজন বলেছিল, এরকম ঘটলে ঘাবড়ে যেও না। যারা গাড়িতে উঠে পড়েছ, তারা পরের স্টেশনের প্ল্যাটফরমে নেমে অপেক্ষা কোরো। যারা উঠতে পারোনি, তারা পরের গাড়িতে গিয়ে সেখানে ওদের সঙ্গে মিলিত হোয়য়া।
কাজের সূত্রে পরিচয় বাড়ছিল এক-আধজনের সঙ্গে। তার মধ্যে একজন ছিল আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের কৃষ্ণাঙ্গ টিকিট-চেকার। আমি ত্রৈমাসিক টিকিট কিনতাম। তখন যাত্রার সময়ে টিকিট দেখাবার কোনো আবশ্যকতা ছিল না–ফেরার পথে স্টেশন থেকে বেরোবার মুহূর্তে দেখাতে হতো। অল্পকালের মধ্যেই বিশেষ করে সেই চেকারের সঙ্গে ভালো চেনা হয়ে গেল। ফলে, অনেক সময়ে তাকে টিকিট না দেখিয়ে কেবল অভিবাদন করেই বেরিয়ে আসতাম। একদিন সে আমায় ডেকে বললো, দেখো, আমি জানি, তোমার কোয়ার্টার্লি টিকেট আছে। কিন্তু সবাই তো জানে না। তুমি যখন ‘গুড ইভনিং’ বলে বেরিয়ে যাও, তখন কেউ ভাবতে পারে, তোমাকে ব্যক্তিগতভাবে খাতির করে আমি তোমার টিকেট চেক করছি না। এটুকু বলতেই আমি শশব্যস্ত হয়ে বললাম, এখন থেকে আর এই ভুল হবে না। সে হেসে বললো, আমি বুঝি, কথাটা তোমার মনে ওঠেনি। কিছু মনে কোরো না কিন্তু।
আমাদের বাড়িতে যে দুধ সরবরাহ করতো, আনন্দ তাকে মিকম্যান ভাই বলে ডাকতো। সে-ও খুব মজা পেতো এই ডাকে, ভাই কথাটার অর্থ তাকে ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়েছিল। সে এলেই আনন্দ ছুটে যেতো এবং ব্যস্ততা সত্ত্বেও সে আনন্দের জন্যে দু-মিনিট সময় ব্যয় করতো। তার সঙ্গে আনন্দের। ছবি তোলা হলে সাগ্রহে সে ছবির এক কপি চেয়ে নিয়েছিল।
প্রতি মাসে দু-তিন তারিখের মধ্যে দৈনিক পত্রিকার বিল শোধ করতাম বাড়ির কাছে নিউজস্ট্যান্ডে গিয়ে। এর মালিক ছোটোখাটো দেখতে, বয়স্ক মানুষ, ককনি হওয়াই সম্ভবপর। বিল-পরিশোধের অবকাশে তার সঙ্গে কুশল-বিনিময় হতো, সামান্য দু-একটি কথা। যেদিন শেষ বিল দিতে যাই, সেদিন দেখি, বুড়োর চোখ ছলছল করছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নিশ্চয় দেশে ফিরে যেতে পেরে খুশি হবে, তাই না? আচ্ছা, বাংলাদেশ কি অনেকদূর? প্লেনে যেতে কতো ঘণ্টা লাগে? আমার সঙ্গে দোকান থেকে বেরিয়ে তিনি কয়েক কদম হাঁটলেন। তারপর আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে, আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘গড ব্লেস ইউ।’ তারপর চকিতে ফিরে গেলেন।
এখানে আরো একজনের কথা বলতে হয়।
মিস এলিজাবেথ ক্লার্কসন ছিলেন সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক। তিনি কিছুকাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন। সে-সময়ে একদিন ঈশ্বরদী বিমানবন্দর থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবাসে যেতে তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়। সেই সূত্র ধরে চট্টগ্রামে বেড়াতে এসে তিনি আমাদের অতিথি হন। ভদ্রমহিলার বয়স হয়েছে, কিন্তু খুবই রসিক তিনি। রাজশাহীর কোনো সহকর্মীর রহস্যময় আচরণ ও কথাবার্তার গল্প করে তিনি আমাদেরকে খুব হাসিয়েছিলেন। তিনি যখন চট্টগ্রামে আসেন, তখন আমাদের বিলাতযাত্রা একরকম স্থির হয়ে গেছে। তিনি জানালেন। যে, আমরা ইংল্যান্ডে যেতে যেতে তিনিও সেখানে ফিরে যাবেন এবং সনির্বন্ধ অনুরোধ করে গেলেন, আমরা যেন অবশ্যই সপরিবারে সোয়ানসিতে বেড়াতে যাই–সেখানে থাকার ব্যবস্থা উনি করে দেবেন।
লন্ডনে যাওয়ার পর আমরা টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি আর তিনি প্রায়ই টেলিফোন করে তার আমন্ত্রণের পুনরাবৃত্তি করেন। শেষ পর্যন্ত আমরা সোয়ানসিতে যেতে পারিনি। এলিজাবেথ ক্লার্কসন যখন নিশ্চিত হন যে, আমরা যেতে পারছি না, তখন তিনি এক ছুটির দিনে লন্ডনে আসেন শুধু আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। আমাদের বাসায় চা খেয়ে তিনি আবার ফেরার পথ ধরেন। তার এই সহৃদয়তা যে আমাদের খুব স্পর্শ করেছিল, তা বলা বাহুল্য।
২৩.
মামুনের সঙ্গে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, দেশে ফেরার আগে তার গাড়ির সঙ্গে ট্রেলার লাগিয়ে আমরা দুই পরিবার একবার প্যারিস দেখে আসবো। সেরকম প্রস্তুতিও নেওয়া হলো খানিকটা। কিন্তু বাদ সাধলো মীরা। সে ওই অবকাশে নাদিরাদের বাড়ি যাবে মার্থার টিডফিল্ডে-ইচ্ছে করলে আমরা ওয়েলসে খানিকটা ঘুরে নিতে পারি। আমরা হতাশ হলাম–বিশেষ করে, বেবী, এবং রুচিও খানিকটা–সে স্কুলে ফরাসি ভাষার প্রাথমিক পাঠ নিচ্ছিল, ফলে প্যারিস সম্পর্কে তার একটা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। লন্ডনে নেমেই তো আমরা একবার ওয়েলসে এসেছি–আবার সেখানে কেন?
শেষ পর্যন্ত ওয়েলসেই যাওয়া হলো। প্রথমে মার্থার টিডফিল্ডে এবং পরে উত্তরদিকে উপসাগরের পাড় ঘেঁষে বাঙ্গোর প্রভৃতি স্থানে। বাঙ্গোর আমাদের বেশ ভালো লেগেছিল–সতার-না-জানা মানুষ সমুদ্রের উপকূলে যতটা দাপাদাপি করতে পারে, আমরা সকলে তা করলাম।
বাঙ্গোরে এক বাঙালি রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে দেখা গেল, বেয়ারা আমাকে ঠিকই শনাক্ত করেছে। নিজের পরিচিতি বঙ্গদেশ ছাড়িয়ে বাঙ্গোর পর্যন্ত পৌঁছেছে জেনে আত্মশ্লাঘা জাগলো। তারপরই রহস্যভেদ। লন্ডনের বাংলা সাপ্তাহিক জনমরে সাম্প্রতিকতম সংখ্যার একটি সচিত্র প্রতিবেদনে আমি অন্তর্ভুক্ত। তা সত্ত্বেও কিংবা সে-কারণেই রেস্টুরেন্টে বেশ খাতির পাওয়া গেল।
লন্ডনে ফিরে এসে বিদায় নেওয়ার পালা। খাওয়া-দাওয়ার এক-আধটা আয়োজন নিজের বাড়িতেও করা হয়েছিল। তার একটিতে মিসেস জেমস আসতে পেরেছিলেন।
আমি চলে আসার আগে সোয়াসের ডাইরেক্টর প্রফেসর ফিলিপস একদিন মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের ছাত্রদের পড়াশোনার কথা তুলেছিলেন এবং একজন সম্পর্কে হতাশা ও বিরক্তি জ্ঞাপন করেছিলেন। ব্যাপারটা আমার খুব স্বাভাবিক মনে হয়নি। তিনি কি চেয়েছিলেন সেই ছাত্রকে আমি তার মনোভাব জ্ঞাপন করি? কিন্তু তার সঙ্গে যে আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই, তা আমি তাঁকে জানিয়েছিলাম। আমি অবশ্য শেষ পর্যন্ত কাউকেই কিছু বলার চেষ্টা করিনি।
২৪.
আগস্টের ১২ তারিখে সরকারি সফরে ড. কামাল হোসেনের যুগোস্লাভিয়া যাওয়ার কথা। তিনি লন্ডনে এলেন আগের দিন এবং এত্তেলা পাঠালেন। ১২ আগস্ট আমিও সবাইকে নিয়ে দেশে ফিরে যাবো।
কামাল আমাকে খুব করে অনুরোধ করলেন আর-কিছুদিন লন্ডনে থেকে যেতে। কারণটা এই : অক্সফোর্ডের সেন্ট অ্যান্থনিজ কলেজে বাংলাদেশ স্টাডিজের একটা চেয়ার সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছিল কিছুকাল ধরে–সেটা প্রায় চূড়ান্ত হয়ে এসেছে। কামালের খুব ইচ্ছা, ওই পদটা আমিই প্রথম লাভ করি, এবং তিনি মনে করেন, আমি লন্ডনে থেকে গেলে আমার মনোনয়ন পেতে অনেক সুবিধে হবে। আমি আব্বার অসুস্থতার কথা বললাম এবং আমার পক্ষে যে কোনো অবস্থাতেই আর প্রবাসে থেকে যাওয়া সম্ভবপর নয়, তা বোঝাবার চেষ্টা করলাম। কামাল একটু ক্ষুণ্ণ হলেন বটে, কিন্তু আমার কথা মেনে নিলেন।
তাঁর সঙ্গে দেশের অবস্থা সম্পর্কে বেশি কথা হলো না। তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েও যে বেশি স্বস্তিতে নেই, তা বোঝা যাচ্ছিল। তাছাড়া, দুদিন পর তো নিজেই দেশে ফিরে স্বচক্ষে সব দেখতে পাবো, তাকে বিব্রত করে আর কী লাভ!
ক্লাইভ রোডের যে-বাড়িতে আমরা থাকতাম, আমরা লন্ডন ছেড়ে আসার আগে তা ভাড়া নিতে এলেন হাসিনুর রেজা চৌধুরী। তাঁর অনুজ জামিলুর রেজা চৌধুরী আমাদের ঘনিষ্ঠ, হাসিনুর রেজার শ্বশুর এম এ বারীর (এককালে পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে বোর্ড ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান) পরিবারের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় দীর্ঘকালের। তিনি সঙ্গে নিয়ে এলেন এম এ লস্করকে। লস্কর সাহেবও আমার দীর্ঘকালের পরিচিত, এক সময়ে তিনি মতিঝিলের কো অপারেটিভ প্রেসের ম্যানেজার ছিলেন। শুনেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে চলে গিয়েছিলেন সউদি আরবে। সেখান থেকে এসেছিলেন ইংল্যান্ডে। বাড়িটা সম্ভবত তাঁরই দরকার ছিল। লস্কর সাহেব প্রথম সাক্ষাতে একটু বিব্রত হলেন, কিন্তু পুরোনো পরিচয়ের দাবিতে তা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় নিলেন না। বাড়িওয়ালা এলেন, সব ব্যবস্থা হয়ে গেল।
আমরা বাড়ি ছেড়ে এবং জাহাজে মালপত্র পাঠাবার ব্যবস্থা করে গিয়ে উঠলাম হায়দারের কাউনসিল-ফ্ল্যাটে, এক বিশাল বাড়ির ১৪ তলায়। কষ্ট যা হওয়ার তা হায়দার ও হুসনার হলো। আমরা কটা দিন আনন্দেই কাটালাম। আমাদের বিদায় দিতে মামুনও এলো লন্ডনে। তারপর দেশে ফেরার পালা।
হননের কাল
১.
১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেশে ফিরে এলাম। বিমানবন্দরে আত্মীয়স্বজন অনেকেই গিয়েছিলেন আমাদের আনতে। সেই সঙ্গে, একটু অবাক হয়েই দেখলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক-মনসুর মুসা, আবুল কাসেম ফজলুল হক, মোহাম্মদ আবু জাফর, আহমদ কবির–উপস্থিত। এরা সকলেই আমার প্রাক্তন ছাত্র। জানলাম, এরা আমার সঙ্গে কিছু পরামর্শ করতে চায়। বিকেলে এদের বাড়িতে আসতে বললাম।
আমাদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হতে পেরে আব্বা খুব খুশি হলেন। এপ্রিল মাস থেকে তিনি শয্যাশায়ী, ডাক্তারি করা আর সম্ভবপর হচ্ছে না। তাঁর শরীর ভেঙে পড়েনি, কিন্তু চোখেমুখে অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট। তিনি যে ক্যানসারে আক্রান্ত, তা তাঁকে জানানো হয়নি। বুকে কষ্ট অনুভব করেন, সে-কথাটিই বললেন।
বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা এলো। বাকশালে যোগ দিতে তাদের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে, তবে তারা যোগ দিতে চায় না। ওদিকে চাপও বাড়ছে, এ-অবস্থায় কী তাদের করা উচিত, সে-সম্পর্কে আমার পরামর্শ চায়। বললাম, বাকশালে আমি যোগ দেবো না। তাতে যদি আমার কিছু অসুবিধে হয়, তার জন্যে তোমাদের ভাবিকে প্রস্তুত থাকতে বলেছি। আশা করি বাকশালে যোগ না দিয়ে আমি থাকতে পারবো। দরকার হলে বঙ্গবন্ধুকে বলতে পারবো, দলে যোগ না দেওয়ার স্বাধীনতা আমাকে দিন–উনি সেই সুযোগটা আমাকে দেবেন বলে বিশ্বাস করি। তোমাদের সেই সুবিধে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি-অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
বুঝলাম, তাদের যেমন দলে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তেমনি দলে যোগ-না-দেওয়ার বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই তো সোৎসাহে যোগ দিচ্ছেন–যোগদানে অনিচ্ছুকদের সংখ্যা অল্প। আমাদের সহকর্মীদের অনেকে যোগ দিয়েছেন, অন্যেরা যাতে যোগ দেয়, তা নিশ্চিত করাও কেউ কেউ নিজের কর্তব্য বিবেচনা করছেন–এঁদের নিয়েই বিপদ। এই অবস্থায় বাইরে থেকে পরামর্শ দেওয়া সহজ নয়।
বাড়ির টেলিফোন কাজ করছে না। সুতরাং লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও পারছি না। সবাই মিলে একবার শ্বশুরবাড়ি ঘুরে এসেছি, এইমাত্র। অনেকদিন পর ফিরেছি, অসুস্থ বাপের সঙ্গেই নাহয় সময় কাটাই। কয়েকদিনের মধ্যেই তো চট্টগ্রামে চলে যাবো।
১৪ তারিখ এভাবে কাটলো। ১৫ তারিখ সকালে তখনো ঘুম থেকে উঠিনি। দরজায় করাঘাত করে আব্বা বললেন, ‘শেখ সাহেবকে মেরে ফেলেছে–রেডিওতে বলছে। সেই মুহূর্তের প্রতিক্রিয়া ভাষায় ব্যক্ত করা শক্ত। খুব বড়রকম শূন্যতা বোধ করেছিলাম, এটুকু শুধু বলতে পারি। পাকিস্তানিরা যা করতে সাহস করেনি, এ দেশে জাত কিছু লোক তা অনায়াসে করে ফেললো–ভাবতেও অবাক লাগে! খবরটা দেওয়ার সময়ে আব্বার কণ্ঠস্বরে দুঃখের আভাস ছিল না–তাতেও খুব ব্যথিত হয়েছিলাম।
বেতারের সামনে এসে বসলাম। মেজর ডালিমের উদ্ধত ঘোষণা শুনলাম। তারপর নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমাদের ভাষণ। দেশে সামরিক আইন জারি হয়েছে–তিনি সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। ভাষণ শেষ হলো ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ দিয়ে। অভ্যুত্থান যে পাকিস্তানপন্থীরা ঘটিয়েছে, এ যেন। তারই প্রকাশ্য ইঙ্গিত।
বঙ্গবন্ধু, আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মনির পরিবারের সবাই যে নিহত হয়েছেন, তা ধীরে ধীরে জানা গেল। প্রথম ধাক্কা সামলে নেওয়ার পরে আমার মনে হলো, কামাল হোসেনের পরিবার অরক্ষিত। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিয়ে চললাম কাকরাইলে বড়োবুর কাছে। রাস্তায় লোকজন কম, কিন্তু যারা চলাচল করছে, তাদের দেখে মনে হচ্ছে না, এমন ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। বড়োবুদের জিজ্ঞাসা করলাম, প্রয়োজন হলে কামালের পরিবারকে তাদের বাসায় এনে তোলা যাবে কি না। বড়োবু ও দুলাভাই নির্দ্বিধায় সম্মতি দিলেন। ওঁদের ওখান থেকে ফোন করে হামিদাকে বললাম, আমি আসছি। নিউ ইস্কাটন রোডে সরকারি কোনো সংস্থার অতিথি ভবনে কামালের সরকারি বাসস্থান। সেখানে পৌঁছে হামিদাকে বললাম, সরকারি বাড়িতে থাকা তাদের জন্যে নিরাপদ নয়। ঠাটারিবাজারে আমাদের বাড়িতে সুবিধের অভাব–কাকরাইলে আমার বোনের বাড়িতে বলে এসেছি, সেখানে তাঁদের নিয়ে যেতে চাই। নিরাপত্তার যে অভাব, তা অস্বীকার করলেন না হামিদা, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে তাঁর শাশুড়ি আছেন–তাঁকে অন্য কোথাও যেতে রাজি করানো যাবে না।
কামালের মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, পরিস্থিতির বাস্তবতা তাকে বোঝানো সম্ভবপর নয়।
এমন সময়ে কামালের মামাতো ভাই সৈয়দ আলী কবীর এলেন। তিনিও এসেছেন সকলকে নিয়ে যেতে। হামিদাকে বললেন দ্রুত গুছিয়ে নিতে; ফুফুকে বললেন, কোনো কথা নয়–একটা ব্যাগ বা স্যুটকেস গুছিয়ে নিন, কদিন আমার বাড়িতে থাকবেন। আমাকে বললেন, যদি আমার বাড়ি থেকে ওদের সরে যেতে হয় কোনো কারণে, তাহলে তোমাকে খবর দেবো। আমি সকলকে। রেখে চলে এলাম।
রাস্তা ধরে হাঁটছি আর রিকশার খোঁজ করছি। এমন সময়ে দেখি, সিভিল সার্ভিসের সদস্য এম এম রেজা আমাকে ডাকছেন তার রিকশায় উঠতে। উঠে পড়লাম। বললাম, নীলক্ষেতে যাবো, রাজ্জাক সারের বাসায়।
সেখানে যেতে যেতে অনেক কথা হলো দুজনে। ঘটনার আকস্মিকতা ও নির্মমতায় আমরা উভয়েই হতচকিত ও মর্মাহত। যে যা গুজব শুনেছি, তা। বিনিময় করলাম।
রাজ্জাক সাহেব আমাকে দেখে অবাক হলেন, জানতে চাইলেন কোত্থেকে আসছি। আমার জবাব শুনে বললেন, হামিদাদের কথা তারই আগে মনে। হওয়া উচিত ছিল। তাঁর ভ্রাতৃবধূ–আমাদের হেলু আপা–বললেন তাঁদের বাসায় ওঁদের নিয়ে আসতে। বললাম, আপাতত তার দরকার হচ্ছে না, পরে দেখা যাবে।
রাজ্জাক সাহেবের কাছে শুনলাম, আত্মীয়তার সূত্রে মেজর ডালিম গিয়েছিল তার ওখানে–ঘটনা ঘটিয়ে। তার সঙ্গে ছিল কর্নেল ফারুক। দেশের রাজনীতি অর্থনীতি বিষয়ে সারের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল ফারুক। সার বলেছিলেন, পয়সা খরচ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ছাত্রেরা তাঁর সঙ্গে এসব বিষয়ে। আলোচনা করে। তিনি শুধু শুধু একজনের সঙ্গে তা নিয়ে আলাপ করবেন কেন? তার যদি এতই জ্ঞানপিপাসা থাকে, নিউ মার্কেট থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির নোটবই কিনে নিলে সে লাভবান হবে।
ডালিম ও ফারুক যে সারের বাসায় এসেছিল, তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কোনো শিক্ষক–রাজ্জাক সাহেবেরই ছাত্র–কিছু অপপ্রচারণা চালিয়েছিল। হয়তো আরো কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়েছিলেন।
সারের বাসা থেকে বড়োবুকে ফোন করে জানালাম, তার বাড়িতে কেউ থাকতে যাচ্ছে না। বাড়ি ফিরতে বেশ দেরি হলো। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধান, বাংলাদেশ রাইফেলসের মহাপরিচালক, রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক, পুলিশের মহাপরিদর্শক বেতারযোগে নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন করলেন–বলা উচিত, আনুগত্য জ্ঞাপন করতে বাধ্য হলেন। মন্ত্রিসভা গঠিত হলো : মোহাম্মদউল্লাহ উপ-রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হলেন, আগের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা থেকে গেলেন, থাকলেন না সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ ও কোরবান আলী। বঙ্গবন্ধুর সময়ে চাকুরিচ্যুত নূরুল ইসলাম মঞ্জুর প্রতিমন্ত্রীর পদে প্রত্যাবর্তন করলেন। বেশির ভাগ মন্ত্রীকেও যে সেনাবাহিনীর সদস্যদের পাহারায় বঙ্গভবনে নেওয়া হয়েছিল, সে-খবরও পাওয়া গেল।
পরে সচিবালয়ে একদিন অর্থমন্ত্রী ড. এ আর মল্লিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। দুপুরের খাবার খেতে খেতে শোনালেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানের কাহিনি। মন্ত্রিত্ব নিয়ে আত্মগ্লানিতে ভুগছেন। দু হাত প্রসারিত করে বললেন, ‘মন্ত্রিত্ব যে করছি, মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর রক্ত আমার হাতে লেগে রয়েছে।’ চোখে তার অশ্রু।
১৬ আগস্টে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু সমাধিস্থ হন। হেলিকপ্টারযোগে লাশ নিয়ে গিয়ে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দাফন করা হয়। কীভাবে কাফনের কাপড় সংগৃহীত হয়, কীভাবে কাপড়-ধোওয়া সাবান দিয়ে তাকে গোসল করানো হয়, যারা তার দাফন সম্পন্ন করেছিলেন, সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের সঙ্গে কেমন দুর্ব্যবহার করেছিল, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মুখে তার বিবরণ শুনেছিলাম অনেকদিন পরে।
২.
আব্বার চিকিৎসার বিষয়ে একে একে কথা বললাম ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ডা. নূরুল ইসলামের সঙ্গে–তাঁদেরকে আমার কৃতজ্ঞতাও জানালাম। ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. ফজলুল হকও আব্বাকে দেখেছিলেন–তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনি বললেন, ক্যানসারের চিকিৎসা করে হয়তো ছ মাস থেকে এক বছর আব্বাকে টিকিয়ে রাখা যেতে পারে, কিন্তু এই বয়সে কেমোথেরাপি দিলে তিনি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় কষ্ট পাবেন। তবে সিদ্ধান্ত আমাদের। আব্বাকে যিনি নিত্য দেখেন, ড. করিম, তার সঙ্গে আমাদের আগেই কথা হয়েছিল।
আব্বা এখন থাকছেন বিয়ের আগে আমি যে-ঘরটায় থাকতাম, সেখানে। তার পাশের ঘরে যেখানে তিনি বরাবর থেকে এসেছেন, তার মেঝেতে পাটি পেতে আমরা পাঁচ ভাইবোন বসলাম সিদ্ধান্ত নিতে। আখতার প্রথম থেকেই বলতে থাকল, আমরা যা সিদ্ধান্ত নিই, তার সঙ্গে সে একমত হবে, তার কিছু বলার নেই। আমি বললাম, এই অবস্থায় কেমোথেরাপি না দিয়ে প্যালিয়েটিভ দেওয়াই ভালো হবে। ছোটোবু আমার সঙ্গে একমত হলো। মেজোবু একটু চিন্তা করে বললো, ‘চিকিৎসা করতে গিয়ে আব্বার কষ্ট বাড়ুক, তা আমি চাই না।’ বড়োবু কিছুই বলতে পারছিল না। মেজোবু কেঁদে ফেলে তাকে বললো, ‘তুমি চুপ করে থাকলে হবে না। তোমার যা ইচ্ছে তা খুলে বলতে হবে।’ আরো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বড়োবু বললো, তোমরা যা বলছ, তাই হোক।’ এবারে তিন বোনই কাঁদতে লাগলো। খানিকক্ষণ পরে সবাই উঠে দাঁড়ালাম। মনে হলো, আমরা সব ভাইবোন মিলে আব্বাকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম। আব্বাকে আমাদের সিদ্ধান্ত জানানো হলো–তিনি তা মেনে নিলেন। ডা. করিমকেও বললাম–তিনি তা অনুমোদন করলেন।
আব্বার কষ্ট ক্রমশ বাড়তে থাকল। তিনি একদিন আমাকে বললেন, আমার মনে হচ্ছে, আমার সমস্যা লাংসে, কিন্তু ডাক্তাররা বোধহয় সেটা ধরতে পারছে না। তারা এটা-ওটা করছে, কিন্তু রোগের চিকিৎসা করতে পারছে না।’
এ-কথা শুনে অশ্রু গোপন করা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।
বেবীদের ঢাকায় রেখে আমাকে চট্টগ্রামে এসে কর্তব্যকর্মে যোগ দিতে হলো। উঠলাম আবু হেনা মোস্তফা কামালের বাসায়। দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি-বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ভারতবিরোধী ও পাকিস্তানি ভাবাপন্ন কথাবার্তা প্রকাশ্যে বলতে কেউ আর এখন দ্বিধা করছেন না–আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীনের নিন্দাবাদ চলছে। আমি রুশ-ভারতের দালাল বলে অনেকের কাছে গণ্য হয়েছি, কেউ কেউ আমার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, কেউ কেউ বলছেন–আমি ভারত থেকে এসেছি, সেখানেই আমার ফিরে যাওয়া উচিত। স্বাধীনতালাভের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের স্বার্থহানির আশঙ্কায় যারা আমার আনুকূল্য প্রার্থনা করেছিলেন, দেখলাম, আমার প্রতি তাদেরই রোষ অধিক। এঁদের মধ্যে এমনো একজন ছিলেন, যার কোনো ক্ষতি যাতে না হয়, ১৯৭২ সালে আমি তা দেখেছিলাম।
চট্টগ্রামে গিয়ে আমি ড. আউয়ালের কাছ থেকে বিভাগের দায়িত্ব বুঝে নিলাম। তারপর উপাচার্যকে বললাম, আমি বিভাগের সভাপতির পদ ত্যাগ করতে চাই যাতে সৈয়দ আলী আহসান সভাপতি হতে পারেন। আবুল ফজল, মনে হলো, খুশিই হলেন। সৈয়দ আলী আহসানকে বলায় তিনি বললেন, তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে, প্রশাসনিক দায়িত্বে এতকাল অভ্যস্ত থেকে কেবল বিভাগের অধ্যাপক হয়ে থাকা তার জন্যে অস্বস্তিকর। তিনি সভাপতির দায়িত্ব পেয়ে খুশিই হলেন। শুধু ড. ইউনূস আমাকে কিঞ্চিৎ ভর্ৎসনা করলেন। বললেন, আপনার বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন আইনের স্পিরিট যাচাই করার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল–ওখানেই সিনিয়র থাকতে জুনিয়র বিভাগের দায়িত্ব পালন করছিলেন। আপনি সেটা নষ্ট করে দিলেন।
চট্টগ্রামে আমি একনাগাড়ে থাকতেও পারছিলাম না। ছুটিছাটা থাকলে তো ঢাকায় চলেই আসি–আব্বার অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা থেকে খবর যায়, আমি তদ্দণ্ডেই ঢাকা রওনা হই, এসব ক্ষেত্রে প্লেনেই। এমনো হয়েছে যে, ট্রেনে করে সকালে চট্টগ্রামে এসে পৌঁছেছি, বিকেলেই ঢাকা থেকে খবর গেল। আমি সন্ধ্যার ফ্লাইট ধরে ঢাকায় আবার ফিরে এসেছি।
শেষ কদিন খুব কষ্ট পেলেন আব্বা। হঠাৎ করে বুকের জ্বালা-যন্ত্রণায় শোওয়া-অবস্থা থেকে লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন। কিংবা মেঝেতে শুয়ে পড়তেন। আমাদের মামা সৈয়দ সাখাওয়াত আলী রোজ এসে দোয়া-দরুদ পড়ে যেতেন কিছুক্ষণ। আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, ‘দেখো, তোমার সাকা মামু যেন আমার জানাজা পড়ায়।
আব্বার অবস্থা জেনে আমার চাচাতো ভাই আমিনুজ্জামান খুলনা থেকে চলে এলো। আমরা পাঁচ ভাইবোন আর আমিন আবার সেই পাশের ঘরে পাটিতে বসেছি। মেজোবু কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘তোমরা সবাই মন থেকে আব্বাকে ছেড়ে দাও, তাহলে তার কষ্টের শেষ হবে। তারপর আমাদের একেকজনকে জিজ্ঞেস করে, ‘ছেড়েছ? কেউ হ্যাঁ বলে, কেউ চুপ করে থাকে। শেষে সে পড়ে বড়োবুকে নিয়ে : ‘তুমি ছাড়তে পারছ না বলে আব্বা যেতে পারছে না। ছেড়ে দাও, আব্বাকে ছেড়ে দাও।’ এক পর্যায়ে বড়োবু অস্ফুটস্বরে বলে, ‘দিলাম।
২৭ অক্টোবর ভোরে আব্বার শেষ নিশ্বাস পড়ল। খানিক পরেই আমাদের আলেম মামা সৈয়দ মজহার আলী–যিনি দীর্ঘকাল ঢাকা বেতারে কোরান তেলাওয়াত ও তরজমা পাঠ করতেন–এসে গেলেন কিছু না জেনেই।
বড়োবু হঠাৎ করেই তাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘লোকে যে বলে মরাবাড়িতে চার দিন চুলো জ্বালাতে নেই–এমন কোনো নিয়ম আছে?’
মামা বললেন, মানুষ শোকগ্রস্ত থাকে বলে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করে উঠতে পারে না–আত্মীয়-প্রতিবেশীরা খাবার পাঠায়। পারলে নিজেদেরই রান্নাবান্না করা ভালো। চুলো জ্বলল। আমরা চা খেলাম। আমি টেলিফোন নিয়ে বসলাম খবর দিতে। আহমদ এসে বেতারে খবর প্রচারের ব্যবস্থা করলো। নেয়ামাল এসে আব্বার মৃত্যুসংবাদ লিখতে বসলো। সে কিছু তথ্য চায়। আমি বললাম, ‘আমিই বরঞ্চ লিখি।’ লিখলাম, নেয়ামাল কপি করলো। আবুল হাসনাত, হায়াৎ মামুদ–এরা সব কাগজে খবর পৌঁছোনোর দায়িত্ব নিল। একদিন পর দৈনিক বাংলায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ আব্বা সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘একজন সাহিত্যানুরাগী চিকিৎসক’ নামে একটি চমৎকার স্মৃতিকথা।
বায়তুল মোকাররমে বাদ জোহর জানাজা। নারিন্দার পীর নজরে ইমাম সাহেব জানিয়েছেন, উনি আসবেন জানাজায় শরিক হতে। তার শ্বশুর পীর আবদুস সালামের সময় থেকে ওই পরিবারের সঙ্গে আব্বার সৌহার্দ্য। প্রয়োজনে তারা আব্বার ওষুধ খান, আব্বা তাদের দোয়া চান। পীর সাহেব আসছেন জেনে সাকা মামুর সংকোচের শেষ নেই। তিনি পীর সাহেবের মুরিদ, পীর সাহেবকে কাতারবন্দি করে তিনি নামাজ পড়াবেন কী করে, পীর সাহেবকে কথাটা বলবেই বা কে?
আমিই বললাম। পীর সাহেব অতি সজ্জন, সৌজন্যপরায়ণ, মহানুভব। বললেন, এটা আপনার আব্বার ওয়াসিয়ত–তাই করতে হবে।’ তিনিই মামাকে ডেকে বললেন জানাজা পড়াতে।
আজিমপুর গোরস্থানে মায়ের কবরের পাশে আব্বা নিজের জন্যে জায়গা কিনে রেখেছিলেন। সেখানেই তাঁর মাটি হলো।
কুলখানির পরদিন রাতের ট্রেনে রওনা হয়ে ১ নভেম্বর সকালে চট্টগ্রামে। পৌঁছলাম। ততদিনে ক্যাম্পাসে আমার নামে বাড়ির বরাদ্দ পেয়ে গেছি।
স্টেশনে পরিচিত কে-একজন জানতে চাইলেন, ঢাকা থেকে কী খবর নিয়ে এসেছেন? ৩ তারিখে নাকি কু হচ্ছে?
পালটা প্রশ্ন করলাম, ‘অগ্রিম তারিখ জানিয়ে কু্য হয় নাকি?
৩.
বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর থেকে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক জীবনে কোনো না কোনো ঘটনা ঘটছে। বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরদিনই নতুন সরকারকে সমর্থন জানিয়ে মওলানা ভাসানী বার্তা পাঠালেন। কয়েকদিনের মধ্যে সউদি আরব ও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ, কোরবান আলী প্রমুখ। নেতা প্রথমে এবং জিল্লুর রহমান, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক প্রভৃতি পরে গ্রেপ্তার হলেন। জেনারেল এম এ জি ওসমানী রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নিযুক্ত হলেন; জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ ও এয়ার ভাইস-মার্শাল এ কে খন্দকার রাষ্ট্রদূত হলেন; মেজর-জেনারেল জিয়াউর রহমান হলেন সেনাবাহিনীর প্রধান। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গভবনে সংসদ সদস্যদের সভা আহ্বান করলেন রাষ্ট্রপতি–সেখানে নাস্তানাবুদ হলেন তিনি। কাদের সিদ্দিকী অস্ত্র হাতে তুলে নিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের একদল মুজিব-হত্যার প্রতিবাদে, একদল মোশতাকের সমর্থনে মিছিল করলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজে’র নামে প্রচারপত্র বের হলো ‘শেখ মুজিবের দালাল শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়’ শিরোনামে। দুর্নীতির দায়ে প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মযহারুল ইসলাম, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরী গ্রেপ্তার হলেন।
বেতারে মযহারুল ইসলামের গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে আমি গিয়েছিলাম সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে দেখা করতে তিনি তখন আজিমপুর কলোনিতে ভাইয়ের বাসায় ছিলেন। দেখলাম, খবরটা উনি জানেন। আমি বললাম, ‘সার, মনে হয়, সরকার আপনাকে কিছু করতে চাইবে–আপনার সম্মত হওয়া উচিত হবে না।’ তিনি বললেন, ‘না, আমি আর কোনো দায়িত্ব নিতে যাচ্ছি না–অনেক হয়েছে। পরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হওয়ার পরে আবার দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন, ‘মোশতাক কিছুতেই ছাড়ল না। বললাম, ‘আপনি দেখা না করতে গেলেই পারতেন।’ তিনি বললেন, ‘এমন করে খবর পাঠালো যে না-গিয়ে পারলাম না।’
গুজবেরও অন্ত নেই। যেমন, ভারতীয় হেলিকপ্টার আসছে–জেলখানা থেকে তাজউদ্দীনকে উদ্ধার করে তাকে ক্ষমতায় বসাবে। দায়িত্বশীল বলে পরিচিত সাংবাদিকেরাও অত্যন্ত দায়িত্বহীন সংবাদ পরিবেশন করেন। তাতে উত্তেজনা ও বিভ্রান্তি বাড়ে।
৩ নভেম্বর সকাল থেকে ঢাকা বেতারে অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছিল না। তা থেকেও অনেক গুজবের জন্ম হয়। রাতে বেতারের এক ঘোষণায় বলা হয়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত চারজন রাজনৈতিক নেতার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তদন্ত করার জন্যে রাষ্ট্রপতি একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। বিচারপতি আহসানউদ্দীন চৌধুরী এর সভাপতি, বিচারপতি কে এম সোবহান ও বিচারপতি সৈয়দ মুহম্মদ হোসেন সদস্য। নিহত নেতা কারা, বেতারে তা বলা হয়নি। আমি বেবীকে বললাম, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এঁরা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান।
সেদিন সকালে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এক অভ্যুত্থান ঘটে–শোনা যায়, তার লক্ষ্য ছিল বঙ্গভবন থেকে খুনি সামরিক কর্মকর্তাদের বহিষ্কৃত করা। মেজর-জেনারেল জিয়া বন্দি হন, খালেদ মোশাররফ ঘোষিত হন সেনাবাহিনী-প্রধান বলে। ৪ তারিখে বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রতিবাদে যে-মিছিল হয়। ঢাকা শহরে, তাতে যোগ দেন রাশেদ মোশাররফ ও তাঁদের মা। তাতে খালেদ মোশাররফ চিহ্নিত হন আওয়ামী লীগের সমর্থক ও ভারতপন্থী বলে। খালেদ চাপ দেন মোশতাককে। ফলে খুনি সামরিক কর্মকর্তারা দেশ ছেড়ে ব্যাংককে চলে যেতে বাধ্য হয়। ৫ তারিখে প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করেন মোশতাক। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে সংসদ বাতিল করেন বিচারপতি সায়েম, তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বও গ্রহণ করেন। ৭ তারিখে সিপাহী বিপ্লব’ বলে পরিচিত আরেক অভ্যুত্থানে খালেদ এবং আরো কয়েকজন সেনা-কর্মকর্তা নিহত হন, মুক্ত হন। জিয়া। পরে নৌবাহিনী-প্রধান ও বিমানবাহিনী প্রধানের মতো তিনি নিজেও উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদবি গ্রহণ করেন, কিন্তু ক্ষমতার চাবিকাঠি তার হাতে রয়ে যায়।
৪.
অল্পকালের মধ্যে জানা গেল যে, ৭ নভেম্বরের সিপাহি বিপ্লব-সংগঠনে কাজ করেছে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামে একটি সদ্যগঠিত সংগঠন এবং তার পেছনে কাজ করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতারা, বিশেষ করে কর্নেল তাহের। তাই আশ্চর্য নয় যে, বিপ্লবের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন মেজর এম এ জলিল ও আ স ম আবদুর রবের মতো নেতারা। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতেও কর্নেল তাহেরের ভূমিকা ছিল প্রধান। মুক্তিলাভ করেই জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বলে ঘোষণা করেছিলেন বেতারে–সে-ঘোষণা আমি শুনিনি, তবে অনেকেই শুনেছিলেন। পরে রাষ্ট্রপতি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করলে সেনাবাহিনী-প্রধানরূপে জিয়া উপ-প্রধান সামরিক প্রশাসকের পদ গ্রহণ করেন, কিন্তু তার ওই প্রথম ঘোষণাটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ঘোষিত লক্ষ্য জওয়ানদের উন্নততর জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করা এবং তার দাবিনামার মধ্যে ছিল সেনা-কর্মকর্তা ও জওয়ানদের পার্থক্য লোপ করা, তাদের জন্য একইরকম বেতন-স্কেল, বাসস্থান ও অন্যান্য সুবিধা প্রবর্তন করা, এবং ব্যাটম্যানের পদ লুপ্ত করা। জওয়ানদের রোষবশত ৭-৮ তারিখে তাদের হাতে কেবল অফিসার হওয়ার কারণে অনেকে নিহত হন–আমাদের এক পরিচিত মহিলা-চিকিৎসকও তার মধ্যে একজন। তার অবহেলায় কোনো এক জওয়ানের স্ত্রীর মৃত্যু হয়–এই ছিল অভিযোগ। এহেন বিপ্লবী সৈনিকদের দাবি কোনো সরকারের পক্ষে কতটা। পূরণ করা সম্ভবপর, কে বলবে!
কয়েকদিনের মধ্যেই কর্নেল তাহের, মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব এবং তাদের মতাবলম্বী আরো কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেন। শোনা গেল, তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং সরকার উৎখাত করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা হবে। এরই প্রতিক্রিয়ায় পরদিন কর্নেল তাহেরের দুই ভাইসহ জাসদের বেশ কয়েকজন কর্মী ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনকে অপহরণের চেষ্টা করেন। হাই কমিশনে কর্তব্যরত পুলিশদের গুলিতে কয়েকজন হতাহত হন–এঁদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা। গুলিতে সমর সেনও সামান্য আঘাত পান। ১৯৭১এর ডিসেম্বরে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে এই সমর সেনই ভুট্টোর সঙ্গে তর্কযুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। সমর সেনের অপহরণচেষ্টার সঙ্গে জড়িত আহত ব্যক্তিরা গ্রেপ্তার হন।
সে-সময়ে এটাও পরিষ্কার হয় যে, যেসব সাবেক ও কর্মরত সামরিক কর্মকর্তার নেতৃত্বে ১৫ আগস্টের রক্তপাত ঘটে, জেলখানার অভ্যন্তরে ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড তাঁরাই ঘটিয়েছেন। সেই রাতে তাঁদের কয়েকজনকে ব্যাংককে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, অনেকে পরিবার নিয়েই চলে যান। ব্যাংককে তাঁরা সাংবাদিকদের জানান যে, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রে তারা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। ৭ নভেম্বরের পরে শোনা যাচ্ছিল, তারা দেশে ফিরে আসছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান বা থাইল্যান্ডে আশ্রয় না পেয়ে তারা চলে গেছেন লিবিয়ায়। সেদেশে তাদের আশ্রয়লাভের পশ্চাতে পাকিস্তানের হাত ছিল বলে শোনা যায়। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক দ্রুত গড়ে উঠছে–উভয় দেশে রাষ্ট্রদূত-বিনিময় হয়েছে। এককালের আওয়ামী লীগ-নেতা, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ১৯৭০এর জাতীয় পরিষদ-সদস্য, ১৯৭১এ পাকিস্তানের সহযোগী জহিরউদ্দীন সেদেশে আমাদের প্রথম রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে রাষ্ট্রপতি সায়েম তাঁর বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করেছেন বিচারপতি সাত্তারকে–যিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন সাফল্যের সঙ্গে। উভয়েই একসঙ্গে বিচারপতি থাকা ছাড়াও এক সময়ে শেরে বাংলার কনিষ্ঠ আইনজীবী ছিলেন–তাঁদের বন্ধুত্ব পাকিস্তানপূর্ব যুগের। রাষ্ট্রপতি আর বিচারপতি একসঙ্গে শুনতে ভালো লাগে না বলে এখন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম বলা হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট একটি উপদেষ্টা-পরিষদ গঠন করলেন নভেম্বরের শেষে। এর সদস্য হলেন অধ্যাপক আবুল ফজল, কাজী আনোয়ারুল হক, ড. আবদুর রশীদ ও ড. মীর্জা নূরুল হুদা।
৫.
অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে চলে যাওয়ায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সভাপতিরূপে আমাকেই নিযুক্ত করলেন উপাচার্য। এটি আমার প্রাপ্য ছিল না–কেননা, ওই পদ আমি ত্যাগ করেছি। আমার প্রতি স্নেহবশতই নিয়োগটি দিলেন আবুল ফজল। তবে তাঁর বিবেচনা ছিল এই যে, সৈয়দ আলী আহসান যাতে বিভাগের প্রধান হতে পারেন, সেজন্যেই সময়ের আগে আমি পদটি ছাড়ি। যতদিন আমার বিভাগীয় প্রধান থাকার কথা ছিল, অন্তত ততদিন আমাকে দায়িত্ব দিলে কাউকে বঞ্চিত করা হয়। না। এটা ঠিক আইনি সিদ্ধান্ত নয়, খানিকটা মানবিক সিদ্ধান্ত হতে পারে। বিভাগের সহকর্মীরা কেউ আপত্তি করলে তার মীমাংসা কী হতো, বলা দুষ্কর। তবে সকলেই এটা মেনে নিলেন, তাই কোনো সমস্যা হলো না।
এর আগে আমি দুটো নৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম–তার একটা রাখতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে সকলকে ভূতাপেক্ষ দু বছরের জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার সরকারি নিয়ম হয়েছিল। তার জন্য আবেদন করতে হতো। আমি ওই সুযোগ নেবো না মনে করে আবেদন করিনি। আমাদের সহকর্মী রণধীর বড়ুয়া তখন খুব কুণ্ঠিত হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি আবেদন করবেন কি না। আমি বলেছিলাম, এটি আমার একান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত–সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়, তিনি অনায়াসে আবেদন করতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বকেয়া বেতনও দেওয়া হয়েছিল–যেসব শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মে যোগ দেননি, তাঁদের সকলকে। আমি তার জন্যেও আবেদন করিনি এই ভেবে যে, এর মধ্যে অনেকটা সময়ে আমি বাংলাদেশ সরকারের বেতন নিয়েছি। পরে একসময়ে, অর্থসংকটের জন্যে, দরখাস্ত করে বকেয়া বেতন তুলে নিই। তবে জ্যেষ্ঠতা কখনোই দাবি করিনি। নীতিনিষ্ঠ হলে দ্বিতীয়বার বিভাগের সভাপতি হতাম না, কিন্তু উপাচার্য যখন দিলেন, তখন আপত্তি করলাম না।
এর অল্পদিন পর আচার্যের আহ্বান পেয়ে উপাচার্য আবুল ফজল ঢাকায় গেলেন, ফিরলেন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা-পরিষদের সদস্য হয়ে। রেজিস্ট্রার জানালেন, উপাচার্য ফিরেছেন এবং আমাদের কয়েকজনকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সাহিত্য-নিকেতনে। অধ্যাপক আবদুল করিম, রেজিস্ট্রার মুহম্মদ খলিলুর রহমান, আমি এবং আরো কেউ কেউ গেলাম, ড. মুহাম্মদ ইউনূস গিয়েছিলেন কি না মনে নেই। আমরা সবাই আবুল ফজলকে অভিনন্দন জানালাম। তিনি জানালেন, তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন ড. করিম, তার নিয়োগপত্রও তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। আমরা অধ্যাপক করিমকেও অভিনন্দন জানালাম। আবুল ফজল বললেন, তিনি পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন এবং কয়েকটি জরুরি ফাইল সই করে তারপর কার্যভার হস্তান্তরিত করবেন। আমরা পরস্পর তাকাতাকি করলাম, শেষে আমিই বললাম, ‘সার, আপনি যেহেতু প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন, সেহেতু আপনার পক্ষে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ফাইল দেখা সমীচীন হবে না। তবে আপনি কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করলে তা নিশ্চয় অপূর্ণ থাকবে না।’ তিনি আমার কথা সবটা বুঝলেন কি না জানিনা, বললেন, আমার কিছু কাজ করা বাকি রয়েছে–যেমন, মাহবুবউল্লাহ্র অ্যাড হক অ্যাপয়েন্টমেন্ট।’ তখন স্থির হলো, পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পেছনের তারিখ দিয়ে তিনি কয়েকটি ফাইল সই করবেন।
২৮ নভেম্বর সকালে আবুল ফজল উপাচার্যের দায়িত্বভার অর্পণ করলেন আবদুল করিমকে। তখন পর্যন্ত আবদুল করিম কলা অনুষদের ডিনও ছিলেন। তাঁর মেয়াদের অবশিষ্ট অংশের জন্য কলা অনুষদের ডিনের দায়িত্ব আমি পেলাম।
এক সময়ে একান্তে আবুল ফজলকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, সামরিক শাসনের অধীনে তিনি রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হতে সম্মত হলেন কেন? তিনি বলেছিলেন, বিচারপতি সায়েমের সনির্বন্ধ অনুরোধ তিনি এড়াতে পরেননি; তাছাড়া, উপদেষ্টার পদে থেকে এই দুঃসময়েও যদি ভালো কিছু করতে পারা যায়! এটি যে তিনি মন থেকে বিশ্বাস করেছিলেন, তাতে আমার সন্দেহ ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয়-পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে বিদায়-সংবর্ধনা জানানো হলো চট্টগ্রাম ক্লাবে এক অনুষ্ঠান করে। সেখানে আমিও কিছু বললাম–তাতে সেই সময়ের দুরূহতার ইঙ্গিত ছিল। বক্তৃতায় আবুল ফজল বললেন, এই সংকটকালে দেশের জন্যে কিছু করতে পারার আশায় তিনি এই গুরুদায়িত্ব নিয়েছেন, নইলে এই বয়সে বিদেশে গিয়ে থাকা তার অভিপ্রেত হতো না।
বেবী ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো, উপদেষ্টাকে কি খুব দেশের বাইরে থাকতে হবে?
বললাম, ‘উনি ঢাকায় থাকার কথা বোঝাতে চেয়েছেন।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন দায়িত্ব নিয়ে আমার চলা শুরু হলো।
এর মধ্যে লেখালিখির কাজ কিছু এগিয়েছে।
১৯৭২ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের উদ্যোগে মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও আনোয়ার পাশা–শহীদ এই তিন শিক্ষক সম্পর্কে একটি বক্তৃতামালা আয়োজিত হয়। আয়োজকদের ইচ্ছায় সেখানে আমি ‘মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ পড়ি। স্বাধীনতার পরে এটাই ছিল আমার প্রথম লেখা–ঢাকায় বসে লিখি। পরে চট্টগ্রামে এসে লিখি মুনীর চৌধুরীর জীবনী ও তাঁর সম্পর্কে আমার স্মৃতিকথা। মুনীর চৌধুরী নামে তা দৈনিক বাংলার রোববারের সাময়িকীতে তিন কিস্তিতে প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে। গ্রন্থাকারে এই প্রবন্ধ দুটি প্রকাশের প্রস্তাব ও পরিকল্পনা করে ভূঁইয়া ইকবাল ও মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী থেকে এটি প্রকাশের ইচ্ছা জ্ঞাপন করে মফিদুল হক। কিন্তু জাহাঙ্গীর যেহেতু আগেই কথাটা পেড়েছে, সুতরাং, তার দাবি, তার কথাই শিরোধার্য। ফলে, ‘থিয়েটার থেকে রামেন্দু মজুমদার এটি প্রকাশ করলো, আর পরিবেশনের ভার নিলো জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী। আমি বিলেত থেকে ফিরে পুনর্লিখন। করলাম। বইটি মুদ্রিত হলো বাংলা একাডেমি প্রেসে–আফজাল হোসেনের যত্নে। মুনীর অপটিমার ফন্ট ব্যবহার করে চমৎকার প্রচ্ছদ করে দিলেন। কাইয়ুম চৌধুরী। মুনীর চৌধুরী বের হলো ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে। বইটি উৎসর্গ করি লিলি চৌধুরীকে।
এখন মফিদুলের দাবি, তার প্রকাশনীকে একটি বই দিতে হবে। অক্সফোর্ড ও সাসেক্সে যে-প্রবন্ধ দুটি পড়েছিলাম, তার বাংলা ভাষ্য করে দিলে সে খুশি হয়। সেই কাজ শুরু করেছিলাম ঢাকায়, আব্বার অসুস্থতার সময়েই, এখন। চট্টগ্রামে এসে শেষ করলাম। মফিদুলকে জানালাম, এইসঙ্গে আগের লেখা দুটি প্রবন্ধ যোগ করবো। ১৯৬৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম। বিভাগের এক আলোচনা-সভায় ড. আবদুল মজিদ খানের আমন্ত্রণে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম। সেটি পুনর্লিখন করে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য : সমাজের কিছু চিত্র’ নামে যোগ করলাম। আর দিলাম বিলেত যাওয়ার আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা সমিতিতে পঠিত চর্যাগীতির সমাজচিত্র প্রবন্ধটি–এটি অবশ্য আমার সম্পাদিত পাণ্ডুলিপি পত্রিকায় (চতুর্থ খণ্ড, ১৯৭৫) প্রকাশ করি, অন্যগুলো মুদ্রিত হয়নি। বইয়ের পরিকল্পনাকালে বিজ্ঞাপন দেবে বলে মফিদুল নাম চেয়ে বসলো। বললাম, সমাজ ও সাহিত্য দিয়ে দাও। আবুল হাসনাত সম্পাদিত গণসাহিত্য পত্রিকায় এই নামেই বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। পরে মফিদুল বললো, নামটা বড়ো গতানুগতিক হয়ে গেল। আমারও তাই মনে হলো। ততদিনে অকসফোর্ডে-পড়া প্রবন্ধটির বাংলা ভাষ্যের নাম দিয়েছি ‘স্বরূপের সন্ধানে’। মফিদুলকে বললাম, বইয়েরও এই নাম দিলে কেমন হয়? সে লুফে নিলো। স্বরূপের সন্ধানে বের হলো ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বরে। এটি উৎসর্গ করি অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেছে। সেকথা এখানে বলা দরকার।
১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একদিন আবু হেনা মোস্তফা কামাল আমাকে বললেন, তিনি বিবিসি বাংলা বিভাগে যোগ দেওয়ার আহ্বান পেয়েছেন এবং সেটি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। আমি জানতাম, লন্ডনে থাকতে তিনি বিবিসি-র বাংলা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন এবং রাজশাহীতে প্রত্যাবর্তনের পরে তাঁর সেখানে চাকরি নিয়ে যাওয়ার কথা একবার উঠেছিল। তখন সেটা ঘটেনি, সুযোগটি এখন আবার দেখা দিয়েছে। আমি সে-হিসেবেই বিষয়টা দেখলাম। এবং বললাম, এতে তার আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ঘটবে, ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষারও হয়তো সুবিধে হবে, কিন্তু আমার তো মনে হয়, শিক্ষকতাই তার যথার্থ ক্ষেত্র, সেটা ছেড়ে যাওয়া কি উচিত হবে? উত্তরে আবু হেনা বললেন, শিক্ষকতায় তাঁকে রাখার ব্যাপারে আমি তো কিছু করছি না। আমি অবাক হলাম বললে কম বলা হয়। ১৯৭৩ সালে আমিই উদ্যযাগী হয়ে তাঁকে চট্টগ্রামে নিয়ে আমি। ভূঁইয়া ইকবাল যখন তাঁর প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ শিল্পীর রূপান্তর (ঢাকা, ১৯৭৫) প্রকাশের উদযোগ নেয়, তখন আমি যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছিলাম–বইয়ের ভূমিকায় তার ইঙ্গিত তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। তাহলে আমার ত্রুটি কোথায়? পরে বুঝলাম, সৈয়দ আলী আহসান রাজশাহীতে চলে যাওয়ায় অধ্যাপকের যে-পদটি অস্থায়ীভাবে শূন্য হয়েছে, গত তিন মাসে তা পূরণ করার কোনো প্রয়াসই আমি নিইনি, অথচ তিনি ওই পদের প্রত্যাশী। পদটি বিজ্ঞাপিত হলে হয়তো তিনিই সেটি লাভ করবেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁর আগে থেকে বিভাগে সহযোগী অধ্যাপকরূপে কর্মরত দুই শিক্ষক মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল ও মাহমুদ শাহ্ কোরেশী-মর্মাহত হবেন, সেকথাও না ভেবে পারা যাচ্ছে না। এসব বিবেচনা, আবু হেনার ধারণায়, অযৌক্তিক। তিনি আমার বাড়ি আসা বন্ধ করে দিলেন। এবং একদিন রেজিস্ট্রারের অফিসে বসে আবিষ্কার করলাম যে, তিনি আমার সঙ্গে বাক্যালাপও বন্ধ করেছেন। তারপর দেখলাম, আনন্দের–তার বয়স তখনো চার বছর হয়নি–’না-চাচা না-চাচা’ ডাকেও সাড়া দিচ্ছেন না। মনটা বিষণ্ণতা ও তিক্ততায় ভরে গেল।
তখনকার পরিস্থিতিতে বিভাগে অধ্যাপক-পদের সংখ্যাবৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। সুতরাং, হয় এ-পদ শূন্য রাখতে হবে, নইলে একাধিক জনকে অসন্তুষ্ট করে তা পূর্ণ করতে হবে। আমি শেষের বিকল্পই বেছে নিলাম। উপাচার্যকে বলতে গেলাম, অধ্যাপকের অস্থায়ী পদ বিজ্ঞাপিত করার অনুরোধ জানিয়ে আমি আনুষ্ঠানিক পত্র দিতে যাচ্ছি। তিনি জানতে চাইলেন, এর ফলে বিভাগে কী প্রতিক্রিয়া হবে এবং কীভাবে আমি তা সামলাবো, তা ভেবে দেখেছি কি না। বললাম, ‘ভেবে দেখেছি, কাজটা সহজ হবে না; কিন্তু আজ হোক কাল। হোক, এ-ঝুঁকি আমাকে নিতে হবে।’
পদ বিজ্ঞাপিত হলো। আবু হেনা নির্বাচিত হলেন। অপর দুই সহকর্মী ক্ষুব্ধ। হলেন। সৈয়দ আলী আহসানও আমার উপর বিরক্ত হলেন। তিনি মনে করলেন, বিজ্ঞতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে আমি বিষয়টি মোকাবেলা করতে পারিনি।
পরে আবু হেনার কাছ থেকে এই চিঠিটা আমি পাই।
এস-ই/১১ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
২৫শে অগস্ট, ১৯৭৬
আনিস সাহেব,
গত কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম আপনার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো। কিন্তু অনুষদের নির্বাচন এবং অন্যান্য কাজকর্মের জন্যে আপনি এতই ব্যস্ত ছিলেন যে আমার পক্ষে সময়টা অনুকূল মনে হয়নি। নির্বাচনের ফল বেরুনোর পরে মনটা এত খারাপ হয়ে গেলো যে এ-সব ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ, ভেবেছিলাম, আর আপনার কাছে তুলবোই না। কিন্তু এখন দেখছি সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। ২৮ তারিখে সিন্ডিকেটের মিটিং। হ্যাঁ, আমি বিবিসিতে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়েছি। এই সিদ্ধান্ত কেন নিলাম, তা বলতে গেলে চিঠিতে কুলোবে না। সংক্ষেপে মানসিক-শারীরিক-আর্থিক, নানাবিধ কারণেই।
আপনার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণ স্বীকার করতে হবে কোনোদিন ভাবিনি। ১৯৭৩ সালে কী অবস্থায় আপনি আমাকে রাজশাহী থেকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন–সেটা কি ভুলে যাওয়া সম্ভব? আমি গত কয়েক মাস আপনার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করিনি–তার জন্যে নিজে কতোটুকু পীড়িত হয়েছি তা নিজেই জানি। হয়তো আমি এখান থেকে কিছুদিন দূরে থাকলে এইসব কষ্টকর স্মৃতি আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে যাবে। আপনি কাল ঢাকা যাচ্ছেন। সেখানে ভাবিকে বলবেন যে আমি সত্যি সত্যি অকৃতজ্ঞ নই। তিনি যে ১৯৭৩ সালের তিনটি মাস আমাকে সহোদরের মতো যত্ন করেছিলেন–তা আমি কোনোদিন ভুলবো না–কারণ আমার জীবনে এরকম সমাদর-মমতা খুব কম পেয়েছি। আমি সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম যখন দিনের পর দিন আপনাদের ওখানে যেতাম না বলে, আনন্দকে দেখতে পাইনি। ওর সঙ্গে আমার পুরনো সম্পর্কটা আর বাঁচিয়ে তোলা হলোই না।
এসব কথা সাক্ষাতে বলতে পারতাম না বলেই চিঠি লিখলাম। এই বৃদ্ধ বয়সেও, মনে হচ্ছে, বেশ ভাবপ্রবণই হয়ে পড়েছি। ক্ষমা করবেন।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল।
চিঠিটা যে মর্মস্পর্শী, সেকথা অনস্বীকার্য, তবে তখন আমার উদবেগ হলো এই ভেবে যে, এতকিছুর পর যদি তিনি বিবিসিতে চলে যান, তাহলে সবদিক থেকে আমি বিব্রত হবো। তিনি অবশ্য বিবিসি-তে আর যাননি, অধ্যাপক পদ গ্রহণ করে আপাতত চট্টগ্রামে রয়ে যান। সৈয়দ আলী আহসান পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের দুটি নতুন পদ সৃষ্টি করে আউয়ালকে বাংলা বিভাগে এবং কোরেশীকে ইনসটিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজে নিয়ে যান।
আবু হেনার চিঠিতে অনুষদের যে-নির্বাচন সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, সে-বিষয়ে কিছু বলি। আবদুল করিম উপাচার্য নিযুক্ত হওয়ায় আমি কলা। অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন হই, তা আগে উল্লেখ করেছি। কর্তৃপক্ষ ডিন নির্বাচনের তারিখ এমনভাবে দিলেন যাতে মোহাম্মদ আলী বিলেত থেকে ফিরে তাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। আমি যে নির্বাচনে প্রার্থী হবো, তা ছিল অবধারিত। মোহাম্মদ আলী কাজে যোগ দিয়েই মনোনয়নপত্র দাখিল করলেন, সৌজন্যের খাতিরেও আমাকে কিছু বললেন না। তাঁর স্ত্রী খালেদা হানুম আমাদের বিভাগে শিক্ষক–তিনিও তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে যোগদানপত্র দিলেন–সেটা আমি সই করে রেজিস্ট্রারের দপ্তরে পাঠাবার আগেই ভোটার-তালিকায় তার নাম মুদ্রিত হয়ে গেল। রেজিস্ট্রারকে ফোন করে জানতে চাইলাম, এটা কীভাবে সম্ভবপর হলো? তিনি লজ্জিত হয়ে সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন, আমি যেন যোগদানপত্রটা তখনই তাঁর দপ্তরে পাঠিয়ে দিই। বললাম, ‘ভয় পাবেন না-ওটা আটকে রেখে আমি আপনাকে বিপদে ফেলবো না। নির্বাচনে এখন আমাদের বিভাগ থেকে আরো দুজনকে সঙ্গে পেলেন মোহাম্মদ আলী। আমি হেরে গেলাম।
রাতে আমি যখন শুয়ে পড়েছি, তখন গেট টপকে আমাদের সহকর্মী রশীদ আল ফারুকী আমার বাসায় এলো। বললো, নির্বাচনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সে মামলা করতে চায়। আমি তাকে নিষেধ করলাম।
৬.
১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে টোকিওতে ইউনেসকো আয়োজন করলো এশিয়ার সাংস্কৃতিক গবেষণা-প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিনিধি-সভা। উদ্দেশ্য : ইউনেসকোর সদর দপ্তরে কিছু গবেষণা-প্রস্তাব পাঠানো। শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ে রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা অধ্যাপক আবুল ফজল এতে যোগ দিতে মনোনয়ন দিলেন আমাকে। উদ্যোক্তারা দাবি করলেন বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক গবেষণার সমকালীন অবস্থা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ; আমি তা উপস্থাপন করতে সম্মতি জানালাম। তাঁরা লিখলেন, টিকিট পাঠাচ্ছেন, কিন্তু সে-টিকিট আর সময়মতো এসে পৌঁছোলো না। প্রবন্ধটাও আর শেষ করতে হবে না ভেবে যখন সান্ত্বনালাভের চেষ্টা করছি, তখন ঢাকা থেকে কোনো ট্রাভেল এজেন্সির টেলিফোন : চট্টগ্রামে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা সময়মতো জানাতে পারেননি যে, আমাকে টিকিট দেওয়ার ফরমাশ তারা পেয়ে গেছেন। আমি বললাম, এখন আর জেনে লাভ কী? তাঁরা জানালেন, আমি অবিলম্বে ঢাকায় পৌঁছোলে সপ্তাহব্যাপী সম্মেলনের মাঝামাঝি ধরতে পারব। আমি বেশি আগ্রহ না দেখানোয় তারা পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন : আমি না গেলে তারা দোষের ভাগী হবেন ইত্যাদি। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, সেখানে একরাত থেকে ব্যাংককে। ব্যাংককে রাত্রিযাপন করে টোকিওতে যখন পৌঁছোলাম, তখন ১৩ তারিখের অনেক রাত। যিনি বিমানবন্দরে নিতে এসেছিলেন, তাকে আমার বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করায় যথোচিত দুঃখপ্রকাশ করলেন। হোটেলে পৌঁছে দিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আমার লেখাটি চাইলেন : যদিও ওটা উপস্থাপনের সময় চলে গেছে, কিন্তু তা বিলি করতে তো হবে। আমার মাথায় বজ্রাঘাত : কী করে বলি যে, সেটা লেখা হয়নি। বললাম, কাল সকালে দেবো–এত রাতে নিয়ে আর কী করবেন! তিনিও ওস্তাদ। বললেন, সকালে নিতে এলে যদি আপনার ঘুমের ব্যাঘাত হয়, তাই এখনি নিয়ে রাখতে চাইছিলাম, ওটার ফটোকপি করতে হবে তো! বললাম, তার চেয়ে কিছু বেশি করতে হবে–আমার হাতের লেখা থেকে টাইপ করতে হবে, অবশ্য আপনাদের টাইপিস্ট যদি আমার লেখা পড়তে পারে! ভদ্রলোক এবারে রণে ভঙ্গ দিলেন : সকাল সাতটায় এলে কি বেশি আগে হয়ে যাবে? বললাম, আদৌ নয়। নৈশভোজের পর্ব প্লেনেই সেরে এসেছিলাম। নোটটা সঙ্গে এনেছিলাম আর গ্রন্থপঞ্জি। এক কাপ কফি খেয়ে বসে গেলাম লিখতে। হোটেলের যে-স্টেশনারি ঘরে ছিল, তাতেই লিখতে আরম্ভ করলাম। রিসেপশন থেকে কিছু বাড়তি কাগজ নিয়ে এলাম। ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু বিছানার দিকে তাকাচ্ছি না। লেখা শেষ করতে ভোর হয়ে গেল। তারপর গোসল শেষ করে সকালের নাশতার জন্যে যখন তৈরি হয়েছি, তখন কান্ডারি এলেন লেখা নিতে। আমার চুল যদি বুঝেও থাকেন, তা জানতে দিলেন না। বললেন, টাইপ হয়ে গেলে একবার দেখিয়ে নেবো। ইলেকট্রিক টাইপরাইটারে সুন্দর মুদ্রণ হলো, দেশীয় নাম ও গ্রন্থনামও নির্ভুল। প্রায় তিন পৃষ্ঠার প্রবন্ধ, দেড় পৃষ্ঠার গ্রন্থপঞ্জি। সকালের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে দেখি, লেখাটি বিলির জন্যে প্রস্তুত। পরে টের পেলাম, সময়ের অভাবজনিত সংক্ষিপ্ততা আমার লেখনীর সংযম বলে গণ্য হয়ে প্রশংসাযোগ্য হয়েছে। একেই বলে লীলাখেলা!
মধ্য-এশিয়ার প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন ইতিহাসবিদ বোবোজান গফুরভ। দু বছর আগে প্যারিসে ওরিয়েন্টালিস্ট কংগ্রেসে তিনি ছিলেন, কিন্তু সেবারে আলাপ হয়নি। বাংলাদেশ থেকে গেছি শুনে তিনি জানতে চাইলেন, কেমন আছি এবং আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই মুচকি হেসে বললেন, ইউনিফর্ম পরলে প্রত্যেক সামরিক কর্মকর্তা নিজেকে আলেকজান্ডার মনে করে। বাংলাদেশে সামরিক শাসনের বয়স তখন ছ মাস পেরিয়েছে। সম্মেলনে যে দুজনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, তাদের একজন ইন্দোনেশীয় অর্থনীতিবিদ-বয়সে আমার চেয়ে সামান্য বড়ো, আরেকজন মালয়েশীয় স্থপতি-কুয়ালামপুরের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদের ডিন–বয়সে আমার ছোটো। তাঁদের দুজনেরই নাম ভুলে গেছি। মনে আছে নারায়ণ মেননকে–একদা অল ইন্ডিয়া রেডিওর বড়োকর্তা, সংগীতবিশেষজ্ঞ, তখন বোম্বাইতে অবসরজীবন যাপন করছিলেন। তাঁর স্ত্রী রেখাও সুপরিচিত সংগীতশিল্পী–তিনি অবশ্য টোকিওতে আসেননি। মেনন আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, যখনই বোম্বাই দিয়ে আসা-যাওয়া করি, তাঁর বাড়িতে যেন অতিথি হই। আরেকজনের কথাও উল্লেখযোগ্য। তিনি এসেছিলেন আফগানিস্তান থেকে–সরকারি কর্মকর্তা, তখন আছেন বহিঃপ্রচার বিভাগের শীর্ষদেশে, কিন্তু গবেষণার সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক নেই। নিতান্ত ভালোমানুষ, খোলাখুলিই বললেন, তোমাদের মতো অ্যাকাডেমিকদের মধ্যে আমি ডাঙায় তোলা মাছ–খেই পাচ্ছি না কিছুতে, কী যে বলব, ঠাহর করতে পারি না। বললাম, কিছু যে বলতেই হবে, এমন কথা নেই। বলার কথা থাকলে বলবেন, নইলে অন্যের কথা শুনবেন কিংবা শোনার ভান করবেন। তিনি খুব একটা স্বস্তির হাসি হাসলেন। আফগানিস্তানের পরবর্তী রাজনৈতিক ডামাডোলের সময়ে আরো অনেকের মতো এই সরল মানুষটিকেও প্রাণ দিতে হলো কি না, এ প্রশ্ন আমার মনে পরে অনেকবার দেখা দিয়েছিল, তবে তার উত্তর পাইনি।
অধিবেশনে যোগ দিয়ে বুঝলাম, ঠাণ্ডা লড়াইয়ের জের এখানেও চলছে–গফুরভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকায়, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জায়গায় থাইল্যান্ডের প্রতিনিধি। একটি খসড়ায় থাই প্রতিনিধির দেওয়া দুটি বাক্যের প্রবল বিরোধিতা করলেন গফুরভ। মীমাংসায় আসা যাচ্ছে না। আমার পাশেই ছিলেন ইন্দোনেশীয় অর্থনীতিবিদ। তাঁকে বললাম, গফুরভের কথাটা পাদটীকায় দিলে কেমন হয়? তিনি বললেন, ভালোই হয়, প্রস্তাব করে দেখুন। আমি প্রস্তাব করলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সমর্থন পেয়ে গেলাম। কিন্তু ব্যাপারটার শেষ ওখানে হলো না। বিকেলের অধিবেশনে থাই প্রতিনিধি বললেন, মূল খসড়ায় তার প্রস্তাবিত বাক্য তিনি প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন এবং আশা করছেন যে, পাদটীকাও সেই সঙ্গে প্রত্যাহৃত হবে। কিন্তু গফুরভ তাঁর কথা ফিরিয়ে নেবেন না। আবার অচলাবস্থা। ইউনেসকোর এশীয় আঞ্চলিক দপ্তরের পরিচালক, জাপানি ভদ্রলোক, আমাকে আহ্বান জানালেন মতামত দিতে। আমি বললাম, দুটো বিরোধী মতকে জায়গা দেওয়ার জন্যে আমি পাদটীকার প্রস্তাবটি দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিজ্ঞা না থাকলে তার টীকার সার্থকতা থাকে না। যেহেতু মূল কথাগুলি প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেহেতু টীকার আর প্রয়োজন নেই। এবারো বড়োরকম সমর্থন পেলাম, কিন্তু গফুরভ খুব বিষণ্ণ হলেন। বিরতির সময়ে বললেন, আমার মনের পরিবর্তনে তিনি খুব। আহত হয়েছেন।
পরদিন আবার এক বিতর্কের যখন অবসান হচ্ছিল না, এশীয় আঞ্চলিক দপ্তরের পরিচালক নিজের আসন ছেড়ে আমার আর ইন্দোনেশীয়ের আসনের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বললেন, তোমরা একটা সমাধান বের করো–এক্ষুনি। কিন্তু সেবার আর আমাদের কথায় কাজ হয়নি।
আমাদের প্রতিনিধি-সভা যদিও ইউনেসকোর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়, এর স্থানীয় আয়োজক ছিল টোকিওর সেন্টার ফর ইস্ট এশিয়ান কালচারাল স্টাডিজ। এই কেন্দ্রে গিয়ে দেখলাম, আমাদের প্রত্যেককে এক বছরের জন্যে বিনা চাঁদায়। সদস্য করে নেওয়া হয়েছে। এক বৎসরের মধ্যে টোকিওয় এলে কেন্দ্রের। অতিথিশালায় সুলভে থাকতে পারবো। পুরো বছর ধরে তাদের কাছ থেকে অনেক কাগজপত্র পেয়েছিলাম।
সেই সন্ধ্যায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো এক জাপানি রেস্তোরাঁয়। ঢুকতেই সুন্দরী হোস্টেস আমার জুতো খুলতে উদ্যত হলো। আমি বাধা না দিয়ে পারলাম না। আমন্ত্রকদের একজন এগিয়ে এসে বললেন, এটাই এখানকার। দস্তুর–আপত্তি করলে তা রূঢ়তা বলে বিবেচিত হবে। অতি যত্নে মেয়েটি জুতো খুলে নিয়ে দরজা টেনে ধরলো। আমরা ভোজনকক্ষে প্রবেশ করলাম। নিচু চেয়ার-টেবিল। টেবিলের মাঝখানটা বৃত্তাকারে কাটা। তার নিচে স্টোভের মতো কিছু একটা রাখা। সেটায় আগুন ধরানো হলো। একটা বড়ো পাত্রে সাদা সিরকাজাতীয় জলীয় পদার্থ এনে তার ওপর রাখা হলো। ছোটো ছোটো পেয়ালায় সস ঢেলে প্রত্যেকের সামনে দেওয়া হলো। তারপর ট্রেতে আনা হলো কাঁচা তরিতরকারি এবং গোমাংস। যার যার ইচ্ছেমতো বড়ো পাত্রে সেসব সিদ্ধ করে নিয়ে ছোটো পেয়ালার সস মাখিয়ে খেতে হয়। অতি উপাদেয়। যে গোমাংস সরবরাহ করা হলো, তা অতি বনেদি–কোবে বিফ বলে পরিচিত। গরুকে বিয়ার খাইয়ে যথাযথ পুষ্ট করার পর তা জবাই করা হয়। সে-গোশতের স্বাদই আলাদা। আমি এবং কাবুলি পাশাপাশি বসে খুব খেলাম।
দিনের বেলায় গেলাম জাপানি টি-সেরেমনিতে। অতি চমৎকার এক উদ্যান পুষ্পেপল্লবে সুশোভিত। ঝরনাধারা বয়ে চলেছে সমতলে। তার ওপর চৌকো পাথরের সারি। ইচ্ছে করলে তার ওপর দিয়ে লাফিয়ে বা হেঁটে যাওয়া যায়। একটু পরে অপেক্ষাকৃত অনলংকৃত প্যাভিলিয়ন। মস্ত বড়ো কিন্তু নিচু একটা টেবিলের চারদিকে একাধিক সারিতে জায়গা করে নেওয়া হলো। জাপানি পোশাকে সুসজ্জিত কয়েকজন মহিলাও আছেন টেবিলের চারপাশে। যথাসময়ে তাদের একজন চায়ের একটি কাপ নেড়ে-চেড়ে ভালো করে দেখে পার্শ্ববর্তিনীর হাতে দিলেন। তিনি আবার একইরকম করে দেখে শুনে দিলেন পরের জনের হাতে। এমনি করে কাপটি এসে থামলো প্রথমে যিনি হাতে নিয়েছিলেন তাঁর বাঁ-পাশের জনে। এভাবে চায়ের পেয়ালা সবার কাছে পৌঁছোবার পর সুদৃশ্য টি পট থেকে চা ঢালা এবং তা ধীরে ধীরে পান করা। সময়সাপেক্ষ, তবে দৃষ্টিনন্দন ব্যাপার। খাওয়ার চাইতে পরিবেশন-প্রণালি এবং সবার একসঙ্গে মিলিত হওয়ার ব্যাপারটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ইন্দোনেশীয় অর্থবিদ আমাকে একটি কথা বলেছিলেন, পরে তা আমি কোথাও কোথাও উদ্ধৃত করেছি। তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সে-সময়ে সিদ্ধান্ত হয় যে, শিক্ষার মাধ্যম ওলন্দাজ থেকে রাতারাতি পরিবর্তন করে বাহাসা ইন্দোনেশিয়া হবে। তাই হয়েছিল। তাদের শিক্ষকেরা অভ্যস্ত ছিলেন ওলন্দাজে পড়াতে। তাদের বেশ অসুবিধে হতো গোড়ার দিকে এবং দেখা যেতো, নতুন মাধ্যমে পড়াতে গিয়ে তাঁরা শতকরা নব্বই ভাগ ওলন্দাজ শব্দ ব্যবহার করছেন। কিন্তু ওইভাবে যে শুরু হলো প্রায় বিনা প্রস্তুতিতে, কালক্রমে সেটিই হয়ে গেল রীতি। পরবর্তী প্রজন্মের ওই অসুবিধে আর হয়নি।
৭.
টোকিও থেকে ফেরার পথটা নিয়েছিলাম ম্যানিলা ও হংকং হয়ে। অগ্রজপ্রতিম আবুল মাল আবদুল মুহিত তখন ম্যানিলায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক। তাঁর ও সাবিয়ার সঙ্গে কয়েকদিন কাটাতেই ম্যানিলা যাওয়া। ইউনেসকোর সভায় ফিলিপিনসের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন সেখানকার ন্যাশনাল লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক। তাঁকে দিয়ে মুহিত ভাইকে আমার ম্যানিলা পৌঁছোবার দিনক্ষণ জানালাম।
ম্যানিলায় মুহিতের বাড়িতে অভ্যর্থনা জানালো তাঁর দীর্ঘকালের সেবক কাদের। প্রথমেই বললো, ‘আপনি গিয়াস সাহেবের সঙ্গে আমাদের বাড়ি আসতেন না!’ আমাদের বন্ধু শহীদ গিয়াসউদ্দিন আহমদকে কাদের আমার চেয়েও বেশি মনে রেখেছে। তাতে যেমন ভালো লাগল, তেমনি গিয়াসের জন্যে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সাবিয়া গিয়াসের সাক্ষাৎ ছাত্রী।
মুহিত-দম্পতির যত্নে সময়টা খুব ভালো কাটল। ম্যানিলার যা দ্রষ্টব্য, তা দেখা হলো। এক ফাঁকে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে গ্রন্থাগারিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এলাম। তাছাড়া দেখা হলো মমতাজ ইকবাল এবং আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের চাকরি হারিয়ে আমিনুল ইসলাম যোগ দেন পাকিস্তান ইনসটিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট ইকনমিকসে। সেখান থেকে আসেন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে। আমিনুল ইসলাম এক সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টে আপ্যায়ন করলেন। তার সঙ্গে তাঁর স্ত্রী সুলতানা আরা ওরফে ইভা, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকেই আমার বছর দুই পরে এম এ পাশ করেন, সুতরাং তাঁর সঙ্গে বিলক্ষণ পরিচয় ছিল। আর ছিল তাদের শিশুকন্যা। অতিথি মুহিত ও আমি। প্রবাসী বাঙালিদের একটি অনুষ্ঠানে যেতে হলো বলে আমাদের সঙ্গে সাবিয়া যোগ দিতে পারেননি।
সাবিয়া জানতে চাইলেন আমার কেনাকাটির ফর্দ কী। যখন বললাম, বেবীর একমাত্র ফরমাশ মশারির কাপড়, তখন তিনি হেসে অস্থির। বেবী তাঁর সহপাঠী। সাবিয়া বললেন, এখানে এতজন এতকিছু কেনে, কাউকে মশারির কাপড় কিনতে দেখিনি। সেটা কেনা হলো। আরো টুকিটাকি এবং সাবিয়ার দেওয়া উপহারসমেত ম্যানিলাত্যাগ।
হংকং বিমানবন্দরে যখন নামলাম, মনে হলো, প্লেনটা সমুদ্রে গিয়ে পড়বে। সমুদ্র ভরাট করে জমি বাড়ানো হচ্ছে। শহরটা বড়ো হচ্ছে একটু একটু করে। বিমানবন্দর থেকে সেখানকার কর্মীদের সাহায্যে যোগাযোগ করে হোটেল অ্যামবাসাডরে জায়গা পাওয়া গেল। হংকংয়ে দেখার মতো জিনিস বেশি নেই, কেনার মতো জিনিস আছে প্রচুর। আমার সামর্থ্য ও প্রয়োজন দুইই সীমিত। আর-দশজন পর্যটকের সঙ্গে স্টার ফেরিতে কাওলুন যাতায়াত করি, হেঁটে হেঁটে একটু একটু করে শহর দেখি, দোকানপাটে চুঁ দিই। জিনিসপত্র শস্তা, তবে কোনটি আসল ব্র্যান্ড, কোনটি নকল, তা বোঝা কঠিন। একটা স্যামসোনাইট ব্রিফকেস কিনলাম–আসল-নকলের চিন্তা না করে, সেটি আর ব্যবহার না করলেও এখনো টিকে আছে। হংকংয়ের রাতের জীবনের সামান্য পরিচয় নিলাম–একটা টপলেস বারে বসে পান করে।
ব্যাংককে রাত্রিযাপন করলাম আগেরবারের মতোই এয়ারলাইনসের সৌজন্যে। সেখানে ট্যাকসি নিলেই তার ড্রাইভাররা নানারকম ছবি দেখায়, নানা জায়গায় নিয়ে যেতে চায়। তাদের এড়াতে কষ্ট করতে হয়। নিজের মতো সামান্য ঘোরাঘুরি করি, খাইদাই। এখানকার হোটেল অ্যামবাসাডরের ফুড কোর্টটি বেশ পছন্দ হলো। হাতে সময় কম, একটু ক্লান্তিও বোধ হয়। তারই মধ্যে অনুভব করি, শহরটা নতুন করে এবং আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলার ক্লান্তিহীন প্রয়াস চলছে।
৮.
আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলাম মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ পরীক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নিতে। কিন্তু তার আগেই, ২৯ তারিখ সকালে। খবর পাওয়া গেল, কবি নজরুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম পিজি হাসপাতালে। লোকে লোকারণ্য। ভিড় ঠেলে যখন ওপরে উঠলাম, তখন জানলাম, লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে বাংলা একাডেমিতে। সেখানে গিয়ে শুনলাম, লাশ ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে। সেখানে যারা ছিলেন, তাঁরা বললেন, লাশ বাংলা একাডেমিতে। আসলে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে লাশ নেওয়া হয়েছিল, তবে বেশ পরে।
পথ চলছি আর কবির কথা মনে পড়ছে। প্রথমে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম ১৯৫৯ সালে, কলকাতায়। মানিকতলায় একটা ফ্ল্যাটে থাকতেন তখন। শেষ দেখি বাংলা একাডেমিতে, ১৯৭৪ সালে। তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল গাড়ি করে। তিনি কিছুতেই গাড়ি থেকে নামবেন না। একরকম টেনে-হিঁচড়ে তাঁকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মঞ্চে তুলে দেওয়া হয়। আমার খুব খারাপ লেগেছিল। মনে হয়েছিল, নিজেদের খাতিরে তার ওপর অত্যাচার করছি। আমরা। সেদিনকার অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম একজন বক্তা। কবির পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর সম্পর্কে কিছু বলা ছিল পরম সৌভাগ্যের বিষয়। আমি সেবারে নজরুলের গদ্যরচনার বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, এসব রচনা যতটুকু সমাদর পাওয়ার যোগ্য, ততটুকু পায়নি।
বাংলা একাডেমিতে সেদিন যখন দ্বিতীয়বারের মতো ফিরে এলাম, তখন দেখি প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম সেখানে উপস্থিত। তাঁর কথা থেকে মনে হলো, তিনি চাইছেন, বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে কবিকে সমাহিত করা হোক। তখনই প্রথম উপলব্ধি করলাম যে, কবিকে ঢাকায় সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে কোনো এক পর্যায়ে–সে-বিষয়ে তাঁর পুত্রদের মতামত কেউ নিয়েছেন কি না, বোঝা গেল না। এটা তো সবারই জানা যে, চুরুলিয়ায় যেখানে প্রমীলাকে কবর দেওয়া হয়, তার পাশে কবির সমাধির জন্যে জায়গা রাখা ছিল। মনে হলো, এই মুহূর্তে কবির মৃতদেহের ওপরে তাঁর পরিবারের চেয়ে বাংলাদেশ সরকারের দাবি অধিক।
প্রেসিডেন্টের কথার জবাবে একাডেমির মহাপরিচালক ড. আশরাফ সিদ্দিকী বললেন, একাডেমির পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা-অনুযায়ী ওই প্রাঙ্গণে একটি ভবন নির্মাণের কথা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট এক পর্যায়ে রুষ্ট হয়ে বললেন, আপনার পরিকল্পনা আমি ছিঁড়ে ফেলে দেবো। অনেকেই নজরুলের সমাধির স্থান সম্পর্কে সুপারিশ করতে থাকলেন প্রেসিডেন্টের কাছে। কেউ বললেন, রেসকোর্সে তিন নেতার সমাধির পাশে তার জায়গা হতে পারে। আমরা দু একজন বললাম, শহীদ মিনারের উলটো দিকের জায়গাটা বিবেচনা করা যেতে পারে। ড. রফিকুল ইসলাম ও মুস্তাফা জামান আব্বাসী–সম্ভবত সেইসঙ্গে জাদুঘরের ড. এনামুল হকও-খুব করে বলতে থাকলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মসজিদের পাশে তাঁকে কবর দিতে এবং তাঁরা নজরুলের সেই গানটির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরীকেও অনুরোধ করছিলেন এই দাবি জানাতে। উপাচার্য বললেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তেমন সিদ্ধান্ত হলে বিশ্ববিদ্যালয় সকল আনুষ্ঠানিকতা পালন করবে।
এমন অবস্থায় প্রেসিডেন্ট ফিরে গেলেন–সম্ভবত বঙ্গভবনে। সেখানে উপদেষ্টা-পরিষদের সভায় স্থির হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-প্রাঙ্গণেই। কবির শেষ শয্যা রচিত হবে। যথারীতি সব ব্যবস্থা সম্পন্ন হলো। খবর পাওয়া গেল, কাজী সব্যসাচী অচিরেই ঢাকায় এসে পৌঁছোবেন। তাতে একটু চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। রেসকোর্সে জানাজা পড়া হলো। শবাধার বহন করলেন প্রেসিডেন্ট এবং সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধান। সেই সময়ে আকাশে একটি উড়োজাহাজ দেখা গেল। অনেকেই বললেন, ওই আসছে সব্যসাচী। ভিড়ের মধ্যে কেউ চেঁচিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়–তিন বাহিনীর গার্ড অফ অনার। দিয়ে–কবিকে সমাধিস্থ করা হলো। সবকিছু শেষ হওয়ার পরেও আমরা কিছু লোক দাঁড়িয়ে রইলাম। কাজী সব্যসাচী এলেন–কবরের কাছে গেলেন, বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য না করে অস্ফুটস্বরে বললেন, আমার জন্যে একটু অপেক্ষা। করলেন না!’ তিনি চলে গেলেন, আমরাও যে-যার পথ ধরলাম।
বাড়ি ফিরলাম বেশ দেরিতে। শুনলাম, টেলিভিশন থেকে বারকয়েক ফোন এসেছে, রাতে কবির সম্পর্কে একটি অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হবে–আমি যেন অবশ্যই তাতে যোগ দিই। অবসন্ন দেহ ও মন নিয়ে টেলিভিশন-ভবনে যখন পৌঁছোলাম, তখন অনুষ্ঠান শুরু হতে কয়েক মিনিট বাকি। সকলে স্টুডিওতে একটা বড়ো টেবিল ঘিরে বসে আছেন : কাজী মোতাহার হোসেন, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল, মঈনুদ্দীন, কবীর চৌধুরী, সিকান্দার আবু জাফর, আশরাফ সিদ্দিকী, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ফিরোজা বেগম, রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, শাহাবুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। হয়তো হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন, ছিলেন আরো কেউ কেউ। মুস্তাফা মনোয়ার আমাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিলো তাদের মধ্যে এবং নিজেকেই জায়গা করে নিতে হলো। অনুষ্ঠানটি মর্মস্পর্শী হয়েছিল। তবে একটু ছন্দপতন হয় কাজী মোতাহার হোসেন যখন নিজের বক্তব্যের শেষে নজরুলের একটি গান গেয়ে শোনালেন, তখন।
এরপর সৈয়দ আহমদ হোসেন ও এনামুল হক মিলে উদ্যোগ নিয়েছিলেন নজরুলের জন্যে একটি নাগরিক শোকসভা অনুষ্ঠানের। আমি বাংলা বিভাগে পরীক্ষা নিচ্ছি। এরই মধ্যে আহমদ ঢুকল। তার হাতে শোকসভা আহ্বান করে লেখা পত্র–তাতে অনেকে সই দিয়েছেন এর মধ্যে। অধ্যাপক আহমদ শরীফ তখন বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান। আহমদ তার সামনে কাগজটা খুলে ধরলো। তিনি দু-একটি নাম দেখে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন : মস্কোওয়ালাদের সঙ্গে আমি সই দিই না।’ আহমদ বললো, ‘সার, এ তো নজরুলের জন্যে শোকসভার আহ্বান।’ আমিও তার সঙ্গে যোগ দিলাম। কিন্তু আহমদ শরীফ অবিচলিত। এসব লোকের সঙ্গে তিনি স্বাক্ষর দেবেন না। আহমদ ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে গেলো।
নাগরিক শোকসভার আহ্বানে আমার স্বাক্ষর থাকলেও সভায় আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। আমাকে চট্টগ্রামে ফিরে যেতে হয়েছিল। সভা হয়েছিল ইনজিনিয়ার্স ইনসটিটিউটে। বেশ বড়ো ও ভালো অনুষ্ঠান–দলমতনির্বিশেষে কবির প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন।
৯.
গত এক বছরে দেশে অনেক কিছু ঘটে গেছে। সামরিক আইনের ঘোষণার দ্বারা সংবিধান সংশোধন করে দেশের নাগরিকদের বাঙালি না বলে বাংলাদেশি আখ্যায়িত করা হয়েছে; দালাল আদেশ বাতিল হয়েছে; রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা ব্যক্তিগত খাতে ছেড়ে দেওয়া শুরু হয়েছে–মওলানা ভাসানী এই নীতি সমর্থন করেছেন। বিমানবাহিনী-প্রধান এম জি তাওয়াব পদত্যাগ করে জার্মানিতে ফিরে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সেখানেই ছিলেন, একবার কলকাতায় এসে বাংলাদেশ সরকারের কাছে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু বিনিময়ে তিনি কী পাবেন, তা জানতে চেয়ে হতাশ হয়ে জার্মানিতেই প্রত্যাবর্তন করেন। এই ঘটনার কথা আমি তাজউদ্দীন আহমদের কাছে জেনেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এয়ার ভাইস-মার্শাল এ কে খোন্দকারকে সরিয়ে তাওয়াবকে বিমানবাহিনী-প্রধান করা হয়। যে-সাত মাস তিনি ওই পদে ছিলেন, সে-সময়ে তিনি পাকিস্তানপন্থী ও জামাতপন্থীরূপেই নিজের ভাবমূর্তি তুলে ধরেছিলেন। সিরাতুননবী-উপলক্ষে ঢাকায় বিশাল সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন, সমাবেশে যোগদানকারীদের দুপুরে ভালোরকম খাইয়েছিলেন পঞ্চাশ পয়সায়, সউদি আরব ও লিবিয়ার রাষ্ট্রদূতদের দুপাশে বসিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারকে গালমন্দ করেছিলেন প্রচুর, এবং ধর্মীয় পরিচয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশকে তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র বানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার সহকর্মীরা বোধহয় সেই মুহূর্তে অতদূর যেতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাই কোথাও সংঘাত লেগে থাকবে এবং তার ফলে তাওয়াবকে বিদায় নিতে হয়। এদিকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে কর্নেল তাহেরের প্রাণদণ্ডাদেশ হয়, তার প্রাণরক্ষার যে-আবেদন করেন তাঁর পরিবারের সদস্যেরা, অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপতি তা প্রত্যাখ্যান করেন, এবং পঙ্গু ব্যক্তিকে ফাঁসি না দেওয়ার প্রচলিত নিয়ম অগ্রাহ্য করে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করা হয় কূটনৈতিক নিয়োগ দিয়ে–ব্যতিক্রম শুধু কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশীদ। তার একটা কারণ হয়তো এই যে, লন্ডনে তাঁরা এই মর্মে বিবৃতি দেন যে, বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে খন্দকার মোশতাক ও মেজর-জেনারেল জিয়াউর রহমানের সংস্রব ছিল।
বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরীকে অপসারণ করা হয়। মাস ছয়েকের মধ্যে সিনেট উপাচার্য-নিয়োগের জন্যে যে-নতুন প্যানেল নির্বাচিত করে, তাতে আবার আবদুল মতিন চৌধুরীর নাম থাকে। সেইসঙ্গে নির্বাচিত হন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী। উপাচার্য নিযুক্ত হন ফজলুল হালিম চৌধুরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক গণতন্ত্রমনা শিক্ষক–যাঁরা আইয়ুবের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন, তাঁরাও–সরকারের কাছে বাকশালপন্থী নির্বাচিত সিনেট ভেঙে দেওয়ার আবেদন জানান।
এ-সময়ে একদিন চট্টগ্রাম শহর থেকে ক্যাম্পাসে বাসায় ফিরে শুনি যে, আমার কাছে একজন অতিথি এসেছিলেন এবং তিনি আমাকে না পেয়ে আলমগীর সিরাজুদ্দীনের বাসায় অপেক্ষা করছেন। ফোন করে জানলাম, তিনি অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ। আসহাবউদ্দীন সাহেবকে আমি চিনি ১৯৫২ সালে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সম্মেলনের সময় থেকে। তিনি লায়লা নূরকে দিয়ে আমার একটি ছোটগল্পের ইংরেজি অনুবাদ করিয়ে তাঁর সম্পাদিত Teacher পত্রিকায় ছেপেছিলেন। তাঁকে সসম্মানে আমার বাসায় আসতে অনুরোধ করলাম। তিনি এলেন। জানতে চাইলেন, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করি কি না। আমার উত্তর শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে ময়মনসিংহ-সীমান্তে ভারত যে-হামলা করছে, আমি তার প্রতিবাদে বিবৃতি দিতে প্রস্তুত কি না। আমি বললাম, এটা সত্যিকার হামলা হলে আমি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতাম, কিন্তু হামলার বিষয়টা অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্যে সরকারি প্রচার বলে সন্দেহ করার কারণ আছে। তিনি আমার কথা মানলেন না। এবারে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করেন কি না। তিনি বললেন, অবশ্যই করেন। আমি জানতে চাইলাম, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছর পরেও তাহলে তাদের পার্টির নামে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবহৃত হচ্ছে কেন? এ-প্রশ্নের জন্যে অধ্যাপক তৈরি ছিলেন না, কিন্তু উত্তর দিতে তার দেরি হয়নি। তিনি বললেন, পার্টি-কংগ্রেস ছাড়া পার্টির নাম বদল করা যায় না, আর কংগ্রেস ডাকার অনুকূল পরিস্থিতি এতদিন ছিল না। এখন পরিস্থিতি অনুকূল হয়েছে, কংগ্রেস করে তারা পার্টির নাম বদল করবেন।
১০.
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক টিলার ওপর নির্মিত কোনো ঠিকাদারের তত্ত্বাবধায়কের কোঠা পরিত্যক্ত হওয়ায় সেখানে ক্লাব স্থাপন করা হলো। তার আগে বিকেলবেলায় আমরা কয়েকজন পালাক্রমে একেকজনের বাড়িতে কনট্রাক্ট ব্রিজ খেলে বেড়াতাম। এখন এক ছাদের নিচে তাস, দাবা, ক্যারম খেলার এবং সেই সঙ্গে চা-পানের ব্যবস্থা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন নিয়ে আমরা যারা এ-দলে ও-দলে বিভক্ত ছিলাম, তারাও একসঙ্গে ওঠাবসার একটা সহজ সুযোগ পেয়ে গেলাম।
আমাদের ভাগটা ঠিক জাতীয় রাজনীতিকেন্দ্রিক ছিল না, আবার একেবারে রাজনীতিবর্জিতও ছিল না। মোটের ওপর যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, অন্তত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শের পক্ষের, তাঁরা একদিকে ছিলাম। আমাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, জাসদ, সিপিবির সমর্থক ছিলেন, চীনপন্থী রাজনীতির সমর্থক ছিলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক নন-এমনও অনেকে ছিলেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হওয়া উচিত, কী হওয়া উচিত নয়, এটাই ছিল তাৎক্ষণিক চিন্তার বিষয়। এই ভাগাভাগি তিক্ততার সৃষ্টি করেনি–অন্তত অনেকদিন পর্যন্ত। মোহাম্মদ আলীকে আমি অনেক সময়ে তাঁর বাড়ি থেকে কলাভবনে অথবা কলাভবন থেকে বাড়ি পৌঁছে দিতাম আমার গাড়িতে। কলা অনুষদের ডিনের নির্বাচনে যেদিন আমি তার কাছে হেরে যাই, সেদিনও তাকে অফিস থেকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলাম। বলা যায়, প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও সৌজন্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখার একটা চেষ্টা ছিল। তবে শেষরক্ষা করা যায়নি।
ক্যাম্পাসের বাইরে আমাকে অনেক সময় দিতে হতো। ঢাকায় নানাকাজে আসতে হতো, কদাচিৎ রাজশাহীতেও যেতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে, তার চাইতে বেশি যাওয়া হতো কুমিল্লায় ‘অলক্তে’র নানা উপলক্ষে। তবে চট্টগ্রাম শহরে আসতাম বেশ ঘন ঘন। বন্ধুদের মধ্যে আবদুল আলী তো ছিলেনই, ১৯৭৩ সালে যুগ্ম কর কমিশনার হয়ে মোহাম্মদ আলী এলো–সে থাকলো টানা ছয় বছর। তার আগ্রাবাদের সরকারি বাসভবন বন্ধুদের আড্ডার একটা ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ালো। আমার ভাগ্নি সেলিমা ও ভাগ্নিজামাই আফজালের নাসিরাবাদের বাড়িতে যেতাম। হাবিবুল্লাহ খান ও সালমা খান-দম্পতি আপ্যায়ন করতে ভালোবাসতেন–তাঁদের বাড়িতে বড়ো বড়ো জমায়েত হতো। সেখানে দুই শিল্পী-দম্পতির সাক্ষাৎ পাওয়া যেতো-রাজিয়া শাহিদ ও শাহিদের এবং চমন আফরোজ কামাল ও শামসুল কামালের। কামালদের বাড়িতেও গেছি। আরেক কামাল-ডা. কামাল এ খানের–আমন্ত্রণও ছিল অপ্রতিরোধ্য।
চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক উদ্যোগের সঙ্গে আমার ছিল নাড়ির যোগ। রবীন্দ্র জয়ন্তী-নজরুল-জয়ন্তী, একুশে ফেব্রুয়ারি-নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস-বিজয় দিবস–এসব পালনের জন্য যত কমিটি হতো, তাতে আমি সক্রিয় থাকতাম। এই ধরনের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও পরিবেশনে আবুল মোমেন ও কামাল এ খানের বড় ভূমিকা থাকতো। শামসুল হোসাইন ও মাহবুবুল হকও এসবের সঙ্গে জড়িত থাকতেন। মোমেনের সুচিন্তিত পরামর্শে আমি সবসময়ে উপকৃত হয়েছি।
চট্টগ্রামে যতদিন বাংলাদেশ পরিষদ টিকে ছিল, ততদিন তার অনুষ্ঠানেও যেতাম–মূলত তার পরিচালক ফখরুজ্জামান চৌধুরীর কারণে। তার সঙ্গে আমার প্রীতির সম্পর্ক ছিল, তবে আমার চেয়েও তার অন্তরঙ্গতা ছিল আবু হেনা মোস্তফা কামালের সঙ্গে। বাংলাদেশ পরিষদের বাইরেও আমরা তিনজন মিলিত হতাম। সময় করতে পারলে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতেন মুর্তজা বশীর এবং চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার হাসনাত আবদুল হাই। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক জীবনে হাসনাত আবদুল হাইয়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল এবং তার উদ্যোগেই সেখানে শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তনের প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হয়েছিল। মনে পড়ে, ফখরুজ্জামান চৌধুরী একবার স্কুটারযোগে শহর থেকে আমার বাড়িতে আসতে গিয়ে যাত্রার প্রায় শেষে এসে স্পিডব্রেকারে গাড়ির গতি শ্লথ না করায় মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। স্কুটার থেকে নেমে ড্রাইভারকে তিনি একটা চড় মেরেছিলেন এবং তার দরুন তাকে দশ টাকা দিয়েছিলেন ভাড়ার অতিরিক্ত। হাসনাত আবদুল হাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে চট্টগ্রামের জেলা জজ নূরুল ইসলামের সঙ্গে আমার একটা বিরোধ মিটিয়ে দিয়েছিলেন। আমার মুনীর চৌধুরী বইয়ের কোনো মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে জজ সাহেব আমাকে উকিলের চিঠি পাঠিয়েছিলেন।
একবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসছিলাম বিমানে। সহযাত্রীদের মধ্যে। ছিলেন কবীর চৌধুরী এবং শামসুল কামাল। কুমিল্লা পার হতে হতে বিমানটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পড়ে প্রায় ওলট-পালট করতে থাকল। কোনো কোনো যাত্রীর আসনের সামনের ট্রেতে রাখা গ্লাস উড়ে গিয়ে কেবিনের মধ্যে লুটোপুটি খেতে লাগল। ক্রুদের পাংশু মুখ দেখে বিপদের মাত্রা অনুধাবন করতে পারছিলেন যাত্রীরা। শেষ পর্যন্ত আবার ওই দুর্যোগের মধ্য দিয়েই বিমান ফিরিয়ে ঢাকায় নিয়ে এলেন পাইলটেরা। পরে জেনেছিলাম, বিমানের রাডার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং ককপিট থেকে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। মহিলা এবং নাবালকদের আগে নামবার সুযোগ দিতে আসনে বসে রইলাম। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে ১৪-১৫ বছর বয়সের একটি মেয়ে আমার গায়েই বমি করে দিলো। তেজগাঁও বিমানবন্দরের টয়লেটে গিয়ে যতটা-পারা যায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া গেল। কবীর ভাই যাত্রা বাতিল করে বাড়ি ফিরে গেলেন। শামসুল আলম ফোন করে তার অফিস (গ্ল্যাকসো) থেকে গাড়ি আনালেন। সেই গাড়িতে আমরা দুজন চট্টগ্রামে ফিরে এসেছিলাম–ফেনীতে তাঁর বাড়ি হয়ে।
১১.
লন্ডন থেকে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির পরিচালক জোন ল্যানকাস্টারের চিঠি পেলাম। লিখেছেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা কুঠির কাগজপত্রের যে হ্যান্ডলিস্ট আমি তৈরি করে দিয়েছিলাম, সেটা নিয়ে আলোচনা করে তাঁরা ওইসব কাগজপত্রের একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকাপ্রণয়নের আবশ্যকতা অনুভব করেন। আমি সে-কাজটা করব কি না, তা জানতে যখন তারা আমার খোঁজ করেন, তখন শোনেন, আমি দেশে ফিরে এসেছি। ব্রিটিশ অ্যাকাডেমির ওরিয়েন্টাল ডকুমেন্টস্ কমিটির কাছ থেকে তারা আমার তিন মাসের ব্যয়নির্বাহের একটা ব্যবস্থা করেছেন। এখন আমি যদি কাজটা করতে সম্মত হই এবং যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে তাঁরা বাধিত হন।
আমি প্রলুব্ধ হলাম। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করলাম লন্ডন যাওয়া-আসার বিমানভাড়া চেয়ে। উপাচার্যের সুপারিশসহ সে-আবেদন হাতে হাতে নিয়ে গেলাম অধ্যাপক এম এ বারীর কাছে। তিনি খুব উৎসাহী হলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বললেন, কমিশন থেকে এজন্যে অর্থ-মনজুরি সম্ভবপর, তবে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে কিছু সময় লাগবে।
আবদুল মোমেন ততদিনে লিডসের পাট চুকিয়ে লন্ডনে চলে এসেছেন। সপরিবারে। তাঁকে লিখলাম মাথা গোঁজার একটা ঠাই ঠিক করে দিতে। তিনি পত্রপাঠ লিখলেন, তাঁদের সঙ্গে আমি অনায়াসে থাকতে পারি।
১৯৭৭ সালের ২৫ মার্চ সকালে হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। সেখান থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে গেলাম লন্ডনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ল্যাম্বল স্ট্রিটে মোমেনের কাউন্সিল-ফ্ল্যাটে। তিনি ছিলেন না। রোজী হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন, কৌতূহলের সঙ্গে রঙ্গন। মোমেন সর্বক্ষণের চেয়েও বেশি সময় কাজ করেন ক্যামডেন কাউনসিল ফর রেস রিলেশনসে। রোজী কাজ করেন। খণ্ডকাল। ছেলে স্কুলে যায়। প্রকৃতপক্ষে ছেলের ঘরই আমি অধিকার করলাম। সে গেল বাপ-মার ঘরে।
সপ্তাহের দিনগুলোয় সকালবেলায় নাশতা খেয়ে চলে যেতাম লাইব্রেরিতে। সেখান থেকে কোনোদিন বিবিসি হয়ে, কোনোদিন আর কোথাও গিয়ে, কোনোদিন সিনেমা-থিয়েটার দেখে রাতে ফিরতাম। ফিরে কখনো একা, কখনো একসঙ্গে, চা-কফি খেতাম। শনিবারে মোমেনদের সঙ্গে বাজারে যেতাম, আমিও টুকটাক কিছু কিনতাম এবং তাঁদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সারতাম। রঙ্গনের সঙ্গে আমার একটা লেনদেনও চুকিয়ে ফেলতে হতো সেদিনে। সে বুদ্ধিমান, চঞ্চল ও কৌতুকপ্রবণ। তার চাঞ্চল্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমি প্রস্তাব করলাম, তার সেবার জন্যে সে এক পেনি করে পাবে, আর আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করলে তার এক পেনি জরিমানা হবে। যেমন, সকালে সে আমাকে চিঠি এনে দিলে তার হিসেবে এক পেনি জমা হবে, আবার পায়ে-পা দিয়ে আমাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করলে তার এক পেনি জরিমানা হবে। এই যোগ-বিয়োগের পরে যা তার প্রাপ্য হতো, সেটা তাকে দেওয়া হতো শনিবারে, বাজারে গিয়ে। তা দিয়ে সেখানেই সে কিছু কিনে নিতো। জরিমানা দিতে তার আপত্তি ছিল না, তবে সে খেয়াল রাখতো যাতে সপ্তাহান্তে তার হাতে কিছু জমা পড়ে। আয় বাড়াবার চেষ্টাও তার ছিল। যেদিন দুটো চিঠি আসততা, সেদিন সে জানতে চাইতো তার পাওনা এক পেনি হলো, না দুই পেনি। আমি বলতাম, এটা একবারের সেবা, অতএব এক পেনি। সে মেনে নিয়ে চলে যেতো। যে-সপ্তাহে সেবা বেশি হতো, সে-সপ্তাহে তার জরিমানা দেওয়ার প্রবৃত্তিও একটু বাড়তো।
আমি একবার আমার ছাত্রী নাসরীন ওরফে হেলেনের বাড়িতে এই ব্যবস্থার কথা বলেছিলাম। কদিন পরে সে বললো, সার, কী গল্প আপনি করে এলেন! এখন কোনো কাজ করতে বললে আমার মেয়ে বলে, এক পেনি দিতে হবে।’
মোমেনদের বাড়িতে আমি মহা-আনন্দে ছিলাম। তার একটা প্রধান কারণ, তারা আমাকে অতিথি জ্ঞান করতেন না। আমি নিজের মতো থাকতাম এবং আসা-যাওয়া করতাম।
একরাতে বাড়ি ফিরে আমি ইলেকট্রিক কেতলি চালু করে দিলাম। আমার মনে হয়েছিল, তাতে পানি আছে, আসলে ছিল না। ফলে সেটা নষ্ট হয়ে গেল এবং আমি খুব বিব্রত বোধ করলাম। একজনের নাম করে মোমেন বললেন, ‘আমি তাঁর ইলেকট্রিক কেটল এরকম নষ্ট করে ফেলেছিলাম। উনি বলেছিলেন, সারিয়ে আনলেই হবে।
আমি পরদিন মোমেনদের কেতলি সারিয়ে এনেছিলাম।
মোমেনের কাজ ছিল ক্যামডেন এলাকার শ্রমজীবী বাঙালিদের দেখাশোনা করা। তার সঙ্গে অমন এক-আধজনের বাড়িও গিয়েছি। বাড়ির লোকদের সঙ্গে তেমন কথাবার্তা হয়নি। মোমেনের কাছে লন্ডনের রেস্টুরেন্ট-কর্মী অনেক আসতেন। এঁরা লন্ডনের নানা এলাকায় থাকতেন ও কাজ করতেন। তাঁদের সঙ্গে আমারও ভালোই আলাপ হতো। কর্মীদের সমবায়ভিত্তিক মালিকানায় রেস্টুরেন্ট চালাবার সম্ভাবনা সম্পর্কে তারা আলাপ করতেন। তাঁদের সে-প্রয়াস পরে সফল হয়েছিল।
মোমেনের সহকর্মীদের কারো কারো সঙ্গে পরিচয় হয়। সামিন ছিলেন সালমান রুশদির বোন। জ্যান ড্রাইডেন দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গিনী। বর্ণবৈষম্যের দেশ ছেড়ে এসেছে, লন্ডনে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে কাজ করে প্রায়শ্চিত্ত করছে অন্যের হয়ে। আশা করছে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাবে।
মোমেনের কাজ চিত্তাকর্ষক, সহকর্মীরাও আন্তরিক। তাই কাজে ডুবে থাকা তার পক্ষে সহজ। তিনি স্কোয়াটারদের পক্ষে, আমি দোমনা। গৃহহীনদের প্রতি আমার সহানুভূতি আছে, কিন্তু দল বেঁধে অন্যের সম্পত্তি দখল করা! তিনি। নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দেখান, আমি শুনি।
এমনি করে মোমেনের কাছ থেকে চিন্তা-উদ্রেককারী অনেককিছু শুনতে পাই।
১২.
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে বসলাম চিঠিপত্রের খাতা নিয়ে। ঢাকা কুঠির অধীনে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরায় কোম্পানির আটটি আড়ং ছিল। এ আড়ং মেলা নয়, কোম্পানির ফরমাশমতো কাপড় বুনে তাঁতিরা এখানে জমা দিয়ে দাম বুঝে নিতো। ফরমাশ আসততা লন্ডন থেকে কলকাতায়, সেখান থেকে ঢাকা কুঠিতে, কুঠি থেকে আড়ংয়ে। আড়ংয়ের গোমস্তা দাদন দিয়ে কাপড় তৈরি করাতেন। কাপড় বিন্যস্ত হতে পাঁচ শ্রেণিতে। গোমস্তার মনঃপূত না হলে একশ্রেণির কাপড় হয়তো নেওয়া হতো তার নিচের শ্রেণিতে, নয়তো ফেরত দেওয়া হতো। তাঁতির পাওনা থেকে দাদনবাবদ দেওয়া টাকার হিসাব বাদ দিয়ে যদি তার কিছু প্রাপ্য হয়, পেতো। নইলে নতুন করে দাদন নিয়ে সে কোম্পানির কাছে বাঁধা পড়ে থাকতো। এক আড়ংয়ে একবার ঢাকা থেকে যে-পরিমাণ টাকা গিয়েছিল, টিক সেই পরিমাণ টাকাই আদায় হিসেবে ফিরে আসে। দাদন নেওয়া তাতি অন্য কারো কাছে কাপড় বেচতে পারতো না। সে মারা গেলে কোম্পানি তার ঘটিবাটি বেচে দাদনের টাকা আদায় করতো। গোমস্তারা যে পরিমাণ কাপড় আদায় করতে চাইতো, তা-অনেক সময়ে তাঁতি দিতে পারতো না। তখন সে পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে যেতো, পেশা বদল করে অন্য কোথাও বসবাস করতো।
আমি এসব চিঠির সার-সংকলন করতাম ইংরেজিতে। চিঠির ওপরে ইংরেজিতে কিছু নোট রাখতেন ফ্যাক্টর বা তাঁর অধীন কোনো ইংরেজ কর্মচারী। সেগুলো কাজে লাগতো। একবার ferretted শব্দ দেখে খুব বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। যখন নতুন-পুরোনো কোনো ইংরেজি অভিধানে তা খুঁজে পেলাম না, তখন বুঝতে পারলাম, ওটা ফেরত শব্দের সাহেবি রূপ। লাইব্রেরিতে বসে যা নোট করি, বাড়ি এসে সেসব গুছিয়ে পরিষ্কার করে লিখি। তারপর মাইকেল ও’কিফের হাতে দিই। লাইব্রেরির টাইপিস্টকে দিয়ে টাইপ করিয়ে সেগুলো সে। আমাকে দেয়। আমি আবার বাড়িতে বসে সংশোধন করি। তারপর চূড়ান্তভাবে টাইপ হয়। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে মাইকেল ছিল আমার প্রধান সহায়। দুই উপপরিচালক মার্টিন ময়ার ও আর, ডেসমন্ড খোঁজখবর নিয়ে এবং অন্যভাবেও সাহায্য করেন। পুরোনো মানচিত্র থেকে আড়ংয়ের অবস্থানগুলো দেখিয়ে দেন। অ্যানড্র কুক।
লাইব্রেরির সলিম কুরেশি একদিন স্যান্ডউইচের দোকানে পরিচয় করিয়ে। দেন বেলুচিস্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক বাললাচের সঙ্গে। আমার পরিচয় দিতেই বালোচ প্রশ্ন করলেন, তোমরা শেখ মুজিবকে মারলে কেন? আমি এ-প্রশ্নের জন্যে তৈরি ছিলাম না। কী বা বলতে পারি তার উত্তরে। সলিম বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার প্রতিবাদ করায় বালোচকে জেল খাটতে হয়েছিল। এমন লোককে কি বলা যায় যে, তোমার মানবিক মূল্যবোধ বৃথা হয়েছে বাংলাদেশে। বালোচ গবেষণা করছিলেন জার্মানিতে। তার উপকরণ সংগ্রহ করতে গ্রীষ্মকালে এসেছেন লন্ডনে। পরে ১৯৭৯ সালে তাঁর সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়েছিল, সেকথা যথাস্থানে।
সেই স্যান্ডউইচের আড্ডায়ই এক তরুণ ইংরেজ আমাকে বলেছিল, তার বাড়িতে মাদকের আসর বসে মাঝে মাঝে। আমি গেলে সে স্বাগত জানাবে। শুনে মোমেন বললেন, অভিজ্ঞতাসঞ্চয়ের জন্যে যেতে পারেন। আমি সাহস করিনি।
১৩.
বিবিসির বাংলা বিভাগ থেকে তখন কমল বোসের বিদায় নেওয়ার পালা। সেই কবে এসেছিলেন, তিনি যে একদিন থাকবেন না বিভাগে, কারো তা মনে হয়নি। তার বিদায়-উপলক্ষে বেশ কটি পার্টি হলো। আমি প্রায়ই উপস্থিত থাকলাম।
সিরাজুর রহমান এখন কমল বোসের জায়গাটি নিলেন–জন ক্ল্যাপহামের পরেই তার স্থান। তিনি আমাকে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ডাকেন। ডাকেন দীপংকর ঘোষ, সৈয়দ শামসুল হক, শ্যামল লোধ। নূরুল ইসলাম আমাকে দিয়ে ছোটোদের জন্যে তিন মাসের কথিকা একসঙ্গে রেকর্ড করিয়ে নিলেন। তেরোটা কথিকা একসঙ্গে রেকর্ড করলাম–পানি না খেয়ে, স্টুডিওতে যে-মেয়েটি কাজ করে, সে নাকি একটু অবাক হয়েছিল তাতে।
সৈয়দ হক সবে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় রচনা শেষ করেছেন। আমি তার পাণ্ডুলিপির প্রথম পাঠক। কিছু পরামর্শ দিই নাট্যকারকে। তিনি অনেকখানি গ্রহণ করেন।
বিবিসির অনুষ্ঠান করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, নিচের তলায় বিবিসি ক্লাবে আড্ডা হয় অনেকের সঙ্গে। মানসী বড়ুয়া ও সেই সূত্রে সরোজ বড়ুয়ার সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্কের সূচনা হয়ে গেল। মানসী তার বাড়িতে একদিন খাওয়াবে আমাকে, আমি লন্ডন ছাড়ার আগে। কিন্তু হঠাৎ সে সড়ক-দুর্ঘটনায় আহত হলো ভয়ংকর। হাসপাতালে দেখতে গেলাম। মানসী কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, আনিস ভাই, তোমাকে আমার খাওয়ানো হলো না।
আমি বলি, ‘এবার না হোক, আবার হবে।’
আমার কথা ঠিক হয়েছিল।
১৪.
আগেরবার যখন লন্ডনে ছিলাম, তখন নবনীতা দেবসেন তার বন্ধু ডা. অমেয়া দেবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। নবনীতার মতো অমেয়া নামটিও, শুনেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। তবে নবনীতা দেব, আর অমেয়া দেবা। দেব না হয়ে দেবা কেন, তা কি ইংরেজি বানানের মর্যাদা রক্ষা করতে–কেউ কেউ পরে জানতে চেয়েছিলেন আমার কাছে। বলেছিলাম, ইংরেজি বানান নয়, সংস্কৃত উচ্চারণ রক্ষা করতে। বাংলায়ও সে-উচ্চারণ অটুট আছে ‘যেমন দেবা তেমনি দেবী’ এই প্রবাদবাক্যে। অমেয়ার ডাকনাম বুলু। বহুকাল ধরে সে লন্ডনে। জিপি অর্থাৎ জেনারেল প্র্যাকটিশনার।
এবারে গিয়ে ফোন করতেই বুলুর সাদর আহ্বান। সে থাকে পূর্ব লন্ডনে–আমরা যাকে পূর্ব লন্ডন বলে শনাক্ত করি, তার কিছুটা উত্তরে–এক চারতলা বাড়ির তিনতলার ফ্ল্যাটে। সাউথ উডফোর্ড আন্ডারগ্রাউন্ডে নেমে একটু হেঁটে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে দেখা গেল আসবাব আর বইপত্রে ঠাসা ঘর। পরে জানা গেল বাংলা গান ও পাশ্চাত্য সংগীতের বিশাল সংগ্রহ তার। বুলু নিজে রান্না করেছিল। কিন্তু যা খেলাম, তার অনেকখানিই উদ্গিরণ করে দিলাম। ডাক্তারের বাড়ি, সুতরাং সঙ্গে সঙ্গে ওষুধও খেতে হলো। আমার লজ্জার মাত্রা তাতে একটু বাড়লো।
বুলু লন্ডনের ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক। ইউরোপে কোনো সম্মেলনে অচিরে ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে তার প্রবন্ধ পড়ার কথা। এই প্রসঙ্গে ব্রাহ্ম-আন্দোলন সম্পর্কে কিছু বাক্যবিনিময় হলো। আমি যতদূর জানতাম, তার প্রায় সবটাই বলা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে বুলুর ভুল ধারণা হলো যে, এ-বিষয়ে আমি অনেক জানি, যা প্রকাশ করেছি তা সামান্যমাত্র। সুতরাং তার দিক দিয়ে আলোচনার একটা তাগাদা রয়ে গেল। আবার যাওয়ার আমন্ত্রণটা আর লৌকিক শিষ্টাচারে সীমাবদ্ধ রইল না।
সেই থেকে উভয়ের অবসরের সময়টা মিলে গেলে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। হয় আমি তার বাড়ি গিয়েছি, নয় ওয়ালথামসটো আন্ডারগ্রাউন্ডের বাইরে অপেক্ষা করেছি–বুলু সার্জারিফেরত তুলে নিয়েছে। কখনো আমরা অন্যত্র মিলিত হয়েছি। বইপড়ার যথেষ্ট সময় না পেলেও বুলু বই কিনতে ভালোবাসততা, সিনেমা-থিয়েটারে যেতে চাইতো। পাবে বসতে বা বাইরে খেতেও সে আগ্রহী ছিল। এর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় একা যাওয়া যায় না বা একা যেতে ভালো লাগে না। তার সঙ্গে রুচির মিল থাকায় এসব জায়গায় একসঙ্গে যাওয়া আমরা উপভোগ করেছি। অনেক সময়ে–বিশেষ করে সে ‘অন কল’ থাকলে–তার বাড়িতে বসে গল্প করেছি, কখনো তার রান্না খেয়েছি, কখনো বাইরে থেকে খাবার এনে খাওয়া হয়েছে।
গাড়িচালনায় বুলু ক্লান্তিহীন। কখনো কখনো এতটা পথ আমাকে পৌঁছে দিয়েছে। তবে সাধারণত আমি নিজের মতোই ফিরেছি। একবার গল্প করতে করতে টিউব-চলাচলের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় ট্যাকসি নিতে হয়।
আরেকবার ফিরতি ট্রেনে খানিকক্ষণ চলার পরে টের পাই, ঘরের বাইরের দরজার চাবি আনতে ভুলে গেছি। মোমেনরা আগেভাগে শুয়ে পড়েন। অত রাতে ঘুম থেকে তাদের জাগিয়ে আমার বাড়ি ফেরার কথা নয়। সুতরাং পথে নেমে চলে গেছি বুশ হাউজে। বিবিসির ভোরের বাংলা অনুষ্ঠান করতে যিনিই আসেন, তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া যাবে। গিয়ে দেখি, সেদিন শফিক রেহমানের পালা। আমার সংকটের কথা বলতে তিনি বললেন, আজই আমাদের বন্ধু মোকাম্মেল হক এসেছে তার নবপরিণীতাকে নিয়ে। ছেলের ঘরটা তারা নিয়েছে। আরেকটা বাড়তি ঘরে আমার জায়গা হতে পারে, তবে সেটা হয়তো আরামদায়ক হবে না। বললাম, এক রাতের জন্যে এমনকী আর অসুবিধে হবে!
রাতটা কাটিয়ে সকালে নাশতা খেয়ে সবার কাছে বিদায় নিলাম। মোকাম্মেলের স্ত্রী তালেয়ার সঙ্গে পরিকল্পনা করতে থাকলো দোকানে যাওয়ার এবং বিনোদন সন্ধান করার আগ্রহে।
বুলুর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমি কোনো কৌতূহল প্রকাশ করিনি। ফলে একটু একটু করে সে-ই অনেকটা জানাতে থাকে। জীবনের দাক্ষিণ্যলাভ সবার ঘটে না। কেউ কেউ সেই ক্ষতির পূরণ খোঁজে কাজে ডুবে গিয়ে। দেশে বুলুর মা এবং ভাইবোনেরা আছেন তাদের জন্যে সে কর্তব্যের অধিক করতে চায়। সে সহজে বন্ধুত্ব করে, বন্ধুদের জন্যে নিজেকে উজাড় করে দেয়, মাঝে মাঝে সেখানেও ধাক্কা খায়। ফলে তার স্বভাবের একটা দিক স্পর্শকাতর হয়ে থাকে।
মানসীদের সঙ্গে বুলুর আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে, দীপংকর ঘোষদের সঙ্গে আছে আগে থেকে যোগাযোগ। সিরাজুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় আছে, সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গেও আছে আলাপ। বিবিসি ক্লাবে আসে সে, তবে কদাচিৎ, নাজির আহমদ তাকে খুব পছন্দ করেন।
তার বাড়িতে আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব অনেক আসেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। আমার বিশেষ ভালো লাগে রানা বলে তার দূরসম্পর্কের এক ভাইকে।
এবারে লন্ডন থেকে ফেরার পূর্বমুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের কবিতার চরণ মনে পড়েছে : প্রবাসের দিন মোর পরিপূর্ণ করি দিলে, নারী,/ মাধুর্যসুধায়। মনে মনেই তা বলেছি, কারো সামনে উচ্চারণ করিনি। বোধহয় তার প্রয়োজনও ছিল না।
১৫.
আমাদের ফুপা, পুলিশের ডিআইজি, আবু কামাল লন্ডনে এসেছেন সরকারি কাজে। কাজ সারার পর দিন দুই সময় আছে তার হাতে। ওই দুদিন আমি তার সঙ্গে ঘুরি। দ্রষ্টব্য কিছু দেখাতে নিয়ে যাই অথবা কেনাকাটায় সাহায্য করি।
অক্সফোর্ড স্ট্রিট দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ চোখে পড়ে, অনিরুদ্ধ রায় বসে আছে এক রেস্টুরেন্টে। একই টেবিলে এক শ্বেতাঙ্গিনী ও একটি শিশু।
ফুপাকে বলি, চলুন, এখানে চা খেয়ে নিই। তারপর দ্রুত অনিরুদ্ধের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করি, মহিলাকে না হয় বুঝলাম, বাচ্চাটা এলো কোথা থেকে?
অনিরুদ্ধ চমকিত, আমাকে দেখে বিস্মিত ও আনন্দিত, আমার প্রশ্ন শুনে হেসে কুটিকুটি। প্যারিসে যাচ্ছে সে লাইব্রেরি ও আর্কাইভসে বইপত্র ঘাঁটতে। যাওয়ার পথে লন্ডনে থেমেছে। আরো দু-একদিন থাকবে। আছে ইন্ডিয়ান ওয়াইএমসিএ-তে।
ফুপার কাজ শেষ করে সপ্তাহান্তটা ব্যয় করি অনিরুদ্ধের সঙ্গে। আনন্দদায়ক সময় কাটে।
তখন মারারজী দেশাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী। লন্ডনে ভারতীয় ছাত্রদের সভায় তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন। অনিরুদ্ধ যায়নি সেখানে, তবে তার সহবাসীদের কাছে বিবরণ শুনেছে। প্রথমে তো মোরারজী তাঁর বিখ্যাত ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন স্বাস্থ্য ভালো রাখার। তারপর ব্রিটেনে বর্ণবাদী মনোভাব সম্পর্কে এক শ্রোতার অভিযোগের জবাবে দিয়েছেন সহজ সমাধান : ইউ লাভ দেম, দে উইল লাভ ইউ।
আমি যে লন্ডনে কাজের কিছু করছি, অনিরুদ্ধ তা স্বীকার করে না। বলে, ওসব আমার বেড়াতে আসার ছল।
যাওয়ার আগে সে আমাকে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। বললো, দোকানে গিয়ে কাপড়টা পালটে নিয়ে তার কাছে যেন ডাকযোগে পাঠাই প্যারিসে। ইচ্ছে না থাকলেও কাজটা করতে হলো।
প্যারিস অনিরুদ্ধের দ্বিতীয় শহর। কারো ভারত ভ্রমণকাহিনি নিয়ে কাজ করছে তখন সে। কাজটা করে খুব সুখ পাচ্ছে।
১৬.
কামাল হোসেনরা অক্সফোর্ডে আছেন। এর মধ্যে রেহমান সোবহান এসে সেখানে যোগ দিয়েছেন কুইন এলিজাবেথ হাউজে। কুইন এলিজাবেথ হাউজ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন নূরুল ইসলাম–এফএওতে একটা বড়ো পদে যোগ দেবেন, থাকবেন রোমে। ওদিকে মুশারফ হোসেনও চলে এসেছেন অক্সফোর্ডে।
আমাদের বন্ধু অর্জুন সেনগুপ্ত ব্রাসেলসে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিল। দিল্লিতে সরকারবদলের ফলে তার সে-দায়িত্বের অবসান ঘটেছে। সেও চলে এসেছে। অক্সফোর্ডে।
অক্সফোর্ডে গেলে সব সময়ে ভালো লাগতো। এখন সময়টা আরো জমিয়ে কাটে।
তপন রায়চৌধুরীর অধীনে পিএইচি ডি ডিগ্রির জন্যে গবেষণা শুরু করেছেন হামিদা হোসেন। যদিও ছাত্রী তিনি ইংরেজি সাহিত্যের, তবে ইতিহাসের গবেষণায় তা বাধা হয়নি। তাঁর বিষয় : বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দাদন নেওয়া তাঁতিদের অবস্থা। গবেষণার কাজে তিনি আসেন ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। আমি যেসব চিঠিপত্র ঘাঁটছি, তা তার কাজে আসে। তিনি আমাকে কিছু প্রাসঙ্গিক সূত্রের খবর দেন, তা আমার কাজে লাগে।
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম ও শরীফউদ্দীন আহমদ নিয়মিত আসেন, আসেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সুশীল চৌধুরী। কিংস কলেজের পিটার মার্শাল আসেন, আমার কাজকর্মের খবর নেন।
তার নতুন বই বেরিয়েছে East Indian Fortunes–আমি তা সংগ্রহ করি।
লাইব্রেরিতে একদিন একটি ভারতীয় মেয়ে বললো, আপনাদের রাষ্ট্রপতির মেয়ে থাকে আমাদের হস্টেলে। আমার কাছ থেকে আপনার কথা জেনে সে যেতে বলেছে আপনাকে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছে নিগার। এখন লন্ডনে এসেছে উচ্চশিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নিতে। গেলাম তার কাছে। গল্পসল্প হলো। রাজনীতির কথা হলো খুবই সামান্য। মনে হলো, বিচারপতি সায়েম খুব ভালো অবস্থায় নেই।
সোয়াসে যাই। প্রফেসর স্মিথ সৌজন্য প্রকাশ করেন, তবে আমার কাজে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। আমি সাহিত্যের ছাত্র হয়ে কোম্পানির কাগজপত্র নিয়ে এত উৎসাহী কেন, তিনি তা বুঝে পান না।
তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিছু সময় কাটাই। রাজেশ্বরী দত্তের ঘরটা বন্ধ–কাউকে তা বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। সেদিকে তাকিয়ে আমি দীর্ঘশ্বাস চাপি। তারাপদর বাড়িতে দেখা হয় সস্ত্রীক অমর্ত্য সেনের সঙ্গে।
নাজিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সোয়াসে। সাজ্জাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে সে এক বয়স্ক ব্রিটিশকে বিয়ে করেছে। তাদের বাড়ি যাই একদিন।
লাইব্রেরির কাজ তিন মাসে শেষ হয় না–আরো এক মাস লেগে যায়। চলে আসার আগে জোন ল্যানকাস্টার আমার সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন। বাস্তবিকই ভোজ–পাঁচটি কোর্স অন্তত, দুরকম ওয়াইন। লাইব্রেরির ওপর দিকের তিন-চারজন কর্মকর্তার সঙ্গে মাইকেলও আমন্ত্রিত। আমি খুব সম্মানিত বোধ করি।
৩০ জুলাই দেশের পথে রওনা হই।
১৭.
এর মধ্যে দেশে অনেক কিছু ঘটেছে।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সায়েম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে সাধারণ নির্বাচন হবে। হঠাৎ করেই মওলানা ভাসানী বললেন, দেশবাসী এখন নির্বাচন চায় না। তাহলে কি তারা চায় সামরিক শাসন চলুক? এ-প্রশ্ন ওঠার বা তার জবাব দেওয়ার আগেই মওলানা মৃত্যুবরণ করলেন। আর কী আশ্চর্য! তার পরপরই নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করলেন রাষ্ট্রপতি। বললেন, যথেষ্ট সময় নেই। তারপরই তিনি প্রধান সামরিক শাসকের দায়িত্ব হস্তান্তর করলেন উপ-প্রধান সামরিক প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে। কয়েক মাস পরে স্বাস্থ্যগত কারণে বিচারপতি সায়েম ত্যাগ করলেন রাষ্ট্রপতির পদ। জিয়া রাষ্ট্রপতি হলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন-অনুষ্ঠানের, আর ৩০ মে। রাষ্ট্রপতিপদে গণভোটের। তিনি তো স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে খালখনন, খালনদী পুনঃখননের কর্মসূচি দিয়েছিলেন আগে, এখন ১৯ দফা কর্মসূচি দিলেন। তার প্রতি বড়রকম সমর্থন জানালেন মোহাম্মদ তোয়াহা, জিয়ার কাজকর্মের মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমানবলে সংবিধান সংশোধন করলেন–সংবিধানের সূচনায় সংযোজন করলেন বিসমিল্লাহ, প্রস্তাবনায় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের বদলে আনলেন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় আনলেন সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা করলেন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার বলে।
৩০ মে গণভোট হলো। জিয়াউর রহমান প্রায় ৯৯ শতাংশ হাঁ-ভোট পেলেন। যেদিন এ খবর পাওয়া গেল, সেদিন ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির ওয়াশরুমে হাত ধুচ্ছি, এক মধ্যবয়সী ইংরেজ জানতে চাইলেন, ‘তোমাদের রাষ্ট্রপতি শতকরা ১০০ ভাগ ভোট পেলেন না কেন–তোমার মতো দু-চারজন। দেশের বাইরে আছে বলে?’ গণভোটের পরে তাঁর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেন খান আবদুস সবুর খান ও আতাউর রহমান খান।
আরো একটা মজার ব্যাপার ঘটলো। জুনে জিয়া কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে এলেন লন্ডনে। সঙ্গে পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহম্মদ শামসউল হক। প্রচারমাধ্যমে দেখি তার পরিচয় দেওয়া হয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ-দেশে উপদেষ্টার কোনো অর্থ হয় না, তাই মন্ত্রী না হলেও তাঁকে অভিহিত করা হচ্ছে মন্ত্রী বলে।
বিচারপতি আবদুস সাত্তার উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হয়েছেন। উপদেষ্টামণ্ডলীর কেউ কেউ পদত্যাগ করেছেন–যেমন, হাফিজউদ্দীন, আকবর কবির। নতুন উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছেন আমার বন্ধু মোজাফফর আহমদ, আত্মীয় জামালউদ্দীন আহমদ, বহুদিনের পরিচিত শামসুল হুদা চৌধুরী ও আবদুল মোমেন খান।
কোথায় যাচ্ছি আমরা, কে বলবে!
১৮.
এবারে বিদেশে যাওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলাম, এই যাত্রার সময় থেকেই বিভাগীয় সভাপতির পদ থেকে আমি অব্যাহতি নিচ্ছি, অতএব আমার জায়গায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নিযুক্ত না করে যেন পূর্ণ মেয়াদে নতুন সভাপতি নিয়োগ করা হয়। আমার মনের মধ্যে এই ভাবনা ছিল যে, তাতে ১৯৭৫ সালে কিছুটা নিয়মভঙ্গ করে আমার আবার সভাপতি হওয়ার ব্যাপারটার খানিক শোধন হবে। কর্তৃপক্ষ যথারীতি আবু হেনা মোস্তফা কামালকে নতুন সভাপতি নিযুক্ত করেন। ফিরে এসে আমি শুধুই শিক্ষক হয়ে থাকি, তবে বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসনের সঙ্গে নানা কাজে আমার সংশ্লিষ্টতা থেকেই যায়।
জহুরুল হকের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিশন যে-রিপোর্ট দিয়েছিল, তাতে সরকার খুশি হয়। সুতরাং একই কমিশনকে দেওয়া হয় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম তদন্ত করার দায়িত্ব। কমিশন চট্টগ্রামে এলে তাঁদের সামনে হাজির হতে ডাক পড়ে আমার। কমিশনের সভাপতিই আমার কাছে জানতে চান, এই যে কর্মে কনিষ্ঠ একজন বিভাগীয় সভাপতির অধীনে আমাকে কাজ করতে হচ্ছে, সেটা আমার কেমন লাগছে? আমি বলি, আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। আমি যখন সভাপতি ছিলাম, তখন সহকর্মীদের নিজের অধীন বিবেচনা করিনি, এখনো নিজেকে কারো অধীন মনে করছি না। সভাপতি সহকর্মীদের নেতৃত্ব দেন, তার কমবেশি তো নয়। জহুরুল হক বলেন, ‘ও, আপনি দেখছি তাহলে নব্যপন্থী। আপনার ক্ষেত্রে কী হয়েছে জানি না, তবে সিনিয়রকে বাদ দিয়ে জুনিয়র চেয়ারম্যান হবেন–দিস ইজ হার্ডলি অ্যাকসেপ্টেবল। আমি হাসলাম, তর্ক করলাম না।
তিনি এবারে প্রশ্ন করলেন, আপনার সময়ে সুলতান আহমদ ভূঁইয়া নামে একজন টিচার অ্যাপয়েনটেড হন। তাঁর তো অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার ভালো নয়। হাউ ওয়াজ ইট পসিবল?
সুলতান আহমদ ভূঁইয়া আমাদের উপাচার্য আবদুল করিমের সহাধ্যায়ী ছিলেন, তবে এমএ পাশ করেছিলেন পরে, ১৯৫১ সালে। তার পরীক্ষার ফলাফল তেমন ভালো ছিল না, কিন্তু যাকে আমরা বলি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য-বিশেষ করে সে-সময়কার মুসলমান কবিদের বিষয়ে তিনি ভালো জানতেন। ছাত্রাবস্থায় মাহে নও পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, সুকুমার সেনের বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাসে তার উল্লেখ আছে। পরে তিনি যশোর ক্যাডেট কলেজে এবং বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন। আবদুল করিম উপাচার্য হওয়ার পরে তিনি তাকে ও আমাকে একই সঙ্গে চিঠি লেখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নিয়োগ হতে পারে কি না, তা জানতে চেয়ে। তার বিশেষজ্ঞতা আমাদের কাজে আসবে ভেবে আমি আগ্রহ প্রকাশ করি। উপাচার্য এতে স্বস্তি পান। আমরা তাঁকে চাকরির জন্য আবেদন করতে উৎসাহিত করি। তিনি নিয়োগলাভ করেন।
মনে হয়, এটা অনিয়ম বিবেচনা করে, আমাদের কোনো সহকর্মী এদিকে তদন্ত কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আমি কমিশনকে ওপরের কথাগুলো বলি। নিজের দায়িত্ব স্বীকার করি। কমিশনকে বোধহয় ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে, উপাচার্যের ইচ্ছা আমি পূরণ করেছি মাত্র। সেটা যে ঠিক নয়, সে কথা আমি কমিশনকে জানাই।
সুলতান আহমদ ভূঁইয়া অবশ্য আমাকে হতাশ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পরে গবেষণায় তাঁর আর আগ্রহ দেখা যায়নি। আমি তাকে শেখ। চাঁদের কাব্য সম্পাদন করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, পিএইচডি ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে অথবা গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশের লক্ষ্যে কাজটি তিনি করতে পারেন। তিনি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু কাজে প্রবৃত্ত হননি। তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্রে ছাত্র বা সহকর্মীদেরও আগ্রহী করে তুলতে পারেননি।
কমিশন এ-বিষয়ে কী বলেছিলেন, তা আমার জানা হয়নি। তদন্তের রিপোর্ট বেরিয়েছিল কি না তা-ই মনে পড়ে না।
এর মধ্যে জানলাম, ড. মুহম্মদ এনামুল হক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন।
কিছুকাল আগে শিক্ষক-নির্বাচনের কাজে এনামুল হক চট্টগ্রাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের। পদে তাঁর নিয়োগের আকস্মিক অবসান ঘটেছে। কথায় কথায় তিনি আমাকে বললেন, তিনি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নিয়োগের বিরোধিতা। করেছিলেন, তার কারণ এই নয় যে, আমার প্রতি তাঁর মনোভাব প্রতিকূল কিংবা আমার লেখাপড়া সম্পর্কে তাঁর মনে সন্দেহ আছে। তিনি বাধা দিয়েছিলেন, কেননা আমি নিয়মমাফিক আবেদন করিনি। সুতরাং তিনি আশা করেন, তাঁর প্রতি আমি ক্ষোভ পোষণ করব না। আমি বললাম, ‘সার, আমার আচরণে কি আপনার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে কখনো? তিনি বিব্রত হয়েই বললেন, ‘না, আমি তা বলি না।’
এরপরে উপাচার্য আমাকে বলেন যে, জীবনের শেষ দিনগুলো জন্মভূমি চট্টগ্রামে কাটাতে পারলে এনামুল হক খুশি হবেন। এ-বিষয়ে আমরা কি কিছু করতে পারি?
আবুল ফজল তখন শিক্ষা ও সংস্কৃতি-বিষয়ে রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা। তিনিও চেয়েছিলেন এনামুল হক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসুন।
এনামুল হককে বাংলা বিভাগে নিয়োগদানের একটা প্রস্তাব আমি উপাচার্যের কাছে পাঠাই। সে-বিষয়ে চূড়ান্ত কিছু হওয়ার আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসি অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রণ পান। তিনি সেটাই গ্রহণ করেন। নানা কারণে ঢাকায় থাকাই তাঁর পক্ষে সুবিধাজনক বলে তিনি মনে করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. কাজী দীন মুহম্মদ পদচ্যুত হন। এই আদেশের বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে মামলা করেন। বিষয়টার ফয়সালা হতে সময় লাগে। এর মধ্যে তাঁকে খুব আর্থিক কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়। আমি বিভাগের দায়িত্বে থাকতেই একদিন খাতুনগঞ্জে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ছোটোখাটো একটা ব্যবসার কাজে তিনি এসেছিলেন। আমি তাঁকে বলি, তিনি চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নিয়োগের জন্যে আমি চেষ্টা করতে পারি। তিনি বলেন, না, তিনি হাইকোর্টের রায়ের অপেক্ষায় থাকবেন। পরে রায় তাঁর পক্ষে যায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন।
১৯.
রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টার পদ থেকে আবুল ফজলকে পদত্যাগ করতে হয়। সেইদিনই সৈয়দ আলী আহসান তার স্থলাভিষিক্ত হন। আমি তখন লন্ডনে।
ফিরে আসার পরে রশিদ চৌধুরী একদিন আমাকে বলেন যে, আলী আহসান আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন। আমি ঢাকায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাকে বলেন, ‘দেখো, একটা ব্যাপারে মানুষের দুরকম অ্যাটিচুড হতে পারে। কেউ ভাবতে পারে, আমি এই সরকারের সঙ্গে কোনোরকম সহযোগিতা করবো না। আবার কেউ ভাবতে পারে, সরকারে যেই থাকুক, দেশকে আমার যা দেওয়ার, তা আমি দেবো। তুমি কী মনে করো?’
বললাম, আমার কাজ তো আমি করে যাচ্ছি। সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে আমার অবস্থার তো হেরফের হয়নি।’
কথাটা বোধহয় ভালো শোনায়নি। তিনি বললেন, ‘তোমাকে কোনো সরকারি দায়িত্ব দিলে তুমি কি তা গ্রহণ করবে?
জানতে চাইলাম, কী ধরনের দায়িত্ব?
বললেন, ‘শিল্পকলা একাডেমী বা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব। তাছাড়া, ভারতে যেমন ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট আছে, বাংলাদেশে ওরকম একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা আমি ভাবছি। জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রকে রূপান্তরিত করে সেটা হতে পারে, অথবা নতুন করে তা প্রতিষ্ঠা করা যেতে। পারে। পিইএনকেও আমি সক্রিয় করে তুলতে চাই। তার জন্যে একজন সার্বক্ষণিক নির্বাহী কর্মকর্তা দরকার। সামনেই পিইএনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন হবে অস্ট্রেলিয়ায়, তার জন্যে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আমি এসব কাজের জন্যে তোমার কথা ভেবেছি।’
বললাম, ‘সার, আপনি জানেন, শিক্ষকতা ছাড়া আমি আর কিছু করতে চাই না। ৭২ সালে ইউসুফ আলী তো আপনাকে দিয়েই বলিয়েছিলেন আমাকে বাংলা একাডেমির পরিচালক হতে। ৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু আমাকে শিক্ষা-সচিব করতে চেয়েছিলেন। আমি মাফ চেয়ে নিয়েছিলাম। সরকারি দায়িত্ব নেওয়া আমার পোষাবে না।
আলী আহসান এ-প্রসঙ্গে আর কিছু বলেননি, কিন্তু তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। পরে রাজ্জাক সাহেবকে বলেছিলেন, আনিস খুব রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে।’ সার জানতে চেয়েছিলেন, এমন মনে হওয়ার কারণ কী? আলী আহসান বলেছিলেন, তিনি আমাকে একাধিক পদের কথা বলেছিলেন, আমি কোনোটাই গ্রহণ করতে সম্মত হইনি। রাজ্জাক সাহেব বলেছিলেন, ‘এমনো তো হইতে পারে যে, হ্যায় টিচিংটা হাছাই পছন্দ করে।’
তার মেয়ে-জামাই চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পরে আলী আহসান ক্যাম্পাসে এসে উঠতেন তাঁর আত্মীয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক, শামসুল আলমের বাড়িতে–আমার একটা বাড়ির পরে। অনেক সময়ে তিনি আসার আগেই খবর পেতাম, অনেক সময়ে তিনি এসে খবর দিতেন। আমি সাধারণত সঙ্গে সঙ্গেই দেখা করতে যেতাম। একবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কাগজে দেখলাম, আপনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ আমলে মসজিদে আজান দেওয়া যেতো না, নামাজ পড়ায় বিঘ্ন হতো। এমন কথা কী করে বললেন?’
আলী আহসান বললেন, এ কথা উনি বলেননি।
বললাম, একাধিক কাগজে এমন রিপোর্ট বেরিয়েছে। আপনি প্রতিবাদ করলেন না কেন?
আমার শিক্ষক বললেন, প্রতিবাদ তো করেছিলাম। আমার পিআরও একটা অপদার্থ। কাগজে প্রতিবাদ ছাপাতে পারেনি।’
একবার বকরিদে আমরা সপরিবারে কাপ্তাই যাবো বলে স্থির করলাম। তারপরই শুনলাম, আলী আহসান চট্টগ্রামে আসছেন। তিনি বোধহয় তখন আর উপদেষ্টা নেই। ঈদের আগের দিন সকালে আমি ক্যাম্পাস ছাড়লাম, তিনি তার খানিক পরই সেখানে পৌঁছোলেন। আমি নেই জেনে তাঁর ধারণা হলো, তাকে এড়াতে আমি কাপ্তাই চলে গেছি। এ কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করেছিলেন, আমাকে কিছু বলেননি, ফলে তাঁর এই ভ্রম নিরসনের কোনো চেষ্টাও আমি করিনি।
আরেকবার ঢাকায় এক বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁকে সালাম দিলাম, তিনি সালাম নিলেন না। আমার ওপর বিরক্ত হয়ে আছেন ভেবে আমি দ্রুত সরে গেলাম। পরে অন্যের কাছে তিনি নালিশ করেন, আমি নাকি তাঁকে দেখেও না-দেখার ভান করে সরে গেছি। আমি খুবই দুঃখিত হলাম।
অনেক পরে, মনে হয়, তাঁর মন থেকে এসব ধারণা দূর হয়েছিল। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি আবার আমার সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করেছিলেন।
২০.
১৯৭৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরে জাপানি রেড আর্মির কয়েকজন সদস্য মধ্য আকাশে জাপান এয়ারলাইনসের একটি বিমান ছিনতাই করে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানটিতে দেড় শতাধিক আরোহী ছিল, তা ছাড়া ক্রু তো ছিলই। ছিনতাইকারীরা জাপানে কারাবন্দি তাদের কয়েকজন দলীয় সদস্যের মুক্তি দাবি করে এবং সেইসঙ্গে চায় কয়েক লক্ষ মার্কিন ডলার। বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস-মার্শাল এ জি মাহমুদ ঢাকা বিমানবন্দরের কনট্রোল টাওয়ার থেকে দিনরাত ছিনতাইকারীদের সঙ্গে দেন-দরবার করতে থাকেন। তার ফলে কয়েকজন জিম্মি নারী ও শিশু মুক্ত হয়। কিন্তু ছিনতাইকারীরা মুক্তিপণের দাবিতে অটল থাকে এবং যাত্রীসহ বিমানটি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে। ১ অক্টোবর আরেকটি জাপানি বিমানে কারাবন্দি রেড আর্মির সদস্যদের এবং পণের অর্থ ঢাকায় আনা হয়। জিম্মিরা মুক্তিলাভ করে। পরদিন কিছু আরোহী নিয়ে আটক বিমানটি কুয়েত যাত্রা করে, অপর বিমানে রেড আর্মির সদস্যেরা কোনো অজ্ঞাত গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়। সকলে স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করে।
২ অক্টোবর সকালে বাংলাদেশ বিমানযোগে আমার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাওয়ার কথা। ক্যাম্পাস থেকে নিজের গাড়িতে রওনা হয়েছি, জুবিলি রোডে। বিমান অফিসে থামলাম বিমান সময়মতো যাচ্ছে কি না, তা জিজ্ঞেস করতে। বিমান অফিসে থমথমে অবস্থা, উপস্থিতিও কম। একজন বললেন, ‘ঢাকা থেকে ফ্লাইট আসেনি, আপনি বরঞ্চ পরে ফোন করে খবর নিয়ে তারপর এয়ারপোর্টে যাবেন। বিমান থেকে আবদুল আলীর বাড়িতে গেলাম। তিনি গুজব শুনেছেন, ঢাকা বিমানবন্দরে গোলযোগ চলছে। ভাবলাম, কালই তো ছিনতাই নাটকের অবসান হলো, আবার কিসের গোলযোগ। আলীর বাসা থেকে ঢাকায় ফোন। করলাম আমার মামাতো ভাই সৈয়দ কামরুজ্জামানকে। তিনি বললেন, ঢাকায় গোলমাল হচ্ছে। কোনো অবস্থাতেই আসবে না। টিকিট ফেরত দিয়ে বাড়ি চলে যাও। অন্য কোনোভাবে আসার চেষ্টা করবে না।’
এদিক-ওদিকে খবর নিয়ে যেটুকু জানা গেল, তা এই : ৩০ তারিখে বগুড়া সেনানিবাসে গোলযোগ হয়েছে, আজ সকাল থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে এবং ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের দু-দলে গুলিবিনিময় হয়েছে। বগুড়া ও ঢাকায় অনেক হতাহত। মনে হয়, কোনো একদল রাষ্ট্রক্ষমতাদখলের চেষ্টা করেছে। সেদিন রাষ্ট্রপতি জিয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। এরকম পরিস্থিতিতে যেমন বলা হয়, তেমনি।
কয়েকদিনের মধ্যে প্রায় পাঁচশ সেনা-কর্মকর্তা ও সৈনিকের বিচারকার্য সম্পন্ন হয়ে গেল। অনেকের মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হলো। এসব দণ্ড কার্যকর হলো, তার পাশাপাশি আবার তদন্তের ব্যবস্থাও হলো। বিচার ও শাস্তি হলো বটে, তবে ন্যায়বিচার হলো কি না, সে-সম্পর্কে সন্দেহ রয়ে গেল। আপাতত জিয়া ক্ষমতাসীন রইলেন।
কিছুদিনের মধ্যে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় গণতান্ত্রিক দলের আবির্ভাব ঘটলো। এর আহ্বায়ক উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার। অচিরেই তাতে যোগ দিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়া। ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হলো। জিয়া প্রার্থী হলেন–জাগদল বা জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী। এই ফ্রন্টে জাগদল ছাড়া রয়েছে মশিউর রহমান ওরফে যাদু মিয়ার নেতৃত্বাধীন ভাসানীপন্থী ন্যাপ, কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ইউপিপি, মুসলিম লীগ, লেবার পার্টি ও তফসিলী ফেডারেশন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জেনারেল ওসমানী–গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের মনোনীত প্রার্থী। এই জোটে রয়েছে আওয়ামী লীগের দুটি অংশ (আবদুল মালেক উকিল ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন), ওসমানীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় জনতা পার্টি, পিপলস লীগ ও গণ আজাদী লীগ। কমিউনিস্ট পার্টি জোটভুক্ত হয়নি, তবে ওসমানীর প্রার্থিতা সমর্থন করেছে।
নির্বাচনে প্রত্যাশিতরূপে জিয়া বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেন। মশিউর রহমান সিনিয়র মন্ত্রী নিযুক্ত হলেন। ৩০ জনের মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে গেল।
মোজাফফর আহমদ রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হিসেবে সরকারি কাজে চট্টগ্রামে এলে একবার ক্যাম্পাসে আমাদের কাছে আসতেন। সেবারও তিনি এসেছিলেন। রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে গেলেন। ট্রেনে উঠলেন উপদেষ্টা হিসেবে। ট্রেন থেকে যখন নামলেন, তখন আর তিনি উপদেষ্টা নন। তিনি জিয়ার রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি।
২১.
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সচিব শহীদুল্লাহর সঙ্গে ঢাকায় দেখা হলে তিনি জানালেন, অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরী পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি আমাকে দেখতে চেয়েছেন, আমি যেন একবার যাই।
হাসপাতালে গিয়ে বুঝতে পারলাম, তার অবস্থা গুরুতর। আমাকে দেখে। তিনি খুশি হলেন। সাঞনয়নে বললেন, আনিস সাহেব, সিগারেট ছেড়ে দেন। আমার যত কষ্ট, সব সিগারেট খাওয়া থেকে।
তিনি প্রচুর সিগারেট খেতেন। লাইব্রেরিতে যখন পড়তেন, সিগারেট খেতে বাইরে বেরিয়ে আসতেন। সময় যাতে নষ্ট না হয়, তাই দুই টানে একটা সিগারেট শেষ করে আবার পাঠকক্ষে ফিরে যেতেন। কবে থেকে তিনি সিগারেট খাওয়া ধরেছিলেন, তা আমার জানা নেই। আমি আরম্ভ করেছিলাম এমএ পাশ করার পরে। অতদিনে যখন সিগারেটের নেশা হয়নি, তখন আর হবে না মনে করে বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় কেউ সিগারেট দিলে এক-আধটা খেতে শুরু করি। তারপর দিনে দুটো কিনতে থাকি। এখন রোজ ২০/২৫টা খাই। সিগারেট ছেড়ে দেবার কথা ভাবিনি। মুজাফফর সাহেব সনির্বন্ধ অনুরোধ করায় বললাম, ‘চেষ্টা। করবো, সার্।
কথা বলতে তার কষ্ট হচ্ছিল। একটু পরে কেবিন ছেড়ে চলে এলাম। তিনি যে একবার আমার ওপর রাগ করেছিলেন, সেকথা মনে হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কলকাতায় কীভাবে দিন কাটিয়েছেন, তা মনে পড়ল। স্বাধীনতালাভের পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন–তখন আমাকে সেখানে আনতে চেষ্টা করে কেমন হেনস্তা হয়েছিলেন, তাও মনে হলো। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন গঠিত হলে তিনি তার প্রথম সভাপতি হন। তখন আমলাদের অসহযোগিতার কথা বলতেন। বাকশাল আমলে তিনি শিক্ষামন্ত্রী হন, কিন্তু মন্ত্রিত্ব তাঁর ভালো লাগেনি। খন্দকার মোশতাকের আমলেও তাঁকে মন্ত্রিত্ব করতে হয়েছিল, সে ছিল আরো খারাপ অবস্থা। মোশতাকের পতনের পরে মন্ত্রিসভা ভেঙে গেলে তিনি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় ফিরে আসেন।
আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার কয়েকদিন পরে তিনি মারা যান। তখন তাঁর বয়স ৫৫ হয়েছে কি হয়নি।
২২.
আনোয়ার আবদেল-মালেকের চিঠি পেলাম। তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা-প্রকল্প হাতে নিয়েছেন দেশীয় বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতা সম্পর্কে। ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাসে জাপানের কিয়োটোতে এশিয়ান সিম্পোজিয়াম অন ইনটেলেকচুয়াল ক্রিয়েটিভিটি ইন এনডোজেনাস কালচার অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে আমাকে প্রবন্ধ পড়তে হবে। আমি সম্মত হলে তিনি জাতিসংঘ। বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। তারা আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবেন।
জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ক্যাম্পাস নেই, ছাত্র নেই, শিক্ষক নেই। তার এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করে এক রসিক ব্যক্তি মন্তব্য করেছিলেন যে, ঈশ্বরের মহত্ত্ব এখানেই যে, তাঁকে না-যায় দেখা,–যায় শোনা। টোকিওতে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দপ্তর–সেখানে রেক্টর আছেন, ভাইস-রেক্টর আছেন, বেশ কিছু কর্মকর্তা আছেন। ১৯৭৬ সালে যখন টোকিও যাই, তখন সেখানে গিয়েছিলাম। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ-কর্মকর্তা চিদাম্বরম ছিলেন আমার পূর্বপরিচিত। তিনি আমাকে অফিস ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন এবং তাঁদের কাজকর্ম সম্পর্কে বলেছিলেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় নানা গবেষণামূলক প্রকল্প গ্রহণ করে, পৃথিবীর নানা দেশের বিদ্বজ্জনকে তার সঙ্গে জড়িত করে এবং সেসব গবেষণার ফল প্রকাশ করে।
খবরের কাগজে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর পড়ে বেবী একবার জানতে চেয়েছিল, তার সঙ্গে জড়িত হওয়ার আগ্রহ বা সুযোগ আমার আছে কি না। আমি বলেছিলাম, ওরা আর যাই করুক, বাংলার গবেষণা করবে না। এখন আনোয়ার আবদেল-মালেকের কল্যাণে সংযোগটা ঘটলো।
চিঠি এলো ভাইস-রেক্টর কিনহিডে মুশাকোজির কাছ থেকে। আমন্ত্রণ, আসা-যাওয়া-থাকার ব্যবস্থা এবং প্রবন্ধের সম্মানী বাবদ দু হাজার মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। সম্মতি জানাতে বিলম্ব করলাম না। প্রবন্ধ লেখার কাজে লেগে গেলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্বপন আদনানকে বললাম আমার কাজে সাহায্য করতে। আমি প্রবন্ধটার খসড়া করবো, সামাজিক পটভূমির সঙ্গে সৃজনশীলতার যে-সম্পর্ক আমি দেখাতে চাই, তিনি সেটার বিচার করবেন এবং সামগ্রিকভাবে পরামর্শ দেবেন। সম্মানীর অর্থ আমরা ভাগাভাগি করে নেবো।
বেশ পরিশ্রম করে প্রবন্ধ লিখলাম। স্বপন আদনানও প্রভূত সাহায্য করলেন। বিষয়টির একটি তাত্ত্বিক ভিত্তিও তিনি দেওয়ার চেষ্টা করলেন। সম্মেলনের আগেই প্রবন্ধটি টোকিওতে পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভবপর হলো।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলাম ৮ নভেম্বরে, ঢাকা থেকে রওনা হলাম ১০ তারিখে। ব্যাংককে একদিন কাটিয়ে শহরটির সঙ্গে পরিচিত হওয়া গেল। ১২ তারিখে সেখান থেকে পৌঁছলাম ওসাকা বিমানবন্দরে। সেখান থেকে গাড়িতে কিয়োটোয়।
কিয়োটো জাপানের প্রাচীন রাজধানী। বনেদি শহর। জাপানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বলে এই শহরের অধিবাসীরা তাকে দাবি করে। তাদের মতে, টোকিও হতে পারে জাপানের রাজধানী ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র, কিন্তু দেশের সংস্কৃতিকে জানতে হলে কিয়োটোয় আসতে হবে। সিম্পোজিয়মের ফাঁকে ফাঁকে কিছু সময় পাওয়া গেল বটে, কিন্তু কাজে এবং নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতেই তার অনেকখানি চলে গেল। আয়োজকদের ব্যবস্থাপনায় সামান্য কিছু দেখা হলো–জাদুঘর এবং বৌদ্ধমন্দির, তবে কিয়োটোকে জানবার পক্ষে তা কিছু নয়।
সিম্পোজিয়ম হলো ১৩ থেকে ১৭য়। উদবোধনী ছাড়া চারটি খোলা অধিবেশন এবং প্রতি অধিবেশনের বিষয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপের পৃথক বৈঠক। উদৃবোধনী অধিবেশনে কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ভাষণ দিলেন তার প্রেসিডেন্ট মিশিয়ো ওকামোতো এবং অতিথির ভাষণ দিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস প্রফেসর তাকেও কুওয়াবারা। আনোয়ার আবদেল-মালেক সমন্বয়ক হিসেবে দীর্ঘ বক্তৃতা পাঠ করলেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বললেন ভাইস-রেক্টর কিনহিডে মুশাকোজি এবং রেক্টর জেমস হেস্টার। শুনলাম, মুশাকোজি খুব অভিজাত পরিবারের মানুষ, তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি আছে। হেস্টার যে পণ্ডিত হিসেবে খুব বিশিষ্ট, তা বোধহয় নন, তবে মার্কিন বলে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রেক্টর হওয়ার গৌরব লাভ করেছেন। দুজনেই খুব ভদ্র ও সহৃদয় মানুষ। আরেক ভাইস-রেক্টর, আলেকজান্ডার কোয়াপং, একটু গোমড়ামুখ করে ছিলেন। প্রকল্পটি এই আফ্রিকি বিদ্বানের এলাকার বাইরে বলে সিম্পোজিয়মে তার তেমন কোনো ভূমিকা নেই–হয়তো এই কারণে। প্রোগ্রাম অফিসার হোসাম ইসা, চিফ অফ কনফারেনসেস অ্যান্ড সার্ভিসেস রবিন্দর মালিক এবং সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার পুনা উইগনোরাজা ছোটাছুটি করছেন সব সময়ে। উইগনোরাজাকে তখন কেবল ব্যবস্থাপক মনে করেছিলাম, পরে তাঁর পাণ্ডিত্যের সঙ্গে পরিচিত হই।
সিম্পোজিয়মের জেনারেল র্যাপোর্টিয়র নিযুক্ত হয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সভাপতি এবং ভারতীয় রাজ্যসভার সদস্য রশীদউদদীন খান। চারটি অধিবেশনের সভাপতি ও র্যাপোর্টিয়র যথাক্রমে কলকাতার সেন্টার ফর দি স্টাডিজ অফ সোশাল সায়েন্সেসের পরিচালক বরুণ দে ও আমি; চীনের অ্যাকাডেমি অফ সোশাল সায়েন্সেসের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনালিটি স্টাডিজের ভাইস-ডিরেক্টর ফেই সিয়াও-তুং ও হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনারেল সায়েন্সেস ফ্যাকালটির অধ্যাপক শিংগো শিবাতা; সিঙ্গাপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মালয় স্টাডিজ বিভাগের প্রধান সৈয়দ হুসেন আলাতাস ও প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক, ভিয়েতনামের সন্তান, লে থান খোয়; এবং কাবুলে ইউএনডিপিতে কর্মরত আফগান কূটনীতিবিদ এ এইচ তাবিবি ও দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এ এন পাণ্ডেয়া। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়কে ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন এই তাবিবি। পাণ্ডেয়া পরে। আনোয়ার আবদেল-মালেকের সঙ্গে যৌথভাবে সিম্পোজিয়মের প্রবন্ধাবলি ও কার্যবিবরণী সম্পাদনা করেছিলেন। সেটা দেখেই এতজনের নাম ও পরিচয় দিতে পারছি।
প্রথম অধিবেশনে এক ইন্দোনেশীয় মহিলা অনর্থক তর্ক জুড়ে দিয়ে এত সময় নষ্ট করলেন যে, কর্মসূচির ব্যাঘাত ঘটে গেল। প্রথম অধিবেশন তো সময়মতো শেষ হলো না, দ্বিতীয় অধিবেশনও শেষ করতে বিলম্ব হলো। তৃতীয় অধিবেশনের সভাপতি তাই ঘোষণা করলেন যে, তিনি কাউকে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে এক মিনিটও বেশি বলতে দেবেন না; সময় শেষ হলেই টেবিল ঠুকবেন হাতুড়ি দিয়ে, আর সেই সঙ্গে বক্তার মাইক্রোফোন বন্ধ হয়ে যাবে। সৈয়দ হুসেন আলতামাসের দশাসই শরীর, শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডল গাম্ভীর্যপূর্ণ–তাঁকে অমান্য করবার সাহস কার! আর মাইক্রোফোন বন্ধ হয়ে গেলে কথা বললেও বা শুনবে কে! আমাকে যখন তিনি প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে আহ্বান জানালেন, আমি বললাম, আশা করি, হাতুড়ি পেটাবার আগেই আমি বক্তব্য শেষ করবো। আমার প্রবন্ধ প্রচারিত হয়েছে, সুতরাং ইচ্ছা। করলেই যে-কেউ তা দেখে নিতে পারবেন। আমি মাত্র কয়েকটি বিষয়। সকলের গোচরে আনতে চাই। তারপর কিছু কথা বলে নির্ধারিত সময়ের দু তিন মিনিট আগেই বক্তব্যের ইতি টানলাম। এতেই আমার প্রতি সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। সভাপতি আমার কাণ্ডজ্ঞানের ভূয়সী প্রশংসা করলেন, রেক্টর হেস্টার পাশ থেকে আমাকে ধন্যবাদ জানালেন, আনোয়ার আবদেল-মালেক নিজের আসন থেকে উঠে এসে বললেন, তোমার ভদ্রজনোচিত আচরণ সিম্পোজিয়ম বাঁচিয়ে দিয়েছে–এরপর কেউ বেশি বলতে লজ্জা পাবে, আলোচনা-পর্বে তুমি আবার সময় নিও। সত্যি সত্যিই আলোচনা-পর্বে আমার নাম ঘোষিত হলো প্রথমে। আমি বলতে চাইনি, বলতে প্রস্তুতও ছিলাম না। তবু দু-একটা অকিঞ্চিত্ত্বর কথা বললাম, সংক্ষেপে বলায় তার অন্তঃসারশূন্যতা বোধহয় ধরা পড়েনি।
র্যাপোর্টিয়রদের একটা অসুবিধা এই হলো যে, তারা যে-অধিবেশনে প্রবন্ধ পড়েছেন, তার ওয়ার্কিং গ্রুপে উপস্থিত থাকতে পারলেন না, রিপোর্ট করার জন্যে থাকতে হলো অন্য অধিবেশনের ওয়ার্কিং গ্রুপে। কারণ, মূল অধিবেশনের বিবরণীর সঙ্গে ওয়ার্কিং গ্রুপের কার্যবিবরণী তৈরি করাও ছিল র্যাপোর্টিয়রের কাজের অন্তর্ভুক্ত। তার জন্যে সভাপতির সঙ্গে বসার কথা। বরুণ দে বললেন, ‘আর বসতে হবে না। আপনি লিখে ফেললে আমি একবার চোখ বুলিয়ে দেবো। ভালোই। তবে বরুণের দেখার সময় কখন হবে, তার জন্য কিছু অপেক্ষা করতে হলো। এক সন্ধ্যায় অনেকে বেড়াতে যাচ্ছেন দল বেঁধে। ফিলিপিনসের মেরি রাসলিস হোলনস্টাইনার আমাকে ডাকতে এলেন। বরুণকে ফোন করতে তিনি বললেন, আপনি থাকুন, আমি আসছি।’ মেরিকে বললাম, কর্তব্যের ডাক এসেছে–আমার আর যাওয়া হবে না।’ মেরি চলে গেলেন। পরে বরুণ আড্ডা জমিয়ে ফেললেন। শেষকালে আমার খসড়াটা সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফিরলেন। এমন হবে জানলে বেড়াতে যেতে পারতাম। বরুণ যেমন পণ্ডিত, তেমনি তীক্ষ্ণধী। সামান্য যা যোগ-বিয়োগ করলেন, তাতে রিপোর্ট অনেক উন্নতমানের হলো।
এই পর্যায়ের পরে জেনারেল র্যাপোর্টিয়র বসলেন সব ব্যাপোর্টিয়রদের নিয়ে। সেখানে সব অধিবেশনের সভাপতিদের ডাকা হয়েছিল, তবে সবাই। আসেননি। এই বৈঠকে আমি একটু বেশি কথা বলে ফেললাম। তবে সবাই সেটা ভালোভাবে নিয়েছিলেন। ফলে কোথাও আটকে গেলে রশীদউদদীন খান আমার দিকে তাকিয়ে বলতেন, আনিস কি বিষয়টার সমাধান দেবেন?
এই কাজ করতে গিয়ে বাকি র্যাপোর্টিয়রদের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। লে থান খোয় ও পাণ্ডেয়ার সঙ্গে আমার পরেও দেখা হয়েছিল, শিংগো শিবাতার সঙ্গে হয়নি। তবু আমার বিশ্বাস, আমরা সবাই সবাইকে। মনে রেখেছি।
আর যাদের সঙ্গে সৌহার্দ্য ঘটেছিল, তাদের মধ্যে ছিলেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ জাকার্তার রেক্টর সুলতান তকদির আলিসাভানা। তিনি আমাকে ইন্দোনেশিয়া-ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তখন একজন জানালেন, বালি দ্বীপের সকল নাচের দলকে নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। তিনি যে একজন বড়ো পণ্ডিত, সেকথা আমি ঢাকায় ফিরে জানলাম মনসুর মুসার কাছ থেকে এবং, আরো পরে, তার সম্মানে প্রকাশিত বিদ্বজ্জনদের রচনাসমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ দেখে। টোকিওর ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসের তাকেশি হায়াশি খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, সেই সঙ্গে রসিক মানুষও। আতানেও দ্য ম্যানিলা ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অফ ফিলিপিনস কালচারের সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক মেরি রাসলিস হোলনস্টাইনার খুব মিশুক প্রকৃতির। সিম্পোজিয়মেই তিনি এক মজার গল্প করেছিলেন : ফিলিপিনসে জেলে-অধ্যুষিত কিছু দ্বীপ আছে। কিছু পর্যটন-ব্যবসায়ী অমন একটা দ্বীপ কিনে নিয়ে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলতে স্থির করে। তবে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যে তারা পরিকল্পনা করে যে, কিছু সুন্দরী কেবল মাছধরা জাল পরে পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানাবে। যাদের প্রবল আপত্তির মুখে এই পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয় এবং দ্বীপটি অক্ষুণ্ণ থাকে, তাদের মধ্যে মেরি একজন। আমার Cultural Pluralism বক্তৃতায় আমি এই ঘটনাটা বলেছিলাম। আরেকজনের সাহচর্য আমার ভালো লেগেছিল–তিনি টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের লিবারাল আর্টস ফ্যাকালটির অধ্যাপক মুনেসুকে মিতা।
সম্মেলনে আরো যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক স্বনামধন্য সচ্চিদানন্দ মূর্তি, পেনাংয়ের ইউনিভার্সিটি সেইনস মালয়েশিয়ার সেন্টার অফ পলিসি রিসার্চের পরিচালক কে জে রত্নম, ফিজির ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ প্যাসিফিকের ভাইস-চ্যান্সেলর জেমস মারাজ, বেলগ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর মিরোস্লাভ পিচুইলিক, ব্রাজিলের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সেলসো ফুরতাদো এবং প্যারিসের ফাদার ব্রুনো রাইস উল্লেখযোগ্য।
পৃথিবীর ২২টি দেশের ৬৬ জন বিদ্বানের সঙ্গে কয়েকদিন যাপন করার সুখস্মৃতি নিয়ে ১৮ তারিখ সকালে কিয়োটো ছাড়লাম।
২৩.
ওসাকা থেকে এলাম হংকংয়ে। এবার কিছু কেনাকাটার ফর্দ নিয়ে গিয়েছিলাম। হংকং বিমানবন্দর থেকে যোগাযোগ করে এবারে কোনো হোটেলে জায়গা পাওয়া গেল না। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায়! একটা ট্যাকসি নিয়ে চলে এলাম হোটেল অ্যামবাসাডরে। বিমানবন্দরে যে-মেয়েটি আমার জন্যে জায়গা। খুঁজছিল, সে অবশ্য বলেছিল, ওখানে জায়গা নেই। আবার এ-ও বলেছিল যে, আমি যেতে যেতে কোথাও হয়তো কোনো অতিথি হোটেল ছেড়ে গেলে জায়গা পাওয়া যেতে পারে। সেই ভরসায় অ্যামবাসাডরে এলাম। কিন্তু ঠাই নেই। হোটেলের বেল-ক্যাপ্টেনকে বললাম, আগে এখানে থেকে গেছি, কিন্তু আজ ঘর খালি নেই। আমি কি তোমার কাছে সুটকেস রেখে জায়গার সন্ধানে যেতে পারি? সে সম্মত হলো।
চরণযুগল ভরসা করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। হোটেলে স্থান নেই, গেস্ট হাউজে খোঁজ করি। একটা গেস্ট হাউজে দেখলাম লেখা রয়েছে খালি আছে। কিন্তু রিসেপসনিস্ট মহিলা বললেন, জায়গা নেই। বুঝলাম, আমি প্রাচ্যদেশীয় হওয়ায় তাঁর এই জবাব।
ক্লান্ত ও পিপাসাত হয়ে একটি বারে ঢুকে পড়ি। তখনো বার ভালো করে খোলেনি। অদূরে এক ভদ্রলোক বসে আছেন মাত্র–আপ্যায়ন করার লোকজন। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ শুনি অপর খরিদ্দারের কণ্ঠস্বর : তোমাকে এত মনমরা দেখাচ্ছে কেন? এসো, কাছাকাছি বসা যাক।
উঠে এসে ভদ্রলোকের পাশে বসলাম। পরিচয় হলো। উনি নিউ ইয়র্কে প্যানাম এয়ারলাইনসে প্রশাসনিক কাজ করেন। আমার দুরবস্থার কথা শুনে বললেন, কিছু মনে কোরো না। এ তোমার অবিবেচনার ফল। একটা ব্যস্ত শহরে আসছো। আগে থেকে বাসস্থান ঠিক করে আসবে না? দু-সপ্তাহ আগে চেষ্টা করলে নিশ্চয় জায়গা পেতে।
কথাটা শুনতে ভালো লাগলো না, কিন্তু তার যথার্থতা অস্বীকার করতে পারলাম না। একটি ছেলে এসে অর্ডার নিয়ে গেল–খুব যে প্রসন্নচিত্তে, তা বলা যায় না। হাসিমুখে একটি মেয়ে অর্ডার নিয়ে এলো।
ভদ্রলোক বললেন, এই যে তোমরা বাংলাদেশ এয়ারলাইনস চালাও, কেন চালাও? ন্যাশনাল ক্যারিয়ার–একটা মর্যাদার ব্যাপার! কিন্তু তার জন্যে কত লোকসান দিতে হয়, তোমার কোনো ধারণা আছে? আমি বলতে পারি, বহুকাল তোমাদের লোকসান দিতে হবে, হয়তো কখনো লাভের মুখ দেখবে না। এত টাকা নষ্ট করে জাতীয় মর্যাদালাভের কোনো অর্থ হয়? স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশগুলো সকলে মিলে একটা এয়ারলাইনস চালায়। দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশ মিলে কি একটা এয়ারলাইনস চালাতে পারে না? আমি তোমাকে বলছি, প্যানামের মতো এয়ারলাইনস এখন হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে তোমরা?
আরো খানিকক্ষণ গল্প হলো। আমরা একসঙ্গে বের হলাম, কিছুক্ষণ একসঙ্গে হাঁটলাম। ভদ্রলোক বিদায় নেওয়ার সময়ে বললেন, ‘আই হোপ, ইউ ডোনটু এন্ড আপ ইন এ হোরহাউস।
আবার খোঁজাখুঁজি। কে যেন চুংকিং আর্কেডের কথা বললো। সেখানে গিয়ে ঘর পাওয়া গেল। অত্যন্ত অপরিসর, দরজা খুলে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠতে হয় আর কি! তাই সই, অ্যামবাসাডরে গিয়ে সুটকেস নিয়ে এলাম–এবারে ট্যাকসিতে।
তারপর বেরিয়ে খেয়েদেয়ে ফিরলাম, অমন ঘরে ফিরতে মন চাইছিল না যদিও।
পরদিন কেনাকাটা। নিজেদের জন্যে একটা টেলিভিশন, কনিষ্ঠ শ্যালিকা সিমিনের বিয়ে সামনে–তার জন্য পাথরের একটা গয়না। মেজো শালি নাজু। ডলার দিয়ে দিয়েছিল ক্রিস্টালের কিছু জিনিস কিনতে–তাও নেওয়া হলো। এসব জিনিস রাখার মতো জায়গা নেই ঘরে। টেলিভিশনটা গেস্ট হাউজ কর্তৃপক্ষের জিম্মায় রাখলাম।
২০ তারিখে হংকং থেকে ব্যাংককে এলাম। থাই এয়ারওয়েজ অতিরিক্ত মালের মাশুল নিলো না। মনে মনে খুশি হলাম।
ব্যাংককে থাই এয়ারওয়েজের অতিথি হিসেবে রাত কাটালাম। হোটেল বরাদ্দ করতে এবং ট্যাকসির কুপন দিতে প্রয়োজনাতিরিক্ত সময় নিলো বিমানবন্দরে। তবে সেখানে সুটকেস বাদে বাকি সব মাল নিজের খরচে রাখা গেল, এই যা স্বস্তি।
পরদিন ঢাকা যাওয়ার সময়ে অতিরিক্ত মালের মাশুল গুনতে হলো। যতই বলি না কেন হংকংয়ে বাড়তি পয়সা নেয়নি, ব্যাংককে নতুন জিনিস যুক্ত হয়নি, তাতে কাজ হলো না।
২৪.
হাসান হাফিজুর রহমান মস্কোতে প্রেস কাউনসেলর হয়ে গিয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে, ১৯৭৪-এ তাঁর সেই নিয়োগের অবসান ঘটে। দেশে ফিরিয়ে এনে তাকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে ওএসডি–অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি, আমার এক বন্ধুর ভাষ্যে অফিসার ইন স্পেশাল ডিফিকালটিজ–নিয়োগ করা হয় বছরখানেকের জন্যে। তারপর তিনি বেকার। একটা পর্যায়ে সংসারের জিনিসপত্র বিক্রি করে তাঁকে চলতে হয়। আমার সঙ্গে একবার তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে যোগদানের সম্ভাব্যতাও আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু যে-পদমর্যাদা বা বেতন পেলে তার পোষাতো, সেটা তাঁকে দেওয়া সম্ভবপর ছিল না বলে কথাটা আর বেশিদূর এগোয়নি। বৎসরাধিকাল বেকারজীবন যাপনের পর তাকে আবার তথ্য মন্ত্রণালয়ে ওএসডি করা হয় এক বছরের জন্যে। তারও কিছুকাল পরে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ইচ্ছায়, তাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা ও মুদ্রণ প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার পরামর্শে নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার ওই প্রকল্পের একটি প্রামাণ্যকরণ কমিটি গঠন করে ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে :
১. ড. মুফীজুল্লাহ্ কবীর, প্রো ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২. ড. সালাহউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
৩. ড. সফর আলী আকন্দ, পরিচালক, ইনসটিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
৪. ড. এনামুল হক, পরিচালক, ঢাকা যাদুঘর
৫. ড. কে এম মোহসীন, সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৬. ড. শামসুল হুদা হারুণ, সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৭. ড. আহমদ শরীফ, অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৮. ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
৯. জনাব হাসান হাফিজুর রহমান, বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মুক্তিযুদ্ধের
ইতিহাস প্রকল্প। আহমদ শরীফ এই প্রকল্পে যুক্ত হতে অসম্মত হন। তখন তার জায়গায় জাতীয় গ্রন্থাগার ও আর্কাইভসের পরিচালক কে এম করিমকে নিয়ে কমিটি পুনর্গঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এবারে অধ্যাপক মফীজুল্লাহ্ কবীরকে প্রামাণ্যকরণ কমিটির সভাপতি, হাসান হাফিজুর রহমানকে সদস্য সচিব এবং বাকি সাতজনকে সদস্য বলে অভিহিত করা হয়। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি থেকে প্রকল্পের অফিস স্থাপিত হয় সেগুনবাগিচায় এবং সামান্য লোকবল নিয়ে এর কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের সার্বক্ষণিক গবেষক হিসেবে যোগ দেন ইমামুর রশীদ, আফসান চৌধুরী, শাহ আহমদ রেজা ও ওয়াহিদুল হক। সুকুমার বিশ্বাস ও রতনলাল চক্রবর্তী নানাভাবে সাহায্য করেন। পরে ত্রিদিব দস্তিদার কর্মী হিসেবে প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট হন।
প্রকল্প হাতে নিয়ে হাসান হাফিজুর রহমান যখন আমার সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করেন, তখন আমি তাকে বলি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসরচনার চেষ্টা না করে দলিলপত্র সংকলন করতে। কারণ সরকারি উদযোগে লেখা ইতিহাস পক্ষপাতহীন হওয়া দুরূহ। অন্যদিকে দলিল নিজ থেকেই এক ধরনের সত্য প্রকাশ করে। হাসান আমার যুক্তি মেনে নেন। আরো কেউ কেউ এ-প্রস্তাব সমর্থন করেন। সরকারকে বিষয়টা বোঝাতে কিছু সময় লাগে।
প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর এক বছর করে বাড়তে থাকে। মেয়াদবৃদ্ধির আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ হতে মাঝে মাঝেই বিলম্ব ঘটে। তখন প্রকল্পের পরিচালক ও কর্মীদের বেতন পেতে বিলম্ব হয়। এই মানসিক চাপের মধ্যে তাদের কাজ করতে হয়। দলিলপত্র ছাপা হওয়া শুরু করলে স্পেশাল ব্রাঞ্চের কর্মকর্তারা ছাপা ফর্মা নিয়ে পরীক্ষা করেন বেশ সময় ধরে। তাদের অনুমোদন পেতে দেরি হয়। তাতেও এক ধরনের মানসিক উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়তে হয় সংশ্লিষ্ট সকলকে।
প্রামাণ্যকরণ কমিটির সভায় নিয়মিত যোগদান করা আমার পক্ষে সম্ভবপর হয়নি-মধ্যে মধ্যে দেশের বাইরে থাকা এবং দেশে থাকলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকা তার কারণ। তবু প্রকল্পের কাজটি আমি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করি। প্রামাণ্যকরণ কমিটির সভায় মাঝে মাঝে উত্তাপের সৃষ্টি হতো। কমিটির কোনো কোনো সদস্য যেমন আওয়ামী লীগের পক্ষপাতী ছিলেন, গবেষকদের কেউ কেউ তেমনি আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিহীন ছিলেন। দৃষ্টিভঙ্গির এই পার্থক্য কখনো কখনো সংঘাতের সৃষ্টি করতো। প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পরে। মুক্তিযুদ্ধের বদলে স্বাধীনতা-যুদ্ধ শব্দবন্ধ ব্যবহারের সরকারি সিদ্ধান্ত হয়। প্রকল্পকে তা মেনে নিতে হয়। তবে শেষ পর্যন্ত বস্তুনিষ্ঠভাবেই কাজটি সম্পন্ন হয়। কমিটির কাজে তবু একটা ত্রুটি রয়ে যায়। প্রামাণ্যকরণ কমিটি কোন কোন দলিল অনুমোদন করলো, সভার কার্যবিবরণীতে তার তালিকা রক্ষা করা হতো না। ফলে এমন অভিযোগের সুযোগ সৃষ্টি হতো যে, প্রামাণ্যকৃত কোনো দলিল মুদ্রিত হয়নি। এমন তালিকা তৈরি করা বা কমিটির পরবর্তী সভায় তা স্থিরীকৃত করিয়ে নেওয়ার জন্যে আমরা কেউ কেউ হাসান হাফিজুর রহমানকে অনুরোধও করেছি। কেন জানি না, সে-অনুরোধ তিনি রক্ষা করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, যা-কিছু অনুমোদিত হচ্ছে, তার সবই গ্রন্থভুক্ত হতে যাচ্ছে।
এই প্রকল্পের জন্যে হাসান হাফিজুর রহমান খুব খেটেছিলেন। প্রকল্পের গবেষকেরাও যথেষ্ট পরিশ্রম করেছিলেন। বাংলা একাডেমির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে সংগৃহীত দলিলপত্র এই প্রকল্পের কাছে হস্তান্তরিত হয়। প্রকল্পের উদ্যোগে বিপুল পরিমাণ দলিল সংগৃহীত হয়। অনেকে অবশ্য নিজেদের সংগ্রহের জিনিসপত্র হাতছাড়া করতে চাননি, কেউ কেউ অনুলিপিও দিতে চাননি। তবু সাড়ে তিন লাখ পৃষ্ঠার কাগজপত্র সংগ্রহ করা যায়। তার থেকে ছাপা হয় ১৫০০০ পৃষ্ঠার দলিল। মূল পরিকল্পনায় তার অর্ধেক পরিমাণ ছাপার কথা ছিল। বর্ধিত কলেবরে প্রকাশের জন্যে অর্থাৎ অতিরিক্ত ব্যয়-বরাদ্দের জন্যে হাসানকে অনেক দেন-দরবার করতে হয়। শেষদিকে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। সম্পাদক হিসেবে তাঁর দায়িত্বভার অর্পণ করা হয় কে এম মাহসীনকে। তবে দলিলপত্রের ভূমিকা হাসান লিখে যেতে পেরেছিলেন। তার ইচ্ছায় তাতে আমি খানিকটা যোগ-বিয়োগ করেছিলাম। হাসান খুব আত্মতৃপ্তির সঙ্গে বলেছিলেন, একুশে ফেব্রুয়ারির পর আবার একটা কাজ আমরা একসঙ্গে করতে পারলাম।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রসংকলনে সময় লাগে, মুদ্রণেও যথেষ্ট সময় নেয়। এর ১৫ খণ্ড প্রকাশ পেতে পেতে দেশেও নানারকম পরিবর্তন ঘটে যায়।
২৫.
ঐতিহ্য সংরক্ষণ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্যে সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিল। যতদূর মনে পড়ে, উদ্যোগটা নিয়েছিলেন আবুল ফজল। তিনি উপদেষ্টা-পরিষদ থেকে চলে গেলে কীভাবে যেন ওই কমিটির দায়িত্ব এসে পড়ে তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল হুদা চৌধুরীর ওপরে। একজন সদস্য হিসেবে এর একটি বা দুটি সভায় যোগ দিয়েছিলাম। একটি সভার কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে।
সভাস্থলে পৌঁছোবার পরপরই সভাপতি এসে গেলেন। শামসুল হুদা চৌধুরী মজলিসি লোক। আরো সদস্যের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে খোশগল্প জুড়ে দিলেন। আমাকে লক্ষ করে বলতে শুরু করলেন : জাতীয় সংগীত করার জন্যে তোরা আর গান পেলি না! বঙ্গভঙ্গ-আন্দোলনের গান বেছে নিলি–তাও বাউল সুরের, যাতে উদ্দীপনার একান্ত অভাব। ধনধান্যপুষ্পভরা’ হলেও একরকম হতো। হাসতে হাসতে বললাম, আমার সোনার বাংলা’ গানটি বহুকাল আমাদের মর্মের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া বিদেশিদের দিয়ে আমাদের দেশকে সকল দেশের সেরা’ বলানো কি ঠিক হতো?’ উনি তার জবাব দিলেন না। বলতে থাকলেন : ‘আর আমাদের দাদারা তো আরো এককাঠি এগিয়ে। পঞ্চম জর্জের বন্দনাকে জাতীয় সংগীত বানিয়ে ফেললো।’ মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে উপদেষ্টার কথায় সায় দিচ্ছেন কেউ কেউ। আমি এবারে আর হাসতে পারলাম না। বললাম : ‘এ-নিয়ে যেসব বাদানুবাদ হয়েছে, আপনার তা জানার কথা। রবীন্দ্রনাথের নিজের বক্তব্যও রয়েছে এ-বিষয়ে। ওটা যে পঞ্চম জর্জের বন্দনা। নয়, তা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত।’ শামসুল হুদা চৌধুরী বললেন : আমি আদ্যোপান্ত জানি। আর যাকে হোক, আমাকে বোঝাতে আসিস না যে, ওটা সম্রাটের বন্দনা নয়। ওটা যে পঞ্চম জর্জের বন্দনা, তার কনটেমপোরারি এভিডেনস আছে।’
শামসুল হুদা চৌধুরী শান্তিনিকেতনের ছাত্র ছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বোলপুরের একেবারে পাশে। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি জানেন যথেষ্ট। তবে নিজে যা বলছেন, তার পালটা যুক্তি শুনতে রাজি নন। আমি তো সাক্ষ্যপ্রমাণ। সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি না। অতএব, এ-তর্কের ছেদ টানলাম।
পাহাড়পুরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে ইউনেসকোর সাহায্য চাইবার একটা প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল এই কমিটির সভায়। তারপর অত্যন্ত কাছাকাছি সময়ের লোকজনের স্মৃতিরক্ষার জন্যে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সভাপতির কোনোটাতেই আপত্তি নেই।
রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে যাওয়ার পরেও শামসুল হুদা চৌধুরী জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার সদস্য রয়ে গিয়েছিলেন।
মন্ত্রিসভা গঠনের অল্পকাল পরেই জিয়াউর রহমান জাগদল বিলুপ্ত করেন, গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতে থাকেন, জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নিযুক্ত করেন সেনাবাহিনীর স্টাফ-প্রধান। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল দুই তৃতীয়াংশের অধিক আসন লাভ করে। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় স্থান লাভ করে–তবে তার আসনসংখ্যা থাকে সামান্য। নির্বাচনের ছয় সপ্তাহের মধ্যে শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও মওদুদ আহমদ হন সহকারী প্রধানমন্ত্রী। এই খবরটা আমি পাই বিদেশে বসে।
২৬.
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি অ্যান্ড রেকর্ডসের পরিচালক জোন সি লানকাস্টার অবসর নিয়েছেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সোয়াসের গ্রন্থাগারিক বি সি ব্লুমফিল্ড। ১৯৭৭ সালে আমি ঢাকা কুঠির কাগজপত্রের তালিকা তৈরি করে দিয়ে আসার পরে লাইব্রেরিতে অনুরূপ আরো কিছু কাগজপত্র পাওয়া গেছে। ব্লুমফিল্ড আমাকে লিখলেন, আরেকবার লন্ডনে গিয়ে যদি আমি এগুলোর তালিকা করে দিতে পারি, তবে একসঙ্গে বই করে ছাপা যাবে। এবারেও ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি ওরিয়েন্টাল ডকুমেন্টস কমিটি আমার স্থানীয় খরচ নির্বাহ করবেন, যাতায়াত খরচের ব্যবস্থা আমাকে করতে হবে।
আবুল মাল আবদুল মুহিত তখন বহিঃসম্পদ বিভাগের সচিব। তাকে আমার প্রয়োজনের বিষয়টা অবহিত করলাম। তাঁর হাতে যা আছে, তার থেকে কিছু করা গেল না। তিনি ফোন করলেন বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিব এ বি এম গোলাম মোস্তফাঁকে। সবটা খুলে বলে অনুরোধ করলেন আমাকে বাংলাদেশ বিমানের একটি সৌজন্যমূলক টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। কয়েকদিন পর জানা গেল, ব্যবস্থা হয়েছে।
১৯৭৯ সালের ১০ মার্চ লন্ডন রওনা হলাম। এবারও গিয়ে উঠলাম আবদুল মোমেনের বাড়িতে। গিয়ে দেখি, তার ভগ্নিপতি, ঢাকা বেতারের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক আবু শাহাদাৎ, এক প্রশিক্ষণ-কর্মসূচিতে লন্ডনে এসেছেন বিবিসির সঙ্গে যুক্ত হতে। তিনি স্বাভাবিকভাবে মোমেনদের অতিথি। অনতিবিলম্বে তাঁর পরিবার এসে সেখানেই তাঁর সঙ্গে মিলিত হবে। অতএব অন্যত্র বাসস্থান সন্ধান করা আমার কর্তব্য। এ-বিষয়ে মোমেনই সাহায্য করলেন। তাঁর সহকর্মী জ্যান ড্রাইডেন এই গ্রীষ্মবকাশে খুব শখ করে বাংলাদেশে যেতে চেয়েছিল। এমন কথাও হয়েছিল যে, জ্যান বাংলাদেশে গেলে চট্টগ্রামে আমার বাড়িতে কয়েকদিন থাকবে। কিন্তু তার পাসপোর্ট দক্ষিণ আফ্রিকার বলে সে বাংলাদেশের ভিসা পেল না। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে সে স্থির করলো, হংকং যাবে বেড়াতে। এখন তার ফুলগাছে পানি দেওয়ার দায়িত্ব। কাউকে নিতে হবে। মোমেন আমাকে নিয়ে গেলেন জ্যানের বাড়িতে। বললাম, ‘আমি তব মালঞ্চের হবো মালাকর।’
কিংস ক্রস স্টেশনের খুব কাছে জাড স্ট্রিটের একটা বাড়িতে জ্যানের বাস। সেখানে একতলা ও দোতলার খানিকটা নিয়ে থাকেন দুই চিরকুমারী–মেরি ও তার বোন। দোতলার খানিকটা ও তেতলা জ্যানের দখলে। জ্যান খুব আনন্দের সঙ্গে আমাকে থাকতে দিলো, তবে অনেকরকম সাবধানবাণী উচ্চারণ করলো। মেরি ও তার বোন দুজনেরই বয়স হয়েছে, একটু খিটখিটে মেজাজের, তার ওপর বর্ণবিদ্বেষী-মোমেন তাদের চক্ষুশূল। শ্বেতাঙ্গিনী জ্যানের কাছে কৃষ্ণাঙ্গদের আসা-যাওয়া তাঁরা পছন্দ করেন না। আমি যেন ঘরে আওয়াজ না করি, রাতে টয়লেট ব্যবহার করলেও যেন ফ্লাশ না করি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরতে না পারলে, নিচে যে-লিখিত নোটিশ আছে, তা যেন টাঙিয়ে দিয়ে যাই। বাড়িতে যেন একসঙ্গে বেশি লোককে আমন্ত্রণ না করি। ফুলের টবগুলোয় কখন কতটা পানি দিতে হবে, জ্যান তা বুঝিয়ে দিলো। টেলিফোনে লোকে যেন তাকে বিরক্ত না করতে পারে, তার একটা ব্যবস্থা সে করেছিল। সেটাও বুঝে নিলাম। জ্যান হংকং রওনা হওয়ার আগেই তার বাড়িতে আস্তানা গেড়ে ফেললাম।
জ্যানের বাড়িতে মাসাধিককাল আমি খুব স্বচ্ছন্দে ছিলাম, কিছু অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেছিলাম। ওর বাড়ির সামনের রাস্তায় একটা লড্রেটে কাপড় ধুতে যেতাম। সেখানে মহিলাদের ভিড়, ক্কচিৎ কখনো পুরুষের দেখা পাওয়া যেতো। আমাকে দেখে মহিলারা পরস্পর যেসব সংলাপ বিনিময় করতেন, তা এরকম : লন্ডনের আসল বাসিন্দারা কোথায় গেল? শহরটা সব বিদেশিতে ভরে গেল, তাই না? এই পরদেশিরা কী যে করে এদেশে! আমাদের বাড়িঘর দোকানপাট আস্তে আস্তে সব বেদখল হয়ে যাচ্ছে।আমি শুনে না-শোনার ভান করি, বুঝে না বোঝার ভাব করি।
বাড়িতে আমি জ্যানের নির্দেশমতো চলি। খুব কমই কাউকে আসতে বলি। আমার ভাগ্নি শিরিণ কয়েক বছর লিবিয়ায় কাটিয়ে দেশে ফেরার পথে লন্ডনে এলো। সঙ্গে তার স্বামী ডা. আনওয়ার-উল-আজিম এবং শিশুকন্যা শাওন। তাদের আসতে বলেছিলাম একদিন। আরো কেউ কেউ অল্পক্ষণের জন্যে এসেছে–মূলত আমাকে নিতে। আমার মনে হয়েছে, ডোরবেল শুনলে মেরি অথবা তার বোন পর্যবেক্ষণ করতেন–কে আসছে। কিন্তু কখনো তা নিয়ে আমাকে কিছু বলেননি, কোনো মন্তব্যও আমার কানে আসেনি। বরঞ্চ বুলু একদিন সামনে পড়ে যাওয়ায় মেরি বেশ সৌজন্যপূর্ণ আচরণ করেছিলেন।
আমার সঙ্গে রোজই তাদের কুশলবিনিময় হতো। একদিন সকালে ঘরের ভেতরে চাবি রেখে দরজা বন্ধ করে ফেলেছিলাম বাইরে থেকে। সেদিন সাহায্য চাইতে তাঁদের কাছে যেতে হলো। মেরি আমাকে বসতে বলে নিজেই পুলিশে খবর দিলেন, চাবিওয়ালা ডাকিয়ে দরজা খোলার ব্যবস্থা করে দিলেন, অনুরূপ আরেক ঘটনার গল্প করে বোঝাতে চাইলেন এমন হয়েই থাকে। আমি তাদের কাছে খুব কৃতজ্ঞ বোধ করেছিলাম।
জ্যান ফিরে আসার আগে মেরি একদিন আমাকে ডাকলেন। জানতে চাইলেন, জ্যান চলে এলে আমি কোথায় যাব? বললাম, কোথাও একটা মাথা গোঁজার ঠাই করে নেবো। তিনি বললেন, কেন, জ্যানের বাড়িতে তো জায়গা আছে–তুমি এখানে থেকে গেলেই পারো। জ্যানকে বলে দেখো না কেন? আমি তো অবাক। বললাম, এখানে আমার পক্ষে থাকা সম্ভবপর হলে জ্যান নিজেই আমাকে বলবে, আমি সে কথা বলে ওকে বিরক্ত বা বিব্রত করতে চাই না।
জ্যান ফিরে আসার পরে আমি তাকে কিছু বলিনি, বোধহয় মেরিই বলেছিলেন। জ্যান আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কি মন্ত্র করেছ মেরিকে? যে কালো লোক দেখতে পারতো না, সে তোমাকে রাখার জন্যে ব্যস্ত হয়ে গেছে। উত্তরে আমি শুধু হাসলাম।
মানুষ বড়ো জটিল প্রাণী। তাছাড়া, বঙ্কিমচন্দ্র যেমন বলেছিলেন, মনুষ্য বড়ই পরাধীন।
২৭.
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি অ্যান্ড রেকর্ডসে যেসব কাগজপত্র আমাকে তালিকাভুক্ত করতে হবে, এখন সবসুদ্ধ তা দাঁড়ালো এরকম : (১) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা কুঠির সঙ্গে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরায় অবস্থিত তাদের আটটি আড়ঙ্গ অর্থাৎ সুতি বস্ত্র-উৎপাদন কেন্দ্রের (ঢাকা, ধামরাই, সোনারগাঁও, টিটবাদী; জঙ্গলবাড়ি-বাজিতপুর; চাঁদপুর, নারায়ণপুর ও শ্রীপুর) ১৭৯২ ও ১৮০০ সালে লেখা ২৯ খণ্ড দৈনন্দিন চিঠি; (২) ১৭৯১ থেকে ১৮০৯ সালের মধ্যে নানা সময়কার ঢাকা কুঠির বস্ত্র-উৎপাদনের ১৬ খণ্ড হিসাবখাতা; (৩) মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুর কুঠির এবং তার অধীন তিনটি আড়ঙ্গের অর্থাৎ রেশমি বস্ত্র উৎপাদন-কেন্দ্রের ১৭৯১ ও ১৮০৯ সালের ১৭ খণ্ড হিসাবখাতা; (৪) মুর্শিদাবাদের কাসিমবাজার কুঠির রেশমি বস্ত্র ব্যবসাসংক্রান্ত ১৮০০-০১ সালের দুটি হিসাবখাতা; (৫) চাকলা জাহাঙ্গীরনগরের ১৭৭৭-৭৮ সালের (বাংলা ১১৮৪ সনের) রাজস্বসংক্রান্ত একটি হিসাবখাতা, চাকলা মেদিনীপুর ও চাকলা জলাসসারের ১৭৮৩ সালের রাজস্বসংক্রান্ত কিছু কাগজ, নদীয়ার কৃষ্ণনগর-বোলান্দিয়ার ভাড়ার রসিদপত্র; মুর্শিদাবাদের আবগারি মহালের ১৮০৮ সালের একটি হিসাবখাতা ও একই সময়ে হিসাবের কিছু কাগজ; ২৪ পরগনার একটি তালুকের ১৮১০ সালের দুটি রোবকারি ও একটি আমলদারি, ওই জেলার বানিয়াঘাটা ফেরিসংক্রান্ত ১৮১২ সালের কিছু কাগজপত্র, ২৪ পরগনা কালেক্টরির ১৮১০ থেকে ১৮১৩ সালের মধ্যেকার নানা ধরনের পরোয়ানা, দস্তক, শিয়া, তৌজি ও ট্রেজারির মাসিক হিসাব; (৬) ঢাকার কোর্ট অফ অ্যাপিল অ্যান্ড সার্কিটের ১৭৯৫-৯৬ ও ১৮১৪ সালের দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার কাগজপত্র, হুগলির জেলা জজ আদালতের ১৮০৩ ও ১৮১৪ সালের কাগজপত্র-এর মধ্যে বর্ধমানের মহারাজা তেজচন্দ্রের, হাজি মুহম্মদ মহসিনের এবং রামমোহন রায়ের মামলার কাগজ আছে, সদর দেওয়ানি আদালতে রানি ভবানী ও অন্যান্যের ১৮০৬ সালের আপিলের কাগজপত্র, হুগলির ফৌজদারি আদালতের ১৮১৪ সালের কাগজপত্র, যশোর দেওয়ানি আদালতের ১৭৯০ সালের, বর্ধমান। দেওয়ানি আদালতের ১৭৯৭ সালের ও ২৪ পরগনার দেওয়ানি আদালতের ১৭৯৭ সালের হিসাবসংক্রান্ত কাগজপত্র; (৭) জর্জ বোগলের সংগ্রহে ১৭৭৭ থেকে ১৭৭৯ সালের মধ্যেকার নানা ধরনের কাগজপত্র; (৮) ব্রায়ান হজসনের সংগ্রহে তারিখবিহীন একটি শব্দতালিকা–বাংলা, অসমিয়া ও আরো দুটি ভাষায় লেখা, এবং (৯) ১৭৭৯, ১৮১০ ও ১৮১৩ সালের তিনটি বিবিধ কাগজ।
ঢাকা কুঠির বেশির ভাগ কাগজপত্র ছিল সেখানকার কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট জজ টেলরের আমলের। যে-কোনো কারণেই হোক, তিনি এসব নিয়ে দেশে ফিরে আসছিলেন। পথে জাহাজে তাঁর মৃত্যু হলে এসব কাগজ ইন্ডিয়া অফিসে চলে আসে। ২৪ পরগনার রাজস্বসংক্রান্ত কাগজপত্র কলকাতার বোর্ড অফ রেভিনিউ থেকে হেইলিবারি কলেজে পাঠানো হয়েছিল–সম্ভবত সেখানকার ছাত্রদের ব্যবহারের জন্যে। জঙ্গীপুর কুঠির কাগজও বোধহয় কোনো বিশেষ কারণে লন্ডনে পাঠানো হয়েছিল। বোগল ও হজসন নিজেদের সংগ্রহ দিয়ে গিয়েছিলেন ইন্ডিয়া অফিসে–এগুলো ইউরোপীয় পাণ্ডুলিপির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইউরোপীয় পাণ্ডুলিপির সহকারী কিপার আর জে বিঙ্গল এগুলোর প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
এবারে দেখতে পেলাম কিছু কাগজপত্রের সঙ্গে ইংরেজিভাষায় পেনসিলে লেখা কিছু টোকা রয়েছে। খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল যে, বেঙ্গলি লিটারেচর (অকসফোর্ড, ১৯৪৮) গ্রন্থের লেখক এবং টমাস অটওয়ের ওয়র্কসের (অকসফোর্ড, ১৯৩২) সম্পাদক ড. জে সি [জ্যোতিষচন্দ্র] ঘোষকে কোনো এক সময়ে এইসব কাগজ তালিকাভুক্ত করতে দেওয়া হয়েছিল। ড. ঘোষ অত্যন্ত পণ্ডিত ব্যক্তি-তবে পুরোনো বাংলা লেখা বোধহয় খুব ভালো পড়তে পারতেন। না। কিছুদিন কাজ করে তিনি আর অগ্রসর হননি।
আমি আগেরবার ১২ খণ্ড চিঠিপত্র তালিকাভুক্ত করেছিলাম। তার তুলনায় এবারে কাজ বেশি। কোমর বেঁধে লেগে গেলাম। মাইকেল ও’কিফকে বললাম, আরো তিন খণ্ড যদি না-ও হয়, অন্তত আরো এক খণ্ড চিঠিপত্র কোথাও থেকে থাকবে–ভালো করে খোঁজ করে দেখো। আমি থাকতে কিছু পাওয়া গেল না–চলে। আসার পরে একটি খণ্ড বের হলো। সেটা পরে তালিকাভুক্ত করেছিলাম।
এবারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহেদা আহমদ ও শিরিন ওসমানীকে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে পেলাম। শরীফউদ্দীন আহমদ আছেন এখনো, ইফতিখার উল আউয়াল যোগ দিয়েছেন। শরৎচন্দ্র বসুর পৌত্র–এখন স্বনামধন্য সুগত বসু তখন কেমব্রিজে গবেষণা করছিল পিএইচ ডি পর্যায়ে। সেও খুব নিয়মিত আসততা এই লাইব্রেরিতে। তার সঙ্গে দস্তুরমতো হৃদ্যতা হয়ে গেল।
লাইব্রেরিতে ঢুকে একদিন সৈয়দ আলী আহসানকে পেলাম। রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হিসেবে তখন তার নিয়োগের অবসান হয়েছে। তিনি যাচ্ছেন আমেরিকায়, বড়ো মেয়ে জিনাতের কাছে। পথে থেমেছেন লন্ডনে। সেই সুযোগে লাইব্রেরিতে কিছু বইপত্র দেখবেন, তবে বেশি সময় নেই তাঁর হাতে। এই লাইব্রেরি ব্যবহারের প্রস্তুতিও নেই তাঁর। আমি তাঁকে কাগজ-পেনসিল দিলাম। দুপুরে খেতে নিয়ে গেলাম কাছের গ্রিক রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টে বসে তিনিই প্রথম মুখ খুললেন : ‘শেখ মুজিব একজন হৃদয়বান মানুষ ছিলেন।’ তারপর আরো নানা কথা হলো। সেদিনের পরে লাইব্রেরিতে আর আসতে পারেননি তিনি।
ডেভিড কফ এসেছেন আমেরিকা থেকে। তাঁকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গেলাম ইয়ং ভিকের রেস্টুরেন্টে। যার যার ট্রে-তে খাবার তুলে নিয়েছি। দামটা আমি দিলাম। ডেভিড কফ টেবিলে ট্রে রেখে ফিরে গেলেন। দেখি, নিজের জন্য বিয়ার কিনে আনছেন। আমার কোনো পানীয় লাগবে কি না, একবারও জানতে চাননি।
কোয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বালোচ আবার এসেছেন জার্মানি থেকে। বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। চান্সেলর জিয়াউল হককে চিঠি দিয়ে বলেছেন, আপনি জানেন, জুলফিকার আলী ভুট্টোর হাতে আমি নির্যাতিত হয়েছি। কিন্তু ভুট্টোকে ফাঁসিতে লটকে আপনি কলঙ্কভাগী হয়েছেন। আপনি যে-বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্সেলর, সে-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি শিক্ষক হয়ে থাকতে পারি না। বালোচকে জিজ্ঞাসা করি, এর প্রতিক্রিয়া কী হবে? তিনি বলেন, জিয়াউল হক যতদিন ক্ষমতায় থাকবে, আমি দেশে ফিরতে পারব না। জানতে চাই, তার পরিবারের কী হবে? বালোচ পিঠ খাড়া করে উত্তর দেন, আমার উপজাতি আছে না?
খান আবদুল ওয়ালী খান কদিন কাজ করলেন লাইব্রেরিতে। যেচে গিয়ে আলাপ করলাম। পাকিস্তানের অবস্থা ভালো নয়, এটুকু বললেন তিনি। যোগ করলেন, তাঁর নিজেরও নিরাপত্তা নেই।
তাঁর সঙ্গে ওঠাবসা করতে চান না বালোচ। বলেন, এই হলো পাকিস্তান। দেশের দুঃসময়ে রাজনৈতিক নেতা নিরাপদে থাকতে চলে এসেছেন লন্ডনে, বই লেখার মালমশলা সংগ্রহ করছেন। নেতা না থাকলে দেশে আন্দোলন করবে কে? সাধারণ মানুষকে চালাবে কারা? এই করেই তো জিয়াউল হকের মতো সামরিক একনায়কেরা নিষ্কণ্টক হয়। আমার দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
২৮.
বেবী জরুরি বার্তা পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম থেকে। এপ্রিলের শেষে মেক্সিকো সিটিতে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার হবে। আনোয়ার আবদেল-মালেক চিঠি পাঠিয়েছেন, ঢাকার কেএলএম অফিস থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে বলেছেন। বেবী তাঁকে জানিয়েছে যে, আমি আছি লন্ডনে। কেএলএমকেও জানানো হয়েছে সেকথা। সব কাগজপত্র সে পাঠিয়ে দিয়েছে জ্যানের ঠিকানায়।
লন্ডনে কেএলএম অফিসে যোগাযোগ করলাম। হ্যাঁ, সব ঠিক আছে, এখান থেকে টিকিট দিতে কোনো অসুবিধে নেই, কিন্তু তার আগে আমাকে মেক্সিকোর ভিসা নিতে হবে।
মেক্সিকোর দূতাবাসে গেলাম। বাংলাদেশের সঙ্গে তখনো মেক্সিকোর কূটনৈতিক সম্পর্ক হয়নি, অতএব আমাকে ভিসা দেওয়া যাবে না।
লন্ডনে আমাদের হাই কমিশনে যাই। ডেপুটি হাই কমিশনার মহসিনকে খুলে। বলি আমার অবস্থা। তার পরামর্শে তাঁর অফিস থেকে আনোয়ার আবদেল মালেককে ফোন করি প্যারিসে–তিনি আগাম চলে গেছেন মেক্সিকোয়। তার সেক্রেটারি আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবেন বলে মনে হয় না। মহসিন ভেবেচিন্তে বলেন, তিনি একটা ডিও লিখবেন মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূতকে–তাতে কাজ হবে কি না বলা যাচ্ছে না।
মহসিনের চিঠি নিয়ে আবার যাই মেক্সিকান দূতাবাসে। তারা বিরক্ত হয়। বলে, বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীকে কী করে ভিসা দেওয়া সম্ভব? তাদের দপ্তরের এক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করি, আমি কি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করতে পারি? তিনি একটু ভেবে বলেন, জেনে আসি তিনি দেখা করবেন কি না। তবে তিনিই আপনার শেষ আদালত।
রাষ্ট্রদূত দেখা করতে সম্মত হন। মহসিনের চিঠিটা পড়েন। আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক? তাহলে তো তোমার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হয়। তিনি ফোনে কাউকে কিছু বলেন স্প্যানিশে। তারপর আমাকে বলেন, তোমাকে নিচে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে-ভিসা দিতে যতক্ষণ লাগে। আমি অবাক হয়ে যাই এত অল্প সময়ে সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ায়। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে কূল পাই না। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করেন, নিজে দরজা খুলে দেন।
নিচে নেমে অপেক্ষা করি। সামনে লোকজন কাজ করছে। ভেতর থেকে এক তরুণী এসে কারো সঙ্গে কথা বললো। আমার দিকে একটু তাকালো। তারপর চলে গেল।
অত সুন্দরী আমি এর আগে দেখিনি। পরেও যে খুব দেখেছি, তা নয়। জামার ওপর থেকে সে যেভাবে নিজের স্তনযুগল স্পর্শ করলো, তাতে মনে হলো, নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে সে সচেতন।
একটু পরে একটি অল্পবয়সী ছেলে আমার পাসপোর্ট নিয়ে এলো। মাথা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে বললো, রাষ্ট্রদূতের সৌজন্যসহ।
কেএলএম থেকে টিকিট পেতে কোনো ঝামেলা হলো না।
জ্যান এবং মেরি ও তার বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চললাম। ২১ এপ্রিলে লন্ডন থেকে আমস্টারডাম। সেখান থেকে মেক্সিকো সিটিতে পৌঁছোবো পরদিন।
লন্ডন থেকে আমস্টারডাম অল্পক্ষণের যাত্রা। সেখানে পৌঁছে মেক্সিকোগামী ফ্লাইট ধরতে গিয়ে জানা গেল, যাত্রা বিলম্বিত হবে–বিমান খারাপ হয়ে গেছে, সেটা সারানো হচ্ছে।
বিমানবন্দরে অপেক্ষা। এয়ারলাইনসের সৌজন্যে লাঞ্চ খাওয়া। তারপর ঘোষণা, ইচ্ছে করলে এই ফ্লাইটের যাত্রীরা নিজের খরচে শহর ঘুরে আসতে পারে।
এই অবস্থায় বিমানবন্দরে কে বসে থাকতে চায়? পাসপোর্ট রেখে একটা কাগজ নিয়ে বাসে করে শহরের মধ্যস্থলে পৌঁছোলাম। মনোরম দৃশ্য চারদিকে। কিন্তু আসতে যত সময় নিলো, তাতে বেশিক্ষণ ঘোরাঘুরির সম্ভাবনা তিরোহিত হয়ে গেল। অল্প খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ফেরার বাস ধরার চেষ্টা করলাম। বাস পেতে সময় লাগলো। বিমানবন্দরে বাস থেকে নেমে খোঁজ নিয়ে বুঝলাম, ভুল টার্মিনালে এসেছি। এখান থেকে হেঁটেই যেতে হবে জায়গামতো। ফেরার সময় চলে যাচ্ছে। দৌড়োতে দৌড়োতে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছোলাম। কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। বিমান কি আমাকে। রেখে চলে গেল? তারপর জানলাম, যেতে আরো বিলম্ব হবে–যাত্রীরা সব ডিনার খেতে গেছে।
ডিনার খেতে গিয়ে গলায় খাবার আটকে যায়। শ্বাসরোধ হবার অবস্থা। আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে গলা চেপে ধরে খাবার বের করি। আশেপাশের টেবিল থেকে দু-একজন তাকিয়ে দেখে। সাহায্য করবে-করবে ভাব করে। তার আগে আমি আবার চেয়ারে বসে পড়ি। হাঁফ ছাড়ি, পানি খাই।
অনেক রাতে বিমান ছাড়ে। মাঝে জ্বালানি নেওয়ার জন্য হিউসটনে বিরতি। তবে বিমান থেকে নামা যায় না। মেক্সিকো সিটিতে পৌঁছোতে খুব বিলম্ব হয়। সেখানে প্রায় ভোর। মালপত্র নিয়ে বাইরে এসে আমার জন্যে অপেক্ষমাণ কাউকে পাই না। কী করবো, কোথায় যাবো? ভাবলাম, কোনো মেসেজ আছে নাকি দেখে আসি। আছে। একটা হোটেলের নামঠিকানা দিয়ে সেখানে সটান চলে যেতে বলা হয়েছে। তাই করলাম। হোটেলকক্ষের বিছানায় ক্লান্ত শরীর ছেড়ে দিয়ে মনে হলো, বাঁচা গেল।
২৯.
মেক্সিকোর সভ্যতা অনেক পুরোনো। অন্তত দশ-বারো হাজার বছর আগে সেখানে যে মানববসতি শুরু হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মেক্সিকোয় বসতিস্থাপনকারীদের মধ্যে যে অনেক এশীয় ছিল, সে-সম্পর্কেও ইতিহাসবিদেরা একমত। মায়া-সভ্যতা ও অ্যাজটেক-সভ্যতার বিকাশ এ অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছিল।
সেমিনারের উদ্যযাক্তারা সেই প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন দেখাবার ব্যবস্থা দেখলাম। ওই মুহূর্তে তাদের কাজের বেশি নমুনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু মেক্সিকো নগরীর অনতিদূরে অ্যাজটেকদের কীর্তি দেখে মন ভরে গেল। টেনচটিটুলান দেখলাম, দেখলাম সূর্য ও চন্দ্রের মন্দির। তখনো মিশরে যাইনি। সুতরাং অ্যাজটেকদের পিরামিডই আমার প্রথম দেখা পিরামিড। সে এক আশ্চর্য ব্যাপার! স্প্যানিশ বিজয়ীরা তাদের স্থাপত্য-ভাস্কর্য কিছু কিছু নষ্ট করেছিল বটে, কিন্তু যা টিকে রয়েছে, তার বিশালতা ও সৌন্দর্য মনকে। গভীরভাবে আপ্লুত করে। মানুষের কল্পনাশক্তি ও উদ্ভাবননৈপুণ্য এবং সেই সঙ্গে কর্মযজ্ঞ ও শ্রমনিয়োগের বিপুলতার যে-পরিচয় এখানকার ইট-পাথরে এখনো ধরা রয়েছে, তা ক্রমাগত বিস্ময় জাগায়। মেক্সিকোর ইতিহাসে অ্যাজটেকদের কাল একাদশ থেকে যোড়শ শতাব্দী। তারপর স্পেনীয়রা এ-ভূখণ্ড জয় করে নেয়। মিগুয়েলা নামে যে-মহিলা আমাদের প্রদর্শক ছিলেন, তার কথাবার্তায় অ্যাজটেকদের পুরাকীর্তির প্রতি ভালোবাসা এবং সে-সম্পর্কে গর্ববোধ যেমন প্রকাশ পাচ্ছিল, তেমনি স্পেনীয় বিজয়ীদের অসভ্যতা ও নির্মমতা সম্পর্কেও লজ্জাবোধ ও বিতৃষ্ণা লুকোনো থাকছিল না।
আমাদের সভাস্থল মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্মেলন চলল ধীরগতিতে। কোনো অধিবেশনই সময়মতো আরম্ভ হয় না। কারো তেমন তাড়াহুড়ো নেই, দেরির জন্যে আফসোসও নেই। মেক্সিকো নগরীর সংবাদপত্রের সম্পাদক পরিষদ থেকে কয়েকজন এসে পরদিন তাঁদের সঙ্গে চা-পানের আমন্ত্রণ করে গেলেন। পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে যখন উদ্যোক্তাদের জিজ্ঞেস করলাম, আমরা। কখন রওনা হবো, তাঁরা অলসকণ্ঠে জানতে চাইলেন, আমি কি সেখানে যেতে খুবই আগ্রহী? বললাম, ওঁরা তো আপনাদের সামনেই কাল আমন্ত্রণ করে গেলেন এবং, মনে হলো, আপনারা সে-আমন্ত্রণ গ্রহণও করলেন, এখন না গেলে কেমন হবে? আপনারা কি জানিয়ে দিয়েছেন যে, আমরা যেতে অপারগ? তাঁরা বললেন, হ্যাঁ, ওরা ভদ্রতা করে নিমন্ত্রণ করলো, আমরা ভদ্রতা করে প্রত্যাখ্যান করলাম না। এখন যাওয়া না-যাওয়া আমাদের ওপরে। আমরা না গেলে ওরা বুঝতে পারবে যে, আমরা অপারগ। তবে তুমি যদি যেতে চাও, আমরা তার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আমি বললাম, ওঁদের কাউকে তো আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, ওঁদের আমন্ত্রণ আপনাদের সময়-সূচির অন্তর্ভুক্ত না হলে যাবোই বা কেন? তারা বললেন, তুমি দেখছি খুব সিরিয়াস মানুষ। এসব ব্যাপারে এমন হয়েই থাকে।
মেক্সিকোতে একটি ইনস্টিটিউট অফ ফাইন আর্টস আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশাল ভবনে তার অধিষ্ঠান। চমৎকার মিলনায়তন, সুন্দর গ্যালারি, পরিচালকের দপ্তরও মনোরম। সেখানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। পরিচালক পরদিন সন্ধ্যায় তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন। আমাদের বলা হলো, রাত আটটা নাগাদ আমরা যেন হোটেলের লবিতে অপেক্ষা করি। বাস এসে আমাদের যথাস্থানে নিয়ে যাবে। আটটা থেকে আমরা অপেক্ষমাণ, নটা বেজে গেল–বাসের দেখা নেই। কর্তৃপক্ষীয় একজনকে পাওয়া গেল–তাঁর কাছে জানতে চাইলাম আমরা কখন রওনা হবো? তিনি বেশ বিস্মিত হয়ে বললেন, বাস এলেই রওনা হবো। জিজ্ঞাসা করলাম, বাস কখন আসবে? তিনি আরো অবাক হয়ে বললেন, যে-কোনো সময়ে এসে যাবে। বাস এলো, আমরা রওনা হলাম। টের পেলাম, পরিচালক থাকেন শহরের উপকণ্ঠে। ফলে, রাত দশটার পরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছোলাম। বিলম্বের জন্যে কেউ ক্ষমা চাইলেন না, গৃহকর্তাও তার কারণ জানতে চাইলেন না। পানীয় হাতে আমরা তার প্রাসাদোপম অট্টালিকা, তার চিত্রসংগ্রহ, আসবাবপত্র, গৃহসজ্জা, এমনকী বাগান ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলাম এবং সুসজ্জিত নরনারীর সঙ্গে আলাপ করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু অতিথিদের অনেকেই ইংরেজি জানেন না বলে আলাপ খুব জমলো না। খিদে পেতে লাগলো, কিন্তু তখনো তরল থেকে শক্তে আসার সময় হয়নি। রাত এগারোটার পরে খাবার দেওয়া হলো। প্রচুর আয়োজন। কেউ যে বেশি খেলেন, তা নয়, কিন্তু ভোজনপর্ব চললো অনেকক্ষণ ধরে। রাত বারোটার পরে আমরা বাসে উঠলাম ফেরার জন্যে। যখন গেট দিয়ে বের হচ্ছি, তখন দেখি, দুই গাড়িভর্তি অতিথি সবে আসছেন নৈশভোজে যোগ দিতে।
মেক্সিকো নগরীতে অফিসের সময় কী, তা জানতে চেয়েও আমি প্রায় একই অবস্থায় পড়েছিলাম। উত্তর পেয়েছিলাম, কে কখন অফিসে যায়, তার ওপর নির্ভর করে সে কতক্ষণ সেখানে থাকবে। জানতে চাইলাম, লোকজন কারো। সঙ্গে দেখা করতে চাইলে কখন যায়? বললো, ফোনে সময় ঠিক করে যায়। একটা কোর-টাইম আছে বটে, কিন্তু সবাই দিনে আট ঘণ্টা অন্তত থাকে অফিসে, তার মধ্যে দর্শনার্থীরা হাজির হয়ে যায়।
হোটেল থেকে ছেলেমেয়েদের একটা পিকচার-পোস্টকার্ড পাঠালাম। পরদিন আরেকটা পাঠালাম ডাকঘর থেকে। মাশুল একরকম নয়। তৃতীয় পোস্টকার্ড ওই ডাকঘর থেকেই পাঠালাম–এবার মাশুল আরেকরকম। বুঝলাম, যার যেমন মনে হয়, সে তেমনি মাশুল সংগ্রহ করছে। নিশ্চয় কোথাও হার লেখা আছে, কিন্তু তা দেখার কষ্ট কেউ করছে না।
আনোয়ার আবদেল-মালেককে অজস্র ধন্যবাদ যে, সেমিনারে আমাকে কোনো দায়িত্বপালন করতে হয়নি। আমি শ্রোতা। বেশির ভাগ প্রবন্ধ স্প্যানিশে, দু-একটি পর্তুগিজে, এক-আধটি ফরাসিতে, কয়েকটি ইংরেজিতে। সব প্রবন্ধ তাৎক্ষণিক অনুবাদের ব্যবস্থা আছে, তবে অনুবাদের মান সব একরকম নয়। ফলে কিছু কিছু লেখার মর্মগ্রহণ বেশ কঠিন হয়েছিল আমার পক্ষে। তাছাড়া, ল্যাটিন আমেরিকা সম্পর্কে আমার পর্বতপ্রমাণ অজ্ঞতা অনেক কিছু বোঝার পক্ষে বাধাস্বরূপ হয়েছিল। তাই অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো সংগত নয়।
আয়োজকরা খুবই বন্ধুবৎসল। তারা আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যবিধানে ত্রুটি করেননি। নিজেদের মতো চলাফেরার সময়ও দিয়েছিলেন। তারা আরো একটি কাজ করেছিলেন। মেক্সিকো যাওয়ার আগেই আমাদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলেন, আমরা কে কে টাবাসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিশতবর্ষপূর্তি-অনুষ্ঠানে যেতে আগ্রহী। মেক্সিকো নগরীর সেমিনারশেষে সেখানে যেতে হবে। টাবাসকো বলতে এতদিন কেবল চিলি-সস জানতাম। সেখানে যে দু শ বছরের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তা কখনো শুনিনি। এই সুযোগ ছাড়তে চাইলাম না।
মেক্সিকোর কাজ শেষ, টাবাসকো যাবো। তার ঠিক আগে, সেমিনারে যোগদানকারী কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক সহযোগী অধ্যাপক একদিন আমার ঘরে ঢুকে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ল। মলিন মুখ, তাতে দুশ্চিন্তার বলিরেখা। জানতে চাই, কী হয়েছে। সে বলে, সর্বনাশ হয়েছে। বাড়ির জন্যে কিছু কেনার আগেই দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। আমি কাল ফিরে যাচ্ছি। দোকান পরশু খুলবে।
বললাম, আগেভাগে কাজটা করতে হতো। এখন আর কী করবে!
সে বললো, কিছু না নিয়ে আমি বাড়ি ঢুকতে পারবো না। তবে তুমি আমাকে বাঁচাতে পারো।
আমি অবাক হই। বলি, আমি?
হ্যাঁ। ওই সামনের দোকানে মেয়েদের যে-পোশাক আছে এদেশি, তার তিন সাইজের প্রত্যেকটি পাঁচটি করে কিনবে। একটা সুটকেসও কিনতে হবে। তাতে ওসব ভরে কুয়েত এয়ারলাইনসে লন্ডন থেকে আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে। এয়ারলাইনসকে পয়সা দিতে হবে না–সুটকেস ছাড়াবার সময়ে আমি ভাড়া দিয়ে দেবো। তুমি শুধু জিনিসপত্র কিনে সুটকেসে ফেলবে আর সুটকেস সঙ্গে করে নিয়ে যাবে লন্ডনে। আর সেখানে কুয়েত এয়ারলাইনসের অফিসে পৌঁছে দিয়ে তোমার কাজ শেষ। বলল, আমার এই উপকারটা করবে। নইলে বাড়িতে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে।
বললাম, করবো।
কুয়েতি এতক্ষণে উঠে বসলো। পোশকের দাম গুনে গুনে দিলো–সুটকেসের দামও ধরে দিলো একটা।
আমি কখনোই বাজার-সওদা করতে পারি না। তারপর এরকম পাইকারি হারে মেয়েদের পোশাক কেনা! ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বউ কটা তোমার? বলেছিল, বউ একটা, কিন্তু শালি আছে, বোন আছে। কোথাও গেলে পনেরো বিশটা কাপড়ের নিচে কিনতে পারি না।
নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো।
বোধহয় সেই রাতেই ঘুমের মধ্যে আমার মাল-পুল হলো। তীব্র যন্ত্রণায় বিছানা থেকে ছিটকে পড়লাম মেঝেতে। গড়াগড়ি দিলাম কার্পেটে। বেশ অনেক পরে ব্যথার উপশম হলো। তারপর প্রায়ই এই কষ্টে পড়েছি। তবে অত যন্ত্রণা কখনো পাইনি। হয়তো প্রথমবার বলে যন্ত্রণার বোধ তীব্র হয়েছিল।
কুয়েতির জিনিসপত্র কিনে সুটকেসে ভরে হোটেলে রেখে গেলাম। টাবাসকো থেকে ফিরে এখানে আসবো। তখন নিয়ে যাবো।
৩০.
বিমানবন্দরে এসে বসে আছি। এক অ্যাডভোকেট আমাদের পথপ্রদর্শক। তাকে যতই জিজ্ঞাসা করি, প্লেন কটায় ছাড়বে, সে খালি বলে, সবাই এসে পড়লেই রওনা হবো; এই এখনই ছাড়বে; প্লেনে ওঠার ডাক এলো বলে। তাকে পইপই করে বলে দিয়েছি কবে আমরা ফিরে আসতে চাই। সে মাথা নাড়ায় আর বলে, নো প্রবলেম। যাত্রার রহস্যটা বোঝা গেল। আমরা কোনো নিয়মিত ফ্লাইটে যাচ্ছি না। তাই বিমানযাত্রার কোনো নির্ধারিত সময় নেই। টাবাসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিশতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান উদ্ববাধন করবেন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট। তাঁর বিমানবহরের একটি দয়াপরবশ হয়ে তিনি বরাদ্দ করেছেন আমাদের যাত্রার জন্যে। শুধু আমরা কজন বিদেশি নই, মেক্সিকোর অনেক বিদ্বজ্জন, সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, বিশিষ্ট নাগরিক আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। সবাই এসে পৌঁছোলে বিমান ছাড়বে। যিনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, তিনি তত দেরিতে বিমানবন্দরে আসছেন। সবাই এসে গেলে আমরা যাত্রা করলাম।
টাবাসকোতে একটি পাঁচতারা হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। হোটেল কক্ষে পৌঁছোবার পরপরই টেলিফোন বাজল। ফোন তুলতেই একটি নারীকণ্ঠ চমৎকার ইংরেজিতে সঙ্গদানের প্রস্তাব করলো। দুপুরে খেতে বসে আমাদের জাপানি বন্ধু তাকেশি হায়াশি চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ফোন পেয়েছিলে কোনো?
সম্মতিসূচক উত্তর দিলাম।
সে কেবল বললো, হোটেলের রিসেপশনের সঙ্গে নিশ্চয় ওদের যোগ আছে। এটা ভাবতে পারিনি।
পরদিন টাবাসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে বেশ আগে যেতে হলো। আমরা যাওয়ার পরে একটা মহড়া হলো–সমাবর্তন-অনুষ্ঠানের মহড়া যেমন হয়। তারপর বসে থাকা। তারপর প্রেসিডেন্টের আগমন। অনুষ্ঠান খুব দীর্ঘ নয়। কিন্তু সুচারু। তারপর চা-পান। সেই রাতে টাবাসকো প্রদেশের গভর্নরের নৈশভোজ। সন্ধ্যা হতে না হতেই কয়েকজন লোক কিছু গাউন আর হাওয়াই শার্ট নিয়ে হোটেলে এসে হাজির। কী ব্যাপার! মাননীয় গভর্নর এসব। পোশাক পাঠিয়েছেন নিমন্ত্রিতদের জন্যে–তাঁরা এই পোশাকে সজ্জিত হয়ে গভর্নরের প্রাসাদে নৈশভোজে যাবেন, এই তার বিনীত অনুরোধ। তিন সাইজের গাউন, তিন সাইজের হাওয়াই শার্ট–যার যেটা লাগে। মেয়েদের পোশাক যেমন সব একরকম নকশা ও ছটকাটের, পুরুষদের পোশাকও তেমনি অভিন্ন। হাওয়াই শার্ট আনারসের খোসা থেকে তৈরি তন্তু দিয়ে বানানো–ফিলিপিনসে খুব দেখা যায়।
পুরো ব্যাপারটা বুঝতে, পোশাক বাছাই করতে, কারো কারো পক্ষে বাছাই করা পোশক বদল করতে, সময় নিলো। সরকারি গাড়ির বহর এসেছে–অতিথিদের যেন ঠাসাটাসি করে যেতে না নয়। কিন্তু কর্মকর্তাদের খবরদারি আর একসঙ্গে যাওয়ার চেষ্টায় আমাদের প্রাণান্তকর অবস্থা। সরকারি গাড়িতে যাচ্ছি বলে নিরাপত্তা বাহিনীর উৎপাত তেমন নেই। তবে মেক্সিকোতে এরা নিরাপত্তা সম্পর্কে বেশ সচেতন। বলে, যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে মেক্সিকো থেকে মাদকদ্রব্য চালান হয়, বিনিময়ে আসে আগ্নেয়াস্ত্র। সারা দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে আর কিছুর দরকার নেই।
গভর্নরের প্রাসাদে আনুষ্ঠানিক ভাব-বিনিময়, উস্কৃষ্ট পানভোজন, চমৎকার সংগীত। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিশতবর্ষ আর কোথাও এমন জাতীয়ভাবে পালিত হয় কি না কে জানে!
টাবাসকো ঐতিহাসিকভাবে যেমন প্রাচীন, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। নবীন প্রবীণের চমৎকার সমাবেশ। আমরা আজ নগরীর উদ্যানে যাই তো কাল পুরাকীর্তি দেখতে যাই। যেদিন মেক্সিকো নগরীতে ফেরার কথা, সেদিনও বেড়াবার কর্মসূচি। হায়াশি যাবে না। বলে, বেড়াতে গেলে প্লেন ধরতে পারবে না। এদের যা সময়জ্ঞান!
আমাদের অ্যাডভোকেট বলে, চলো চলো। নো প্রবলেম।
আমি যেতে সাব্যস্ত করি। দুই বাস ভর্তি হয়ে যাই। প্রতি বাসে সাত-আটজন তরুণ-তরুণী দোভাষী ও পথপ্রদর্শক। তারা খুবই মিশুক, বন্ধুসুলভ।
ফিরতি পথে দোভাষীদের প্রস্তাবে ছবি তোলার ধুম পড়ে গেল। সদলে, দু তিনজনে, কোনো একজনের সঙ্গে। যে-অল্পবয়সী মেয়েটি আমার দোভাষী ছিল, সে এগিয়ে এসে হঠাৎ আমার গালে গাল লাগিয়ে ছবি তোলার জন্যে দাঁড়িয়ে গেল। এক তরুণ জিজ্ঞেসা করলো, ছবির কপি চাই নাকি আমার। বললাম, চাই তো বটে, কিন্তু আমি তো আজ রাতেই টাবাসকো ছেড়ে যাচ্ছি। সে বললো, তুমি খরচ দিয়ে গেলে তোমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে পারি। দিলাম কিছু। আরেকজন বললো, ছবি প্রিন্ট করার জন্য কিছু দেবে না ওকে? দিলাম। অন্য কেউ কেউও, দেখি, দিচ্ছেন। ওসব ছবি আমি কোনোকালে পাইনি। মনে হয় না, আর-কেউ কখনো পেয়েছেন।
ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়। হোটেলে খোঁজ করে জানতে পাই, হায়াশি বিমানবন্দরে চলে গেছে। মালপত্র গোছানোই ছিল। সেসব নিয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠে বিমানবন্দরে পৌঁছানো গেল।
দেখি, হায়াশি ফুঁসছে। অ্যাডভোকেটকে লক্ষ্য করে বলছে, ইউ আর স্টুপিড।
কী হয়েছে? অ্যাডভোকেট এত বলা সত্ত্বেও সে আমাদের ফেরার আসন সংরক্ষণ করতে ভুলে গেছে। কোনো ফ্লাইটেই এখন জায়গা নেই। আমরা সাতজন আটকে গেছি।
অ্যাডভোকেটের বিকার নেই। বলে, ‘নো প্রবলেম।
একটু পরে বাসে করে হোটেলে ফিরে আসি। রুম ছেড়ে দিয়ে গেছি। নতুন করে রুমও দিচ্ছে না। হোটেলের লোক আমাদের লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে বলছে আর ইচ্ছেমতো খেয়ে নিতে বলছে। অ্যাডভোকেট একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে–কাকে কে জানে!
অনেকক্ষণ পরে সে বললো, চলো।
কোথায়?
এয়ারপোর্ট, এয়ারপোর্ট।
বিমানবন্দরে এলাম। আমাদের সাতজনের জন্যে একটা একজিকিউটিভ প্লেন চার্টার করা হয়েছে। মেক্সিকো সিটি থেকে সেটা এসে পৌঁছোলেই আমরা ফিরতি যাত্রা করতে পারব। অ্যাডভোকেট বলছে, ‘নো প্রবলেম।
হায়াশির রাগ তাতেও কমছে না।
জীবনে ওই একবারই একজিকিউটিভ প্লেন চড়লাম। আসনগুলো চমৎকার। গোল টেবিল জুড়ে কনফারেন্সের জায়গা। সেখানে বসে খাওয়া-দাওয়াও চলে। দুজন মাত্র ক্রু। আমাদের জন্যে তাই যথেষ্ট। তারা সর্বক্ষণ খাওয়াতে চায়।
গভীর রাতে মেক্সিকো নগরীতে ফেরা। সেখান থেকে হোটেলে। রাতে আর ঘুমোবার অবকাশ হলো না। ভালো করে সকাল হওয়ার আগেই আবার বিমানবন্দরে রওনা হয়ে গেলাম। লন্ডনের প্লেন ধরতে হবে।
এবারে কুয়েতির সুটকেস আমার সঙ্গে।
৩১.
মেক্সিকো থেকে ফিরে আমার প্রথম কাজ হলো কুয়েতি অধ্যাপকের সুটকেস। নিয়ে কুয়েত এয়ারলাইনসে যাওয়া। সেখানকার লোকজন জানিয়ে দিলো, সুটকেস পাঠাতে হলে পুরো ভাড়া চুকিয়ে পাঠাতে হবে-মাশুল দিয়ে মাল ছাড়িয়ে নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা তাদের নেই। অগত্যা পঞ্চাশ পাউন্ড পকেট থেকে দিয়ে সুটকেস পাঠালাম। পথে-পাওয়া বন্ধুকে সেটা জানিয়ে চিঠিও দিলাম। আশায় আশায় থাকলাম, ধন্যবাদসহকারে একটা ব্যাংক ড্রাফট আসবে। ড্রাফট দূরের কথা–প্রাপ্তিস্বীকারই এলো না।
তবে লন্ডনে ফিরে এটাই যে প্রথম কাজ ছিল, তা বলা ঠিক হলো না। প্রথম কাজ ছিল নতুন ঠিকানা খোঁজা। হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করেছিলাম ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির প্রতিভা বিশ্বাসকে। তিনি একসময়ে বলেছিলেন যে, প্রয়োজনে আমার থাকবার ব্যবস্থা করে দেবেন। এখন আমার। ফোন পেয়ে বললেন, খোঁজ নিয়ে জানাবেন। মিনিট ১৫ পরে আবার ফোন করলাম। বললেন, মর্ডেনের দিকে একটা জায়গা আছে। তাঁর কাছ থেকে নম্বর নিয়ে গৃহকত্রী ছায়া বসাককে ফোন করলাম। তিনি জানালেন, একটি ঘর খালি আছে এবং সেটা আমাকে দিতে পারবেন। আমি কবে থেকে নিতে ইচ্ছুক–তাঁর এই প্রশ্নের জবাবে যখন বললাম, এখনই আসতে চাই, তিনি একটু অবাক হলেন, তবে আপত্তি করলেন না। বললেন, মর্ডেন আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে তাকে যেন আবার ফোন করি। এই মর্ডেনের দু স্টেশন উত্তরে কলিয়ার্স উড–১৯৭৪-৭৫ সালে সেটিই ছিল আমার বাসস্থানের নিকটতম টিউব স্টেশন। মর্ডেন থেকে গৃহকত্রীকে ফোন করে দিকনির্দেশনা চাইলাম–সেটাও বাহুল্য, কেননা স্থানীয় মানচিত্র তো আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনেই থাকে। ছায়া বিশ্বাস বললেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি। আমার আপত্তিতে কাজ হলো না। তিনি গাড়ি চালিয়ে এলেন এবং মালপত্রসমেত আমাকে বাড়ি নিয়ে গেলেন।
বাড়িটা স্যান্ডবোর্ন অ্যাভিনিউতে–স্টেশন থেকে হাঁটা-পথ। সুন্দর বাড়ি, গৃহকত্রীর যত্নে তা ছিমছাম। ভদ্রমহিলার স্বামী অতুল বিশ্বাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র ছিলেন, পরে পেশাগত পড়াশোনা করেছেন লন্ডনে, এখন লিবিয়াতে কর্মরত। পরিবারের সবাই–মানে স্বামীস্ত্রী ও পুত্রকন্যা–সেখানেই ছিলেন, ছায়া বিশ্বাস সম্প্রতি সন্তানদের নিয়ে চলে। এসেছেন লন্ডনে। তিনি ব্রিটিশ সরকারের চাকরি করেন, ওভালের দিকে তার অফিস। জলি হাইস্কুলে পড়ছে, ছেলেটিও সবে স্কুলে যেতে শুরু করেছে। বাড়ির একতলায় ড্রয়িং রুম, ডাইনিং রুম–সেটা লিভিং রুমও বটে–এবং রান্নাঘর। দোতলায় তিনটি বেডরুম ও বাথরুম। দুটি বেডরুমে ওঁরা তিনজন থাকেন, তৃতীয়টি আমি অধিকার করলাম। পরে জানা গিয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবাদে অতুল বিশ্বাস আমাকে চেনেন এবং লিবিয়ায় তাঁদের অন্তরঙ্গ এক পরিবার ঢাকায় আমার পূর্বপরিচিত।
ছায়া বিশ্বাস অতিশয় সদাশয় মানুষ। তার বাড়িতে যাওয়ার পরে সপ্তাহান্তে আমি একটা ব্যাগে ময়লা কাপড় নিয়ে লড্রেটে ধুতে যাচ্ছিলাম। তিনি বাধা দিলেন। বললেন, বাড়িতে তো ওয়াশিং মেশিন আছে–আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’ আমার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে রেখে দিলেন। এরপর থেকে আমাকে আর নিজ হাতে কিছু করতে হতো না–শুধু ময়লা কাপড়ের ব্যাগ রেখে গেলেই হতো। তিনি ধুইয়ে, বাড়ির পেছনের জমিতে টাঙানো দড়িতে শুকিয়ে, ভাজ করে, আমার বিছানার ওপরে রেখে দিতেন।
একবার বুলুর বাড়িতে কয়েকদিন ছিলাম। ছায়া বিশ্বাস সে-কদিনের ভাড়া নিতে অস্বীকার করেছিলেন। আমি বলেছিলাম, আমি না থাকলে কী হবে, তাঁর ঘর তো দখল করে রেখেছি। তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন, তিনি পেশাদার বাড়িওয়ালি নন।
আমি চেষ্টা করতাম সকালে ওঁদের পরে বাথরুম ব্যবহার করতে–যাতে বাচ্চাদের স্কুলে যেতে কিংবা মহিলার অফিসে যেতে দেরি না হয়ে যায়। সকালে নাশতা খেয়ে বেরিয়ে পড়তাম, রাতে খেয়েদেয়ে ফিরতাম। কোনো কোনো বেলা যে তাদের সঙ্গে খাইনি, তা নয়, তবে এটিই ছিল আমার সাধারণ নিয়ম। এঁরা জেগে থাকলে একসঙ্গে টেলিভিশন দেখতাম কিংবা আমি খাবার টেবিলে লিখতে বসে যেতাম, ওঁরা বা উনি টেলিভিশন দেখতেন কিংবা আমাকে কফি খাওয়াতেন। জলি খুব সরল ও লক্ষ্মী মেয়ে–নানাভাবে সাহায্য করতে চেষ্টা করতো। তার ভাইটিও মিশুক প্রকৃতির–তার দাবি ছিল আমার কলমের ওপরে। আমি লিখতে বসলেই সে জিজ্ঞেস করতো, ‘হোয়্যার ইজ মাই ব্লু পেন? কলমটা অবশ্য নীল ছিল না, নীল ছিল তার রিফিলের কালি।
রিফিলের প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ল। বুশ হাউজের নিচতলা থেকে কলমের রিফিল কিনেছিলাম কয়েকটা। ঘরে ফিরে টের পেলাম, সেল্সগার্ল ভুলে দুটো রিফিল বেশি দিয়েছে। পরদিন যখন তাকে সেগুলো ফেরত দিতে গেলাম, সে সবিস্ময়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ইউ আর ভেরি অনেস্ট!’ শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। মনে হয়েছিল, আমি কৃষ্ণাঙ্গ বলেই সে সততার কথাটি তুললো, শ্বেতাঙ্গ হলে হয়তো শুধু ধন্যবাদ দিতো বা নিজের অসতর্কতার জন্যে লজ্জা প্রকাশ করতো। আবার এমনো হতে পারে যে, সবটাই পরিবেশের কারণে আমার স্পর্শকাতরতার ফল।
৩২.
বুলুর মা উমা দেবা এসেছেন মেয়ের কাছে–পারলে এখানেই থেকে যাবেন। বুলুর কাছে যাঁরা আসেন, তাঁরা সবাই প্রায় তার আত্মীয় বা পরিচিত। আমার মতো দু-চারজন অচেনা যারা আসে, তাদেরকেও তিনি আপন করে নেন। সর্বসংস্কারমুক্ত মানুষ নিজের কথা কম বলেন, অকারণ কৌতূহল প্রকাশ করেন না। যত বলেন, তার চেয়ে শোনেন বেশি।
বুলুর সঙ্গে মেলামেশার সূত্রটা আবার কুড়িয়ে নেওয়া গেল। মাঝে মাঝে মাসিমা এবং মানসী ও সরোজ আমাদের অভিযানে যোগ দেন। একবার সবাই মিলে বাইরে খেতে যাব। মানসীরা এসে গেছে। বুলু কার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করছে–কথা আর ফুরোয় না। শেষ পর্যন্ত যখন সে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এলো, আমি বললাম, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল না জন্মালে তোমার খুব অসুবিধে হতো। সবাই একচোট হেসে নিলো।
একসময়ে সমুদ্রতীরবর্তী বোর্নমাউথে বেড়াতে গেলাম। এক গাড়িতে মাসিমা, বুলু ও আমি। অন্য গাড়িতে সরোজ ও মানসী। একটা ব্রেড-অ্যান্ড ব্রেকফাস্টে জায়গা পাওয়া গেল। পুরুষেরা এক ঘরে, মেয়েরা আরেক ঘরে–কড়া বিভাজন। এক জায়গায় বুলু গাড়ি পার্ক করবে–পার্কিংয়ের জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ করে এক গাড়ি সজোরে এসে আমাকে চাপা দেয় আর কী! আমি পালালাম, পার্কিংটা ওই গাড়িওয়ালাদের দখলে চলে গেলো। বুলু প্রতিবাদ করলো এবং সেই গাড়ির চালক ও আরোহী দুই শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে তার রীতিমতো ঝগড়া লেগে গেলো। বুলুর সমর্থনে মানসীও কিছু বললো–কেবল সরোজ ও আমি দূরে দূরে রইলাম। কাজটা একদম পুরুষোচিত হলো না। এ-নিয়ে বুলুর তিরস্কার শুনতে হলো।
বোর্নমাউথ জায়গাটা খুব সুন্দর। সমুদ্রের ধারের মাটি এখানে নীলাভ। সেই মাটি দিয়ে বাসনপত্র থেকে শুরু করে ঘর সাজাবার জিনিস তৈরি হয়। তার কিছু নমুনাও সংগ্রহ করা গেল। রাতের বোর্নমাউথ আলোকমালাসজ্জিত–আরো আকর্ষণীয়। দিনে জায়গাটা লোকে লোকারণ্য। আমরা কেউই পানিতে নামছি না, সাঁতারের পোশাকপরা নরনারীর মাঝখানে আপাদমস্তক সজ্জিত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি-সেটা বেশ বেমানান। তবে এখানে কে কাকে লক্ষ করে! সবাই প্রকৃতির সৌন্দর্যভোগ করতে এবং আমোদফুর্তি করতে ব্যস্ত। দু রাত সেখানে। কাটিয়ে ফিরতি যাত্রা।
ফেরার পথে স্টোনহেনজ দেখলাম। পাঁচ হাজার বছর আগে এখানে যা ছিল, তার ধ্বংসাবশেষ। এতকাল পরেও যা টিকে আছে তা দেখার এক আশ্চর্য অনুভূতি! মানুষের কী অপরূপ কল্পনা, কী অসাধ্য পরিশ্রম, কী অপরাজিত সংকল্প কাজ করেছে এর পেছনে। ওই বিশাল বিশাল পাথর কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে, কেমন করে টেনে এনেছে, কেমন করে সাজিয়েছে, কত সময়। লেগেছে–কে জানে!
লন্ডনে প্রবেশের পূর্বমুহূর্তে সান্ধ্য দৈনিকের খবরে দেখা গেল–আততায়ীর বোমার আঘাতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন নিহত হয়েছেন। রিপাবলিকান আর্মির কাজ। বুলুর বাড়িতে ফিরে টেলিভিশন ঘিরে বসলাম। কত জানা-অজানা ইতিহাস তার পর্দায় উন্মোচিত হলো।
মাউন্টব্যাটেন সম্পর্কে আমার মনে ক্ষোভ ছিল। ভারতবর্ষে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্যে ব্রিটিশ সরকার সময় বেঁধে দিয়েছিলেন ১৯৪৮ সালের জুন পর্যন্ত। মাউন্টব্যাটেন তাড়াহুড়ো করে ১৯৪৭ সালেই সে-কাজ সম্পন্ন করেন। ফলে দ্রুতগতিতে পাঞ্জাব ও বঙ্গ বিভাগ করতে গিয়ে মানুষের দুর্দশা কিছু বেড়েছিল। আরেকটু সময় নিয়ে ক্ষমতা-হস্তান্তর করলে হয়তো অত রক্তপাত হতো না। আর এ দ্রুত ব্যবস্থা তিনি নিয়েছিলেন ভারতবাসীর কথা ভেবে নয়, নিজের পরবর্তী দায়িত্বগ্রহণের সুবিধের কথা চিন্তা করে–এটাই আমার ধারণা।
বছর দুই আগে আমার বন্ধু লেওনার্ড গর্ডন মাউন্টব্যাটেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। মাউন্টব্যাটেন তখন যুক্তরাজ্যের বাইরে কোথাও যাচ্ছিলেন–লেনিকে বলেছিলেন, তার বাড়ি থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত গাড়িতে তার সঙ্গে সে কথা বলতে পারে। সেই সাক্ষাৎকারের বিবরণ শুনে মনে হয়েছিল, ভারতে থাকাকালে কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা সম্পর্কে পূর্বধারণাজাত বিরাগ তাঁর মধ্যে কাজ করেছিল। এতকিছু সত্ত্বেও মাউন্টব্যাটেন নিহত হওয়ায় বেদনা অনুভব করেছি।
বুলু এরপর মাসিমাকে নিয়ে বেড়াতে গেলো মার্কিন মুলুকে। ফ্ল্যাট বন্ধ করে মানসীর কাছে চাবির গোছা দিয়ে চলে গেলো। কী এক কারণে সেখান থেকে ফোন করে বললো, আমি যেন তার ফ্ল্যাটে কয়েকদিন গিয়ে থাকি। মানসীর কাছ থেকে চাবি নিয়ে সেখানে সাত-আট দিন থাকলাম।
বুলুর কাছে হরদম ফোন আসে–অপরপ্রান্ত জানতে চায়, আমি কে। পরিচয় দিতে দিতে হয়রান হয়ে পড়ি। এক সকালে এমনি এক ফোন এসেছে। আমার পরিচয় পেয়ে ওপাশের নারীকণ্ঠ বললো, আনিস মামা, আমি মঞ্জু।’ ফাহমিদা মজিদ ওরফে ফাহমিদা হাফিজ ওরফে মঞ্জু। তার বাড়িতে কী একটা অনুষ্ঠানে বুলুকে নিমন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। বুলু নেই, কিন্তু আমাকে যেতে হবে। বিশেষ আপত্তি করিনি। ডা. সৈয়দ আনোয়ারুল হাফিজ আমার দীর্ঘকালের পরিচিত। আর মঞ্জু তো শিশুকাল থেকে আমার ভাগ্নি। গেলাম তাদের বাড়ি এবং আপ্যায়িত হয়ে ফিরলাম।
বুলু ফেরার আগে মানসী তার ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে রাখলো। আমরা তিনজনে মিলে তাঁদের দুজনকে আনতে গেলাম বিমানবন্দরে। দেখি, বিমর্ষ মুখে বের হচ্ছেন মা ও মেয়ে। কী ব্যাপার? লাগেজ আসেনি। পরে বহুকষ্টে তা উদ্ধার হয়েছিল অথবা সবটুকু উদ্ধার হয়নি।
মাঝখানে আমার শরীরটা খারাপ করেছিল। বুলু আমাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিলো। হাসপাতালে যখন বুলু আমার থেকে একটু দূরে, তখন কৌতূহলী নার্স আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ইজ শি ইওর ওয়াইফ? বললাম, ‘আই উইশ শি ওয়্যার, বাট শি হ্যাঁপেনস টু বি ওনলি মাই জিপি। মেয়েটি লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেলো। এ-কথায় পুরো সত্য বলা হয়নি, তবে প্রশ্নের উত্তর হিসেবে তা খারাপ হয়নি।
মানুষের জন্যে বুলুর দরদ ছিল অসাধারণ। ভারত থেকে একটি অবাঙালি ছেলে এসেছিল লন্ডনে চিকিৎসা করতে। সামান্য পরিচয়ের সূত্র ধরে সে। যোগাযোগ করেছিল বুলুর সঙ্গে। বুলু তার জন্যে অনেক করেছিল, এমনকী, যে হাসপাতালে সে ছিল, তার ডাক্তার-নার্সদের সঙ্গে তার ঝগড়া পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটি হাসপাতালেই মারা যায়–বুলু সে-মৃত্যু একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। তার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, হাসপাতালের বিরুদ্ধে সে মামলা করার কথাও ভেবেছিল–আমরা কয়েকজন মিলে তাকে নিরস্ত করি। আরেকবার কেরালা থেকে এক ডাক্তার এসেছিলেন কোনো এক সম্মেলনে। সম্মেলনের পরে বুলু তাঁকে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিল, লন্ডন ঘুরিয়ে দেখেছিল, আমরা সকলে মিলে নাটক দেখতে এবং বাইরে খেতে গিয়েছিলাম। সেই রাতে তাদেরকে বিবিসি-র বাংলা বিভাগও দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলাম।
৩৩.
বিবিসি-র বাংলা অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নিই। আগে থেকে কর্মসূচি স্থির হয়ে থাকে। আবার, মাঝে মাঝে হঠাৎ করে ডাকও পড়ে। একবার ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে বসে কাজ করছি–সিরাজুর রহমানের ফোন এলো, তখনই যেতে হবে। গিয়ে জানলাম, ভুট্টোর ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়ে গেছে, নির্ধারিত বিষয় কিছু বাদ দিয়ে এই প্রসঙ্গে বিশদ আলোচনা হবে। সেইসব বিষয়বস্তু অনুবাদ ও পাঠ করতে হবে।
সেদিন বিকেলে বিবিসি ক্লাবে ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে দেখি। তিনি বেশ উদবিগ্ন ছিলেন। সামরিক শাসকদের উন্মত্ত আচরণের মধ্যে দেশে ফিরে যাবেন কি না ভাবছিলেন। ঢাকার খবর জানতে চাইলেন আমার কাছে, তারপর নিজেই বললেন, কী আর জিজ্ঞেস করবো, আমি যাদের জানতাম, তাদের অনেকেই তো আর নেই।
ভুট্টোর প্রতি আমার বিরাগের সীমা ছিল না, কিন্তু সামরিক শাসকদের হাতে, এমন প্রহসনমূলক বিচারে, তাঁর মৃত্যু গ্রহণযোগ্য ছিল না।
একদিন জন ক্ল্যাপহাম আমাকে ডেকে নিলেন তাঁর অফিসে। জানতে চাইলেন, আমি ওসি (অকেশনাল কনট্রিউবিটার) হতে রাজি কি না অর্থাৎ তাদের আরেকটু বেশি সময় দিতে পারব কি না। তাহলে আমাকে দরকারমতো সংবাদ অনুবাদ করে পাঠ করতে হবে এবং রাতের ট্রানসমিশনের–অর্থাৎ যে-অনুষ্ঠান আমাদের দেশে ভোরবেলায় শোনা যায়–তার দায়িত্ব নিতে হবে। একটু সময় চাইলাম, তারপর সম্মত হলাম। এতে কাজ একটু বাড়লো।
একদিন দুপুরে সংবাদের দায়িত্ব আমার ছিল–তা পালন করতে পারিনি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহম্মদ খলিলুর রহমানের পুত্র জিয়াউর রহমান লন্ডন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিল। বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম তার জন্যে–কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কেউ কারো দেখা পাইনি। সে চলে যাবে পরদিনই। রাতে যখন সে ফোন করলো, তখন পরদিন তার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় স্থির করলাম। সে আসতে দেরি করলো–লন্ডনে প্রথম এসেছে, দেরির জন্যে দোষ দিতে পারি না। কিন্তু তাকে খাইয়ে বিদায় দিতে গিয়ে আমার আর সংবাদ অনুবাদ করার সময় রইলো না। অন্য কাউকে তা করতে পাঠানো হলো। পরে আমি গিয়ে সেই সংবাদপাঠকের মূল দায়িত্ব পালন করলাম।
রাতের ট্রানসমিশনের জন্যে বেশ আগে যেতে হতো বার্তা বিভাগে। সেখানে বসে অনুবাদ করতে হতো। তারপর বাংলা বিভাগে এসে বাকি অনুষ্ঠানের রেকর্ড নিয়ে যেতে হতো স্টুডিওতে। সংবাদপাঠের পর সেটা বাজানো হতো। অনুষ্ঠানশেষে বিবিসি-র ভাড়া করা ট্যাকসিতে ফিরতাম মধ্যরাতের অনেক পরে।
এক রাতে সংবাদ অনুবাদ করে স্টুডিওতে চলে গেছি। তার মধ্যে বার্তা সম্পাদক এলেন ইংরেজিতে লেখা এক টুকরো খবর নিয়ে। ওটা প্রচার করতে হবে। অনুবাদ করার সময় নেই। ইংরেজি কাগজটা সামনে রেখে মুখে মুখে অনুবাদ করে গেলাম। ভুল করিনি। তবে লিখিত অনুবাদে একবার ত্রুটি হয়েছিল আমার। কিং অফ জর্ডানকে জর্ডানের বাদশাহ না বলে রাজা বলেছিলাম। সিরাজুর রহমান এই ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন পরদিন।
আরেক সন্ধ্যায় বেশ একটা স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমি স্টুডিওতে গেছি, স্টুডিও কমিশনার যে-তরুণী, সেও এসেছে। মাইক্রোফোনে কণ্ঠস্বর যাচাই করার জন্যে দু-চার কথা বলেছি, মেয়েটি কাঁচের ওপাশ থেকে বলে উঠলো, ‘হোয়াট এ লাভলি ভয়েস!’ আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আমার কণ্ঠস্বর যদি ভালোও হয়ে থাকে, তার জন্যে নিজে কোনো কৃতিত্ব দাবি করতে পারি না।
অনুষ্ঠানের শেষে তার ঘরে প্রবেশ করলাম অনুষ্ঠানের বাকি অংশের ধারণকৃত রেকর্ড ফেরত নিতে। মেয়েটি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, অনুষ্ঠানশেষে আমি কোথায় যাবো? বললাম, বাড়ি। সে জানতে চাইলো, কোথায়। এলাকার নাম বললাম। তারপর আমি আর কিছু বললাম না বলে সে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
৩৪.
এবারে আমি যখন লন্ডনে এলাম, তখন সেখানে বাংলাদেশের হাই কমিশনার এ আর এস দোহা-মিনু দোহা নামে অধিকতর পরিচিত। তাঁকে অনেকেই পছন্দ করতেন না এবং তা হয়তো অকারণে নয়। তবে সেবারে হাই কমিশনে অনুষ্ঠেয় আমাদের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানটিতে দেশের প্রবাসী শিশুদের গুরুত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি একটি ভালো কাজ করেছিলেন। তারাই সারাদিন গানবাজনা-আবৃত্তি-খেলাধুলা করবে। সন্ধ্যায় সংবর্ধনা-অনুষ্ঠানটি হবে বড়োদের জন্যে। একাধিক বয়োবর্গের শিশু-কিশোরদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছিল। হাই কমিশনের প্রেস মিনিস্টার সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশিম বিচারকমণ্ডলী গঠন করেছিলেন, এর তিন সদস্য শিল্পী। কামরুল হাসান, তিনি নিজে এবং আমি। কামরুল হাসান তখন লন্ডনে এসেছিলেন বেড়াতেওবায়েদ জায়গীরদারের বাড়িতে থেকে ছবি আঁকছিলেন প্রচুর, একটা চিত্রপ্রদর্শনীর চিন্তাও ছিল তাঁর মাথায়। যথাস্থানে উপস্থিত হয়ে। জানতে পারলাম, প্রতিযোগিতার বিষয়ের মধ্যে আছে কবিতা-আবৃত্তি, সংগীত এবং তেলাওয়াত-ই-কুরআন। আমি প্রমাদ গনলাম। কুরআন-তেলাওয়াতের বিচারক হওয়ার অধিকার কামরুল হাসান ও নাজমুদ্দীন হাশিমের আছে, কিন্তু আমার! শেষ পর্যন্ত অবশ্য কাজটা এড়ানো গেল না–কেবল শ্রুতিমাধুর্যের ভিত্তিতে নম্বর দিলাম। কেউ যে বিচার কিংবা বিচারক সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেনি, তাই ভাগ্যি। বিচার যেমন হোক, বাচ্চাদের উৎসাহ দেখে খুব ভালো লেগেছিল। অনেকের জন্যেই বাংলা আর প্রথম ভাষা নেই, তবু যথাসাধ্য চেষ্টা করছে বাংলায় কবিতা পড়তে, গান গাইতে! দুপুরে খাওয়ার সময়ে ছোটোদেরকেই আগে খেতে দেওয়া হয়েছিল–খুব সুশৃঙ্খলভাবে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছিল তারা। অভিভাবকেরা ছিলেন পেছনে, তবে বাচ্চাদের মতো। সুশৃঙ্খল ছিলেন কি না সন্দেহ।
সন্ধ্যায় সংবর্ধনা। বহু অতিথি এসেছিলেন। ডেপুটি হাই কমিশনার মহসীন খুঁজে পেতে নিয়ে এসেছিলেন প্রফেসর জে এস টার্নারকে। তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব। থেকে অবসর নিয়েছিলেন প্রায় সিকি শতাব্দী আগে। তাঁকে বসানো হয়েছিল একটা চেয়ারে–কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিলেন, অবশ্য সবাই তাঁকে নিবৃত্ত করছিল। তাঁর কাছে গিয়ে পরিচয় দিলাম। আমি তাঁর জেনারেল ইংলিশ ক্লাসের সাধারণ ছাত্র–আমাকে মনে রাখার কোনো হেতু নেই। তিনি অবশ্য চিনতে না পারার কারণ হিসেবে নিজের স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কথা বললেন, আমি তার ছাত্র শুনেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। বললেন, কতকাল আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে এসেছি, তোমরা এখনো আমাকে মনে রেখেছ, এত সম্মান জানাচ্ছ–এ আমার আশার অতীত। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছতে থাকলেন।
পরে একদিন দুপুরবেলায় এক রেস্টুরেন্টে কামরুল হাসান ও আমাকে খাওয়ালেন নাজমুদ্দীন হাশিম। তাঁর অভিজ্ঞতা বিস্তর, কথা বলার ভঙ্গি আকর্ষণীয়। যে-বিষয়েই বলেন, শুনতে ভালো লাগে।
কামরুল হাসান শেষ পর্যন্ত চিত্রপ্রদর্শনী করতে পেরেছিলেন কমনওয়েলথ ইনসটিটিউটে। লোকসমাগম ভালো হয়েছিল, ছবির বিক্রিও মন্দ হয়নি। তিনি খুশি হয়েছিলেন। প্রদর্শনীর শেষে প্যারিস ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন।
সেবারকার নববর্ষ-উদযাপনের কথাও মনে পড়ে। ফিসবেরি পার্ক এলাকায় তার আয়োজন করেছিলেন জেবউননেসা বখশ। বয়সে আমার চেয়ে। বেশ খানিকটা বড়ো, কিন্তু এম এ ক্লাসে আমার ছাত্রী ছিলেন। তিনি তখন লন্ডনে এক স্কুলে শিক্ষকতা করেন, সেখানকার স্কুলগুলিতে বাংলা শিক্ষাদানের ব্যাপক ব্যবস্থা যাতে হয় তার চেষ্টা করেন, আর লেখালিখি করেন। ওই অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, কবিতা পড়তে অনুরোধ করায় আমি কিছুটা সংক্ষেপ করে রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষশেষ’ পড়েছিলাম। তার খানিক পরে স্থানীয় পার্লামেন্ট-সদস্য এলেন। জেবউননেসা বখশ পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেলে তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি ঠিক শুনেছি তো-উনি বললেন, তুমি তার শিক্ষক! আমি বললাম, একেই বলে বরাত। তিনি বললেন, শুনলাম, তুমি এখানে কবিতার ব্যাখ্যা করেছ। বুঝলাম, তার কাছে কবিতার যথার্থ আবৃত্তি মানে তার এক ধরনের ব্যাখ্যা-ইনটারপ্রিটেশন। আমার কবিতাপাঠ আবৃত্তির পর্যায়েও পড়ে না, একথা তাঁকে বোঝাতে যাওয়া বৃথা। বললাম, একরকম।
সেবারে এবং তার পরেও জেবউননেসা বখশের বাড়িতে আপ্যায়িত হয়েছি। বখশ সাহেব অতি ভদ্র, দয়ালু ও বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ। সব বিষয়ে স্ত্রীকে সাহায্য করেন। তিনিও আমাকে সার’ বলে সম্বোধন করছিলেন–বাধা দিয়ে লাভ হয়নি।
৩৫.
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির পূর্বতন ডাইরেক্টর জোন ল্যানকাস্টার লোকমুখে জেনেছেন, আমি আবার লন্ডনে এসেছি লাইব্রেরির কাজে। তিনি নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানালেন আমাকে। সেইসঙ্গে লাইব্রেরির বর্তমান ডাইরেক্টর ব্লুমফিল্ড, দুই ডেপুটি ডাইরেক্টর ডেসমন্ড ও মার্টিন এবং মাইকেল ও’কিফকেও নিমন্ত্রণ করেছেন। ডেপুটি ডাইরেক্টরদের একজন আমাকে বললেন, তিনি যেতে উৎসাহবোধ করছেন না, কেননা জোনের সাহচর্য সন্ধ্যা কাটানোর সেরা উপায় নয়। আমি শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম। ভদ্রমহিলাকে আমার খুবই চমৎকার মনে হতো, অথচ তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের একজনের কাছে তাঁর আচরণ ও কথাবার্তা এমন দুঃসহ মনে হয়! মানুষ যে কত দুয়ে, এ থেকে তা বোঝা যায়।
নিমন্ত্রণরক্ষা করতে অবশ্য সবাই গেলেন। একদিন লাইব্রেরিতে কিছু বেশি। সময় কাটিয়ে দুই গাড়ি করে আমরা পাঁচজন একসঙ্গে গেলাম। জোন ল্যানকাস্টার লন্ডনের এক প্রান্তে একা থাকেন। সুন্দর, গোছালো বাড়ি। তিনি নিজে রান্না করেছেন। অতিথিদের যত্নের ত্রুটি করলেন না। আমি খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ করতে থাকলাম, তার কোনো আচরণ পীড়াদায়ক হতে পারে কি না। সেইসঙ্গে যিনি কেবল ভদ্রতার খাতিরে গেছেন, তাঁকেও পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম। হয়তো জোন একটু বেশি কথা বলেন, এর অতিরিক্ত আর কিছু আমি খুঁজে পেলাম না। অপরপক্ষে আমন্ত্রিত কেউ যে অস্বস্তি বোধ করছেন, সেটাও বোঝার উপায় ছিল না। জোন আমন্ত্রণও করেছেন হিসেব করে–পাঁচজন অতিথি এবং গৃহকত্রী মিলে খাবার টেবিলের চারপাশে সুন্দর বসে গেলেন।
আমি নিজে খুবই অভিভূত। জোন ল্যানকাস্টারের সঙ্গে আমার পরিচয় কাজের সূত্রে। ব্যক্তিগত কোনো সংযোগ গড়ে ওঠার সুযোগ হয়নি। কর্মক্ষেত্র থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন, আমিও এসে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। এমন অবস্থায় আমাকে নিমন্ত্রণ করার বাধ্যবাধকতা তাঁর ছিল না। তবু যে তিনি এত কষ্ট স্বীকার করলেন, তার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম।
আবার এটা ভেবেও বিস্মিত হলাম যে, যিনি জোনকে অপছন্দ করেন, তিনি অকপটে কথাটা আমাকে বলে দিলেন। না বললে আমি ঘুণাক্ষরেও ব্যাপারটা টের পেতাম না, জানতেই পারতাম না যে, সৌজন্যের আবরণে কেউ ভিতরের অস্বস্তি ঢেকে রেখেছেন।
না জানলেই ভালো হতো। সন্ধ্যাটা তাহলে আমার জন্য নিরঙ্কুশ ভালো লাগার হয়ে থাকতো।
৩৬.
বন্ধু এ বি এম শফিউল্লাহর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।
পরিকল্পনা কমিশনের চাকরি ছেড়ে শফিউল্লাহ্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিলেন পিএইচ ডি করতে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তিন ছেলেমেয়ে এবং নববিবাহিত বধূকে। বিদেশ থেকে চিঠি লিখে তাঁর পুনর্বিবাহের কথা জানিয়েছিলেন আমাকে। মেয়েটি অল্পবয়সী। চট্টগ্রামের কুণ্ডেশ্বরী বিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রী ছিল–কোনো না কোনো সূত্রে তখন তাকে জানতাম। পরে অস্পষ্টভাবে শুনেছিলাম, বিয়েটা ভেঙে গেছে, তবে শফি ডিগ্রি অর্জন করে যুক্তরাষ্ট্রেই রয়ে গেছেন।
এবার আকস্মিক দেখা হওয়ায় জানলাম, ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ড পেরেন্টহুড ফেডারেশনের চাকরি নিয়ে শফি লন্ডনে আছেন। ইলফোর্ডে নিজের বাড়িতে থাকেন। ছেলেমেয়েরা সবাই এখানে স্কুলে যায়। মনে হলো, তিনি ভালো আছেন।
আমার সব খোঁজখবর নেওয়ার পরে শফি বললেন, আমাকে তাঁর বাড়িতে থাকতে হবে। ছাড়াছাড়ি নেই। আমি মৃদু আপত্তি করলাম, তিনি একটু দূরে থাকেন, এই অজুহাতে। শফির হিসেবে কর্মক্ষেত্রে আসা-যাওয়ায় এখনকার চেয়ে আমার বেশি সময় লাগবে না। ওয়াটারলু স্টেশন পর্যন্ত ব্রিটিশ রেলেই আসতে পারবো।
অগত্যা ছায়া বিশ্বাসকে কুণ্ঠিত হয়ে বললাম, তার আশ্রয় ছেড়ে যাবো। তিনি হেসে বললেন, যেদিন বিমানবন্দর থেকে ফোন করে তাঁর বাড়িতে উঠেছিলাম, তিনি সেদিন ভেবেছিলেন, লন্ডনে আমার কেউ নেই। পরে তো দেখলেন, আমার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই। তাদের কেউ যদি টানে আমাকে–তিনি বাধা দেবেন কেমন করে!
বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীর কথাটা একটু অন্যভাবে আমাকে একদিন বলেছিল ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির ডেকে কর্মরত একটি মেয়ে। আমার কাছে বাইরে থেকে ফোন এলে ডেকে কর্তব্যরতরা ডেকে দিতো আমাকে। মেয়েটি একদিন হাসতে হাসতে বললো, মনে হয়, লন্ডনে তোমার অনেক পড়ুয়া আছে–সবাই মেয়ে।
আমি হেসে বললাম, দেখো, আমার ছাত্রেরা সব দেশে আছে, বেশির ভাগ মফস্বল শহরে অধ্যাপনা এবং কঠোর জীবনসংগ্রাম করছে। ছাত্রীরা অধিকাংশ ভালো বিয়ে করে প্রবাসী হয়েছে। শিক্ষককে খাতির করার দেশীয় রেওয়াজ তারা পালন করে যাচ্ছে। তাই তোমাদের বিরক্ত করে।
সে বলেছিল, বিরক্তিবোধ করি না, পর্যবেক্ষণ করে মজা পাই।
তাকে এবং ডেসকে কাজ-করা আরেকটি মেয়েকে একদিন লাইব্রেরির কাজের শেষে পাবে নিয়ে গিয়েছিলাম।
ছায়া বিশ্বাস আমাকে বিদায়ী ভোজ খাওয়ালেন। বুলু ও মাসিমাকে এবং শফিকে নিমন্ত্রণ করলেন। তাঁর বাড়ি ছেড়ে যেতে আমার কষ্ট হলো।
শফির বাড়িতে তাঁর গাড়িতে এলাম। বুলু ও মাসিমাও সঙ্গে এলেন পৌঁছে দিতে। এখান থেকে গাড়িতে গেলে বুলুর বাড়ি কাছে, টিউবে গেলে অনেক ঘুরে যেতে হয়।
শেলী, মণি, মহী আমাকে স্বাগত জানালো। ওদের মধ্যে কেবল শেলীরই মনে আছে আমাকে।
পরদিন টেলিফোন-বই বের করে ফোন করছি শফির বাসা থেকে। মহী ধীর পায়ে এসে জানতে চাইলো, আর দিজ অল লন্ডন নাম্বারস্?’
বলি, হ্যাঁ।
সে আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘ডু ইউ নো সো মেনি পিপল ইন লন্ডন?’
হ্যাঁ, ছায়া বিশ্বাসের ভাষায়, আমার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই এখানে। সে আমার পরম সৌভাগ্য।
৩৭.
কামাল হোসেনকে নরওয়ের ক্রিশ্চেন মিকেলসন ইনসটিটিউট একটা দায়িত্ব দিয়েছিল–স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার অভিজ্ঞতা লিখে ফেলতে। নিয়মরক্ষার জন্যে পাণ্ডুলিপি পড়ে একজনকে মতামত দিতে হবে। কামালের পরামর্শে ইনসটিটিউট সেই রিভিউর কাজটা দিলেন আমাকে। তাদের অতিথি হয়ে এক সপ্তাহ থাকার আমন্ত্রণ। কামালও তখন সেখানে থাকবেন।
চাইবামাত্র ভিসা পাওয়া গেল। সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে কামাল ও আমি এসএ এসের ফ্লাইটে বাৰ্গেনে গেলাম।
ইনসটিটিউটের একতলায় সামনের দিকে কয়েকটি সুসজ্জিত শয়নকক্ষ, রান্নাঘর, বাথরুম। তার ওপর তলায় অফিস। চারতলা বাড়ির বাকি সবটা নিয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। প্রত্যেক তলায় ইলেকট্রিক কেটল এবং চা-কফির সরঞ্জাম রাখা আছে। বই পড়তে পড়তে যখন-তখন নিজে বানিয়ে চা-কফি খাওয়া যায়। যারা ইনসটিটিউটে থাকছে, তারা দিনরাত্রির যে-কোনো সময়ে গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে পারে। এমন চমৎকার ব্যবস্থা আর আমি কোথাও দেখিনি।
আমরা বেশির ভাগ সময়ে ঘরেই খাই। রান্নাবান্নার দায়িত্ব কামালের। অবশ্য রান্নার কাজ সামান্যই। প্রায়-রান্না করা খাবার পাওয়া যায়, হরেকরকম রুটি ও পনির। ইচ্ছে করলে ভাত খাওয়া হয়। ঘরে খেতে না চাইলে খানিক হেঁটে রেস্টুরেন্টে যাওয়া চলে।
আমরা থাকতে থাকতেই রেহমান সোবহান এসে যোগ দিলো। অন্য কোনো কাজে এসেছে। বাইরে খাওয়াই তার পছন্দ। সেইসঙ্গে সিনেমা দেখাও। এসব ক্ষেত্রে আমরা তার অনিবার্য সঙ্গী।
ইনসটিটিউটের প্রধান ইউস্ট ফালান্ডের সঙ্গে ঢাকায় একবার আমার দেখা। হয়েছিল। পাকিস্তান আমলেই তিনি অর্থনীতি বিষয়ে সরকারকে মাঝে মাঝে উপদেশ দিতেন। পাকিস্তান সম্পর্কে বইও লিখেছেন। পূর্বাঞ্চলের প্রতি তাঁর সহানুভূতি গড়ে উঠেছিল তখনই। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেছিলেন আন্তরিকভাবে।
ইউস্ট তাঁর গাড়িতে করে মনোরম বার্গেন শহর দেখালেন। নিজের বাড়িতে নিয়ে খাওয়ালেন। তারপর বললেন, আমার বাংলাদেশি পৌত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। স্বাধীনতার পরে এদেশের একটি শিশুকে তিনি পোষ্য নিয়েছিলেন। যাকে বলে যুদ্ধ-শিশু, সে তাই। মেয়েটির বাংলা শেখার অবকাশ হয়নি। ইউস্ট তার দোভাষী হয়ে গেলেন।
১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান থেকে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত সময়ের স্মৃতিকথা আছে কামালের। সেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ/ দলিলপত্র বইয়ের সাক্ষাৎকার খণ্ডে স্থান পেয়েছে। আমি তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলাম, ১৯৭১-এ বন্দিজীবনের কাহিনি লিখে ফেলতে। তিনি সময় করতে পারেননি। ইউস্ট ফান্ডের আগ্রহে এখন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত কালপর্বের স্মৃতিকথা লিখলেন। যে-সাতদিন আমরা একসঙ্গে থাকলাম, তখনো পাণ্ডুলিপিতে সংযোজন-বিয়োজন-পরিমার্জন চলছিল। ঘটনাপ্রবাহ যেমন দেখেছিলেন, তেমন লিপিবদ্ধ করেছিলেন কামাল। পরবর্তীকালের জ্ঞাত তথ্যের আলোকে আগের বিষয় বিচার করেননি। সবকিছুই বলেছেন। খুব মৃদুতার সঙ্গে।
পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে আমার সপ্রশংস মন্তব্য লিখে ফেলতে বেশি সময় লাগেনি। এক-আধটা পরামর্শও বোধহয় দিয়েছিলাম। তা মূলত নিয়মরক্ষার খাতিরে।
১১ তারিখে আমরা লন্ডনে ফিরে এলাম। হিথরো বিমানবন্দরে শুল্ক-কর্তৃপক্ষ কামালের ব্যাগ আর আমার সুটকেস বেশ ভালো করে পরীক্ষা করলেন। সাধারণত এমন হয় না। কামালকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের কি একজোড়া চোরাচালানি মনে হচ্ছে?
৩৮.
চমন আফরোজ কামাল লন্ডনে এসেছেন চিকিৎসা করতে। তাঁকে দেখতে গেলাম। তখন শামসুল কামাল বললেন তাঁর আত্মীয় জামাল নজরুল ইসলামের কথা। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি গণিতের শিক্ষক। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই শুনে শামসুল কামাল টেলিফোন নম্বর দিয়ে বললেন, আমি যেন অবশ্যই ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করি–করলে আমার ভালো লাগবে।
ফোনে জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ করলাম। সত্যি ভালো লাগলো। তিনি আমন্ত্রণ জানালেন কেমব্রিজে। ঠিক হলো, পরের রোববার তার সঙ্গে দেখা করতে যাবো।
বুলুকে কেমব্রিজ যাওয়ার খবর দিতে সে বললো, ওই রোববারে তার অবসর আছে। আমি চাইলে সে আমাকে গাড়ি করে নিয়ে যেতে পারবে। ঈঙ্গিত জায়গায় আমাকে নামিয়ে দিয়ে সে বইয়ের দোকান হেফার্সে থাকতে পারে, ফেরার সময় হলে আমাকে তুলে নিতে পারে।
জামাল নজরুল ইসলামকে যখন জানালাম যে, আমি একজন ডাক্তার-বন্ধুর সওয়ার হয়ে কেমব্রিজে আসতে চাই, তিনি তাকেও সাদর আমন্ত্রণ জানালেন।
গৃহকত্রী সুরাইয়া ইসলাম লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে গবেষণা শুরু করেছেন সবে। তাদের কন্যাদুটি হাই স্কুলে পড়ে। আমরা পৌঁছোতে সকলে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন।
জামাল ও সুরাইয়া উভয়েই সদালাপী। সাহিত্যে ও সংগীতে জামালের আগ্রহ আছে। তার মা রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর অনুবাদ করেছিলেন উর্দুতে। আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্পর্কে তার মামা। জামাল জানালেন, বাংলাভাষায় তাঁর। অধিকার সীমিত, তবে রবীন্দ্রসংগীত তিনি ভালোবাসেন। বুলুর সঙ্গে কথা বললেন পাশ্চাত্য সংগীত নিয়ে। সুরাইয়ার গবেষণার বিষয় উনিশ-বিশ শতকের। বাঙালি মুসলমান সমাজ। আমার লেখার সঙ্গে তার পরিচয় আছে, প্রমাণ হিসেবে আমার একটা আস্ত বই দাখিল করলেন। আলাপ দ্রুত জমে গেল। রন্ধননিপুণ সুরাইয়া অনেক কিছু রান্না করেছেন। সেসব খাওয়ার পরে সংগীতপর্ব। জামাল পিয়ানোতে বসলেন। সদফরা দু-বোন রোমান অক্ষরে লেখা দেখে রবীন্দ্রসংগীত গাইলো।
বিদেশে বড়ো হলে বাংলা উচ্চারণে একটু আড়ষ্টতা থাকে অনেকেরই। আন্তরিক উৎসাহ দিয়ে তারা সেটি পুষিয়ে দিলো। জামাল ভালো পিয়ানো বাজান। মেয়েদের গানের সঙ্গে তো বাজালেনই, একাও রবীন্দ্রসংগীতের সুর তুললেন।
কথায় কথায় ১৯৭১ সালের কথা উঠল। জামাল নজরুল ইসলাম তখন ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে যেসব চিঠি লিখেছিলেন, তার কিছু কিছু দেখালেন। বাংলাদেশে গণহত্যা ও নির্যাতনের করুণ চিত্র তিনি তাতে তুলে ধরেছিলেন। সেসব চিঠির উত্তর অনেকে যেভাবে দিয়েছিলেন, তাও মর্মস্পর্শী।
জামাল যখন বললেন যে, তিনি দেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছেন, তখন আমি অবাক হলাম। কেমব্রিজে শিক্ষকতা করছেন, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। থেকে তার বই বেরিয়েছে। গবেষক হিসেবে তিনি নাম করেছেন, এখানে গবেষণার এত সুযোগ রয়েছে। এসব ছেড়ে দেশে ফিরে যাবেন–আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। অথচ তিনি যে কথার কথা বলছিলেন না, তাও স্পষ্ট। দেশে পড়াশোনার পরিবেশ সম্পর্কে তিনি খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন।
কেমব্রিজ ইউভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত তাঁর বইয়ের দুটি কপি আমার হাতে দিলেন জামাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের জন্যে।
এই চমৎকার পরিবারের সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে দিন কাটিয়ে আমরা বিদায় নিলাম।
ফেরার পথে বুলু জিজ্ঞেস করলো, গাড়িতে ১০০ মাইল স্পিডে গেছো কখনো?’
বললাম, যাইনি।’ তার মতলব বুঝে যোগ করলাম, যেতে চাইলে পুলিশের হাতে নির্ঘাত ধরা পড়বে।
‘দেখা যাক।’ বলে বুলু গতি বাড়ালো গাড়ির। হাইওয়েতে গতিবেগের সর্বোচ্চ সীমা আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি। ১০০ মাইল গতিতে উঠে বুলু নেমে এলো ৮০ মাইলে। খানিক পরে আরেকবার কাঁটা ১০০ মাইল স্পর্শ করলো। তারপর অবশ্য নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকলাম আমরা।
বুলুকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, ‘তোমার ভাগ্য ভালো। ধরা পড়োনি।’
বুলু হাসলো। ইংরেজিতে বললো, উপভোগ করতে হলে ঝুঁকি নিতে হয়।
৩৯.
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি একটা মহামিলনক্ষেত্রও বটে। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে পুনর্মিলনের এবং নতুন বন্ধুলাভের অনুকূল স্থান। লন্ডনে যখন সপরিবারে ছিলাম, তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রন ইনডেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে বৃত্তান্ত সবিস্তারে বলেছি। পরে আবার দেখা হয় রনের সঙ্গে। আগেরবার যে বই নিয়ে সে কাজ করছিল, সেটি তখন বেরিয়ে গেছে। রন এবারে কাজ করছে। অন্য বিষয় নিয়ে।
তাকে একরাতে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলাম আমাদের দেশি খাওয়া খাওয়াতে। পরিবেশন করতে যে এলো, সে সালাম করে বললো, আমি আপনার ছাত্র। তাকে আমার মনে পড়েনি। তখন সে জানালো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল সে–বাংলার নয়, অন্য বিভাগে। আমাদের আলাপ শুনে রন মিটিমিটি হাসতে থাকলো।
খাওয়া-দাওয়ার শেষে বিল এনে ছেলেটি বললো, স্টাফ ডিসকাউন্ট দিয়েছি, সা। তাকে ধন্যবাদ জানালাম।
রন বললো, ‘লন্ডনেও দেখছি তোমার অনেক প্রভাব।
বললাম, ‘শুনলেই তো, ও ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল। শিক্ষকজ্ঞান করে। আমাকে খাতির করছে।’
রন বললো, ‘এটা শুধু তোমাদের কালচারেই সম্ভব। আমার সরাসরি কোনো ছাত্রও দেশে-বিদেশে এমন করতো না।’
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতেই বছর বারো বাদে দেখা হয়েছিল লেওনার্ড গর্ডনের সঙ্গে। আমি যখন শিকাগোয়, তখন সে পিএইচ ডি করছিল ইতিহাসে। প্রেমও করছিল। আমি চলে আসার পরে সে ডিগ্রি অর্জন করে, তার অভিসন্দর্ভ Bengal: The Nationalist Phase নামে প্রকাশিত হয়ে সমাদৃত হয়। লেনি অধ্যাপনা করে স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্কে। এখন সে সুভাষ বসু ও শরৎ বসু সম্পর্কে গবেষণা করছে। এই ব্যাপারেই সে সাক্ষাৎকার নিয়েছিল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের। পরে তার এই গবেষণাকর্ম Brothers Against the Raj নামে খ্যাতিলাভ করেছিল।
আমি শিকাগো থেকে চলে আসার পরে লেনি বিয়ে করেছিল তার প্রেমিকাকে–সে-খবর দেশে বসে পেয়েছিলাম। তার সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসে চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, বউ কেমন আছে?
লেনি বললো, ও, তুমি জানো না। আমাদের বিয়ে ভেঙে গেছে।
বললাম, দুঃখিত। আমি জানতাম না।
সে বললো, ঠিক আছে। তবে আমি একজনের সঙ্গে থাকছি। মেয়েটি সংস্কৃতবিদ। অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়।
দু বছরের মাথায় এবারে লেনির সঙ্গে আবার দেখা। আবার রেস্টুরেন্টে বসে কুশল বিনিময় করি। তুমি যে-মেয়েটির সঙ্গে থাকো, সে কেমন আছে, এমন প্রশ্ন করতে কুণ্ঠা লাগে। আমি সে-প্রসঙ্গে যাই না।
লেনি নিজেই কথাটা তোলে। গতবারে তোমাকে বলেছিলাম, আমি একজনের সঙ্গে থাকি, মনে আছে?
বলি, হ্যাঁ। এবারে জানতে চাই, কী খবর তার?
লেনি বলে, আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি।
বলি, সুখবর। আগাম অভিনন্দন। কতদিন থাকলে তোমরা একসঙ্গে?
প্রায় দশ বছর।
বেশ তো। মধুর সমাপ্তি। অনন্তকাল সুখে থাকো।
এই প্রসঙ্গের আরেকটি পর্ব আছে। সেটি এখানেই বলে নিই।
পরের বছর চট্টগ্রামে টেলিগ্রাম পাই লেনির। কলকাতা থেকে পাঠিয়েছে। কদিনের জন্যে বেড়াতে আসতে চায় চট্টগ্রামে। আমি থাকবো কি না জানতে চায়।
নির্দিষ্ট দিনে তাকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে আসি বাড়িতে। সে আসতে আসতে বলে, সে কোনো বক্তৃতা দিতে চায় না, কোনো সভায় যেতে চায় না। পরিপূর্ণ বিশ্রাম নেবে, পারলে শুয়ে শুয়ে দিন কাটাবে।
এবারে তার স্ত্রীর সংবাদ নিই। লেনি বলে, একসঙ্গেই এসেছিলাম ভারতে। সে গেল কাঠমান্ডুতে। আমি ভাবলাম, এই ফাঁকে তোমার এখান থেকে বেড়িয়ে যাই।
বললাম, খুব ভালো করেছ। কেমন আছো তোমরা?
লেনি ম্লান হাসি হাসে। বলে, বিয়েটা টিকবে কি না সন্দেহ।
জানতে চাই, কী হলো আবার?
বলে, আমি সন্তান চাই, সে চায় না।
বলি, তুমি একটা হতভাগা। দশ বছর একসঙ্গে কাটালে, আর সে মা হতে চায় কি না, এতদিন তা জানতে পারোনি?
লেনি চুপ করে থাকে।
ইফরাইম মিলারের সঙ্গেও এমনি করে দেখা হয়ে গিয়েছিল লন্ডনে। ইফরাইম ছিল অ্যারোনটিকাল ইনজিনিয়ার। কী খেয়াল হলো, চাকরি-বাকরি ছেড়ে বাংলা পড়তে শুরু করলো। তারপর ডিমকের অধীনে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে গবেষণায় প্রবৃত্ত হলো পিএইচ ডি পর্যায়ে। কলকাতায় এলো, সেখান থেকে ঢাকায়, সেখান থেকে যোগাযোগ করে চট্টগ্রামে। কদিন থাকলো আমার বাড়িতে।
ওই গবেষণারই কাজ করছিল লন্ডনে। আমাকে একদিন সাউথ ব্যাংকে নিয়ে গেল সিনেমা দেখাতে। শাবানা আজমি-অভিনীত অঙ্কুর।
এবারে একদিন দুপুরবেলায় খাওয়া সেরে উঠেছি লাইব্রেরির লিফটে। সহযাত্রীর সঙ্গে গল্প করতে করতে এক শ্বেতাঙ্গিনীও উঠলো তাতে। মুখটা চেনা মনে হলো। চারতলায় লিফট থেকে নেমে তার উদ্দেশে ‘এক্সকিউজ মি বলেছি, দাঁড়িয়ে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে সে-ও আর ইউ’ বলে হেসে দিলো। হাসি দেখে নিঃসন্দেহ হলাম। গেইল মিনো। ঢাকায় ইউএসআইএসে উপ-প্রধান ছিল। পনেরো বছর আগে যখন আমি ফুলব্রাইট স্কলারশিপের জন্যে দরখাস্ত করি, তখন আমার ইংরেজিজ্ঞানের সার্টিফিকেট নিয়েছিলাম তারই কাছে। আমেরিকা থেকে ফিরে তাকে আর ঢাকায় পাইনি। তবে জানতে পেরেছিলাম, সরকারি চাকরি ছেড়ে সে লেখাপড়ার জগতে প্রবেশ করেছে। তার পিএইচ ডি র কাজ The Khilafat Movment in India প্রশংসিত হয়েছে।
এতকাল পরে দেখা। স্থির হলো, পরদিন লাইব্রেরির কাজ সেরে আমরা কোথাও গিয়ে বসবো এবং এতদিনের হিসাবনিকাশ করবো।
সেইমতো একটা পাবে গিয়ে বসলাম। গেইলের স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য উভয়েরই খানিকটা হানি হয়েছে। বললাম, শিকাগো থেকে ফিরে তোমার খোঁজ করেছিলাম, গেইল। শুনলাম, তুমি ওয়াশিংটনে বদলি হয়ে গেছে। তারপর শুনলাম, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছ। তোমার বইটার খবর রাখি, আর কিছু জানি না।
গেইল আমার দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হাসি হাসে। একটু একটু খায়, কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরেটা দেখতে থাকে। ধীরে ধীরে কথা বলে।
ঢাকা থেকে সে বদলি হয়ে গিয়েছিল ওয়াশিংটন ডিসিতে, ইউএসআইএসের সদর দপ্তরে। কিন্তু সরকারি কাজ তার ভালো লাগছিল না, একদিন চাকরি ছেড়ে দিলো। তারপর ঢুকে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচডি করলো, বিয়ে করলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেলো, সন্তানের জন্ম দিলো। এ পর্যন্ত সবই ভালো। হঠাৎ করে কদিনের অসুখে মারা গেল ছেলেটি। আকাশ ভেঙে পড়ল তার মাথায়। সে যে কী অসহ্য কষ্ট, তা বলা যায় না। চাকরিতে ইস্তফা দিলো, কষ্ট ভুলতে মাদক ধরলো। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, পুরোপুরি মাদকাসক্ত বনে গেল। ধ্বংসের প্রান্তে এসে আবার তার বাঁচতে ইচ্ছে হলো। তখন শুরু হলো মাদক ছাড়ার যুদ্ধ। সেটাও অবর্ণনীয় কষ্টের ব্যাপার। তবে সে হাল ছাড়েনি, শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে তার ইচ্ছাশক্তির। এত কিছুর পর বিদ্যায়তনিক জগতে ফিরে আসা সহজ ছিল না। সেখানেও তাকে যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়েছে, তবে পরিণামে সফল হয়েছে সে।
‘আমাকে খুব খারাপ দেখছ, তাই না?’ গেইল আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
আমি মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে কথাটা স্বীকার করি।
‘এখন অনেক ভালো আছি। সংকটের সময়ে যদি আমাকে দেখতে! হয়তো চিনতেই পারতে না।’ গেইল সামনের পাত্র তুলে অনেকটা চুমুক দেয়। পাত্র নামিয়ে বলে, এবার তোমার কথা বলো।
৪০.
শফিউল্লাহর সংসারে তিনিই কর্তা, তবে কাজেকর্মে তাকে এদেশ-সেদেশ যেতে হয়। তখন তো বটেই, এমনি সময়েও বাড়ির কাজের বেশিটা করতে হয় শেলীকে। শেলীর ইচ্ছে, দেশে ফিরে এসে সে চারুকলা ইনসটিটিউটে পড়বে। ছেলেরা দেশে আসতে আগ্রহী নয়, শফিরও এখন দেশে ফেরার পরিকল্পনা নেই। তবে একবার সবাইকে নিয়ে ঢাকায় বেড়িয়ে যাবে।
সেই বেড়িয়ে যাওয়ার সময় এসে গেল। শফির একটু দুশ্চিন্তা আমাকে নিয়ে। একা আমাকে রেখে আসবে–আমার না জানি কত অসুবিধে হবে। আমি খোঁচা দিই, বেশ তো ছিলাম মর্ডেনে। এখন বাড়ি ডেকে এনে সবাই চলে যাচ্ছেন। এ তো বাড়িতে অতিথি নিমন্ত্রণ করে গৃহকর্তার বাইরে বেরিয়ে পড়ার মতো।’ শফি নানারকমভাবে ব্যাখ্যা দিতে চান। আমি হাসি।
শফিদের অনুপস্থিতিতে শুধু সকালের নাশতাটাই নিজে করে নিতাম। দু বেলা বাইরে খেতাম। ফিরতাম দেরিতে। বিবিসি-র নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পর যেদিন কাজ থাকতো সেখানে সেদিন তো মধ্যরাতের অনেক পরে অর্ধনিদ্রিত লন্ডন দেখতে দেখতে ট্যাকসিতে ফিরতাম। নইলে টিউব আর ট্রেন ধরে ফেরা।
একবার কামাল হোসেন ও হামিদা এলেন অকসফোর্ড থেকে। তাঁদের সঙ্গে সিনেমা দেখে খেয়ে মার্বেল আর্চে বোধহয় শেষ টিউবটা ধরতে পারলাম দৌড়ে। কামরায় আরেকজন মাত্র যাত্রী। খানিক পরে টের পেলাম, তিনি আমাকে মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। আরো একটু পরে তিনি উঠে আমার কাছে এসে বসলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে, তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?
আমি একটু ভয়ই পেলাম। অন্যেরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, অমন অবস্থায় কনডাক্টর-গার্ডের কাছাকাছি কামরায় উঠতে। এই রাতে তা করার সময় ছিল না। বললাম, না, রাত বেশি হওয়ায় একটু চিন্তা করছি আর কী!’
তিনি জিজ্ঞাসা করে যেতে থাকলেন কোথায় থাকি, কোন স্টেশনে নামবো, কীভাবে বাড়ি যাবো। আমার ভয় বাড়তে লাগলো। পরে অবশ্য কিছু হয়নি।
মানুষের এমনি স্বভাব। গভীর রাতে একা পথ চলতে ভয় হয়। আবার হঠাৎ পদশব্দ পেলেও ভয় লাগে।
৪১.
ফ র মাহমুদ হাসান ও শামসী আরাকে চিনি তাদের ছাত্রজীবন থেকে আমার ভাগ্নে মামুনের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বের সুবাদে। আমি যখন সপরিবারে লন্ডনে, তখন তাদের সঙ্গে যোগাযোগটা পুনঃস্থাপিত হয়। মাহমুদের পিএইচডির কাজ তখনো বোধহয় শেষ হয়নি। এর মধ্যে সে লন্ডনের সাপ্তাহিক জনমত সম্পাদনা করেছিল কিছুকাল, বিবিসির বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশ নিয়েছিল এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজে জড়িয়ে গিয়েছিল। বিবিসির অনুষ্ঠান করতে গিয়ে এক বিপ্লবী স্লোগান প্রচার করায় সেখানকার পথ ওর জন্যে বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তাতে তার পরোয়া ছিল না। শামসী–যাকে আমরা জ্যোৎস্না বলে ডাকতেই অভ্যস্ত–শিক্ষকতা করতো লন্ডনের এক স্কুলে। দুই মেয়ে নিয়ে তারা থাকতো মাহমুদের মেজো ভাই মামুন ও তার স্ত্রীর সঙ্গে একই বাড়িতে। মামুনের অবশ্য পড়াশোনার জন্যে আরেকটা ডেরা ছিল–সেখানেই তিনি বেশির ভাগ সময় থাকতেন। তাঁর স্ত্রী অতি সরল মেয়ে–মাহমুদের ঠাট্টার হুলে বিদ্ধ হয়ে সবসময়ে অস্থির থাকতেন। আমরা সপরিবারে মাহমুদদের বাড়ি গেলে জ্যোৎস্নার কাজ বেড়ে যেতো, তার জা কিছুটা ভাগ নেওয়ার চেষ্টা অবশ্য করতেন। নিদারুণ পরিশ্রমের মধ্যেও জ্যোৎস্নার মুখের হাসিটি অম্লান থাকতো।
পরের দুবার যখন আমি একা লন্ডনে ছিলাম, তখনো মাহমুদদের বাড়িতে একইরকম আপ্যায়ন পেয়েছি। একবার সপ্তাহান্তে ওদের বাড়ি যাবো বলে মাহমুদের সঙ্গে স্থির করলাম, এর মধ্যে শিল্পী রশিদ চৌধুরী চলে এলেন লন্ডনে। মাহমুদকে ফোন করে বললাম, রশিদ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে আসবো তার অসুবিধে না হলে। মাহমুদ মহা আনন্দিত হয়ে সম্মতি জানালো; জানতে চাইলো, রশিদ চৌধুরীকে সে ফোন করবে কি না। বললাম, তার দরকার হবে না। রশিদ একটু ইতস্তত করছিলেন। বলছিলেন, আমার যখন যাওয়ার কথা, আমিই যেন মাহমুদদের বাড়ি চলে যাই, তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎটা না হয় আরেকদিন হবে। আমি বললাম, তা নয়, ইচ্ছে করলে ওইদিন বাদ দিয়ে অন্য কোনোদিন সেখানে যাওয়া যায়, তবে আমি চাইছিলাম, বিকেলটা একসঙ্গে ঘোরাঘুরি করে রশিদকে নিয়েই সেখানে যাবো এবং সেখানে খাওয়াদাওয়া সেরে একসঙ্গে ফিরবো। একথাও বললাম যে, তাঁর কুণ্ঠিত হওয়ার মতো কারণ থাকলে আমি কখনোই তাকে নিয়ে যেতে চাইতাম না। রশিদ যেতে সম্মত হলেন।
মাহমুদের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া গেল না। জ্যোৎস্নার মুখ দেখে বোঝ। গেল, সে আমাদের আগমন প্রত্যাশা করছিল না। তবে আমাদের দেখে সে বুঝে নিয়েছিল যে, মাহমুদকে বলে-কয়েই আমি একজন বিশিষ্ট অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে। গেছি। আমি জানতে চাইলাম, মাহমুদ বুঝি তোমাকে বলতে ভুলে গেছে? জ্যোৎস্না বললো, তাতে কিছু নয়, আপনারা বসেন। মাহমুদ যে কখন ফিরবে, কিছু বলে যায়নি। আশা করি, বেশি দেরি হবে না।’ রশিদ বিব্রত হয়ে আমার। দিকে তাকালেন। জ্যোৎস্নাকে বললাম, আজ বরঞ্চ আমরা আসি, আরেকদিন আসা যাবে। সে বললো, তা হবে না। খাওয়াদাওয়া করে তারপরে যাবেন। আমি এখনো রান্না চড়াইনি–কোনো অসুবিধে হবে না।’
রশিদ আর আমি বসে বসে গল্প করতে লাগলাম। জ্যোৎস্না মাঝে মাঝে এসে খোঁজখবর নিতে থাকলো। বেশ খানিকক্ষণ পরে মাহমুদের প্রবেশ, আমাদের দেখে শিরে করাঘাত, হইচই, খবরদারি। জ্যোৎস্নার আন্তরিকতায় রশিদের বিব্রতভাব খানিকটা দূর হয়েছিল, বাকিটা দূর হয়ে গেল মাহমুদের কথার তোড়ে। অতিথিকে বাড়িতে ডেকে ভুলে যাওয়া যে এই লোকটির পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক, রশিদের সে-প্রত্যয় জন্মালো এবং জ্যোৎস্নাকে এমন পরিস্থিতি যে প্রায়ই সামলাতে হয়, তা অনুমান করে তার প্রতিও কিছু সহানুভূতি দেখা দিলো। ওদের বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে এই দম্পতি রশিদের আপন হয়ে গিয়েছিল।
এর বেশ কিছুকাল পরে লন্ডনেই একদিন ওবায়েদ জায়গীরদার আমাকে বললো, তোমার বন্ধু এখন একটা বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে স্থিত হতে চায়। রশিদকে আমার কাছে উল্লেখ করতে হলে সে হয় তোমার বন্ধু’ নয় ‘আমার বন্ধু’ বলতো।
আমি খুবই বিস্মিত হলাম। রশিদের মতো সংসারী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। স্ত্রী অ্যানি ও দুই কন্যা রীতা-রোজার প্রতি তার ভালোবাসার অবধি ছিল না। ঘরের কাজে তিনি ছিলেন নিরলস, গাড়ির পরিচর্যায় ক্লান্তিহীন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিদেশি নাগরিকদের যখন বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আন এবং তার দুই মেয়ে-রোজা ও রীতাও–ফ্রান্সে চলে গিয়েছিলেন। পরে হাবিবুল্লাহ খানের সাহায্যে রশিদ করাচি বিমানবন্দর হয়ে প্যারিসে চলে গিয়েছিলেন। প্যারিসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারকর্মে রশিদ নিজে তো বটেই, আনও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন, এ কথা তিনি বলতেন। এখন কী এমন ঘটলো যে, তাদের দুজনের মধ্যে আবির্ভাব হলো তৃতীয় ব্যক্তির?
ওবায়েদের কথার পিঠে কী বলব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষে জানতে চাইলাম, তোমারও এই মতলব নাকি?’
ওবায়েদেরও ফরাসি স্ত্রী। একবার ওদের কেন্টের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, অঁরিয়েতের এক পা পুরো প্লাস্টার করা। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ওবায়েদ কি তোমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল?
সে হাসলো। বললো, তুমি একথা বলছো? আমার এক বান্ধবী আমাকে কী জিজ্ঞাসা করেছিল, জানো? সে বলে, তুমি কি ওকে লাথিটা খুব কষে মেরেছিলে?
ওবায়েদ সেদিন আমার প্রশ্নের জবাব দেয়নি, খুব একচোট হেসেছিল শুধু। তবে পরে ওদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়, যদিও ওবায়েদের সঙ্গে রশিদের বিষয়ে যখন কথা বলছিলাম, তখন তেমন পরিস্থিতির উদয় হয়নি।
ওবায়েদ সে-মুহূর্তে রশিদের পক্ষ নিয়ে দু-একটি কথা বললো। বাঙালি মেয়েটি যে কে, তা অবশ্য সে খুলে বলেনি, আমিও জানতে চাইনি। ওবায়েদ শুধু বলেছিল, ‘তোমাদেরই ছাত্রী।’
দেশে ফিরে আসার পরে জানতে পাই, সে আমারই প্রিয় ছাত্রী জান্নাত সুলতানা। বাংলায় অনার্স নিয়ে সে যখন ভর্তি হয়, সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে চারুকলা নিতে চাইলে তাকে আমি উৎসাহিত করেছিলাম। সেই সুবাদেই রশিদের সঙ্গে তার যোগাযোগ।
ততদিনে পরিস্থিতি যতটাসম্ভব জটিল হয়েছে। সম্ভবত জান্নাত রশিদকে বিয়ে করেছে, আন মেয়েদের নিয়ে প্যারিসে চলে গেছেন, তারপর রশিদ কন্যাদের সঙ্গে ও তাদের মায়ের সঙ্গেও পুনর্মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। চট্টগ্রাম থেকেই জান্নাত একটা চিঠি পাঠিয়েছিল আমাকে–সুন্দর চিঠি। কুণ্ঠিত হয়েই সে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তার পিত্রালয়ে–আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি যাইনি–যদিও তার সঙ্গে কথা বলার স্পৃহা আমার কম ছিল। না। কিন্তু তার বাড়ি গিয়ে কী বলব আমি? এসব ক্ষেত্রে অন্যের পক্ষে কিছু পরামর্শ দেওয়াও কঠিন।
পরে মনে হয়েছে, জান্নাত যদি আসততা আমার কাছে, তাহলে কি আমি সাগ্রহে তার কথা শুনতাম না? কিছু না কিছু কি বলতাম না? ওই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার আসা ছিল অসম্ভব। তাই আসতে পারেনি। তাই ডেকে পাঠিয়েছিল আমাকে হিতৈষী ভেবে। গেলাম না কেন?
আবার একথাও মনে হয়েছে, ওই মুহূর্তে আন যদি কথা বলতে চাইতেন আমার সঙ্গে, নিশ্চয় আমি যেতাম, কিন্তু তাকেই বা কী বলতাম!
৪২.
আট মাস পরে দেশে ফিরলাম ১৯৭৯ সালের ১২ নভেম্বরে।
আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পরে শিক্ষকদের অনেকেই অন্যত্র চলে গেছেন। প্রথমে মোহাম্মদ আবু জাফর যোগ দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর মোহাম্মদ আবদুল কাইউম লন্ডন থেকে পিএইচডি করে ফিরে এসে সৈয়দ আলী আহসানের টানে চলে যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। হায়াৎ মামুদ ১৯৭৩ সালে মস্কো চলে যান–ফিরে এসে জাহাঙ্গীরনগরে যোগ দেন। রাজিয়া সুলতানার পক্ষেও সেখানে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ায় তিনি সেখানেই গেলেন। আবুল কালাম মনজুর মোরশেদও গেলেন সেখানে। এরপর রাজশাহী। বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেন মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল ও মাহমুদ শাহ কোরেশী। অধ্যাপক হচ্ছেন না কেন, সেই ক্ষোভে চট্টগ্রাম ছাড়তে চেয়েছিলেন। আবু হেনা মোস্তফা কামাল। এখন অধ্যাপক হওয়ার পরও চট্টগ্রাম ছাড়তে চাইলেন তিনি। ১৯৭৮ সালের শেষে চলে গেলেন ঢাকায়। আমি তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে এসেছিলাম–এমন দাবি করা বোধহয় অসংগত হবে না। তার বিদায় সভায় তাই বলেছিলাম, ‘একদিন এই বিভাগের মনে হয়েছিল, তাঁকে এখানে। প্রয়োজন। তাই তাকে সাদরে বরণ করা হয়েছিল এখানে। আজ তিনি মনে করছেন, এই বিভাগকে তার আর প্রয়োজন নেই। তাই আমাদের ছেড়ে যাচ্ছেন। জাহাঙ্গীর তারেককেও আমি নিয়ে এসেছিলাম সহযোগী অধ্যাপকরূপে, অ্যাড হক ভিত্তিতে। আবু হেনার পরে সে-ই হয় বিভাগের সভাপতি। আর মাসকয়েক পরে সেও চলে যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনসটিটিউটে, ফরাসি ভাষার সহযোগী অধ্যাপক হয়ে। আমার সময়ে আর যারা যোগ দিয়েছিল, তাদের মধ্যে রাজীব হুমায়ূনও অচিরে চলে যাবে।
নতুন যোগদানকারীদের মধ্যে আর ছিল রশীদ আল ফারুকী, শিপ্রা দস্তিদার, ভূঁইয়া ইকবাল, ফজিলতুননেসা। আমার কার্যকালে, তবে আমার অনুপস্থিতিতে, যোগ দিয়েছিল মুহম্মদ শামসুল আলম, শাহজাহান মনির ও চৌধুরী জহুরুল হক। আমার সহকর্মীদের কার্যকালে, আমি চট্টগ্রামে থাকতে, আরো যোগ দিয়েছিল ময়ূখ চৌধুরী, সৌরেন বিশ্বাস, গোলাম মুস্তাফা, লায়লা জামান, আহমদ নূরুল ইসলাম। এবার ১৯৭৯ সালের নভেম্বরে আমি যখন ফিরলাম, তখন মনিরুজ্জামান মহীশূর এবং রশীদ আল ফারুকী, দিলওয়ার হোসেন, ভূঁইয়া ইকবাল কলকাতায়, পিএইচডি করতে গেছে আগে-পরে।
এবারে এসে খবর পেলাম মুহাম্মদ ইউনূস দু-বছরের ছুটি নিয়ে টাঙ্গাইলে গেছেন সেখানে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা করতে। এর পটভূমিটা একটু বলা দরকার।
ইউনূস যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের সভাপতি, তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পল্লী-উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্পের সূচনা করেছিলেন ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুইন-উদ-দীন আহমদ খান। ইউনূস এসে এই প্রকল্পের ভার নেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের গ্রামগুলোর মানুষজনদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়-সম্প্রদায়ের একটা যোগাযোগ ঘটানো। আসল অভিপ্রায়–দুদিকের মধ্যকার দূরত্ব ঘোচানো, উন্নয়নের ছোঁয়া গ্রামে পৌঁছে দেওয়া। ১৯৭৫-এ বিদেশ থেকে ফিরে আমি তার সম্পর্কে অবহিত হলাম। কৃষির উন্নয়নের জন্যে এই প্রকল্পে কাজ হচ্ছিল, সেই সঙ্গে সাক্ষরতা অভিযানও চলছিল। আমাদের বিভাগের মনিরুজ্জামান সাক্ষরতার বিষয়ে। প্রকল্পের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। এক-আধদিন আমাকেও সে নিয়ে যায় এ বিষয়ে কর্মীদের কাছে কিছু বলতে। ইউনূস প্রথম থেকেই কিছু উৎসর্গীকৃত। সহযোগী পেয়েছিলেন। তাঁর বিভাগেরই শিক্ষক লতিফি তাঁদের মধ্যে প্রধান। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থেকেও তিনি কর্মী বেছে নিয়েছিলেন। ইউনূসের প্রতি তাঁদের আনুগত্য ছিল প্রশ্নহীন, তাদেরকে ইউনূস প্রেরণা দিয়েছিলেন অন্তহীন।
পরের ধাপে ইউনূস প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নবযুগ’ খামারের–তেভাগার নীতি অনুসরণ করে। এ-সম্পর্কে আমি খুব বেশি জানার সুযোগ পাইনি। তবে এ প্রকল্প যে সফল হয়েছিল, তা বোঝা গিয়েছিল ১৯৭৮ সালে নবযুগ রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়ায়।
কিন্তু ইউনূস এতে তৃপ্ত হননি। আশপাশের অতি দরিদ্র মানুষদের দুরবস্থা তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন। নবযুগ দিয়ে তাদের কষ্ট লাঘব করা যাচ্ছিল না। সরেজমিনে দেখেশুনে তিনি উপলব্ধি করেন, কিছু অর্থ ঋণস্বরূপ পেলে এরা মহাজনদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারে, নিজের মতো উপার্জন করতে পারে। নিজের থেকে কিছু মহিলাকে ঋণ দিয়ে যে-পরীক্ষা তিনি করেছিলেন, তা সফল হয়েছিল। ফলে ইউনূস গেলেন রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখায়–এদের জন্যে ঋণ পাওয়া যায় কি না, তা দেখতে। তারা বললো, ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই, আছে আঞ্চলিক দপ্তরের। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-সন্নিহিত জোবরা গ্রামের জন্য কিছু ঋণ পাওয়া গেল। সেই ঋণ বিতরণ করেই সূচনা হয় গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণদান কর্মসূচির।
এই উদযোগে পরে ইউনূস সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছিলেন দুজনের কাছ থেকে–তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ কে গঙ্গোপাধ্যায় আর বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এ এম আনিসুজ্জামান। তখনই কথা উঠেছিল, জোবরায় গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকল্প সফল হয়েছে–কারণ, ইউনূস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও চট্টগ্রামের সন্তান, তার জোবরা গ্রাম একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন এলাকা। সুতরাং ঋণগ্রহীতারা একরকম বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকে। বাংলাদেশের অন্যত্র এ-প্রকল্প সফল হবে কি না, সন্দেহ।
ইউনূস তাদেরকেই বলেছিলেন জায়গা ঠিক করে দিতে। তিনি দেখাবেন যে, সেখানেও তার প্রকল্প সফল করা সম্ভবপর। তারা নির্বাচন করেছিলেন টাঙ্গাইল। সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের বেশ কয়েকটি শাখায় এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হবে। আর তাঁর সহকর্মীরা জোবরায় এবং আশপাশের গ্রামীণ ব্যাংক চালিয়ে যাবেন।
এই প্রস্তাব মেনে নিয়েই ইউনূস চলে যান টাঙ্গাইলে। যদিও তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে গেলেন, সবটা শুনে আমার মনে হয়েছিল, এ তাঁর অগস্ত্য-যাত্রা। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আর ফিরছেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পাহাড়-চূড়ায় যে বাড়িতে আমি কিছুকাল ছিলাম, পরে ইউনূস ছিলেন সে-বাড়িতে। ইউনূস-দম্পতির সঙ্গে দেখা করতে সেখানে গিয়েছি। একরাতে ওঁরাও এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। বোধহয় বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল বলে মোমবাতির আলো জ্বেলে আমরা বসেছিলাম টেবিল ঘিরে। ইউনূস তার প্রকল্পের কথা বলছিলেন উৎসাহ আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে। তখনই মনে হয়েছিল, প্রথাগত শিক্ষকতার মধ্যে তিনি আর আবদ্ধ রইবেন না।
তারপর মনিকার জন্ম হলো, শিশুসন্তানকে নিয়ে ভেরা মার্কিন দেশে ফিরে গেলেন। ইউনূস একাগ্রচিত্তে লেগে রইলেন তাঁর কাজে। তখনো তার এই খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি হয়নি। তখনো তিনি অনিশ্চিত পথের যাত্রী।
৪৩.
এসব লেখার এই এক দায়। সামনের কথা লিখতে শুরু করলে পেছনের কথা আবার ভিড় করে আসে। তখন ফিরে তাকাতে হয়।
এবারে আমার লন্ডন-প্রবাসকালে লতা মঙ্গেশকর সেখানে এসেছিলেন সদলে। বোধহয় প্রতি বছরই আসছেন ইদানীং। অন্তত অল্পকাল আগেই তো এমনি অনুষ্ঠান করে গেলেন রয়াল অ্যালবার্ট হলে–তার রেকর্ড শুনে শিহরিত হয়েছিলাম। এবার অনুষ্ঠান হবে লন্ডন প্যালেডিয়ামে। লন্ডনের দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে–ধুম পড়ে গিয়েছে টিকিট কেনার। বুলু, মাসিমা, সরোজ, মানসী–সবারই টিকিট কাটা হয়ে গেছে। বুলু যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ওই অনুষ্ঠানে আমি যেতে চাই কি না এবং টিকিটের দুষ্প্রাপ্যতার কথা না বুঝে আমিও সোৎসাহে বলে দিলাম, হ্যাঁ, তখন শুরু হলো টেলিফোনে তার অভিযান। তাতে কাজ না হওয়ায় আমি তাকে ক্ষান্ত হতে বললাম, কিন্তু ততক্ষণে তার জেদ চেপে গেছে। অনুষ্ঠানের দিন সকালে আমাকে। নিয়ে সরাসরি চলে গেল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যে-বাড়িতে উঠেছেন, সেখানে। তার গৃহকর্তা নিশীথ গাঙ্গুলির (পদবিটা ঠিক লিখলাম তো?) সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে বুলুরই বাড়িতে। ভদ্রলোক সবসময়ে চমৎকার চমৎকার রঙিন টুপি পরেন, কথা বলেন গুছিয়ে। তার একটা ট্রাভেল এজেন্সি আছে এবং তার কাছ থেকে বুলু উড়োজাহাজের টিকিট কিনে থাকে। বস্তুত, এই অনুষ্ঠানের টিকিটও সে তাঁরই কাছ থেকে কিনেছে, এখন আর পাচ্ছে না, তবে তার সন্দেহ, নিশীথের হাতে টিকিট আছে, কিন্তু তিনি তা হাতছাড়া করছেন না। বুলু তাই সরাসরি হানা দিলো সে-বাড়িতেই, তবে গৃহকর্তার কাছে নয়, একেবারে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে। ছুটির দিন সকালবেলা, বসার ঘরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ঘিরে ভিড়–কিন্তু কার সাধ্য রোধে তার গতি! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জিত করে আমার পরিচয় দিয়ে বললো, ওর জন্যে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না, ওকে রেখে যাই বা কী করে, আপনি নিশীথকে বলে দিন একটা টিকিট দিতে।’ হেমন্ত সে-কথার সরাসরি জবাব না দিয়ে আমার সঙ্গে সৌজন্যমূলক দু-চারটে কথা বললেন, অন্যদের সঙ্গেও বাক্যবিনিময় করলেন। বুলু নিজেকে বেশ সামলে রাখলো ততক্ষণ। তারপর একসময়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তবে যাই হেমন্তদা, আপনি নিশীথকে বলে দিন একবার!’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন গৃহস্বামীকে ডেকে বললেন, হ্যাঁ নিশীথ, এই অধ্যাপকের জন্যে তো একটা টিকিটের ব্যবস্থা করে দিতে হয়। নিশীথ শশব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। বুলুকে তো আমি বলেই ছিলাম।’ আমি উঠে দাঁড়িয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ততক্ষণে পাশের ঘরে বুলু আর নিশীথের লেনদেন চলছে।
অনুষ্ঠানটা ছিল সেই সন্ধেবেলায়ই। আমি বুলুর ওখানেই রয়ে গেলাম। বিকেলে মানসীরা এসে পড়ল। তারপর পাঁচজনে একত্রে যাত্রা। লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে হলে ঢোকা। হল তো নয়-লোকারণ্য।
সংগীতানুষ্ঠানের শুরুতে দিলীপকুমার মঞ্চে উঠে আহ্বান করলেন লতা মঙ্গেশকরকে। শ্রোতাদের করতালি থামতে চায় না। তার মধ্যে সায়রা বানু এসে পুস্পার্ঘ্য দিলেন লতাকে। তাঁকে সম্মান জানিয়ে দিলীপকুমার নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন উর্দুতে, তবে সে-উর্দু ফারসিবহুল। সব কথার অর্থ বুঝিনি, কিন্তু এমনই শ্রুতিমধুর তাঁর বাচন, শব্দের ঝংকার এমন লালিত্যপূর্ণ, এমন। দৃষ্টিনন্দন তাঁর সর্বদেহের ভঙ্গি যে সে-বক্তৃতা শোনাও এক পরম রমণীয় অভিজ্ঞতা। এরপর একে একে সহশিল্পীদের আবির্ভাব–আশা ভোসলে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নীতীন মুকেশ, বাদকবৃন্দ। ঘোষণায় বলা হলো, প্রথম দুজনের সঙ্গে গীত লতার কিছু জনপ্রিয় গান আবার তাঁদের কণ্ঠেই শোনা যাবে, আর মুকেশের সঙ্গে যেসব গান গেয়েছিলেন তিনি, তার কয়েকটি গাইবেন লোকান্তরিত শিল্পীর পুত্র নীতীনের সঙ্গে। নীতীন মঞ্চে প্রবেশ করে লতাকে প্রণাম করেছিলেন পা-ছুঁয়ে, তারপর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলেন লতার কাছে এই বলে যে, তাঁর বাবার গাওয়া গান তাঁর মতো অযোগ্য মানুষ গাইবার সুযোগ পাচ্ছেন লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে।
লতার একক গান, সহশিল্পীর সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গান এবং দু-একটি সম্মেলক গান হলো। আশা ও হেমন্তও একক গান গাইলেন ফাঁকে ফাঁকে। গনের মাঝে যে দু-চারটে কথা বললেন লতা মঙ্গেশকর–সেও অতি মধুর। সেদিন মিলনায়তন তেমন সজ্জিত ছিল না, মঞ্চসজ্জাও ছিল সাধারণ, কিন্তু কী যে অসাধারণ একটা আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল, তা বলার নয়। প্রতিটি গানের পরে শ্রোতাদের করতালি আনন্দ-হিল্লোল বইয়ে দিয়েছিল। কোথা থেকে যে দু-আড়াই ঘণ্টা চলে গেল, টের পাওয়া গেল না। অনুষ্ঠানশেষে দিলীপকুমার আবার মঞ্চে উঠলেন বিদায়বার্তা জানাতে, কিন্তু ততক্ষণে তাঁর কথা জড়িয়ে এসেছে–প্রারম্ভিক ভাষণের ইন্দ্রজাল অপগত হয়েছে। তারপরও, এমনকী মিলনায়তন থেকে বেরিয়ে আসার পরেও, মোহের ঘোর আমাদের কাটে না।
এই প্যালেডিয়ামেই আমরা পাঁচজন ইউল ব্রাইনারের দি কিং অ্যান্ড আইনাটক দেখতে গিয়েছিলাম। পঞ্চাশের দশকে তার চলচ্চিত্র আনা অ্যান্ড দি কিং অফ সিয়াম দেখে সকলে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তখন দেশের তরুণদের মধ্যে ইউল ব্রাইনারের মতো মাথা কামিয়ে ফেলার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। চলচ্চিত্রটি অমন সাড়া জাগিয়েছিল বলে তার নাট্যরূপ দেখার আগ্রহ ছিল বহুজনের। চলচ্চিত্রের অত কারিগরি সুবিধে থাকা সত্ত্বেও নাটকটি বহুগুণ ভালো লাগলো। সকলেই ভালো অভিনয় করেছিলেন, কিন্তু মনে হলো, ইউল ব্রাইনার একাই মাতিয়ে রাখলেন সবটা সময়। নাটকের শেষে মোহিত দর্শকেরা হলের বাইরে ভিড় করলো–নায়ককে এক নজর দেখবে কিংবা তার স্বাক্ষর শিকার করবে বলে। এমন ভিড়ভাট্টা অপ্রত্যাশিত ছিল না, তাই ইউল ব্রাইনার প্রেক্ষাগৃহের অত্যন্তরেই রয়ে গেলেন অনেকক্ষণ। পুরো ব্যাপারটা তখন ধৈর্যের প্রতিযোগিতায় পরিণত হলো। অভিনেতা বেরিয়ে আসেন না, দর্শকেরাও জায়গা ছাড়ে না। দু-চারজন যে রণে ভঙ্গ দেয়নি, তা নয়, কিন্তু বুলু ও মানসী পণ করেছে, অনুষ্ঠানপত্রে তার স্বাক্ষর নেবেই। দাঁড়িয়ে থাকতে মাসিমার কষ্ট হয়, সরোজ ও আমার ধৈর্য ফুরিয়ে আসে, কিন্তু আমাদের অন্য দুই সঙ্গিনী অদম্য। শেষ পর্যন্ত ইউল ব্রাইনার বেরিয়ে আসেন, প্রবল করতালি রাত্রির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, কেউ কেউ তার হাতে ফুল গুঁজে দেয়, কেউ কেউ দূর থেকে ফুল ছুঁড়ে দেয়, কেউ কেউ অনুষ্ঠানপত্র এগিয়ে দেয় স্বাক্ষরের দাবিতে। বুলু ও মানসী স্বাক্ষরসমেত অনুষ্ঠানপত্র নিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে ফেরে। বুলু তারটা আমাকে দান করতে চায়। আমি বলি, কী করবো নিয়ে, আমার তো অটোগ্রাফ জমাবার শখ নেই।’ সে বলে, এটা বাড়ি নিয়ে যাও, তোমার ছেলেমেয়েকে দিও-ওরা খুশি হবে। একবার ইচ্ছে হলো বলি, আমরা থাকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিভৃতে–সেখানে বাইরের পৃথিবীর আঘাত অতি মৃদু–আমার সাত থেকে পনেরো বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা ইউল ব্রাইনারকে জানার সুযোগ পায় না। কিন্তু বুলুর আন্তরিকতা দেখে তা আর বলা হয় না। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানপত্র নিই, দেশে ফিরে তা তুলে দিই ছেলেমেয়ের হাতে। তারা নেড়েচেড়ে রেখে দেয় সেটা, তারপর একসময়ে হারিয়ে ফেলে। আমার কাছে থাকলেও তার পরিণতি এমনি অমোঘ হতো।
এইবার প্রবাসকালে তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়ে গেল। প্রতিবারই তার স্ত্রী ছিলেন সঙ্গে, একবার ছিলেন তার মাও। অমিতা সেনের সঙ্গে সেই আমার প্রথম ও শেষ দেখা। ঢাকার স্মৃতি তাঁর চিত্তে দেদীপ্যমান। আমি সত্যেন সেনকে চিনি বলায় খুশি হলেন। নবনীতার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের কথাও বলেছিলাম। সে-সন্ধের বেশির ভাগ সময়টা তিনি কাটিয়েছিলেন আমার সঙ্গে গল্প করে। শান্তিনিকেতনের নানা প্রসঙ্গ তুলেছিলেন।
৪৪.
১৯৭৬ সালে আমাকে হারিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলা অনুষদের ডিন হয়েছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী। ১৯৭৮ সালে তিনি আবার একই পদের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাদের মনোনীত ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন। তিনি সেবার জয়লাভ করেছিলেন। ১৯৮০ সালে আমি প্রার্থী হলাম এবং এবারে নির্বাচিত হলাম। আলমগীর হয়তো দ্বিতীয়বার ডিন হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন মনে মনে, যদিও মুখ ফুটে কিছু বলেননি। তবে তাঁর সঙ্গে ধীরে ধীরে আমার একটা দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করলো।
এর মধ্যে আনোয়ার আবদেল-মালেক বললেন, দেশীয় সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে যদি আমি দু-একটি ওয়র্কশপ করতে চাই চট্টগ্রামে, তার প্রকল্প থেকে তার খরচ জোগানো যাবে। আমি কোমর বেঁধে লেগে গেলাম। দুজন তরুণ সহকর্মী আমাকে খুব সাহায্য করলেন। গোলাম মুস্তাফার বুদ্ধি-পরামর্শ খুব কাজে দিলো ওয়র্কশপের পরিকল্পনায়। আর সৌরেন বিশ্বাস গভীর পরিশ্রম করলো ওয়র্কশপের ব্যবস্থাপনায়।
ওয়র্কশপের নামটি লম্বা রাখা হলো : ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড দি ইন্টিগ্রেশন অফ ট্রাডিশনস অ্যান্ড মডার্ন অ্যাটিচুড়স। একটা উপ-শিরোনামও দেওয়া হলো : উইথ স্পেশাল রেফারেনস টু বাংলাদেশ অ্যান্ড দি ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট। প্রথম ওয়র্কশপ হলো ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে। উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল করিম উদবোধন করেছিলেন। উদবোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে। বাকি অধিবেশনগুলো চেরাগি পাহাড়ে মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের মিলনায়তনে। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় আর বাংলাদেশে–সব ছেড়ে-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যুক্ত উদ্যোগে এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে–এটি ছিল যথেষ্ট বিস্ময়ের ব্যাপার। তার ওপরে যখন জানা গেল যে, জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা-প্রকল্পের অধীনে মূলত আমার দায়িত্বে এটা ঘটতে যাচ্ছে, তখন বিস্ময়ের সঙ্গে হয়তো একটু অবজ্ঞাও মিশ্রিত হয়েছিল। তবু বিশিষ্টজনেরা এতে অংশ নিয়েছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে রাজি করিয়েছিলাম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল ভাষণ দিতে। তার অল্পসংখ্যক লেখার মধ্যে এটি একটি। আয়োজক কমিটির সভাপতি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজ্যেষ্ঠ ডিন সামাজিক বিজ্ঞানের আর আই চৌধুরী, সদস্য-সচিব ছিলেন বাংলা বিভাগের সভাপতি মনিরুজ্জামান। সকল ডিন এই কমিটির সদস্য ছিলেন, প্রকল্প-পরিচালক হিসেবে আমি সদস্য ছিলাম আর ছিল বিভাগের তিন শিক্ষক-দিলওয়ার হোসেন, চৌধুরী জহুরুল হক ও গোলাম মুস্তাফা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা অংশ নিয়েছিলেন–অনুপম সেন, মাহবুবউল্লাহ ও রফিউদ্দীন আহমদ প্রবন্ধ পড়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজির অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সরদার ফজলুল করিম, অর্থনীতির মুশারফ হোসেন, বাংলার আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও মনসুর মুসা, ইতিহাসের আবদুল মমিন চৌধুরী ও কে এম মোহসীন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের আবু ইমাম ও অর্থনীতি বিভাগের সনৎকুমার সাহা, বাংলাদেশ সরকারের
তৎকালীন অতিরিক্ত শিক্ষাসচিব আবদুল্লাহ আল মুতী, তাছাড়া হামিদা হোসেন হয়। অধিবেশনে সভাপতিত্ব, নয়তো প্রবন্ধপাঠ, নাহয় প্রবন্ধের আলোচনা করেছিলেন। মনে হয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীও (তিনি উপাচার্য হওয়ায় আমি যখন তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম, তখন তিনি বলেছিলেন, ভাইস-চান্সেলর হওয়াটা শিশুদের হাম হওয়ার মতো–একবার হয়ে গেলে আপদ চুকে যায়’) এসেছিলেন–প্রথমটায় যদি নাও এসে থাকেন, দ্বিতীয়টায় অবশ্যই এসেছিলেন।
দ্বিতীয় কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালের নভেম্বরে। এর উদৃবোধন করেছিলেন উপাচার্য আবদুল আজিজ খান। এবারেও উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। হয়েছিল ক্যাম্পাসে, বাকিসব চিটাগং পোর্ট ট্রেনিং সেন্টারের মিলনায়তনে। জায়গাটা একটু দূরে বটে, তবে এর সুযোগ-সুবিধে যথেষ্ট আছে এবং তার সবই পাওয়া গেল পোর্ট ট্রাস্টের সচিব মিজবাহউদ্দিন খানের সৌজন্যে। এর কর্মসূচিটি হাতের কাছে থাকায় সবটা তুলে দিতে পারছি :
উদবোধনী অধিবেশন
স্বাগত ভাষণ : মুহম্মদ আনিসুজ্জামান (সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন); উদবোধনী ভাষণ : এম আবদুল আজিজ খান। প্রকল্প-পরিচিতি : আনিসুজ্জামান; সভাপতির ভাষণ : জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। ধন্যবাদজ্ঞাপন : মনিরুজ্জামান। প্রথম অধিবেশন। প্রবন্ধ : আবদুল্লাহ্ আল-মুতী; আলোচক : এ কে শামসুদ্দীন আহমদ, এখলাসউদ্দীন আহমদ। প্রবন্ধ : শামসুল হক (আই ই আর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়); আলোচক : সরদার ফজলুল করিম, আবদুল্লাহ আল-মুতী। সভাপতির ভাষণ : আব্দুর রাজ্জাক।
দ্বিতীয় অধিবেশন
প্রবন্ধ : মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ; আলোচক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, গোলাম মুরশিদ। প্রবন্ধ : মনসুর মুসা; আলোচক : মোহাম্মদ আলী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল। সভাপতির ভাষণ : কবীর চৌধুরী।
তৃতীয় অধিবেশন
প্রবন্ধ : এম মোফাখখারুল ইসলাম; আলোচক : রেহমান সোবহান, মাহবুবউল্লাহ। প্রবন্ধ : সিরাজুল ইসলাম; আলোচক : সনকুমার সাহা, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর; প্রবন্ধ : মাহবুবউল্লাহ; আলোচক : আবদুল গফুর (বিআইডিএস), হামিদা হোসেন। সভাপতির ভাষণ : মুশারফ হোসেন।
চতুর্থ অধিবেশন
প্রবন্ধ : আবদুল মমিন চৌধুরী; আলোচক : আবু ইমাম, কে এম মোহসীন। প্রবন্ধ : রফিউদ্দীন আহমদ; আলোচক : আবদুল মমিন চৌধুরী, অনুপম সেন। সভাপতির ভাষণ : আবদুল করিম। পঞ্চম অধিবেশন প্রবন্ধ : মুইন-উদ-দীন আহমদ খান; আলোচক : আবদুল করিম, মুহম্মদ আবদুল গফুর (আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)। প্রবন্ধ : মুহম্মদ আনিসুজ্জামান; আলোচক : সিকান্দার খান, মইনুল ইসলাম। সভাপতির ভাষণ : আবু ইমাম।
সমাপ্তি অধিবেশন
একজন অতিথির ভাষণ; মনিরুজ্জামানের ধন্যবাদজ্ঞাপন; সভাপতির ভাষণে কর্মশালার আলোচনার সারসংক্ষেপ : আনিসুজ্জামান।
.
দুটি কর্মশালাতেই মানবিকী বিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের এতজন সাধক অংশগ্রহণ করেছিলেন, যা সচরাচর দেখা যায় না। আমাদের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও কোনো অভিযোগ শুনিনি। আমার সহকর্মীরা যেমন প্রাণপণে কাজ করেছিলেন, আমার পক্ষে তা ছিল শ্লাঘার বিষয়। অংশগ্রহণকারীদের সহযোগিতাও ছিল খুব উল্লেখযোগ্য। এ রকম কর্মশালা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। তা করেনি, তবে আনোয়ার আবদেল-মালেক খুশি হয়েছিলেন এবং আমাকে বলেছিলেন, পরে কোনো আন্তর্জাতিক আলোচনা সভায় এই কর্মশালার বিবরণ উপস্থাপন করতে। আমি তা করেছিলাম আলজিয়ার্সে, সে-কথা যথাসময়ে বলা যাবে।
৪৫.
১৯৭৯ সালে–আমার বিদেশযাত্রার অল্পকাল পরেই–দেশ থেকে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয়। তার কিছুকাল পরে ১৯৭৪ সালে জারিকৃত জরুরি অবস্থারও অবসান ঘটে এবং সংবিধানে দেওয়া নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাতে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়, তা নয়। তবু সামরিক শাসনের অবসান এবং মৌলিক অধিকারের পুনর্বহাল স্বস্তিকর অবস্থা বই কি! এ-সময়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের জাতীয় সম্মেলনে দলীয় রাজনীতির প্রারম্ভিক পর্যায়ে হঠকারিতা করা হয়েছিল বলে স্বীকার করা হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান খাল-খনন কর্মসূচি গ্রহণ করে অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধন করবেন বলে ঘোষণা দেন। এতে বেশ সাড়া পড়ে যায়। কমিউনিস্ট পার্টি পর্যন্ত এই কর্মসূচিকে সোৎসাহে সমর্থন করে। শুনেছিলাম, মণি সিংহ এ-বিষয়ে একমত হননি, কিন্তু পার্টির অধিকাংশ সদস্যের মত তিনি মেনে নেন। জিয়াউর রহমান কথায় কথায় বিপ্লবের ধুয়া তুলতে থাকেন এবং সাধারণ মানুষ বুঝিলাম, নাই বুঝিলাম, জয় তব জয়’ ভাব নিয়ে তাঁকে সংবর্ধিত করে। তরুণদের মধ্যে জাসদ তখনো জনপ্রিয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পড়তে যায় মাহমুদুর রহমান মান্না। সেখানে সে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়। আওয়ামী লীগ তখনো বাকশালে-আওয়ামী লীগে এবং আওয়ামী লীগের একাধিক দলে বিভক্ত। তবে তারাও ঘর গোছাতে শুরু করে।
১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের–অন্য কথায়, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের–পঞ্চাশ বর্ষপূর্তি। চট্টগ্রামে তা উদ্যাপনের জন্যে নাগরিকদের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠিত হয় আমাকে সভাপতি এবং সদ্যপ্রয়াত অ্যাডভোকেট শফিউল আলমকে সম্পাদক করে। সেদিনকার বিপ্লবীদের মধ্যে বিনোদবিহারী চৌধুরী, কালীপদ চক্রবর্তী ও অনঙ্গ সেন আমাদের মধ্যে থাকায় আমরা খুব উৎসাহিত বোধ করি। যে-জালালাবাদ পাহাড়ে সূর্য সেনেরা যুদ্ধ করেছিলেন, তা এখন চট্টগ্রাম সেনানিবাসের চৌহদ্দির অন্তর্ভুক্ত। আমরা সেখানেই একটি স্মারকস্তম্ভ নির্মাণের প্রস্তাব করি। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এবং ঢাকায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ-বিষয়ে চিঠি লিখে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তখন কমিটির পক্ষ থেকে আমরা কয়েকজন চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মনজুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি জানান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতির জন্যে আমাদের চিঠি ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে কোনো আপত্তি না জানালে–সম্ভবত অনুমোদন ও বাধা কোনোটাই আসবে না–তিনিই স্মারকস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুমতি দেবেন নিজের দায়িত্বে। আমাদের প্রতিনিধিদলকে সঙ্গে নিয়ে সেদিনই তিনি স্মারকস্তম্ভের জায়গাটি চিহ্নিত করেন। আমরা লিখিতভাবে ও মৌখিকভাবে তাকেই অনুরোধ করি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্যে। তিনি সম্মতি দেন।
জিওসির দপ্তরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আঁকা কয়েকটি তৈলচিত্র টাঙানো ছিল। কিছুক্ষণ পর পর সেদিকে আমার চোখ যাচ্ছিল। তা লক্ষ করে জেনারেল মনজুর বললেন, ‘এগুলো আমি আঁকিয়েছি। ছবিতে যাদের মুখ দেখছেন, তারা সবাই। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, শিল্পীর কল্পনা নয়। ছবি আঁকাবার জন্যে আমি তাদের জড়ো করিয়েছিলাম। আমি তাঁর উদ্যোগের প্রশংসা করলে তিনি মৃদু হাসেন। আমি এক ফাঁকে তাঁর স্কুলজীবনের সহপাঠী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোকাদ্দেসুর রহমান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবদুল মমিন চৌধুরীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগের কথা। বলি। তিনি আরমানিটোলা স্কুল নিয়ে সামান্য স্মৃতিচারণ করেন। স্থির হয়, ১৮ এপ্রিল সকালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে এবং সেদিন সকলে অবাধে সেনানিবাসে প্রবেশ করতে পারবেন।
চট্টগ্রাম বিপ্লবের পঞ্চাশবর্ষপূর্তি উদ্যাপন পরিষদের সভাশেষে একদিন বেরিয়ে আসছি। দেখি, এক তরুণ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই সরকারি গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মী বলে মনে হয়। সে-ও আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। বোঝাই গেল, আমাকে সে চেনে না। সে জানতে চাইলো, আমি মিটিং থেকে বের হচ্ছি কি না। আমার হাঁ-সূচক উত্তর শুনে সে প্রশ্ন করলো, চট্টগ্রামে বিপ্লব করা সম্পর্কে সভায় কী স্থির হলো। তার জ্ঞানের বহর দেখে আমি বিস্মিত হলাম। পালটা প্রশ্ন করলাম, সে এই সভার খবর পেল কোথা থেকে? সে বললো, খবরের কাগজ থেকে। আমি বললাম, আজ স্থির হয়েছে যে, ১৮ এপ্রিলে আমরা সবাই ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে বিপ্লব করবো। আপনিও আমাদের সঙ্গে আসতে পারেন।’ বেচারির একেবারে ভিরমি খাওয়ার অবস্থা।
১৮ এপ্রিল সকালে ক্যাম্পাস থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে সেনানিবাসের একটি প্রবেশদ্বারে আমার আগমনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে গন্তব্যে কীভাবে পৌঁছাবো জানতে চাওয়ায় কর্তব্যরত প্রহরী নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো, ‘সামনে গিয়ে ডান দিকে যান–ধুতি, হারমোনিয়াম, সব ওদিকেই গেছে।’ তিক্ততা নিয়েই যথাস্থানে পৌঁছোলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে সবাই এসে পড়লেন। কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে জেনারেল মনজুর এলেন নির্ধারিত সময়ের একটু পরে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, তার সহকর্মীরা দায়ে পড়ে এসেছেন–তাঁরা আদৌ এ বিষয়ে আগ্রহী নন। মনজুর এসে আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বলেছিলেন, সূর্য সেনের সহযোগী বিপ্লবীদের কয়েকজন চট্টগ্রামে আছেন–তাঁরা কি এসেছেন?’ বললাম, তারা এখানেই আছেন। উনি বললেন, ‘আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিন। আমি আলাপ করিয়ে দিলাম। মনজুর তাদের বললেন, আপনারা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন–আমি আপনাদের পেছনে থাকবো। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, আপনি আমার পাশে থাকবেন। আমি বললাম, ‘ভিত্তিপ্রস্তরে তো আপনার নাম লেখা হয়েছে–আপনি স্থাপন করলেই ভালো হয়। মনজুর বললেন, ‘লেট’স পে হোমেজ টু হিস্ট্রি। আমি তার কথা শুনে গভীরভাবে আপ্লুত হলাম।
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জায়গায় বিনোদবিহারী চৌধুরী, কালীপদ চক্রবর্তী ও অনঙ্গ সেন সামনে দাঁড়ালেন, তার পেছনের সারিতে সামরিক পোশাকে জেনারেল মনজুর, সঙ্গে আমি, তার পেছনে ইউনিফর্মপরা সামরিক কর্মকর্তারা, তার পেছনে বাকি সবাই। বিপ্লবীরা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। মনজুর স্যালুট দিলেন। সেনাবাহিনীর ছোটো বাদকদল বিউগল বাজালো। তারপর দু-তিনটি গান পরিবেশিত হলো। সকালের অনুষ্ঠানের সেখানেই সমাপ্তি। জেনারেল মনজুর ও তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে করমর্দন করে ফিরে এলাম।
সন্ধ্যায় মুসলিম ইনসটিটিউটে স্মরণসভা। প্রধান অতিথি হয়ে ঢাকা থেকে এসেছেন বিচারপতি সৈয়দ মুহম্মদ হোসেন। রেলস্টেশন থেকে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের বাড়িতে। তাঁর সঙ্গ মানেই আনন্দের উৎস। সভাস্থলে তিনি একটু আগে আসতে চাইলেন–সকলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হবে, এই কারণে। তাই হলো। কিছুকাল আগে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাঁর মৌখিক ভাষণ টেপ থেকে অনুলিখিত হয়ে মহানায়ক বঙ্গবন্ধু’ নামে পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং তাৎক্ষণিক সাড়া জাগায়। ফলে, তার বক্তৃতা শুনতে মানুষের খুব আগ্রহ ছিল, তাঁকে দেখতে ও তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতেও অনেকে উৎসুক ছিলেন। ফলে তাঁকে ঘিরে সর্বক্ষণ ভিড় লেগে ছিল। সেই সন্ধ্যায় তিনি খুব উদ্দীপনাময় ভাষণ দিয়েছিলেন–তাতে স্বাধীনতা-ঘোষণার বিষয় নিয়ে জিয়াউর রহমানের নাম না করে তাঁর প্রতি কিছু শ্লেষোক্তি ছিল। শ্রোতারা তাঁর বক্তৃতা খুব উপভোগ করেছিলেন। প্রধান অতিথি সেই রাতের ট্রেনেই ঢাকায় ফিরে যান।
৪৬.
রুচি এসএসসি পরীক্ষা দিলো ১৯৮০ সালে। ওই পরীক্ষায় তার একটি বিষয় ছিল সংগীত। বোর্ডের নিয়মানুযায়ী, সংগীতের পরীক্ষা দিতে হবে কুমিল্লায়, বোর্ডের অফিসে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে আমি গাড়ি চালিয়ে গেলাম কুমিল্লায়, উঠলাম বোর্ডেরই অফিস-সংলগ্ন অতিথি-নিবাসে। যতদূরসম্ভব আত্মগোপন করে থাকলাম–বেশি প্রকাশিত হলে মনে হতে পারে, মেয়ের পরীক্ষার তদৃবির করতে এসেছি। খাওয়া-দাওয়া সারলাম বোর্ড অফিসের উলটোদিকের ছালাহউদ্দীন রেস্টুরেন্টে। কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষা-নিয়ন্ত্রক শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে আকস্মিকভাবে দেখা হয়ে গেল–তিনি তাঁর সরকারি বাসভবনে যেতে বললেন। তাঁর স্ত্রী আমার সহোদরাতুল্যা–আবাল্য তাকে বকুল আপা বলে ডাকি। সুতরাং যেতেই হলো এবং চায়ের সঙ্গে বকুনি খেতে হলো-কুমিল্লায় এসেছি, তাও সপরিবারে, অথচ নিজে থেকে দেখা করিনি। আমার শ্যালক আজিজের বন্ধু–এখন আর সে নেই–দেওয়ান তাইয়েবুর রহমান তখন যমুনা অয়েল কোম্পানির কুমিল্লা অফিসের কর্মকর্তা। কীভাবে যেন খবর পেয়ে সে আমাদের খুঁজে বের করলো এবং ক্রমাগত আফসোস করতে থাকলো। সে কুমিল্লায় আছে, আর আমরা কিনা তার ওখানে না উঠে থাকছি বোর্ড অফিসের অতিথিশালায়, আর খাচ্ছি ছালাহউদ্দীন রেস্টুরেন্টে–এর চেয়ে বড়ো অঘটন আর কী হতে পারে! কবুল করতেই হলো যে, সে যে কুমিল্লায় আছে, সেকথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। সেদিনই দুপুরে ওদের বাড়ি যেতে হলো। তার স্ত্রী নাজমা সেই দুপুরেই ঢাকায় ফিরে যাবে–তারই মধ্যে রান্নাবান্না করে সযত্নে আমাদের খাওয়ালো। তাদের ছেলেমেয়েরা তখন খুবই ছোটো। এখন তো নাজিয়া আন্দালিব প্রিমা চিত্রশিল্পী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দেওয়ানের বাড়ি থেকে খেয়েই আমরা চট্টগ্রামের পথে রওনা হলাম।
যে-সন্ধ্যায় সেবারে এসএসসির ফল প্রকাশিত হলো, সে-সন্ধ্যায় রুচির ফলাফলের খবর পাইনি, কেননা, শহর থেকে দূরে হওয়ায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে (স্কুল ও কলেজ শাখা মিলিয়ে) কাগজপত্র এসে পৌঁছোতে দেরি হয়। পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান সহকারী আবদুর রশীদ শহর থেকে বিভাগে পৌঁছে আমাকে ফোনে জানালেন, মেধা-তালিকায় রুচি অষ্টম স্থান পেয়েছে, দৈনিক আজাদীতে পুরো তালিকা বেরিয়েছে, বিভাগের পিয়ন দিয়ে তিনি কাগজটা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। খবরটা পেয়ে কী যে অভিভূত হয়ে গেলাম–তা বলার নয়। তারপরেই কলেজের স্কুল শাখার প্রধান শিক্ষক ফোন করলেন, রুচিকে এবং তার বাপ-মাকে অভিনন্দন জানাতে। তাকে বললাম, মেয়ের লেখাপড়ার বিষয়ে আমার কোনো ভূমিকা নেই, কিছু আছে তার মায়ের, বেশি আছে তার শিক্ষকদের আর এখলাসউদ্দীনের। এখলাসউদ্দীন আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক-কলেজটির দেখাশোনা করার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব তিনি নিয়েছিলেন। তাঁর সমালোচকেরা বলতেন, নিজের বিভাগের চেয়ে কলেজের দিকে তার মনোযোগ বেশি। কথাটা খুব মিথ্যে নয়। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর প্রতি তার নজর ছিল–তাদের মধ্যে যারা ক্যাম্পাসে থাকতো, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি পড়াতেন এবং পড়াশোনার তত্ত্বাবধান করতেন। রুচিদের গৃহশিক্ষক ছিলেন তাদেরই স্কুলশিক্ষক আলেফ হোসেন। তিনি খুবই যত্নের সঙ্গে ওদের পড়িয়েছিলেন। ফলাফল জেনে এখলাস এলেন মুচকি হাসতে হাসতে–তারপর অন্য প্রতিবেশীরা। খাওয়াদাওয়া ছাড়াই এক মহোৎসব হয়ে গেল।
সেইবারই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার কৃতী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে হিজবুল বহরজাহাজে আনন্দ-ভ্রমণে গিয়েছিলেন। রুচি যায়নি–সম্ভবত তার চেয়ে যারা পরীক্ষায় ভালো ফল করেছিল, তাদেরই নিমন্ত্রণ ছিল। তবে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির দেওয়া সংবর্ধনায় সে উপস্থিত ছিল। টেলিভিশনে হিজবুল বহর অধ্যায়ের যে-দৃশ্য দেখেছিলাম, তা আমার কাছে প্রীতিপ্রদ মনে হয়নি। দেখলাম, জিয়াউর রহমান বক্তৃতা দিচ্ছেন, আর তার পায়ের কাছে সুরের কুসুমগুলির মতো ছড়িয়ে আছে ছাত্রছাত্রীরা, সামনের দিকে শিক্ষকেরাও আছেন। সেখানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ কে এম আমিনুল হকও ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন, তখন তাঁকে দেখেছি গোঁফ-দাড়ি কামানো এবং নিখুঁত পাশ্চাত্য পোশাকে সুসজ্জিত। পরবর্তীকালে ধর্মানুরাগবশত তিনি বেশ বড়ো দাড়ি রেখেছিলেন এবং আলখাল্লা গোছের পোশাক পরার অভ্যাস করেছিলেন। জিয়াউর রহমান বক্তৃতার মাঝখানে তাকে যেভাবে ‘এই যে মৌলভি সাহেব বলে সম্বোধন করছিলেন, তাতে তার প্রাপ্য সম্মান জানানো হয়নি বলে আমার মনে হয়েছিল।
এই হিজবুল বহর-ভ্রমণ থেকেই বাংলাদেশের ছাত্র-রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। কৃতী ছাত্রদের অনেককে রাষ্ট্রপতি কাছে টেনে নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তার মানে দাঁড়িয়েছিল তাঁর রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হওয়া। ছাত্র-রাজনীতি করলে ক্ষতি ছিল না, কিন্তু কৃতীদের কেউ কেউ যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের নেতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেটাই ছিল সবচেয়ে শোচনীয় ব্যাপার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-সংঘর্ষ তার আগেই শুরু হয়েছিল, এবারে সে-সংঘাত প্রবল হলো।
৪৭.
১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে নোবেল পুরস্কারবিজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম। এলেন বাংলাদেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এম হারুন অর রশীদ তাঁর এই সফরের আয়োজন করেন। সুতরাং তিনি এসেছিলেন মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই। এই সুযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিএসসি উপাধিতে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পেছনে বেশি সক্রিয় ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এখলাসউদ্দীন। আহমেদের উদযোগ, তবে উপাচার্য আবদুল করিমেরও যথেষ্ট আগ্রহ ছিল এ বিষয়ে। অধ্যাপক সালামের মতো গুণী মানুষকে আমাদের মধ্যে পেয়ে আমরা খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম।
কাছাকাছি সময়ে আরেক গুণী মানুষকে আমাদের মধ্যে পেয়েছিলাম। তিনি সমাজবিজ্ঞানী রামকৃষ্ণ মুখার্জি। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আমন্ত্রণে–এ কে নাজমুল করিম স্মারক বক্তৃতা দিতে–ওই স্মারক বক্তৃতার শুরুই হয়েছিল তাঁকে দিয়ে। এই সুযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগ তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ওই বিভাগে একটা বক্তৃতা দিতে। তিনি সম্মত হয়েছিলেন এই শর্তে যে, চট্টগ্রামে তিনি থাকবেন আমার বাড়িতে। আমি বাংলার ছাত্র হয়ে অত নামজাদা সমাজবিজ্ঞানীর প্রিয়পাত্র হলাম কী করে, এ-প্রশ্ন আমাদের অনেক সহকর্মীকে আলোড়িত করেছিল। অধ্যাপক মুখার্জি বক্তৃতা দিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগে আর সস্ত্রীক থাকলেন আমার ক্যাম্পাসের বাড়িতে। পূরবী মুখার্জির সঙ্গে আমার সেই প্রথম পরিচয় হলো–নিজের গুণে তিনি আমাদের সবাইকে অল্প সময়েই আপন করে নিয়েছিলেন। আনন্দ তখন বছর আটেকের ছেলে–সে রামকৃষ্ণ মুখার্জির খুব ভক্ত হয়ে গেল, তার আয়েশের দিকে খুব নজর রাখতে থাকলো। তার ক্ষিপ্রতা দেখে মুখার্জি তাকে ডাকতে শুরু করলেন ম্যানেজার বলে। কিছু দরকার হলে আমাকে না ডেকে আনন্দকে ডাকতেন। বলতেন, ওকে বললে সব ম্যানেজ করে দেবে। ওঁদের নিয়ে সপরিবারে রাঙামাটি গেলাম গাড়ি চালিয়ে গিয়ে অবশ্য বিজ্ঞপ্তি দেখলাম, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বিদেশিদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ। একটু ভয় পেলাম। তবে সবটা নির্বিঘ্নে কাটলো। রামকৃষ্ণ মুখার্জি অনর্গল কথা বলে গেলেন–আমরা শুনতে থাকলাম।
এর আগেরবার রাঙামাটি গিয়েছিলাম কুণ্ঠিত হয়ে। ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ আমার ছোটো ভায়রা মোবারক হোসেনের বড়ো ভাই। তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে থাকতে আমাদের দুই পরিবারে বেশ যাতায়াত ছিল। তিনি সদ্য বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমির কম্যান্ডান্ট নিযুক্ত হয়েছেন–তার আগে তার দায়িত্ব ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে। হান্নান শাহ চাইলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে আসার আগে আমাদের একবার সে-অঞ্চল ঘুরিয়ে আনবেন। তাঁর পরিবারের সঙ্গে আছেন বিএমএ-র বিদায়ী কম্যান্ডান্ট মেজর জেনারেল আবদুর রহমান এবং পার্বত্য এলাকায় নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুস সালাম সপরিবারে। চতুর্থ পরিবার আমাদেরটা। সামরিক বাহিনীর গাড়িতেই ক্যাম্পাস থেকে রাঙামাটি গেলাম। সেখানে ওঠা হলো লঞ্চে–জলপথেই বেশির ভাগ সময় বেড়িয়ে ও খেয়ে রাঙামাটি ফেরা। আবার সড়কপথে চট্টগ্রাম-প্রত্যাবর্তন।
আবদুর রহমান যখন ব্রিগেডিয়ার হিসেবে বিএমএ-র কম্যান্ডান্ট ছিলেন, তখন কোনো একটা উপলক্ষে আমি তাঁদের অ্যাকাডেমিতে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। তখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়। কথায় কথায় আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তরুণ সামরিক কর্মকর্তাদের দেখি অন্যের সঙ্গে খুব রূঢ় আচরণ করতে, এর কারণ কী?’ তিনি বলেছিলেন, আপনি যাদের কথা বলছেন, ওরা নিশ্চয় ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। অল্পবয়সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কঠোর শাসনের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। আদেশ দিতে ও মানতে শিখেছে, মায়া-মমতা পায়নি, করতেও শেখেনি। তারপর তাঁর বিএমএ-র এক ছাত্রের কথা বললেন। তার পিতৃবিয়োগের সংবাদ পেয়ে তিনি তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কারণ না জানিয়েই। সে ফিরে আসার পরে তাকে নিজের অফিসে ডেকে পাঠিয়ে যখন সমবেদনা জানিয়েছিলেন, তখন সে বেশ চটপটে ভাবেই বলেছিল, তার খুব অসুবিধে হবে না। জেনারেল রহমান বলেছিলেন আমাকে, নিজের পরিবারের জন্যেই যার টান নেই, দেশের প্রতি তার টান আসবে কোথা থেকে? তাঁর সেদিনের কথাবার্তায় আমার মনে শ্রদ্ধামিশ্রিত বিস্ময় জেগেছিল।
হান্নান শাহর আমন্ত্রণে ভ্রমণে গিয়ে মেজর জেনারেল আবদুর রহমানের সঙ্গে এবার পরিচয়টা প্রগাঢ় হলো। তিনিই বললেন, তাঁর ছেলের নাম রেখেছেন আমার শিক্ষক মুহম্মদ আবদুল হাই। হাই সাহেবের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তার তদানীন্তন শ্বশুর ড. আবদুল মতিন চৌধুরীর মাধ্যমে। এতক্ষণে তাঁর পরিচয় আমার কাছে স্পষ্ট হলো। আমিও এই সুযোগে বললাম যে, তাঁর প্রথম শাশুড়ি–তাছাড়াও আত্মীয়া–রাজিয়া মতিন চৌধুরী নিজের অদৃষ্টদোষে আমার ছাত্রী হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মনে হলো, ব্যাপারটা তাঁর অজানা নয়।
তিন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে অনিবার্যভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সম্পর্কে আলাপ হলো। সেখানকার রাজনৈতিক সমস্যার যে-সামরিক সমাধান আমাদের সরকার খুঁজছেন, তা যে সফল হতে পারে না, সে সম্পর্কে আমার দৃঢ় বিশ্বাসের কথা আমি ব্যক্ত করলাম। ওঁরা বললেন, বিদ্বজ্জনেরা বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে থাকেন এবং আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আমি মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা বললাম, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপিনসের নজির দেখালাম। ওঁরা জানতে চাইলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশের যেসব স্থাপনা আছে–যেমন, পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প কিংবা উপগ্রহ যোগাযোগ-কেন্দ্র–এসব কি আমি পাহাড়িদের কাছে সমর্পণ করতে বলি? আমি বললাম, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসকেরা তো এই ধরনের চিন্তা করেছিলেন। পাহাড়িরা পুরো দেশটাকে নিজের বলে ভাবতে না পারলে একদিন তারা বিচ্ছিন্নই হয়ে যাবে। পার্বত্য এলাকায় বাঙালিদের বসতিস্থাপন করে আমরা যে-পথে অগ্রসর হচ্ছি, তা বাংলাদেশকে আপন ভাবতে তাদের সাহায্য করবে না।
মতপার্থক্য হলেও আমরা কেউ উত্তেজিত হইনি, কেউ আমার দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করেননি।
লঞ্চে যেতে যেতে এক তীরে কিছু পাহাড়িকে চলাফেরা করতে দেখেছিলাম। আমাদের প্রতি তাদের দৃষ্টিতে প্রবল ঘৃণা ছিল বলে মনে হয়েছিল। ক্যাম্পাসে ফিরে আসার পরে বেবীও আমাকে তার ঠিক একই অনুভূতির কথা বলেছিল।
৪৮.
সৃষ্টিশীলতা নিয়ে সিম্পোজিয়াম। এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার পর এবার আরব ভুবন। পর্যায়ক্রমে তৃতীয় সম্মেলন। এটি অনুষ্ঠিত হলো কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেক্সিকোতে যে-কুয়েতি অধ্যাপকের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল, তিনিই এর আয়োজক।
আমাদের থাকার ব্যবস্থা কুয়েত-শেরাটনে। ঘরের টেবিল-ল্যাম্পটা কাজ করছিল না। আমার নালিশের জবাবে যে-তরুণ সেটা সারাতে এলো, সে কাজ করতে করতে প্রশ্ন করলো, আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?’ বললাম, না, আমি এসেছি বাংলাদেশ থেকে। তখন সে হৃষ্টচিত্তে জানতে চাইলো, বাংলাদেশে কোথায় থাকেন আপনি?’ চট্টগ্রাম শুনে সে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় প্রশ্ন করলো, চট্টগ্রামের কোথায়? বুঝিয়ে বললাম। সে নিজে চট্টগ্রামের সন্তান–চাকরি নিয়ে এখানে এসেছে বৎসরাধিককাল। তার সনির্বন্ধ অনুরোধ, যে-কোনো প্রয়োজন হলে তাকে যেন খবর দিই, সে যথাসাধ্য করবে।
কুয়েত শহরের রাস্তাঘাটে বেশি পুলিশ লক্ষ করলাম না, কিন্তু সকলেই দেখি, ট্রাফিক সিগনাল মেনে চলছে। ঢাউস ঢাউস গাড়ির চালকেরা সকলেই পথচলার অগ্রাধিকার দিচ্ছে পথচারীকে। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, সুবিন্যস্ত রাস্তাঘাট।
সম্মেলনস্থানে এক কুয়েতি বললেন, আপনার নামটা বেশ অভিনব–আনিসুর রহমান, আনিসুল ইসলাম নয়, আনিসুজ্জামান। এমনটা আর শুনিনি। আমি কিছু বলার আগে পাশ থেকে আরেক আরব বলে উঠলেন, অবাক হওয়ার কী আছে? আনিস আল-জামান, যুগবন্ধু। খাঁটি আরবি নাম। প্রথম ব্যক্তি জানতে চাইলেন, তিনি কোন দেশ থেকে এসেছেন। দ্বিতীয়জন জানালেন, মিশর। প্রথমজন বললেন, মিশরে হয়তো আপনারা এ-ধরনের নামের সঙ্গে পরিচিত, আমরা, কুয়েতিরা, নই।
আয়োজক অধ্যাপক একটু পরে এলেন, আমাকে দেখে সহর্ষে জড়িয়ে ধরলেন। আমি বললাম, তোমাকে যে আমি লন্ডন থেকে সুটকেস পাঠালাম, সেটা পেয়েছিলে? সে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, অবশ্যই অবশ্যই। তুমি আমার প্রিয় ভ্রাতা। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। বললাম, তুমি একবার প্রাপ্তিস্বীকার পর্যন্ত করলে না! (আমার টাকা খরচের কথা মুখ ফুটে বললাম না, ভাবলাম, এই প্রসঙ্গে তার মনে পড়বে।) সে বললো, প্রাপ্তিস্বীকার করিনি? নিশ্চয় করেছি। তুমি আমার প্রিয় ভ্রাতা। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। তবে তার কথা শুনে স্পষ্টই বোঝা গেল, প্রাপ্তিস্বীকারের ইচ্ছে থাকলেও সেটা করা হয়ে ওঠেনি তার পক্ষে।
চিঠিতে আনোয়ার আবদেল-মালেক লিখেছিলেন, সম্মেলনে আমার কোনো প্রবন্ধ পড়বার দরকার নেই। পঠিত প্রবন্ধ এক-আধটা আলোচনা করলেই হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর তিনি বললেন, প্রিয় আনিস, তোমাকে বলেছিলাম, কিছু লিখতে হবে না। এখন দেখছি, লেখা দরকার। তুমি ভাই রাতের মধ্যে একটা লেখা তৈরি করে ফেলল।
সারারাত জেগে লিখলাম–অ্যান আউটসাইডার’স ভিউ অফ অ্যারাব এনডোজেনাস ইন্টেলেকচুয়াল ক্রিয়েটিভিটি। সারকথা : আরব সৃষ্টিশীলতায় আমি তিনটে বৃত্ত দেখতে পাই। প্রথমটি আঞ্চলিক, উপজাতীয়ও বলা যেতে পারে-আরবদের মধ্যেই অঞ্চলভেদে তার রকমফের আছে। দ্বিতীয়টি ইসলামি–এটা তারা ভাগ করে নেয় সংখ্যাগুরু অনারব মুসলমানের সঙ্গে। তৃতীয়টি অপেক্ষাকৃত আধুনিকতার যোগ সারা বিশ্বের সঙ্গে। প্রায় বছর দুই পরে মরক্কোর কিং হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের মিশরীয় অধ্যাপক হাসান হানাফি আমাকে বলেছিলেন, আরবরা যে মুসলমানদের মধ্যে সংখ্যালঘু, এ কথাটা তুমিই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলে-সেকথা আমার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছি।
রাতে খাওয়ার সময়ে লক্ষ করলাম, অদূরে এক টেবিলে অধ্যাপক আবুদস সালাম আসীন। তাঁর কাছে গিয়ে পরিচয় দিলাম। চট্টগ্রামের স্মৃতি তার একেবারেই সাম্প্রতিক। সুতরাং খুশি হয়েই আমাকে গ্রহণ করলেন। তিনি কুয়েতে এসেছেন আরেকটি আলোচনা-সভায় যোগ দিতে। শেরাটনেই আছেন।
আনোয়ার আবদেল-মালেককে জানালাম, সালাম এই হোটেলেই আছেন। তিনি তাঁকে সম্মত করালেন আমাদের সমাপ্তি অধিবেশনে কিছু বলতে।
পরে, আমার সঙ্গে আলাপে, সালাম খুব হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর আশা ছিল, আরব দেশগুলোর কোনো একটিতে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণার জন্য ত্রিয়েস্তের মতো একটি কেন্দ্রস্থাপনে তেল-সম্পদের এই মালিকদের উৎসাহিত করতে পারবেন। তাহলে তরুণ মুসলমান গবেষকেরা সেখানে। জড়ো হয়ে গবেষণা করতে সমর্থ হবে। কিন্তু সে-বিষয়ে এঁরা কেউ সাড়া দিলেন না। তিনি আরো বললেন, দেখো, এরা কল-কারখানা বসাচ্ছে বটে, তার সবই টার্ন-কি ব্যবস্থায়। ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা জাপান ঠিকা নিয়ে কাজটা করে দিচ্ছে–এরা কেউ চোখে দেখে শিখতেও চাইছে না। তেলের টাকার গরমে এদের মাথা গরম–নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববারও সময় নেই। সালামের ইসলাম ও মুসলমানপ্রীতি সুবিদিত। আমি একসময়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি শেষ কবে গেছেন পাকিস্তানে। দুঃখের সঙ্গেই বললেন তিনি, পাকিস্তানে আহমদিয়াদের অমুসলমান ঘোষণা করার পরে স্বদেশে আর তিনি যাননি।
আয়োজকরা অনারব প্রতিনিধিদের সঙ্গে কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে দোভাষী যুক্ত করেছিলেন। যে-ছেলেটি আমার ভাগে পড়েছিল, বুঝলাম, সে সম্পন্ন ঘরের ছেলে। সে ইংরেজি ভাষার ছাত্র, তবে তার পোশাক ঐতিহ্যবাহী আরবদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেওয়াজ-অনুযায়ী আগের বছর গ্রীষ্মকালে সে ইংল্যান্ডে গিয়েছিল ভাষাটা রপ্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয়েরই খরচে। দুটি মেয়ে-দোভাষীর সঙ্গে সে আমার পরিচয় করিয়ে দিলো–তারা ফরাসি পড়ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে–তারাও সেবারে ঘুরে এসেছে প্যারিস। সম্মেলনের অবকাশে ওদের তিনজনকে নিয়ে কফি শপের এক টেবিলে বসে গল্প করলাম। তরুণটি বললো, লেখাপড়া শেষ করে সে ইংল্যান্ডে নাহয় আমেরিকায় চলে যাবে। কুয়েতে কোনো লাইফ নেই, আছে কেবল ভণ্ডামি। এই শেরাটনে পর্যটকেরাও হার্ড ড্রিংক খেতে পায় না, অথচ সম্পন্ন সব কুয়েতির বাড়িতে একটি করে সেলার আছে। সপ্তাহান্তে ট্রেলার নিয়ে তারা চলে যায় শহরের বাইরে–ফ্রিজে পানীয় ভর্তি করে নিয়ে যায়, খালি বোতল সেখানেই ফেলে আসে। মেয়েদুটির দ্বিতীয় ভাষা যদিও ফরাসি, তবু ইংরেজি খানিকটা বলতে পারে। তারা পরেছে একই রকম পাশ্চাত্য পোশাক। ওদের মধ্যে একজনকে খুবই কমবয়সী মনে হয়েছিল। শুনলাম, তার বিবাহবিচ্ছেদ পর্যন্ত হয়ে গেছে। সেও ভাবছে, পড়াশোনার শেষে ফ্রান্স বা সুইজারল্যান্ডে চলে যাবে। আমার দোভাষীকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা সবাই চলে গেলে দেশে থাকবে কে? আমদানি-করা এভিয়র বোতল থেকে পানি খেতে খেতে সে বললো, যারা নিরুপায়, তারা থাকবে। আর জনশক্তি আমদানি হবে এই এভিয়র বোতলের মতো। সবই তো আমরা আমদানি করি।
কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিভাগের সেক্রেটারি মেয়েটি মিশরীয়। সে বহু বছর এখানে কাজ করছে। সে কথায় কথায় বললো, কুয়েতিরা অ-স্থানীয়দের কখনো মর্যাদার চোখে দেখে না। আমি যে আরব, কিন্তু তাও কখনো এদের কাছে সমকক্ষ হতে পারব না।
এক ফিলিস্তিনি মহিলা–ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক-অনুযোগ করলেন স্বদেশীয়দের সম্পর্কে। বললেন, যারা ফিলিস্তিনে আছে, তারা সংগ্রাম করছে, কষ্টস্বীকার করছে। আমার মতো যেসব ফিলিস্তিনিকে তুমি বিদেশে দেখো, তারা প্রায় সকলেই বিলাসী জীবনযাপনে ব্যস্ত, নইলে কীভাবে তেমন জীবন যাপন করা যায়, তার সন্ধানে রত। আরব দেশগুলোতে আমরা আশ্রয় পাই, কাজ পাই, কিন্তু তারা আমাদের কখনো আপন করে নেয় না।
কুয়েতে সম্মেলনটা হয়েছিল পাঁচ দিন ধরে। সুতরাং সাধারণত সম্মেলনে যেমন চাপ থাকে, তার থেকে এটি ছিল মুক্ত। আমরা বেশ হেসে খেলে বেড়িয়ে গল্প করেও অধিবেশনে যোগ দিতে পেরেছি। খাওয়া-দাওয়াও ছিল অপর্যাপ্ত। বিদায়ী নৈশভোজটা হয়েছিল শেরাটনের ব্যাংকোয়েট হলে। স্থানীয় আমির-ওমরাহ গণ্য-মান্যেরা এসেছিলেন। হলে ঢুকতেই দরজার দু পাশে দুটি আস্ত রোস্ট ল্যাম–সঙ্গে কার্ভিংয়ের হরেকরকম ছুরি-কাঁটা-চামচ। তারপর অফুরান খাদ্যসামগ্রী টেবিল ভরে। সময় হলে প্রথমে অতিথিদের বলা হলো খাবার নিতে। আমরা সে দুম্বার খানিকটা সংগ্রহ করলাম ছুরি-কাঁটা দিয়ে কেটে। আমাদের নেওয়া হয়ে যাওয়ার পরে স্থানীয় বন্ধুরা গেলেন খাবার নিতে। ছুরি-কাঁটা-চামচ ফেলে তাঁদের অনেকেই হাত ঢুকিয়ে দিলেন দুম্বার পেটে–কেউ কেউ প্রায় কনুই পর্যন্ত। ফলে, আমরা আর দ্বিতীয়বার দুম্বার কাছে ঘেঁষলাম না।
পরিকল্পনা করেছিলাম, কুয়েত থেকে আবুধাবি হয়ে ফিরব–সেখানে আমার শ্যালিকা নাসরীন, ভায়রা এফ আর এম হাসান এবং তাদের শিশুপুত্র আন্দালিব আছে। আমার যাতায়াতের টিকিট ছিল কুয়েত এয়ারওয়েজে, কিন্তু কেন যেন এই সেক্টরটার টিকিট ছিল মিল ইস্ট এয়ারলাইনসে (এমইএ)। কুয়েত সিটি বিমানবন্দরে তাদের হয়ে কাজ করে এয়ার ইন্ডিয়া। সেখানে রিপোর্ট করতেই ডেস্ক থেকে বলা হলো, আপনার ভিসা নেই, আপনাকে যেতে দেওয়া হবে না। বললাম, আমার জন্যে ভিসা নিয়ে লোক অপেক্ষা করবে আবুধাবি বিমানবন্দরে। তাতে কাজ হলো না। বিমানবন্দরে এয়ার ইন্ডিয়ার ঊর্ধ্বতন এক ভারতীয় কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বললেন, দেখুন, ভিসা ছাড়া যাত্রী আমরা। নিই না, কেননা, ভিসা না পেলে সে-যাত্রীকে নিজেদের খরচে ফিরিয়ে আনতে হয়–সে-ঝুঁকি কোনো স্টাফ নিতে চায় না। আপনি কি নিশ্চিত যে, সেখানে পৌঁছে আপনি ভিসা পাবেন? বললাম, ঢাকা ছাড়ার আগে আমার আত্মীয়ের সঙ্গে সেরকম কথা হয়েছে। ভদ্রলোক বললেন, আপনার আত্মীয়কে ফোন করে জেনে নিন, তিনি আপনার জন্যে ভিসা সংগ্রহ করতে পেরেছেন কি না। কুয়েতি বন্ধু আমার টাকাটা ফেরত দেবে, এই বৃথা ভরসায় হাতের পয়সা সব খরচ করে ফেলেছি। সঙ্গে যা আছে, তাতে দূরপাল্লার ফোন করা যাবে কি না সন্দেহ। আমাকে ইতস্তত করতে দেখে ভদ্রলোক তার সামনের টেলিফোন দেখিয়ে বললেন, এখান থেকেই কথা বলুন। তাই করলাম। হাসান আমাকে আশ্বস্ত করলো, আমি ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করলাম। তিনি বললেন, চলুন, কাউন্টারের দিকে যাই। তারপর প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে উচ্চারণ করলেন, আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আপনার যাতে অসুবিধে না হয়, তা দেখা আমার কর্তব্য। কাউন্টারে আমাকে নিয়ে গিয়ে, সেই আগের লোকটিকেই বোধহয়, বললেন আমাকে বোর্ডিং পাস দিয়ে দিতে। সে বললো, ওঁর ভিসা নেই, আমি ওঁকে বোর্ডিং পাস দিতে পারব না। ভদ্রলোক অনুচ্চ অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, হি ইজ এ ইউনিভার্সিটি প্রফেসর। আই টেক রেসপনসিবিলিটি ফর হিম। ইউ ক্যান গেট ইট ইন রাইটিং ফ্রম মি লেটার, বাট ইস্যু দি বোর্ডিং পাস নাউ।’ বলেই ভদ্রলোক ফিরে গেলেন। আমি অভিভূত হয়ে প্রায় দৌড়ে গিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানালাম।
আবুধাবি বিমানবন্দরে হাসান এসেছিল আমার ভিসা এবং তার অফিসের এক আরব যুবককে নিয়ে। কোনো ঝামেলা হলো না। বিমানবন্দর থেকে। বেরিয়ে সবুজের সমারোহ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। এরা কত কষ্ট করে সবুজ করছে, আর আমরা কত অবহেলায় সবুজ হারাচ্ছি!
তিনটে দিন খুব ভালো কাটলো আবুধাবিতে। বেড়ানো হলো, অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলো। আমার শ্যালক আজিজের বন্ধু হেলালের বাড়িতে এবং রাষ্ট্রদূত মুহম্মদ মহসিনের বাড়িতে খেলাম। দোকান-বাজারে গিয়ে দেখি, বাংলায় আমাদের ডাকাডাকি করছে। এক দোকানে মধ্যবয়সী এক সেলসম্যান নিম্নকণ্ঠে আমার নাম করে জিজ্ঞাসা করলেন, আমিই সেই ব্যক্তি কি না। খুব অবাক হয়ে বললাম, হ্যাঁ, আপনি কেমন করে চিনলেন? তিনি বললেন, দেশে থাকতে কাগজে আপনার ছবি দেখেছি। তারপর জানালেন, চট্টগ্রামেরই এক গ্রামাঞ্চলে তিনি শিক্ষকতা করতেন। তাতে জীবনযাত্রা নির্বাহ করা ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল। তাই চাকরি নিয়ে চলে এসেছেন। পেশার পরিবর্তনে তিনি একটু গ্লানিবোধ করেন, তাঁর কথার ভঙ্গি থেকে তা বেশ বোঝা গেল।
আমি কুয়েতে যাওয়ার আগে উপাচার্য আবদুল করিম বলেছিলেন, তাঁর জন্যে যেন সেখান থেকে এক বোতল জয়তুনের তেল নিয়ে আসি। আমার দোভাষী সেই ছাত্রটিকে বলেছিলাম তা সংগ্রহ করে দিতে। সে প্রায় আধা গ্যালনের এক প্লাস্টিক-কন্টেনারে যা নিয়ে এলো, তা বিদেশি অলিভ অয়েল। সেটা সুটকেসে নেওয়া সম্ভবপর ছিল না বলে কুয়েত থেকে আবুধাবি, আবুধাবি থেকে ঢাকা, এবং ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে হাতে করে নিয়ে আসতে হলো। প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রে কৌতূহলীদের প্রশ্নের জবাবে বলতেই হলো, ‘তেল–ভাইস চান্সেলরকে দিতে যাচ্ছি।’
৪৯.
মাসখানেক পরেই, কিছুটা আকস্মিকভাবে ও অপ্রত্যাশিতভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল আজিজ খান। তিনি মন্ত্রী ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছোটো ভায়রা। কেউ বললেন, তার নিয়োগ হয়েছে সেই সুবাদে; কেউ বললেন, তাঁর সঙ্গে আলাপে প্রীত হয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বয়ং এই দায়িত্ব তাঁকে অর্পণ করেছেন।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের একটা সুযোগ আমার ঘটেছিল এর অল্পকাল আগে। সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত কিছু লোককে তিনি বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মতবিনিময় ও নৈশভোজের জন্যে। রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণরক্ষা কর্তব্যের শামিল–সুতরাং যাতায়াত-খরচ দেবে বিশ্ববিদ্যালয়। আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলাম।
গিয়ে দেখি, এলাহি কাণ্ড। বহু লোকের সমাগম। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী গেছেন একাডেমির কিছু প্রকাশনা সঙ্গে নিয়ে–গাড়ি থেকে সেসব নামাতেই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যেরা হাঁ-হাঁ করে ছুটে এসেছেন। আগে থেকে অনুমতি না নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে এসব দেওয়া যাবে না। অনেক বয়স্ক মানুষ এসেছেন–চলাফেরা তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য হলেও।
রাষ্ট্রপতি বক্তৃতা দিলেন, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র সম্পর্কে সচেতন থাকতে এবং দেশে-বিদেশে সেই স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরতে আহ্বান করলেন। তিনি আরো জানালেন, তিনিও একসময়ে সাহিত্যচর্চা করতেন এবং তারও একটি লেখার খাতা ছিল। এ-সময়ে মোহাম্মদ মোদাব্বের ব্যাকুলভাবে জানতে চাইলেন, খাতাটা এখনো তাঁর কাছে আছে কি না। তাঁকে হতাশ করে জিয়াউর রহমান বললেন, সেটা হারিয়ে গেছে। বক্তৃতার শেষে রাষ্ট্রপতি জিজ্ঞাসা করলেন, উপস্থিত ব্যক্তিদের কারো কোনো প্রশ্ন আছে কি না। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বললেন, ‘রামপ্রাণ গুপ্ত, কেশবচন্দ্র গুপ্তের মতো হিন্দু লেখকেরা হজরত মুহম্মদ, ইসলামের ইতিহাস এবং ভারতে মুসলিম শাসন সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো বই লিখেছেন–সেসব বই এখন দুষ্প্রাপ্য। সরকার যদি বাংলাদেশে এসব বই পুনর্মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন, তবে সকলে উপকৃত হবে। তার কথাটা জিয়াউর রহমান বুঝতে পারেননি, সুতরাং বিরক্তির সুরে প্রশ্ন করলেন, আমরা সবাই বাংলাদেশি–আপনি হিন্দু-মুসলমানের প্রশ্ন তুলছেন কেন?’ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ নিজের কথাটা পরিষ্কার করতে উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু এরই মধ্যে আর কেউ প্রশ্ন করে ফেললেন এবং আজরফ সাহেবের নিকটতম উপবিষ্টেরা তাঁকে সযত্নে বসিয়ে দিলেন। মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের সাহিত্য সম্পর্কে কিছু একটা বললেন। রাষ্ট্রপতি একটু কুপিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা-যুদ্ধ বলি–আপনি মুক্তিযুদ্ধ বলছেন কেন? আমার কিছুই বলার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু এই ক্ষণটিতে আমি উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, মাননীয় রাষ্ট্রপতি, খবরের কাগজে পড়লাম, সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করছেন। মুক্তিযুদ্ধ না হয়ে থাকলে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি হচ্ছে কীভাবে? রাষ্ট্রপতি দৃঢ়ভাবে বললেন, আমরা স্বাধীনতা-যুদ্ধ বলি। আর অল্পক্ষণ এরকম মতবিনিময়ের পরে নৈশভোজের ডাক পড়ল। শুরু হয়ে গেল রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছাবার প্রতিযোগিতা।
সে-বছরে ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা-দিবস না বলে সরকারিভাবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল জাতীয় দিবস হিসেবে।
৫০.
১৯৮০ সালের কোনো এক সময়ে ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনের এক কর্মকর্তা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের কাছে গিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসের পক্ষ থেকে তাঁকে ভারত-ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানাতে। তিনি সেই কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা ড. আনিসুজ্জামানকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন না? কর্মকর্তা নিশ্চয় অপ্রতিভ হয়েছিলেন, তবে শিষ্টাচার বজায় রাখতে বলেছিলেন, নিশ্চয় নিশ্চয়, ওঁকেও আমরা যথাসময়ে নিমন্ত্রণ করবো। রাজ্জাক সাহেব নিস্পৃহভাবে জানিয়েছিলেন, ওকে যখন নিমন্ত্রণ। করবেন, তখন আমাকে বলবেন; আমরা একসঙ্গে যাবো।
আমি তখন চট্টগ্রামে। এসব কথোপকথনের খবর পাই অনেক দেরিতে। আমাকে নিমন্ত্রণ করার আদৌ কোনো পরিকল্পনা আইসিসিআরের ছিল কি না, আমার জানা নেই। সারের কথায়, মনে হয়, তারা নড়াচাড়া শুরু করলেন। তারা সারকে নিতে চান, তবে এটাও বুঝলেন, তাঁর যাওয়ার শর্ত, সঙ্গে আমাকে নিতে হবে। এই অবস্থায় কিছু না করেও বোধহয় তারা পারলেন না। সুতরাং চট্টগ্রামে আমার কাছে ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনের একজন প্রতিনিধি এসে জানালেন, তাঁরা আমাকে ভারত-সফরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। আমি কবে যেতে পারবো, জানতে পারলে তারা বাধিত হবেন। আর হ্যাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকও এই সফরে আমন্ত্রিত। রাজ্জাক সাহেব বলেছেন, তিনি আমার সঙ্গেই যাবেন। সুতরাং আমি অধ্যাপক রাজ্জাকের সঙ্গে পরামর্শ করে যদি কর্মসূচি তৈরি করি, তাহলে আরো ভালো হয়। তারা কলকাতা, দিল্লি ও বোম্বাইতে আমাদের জন্যে ব্যবস্থা করেছেন। অধ্যাপক রাজ্জাক তার অতিরিক্ত যেতে চান ত্রিবান্দ্রমে। সেখানে আমাকেও যেতে হবে। তাছাড়া অন্যত্র কোথাও যদি আমি যেতে চাই, তা যেন জানাই। তারা সেখানেও আমাদের দুজনের যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
সারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমি আমন্ত্রণ-রহস্যভেদ করতে পারলাম। যথোচিত লজ্জিত হলাম। সার লজ্জার কোনো কারণ দেখলেন না। বললেন, উনি তো ওদের আমাকে দাওয়াত করতে বলেননি, উনি শুধু বলেছেন, আমার সঙ্গে যাবেন। তাদের সামনে সব পথই খোলা ছিল। চাইলে আমাকে নেমন্তন্ন না করলেও পারতো। উনি না গেলে যে ওদের খুব ক্ষতি হতো, তা তো নয়। ওঁর আসল ইচ্ছে, দিল্লিতে তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক অমিয় দাশগুপ্তের দেখা পাওয়া। আর সুযোগ যদি হয়, তাহলে কেরালায় ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে তাঁর বন্ধুস্থানীয় ড. কে এন রাজের সঙ্গে দেখা করা। ভারতে তিনি তেমন কাউকে চেনেন না–আমার যেমন ভালো লাগে, তেমন প্রোগ্রাম করতে পারি। তিনি যে-কোনো জায়গায় যেতে প্রস্তুত, তবে কোথাও বক্তৃতা দিতে পারবেন না। আনুষ্ঠানিক হোক, লেখাপড়াসংক্রান্ত হোক–যেখানে যা বলার দরকার, আমাকেই বলতে হবে।
দিন-তারিখ ঠিক করেই হাই কমিশনকে জানালাম। বললাম, কলকাতায় একটু বেশি সময় থাকতে চাই এবং তার মধ্যে এক ফাঁকে শান্তিনিকেতন ঘুরে আসতে চাই।
সপ্তাহতিনেকের সফর। ঢাকা থেকে দিল্লি। সার বাজার কুঁড়ে বড় মাপের দুটো ইলিশ মাছ নিয়েছেন তাঁর শিক্ষকের জন্যে। বিমানবন্দর থেকে আমি এক বোতল ব্ল্যাক লেবেল নিয়েছি কলকাতায় পৌঁছে বরুণ দে-কে দেবো বলে।
দিল্লিতে প্রথম সুযোগেই অমিয় দাশগুপ্তের বাড়িতে যাওয়া হলো। এইখানে তার একটু পরিচয় দেওয়া হয়তো প্রাসঙ্গিক হবে। অমিয়কুমার দাশগুপ্তের (১৯০৩-৯২) আদি বাড়ি বরিশাল জেলার গৈলায়। ১৯২২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং রাজনৈতিক অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণির বিএ অনার্স ও এমএ ডিগ্রি লাভ করে এখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিভাগ আলাদা হয়ে গেলে তিনি অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে অল্পকাল কটকের র্যাভেন শ কলেজে এবং দীর্ঘকাল বেনারসে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। একসময়ে তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপকও ছিলেন। আমরা যখন দিল্লিতে যাই, তখন তিনি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। শেষজীবনে তিনি বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করেন এবং শান্তিনিকেতনেই তার মৃত্যু হয়। অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর কিছু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ ব্যাপক সমাদর লাভ করে। রাজ্জাক সাহেব তার ছাত্র ছিলেন ১৯৩২ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত, পরে রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগে সহকর্মী হয়েছিলেন, বিভাগ ভাগ হয়ে গেলে তিনি অবশ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যোগ দেন।
দিল্লিতে গুরুশিষ্যের মিলনের দৃশ্যটা ছিল দেখার মতো। অমিয় দাশগুপ্ত সাগ্রহে আমাদের আগমনের অপেক্ষায় ছিলেন। রাজ্জাক সাহেব তার পা ছুঁতেই তিনি যে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, সে-আলিঙ্গন সহজে শেষ হয় না। অমিয়বাবুর স্ত্রী কাছে দাঁড়িয়ে মুখে হাসি ছড়িয়ে স্নেহের দৃষ্টিতে রাজ্জাক সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সার তাঁকেও পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। আমি তাঁকে অনুসরণ করলাম। কুশল-বিনিময়ের পরে অমিয়বাবু জানালেন, তাঁর পুত্র পার্থসারথী লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সে অধ্যাপনা করছেন, কন্যা অলকানন্দা বোম্বাইতে, জামাতা আই জি প্যাটেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার গভর্নরপদের মেয়াদশেষে বোম্বাইতেই কী এক গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। আমরা কি বোম্বাই যাবো? তাহলে যেন অবশ্যই তাদের ওখানে যাই–তিনি ওদের বলে রাখবেন।
অমিয়বাবুর বাড়িতে আমরা একাধিক বেলা খেলাম। গল্পগুজব যা হলো, তাতে ঘুরেফিরে আসতে থাকলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শহরের কথা। একটু পরপরই অতীত পুনরায় নতুন হতে থাকলো। আমি তাঁর ছাত্রের স্নেহভাজন হওয়ায় ছাত্রের প্রতি তার ভালোবাসার একটু ভাগ আমিও পেলাম। তাঁর মৃত্যুর অল্পকাল আগে শান্তিনিকেতনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক নুরুল মোমেনের। অমিয়বাবু তাঁর কাছে যেভাবে আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাতে নুরুল মোমেনের প্রত্যয় জন্মেছিল যে, আমি প্রফেসর এ কে দাশগুপ্তের একজন প্রিয়পাত্র।
আমরা গেলাম দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে–কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে সৌজন্য-সাক্ষাৎকার করতে। জওহরলালে তখনো বোধহয় পার্থসারথী ছিলেন উপাচার্য–তিনি খুবই সহৃদয় মানুষ। আমাদের দেখা হলো শিক্ষামন্ত্রী নূরুল হাসানের সঙ্গে। তার সঙ্গে আমার সামান্য পরিচয় হয়েছিল ১৯৭১ সালে। সারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল–তা কি ১৯৭৪ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় যখন সারুকে সাম্মানিক ডি. লিট উপাধি দেয়, তখনকার, নাকি আরো আগে যখন তারা উভয়েই বিদেশে ছিলেন, তখনকার, ঠিক বলতে পারবো না। কথাপ্রসঙ্গে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়। থেকে প্রকাশিত দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস-সম্পর্কিত মানচিত্রমালার প্রশংসা করেছিলেন সার। নূরুল হাসান বললেন, ওটা আপনার ভালো লেগেছে? তাহলে আমাদের অ্যাটলাসটা আপনি দেখেন নি। সেটা শিকাগোরটার চেয়ে বহুগুণে ভালো। সার, মনে হয়, কথাটা স্বীকার করলেন না, তবে হয়তো। সৌজন্যবশতই এ-নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেন না।
ডি এস কোঠারি তখন উচ্চশিক্ষাবিষয়ক কোনো উচ্চপদে আসীন। তার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমরা রজনী কোঠারির সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভেও গেলাম। রজনী জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা-পর্ষদের সদস্য। আমি যে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার সঙ্গে যুক্ত, তা তিনি জানতেন। তবে আমাদের প্রকল্প-পরিচালক আনোয়ার আবদেল মালেক ও তার মধ্যে বোধহয় যথেষ্ট প্রীতি ছিল না। সুতরাং একবারমাত্র ওই প্রসঙ্গের উল্লেখ করে আমরা থেমে গেলাম। রাজ্জাক সাহেব সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। থাকলে তিনি যেভাবে নিজের বিদ্যা জাহির করেছিলেন, তা করতেন না।
দিল্লি থেকে আমরা ট্যাকসি করে জয়পুর গেলাম, সেই রাতেই আবার ফিরে এলাম। পথের দু পাশে বিস্তীর্ণ ফসলক্ষেত্রে কর্মরত নরনারীর বর্ণবহুল পরিধেয় অতি দৃষ্টিনন্দন। জয়পুরের রাজকীয় প্রাসাদগুলিও মনোমুগ্ধকর।
বোম্বাইতে আই জি প্যাটেলের বাড়িতে নৈশভোজ খাওয়া হলো–ভোেজ কয় যাহারে। শহরের বাইরে বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস এবং শহরে নির্মীয়মাণ ক্যাম্পাস–দু জায়গায়ই গেলাম। মালাবার হিলসে জিন্নাহ্ যে বাড়িতে থাকতেন, সেটা দেখা হলো। হোটেলের ডাইনিং হলের হোস্টেস মেয়েটি দেখতে খানিকটা শাবানা আজমির মতো। বয়স্ক মানুষ বলে রাজ্জাক সাহেবের খুব যত্নআত্তি করতো, স্বাভাবিকভাবে আমিও তার ভাগ পেতাম। সার কিন্তু কোনো কথাই তার সঙ্গে বলতেন না, খাওয়ার অর্ডারটাও আমাকে দিতে বলতেন। হোটেলে আমাদের শেষরাতে খাওয়ার সময়ে সার আমাকে বললেন মেয়েটিকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানাতে। সে খুবই অভিভূত হলো। বললো, তার। অবস্থায় বাংলাদেশে যাওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত, কিন্তু যদি কখনো তেমন সুযোগ হয়, অবশ্যই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। আমাদের সহৃদয়তা তাকে খুব স্পর্শ করেছে।
ত্রিবান্দ্রমে কে এন রাজ খুব সমাদর করলেন। তার সেন্টারটা স্বয়ংসম্পূর্ণ–সেখানেই আমরা থাকলাম। অনেক গবেষক কাজ করছেন, গ্রন্থাগার খুব সমৃদ্ধ। রাজ্জাক সাহেব সেখানে বক্তৃতার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করায় প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের সঙ্গে এক বৈঠকের আয়োজন করলেন কে এন রাজ। সেখানে রাজ্জাক সাহেবের পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, ‘ঢাকায় নাম না করে শুধু সার বলতে আব্দুর রাজ্জাককেই বোঝায়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমাকে বলেছেন যে, তাঁর শাশুড়ি–যিনি কোনোদিন স্কুলে যাননি, তিনিও-ওঁকে সার বলে সম্বোধন করেন। সভায় তুমুল হাস্যধ্বনি ও করতালি।
ত্রিবান্দ্রম থেকে মাদ্রাজ যেতে হবে। বিমানবন্দরে যখন উড়োজাহাজে ওঠার ডাক পড়ল, সার আমার ব্যাগটি হাতে করে অগ্রসর হলেন। আমি তাঁকে বারংবার বলতে থাকলাম সেটা আমার হাতে দিতে, তিনি কর্ণপাত করলেন না। নিরাপত্তা বেষ্টনীতে আমার ঠিক সামনে তিনি। একজন কর্মকর্তা তার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে খুললো। ওপরেই স্কচ হুইস্কির বোতল দেখে সারের দিকে অর্থপূর্ণ হাসি ছুঁড়ে দিয়ে সে ব্যাগ বন্ধ করে দিলো। আমার খুবই রাগ হলো। ভর্ৎসনার সুরে সারুকে বললাম, আপনাকে বারবার বলছি আমার ব্যাগ আমার হাতে দিতে, আপনি কিছুতেই শুনলেন না। সার খুব নিস্পৃহভাবে জানতে চাইলেন, ক্যান, কী হইছে?’ বললাম, ‘দেখলেন না, লোকটা আপনার দিকে চেয়ে কীভাবে হাসলো? কী ভাবলো, বলেন তো!’ সার বললেন, ‘তায় কী হইলো? হার লগে আমার জীবনে দেখা হইবো নাকি?’ এরপরে আমি আর কী বলতে পারি!
মাদ্রাজে শুধু রাতটা হোটেলে কাটানো। পরদিন সকালে সমুদ্রোপকূলে কিছুটা গাড়িতে ঘোরা। খানিক পরই কলকাতা যাত্রা।
কলকাতায় হোটেলে পৌঁছে ফোন করলাম অনিরুদ্ধ রায়কে। ইংরেজিতে বললাম, আমি আলীগড় থেকে আসছি। পার্ক হোটেলে আছি। তারপর ওর সুপরিচিত এক মহিলার নাম করে বললাম, তিনি আমাকে আপনার ফোন নম্বর দিয়েছেন, আমার হাতে একটা চিঠিও দিয়েছেন। আপনি কি একবার আসতে পারবেন চিঠিটা নিতে? আমি তো কলকাতা ভালো চিনি না, নইলে নিজেই পৌঁছে দিতাম। অনিরুদ্ধ খুব ব্যগ্র হয়ে বললো, না না, আমিই আসবো। আপনার রুম নম্বরটা বলুন। আমি রুম নম্বর জানালাম। সে আবার বলতে বললো। বললাম। সে এবার বাংলায় বললো, ‘গলাটা চেনা মনে হচ্ছে।’
খানিক পর অনিরুদ্ধ এলো। খবর পেয়ে অনিল সরকারও এলো। আমাদের আড্ডা জমে উঠলো। বরুণ দে-কে ফোন করে স্কচ-বার্তা জানালাম। স্থির হলো, হোটেলে থাকার নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হলে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেসের অতিথি-ভবনে আমরা কয়েকদিন থাকবো। আর সেন্টারে আমি একদিন বক্তৃতা দেববা ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে পাওয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা কুঠির বাংলা চিঠিপত্র সম্বন্ধে।
কলকাতায় সারের দুই বন্ধু আছেন। অধ্যাপক আবদুল ওয়াহেদ মাহমুদ ওরফে বাচ্চু মিয়া এবং তাঁর অনুজ, ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসের কর্মকর্তা, আবদুল হাই মাসুদ ওরফে গেঁদু মিয়া। দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র, তবে এ ডব্লিউ মাহমুদ বিশিষ্ট–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু। প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে তার খ্যাতি আকাশচুম্বী। সামাজিক ক্ষেত্রেও তার বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে থাকেন তিনি সঙ্গিনীকে নিয়ে। তাঁর বাড়িতে একাধিকবার যাওয়া হলো এবং যথারীতি খাওয়া-দাওয়া হলো। একরাতে এ এইচ মাসুদের কিমবার স্ট্রিটের বাসায় খেলাম এবং তার বিদুষী কন্যার সঙ্গে পরিচিত হলাম।
দিল্লিতে সার যেসব বইয়ের দোকানে গিয়েছিলেন, তা ছিল মূলত ইংরেজি বইয়ের দোকান এবং নতুন বইয়ের দোকান। পুরোনো দিল্লির বনেদি দোকান থেকে বেশ দাম দিয়ে পুরোনো ইতিহাস বইয়ের হাল পুনর্মুদ্রণ কিনেছিলেন। মনোহারলালের পুস্তক-তালিকায় নাম ছিল, কিন্তু দোকানে মজুদ ছিল না, এমন একটি বইয়ের দাম দিয়ে এসেছিলেন সকালে, ওরা বিকেলে সেটা পাঠিয়ে দিয়েছিল। পরদিন সকালেই আমাদের দিল্লি ছাড়ার কথা ছিল। কলকাতায় এসে সার কিছু নতুন বা অনেকদিনের আগে প্রকাশিত বই কিনলেন এশিয়াটিক সোসাইটি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে। আমিও অল্পস্বল্প কিনলাম। তখন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি দিলীপকুমার বিশ্বাস এবং সম্পাদক সরোজমোহন মিত্র। সৌভাগ্যক্রমে এক সন্ধ্যায় তাঁদেরকে পরিষদে পেয়ে গেলাম। উভয়েই আমাদের খুব সমাদর করলেন। সার অবশ্য ধারণা করলেন যে, সমাদরের লক্ষ্য আমি, তিনি উপলক্ষ মাত্র, তবে তা ঠিক নয়।
সার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন মফিদুল হকের সঙ্গে–ওদের যারা বই পাঠায় কলকাতা থেকে, তারা সেই চালানের সঙ্গে সারের পছন্দ-করা বই পাঠিয়ে দেবে। বইয়ের দামও ঢাকায় দেওয়া যাবে। তবে তাঁর সত্যিকারের অভিযান শুরু হলো পুরোনো বইয়ের সন্ধানে। এসব বইয়ের দোকানদারেরা সহজে তাদের সেরা সংগ্রহ দেখাতে চায় না। যখন বুঝতে পারে, খরিদদার সত্যি সমঝদার, তখনই কেবল সেসব বের করে। সারের পোশাক-পরিচ্ছদ, বাঙাল ভাষায় কথাবার্তা শুনে তারা প্রথমে গা করেনি, তারপর বইপত্র সম্পর্কে তার আগ্রহ এবং মূল্য সম্পর্কে তার ধারণার পরিচয় পেয়ে তারা ক্রমশ উৎসাহী হয়ে উঠলো। সবচেয়ে আনন্দের কথা, একাধিক খণ্ডের একটি বইয়ের যে-খণ্ডটি ১৯৭১ সালে সারের বাড়ি থেকে খোয়া গিয়েছিল, সেটি তিনি কলকাতায় পেয়ে গেলেন।
হোটেল ছেড়ে আমরা যখন সেন্টার ফর দি স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেসের অতিথি-ভবনে থাকছি, তখনই একদিন শান্তিনিকেতনে যাওয়া হলো। সুরঞ্জন দাশ-তখন শান্তিনিকেতনে থেকে গবেষণা করছে, এখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য-অনিল সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ। তার অভিভাবকত্ব মেনে আমরা শান্তিনিকেতনে গেলাম। কলকাতা থেকে এক গাড়িতে সার, আমি আর অনিল। সুরঞ্জন আগেই পৌঁছে গেছে সেখানে। অম্লান দত্ত তখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। তিনি অত্যন্ত সহৃদয় ব্যক্তি, আমাকেও প্রীতির চোখে দেখেন। তিনি যথারীতি অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করলেন। সুরঞ্জন আমাদের সব ঘুরিয়ে দেখালো। পরদিন বিকেলের দিকে রওনা হয়ে রাতে কলকাতায় ফিরে এলাম।
এবার সেন্টারে আমার বক্তৃতার পালা। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিতব্য আমার Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Office Library and Records বইটির ভূমিকার খানিকটা অংশ সামনে খোলা রেখে বাংলায় বলে গেলাম। বক্তৃতা যেমনই হোক, শ্রোতার সংখ্যা ছিল আশাতীত। আমার বন্ধুদের অনেকেই এসেছিলেন। প্রবীণদের মধ্যে ছিলেন অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত। সকলেই আমার প্রতি দাক্ষিণ্য প্রকাশ করেছিলেন। তাই প্রশ্ন যা হয়েছিল, তার উত্তর দিতে পেরেছিলাম। রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে ভবতোষ দত্তের দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়েছিল। তাছাড়া, তাঁর সম্পর্কে কৌতূহলী আরো অনেকে ছিলেন। সভার শেষে তাঁকে ঘিরে আড্ডা জমেছিল।
আমার ঘনিষ্ঠজন বরুণ দে, অনিল সকার ও অনিরুদ্ধ রায়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে সার খুব প্রীত হয়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, তাঁদের কালে বাঙালি হিন্দু সমাজে এমন প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটেনি–অন্তত তিনি লক্ষ করেননি। তিনি নিশ্চয় সে-সময়ে অনেক উদার ছাত্র-শিক্ষকের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তবে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স্ক যাদের সঙ্গে তাঁর এবার পরিচয় হলো, তাদের অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছিল। তার মনে হয়তো এই কথাটি দেখা দিয়েছিল যে, তাদের কালে এমন উদারতা সর্বব্যাপী হলে দেশের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো।
ভারত-ভ্রমণশেষে সানন্দিতচিত্তে আমরা দেশে ফিরে এলাম।
তারপর একদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে সারের বাড়িতে গিয়ে দেখি, কলকাতা থেকে আমাদের বইপত্র এসে গেছে এবং যেসব বইয়ের দুটি করে কপি আছে, আমাদের এক তরুণ সহকর্মী তার থেকে একটি বেছে আলাদা করে রাখছে। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ডুপ্লিকেটগুলো আমার।’ তখন বোধহয় সারেরও খেয়াল হলো। অদম্য গবেষক বললো, ‘ঠিক আছে, আমি এগুলো দেখে নিয়ে আপনাকে ফেরত দেবো। তারপর যা হওয়ার তা হলো।
তারও বেশ কিছুদিন পরে চট্টগ্রামে ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনের সেই কর্মকর্তা আমার কাছে জানতে চাইলেন আমাদের ভারতভ্রমণ কেমন হলো। বললাম, খুব ভালো। বন্দোবস্ত ছিল খুব ভালো, মানুষজন ছিলেন অতিথিপরায়ণ, দ্রষ্টব্য ছিল চিত্তচমঙ্কারী। তিনি একটু থেমে বললেন, ‘ফিরে এসে আপনারা কেউ আইসিসিআর-কে কিছু লিখে জানালেন না। তাই আমরা একটু চিন্তিত হয়েছিলাম।’
সারের তো চিঠি লেখার অভ্যাস নেই। কিন্তু আমিও ভারতীয় হাই কমিশন বা আইসিসিআরকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু লিখিনি। ভদ্রলোকের কথায় লজ্জা পেলাম। মনে হলো, এখন লিখি। তারপর মনে হলো, এখন আর লিখে কী হবে, বড়ো দেরি হয়ে গেছে।
৫১.
১৯৮১ সালের ৩০ মে। আমার ভাগ্নি-জামাই কাজী আলী আফজাল চট্টগ্রাম শহর থেকে এসেছেন তার পরিচিত দুই ভদ্রলোককে নিয়ে। ক্যাম্পাসের বাসায় বসার ঘরে বসে কথা বলছি। ওঁরা চলে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো। এরই মধ্যে ফোন এলো বিভাগ থেকে : সার্কিট হাউজে অবস্থানকালে মধ্যরাত্রির পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছেন চট্টগ্রাম সেনানিবাসের কিছুসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তার হাতে। ওইটুকু শুনেই শহরবাসীরা দ্রুত প্রস্থান করলেন। আমি চেষ্টা করলাম বেতারে খবর শুনতে।
ঢাকা আর চট্টগ্রাম বেতারের ঘোষণা একরকম নয়। ঢাকা বেতার বলছে, কিছু দুষ্কৃতকারী সামরিক ব্যক্তি জিয়াকে হত্যা করেছে, এসব বিদ্রোহী সৈনিক ও সেনা-কর্মকর্তাদের অবিলম্বে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে (সেইসঙ্গে মৌলিক অধিকার স্থগিত হয়)। চল্লিশ দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বেতার বলছে, রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হয়েছেন, এক বিপ্লবী পরিষদ দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বেতারের কথায় কান না দিতে দেশবাসীকে অনুরোধ করছে ঢাকা বেতার। চট্টগ্রাম বেতার থেকে এক পর্যায়ে চট্টগ্রাম সফররত নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এ খান বিপ্লবী পরিষদের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করলেন। পরে ঢাকা বেতার থেকে বলা হলো, তিনি একটি জাহাজযোগে ঢাকা রওনা হয়ে গেছেন। আরো পরে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানের সঙ্গে তিনিও সংবিধানমতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন করলেন।
আমার মনে হলো, ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ ও তাঁর পরিবারের খবর নেওয়া দরকার। বেতারের প্রথম ঘোষণা শুনেই বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ফোন করে কম্যান্ডেন্টের বাসায় সংযোগ দিতে অনুরোধ করলাম। টেলিফোন বেজে চলল, কেউ সাড়া দেয় না। বুঝলাম, বাড়িতে কেউ নেই। ভাবলাম, নিরাপদে থাকলেই হলো। পরে ভাবি ফোন করে জানিয়েছিলেন যে, তারা নিজেদের বাসস্থানে নেই, তবে নিরাপদে আছেন।
ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে হাটহাজারিতে গেলাম। থানায় পাওয়া গেল ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম কুদুসকে। তাঁকে খবরাখবর জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, বিপদের মধ্যে আছেন। শুধু রাষ্ট্রপতিই নিহত হননি, সেনাবাহিনীর হাই কম্যান্ডের সঙ্গে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বিরোধ লেগে গেছে এবং তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। গুজব, ঢাকা বা কুমিল্লা থেকে সেনাবাহিনীর ইউনিট রওনা হয়েছে চট্টগ্রামের দিকে, চট্টগ্রাম থেকে সৈন্য পাঠানো হয়েছে শুভপুর ব্রিজে তাদেরকে প্রতিরোধ করতে।
ক্যাম্পাসে ফিরে আসতে অর্থনীতি বিভাগের এক শিক্ষকের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি নিশ্চিত, ভারতের প্ররোচনায় এ-হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। ভারতীয়রা সীমান্তের দিকে এগিয়ে এসেছে সংঘর্ষ বাধাবার জন্যে।
যে-সারিতে আমার বাসা, তার দক্ষিণের সারির প্রথম বাসাটি আমাদের উপ রেজিস্ট্রার (জনসংযোগ) আবু হেনা মোহাম্মদ মহসীনের। তার শ্যালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমানকে জানতাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। এখন শোনা গেল, জিয়ার হত্যাকারীদের মধ্যে তিনি একজন। আরো শুনলাম, মিলিটারি জিপে করে আজই সকালে তিনি নাকি বোনের বাড়িতে এসেছিলেন কিছুক্ষণের জন্যে।
লোকমুখে ঘটনার দুটি প্রধান ভাষ্য দাঁড়িয়ে গেল। জেনারেল আবুল মনজুরের সঙ্গে কিছুকাল ধরে জিয়াউর রহমানের মনান্তর চলছিল। সামরিক গোয়েন্দারা রাষ্ট্রপতিকে চট্টগ্রামে রাত্রিযাপন করতে নিষেধ করেছিল, জিয়া তা শোনেননি। এ-দুটি বিষয় উভয় ভাষ্যেই ছিল। তারপর, এক ভাষ্য-অনুযায়ী, কিছুসংখ্যক বিক্ষুব্ধ সেনাকর্মকর্তা রাষ্ট্রপতিকে অপহরণ করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া তাদের এক দাবি; সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে ক্ষমতার রদবদল ঘটানোও তাঁদের উদ্দেশ্য। তারা ভেবেছিলেন, অপহরণ করে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে তারা এসব কাজ করিয়ে নেবেন। কিন্তু তাঁদেরই মধ্যে এক সামরিক কর্মকর্তা মদোন্মত্ত হয়ে নিজের অস্ত্র দিয়ে জিয়াকে হত্যা করেন। এরপর তারা সবাই সেনানিবাসে ফিরে এসে জিওসি-কে সবকিছু জানান। মনজুর তাঁর কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের কাজের দায়িত্ব নিজে নিয়ে সেনা সদর দপ্তরের সঙ্গে আলাপ করতে চান। সদর দপ্তর তাকে আত্মসমর্পণ করতে বললে তিনি অস্বীকার করেন এবং সেনাপ্রধানকে পদচ্যুত করার ঘোষণা দিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব দাবি করে বসেন।
অপর ভাষ্য-অনুযায়ী, জেনারেল মনজুর উচ্চাকাঙ্ক্ষী সামরিক কর্মকর্তা, শিক্ষিত ও মার্জিত। তার কিছু ঘনিষ্ঠ অনুসারী আছে। তাদের দিয়ে জিয়া-হত্যা ঘটিয়ে তিনি ক্ষমতা অধিকার করতে চেয়েছিলেন। ঢাকার বাইরের অন্তত দুটি সেনানিবাসের প্রধানেরাও এই ষড়যন্ত্রের অংশীদার। এখন অবস্থা বেগতিক দেখে তারা চুপ করে গেছেন।
তৃতীয় একটি ভাষ্য-অনুযায়ী, এই খেলায় তৃতীয় একজন আছেন। তিনি কৌশলে জিয়াকে সরিয়েছেন, এখন মনজুরকে সরাবেন। তারপর দু-একজন উচ্চপদস্থ মুক্তিযোদ্ধা সেনা-কর্মকর্তাকে অবসর দিয়ে, দেশের বাইরে পাঠিয়ে, সেনাবাহিনীতে প্রথমে, তারপর দেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল করবেন।
প্রশ্ন রয়ে যায়, মনজুর কি এতই অর্বাচীন যে, চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করলেই দেশের শাসনভার তার করায়ত্ত হবে বলে ভাবতে পেরেছিলেন? আবার এ-প্রশ্নও রয়ে যায় যে, তিনি কি এতই অপেশাদার যে, তাঁর অধীন কর্মকর্তারা রাষ্ট্রপতি-হত্যার পরিকল্পনা করছেন আর তিনি কিছুই জানতে পারছেন না? তিনি হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব নিলেন, অথচ দোষীদের নিরস্ত করার কোনো প্রয়াস নিলেন না কেন? অথবা চট্টগ্রাম বেতার থেকে একবারও তিনি জাতির উদ্দেশে কিছু বললেন না কেন?
পরে ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহর কাছ থেকে যে-ঘটনাটি জেনেছিলাম, সেটা এখানে বিবৃত করা যায়।
ব্রিগেডিয়ার হান্নান ৩০ মে সকালে মনজুরের প্রতি বিশ্বস্ত সৈন্যদের দ্বারা আটক অবস্থায় ছিলেন। ৩১ তারিখে তাকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জেনারেল মনজুরের অভিপ্রায়-অনুযায়ী তিনি ঢাকায় টেলিফোনে চিফ অফ জেনারেল স্টাফ জেনারেল নূরউদ্দীন খানের সঙ্গে কথা বলেন। মনজুর তাঁর পাশে বসে ছিলেন; ঢাকায় নূরউদ্দীনের পাশেও আরো কেউ বসে ছিলেন। ঢাকার আত্মসমর্পণ-দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মনজুর আলোচনার প্রস্তাব দেন। এক পর্যায়ে ঢাকা থেকে জেনারেল ওয়াহিদসহ উচ্চপদস্থ দুজন সামরিক-কর্মকর্তা চট্টগ্রামে আসবেন বলেও কথা হয়। (তারা কি সমকক্ষ হিসেবে কথা বলতে আসছিলেন, না মনজুরকে বন্দি করে নিয়ে যেতে আসছিলেন, তা পরিষ্কার ছিল না।) টেলিফোনে কথা শেষ করার সময়ে হান্নান শাহ শুনতে পান, পাশের জন বলছেন, এখন পাখি ফাঁদে পড়েছে। এই কণ্ঠস্বর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বলে হান্নান শাহর মনে হয়েছিল।
ততক্ষণে অবশ্য মনজুরের অবস্থা সত্যি খারাপ হয়ে এসেছে। ৩০ মে তাঁকে এবং আরো কয়েকজন সেনা-কর্মকর্তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদচ্যুত করা হয়। সেনাপ্রধান প্রকাশ্যে তার নাম করে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। মনজুরের ঘোষিত সান্ধ্য আইন সত্ত্বেও ৩১ তারিখে ঢাকা ও চট্টগ্রামে জিয়ার গায়েবি জানাজায় বিপুল জনসমাগম হয়। আওয়ামী লীগের সদ্যনির্বাচিত সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ সব রাজনৈতিক দলের প্রধানেরাই সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এতে মনজুরের না থাকে জনসমর্থন, না থাকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। চট্টগ্রামের বাইরে যেসব সামরিক ইউনিট তিনি পাঠিয়েছিলেন, তার কর্মকর্তাদেরও কেউ কেউ পালিয়ে যান। তিনি স্পষ্টই উপলব্ধি করেন, সেনানিবাসের অভ্যন্তরেও তাঁর প্রতি সমর্থন ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ৩১ মে রাতেই তিনি সপরিবারে সেনানিবাস ত্যাগ করে উত্তরের দিকে চলে যান।
৩১ তারিখে দিনেই আমরা জানতে পারি যে, জিয়াউর রহমানের প্রাণরক্ষার চেষ্টায় নিহত হন তার প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল মইনুল আহসান এবং তাঁর এডিসি ক্যাপ্টেন আশরাফুল হাফিজ খান। এঁরা উভয়েই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা-কর্নেল মইন ছিলেন বীরপ্রতীক আর ক্যাপ্টেন আশরাফ রক্ষী বাহিনীর সাবেক অফিসার। তাঁদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের কয়েকজন সদস্য এবং পুলিশের একজন সদস্যও নিহত হন।
জিয়াউর রহমানের সফরসঙ্গীদের মধ্যে মন্ত্রী ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ৩০ তারিখ ভোরেই সার্কিট হাউজ থেকে বেরিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে থাকেন শহরে। আরেক মন্ত্রী ডা. আমিনা রহমানকে সার্কিট হাউজ থেকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান চট্টগ্রামের এনডিসি নাসিরুদ্দীন আল মাসুদ। নাসির ও তার স্ত্রী কণার (আমার বন্ধু গাজী শাহাবুদ্দীন আহমদের ছোটো বোন) মুখে পরে আমরা সে-বৃত্তান্ত জানতে পারি।
১ জুন মানিকছড়ির এক চা-বাগানে দুপুরের খাওয়ার খাওয়ার সময়ে জেনারেল মনজুর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার করে তাঁকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের কিছু সময়ের জন্যে হাটহাজারি থানায় এনে রাখা হয়। শোনা যায়, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম কুদুসকে মনজুর বারবার অনুরোধ করেছিলেন তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করার জন্য। কুদুস সেকথা শোনেননি, তিনি সেনা-কর্মকর্তাদের হাতেই মনজুরকে তুলে দেন। তাঁরা তাঁকে নিয়ে আসেন সেনানিবাসে এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের সামনেই তাঁকে হত্যা করা হয়। বলা হয়, জিয়া-হত্যায় বিক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ সেনারা মনজুরকে হত্যা করেছে। কুদুস পরে ঢাকায় মতিঝিল থানায় বদলি হন। সরকারি কর্ম ত্যাগ করে আরো পরে তিনি দেখা দেন বিশিষ্ট শিল্পপতিরূপে।
মনজুরের সঙ্গে আরো দু-একজন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। এঁদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান ও কর্নেল মাহবুব দুজনেই মানিকছড়ির কাছেই নিহত হন। জীবদ্দশায় ধরার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এঁদেরকে হত্যা করা হলো কেন এবং মনজুরকে বাঁচিয়ে রেখে জিয়া-হত্যারহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা হলো না কেন, এ-প্রশ্ন বহুজনকে আলোড়িত করেছে। আমার মামাতো ভাই সৈয়দ কামরুজ্জামান একবার এক সামরিক কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, দেশের প্রেসিডেন্টকে মারা আপনাদের প্রেরোগেটিভ, কিন্তু প্রেসিডেন্ট-হত্যার দায়ে অভিযুক্ত লোককে বেসামরিক বাহিনী ধরে দিলোতাকে আপনারা কোন অধিকারে মারলেন?’ ওই কর্মকর্তা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ওই স্থান ত্যাগ করেছিলেন।
১ জুন রাঙ্গুনিয়ায় জিয়ার কবর খুঁজে পাওয়া যায়। সেখান থেকে তাঁর দেহাবশেষ তুলে ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ওই হেলিকপ্টারেই ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. আমিনা রহমান। ঢাকায় ফেরেন। শেরে বাংলা নগরে বিশাল জানাজার পরে জিয়ার দেহাবশেষ সমাধিস্থ হয়।
এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য/স্বাধীনতার প্রথম দশক (ঢাকা, ২০০০) বইতে মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী লিখেছেন যে, জিয়া-হত্যার সংবাদ পেয়েই সেনাবাহিনী-প্রধান জেনারেল এরশাদ ‘পরোক্ষ ইঙ্গিতে সামরিক আইন জারির কথা বললেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তা করতে তাঁকে। আরো প্রায় দশ মাস অপেক্ষা করতে হয়। আপাতত তাঁর নির্দেশে মেজর জেনারেল মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে এক তদন্ত কমিটি গঠিত হয় চট্টগ্রামে সেনাবিদ্রোহ সম্পর্কে অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে। এই কমিটি ৩৫ জন সেনা-কর্মকর্তাকে কোর্ট মার্শাল করার সুপারিশ করেন। মেজর জেনারেল আবদুর রহমানের সভাপতিত্বে গঠিত একটি ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শালে ২৯ জন অভিযুক্ত হন। কোর্ট মার্শালে বাদীপক্ষের কৌঁসুলি ছিলেন ব্রিগেডিয়ার নাজিরুল আজিজ চিশতী ও কর্নেল এ এম এস এ আমিন। আসামিপক্ষকে। সমর্থন করার জন্যে সেনা-কর্তৃপক্ষ যে-তিনজনকে মনোনীত করেন, তাঁরা হলেন ব্রিগেডিয়ার আনোয়ার হোসেন, কর্নেল মুহম্মদ আইনুদ্দীন ও লেফটেনান্ট কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আটাশ বছর (ঢাকা, ১৯৯৯) বইতে মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম লিখেছেন যে, ‘বিচার প্রক্রিয়াটি অতি সংক্ষিপ্ত ছিল এবং হঠাৎ করে শেষ হয়েছিল। বিচারে ১৩ জন কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড এবং আরো ১৪ জন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তেরা সবাই এবং কারাদণ্ডপ্রাপ্তেরা প্রায় সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সর্বকনিষ্ঠ ছিল ক্যাপ্টেন জামিল হক–আমার বন্ধু এ জেড এম আবদুল আলীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। কারাদণ্ডিতদের মধ্যে ছিলেন মেজর লতিফ–আমার ছাত্রী শিরিণ আখতারের স্বামী।
কোর্ট মার্শালের মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা রুজু করা হয়। আবেদনকারীদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন এম এইচ খোন্দকার, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, খন্দকার মাহবুবউদ্দীন আহমেদ, ড. এম জহির, গাজীউল হক ও জাকের আহমদ। সরকারপক্ষে দাঁড়ান অ্যাটর্নি জেনারেল কে। এ বাকের, তাঁর সঙ্গে আবদুল ওদুদ ভূঁইয়া, সোহরাব আলী, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এম এম হক ও বি হোসেন। তিনদিন শুনানির পরে বিচারপতি ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি লতিফুর রহমানকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ মামলা খারিজ করে দেন। তাঁরা বলেন, কোর্ট মার্শালের বিরুদ্ধে রিট আবেদন গ্রহণের এখতিয়ার হাইকোর্টের নেই। আবেদনকারীরা আপিল বিভাগে আপিল করেন। সেখানে আবেদনকারীদের পক্ষে যোগ দেন ড. কামাল হোসেন ও সিরাজুল হক। পাঁচদিন শুনানির পরে প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, বিচারপতি রুহুল ইসলাম, বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ আপিল প্রত্যাখ্যান করেন মূলত এখতিয়ারের প্রশ্নেই।
মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তদের প্রাণরক্ষার দাবিতে তাঁদের স্বজনরা অনশন করেন। ২২ সেপ্টেম্বর আপিল আদালতের রায় ঘোষিত হলে ঢাকায় প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়, ঢাকার বাইরেও প্রতিবাদ করা হয়। পরে আওয়ামী লীগসহ বহু রাজনৈতিক দল
মৃত্যুদণ্ডদানের নিন্দা করে। অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করার প্রার্থনা অস্থায়ী। রাষ্ট্রপতি না-মনজুর করেন। দেশের বিভিন্ন কারাগারে ২২ সেপ্টেম্বর রাতেই ১২ জন সামরিক কর্মকর্তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আরেকজনের ফাঁসি বিলম্বিত হয় তিনি তখন চিকিৎসাধীন ছিলেন বলে। ক্যাপ্টেন জামিলের পিতা ছিলেন তখন ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ প্রিজনস। শোনা যায়, পুত্রসহ ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার নির্দেশ তাঁকেই স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। কারাদণ্ডে দণ্ডিত কর্মকর্তাদের শাস্তি পরবর্তীকালে লাঘব করা হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তারা মুক্তিলাভ করেছিলেন।
জিয়া-হত্যার তদন্ত হয়নি, সুতরাং সে-রহস্য উদঘাটিত হয়নি। তদন্ত, বিচার ও শাস্তি যা হয়েছিল, তা সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের কারণে। বহু বৎসর পরে মনজুর-হত্যার জন্যে তাঁর ভাই ব্যারিস্টার আবুল মনসুর জেনারেল এরশাদকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা দায়ের করেন। নানা কারণেই বাদীপক্ষ সে-মামলা ঠিকমতো চালাতে পারে নি। তবে মামলাটি এখনো বিচারাধীন।
যশোরের জিওসি মেজর জেনারেল মীর শওকত আলীকে জিয়া-হত্যার পরপর সদর দপ্তরে বদলি করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে তাঁকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করা হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই অবসর দিয়ে মিশরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। জেনারেল মইন লিখেছেন, মেজর জেনারেল আবদুস সামাদের নেতৃত্বে গঠিত একটি বোর্ডের মাধ্যমে ‘আরো প্রায় ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে বিভিন্ন অজুহাতে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়। অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা নন, এমন কর্মকর্তাদেরও কেউ কেউ অবসরপ্রাপ্ত হন। নিজের অবস্থা সম্পর্কে জেনারেল মইন লিখেছেন :
যেহেতু আমি অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল তাই নিয়ম অনুসারে আমার সার্বিক তত্ত্বাবধানে কোর্ট মার্শাল হওয়ার কথা। অথচ, আমাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে না জানিয়ে এবং না জড়িয়ে সেনাবাহিনীর প্রচলিত আইন ভেঙে ওইসব কোর্ট মার্শাল ও তদন্ত করা হয়। এদিকে আমার পেছনে সর্বক্ষণ গোয়েন্দা। আমার টেলিফোনে আড়িপাতা হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টা বাসাতে আমার চালচলন পর্যবেক্ষণের জন্য সামরিক গোয়েন্দারা গাড়িতে ওয়ারলেস লাগিয়ে পাহারা দিচ্ছে। এক পর্যায়ে একদিন আমি গোয়েন্দাদের সার্বক্ষণিক পাহারায় অতিষ্ঠ হয়ে টেলিফোনে খুব রূঢ় ভাষায় সামরিক গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী (পরে। এরশাদের মন্ত্রী) ও সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদকে বিষয়টি অবহিত করি। তারা দুজন এমন ভান করলেন যেন তাদের অজান্তেই আমার ওপর নজরদারি হচ্ছে। বস্তুত তাঁদের অজান্তে এমনটি হবে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
১৫ নভেম্বর দেশে রাষ্ট্রপতি-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি সাত্তার যাতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন, সেজন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়। বিএনপি প্রার্থী হিসেবে তিনি পান এক কোটি ৪২ লাখের ওপর ভোট। আওয়ামী লীগ প্রার্থী এবং অন্যদের দ্বারা সমর্থিত ড. কামাল হোসেন পান প্রায় ৫৭ লাখ ভোট। হাফেজজী হুজুর পান চার লাখের কাছাকাছি। জেনারেল ওসমানী পান তিন লাখের কিছু বেশি। মেজর জলিল পান প্রায় আড়াই লাখ। ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ পান প্রায় সোয়া দুই লাখ।
নাগরিকদের পক্ষ থেকে অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন একটি বিবৃতি দিয়ে কামাল হোসেনকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম।
জেনারেল এরশাদ প্রায় প্রকাশ্যেই বিএনপি প্রার্থীর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। নির্বাচনে বড়রকম কারচুপি হয়। চট্টগ্রামের একটি ভোটকেন্দ্রে যখন ভোটগণনা চলছিল, তখন বেতার-টেলিভিশনে সেই কেন্দ্রের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষিত হয়।
কাছে-দূরে
১.
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কলকাতা থেকে মুক্তধারা আমার মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য পুনর্মুদ্রণ করেছিল। সেটাই ছিল দেশের বাইরে আমার বইয়ের প্রথম। প্রকাশনা। ১৯৭৮ সালে কিয়োটোতে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিম্পোজিয়মে পঠিত প্রত্যেকটি প্রবন্ধই বোধহয় মনোগ্রাফ-আকারে ওই বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করেছিল টোকিও থেকে। তার মধ্যে আমারটাও ছিল একটি। সেটি আবার সংকলিত হয়েছিল আনোয়ার আবদেল মালেক ও এ এন পাণ্ডেয়া-সম্পাদিত সিম্পোজিয়মের বিবরণ-সংবলিত Intellectual Creativity in Endogenous Culture গ্রন্থে, তাও টোকিও থেকেই, ১৯৮১ সালে। এই ১৯৮১ সালেই লন্ডন থেকে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি প্রকাশ করলো আমার Factory Correspondence and other Bengali Documents in the India Office Library and Records, গ্রন্থস্বত্ব রানির। আমি পরিহাস করে বলেছিলাম, রানি আমার প্রকাশকদের একজন।
লাইব্রেরি-কর্তৃপক্ষ আমার জন্যে বই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ঢাকায় ব্রিটিশ কাউনসিলের কাছে–কূটনৈতিক ব্যাগের সুবিধে নিয়ে। ব্রিটিশ কাউনসিলের আঞ্চলিক প্রতিনিধি আমাকে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, কীভাবে বইটি গ্রহণ করার সুবিধে আমার হবে। বলেছিলাম, আমি ঢাকায় আসছি–তখন সংগ্রহ। করবো। সে-ভদ্রলোকের সঙ্গে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ভালো আলাপ ছিল। সারূকেও তিনি বইটির প্রাপ্তিসংবাদ জানিয়েছিলেন। সার মহাখুশি। চট্টগ্রামে আমাকে ফোন করে নানা কথা বললেন। আমি ঢাকায় এসে সারূকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিটিশ কাউনসিলে গেলাম। বইগুলো নিয়ে সার ও আমি স্বামীবাগে এলাম–সেখানে বেবী এবং ছেলেমেয়েরাও ছিল। সার বেবীকে বললেন, আমার ষাট বছর বয়সে বইটি বের হলে তিনি এত উত্তেজিত হতেন না, মধ্য-চল্লিশে ব্লুমহার্টের ক্যাটালগের সাপ্লিমেন্টারি ভলিউম প্রকাশ করতে পারা একেবারে সামান্য অর্জন নয়। আমার মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য এবং মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র (ঢাকা, ১৯৬৯) তাঁর অনুমোদন লাভ করেছিল। তবে স্বরূপের সন্ধানে (ঢাকা, ১৯৭৬) তাঁর কৌতূহল জাগায়নি, এবং মুনীর চৌধুরী (ঢাকা, ১৯৭৫) পড়ে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘কী সব। লিখছেন! এখন তিনি প্রসন্ন হলেন, যদিও এ-প্রসন্নতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আমি যে দেশ-বিদেশে সেমিনার-সিম্পোজিয়মে প্রবন্ধ পড়তে যাই, এ ছিল তাঁর খুবই অপছন্দ। তিনি বলতেন, ‘ওদের দরকার সেমিনার করা, কিন্তু হেইখানে প্রবন্ধ পড়ার কী দরকার আপনার! অন্যের কাজে সময় নষ্ট না কইরা নিজের কাজ করেন না কেন?’ পরে তিনি আশাহত হয়ে বলেছিলেন, আপনি তো আর ল্যাখ্যাপড়া করলেন না! তিনি নিজেই মুসলিম-মানস ইংরেজিতে অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন, শেষ করতে পারেননি; আমার কাছে তার অনেক প্রত্যাশা ছিল, আমি পূরণ করতে পারিনি। তাঁর নির্লিপ্ততা আমি আয়ত্ত করারও চেষ্টা করিনি।
Factory Correspondence-এর প্রকাশ আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা, একথা আমি সব সময়ে স্বীকার করবো। ওটি আমার অশেষ পরিশ্রমের ফসল। Bulletin of the School of Oriental and African Studiesu 478 কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের Modern Asian Studiesএ তার অনুকূল সমালোচনা বের হয়েছিল। তা না হলেও, আমি জানতাম, আমি ফাঁকি দিইনি। কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমিক স্টাফ ফেলো হিসেবে আমি নামমাত্র যুক্ত ছিলাম সোয়াসের ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ অ্যান্ড সিলোন ডিপার্টমেন্টের প্রধান। প্রফেসর রাইটের সঙ্গে। সংস্কৃতের পরে বিকশিত হয়েছে, এমন কোনো ভাষার সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহী হওয়ার কোনো কারণ তাঁর ছিল না। তিনি যখন প্রথম। শোনেন যে, আমি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোন ঢাকা কুঠির ‘লেটার-বুকস নিয়ে মেতে উঠেছি (লেটার-বুকস’ কথাটাতেই তার আপত্তি ছিল), তখন সাহিত্যের অধ্যাপকের এহেন দুর্মতিতে তিনি বেশ উদৃবিগ্ন হয়েছিলেন, যদিও তা যথাসাধ্য চেপে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি ওঁকে এক কপি বই পাঠিয়েছিল সৌজন্যস্বরূপ, তিনি পত্রপাঠ–সম্ভবত বইটির একটি পাতা না খুলেই–সেটা চালান করে। দিয়েছিলেন সোয়াস লাইব্রেরিতে। পরে তিনি আমাকে বলেছিলেন, আশা করি, আমি কাজটা ঠিকই করেছি।’
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরির ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান ডেসমন্ড আমাকে জিজ্ঞাসা। করেছিলেন, কত কপি বই ছাপবেন। আমি বলেছিলাম, পাঁচ পাউন্ডের কম দাম হলে ৫০০, নইলে ৩০০। ডেসমন্ড হতাশ হয়ে বললেন, এত কম! আমি বলেছিলাম, এটা শোওয়ার আগে পড়ার (বেডসাইড রিডিং’) মতো বই হতে যাচ্ছে না। তারা বইয়ের দাম ধরেছিলেন ১৬ পাউন্ড। আমার ধারণা, ওই বইয়ের বড়ো ক্রেতা ছিলাম আমিই। পরের বছর লন্ডনে গিয়ে, বন্ধুবান্ধবদের উপহার দেওয়ার জন্যে, আমি পাঁচ কপি বই কিনেছিলাম।
২.
দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি, যদিও যেদিন ১২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সেনা বিদ্রোহের দায়ে ফাঁসি দেওয়া হয়, সেদিনই জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা হয়। তারপর রাষ্ট্রপতি-নির্বাচন। বৃহৎ মন্ত্রিসভা-গঠন। আমার খুবই শ্রদ্ধেয় মানুষ ড. এম এন হুদার উপরাষ্ট্রপতিরূপে নিয়োগলাভ।
এর মধ্যে শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে এলো। আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সে দেশে ফিরেছিল, তার পরপরই জিয়া-হত্যার ঘটনা ঘটে। সেদিন সে সফরে গিয়েছিল সিলেটে। এখন চট্টগ্রাম-সফরে এসে সে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলো ক্যাম্পাসে। তার এ সৌজন্যবোধে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। এতদিন। পরে দেখা হওয়ায় প্রথমেই তার স্বজন-হারানোর দুঃখের কথাটাই মনে ভিড় করেছিল। রাজনীতির কথা যা হয়েছিল, তা সামান্য।
এদিকে সেনাপ্রধান এরশাদ হঠাৎ করে খুব সক্রিয় হয়ে উঠলেন। আজ এক সেনানিবাসে, কাল আরেক সেনানিবাসে বক্তৃতা। এ-কাগজে সাক্ষাৎকার, ও কাগজে বিবৃতি। দেশের শাসনব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর অংশ দাবি করে বসলেন তিনি। জেনারেল ওসমানী বললেন, সামরিক বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় এমন বিবৃতি দেওয়া সকল নিয়মবহির্ভূত। কা কস্য পরিবেদনা!
এই পরিস্থিতিতে আমি চলে গেলাম দেশের বাইরে এবং বেশ কিছু কালের জন্যে। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পের অংশস্বরূপ আনোয়ার আবদেল-মালেক ‘বিশ্বের রূপান্তর’ শিরোনামে পাঁচটি নতুন সেমিনার অনুষ্ঠানের প্রস্তাব অনুমোদন করিয়ে নেন। প্রথমটি বেলগ্রেডে হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে, ১৯৭৯ সালে; দ্বিতীয়টি হলো মাদ্রিদে, অর্থনীতি ও সমাজ নিয়ে, ১৯৮০ সালে। দ্বিতীয়টিতে তিনি আমাকে যোগ দিতে বলেছিলেন; মাদ্রিদে কখনো যাওয়ার সুযোগ পাইনি, তা সত্ত্বেও সেখানে আমি যাইনি, বিষয়টি আমার এলাকাভুক্ত নয় বলে। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে তিনি আলজিয়ার্সে সংস্কৃতি ও চিন্তাধারা-বিষয়ে (Culture and Thought in the Transformation of the World) তৃতীয় সেমিনার করবেন। এতে আমাকে যোগ দিতে হবে, শুধু তাই না, এই সেমিনারের বিবরণও গ্রন্থাকারে প্রকাশের জন্যে তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদন করতে হবে। আমি রাজি হলাম। তবে এই শর্তে যে, আলজিয়ার্সে সেমিনারে যোগ দেওয়ার পরে আমি প্যারিসে তাঁর কাছাকাছি থেকে বিবরণ সম্পাদনা করবো। বস্তুত, দেশে আমার নানাধরনের সংশ্লিষ্টতার কারণে আশঙ্কা হচ্ছিল, সম্পাদনার কাজটা সময়মতো শেষ করতে পারবো না। তার ওপর এক সম্পাদক প্যারিসে, অপরজন চট্টগ্রামে, সমন্বয়সাধনও দুরূহ। আনোয়ার আবদেল-মালেককে বললাম, আমার পারিশ্রমিকের অর্থটা প্যারিসে দিলে তা দিয়ে আমার থাকা-খাওয়া চলে যাবে। তিনি যেন তেমন ব্যবস্থা করেন। আনোয়ার খুবই খুশি হলেন, তবে তিনি নিশ্চয় আমাকে বেকুব ঠাওরালেন।
অতএব এক ‘পউষ প্রখর শীতে ঝঝর ঝিল্লিমুখর রাতি’তে (বোধহয় পৌষ আসতে তখনো দু-চারদিন বাকি ছিল) চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে, দিল্লি বোম্বাই-রোম হয়ে আলজিয়ার্স রওনা হলাম। ঢাকায়, আমার বন্ধু আবদুল আলীর জ্যেষ্ঠাগ্রজ, এ জেড এম আবদুল আলিম বললেন, ‘সে কী, তুমি আলজিরিয়া যাচ্ছো, মিসেস আলজিরিয়া তো এখন ঢাকায়। তাঁর শ্যালিকা ইলার স্বামী আবুল ফতেহ্ আলজিয়ার্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। ওই সময়টায় ইলা আবার ঢাকায়। তাই তার এই বিস্ময় বা দুঃখবোধ।
ঢাকা থেকে রোম পর্যন্ত গেলাম এয়ার ইন্ডিয়ায়। ওখান থেকে অন্য এক এয়ারলাইনসে আলজিয়ার্স। বিমানবন্দরে পৌঁছে ভিসা পেতে কোনো অসুবিধে হলো না। এক সরকারি কর্মকর্তা আমাকে নিতে এসেছিলেন সেখানে। অল্পসময়ে আনুষ্ঠানিকতা পার করে তিনি আমাকে পৌঁছে দিলেন হোটেলে। রোম-আলজিয়ার্স অংশে বিমানে নৈশভোজ করতে হয়েছিল। তাতে এমন কিছু খেয়েছিলাম, যা আমার সয়নি। রাতে বমি করতে শুরু করলাম। বেসিন ভরে গেল, আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম। কোনোক্রমে বমি করতে যাই আর বিছানায় ফিরে আসি। ঘরের টেলিফোন কাজ করে না, সাহায্য প্রার্থনা করার উপায় নেই। সকালে যে-মেয়েটি ঘর পরিষ্কার করতে এলো, সে আরবিতে কী যে বললো, বোঝার উপায় নেই। ভাবলাম, এবার সাহায্য আসবে। এলো না। সকালে সেমিনারের উদ্ববাধনী অনুষ্ঠান। আমি হোটেলে, অথচ অনুষ্ঠানে নেই। সেই অধিবেশনের শেষে আনোয়ার আবেদল-মালেক এলেন সেমিনারের সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি ড. জামিল বেনবুজিদকে নিয়ে আমার খোঁজ করতে। ভাগ্যক্রমে তিনি একজন পেশাদার চিকিৎসক, এদেশের উচ্চতর বৈজ্ঞানিক গবেষণা মন্ত্রণালয়ের পরিচালক। তিনি এসে আমাকে দেখলেন, ব্যবস্থাপত্র লিখলেন, ওষুধ পাঠিয়ে দিলেন, দিনটা বিশ্রাম করে কাটাতে বললেন, টেলিফোন ঠিক করার ব্যবস্থা করলেন। তার কথা শুনেই অর্ধেক ভালো হয়ে গেলাম, অধিবেশনে অনুপস্থিতির ফলে লজ্জিত হওয়ার কারণও অপসৃত হলো।
সেমিনারে যোগ দিলাম দ্বিতীয় দিনে। দেখি, কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন দি সোশাল সায়েন্সেসের পার্থ চট্টোপাধ্যায় এসেছেন–সেন্টারের অতিথি ভবনে একাধিকবার থাকার সুযোগে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ছিল। নিউ ইয়র্ক থেকে এসেছেন ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন–তারই আমন্ত্রণে ১৯৭৪ সালে মন্ট্রিয়লে গিয়েছিলাম এক সেমিনারে। এখন তিনি স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কে (বিংহ্যামটন) ফার্ডিনান্ড ব্রডেল সেন্টার ফর দি স্টাডিজ ইন ইকনমিক্স, হিস্টরিকাল সিসটেমস অ্যান্ড সিভিলিজেশনের পরিচালক–তাঁর সেন্টার সম্পর্কিত কাগজপত্র আমাকে নিয়মিত পাঠিয়ে থাকেন চট্টগ্রামে। প্যারিস থেকে এসেছেন ফাদার ব্রুনো রাইবস–যে-শ্রেণির যাজকেরা আফ্রিকায় ও ল্যাটিন আমেরিকায় এসটাবলিশমেন্ট-বিরোধী সংগ্রামে জড়িত, তিনি সেই শ্রেণির; বলেন, খ্রিষ্টের শিক্ষাই তাঁকে প্রতিবাদী হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ১৯৭৮ সালে, কিয়োটোতে।
নতুন করে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হলো। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন রেক্টর হয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার সমাজবিজ্ঞানী সোয়েজাতমোকো। মালয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুসেন আলি–বামপন্থী চিন্তাধারার জন্যে জেল খেটেছেন অনেককাল। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. জন ডান। মেক্সিকোর এক গবেষণা-প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ড. সুসানা ব্রুনা। বুদাপেস্টের কার্ল মার্কস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অধ্যাপক ড. তামাস জানতেস। আলজিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রধান নাজি সাফির। দার-এস-সালামের এক কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. এমনুয়া। আরো অনেকে। তার মধ্যে আনোয়ার আবেদল-মালেকের সচিব ক্রিস্তিন কলপার কথা পরে বলতে হবে।
আনোয়ার আবদেল-মালেক নাকি সেমিনারের মূল প্রতিবেদক করতে চেয়েছিলেন আমাকে, আমি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে ভার বর্তালো পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ওপরে। তবে চারটি অধিবেশনের একটির রিপোর্ট আমাকে তৈরি করতে হলো। বাকি তিনটি করলেন অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অয়ভিন্দ অসতেরুদ, ভেনেজুয়েলার কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা-কেন্দ্রের পরিচালক ড. হোসে অগাস্তিন সিলভা-মিশেলেনা এবং বেলগ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. ব্লাদিমির স্তামবুক।
সেমিনার চললো ১৩ থেকে ১৭ ডিসেম্বর অবধি। ১৫টি প্রবন্ধ, আটটি গবেষণা-প্রতিবেদন, আরেকটি বাড়তি লেখা। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে যে-সেমিনার দুটি করেছিলাম, আমারটা ছিল তার আলোচনার সারসংক্ষেপ। পার্থের লেখাটাও এমনি প্রতিবেদন-শ্রেণিভুক্ত। সেটি পরে তাঁর Nationalist Thought and the Colonial World (লন্ডন, ১৯৮৬) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এটি পড়ার আগে তিনি ছোটো যে-ভূমিকা করেছিলেন, তাতে বলেছিলেন যে, আমার উপস্থিতিতে লেখাটি পড়তে তার সংকোচ হচ্ছে, কেননা, এতে বাংলার যেসব লেখকের প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে, তাদের সম্পর্কে আমি অনেক বেশি জানি। পার্থের এ-কথায় অনেকেই আমাকে মস্ত পণ্ডিত বলে ভুল করেছিলেন। কলম্বো থেকে সুসান্ত গুণতিলেকে আসতে পারেননি, কিন্তু ঐতিহ্য ও আধুনিকতা সম্পর্কে অতি চমৎকার একটি প্রবন্ধ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আরো কয়েকটি ভালো প্রবন্ধ উপস্থাপিত হয়েছিল। লেখাগুলো ছিল আরবি, ইংরেজি, ফরাসি ও স্প্যানিশে। ফলে তাৎক্ষণিক অনুবাদের ওপর খুব ভরসা করতে হয়েছিল।
যে-হোটেলে আমরা ছিলাম, সেমিনার হয়েছিল সেখানেই। তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ তাই বেশি হয়নি। যেখানে বেনবেল্লা গৃহবন্দি ছিলেন দীর্ঘকাল, তার সামনে দিয়ে বারদুই আসা-যাওয়া করতে হলো। বেনবেল্লা বোধহয় তখন দেশত্যাগের শর্তে মুক্ত হয়েছেন–প্যারিসে প্রবাসজীবন যাপন করছেন। বুমেদিন তখন আর বেঁচে নেই। তবে আলজিরিয়ার স্বাধীনতা-সংগ্রামের বেশ কিছু স্মারক এখানে-ওখানে দেখা গেল। তবে তার চেয়েও বেশি দেখা গেল নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বত্র উপস্থিতি। ইসলামপন্থীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তারও কিছু আভাস পাওয়া গেল। এফএলএনের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সেমিনারের বোর্ড অফ অনারে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হলো।
একদিন সবাই মিলে যাওয়া হলো আলজিয়ার্সের বাইরে। রোমানরা যখন এই অঞ্চল শাসন করেছিল, তার স্মৃতিনিদর্শন দেখতে। রোমানদের তৈরি নগর দেওয়ালের ভগ্নাবশেষ তখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। সে-আমলের নগর পরিকল্পনার কিছু বিস্ময়কর প্রমাণও পাওয়া গেল।
রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহর আমন্ত্রণে এক সন্ধ্যা তাঁর বাড়িতে কাটালাম। ঢাকা থেকে তিনি খবর পেয়েছিলেন আমার আসার, পৌঁছে আমিও ফোন করেছিলাম। এই সৌজন্যপরায়ণ মানুষের সান্নিধ্যে সন্ধ্যাটা ভালো কাটলো।
হোটেলে একদিন আনোয়ার আবদেল-মালেকের সঙ্গে দেখা করতে এলো দুটি মেয়ে। তার মধ্যে একজন অপূর্ব সুন্দরী। আনোয়ার তার নাম দিয়েছিল নেফারতিতি। আলজিয়ার্সে রাষ্ট্রীয় বেতারের ঘোষিকা। আরবি ছাড়াও ভালো ইংরেজি ও ফরাসি বলে। অনেককাল পরে প্যারিসে আনোয়ারের ঘরেই আবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
আলজিয়ার্স থেকে আনোয়ার, মাদাম কলপ ও ফাদার রাইবস একসঙ্গে ফিরে গেলেন প্যারিসে। অন্য একটি ফ্লাইটে পার্থ ও আমিও সেখানে যাত্রা করলাম। পার্থ কয়েকদিন থাকবেন প্যারিসে। আমার প্রায় মাসতিনেক থাকার পরিকল্পনা। সিতে য়ুনিভার্সিতেয়ারে রেজিস রোবের গারিক বলে একটি অংশ আছে–সফরকারী বিদেশি শিক্ষকদের থাকতে দেওয়া হয় সেখানে। ওই রেজিসে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।
৩.
প্যারিসে পৌঁছানোমাত্র আনোয়ার আবদেল-মালেকের সেক্রেটারি ক্রিস্তিন কলপা আমাকে তার পক্ষপুটে টেনে নিলেন। ঠিকমতো পৌঁছোলাম কি না এবং রজিস রোবের গারিকে আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে কি না, তা জানতে টেলিফোন করলেন প্রথমে। পরদিন সকালে আনোয়ারের অফিসে কীভাবে পৌঁছোবো, তার হদিস দিলেন।
আনোয়ার আবদেল-মালেকের অফিস সঁত্র নাসিওনাল র্যশেৰ্শ সিয়ান্তিফিক বা সংক্ষেপে সিএনআরএসে। সেখানে তাঁর কক্ষে বসেন ক্রিস্তিন এবং কনিষ্ঠ সচিব সানিয়া আরুসি। সানিয়া আরব ও তরুণী, ফরাসি তার মাতৃভাষার মতো, ইংরেজিও আয়ত্তে, তবে দ্রুত কাজ করতে অভ্যস্ত নয়। সেই ঘরেই জানলার পাশে আমার জন্য চেয়ার-টেবিল পাতা হয়েছে। ক্রিস্তিন আমাকে সঙ্গে করে অফিস থেকে বেরিয়ে প্রথমে গেলেন ব্যাংকে–আমার হিসাব খুলতে। তারপর বড় একটা দোকানে গিয়ে–আমার কী কী লাগবে, জেনে নিয়ে এবং কী কী লাগতে পারে, ভেবে নিয়ে–একে একে সব সংগ্রহ করে দিলেন। তার মধ্যে একটি অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাস ছিল–তাতে বৈদ্যুতিক তার লাগিয়ে ইমারশন হিটারের মতো চা-কফির জন্যে পানি গরম করা যেতো–ভারি সুবিধের। জিনিসপত্র কিনে-কেটে সিএনআরএসে ফেরা। সেখানে আমার পরিচয়পত্র সংগ্রহ করা, ওই বিশাল ভবনের যেসব অংশের সঙ্গে আমার যোগাযোগ অপরিহার্য–যেমন, লাইব্রেরি, ডাইনিং রুম, ক্যাফেটারিয়া–সেগুলো চেনানো এবং ভর্তুকি-দেওয়া হারে খাবার কুপন কেনা। তারপর দুপুরে একসঙ্গে খাওয়া। তিনি বাড়ির টেলিফোন নম্বর আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। এখন খুব জোর দিয়েই বললেন, প্রয়োজন হলেই যেন যে-কোনো সময়ে তাঁকে নিঃসঙ্কোচে ফোন করি বাসায়। ক্রিস্তিনকে আমি মাদাম কলপা বলে ডাকতাম, তিনিও আমাকে প্রফেসর আনিস বলে সম্বোধন করতেন। এই আনুষ্ঠানিকতা সত্ত্বেও আমাদের গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। অফিসের বাইরেও আমরা একসঙ্গে খেয়েছি, একসঙ্গে সিনেমায় গেছি, তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছি, তাঁর স্বামীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, যে-কোনো সময়ে তাঁর সাহায্য চেয়েছি এবং পেয়েছি।
আলজিয়ার্স থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায় আর আমি একসঙ্গে প্যারিসে এসেছিলাম। পার্থর স্ত্রী সেখানে আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন। আমাদের তিনজনকে এক সন্ধ্যায় আনোয়ার আবদেল-মালেক তাঁর বাড়িতে নৈশভোজে ডাকলেন। তার সঙ্গে তাঁর মিশরীয় ডাক্তার স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে অনেক দিন। মহিলা বোধহয় জেনেভায় থাকেন। তাদের কন্যা–একমাত্র সন্তান–ডাক্তারি পড়ে ভিয়েনায়। আমরা গিয়ে দেখলাম, অতি সুন্দরী এক ফরাসিনী রান্নাবান্না করছেন, যথাসময়ে তিনিই পরিবেশন করে খাওয়ালেন। পরেও দেখেছি, আনোয়ার কাউকে বাড়িতে খেতে ডাকলে কোনো না কোনো মহিলা এসে সবকিছু সামাল দেন। একইসঙ্গে গুণবান ও রূপবান হওয়ার এই সুবিধাটা তিনি পুরোপুরি লাভ করেছেন এবং ভোগ করেছেন।
সেই প্রথম সন্ধ্যায় আনোয়ারের ফ্ল্যাটে ঢুকে তাঁর সুন্দরী বান্ধবীকে লক্ষ করার আগে যা চোখে পড়েছিল, তা ড্রয়িংরুমের টেবিলে রাখা জামাল আবদেল নাসেরের আবক্ষ প্রতিকৃতি। জীবনের শেষদিকে নাসের যখন মিশরে বামপন্থীদের দমন করতে অগ্রসর হন, তখন গ্রেপ্তার এড়াতে এক গভীর রাতে আনোয়ার আবদেল-মালেক স্বদেশ ত্যাগ করে ফ্রান্সে চলে আসেন। সেই থেকে প্যারিসই তার স্থায়ী আবাস, যদিও পরে তিনি নিজের মায়ের কাছে এবং দেশমাতৃকার কাছে ফিরে গেছেন। এসব কথা ভেবেই আমি মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি না নাসেরের দ্বারা নির্যাতিত ও বিতাড়িত, তাহলে তাঁর ছবি কেন আপনার ঘরে শোভা পাচ্ছে? আনোয়ার দ্বিধাহীনভাবে বলেছিলেন, নাসের আমার প্রতি সুবিচার করেননি, কিন্তু মিশরের জন্য তিনি যা করেছেন, তা অবিস্মরণীয়। হয়তো আর কয়েক বছর বাঁচলে তার নীতির পরিবর্তন হতো এবং আমি দেশে ফিরে যেতে পারতাম। আনোয়ার সাদাতকে আনোয়ার আবদেল মালেক যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়নক ভাবতেন। আমরা যখন সেই সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে বসে আলাপ করছি, তখন সাদাত নিহত এবং হোসনি মুবারক সদ্য রাষ্ট্রপতি হয়েছেন মিশরের। তাঁর প্রতিও আনোয়ারের আস্থা ছিল না। আনোয়ার ছিলেন ইসরাইলের চরম বিরোধী। নাসের ছাড়া আর কেউ সত্যিকারভাবে ইসরাইলের বিরোধিতা করেছেন বলে তিনি মনে করতেন না। তার সন্দেহ ছিল, ইসরাইলি গোয়েন্দারা তাঁকে চোখে-চোখে রাখছে। তিনি বলতেন, হে আমার প্রিয় ভ্রাতা, রমণীর সান্নিধ্যলাভের বিষয়েও খুব সতর্ক থাকতে হয়, কারণ ইসরাইলিদের কৌশলের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
প্যারিসে আমার কাজটা ছিল আলজিয়ার্সে সদ্যসমাপ্ত সেমিনারের কার্যবিবরণী তৈরি করা। অধিবেশন-অনুযায়ী পঠিত প্রবন্ধগুলো সাজিয়ে তার একটা ভূমিকা লিখে আমি দায়িত্ব শেষ করতে পারতাম। কিন্তু আমি তার বদলে চেয়েছিলাম, ভাব-অনুযায়ী একটা কার্যবিবরণী তৈরি করতে। একই প্রবন্ধে যদি একাধিক ভাবের প্রসঙ্গ এসে থাকে, তবে সেই প্রবন্ধকে ভাব-অনুযায়ী ভাগ করে একাধিক জায়গায় সন্নিবিষ্ট করতে। ফরাসি, স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ ভাষায় লিখিত প্রবন্ধ নিয়ে কী করবো, তা ছিল আমার শিরঃপীড়ার বিষয়। আনোয়ার। বলেছিলেন ফরাসি প্রবন্ধগুলো ক্রিস্তিন ও সানিয়া মিলেমিশে ব্যাখ্যা করে দেবেন। আমার কাছে। ওই সন্ধ্যায় তিনি বললেন, তোমার জন্যে সুসংবাদ, সুসানা ব্রুনাও আলজিয়ার্স থেকে প্যারিসে এসেছে এবং থাকছে তার এক বান্ধবীর সঙ্গে–তুমি যেখানে আছ, তারই পাশের বাড়িতে। সুন্দরী মহিলার সঙ্গে কাঁধ ঘষাঘষি করতে তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি সুসানাকে বলে দিচ্ছি, তুমি তার ওখানে যাবে এবং যতক্ষণ লাগে, সে তার স্প্যানিশ প্রবন্ধ তোমাকে ইংরেজি করে শোনাবে। আমি বললাম, আপনার মতো আকর্ষণীয়তা আমার নেই, তবে আপনার জানা উচিত, মহিলাদের অনুবর্তী হতে আমার কোনো দ্বিধাও নেই।
অতএব এক সকালে পাশের বাড়ি গিয়ে হানা দিলাম এবং সুসানা ব্রুনার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বললাম। মুশকিল হলো এই যে, তার ইংরেজিজ্ঞান কিছুটা সীমাবদ্ধ, ফলে নিজের প্রবন্ধের যে-ইংরেজি ভাষ্য সে মুখে-মুখে প্রণয়ন করছিল, তা স্প্যানিশ বাক্যরীতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারছিল না। আমি তার কথামৃত টুকে রাখছিলাম বটে, তবে সর্বত্র মর্মভেদ করতে সমর্থ হচ্ছিলাম না।
এর মধ্যে তার গৃহকত্রী একাধিকবার দেখা দিলেন এবং কফি ও খাবার পরিবেশন করলেন। ভদ্রমহিলাও, মনে হলো, মেক্সিকান এবং সন্দেহাতীতভাবে অপূর্ব সুন্দরী। বিদায় নেওয়ার সময়ে তিনি বললেন, যেহেতু আমি তার নিকটতম প্রতিবেশী, সেহেতু তিনি আশা করবেন, সুসানা চলে যাওয়ার পরও আমি তার খোঁজ নেবো। আমি বার দুই ফোন করেছিলাম, কিন্তু পরিচারিকার সঙ্গে ফরাসিতে কিছু বলতে অপারগ হওয়ায় গৃহকত্রীর কাছে পৌঁছাতে পারিনি। আমি নীরব থাকলেও ভদ্রমহিলা যেচে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, তা বোধহয় সভ্য সমাজের দস্তুর নয়।
৪.
প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রতিষ্ঠান আছে–আঁস্তিত্যু নাসিওনাল দ্যে লংগ এ সিভিলিজাসিওঁ ওরিয়তাল বা প্রাচ্যের ভাষা ও সভ্যতা সম্পর্কিত জাতীয় ইনস্টিটিউট, সংক্ষেপে ইনালকো। সেখানে বাংলা ভাষার শিক্ষক তখন দুজন–ফ্রাঁস ভট্টাচার্য ও সিরাজুল ইসলাম। মঙ্গলকাব্য সম্পর্কে গবেষণা করে ফ্রাঁস ডক্টরেট অর্জন করেছেন, বাংলা থেকে ফরাসিতে অনুবাদ করেছেন প্রচুর–যেমন, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালি, সত্যজিৎ রায়ের অনেক ছবির ফরাসি সাব-টাইটুল তার করে দেওয়া। সিরাজুল ইসলাম মূলত পরিসংখ্যানবিদ, তবে ওই ইনস্টিটিউটে বাংলা পড়াচ্ছেন অনেককাল ধরে। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় লন্ডনে, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে–সেখানে তিনি বঙ্গদেশে মরত্ব বা নশ্বরতা নিয়ে দুঃসাধ্য ও চমকপ্রদ গবেষণার উপকরণ আহরণ করছিলেন। এই বাংলা শিক্ষকদ্বয়ের সম্পর্ক আদর্শস্থানীয় নয়। সুতরাং তাদের সঙ্গে আলাদা করে সাক্ষাৎ করতে হলো।
ফ্রাঁস খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাকে গ্রহণ করলেন। আমার একটা বক্তৃতার আয়োজন করলেন তিনি ইনালকোতে। তাছাড়া যে জন পনেরো ছাত্রছাত্রী বাংলা পড়ে, তাদের তার বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ করলেন আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যে। আমি তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তারা বাংলা শিখতে চায় কেন। কেউ বললো, সত্যজিৎ রায়ের ছবি দেখে সে আগ্রহী হয়েছে; কেউ বললো, রবীন্দ্রনাথের কোনো লেখার অনুবাদ পড়ে মূল ভাষাটা জানতে উৎসাহী হয়েছে। একটি মেয়ে বললো, তার ছেলে-বন্ধু বাংলাভাষী, তাই সে বাংলা শিখতে চায়।
আমার অনুরোধে ফ্রাঁস আমাকে নিয়ে গেলেন বিবলিওথেক নাসিওনালে এবং সেখানকার সদস্য হতে সাহায্য করলেন। সময় ও সুযোগমতো আমি সেখানে বসে আঠারো শতকের বাংলা পাণ্ডুলিপিগুলো দেখি। এর মধ্যে ইন্দ্রাণীর সংগৃহীত সেক্রেতেয়ার বেঙ্গলের পাণ্ডুলিপি ছিল–তার সবটাই আমি হাতে নকল করে নিই। তাছাড়া অগুস্তে অসার শব্দমালাগুলো দেখি এবং বাংলা আদর্শলিপির মতো একটা পাণ্ডুলিপিও পরীক্ষা করি। ফ্রাসের সঙ্গে কথা বলতে বলতে স্থির করলাম, যদি কখনো সময় ও সুযোগ হয়, তিনি ও আমি মিলে অন্তত অসার বাংলা-ফরাসি শব্দমালা সম্পাদনা করবো। বহুকাল পরে সত্যিই কাজটি করতে পেরেছিলাম।
ফ্রাঁসের স্বামী লোকনাথ ভট্টাচার্য তখন ভারতে–বোধহয় সাহিত্য একাডেমির সচিবের দায়িত্বস্বীকার করে দিল্লিতে কর্মরত। তাঁদের একমাত্র সন্তান-কন্যা–ইসা অত্যন্ত সদালাপী। প্রাণরসায়ন পড়ে ফার্মেসিস্ট হবে বলে তখন সে ভাবছিল।
সিরাজুল ইসলাম সিতে য়ুনিভার্সিতেয়ারে চলে এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর মনে হয়েছে, ইনালকো তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়নি। তাই তিনি কর্তব্যের অধিক কোনো কাজেই সেখানে জড়াতে চান না। এই কারণে আমার বক্তৃতায় উপস্থিত থাকেননি, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারের সময়েও নয়। এমন অভিমান করে হয়তো তিনি ছাত্রছাত্রীদের থেকেও দূরে চলে যাচ্ছিলেন, যা শিক্ষকের জন্যে অভিপ্রেত নয়। তিনি কিছু একটা করতে চাইছিলেন, কিন্তু ঠিক কী যে করবেন, তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
৫.
আমি সকালে উঠে মুখ হাত ধুয়ে রাস্তাটা পার হয়ে সিতে য়ুনিভার্সিতেয়ার স্টেশনে আসি। সেখানে কফির দোকানে দাঁড়িয়ে ক্রোয়াসে আর কফি খাই। দুপুরে হয় সিতের মূল ডাইনিং হলে এসে ছাত্রদের সঙ্গে লাঞ্চ খাই তুমুল হইচইয়ের মধ্যে, নয়তো সিএনআরএসে এসে ক্রিস্তিনের সঙ্গে–অথবা তিনি ব্যস্ত থাকলে একাই–খাওয়াটা সারি। লেখালিখির কাজটা ঘরে বসেই করি বেশির ভাগ। খানিকদূর লেখা হলে ক্রিস্তিনকে দিয়ে যাই টাইপ করার জন্যে। সন্ধ্যায় স মিশেল এলাকায় যাই। সেখানে নানা দেশীয় খাবারের রেস্টুরেন্টের সারি। কোনো একটায় রাতের খাবার খাই। কখনো কখনো ফাস্ট ফুড খেয়ে নিই। কদাচিৎ ভালো রেস্টুরেন্টে যাই। জাঁ পল সার্ত যেখানে আড্ডা দিতেন, সেখানে যেমন গেলাম এক সন্ধ্যায়।
ঘরে বসে কাজ করার সময়ে কফি বানিয়ে খাই। একদিন লক্ষ করলাম অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসটা গরম হওয়ায় কাঠের মেঝেতে কালো দাগ পড়ছে। ওটার ব্যবহার বন্ধ করে দেবো ভাবলাম। সেদিন মেইডের চোখেও দাগটা ধরা পড়ল। সে কীসব বললো। ভাবলাম, তিরস্কার করছে বা সাবধান করে দিচ্ছে। খানিক পরে দেখি, সে আবার এসেছে, এবারে হাতে একটা সেরামিক ইট। ঘরের একধারে ইটটা রেখে তার ওপরে অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসটা বসিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিলো, এবার আর দাগ পড়ার আশঙ্কা নেই। এক গাল হেসে মাথা। দুলিয়ে সে যা বললো, তার মর্মার্থ হয়তো ঠিক আছে? কিংবা খুশি তো? আমি তাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানালাম।
সিতের ডাইনিং হলে একদিন একটি মেয়ে এসে আমার নাম করে জানতে চাইলো, আমিই সেই ব্যক্তি কি না। তার অনুমান ঠিক, একথা জানাবার পরে সে নিজের পরিচয় দিলো। নাম হাসনাত জাহান। তার বড় বোন ফিরোজ জাহান ঢাকায় সরকারি কলেজে বাংলার শিক্ষক–আমার বিলক্ষণ পরিচিত। বস্তুত আমার ছোটোবুর সঙ্গে তাদের পরিবারের খুবই অন্তরঙ্গতা। হাসনাতের অধীত বিষয় ভিন্ন হলেও ফ্রাঁস ভট্টাচার্যের সঙ্গে সে গবেষণা শুরু করেছে অঁদ্রে জিদকৃত গীতাঞ্জলির অনুবাদ সম্পর্কে। সিতের বিশাল এলাকার মধ্যে অনেকগুলি মেজো বা ভবন আছে–কয়েকটি কোনো না কোনো দেশের নামে–মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত প্রভৃতি, কয়েকটি অন্য নামে। এমনি একটি মেজোতে হাসনাত থাকে, খণ্ডকালীন কাজও করে।
সেদিন থেকে হাসনাত আমার পথপ্রদর্শক ও পরামর্শদাতা হয়ে গেল। সে আলাপ করিয়ে দিলো নাসিমা জামানের সঙ্গে। নাসিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রিলাভের জন্যে গবেষণা করছে। সে-ও আমার এক সহায় হয়ে দাঁড়ালো। ওরাই আমাকে নিয়ে গেল পপিদু সঁৎরে। তার অত্যাধুনিক স্থাপত্যরীতি বাইরে থেকে আমার ভালো লাগেনি, তবে ভেতরটা খুবই সুন্দর। দোকানপাট থেকে শুরু করে সিনেমা হল পর্যন্ত কী নেই সেখানে! সেখানকার সিনেমা হলে সত্যজিৎ রায়ের কয়েকটি ছবি দেখেছিলাম।
হাসনাত আমার কাপড় ধোওয়ার সমস্যার সমাধান করে দিলো। ওদের মেজেতে লড্রেট আছে। সে নিজেই চাইলো সেখানে আমার কাপড়চোপড় ধুয়ে দিতে। আমি বললাম, মেশিনে কাপড় দেওয়া-নেওয়ার সময়ে সে উপস্থিত থাকলে যথেষ্ট সাহায্য হবে।
সপ্তাহান্তের দিনগুলোতে হাসনাত, নাসিমা ও আমি দুপুরে একসঙ্গে খাওয়ার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন বাইরে থেকে আসা এক বা একাধিক বাংলাদেশি। তার মধ্যে ডা. ওয়াহিদ নামে এক তরুণ প্রায়ই আসেন। তিনি খুব নামজাদা এক ডাক্তারের অধীনে কাজ করেন। সেই প্রবীণের নানারকম খামখেয়ালির গল্প বলে মাতিয়ে রাখেন। ডা. ওয়াহিদ পরে হৃদ্রোগ-বিশেষজ্ঞ হিসেবে খুব খ্যাতি অর্জন করেন এবং কিছুকাল আগে বারডেমের নতুন কার্ডিয়াক সেন্টারে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করে আবার ফ্রান্সে ফিরে যান।
হাসনাতই খবর দিলো যে, যুক্তরাষ্ট্র-ভবনে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা আছে এবং অন্য ভবনের অতিথিরাও সেখানে গিয়ে খেতে পারে। সেই থেকে আমার প্রাতরাশের জায়গা বদলে গেল এবং তৃপ্তির সঙ্গে দিন শুরু করতে সমর্থ হলাম।
রোববারে আমার ঘরের জানলা দিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেতাম। খোলা জায়গায় দু দল ইরানি ছাত্র সমবেত হয়েছে। একদল বয়ে এনেছে আয়াতোল্লাহ খোমেনির ছবি, আরেক দলের হাতে শাপুর বখতিয়ারের প্রতিকৃতি। দুদল আলাদা সভা করছে। খানিক পরই একদল চড়াও হচ্ছে অপর দলের ওপরে। অনতিবিলম্বে গাড়িভর্তি পুলিশের আবির্ভাব হাতের মোটা ব্যাটন দিয়ে তারা নির্বিচারে ইরানিদের মারছে, অনেককে ধরে গাড়িতে তুলছে। বাদ-প্রতিবাদ এভাবে মুলতবি হচ্ছে পরের রোববার পর্যন্ত।
প্যারিসে আসার পরপরই ফোন করলাম আমাদের ভিয়েতনামি বন্ধু লে থান খোয়কে। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিয়োটো সিম্পোজিয়ামে। সে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিষয়ের অধ্যাপক, অতি চমৎকার মানুষ। আমার ফোন পেয়েই যথেষ্ট উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো এবং পরের শনিবারই লাঞ্চ খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালো তার বাড়িতে। এখন ভাবতে লজ্জা করে, পয়সাকড়ির হিসেব করে আমি খুব শস্তা একটা হোয়াইট ওয়াইন কিনে নিয়ে গেলাম তার জন্যে। লে থান খোয় এমনই ভদ্রলোক, সঙ্গে সঙ্গে সেটা ফ্রিজে রেখে দিয়ে খাওয়ার সময়ে পরিবেশন করলো। অবশ্য তার বিকল্পও ছিল। সেই দুপুরে তার আরেকজন অতিথি ছিলেন ইউনেসকোর এক আফ্রিকান কর্মকর্তা–বেশ উচ্চ পদাধিকারী। ভদ্রলোক আমাকে উৎসাহ দিতে বললেন, ফরাসি ভাষা ইংরেজির চেয়ে অনেক সহজ, তোমার শিখতে সময় লাগবে না। ইংরেজরা লেখে এক রকম, বলে আরেক রকম, বুঝতেই প্রাণান্ত। আমি বললাম, ফরাসিরা যা লেখে, তার অর্ধেক যে উচ্চারণ করে না, সেটাই তো আমার কাছে সমস্যা মনে হয়। ভাষা ছেড়ে উঠলো খাবারের প্রসঙ্গ। লে থান খোয় বললো, প্যারিসে ভিয়েতনামি রেস্টুরেন্ট আছে অনেক। একটু ভালো জায়গার ভিয়েতনামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওয়েটারের সাহায্য নিয়ে ফরমাশ দিলে তুমি ঠকবে না। সে কয়েকটা খাবারের নামও বলে দিয়েছিল।
সেসব নাম মনে রাখতে পারিনি। তবে তার পরামর্শমতো গোটা দুই ভিয়েতনামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবারের ফরমাশ দিয়েছিলাম। আমার অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। আমার ফরাসি ভাষাশিক্ষা মোটেই এগোয় নি। ক্রিস্তিন। বলেছিলেন রোজ সন্ধ্যায় টেলিভিশনের খবর শুনতে। আমাদের রেজিসের টিভিরুমে গিয়ে সে-চেষ্টা করেছিলাম। সবসময়ে খবর দেখতেও পেতাম না, কেননা অন্য চ্যানেলের কোনো প্রোগ্রাম হয়তো অন্য কেউ দেখছেন। ভাষাশিক্ষার জন্যে যে-সময় দিতে হয়, তাও আমার হাতে ছিল না। সুতরাং আমার ফরাসিজ্ঞান সৌজন্যবিনিময় এবং সামান্য কিছু কেনাকাটার সামর্থ্যের চেয়ে বেশি হলো না।
৬.
আমার আলজিয়ার্স যাওয়ার আগেই আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ক্লিনটন বুথ সিলি, সে কথাটা এখানে উল্লেখ করার মতো। জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে গবেষণা করে এবং তাঁর কবিতার অনুবাদ করে ক্লিন্ট বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। জীবনানন্দ সম্পর্কে তাঁর বই A Poet Apart উচ্চপ্রশংসিত হয় এবং বাংলা সাহিত্যের প্রচার ও প্রসারে ভূমিকার জন্যে ক্লিন্ট পরে আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন–সে পুরস্কারের অর্থও তিনি জীবনানন্দের কবিতার প্রচার ও প্রসারের জন্যে ব্যয় করতে কবি-পরিবারের হাতে তুলে দেন।
গবেষণার উপকরণ সংগ্রহের লক্ষ্যে ছ মাস বাংলাদেশে কাটাবার জন্যে ১৯৮১ সালে ক্লিন্ট ফুলব্রাইট বৃত্তি লাভ করেন। তিনি স্থির করেন, তিন মাস ঢাকায় ও তিন মাস চট্টগ্রামে থাকবেন। আমাকে তিনি লেখেন চট্টগ্রামে তার থাকার ব্যবস্থা করতে। স্বগৃহে আমি তাঁকে সাদর আমন্ত্রণ জানাই, তিনি তা গ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বক্তৃতা দেন, চট্টগ্রাম শহরে সভা সমিতিতেও যোগ দেন এবং আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েন। ছেলেমেয়েরা ক্লিন্ট চাচার সান্নিধ্য খুব উপভোগ করে।
পরে ক্লিন্ট বাংলা শেখার যে-বইটি লেখেন, তাতে তাঁকে লেখা রুচির একটি চিঠি নামধাম বদলে গ্রহণ করেন–চিঠি লেখার আদর্শ নমুনারূপে। আদর্শ মানে এখানে স্বাভাবিক, অকৃত্রিম।
ক্লিন্ট ঘরে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে থাকেন, খাবার দেওয়া হয়েছে বললেই হাতের কাজ ফেলে তৎক্ষণাৎ টেবিলে চলে আসেন। কাজে ও বিনা কাজে যারা আমার কাছে আসেন, অনেক সময়ে তিনি তাঁদের সঙ্গে আলাপ করেন। কামরু ভাই একবার ঢাকা থেকে গাড়ি চালিয়ে সোজা আমার বাসায় চলে আসেন। তখন বেবী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমি শহরে চলে গিয়েছিলাম। ক্লিন্টই তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। কামরু ভাই পরে বলেছিলেন, ‘লুঙ্গি-পরা সাহেবের সঙ্গে বাংলায় কথা বলব না ইংরেজিতে, সেটাই স্থির করতে পারছিলাম না।
আমার এবার প্রবাসযাত্রার আগে চট্টগ্রাম শহরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে আমাদের তরুণ সহকর্মী গোলাম মুস্তাফা আমার Factory Correspondence সম্পর্কে একটি আলোচনা পাঠ করে। ক্লিন্ট এ-সভায় উপস্থিত থাকেন এবং সবটা বেশ উপভোগ করেন বলে জানান।
আমি প্যারিসে পৌঁছোবার কিছুদিন পরে শিকাগো থেকে ক্লিন্টের বান্ধবী গোয়েনের একটি চিঠি পাই। সঙ্গে ৩০০ মার্কিন ডলারের একটি চেক। গোয়েন লিখেছেন, ক্লিন্টের কথামতো তিনি চেকটা পাঠাচ্ছেন। এটা ক্লিন্টের আতিথ্যগ্রহণের প্রতিদান বলে যেন আমি মনে না করি। বিদেশ-বিভুঁইয়ে টাকা পয়সার দরকার হতে পারে, অন্তত পরিবারের জন্যে কিছু কেনাকাটা করতেও। বন্ধুকৃত্য হিসেবে আমি যেন চেকটা গ্রহণ করি।
৭.
ইউনেসকোতে তখন আমার চেনাজানা দুজন কাজ করতেন : ড. আবদুল মুয়ীদ ও মাহফুজ আনাম। তার আগে মুয়ীদ ছিলেন কুমিল্লার পল্লী-উন্নয়ন একাডেমিতে। তাঁর মৃত্যুর পরে সেখানে একটি কক্ষ তাঁর স্মৃতিতে চিহ্নিত হয়েছে। তাঁর স্ত্রী ফাতেমা হলেন ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বোন এবং বেবীর সহপাঠী। মুয়ীদের আমন্ত্রণে মাঝে মাঝে তার অফিসে যেতাম। সেখান থেকে তাঁর গাড়িতে করে তার বাড়ি। সেখানে আমাকে খাইয়ে-দাইয়ে তিনি মেট্রোতে তুলে দিতেন আমাকে। নিজের মতো ফিরে আসতাম।
দেশের অবস্থা নিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই খুব উদৃবিগ্ন ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উভয়েরই ছিল প্রবল আস্থা। সামরিক শাসন ও বিএনপির রাজনীতি তাঁদের অনুমোদন লাভ করেনি। বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারার পুনরাবির্ভাব তাদের শঙ্কিত এবং অনেক পরিমাণে হতাশ করেছিল। আমার সঙ্গে তাঁরা প্রধানত এসব বিষয়েই কথা বলতেন।
মাহফুজ আনাম আমাকে তার বাড়ি নিয়ে গেল সপ্তাহান্ত কাটাতে। মেট্রো থেকে বেরিয়ে একটা সুন্দর বনাঞ্চল পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে। শাহীনের আতিথেয়তা পরম উপভোগ্য। রোজ তখন নিতান্তই শিশু–খুবই আদরণীয়। দেশের বিষয়ে উদ্বেগ থাকলেও মাহফুজের মধ্যে একটা আশাবাদ কাজ করে। হতাশ্বাস না হয়ে বরঞ্চ কী করণীয় আছে, সে তা খোঁজ করার পক্ষপাতী।
হাসনাতের মাধ্যমে পরিচয় হয় প্রলয় দত্তের সঙ্গে। সে এখানে আছে বেশ কিছুকাল, চেষ্টা করছে কৃতবিদ্য দোভাষী হতে। তার জন্যে একাধিক ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা দরকার। ফরাসি ও স্প্যানিশ নিয়েছে সে, হয়তো জার্মানও সেইসঙ্গে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা ফরাসিতে অনুবাদও করছে। প্রলয়ের প্রাণশক্তি অসাধারণ। গল্প করে, হই-হুঁল্লোড় করে, সময় কাটাতে তার জুড়ি নেই। তার ফরাসি বান্ধবী অপেক্ষাকৃত চুপচাপ-ভাষার বাধাও তার একটা কারণ হতে পারে। আমি দেশে ফিরে আসার পরে একবার প্রলয় তার বান্ধবীকে নিয়ে চট্টগ্রামে নিজের বাড়িতে এসেছিল–তখন তারা দুজনেই চট্টগ্রাম। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে।
হাসনাতের দক্ষিণ ভারতীয় বন্ধু কুমার স্বল্পভাষী, খুবই সৌজন্যপরায়ণ। কী যেন একটা চাকরি করে। আর হাসনাতের স্প্যানিশ বান্ধবী অ্যালিস শিক্ষাবিষয়ে পড়াশোনা করছে। অ্যালিসের ইতালীয় স্বামী জিওভানি পেশায় ডাক্তার–চর্মরোগে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। দুজনই চমৎকার মানুষ। অ্যালিস তার বাবার গল্প করে–তিনি খ্যাতিমান স্থপতি। কোনো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন-সংস্থা তাঁকে আহ্বান জানিয়েছিল আফ্রিকার একটি দরিদ্র দেশে বাঁধ নির্মাণের নকশা তৈরি করে দিতে। সরেজমিনে সেখানে গিয়ে তার মনে হয়, বাঁধ তৈরি করে দিলেও তা যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করার সামর্থ্য সেদেশের নেই। ফলে তা কাল হয়ে উঠতে পারে তাদের জন্যে। সুতরাং তিনি সেই কাজটি করতে অস্বীকার করেন। জিওভানি বলে, তার শ্বশুর খুব ভালো দাবাড়। তাকে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন কম্পিউটারে দাবা খেলতে। খেলতে গিয়ে জিওভানি দেখে, কম্পিউটারে প্রতিপক্ষ খালি খেলে না, তার খেলা নিয়ে কটাক্ষও করে। সত্যি সত্যি অপমান বোধ হয় তার, খেলা বন্ধ করে দেয়। জিওভানি পানভোজন রসিক। সেসব সম্পর্কেও তার গল্প করার এবং পরামর্শ দেওয়ার আছে। এই দম্পতির সঙ্গে পরেও আমার প্যারিসে দেখা হয়েছে, তারা স্থায়ীভাবে ইতালিতে চলে যাওয়ার পরেও কিছুকাল যোগাযোগ থেকেছে।
৮.
আমার লেখা কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পরে আনোয়ার আবদেল-মালেক বলেন, ব্যস, আমি আর দেখতে চাই না। তুমি সব শেষ করে আমাকে দিও। আমার যদি কিছু যোগ করার থাকে, তখন আমি তা করবো।
ফলে আমি স্বাধীনভাবে লিখতে থাকি। ফরাসিতে লেখা প্রবন্ধ মুখে মুখে তরজমা করেন ক্রিস্তিন। আমি শুনে শুনে টুকে নিই। পর্তুগিজ-জানা এক সেক্রেটারিকে ধরে একটা প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ লিখিয়ে আনেন ক্রিস্তিন। আমি সেটা ব্যবহার করি। আমার লেখা খানিকটা অগ্রসর হলে টাইপ করতে দিই তাঁকে। টাইপ করা হলে পড়ে আবার শুদ্ধ করতে দিই। আমার লেখায় কোনো অপরিচিত ইংরেজি শব্দ পেলে একটা কাগজে তা টুকে রাখেন ক্রিস্তিন। পরে অভিধান দেখে তার অর্থ ও ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করেন। আমার কাছে একসময়ে জানতে চান, আমার ব্যবহৃত তাঁর অজানা ইংরেজি শব্দের বেশির ভাগ ল্যাটিন থেকে এসেছে–তার কী কোনো কারণ আছে? আমি বলি, আমি তো ল্যাটিন জেনে সেসব ব্যবহার করিনি–সুতরাং কারণ বের করা যাবে না।
ক্রিস্তিন একদিন হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেন, আচ্ছা আপনার মেয়ে যদি অবিবাহিত অবস্থায় মা হতে চলে, তখন আপনি কী করবেন?
আমি একটু থতমত খাই। বলি, এমন অবস্থা তো কল্পনা করিনি। সুতরাং সে-ভাবনা মাথায় আসেনি।
সানিয়া বলে, যদির কথা হচ্ছে।
আমি বলি, সম্ভবত সে-অবস্থায় আমার মেয়ে যা চাইবে, আমি তাই চাইবো। সে যদি ভ্রূণ নষ্ট করতে চায়, তাকে সাহায্য করবো। সে যদি সন্তান জন্ম দিতে চায়, তাহলেও সাহায্য করবে।
ক্রিস্তিন বলেন, এখন বলতে পারি, আপনি সত্যি উদার। অনেক উদার মানুষই এসব ক্ষেত্রে ঔদার্য হারিয়ে ফেলে।
ক্রিস্তিনের পরামর্শে আমি প্রতি সপ্তাহে বিনোদনের বিবরণ-সংবলিত পত্রিকা। কিনি। তা দেখে সিনেমা দেখতে যাই। এভাবে চার্লি চ্যাপলিনের কিছু চলচ্চিত্র দেখা হয়, আবার জেমস বন্ডও দেখি। ইংরেজি সাব-টাইটল আছে, অন্য ভাষায় তৈরি এমন ছবিও দেখা হয়। প্যারিসের দর্শনীয় বস্তু দেখতে যাই। পুরোনো বাড়ি কিংবা রাস্তা। বাস্তিল। নানা জাদুঘর। স্যুভে কতবার গেলাম। অল্প অল্প করে দেখি। মোমার্তের দিকে যাই–শিল্পীরা ছবি আঁকছেন, তা দেখি। খাবারের বৈচিত্র্য খুঁজি। এক সন্ধ্যায় মুলা রুজে যাই।
জিওভানি একটা ইংরেজি বইয়ের দোকানের খোঁজ দিয়েছিল–সেখানে মাঝে মাঝে যাই। তার পরামর্শমতো পি ডি জেমসের গোয়েন্দাকাহিনি কিনি। অতটা মুগ্ধ হই না।
এক সপ্তাহান্তে ভের্সাই গেলাম। প্রাসাদ এবং সংগ্রহ দেখে দিন কেটে গেল। দুঃখের বিষয়, তখন সন্ধ্যায় আতসবাজির কর্মসূচি ছিল না। সেটা না-দেখার। অতৃপ্তি নিয়ে ফিরলাম।
৯.
প্যারিসের জাদুঘরে ছবি দেখতে দেখতে, এক সময়ে মনে হলো, অ্যামস্টারডাম এত কাছে–সেখানে গিয়ে তো আরো ছবি দেখে আসা যায়। একটা নতুন দেশেও যাওয়া হবে।
ভিসা পেতে অসুরিধে হলো না। কোচে করে সন্ধ্যায় রওনা হলাম। কোচে। বসেই কাস্টমস-ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ। সকালে অ্যামস্টারডাম। একটি হোটেলে পৌঁছে সকালের নাশতা। তারপর যে-যার মতন ঘুরে বেড়ানো।
অ্যামস্টারডামে একা-একা ঘুরতে অসুবিধে হয় না। এখানে বেশির ভাগ মানুষ ত্রিভাষী–ওলন্দাজ ছাড়া ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মানের মধ্যে দুটি জানে–অন্তত কাজ চালাবার মতো। বেশির ভাগই ইংরেজি জানে এবং অপরকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক। সুতরাং পথ জিজ্ঞেস করে ট্রামে করেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া যায়।
এখানে ডাচ মাস্টারদের এত ছবি রাখা আছে! দেখে সত্যি সুখ হয়। তবু মনে হয়, আরেকবার আসতে হবে।
প্রান্তরের পর প্রান্তর নানা রঙের টিউলিপ ফুটে আছে। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
উইন্ডমিল দেখি, পনির বানাবার কারখানা দেখি। ভিতরে যাই না।
অ্যামস্টারডামের খালে নৌকাভ্রমণ পর্যটকদের অবশ্য করণীয়। বস্তুত ভ্রমণটা আনন্দের। নৌকা থেকে এ শহরের সবচেয়ে পুরোনো বাড়ি দেখা যায়। তাও চমকপ্রদ।
সন্ধ্যায় হোটেলে ফেরার পথে দেখি একদিকে নারী-পুরুষনির্বিশেষে জনস্রোত যাচ্ছে। আমি তাদের সঙ্গ নিই। দেখি, এক এলাকায় পরপর কয়েকটি বাড়িতে বিরাট কাঁচ-লাগানো ছোটো ঘরে একেকজন স্বল্পবসনা রঞ্জিতবর্ণা মহিলা ভঙ্গিসহকারে আসীন। অনেকটা অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছের মতো–তফাৎ এই যে, অ্যাকুরিয়ামে মাছ নড়াচড়া করে, আর এই নারীরা গতিহীন। হঠাৎ স্ট্যাচু বলে ভুল হতে পারে! দু-একজন তোক একটু এগিয়ে গিয়ে পাশের দরজা ঠেলে তাদের সঙ্গে বোধহয় দরদস্তুর করছে–তখনই কেবল তাদের মাথা হেলে, ঠোঁট নড়ে, অন্যথায় তারা নিশ্চল। রাস্তাটি খুব লম্বা নয়, তবে পুরো সড়কজুড়ে একই দৃশ্য।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাবা দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় যে তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, তাদের কালে বিজয়ার রাতে লোকজন দেবীপ্রতিমা দেখার মতো বারাঙ্গনাদর্শন করে বেড়াত, এ যেন সে রকম।
হোটেলে ফিরে আসি। দ্রুত কিছু খেয়ে নিই। তারপর কোচে চাপি। ভোরবেলা ফিরে আসি প্যারিসে।
১০.
প্যারিসের কাজ শেষ করে মার্চের ৬ তারিখে রাতের কোচে লন্ডনে রওনা হলাম। ফেরিতে ইংলিশ চ্যানেল পার হতে যে একটু রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম, সেকথা কবুল করা ভালো। সাতারু ব্ৰজেন দাশের কথা বারবার মনে পড়ছিল।
লন্ডনে আমার মাসখানেক থাকার পরিকল্পনা। উঠলাম আবদুল মোমেনের বাড়িতে। প্রথমে গেলাম ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। সেখান থেকে আগের বছরে আমার Factory Correspondence প্রকাশিত হওয়ায় আমার খাতির কিছু বেড়েছে। আরো একটা ব্যাপার। ১৯৭৯ সালে সেখানে কাজ করার সময়ে আমি ঢাকা কুঠির চিঠির খাতা পাই তেইশটা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল, আরো চিঠির একটা খাতা লাইব্রেরিতে কোথাও অগোচরে আছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট কিপার মাইকেল ও’কিফকে সেকথা বলেছিলাম, ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান আর জি সি ডেসমন্ডকেও বলেছিলাম। ওঁরা আমার কথাকে গুরুত্ব দেননি, তা নয়, তবে কিছু খুঁজে পাননি। এবার লাইব্রেরিতে যেতেই মাইকেল বললো, তোমার অনুমান যথার্থ। চিঠির আরেকটা খাতা এতদিনে পাওয়া গেছে। আমি হতাশ গলায় বললাম, তাতে আর কী লাভ? বই তো বেরিয়ে গেছে। মাইকেল বললো, চিঠির খাতা পাওয়ার পরই ডেসমন্ডের সঙ্গে এ-বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। উনি ব্লুমফিল্ডের সঙ্গেও কথা বলেছেন। তুমি যদি এটা তালিকাভুক্ত করতে রাজি হও, তাহলে আমরা ছোটো আকারে একটা সাপ্লিমেন্ট বের করবো এবং তোমার বইয়ের সঙ্গে এটা ক্রেতাদের এমনি দেওয়া হবে। এমনকী, যদি কেউ দাবি করে যে, তোমার বই কিনেছে, তাহলে সেও বিনা পয়সায় এর একটা কপি পাবে। অবশ্য তুমি যদি কাজটা করতে সম্মত হও, তবে এটা হবে। ভালোবাসার খাটুনি। আমরা কোনো পারিশ্রমিক তোমাকে দিতে পারবো না–লাইব্রেরির তেমন পয়সা নেই, এবং ব্রিটিশ অ্যাকাডেমির কাছে দুবার আমরা এর জন্যে মনজুরি চেয়েছি, এই একটা খাতার বিবরণ লেখার জন্যে আবার মনজুরি চাওয়া যাবে না। আমি বললাম, মাইকেল, তুমি জানো, তোমরা যে-পয়সা আমাকে দিয়েছ, তাতে আমার লন্ডনে থাকা-খাওয়ার খরচ কুলাতো না। ভাগ্যিস আমার বন্ধুবান্ধব ছিল এবং বিবিসির বাংলা বিভাগ ছিল। আমি এই কাজটা করবো, তাহলে এই পর্বের কাজ সমাধা হয়। তোমাদেরকে পয়সা দিতে হবে না। আমার বন্ধুবান্ধব এবং বিবিসি দীর্ঘজীবী হোক। আমার খরচ আমিই জোগাবো।
পরদিন থেকে ওই খাতার চিঠির বিবরণ লিখতে লেগে গেলাম।
লন্ডনে এতজনের কাছে আমি ঋণী, তাদেরকে অন্তত এক কপি করে বই উপহার দিতে হয়। মোমেন, জ্যান, বুলু, শফিউল্লাহ–এদেরকে বই না দিয়ে পারি কী করে! দেশেও তো কাউকে কাউকে দিতে হবে–বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল করিম–এঁদেরকে। আমাকে মাত্র এক কপি বই পাঠিয়েছিল ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি। আরো এক কপি বই পেলাম সৌজন্যস্বরূপ। আর ছয় না আট কপি বই কিনলাম। বই ছিল মিসেস পি ওয়ার্ডের দায়িত্বে। তাঁরও নাম প্রতিভাতার বাবা সুকুমার রায় একদা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্য সচিব। তাঁকে নামে জানতাম। মিসেস ওয়ার্ড আগে ছিলেন ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে–সেখানে আমার বন্ধু শামসুল মোরশেদের (পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন-উপদেষ্টা) তিনি ছিলেন সহকর্মী ও বন্ধু। মিসেস ওয়ার্ড আমার প্রত্যাশার অধিক ছাড়ে বইগুলি আমাকে বিক্রি করলেন এবং একদিন লাঞ্চের সময়ে ওল্ড ভিকের পাশে একটা ওয়াইন বারে আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে খাওয়াটা গৌণ, পানটা মুখ্য এবং তা যেমন আনন্দদায়ক, তেমনি শিক্ষাপ্রদ।
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে একদিন সেই ইরানি মেয়েটি এসে উপস্থিত। গতবারে আমি যখন এখানে কাজ করছিলাম, তখন সেও এখানে লেখাপড়া করছিল। আমার সঙ্গে সৌজন্য-বিনিময়ের বেশি আলাপ হয়নি তার, তবে প্রায় রোজই তার সঙ্গে দেখা হতো। সে আসততা পাশ্চাত্য পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে, দেখে মনে হতো সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে। এবারে তার চোখে-মুখে বেশে-বাসে মলিনতার আভাস। পাঠকক্ষের দরজা পেরোতেই সে আমার সঙ্গে যোগ দিলো। কেমন আছো, জিজ্ঞেস করায় সে বললো, বেশ খারাপ। ইরানের বিপ্লবে যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে তাদেরটা একটা। তারা যে শাহর সমর্থক, তা নয়, বরঞ্চ শাহর সময়ে সাভাকেরা যে-অত্যাচার করেছে, তারা তার ঘোর বিরোধী। তবে তাদের পরিবার সংগতিসম্পন্ন এবং পাশ্চাত্যভাবাপন্ন। কেবল সেজন্যেই তাদের দুর্গতি হয়েছে। তার বড়ো ভাই বিমানচালক। কদিন আগে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন ভাগ্যান্বেষণে। সেও অনেক কষ্টে তেহরান থেকে বেরিয়েছে–জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে তার নেই। তার ভাগ্যে যা আছে তা-ই হবে।
মেয়েটি নিম্নস্বরে কথা বলছিল এবং মাঝে মাঝে পেছন দিকে তাকাচ্ছিল–কেউ তার কথা শুনছে কি না, সেটা দেখতে। বোঝা গেল, যে আতঙ্কের মধ্যে সে এতকাল কাটিয়েছে, তার রেশ এখনো যায়নি।
আমার মনে পড়ল, ইরানি বিপ্লবের সাফল্যের আশায় কত রাত বেতারযন্ত্রের সামনে বসে কাটিয়েছি। প্যারিস থেকে স্বদেশে ফিরে আসছেন জনগণের মুক্তিদাতা–আয়তোল্লাহ খোমিনির এই রূপই চোখে ভেসে উঠেছিল। কিন্তু তার শাসনকালে যে নতুন করে নিপীড়ন ও রক্তপাতের সূচনা হবে, তা তখন বোঝা যায়নি।
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সেবারে যতদিন ছিলাম, মেয়েটি অনিয়মিতভাবে আসততা। সে এলে এবারে স্বতোপ্রণোদিত হয়ে আমিই তার খোঁজখবর নিতাম। সে আগ্রহ করে কথাবার্তা বলতো বটে, কিন্তু আমি আর তার হাসিমুখ দেখিনি।
১১.
লাইব্রেরিতে প্রথম দিন হাজিরা দিয়ে আমার গন্তব্য ছিল বুশ হাউজে বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের বাংলা বিভাগ। সিরাজুর রহমান এখন তার প্রধান–বরাবরের মতো তিনি অভ্যর্থনা করলেন। কিন্তু এবার সেখানে এক বড়ো শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল শ্যামল লোধের তিরোধানে। শ্যামল সপরিবারে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন সমুদ্র-সৈকতে। তিনি যখন সাঁতার দিতে নেমেছেন সমুদ্রে, তখনই স্ত্রীকন্যার চোখের সামনেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়। ১৯৭৯ সালে। শ্যামলের বাড়িতে গিয়েছিলাম নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে–তখন তার ইংরেজ স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় এবং সদ্য শৈশবোত্তীর্ণ কন্যার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তারপর শ্যামল এসেছিলেন বাংলাদেশে–চট্টগ্রামে আমার বাড়িতে দু দিন দুরাত কাটিয়েছিলেন, বিবিসির শ্রোতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে। সেই দিনগুলির এবং শ্যামলের অকৃত্রিম বন্ধুত্বের স্মৃতি পীড়া দিচ্ছিল বারবার–কিন্তু ততদিনে জেনে গেছি, জীবন এমনই, কারো জন্যে অপেক্ষা করে না, কারো জন্যে থেমে থাকে না।
বিবিসি বাংলা বিভাগে গিয়ে দেশের কিছু খবর পাওয়া গেল। রাষ্ট্রপতি সাত্তার নিজে যে-মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন, তিন মাসের মধ্যে তাকে দুর্নীতিপরায়ণ বলে বরখাস্ত করেছেন তিনি নিজেই। তার অব্যবহিত পূর্বে মন্ত্রী আবুল কাসেমের সরকারি বাসভবন থেকে সাত হত্যার আসামি ইমদুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং এমন এক ভয়ানক সন্ত্রাসীকে আশ্রয়দান ও তাকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশকে বাধাদানের অভিযোগে মন্ত্রীবর গ্রেপ্তার হয়েছেন। কয়েকজন নতুন মন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন। পরবর্তী কয়েক দিনে বিবিসিতে কাজ করার সূত্রে জানা গেল, দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী–আমার আত্মীয় জামালউদ্দীন আহমদ এবং অগ্রজপ্রতিম এস এ বারী এ টিসহ বেশ কয়েকজন প্রাক্তন মন্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আরো আছেন আমার বন্ধু হাবীবুল্লাহ খান, পরিচিত নূরুল হক ও কে এম ওবায়দুর রহমান এবং আমার ছাত্র তানবীর আহমদ সিদ্দিকী। তাঁদের সবার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের হয়েছে। ড. এম এন হুদা উপরাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করেছেন এবং মোহাম্মদউল্লাহ-যাকে বঙ্গবন্ধু
অকারণে রাষ্ট্রপতিপদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন, তিনি–উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। পুতুলনাচের সুতো যে আর কারো হাতে বাঁধা, সেকথা বুঝতে অসুবিধে হলো না।
২৪ মার্চ সকালে বাথরুমে দাড়ি কামাচ্ছি–পাশেই রান্নাঘর থেকে মোমেনের চিৎকার : বাংলাদেশে কু্য হয়ে গেছে–জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেছে।’
খবরটা যে একেবারে অপ্রত্যাশিত, তা বলা যাবে না। তবু কী এক বিষণ্ণতায় মন ভরে গেল। খাবারটাও বিস্বাদ মনে হলো।
বুশ হাউজে এসে শুনলাম, রাষ্ট্রপতি সাত্তার নিজেই সেনাপতি এরশাদকে আহ্বান করেছেন ক্ষমতা নিতে। কয়েক শতাব্দী আগে নবদ্বীপে ইখতিয়ারউদ্দীন মুহম্মদ ইবনে বখতিয়ার খিলজির সসৈন্য আগমনে গৌড়রাজ লক্ষ্মণ সেন নাকি খাবারের থালা ফেলে খিড়কি দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই তুলনায় বিচারপতি সাত্তার আর এমন কী করেছেন। তবে লক্ষ্মণ সেনের প্রতিপক্ষ ছিল তুর্কি সৈন্য, এরশাদ তো স্বদেশি সেনাবাহিনীর প্রধান।
ক্রমে জানতে পারলাম, বিচারপতি এ এফ এম আহসানউদ্দীন চৌধুরী রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হয়েছেন এবং বেশ কজন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে প্রধান সামরিক শাসনকর্তার উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনা কর্মকর্তারা ক্ষমতা দখল করে বিচারপতিদের যে রাষ্ট্রপ্রধান করে টেনে আনেন, তা বাংলাদেশে একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিচারবিভাগের জন্যে এটা ভালো হচ্ছে বলে মনে হয় না।
উপদেষ্টাদের মধ্যে আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্ ও আবুল মাল আবদুল মুহিত আছেন। এঁরা উপদেষ্টা-পরিষদে যাওয়ায় আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। আমার ধারণা হলো, আমাদের যেসব রাজনৈতিক বন্ধু মুহিতের ঘনিষ্ঠ, সামরিক শাসনের সমর্থক না হয়েও তারা তাঁকে এই দায়িত্বগ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। হয়তো তাঁদের চাপে সামরিক শাসনবিরোধী হয়েও মুহিতকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এর জন্যে যে তাকে একদিন মূল্য দিতে হবে, একথা ভেবে আমার খারাপ লাগলো।
১২.
প্যারিস থেকে আমি লন্ডনে আসবো জেনে আনোয়ার আবদেল-মালেক বললেন, তাহলে তুমি আর কদিন বেশি থেকে কেমব্রিজে আমি যে-সেমিনার করছি (Geo-political visions of the World), তাতে যোগ দাও। আমি হলফ করে বলতে পারি, তোমার তা ভালো লাগবে।
সেমিনারের স্থান রবিনসন কলেজ। ওটাই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীনতম কলেজ–কোনো টেলিভিশন-নির্মাতার টাকায় তৈরি এবং তারই নামে কলেজের নাম। বনেদি কলেজগুলোর সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের খানিকটা অবজ্ঞা আছে এই কলেজটির প্রতি। তবে কলেজটির নির্মাণশৈলী আধুনিক, সে হিসেবে তার কিছু সুবিধা আছে যা অন্য কলেজে লভ্য নয়। সেমিনারের সময়টা কলেজ বন্ধ–সুতরাং আমাদের প্রত্যেককে আলাদা ঘর দিতে কোনো অসুবিধা হয়নি।
এই সেমিনারের মধ্যমণি জোসেফ নিডহাম–বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ হিসেবে তাঁর জগৎজোড়া খ্যাতি। কয়েক খণ্ডে রচিত তাঁর Science and Civilization in China (কেমব্রিজ, ১৯৫৪ থেকে) বইটি মানব-মনীষার অসামান্য নিদর্শন বলে কীর্তিত। তাঁর গবেষণার সুবিধের জন্যে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা। একটি গ্রন্থাগার তৈরি করে দিয়েছেন–পূর্ব এশিয়ার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-সম্পর্কিত বইপত্র দিয়ে। তাছাড়া কয়েকজন বিশিষ্ট সহকারীও দিয়েছেন তাঁর কাজে সাহায্য করতে।
কেমব্রিজ থেকে যারা এ-সেমিনারে যোগ দিয়েছেন, তাঁদের একজন অর্থনীতিবিদ জোন রবিনসন, আরেকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন ডান। জোন রবিনসনের বয়স হয়েছে, চলতে-ফিরতে কষ্ট হয়–যদিও মুখে সেকথা বলেন না। জন ডানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল আলজিয়ার্সে, এবার আবার সাক্ষাৎ হলো। কলকাতা থেকে এসেছেন বরুণ দে–তাতে আমি খুবই আনন্দিত। শিকাগো থেকে এসেছেন প্রবীণ ইতিহাসবিদ ডোনাল্ড লাক–দক্ষিণপূর্ব ও পূর্ব এশীয় ইতিহাস সম্পর্কে বড়ো বিশেষজ্ঞ। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে এই প্রথম যোগ দিয়েছেন চীনের দুজন পণ্ডিত-চীনকে সঙ্গে পেয়ে আনোয়ার খুবই উল্লসিত।
সেমিনার আরম্ভ হওয়ার আগের দিন প্রায় সবাই কলেজে পৌঁছে গেছি। রাতে খাবার সময়ে আমি আর বরুণ যে-টেবিলে বসেছি, সেখানে এসে যোগ দিলেন ডোনাল্ড লাক। আমি শিকাগোতে ছিলাম শুনে খুব খুশি হলেন। ওই টেবিলে আরো জনাতিনেক এসে বসলেন। আমরা মেন্যু দেখছি, অধ্যাপক লাক জিজ্ঞাসা করলেন, কে কে ওয়াইন খেতে চাও। জিজ্ঞাসা করার কারণ, তার দামটা আমাদের দিতে হবে–সেমিনার-কর্তৃপক্ষ দেবে না। দেখা গেল, টেবিলের সবাই ওয়াইন খেতে চায়। একজন তো ওয়াইন-লিস্ট নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। লাক একটা ওয়াইনের কথা বললেন, সে বললো আরেকটা। লাক হাতের তালিকাটা টেবিলে রেখে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার যুবক বন্ধু, আমি ৪০ বছর ইতিহাস পড়াচ্ছি–হয়তো ইতিহাস সম্পর্কে আমার অনেক কিছু অজানা। তবে ওয়াইন সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল, এমন দাবি করতে পারি। তুমি আমার ওপর নির্ভর করতে পারো। লাকের কথায় সে বেচারি চুপসে গেল।
আমি খুব মজা পেলাম। একটু একটু করে প্রশ্ন করতে থাকলাম লাককে-ওয়াইন-বিষয়ে তার আগ্রহ সম্পর্কে জানতে। তিনি ওয়াইন-সম্পর্কিত একাধিক সাময়িকীর গ্রাহক, বাড়িতে জায়গা হয় না বলে শিকাগোতে স্বতন্ত্র একটি সেলার ভাড়া করেছেন, লন্ডনে ওয়াইনের নিলাম হলে শিকাগো থেকে। তিনি টেলিফোনে তাতে ডাক দেন, তারপর নিলাম জিতলে সেই ওয়াইনের সংগ্রহ জাহাজযোগে শিকাগোতে আনিয়ে নেন। তার সংগ্রহে সবচেয়ে পুরোনো ওয়াইনের বোতল কত সালের, তা জানতে চাইলে, লাক বললেন, আমার জন্মসালের এক বোতল ওয়াইন আছে, সেটা যে খুব ভালো, তা নয়, তবে স্মারক হিসেবে রেখেছি–আমার পৌত্রকে উপহার দিয়ে যাবো।
সেমিনারের উদ্বোধনীতে নিডহাম বললেন তাঁদের সময়কার কোনো গ্রন্থাগারের কথা। সে-গ্রন্থাগারে পৃথিবীর ইতিহাস ও ইউরোপের ইতিহাস স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত থাকতো–তারপর থাকতো অন্যান্য দেশের ইতিহাস বলে একটা অংশ। ইউরোপ ছাড়া পৃথিবীর বাকি অংশকে এইভাবে এক করে রাখার মধ্যে যে ইউরোপকেন্দ্রিক মনোভাব আছে, তার সমালোচনা করলেন তিনি।
সেমিনারে বরুণ দে শুধু ভালো বক্তৃতা করেন নি, বিভিন্ন সময়ে তাঁর মন্তব্যও খুব মনোগ্রাহী হয়েছিল। নিডহাম তো বললেন, বরুণ দে কোন বিষয়ে জানেন না, তা আমি ঠাহর করতে পারছি না। আনোয়ারের বক্তৃতায় সমাজবিজ্ঞানের দুরূহ পারিবারিক শব্দের প্রচুর ব্যবহার ছিল। নিডহাম চোখ বন্ধ করে তা শুনছিলেন। বক্তৃতা শেষ হলে চোখ খুলে বললেন, এটা কেউ ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেবে আমার জন্যে? আনোয়ার খুব অপ্রতিভ হলেন–যদিও নিডহাম ব্যক্তিগতভাবে তাকে অপ্রতিভ করতে চাননি।
নিডহামের প্রধানতম সহকারী ছিলেন এক বয়স্ক চেক বিজ্ঞানী–এখন ব্রিটিশ নাগরিক। সেমিনারের অধিবেশনগুলির মধ্যবর্তী এক সময়ে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তাগোরে কি তোমাদের দেশে এখনো জনপ্রিয়?
তাগোরে কে, তা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল, তবে বেশি নয়। বললাম, রবীন্দ্রনাথ আমাদের সংস্কৃতির প্রধানতম গর্বের পাত্র; তাঁকে নিয়ে আমরা রীতিমতো যুদ্ধ করেছি; তাঁর গানকে আমরা জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দিয়েছি।
তিনি সন্তুষ্ট হলেন। আমি জানতে চাইলাম, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর জানবার বা কৌতূহলের সূত্র কী?
তিনি হেসে বললেন, সে এক মজার ঘটনা। আমার বড়ো ভাই আর আমি দেশে একই স্কুলে পড়েছি একটু আগে-পরে। সে একবার অ্যাসাইনমেন্ট নিলো, তাগোরে সম্পর্কে লিখবে। তখন তিনি সদ্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তা সত্ত্বেও আমাদের শহরে ও ভাষায় তাগোরে সম্পর্কে বইপত্র খুঁজে পাওয়া দুরূহ। কিন্তু সে দমবার পাত্র নয়। তার অ্যাসাইনমেন্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত সারাদিন ধরে সে তাগোরের কথা বলতে থাকতো। কোন সুদূর ভারতবর্ষের কবিতার সম্পর্কে অগ্রজের এই মুগ্ধতা আমার মনে দাগ কেটেছিল। আমি তো বিজ্ঞানী–কবিতার সমঝদার নই। কিন্তু ভাইয়ের কাছে শুনে কবিকে খানিকটা জেনেছিলাম। পরে তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পড়েছি আর তার শতবার্ষিকীর সময়ে তাকে আরেকটু জেনেছি। মানুষের ওপর তার প্রভাব, শিল্পী হিসেবে তাঁর মহত্ত্ব দূর থেকে অনুধাবন করতে পারি।
একদিন রাতে খাওয়ার সময়ে দেখি, চীনা বিদ্বানেরা তাঁদের নৈশভোজের কুপন দিয়ে গেছেন দুই চীনা ছাত্রকে। তারা খুব জড়োসড়ো হয়ে খাচ্ছে। অন্যেরা অনেকে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে বটে, কিন্তু কেউ এ-বিষয়ে উচ্চবাচ্য করছে না।
লাঞ্চের বিরতিতে একদিন দেখি ডোনাল্ড লাক বাইরে থেকে ফিরছেন। এমনি ফরসা মানুষ, ভারিক্কি চেহারা–এখন যথেষ্ট রক্তিম দেখাচ্ছে। আমার টেবিলে বসে পড়ে বললেন, এমন একটা অসম্ভব ব্যাপার ঘটেছে যে, আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না।
জানতে চাইলাম, কী ঘটেছে?
লাক বললেন, ট্রাভেলার্স চেক ভাঙাতে গিয়েছিলাম। মানি এক্সচেঞ্জে যে মহিলা বসেন, তিনি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, আমি আর্জেন্টাইন কি না। বললাম, না, কিন্তু কেন? মহিলা জবাব দিলেন, তাহলে আপনার টি সি আমি ভাঙাতাম না।
তখন ফকল্যান্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ব্রিটিশ রণতরি ঝাঁক বেঁধে রওনা হয়ে গেছে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশে। ব্রিটেনের জয়ধ্বনি এবং আর্জেন্টিনার নিপাত-কামনা শোনা যাচ্ছে ইংল্যান্ডে।
অধ্যাপক লাক বেদনার্ত কণ্ঠে বললেন, বিশ শতকের শেষে এমন যুদ্ধবাদ, এমন বর্ণবাদ, ভাবা যায়?
বললাম, মার্গারেট থ্যাচারের বক্তৃতা শুনলে আপনি তার যথেষ্ট প্রমাণ। পাবেন।
সেমিনারের মধ্যে একদিন জানলাম, মোমেনের বাড়ি থেকে টেলিফোন এসেছিল আমার খোঁজে। এটা প্রত্যাশিত নয়। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম তার বাড়িতে–মোমেন ও রোজী কেউই বাড়ি নেই, রঙ্গন টেলিফোন ধরলো। আমাকে কেন খোঁজ করেছিল, জানতে চাওয়ায় সে বললো, এ টেলিফোন কল কেম ফ্রম বাংলাদেশ। ইয়োর লিটল সিসটার হ্যাজ ডায়েড অফ অ্যাকসিডেন্ট।
আমি বিমূঢ়। লিটল সিসটার কে? রীনা-বীণাদের কেউ?
রোজী কখন বাসায় থাকবে জেনে নিয়েছিলাম। আবার ফোন করলাম সে সময়ে। রোজী বললো, যশোর থেকে ছোটোবু-দুলাভাই বাসে করে ঢাকায় ফিরছিলেন। সাভারের কাছে আরেক বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে ছোটোবু আসনে বসেই মারা গেছে, ছোটোদুলাভাই গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে আছেন।
আমার পৃথিবীটা এক নিমিষে কেমন জানি হয়ে গেল।
আনোয়ারকে বললাম, আমার বোন মারা গেছে, আমি এখনই দেশে ফিরে যাবো। সেমিনারের বাকি সময় থাকতে পারব না।
তিনি বললেন, তুমি যেতে চাইলে বাধা দেওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ভেবে দেখো, তুমি কি ফিরে গিয়ে দাফন-কাফনে উপস্থিত থাকতে পারবে?
আমি তার কথার উত্তর দিলাম না। একটা ট্যাকসি নিয়ে রেলস্টেশনে চলে এলাম। পরের ট্রেনে লন্ডনে পৌঁছে সোজা এয়ার ইন্ডিয়া অফিসে। তারা আগের কোনো ফ্লাইট ধরাবার বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারল না। বললো, সম্ভব হলে ফোনে জানাবে। মোমেনদের বাসার ফোন নম্বর দিয়ে রাখলাম।
ফিরে এলাম কেমব্রিজে। বরুণ সঙ্গ দিলেন। সেমিনারেও বসলাম। কিন্তু মন দিতে পারলাম না।
এয়ার ইন্ডিয়ার ফোন আসে না। উলটো নিজেই ফোন করি। কোনো লাভ হয় না।
এপ্রিলের ১০ তারিখে রওনা হই। বোম্বে আসতে আসতে বিলম্ব হয়ে যায়। ঢাকার ফ্লাইট পাবো কি না সন্দেহ হয়। ক্যাপ্টেনকে চিরকুট পাঠাই–আমার বোন মারা গেছে। যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় ফিরতে চাই। আপনি কি কন্ট্রোল টাওয়ারে খবর দিয়ে কানেকটিং ফ্লাইট ধরাবার ব্যবস্থা করতে পারবেন?
এয়ার হোস্টেস এসে বলে, উনি চেষ্টা করবেন।
পরে বুঝতে পারি, আমার ওই অনুরোধের কোনো অর্থ ছিল না। আর ক্যাপ্টেন যা বলে পাঠিয়েছিলেন, তা কেবল আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে।
তবে ঢাকাগামী ফ্লাইট ধরতে ব্যর্থ হইনি।
১৩.
ঢাকায় ফিরে প্রথমে গেলাম বনানীতে–ছোটোবুর কবরে।
ছোটোবুর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতো। তার অনেক সুখ দুঃখের সাথী ছিলাম আমি। অল্প সম্বল নিয়ে বড়ো সংসার চালাতে তাকে বেশ কষ্ট করতে হতো। তার মধ্যেও সে মুখের হাসি ম্লান হতে দেয়নি। নিপুণ হাতে ঘরবাড়ি গুছিয়ে রাখতো সে। শেষকালে কিছুই আর তাকে ধরে রাখতে পারলো না। কাউকেই ধরে রাখা যায় না।
ছোটোদুলাভাইকে দেখতে গেলাম হাসপাতালে। তখনো তিনি জানেন না, ছোটোবু নেই। আমাকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার ছোটোবুকে দেখে এসেছ? কেমন আছে?’
কী উত্তর দেবো! বললাম, ‘দেখে এসেছি।’
১৪.
১৯৮২ সালে কুমিল্লা বোর্ডের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল, মানবিক বিভাগে রুচি বিংশ স্থান অধিকার করেছে। আমাদের বাড়িতে তো বটেই, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে এবং আমাদের পাড়ায়ও এ-নিয়ে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। এখলাসউদ্দীন তার আগের মন্তব্যের পুনরুক্তি করলেন আমার সম্পর্কে : সারা বছর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কোনো খবর রাখি না, কেবল পরীক্ষায় তারা ভালো ফল করলে গৌরবের ভাগী হই।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা দেখি না, বেবীর এমন অনুযোগের কারণে একদিন ওদের তিন ভাইবোৰুকে বলেছিলাম, বইপত্র নিয়ে এসো। স্কুলে বাড়ির কাজ কী দিয়েছে, শুনি। আনন্দ বললো, ‘চার লাইন কবিতা মুখস্থ করতে দিয়েছে।
জানতে চাইলাম, ‘মুখস্থ করেছ?’
সে বললো, ‘দু লাইন করেছি।’
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘চার লাইন মুখস্থ করতে দিয়েছে–তুমি দু লাইন মুখস্থ করেছ কেন?’
তার জবাব, ‘এক লাইন শুনেই তো সার বলেন, বোসো।’
বুঝতে পারি, শ্রেণিকক্ষের সব ছেলেমেয়ের পড়া ধরার মতো সময়ের সংকুলান হয় না এক পিরিয়ডে। এও বুঝতে পারি যে, ছোটো ছেলেমেয়েরাও এই পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার পথ খুঁজে নিয়েছে।
ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার তত্ত্বাবধানে আমার পক্ষে আর এগোনো সম্ভব হয়নি।
১৫.
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল আজিজ খানের সততা সম্পর্কে আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়সংকোচেও তিনি নানারকম ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিস্তর বৃক্ষরোপণ তাঁর অক্ষয় কীর্তি। বিদ্যমান নিয়মকানুন তিনি সব সময়ে অনুসরণ করতে চাইতেন না-এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার বিরোধ হতো। তিনি ধার্মিক ছিলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজেকর্মেও তার প্রকাশ ঘটিয়ে ফেলতেন–এ-নিয়েও আমাদের মতান্তর ঘটতো। একবার জানা গেল, বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি মাদ্রাসার পত্তন হয়েছে, নিজের দায়িত্বে উপাচার্য তার অনুমোদন দিয়েছেন এবং আর্থিক দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয় নেবে বলে সিদ্ধান্ত করে ফেলেছেন। আমি তাকে বলি, এ-বিষয়ে এককভাবে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে স্কুল-কলেজের ব্যয়নির্বাহের দায়িত্ব নিয়েছে, সেখানে মাদ্রাসার দায়িত্ব না নেওয়ার কোনো হেতু নেই। তর্কের মধ্যে আমি বলেছিলাম, মাদ্রাসা-শিক্ষার পক্ষে কথা বলেন, এমন অনেককেই দেখেছি, নিজের ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পাঠান না। কয়েকদিন পরে শুনলাম, উপাচার্য তার ছেলেকে ওই মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছেন। এ-ঘটনাটি তাঁর আমলের পরের দিকের, কিন্তু প্রায় প্রথম থেকেই পদ্ধতিগত প্রশ্ন নিয়ে আমার সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কখনো কখনো এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি আমাদের অগোচরে রাখতেন এবং তা প্রকাশ হয়ে পড়লে এক ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এ রকম কোনো একটি ঘটনার পরে অ্যাকাডেমিক কাউনসিলের সভায় আমি বলেছিলাম যে, উপাচার্যের কথায় আমি আস্থা রাখতে পারছি না। আমি তখন কলা অনুষদের ডিন। আমার এই রূঢ় উক্তিতে সভায় বেশ হইচই হয়েছিল।
বিদেশ থেকে আমার চট্টগ্রামে ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যে কাগজে দেখলাম, রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ এফ এম আহসানউদ্দীন চৌধুরী চট্টগ্রাম সফরে আসছেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চানসেলরও। আমি ভাবলাম, তাঁর সঙ্গে দেখা করে উপাচার্যের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আপত্তি জানাবো। হাসনাত আবদুল হাই তখন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার। তাকে অনুরোধ করলাম, চানসেলরের সঙ্গে সাক্ষাতের একটা ব্যবস্থা করে দিতে। তিনি বললেন, এখন সামরিক শাসনের কাল, তাই রাষ্ট্রপতির সফর-সম্পর্কিত সকল ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছেন আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক। আমি চাইলে তাকে অনুরোধ করতে পারি। তাতে কোনো কাজ হবে কি না, সে-সম্পর্কে আমার সন্দেহ ছিল। তবু হাসনাত আবদুল হাইকে বললাম, আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসককে আমার কথাটা বলতে। হাই জিওসিকে ফোন করে আমার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিলেন–আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু বললেন না। অনতিবিলম্বে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে গিয়ে সাক্ষাৎ করলাম মেজর জেনারেল এম এ মান্নাফের সঙ্গে। বললাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনদের মধ্যে আমি জ্যেষ্ঠ-সেই দায়িত্ববোধ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে চানসেলরের সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। তিনি খুব সৌজন্যের সঙ্গে বললেন, আপনাকে আসতে হবে ভাইস-চানসেলরের মাধ্যমে। বললাম, ভাইস-চানসেলরের সম্পর্কেই আমি অভিযোগ করতে চাই। তিনি বোধহয় একটু বিস্মিত হলেন, তবে সেটা প্রকাশ না করেই বললেন, প্রোটোকল অনুযায়ী ভাইস চানসেলরের মাধ্যমেই আমাকে চানসেলরের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রার্থনা করতে হবে, সাক্ষাতের কারণ বর্ণনা করে। আমি বুঝতে পারলাম, কোনো কাজ হলো না, বরঞ্চ এমন ধারণার সৃষ্টি হলো যে, আমি উপাচার্যের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছি। এটা আমার পক্ষে ভালো হয়নি।
অল্পকালের মধ্যে শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আবদুল মজিদ খান চট্টগ্রাম সফরে এলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হলেন। তাঁর সঙ্গে আমার অনেককালের পরিচয়, তবে তিনি নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পরে এই প্রথম দেখা। আলোচনা করতে করতে বেশ তর্কই হয়ে গেল তাঁর সঙ্গে, কিন্তু বিষয়টিকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নেননি। সভার পরে আমরা কয়েকজন আবার উপাচার্যের অফিসকক্ষে তাঁর সঙ্গে বসলাম। তখন একদল ছাত্র এসে ড. মজিদ খানের সঙ্গে দেখা করতে চাইলো–তারা বেশ সংঘবদ্ধ হয়ে এসেছে, উপাচার্যের বিরুদ্ধে স্লোগানও দিচ্ছে। যেহেতু ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করার কোনো কর্মসূচি শিক্ষা-উপদেষ্টার ছিল না, তিনি তাদের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন না, অথবা বলা যেতে পারে, সরকারি প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে ছাত্রদের সঙ্গে দেখা না করার পরামর্শ দেওয়া হলো। ছাত্ররা দেখা করার জন্যে চাপ দিতে লাগলো। তখন জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ছাত্রদের যেন আমি চলে যেতে বলি। তার ধারণা, আমি ঠিকমতো বললে ছাত্ররা চলে যাবে। বুঝতে পারলাম যে, তাঁরা ধরে নিয়েছেন, ছাত্রদের সেখানে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে আমার সংশ্রব আছে। আমি ছাত্রদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলাম, তাতে কাজ হলো না। কিছুক্ষণ পর গোয়েন্দা কর্মকর্তা আবার আমাকে একই অনুরোধ জানালেন, এবারে তার সঙ্গে যোগ দিলেন সাদা পোশাকপরা একজন সামরিক কর্মকর্তা–হয়তো সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কেউ। আমি ছাত্রদের সঙ্গে আবার কথা বললাম। তারা এবারে চলে যেতে সম্মত হলো। তাতে গোয়েন্দাদের ধারণা পোক্ত হলো।
এর অল্পকালের মধ্যে আমাদের পূর্বতন উপাচার্য আবদুল করিম, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আফিজউদ্দিন আহমদ, প্রধান প্রকৌশলী নাসিরউদ্দীন চৌধুরী এবং সহকারী প্রকৌশলী লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সামরিক আইনে মামলা দায়ের হলো। অভিযোগ যে বর্তমান উপাচার্যের উদযোগে আনীত হয়েছে, সেটা স্পষ্টতই জানাজানি হলো। দুর্নীতির তদন্ত বা দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হওয়ায় আমার কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু সামরিক আইনের অধীনে উপাচার্যের বিচারে আমার ঘোরতর আপত্তি ছিল। তার ওপর, আবদুল করিম আমার সরাসরি শিক্ষক–সেই মর্যাদা অমি সব সময়ে তাঁকে দিয়েছি, তাঁর সঙ্গে মতপার্থক্য ঘটলেও। তাঁর প্রতি আমার সহানুভূতি আমি গোপন করলাম না।
এ-সময়ে উপাচার্য আজিজ খানের ভবনে এক নৈশভোজের আমন্ত্রণ পেলাম। উপস্থিত হয়ে দেখলাম, অপর নিমন্ত্রিত অতিথি হলেন জেনারেল মান্নাফ। তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ হলো, তিনি খুবই সৌজন্যের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এক পর্যায়ে গৃহকর্তার অনুপস্থিতিতে তিনি জানতে চাইলেন যে, উপাচার্য থাকার সময়ে অধ্যাপক করিমের সঙ্গে আমার মতপার্থক্য ছিল বলে তিনি শুনেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হওয়ায় আমি তাঁর পক্ষসমর্থন করেছি বলেও তিনি জেনেছেন। ব্যাপারটা তাঁর বোধগম্য হচ্ছে না। আমি বললাম, তিনি যা শুনেছেন, সবই সত্যি। দুর্নীতির যে-অভিযোগ অধ্যাপক করিমের বিরুদ্ধে হয়েছে, তার সত্যাসত্য সম্পর্কে আমি কিছু জানি না এবং সে বিষয়ে কিছু বলিওনি। আমার আপত্তি সামরিক আইনে তার বিচারে–দেশের প্রচলিত আইনে বিচার হলে আমি কোনো কথা বলতাম না। আমি আরো বললাম, এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মযহারুল ইসলাম সামরিক আইনে দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরীও অনিয়মের অভিযোগে সামরিক আইনে সাজা পেয়েছেন এবং পরে মুক্ত হয়ে অল্পকালের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। সামরিক আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি আত্মপক্ষসমর্থনের যথাযথ সুযোগ পান না বলে আমার বিশ্বাস। এইভাবে সামরিক আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদাধিকারীর হেনস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং তার শিক্ষকদের ভাবমূর্তি যেভাবে ধ্বংস করছে, আমি তার বিরুদ্ধে। জেনারেল মান্নাফ পালটা প্রশ্ন করলেন, উপাচার্যেরা যদি দুর্নীতি বা অনিয়ম করেন, তাতে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোটা সম্প্রদায়ের (ইউনিভার্সিটি কমিউনিটির) ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না? বললাম, নিশ্চয় হয়। তবে দুর্নীতি বা অনিয়ম সম্পর্কে প্রশাসন এত নিশ্চিত হলে প্রচলিত আইনে বিচার করলেই পারে। তিনি বললেন, আমার তো জানার কথা যে, প্রচলিত আইনে বিচার সময়সাপেক্ষ হয় এবং তার ফাঁকফোকর দিয়ে অভিযুক্তরা অনেক সময়েই বেরিয়ে যায়। আমি বললাম, জেনারেল তো নিশ্চয় জানেন যে, শুধু বিচার হলেই হয় না, তা যে সুবিচার হয়েছে, তা দৃশ্যমান হওয়া আবশ্যক হয়। জেনারেল হাসলেন। বললেন, তিনি আশা করবেন যে, অনুরাগ-বিরাগের দ্বারা নিজের ন্যায়বোধকে আমি বিচলিত হতে দেবো না। ওই প্রসঙ্গের সেখানেই পরিসমাপ্তি ঘটলো। পরে আমরা অন্যান্য বিষয়ে আলাপ করলাম। তাঁর মা-শিশু একাডেমীর পরিচালক–জোবায়দা খানমের সঙ্গে আমার পরিচয়ের কথা বললাম। বুঝতে পারলাম, তিনি সে-সম্পর্কে অবহিত।
প্রসঙ্গান্তরে কিছুকাল পরের একটি ঘটনার উল্লেখ করি। চট্টগ্রাম থাকতে প্রায়ই রাতের মেলে আমি ঢাকা আসা-যাওয়া করতাম। সাধারণত, টেলিফোন করে আসন সংরক্ষণ করতে অনুরোধ জানাতাম, তারপর ট্রেন ছাড়ার কিছু আগে স্টেশনে গিয়ে টিকিট নিতাম। একবার কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে শুনি, আমাকে ওপরের বার্থে যেতে হবে, কেননা জোবায়দা খানম চট্টগ্রাম যাবেন এবং আর কোথাও জায়গা না পেয়ে বলেছেন, আমার সঙ্গে একই কুপে যাবেন এবং সংশ্লিষ্ট রেল-কর্মচারীকে আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, তিনি যাচ্ছেন জানলে আমি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিচের বার্থ ছেড়ে দিয়ে ওপরের বার্থে যাবো। কথাটা পুরোপুরি সত্যি। তিনি আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করলেও ছোটো ভাইয়ের মতো জানেন এবং আমিও তাকে বড়ো বোনের মতোই দেখি। তিনি কামরায় উঠে আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যে অনেক দুঃখপ্রকাশ করলেন এবং তাঁকে ওই রাতেই যেতে হবে বলে অনন্যোপায় হয়ে ওই ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন বলে ব্যাখ্যা করলেন। আমি তাকে বললাম যে, তিনি আমার ওপরে সব সময়েই অমন দাবি করতে পারেন। পরদিন চট্টগ্রামে পৌঁছে দেখা গেল, ছেলের বাড়ি থেকে তাকে কেউ নিতে আসেনি-যোগাযোগের কোনো বিভ্রাট ঘটেছে। আমি বললাম, আপা, আপনাকে আমি ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে দিয়ে যাবো-আমাকে তার সামনে দিয়েই বাড়ি যেতে হবে। তাকে জিওসি-র বাড়িতে নামিয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম। বাড়ি পৌঁছোতেই জেনারেল মান্নাফের ফোন পেলাম–তার মাকে সাহায্য করায় তিনি আমাকে সমূহ ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।
যাহোক, ওই মামলায় জরিমানা এবং আদালত চলা পর্যন্ত আটক থাকার শাস্তি হয়েছিল অধ্যাপক আবদুল করিমের, অন্যদেরও কিছু সাজা হয়েছিল। সাজাপ্রাপ্ত সকলের বাড়িতেই আমি সহানুভূতি জানাতে গিয়েছিলাম। সে-খবর শুনে উপাচার্য আজিজ খান আমার কাছে তার সত্যতা জানতে চেয়েছিলেন। আমি যখন বলি যে, তিনি যা শুনেছেন, তা সত্যি, তখন তিনি চুপ করে গিয়েছিলেন, এ-প্রসঙ্গে আর কিছু বলেননি।
১৯৮৩ সালে ঢাকায় ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সামরিক আইনের নিষেধ অমান্য করে চট্টগ্রাম শহরে এসে মৌন মিছিল করি। মিছিল বের করার উদ্দেশ্যে আমরা যখন শহরে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে এসে সমবেত হই, তখন দুজন পুলিশ-কর্মকর্তা এসে আমাদের বলেন, কর্তৃপক্ষ আমাদের মিছিলে বাধা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তবে সার্বিক নিরাপত্তা ও যান-চলাচলের স্বার্থে তারা মিছিলের যাত্রাপথ সম্পর্কে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছেন। আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করি এবং উভয়পক্ষের সম্মত পথ ধরে মিছিল পরিচালনা করি। পরে আমরা শুনেছিলাম যে, শিক্ষকদের সঙ্গে কোনো সংঘর্ষে লিপ্ত না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন জেনারেল মান্নাফ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হলে একবার পুষ্পেদ্যান-রচনার বিশেষ উদযোগ নেওয়া হয়। ঘটা করে উদ্যানের উদ্বোধন হয়। হলের প্রোভোস্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ হারুন-উর রশীদ সেই অনুষ্ঠানে আমাকে প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন এবং বাগানের ফুল না ছিঁড়তে ছাত্রদের পরামর্শ দিতে বলেছিলেন। আমার বক্তৃতার শেষ বাক্যটি ছিল এই : ‘আমরা যদি মনে রাখি যে, বন্যেরা বনে সুন্দর, সৈন্যেরা ব্যারাকে এবং পুষ্প উদ্যানে, তাহলে জীবন অনেক সুসহ হয়।’ পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জুড়ে এবং তার দু একদিনের মধ্যে চট্টগ্রাম শহরে পোস্টার পড়েছিল : ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, সৈন্যেরা ব্যারাকে।’ তখনো সামরিক শাসন চলছে।
পরের দিকে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আমি তার প্রতিনিধিরূপে সিন্ডিকেট-সদস্য নির্বাচিত হই। তার অল্প সময়ের মধ্যেই সিন্ডিকেটে চানসেলরের প্রতিনিধিরূপে আমার মনোনয়নের সংবাদ আসে। আমি বিস্মিত হই, তবে ধরে নিই যে, সম্ভবত ড. মজিদ খানের সুপারিশে এটা ঘটেছে। মনোনয়নলাভের পরে আমি নির্বাচিত সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিই। কিছুকাল পরে চট্টগ্রাম শহরে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ শিক্ষক সমিতির এক সভায় আমি বাংলাদেশে সামরিক শাসন এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে একটি বক্তৃতা করি। তার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি আসে যে, সিন্ডিকেটের সদস্যরূপে আমার মনোনয়ন চানসেলর বাতিল করেছেন। পরে জানতে পারি, আমার ওই বক্তৃতার সংবাদ চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল নূরুদ্দীন খানের কাছে পৌঁছায়। তিনি তা চানসেলর এরশাদের গোচরে আনেন। শিক্ষা সচিব কাজী জালালউদ্দীন আহমদকে ফোন করে এরশাদ জানতে জানতে চান যে, আমার মনোনয়ন আইনত বাতিল করা যায় কি না। শিক্ষা সচিব বলেন, যিনি মনোনয়ন দেন, তিনি অবশ্যই তা বাতিল করতে পারেন। অতএব, সিন্ডিকেটে আমার সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায়।
ঘটনাক্রমে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের প্রতিনিধি পদটি তখনো শূন্য ছিল। আমি আবার নির্বাচনে প্রার্থী হই, আবার নির্বাচিত হই, আবার সিন্ডিকেটের সদস্যপদ লাভ করি।
এই সময়ে আমার হাতে অনেকগুলো কাজ জমে গেল। জাপানের ৎসুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে হবে মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন। উদ্যাক্তারা কার কাছে আমার নামধাম পেয়েছেন, জানি না, সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আবার আনোয়ার আবদেল মালেক লিখেছেন, কেমব্রিজের সেমিনারের কার্যবিবরণী আমাকেই সম্পাদনা করতে হবে। যেভাবে আলজিয়ার্সের সেমিনারের কার্যবিবরণী সম্পাদনা করেছিলাম, সেভাবেই কাজটা করা কর্তব্য। তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কথা বলে ফেলেছেন আমাকে জিজ্ঞাসা না করেই। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় আমার পারিশ্রমিকের অর্থ আগাম পাঠাবেন প্যারিসে। সেখানে আমি পাণ্ডুলিপি তৈরি করে ফেলতে পারবো আগেরবারের মতো সকল ব্যবস্থায়। আমি না। বললে তিনি শুনছেন না। ওদিকে ১৯৭৫ সালের পরে পুরোনো বাংলা গদ্যের কাজটা আর ধরা হয়নি। কলকাতায় গিয়ে মাসাধিককাল কাজ করা প্রয়োজন–মূলত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের গ্রন্থাগারে রক্ষিত পাণ্ডুলিপি পড়া এবং নকল করা।
একসঙ্গে তিনটি সফরের প্রস্তাব দিয়ে ছুটি চাইলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অনুমতি চাইলাম বিদেশে যাওয়ার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সুপারিশ করলেন। তারপর বেশ সময় নিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তর থেকে চিঠি এলো বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের কাছে। জেনারেল সালজার জানতে চান, এত দীর্ঘ সময়ের জন্য অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের অনুপস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের প্রতিকূল হবে কি না সে সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত। বিশ্ববিদ্যালয় তো আগেই আমার বিষয়ে সুপারিশ করেছে, তারই পুনরাবৃত্তি হলো। আমি তদবির করতে গেলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। প্রায় পুরো একটা দিন লেগে গেল। শিক্ষামন্ত্রীর একান্ত সচিব অধ্যাপক শুজাউদ্দীন–যিনি আমার বিশেষ পরিচিত–তিনি আর ড. মজিদ খানকে আমার উপস্থিতির কথা বলার সুযোগ পান না। মন্ত্রী যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন করিডোরে তাঁকে পাকড়াও করলাম। তিনি আমাকে দেখে অবাক হলেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের অফিসে ফিরে গেলেন। ফাইলটা খুঁজে আনালেন, তারপর লিখলেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে বিদেশে যেতে দেওয়া হবে দেশের স্বার্থের অনুকূল।
হিতৈষীরা বললেন, তাতেও হবে না। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসনের দপ্তরে তদবির করতে হবে। কাকে ধরবো! বেবীর বান্ধবী ও আমার ছাত্রী আবেদার স্বামী জেনারেল মোজাম্মেল ওই দপ্তরের প্রভাবশালী কর্মকর্তা। আবেদার ফোন নম্বর জোগাড় করে তাকে বললাম, জেনারেল মোজাম্মেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে। তিনি বললেন, জেনারেল সামনেই আছেন, আমি টেলিফোনেই কথা বলতে পারি। খুব বেশি বলতে হলো না। তিনি বললেন, আমি দেখবো। দিন দুই পরে জানা গেল, ফাইলে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সই হয়ে গেছে।
১৬.
ৎসুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক মূল্যবোধ-সম্পর্কিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সময় ঘনিয়ে এলো। অথচ আমার যে-প্রবন্ধ সেখানে পড়ার কথা, তা এগোচ্ছে না। শেষে স্থির করলাম, দুদিন আগে বেরিয়ে পড়ব-ব্যাংককে। হোটেলে বসে প্রবন্ধ তৈরি করে তবে যাব ৎসুকুবায়।
১৯৮৩ সালের ১৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম ছাড়লাম। ঢাকা থেকে ব্যাংককে গেলাম পরদিন। ১৭ ও ১৮ এই দুদিনে নিজের খরচে হোটেলে থেকে লেখা শেষ করলাম। ১৯ তারিখে পৌঁছোলাম নারিতায়। বিমানবন্দরে দেখা হয়ে গেল ডা. তাহমিনা হোসেনের সঙ্গে সরকারি প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে তিনি একটি সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন।
উদ্যাক্তারা গাড়ি পাঠিয়েছেন বিমানবন্দরে। তাতেই যাওয়া গেল। ৎসুকুবায়। একটা বড় হোটেলে থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। রিসেপশনেই যথেষ্ট ভিড়। কোনোমতে চাবি নিয়ে কক্ষে ঢোকা। জাপানে যেমন হয় সাধারণত, ঘরটা অপরিসর, বাথরুম আরো সংকীর্ণ–তবে কোনো কিছুর অভাব নেই, সবই সুসজ্জিত। স্নান সেরে তৈরি হয়ে বের হবো ঘর থেকে–টের পেলাম, চাবি নেই সঙ্গে। ওটা দরজায় রেখেই ঢুকে পড়েছি ঘরে, এখন তালাবদ্ধ অবস্থা। দরজা খুলতে না পেরে টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাতে থাকলাম। যিনি টেলিফোন ধরলেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম রিসেপশন? উত্তর এলো, জি হ্যাঁ, কী করতে পারি? বললাম, ঘরে আটকা পড়ে গেছি–সাহায্য চাই। বললেন, এক্ষুনি। খানিক পরে সাহায্য এলো।
নিচে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসেছি। এক অনতিতরুণ ইংরেজ এগিয়ে এসে বলল, আশা করি, তোমাকে উদ্ধার করতে সময় নেয়নি এরা–এবারে রিসেপশনের নম্বরটা জেনে নিও। বুঝলাম, আন্দাজে ফোন করতে গিয়ে এরই ঘরে ডাকটা গেছে এবং আমার দুর্বিপাকের কথা সে-ই জানিয়েছে। রিসেপশনকে। তখন মনে পড়ল, চেক-ইন করার সময়ে আমার সামনে দুই নরনারী দাঁড়িয়ে ছিল। পুরুষটি ইনিই। একটু তাকাতে অদূরে মেয়েটিকেও দেখতে পেলাম মিটিমিটি হাসছে। লোকটি এবারে আমাকে আহ্বান জানাল তাদের সঙ্গে যোগ দিতে। পরিচয় দিলো নিজেদের। তারা লন্ডনে গ্যালাপে সহকর্মী, মানবিক মূল্যবোধ সম্মেলনেই যোগ দিতে এসেছে। ভদ্রলোকের নাম বোধহয় গর্ডন, মেয়েটির নাম এখন ভুলে গেছি। দুজনে সদালাপী তো বটেই, বেশ হাসিখুশি, লোকটি তো ফুর্তিবাজ।
পরদিন রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে মনে হলো, সম্মেলন তো নয়, মেলা। সাদা, পীত, কালো, তরুণ, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ নরনারীতে জায়গাটা গিজ গিজ করছে। কেউ আমার প্রবন্ধ চাইল না, সুতরাং নিজের মূল্যবান (হোটেল খরচের হিসেবে) লেখাটা কারো ওপর চাপাবার চেষ্টা করলাম না–ওটা জ্যাকেটের পকেটেই রয়ে গেল।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা বেশ জমকালো হলো। মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে দেখা হয়ে গেল হাসান হানাফির সঙ্গে। এই মিশরীয় ভদ্রলোক মরক্কোর কিং হাসান ইউনিভার্সিটির দর্শনের অধ্যাপকতার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল কুয়েতে। দেখামাত্র জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, হে আমার প্রিয় ভ্রাতা, তুমি যে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলে, মুসলমানদের মধ্যে আরবরা সংখ্যালঘু, সেকথা আমার একটা লেখায় উল্লেখ করেছি। এবারে তুমি কী বার্তা বহন করে নিয়ে এসেছ?
বললাম, কোনো বার্তা নয়, অনেক কষ্ট করে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম, তাও কেউ চাইলো না। সেটা আমার সঙ্গেই ফেরত যাবে।
হানাফি বললেন, তাহলে কি আমরা তোমার গভীর চিন্তার ফসল থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছি?
বললাম, গভীর চিন্তা না ছাই। আমি আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর নেওয়া আমার পোষায় না। লোভে পড়ে এসব সম্মেলনে আসি। কোনোমতে আত্মরক্ষা করতে পারলে হয়।
হানাফি বললেন, তুমি কি ভাবো, আমি অন্য উদ্দেশ্যে এসব জায়গায় আসি? তবে এখানে এসে মনে হচ্ছে, এরা লোক জড়ো করতে যত আগ্রহী, কথা শুনতে তত নয়।
বললাম, আমার পক্ষে সেটাই ভালো।
মধ্যাহ্ন-বিরতির পর অনেকগুলো অধিবেশন সমান্তরালভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। আমার জন্যে যেটা বরাদ্দ, সেখানে গিয়ে দেখি, গর্ডনও তাতে উপস্থিত। চেনামুখ দেখে আমরা উভয়েই খুশি, বসলাম পাশাপাশি। এক মার্কিন অধ্যাপক মডারেটর, এক বিদ্বান জাপানি প্রবন্ধ-পাঠক। লেখাটি পড়া হলো জাপানি ভাষায়, দীর্ঘক্ষণ ধরে। সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি অনুবাদও শুনলাম দোভাষীর কণ্ঠে, তবে অনেক কিছু অস্পষ্ট রয়ে গেল। চা-বিরতিতে সঞ্চালক বললেন, ইংরেজি অনুবাদটি ভালো হয়নি। মেয়েটি সম্ভবত বাণিজ্যিক সভা সমিতিতে দোভাষীর কাজ করে, সংস্কৃতিবিষয়ক অনেক পরিভাষার সঙ্গে পরিচিত নয়।
বিরতির পরে আলোচনা শুরু। প্রবন্ধ-পাঠককে আমি একটা প্রশ্ন করলাম–তাতে symbiosis কথাটা ব্যবহার করেছিলাম। গর্ডন আমাকে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমি synthesis বলতে চাইছি কি না। সঞ্চালক আমার হয়ে জবাব দিলেন, না উনি সিমবায়োসিস বলেছেন, ঠিকই বলেছেন।
গর্ডন আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘ইউ অ্যাকাডেমিকস ক্যান বি কোয়াইট ট্রাইং।
আমার প্রশ্নের উত্তরে মূল বক্তা এতক্ষণ ধরে কথা বললেন যে, সঞ্চালক তাঁকে থামাতে পারেন না। গর্ডন ফিস ফিস করে বললো, ঈশ্বরের শপথ, যদি তুমি আরেকটা প্রশ্ন করো, তাহলে তোমার টাই দিয়েই গলায় ফাঁস দিয়ে তোমাকে মেরে ফেলব।
সঞ্চালক বললেন, আমাদের হাতে সময় এত কম যে, আর কাউকে মূল কোনো প্রতিপাদ্য উপস্থাপন করতে বলতে পারছি না। আলোচিত বিষয়ে যদি কেউ কোনো আলোকপাত করতে চান।
কেউ হাত তুললেন না। সঞ্চালক ভাষণ দিতে শুরু করলেন।
প্রায় ছটা বাজে। আমি একটা কাগজে লিখলাম : ইলেভেন্থ কম্যান্ডমেন্ট : দাউ শ্যাল নট হোল্ড সেমিনারস আফটার সি পিএম। কাগজটা গর্ডনের দিকে এগিয়ে দিলাম।
সে বললো ফিস ফিস করে, গলায় ফাঁসের কথা ভুলো না।
সেদিনের মতো কাজ শেষ।
আয়োজকদের হয়ে যে-ছেলেটি আমাকে আনতে গিয়েছিল, তার সঙ্গে দেখা। একগাল হেসে বললো, ইওর প্রিন্স হ্যাজ অ্যারাইভড।
কিছুই বুঝলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের আবার প্রিন্স কে? বলো তো কে এসেছে জাপানে?
সে আরো একগাল হেসে বললো, জাপানে নয়, বাংলাদেশে। তোমাদের প্রেসিডেন্টের পুত্রলাভ হয়েছে।
মনে মনে বললাম, এ তো বড় রঙ্গ, জাদু, এ তো বড় রঙ্গ। গর্ডন ও তার সহকর্মীর সঙ্গে বাকি সন্ধেটা কাটলো।
পরদিন কোনো নির্দিষ্ট অধিবেশনে উপস্থিত থাকার কথা নয়। পছন্দসই এ অধিবেশনে ও-অধিবেশনে টু দিই। যতক্ষণ ভালো লাগে থাকি, তারপর বেরিয়ে আসি। এক জায়গায় হাসান হানাফির সঙ্গে দেখা। তিনি জানতে চান, তুমি কয় মিনিট কথা বলেছ?
বলি, তিন মিনিট, বড়জোর চার।
জিজ্ঞাসা করেন, তোমার ওই তিন-চার মিনিটের কথার জন্য এদের কত খরচ হয়েছে? তোমার প্রতি মিনিট কথার মূল্য কত?
আমি প্রশ্ন করি, আপনি কতক্ষণ বলেছেন?
হেসে বললেন, বড়জোর পাঁচ মিনিট।
ৎসুকুবা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে দেখছি। কে যেন ‘সার’ বলে ডাকল। দেখি, আমাদের আর্ট কলেজের মাহমুদুল হক।
মাহমুদুল হক জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে এসেছেন। আমাকে দেখে অবাক। আগাগোড়া শীতবস্ত্রে আচ্ছাদিত আমাকে ঠাহর করতেও সময় নিয়েছে। কিন্তু একবার চেনামাত্রই আতিথেয়তার অদম্য ঝোঁক মাথাচাড়া দিয়েছে। সুতরাং তাঁর বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করতে হলো। সেখানে দেখা পেলাম আরেক শিল্পী জামাল আহমেদের। জামালও বৃত্তি নিয়ে ৎসুকুবায়, সেও অতি অতিথিপরায়ণ। ফলে তার ডেরায় গিয়ে তুলিকে কষ্ট দেওয়া অনিবার্য হয়ে দাঁড়ালো।
ৎসুকুবার পাট চুকিয়ে ট্রেনে এলাম টোকিওতে। বলা যায়, আমার পূর্বপরিচিত সন্দীপ কুমার ঠাকুরের সঙ্গে। তিনি শিক্ষকতা করেন ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর ব্যবস্থাপনায় টোকিওতে দু রাত থাকা গেল ইনস্টিটিউট অফ ইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের অতিথিশালায়। রাতে একটু জ্বর-জ্বর ভাব, পরদিন বিকেলে সেটা ছাড়লো। সন্ধ্যার দিকে বের হলাম। রাতে বাইরে খেয়ে ফিরলাম। জ্বরাক্রান্ত ও বহিষ্ক্রান্ত হওয়ার ফলে সন্দীপের সঙ্গে তেমন আড্ডা হলো না।
আমার শ্যালক আজিজ টোকিওর এক বিশেষ দোকান থেকে তার জন্যে টাই কিনে নিয়ে যাওয়ার ফরমাশ দিয়েছিল। সকালবেলায় মেট্রো করে জায়গামতো পৌঁছে সওদা করলাম। সেখানেই বোধহয় মেট্রোর ইংরেজি নির্দেশিকা ফেলে এলাম। ফেরার পথে তাই ভয় করতে লাগলো, ঠিক স্টেশনে নামতে পারব তো! বলা বাহুল্য, স্টেশনে ইংরেজিতে কোনো সাইনবোর্ড নেই, গাড়ির ভেতরে লাইনের যে-চিত্র দেওয়া আছে তাও জাপানি ভাষায়। আমার উলটো দিকের সারিতে এক মহিলাকে মার্কিন বলে মনে হলো। সাহস করে ইংরেজিতে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার গন্তব্য সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারবেন কি না। তিনি ধারণা দিলেন এবং যথাস্থানে ফিরে এলাম।
সন্ধ্যায় টোকিও থেকে প্যানামে যাবো হংকংয়ে। বিমানের দরজায় দুজন বিমানবালা অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করছে। তার মধ্যে একজন সহাস্যে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কি আজ সকালে মেট্রোতে অমুক স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলে?
বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি, তুমিই কি আমার উদ্ধারকারিণী?
সে বলে, হ্যাঁ।
মেয়েটি ইউনিফরমে থাকায় তাকে চেনার উপায় নেই। আমার সকালের পোশাকে সামান্য পরিবর্তন সত্ত্বেও সে চিনতে পেরেছে। অবাক হওয়ারই কথা।
বিমানবালা আমার আসনসংখ্যা দেখে রাখল। বললো, বিমান ছাড়লে দেখা হবে।
মেয়েটি সামনের দিকে একটি কেবিনে কর্তব্যরত। বিমান ছাড়ার পরে সে এলো। দু দণ্ড কথা বলে আমার কিছু প্রয়োজন কি না জেনে ফিরে গেল। আমি যখন বললাম যে, তোমার কেবিনে আমার আসন কিংবা আমার কেবিনে তোমার ডিউটি পড়লে ভালো হতো, তখন সে হাসলো। বললো, বিমান নামার আগে আবার আসবে।
সত্যি সে আবার এলো। হংকংয়ে আমি কোথায় থাকবো জানতে চাইলো। বললাম, অ্যামবাসাডর হোটেলে। সে দলেবলে কোথায় থাকবে, তাও বললো। আমার হোটেল থেকে সেটা খুব দূরে নয়।
ক্ষণিকের অতিথির সঙ্গে তার এমন ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলাম। হংকংয়ে হোটেলে পৌঁছে একবার ভেবেছিলাম, তাকে একটা ফোন করি। তারপর রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টারের মতো মনে এই তত্ত্বের উদয় হলো, জীবনে এমন কত সাক্ষাৎ, এমন কত বিদায় আছে, ফোন করে ফল কী? পৃথিবীতে কে কার!
আগেরবারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার আগে থেকেই অ্যামবাসাডরে ঘর সংরক্ষণ করা হয়েছিল। সুতরাং দুদিন দুরাত হংকংয়ে আরামেই ছিলাম। সেখান থেকে ব্যাংকক। ব্যাংককে এবারে এয়ারলাইনসের অতিথি হয়ে এক রাত হোটেলে কাটিয়ে ঢাকায় ফেরা।
একদিনে বলার মতো কিছু ঘটেনি।
১৭.
ফেব্রুয়ারির শেষে পুরোনো পাণ্ডুলিপি দেখতে গেলাম কলকাতায়। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের প্রধান–সহায়তার হাত বাড়িয়েই রেখেছেন। বিভাগের সচিব ড. তুষারকান্তি মহাপাত্র আবার আমার বন্ধু অনিল সরকারের ঘনিষ্ঠ। তিনি কর্তব্যের অধিক করলেন। বাংলা বিভাগের পাণ্ডুলিপি দেখার সুব্যবস্থা তো করলেনই, উপরন্তু পরামর্শ দিলেন, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সুধাংশু তুঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। সুধাংশু তুঙ্গ ‘বাংলার বাইরে বাংলা গদ্যের চর্চা (ষোড়শ-অষ্টাদশ শতক)’ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন–সেটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। পরে আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করায় তিনি আমাকে কিছু মূল্যবান উপকরণ পাঠিয়েছিলেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে করতে বাংলা বিভাগের কোনো কোনো শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ হয়–ক্ষুদিরাম দাস, আশুতোষ দাস, উজ্জ্বলকুমার মজুমদার। আশুতোষ দাস একটু বেশি সময় ব্যয় করেন আমার জন্যে, একদিন বিকেলে নিয়ে যান কলেজ স্ট্রিটে তাঁর প্রকাশকের কাছে–সেখানে বসে সিঙ্গাড়া ও মিষ্টিসহযোগে চা খাওয়া হয়। এতটা যে করেন, সে আমি বাংলাদেশ থেকে গেছি বলে। তিনি পূর্ববঙ্গের লোক, এখানকার প্রতি তাঁর প্রাণের টান রয়ে গেছে। তিনি অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথোপযুক্ত মর্যাদা পাননি–তিনি পূর্ববঙ্গের মানুষ বলে। জিজ্ঞাসা করে যখন জানেন আমার পিতৃপুরুষের ভিটে পশ্চিমবঙ্গে, তখন একটু হতাশ হন। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে ‘নব চর্যাপদে’র অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি থেকে খানিক নকল করে নিই। সুকুমার সেনের বাড়িতে গিয়ে তাকে যখন সে-কথা জানাই, তিনি আমার নকল-করা পদগুলি পড়ে শোনাতে বলেন–তাঁর দৃষ্টিশক্তি তখন বেশ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। আমার মুখে শুনে। পদগুলি সম্পর্কে দু-একটি মন্তব্য করেন তিনি, তবে ঈষৎ ব্যঙ্গের সুরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ সম্পর্কে যা বলেন, তাতে বুঝি, বিভাগের প্রতি তিনি খুবই বিরক্ত। পুরোনো গদ্য নিয়ে আমি কাজ করছি জেনে খুশি হন তিনি, পরামর্শ দেন, আলোচনার সঙ্গে যেন বিশদ উদ্ধৃতি দিই।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেও যাই পাণ্ডুলিপি দেখতে। সেখানে বিশ্বনাথ দে বড়ো সহায়। বলেন, ‘আমাদের এখানে বিদ্যুৎ কখন থাকে, কখন থাকে না, তার ঠিক নেই। আপনি অনেকগুলো পাণ্ডুলিপি চাইবেন–কর্মীরা ওপর থেকে নামিয়ে এনে রাখবে–আপনি নিজের সুবিধেমতো পড়বেন। নইলে পাণ্ডুলিপির অপেক্ষায়ই আপনার অনেক সময় কেটে যাবে। সাহিত্য পরিষদৃগ্রন্থাগারে আলাপ হয় প্রশান্তকুমার পালের সঙ্গে তিনি রবিজীবনীর নতুন কোনো খণ্ডের উপকরণ আহরণ করছেন। কী নিষ্ঠার সঙ্গেই না রবীন্দ্রনাথের কবিতার বইয়ের পাঠের সঙ্গে পত্রিকায় প্রকাশিত পাঠ মিলিয়ে চলেছেন শব্দ ও যতিচিহ্ন ধরে ধরে! পরে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবনে পাণ্ডুলিপি যদি পাওয়া যায় তার সঙ্গে মেলাবেন। তাঁর সঙ্গে গল্প করতে মাঝে মাঝে চলে যাই রাস্তা পেরিয়ে অপরদিকের ফুটপাতে–সেখানকার চায়ের দোকানে মাটির ভাঁড়ে চা খাই আর তাঁর কাজের বিষয়ে নানা কথা শুনি।
বরুণ দের সৌজন্যে থাকি সেন্টার ফর দি স্টাডিজ অফ সোশাল সায়েন্সেসের অতিথি-ভবনে। রাত দশটায় সেটার দরজা বন্ধ হয়ে যায়, সুতরাং ফিরতে হয় তার আগেই। একদিন দেরি হয়ে গেল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হায়াৎ মামুদের পিএইচ ডি ডিগ্রিলাভ উপলক্ষে ইন্টারন্যাশনাল হস্টেলে তাঁর ঘরে পানাহারের আয়োজন হয়েছে–ঢাকার আলমগীর রহমান, চট্টগ্রামের ভূঁইয়া ইকবাল ও লায়লা জামান, যাদবপুরের নবনীতা দেবসেন, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, সুবীর রায়চৌধুরী, অমিয় দেব, শুদ্ধশীল বসু–এঁরা সবাই আছেন। অতিথি-ভবনের দোহাই দিয়ে আমি যতই উঠতে চাই, কেউ না কেউ আটকে দেন। শেষ পর্যন্ত আড্ডা শেষ হলো। নবনীতা, প্রণবেন্দু, অমিয়, শুদ্ধশীল ও আমি এক ট্যাকসিতে অতিথি-ভবনে এসে দেখলাম, যথারীতি দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। কলিং বেল বাজিয়ে কোনো লাভ হলো না। আমার অবস্থার জন্যে শুদ্ধশীল নিজেকেই অনেকটা দায়ী মনে করলো। সে অপরিসীম দক্ষতায় পাচিল টপকে ভেতরে গেল এবং সামনের দরজায় করাঘাত ও তারস্বরে ডাকাডাকি করতে লাগলো। ওপরতলার লোকজনের ঘুম ভেঙে গেল, তারা আলো জ্বালালেন, বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন কী হচ্ছে দেখতে, তারপর ভেতরে চলে গেলেন। আমি ধরেই নিলাম, পরদিন ওঁরা নালিশ করবেন। শেষ পর্যন্ত দরজা খুললো। শুদ্ধশীলের তম্বি শুনে যে দরজা খুলেছিল সে বললো, দশটায় দরজা বন্ধ করে দেওয়া নিয়ম। শুদ্ধশীল। খুবই অপমানিত বোধ করে জানতে চাইলো, কোনো ভদ্রলোক রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ফেরে? যাহোক, আমি ঘরে ঢুকতে পেলাম। ওরা চারজন ওই ট্যাকসি নিয়ে চলে গেল।
সবাইকে নামিয়ে শুদ্ধশীল শেষে বাড়ি ফিরবে, এমন ব্যবস্থা। বাড়ির কাছাকাছি যখন এসেছে, তখন ট্যাকসি-চালক শুদ্ধশীলের কাছে তার যা আছে তা দিয়ে দেওয়ার দাবি জানায়। ব্যাপারটা বুঝতে শুদ্ধশীল একটু সময় নেয়–তারই মধ্যে চালক তাকে সতর্ক করে দেয় তার কথা অমান্য করার পরিণাম সম্পর্কে। হৃতসর্বস্ব শুদ্ধশীল বাকি পথ পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে।
কলকাতায় আমার কাজ প্রায় শেষ। ফাঁকে ফাঁকে ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল ও এশিয়াটিক সোসাইটিতেও কাগজপত্র দেখে ফেলেছি। এখন ফেরার পালা। ফেরত আসার তারিখ বসাতে হবে টিকিটে, যেতে হবে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স অফিসে। এক বিকেলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কলেজ স্ট্রিট ও মহাত্মা গান্ধি রোডের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে ট্যাকসি খুঁজছি আর খালি দেখলে। তার পেছনে দৌড়াচ্ছি।
একটা খালি ট্যাকসি দেখে আমি তার বাঁ-দিকের দরজার হাতলে হাত দিয়েছি, তারই মধ্যে আরেকজন ডানদিকের দরজা খুলে উঠে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে আহ্বান করলো, ‘উঠে পড়ুন! অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ সামান্যই, আমাকে চিনে ডাকলেন কি
কে জানে! দ্বিতীয়বার তার আহ্বান শুনে উঠেই পড়লাম। ট্যাকসি চলতে থাকলো কলেজ স্ট্রিট ধরে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পায়ের কাছে খবরের কাগজে মোড়া কিছু একটা রাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমা বের হতেই সেটা ধরে মুখের কাছে নিয়ে তিনি বললেন, ‘ট্যাকসিতে খেতে-খেতে যাচ্ছি দেখলে ছেলেমেয়েরা কী মনে করবে, তাই একটু দেরি করলাম। এবারে চুমুক এবং প্রশ্ন, কোথায় যাবেন?’ বললাম, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইসে–আমাকে মোড়ে নামিয়ে দিলে চলবে।’ শক্তি বললেন, তা কী হয়? আমিও যাবো আপনার সঙ্গে। তারপর। বোতলটার দিকে ইঙ্গিত করে, এটা ততক্ষণে শেষ করে ফেলা দরকার।’ এরপর চুমুক এবং প্রশ্ন, ‘ওখানে কী কাজ?’ বললাম, ‘ফেরার দিনক্ষণ এনডোর্স করতে হবে টিকিটে।’ এ আর এমন কী’ বলে শক্তি যথাকৰ্তব্য করতে। থাকলেন। ট্যাকসি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে এসে থামলো। শক্তি বৃথা চেষ্টা করলেন ট্যাকসিটাকে দাঁড় করিয়ে রাখার। আমি বৃথা চেষ্টা করলাম ট্যাকসিভাড়া দেওয়ার।
আমি একতলায় টিকিট কাউন্টারে যেতাম। শক্তি আমাকে দোতলায় নিয়ে গেলেন পাবলিক রিলেশনস ম্যানেজার কল্যাণ মজুমদারের কাছে। বললেন, ‘ইনি বাংলাদেশের বিশিষ্ট অধ্যাপক। কফি খাওয়াও এবং যথাশীঘ্র এঁর কাজটি করে দাও।
কাজ হয়ে গেলে কল্যাণ মজুমদারকে ধন্যবাদ দিয়ে নিচে নামি। শক্তি জানতে চান, কোথায় যাবো। অতিথি-ভবনের ঠিকানা বলি। তিনি বলেন, ‘সেখানে পরে গেলে হবে। এখন আমার সঙ্গে চলুন। আর এই আজ্ঞে-আপনি ভালো লাগছে না। আমি তুমি বলব, তুমিও আমাকে তুমি বলবে।’
এবারে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে এক বন্ধ রেস্টুরেন্ট ও বারের সামনে। ট্যাকসি থেকে নামলাম। হাঁকডাক করে দরজা খোলানো হলো। নিচের তলায় এক টেবিল অধিকার করে শক্তি পানীয় আনতে হুকুম করলো আর বললো, ‘সঙ্গে কিছু দিস রে বাপু!’ বেয়ারার বললো, ‘সার, আজ ড্রাই ডে।’ শক্তি সখেদে বললো, বাবা, বাংলাদেশ থেকে আমার বন্ধু এসেছে, তাকে নিয়ে। এসেছি খাওয়াবো বলে, তোরা বন্ধুর সামনে আমাকে অপমান করবি!’ সে বললো, ‘সার, আমি কী করবো! ম্যানেজার সাহেবও নেই।’ শক্তি বললো, ‘টেলিফোনে লাগা ম্যানেজারকে।’ আমি বাধা দিতে চেষ্টা করি, তাতে কাজ হয় না। টেলিফোনে আবার তার কথা, বাংলাদেশ থেকে খুব সম্মানিত একজন অতিথি নিয়ে এসেছি–ওসব ড্রাই ফ্রাই বুঝি না–আমার মানসম্মান নেই বুঝি! এবার টেলিফোন গেল ওয়েটারের হাতে–’হ্যাঁ সার, হ্যাঁ সা’ শুনতে পেলাম। তার মুখে। তারপর দোতলায় প্রাইভেট অফিস’ লেখা এক ঘরে আমাদের বসিয়ে সে গেল রসদ আনতে। আমি শক্তিকে বলি, আমার জন্যে এটা খুব আর্লি। সে বলে, ‘ড্রিংকসের আবার আর্লি-লেট কী! এতক্ষণে সে আরাম করে। বসে। জোড়া আসনের একটায় হেলান দিয়ে বলে, ‘আল মাহমুদের কবিতা আমার খুব ভালো লাগে। শামসুর রাহমানের চেয়েও।
সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে বেরোনো গেল। ময়দানের দিকে কোনো একটা মেলা বসেছে। সেখানে তার যাওয়ার কথা। আমি বিদায় নিতে চাইলাম। সে বললো, ‘কেন এমন কচ্ছ? আমার সঙ্গ কি তোমার খুব খারাপ লাগছে? শশব্যস্তে বলি, না, না, তা নয়; তোমার এখানে কাজ আছে আর আমারও ফেরা দরকার।’ সে বললো, আচ্ছা, ওখানে হয়ে তোমাকে পৌঁছে আমি বাড়ি ফিরবো!’
মেলায় অসংখ্য ছেলেমেয়ে শক্তির সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল। এখানে। তার কোনো আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব ছিল না, কিন্তু অন্তত বিশ-পঁচিশজনকে সে এখানে আসতে বলেছিল, তা বোঝা গেল। সবাইকে সে আমার পরিচয় দেয় অতিরঞ্জিত করে, কিন্তু তাদের লক্ষ্য তো শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সৌজন্য করে যারা আমার সঙ্গে কথা বলে, তাদেরও মন পড়ে থাকে তার দিকে। ভালোই লাগে দেখতে-কবির জন্যে মানুষের এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। তারা শক্তির কবিতা আবৃত্তি করে, তার কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে চায়। শক্তি বলে, ‘আমি পদ্য লিখি–কবি হলো সুনীল। ওর কবিতা ভালো করে পড়লে তোমরা অনেক কিছু পাবে। মাঝে মাঝে তাগাদাও দিই শক্তিকে, কিন্তু খুব জোরের সঙ্গে নয়। সে বলে, এখান থেকে বেরিয়ে কোথাও একটু বসে তারপর ফেরা যাবে!’ এবারে আমি শঙ্কিত হই। বলি, তেমন মতলব থাকলে তোমাকে একাই যেতে হবে।’
মেলা থেকে বেরিয়ে ট্যাকসি নিই। শক্তি ততক্ষণে মন বদলে ফেলে। বলে, ‘আমাকে বাড়িতে নামিয়ে যদি তুমি ফেরো, খুব অসুবিধে হবে?’ আমি রাজি হই। শক্তি বলে, আমার বউটা খুব লক্ষ্মী। আমি বড়ো কষ্ট দিই তাকে। তারপর খানিক চুপ করে থাকে।
১৮.
একদিন গেলাম নবনীতা দেব সেনের হিন্দুস্থান পার্কের ভালো বাসা বাড়িতে। ডাক পড়ল তার মা রাধারানী দেবীর ঘরে। ওঁর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না–বিশাল খাটে শুয়ে ছিলেন। সেই খাটের এক প্রান্তে নবনীতা বসে, সেদিন সে একটু সেজেছে। অদূরে একটা চেয়ারে আসীন তারাপদ রায়। তার পাশের চেয়ারটিতে গিয়ে বসলাম। নবনীতা জিগ্যেস করলো, জানো তো আজ ভাইফোঁটা?’ বললাম, ‘তাই নাকি? সে বললো, ‘তোমাদের দুজনকেই আজ ফোঁটা দেবো।’
খানিক পরে তারাপদ আর আমি মেঝেতে বসলাম আসন গেড়ে। নবনীতা চন্দনের বাটি নিয়ে বসলো আমাদের মুখোমুখি। সে ছড়া কাটতে লাগলো, তার শেষটা অনেকটা এরকম : যমের দুয়ারে দিয়ে কাঁটা/ভগ্নি দেয় ভাইকে ফোঁটা’। উত্তরে বোনের কল্যাণকামনায় ভাইকেও কিছু বলতে হয়, কিন্তু তা আমার জানা নেই। তারাপদ বললো, আমি বলছি, তুমি আমার সঙ্গে বলতে থাকো।’ নকল করে পাশ করলাম। রাধারানী দেবী মৃদু মৃদু হাসতে থাকলেন। নবনীতা আমাদের কপালে ফোঁটা দিলো। ফোঁটা মেখে খেতে বসলাম। ভোজ কয় যাহারে।
আরেক সন্ধ্যায় নবনীতার বাড়িতে গিয়ে দেখি অমর্ত্য সেন বসে আছেন। নবনীতার মুখে ঝড়ের আভাস। ওদের বড়ো মেয়ে অন্তরাও রয়েছে সেখানে। ব্যাপারটা এরকম: অমর্ত্য কলকাতায় এসেছেন অল্প সময়ের জন্যে। ও-বাড়ি গেছেন মেয়েদের দেখতে। নবনীতা তাকে রাতে খেয়ে যেতে বলছে, কিন্তু সে অনুরোধ তিনি রাখতে পারছেন না, কেননা তার অন্যত্র খাওয়ার নিমন্ত্রণ রয়েছে। নবনীতার প্রশ্ন, সময়ের যদি এতই টানাটানি, তাহলে আর আসা কেন? এইরকম কথাবার্তার মধ্যে তৃতীয় পক্ষের বসে থাকাটা স্বস্তিকর নয়। সুতরাং এক ফাঁকে বললাম, আমি আসি এখন।’ নবনীতা ঝঝের সঙ্গে বলে উঠলো, ‘তোমারও নেমন্তন্ন আছে নাকি?’ বললাম, না, তা ঠিক নয়, তবে।’ নবনীতা হুকুম করলো, তবে বসে থাকো।’ অন্তরা নিঃশব্দে চোখ বড়ো করে আমাদের সবাইকে একবার দেখে নিলো। সেই মুহূর্তে তার ছোটো বোন টুম্পা ঘরে ঢুকে। কী গো আনিস মামা, কখন এলে?’ বলে জায়গামতো বসে পড়ল–তাতেই আবহাওয়াটা একটু লঘু হয়ে গেল।
অমর্ত্য সেনের সঙ্গে আমার সর্বশেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের লন্ডনের বাড়িতে। আমি তাকে সে-কথা মনে করিয়ে দিলাম। তিনি বললেন, তার বিলক্ষণ মনে আছে। বস্তুত অমর্ত্য লন্ডনে এলে তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে তাঁকে একবার যেতেই হতো। আমি লন্ডনে থাকলে তারাপদ আমাকেও আমন্ত্রণ জানাতেন। সেখানে অমর্ত্যকে কখনো একা, কখনো সস্ত্রীক, একবার তার স্ত্রী ও মায়ের সঙ্গে পেয়েছি। অমিতা সেনের কাছে আমি নবনীতার বন্ধু বলেই নিজেকে পরিচয় দিয়েছি, যদিও তারাপদ আমার পপাশাকি পরিচয় অনেক দিয়েছেন। অমিতা সেনকে এটাও বলেছিলাম যে আমি সত্যেন সেনের স্নেহধন্য। তা শুনে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। ঢাকার কথা বলতে তিনি ভালোবাসতেন। তাঁর স্বামী আশুতোষ সেন যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত সে-সময়ের স্মৃতি তাঁর চিত্তে অমলিন হয়ে ছিল। তার থেকেই কিছু কিছু আহরণ করে কথা বলতে থাকলেন।
কলকাতার সেই সন্ধেবেলায় অমর্ত্য শেষ পর্যন্ত অন্যত্র নিমন্ত্রণরক্ষা করতে চলে গেলেন। নবনীতা ঘোষণা করলো, সবাই মিলে বাইরে খেতে যাবে। মেয়েরা তৈরি হয়ে এলে নবনীতাই গাড়ি চালিয়ে আমাদের নিয়ে এলো হাজরার মোড়ে এক ঢাবায়। আমি এর আগে আর কখনো ঢাবায় খাইনি। অতএব নতুন একটা অভিজ্ঞতা হলো।
১৯.
এপ্রিলের গোড়ায় কলকাতা থেকে ফিরে এসে সে-মাসের মাঝামাঝি প্যারিস রওনা হলাম। ঢাকা ছাড়ার আগে লন্ডন থেকে লেখা হায়াৎ মামুদের চিঠি পেলাম। রোজীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করে আবদুল মোমেন বিয়ে করেছে। সালমান রুশদীর বোন সামিনকে। যদি সম্ভবপর হয়, প্যারিস যাওয়ার পথে আমি যেন লন্ডনে রোজীর সঙ্গে দেখা করে যাই। আমার টিকিটটা ছিল ঢাকা কলকাতা-বোম্বাই-প্যারিসের। সুতরাং প্যারিসে যাওয়ার পথে লন্ডনে থামা সম্ভবপর নয়। প্যারিসে পৌঁছে প্রথম সপ্তাহান্তেই কোচে করে লন্ডনে এলাম। একরাত থাকলাম বুলুর বাড়িতে। রোজীর বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে এবং একটা রেস্টুরেন্টে মোমেনের সঙ্গে দেখা করলাম। সামিনের সঙ্গে দেখা করিনি। ফলে, তিনি আমাকে তাঁর প্রতি বিরূপ ভাবলেন।
প্যারিসে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল আগেরবারের মতোই সিতে য়ুনিভার্সিতেয়ারের রেজিস রোবের গ্যারিকে। কিন্তু সবটা সময়ের জন্যে সেখানে জায়গা পাওয়া যায়নি। ফলে, ওই চত্বরেই অন্য এক মেজেতে আমাকে চলে যেতে হয়, থাকতে হয় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। যেদিন বাসস্থান পালটাবো, তার আগের দিন আনোয়ার আবদেল-মালেকের ফ্ল্যাটে গেছি। খানিক পরে আলজিয়ার্সে দেখা সেই মেয়েটি এলো আবদেল-মালেক যার নাম দিয়েছিলেন নেফারতিতি। মেয়েটি যখন আমার ঠিকানা চাইলো, বললাম, কালই জায়গা বদল করছি। নতুন জায়গার টেলিফোন নম্বরটা জানা হয়নি, পুরোনোটা সঙ্গে নেই। ব্যাপারটা সত্যি, কিন্তু মেয়েটির বোধহয় আমার কথা বিশ্বাস হয়নি। সে হয়তো ভাবলো, আমি তাকে এড়িয়ে যাচ্ছি। তাই আমি যখন বললাম, তোমার ফোন নম্বর দাও, নতুন জায়গায় গিয়ে তোমাকে ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর জানিয়ে দেবো, তখন সে আমাকে এড়িয়ে গেল। এই পরমাসুন্দরীর সঙ্গে যে আমার আর যোগাযোগ হলো না, সে-ক্ষতিটা আমারই।
এবারে হাসনাত জাহান আর সিতেতে ছিল না, ঘর ভাড়া করেছিল বাইরে। সুতরাং সিতেতে আমার অভিভাবকত্বের ভার সম্পূর্ণই পড়েছিল নাসিমা জামানের ওপরে। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার রওশানুজ্জামান প্যারিসে গিয়েছিলেন কোনো এক প্রশিক্ষণ-উপলক্ষে, কিছুদিন তাঁর সঙ্গ পাওয়া গিয়েছিল। হাসনাতের বাসায় জিওভানি-দম্পতির সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হতো, তারাও এক-আধবার সিতেতে এসে আমার সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে গেছে। অন্যদিকে আনোয়ার আবদেল-মালেক ও ক্রিস্টিন কলপা তো ছিলেনই, তবে সানিয়া ছিল না। ফ্রাঁস ভট্টাচার্যও ছিলেন। তাঁর সৌজন্যে ইনালকোতে এবারও কিছু বলতে হলো। দিলীপ ছিল, কিন্তু গতবারে তার যে-ফরাসি বান্ধবীকে দেখেছিলাম, যাকে নিয়ে সে একবার চট্টগ্রাম হয়ে এলো, তাকে দেখলাম না।
তখন প্যারিসে আমাদের রাষ্ট্রদূত কে এম শেহাবউদ্দীন। তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর উদার আতিথেয়তা উপভোগ করেছি। তবে ইনালকোর সঙ্গে আমাদের দূতাবাসের যোগাযোগ-স্থাপনের চেষ্টায় আমি সফল হইনি। ইনালকো তথা ফ্রাসের ধারণা, বিদ্যায়তনিক বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস উদাসীন। দূতাবাস তথা রাষ্ট্রদূতের ধারণা, বাংলাদেশের বিদ্বজ্জন দেখলে ইনালকোর মতো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা যেমন আগ্রহ দেখান, আসলে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের তেমন। আগ্রহ নেই। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেই তারা বেশি উৎসাহী, তাই সেদেশের দূতাবাসের সঙ্গে তাঁদের আদানপ্রদান হয়, আমাদের দূতাবাসের সঙ্গে হয় না। দূতাবাসের কথা যে অগ্রাহ্য করার মতো, তা নয়। তবে বিদেশের বিদ্যায়তনিক ও সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের দূতাবাসের সম্পর্ক যে খুব ক্ষীণ, তাও সত্য।
প্যারিসে থাকাটা সবদিক থেকে আনন্দদায়ক হয়েছিল আমার পক্ষে। কাজও সম্পন্ন হয়েছিল দ্রুতগতিতেই–কিছুটা আগেরবারের অভিজ্ঞতার ফলে। এবারে মার্কস ব্রাদার্সের কয়েকটা ছবি দেখার সুযোগ হয়। প্যারিসের মিউজিয়মগুলোর সঙ্গে পরিচয়ও আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি প্যারিস থেকে যাই লন্ডনে–এবারও কোচে। শফিউল্লাহ লন্ডনের বাইরে কোথাও গেছেন, আমি উঠলাম জ্যান ড্রাইডেনের বাসায়। ওর ছেলে-বন্ধু অ্যালান ততদিনে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে জ্যানের ফ্ল্যাটেই উঠেছে। তারা খুব শিগগিরই বিয়ে করতে যাচ্ছে–দিন-তারিখ ঠিক হয়ে গেছে। জ্যান তো খুব গোছালো মেয়ে। নতুন সংসার পাততে তার কী কী প্রয়োজন। হবে, তার একটা তালিকা যেখানে তার টেলিফোন থাকে, তার পাশেই টাঙিয়ে রেখেছে। বিয়েতে নিমন্ত্রিত বন্ধুরা সেই তালিকা-অনুযায়ী উপহার আনতে পারবে। তালিকা শুনে যে বলছে সে অমুকটা দেবে, সেই উপহারসামগ্রীর নামের পাশে উপহারদাতার নাম লিখে রাখছে জ্যান। এরপর কেউ জানতে চাইলে ওই বস্তুর নাম সে করবে না।
ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি হালে আঠারো শতকের চন্দননগরবাসী ফরাসি ব্যবসায়ী ও কুঠিয়াল ভেরলের পারিবারিক কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে। তার মধ্যে কিছু বাংলা কাগজপত্র আছে। তার একটা তালিকা করে দেওয়ার অনুরোধ এলো। সেই কাজে লেগে গেলাম। তখন কথা উঠলো, কিছু পুরোনো কাব্যের পাণ্ডুলিপি এবং রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তলিখিত গানের যে-সংগ্রহ লাইব্রেরিতে আছে, তাও তার সঙ্গে তালিকাভুক্ত করি না কেন! আমিও সাগ্রহে সে-কাজটা করলাম। একটি ছোটো তালিকাগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে গেল। হাকিম নড়ে যাওয়ায় অবশ্য সে-তালিকা আজো প্রকাশিত হতে পারেনি।
ফেরার পথে রোমে থেমে আসবো বলে স্থির করলাম। লন্ডনের ইতালীয় দূতাবাস থেকে ভিসা নিতে গিয়ে লাইন দিতে হলো ফুটপাতে–একটু ভিজেও গেলাম। সমবেত ভিসাপ্রার্থীগণ সুসভ্য ভাষায় দূতাবাসকে গালাগাল করতে থাকলো–কিন্তু তা দেয়াল ভেদ করে কর্তৃপক্ষের কর্ণগোচর হলো না। এয়ার ইন্ডিয়ার লন্ডন অফিসে যেতেই দেখা হয়ে গেল নূরুল কাদের ওরফে ঝিলুর সঙ্গে। সেও রোম হয়ে দেশে ফিরবে। রোমে পৌঁছোবে আগে, তবে রোম ছাড়বে আমার সঙ্গে একই ফ্লাইটে। রোমে যে-হোটেলে সে থাকবে, তার ঠিকানা দিলো। আগস্টের মাঝামাঝি আমি রোমে পৌঁছোলাম। পরদিন ঝিলু এবং তার ছেলের সঙ্গে সারাটা সময় কাটালাম রোমের দ্রষ্টব্য দেখে। তার পরদিন আমার জিনিসপত্র নিয়ে ওর হোটেলে। আরো কিছু ঘোরাঘুরি করে, লাঞ্চ খেয়ে ফিরতি পথে যাত্রা। ওর জিনিসপত্র এতই বেশি যে স্যুটকেসের ডালা লাগানো ভার। অগত্যা আমি একবার করে সুটকেসের ওপরে চেপে বসি আর ঝিলু স্যুটকেস বন্ধ করে। বিমানবন্দরে এসে বোঝা গেল, আমার জিনিসপত্রও নেহাৎ কম নয়। অতিরিক্ত মালের মাশুল দিতে হবে। কাউনটার যদিও এয়ার ইন্ডিয়ার, তার ব্যবস্থাপনা অল-ইতালিয়ার। তারা মার্কিন ডলার নেবে না, শুধু ইতালীয় লিরা নেবে। আমি দৌড়ে যাচ্ছিলাম মানি-এক্সচেঞ্জে। ঝিলু থামিয়ে দিয়ে পকেট থেকে এক মুঠো লিরা বের করে বললো, ‘সময় নেই টাকা ভাঙানোর।’ ঝিলুকে বোধহয় বাড়তি কিছু দিতে হয়নি–দুটো টিকিট তার বিজনেস ক্লাসের।
বোম্বাইতে যাত্রাবিরতি। এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনায় হোটেলে। সেখানে আমি ঝিলুকে জোর করে ডলার গছিয়ে দিলাম। ঝিলু কেনাকাটি করবে, আমাকেও সঙ্গে নিলো। হোটেলে ফিরে এসে একটা শাড়ির প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে বললো, এটা তোমার বউয়ের জন্য।
বিকেলে ঢাকার ফ্লাইট। বাংলাদেশ সরকারের এক প্রতিনিধিদল ফিরছেন। আফ্রিকার কোনো দেশ সফর করে–সম্ভবত কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনের শেষে। দলের সদস্যেরা আমার সহযাত্রী। ঝিলু তার কেবিন থেকে বেরিয়ে আমার খোঁজ নিতে এসে তাঁদেরও সাক্ষাৎ পেল। এয়ার হোস্টেসকে বললো, এদের সকলকে ড্রিংকস দাও আমার হয়ে–যে যা খেতে চায়। বিস্মিত এয়ার হোস্টেস পরে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, উনি কে? আর তোমরা এতজন পরস্পরকে চেনো কী করে?’ বললাম, বাংলাদেশ ছোটো জায়গা। লোকসংখ্যা যদিও অনেক, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সংখ্যা খুব বেশি নয়। আমাদের কালে একটাই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল–সুতরাং পরস্পর চেনাজানা থাকা অস্বাভাবিক নয়। দিলদরাজ যে-ব্যক্তি সবাইকে আপ্যায়ন করতে চাইলেন, তিনি এককালে সচিব ছিলেন, এখন বড়ো শিল্পপতি। সবাইকে না হলেও অধিকাংশকে চেনেন। আর তার হৃদয়টা খুব বড়ো।’
ঢাকায় নেমে ল্যান্ডিং কার্ডটাও ঠিকমতো পূরণ করলো না ঝিলু। নাম, পাসপোর্ট নম্বর লিখে আর সই করে ছেড়ে দিলো। ইমিগ্রেশন অফিসারকে বললো, এখন বাড়ি ফেরার জন্যে ব্যাকুল, এত লিখতে পারবো না, বাকিটা আপনি লিখে নেবেন। কাস্টমসের কর্মকর্তা জানতে চাইলেন, তার কাছে। বৈদেশিক মুদ্রা কত আছে। সে বললো, আছে দু-এক হাজার ডলার–এখন গুনতে পারবো না, বাড়ি যাবো। কর্মকর্তা এবারে তার স্যুটকেস খুলতে চাইলো। সে বললো, ‘এই ড. আনিসুজ্জামানকে স্যুটকেসের ওপর বসিয়ে তারপর তালা লাগিয়েছি। এখন খুললে আর বন্ধ করতে পারবো না। এখানে আর ঝামেলা করবেন না–তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে চাই।’
সত্যি আর কেউ ঝামেলা করলেন না।
২০.
চট্টগ্রামে ফিরে আসার পরের একটি স্মরণীয় ঘটনা শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের নামে স্থানীয় বিমানঘাঁটির নামকরণ। সার্জেন্ট জহুরুল হককে আমি সামান্য চিনতাম, তাঁর অগ্রজ আমিনুল হকের সঙ্গেই পরিচয় ছিল বেশি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকাকালে ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে নিরাপত্তা রক্ষীদের গুলিতে তিনি নিহত হন। তাঁর প্রতি ব্যাপক সমর্থনজ্ঞাপন এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ছাত্রেরা তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল রাখে। বিমানবাহিনী এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দেশের বিভিন্ন বিমানঘাঁটি পরিচিত হবে মুক্তিযুদ্ধের এবং স্বায়ত্তশাসন-আন্দোলনের শহীদদের নামে। যশোরের বিমানঘাঁটির নাম দেওয়া হচ্ছে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বিমানঘাঁটি, চট্টগ্রামেরটা শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক বিমানঘাঁটি।
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক বিমানঘাঁটির নামকরণ-অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় দু-এক কথা বলার জন্যে। ঘাঁটির অধিনায়ক স্বাগত ভাষণ জানালেন, অ্যাডভোকেট আমিনুল হক ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করলেন, আমি সামান্য কিছু বললাম, তারপর বিমানবাহিনী-প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ ভাষণ দিলেন। অতি সংক্ষিপ্ত তবে ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের শেষে চা-পান। আমিনুল হক ঢাকা থেকে এসেছিলেন সপরিবারে। তার স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রী ছিলেন। বহুদিন পর তাঁর সঙ্গে দেখা হলো।
এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি খুব সম্মানিত বোধ করেছিলাম। এয়ার ভাইস-মার্শাল সুলতান মাহমুদকে তাই সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানালাম। আলাপের এক পর্যায়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কথা উঠলো। দেখলাম, আমাদের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। তিনি ক্যাডেট কলেজের মতো বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবশ্যকতায় দৃঢ়বিশ্বাসী, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী, উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে উদৃবিগ্ন, তবে শিক্ষাবিস্তারের বিষয়ে খানিকটা উদাসীন। অনেকক্ষণ ধরে আমরা নিষ্ফল তর্ক করলাম।
সুলতান মাহমুদ একজন মুক্তিযোদ্ধা। তবে সেই মুহূর্তে তাঁকে এলিট সমাজের বিশেষ প্রতিনিধি বলে মনে হয়েছিল।
২১.
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বড়োরকম বিপর্যয় ঘটে গেল।
বিষয়টার শুরু পরীক্ষা পেছানোর দাবি নিয়ে–তা এমন কিছু নতুন নয়। ছাত্রেরা দাবি নিয়ে উপাচার্যের কাছে উপস্থিত হয়, তিনি অনুষদের ডিন, আবাসিক হলের প্রোভোস্ট এবং বিভাগীয় চেয়ারম্যানদের তাঁর দপ্তরে ডাকেন, কথাবার্তা হয়, কখনো তাৎক্ষণিক মীমাংসা হয়, কখনো আন্দোলন দীর্ঘায়িত হয়। এবারেও সূচনাটা তেমনই হলো। আমরা উপাচার্যের দপ্তরে হাজির হলাম, আলোচনা চলতে চলতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাবৃদ্ধি পেতে থাকলো। উপাচার্যের সচিব একসময়ে এসে আমাদের গাড়িগুলো সরিয়ে রাখার পরামর্শ দিলেন। আমি তার হাতে গাড়ির চাবি দিয়ে বললাম, কাউকে দিয়ে উত্তর ক্যাম্পাসে কারো বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করে রাখতে। একটু পরই ছাত্রছাত্রীরা ঘোষণা করলো তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা আমাদের ঘেরাও করে রাখবে। আমরা দাবি মানতে রাজি নই–উপাচার্যের অফিসকক্ষেই রাত্রিযাপনের কোনো বিকল্প দেখা গেল না।
এই সময়েই আবিষ্কার করা গেল যে, এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলা বিভাগেরই এক ছাত্র এবং এক ছাত্রী। ছাত্রটি আমার এক ছাত্র ও সহকর্মীর (সে তখন দেশে ছিল না) অনুজ, আমার বিশেষ স্নেহভাজন, আবাসিক হলে জায়গা পাওয়ার আগে আমারই বাড়িতে বাস করেছিল। ছাত্রীটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তার ভ্রাতুস্পুত্রী, আমার নিকটতম প্রতিবেশিনী, সংগীতে পারদর্শিনী, আমার বাড়িতে তার অবাধ যাতায়াত, বাড়ির সবাই তাকে ভালোবাসে। এরা দুজনেই আমার এত ঘনিষ্ঠ যে, যদি কেউ মনে করেন যে, উপাচার্যকে বিব্রত করার জন্যে আন্দোলনে আমি এদের প্রবৃত্তি দিয়েছি, তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না।
আমরা সারারাত উপাচার্যের ঘরে আটকে থাকলাম এবং আমাদেরও রাগের মাত্রা বাড়তে থাকলো। ভোর হতে হতে আমরা সিদ্ধান্ত করলাম যে, ঘেরাও ভেঙেই আমরা বেরিয়ে পড়বো। তার মানে সিঁড়িতে যেসব ছেলেমেয়ে সারারাত ধরে শুয়ে-বসে আছে, আক্ষরিক অর্থে তাদের গায়ের ওপর দিয়ে আমরা নেমে যাবো। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না, কিন্তু সবাই একমত হলেন যে, ঘেরাওকারীরা সীমা ছাড়িয়ে গেছে, অতএব আমাদেরও কঠোর হতে হবে।
হঠাৎ দরজা খুলে ছেলেমেয়েদের একরকম পাড়িয়েই আমরা একযোগে নেমে এলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় তারাও বিমূঢ়, কেউ কেউ আমাদের পা জাপটে ধরতে চেষ্টা করলো, আমরা সজোরে তাদের হাত সরিয়ে দিলাম। আমি বেশ আগের দিকেই ছিলাম। উপাচার্যের দপ্তর থেকে বেরিয়ে আমি চললাম উত্তর ক্যাম্পাসে। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরবো। ক্যাম্পাসের পশ্চিম দিক দিয়ে অনায়াসে চলে যেতে পারতাম নিরাপদে। কিন্তু গাড়িতে উঠে মনে হলো, একা না গিয়ে বরঞ্চ আরো কয়েকজন সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে যাই। গাড়ি নিয়ে উপাচার্যের অফিসের দিকে চললাম, দু-একজন সহকর্মীকে বোধহয় গাড়িতেও তুললাম, তারপরই পড়ে গেলাম বিক্ষুব্ধ ছাত্রদলের সামনে।
তারপর যা ঘটলো, তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ও অভাবিত। ছাত্রদের দেখে আমি গাড়ি থামালাম এবং নেমে আসার চেষ্টা করলাম। তখনই লাঠির বাড়ি দিয়ে গাড়ির সামনের ও পেছনের উইন্ডস্ক্রিন ভাঙা শুরু হলো। ছাত্রেরা আমার সঙ্গে অসংগত আচরণ করবে না বলে আমার অহংকারও চূর্ণ হলো। আমি একেবারেই বিমূঢ়। ছাত্রেরা কাঁচ ভেঙে আনন্দিতচিত্তে প্রস্থান করলো। গণিত বিভাগের অধ্যাপক ফজলী হোসেনের চুলের মধ্যে ভাঙা কাঁচ ঢুকে মাথার চামড়া খানিক কেটে গেল। ততক্ষণে পেছনে-পড়া সহকর্মীরা কাছে চলে এসেছেন। আমি কেন অকুস্থলে ফিরে গেলাম, সেজন্যে তাঁরা তিরস্কার করতে থাকলেন। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছোটো নূরুল ইসলাম সামনের সিটের কাঁচ সরিয়ে গাড়িতে বসলেন। বাড়িতে ফিরলাম গাড়ি নিয়ে এবং গাড়ি গ্যারাজে রেখে নূরুল ইসলাম ও আমি আবার রওনা হলাম অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে যোগ দিতে। তখনই টের পেলাম, আমার পায়ের আঙুলের কাছে কিছুটা কেটে গেছে এবং সামান্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
আটকাবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়া সহকর্মীরা তাদের দিকে আমাকে যেতে দেখে তিরস্কারই করলেন এবং যার যার বাড়ি না গিয়ে সবাই আমার বাড়িতেই এলেন। যারা আমাদের সঙ্গে রাতে ছিলেন না, তাঁরাও অনেকে এসে যোগ দিলেন। পাড়ার মহিলারাও এলেন সহানুভূতি জানাতে। ডাক্তার এসে আমার শুশ্রূষা করলেন। উপাচার্য একবার নিজের বাড়ি ঘুরে সরাসরি চলে এলেন এবং করণীয় সম্পর্কে সকলের পরামর্শ চাইলেন। খবর পাওয়া গেল যে, নেতৃত্বদানকারী আমার ছাত্র ও ছাত্রী ক্যাম্পাস ছেড়ে গেছে এবং খুব সম্ভব চট্টগ্রাম ত্যাগ করেছে।
পরদিন থেকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেল আমার কাছে। ওই ছাত্র এবং ছাত্রীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ সম্পর্কে তাঁরা জানতে চাইলেন, তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে এই আন্দোলন সম্পর্কে আমি আগে কিছু আঁচ করতে পেরেছিলাম কি না, তাও ছিল তাঁদের জিজ্ঞাস্য। যারা গাড়ির কাঁচ ভাঙলো, তাদের কাউকে আমি শনাক্ত করতে পেরেছি কি না, তাও ছিল তাদের জানবার বিষয়। অনেক প্রশ্নে আমি যথেষ্ট বিব্রত হয়েছিলাম।
তবে ভাগ্য ভালো, সহকর্মীরা আমাকে ভুল বোঝেন নি। উপাচার্য স্বয়ং যথেষ্ট সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে আমার গাড়ি মেরামত করে দেওয়া হয়। ওই ছাত্র ও ছাত্রীকে বহিষ্কৃত করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারা আর ক্যাম্পাসে ফিরে আসেনি। তবে ছাত্রের বাবা মনে করেছিলেন, আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণেই–অর্থাৎ শিক্ষকদের দলাদলির ফলস্বরূপ–হয়তো তার ছেলেকে এমন শাস্তি পেতে হয়েছিল।
২২.
জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত সেমিনারের যে-রিপোর্টটি পরের বছরে প্যারিসে বসে তৈরি করেছিলাম, ১৯৮৩ সালের শেষদিকে তা ম্যাকমিলান প্রেস থেকে প্রকাশিত হলো লন্ডনে। প্রকাশক আমাকে যে-কপি পাঠিয়েছিল, তা পেতে সময় নিয়েছিল। শফিউল্লাহ্ লন্ডনে বইটি দেখে এক কপি কিনে এনে চট্টগ্রামে আমাকে উপহার দেন। কী যে আনন্দ হয়েছিল, তা অল্পকথায় প্রকাশ করা যায় না।
বইটির নাম Culture and Thought। দেখলাম, আনোয়ার আবদেল মালেক দুটি পরিবর্তন করেছেন আমার পাণ্ডুলিপিতে। সম্পাদক হিসেবে আমার নামটা আগে দিয়ে নিজের নাম পরে দিয়েছেন। আর অবতারণা অংশে এই গবেষণা-প্রকল্প সম্পর্কে প্রকল্প-পরিচালক আনোয়ার আবদেল-মালেকের ভাষণের একটা খণ্ডিতাংশ আমি উদ্ধৃত করেছিলাম, সেখানে তিনি নিজের লেখা সবটাই তুলে দিয়েছেন। আমাদের এই বইটি ছিল Transformation of the World’ সিরিজের–প্রকল্পের নামই ছিল তাই–তৃতীয় খণ্ড। আনোয়ার ছিলেন সিরিজের জেনারেল এডিটর বা সিরিজ-সম্পাদক। প্রথম খণ্ড Science and Technology বেরিয়েছিল আগের বছরে। দ্বিতীয় খণ্ড Economy and Society প্রকাশ পায় ১৯৮৪ সালে। পরিকল্পিত চতুর্থ ও পঞ্চম খণ্ডের নাম ছিল যথাক্রমে Religion and Philosophy 47° The Making of a New International order: A Prospective-এগুলো কবে বেরিয়েছিল, আমার ঠিক জানা নেই। সবকটি খণ্ডের আরবি অনুবাদ কায়রো থেকে এবং স্প্যানিশ অনুবাদ মেক্সিকো থেকে প্রকাশিত হওয়ার কথা–শেষ পর্যন্ত তা হয়েছিল কি না, বলতে পারি না।
ইংরেজি প্রত্যেকটি খণ্ডের জ্যাকেটেই ছিল জার্মান মানচিত্রকর আরুনো পিটার্সের অভিক্ষেপণে পৃথিবীর নতুন মানচিত্র–তবে কোনো অজ্ঞাত কারণে বইতে তাঁর স্বীকৃতি ছিল না। আর্ননা পিটার্স দাবি করেছিলেন যে, মারূকেটরের অভিক্ষেপণ ইউরোপকেন্দ্রিক, দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলি তাতে যথাযথ অনুপাতে রূপ পায়নি। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ তাদের প্রকৃত আয়তনের চেয়ে মারূকেটরের মানচিত্রে ছোটো মনে হয়, তুলনায় ইউরোপের বহু দেশকে বড়ো মনে হয় বটে, কিন্তু আসলে তারা তেমন নয়। এই ত্রুটি সংশোধন করে পিটার্স নতুন অভিক্ষেপণ-অনুযায়ী তাঁর মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। ভূ-পৃষ্ঠের দেশগুলো তাতে লম্বাটে দেখায়, তবে সেটা আসল নয়, আসল কথা তাদের আয়তনের যথার্থ প্রতিফলন।
২৩.
বাংলা সাহিত্যের মানসম্পন্ন ইতিহাসগুলোয় যেসব উপকরণ অবহেলিত হয়েছে কিংবা ওইসব বই প্রকাশের পরে যেসব উপাদান আবিষ্কৃত হয়েছে, সেসব বিষয়কে যথাযথ স্থান দিয়ে বাংলা সাহিত্যের একটি নতুন ইতিহাস রচনার চিন্তা অনেকদিন ধরে আমাদের অঞ্চলে দেখা দিয়েছিল। ১৯৬৮ সালে অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই আমাকে এমন একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে বলেন। বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্ন পরিচ্ছেদ লিখবেন এবং একটি সম্পাদকমণ্ডলী তা সম্পাদনা করে গ্রন্থের আকার দেবেন, এই ধারণার ভিত্তিতে আমি চার খণ্ডে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার পরিকল্পনা প্রণয়ন করি। হাই সাহেব প্রস্তাবটি পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করলে মন্ত্রণালয় অনুকূল সাড়া দেয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে এক লক্ষ টাকার অনুদান মনজুর করে। মুহম্মদ আবদুল হাইকে সভাপতি, মুনীর চৌধুরী ও আহমদ শরীফকে সদস্য এবং আমাকে সদস্য-সচিব করে সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়। ১৯৬৯ সালে হাই সাহেবের মৃত্যুর এবং আমার চট্টগ্রামে চলে যাওয়ার পরে এ-বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদ আবার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য বিষয়ে একটি এবং আধুনিক বাংলা সাহিত্য বিষয়ে অপর একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটি দুটি প্রাথমিক পরিকল্পনার কাজে কিছুদূর অগ্রসর হলেও খুব বেশিদূর যেতে পারেনি। ১৯৮৩ সালে আমি বিদেশ থেকে ফিরে এলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মনজুরে মওলা আমাকে এই দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করেন।
আমাকে প্রধান সম্পাদক করে এবং আহমদ শরীফ, কাজী দীন মুহম্মদ, মমতাজুর রহমান তরফদার ও মুস্তাফা নূরউল ইসলামকে সদস্য করে সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়। আমার পরিকল্পনা-অনুযায়ী ইতিহাসটি বিন্যস্ত হবে পাঁচ খণ্ডে : প্রথম খণ্ডে থাকবে চোদ্দ শতক পর্যন্ত, দ্বিতীয় খণ্ডে পনেরো ও ষোলো শতকের, তৃতীয় খণ্ডে সতেরো ও আঠারো শতকের, চতুর্থ খণ্ডে উনিশ শতকের এবং পঞ্চম খণ্ডে বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের পরিচয়। প্রতি খণ্ডের থাকবে দুটি ভাগ–একভাগে ঐতিহাসিক পটভূমি অর্থাৎ বর্ণিত কালের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের আলোচনা থাকবে। দ্বিতীয়ভাগে থাকবে সে-সময়কার বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারার পরিচয়। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ এক বা একাধিক অধ্যায় লিখবেন। সম্পাদকমণ্ডলী তাতে প্রয়োজনীয় সংশোধন-সংযোজন করবেন। আমার প্রস্তাবিত প্রথম খণ্ডের সূচি সম্পাদকমণ্ডলী অনুমোদন করলে লেখকদের রচনা আহ্বান করে পত্র দিলাম।
এরই মধ্যে মনজুরে মওলা একদিন আমাকে চট্টগ্রামে ফোন করে জানালেন, বাংলা একাডেমী বক্তৃতামালা প্রবর্তিত হতে যাচ্ছে এবং তিনি চান খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমি যেন প্রথম বক্তৃতাটা দিই। বক্তৃতার বিষয় তিনি আমার ওপরেই ছেড়ে দিলেন। কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে আমি সম্মত হয়ে গেলাম।
‘পুরোনো বাংলা গদ্য’ শিরোনামে লিখিত বক্তৃতা দিলাম ১৯৮৪ সালের ১৬, ১৭ ও ১৮ জানুয়ারিতে। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ববর্তী বাংলা গদ্য সম্পর্কে আমার সংগৃহীত মালমশলা এবং নিজস্ব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বক্তব্য উপস্থাপন করলাম। বক্তৃতার তিনদিনই অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক উপস্থিত ছিলেন। তাঁর হাবভাবে মনে হলো, নিতান্ত মন্দ হয়নি। কবীর চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে আমার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। আমার কাছে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন কথাশিল্পী শওকত আলী, তাতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসেরও খানিকটা সায় ছিল।
আমাকে অবাক করে দিয়ে মনজুরে মওলা সঙ্গে সঙ্গেই বক্তৃতাটা ছাপতে অগ্রসর হলেন। তখন ওবায়দুল ইসলাম ছিল বাংলা একাডেমী প্রেসের দায়িত্বে। বইটা বের করায় তার উৎসাহ কারো থেকে কম ছিল না। শিল্পীকে প্রচ্ছদ আঁকতে দিলে দেরি হয়ে যাবে ভেবে সে নিজেই প্রচ্ছদ-পরিকল্পনা করলো, আমার তা ভালো লাগল। সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ প্রুফ দেখে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল। তবু চূড়ান্ত প্রুফ দিয়ে আবদুল হান্নান ঠাকুরকে চট্টগ্রামে আমার কাছে। পাঠালেন মনজুরে মওলা। সে একরাত আমার বাড়িতে থেকে আমাকে দিয়ে প্রুফ সংশোধন করিয়ে ঢাকা ফিরে গেল। অভাবিত ব্যাপার। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পুরোনো বাংলা গদ্য বেরিয়ে গেল।
গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সুধাংশু তুঙ্গ পুরোনো বাংলা গদ্যের কিছু নিদর্শন। আমাকে দিয়েছিলেন-আমার বইতে তার যথাযথ স্বীকৃতি ছিল। তাকে এক কপি বই পাঠালাম। তিনি একাধারে অভিভূত ও বিস্মিত। আমাকে লিখলেন, জানুয়ারি মাসের বক্তৃতা ফেব্রুয়ারিতে বই হয়ে বের হয়, এমন বোধহয় কেবল। বাংলাদেশেই সম্ভবপর। তিনি কবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছেন–তা পড়ে রয়েছে (বইটি বোধহয় ১৯৮৫ সালে প্রকাশ পায়)। বাস্তবিক, পুরোনো বাংলা গদ্য বইটি আমাকে দিয়ে লেখানো এবং অত দ্রুত প্রকাশ করার কৃতিত্ব বা দায়িত্ব মূলত মনজুরে মওলার।
অনেকদিন পরে মনজুরে মওলা আবার আমাকে ফোন করেছিলেন চট্টগ্রামে। সরকার আমাকে একুশে পদক দিতে চাইছে, আমি তা গ্রহণ করবো কি না জানতে চান। তাঁর অনুরোধ, আমার উত্তর যেন হাঁ-সূচক হয়। আমি একদিন সময় নিলাম। একুশে পদক রাষ্ট্রীয় সম্মান–তা পেলে আমি সম্মানিত হবো। কিন্তু যে-সরকার সেটি দিতে যাচ্ছেন, সে-সরকারের ঘোরতর বিরোধী আমি। রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্যের কথা বলা হয় বটে, কিন্তু আমাদের মতো দেশে সে-পার্থক্য নিতান্ত ক্ষীণ। তারপরও, রাষ্ট্রীয় সম্মান যে-সরকারই দেয়, আমি নেবো, এমন একটা ভাবা যেতে পারে হয়তো।
পরের দিন মনজুরে মওলা যখন ফোন করলেন, তখন সম্মতি জানালাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমাকে একুশে পদক দেওয়ার ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী আবদুল মজিদ খানের উদযোগ কার্যকর ছিল। আমার সঙ্গে একুশে পদক আরো পেয়েছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী ও শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। গাফ্ফার চৌধুরী সরকারের বিরুদ্ধে যথেষ্ট লিখছেন তখন। শুনেছি, মজিদ খান। বলেছিলেন রাষ্ট্রপতি এরশাদকে : যার গান গেয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির সকাল হয়, তাঁকে একুশে পদক না দিতে পারা লজ্জার বিষয়।
একুশে পদকের ঘোষণার পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে আমার সহকর্মী ও ছাত্রেরা আমাকে সংবর্ধনা জানিয়ে একটি সুন্দর অনুষ্ঠান করেছিল।
২৪.
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট উপাচার্য-নিয়োগের জন্য তিনজনের নামের একটি প্যানেল তৈরি করবে। একপক্ষ থেকে মনোনীত হলেন ইংরেজির মোহাম্মদ আলী, রসায়নের এ কে এম শামসুদ্দীন আহমদ ও ইতিহাসের আলমগীর মোহম্মদ সিরাজউদ্দীন। আমরা দলে ভারি নই। তাই স্থির হলো, শুধু আমিই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো এ-পক্ষ থেকে। কেউ কেউ প্রস্তাব করেছিলেন, বর্তমান উপাচার্য আবদুল আজিজ খানকে আমার সঙ্গে নিতে। উপাচার্য নিজেও তা চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমাদের মতের মিল খুব সামান্যই। সেক্ষেত্রে • একপক্ষভুক্ত হওয়া আমাদের কারো জন্যেই ঠিক হবে না। উপাচার্যও একাই নামলেন প্রতিযোগিতায়।
প্রথামাফিক সিনেট-সদস্যদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা করতে হলো। ব্যাপারটা আনন্দজনক নয়। ভোট চাইতে না গেলে যিনি স্বতই সমাদর করতেন, তিনি এখন উদাসীনতা দেখালেন। কেউ জানিয়ে দিলেন, অন্য প্রার্থীরাও তাঁর কাছে এসেছিলেন, এ-অবস্থায় তিনি বিপন্ন বোধ করছেন। কেউ বললেন, মুখ ফুটে কিছু বলার দরকার নেই, তিনি মোটের উপর ওয়াকিবহাল এবং যোগ্যকে বঞ্চিত করবেন না। সহকর্মীদের অনেকেই আমার জন্যে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছিলেন আন্তরিকভাবে।
নির্বাচনের ফল প্রকাশ পেলে দেখা গেল, মোহাম্মদ আলী সর্বাধিক ভোট পেয়েছেন, তারপর আমি, তারপর আলমগীর সিরাজউদ্দীন।
প্যানেলে যে-তিনজনের নাম থাকলো, এখন চান্সেলর তার একজনকে উপাচার্য নিয়োগ করবেন। তদৃবির শুরু হলো ক্ষমতার কেন্দ্রে। মন্ত্রী জেনারেল মাহমুদুল হাসানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় রেজাউল হকের সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের হামিদা বানুর পারিবারিক সৌহার্দ্য। সেই সূত্রে হামিদা জেনারেলের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করলেন। আমি ঢাকায় এলাম।
জেনারেল বললেন, ‘প্যানেলের যে-কাউকে প্রেসিডেন্ট ভাইস-চান্সেলর নিযুক্ত করতে পারেন। তবে যাঁকে করবেন, তাঁর কাছে তাঁর কিছু প্রত্যাশা থাকবে।
জানতে চাইলাম, ভাইস-চান্সেলরের কাছে চান্সেলরের আবার কী প্রত্যাশা?’
মাহমুদুল হাসান বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট রাজনীতি করেন, তার ছাত্র-সংগঠন আছে।
কথাটা বাড়তে না দিয়ে বললাম, ছাত্রদের মধ্যে নিরপেক্ষ থাকতে না পারলে কোনো ভাইস-চ্যান্সেলর বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে পারবেন না।’
জেনারেল বললেন, তার মানে আপনি আমাদের সাহায্য করবেন না?
বললাম, আমি মনে করি, ছাত্র-রাজনীতিতে ভাইস-চ্যান্সেলরকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে।’
এরপর চা-মিষ্টি খেয়ে বিদায়গ্রহণ।
অর্থনীতি বিভাগের মাহবুবউল্লাহ আমার পক্ষে চেষ্টা করতে অনুরোধ করেছিলেন বিচিত্রা-সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীকে। মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও শাহাদাত একসঙ্গে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি এরশাদের কাছে।
পরে শাহাদাত আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, ‘আনিস ভাই, এরশাদ আপনার ওপর এত খ্যাপা কেন?’
বলেছিলাম, ‘নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।’
আমি যখন এ-ব্যাপারে ঢাকায়, তখন রাজ্জাক সাহেব আমাকে বলেছিলেন, ভাইস-চ্যান্সেলর হয়ে আমি কী করতে চাই, তা যেন একটা কাগজে লিখে ফেলি।
আমি পরিহাস করে বললাম, আমি যদি ভাইস-চান্সেলর হইতাম শিরোনামে রচনা?
সার বললেন, আপনি যদি অ্যাকাডেমিক কাজকর্ম করতে চান, তাইলে কী করবেন, তার একটা লিস্টি করা ভালো। যদি ফিজিকাল ডেভেলপমেন্ট করবার ইচ্ছা করেন, তয় সেক্ষেত্রে কী করবেন, তার একটা হিসাব করা ভালো। তা না হইলে রোজকার কাজের চাপে কিছুই করতে পারবেন না।
তখন মনে হয়েছিল, ব্যাপারটা গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলের মতো। এখন। বুঝি, ওটা খুবই দরকারি বিষয়।
অল্প কয়েকদিনের মধ্যে অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীকে উপাচার্য নিয়োগ করলেন চান্সেলর।
২৫.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যাপকপদ থেকে নীলিমা ইব্রাহিম ও আহমদ শরীফ অবসর নিয়েছিলেন ১৯৮১ সালের ৩০ জুন। তারপর নীলিমা ইব্রাহিম এক বৎসরের জন্যে এবং আহমদ শরীফ দু বছরের জন্যে পুনর্নিয়োগ পেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী তাঁদের পুনর্নিয়োগের কাল আরো বাড়ানো যেতো–সর্বমোট পাঁচ বছর–কিন্তু কারো ক্ষেত্রেই তা আর হয়নি। তার জন্যে কিছুটা দায়ী ছিল বিভাগের অন্তর্কলহ। ফলে নীলিমা ইব্রাহিম ১৯৮২ সালের ৩০ জুন এবং আহমদ শরীফ ১৯৮৩ সালের ৩০ জুন চূড়ান্ত অবসরে চলে যান। এর কিছুকাল পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল আজিজ খান আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, আহমদ শরীফকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা যায় কি না। আবদুল আজিজ খান ব্যক্তিগতভাবে আহমদ শরীফের অনুরাগী এবং তাঁর বিদ্যাবত্তায় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কাজী নজরুল ইসলামের নামে অধ্যাপকের একটি পদ সৃষ্টি করেছিলেন। সেটি উন্মুক্ত ছিল কেবল অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের জন্যে। অধ্যাপক আবুল ফজল ও অধ্যাপক আবদুল করিমের আগ্রহে একবার এই পদে ড. মুহম্মদ এনামুল হককে নিয়োগদানের প্রস্তাব আমি করেছিলাম। তখন ড. হক নিজেও এই পদে যোগ দিতে উৎসাহী ছিলেন। আমাদের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে হতে এনামুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অধ্যাপকপদ লাভ করেন। সেটি ছেড়ে চট্টগ্রামে আসতে তাঁর আর ইচ্ছে হয়নি। এসব কথা আগে লিখেছি।
কাজী নজরুল ইসলাম অধ্যাপকের পদটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে খালিই পড়ে ছিল। উপাচার্যের ইঙ্গিত পেয়ে আমি যখন এর পরের বার ঢাকায় আসি, তখন আহমদ শরীফের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়ি গিয়ে তাঁকে ওই পদগ্রহণের মৌখিক আমন্ত্রণ জানাই। হেনা আপাকে (সালেহা শরীফ) বলি, দেখেন, আপনি আর্মানিটোলার বাড়ি ছেড়ে নীলক্ষেতে আসতে যেমন কান্নাকাটি করেছিলেন, ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম যেতে যেন তেমন কান্নাকাটি করবেন না। হাজার হোক, চট্টগ্রাম আপনার শ্বশুরবাড়ি। কতদিন আগের তাঁর সেই প্রবল কান্নার কথা মনে রেখেছি দেখে হেনা আপা খুশি হলেন, লজ্জাও পেলেন। মুখে বললেন, ‘দ্যাখো, তোমার সার রাজি হন কি না। উনি যদি যান, তখন দেখা যাবে ছেলেদের ফেলে আমি যেতে পারি কি না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ওই পদে তাঁর নিয়োগের প্রস্তাব করার অনুমতি আহমদ শরীফ আমাকে দিলেন।
এ-প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। আহমদ শরীফ নিয়োগপত্র পেলেন। কদিন দেরি করে তিনি কর্মে যোগ দিতে এলেন। আমাকে বললেন, ‘শোনো। আমি ভেবে দেখেছি, ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে এসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি ঢাকায় বসে নজরুল সম্পর্কে গবেষণা করবো, চট্টগ্রামে এসে তিন মাস পরপর একটি করে বক্তৃতা দিয়ে যাবো। তোমাদের। নিয়োগপত্রেও উল্লেখ নেই যে, আমাকে চট্টগ্রামেই থাকতে হবে।’
উপাচার্যকে বিষয়টা জানালাম। তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। বললেন, ‘আমি আশা করেছিলাম, উনি এখানে থাকলে ছাত্রছাত্রীরা ওঁর সাহচর্য পাবে, তাতে তারা উপকৃত হবে। উনি হয়তো পিএইচ ডি পর্যায়ে গবেষণার তত্ত্বাবধান করবেন। শুধু বক্তৃতা দিতে এলে তার তো কিছু হবে না।’
এ কথা তো আমারও। পরে শুনতে পাই–সত্যমিথ্যা জানি না–আইনের মারপ্যাঁচে সিদ্ধ আমাদের এক ছাত্র-সহকর্মী শরীফ সাহেবকে বুঝিয়েছে, ‘নিয়োগপত্রে তো লেখা নেই যে, আপনাকে চট্টগ্রামে থাকতে হবে কিংবা রোজ সেখানে যেতে হবে। আপনি ঢাকা ছাড়বেন কেন? যে আমাকে কথাটা জানিয়েছিল, তাকে বলেছিলাম, আমাদের নিয়োগপত্রে কি ক্লাস নেওয়ার কথা লেখা থাকে? তাই বলে কি কেউ বলতে পারে, আমি ক্লাস নেবো কেন? সার কথাটা বিবেচনা করলেন না?
আহমদ শরীফকে এ-কথাটা বলতে পারলাম না। কেননা, তিনি ঠিক কাজ করছেন বলে নিজেকে বুঝিয়ে ফেলেছেন। এখন আমি একটা যুক্তি দিলে তিনি পাল্টা যুক্তি দেবেন দশটা। তর্ক করতে গেলে হয়তো বলে বসবেন, ‘তোমাদের চাকরির দরকার নেই আমার–আমি চললাম।
সুতরাং আহমদ শরীফকে আমরা চট্টগ্রামে পেয়েও পেলাম না। তিনি অবশ্য নজরুল-বক্তৃতা দিতে শৈথিল্য করেননি। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল-যে দুবছর তিনি ছিলেন, তখন নির্দিষ্ট সময় অন্তর-অন্তর তিনি বক্তৃতা দিয়ে গেছেন। বক্তৃতাগুলো পরে একালে নজরুল (ঢাকা, ১৯৯০) নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বইটি তিনি উৎসর্গ করেন এভাবে : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল আজিজ খান প্রীতিনিলয়েষু এবং অধ্যাপক এ. টি. এম. আনিসুজ্জামান প্রিয়বরেষু।’ বইতে কোনো ভূমিকা বা মুখবন্ধ নেই। আখ্যাপত্রের উলটো পৃষ্ঠায় যেখানে ইংরেজিতে বইয়ের পরিচয় দেওয়া হয়, সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এতে সংকলিত বক্তৃতাগুলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজী নজরুল ইসলাম অধ্যাপকরূপে প্রদত্ত।
২৬.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হওয়ার অব্যবহিত পরে অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী যখন চট্টগ্রামে আসেন, তখন তিনি ক্যাম্পাসে আমার বাড়িতেও এসেছিলেন। আমার প্রতি তাঁর-পরশুরামের ভাষায়–’অহৈতুকী’ প্রীতি ছিল। তাঁর স্ত্রী ও বেবী যে সহপাঠিনী, তাও তিনি মনে রাখতেন। আমাকে তিনি জিগ্যেস করলেন, বলেন তো, আপনাকে ঢাকায় নেওয়ার ব্যাকরণটা কী?’ আমি বললাম, এটা নিয়ে এত কাদা ছোঁড়াছুড়ি হয়েছে যে আপনার আর নিজের হাত নোংরা না করাই উচিত। অধ্যাপক চৌধুরী আরো দু-একবার পরোক্ষে কথাটা তুলেছেন, আমিও এড়িয়ে গেছি। ব্যাপারটা তার বেশি আর অগ্রসর হয়নি।
তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল হকও আমাকে বললেন, ‘এবারে ঢাকায় চলে আসেন–এখানে তো অনেকদিন হলো, আর কত? একসময়ে আমাকে বললেন, বাংলার প্রফেসরশিপ অ্যাডভার্টাইজড হবে শিগগির, অবশ্যই অ্যাপ্লাই করবেন।’ বিজ্ঞাপন বের হলো, তারপরও আমি নড়াচড়া করিনি। আমি একবার ঢাকায় এলে বাংলা বিভাগের মোহাম্মদ আবু জাফর একটা আবেদনপত্র নিয়ে এসে বললো, আপনি এখানে সই করে দিন, আর কিছু করতে হবে না। নিয়োগ পেলে তখন আপনি ভাববার সময় পাবেন, আসবেন কী আসবেন না। আমি স্বাক্ষর দিলাম, বাকি কাগজপত্র সে-ই কোত্থেকে জোগাড় করে আবেদনপত্র জমা দিয়ে দিলো। জাফরের অসাধ্য কিছুই নেই।
চট্টগ্রামে ফিরে যখন বেবীকে ঘটনাটা বললাম, মনে হলো, সে বেশ খুশিই হয়েছে। ছেলেমেয়েরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, এমন ইচ্ছে সে পোষণ করতো। দুই মেয়ে ঢাকায় পড়তে এলে আমাদেরও চলে আসতে হবে, এটাও সে ভেবে রেখেছিল। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মের জন্যে আমি যে আবেদন করেছি, তা তার ভালোই লেগেছিল।
দরখাস্ত জমা দেওয়ার তারিখ চলে যাওয়ার পরে নির্বাচকমণ্ডলীর সভা আর বসে না। উপাচার্যের কথার সুরও পাল্টে যায়। যিনি আমাকে আনতে ব্যগ্র ছিলেন, তিনি বলেন, ‘ভেবে দেখেন, আসবেন কি না। যদি না-আসার সিদ্ধান্ত নেন তাহলে অ্যাপ্লিকেশন উইথড্র করে একটা চিঠি লিখে দেবেন। যিনি বলেছিলেন, চট্টগ্রামে আমি আর কত দিন থাকবো, তিনি বলেন, আপনি ওখানেই ভাইস-চ্যান্সেলর হয়ে যাবেন, কী হবে ঢাকায় এসে!’ তাঁর ভাবান্তরে আমি আহত হই, কিন্তু বিস্মিত হই না। জানতে পারি, নির্বাচকমণ্ডলীর সভা দেরি করে ডাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তাঁকে–যাতে কর্মে যারা আমার অনুবর্তী, তাঁরা যেন অধ্যাপকপদে নিযুক্তিলাভের ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ পান।
শেষ পর্যন্ত নির্বাচকমণ্ডলীর অধিবেশন ঘটে। বিজ্ঞাপিত পদে এবং পদোন্নতি লাভ করে অধ্যাপক নিযুক্ত হন চারজন : আমি, সৈয়দ আকরম হোসেন, ওয়াকিল আহমদ ও আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ। যেহেতু চট্টগ্রামের পাট চুকিয়ে আসতে আমার সময় লাগবে আর অন্যেরা নিয়োগপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যোগ দিতে পারবেন, সেহেতু আমি হবো কর্মে সবার কনিষ্ঠ।
ততদিনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে মোহাম্মদ আলীর নিয়োগ হয়ে গেছে। আমার সম্পর্কে অত্যন্ত রুচিবিগর্হিত একটি প্রচারপত্র ছড়ানো হয়েছে। তার আগে কলা অনুষদের এক সভায় অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজউদ্দীনের সঙ্গে আমার সংঘাত এমন পর্যায়ে গেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কার্যকারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করতে বাধ্য হয়েছে। সুতরাং চট্টগ্রামের সঙ্গে আমার বাঁধন কাটতে শুরু করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপত্র বোধহয় পেলাম মে মাসে। নিয়োগ গ্রহণ করে চিঠি দিলাম। বললাম, কর্মে যোগদানের জন্যে আমাকে মাসতিনেক সময় দিতে হবে।
সময় চাইবার দুটি কারণ ছিল। রুচি ততদিনে তার নানাবাড়িতে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স পড়ছে। শুচির এসএসসি পরীক্ষার সময়। ঘনিয়ে এসেছে। চট্টগ্রাম ছাড়ার কথা উঠলেই সে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়। সুতরাং বিষয়টি সম্পর্কে আমরা সিদ্ধান্ত নিইনি, তাকে এটা বোঝানো দরকার।
দ্বিতীয়ত, ১৯৮৫ সালে আমার মাসিক বেতন সর্বসাকুল্যে তিন হাজার টাকা। অচিরে নতুন বেতনক্রম চালু হবে। কর্মে জ্যেষ্ঠতা-অনুযায়ী অধ্যাপকদের এক-চতুর্থাংশ সর্বোচ্চ বেতনলাভের যোগ্য হবেন। অর্থাৎ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলে জুলাই মাসে আমার বেতন হয়ে যাবে ছয় হাজার টাকা। সেটা নিয়ে ঢাকায় যোগ দিলে আমার মাইনে ছয় হাজারই থেকে যাবে।
অতএব, আগস্টের কোনো এক সময়ে ঢাকায় যোগ দেবো বলে স্থির করলাম।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরগ্রহণের আবেদন যখন করলাম–শুভানুধ্যায়ীরা বললেন, অবসর নিলে পেনশনের পুরো সুবিধে পাবো, নইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী পেনশনের জন্যে আমার ২৬ বছরের চাকুরিজীবনের মোট দশ বছর গণ্য হবে হিসেবে; আরো পনেরো বৎসর চাকরি করলে তবে পুরো পেনশন পাবো, পনেরো বছর যে বেঁচে থাকবো, তার নিশ্চয়তা কী–তখন বিভাগের এবং বিভাগের বাইরের অনেক সহকর্মীই চাইলেন, আমি থেকে যাই। শহর থেকে বন্ধু ও অনুরাগীরা এসে অনুরোধ জানাতে থাকলেন, আমি যেন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করি।
আমাকে অবাক করে দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা আমার বাড়ির সামনে অবস্থান ধর্মঘট করতে শুরু করে দিলো। একদিন নয়, দুদিন নয়, বহুদিন–এক ঘণ্টা নয়, দুঘণ্টা নয়, অনেক সময়। একবার তো তাদের সরাতে উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকে আসতে হলো। আমি তো অভিভূত, অন্য বিভাগের সহকর্মীরাও অবাক। চট্টগ্রামের সংবাদপত্রে এই অভূতপূর্ব ঘটনার সংবাদ বের হলো।
এই ভালোবাসা ঠেলে ফেলে আসতে আমার খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি জানি, আমাকে যেতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে আরেকটা চিঠি দিয়ে জানালাম, ১৯ আগস্ট তারিখে ঢাকায় যোগ দেবো।
দু-একদিন পর দুপুরে উপাচার্য মোহাম্মদ শামসুল হকের ফোন এলো। বেশ রাগতস্বরেই বললেন, কী, আমার সঙ্গে কথা না বলেই আপনি জয়েন করার তারিখ ঠিক করে ফেলেছেন!
আমি অবাক। নিয়োগ-প্রস্তাব গ্রহণ করেছি, যোগদানের জন্যে মাসতিনেক সময় চেয়েছি। কাজে যোগ দিতে উপাচার্যের সঙ্গে তারিখ ঠিক করতে হবে কেন?
আমি মিনমিন করে কিছু একটা বললাম। উপাচার্য বললেন, না, ১৯ তারিখে আপনি যোগ দেবেন না। আমি পরে আপনাকে জানাবো, কবে যোগ দিতে হবে।’
বাংলা বিভাগের সভাপতি তখন রফিকুল ইসলাম। দু-একদিন আগেই তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে এসেছিলেন। তার কাছে এমন কোনো আভাস তো পাইনি। ফোন করলাম তাকে। তিনি বললেন, এ-বিষয়ে তিনি বিন্দুবিসর্গ জানেন না, কেন যে ভাইস-চান্সেলর আমাকে দেরি করে যেতে বলছেন, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
ঢাকায় ফোন করলাম অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে। তিনি রেগেমেগে ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন, কবে থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে হলে ভাইস-চান্সেলরের অনুমতি নিতে হয়?
ড. কামাল হোসেনকে ফোনে সব জানালাম। তিনি বললেন, উপাচার্যের মৌখিক উপদেশ আমি অগ্রাহ্য করতে পারি। আমি যেন ঈপ্সিত তারিখে কাজে যোগ দিই। কর্তৃপক্ষ বাধা দিলে মামলা করে দেবেন।
ড. মোজাফফর আহমদকেও বলি ব্যাপারটা। তিনি বললেন, এ তো বড়ো অন্যায় কথা। কাউকে দিয়ে বলানো দরকার যে, কাজটা উনি ঠিক। করছেন না।’ মোজাফফরের যাওয়ার কথা ছিল দেশের বাইরে–সেটা তিনি স্থগিত করলেন।
এবার চট্টগ্রামের উপাচার্যকে গিয়ে ধরলাম। সব কিছু খুলে বলে অনুরোধ করলাম, আমাকে অব্যাহতিদানের তারিখ পিছিয়ে দেওয়া যায় কি না, তা বিবেচনা করতে (সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অবশ্য হয়ে গেছে, কিন্তু সে-সিদ্ধান্ত তখনো আমাকে লিখিতভাবে জানানো হয়নি)। বোধহয় পরদিন–ছুটির দিনে–ফোন করে উপাচার্য তাঁর বাড়িতে ডেকে নিলেন। দেখলাম, আলমগীর সিরাজউদ্দীন আগেই পৌঁছে গেছেন। তিনি আমার উপস্থিতিতে উপাচার্যকে বললেন, অবসরগ্রহণের তারিখ একবার স্থির হয়ে গেলে আইনত সেটা আর বদল করা যায় না। তিনি ব্যারিস্টার, আইন ভালো জানেন।
উপাচার্য বললেন, ‘শুনলেন তো, তারিখ বদলানো যাবে না।’
ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম।
শহরের বন্ধুবান্ধবেরা চারুকলা কলেজের প্রাঙ্গণে আমাকে বিদায়-সংবর্ধনা জানানোর আয়োজন করেছেন সেদিনই। আমার ত্রিশঙ্কু অবস্থার কথা দু একজনকে চুপি চুপি বলেছিলাম। তারা ‘বিদায়’ কথাটা উহ্য রেখে আর যা যা করার সবই করলেন। এত ভালোবাসা রাখবো কোথায়!
শামসুল হক সাহেবকে ফোন করলাম। বললাম, ‘১৮ তারিখেই এখানে। আমার কাজ শেষ। ১৯ তারিখে ঢাকায় যোগ না দিলে আমাকে বেকার থাকতে হবে–চাকরিজীবনে ছেদ পড়বে। ভবি ভুললেন না।
জাফর ফোন করে খবর নিচ্ছে কী হলো। আমি ফোন করলাম আমার বন্ধু ও শামসুল হক সাহেবের ছাত্র–পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক–অজয় রায়কে। তাকে অনুরোধ করলাম উপাচার্যের কাছে যেতে। তিনি গেলেন ঠিকই, কিন্তু কাজ হলো না।
ফোন করলাম বন্ধু নুরুল হককে। তার মাধ্যমেই ১৯৫৩ সালে পরিচয় হয়েছিল তার শিক্ষক শামসুল হকের সঙ্গে। নুরুল হক নিজে গেলেন না, কিন্তু তাঁর বন্ধু এম সাইদুজ্জামানকে আমার দুরবস্থার কথা বললেন। সাইদুজ্জামান। শামসুল হক সাহেবের ছাত্র, তখন অর্থমন্ত্রী।
এবারে কাজ হলো। শামসুল হক সাহেব নিজেই ফোন করলেন। বললেন, ‘আপনি আবার সাইদুজ্জামানকে বলতে গেছেন কেন? ঠিক আছে, ১৯ তারিখে আসেন। আগে আমার সঙ্গে দেখা করবেন, তারপর জয়েন করতে যাবেন। ডিপার্টমেন্টে।
১৮ তারিখ রাতের ট্রেনে ঢাকা রওনা হবো। স্টেশনে লোকে লোকারণ্য। সহকর্মীরা ক্যাম্পাস থেকে এসেছেন, শহরের নানা জায়গা থেকে এসেছেন। ছাত্রছাত্রীরা এসেছে–কোনো কোনো ছাত্রী বা প্রাক্তন ছাত্রীর সঙ্গে তার স্বামীও রয়েছেন।
এ কদিন এ এফ রহমান হলের দারোয়ান-মালিরা–মুনশী মিয়া, আবুল খায়ের, জয়নাল, আমীর হোসেন–বিভাগের পিয়ন আলী অমানুষিক পরিশ্রম। করে আমার জিনিসপত্র বাঁধাবাঁধি করেছে। সেসব রেখে যাচ্ছি পরে নিয়ে যাবো বলে। তবে ওরা সকলেই এসেছে স্টেশনে। অনুষদের কেরানি-পিয়ন এসেছে, বিভাগের সহকারী আবদুর রশীদ এসেছেন।
সাড়ে দশটায় গাড়ি ছাড়লো।
স্বামীবাগে শ্বশুরবাড়িতে এসে উঠলাম। নাশতা খেয়ে ছুটলাম উপাচার্যের দপ্তরে। উপাচার্য সমস্ত ব্যাপারটা হালকা করে উড়িয়ে দিলেন। কেন আমি এত উদৃবিগ্ন হয়েছিলাম, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি বললেন, এখান থেকে বেরিয়ে ডিপার্টমেন্টে যান-সেখানে জয়েনিং রিপোর্ট দিয়ে সোজা বাড়ি চলে যাবেন।
বললাম, সার, আপনি যদি অনুমতি দেন, আজ রাতেই চট্টগ্রামে রওনা হই। জিনিসপত্র আনতে দুদিন সময় লাগবে।
শামসুল হক বললেন, ‘তা যান। তবে ওদিকে যাবেন না।’
‘কোনদিকে সার?’
‘ওই টিএসসির দিকে।’
এতক্ষণে বুঝলাম। কলা অনুষদের ডিনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। টিএসসিতে আজ ভোটদান ও গণনা। প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সঙ্গে ইতিহাসের আবদুল মমিন চৌধুরীর। মনিরুজ্জামান উপাচার্যের দলীয় লোক। উপাচার্যকে বোধহয় কেউ কেউ বলেছে যে, আমি মমিন চৌধুরীকে ভোট দেবো, সেজন্যে ঠিক নির্বাচনের দিনেই যোগ দিচ্ছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ব্যাপারটা আগে জানলে উনিশের বদলে বিশে যোগ দিতাম। উনিশ-বিশে পার্থক্য যে সামান্য নয়, সে জ্ঞান হলো।
হালখাতা
১.
চট্টগ্রাম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ট্রাকে এবং প্রফুল্লরঞ্জন সিংহের সৌজন্যে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের এক ট্রাকে আমাদের সংসারের সব মালপত্র ঢাকায় এলো। বইপত্র সব রাখা হলো আমার ছোটো ভায়রা মোবারকের বাড়িতে, কিছু জিনিস আমার মেজো শ্যালিকা নাজুর বাড়িতে। রুচি তো আগে থাকতেই নানাবাড়িতে ছিল, এখন পরিবারের বাকিরাও সেখানে যোগ দিলাম। একদিন শুনলাম, ও-বাড়ির এক ঠিকে ঝি শুচিকে প্রশ্ন করছে : ‘এ-বাড়ি কার?’
‘আমার নানার।’ শুচির উত্তর।
‘ও, আপনের বাপে ঘরজামাই থাকে?’ তার পুনরপি প্রশ্ন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়ি পাওয়ার জন্যে উপাচার্যের কাছে যাই। তাঁর বিশেষ ক্ষমতাবলে যদি তিনি কিছু করেন। তাঁর স্ত্রী যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। তবে উপাচার্য নিয়মের বাইরে যাবেন না। আমাকে অপেক্ষা করতে হবে যতদিন না আমার দান আসে। উপাচার্যকে দোষ দিতে পারি না।
বেবী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে চাকরি করে যাচ্ছে। যতখানি ছুটি নেওয়া সম্ভব, নিয়েছে। চট্টগ্রাম শহরে বাস করে ওর ছোটো ভাই আমের–সে দেখাশোনা করে আজিজের মাছ রপ্তানির ব্যবসা। বেবী তারই সঙ্গে থাকে। বাসে চট্টগ্রাম-ঢাকা-চট্টগ্রাম করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের গ্রন্থাগারে চাকরির দরখাস্ত করেছে।
আনন্দকে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি করা সম্ভবপর হয়েছে। অধ্যক্ষা রাজিয়া মতিন চৌধুরী একাধারে আমার ছাত্রী এবং শিক্ষকতুল্য সহকর্মীর স্ত্রী। তিনি প্রথম থেকেই আনন্দকে স্নেহের চোখে দেখছেন। শুচি প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেছে, ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে ভিকারুন্নিসা স্কুল ও কলেজে এবং হলিক্রস কলেজে। ভিকারুন্নিসার ফল প্রকাশ হতেই অধ্যক্ষা হামিদা আলী বেবীকে বললো, আমার সারের মেয়ে আমার কলেজেই পড়বে। হলিক্রসে পরীক্ষার ফলাফল দেখতেও আর যাওয়া হলো না।
ঢাকায় এসে আমার একেবারেই ভালো লাগছে না। চট্টগ্রামের জন্য মন খারাপ করছে। তার ওপর মে মাস থেকে ধূমপান ত্যাগ করেছি–উইথড্রয়াল সিম্পটম খুব প্রবল। চিত্তে সুখ নেই যাকে বলে, জীবন ও জগৎ বিস্বাদ মনে হয়। বেশির ভাগ সময় বিছানায় শুয়ে থাকি। আহসান হাবীবকে মনে পড়ে। জুন মাসে সপরিবারে ঢাকায় এসেছিলাম, তখন সবাই মিলে তাঁদের বাড়ি গিয়েছিলাম। সেই শেষ দেখা–জুলাই মাসে তিনি চলে গেলেন। হাসান হাফিজুর রহমানকে মনে পড়ে। তিনি চলে গেছেন দু বছর আগে। আমি যেন কোথাও গিয়েছিলাম। ঢাকায় ফিরে তার মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দু-কলম লিখেছিলাম। ঢাকায় বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মেলামেশা করি ঠিকই, কিন্তু জীবনের ছন্দ ঠিক খুঁজে পাই না। চট্টগ্রামে থাকতে প্রায় রোজ বিকেলে কনট্রাকট ব্রিজ খেলতাম। ঢাকায় এসে একদিনও খেলিনি–তেমন তাগাদাও অনুভব করিনি।
বিভাগে আমাকে দেওয়া হয়েছে কারো পরিত্যক্ত রুটিন। সুতরাং এমন অনেক কিছু পড়াতে হচ্ছে যা আমার নিজের এলাকার নয় এবং যা আমি কখনো পড়াইনি। নিজের বইপত্র থেকে অনেক দূরে আছি–বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভরসা। বিভাগের আবহাওয়া মোটের ওপর ভালোই। আহমদ শরীফ ও নীলিমা ইব্রাহিমকে নিয়ে যে-দ্বন্দ্ব ছিল সেখানে, তাদের অনুপস্থিতিতে সেটা অনেকখানি দূর হয়েছে। বিভাগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সবাইকে নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি তেমন সুবিধাজনক নয়। রাষ্ট্রপতি এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে–তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। আন্দোলনকারী ছাত্রদের সঙ্গে সরকারপন্থী ছাত্রদের সশস্ত্র সংঘাত দেখা দিচ্ছে। আমি ক্লাসে বক্তৃতা করছি, তার মধ্যে বোমা বা গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল। কোত্থেকে একদল ছেলেমেয়ে এসে হুড়মুড় করে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে গেল এবং বিনা বাক্যব্যয়ে বেঞ্চিতে আসন নিয়ে বক্তৃতা শোনার ভান করতে লাগলো। এই অবস্থায় আমার পক্ষে পড়িয়ে যাওয়ার ভান করা মুশকিল।
১৫ অক্টোবর জগন্নাথ হলের ভবন ধসে ৩৬ জন ছাত্র (পরে আরো চারজন) মারা যায়, দুই শতাধিক আহত হয়। খবর পেয়ে ছুটে এলাম। আমার কিছু করার নেই–বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা ছাড়া। জানতে পারলাম, ওই ভবন সংস্কার করার চেষ্টা একাধিকবার ব্যর্থ হয়েছে। ওই ভবনেই ছাত্রদের টিভি রুম। সংস্কারকাজ চললে টেলিভিশন দেখার ব্যাঘাত হবে, তাই ছাত্রেরা নাকি কাজে বাধা দিয়েছে। তাই যদি হয় তাহলে কাজটি আত্মঘাতী হয়েছে। এই দুঃখের দিনে একটা ব্যাপার দেখে ভালো লাগলো–ত্রাণকাজে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। রিকশাওয়ালা আহতদের নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে–বিনি পয়সায়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, শুনলাম, লম্বা লাইন লেগেছে রক্তদানকারীদের। প্রত্যেকেই আন্তরিকভাবে কিছু করতে চেষ্টা করছেন। জগন্নাথ হল থেকে যখন রাজ্জাক সাহেবের বাসায় গেলাম, তিনি এই দৃষ্টান্তের উল্লেখ করলেন, কী কন আপনেরা সাম্প্রদায়িকতার কথা! দেখেন তো সকলে কেমন করত্যাছে। হিন্দু-মুসলমান বিচার করে নাই।
রাজনৈতিক সংঘর্ষ বাড়ছে বই কমছে না। জানুয়ারি মাসের একদিনে স্বয়ং উপাচার্যের ভবন আক্রান্ত হলো। সেটি ছিল ছুটির দিন। উপাচার্য ও তার স্ত্রী বাড়ি ছিলেন না। তাঁদের সন্তানেরা ছিল। বাইরে থেকে বিস্ফোরকজাতীয় কিছু ছুঁড়ে দেওয়া হয়। তাতে দোতলার বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় আগুন লেগে যায়–দোতলাই তো আবাসিক অংশ। বড়োরকম ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, কিন্তু হুমকিটা বড়ো ধরনের নিঃসন্দেহে। আমি গিয়ে দেখি উপাচার্য-দম্পতি ততক্ষণে ফিরে এসেছেন–শিক্ষক ও কর্মকর্তা অনেকেই এসেছেন সমবেদনা জানাতে। অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসুল হক ভয়ানক ক্ষুব্ধ ও বিচলিত। বলছেন, আমার উপর রাগ থাকতে পারে, আমার ছেলেমেয়েদের ওপর তার জন্যে শোধ নেবে নাকি? তার কথায় এমন আভাস পাওয়া গেল যে, এই ঘটনার সঙ্গে জাতীয় রাজনীতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির যোগ আছে। পরদিনই তিনি পদত্যাগ করলেন। প্রো-ভাইস চান্সেলর অধ্যাপক আবদুল মান্নান ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব পেলেন। মাস ছয়েক পর তিনি উপাচার্য হিসেবে নিযুক্তিলাভ করেন। আহমদ শরীফের বিখ্যাত গুঁড়ি ক্লাবে তার সঙ্গে আমার একদিন পরিচয় হয়েছিল–আমি অবশ্য ওই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, বোধহয় শরীফ সাহেবের খোঁজে গিয়েছিলাম। আমার স্নেহভাজন সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বিয়ে করে অধ্যাপক মান্নানের কন্যা শামীমা নাসরীন ওরফে রোজীকে। সেই সুবাদে মান্নান সাহেবের সঙ্গে আমার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। শাহেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জনসংযোগ দপ্তরের কর্মকর্তা।
ব্যবসায় প্রশাসন ইনসটিটিউটের সহকারী গ্রন্থাগার পদে বেবী নিয়োগ পেলো। ইনসটিটিউটের পরিচালনা পর্ষদের সভায় নির্বাচকমণ্ডলীর সুপারিশ অনুমোদনের সময়ে উপাচার্য জানতে পারেন যে, যার নাম সুপারিশ করা হয়েছে, সে আমার স্ত্রী। তিনি পরে শাহেদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বেবী যে প্রার্থী, তা আমি তাকে আগে বলিনি কেন। তাতে যে বেবীর বিন্দুমাত্র সুনাম হয়েছিল, তা নয়। ইনসটিটিউটের পরিচালক তখন মোজাফফর আহমদ। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের কথা সুবিদিত। সুতরাং যাঁরা বলতে চাইলেন, তাঁরা ঠিকই বললেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে পক্ষপাত ঘটেছে। তাতে যে বেবীর বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয়েছিল, তাও নয়। নিয়োগলাভ করায় মোজাফরের প্রতি নিশ্চয় বেবী কৃতজ্ঞতাবোধ করেছিল, আমিও করেছিলাম। এপ্রিল মাসে সে কাজে যোগ দেয়। তাতে বাড়তি একটা সুবিধে এই হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়ি পাওয়ার ব্যাপারে আমার আর তার পয়েন্ট যোগ হয়ে আমাদের দাবি অনেকখানি এগিয়ে যায়। উপাচার্য কিছুটা আনুকূল্য করেন। বাড়ি বরাদ্দদাতা কমিটির দুই সদস্য–শিক্ষক সমিতির সভাপতি সাদউদ্দীন এবং কলা অনুষদের ডিন মমিন চৌধুরী–আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে যোগ দেওয়ার তেরো মাস পরে বাসা বরাদ্দ হয় আমার নামে।
জায়গা হলো ৩২ নম্বর বাড়ির তিনতলায়। ওখানে যে-রাস্তা ছিল বাড়ি বানাবার আগে, তার নাম ছিল স্যাভেজ রোড। পরে আমরা বাস করবো ভেবে নয়, কোনো কৃতী সাহেবের নামে রাস্তার নামকরণ হয়েছিল। পাকিস্তানি জোশ থেকে সে-নাম পালটে ঈসা খান রোড করা হয়। আমার ফ্ল্যাটের উলটো দিকে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পরিবার, আমার ফ্ল্যাটের ঠিক নিচেই মুনীর চৌধুরীর পরিবার বাস করেন। আমার দুই শহীদ শিক্ষকের পরিবারের সান্নিধ্য আমার পক্ষে আনন্দজনক হলো। তাছাড়া, চারতলায় থাকেন মৃত্তিকাবিজ্ঞানের আমিনুল ইসলাম ও বাংলার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান; দোতলায় ইসলামের ইতিহাসের মমতাজুর রহমান তরফদার; একতলায় লোকপ্রশাসনের নূর মোহাম্মদ মিয়া ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের আহমদ শামসুল ইসলাম–যাঁকে আবাল্য বড় ভাই বলে ডাকি। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও তাঁকে ছেলেবেলা থেকে চিনতেন বলে বিশেষ খাতির করতেন। ও-বাড়িতে আমরা বেশির ভাগ সমমনা।
আমি ভেবেছিলাম, মাসপয়লায় ফ্ল্যাটে উঠবো। জাফর বললো, বরাদ্দ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়া দরকার, নইলে বেদখল হয়ে যাবে। বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলাম, তাও হয়? সে দৃষ্টান্ত দিলো। আর দেরি করলাম না।
সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে ফ্ল্যাটে উঠলাম। স্বস্তিটা ছিল অপরিসীম।
তার আগে স্বামীবাগে থেকে দুটি কাজ করেছি বাংলা একাডেমীর তাগিদে। মুনীর চৌধুরী রচনাবলীর চতুর্থ খণ্ডের ভূমিকা লেখা আর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রথম খণ্ডের সম্পাদনা। মনজুরে মওলার অন্তহীন দাবি না থাকলে তা করে উঠতে পারতাম না।
এই সময়ে আরো একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত হই। প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুহম্মদ শামসউল হককে সভাপতি করে সরকার একটি পরীক্ষা-সংস্কার কমিটি গঠন করেছিল। মুহম্মদ ফেরদাউস খান, আবদুল্লাহ্ আল-মুতী, এ এম হারুন অর রশীদ ও আমি ছিলাম সদস্যদের মধ্যে। এঁদের সঙ্গে কাজ করা আনন্দদায়ক ছিল। কমিটির সদস্যেরা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে গিয়েছিলেন। আমি কোথাও যেতে চাইনি, যাইওনি। আমরা সর্বসম্মত সুপারিশ দাখিল করেছিলাম। তার একটি বা দুটি মাত্র গৃহীত হয়েছিল।
২.
এতদিনে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতাগ্রহণের সাড়ে চার বছর হয়ে গেল। তিনি প্রথমে সেনানিবাসের মধ্যে সাইকেল চালিয়ে দেখালেন, তারপর নিজে গাড়ি চালিয়ে শহরের পথে চললেন, তারপর সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে আটরশির পীরের সন্দর্শনে যেতে থাকলেন। তার আগে ক্ষমতাসীনদের কাউকে কাউকে দুর্নীতির দায়ে সাজা দিলেন, তারপর তাকে আসন দিলেন নিজের মন্ত্রিসভায়। ভয় ও লোভ দেখিয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল ভাঙলেন, সেসব দলের নেতাদের টেনে নিলেন নিজের কাছে। এক সময়ে ড. কামাল হোসেনসহ বিরোধী দলীয় নেতাদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায় সামরিক গোয়েন্দারা–তাতেও সকলে ভয় পাননি। আমাদের দেশে সামরিক শাসন এলেই লোকে তাকে সমর্থন করে। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউর রহমান সে-সমর্থন পেয়েছেন, এরশাদও পেয়েছেন। তারপরে লোকে তাদের শাসনের স্বরূপ বুঝতে পারে, তখন বিদ্রোহ করে। এরশাদ খুনোখুনির পথে না গিয়ে দুর্নীতি অবাধ করার পথ ধরেন। তাতে অনেককে সঙ্গে পান, জনগণকে পান না। তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়–প্রথমে ছাত্রেরাই পথ দেখায়, তারপর রাজনীতিবিদেরা। তিনি রাজনীতি বন্ধ করেন, সময় বুঝে রাজনীতি অনুমোদনও করেন। তিনি গণভোটে জনসমর্থন দেখান, দেশি-বিদেশি সকল সাংবাদিকই বলেন, ভোটের সঙ্গে ফলাফলের কোনো সংগতি নেই।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পাটি গঠিত হয়। সেপ্টেম্বরের আগে এরশাদ তাতে যোগ দেন না, কিন্তু প্রথম থেকে সবাই জানে, এটাই তার দল। তিনি সংসদ নির্বাচন দেবেন বলে স্থির করেন। শোনা যায়, বিরোধী দল একজোট হয়েছে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া ১৫০টি করে আসনে প্রার্থী হবেন। নতুন অধ্যাদেশ জারি হয়, পাঁচটির অধিক আসনে কেউ প্রার্থী হতে পারবে না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল, জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে সাতদল এবং স্বতন্ত্রভাবে জামায়াতে ইসলামী এরশাদবিরোধী একই ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এর একটা ফল এই হয় যে, দেশের মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াত বৈধতা পেতে শুরু করে। এরশাদ সংসদ-নির্বাচনের সময়সূচি নতুন করে ঘোষণা করেন। বিরোধী দলগুলো তা বর্জন করবে বলে জানায়। তারপর হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। শুনেছি, আওয়ামী লীগের ড. কামাল হোসেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন এর মূল প্রবক্তা। আওয়ামী লীগের এ সিদ্ধান্ত ১৫ দলের মধ্যেই ভাঙন ধরায়। সংসদ-নির্বাচন হয় ৭ মে। জাতীয় পার্টি সংসদে অর্ধেকের বেশি আসন পায়। কামাল হোসেনকে এবং আরো কাউকে কাউকে জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের নির্বাচন হলে জাতীয় পার্টির সেই সংখ্যাধিক্য আরো দৃঢ় হয়। এতদিনে এরশাদ সেনাবাহিনী থেকে অবসরগ্রহণ করেন। তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী এবং মওদুদ আহমদ, ডা. এম এ মতিন ও কাজী জাফর আহমদ উপপ্রধানমন্ত্রী হন।
নবনির্বাচিত জাতীয় সংসদ সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী গ্রহণ করে এরশাদের সামরিক শাসনকালে গৃহীত সকল ব্যবস্থা অনুমোদন করে। আওয়ামী লীগ অবশ্য সংসদ বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়, তবে বিরোধী দলের কিছু সদস্য এবং কয়েকজন স্বতন্ত্র সদস্যের সমর্থন লাভ করে সরকার সংবিধান-সংশোধনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। লায়লা সিদ্দিকী সম্ভবত স্বতন্ত্র সদস্য ছিলেন, তাঁর স্বামী লতিফ সিদ্দিকী দীর্ঘকাল কারাগারে আটক ছিল। লায়লা সিদ্দিকী সপ্তম সংশোধনী সমর্থন করেন, দুদিন পরে লতিফ সিদ্দিকী মুক্তিলাভ করে।
সংসদের বাইরে এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলতে থাকে। সরকারসমর্থক ছাত্র সংগঠন রাষ্ট্রীয় কোনো এজেন্সির সহায়তায় অর্থ ও অস্ত্রবলে বলীয়ান হয়ে ওঠে। তারা অব্যাহতগতিতে সন্ত্রাস চালাতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রভাব পড়ে সর্বাধিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন, প্রকৌশলী-কৃষিবিদ ও চিকিৎসকেরা সমষ্টিগতভাবে ভূমিকা নেন, পেশাজীবীদের ব্যাপক ঐক্য গড়ে ওঠে। তারপরও সামনে কী ঘটবে, তা অজ্ঞাত রয়ে যায়।
৩.
বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কোনো একটা উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না, এমন ভাবনা যখন মনকে অধিকার করেছে, তখন একদিন ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে আমার বাসায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও আমার আলাপ হলো। তারা বললেন, সংবিধানের আওতায় বিকল্প একটি সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়ে যদি একটা বিবৃতি দেওয়া যায়, তাহলে হয়তো নতুন একটা চিন্তার সূচনা হতে পারে। মোজাফফর ও আমি মিলে একটা খসড়া তৈরি করলাম, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের ভার নিলেন অধ্যাপক মুশারফ হোসেন। খসড়া নিয়ে আলোচনার জন্যে পরে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বাড়িতে বসবার ব্যবস্থা হলো। আমি সেখানে যেতে পারলাম না–হঠাৎ জ্বর হয়ে গেল বলে। বিবৃতির চূড়ান্ত রূপদান এবং তাতে স্বাক্ষরদান সেখানেই হলো–আমি পরদিন সই করলাম। ১৯৮৭ সালের ৩১ মার্চ সব কাগজে বিবৃতিটা প্রকাশ পেলো। স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা ৩১ হওয়ায় এটি পরিচিত হলো ৩১ বুদ্ধিজীবী বা ৩১ নাগরিকের বিবৃতি বলে। সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা থেকে বিবৃতির শুরু ও শেষটা তুলে দিচ্ছি :
বাংলাদেশে এখন এক গুরুতর সংকটের মধ্যে আমরা কালাতিপাত করছি। সর্বতোমুখী এই সংকট আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্র স্পর্শ করেছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক গম্ভীর হতাশা বিদ্যমান, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের ব্যাপ্তি ও অসাম্যের বিস্তার, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে অনভিপ্রেত পরিস্থিতি, সামাজিক ক্ষেত্রে চরম নৈরাশ্য ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। সবচেয়ে যা ভয়াবহ, তা হলো, দেশের প্রায় সকল পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে ফেলা হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নামে প্রহসনের অবতারণা করায় রাষ্ট্রপতির আসনের মর্যাদা ও জাতীয় সংসদের বিশ্বাসযোগ্যতা যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষের ভোটদানের মতো প্রয়োজনীয় অধিকার হরণ করে নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলের মধ্যেও গণতান্ত্রিক নীতি ও পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসৃত হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে অনেকেই সংশয়গ্রস্ত। তেমনি ক্ষমতাসীনদের ইঙ্গিতে দল ভাঙাভাঙি ও সুবিধাবাদের যে খেলা চলছে, তাতেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে মানুষের শ্রদ্ধা নষ্ট হচ্ছে।…
এই নৈরাজ্য থেকে মুক্তির পথ অবিমিশ্র গণতন্ত্র। সন্ত্রাসের মাঝে মানুষের ভোটাধিকার হরণের মাধ্যমে যে তথাকথিত প্রহসনমূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা থেকে দেশকে মুক্ত করতে সংবিধানের পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রকৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এজন্য সংবিধানের অধীনে দলনিরপেক্ষ, চরিত্রবান ব্যক্তিসমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রতিষ্ঠা সহায়ক হবে। সে সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হবে সর্বজনীন গণতান্ত্রিক অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সর্বনিম্ন সময়ে দলীয় ভিত্তিতে সুষ্ঠু সন্ত্রাসমুক্ত জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, যে জনপ্রতিনিধিরা সংবিধান-পরিবর্তনের মাধ্যমে যে অগণতান্ত্রিকতা আর্থ-রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে প্রবেশ করেছে, তার নিরসন করবেন। রাজনীতিকে অস্ত্রমুক্ত এবং সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিমুক্ত করার পদক্ষেপও তারা গ্রহণ করবেন। দলনিরপেক্ষ সরকারের কেউই নির্বাচনে কোনপ্রকার অংশগ্রহণ করবেন না বা অর্থবহভাবে কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকবেন না। আমরা মনে করি, বর্তমান নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য থেকে মুক্তির এটিই একমাত্র পথ। গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ গঠনের জন্য এ ব্যাপারে আমরা দেশের সর্বস্তরের মানুষের সক্রিয় সমর্থন প্রার্থনা করি।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, প্রাক্তন বিচারপতি দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বেগম সুফিয়া কামাল, প্রাক্তন উপাচার্য ও অর্থমন্ত্রী ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম, প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, প্রাক্তন সচিব এ কে এম আহসান, প্রাক্তন সচিব সানাউল হক, প্রাক্তন সচিব আবদুল খালেক, পুলিশের প্রাক্তন মহাপরিদর্শক এ বি এম জি কিবরিয়া, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, ব্যারিস্টার রফিকুল হক, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুবউদ্দীন আহমাদ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কাসেম, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ডিন অধ্যাপক জহুরুল হক, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম, অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক ইকবাল মাহমুদ, অধ্যাপক সজীদা খাতুন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক এ এম হারুন অর রশীদ, শিল্পী কামরুল হাসান, কবি শামসুর রাহমান, সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, অধ্যাপক মুশারফ হোসেন, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও ড. ফসিহউদ্দীন মাহতাব।
সকালবেলায় বিবৃতি পড়ে বেজায় ক্রুদ্ধ হয়ে আমার বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেন ছুটে এলো আমার বাড়িতে। আমরা এমন একটা বিবৃতি দিতে যাচ্ছি, অথচ তাকে কিছু জানতে দিইনি, এ ছিল তার অভিযোগ। আরো গুরুতর অভিযোগ এই যে, আমরা একটা মার্কিন পরিকল্পনার ফাঁদে পা দিয়েছি এবং এর পেছনে বড়রকম অসদুদ্দেশ্য আছে। একটু পরে এলো ডা. সারোয়ার আলী–সে তখনো কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত। তার স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে একেবারেই অনুত্তেজিত কণ্ঠে সে বললো, আনিস ভাই, বলেন দেখি, ব্যাপারটা কী। আপনারা এতজনে সই করলেন, অথচ বাইরের কেউ জানতে পারলো না–এমনটা তো বাংলাদেশে সচরাচর ঘটে না। সত্যি বলছি, আমি বুঝতে এলাম, কী ভেবে আপনারা এমন একটা প্রস্তাব তুললেন এবং এর পরে আপনারা কোন দিকে যাবেন।
পরে খবরের কাগজে অন্যান্য প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত-ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সংসদ-সদস্য–আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব জাফর ইমাম বিবৃতিকে বলেন অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক, অসৎ ও হঠকারী আর বিবৃতিদাতাদের অভিযুক্ত করেন বুদ্ধিবৃত্তির অসততার দায়ে। প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর মতে, বিবৃতিটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অন্তর্বর্তী সরকারগঠনের বিধান যেখানে সংবিধানে নেই, সেখানে তা দাবি করে আমরা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছি। উপপ্রধানমন্ত্রী মওদুদ আহমদ বললেন, অন্তর্বর্তী সরকারগঠনের দাবি অবান্তর।
বিবৃতি সমর্থন করলো পাঁচ দল, অলি আহাদের নেতৃত্বাধীন ছয় দলীয় জোট, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল, বাকশাল; ছাত্রলীগের দুটি অংশ এবং ছাত্রদল। বিবৃতিপ্রকাশের সময়ে শেখ হাসিনা ছিল বিদেশে। কয়েকদিন পরে দেশে ফিরে। বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সে বললো, বিবৃতিটি সুনির্দিষ্ট নয়, অস্পষ্ট; সংবিধানের কোন ধারায় কে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবেন, তা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। কিছুদিন আগে আ স ম আবদুর রব জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল, তারপরই আমাদের বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছে। ঘটনাটি, শেখ হাসিনার ভাষায়, বোঝা যাচ্ছে না। দুইয়ের মধ্যে কোনো যোগ আছে কি না, সে জানে না। তবে, তার মতে, এরশাদ সাহেবেরা অনেক খেলাই খেলতে পারেন।
আমাদের প্রস্তাবের সাংবিধানিক ব্যাখ্যা এবারে তৈরি করলেন বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন–আমি তার পুনর্লিখন করলাম। এবারে কিন্তু ৩১ জনের সই পাওয়া গেল না। প্রথমে সরে দাঁড়ালেন সজীদা খাতুন। তিনি আমাকে বললেন, তিনি রাজনীতি করেন না, মুশারফ হোসেনের কথায় একবার বিবৃতিতে স্বাক্ষর দিয়েছেন, তবে বারবার দেবেন না। একটু তিক্তভাবেই জানতে চাইলেন তিনি, ‘মোশাররফ সাহেব কি আড়কাঠি হয়েছেন?’ আরো একজন কেউ স্বাক্ষর দিতে অপারগ হন। তবে ২৯ জনের স্বাক্ষরে ৩১ জনের পক্ষেই বিবৃতি প্রকাশ পেলো।
জেনারেল এরশাদের পতন পর্যন্ত অর্থাৎ পরবর্তী তিন বছর আট মাস পর্যন্ত ৩১ জনের এই গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল, তবে সকলে আমরা একযোগে থাকতে পারিনি। অনেকের ওপরে চাপ আসছিল নানারকম, কেউ কেউ উৎসাহ হারিয়ে ফেলছিলেন, পরিবারের সদস্যদের অস্বাচ্ছন্দ্যের কারণে কেউ কেউ আর একসঙ্গে থাকতে চাইছিলেন না। রাজ্জাক সাহেব একদিন আমাকে বললেন তাকে আর না জড়াতে। আরেকদিন রফিকুল হক বললেন, ৩১ জনের মধ্যে থাকায় তার পেশাগত কাজের ক্ষতি হচ্ছে–তিনি আর আমাদের বৈঠকে যোগ দিতে পারবেন না। সরকারি-আধাসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের তিনি আইনি পরামর্শক ছিলেন–মনে হয়, সেসব দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা চলছিল। তার অবস্থাটা বুঝে আমরা তাঁকে রেহাই দিলাম। তবে অল্পকালের মধ্যে তিনি যখন অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, তখন। আমাদের একটু খারাপ লেগেছিল বই কি! ড. মল্লিক, নীলিমা ইব্রাহিম, এ কে এম আহসান, সানাউল হক, এ বি এম জি কিবরিয়া, খন্দকার মাহবুবউদ্দীন–এঁদের সঙ্গে যোগ শিথিল হয়ে গেল। স্ত্রীহত্যার দায়ে পুত্র গ্রেপ্তার হওয়ার পরে ডা. আবুল কাসেম আর বাইরে তেমন বের হতেন না–সে পর্যন্ত তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ফসিহউদ্দীন মাহতাব যে-প্রকৌশলী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তার ওপরেও সরকারের দিক থেকে প্রচণ্ড চাপ আসে। এক পর্যায়ে
মনে হয়েছিল, পেশাগত সংশ্লেষ এবং বিবৃতিদাতাদের সঙ্গে সংযোগের মধ্যে একটা তাঁকে বেছে নিতে হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আমরা যখন প্রথম বিবৃতি দিই, তখন দৈনিক বাংলার প্রিন্টার্স লাইন থেকে সম্পাদক হিসেবে শামসুর রাহমানের নাম সদ্য বাদ দেওয়া হয়েছে সরকারি আদেশে–৩১ জনের অনেকেই অন্যদের সঙ্গে মিলে তারও প্রতিবাদ করেছি। কিছুকাল পরে শামসুর রাহমান ওই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ত্যাগ করলেন। সংসারের চাপ পুরোদমেই ছিল তার ওপরে, উপার্জনের কোনো বিকল্প উপায় তাঁর ছিল না। তবু তিনি একটা পথ বেছে নিয়েছিলেন। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সরকারি মালিকানাধীন পত্রিকায় চাকরি করে। তাঁর পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে বলাটা নৈতিকতার মাপকাঠিতে ঠিক ছিল না।
আমাদের বেশিরভাগ বৈঠক হতো মুশারফ হোসেন কিংবা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসস্থানে। বক্তব্য স্থির করার পর মুসাবিদা করার ভার অধিকাংশ সময়ে আমার ওপর পড়তো। বিবৃতি তৈরি হয়ে গেলে মইনুল হোসেন ইত্তেফাঁকের লোকবলের সাহায্যে তা বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতেন।
অল্প সময়ের মধ্যেই জনসমাজে আমাদের বিবৃতির একটা গ্রহণযোগ্যতা দাঁড়িয়ে যায়। বিরোধী দলের কেউ আর আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কটাক্ষ করেননি। সরকারি প্রতিক্রিয়া যে বিরূপ ছিল, তা আগেই বলেছি। তবে সরকারের পক্ষ থেকেও আর কেউ প্রকাশ্য বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হননি।
৪.
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ শিক্ষকদের যেসব পরিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসে থাকতেন, কর্তৃপক্ষ সেসব পরিবারকে বাড়ি বরাদ্দ করেছিলেন ১৫ বছরের জন্য। আমি স্পষ্টই দেখতে পাই, ১৯৮৭ সালে যদি তাদের বাসস্থান ছেড়ে দিতে হয়, অনেকেই বিপদে পড়বেন; অন্তত আরো পাঁচ বছরের জন্যে তাঁদের বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। কথাটা বিভাগের শিক্ষকদের কাউকে কাউকে বলায় তারা কর্তৃপক্ষের কাছে এই মর্মে প্রস্তাব করতে সম্মত হলেন। বাংলা বিভাগের শহীদ শিক্ষকদের পরিবারের জন্যে এই সুবিধা চেয়ে বেশ কয়েকজনের স্বাক্ষর সংবলিত আবেদনপত্র নিয়ে আমি গেলাম উপাচার্যের কাছে। তিনি যথেষ্ট সহানুভূতি প্রকাশ করলেন। বললেন, বিষয়টা সিন্ডিকেটে নিতে হবে। যে সিদ্ধান্তই হোক, তা প্রযোজ্য হবে সকল শহীদ শিক্ষকের পরিবারের জন্যে–কেবল বাংলা বিভাগের শহীদ শিক্ষকদের পরিবারের জন্যে নয়। আমি বললাম, তাহলে তো আরো ভালো কথা।
পরদিন হুমায়ূন আজাদ আমার কাছে এসে অভিযোগ করলো। বললো, ‘আপনারা কি ক্যাম্পাসের বাড়িঘর কেবল মৃতদেরকেই দেবেন, যারা জীবিত তাদের পরিবারের কথা ভাববেন না?’ আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, যে-প্রস্তাব আমরা করেছি, তা আমাদের কর্তব্য ছিল। সে তা মানতে চাইল না, উলটো প্রশ্ন করলো, এ-বিষয়ে তো শিক্ষকদের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, কোন অধিকারে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে লিখলাম? এবারে আমি বিরক্তি গোপন করে বললাম, আমরা বিভাগের কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত তো জানাইনি, ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন এমন আবেদন করেছি।’ হুমায়ূন বললো, তাই যদি হবে, তাহলে বিভাগের প্যাডের কাগজে আপনারা চিঠি লিখলেন কোন অধিকারে?’ জবাব দিলাম, তুমি কি জানো না, ব্যক্তিগতভাবে আনুষ্ঠানিক চিঠি। লিখলেও বিভাগের প্যাডের কাগজ ব্যবহার করার অধিকার আমাদের প্রত্যেকের আছে?’ এবারে আমার কথাটা বোধ হয় রূঢ় শুনিয়েছিল। হুমায়ূন খানিক চুপ করে থেকে বললো, আপনাদের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তাহলে আমিও উপাচার্যকে লিখব।’ সে লিখেছিল কি না জানি না। সম্ভবত লেখেনি। বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ সকল শহীদ পরিবারকে আরো পাঁচ বছরের জন্যে বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলেন।
আমি চট্টগ্রামে থাকতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক নিয়োগের জন্য গঠিত নির্বাচক কমিটির একজন সদস্য ছিলাম বিশেষজ্ঞ হিসেবে। চট্টগ্রাম থেকে একবার কী কাজে এসেছি ঢাকায়–উঠেছি বড়ো বোনের বাড়িতে। একদিন শুনলাম, সন্জীদা খাতুন ফোন করেছিলেন আমার খোঁজে। আমি তাকে ফোন করায় তিনি বললেন, তিনি নিজের জন্যে কিছু বলছেন না, তবে অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাচ্ছে না বলে হুমায়ূন খুব খারাপ বোধ করছে–আমি কি এ-বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে কিছু বলতে পারি? বললাম, আমি সিলেকশন কমিটির মেম্বার, আমার পক্ষে কিছু বলা সংগত হবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যোগ দেওয়ার পরে কথাটা আবার উঠল। এবারে রাজ্জাক সাহেব বললেন, হুমায়ূন খুব ফ্রাষ্ট্রেটেড বোধ করছে। একদিন সুযোগ পেয়ে আমি উপাচার্য অধ্যাপক মান্নানকে বললাম, নির্বাচকমণ্ডলীর সভা ডাকার বিষয়টা তিনি বিবেচনা করতে পারেন। যদিও তখনও আমি এই মণ্ডলীর একজন, তবু এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষক হিসেবে কথাটা বলতে অত বাধা অনুভব করলাম না। আমার বলার জন্যে হয়তো নয়, তবু উপাচার্য অল্প সময়ের মধ্যেই নির্বাচক কমিটির বৈঠক আহ্বান করলেন, আমি তাতে অংশ নিলাম এবং সন্জীদা খাতুন ও হুমায়ূন আজাদকে অধ্যাপকপদে নিয়োগের সুপারিশ করা হলো। যথারীতি নিয়োগ হয়ে গেল, তারা নতুন পদে যোগ দিলেন।
বছরখানেক পরে বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটির এক সভায় পরীক্ষা কিংবা এ-ধরনের কোনো বিষয়সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠনের ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে। কে যেন ‘নেক্সট সিনিয়র হিসেবে আমার নাম প্রস্তাব করলো। হুমায়ূন দুম করে বলে বসলো, আনিস সারের চেয়ে আমি সিনিয়র। সবাই একটু অবাক হওয়ায় সে ব্যাখ্যা করলো, সন্জীদা খাতুন ও সে বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হয়েছেন, তাই তাঁদের অবেক্ষাধীন কাল–প্রবেশন পিরিয়ড-এক বছরের, আমি অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে অধ্যাপক হয়েছি। বলে আমার অবেক্ষাধীনকাল দু বছরের। আমার দু বছরের মেয়াদ পূর্ণ হয়নি, তাদের এক বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অতএব, আমার আগে তাঁদের। নিয়োগ কনফার্মড–পাকা–হয়েছে। ফলে তারা আমার সিনিয়র হয়ে গেছেন। এ-বিষয়ে হুমায়ূনের কাছে রেজিস্ট্রারের চিঠি আছে। আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ তখন বিভাগের সভাপতি। তিনি হুমায়ূনকে বললেন, ‘চিঠিটা নিয়ে আসুন আমরা দেখি।’ আমি বললাম, তার কোনো দরকার নেই, হুমায়ূনের মুখের কথাই যথেষ্ট। তাদের দু জনকে আমার সিনিয়র ধরে কমিটির বিষয়ে যা। করণীয়, তা করা হোক।
১৯৬৯ সালে, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাই তখন, বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতার হিসেবে আমার স্থান ছিল সপ্তম। আমার জ্যেষ্ঠ যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে তিনজন বেঁচে নেই, দুজন অবসর নিয়েছেন। তারপরও চট্টগ্রাম থেকে ফিরে আসার পরে জ্যেষ্ঠতার নিরিখে আমার স্থান হয়। সপ্তম। এখন নবম হলো। সাত থেকে নয় এমন কিছু নয়ছয়ের বিষয় নয়।
৫.
শিল্পী রশিদ চৌধুরীর জীবনের শেষ দিনগুলি কষ্টেই কেটেছিল।
দুই স্ত্রীর থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে ঢাকায় বাস করছিলেন তিনি। বেশি কাজ করতে পারছিলেন না বলে তার ওপর একটা আর্থিক চাপ ছিল। এরই মধ্যে বেশ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কিছুদিনের মধ্যে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে গেলেন প্যারিসে। সেখানে অ্যানি এবং রোজা-রীতার সঙ্গে পুনর্মিলন ঘটলো। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় ভর্তি হলেন হাসপাতালে। তাঁর ফুসফুস ও পেটে পানি জমেছিল খুব বেশি। পানি বের করা হলো বটে, কিন্তু চিকিৎসকেরা। তার জীবনের আশা দেখতে পেলেন না। রশিদ নিজেই দেশে ফিরে আসতে চাইলেন। প্যারিসে তাকে দেখাশোনা করছিল ওবায়েদ জায়গীরদার। ডাক্তারেরা। তাকে বলেন, রোগী চাইলে দেশে ফিরে যেতে পারে, তবে তার ভ্রমণকালে সঙ্গী হতে হবে একজন চিকিৎসককে। ডা. সৈয়দ আনোয়ারুল হাফিজ তখন ছিলেন। লন্ডনে। ওবায়েদের অনুরোধে তিনি প্যারিসে আসেন, হাসপাতালের চিকিৎসকেরা তাঁকে রোগীর অবস্থা বুঝিয়ে দেন, তিনি রশিদের সঙ্গে ঢাকায় আসতে সম্মত হন। একই সঙ্গে অ্যানি এবং রোজা-রীতাও ফিরে আসে। ওবায়েদ সকলের যাত্রার ব্যবস্থা করে দেয়, রশিদ যাতে বিমানে শুয়ে আসতে পারেন, সেজন্যে বাড়তি টিকিটও কিনে দেয়।
ঢাকায় ফিরে রশিদ ভর্তি হন ধানমন্ডির মহানগর ক্লিনিকে। খবর পেয়ে বেবী ও আমি তাকে দেখতে যাই। তাঁর, যাকে বলে, মুমূর্ষ অবস্থা। তবু, মনে হয়, চিনতে পারলেন আমাদের, মুখে ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন স্মিত হাসি। ওইটুকুই। জানলাম, সে-সময়ে তাঁকে দেখতে আসতে চেয়েছিল জান্নাত, কিন্তু অ্যানি এবং রোজা-রীতার প্রবল আপত্তির মুখে তার আর আসা হয়নি। শারীরিক কারণেই পরিস্থিতির ওপর রশিদের নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
রশিদকে যখন আবার দেখতে যাই, তখন তাঁর জ্ঞান ছিল না। সংজ্ঞাহীন অবস্থায়ই ৫৪ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের ১২ ডিসেম্বর তাঁর জীবনাবসান হয়।
পরদিন তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণে। সেখানকার ছাত্র-শিক্ষকেরা ভিড় করেছিল তাকে ঘিরে, চারদিক থেকে বন্ধু বান্ধবেরা ছুটে এসেছিল। জান্নাত শেষ পর্যন্ত ক্লিনিকে রশিদকে দেখতে যেতে পেরেছিল।
৬.
জওহরলাল নেহরু এবং অং সানের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে নয়াদিল্লিতে এশিয়ান রিলেশন্স কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। শেষ পর্যন্ত অং সান এতে যোগ দিতে পারেননি (ওই এপ্রিলেই সাধারণ নির্বাচন ছিল বার্মায়), তবে এশিয়ার ত্রিশটি দেশের প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকেরা এসেছিলেন, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাও পর্যবেক্ষক পাঠিয়েছিল।
এই সম্মেলনের স্মরণে চল্লিশ বৎসর পর আরেকটি সম্মেলন আয়োজিত হয় নয়াদিল্লিতে, ভারত সরকারের উদ্যোগে। এশিয়ান রিলেশন্স কোমেমোরেটিভ কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৭ সালের অক্টোবরে। অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক মুশারফ হোসেন ও আমি তাতে যোগ দিয়েছিলাম। বাংলাদেশ থেকে আরো কেউ কেউ বোধহয় গিয়েছিলেন। এশিয়ার নানা দেশ থেকে প্রতিনিধি এসেছিলেন এই বিশাল আনন্দযজ্ঞে। ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি ড. শঙ্কর দয়াল শর্মা সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি স্বাগত ভাষণ দিয়েছিলেন। শঙ্কর দয়াল শর্মা উদ্ধৃত করেছিলেন বৈদিক মন্ত্র, রাজীব গান্ধি বাংলায় ও ইংরেজিতে উদ্ধৃত করেছিলেন নজরুল ইসলামের কবিতার চরণ।
সম্মেলন হয়েছিল বিজ্ঞান ভবনে। বহু লোকজন, আলোচ্য বিষয় অনেক। একই সঙ্গে একাধিক কক্ষে অধিবেশন বসছে। অধিবেশনের বাইরেও একান্তে। কিংবা দল বেঁধে গল্পসল্প অথবা তর্ক চলছে। রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী–নানা পেশার, নানা মতের লোক রয়েছেন। কে আসছেন, কে যাচ্ছেন, তাও সবসময়ে ঠাহর করা যায় না।
সব দেশের প্রতিনিধিরাই এশিয়ায় শান্তি ও ঐক্যপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন। কথাটা বলা যত সহজ, করা ততটা নয়। তখন ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলছিল। সেই যুদ্ধ থামার সম্ভাবনা কেমন, তা জানতে চেয়েছিলাম এক ইরানি প্রতিনিধির কাছে। তাঁর আশা, যুদ্ধ অচিরে শেষ হবে। উৎসাহভরে জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে। তিনি বললেন, ইরাককে হারাতে পারলেই। ইরাকের জনদুই প্রতিনিধিও বললেন, ইরানকে পর্যুদস্ত করেই শান্তিপ্রতিষ্ঠা ঘটবে।
ভারতীয় প্রতিনিধিদের মধ্যে বরুণ দে ছিলেন। এশীয় ঐক্যপ্রচেষ্টার ইতিহাস স্মরণ করতে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ ও ওকাকুরার কথা বললেন। তার ইচ্ছাক্রমে সে-সম্পর্কে আমি দু-চারটে কথার জোগান দিলাম।
সম্মেলনের বাইরেও জমেছিল ভালো। মুশারফ হোসেন ও আমার বন্ধু অর্জুন সেনগুপ্ত–সে বোধহয় তখন ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের সচিব–বেশ বড়ো। এক ভোজের আয়োজন করলো। সেখানে পরিচয় হলো পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. আলাগের সঙ্গে। তিনি তার আগে ছিলেন দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিসের অধ্যাপক, পরে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। অর্জুনের ভোজে আর যদের সঙ্গে পরিচয় হয়, তাঁদের মধ্যে ওবেরয়-পরিবারের এক দম্পতি ছিলেন–নেপালে তাঁদের বোতলের ব্যবসা। খুব আন্তরিকতার সঙ্গে কাঠমান্ডুতে তাঁদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মনুভাই নামে এক বিদ্যানুরাগী ব্যবসায়ীর সঙ্গেও বেশ সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার অনুরোধে পরের বার নয়াদিল্লিতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করায় তিনি মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করেছিলেন আমাকে। ড. আলাগও প্রথমবার আমাদের আলাদা করে খাইয়েছিলেন। তিনি উপাচার্য হওয়ার পরে আবার দেখা হয়েছিল। চিনতে ভুল করেননি।
৭.
১৯৮৭ সালের অনেকখানি জুড়ে, বিশেষ করে বছরের শেষদিকে, এবং ১৯৮৮ সালের শুরুতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেশ প্রবল হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে অন্তরীণাবদ্ধ করা হয়, দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়, জাতীয় সংসদ বিলোপ করা হয়, বাংলাদেশে বিবিসির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়–তার আগে বিবিসির সংবাদদাতা আতাউস সামাদও গ্রেপ্তার হন। বিরোধী দলের আহ্বানে দেশব্যাপী হরতাল পালিত হতে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে–বিশেষত ঢাকায়–সরকারপক্ষীয় ও বিরোধী ছাত্রসংগঠনের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত ঘটতে থাকে ক্রমাগত। চট্টগ্রামে হাসিনার নেতৃত্বাধীন মিছিলে পুলিশের গুলিচালনায় কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটে।
এ-সময়ে রাজনীতিবিদ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে। আত্মগোপন করে থাকেন। আত্মগোপনে থেকে ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা। চৌধুরী আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতেন। একদিন কথা বলে তিনি টেলিফোন আরেকজনকে দিলেন। গলা শুনে টের পেলাম তিনি তার ভায়রাভাই আসাদউল্লাহ। বুঝলাম তাঁর বাড়িতেই ডা. চৌধুরী বাস করছেন। সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ আত্মগোপন করেছিলেন ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদের বাড়িতে। কিছুকাল পরে ইশতিয়াক আহমদকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তাঁর দুর্গতির জন্যে আমরা অনেকে ফয়েজ আহমদকে দায়ী করেছিলাম।
ইশতিয়াক কারাগারে থাকতে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মৃত্যু ঘটে। জানাজায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার জন্য তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। ইশতিয়াকের সঙ্গে দেখা করতে আমরা ছুটে যাই। দেখলাম, শারীরিক অসুবিধে সহ্য করেও তাঁর মনোবল অক্ষুণ্ণ আছে। পরে ইশতিয়াক যেদিন মুক্তি পান সেদিনই গ্রেপ্তার হন ফয়েজ আহমদ। এমনই অদ্ভুত সংঘটন! ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের যে-প্রকোষ্ঠ থেকে ইশতিয়াক মুক্তি পান, সে-প্রকোষ্ঠেই তার জায়গায় স্থান হয় ফয়েজ আহমদের।
এমন পটভূমিকায়, তবে শেষোক্ত ঘটনার আগে, ১৯৮৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণে জাতীয় কবিতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে কবিতা-পাঠের আসরে কবি আবুল হোসেনকে প্রধান অতিথি করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি শারীরিক কারণে অসমর্থ হওয়ায় ওই আসন দেওয়া হয় শিল্পী কামরুল হাসানকে। মঞ্চে বসে জেনারেল এরশাদের ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন তিনি, চিত্রের পরিচিতি লিখেছিলেন ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে। সেই সন্ধ্যায়ই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ওই মঞ্চে ঢলে পড়েন তিনি। শেখ হাসিনার গাড়িতে তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে, কিন্তু ততক্ষণে বড়ো দেরি হয়ে গেছে।
পরদিন তার লাশ নিয়ে আসা হলো চারুকলা ইনস্টিটিউটে। ছাত্র-শিক্ষকদের ইচ্ছা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মসজিদ-প্রাঙ্গণে তাঁকে সমাহিত করা হোক। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সিন্ডিকেট এর আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আর কাউকে এখানে সমাধিস্থ করা হবে না। যারা সেখানে কামরুল হাসানকে দাফন করার অনুরোধ নিয়ে উপাচার্যের কাছে গেলেন, তাদেরকে উপাচার্য সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বললেন, এই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর পক্ষে অনুমতি দেওয়া অসম্ভব। শেষকালে বিষয়টি বিবেচনার জন্যে তিনি সিন্ডিকেটের বিশেষ সভা আহ্বান করতে সম্মত হলেন।
ইত্যবসরে ফয়েজ আহমদ ঘোষণা দিলেন, কামরুল হাসান তাঁর প্রিয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-প্রাঙ্গণেই শেষ শয্যা নেবেন। তিনি তার ব্যবস্থা করতে উপস্থিত সবাইকে আহ্বান করলেন। কবর খোদাইকারদের আগেই ডেকে আনা হয়েছিল। ফয়েজের ঘোষণার পরে তুমুল হইচইয়ের মধ্যে কোদাল পড়ল মাটিতে।
এই কামরুল ভাইই আমাদের ব্রতচারীর গান শিখিয়েছিলেন : ‘চল কোদাল চালাই/ভুলে মানের বালাই।’ কিন্তু সে-কোদালচালনার লক্ষ্য ছিল ভিন্ন।
কামরুল হাসানের মৃত্যু নিয়ে, ওই অনুষ্ঠানে তাদের জায়গা-বদল নিয়ে, পরে ‘নিয়তি’ নামে একটি মর্মস্পর্শী কবিতা লেখেন আবুল হোসেন।
৮.
চট্টগ্রামের সুসন্তান ডা. বি বি চৌধুরী পূর্ব লন্ডনে জেনারেল প্র্যাকটিস করেন। সেখানে পিপলস হেল্থ ক্লিনিক নামে তার একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে–ওই কেন্দ্রে প্রায় বিনামূল্যেই চিকিৎসা পাওয়া যায়, কয়েকজন উদীয়মান ডাক্তারও সেখানে প্রায় বিনাভাড়ায় বাস করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। ডা. চৌধুরী প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠিত করতে, বিশেষ করে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে, সক্রিয়। এতে তার কিছু বিরূপ সমালোচনাও হয়, কিন্তু তিনি তা গ্রাহ্য করেন না। কানুনগোপাড়ায়ও তিনি একটি দাঁতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র চালান।
এহেন ডা. চৌধুরী ১৯৮৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বড়ো করে পালন করবেন বলে স্থির করে সেখানে আমাকে আহ্বান করলেন অতিথি-বক্তা হওয়ার জন্যে। সেইসঙ্গে যোগ করলেন, আমি যেন আমার স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কাগজপত্র নিয়ে যাই সঙ্গে করে–তিনি আমার হৃদয়কে শাসিত করবেন। তার আমন্ত্রণের সমর্থন জানালেন আমার বন্ধু এ বি এম শফিউল্লাহ, আমার ছাত্র গোলাম মুরশিদও সবুজ সংকেত জানালো।
যথারীতি হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছানো গেল। এঁরা তিনজনই আমাকে অভ্যর্থনা করলেন। শফিউল্লার গাড়িতে করে আমরা সবাই তাঁর বাড়িতে এসে পৌঁছোলাম।
তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছিন্ন করে শফিউল্লাহ্ তখন থাকেন উত্তর লন্ডনে। সুসজ্জিত এক বিশাল বাড়িতে–গোলডার্স গ্রিন ও ব্রেষ্ট ক্রসের মাঝামাঝি জায়গায়। এক ফিলিপিনা মেয়ে রোজ দুবেলা এসে শফির বাড়ি পরিষ্কার করে, বিছানা করে, ডিশওয়াশারে হাঁড়িবাসন ধোয়, ওয়াশিং মেশিনে কাপড় ধুয়ে ড্রায়ারে শুকিয়ে ইস্ত্রি করে, তার অনুপস্থিতিতে টেলিফোনের বার্তা লিখে রাখে–শফির সঙ্গে তার পিতা-পুত্রীর সম্বন্ধ। শফির পরিচ্ছন্নতার বাতিক আগের চেয়ে বেড়েছে–আমি তো না-বুঝেই জুতো নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকে পড়লাম, অন্যদের জুতোবিহীন পা দেখে পরে জুতো খুলে রেখে এলাম দরজার বাইরে। শফি অবশ্য প্রতিবাদ করতে থাকলেন, কিন্তু সেদিন বিকেলেই আমার জন্যে একজোড়া কালো মোকাসিন কিনে আনলেন–যাতে জুতোর ফিতে খোলা ও বাধার কষ্ট করতে না হয়। আমরা পৌঁছোবার পর শফি নিজেই চা বানিয়ে আনলেন–চিনির পাত্রে ব্রাউন সুগার। দেখে আমি বললাম, শফি, ব্রাউন সুগার পর্যন্ত চলবে, কিন্তু ব্রাউন ব্রেড চলবে না।’ শফি বললেন, ‘স্বাস্থ্যকর খাদ্যের প্রতি আপনার বিরাগ–একবার খেয়েই দেখুন না।
সন্ধ্যার পরে ফোন করলেন শফিক রেহমান। বললেন, তুমি এমন একটা অনুষ্ঠানে এসেছ যা বিতর্কিত। ভালো হয়, তুমি যদি না যাও।’ আমি বললাম, ‘আমার ঢাকার ফোন নম্বর আছে আপনার কাছে। আগে ফোন করলেন না কেন? এদের টিকিটে এখানে এসেছি–তারপর এদের অনুষ্ঠানে না গিয়ে পারি কী করে!’ শফিক রেহমান হাসলেন। বললেন, ‘সিক হয়ে যাও।’ বললাম, তা হয় না। খানিক পরে আরো একজন একই মর্মে ফোন করলেন। তাঁকেও আমি একই উত্তর দিলাম। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল।
অনুষ্ঠানের আগের রাতে অনুষ্ঠানস্থলে হাঙ্গামা হলো। একটা ছোট্ট শহিদ মিনার করা হয়েছিল–সেটা ভেঙে দেওয়া হয়। বন্ধ মিলনায়তনে প্রবেশের চেষ্টা করতে গিয়ে জনদুই তরুণ গ্রেপ্তার হয় পুলিশের হাতে। শুনলাম, লন্ডনে নিযুক্ত আমাদের হাই কমিশনার এবং দূতাবাসের আরো দু-একজন কর্মকর্তা অনুষ্ঠানে আসবেন–সরকারবিরোধী বাঙালিরা তা চান না। হাই কমিশনার বা কর্মকর্তাদের অবশ্য বক্তৃতা দেওয়ার কথা নয়, তারা শ্রোতা হিসেবে যোগ দেবেন, কিন্তু তাও অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
গ্রেপ্তারের সংবাদে মনটা আরো বেশি খারাপ হলো। তবু যথাসময়ে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলাম।
লন্ডনে তখন আমাদের হাই কমিশনার জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ। তাঁর সঙ্গে এসেছেন ডিফেনস অ্যাটাশে কর্নেল আমসা [এ এম এস এ] আমিন–প্রতিবাদীদের আপত্তি মূলত তাকে নিয়েই, আরো দু-একজন কর্মকর্তা। ডা. বি বি চৌধুরী চাইছেন যতটাসম্ভব আমার সরকারবিরোধী ভাবমূর্তি বড়ো করে তুলে দিতে। আমাকে মঞ্চে আহ্বান করার সময়ে তিনি প্রবল আবেগাক্রান্ত হয়ে আমার পরিচয় দিলেন এবং বলে ফেললেন, ‘গণতন্ত্র-প্রতিষ্ঠার জন্যে যিনি প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছেন, সেই ড. আনিসুজ্জামান। প্রাণ ধারণ করে আছি বলে সেই মুহূর্তে যতটা লজ্জিত হয়েছিলম, বোধহয় তার আগে বা পরে আর কখনো ততটা হইনি।
বক্তৃতাটা উতরে গেল। একুশে ফেব্রুয়ারির কথা বললাম, ভাষা-সংস্কৃতির কথা বললাম, গণতন্ত্রের অপরিহার্যতার কথা, দেশে গণতন্ত্রের জন্যে সংগ্রামের কথা বললাম। প্রতিবাদীরা সমগ্র অনুষ্ঠানে আপত্তির কিছু খুঁজে পেলেন না।
আমার আগে গোলাম মুরশিদ বক্তৃতা করেছিল। তার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েই কেতকী কুশারী ডাইসন এসেছিলেন অক্সফোর্ড থেকে। অনুষ্ঠানের পরে আমরা তিনজন চা খেতে বসেছিলাম একটা রেস্টুরেন্টে। কেতকী বললেন, সবাই যখন আপনাকে সার বলে, আমিও তাই বলব। তারপর তার রবীন্দ্রনাথ ও ভিকটোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে বইটি উপহার দিলেন আমাকে, তাতে কৌতুকচ্ছলে আমাকে সম্বোধন করলেন স্যার/ আনিসুজ্জামান বলে। ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠানের পালা চুকল। এবারে আমার চিকিৎসার উদ্যোগ।
৯.
১৯৮৬ সালের একেবারে শেষদিকে আমার হৃদযন্ত্রের গোলযোগ ধরা পড়ল। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর চিকিৎসাধীন থাকলাম। বিলেত যাওয়ার আগে তার কাছ থেকে আমার স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সংক্ষিপ্তসার লিখিয়ে নিলাম। সেটা সেখানকার চিকিৎসককে দেখাতে হবে। ডা. চৌধুরী বলে দিলেন, লন্ডনের পরীক্ষায় সম্ভবত একটা ব্লক ধরা পড়বে।
ড. কামাল হোসেন পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, লন্ডনে গিয়ে যেন তার বোন আহমদীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। আহমদীকে ফোন করতেই তিনি বললেন, কিংস হসপিটালে ডা. জ্যাকসনের সঙ্গে আমার অ্যাপয়ন্টমেন্ট করে রেখেছেন। আমি যেন যথাসময়ে তার সঙ্গে দেখা করি। একটু বিব্রত হলাম। কেননা ডা. বি বি চৌধুরী বলে রেখেছেন, আমাকে নিয়ে আরেক ডাক্তারের কাছে যাবেন। তিনি অবশ্য এখন বললেন যে, ডা. জ্যাকসন নামকরা চিকিৎসকতার মতামত কাজে আসবে।
প্রাথমিক পরীক্ষার পরে ডা. জ্যাকসন জানালেন, আমার অ্যানজিওগ্রাম করা দরকার–তারপরই কেবল বলা যাবে কী ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন হবে।
ডা. বি বি চৌধুরী এবারে আমাকে নিয়ে গেলেন ডা. মার্টিন রথম্যানের কাছে। তিনিও নানারকম পরীক্ষা করতে দিলেন। যে-তরুণীটি এক্স-রে করলো, সে খুবই সুন্দরী। আমাকে নির্দেশ দিলো, আমি বললেই শ্বাস বন্ধ করে রাখবে খানিকক্ষণের জন্যে। বললাম, তোমাকে বলতে হবে না, তুমি ঘরে ঢুকলেই আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ে আর কী!
ডা. রথম্যান শেষে একই কথা বললেন, অ্যানজিওগ্রাম করতে হবে। শফিউল্লাহর সঙ্গে পরামর্শ করে এবং বাড়িতে কথা বলে ঠিক করলাম, তারই কাছে অ্যানজিওগ্রাম করবো। তিনি আসতে বললেন স্টেপনি গ্রিনের কাছে লন্ডন ইনডিপেনডেন্ট হসপিটাল নামে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে।
ইত্যবসরে তসন্দুক আহমেদের আয়োজনে একুশে ফেব্রুয়ারি-উপলক্ষে আয়োজিত এক সভায় বক্তৃতা দিয়েছিলাম পূর্ব লন্ডনে। সেখানে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক শ্রোতা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পক্ষে, তাহলে বলেন, আমরা সিলেটিরা কেন সিলেটিতে শিক্ষা নিতে পারবো না? আমি ভাষা ও উপভাষার পার্থক্য সম্পর্কে কিছু বলতে চাইছিলাম, কিন্তু তার আগেই তসদুক আহমেদ–তিনি সভাপতিত্ব করছিলেন–বলে দিলেন, আপনাকে এ-প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না। তারপর প্রশ্নকর্তাকে বললেন, ‘এ-বিষয়ে অন্য কোনো সময়ে আলোচনা হবে। প্রশ্নকর্তা খুশি হলেন না। সভাশেষে আমি তসন্দুক আহমেদকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি তো ভদ্রলোকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম–আপনি বাধা দিলেন কেন? উনি বললেন, আপনি উত্তর দিলে আলোচনাটা সেখানেই থামতো না–অন্যদিকে গড়াতে থাকতো। আমি ওকে জানি।’
পরে তসদুক আহমেদ ফোন করে জানান, ওই বক্তৃতা বাবদ আমার কিছু সম্মানী প্রাপ্য হয়েছে। কাউকে পাঠিয়ে আমি যেন আনিয়ে নিই।
যেদিন হাসপাতালে গেলাম, শফি ছিলেন সঙ্গে। তাকে বললাম, আমি অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে গেলে তিনি যেন তসন্দুক আহমেদের কাছ থেকে সম্মানীটা নিয়ে আসেন। তাঁর অবস্থান হাসপাতালের কাছেই।
হাসপাতালে আমাকে একটা কেবিন বরাদ্দ করা হলো। পোশাক পালটে রক্ত ইত্যাদির নমুনা দিয়ে খানিক বিশ্রাম। তারপর হুইল চেয়ারে করে অপারেশন থিয়েটারে যাওয়া।
ডা. রথম্যান বুঝিয়ে বললেন, হাতের যেখানটা আমরা ভাজ করি, সেখানে একটু কেটে ধমনী দিয়ে একটা তার ও ডাই, একটু গরম বোধ হবে, ঢুকিয়ে দেবেন–যে-কোনো পর্যায়ে ব্যথা পেলে বা অস্বস্তিবোধ হলে তাঁকে যেন জানাই। আমাকে লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হবে, সুতরাং আমার জ্ঞান থাকবে–পাশে মনিটরের দিকে তাকালে আমার কী হচ্ছে তার ছবি দেখতে পাবো।
ছবি মোটেই চিত্তাকর্ষক নয়–তাই দেখতে ইচ্ছে হলো না। একটু ঘোর-ঘোর ভাব ছিল। একবার বোধহয় অনিচ্ছায় হাত টেনে নিয়েছিলাম। ডাক্তার খুব ব্যগ্রভাবে জানতে চাইলেন, আমার কষ্ট হচ্ছে কি না। বললাম, ও কিছু না। তিনি বললেন, তাঁকে জানাতে যেন ইতস্তত না করি। তারপর আমার কাছে সব অস্পষ্ট।
ট্রলিতে করে আমাকে কেবিনে ফিরিয়ে আনা হলো। ডাক্তার জানালেন খানিক পরে তিনি আসবেন কথা বলতে।
কেবিনে পাংশুমুখে শফি দণ্ডায়মান। জানতে চাইলাম, টাকা আনতে গিয়েছিলেন কি না। তিনি ধমকে উঠলেন, রাখেন আপনার টাকা। আমি আপনার চিন্তায় অস্থির–আর আপনি ওই কটা টাকার কথা ভাবছেন!’
ডা. রথম্যান জানালেন, একটা ব্লক পাওয়া গেছে। তার মতে, অ্যানজিওপ্লাস্টি করানো দরকার। আমি সম্মত হলে তিনি ব্যবস্থা করবেন। বললাম, দু-একদিনে জানাবো আপনাকে।
বিশ্রাম সেরে শফির বাসায় ফেরা। শফি খুবই চিন্তিত। আমি ভাবছি, অতটা খরচ করবো কীভাবে।
বাড়ির সকলের মত, চিকিৎসা করেই ফেরা ভালো। আমার ভাগ্নে মামুন তখন সউদি আরবে। সে বললো, সে কিছু টাকা পাঠাচ্ছে–চিকিৎসা যেন হয়। টাকা অনেক লাগবে। শফি চেনাজানা সকলকে ফোন করে চাদা তুলতে শুরু করলেন। ওসমান জামাল, সিরাজুর রহমান, শফিক রেহমান, শামসুদ্দীন আহমদ মানিক (পরে হাইকোর্টের বিচারপতি), আরো কেউ কেউ চেক পাঠালেন। প্রয়োজন অবশ্য অনেক বেশি। কথাটা চাউর হতে এক-আধটা অপ্রিয় মন্তব্যও কানে ভেসে এলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এ কে নাজিরউদ্দীন আহমদ তখন বিসিসিআই ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত। তিনি দেশ থেকে লন্ডন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরছিলেন সস্ত্রীক। কার কাছে খবর পেয়ে শফিকে ফোন করলেন–আমাদের দুজনকে লাঞ্চে আমন্ত্রণ জানালেন তার হোটেলে।
খেতে খেতে আমার স্বাস্থ্যের খবর নিলেন, ডাক্তারের মতামত শুনলেন, চিকিৎসার সম্ভাব্য ব্যয়ের পরিমাণ জানতে চাইলেন। শেষে বললেন, আমার আপত্তি না থাকলে পুরো খরচটা তিনি বিসিসিআই ফাউন্ডেশনকে বহন করতে বলবেন। আমাকে কিছুই করতে হবে না, কোনো আবেদনও নয়। ফাউন্ডেশনকে তিনি লিখবেন, শফি আমার হয়ে চেক গ্রহণ করবেন, শুধু ব্যয়সংক্রান্ত সকল রসিদপত্র ফাউন্ডেশনকে পাঠিয়ে দিতে হবে।
আমি একেবারেই হতবাক। নাজিরউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমার পরিচয় এতটা ঘনিষ্ঠ নয় যে আমার চিকিৎসার দায়দায়িত্ব তাঁকে ঘাড়ে তুলে নিতে হবে। আমি যে-পরিস্থিতিতে ছিলাম তাতে বললে অর্থ-সাহায্যের জন্যে আবেদন করতে আমি যে খুব ইতস্তত করতাম, তা নয়। কিন্তু আমার সম্মান তিনিই রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন। এসব বিষয়ে তিনি আগেই ভেবে রেখেছিলেন। তার ব্যবহারে আপ্লুত না হয়ে উপায় ছিল না।
ঘরে ফিরে শফি পাওয়া চেকগুলো ফেরত দিতে শুরু করলেন। প্রত্যেককেই দীর্ঘ কৈফিয়ত দিতে হলো। নাজির ভাই যদিও বলে দেননি, তবু শফি ও আমি বিসিসিআই ফাউন্ডেশনের নামটা প্রচার না করারই সিদ্ধান্ত নিলাম। ফলে, যাদের সাহায্য ধন্যবাদের সঙ্গে ফেরত দেওয়া হলো, তাঁদের সবার মনে নিশ্চয় এই প্রশ্ন জেগেছিল যে, হঠাৎ করে এত অর্থের সংস্থান কীভাবে হলো।
ডা. বি বি চৌধুরী খুব খুশি। তিনি চেয়েছিলেন সম্পূর্ণ চিকিৎসা করে আমাকে ফেরত পাঠাতে। কাজটা হবে কি না, এমন সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। এখন মনে হলো, তরী তীরে ভিড়বে। তার উৎসাহে জোয়ার এসে গেল।
নির্দিষ্ট দিনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া গেল। শফির চিন্তা বাড়ছে–আমার ভালোমন্দের সকল দায় তাঁর। আমার কিছু ঘটে গেলে আমার পরিবারকে কী কৈফিয়ত দেবেন!
ভর্তির সময়ে মাসিমাকে নিয়ে বুলু এলো। আমাকে সাহস জোগাবার দরকার ছিল না, তা সে জানতো। তবু মৃদুকণ্ঠে বলতে চেষ্টা করলো যে, অ্যানজিওপ্লাস্টি ব্যাপারটা শক্ত কিছু নয় এবং যদিও আপকালে সাহায্যের জন্যে সার্জনদের একটা টিম তৈরি রাখা হয় অপারেশন থিয়েটারে (বলা বাহুল্য, রোগীর খরচে), তবু তেমন কিছুর দরকার হয় না সচরাচর।
প্রাইভেট হাসপাতাল–প্রায় পাঁচতারা হোটেলের মতো। সন্ধ্যায় মেনু নিয়ে এলো একটি মেয়ে–চঞ্চল বালিকাই বলা চলে–সঙ্গে ওয়াইন লিস্ট। রোগশয্যায় ওয়াইন খাওয়ার স্পৃহা নেই, খাবারের তালিকা দেখছি মনোযোগ দিয়ে। মেয়েটির আর তর সয় না। জিজ্ঞেস করলো, সে কিছু পরামর্শ দিতে পারে কি না। হেসে বললাম, শুনি তোমার সুপারিশ। সে বললো, তোমার যা যা খাওয়া নিষেধ–সব খেয়ে ফেলো, কাল তো অপারেশন হচ্ছে। তার সরলতা দেখে এবার জোরেই হেসে ফেললাম।
পরদিন অ্যানজিওপ্লাস্টি–বেলুনিং কথাটারই চল বেশি, তখনো স্টেনটিংয়ের প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়নি। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার মুখে শফির কাছে আমার পকেট-চিরুনিটা চাইলাম। শফি বিরক্তির সঙ্গে জানতে চাইলেন, এখন চিরুনি দিয়ে কী করবেন?
বললাম, চুলটা একটু আঁচড়ে নিই, ও টি-তে যদি সুন্দরী নার্স থাকে!
শফির চিন্তাক্লিষ্ট মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটলো।
শিক্ষক প্রশ্ন করেছিলেন ছাত্রকে : ‘গভীর অরণ্যে প্রবেশ করে তুমি সামনে দেখতে পেলে বাঘ। তোমার সঙ্গে কেউ নেই, হাতে কোনো অস্ত্র নেই। এই অবস্থায় তুমি কী করবে?’ ম্লানমুখে ছাত্র উত্তর দিয়েছিল : আমি আর কী করবো সার, যা করার তা বাঘই করবে!
ও টি-তে ঢুকে আমারও কিছু করার ছিল না, যা করার ডাক্তারই করলেন এবারে আমাকে অজ্ঞান করে।
জ্ঞান যখন ফিরলো, তখন আমি কেবিনের বিছানায়। দেখি, শরীরে নানারকম তার লাগানো আর আমার পা-দুটো দুহাতে ধরে আছে ঊর্মি–ঊর্মি মজহার, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার ছোটো বোন। ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন, আমি যেন পা না নাড়াই–সে দায়িত্ব নিয়েছে ঊর্মি। তার সঙ্গে এসেছে ফারুক হায়দার–সেই পরিচয় হলো। অদূরে ম্লানমুখে শফি। আমার জ্ঞান ফিরে এসেছে দেখে বললেন, আমি বাসায় গিয়ে বরঞ্চ ভাবিকে টেলিফোন করি।’
ঢাকায় আমার ফ্ল্যাটে বাড়ির সবাই ছাড়াও আত্মীয়স্বজনের ভিড়। শফির টেলিফোন পেয়ে সবার স্বস্তিবোধ হলো।
আমার কেবিনে শর্ট-সার্কিট টিভি ক্যামেরা। কয়েকটা মাত্র কেবিনের মনিটর করছে তিন-চারজন নার্স। কখনো অস্ফুট আওয়াজ করেছি। লাউডস্পিকারে প্রশ্ন ভেসে এলো, ‘ইয়েস মিস্টার জামান, এনি প্রবলেম?
অমন সেবা-শুশ্রূষা কখনো পাইনি–আগেও নয়, পরেও নয়। যখন দাড়ি কামালাম, নার্স সামনে আয়না ধরে থাকলো। যেদিন গা মোছার অনুমতি পাওয়া গেল, সেদিন নার্স বাথরুমে নিয়ে গিয়ে সর্বাঙ্গ স্পঞ্জ করে দিল। কেবিনে-কেবিনে ম্যানিকিউরিস্ট ঘুরে যাচ্ছে–বাড়তি পয়সা দিয়ে নখ কাটবো কি না জানতে। পথ্যবিদ এলেন পরামর্শ দিতে। কথা বললেন অনেকখানি সময় নিয়ে। একটা ছাপানো কাগজ দিলেন মহিলা। বললেন, এ-কাগজে লেখা আছে কোনটা তোমার খাওয়া উচিত, কোনটা অনুচিত। তবে আমরা তো সামাজিক জীব–সবসময়ে নিয়ম ধরে চলা যায় না। একবেলা যদি অনিয়ম হয়ে যায়, আরেক বেলায় সেটা পুষিয়ে নিও। তুমি নিজেই বুঝবে কী তোমার করণীয়।
ডাক্তার এসে জানালেন, তাঁর কাজ সফল হয়েছে, এখন আমার ছুটি। বললেন, আজ বিকেলে ক্লান্তিবোধ না হওয়া পর্যন্ত তুমি হাঁটবে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত প্রত্যেকদিন হাঁটবে–এর ব্যত্যয় করা চলবে না।
হাসপাতাল থেকে বের হবার ঠিক আগে জেনারেল শফিউল্লাহ্ দেখতে এলেন। সঙ্গে হাই কমিশনের আরো দু-তিনজন। জেনারেল শফিউল্লাহ্ অভিজ্ঞ রোগী–তিনি বাইপাস করিয়েছেন, তারপর অ্যানজিওপ্লাস্টিও। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, বাইপাসের পরে আবার অ্যানজিওপ্লাস্টি কেন? তিনি বললেন, ‘একাধিক ব্লক থাকায় বাইপাস করা হয়েছিল, তারপর আবার একটি আর্টারিতে ব্লক দেখা দিলো–তখন অ্যানজিওপ্লাস্টি।’
তখনই বুঝতে পারলাম, আমি যে অ্যানজিওপ্লাস্টি করলাম–সেটাই নিরাময় নয়। এ-পথেই আবার হাঁটতে হতে পারে।
হাই কমিশনের সবাই চলে যাওয়ার পরে সর্দার নার্স এলেন। বললেন, তুমি, মনে হয়, তোমার দেশের গুরুত্বপূর্ণ লোক।
কেন?–পালটা প্রশ্ন করি।
নাহলে সদলবলে হাই কমিশনার দেখতে আসে!
বলি, ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আছে–তাই এসেছিলেন। আমি গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই।
তিনি হাসেন। বলেন, আমরা ঠিকই বুঝতে পারি, কখন কাকে কেন কোনো উচ্চ পদাধিকারী দেখতে আসে!
হাসপাতাল থেকে আনন্দিতচিত্তে শফির বাড়ি পৌঁছোলাম। সেই বিকেলেই শফি নিয়ে গেলেন ব্রেনট ক্রস শপিং সেন্টারে। বললেন, ‘হাঁটাহাঁটিটা এখান থেকেই আরম্ভ হোক। কিছু কেনাকাটার থাকলে তাও করে নিতে পারেন।’
একটা সুটকেস কিনে ফিরলাম।
পরদিন বাড়িতে অনেকে এলেন দেখতে। প্রত্যাশিতভাবে রোজী, অপ্রত্যাশিতভাবে আনোয়ারা সৈয়দ হক। আরো অনেকে।
ডা, মার্টিন রথম্যান ফোন করে জানালেন, একটা কনফারেসে তিনি আমেরিকায় যাচ্ছেন। আরেকজন ডাক্তারের নাম ও ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, কোনো অসুবিধে হলে যেন তাকে ফোন করি। অসুবিধে হবে ভাবিনি, কিন্তু হলো। জ্বর এলো এবং ছাড়তে চাইলো না। বদলি ডাক্তারকে খবর দেওয়া হলো, সুবিধেজনক সাড়া পাওয়া গেল না।
মাসিমাকে নিয়ে বুলু এলো দেখতে। বললো, ‘চলো আমার বাড়িতে। কাল অন্য ডাক্তার দেখাবো।’
রাতটা তার ওখানে কাটিয়ে পরদিন অন্য ডাক্তারের কাছে গেলাম বুলুর সঙ্গে। তিনি বুলুকে বললেন, তুমি জানো আমি প্রাইভেট রোগী দেখি না। আমি পরামর্শ দিতে পারবো না–দেওয়াটা উচিত হবে না। তুমি হাসপাতালের ডাক্তারের কাছেই রোগীকে নিয়ে যাও।
বুলু তাই করলো। এবারে বদলি ডাক্তার একটু নড়েচড়ে বসলেন। কিন্তু কী যে করবেন, সে-সম্পর্কে তাঁকে নিশ্চিত মনে হলো না। ওষুধ দিলেন বটে, তবে যেন দ্বিধার সঙ্গে।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য জ্বর গেল–সেটা এমনিতে হোক অথবা ওষুধের গুণে হোক। তবে রোগীর প্রতি আগ্রহ ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে, রোগীর আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে, নিশ্চিত হয়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে জনে-জনে যে পার্থক্য ঘটে, তার পরিচয় আবার পেলাম।
১০.
শফির ফিলিপিনা মেড বললো, আপনাকে শওকত নামে একজন ফোন করেছিলেন। বললেন, আগরতলায় তার সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছিল। ফোন নম্বর দিয়েছেন, কথা বলতে বলেছেন।
আগরতলায় যে-শওকতের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তিনি অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী ছাড়া আর কেউ নন। তিনি যুক্তরাজ্যে আমাদের সাবেক হাই কমিশনার, জার্মানিতে সাবেক রাষ্ট্রদূত। কিন্তু কাছের পরিচয়টা না দিয়ে আগরতলার কথা কেন বললেন?
ফোন করে সেটাই প্রথমে জানতে চাইলাম। মীর শওকত আলী হাসলেন। বললেন, ‘আগরতলায়ই তো আপনার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল। আর আমার তখনকার পরিচয়ই তো আসল পরিচয়। পরেরগুলো যেমন এসেছে, তেমনি গেছে।
তিনি ফোন করেছিলেন আমি কেমন আছি, তা জানতে। যদি ভালো থেকে থাকি, তাহলে দু-একদিনের মধ্যে তাঁর সঙ্গে লাঞ্চ খেতে পারি কি? অনেক দিন দেখা হয় না, অনেক কথা জমে আছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কেও তিনি আমার কাছে শুনতে চান।
মীর শওকত মুক্তিযুদ্ধের পরে চট্টগ্রামের জিওসি হয়েছিলেন। তখন তার সঙ্গে মাঝেমাঝে দেখা হতো। টেলিফোনে কথা হতো তার চেয়ে বেশি। চট্টগ্রাম থেকে তিনি বদলি হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। এতদিন পর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তিনি আমার খবর নিচ্ছেন, তা আমার জন্যে আনন্দের বিষয়।
আমি যেখানে থাকি, সেখান থেকে জেনারেল শওকতের বাসস্থান একটু দূরে। টিউব বদলে যেতে হয়। যতক্ষণে পৌঁছোবো ভেবেছিলাম, তার চেয়ে বেশি সময় লেগে গেল। তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডের নিষ্ক্রমণপথে অপেক্ষা করছেন, প্রতিবার ট্রেন এলেই যাত্রীদের দিকে নজর রাখছেন। দুপুরে খাওয়ার সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, চা-কফি কিছু একটা খেয়ে নিয়ে প্রতীক্ষার ক্ষণ পার করছেন তিনি। আমি ট্রেনে বসে অথবা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে উৎকণ্ঠিত-সময়মতো পৌঁছোতে পারছি না, ওঁকে তা জানাতেও সমর্থ হচ্ছি না।
স্টেশনে পৌঁছে মাফ চাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। মীর শওকতের গাড়িতে তার বাড়ি আসা গেল। তিনি বললেন, আপনার পরিচিত একজনকে আসতে বলেছি। সে বলেছে, আপনি পৌঁছোলে খবর দিতে–চলে আসবে শিগগির।
ফ্রিজ থেকে খাবার-দাবার বের করে উনি নিজেই সব গরম করতে লাগলেন। টেবিলও সাজালেন। এর মধ্যে চলে এলো আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু জিয়াউল হক ওরফে টুলুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা-সিরাজুল হক ওরফে দুলু। তাকে আমি। অনেককাল চিনি, সে শওকতের বিশেষ বন্ধু। খেতে খেতে দেশের কথা উঠলো। দুলু মূলত শ্রোতা–আমরা দুজনই কথা বলছি।
বন থেকে ফিরে জেনারেল লন্ডনেই আছেন। এ-মুহূর্তে দেশে ফেরার কথা ভাবছেন না। তবে দেশের কল্যাণের জন্যে এরশাদ-সরকারের যে-পতন হওয়া দরকার, তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই। অনির্দিষ্টকাল তিনি এ দেশে থেকে যেতে পারবেন না, তবে এই সরকারের কালে দেশে ফিরতে চান না। ফিরলে সরকার-পতনের আন্দোলনেই তিনি যোগ দেবেন। বললাম, সরকারবিরোধী আন্দোলন দিনে দিনে তীব্র হচ্ছে, খুব বেশিদিন এরা ক্ষমতায় থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। দেশে ফিরে তিনি প্রকাশ্যে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
জেনারেল শওকত স্পষ্ট করে কিছু না বললেও আমার মনে হলো, রাজনীতিতে প্রবেশ করলে তিনি সম্ভবত বিএনপিতেই যোগ দেবেন।
তাঁর স্ত্রী বোধহয় খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এতক্ষণ। এখন আমাদের চা খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শওকত তার গাড়িতে আবার স্টেশনে পৌঁছে দিলেন–আমাদের সঙ্গে দুলু।
১১.
এবার লন্ডনে আসার ঠিক আগে বড়ো দুলাভাইকে হারালাম। সে-কথা বলার আগে আরো কয়েকটি মৃত্যুর কথা বলতে হয়।
জীবন ও মৃত্যুর বাস, মনে হয়, পাশাপাশি ঘরে। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে সময় লাগে না। কেবল পরের ঘর থেকে আগেরটায় ফেরা যায় না।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে আসার পরে প্রথম যে-মৃত্যু আমাকে আঘাত করে, তা আমার বাল্যবন্ধু নেয়ামাল বাসিরের। তখনো স্বামীবাগে থাকি। রাতে (৩০ নভেম্বর ১৯৮৫) টেলিভিশনের খবরে জানলাম, সে মারা গেছে এবং তার দাফন কাফন সব হয়ে গেছে। খুবই কষ্ট পেলাম। কষ্ট আরো বেশি এ-জন্যে যে, তার মৃত্যুসংবাদ আমাকে জানতে হলো টেলিভিশনের খবর থেকে কেউ আমাকে জানানো প্রয়োজন বোধ করলো না। নেয়ামাল বাসির, সৈয়দ আহমদ হোসেন ও আমি প্রিয়নাথ হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়তাম–সেই থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। আহমদও তার মৃত্যুসংবাদ পায়নি–আমার কাছ থেকেই জানলো।
স্কুলে থাকতেই নেয়ামাল–আমরা ওকে এ-নামেই ডাকতাম, যদিও ওর ডাকনাম ছিল বসির–কবিতা লিখতো এবং কবিতা অনুবাদ করতো। ওর আব্বার কাছ থেকে সে উর্দু ও ফারসি শিখেছিল। ম্যাট্রিকে উর্দুতে লেটার পেয়েছিল, আইএ-তে সে পড়ল ফারসি–তাতেও ভালো নম্বর পেয়েছিল। আমার এক বছর পর আইএ পাশ করে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। বিভাগের অধ্যক্ষ ড. শহীদুল্লাহ সকল ছাত্রকেই ইংরেজি সাবসিডিয়ারি নিতে উৎসাহ দিতেন, ওর ফারসি জ্ঞান দেখে তিনি বললেন, ইংরেজি ও ফারসি পড়তে। একসঙ্গে তিন সাহিত্য পড়ার নিয়ম ছিল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শহীদুল্লাহর বিশেষ চেষ্টায় অ্যাকাডেমিক কাউনসিল নেয়ামালকে এই অনুমতি দেয়। কিন্তু ইংরেজি যাদের পক্ষে কাল হয়, সে ছিল তাদের একজন। বেশ পরে সে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও এমএ পাশ করে।
স্কুলের ছাত্রাবস্থা থেকেই সে নিজের খরচ চালাতো। এক বাড়িতে জায়গির থাকতো, হাতখরচের টাকাটাও জোগাড় করতে হতো তাকেই। কলেজে উঠে থেকেছে মেসে, টিউশনি করেছে, কাগজে টুকটাক লিখে উপার্জন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে ফজলুল হক মুসলিম হলে আবাসিক হয়েছে, কাজ করেছে দৈনিক ও সাপ্তাহিক কাগজে। করাচিতে সে চলে যায় রেডিও পাকিস্তানের কাজ নিয়ে সেখানে সে সংবাদও পাঠ করতো। তারপর চাকরি নেয় সেখানকার ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটে–তাদের পত্রিকা-সম্পাদনার কাজ। সেখান থেকে জাতীয় পরিষদের দোভাষী হয়ে চলে যায় রাওয়ালপিন্ডিতে, তারপর ঢাকায় বদলি হয় জাতীয় পরিষদের সহকারী বিতর্ক সম্পাদক হয়ে। ১৯৭২ সালে সে বাংলাদেশ গণপরিষদের বিতর্ক সম্পাদক পদে উন্নীত হয়।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে, কলেজের ছাত্রাবস্থায়, নেয়ামাল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গ্রেপ্তার হয়। জেল থেকে বেরিয়ে সে আমাদের বাড়িতে ওঠে, কয়েকদিন পরে তাদের মেস খুললে সেখানে ফিরে যায়। ভাষা-আন্দোলনের সময়ে সে বাংলাভাষার দাবির পক্ষে অনেক জায়গায় উর্দুতে বক্তৃতা করে। পরে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার সময়েও তার একটা প্রধান দায়িত্ব ছিল উর্দুতে বক্তৃতা করা। সে একসময়ে ঢাকা টেলিভিশনে উর্দু শিক্ষার আসর পরিচালনা করতো। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এ-নিয়ে সে বিড়ম্বিত হয়। কর্তৃপক্ষ তাকে সন্দেহের চোখে দেখতো, আবার মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউও তাকে সরকারের লোক মনে করতো।
বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা ভাষ্য রচনার দায়িত্ব পেয়ে আমি নেয়ামালকে সঙ্গে নিই এবং তার পরামর্শক্রমে তার এক সহকর্মীকেও আমাদের দলভুক্ত করি। তার ভাষাজ্ঞান এবং সংসদীয় রীতিনীতির অভিজ্ঞতা সংবিধানের বাংলা করার কাজে আমাদের বড়ো সহায় হয়। সে বারবার বলতো, বাংলা শব্দ উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করার যে-সুযোগ আমরা পেয়েছি, তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। তবে সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির সদস্যেরা অনেকক্ষেত্রে প্রচলিত ইংরেজি পরিভাষা রক্ষা করার পক্ষপাতী ছিলেন, তাই আমাদের সকল প্রস্তাব তারা মেনে নেননি। ন্যায়পালের মতো অনেকগুলো পরিভাষা ছিল নেয়ামালেরই উদ্ভাবন। ভাষাব্যবহারে সে খানিকটা রক্ষণশীল ছিল এই অর্থে যে, মূল ইংরেজিতে বহুবচন থাকলে বাংলায়ও বহুবচন-ব্যবহার সে আবশ্যক বিবেচনা করতো। যেমন, পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্সের বাংলা সে করেছিল সংসদীয় বিষয়াবলী। আমার মতে, এখানে বিষয় বললে চলে, বিষয়াবলি বলার দরকার হয় না। তার যুক্তি ছিল এই যে, ইংরেজি ও বাংলা দুই পাঠের সামঞ্জস্য রক্ষার জন্যে ব্যাকরণগত গঠন একরকম হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমি তার কথা মেনে নিয়েছিলাম।
পরবর্তীকালে নেয়ামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় ও ফারসিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেছিল। ফারসিতে সে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল। আরো পরে ইরানের মাশহাদের ফিরদৌসি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদেশি ছাত্রদের জন্যে ফারসি ভাষার পরীক্ষায়ও সে খুব ভালো ফল করেছিল। দেশে ফিরে তার ইচ্ছে হয়েছিল সরকারি চাকরি ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার। ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সে-সুযোগ না পেয়ে সে আমাকে একবার বলেছিল যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ পেলে সে ঢাকা ছেড়ে যেতে দ্বিধা করবে না–যদিও এখানে বেতারকেন্দ্র এবং অন্যান্য সূত্র থেকে তার রোজগার ছিল বেশ ভালো। আমি এ বিষয়ে চেষ্টা করি। তার সকল যোগ্যতা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ আনুকূল্য করেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তার অনূদিত সাজ্জাদ জহিরের উপন্যাস লন্ডনে এক রাত কলকাতার র্যাডিকাল বুক ক্লাব প্রকাশ করে ১৯৫৬ সালে। তাতে আমরা সবাই যে কতটা আনন্দিত হয়েছিলাম, তা বলা যায় না। ঢাকা থেকে তার একাধিক অনুবাদ এর আগে-পরে প্রকাশিত হয়েছিল, অনুবাদকর্মের জন্যে সে বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছিল। শেষকালে দুরারোগ্য ব্যাধি তাকে গ্রাস করে। চট্টগ্রাম থেকে এসে পিজি হাসপাতালে যখন তাকে দেখতে গেছি, তখনো তার মনোবল অটুট ছিল, তবে শেষ পর্যন্ত তাকে হার মানতে হয়।
নেয়ামালের মৃত্যুর পরদিন যখন তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাই, তখন তার স্ত্রী আভা লজ্জিতমুখে বলেছিলেন, আমি যে ঢাকায়, সে-কথা তাঁর মনে ছিল না। চট্টগ্রাম থেকে আমি ফিরে এসেছি তখন তিন মাসের কিছু বেশিদিন মাত্র। তাঁকে আমি দোষ দিইনি। নেয়ামালের ইচ্ছানুসারে আজিমপুর কবরস্থানে সাধারণ কবরে তাকে সমাধিস্থ করা হয়–সে কোনো চিহ্ন রেখে যেতে চায়নি বলে। পরে তার বড়োভাই নেয়ামাল ওয়াকিল আমাকে বলেছিলেন, ওর কবরটা পাকা করা যায় কি না, সে-চেষ্টা করে দেখতে।
আমি আর সে-চেষ্টা করিনি–খানিকটা তা নিষ্ফল হবে ভেবে, খানিকটা নেয়ামালের ইচ্ছার বিরুদ্ধ কিছু করতে চাইনি বলে।
এর কয়েকমাস পরে মৃত্যুবরণ করেন বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন। তাঁদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিল, বেবীদের পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা ছিল নিকটতর, তবে আমি তাকে চিনেছিলাম আমার বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেনের অগ্রজ হিসেবে। আমরা যখন স্কুলে পড়ি, তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ এবং আইন পড়েন। তখনই তার খ্যাতি ছিল আবৃত্তিকার হিসেবে এবং বেতার ও মঞ্চের অভিনেতা হিসেবে। বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশেও অভিনয়ের জন্যে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন, কিন্তু চলচ্চিত্রের জন্যে প্রয়োজনীয় আলোক প্রভৃতির উত্তাপে বিব্রত হয়ে তিনি আর তার কাজ শেষ করতে পারেননি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ঝুঁকেছিলেন বামপন্থার প্রতি। ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনের অব্যবহিত পরে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন গণতন্ত্রী দল প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি হন তার প্রচার-সম্পাদক। পরিণামে, ১৯৫৪ সালে প্রদেশে ৯২ক ধারার শাসন জারি হলে, তিনি কারারুদ্ধ হন। পরের বছরে বুলবুল ললিতকলা একাডেমী-প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং পরে তার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেন। তিনি পাকিস্তান আর্টস কাউনসিল পূর্বাঞ্চল শাখারও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা হাইকোর্টে বিশ বছর আইনব্যবসার কালে তিনি জড়িত ছিলেন অর ডিগনাম অ্যান্ড কোম্পানি নামের আইন-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ১৯৭৪ সালে তিনি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিযুক্ত হন। তিনি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং ইন্টারন্যাশনাল ল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে দীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন। এরশাদের শাসনকালে বিভিন্ন জেলা শহরে হাইকোর্টের আসন স্থাপিত হলে তিনি রংপুরে নিয়োগলাভ করেন। তিনি ছিলেন এই ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী। বঙ্গবন্ধু-হত্যার প্রতিবাদ এবং সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে তিনি নানা ক্ষেত্রে বক্তৃতা দিয়েছেন। ফলে ১৯৮৪ সালে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের এক আদেশবলে বিচারকের পদ থেকে তিনি অপসৃত হন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক, তাঁর জীবনযাপনপ্রণালি ছিল খুবই সাদাসিধে। রঙ্গব্যঙ্গে তাঁর দক্ষতা ছিল স্বভাবজ–আসর জমাবার এমন নৈপুণ্য খুব কমই দেখা যায়।
১৯৮৬ সালের ২ এপ্রিলে টেলিফোনে কথা বলতে বলতে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে বাড়ির কাছে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। খবর পেয়ে বেবী ও আমিও সেখানে দ্রুত পৌঁছেই, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে।
পর বছর আমার মেজো দুলাভাই সৈয়দ আলী হোসেনের জীবনাবসান ঘটে।
মেজোবুর যখন বিয়ে হয়, তখন আমার বয়স আট বছর। মেজো দুলাভাইয়ের আধুনিক জীবনযাপন-পদ্ধতি আমাকে খুব আকৃষ্ট করেছিল। তিনি আমাকে কলকাতার খুব নামি হোটেলের দামি রেস্টুরেন্টে একাধিকবার খাইয়েছেন, ট্যাকসি করে বেড়াতে নিয়ে গেছেন গঙ্গার ধারে। আমার প্রতি তাঁর বিশেষ স্নেহ ছিল। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে আমার দরকারি অথচ ঢাকায় দুষ্প্রাপ্য অনেক বই তিনি বন্ধুবান্ধবকে দিয়ে কলকাতা থেকে আনিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আমি সরকারি আমলা হই, কিন্তু আমি শিক্ষকতার পেশা বেছে নেওয়ায় আমাকে ডাকতে শুরু করেন পণ্ডিতমশাই বলে। আমি বাংলা পড়ে বিদেশে গিয়ে কী গবেষণা করি বা কী সেমিনার সম্মেলন করি, তা ছিল তার কাছে খানিকটা জিজ্ঞাসা ও আনন্দমিশ্রিত বিস্ময়ের বিষয়। আমাকে এবং আমার স্ত্রী-সন্তানদের সবাইকে নিজে বাজার করে খাইয়ে। খুব আনন্দ পেতেন তিনি। ১৯৭০ সালে খুলনায় ইতিহাস পরিষদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে ড. হবিবুল্লাহ, ড. মল্লিক এবং অন্যান্য অতিথির সম্মানে তিনি। একটা রেস্টুরেন্টে বড়রকম ডোেজ দিয়েছিলেন।
মেজোদুলাভাই বেশ কিছুকাল ধরে ভুগছিলেন। তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটায়। ১৯৮৭ সালের জুন মাসে বেবী, বড়ো দুলাভাই ও আমি খুলনায় চলে গেলাম। তিনি বাড়িতেই ছিলেন। আমাদের দেখে খুশি হলেন। কথাবার্তা বলতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল, তবু বলতে থাকলেন। ২৭ তারিখে তিনি চলে গেলেন। খবর পেয়ে আমার ছোটোভাই আখতার খুলনায় গিয়ে পৌঁছোলো দাফন-কাফনের ঠিক আগে।
বৃহত্তর পরিবারের প্রতি তিনি কর্তব্যের অধিক করেছিলেন। তাঁর চেনাজানা অনেকের প্রতিও তাঁর আনুকূল্য ছিল। তাঁর মৃত্যুতে তাই শোকগ্রস্ত হয়েছিলেন তাঁর নিজের পরিবারের বাইরে অনেকে।
এর কিছুকাল পরে হঠাৎ করেই বড়ো দুলাভাইয়ের পাকস্থলীতে ক্যানসার ধরা পড়ল। যাকে বলে নীরব ঘাতক, তারই শিকার হলেন তিনি। কী যে করা যাবে, তা ভেবে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। চিকিৎসকেরা দুলাভাইকেই বললেন, তাঁরা অস্ত্রোপচার করতে চান, তার ফল ভালো হতে পারে, মন্দও হতে পারে। দুলাভাই সম্মতি দিলেন। তলপেট কেটেই জোড়া দিলেন শল্যবিদেরা–আর কিছু করার ছিল না। ১৫ ফেব্রুয়ারিতে রাতে তাকে দেখে বাড়ি ফিরেছি, বেবী রয়ে গেল হাসপাতালে বড়োবুর সঙ্গে। একটু পরই খবর পেলাম তিনি আর নেই।
বড়োবুর বিয়ে হয়েছিল ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে। বিয়ের পরে দীর্ঘকাল দুলাভাই আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আমরাও আবার ঢাকায় এসে তার সঙ্গে ছিলাম। অনেকদিন। এ-সবের মধ্য দিয়ে একটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল তো বটেই। তার ওপর, আব্বা বলতেন, বড়ো জামাইই তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র, দুলাভাইও সববিষয়ে কর্তব্যের অধিক করতেন। আব্বাকে কিছু বোঝাতে হলে আমরা দুলাভাইয়ের শরণাপন্ন হতাম। আমাদের পরিবারের সকল সিদ্ধান্তে তিনি শরিক ছিলেন। কতদিক দিয়ে যে আমাদের সাহায্য-সহযোগিতা-নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা বলে শেষ করা যায় না।
১৫ তারিখে দুলাভাই মারা গেলেন, ১৬ তারিখে আমার লন্ডনে যাওয়ার টিকিট সংগ্রহ করার কথা। যাবো কি যাবো না, এমন দোটানায় পড়ে গেলাম। উদ্ধার করলো বড়োবুই। বললো, তুমি যাও–সবকিছুর ব্যবস্থা যেখানে করা আছে, সেখানে না-যাওয়াটা ঠিক হবে না।
লন্ডনে আমি চিকিৎসা নিয়ে বেরোতে না বেরোতেই সেখানে গিয়ে সস্ত্রীক হাজির হলেন আমার মেজো ভায়রা তফাজ্জল আলী ওরফে মাখন। তিনি বেশ কিছুকাল ক্যানসারে ভুগছিলেন। কেমোথেরাপি নিয়ে তিনি গেলেন অক্সফোর্ড স্ট্রিটের নিকটে তার চাচির বাড়িতে। সেখানে শফি ও আমি কয়েকদিন আড্ডা জমালাম। বেশ ভালোই মনে হলো তাকে। আমি দেশে ফেরার পরে তিনিও ফিরলেন। শরীর খারাপ হওয়ায় আবার তাঁকে নেওয়া হলো লন্ডনে। সেখান থেকে তাগাদা এলো তার ছেলেমেয়েকে পাঠিয়ে দিতে। ওরা দুজনেই অল্পবয়স্ক। মাখনের একটা ব্যবসা ছিল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের জেনারেল সেলস এজেন্সি। সেই সুবাদে ছুটির দিনে ব্রিটিশ হাই কমিশনের ভিসা অফিস খুলিয়ে ওদের ভিসা দেওয়া হলো। ওরা চলে গেল এবং সৌভাগ্যক্রমে বাপ-মায়ের সঙ্গেই ফিরে এলো। কিন্তু মাখনকে ধরে রাখা গেল না। ১৯৮৮ সালের ২০ জুন তিনি চিরতরে চলে এলেন।
তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হলো সিলেটে–হজরত শাহজালালের দরগায় সমাধিস্থ করার জন্যে। তার পরিবারের সঙ্গে বেবী ও আমিও গেলাম। দাফন কাফন সেরে মাখনের বন্ধু অ্যাডভোকেট আবদুল ওদুদ খোন্দকার ও আমি ট্রেনে ঢাকায় ফিরে এলাম।
মাখন ছিলেন খুব বন্ধুবৎসল। নানা সময়ে অনেকের অনেক উপকার করেছেন। তার মৃত্যুতে বোঝা গেল, তারা তা ভোলেননি।
২.
সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমের একমাত্র সন্তান নিগার ফোনে বললো, নানা, আল্লু আপনাকে দু-তিনদিনের মধ্যে আসতে বলেছেন সকাল দশটা থেকে এগারোটার ভেতরে।
গিয়ে হাজির হলাম। বিচারপতি সায়েম বললেন, বঙ্গভবনে আমার শেষদিনগুলো নিয়ে একটা ছোটো বই লিখেছি। ভেবেছিলাম, বেঁচে থাকতে ওটা ছাপাবো না–আমার মৃত্যুর পরে ছাপাতে বলে যাবো। মৃত্যু যখন আসছে না, তখন বইটা প্রকাশের কথা ভাবছি। তোমাকে একজন প্রকাশক খুঁজে দিতে হবে–এমন প্রকাশক যে আমার ইচ্ছে-অনুযায়ী বইটা বার করবে।’
বললাম, প্রকাশক পেতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু বঙ্গভবনে শুধু শেষদিনগুলো নিয়ে লিখছেন কেন? পূর্বাপর ঘটনা বলছেন না কেন?
বিচারপতি বললেন, তোমাদের নিয়ে মুশকিল এই। যা আছে তা ছেড়ে যা নেই তা নিয়ে কথা বলতে শুরু করো।’
বললাম, সবাই জানতে চায়, কী অবস্থায় আপনি রাষ্ট্রপতি হতে সম্মত হলেন। তেসরা নভেম্বর-সাতই নভেম্বরের ঘটনা আপনি কীভাবে দেখেছেন। পরের দিকের ব্যাপারেও মানুষের আগ্রহ আছে। তাই বলছিলাম, সবটা যদি লিখতেন, তাহলে আমাদের ইতিহাসের বড়ো দলিল হয়ে থাকতো।
সাবেক রাষ্ট্রপতি বললেন, নিজের কথা লিখে যাবো কি না, সে-সম্পর্কে নিজের মনেই অনেক তর্ক করেছি। যতটুকু লেখা ঠিক মনে করেছি, তা-ই লিখেছি। এখন বলল, যেটুকু লিখেছি, তা ছাপার জন্যে প্রকাশক পাওয়া যাবে কি না। প্রকাশককে আমার শর্ত-অনুযায়ী বই ছাপতে হবে।’
বললাম, বই ছাপার শর্ত মোটামুটি স্ট্যান্ডার্ডাইজড। আপনার কি বিশেষ শর্ত আছে?
উনি বললেন, ‘আছে। তবে তা টাকা-পয়সাসংক্রান্ত নয়। এ-বই থেকে আমি কোনো রয়ালটি চাই না। আমি চাই, বইটা পেপারব্যাক হবে, এমন সাইজের হবে যা একজন পকেটে নিয়ে ঘুরতে পারে–ট্রেনে-বাসে বসে পড়তে পারে। বইটার দাম যথাসাধ্য কম রাখতে হবে–যাতে ইচ্ছে করলেই কেউ কিনতে পারে। ছাপাটা নির্ভুল হতে হবে। আমাদের প্রকাশকেরা বড্ড অযত্ন করে বই ছাপায়।
একটু থেমে বললেন, যাবার সময়ে ম্যানাসক্রিপ্টের একটা কপি নিয়ে যেও–তোমার জন্য করিয়ে রেখেছি। তোমার কোনো কমেন্ট থাকলে বোলো। কিন্তু যা লিখেছি, তার অতিরিক্ত ইনফরমেশন যোগ করতে বলবে না। তুমি আগে পড়ো। তারপর প্রকাশককে বইয়ের সাবজেক্টটা বোলো। যে রাজি হবে, তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। প্রকাশককে ম্যানাসক্রিপ্ট আমি দেবো–তোমার কপিটা হাতছাড়া করবে না।’
নিগারকে যখন এসব কথাবার্তার সারমর্ম জানালাম, সে বললো, :, আব্দুর বই পকেটে নিয়ে ঘোরার জন্য যেন সবাই বসে আছে! আপনি কাউকে আনরিজনেবুল রিকোয়েস্ট করতে যাবেন না।
প্রকাশক-নির্বাচনের বিষয়ে আমার চট্টগ্রামের সহকর্মী গোলাম মুস্তাফার পরামর্শ চাইলাম। সে সুপারিশ করলো হাক্কানী পাবলিশার্স তথা গোলাম মোস্তফার নাম। তাদের দুজনকে নিয়ে একদিন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির বাড়িতে গেলাম। কথাবার্তা যা হওয়ার, তা হয়ে গেল।
পরে মুস্তাফা ও মোস্তফা একবার আমাকে ছাড়াই তার কাছে গিয়েছিল। সেদিন বিচারপতি মুস্তাফার ইংরেজি জ্ঞানের পরীক্ষা নিয়েছিলেন।
গোলাম মোস্তফা মুখে যদিও লেখকের অভিপ্রায়-অনুযায়ী বই প্রকাশ করতে সম্মত হয়, পরে সে তার ইচ্ছার ওপরে নিজের ইচ্ছা আরোপ করে। তার প্রধান উদবেগ ছিল যে, বইটি খুব ছোটো হয়ে যাবে। সুতরাং সে পি আই ডিতে গিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতির সংক্ষিপ্ত জীবনী, তার কয়েকটি বক্তৃতা, তাঁর বক্তৃতাসংক্রান্ত দুটি খবর, সংবিধানের কয়েকটি সংশোধনী এবং তার আরো কিছু ছবি জোগাড় করে পরিশিষ্টে জুড়ে দিলো। এই অংশ হয়ে দাঁড়ালো মূল রচনার চেয়ে বড়ো। তাতে বই খানিকটা স্ফীত হলো, দামও বাড়লো। এমন সংযোজনে লেখক নিমরাজি হলেন, তবে খুব যে প্রসন্নচিত্তে হলেন, তা নয়।
At Bangabhaban: Last Phase (১৯৮৮) প্রকাশিত হলে তার মুদ্রণ ও বিন্যাস দেখেও তিনি খুব সন্তুষ্ট হননি। পাতলা মলাটের সংস্করণের পাশাপাশি বইটির শক্ত মলাটের সংস্করণও বের হয়। তা নিয়ে অবশ্য তিনি আর কিছু বলেননি। তবে বই যে বের হলো, তাতে তিনি খুশি হয়েছিলেন।
এই সময়েই একদিন আবু রুশদ তার তোপখানার বাসায় আমাকে বলেন, তার আত্মজীবনীর একটি খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। রচনাটি বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এখন প্রকাশক পাওয়া গেলে তা গ্রন্থাকারে বের হতে পারে।
আমি আবার গোলাম মোস্তফাঁকেই বললাম। সে প্রকাশ করতে সানন্দে সম্মত হলো। লেখক-প্রকাশকের যোগাযোগ ঘটিয়েই আমার দায়িত্ব শেষ হয়। জীবন ক্রমশ ছাপা হয়ে বের হয় ১৯৮৯ সালের গোড়ার দিকে। আবু রুশদ বইটি উৎসর্গ করেন তার আযৌবনের বন্ধু আবুল হোসেন ও শওকত ওসমানকে।
শওকত ওসমানের অভ্যেস ছিল সক্কালবেলায় তার পরিচিতজনদের ফোন করা। সুপ্রভাত ভ্রাতঃ, প্রাতঃস্মরণীয়, প্রাতঃস্মরণীয় হও’ বলে তিনি কল্যাণকামনা করতেন। পশ্চিমবঙ্গীয় প্রচলন অনুসরণ করে তিনি আমার স্ত্রীর উল্লেখ করতেন বউমা বলে এবং তারও কল্যাণকামনা করতেন। তার কণ্ঠে স্নেহ ঝরে পড়তো। তারপর তার বক্তব্যের পালা শুরু হতো। তখন জনকণ্ঠে তার ‘শেখের সম্বরা’ প্রতি সপ্তাহে সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হচ্ছে এবং তা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে। তার কিছু ফটোকপি তার জামার পকেটে ফিরতো এবং তাঁর প্রীতিভাজনদের তা বিলিয়ে তিনি আনন্দ পেতেন। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক সময়ে স্থানকালপরিবেশের কথাও তিনি ভুলে যেতেন। সানাউল হকের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আমরা তাঁর বাড়িতে সমবেত হয়েছি। জানাজায় যাওয়ার অপেক্ষায় সকলে। শওকত ওসমান হঠাৎ করে ‘শেখের সম্বরা’র সর্বশেষ কিস্তির ফটোকপি সবাইকে দিতে শুরু করেছেন। আমি উঠে গিয়ে তার হাত চেপে ধরলাম। বললাম, শওকত ভাই, এখানে নয়। তাছাড়া আপনার লেখা আপনাকে বিলোতে হবে কেন? আমাদের দেবেন, আমরা সবার হাতে দিয়ে দেবো। আমার ঔদ্ধত্যে তিনি যে কিছু মনে করেননি, তার কারণ, তিনি আমাকে যথার্থই ভালোবাসতেন এবং আমি যে তার প্রতি যথার্থই শ্রদ্ধাশীল, তা জানতেন। অনেক সময়ে ‘শেখের সম্বরা’র ফটোকপির সঙ্গে তিনি নিজের হাতে নতুন একটা পদ্য লিখে তা দান করতেন। এমন কয়েকটি অংশ আমার কাছে এখনো আছে। শেখের সম্বরার দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের আগে তিনি আমার কাছে বইটির একটি উপযুক্ত নাম চান। আমি বলি, দোভাষী পুথির স্টাইলে ‘শেখের সম্বরা–দোসরা বালাম’ রাখতে পারেন। প্রস্তাবটি তার পছন্দ হয়।
শওকত ওসমান একদিন আমাকে ডেকে পাঠালে আমি তার মোমেনবাগের বাসায় যাই। তিনি জানান, তার অর্থসংকট চলছে। আমি কি তাঁর একটা পাণ্ডুলিপি বাংলা একাডেমিকে দিয়ে কিনিয়ে নিতে পারি? বিদেশের বহু প্রতিষ্ঠান লেখকদের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে রাখে–বাংলা একাডেমি ইচ্ছে করলে তা করতে পারে–সে-পাণ্ডুলিপি মুদ্রণের জন্যে নয়, সংগ্রহ ও প্রদর্শনের জন্যে। মোহাম্মদ হারুন-উর-রশীদ তখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। আমি গিয়ে তাঁকে কথাটা বলি। তিনি শওকত ওসমানকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক, কিন্তু বাংলা একাডেমির কোননা প্রদর্শশালা নেই, ওভাবে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করার ব্যবস্থাও নেই। মহাপরিচালক বিপন্ন বোধ করলেন। আমাদের এই আলোচনার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ইকবাল আহমদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন–তিনি হারুন-উর-রশীদের কাছে কোনো কাজে গিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ঢাকা কলেজে শওকত ওসমান তাঁর শিক্ষক ছিলেন। কোনো ব্যক্তির কাছে পাণ্ডুলিপি বিক্রি করতে যদি শওকত ওসমান রাজি হন, তবে তিনি তা কিনে নিতে পারেন এবং কোনো উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানে তিনি তা দান করতে পারেন। আমি শওকত ওসমানকে এই প্রস্তাব দিলে তিনি সম্মতি দেন। প্রত্যাশিত মূল্যের চেয়ে কিছু বেশি দিয়ে ইকবাল পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে নেন এবং, আমি যতদূর জানি, তা জাতীয় জাদুঘরে দান করেন।
১৩.
চট্টগ্রাম থেকে আমার ঢাকা ফিরে আসা অবধি বাংলাদেশ আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের (আপসো) সাধারণ সম্পাদক ডা. এ এইচ সাইদুর রহমান এই সংগঠনের কাজে আমাকে যোগ দিতে প্রণোদিত করছিলেন। আমি নিমরাজি, তবে কতটা দায়িত্ব পালন করতে পারবো, সে-সম্পর্কে সন্দিহান। ১৯৮৮ সালের ২৪ থেকে ২৮ আগস্ট নয়াদিল্লিতে আপসোর সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেখানে যোগদান না করার কোনো উপায় সাইদুর রহমান রাখলেন না। বস্তুত কংগ্রেসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল বেশ বড়সড়ড়া হলো : শেখ হাসিনা, আহমদুল কবির, হায়দার আকবর খান রনো, সুধাংশুশেখর হালদার, মোনায়েম সরকার, কামাল হায়দার, সাইদুর রহমান, আমি, আরো দু-তিনজন। হাসিনা গিয়েছিল পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও কন্যা সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলকে সঙ্গে নিয়ে। দিল্লি পৌঁছোবার পরে জয়কে প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এশিয়া ও আফ্রিকার ৫৪টি দেশের প্রতিনিধিদল এসেছিল। সহযোগীরূপে ইউরোপের ৯টি দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন, ইউরোপ ও লাটিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশের সাংগঠনিক প্রতিনিধিরা ছিলেন, জাতিসংঘ এবং আরো কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও এসেছিলেন। ভারতীয় প্রতিনিধির সংখ্যাই ছিল পাঁচ শতাধিক। তার মধ্যে ছিলেন ই এম এস নামবুরিপাদ, রাজ্যেশ্বর রাও, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, হরকিষণ সিং সুরজিৎ, সীতারাম ইয়েচুরি, সমর মুখার্জি, চন্দ্রজিৎ যাদব, শেখর গাঙ্গুলি, রশীদউদ্দীন খান, রইস আহমেদ, ডা. ভাস্কর রায়চৌধুরী, এয়ার কমোডর যসজিৎ সিং, কে পার্থসারথী, সত্যসাধন চক্রবর্তী, বিপ্লব দাশগুপ্ত। রমেশ চন্দ্র এসেছিলেন বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রতিনিধি হয়ে, তাঁর স্ত্রী পেরিন ছিলেন ভারতীয় দলে। পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলে আবদুল ওয়ালি খান, মিরাজ খালিদ, তাহেরা মজহার আলী, খাদিজা গওহর, আবদুর রহিম ও মিরাজ মোহাম্মদ খানসহ ১৫/১৬ জন ছিলেন। শ্রীলঙ্কা থেকে আবদুল আজিজ ও এ এ এম মারলিন ছাড়াও কয়েকজন। ভিয়েতনামের প্রতিনিধিদলে মাদাম নগুয়েন থি বি এবং নামিবিয়ার প্রতিনিধিদলে সাম নুজোমা ছিলেন। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যোগ দিয়েছিলেন আলফ্রেড এনজো এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে আবদুল্লাহ হুরি। সোভিয়েত প্রতিনিধিদলে ছিলেন কালানদাররাভ সামানদার, ব্রিটিশ আপসোর প্রতিনিধিদলে ছিলেন মোহাম্মদ আরিফ। কায়রোতে আপসোর সদর দপ্তর–সেখান থেকে এসেছিলেন সভাপতি ডা. মোরাদ গালিব, মহাসচিব নূরি আবদুল রাজ্জাক, সচিবদের একজন চিত্ত বিশ্বাস, অপরজন বিদ্যাশেখরা।
দিল্লিতে হোটেলে পৌঁছে দেখা গেল, আমাদের সবার জন্যে একক কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, হাসিনার জন্যে একটি স্যুইট। আহমদুল কবির বললেন, তাঁর একটা স্যুইট চাই, নইলে দলের সকলে আড্ডা দেবে কোথায়? হোটেল কর্তৃপক্ষের গড়িমসি দেখে তিনি জানালেন, বাড়তি ভাড়া যা লাগে, তা তিনি নিজেই দেবেন, নিমন্ত্রণকর্তাদের ঘাড়ে চাপাবেন না। তাতে কাজ হলো। কিন্তু আমরা ফিরে আসার সময়ে দেখা গেল, বাড়তি ভাড়া নয়, স্যুইটের পুরো ভাড়াটাই হোটেল তাঁর কাছে দাবি করেছে। তারা বলছে, কর্তৃপক্ষের বরাদ্দ করা কক্ষ তিনি নেননি, কর্তৃপক্ষও ভাড়া সমন্বয় করার কথা কিছু বলেনি। অতএব। সম্পূর্ণ ভাড়াটাই আহমদুল কবির দিলেন।
আমরা যেদিন দিল্লি পৌঁছোলাম, সেদিনই আলাপ হলো সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে। তখন সে এখনকার মতো স্বনামধন্য হয়নি, তবে সি পি এমের একজন নেতা হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেছিল। কথায় কথায় জানলাম, সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে সেদিনই মধ্যদিনে তার স্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন। সে-বিষয়ে আমি উদ্বেগ প্রকাশ করায় সীতারাম মৃদু হেসে বললো, কয়েকদিন তাঁকে জেলহাজতে থাকতে হবে–এর অন্যথা হওয়া মুশকিল। দেখলাম, সীতারাম অবিচলিতভাবে সম্মেলনের কাজ করে যাচ্ছে এবং তাও ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে একযোগে।
পরদিন সকালে সম্মেলন উদৃবোধন করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি। ভাষণে যেসব অতিথিকে তিনি বিশেষভাবে স্বাগত জানালেন, তাঁরা হলেন পাকিস্তানের আবদুল ওয়ালি খান, আফগানিস্তানের উপ-রাষ্ট্রপতি আবদুর রহিম হাতিব, ইয়েমেন আরব প্রজাতন্ত্রের উপমন্ত্রী হাসান মক্কী, ভিয়েতনামের (পরে উপরাষ্ট্রপতি) মাদাম বিন, বাংলাদেশের শেখ হাসিনা, তানজানিয়ার আলী আহমেদ, এ এন সির আলফ্রেড এনজো ও পি এল ওর আবদুল্লাহ হুরানি। এই ভাষণে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, প্রতিষ্ঠার ত্রিশ বছর পরে এশিয়া মহাদেশে আপসোর কংগ্রেস এই প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রাজীব গান্ধির বক্তৃতায় বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চের নানা সংকটের বিষয় ছিল, সেই সঙ্গে ছিল স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের আশা।
সম্মেলনের একটি দিন জওহরলাল নেহরুর শতবার্ষিকী পালনে নিয়োজিত হয়। নানারকম ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে সম্মেলনের দিনগুলি কেটে গেল। অনেকের সঙ্গে হাসিনা আমার পরিচয় করিয়ে দেয় তার শিক্ষক বলে-ফলে কিছু অতিরিক্ত সম্মান পাওয়া গেল। হাসিনার ছেলেমেয়ের সঙ্গে ভালোরকম আলাপ জমে গেল–পুতুল ঢাকায় নানারকম চা খাওয়াবার প্রতিশ্রুতি দিলো। ওদিকে আহমদুল কবিরের ঘরে সন্ধ্যার পর জমজমাট আড্ডা। তাতে অন্যদেশের প্রতিনিধিরাও মাঝে মাঝে এসে যোগ দিলেন।
এই সম্মেলনে আপসোর কেন্দ্রীয় সংগঠনের নতুন কমিটিতে সহ-সভাপতির একটি পদ বাংলাদেশের মনোনয়নের জন্যে শূন্য রাখা হয়। পরে সেখানে আমার নাম যুক্ত হয়।
১৪.
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডা. ভাস্কর রায়চৌধুরীর সঙ্গে দিল্লিতে দেখা হলো বটে, তবে তার সঙ্গে এর আগেই পরিচয় হয়েছিল। কলকাতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক নিয়োগের জন্যে যে-নির্বাচনী কমিটি গঠিত হয়, তার বিশেষজ্ঞ-সদস্য নিয়োগ করা হয়েছিল আমাকে। নির্বাচনী কমিটির যে-সভায় আমি যোগ দিতে গিয়েছিলাম, তাতে রবীন্দ্র-অধ্যাপক এবং একজন সহযোগী অধ্যাপক মনোনয়নের কথা ছিল। এই নিয়োগ নিয়ে উপাচার্য ভাস্কর রায়চৌধুরী ও সহ-উপাচার্য ড. ভারতী রায়ের সঙ্গে আমার মতদ্বৈধ হয়েছিল। ওঁদের মনোনয়নের সমর্থনে আরো একজন সদস্য ছিলেন। অন্যপক্ষে কলা অনুষদের ডিন, বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য এবং আমি অন্য প্রার্থীর বিষয়ে একমত হয়েছিলাম। রবীন্দ্র-অধ্যাপক নিয়োগের প্রশ্নে শেষ মুহূর্তে যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে উপাচার্যদের মত সমর্থন করেন। ফলে ওঁদের প্রার্থীর মনোনয়ন নিশ্চিত হয়, তবে ডিন ও আমি মতান্তরসূচক মন্তব্য লিপিবদ্ধ করি। সহযোগী অধ্যাপক বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও বোধহয় তিন-তিন ভোটে কমিটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। তবে মজার কথা এই যে, এই মতবিরোধ সত্ত্বেও সহ-উপাচার্য ভারতী রায়ের সঙ্গে আমার একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তা এখনো অটুট রয়েছে। উপাচার্য প্রথমটায় আমার প্রতি খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন। দিল্লিতেও আমার তা মনে। হয়েছিল। আমার সদস্যপদের মেয়াদকালে নির্বাচকমণ্ডলীর আর কোনো সভা ডাকা হয়নি। পরে অবশ্য উনি যখন একবার ঢাকায় আসেন, তখন নিজের উদ্যোগেই আমাকে টেলিফোন করেছিলেন যদিও ঢাকায় আমাদের দেখা হয়নি।
কলকাতায় সেবারে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। উনি বললেন, ‘চলো দেবীর ওখানে-সে তোমাকে দেখলে খুশি হবে। প্রায় ত্রিশ বছর পরে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হলো এবং প্রথমবারের মতো তাঁর স্ত্রী বিশিষ্ট গবেষক অলকা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। দেবীপ্রসাদ জানতে চাইলেন, কলকাতায় কী উপলক্ষে এসেছি। বললাম, বাংলার অধ্যাপকের সিলেকশন কমিটির সভায়। উনি বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, আমি কি প্রার্থী? বললাম, না, আমি কমিটির সদস্য। উনি এবার আরো বিস্ময় এবং অনেকখানি আনন্দের সঙ্গে বললেন, তাহলে তো তুমি মস্ত পণ্ডিত হয়েছ!’ বললাম, এমন কিছু নয়। নিয়মরক্ষা করতে একজন বিদেশি বিশেষজ্ঞ রাখতে হয়। তাই আমাকে রাখা–বাড়ির কাছে আছি বলে।’ দেবীপ্রসাদ অনেকক্ষণ আনন্দের হাসি হাসলেন।
সেই তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা।
১৫.
১৯৮৮ সালের জুন মাসে সংসদে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী গৃহীত হয়। এতে ঢাকার বাইরে ছটি জেলায় হাইকোর্ট বিভাগের আসন নির্দিষ্ট হয় এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্রধর্ম-ঘোষণার প্রতিবাদে পরদিনই ঢাকা এবং দেশের আরো কয়েকটি শহরে ধর্মঘট পালিত হয়। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেনকে সভাপতি করে আমরা স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করি এবং একাধিক সভা করে রাষ্ট্রধর্মের প্রত্যাহার দাবি করি।
আমাদের আইনজীবী বন্ধুরা অষ্টম সংশোধনীর হাইকোর্ট-সংক্রান্ত বিধানের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে মামলা দায়ের করেন এই বলে যে, তা সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিপন্থী। মামলাটি শুনানির জন্যে গৃহীত হয়।
আমরা কয়েকজন ভাবলাম, রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিপন্থী–এই যুক্তিতে আমরাও হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করবো। এটা করা উচিত হবে কি না, সে-প্রশ্নও উঠলো। কেউ কেউ বললেন, আদালতে যদি আমাদের আবেদন অগ্রাহ্য হয়, তাহলে রাষ্ট্রধর্ম আদালতের অনুমোদন পেয়ে যাবে। তাতে বিষয়টা আরো খারাপ হবে। আমরা কেউ কেউ বললাম, মামলা দায়ের না করলেও তো সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের আবেদন অগ্রাহ্য হলে আর কতোই বা ক্ষতি হবে!
ইতিমধ্যে রাষ্ট্রধর্মের বিধানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হাইকোর্টে দায়ের হয়ে গেল। একটি মামলা করলেন এক হিন্দু ভদ্রলোক। তিনি বললেন, ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হওয়ায় হিন্দু হিসেবে তিনি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন এবং এমন বৈষম্য সংবিধানবিরোধী। আরেকটি মামলা করলেন এক মুসলিম মহিলা। তিনি বললেন, ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হওয়ায় মহিলা হিসেবে তিনি বৈষম্যের শিকার হতে যাচ্ছেন।
এবারে আর আমাদের মামলা না করার কোনো অর্থ রইলো না। প্রধানত সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ আবেদনটি তৈরি করলেন। আবেদনকারী হলেন দশজন : বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, বিচারপতি কে এম সোবহান, বিচারপতি দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, বদরুদ্দীন উমর, ফয়েজ আহমদ ও আনিসুজ্জামান। মামলা রুজু করতে দাঁড়ালেন সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ। আবেদনকারীদের পক্ষে আদালতে উপস্থিত থাকলাম ফয়েজ আহমদ ও আমি। আদালত বললেন, এমন মামলা তো আরো দুটি হয়ে গেছে, সুতরাং এটি বাহুল্যমাত্র। সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ড. কামাল হোসেন বললেন, এই আবেদনটির কিছু বৈশিষ্ট্য আছে–তার একটি আবেদনকারীদের নাম থেকে প্রতীয়মান হবে। এই বলে তিনি সুপ্রিম কোর্টের তিন প্রাক্তন বিচারক এবং সাবেক অ্যাটর্নি-জেনারেল হিসেবে ইশতিয়াকের নাম বললেন। তারপর তিনি আবেদনের কয়েকটি অনুচ্ছেদের প্রতি বিচারপতিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, এতে সংবিধান-সম্পর্কিত কিছু মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।
আমাদের মামলা গৃহীত হলো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এটি নিয়ে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভবপর হয়নি। তার প্রধান কারণ মামলার সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে আমাদের দ্বিধা ও দুশ্চিন্তা। ফলে মামলাটি নথিভুক্ত হয়ে রইলো, তার আর শুনানি হলো না। তবে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি বেশ কিছুকাল সক্রিয় ছিল। একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে আমরা সভা করেছি, একটি প্রবন্ধসংকলন প্রকাশ করেছি। কয়েকটি ঘরোয়া বৈঠক হয় আমার বাসায়। তাতে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন।
আমার বন্ধু ও সংগীতশিল্পী মনোতোষ বড়ুয়া তখন ভিক্ষুজীবন যাপন করছেন। আমার বাসায় এক ঘরোয়া বৈঠকের শেষে সবাই চলে গেলে তিনি রয়ে গেলেন। পোশাকের ভেতর থেকে বেনসন অ্যান্ড হেজেসের একটা প্যাকেট বের করে তিনি সিগারেট ধরালেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বললেন, ‘আমার তো মনে হয়, স্বতন্ত্র নির্বাচন ফিরিয়ে আনা ছাড়া সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার উপায় নেই।’
এই অপ্রত্যাশিত উক্তি শুনে আমি বললাম, তাহলেই ধর্মনিরপেক্ষতার সম্পূর্ণ পরাজয় হবে। আমাদের নেতারা স্বতন্ত্র নির্বাচন-ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন অনেক আন্দোলন করে। এখন তা ফিরিয়ে আনলে স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানকেই ফিরিয়ে আনা হবে।’
তবে তিনি কী গভীর বেদনা ও হতাশা থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচন ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন, তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
১৬.
রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই) এক রাতে এসে জানতে চাইলেন, বড়ো মেয়ের বিয়ের বিষয়ে কিছু ভাবছি কি না।
রুচি তখন অর্থনীতিতে অনার্স পাশ করে এমএ পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার ইচ্ছে, আগে সে এমএ পাশ করুক, তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে। রুচির কাউকে পছন্দ নেই, পছন্দ করার আগ্রহও নেই। সেক্ষেত্রে দায়দায়িত্ব সবটাই তার বাপ-মায়ের।
দাদাভাই বললেন, তাঁর হাতে সৎপাত্র আছে। মরহুম বিচারপতি আবদুল মওদুদের কনিষ্ঠ পুত্র আবু রায়হান আজিমুল হক। বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকসে মাস্টার্স করেছে। বছরখানেক পড়াশোনা করেছে লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। এখন ঢাকায় আইসিডিডিআরবিতে কাজ করে। থাকে তার বড়ো বোন বেবী মওদুদের সঙ্গে। ইচ্ছে করলে আমি গিয়ে তাকে দেখে আসতে পারি। এখানে বিয়ে দিলে মেয়ের পড়াশোনার কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না।
বিচারপতি মওদুদের সঙ্গে আব্বার পরিচয় ছিল কলকাতায়। আমি তাকে চিনতাম লেখক হিসেবে তো বটেই, বিশেষ করে, অধ্যাপক আবু মহামেদ হবিবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে। তিনি যখন কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন সেখানে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা হতো। আমাদের চিন্তাভাবনা ছিল বিপরীতমুখী, তা সত্ত্বেও আমি তাকে শ্রদ্ধা করতাম, তিনিও আমাকে স্নেহের চোখে দেখতেন। বেবী মওদুদকে দাদাভাই খুব ভালোবাসতেন, আমিও স্নেহ করতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রথমবারের শিক্ষকতাকালে সে ছিল আমার ছাত্রী।
এক সকালে বেবীর বাড়ি গিয়ে অপ্রস্তুত রায়হানকে দেখে এলাম। কথাবার্তা আরেকটু এগোলে জানা গেল, তার বড় ভাবি নাজমা অনতিদূর সম্পর্কে আমার খালাতো বোন এবং তার সেজো ভাই হুমায়ূন আমার সাবসিডিয়ারি ক্লাসের ছাত্র ছিল।
বিয়ের সিদ্ধান্ত স্থির হয়ে গেল।
এবারে আমরা সপরিবারে কলকাতায় গেলাম–বহুদিন পরে একসঙ্গে সবাই মিলে বেড়াতে।
জিল্লুর রহিম ওরফে দুলালের সৌজন্যে তার এক বন্ধুর খালি ফ্ল্যাট পাওয়া গেল আলিপুরে। সেখানে ওঠা গেল। সারাদিন বাইরে কাটিয়ে রাতটা সেখানে থাকি। কাছাকাছি মিষ্টির দোকান থেকে সকালের নাশতা আনা হয়। তারপর সবাই মিলে নেমে ফুটপাতের দোকানে চা খেয়ে আমাদের দিন শুরু হয়।
অল্পবয়সী একটি মেয়ে চায়ের দোকানটি চালায়। তার স্বামীকেও দেখা যায় মাঝে মাঝে তাকে সাহায্য করতে। সহজেই ভাব হয়ে যায় মেয়েটির সঙ্গে। সে আমাকে দাদা বলে ডাকে, বসার জায়গা পরিষ্কার থাকলেও গামছা দিয়ে নিজে হাতে আরেকবার মুছে নিয়ে তবে আমাকে বসতে দেয়। আমরা বাংলাদেশ থেকে গেছি শুনে বলে, ওদের বাড়িও এককালে ছিল খুলনা অঞ্চলে, তবে মেয়েটি তা দেখেনি কখনো। তার বাপ-মা কোনকালে পাকিস্তান ছেড়ে চলে এসেছে এদিকে। একসময়ে বেশ কষ্টে গেছে দিন। এখন মোটামুটি চলে যাচ্ছে। তারপর সে কৌতূহলভরে জানতে চায়, বাংলাদেশে কি এখনো অনেক বাঙালি আছে?
আমি বুঝি, বাঙালি বলতে সে কী বোঝাচ্ছে। তবু, সে-ভুল না ভাঙিয়ে বলি, আছে বইকি, বাঙালিরাই তো নিজেদের জন্যে দেশটা গড়েছে।
মেয়েটির মনে এবারে সন্দেহের ঝিলিক দেখা দেয়। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সে জানতে চায়, আমরা কোন জাতের মানুষ।
মুসলমান শুনে তার মুখে বেদনার একটা স্পষ্ট ছাপ ফুটে ওঠে। তা দেখে আমারই কষ্ট লাগে। তাড়াতাড়ি করে নিজেকে সামলে নেয় মেয়েটি। কথা ঘুরিয়ে চলে যায় অন্য কোনো অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে।
পরদিনও সে আগের মতোই বসবার জায়গা মুছে দেয়, যত্ন নিয়ে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়। তবু আমার মনে হয়, সরু একটা তার কোথাও ছিঁড়ে গেছে।
যেদিন সকালে ওকে বললাম আমরা ফিরে যাচ্ছি দেশে, তার দু চোখ অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে বিস্কুটের টিনের দিকে। অস্ফুটকণ্ঠে জানতে চাইলো, কবে আমরা আবার আসবো কলকাতায়। বললাম, ঠিক নেই। যে-কথা বললাম না, তা এই যে, কলকাতায় এলেও এখানে উঠবো না, সুতরাং এমন করে তার দোকানে চা খাওয়া হবে না।
সেদিন ওকে সামান্য কয়েকটা টাকা বেশি দিয়েছিলাম। দিতে বেশ জোর করতে হয়েছিল। পরে কলকাতায় গিয়ে অনেকবার মেয়েটির খোঁজ করতে ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু খোঁজ করা হয়নি।
কলকাতায় বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে অনেক সময় চলে যায়। এবারেও তার ব্যত্যয় হলো না। নতুন করে যাওয়া হলো অধ্যাপক রামকৃষ্ণ মুখার্জীর বাড়িতে।
নিউ মার্কেট থেকে ফোন করতেই তিনি কোলাহল শুরু করে দিলেন। বললেন, সেখান থেকে দুপা হেঁটে মেট্রো ধরতে। তারপর টালিগঞ্জে নেমে দুটো রিকশা নিয়ে ওঁর বাড়ি যেতে। আমরা একটা ট্যাকসি নিয়ে গেলাম। ফাঁকিটা উনি ধরে ফেললেন সহজেই। বললেন, আমার মনে হচ্ছিল, আমার কথা ঠিক তোমার মনঃপূত হচ্ছিল না। ট্যাকসি করে আরামেই এসেছে, তবে অনেকগুলো টাকা খরচ করলে। আমাদের মেট্রো কিন্তু বেশ ভালো।
আনন্দকে নিয়ে ম্যানেজার, ম্যানেজার করে বেশ কিছুক্ষণ হইচই করলেন। তারপর আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা। উঠতে চাইলে বলেন, ‘আহা বোসোনা আরেকটু।
এক ফাঁকে প্রভাতী মুখার্জী আমাকে বললেন, প্রফেসর আর কে মুখার্জীর জন্য একটা ফেলিসিটেশন ভলিউম হচ্ছে–তাতে কেউ লিখতে বলেছে আপনাকে?
বললাম, যশ নন্দনের একটা চিঠি পেয়েছি কিছুকাল আগে–আমেরিকা থেকে লেখা। কিন্তু কী লিখবো, তা ভেবে পাচ্ছি না। এদিকে সময়ও বোধহয় বেশি নেই।’
প্রভাতী মুখার্জী বললেন, আপনাকে একটা লেখা দিতেই হবে–উনি (রামকৃষ্ণ খুবই খুশি হবেন। যে-কোনো বিষয় নিয়ে লিখুন–বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে লিখলেই বা অসুবিধে কোথায়?
যশ নন্দনের উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়। রামকৃষ্ণ মুখার্জীর ৭০ বছরপূর্তিতে যে-বই বেরোবার কথা, তা বের হলো ৭৫ বছরপূর্তিতে। আমি একটা লেখা প্রভাতী মুখার্জীর কাছে পাঠালাম–On the periodization of Bengali Literary History and some related issues নামে। প্রভাতী সেটা জায়গামতো পাঠালেন। R. K. Bhattacharya ও Asok K Ghosh-সম্পাদিত Sociology in the rubric of Social Sciences (Calcutta: Anthropological Survey of India, 1995) বইতে সেটা বের হলো, কেবল সূচিপত্রে আমার নামে s-এর জায়গায় r ছাপা হলো। সে অবশ্য অনেক পরের কথা।
রামকৃষ্ণ মুখার্জীর বাড়ি থেকে সেদিন সপরিবারে ফিরেছিলাম ওই দম্পতির আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে। বিশেষ করে রামকৃষ্ণ মুখার্জীর নিরভিমান আচরণ তাঁর পাণ্ডিত্য ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিকে যেভাবে আড়াল করেছিল, তা অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মতো মনে হয়েছিল।
সেবারে কলকাতা থেকে ফিরে আসার মাসতিনেকের মধ্যে রুচির বিয়ে হয়ে গেল–১৯৮৯ সালের ১০ মার্চে।
১৭.
১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংসদ (ডাকসু) এবং সবকটি আবাসিক হলের ছাত্র-সংসদের নির্বাচন হলো বহু বছর পর। ডাকসুর নির্বাচন-পরিচালনার জন্যে উপাচার্য শিক্ষকদের যে-দল গঠন করেছিলেন, তাতে আমাকে অন্তর্ভুক্ত করেন তিনি। কলাভবনে কর্তব্য পালন করতে হলো–খানিকটা ভোটগ্রহণকেন্দ্র পরিদর্শন, বেশির ভাগ সময়ে উপাচার্যের কাছাকাছি থাকা–এই ছিল দায়িত্ব।
এরশাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিকায় এই নির্বাচন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সরকারপক্ষীয় যে-অল্পসংখ্যক ছাত্র ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাদের নির্ভরতা ছিল পেশীশক্তিতে, ছাত্রসাধারণের সমর্থনে নয়। নির্বাচনে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল যারাই জয়লাভ করুক না কেন, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারবিরোধীদের আনুষ্ঠানিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই কর্তৃত্ব নিয়ে আবার বিরোধী দলীয় ছাত্র-সংগঠনের মধ্যে প্রতিযোগিতা।
পুলিশ ও গোয়েন্দাবিভাগকেও এই নির্বাচনের বিষয়ে উৎকণ্ঠিত মনে হলো। আরো মনে হলো, নির্বাচনে বিরোধী দলীয় ছাত্রদের বিজয় যে অবধারিত, সরকার তা বুঝে গেছেন। সেক্ষেত্রে ছাত্রদলের চেয়ে ছাত্রলীগ তাদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য।
নির্বাচনে ডাকসুতে সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের প্যানেল জয়ী হলো।
ফলাফল ঘোষণার পরে শিক্ষার্থীদের বিজয়-মিছিল বের হয় ক্যাম্পাসে। রোকেয়া হল থেকে ছাত্রীদের যে-মিছিল বের হয়, সেটি সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত হয়।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে সভাপতি করে তিন সদস্যের এক তদন্ত কমিটি গঠন করেন বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ। আমরা রোকেয়া হলে গিয়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করি। দেখা যায়, তদন্ত কমিটির কাছে কারা আসছে, দূর থেকে কিছু ছাত্রী তা লক্ষ করছে।
এক ছাত্রী সে-কথাই বললো তদন্ত কমিটির কাছে। আমি যে সাক্ষ্য দিতে আসছি, সেটা দেখছে সবাই। আপনারা কি আমার নিরাপত্তা দিতে পারবেন?
কবুল করতে হলো, আমরা নিরুপায়। সে-মেয়েটি প্রত্যয়ের সঙ্গে বললো, ‘এসব তদন্তে কিছু হবে না, সার। যারা আমাদের মারধর করেছে, তারা বহালতবিয়তে আছে। তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিলে পরিণাম ভালো হবে না বলে শাসাচ্ছে। ভয়ে কেউ সত্য কথা বলতে আসছে না। তাছাড়া ওরা এত শক্তিশালী, ওদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া যাবে না।’
এরপরও ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আমরা যা আঁচ করতে পেরেছিলাম, তার। ভিত্তিতে রিপোর্ট তৈরি করা হলো, কাউকে কাউকে ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বলে চিহ্নিত করাও গেল।
কিন্তু, সাক্ষ্যদাতা মেয়েটি যেমন আশঙ্কা করেছিল, এ-সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হলো না। ব্যবস্থা নিতে গেলে ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। বলে কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করেছিলেন।
ওই মেয়েটি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহকর্মী হয়েছিল। আমাদের রিপোর্টে যার সম্পর্কে গোলযোগে সংশ্লিষ্টতার সর্বাধিক অভিযোগ আনা হয়, সে মেয়েটিও যথাসময়ে আমাদের সহকর্মী হয়েছিল।
১৮.
জনগণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী ইয়েমেনের আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদ (আপসো) থেকে আকস্মিকভাবেই আমন্ত্রণ এসে গেল। এডেনে তাঁরা এক আন্তর্জাতিক সভা আহ্বান করেছেন–তাতে যোগ দিতে হবে। তাদের চিঠি নিয়ে ঢাকায় এরোফ্লোত অফিসে যেতেই টিকিট পাওয়া গেল–যাতায়াত করতে হবে মস্কো হয়ে। বোঝা গেল, টিকিটটা আসছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সৌজন্যে। তাতে ভালোই হলো। সেই ১৯৭৩ সালে রাশিয়া গিয়েছিলাম, তারপর কত বছর ওমুখো হইনি।
১৯৯০ সালের জানুয়ারি। প্রচণ্ড শীত মস্কোতে। অবশ্য খোলা আকাশের নিচে বের না হলে ঠান্ডা বোঝার উপায় নেই। এডেন যাওয়ার পথে দুদিন এবং ফেরার পথে একদিনের কম থাকার কথা। সোভিয়েত অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসের ইনসটিটিউট অফ ইন্ডিয়ান স্টাডিজের পরিচালকের সঙ্গে দেখা করার একটা ব্যবস্থা করে রেখেছেন কর্তৃপক্ষ–তাছাড়া সবটা সময়ই আমার নিজের।
যে-তরুণীটি আমার দোভাষী, মনে হলো, সে একটু দায়সারাভাবে কর্তব্য পালন করছে। আসতে একটু দেরি করে ফেলে, চলে যেতে চায় তাড়াতাড়ি। এক সন্ধ্যায় প্রশ্ন করলো, আমার কুপন দিয়ে হোটেল থেকে খাবার নিয়ে যদি চলে যাই, আপনি কি কিছু মনে করবেন?
বললাম, মনে করার কি আছে? আমার সঙ্গে খাওয়া তোমার পক্ষে আবশ্যিক হতে পারে না।
সে বললো, আমি যে খাবার নিয়ে চলে গেলাম, অনুগ্রহ করে তা কাউকে বলবেন না।
বললাম, আমার তো মনে হয় না, এটা একটা আলোচ্য বিষয় হতে পারে।
যেটা তাকে বললাম না কিন্তু স্পষ্ট বুঝলাম, সে নিয়ম ভঙ্গ করছে এবং নিয়মভঙ্গের বিষয়টা স্বভাবতই গোপন রাখতে চাইছে।
এর পরে বুঝলাম, মেয়েটি সোভিয়েত সমাজব্যবস্থার ঘোর বিরোধী। এই যে শুনতে পাই স্কুল থেকেই এদের মগজ ধোলাই শুরু হয়, সে-ব্যবস্থা বোধহয় এর ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।
পথে যেতে খাদ্যসামগ্রীর দোকানে লম্বা লাইন দেখি। আমার প্রশ্নের উত্তরে দোভাষী বলে, আমাদের এমন লম্বা লাইন দিয়েই জিনিসপত্র কিনতে হয়। মস্কোতে যত দোকান দেখবেন, সর্বত্রই এ রকম অবস্থা। শুধু রাইসাকে (গর্বাচেভের স্ত্রী) কিউতে দাঁড়াতে হয় না। তার জন্যে অন্য ব্যবস্থা। হয়তো
আরো দু-একজনের জন্যে। কিন্তু আপামর জনসাধারণকে ভোগ্যপণ্য কিনতে হলে এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময়ে কেউ দোকানে। ঢুকে দেখে, তার দরকারি জিনিসের মজুদ শেষ হয়ে গেছে, কখনো দোকানের সিঁড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে কারো মুখের ওপর দোকানের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
কথাগুলো যে সত্যি, তা আমাদের স্বদেশি বন্ধুদের কাছ থেকেই জানতে পারি। তারপরও মেয়েটির প্রতি বাক্যে যে-তীব্র ক্ষোভ লক্ষ করি, তা আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল।
গর্বাচেভের পেরেসত্রোইকার কি এই হাল? তাঁর গ্লাসনস্তে কি এই ফল? মেয়েটি তো পারলে চোখের আগুন দিয়েই সোভিয়েত সমাজব্যবস্থা ভস্ম করে ফেলে!
বন্ধু দ্বিজেন শর্মা অনেককাল আছেন মস্কোতে। তরুণ-তরুণীর মধ্যে এই বিক্ষোভ তিনিও লক্ষ করেছেন। আমাদের রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলামও কিউ নিয়ে নাগরিকদের বিক্ষোভের কথা বললেন।
ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ান স্টাডিজে যেতেই এক মহিলার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আগের বছর দিল্লিতে আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের কংগ্রেসে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। সৌজন্য-বিনিময়ের বাইরে তার সঙ্গে কোনো কথা হয় না।
ইনস্টিটিউটের পরিচালক কথাপ্রসঙ্গে বললেন, দেখুন, আমাদের গবেষণাক্ষেত্রে বহু বাধা, বহু বিঘ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচাইতে মেধাবী ছাত্রকে আমি নিয়োগ করতে চাইবো। আমি তাকে যে-মাইনে দেবো, ট্রাক-ড্রাইভার হলেও সে তার কয়েকগুণ বেশি পাবে। কেন সে গবেষণা করতে আসবে? আপনি তো আমাদের জার্নালের সঙ্গে পরিচিত। সরকার বলছে, তোমরা স্বাবলম্বী হও, যত্র আয় তত্র ব্যয় করো। আপনি বলুন, পৃথিবীর কোন গবেষণা পত্রিকার আয়-ব্যয় সমান। আমরা ভাবছি, ইংরেজি জার্নালটা বন্ধ করে দেবো।
বলেন কী! তাহলে অন্য দেশের বিদ্বানেরা কী করে আপনাদের গবেষণার খোঁজ-খবর রাখবে?
রুশ ভাষার জার্নালটা তো বন্ধ হতে দিতে পারি না। যারা রুশ জানে, তারা আমাদের গবেষণার খবর পাবে। এক-আধটা অ্যাবসট্রাক্ট আছে ইংরেজিতে–তারা আমাদের গবেষণা-প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ ছাপে। তাতে যতটুকু চলার, ততটুকু চলবে। আমি আর কী করতে পারি!
হোটেলের রেস্টুরেন্টে অনেক রুশ দেখি। সোভিয়েত আপসোর এক কর্মকর্তা বললেন, মনে হয়, এরা নব্য ধনী। ব্যবসা করে দু-পয়সা করেছে। একটা কথা বলি, কিছু মনে কোরো না। আমাদের যেসব ব্যবসায়ী স্মাগলিংয়ের সঙ্গে জড়িত, তাদের কাছে বাংলাদেশি তরুণদের খুব সমাদর। বাংলাদেশি আর প্যালেস্টিনিয়ানদের। বিমানে করে ওদের সিঙ্গাপুর-হংকং পাঠায়, ওরা সেখান থেকে জিনিসপত্র স্মাগল করে নিয়ে আসে–খুব পটু এ ব্যাপারে। ধরা না পড়লে তারাও বেশ করে খাচ্ছে। তোমার দেশের অনেক ছেলেই এখন লেখাপড়া স্থগিত রেখে এই কাজে নেমেছে। নগদ পয়সার বিকল্প নেই।
আমি ভাবি, সোভিয়েত ইউনিয়ন কোথায় যাচ্ছে!
সোভিয়েত ইউনিয়ন যেখানেই যাক, আমাকে যেতে হবে এডেন বন্দরে–জনগণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী ইয়েমেনের রাজধানী এডেনে।
শৈশব থেকে এডেন বন্দরের নাম শুনে আসছি–পাঠ্যপুস্তকে ও সংবাদপত্রে তার কথা পড়ে আসছি। এডেনের ডাকটিকিট ও ধাতব মুদ্রা দুইই এক সময়ে আমার সংগ্রহে ছিল। উনিশ শতকে ব্রিটিশ অধিকারে চলে যাওয়ার পরে এডেন কিছুকাল শাসিত হয়েছিল বোম্বাই প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত এলাকা হিসেবে, তারপর তা ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চলে যায় এবং আরো পরে একটি স্বতন্ত্র ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। বন্দরটি ইয়েমেনের একেবারে দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত। ষাটের দশকে ইয়েমেন রাজ্য উত্তর-দক্ষিণে দু ভাগ হয়ে যায়। উত্তরের ইয়েমেন আরব প্রজাতন্ত্র পাশ্চাত্যের এবং দক্ষিণের ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র সোভিয়েত বলয়ের প্রভাবাধীন হয়। সত্তরের দশকের শেষে দুই অঞ্চলে স্বল্পস্থায়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সম্প্রতি দুই দেশের একত্রীকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে এবং ঐক্যবদ্ধ দেশের সংবিধান প্রণীত হয়েছে মাত্র আগের মাসে। আর কয়েক মাসের মধ্যেই দুই দেশ এক হয়ে প্রজাতন্ত্রী ইয়েমেন গঠন করবে। তখন উত্তরের সানা হবে ইয়েমেনের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক রাজধানী, আর এডেন হবে তার অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক রাজধানী।
এডেনে গিয়ে আমি দেখতে পাই আসন্ন একত্রীকরণের নানা নিশানা। চারদিকে উৎসবের একটা ভাব। তা থেকে মনে হয় একত্রীকরণের সম্ভাবনায় লোকজন খুশি। উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভাললা–তার সুফল গোটা রাজ্যে পড়বে বলে অনেকে আশা করছে। অনেকে আবার ভাবছে, বাজার অর্থনীতির চাপে যখন দক্ষিণের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধসে যাবে, তখন উত্তরের সামাজিক বৈষম্য দক্ষিণেও আসন গেড়ে বসবে।
এডেনের সভায় কী আলোচনা হয়েছিল, তা এখন মনে নেই। তবে ওখানকার দিনগুলো যে ভালো কেটেছিল, তা মনে আছে।
১৯.
কয়েক মাসের মধ্যে আমন্ত্রণ এলো কেন্দ্রীয় আপসো থেকে। বান্দুংয়ের ৩৫ বছরপূর্তি-উপলক্ষে কায়রোতে আন্তর্জাতিক সেমিনার। তাতে বাংলাদেশ থেকে দুজনকে নিতে চান তাঁরা, তার মধ্যে একজনকে লিখিত প্রবন্ধ পড়তে হবে। ঠিক হলো, মোস্তাফিজুর রহমান (এখন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক) আর আমি যাবো, তবে লেখাটা আমাকেই তৈরি করতে হবে। এবারো কায়রো যাতায়াত করতে হবে মস্কো হয়ে।
মস্কো বিমানবন্দরে পৌঁছে এবার লক্ষ করলাম, আমাদের সহযাত্রী বাঙালি তরুণের অনেকের সঙ্গেই মোটা মোটা বোঁচকা। আগেরবার চোরাচালানের বিষয়ে যা শুনেছিলাম, তা মনে পড়ল।
মস্কোতে কেউ আমাদের নিতে আসেনি। মোস্তাফিজ এখানে লেখাপড়া করেছেন, রুশ ভাষা তার অধিগত। তিনি একটু হাঁটাহাঁটি করলেন, এখানে সেখানে খবর নিলেন, কোনো লাভ হলো না। বসে বসে কিছুটা সময় কাটাবার পর ভোর হলো। তদ্দণ্ডেই দ্বিজেন শর্মাকে ফোন। তিনি তখনি তাঁর বাড়িতে চলে আসতে বললেন।
একটা ট্যাকসি নিয়ে তাঁর বাড়ি পৌঁছোনো গেল। মুখহাত ধুয়ে নাশতা-পর্ব সারা হলো। খানিক পরে দ্বিজেন ফোন করলেন আপসোর দপ্তরে। তারা বললেন, আমাদের লোক তো থাকার কথা এয়ারপোর্টে। ঠিক আছে, ওঁদেরকে আপনার বাড়িতেই অপেক্ষা করতে বলুন। আমাদের অফিস থেকে আর কেউ গিয়ে ওঁদের হোটেলে পৌঁছে দেবে।
হোটেলে যিনি পৌঁছে দিলেন, তিনি অনেক দুঃখ প্রকাশ করলেন। এমন তো হয় না, এমন হওয়ার কথা নয়। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট দোভাষীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল বিমানবন্দরে। সে বলছে, গিয়ে আমাদের পায়নি। যা হোক, সে এখনি এসে পড়বে হোটেলে।
খানিক বাদে মূর্তিমান সশরীরে হাজির। চেহারা দেখে বোঝা গেল, বকুনি খেয়েছে। হাসি-হাসি মুখ করে বলতে থাকলো, সে সময়মতোই বিমানবন্দরে গিয়েছিল, আমাদের পায়নি। বোধহয় একদিকে সে খুঁজেছে, অন্যদিক দিয়ে আমরা বেরিয়ে এসেছি।
মোস্তাফিজ যখন জানালেন যে, আমরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি, তারপরও সে ভাঙে কিন্তু মচকায় না।
ছেলেটি যে স্বভাবতই মিথ্যেবাদী, তার পরিচয় সে পরেও দিয়েছে। তার ওপর সে পাশ্চাত্যজগতের পরম ভক্ত। মুখে বলছে বটে তার অনুরাগ পাশ্চাত্য সংগীতে (তার মধ্যে তো রুশ সংগীতজ্ঞেরাও আছেন), কিন্তু পাশ্চাত্য জীবনযাত্রার যতটুকু সে জেনেছে তার সবটুকুই তার ভালো লেগে গেছে। তার মতে, স্বদেশে সেই প্রাণশক্তির প্রকাশ নেই, যা পশ্চিমে আছে।
আমি কোন কোন দেশে গেছি, তা সে সাগ্রহে জানতে চায়। ফ্রান্সে গেছি শুনে সে এমন ভাববিহ্বল হয়ে পড়ে যেন আমার পাদুকাযুগলের পূজা করবে।
১৯৭৩ সালে যে-ছেলেটি আমাদের দোভাষী ছিল, তার কথাবার্তার বিষয়, রসবোধ, চালচলনের সঙ্গে এর এমনই পার্থক্য যে, দু-একজনকে দিয়ে একটা দেশের বিচার করা অনুচিত জেনেও আমার মনে হয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্রুত পতনের দিকে ধাবমান।
মস্কোর হোটেলে মাদাম গুয়েন থি বিনের সঙ্গে দেখা হয়। তার সঙ্গে আগের বছরে দেখা হয়েছিল দিল্লিতে। ভিড়ের মধ্যে পরিচয় হয়েছিল–কথাবার্তার তেমন সুযোগ হয়নি। এবারে হলো।
ভদ্রমহিলা বয়সে আমার বছর দশেক বড়ো হবেন। ফরাসি ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন ছাত্রাবস্থায়। কমিউনিস্টদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অপরাধে জেল খেটেছেন কয়েক বছর। ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টে যোগ দিয়ে দ্রুত তার নেতৃস্থানীয় পদে উন্নীত হয়েছেন। দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। পূর্বাপর প্যারিস শান্তি আলোচনায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। শেষ দফা আলোচনায় টেবিল ঘিরে কীভাবে বসা হবে, সে-সম্পর্কে আপত্তি তুলে সভার কাজ বন্ধ রেখেছিলেন দীর্ঘক্ষণ। তাঁর দৃঢ়চিত্ততা পাশ্চাত্য সাংবাদিকদের প্রশংসা অর্জন করেছিল।
মস্কোতে তাকে আমি দেখলাম অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র, মৃদুভাষী মানুষ হিসেবে। এমনিতে গম্ভীর, কিন্তু তীক্ষ্ণ রসবোধেরও পরিচয় দেন। তাঁকে আমার খুবই ভালো লাগতে থাকে।
লেখালেখির কাজ আমি কখনোই সময়মতো শেষ করতে পারি না। মস্কোতে ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে হোটেলের কক্ষে নিজেকে আবদ্ধ রেখে প্রবন্ধ লিখি। আর প্রায় সেভাবেই পৌঁছে যাই কায়রোতে। সেখানে নেমে আমাদের ভিসা পাওয়ার কথা–তাতে একটু দেরি হয়।
হোটেলে পৌঁছে দেখি, ঘরে দুটো আমন্ত্রণপত্র রাখা। সেদিনই বিকেলে আফ্রিকা হাউজে নেলসন মান্ডেলা বক্তৃতা দেবেন। রাতে মান্ডেলাকে মিশরের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংবর্ধনা দেবেন এক হোটেলে। ২৮ বছর পর কারাগার থেকে বেরিয়ে এটাই বোধহয় তাঁর প্রথম বিদেশসফর।
গত বছরে নেলসন মান্ডেলার মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশ আপসোর পক্ষ থেকে খুব ভালো একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম আমরা ইন্জিনিয়ারস ইন্সটিটিউশনে। এতে আমাদের প্রধান সহায় ছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে মান্ডেলার বিবৃতির কিছু কিছু অংশ আমি। অনুবাদ করে দিয়েছিলাম। কবরী সারোয়ার প্রমুখ কয়েকজন শিল্পী তা পাঠ করেছিল। আমার অনুরোধে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান একটি গান রচনা করেছিলেন–তাতে সুর দিয়ে গেয়েছিল বেবী নাজনীন। পরে ডা. সাইদুর রহমান এই অনুষ্ঠানের ভিডিও প্রদর্শন করেছিলেন আপসোর এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। সকলেই তা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে যার মুক্তির দাবি জানিয়েছিলাম, সেই লোকনায়কের সঙ্গে সাক্ষাতের সম্ভাবনায় রোমাঞ্চিত হলাম বই কি!
কোনোমতে চা খেয়েই দৌড় দিলাম আফ্রিকা হাউজে। যানজটের কারণে বেশ খানিকটা আগে নেমে যেতে হলো। আফ্রিকা হাউজে পৌঁছে দেখি, লোকে লোকারণ্য-তিলধারণের জায়গা নেই। মান্ডেলা তখনো আসেননি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমরা ঠিক করলাম, বরঞ্চ সংবর্ধনার জায়গায় চলে। যাই আগে আগে।
সেখানেও মান্ডেলার আসতে দেরি। পান-পর্বের শেষে ভোজের সূচনা হয়ে গেল। মান্ডেলা পৌঁছোলেন না। অতিথিরা বিদায় নিতে শুরু করলেন। কেবল আমরা কয়েকজন মাটি কামড়ে পড়ে থাকলাম।
অতিথিদের ভিড় কম হলে নিমন্ত্রণকর্তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো। পাতলা গড়নের লম্বা মানুষ, সদালাপী, নিরহংকার। কূটনৈতিক শিষ্টাচারে পারদর্শী বলে যার সঙ্গে কথা বলেন, মনে হয়, তার সম্পর্কে কিংবা তার দেশ বা পরিপার্শ্ব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী।
অল্পকাল পরে জাতিসংঘের নতুন সেক্রেটারি-জেনারেল বুট্রোস বুট্রোস গালির ছবি যখন দেখলাম খবরের কাগজে, তখন বুঝতে পারলাম, কায়রোর সেই রাতের নিমন্ত্রণকর্তা ছিলেন তিনিই। আমি তার নাম মনে রাখতে পারিনি।
সেই রাতে অবশেষে মান্ডেলা এলেন। এসেই মাফ চাইলেন। বললেন, কোথাও তিনি সময়মতো যেতে পারছেন না, সময়মতো বের হতে পারছেন না। মানুষের ভালোবাসা, কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা তাঁর কর্মসূচি নষ্ট করে দিচ্ছে।
মান্ডেলা দেরি করে আসায় আমাদের লাভ হলো। তিনি প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলার শ্রম স্বীকার করতে পারলেন।
আমি তাকে আমাদের ঢাকার অনুষ্ঠানের কথা বললাম। তিনি হাসলেন। করমর্দনের সময়ে হাতে মৃদু চাপ দিয়ে চলে গেলেন।
পরদিন সকালে নাশতা খেতে যাচ্ছি। দেখি, মাদাম বিন্ আমার সামনে। তিনি বসতে বললেন, তার টেবিলে। আমি কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি আবার বললেন, বোসো।
বললাম, আপনি আগে বসুন। প্যারিস সম্মেলনে বসা নিয়ে কী কাণ্ডই না আপনি করেছিলেন!
মাদাম বিন্ হাসলেন। বললেন, তখন আমি শত্রুদের সঙ্গে বসতে যাচ্ছিলাম। আর এখন তো বন্ধুদের সঙ্গে বসছি। এখন আমার তো কোনো শর্ত থাকার কথা নয়।
তিনি খুব আন্তরিকভাবে আমাকে ভিয়েতনামে আমন্ত্রণ জানালেন। তবে যাওয়া তো সহজ নয়। অল্পকালের মধ্যে মাদাম বিন ভিয়েতনামের উপরাষ্ট্রপতি হয়ে যান। তখন তার নিমন্ত্রণের কথা আবার মনে পড়ে।
সেমিনার ভালোই হলো। আমার লেখাটি বড়ো হয়ে গিয়েছিল। সাধারণত নির্ধারিত সময়ে আমি বক্তব্য শেষ করতে পারি। এবার পারিনি। সভাপতির তাড়া খেয়ে এত দ্রুত পড়তে লাগলাম যে, যে-মহিলা ইংরেজি-আরবি দোভাষী, তিনি ইংরেজিতেই বললেন, ‘হি ইজ রিডিং টুউ ফাস্ট ফর মি।’ তারপর থেমে গেলেন।
নিজের স্বভাববিরুদ্ধ আচরণে অনুতপ্ত হয়েছিলাম। তবে লেখাটি অনেকের ভালো লেগেছিল। বিদ্যাশেখরা বললো, প্রফেসর, তুমি তো দেখছি থিসিস লিখে ফেলেছ।
কায়রোতে সেই আমার প্রথম সফরে দ্রষ্টব্য অনেক কিছু দেখলাম। নীল নদ, পিরামিড, স্ফিংস। সন্ধ্যার পর হোটেলে আড্ডা।
আপসোর সভাপতি ড. মোরাদ গালিব এককালে মিশরের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। আনোয়ার আবদেল-মালেকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার কথা তাঁকে বললাম। তিনি মৃদু হেসে বললেন, ছেলেটি ভালো।
আনোয়ার আবদেল-মালেক যদি তার কাছে ছেলে হয়, তাহলে আমি তো এখনো জন্মাই নি! আর কথা বাড়ালাম না।
২০.
মৃত্যুর আগে আবু হেনা মোস্তফা কামালের সঙ্গে যে আবার আমার মনোমালিন্য হয়ে গেল, সে কথা ভাবতে এখনো খারাপ লাগে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তিনি খুশিই ছিলেন। উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরীর সৌজন্যে মহসিন হলের প্রোভোস্ট নিযুক্ত হন তিনি, প্রশস্ত বাসগৃহ পেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করেন। কিন্তু তার মধ্যে অস্থিরতা ছিল, নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা ছিল, নানাক্ষেত্রে নিজের দক্ষতাপ্রমাণের অভিপ্রায় ছিল। তাই যখন আমন্ত্রণ পেলেন শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের পদে যোগ দেওয়ার, তখন শিক্ষকতা থেকে ছুটি নিলেন। সেখান থেকে হলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। তিনি উদযোগ নিয়ে আমাকে বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য করলেন এবং একাডেমির নানাকাজে যুক্ত করলেন। এর মধ্যে একটি ছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বাংলা বৈদ্যুতিক টাইপরাইটারের কী-বোর্ড তৈরির কাজ। একইসঙ্গে কী-বোর্ডের বিন্যাস এবং হরফের আদলসৃষ্টি। বিন্যাসের বিষয়ে মূল কাজটি করলেন জামিল চৌধুরী। মুনীর অপটিমার দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে ছিল, তার বিন্যাস সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের কিছু সমালোচনা বা পরামর্শ আমরা গণ্য করেছিলাম। হরফের বিষয়ে কাইয়ুম চৌধুরীকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করে একাধিক নমুনা আঁকিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবে আমরা তখনই প্রশ্ন তুলেছিলাম, কম্পিউটারে বাংলা সফটওয়্যারের উদ্ভাবনের বিষয় যখন আমাদের চিন্তা করা উচিত, তখন আমরা ইলেকট্রিক টাইপরাইটারের জন্য চেষ্টিত হচ্ছি কেন? দেখা গেল, মন্ত্রণালয় মনে করছে, কম্পিউটারে বাংলার ব্যবহার করতে সময় নেবে, ততদিনে ইলেকট্রিক টাইপরাইটারের ব্যবহার আমাদের কাজে গতি দেবে।
আবু হেনা আরেকটি কাজে আমাকে যুক্ত করেছিলেন–বাংলা ভাষাপ্রয়োগে সাধারণ ভুলগুলো সংকলন করে সকলের সামনে তুলে ধরা। এখানে মোহাম্মদ আবদুল কাইউম আমাদের সঙ্গে ছিলেন, একাডেমির একাধিক কর্মকর্তাও এতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ (১৯৮৭) নামে বইটি যখন বের হলো, তখন তা সমাদৃত হয়।
‘সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা’র আদলে বাংলা একাডেমী থেকে জীবনী গ্রন্থমালা’র প্রকাশও ছিল আবু হেনার নিজের পরিকল্পনার অংশ। তিনি আমাকে দিয়ে মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯৮৮) বইটা লিখিয়ে নিয়েছিলেন। আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা’য় যাদের জীবনী আছে,
‘জীবনী-গ্রন্থমালা’য় তার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে। একাডেমীর কর্মকর্তারা তাঁকে বুঝিয়েছিলেন যে, পূর্ববাংলায় জন্মগ্রহণকারী যেসব সাহিত্যিকের জীবনী চরিতমালা’য় আছে, তাঁদেরও নতুন জীবনী লেখার সুযোগ আছে এবং সেক্ষেত্রে আপাতদৃষ্টিতে পুনরাবৃত্তি বলে মনে হলেও এঁদের নতুন জীবনী প্রকাশ করা উচিত। সেটাই হয়েছিল।
এই দৃষ্টান্তটি ব্যতিক্রম হিসেবেই গণ্য হতে পারে, সাধারণত তিনি আমার মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায়ও তিনি অনেক সময়ে প্রকাশ্যেই আমার মতামত প্রথমে শুনতে চাইতেন। একবার একটি বইয়ের সংকলন ও মুদ্রণ নিয়ে একজন পরিচালকের কাজে গাফিলতির অভিযোগ আনলেন এবং তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণের প্রস্তাব করলেন। কাজের ত্রুটি দৃশ্যমান ছিল। আমি বললাম, আগে পরিচালকের কৈফিয়ত চাওয়া হোক, সেটা সন্তোষজনক না হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তিনি ভাবলেন, ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ধরে আমি পরিচালকের পক্ষ নিচ্ছি মহাপরিচালকের মতের বিরুদ্ধে। তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। আমি বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে, আত্মপক্ষসমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া অসংগত হবে–তা তার ত্রুটি যত বড়ড়াই হোক না কেন। আমার বাধাদানের কারণেই পরিষদের ওই সভায় সেই পরিচালকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না, কিন্তু আবু হেনা খুবই খারাপ বোধ করলেন, এটাকে তার পরাজয় হিসেবে দেখলেন, তাঁর মধ্যে প্রবল তিক্ততা দেখা দিলো।
কয়েকদিনের মধ্যে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটাতে এই ঘটনা অনেকখানি ক্রিয়াশীল ছিল। তাঁর শরীর খারাপ হওয়ায় তাঁর স্ত্রী আমাকে খবর দিতে চান–ভাবির পক্ষে সেটাই ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু আবু হেনা নিষেধ করেছিলেন। তিনি চৈতন্য হারিয়ে ফেলার পরে আমি খবর পাই। বেবী ও আমি তখনই তাঁর বাসায় যাই। তার পরপরই অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় হৃদ্রোগ ইন্সটিটিউটে। আমিও তার অনুগমন করি। অল্পকাল পরে চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, আর কিছু করার নেই।
সেটা ছিল ১৯৮৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর।
পরে বাংলা একাডেমী আমাকে আবু হেনা মোস্তফা কামাল-রচনাবলী সম্পাদনার দায়িত্ব দেয়। বিশ্বজিৎ ঘোষের সহযোগে আমি তা করেছি। এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে (২০০১), দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। তার আগে শিল্পকলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত তাঁর গানের সংকলন আমি সাগরের নীলের ভূমিকাও আমি লিখেছি–তার পরিবারের ইচ্ছাক্রমে।
২১.
১৯৮৯ সালের শেষদিকে একবার কলকাতায় গিয়েছিলাম। কাজ ছিল টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউটে বক্তৃতা দেওয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের গোলাম মুস্তাফাও সেখানে আমন্ত্রিত বক্তা ছিল।
এক ফাঁকে মুস্তাফাঁকে নিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি যাই। কথাপ্রসঙ্গে তিনি বললেন, এবার ঢাকায় যাচ্ছি।
উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইলাম, তাই নাকি? কী উপলক্ষে?
কবি বললেন, ‘এশীয় কবিতা উৎসবে।’
আমার উৎসাহে ভাটা পড়ল। বললাম, এ তো প্রেসিডেন্ট এরশাদের শো। আপনি যাবেন?
সুভাষ বললেন, ‘কতদিন ধরে তোমরা এরশাদকে সরাবে-সরাবে বলছ। কিছু তো করতে পারছ না! আমি আর কতদিন ঢাকায় না গিয়ে থাকব!’
তার কথার সত্যতা স্বীকার করতেই হয়।
দ্বিতীয় এশীয় কবিতা-উৎসবে সুভাষ মুখোপাধ্যায় এসেছিলেন নভেম্বর মাসে। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। কবিতা-উৎসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ছাড়া তাকে অধিকার করে রেখেছিল সংগীতশিল্পী বেবী নাজনীন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে সে বাবা বলে সম্বোধন করত।
১৯৯০ সালে কিন্তু স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন প্রবল হলো। ছাত্রদের ধর্মঘট ও সংঘর্ষ, চিকিৎসকদের ধর্মঘট, আইনজীবীদের প্রতিবাদ, শ্রমিক-সংঘর্ষ, পরিবহণ-ধর্মঘট, ছাত্র-পুলিশ সংঘাত, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, হরতাল–এসব লেগেই রইল। অক্টোবর মাসে সারাদেশে রাজপথ ও রেলপথ অবরোধের কর্মসূচি পালিত হলো।
ঠিক সেই সময়ে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় বড়ো বড়ো অক্ষরে খবর ছাপা হলো : বাবরি মসজিদ বিধ্বস্ত।
বাবরি মসজিদ নিয়ে অযোধ্যায় সংঘাতময় পরিস্থিতি গড়ে উঠেছিল কিছুকাল ধরেই। কিন্তু মসজিদটি তখনো বিধ্বস্ত বা আক্রান্ত হয়নি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তা। ভেঙে ফেলতে বদ্ধপরিকর হয়েছে–তাদের সঙ্গে আছে ভারতীয় জনতা পার্টি ও রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ। পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ, কিন্তু বিস্ফোরণ তখনো ঘটেনি।
ইনকিলাবেমিথ্যা সংবাদের সঙ্গে ছিল উত্তেজনাকর সম্পাদকীয়। যেদিন এটা প্রকাশ পেল, ৩০ অক্টোবর, সেই রাতেই চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। দাঙ্গা নয়, নির্যাতন।
পরদিন, শুনেছি, মিথ্যে খবর ছাপানের দায়ে ইনকিলাব্বে কৈফিয়ত চায় সরকার। মওলানা মান্নান তাঁর পুত্রকে নিয়ে–তিনিই পত্রিকার সম্পাদক-রাষ্ট্রপতি এরশাদের দরবারে হাজির হন। সম্পাদক কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা চান এবং ভ্রম-সংশোধনী ছাপবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। ৩১ অক্টোবর কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ছোটো করে তা ছাপা হয়। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, সব ব্যাপারটা ছিল লোক-দেখানো এবং ৩১ তারিখে নাকি স্বল্পসংখ্যক ইনকিলাব মুদ্রিত হয়। ওই সংশোধন এবং ক্ষমাপ্রার্থনা কোনো কাজে আসেনি।
ঢাকায় সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা লেগে যাওয়ার আশঙ্কায় ৩১ তারিখ সকালেই আমরা প্রেস ক্লাবে জড়ো হলাম। কিন্তু করণীয় নির্ধারণ করতে আমাদের অহেতুক বিলম্ব হয়। দাঙ্গাবিরোধী মিছিল নিয়ে আমরা প্রেস ক্লাব থেকে শাঁখারিবাজারে যাই, সেখান থেকে ফিরে আসি প্রেস ক্লাবে। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমরা বের হবার আগেই বিজয়নগরে মিষ্টির দোকান লুঠ হয়, নারিন্দায় বাড়ি আক্রান্ত হয়, ইসলামপুরে স্বর্ণালঙ্কারের প্রতিষ্ঠান লুষ্ঠিত হয়–তার মধ্যে মুসলমানের মালিকানাধীন দোকানও ছিল। ক্রমে ঢাকার বাইরে পরিস্থিতির অবনতি হয়।
আমাদের মিছিলে মহিলাদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। কোতোয়ালি থানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে শান্তিরক্ষা সম্পর্কে আমাদের আলোচনা। ভালোই হয়েছিল, কিন্তু আমাদের অনেকেরই মনে হয়, পুলিশকে যথেষ্ট সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ তখনো ওপর থেকে আসেনি। তবে ৩১ অক্টোবরেই কয়েকটি পাড়ায় শান্তিরক্ষার জন্যে স্কোয়াড গঠন করা সম্ভবপর হয়েছিল। ‘
শেষ পর্যন্ত ওইদিনেই সান্ধ্য আইন জারি হয়। পরদিন কিছুক্ষণের জন্যে শিথিল করে আবার তা প্রয়োগ করা হয়। কারফিউ প্রত্যাহার করা হলেও কোতোয়ালি, সূত্রাপুর ও লালবাগ থানা এলাকায় বলবৎ করা হয় ১৪৪ ধারা। পরে এই ধারার অধীন থানার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
১৪৪ ধারা জারি করায় শান্তিমিছিল বেরোনোর অসুবিধে হয়। তবু যেখানে ১৪৪ ধারা ছিল না, সেখানে মিছিল হয় এবং যেখানে তা ছিল সেখানেও শান্তিরক্ষার উদ্যোগ চলতে থাকে। সম্মিলিতভাবে শান্তিমিছিল বের হয় ৮ নভেম্বরে। ততদিনে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে, কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘুর আস্থা ভয়ানকভাবে বিচলিত হয়।
আমরা অনেকেই বুঝতে পেরেছিলাম, সরকারবিরোধী আন্দোলন থামাতে। এই ধরনের পরিস্থিতি ইচ্ছাকৃতভাবেই সরকার তৈরি করেছে, কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হবে না। সাম্প্রদায়িক পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে এলে মূল আন্দোলন আবার গতি পায়। আন্দোলনের একটি মূলকেন্দ্র বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয় সরকারি নির্দেশে। সে-নির্দেশ অগ্রাহ্য করে আমরা ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ছাত্রেরাও ক্লাসে আসতে থাকে।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা দিতে বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রধান সিরাজুর রহমান ঢাকায় চলে আসেন। এর আগে বিবিসির সংবাদদাতা আতাউস সামাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তারপর এক পর্যায়ে সরকারি আদেশে বাংলাদেশে বিবিসির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিবিসির বহির্বিশ্ব বিভাগের কর্মকর্তারা দেনদরবার করে সে-কার্যক্রম পুনরায় চালু করার অনুমতি পান। খবরের যাথার্থ যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, সেজন্যে সরাসরি সিরাজুর রহমানকে পাঠানো হয় বাংলাদেশে। তিনি এসে ওঠেন শেরাটন হোটেলে, অবসর পেলেই আমি সেখানে চলে যাই। আমরা পরস্পর খবরাখবর বিনিময় করি, শেরাটনে ও ঢাকা ক্লাবে আড্ডা দিই। অনেক সময়ে শহরের অবস্থা দেখতে যাই একসঙ্গে।
এক বিকেলে সিরাজুর রহমান ও আমি এক রিকশায় যাচ্ছি। জিপিওর কাছে স্বৈরাচারবিরোধী মিছিল যাচ্ছে মহিলাদের। আমরা দুজনেই প্রায় একইসঙ্গে সেই মিছিলে বেবীকে দেখতে পাই। বেবী যে মিছিলে যোগ দেবে, তা আমার জানা ছিল না। আমার ও বেবীর নাম না করে ঘটনাটি বিবিসিতে প্রচার করেন সিরাজুর রহমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারপক্ষ ও বিরোধী দলের ছাত্রদের মধ্যে একদিন প্রবল গোলাগুলি হলো। আমরা কলাভবনে আটকে রইলাম অনেকক্ষণ। সামনের রাস্তায় গাড়ি ও লোক-চলাচল বন্ধ করে দিয়ে পুলিশ সেখানে অবস্থান নিলো। আমার ধৈর্যে আর কুলোচ্ছিল না। বন্ধুদের বাধা অগ্রাহ্য করে কলাভবন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পথচারীদের চলাচলে বাধা দিলেও পুলিশ আমাকে বাধা দেয়নি। সামনে গিয়ে দেখি, আমাদের আবাসিক এলাকার গেটে বহুজন অপেক্ষমাণ। তাদের মধ্যে দর্শন বিভাগের রাশিদা আখতার খান রোরুদ্যমানা। তাঁর মেয়ে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্রী–সেখানেই সে আটকা পড়েছে, বাড়িতে আসতে পারছে না। রাশিদা চাইছেন, নিজে স্কুলে গিয়ে মেয়েকে নিয়ে আসতে, কিন্তু সকলেই তাকে বাধা দিচ্ছেন। আমাকে নির্বিঘ্নে ফিরে আসতে দেখে মেয়েকে উদ্ধার করার ইচ্ছে তার প্রবল হলো। শেষকালে আমি বললাম, স্কুলে কথাবার্তা বলে দেখি, অধ্যক্ষ বা শিক্ষকেরা কী বলেন। দরকার হলে আমি গিয়ে তার মেয়েকে নিয়ে আসবো। স্কুলে ফোন করে কথা বললাম। তারা বললেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কাউকেই তারা স্কুল থেকে বের হতে দেবেন না। ছাত্রছাত্রীরা যেমন আছে সেখানে, তেমনি আছেন শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীরা। এই অবস্থায় দু-একজন চলে গেলে বাকিদের ধরে রাখা কষ্টকর হবে। খুবই যুক্তিসংগত কথা। রাশিদাকে আমি বোঝালাম। পরে তাঁর মেয়ে নির্বিঘ্নে ফিরে এসেছিল।
এদিকে সংবাদপত্রের ওপর সেনসরশিপ আরোপ করলো সরকার : সাংবাদিকদের রিপোর্ট ছাপাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। এই আদেশের প্রতিবাদে সাংবাদিকেরা ধর্মঘট করলেন, কালো ব্যাজ পরে মিছিল করলেন। পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেল। কেউ বললেন, এতে সরকারেরই লাভ হলোদেশবাসী সত্য খবর জানুক, এটা তারা চায়নি; এখন লোকের কাছে খবর পৌঁছোনোই বন্ধ হয়ে গেল। কেউ বললেন, কোনো দেশে সাংবাদিকেরা পত্রিকা প্রকাশ করতে অস্বীকার করছে, এটা এত বড়ো খবর এবং সরকারের এত বড়ো নিন্দাবাদ যে সারা পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশের বাস্তবচিত্র সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে গেল।
ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরেও সান্ধ্য আইন জারি হলো। পুলিশ অথবা সরকারি মাস্তানের গুলিতে রোজই মানুষ প্রাণ দিতে থাকলো। সবচেয়ে উত্তেজনাকর হলো ডা. মিলনের হত্যাকাণ্ড। সমস্ত দেশ এতে স্তম্ভিত হয়ে গেল, প্রতিবাদের ঢেউ উঠল, সরকারের মৃত্যুঘণ্টা বাজল।
২৯ নভেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে শিক্ষক সমিতির সভায় স্থির হলো যে, আমরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক, একযোগে পদত্যাগ করবো। আমাদের মধ্যে দু-একজন প্রশ্ন তুললেন, উপাচার্য পদত্যাগ করবেন কি না। আমি বললাম, এটা তাঁর বিবেকের বিষয়; আমাদের পদত্যাগের সঙ্গে তাঁর পদত্যাগের প্রশ্নটি জড়িত করা ঠিক হবে না। আমার কথাটি সকলে মেনে নিলেন। সভাশেষে আমরা মিছিল করে সচিবালয়ের দিকে রওনা হয়ে গেলাম। কার্জন হল পার হতেই পুলিশের বাধা। প্রথমে আমাদের গতিরোধ। আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকায় একটু পরে আমাদের ওপরে উপর্যুপরি কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া। মুহূর্তমধ্যে সংকল্প ত্যাগ করে আমরা পশ্চাদপসরণ করলাম। সহকর্মীরা কেউ কেউ রাস্তার ওপরেই পড়ে গেলেন। তাদের ধরে তুলে আমরা আবার ক্লাবে ফিরে এলাম। আমাদের পদত্যাগের খবর দেওয়া হলো বিবিসিতে।
পরদিন সকালে কলাভবন-প্রাঙ্গণে শিক্ষকেরা জড়ো হলেন, তবে আগের দিনের চেয়ে অনেক কম সংখ্যায়। হলগুলো থেকে এবং বাইরে থেকে ছাত্রেরা জড়ো হতে হতে এক বিশাল সমাবেশ হয়ে গেল। পদত্যাগ করায় শিক্ষকদের অভিনন্দন জানালো ছাত্রেরা, তারা দাবি করলো উপাচার্যের পদত্যাগ। সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ সেখানে অনেকক্ষণ ধরে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আকস্মিকভাবে তিনি অবতীর্ণ হলেন ত্রাতার ভূমিকায়। কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে তিনি উপাচার্য ভবনে গেলেন এবং ছাত্রদের নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে একা উঠে গেলেন দোতলায়। কিছুক্ষণ পরে নেমে এসে ঘোষণা করলেন, উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। ছাত্রদের প্রবল হর্ষধ্বনি। বিবিসির সংবাদে উপাচার্যের পদত্যাগের সংবাদ প্রচার।
বস্তুতপক্ষে অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা পদত্যাগ করেননি। তিনি উপাচার্য হয়েছেন মাত্র মাসছয় আগে। তার দিক থেকে পদত্যাগ করার কোনো কারণ ঘটেনি। তিনি নিজমুখেও কাউকে বলেন নি যে, তিনি পদত্যাগ করেছেন। ফয়েজ আহমদের কথার জন্যে তিনি তো আর দায়ী হতে পারেন না। সে-কথায় পদত্যাগ করার জন্যে তার ওপরে চাপ যদি কমে যায়, তাতে তিনি কী করতে পারেন!
ফয়েজ আহমদকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ-কাজটি তিনি কেন করতে গেলেন! তিনি বললেন, ছাত্রেরা যেমন চাপ সৃষ্টি করছিল, তাতে একটা অঘটন ঘটে যেতে পারতো। সেই পরিস্থিতি এড়াতেই তিনি মুহূর্তের একক সিদ্ধান্তে এমন কাজটি করলেন।
পরবর্তী তিন-চারদিনে আন্দোলন আরো জোরালো হলো, আরো প্রাণহানি ঘটলো। সচিবালয় এবং সরকারি-আধা সরকারি সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এবারে সরকারের পদত্যাগ দাবি করে রাজপথে মিছিল করে নামলেন। রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলির কাছে নানারকম প্রস্তাব দেওয়া হলো, কিন্তু সরকারের পদত্যাগ ছাড়া অন্য কিছুতে তাঁরা রাজি নন বলে জানিয়ে দিলেন। সেনাবাহিনীকে ক্ষমতাগ্রহণের জন্য যথেষ্ট প্ররোচণা দিলেন এরশাদ, কিন্তু সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট-জেনারেল নূরউদ্দীন তাকে বলে দিলেন যে, এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী সে-পথে পা বাড়াবে না। ৪ ডিসেম্বর জানা গেল, এরশাদ পদত্যাগ করবেন এবং একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পদে তিন রাজনৈতিক জোট প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নিয়োগদানে একমত হয়। তাঁর সম্মতি পেতে দেরি হচ্ছিল। তখন বিকল্পের সন্ধান শুরু হয়। মঈদুল হাসানের পরামর্শে আমি এয়ার ভাইস-মার্শাল (অব) এ কে খোন্দকারের নাম প্রস্তাব করি ড. কামাল হোসেনের কাছে। কামাল তখন আত্মগোপনে ছিলেন। এই নাম আলোচিত হতে হতে জানা গেল, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এই দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়েছেন এই শর্তে যে, দায়িত্বকালশেষে তাকে আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যেতে দেওয়া হবে।
৫ তারিখ রাতের খবরে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, এরশাদ যাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ঢল নামলো রাজপথে। মুহূর্তের মধ্যে বেবী ও আনন্দ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মিছিলে যোগ দিতে। আমি ঘরে বসে রইলাম টেলিভিশন সেটের সামনে। তাতে মানুষের আনন্দের যে-প্রকাশ দেখা গেল, তা বহুকাল দেখিনি।
৬ তারিখে প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগের জন্যে বেচারি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তিনি পরিস্থিতির বিকল্প সমাধানের প্রস্তাব করছিলেন। সেখান থেকে বের হয়েই তাকে যেতে হলে ক্ষমতার কেন্দ্রে এবং তাকেই প্রথম ক্ষমতা ছাড়তে হলো। রাষ্ট্রপতি তখন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করলেন। এরপর রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।
২২.
এরশাদের পতনের পর সারাদেশে মানুষের মনে যে-উল্লাস ও আশাবাদ দেখা দেয়, তার একমাত্র তুলনা হতে পারে স্বাধীনতালাভের অব্যবহিত পরে দেশবাসীর আনন্দ ও প্রত্যাশার সঙ্গে। ১৯৯০ সালের বিজয় দিবস সংখ্যা সংবাদ-এ ‘এবারে’ নামে আমি একটা ছোটো লেখায় এই আশাবাদের কথা উল্লেখ করে বলেছিলাম, এবারে তাকে কোনোক্রমে মিথ্যে প্রতিপন্ন হতে দেওয়া চলবে না। হায়, ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া কত কঠিন!
৩১ ডিসেম্বর কমরেড মণি সিংহের সংগ্রামময় জীবনের অবসান হলো। পুস্পার্ঘ্য দিয়ে আমরা শেষবারের মতো তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা যাঁরা হলেন, তাঁদের অধিকাংশই আমাদের চেনাজানা মানুষ, আপনজনই বলা যেতে পারে। তাদের সততা ও যোগ্যতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ ছিল না। একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন যে অনুষ্ঠিত হবে, সবার মনে সেই প্রত্যয় দেখা দিলো।
এরশাদকে প্রথমে আটক রাখা হয় স্বগৃহে। বিবিসিকে দেওয়া তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হলে দুর্নীতির দায়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গুলশানের একটি বাড়িকে সাব-জেল ঘোষণা করে সেখানে তাঁকে সপরিবারে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। বেশ পরে তাকে স্থানান্তরিত করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তাঁর দলের অনেকে গ্রেপ্তার হন বটে, কিন্তু জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেওয়া হয়।
দেশের সরকারপদ্ধতি নিয়ে তুমুল আলোচনা চলতে থাকে। আওয়ামী লীগ এবং বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই সংসদীয় পদ্ধতির পক্ষে মতপ্রকাশ করে। বিএনপির স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায় না। শেষকালে অবশ্য তারাও সংসদীয় পদ্ধতির আনুকূল্য করে।
নির্বাচনী প্রচারণা প্রায় প্রথম থেকেই শুরু হয়ে যায়। আট দলের শরিকদের মধ্যে আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে মতৈক্য না হওয়ায় প্রত্যেক দল স্বতন্ত্রভাবে মনোনয়নপত্র পেশ করে। পরে মনোনয়ন-সমন্বয়ের প্রয়াস নেওয়া হয়। তারপরও মনোমালিন্য রয়ে যায়।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, ভোটার তালিকায় বেবীর নাম আছে, আনন্দের নাম আছে, আমার নাম নেই। দিনশেষে সংবাদ-সম্মেলনে ভোটার-তালিকার অসম্পূর্ণতার দৃষ্টান্ত হিসেবে শেখ হাসিনা এই বিষয়টির উল্লেখ করে। কয়েকটি পত্রিকা থেকে ফোন করে আমার কাছে প্রকৃত অবস্থা জানতে চাওয়া হয়। নির্বাচন কমিশনের সচিব আইয়ুবুর রহমানও আমাকে ফোন করে তার অফিসে যেতে বলেন এবং প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি দেন।
পরদিন জানা যায়, বিএনপি ১৪০টি এবং আওয়ামী লীগ ৮৪টি আসনে জয়লাভ করেছে।
৩৫টি আসন পেয়ে জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি নিয়েছে তৃতীয় স্থান। সেদিন নাকি সংবাদ-সম্মেলন করে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু হয়নি বলে বিএনপির অভিযোগ করার কথা ছিল। এখন পট বদলে গেল। শেখ হাসিনাই বললো, নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. কামাল হোসেন বললেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। নির্বাচনে তিনি অবশ্য পরাজিত হন–অনেকে সে-পরাজয়ের কারণ মনে করেন আওয়ামী লীগের অন্তর্কলহ। তবে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা সম্পর্কে কামালের এই মন্তব্য তার দলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এরই জের ধরে কয়েকদিনের মধ্যে তাঁর গাড়ি আক্রান্ত হয়, তিনিও কটুকাটব্যের শিকার হন।
খালেদা জিয়া ও এরশাদ পাঁচ-পাঁচটি আসনেই নির্বাচিত হলেন। তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শেখ হাসিনা জিতলো একটিতে।
নির্বাচনের আগে বেতারে-টেলিভিশনে শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছিল, সেটি তার অনুকূলে যায়নি বলে অনেকেই মনে করেন।
পরে দলীয় ব্যর্থতার দায়স্বীকার করে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ত্যাগ করে। আরো পরে দলীয় নেতা ও কর্মীদের অনুরোধে পদত্যাগপত্রটি সে প্রত্যাহার করে নেয়।
দুই প্রধান দলের সংসদ-সদস্যরাই এরশাদ-আমলের স্পিকারের কাছে শপথগ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ শপথবাক্য পাঠ করান।
নতুন মন্ত্রিসভা গঠন নিয়েও কিছু টানাপোড়েন হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একবার বলেন যে, কোন দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে, সে-সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি কাউকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে আমন্ত্রণ জানাবেন না। এতে বিএনপি শঙ্কিত হয়ে প্রতিবাদ করে। আওয়ামী লীগ বলে, সাংবিধানিক বিষয়টির আগে নিষ্পত্তি হোক, পরে মন্ত্রিসভা-গঠনের আমন্ত্রণ। বিএনপির প্রতি জামায়াতে ইসলামী সমর্থন জানালে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এক পর্যায়ে খালেদা জিয়াকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে আমন্ত্রণ জানান। আওয়ামী লীগ তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করে রাষ্ট্রপতি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
২৩.
১৯৯১ সালের ২৮ ডিসেম্বরে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ঘোষণা করে যে, অধ্যাপক গোলাম আযম এই সংগঠনের আমির নির্বাচিত হয়েছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিতপূর্বে গোলাম আযম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও বাংলাদেশি ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই তিনি বাংলাদেশে আসেন তার অসুস্থ মাকে দেখতে। সেই থেকে তিনি। এদেশে রয়ে যান এবং নেপথ্য থেকে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব দেন। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেননি, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রার্থনা করেও তিনি বারবার ব্যর্থ হন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার। জাতীয় সংসদে জানান যে, তাঁর নাগরিকত্ব প্রত্যর্পণ করার ইচ্ছা সরকারের। নেই। সকল রীতিনীতি ভঙ্গ করে এহেন ব্যক্তির প্রকাশ্যে এদেশের একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নির্বাচিত হওয়ার পেছনে গূঢ় অভিসন্ধি কাজ করছে। বলে সকলের মনে হয়।
গোলাম আযমকে আমির ঘোষণার প্রতিবাদে এবং বাংলাদেশ থেকে তাঁকে বহিষ্কারের দাবিতে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-সংগঠন এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বিবৃতি দেয়। বড়ো দুটি রাজনৈতিক দলের কোনোটিই তার মধ্যে ছিল না, তবে আওয়ামী লীগের ছাত্র-সংগঠন ছাত্রলীগ ছিল। ১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে গোলাম আযম সম্পর্কে আলোচনায় আওয়ামী লীগ তাঁর বহিষ্কার দাবি করে।
জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকেই শাহরিয়ার কবির আমাকে জানান যে, একটি গণ-আদালত গঠন করে গোলাম আযমের বিচারের বিষয়ে ভাবনাচিন্তা হচ্ছে। এমন একটা উদ্যোগ নেওয়া হলে আমি তাতে অংশ নেবো কি না তিনি তা। জানতে চান। আমি বলি, অবশ্যই নেবো। পরে তিনি আমাকে কর্নেল কাজী নূরউজ্জামানের বাড়িতে আহূত দুটি সভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান। আমি এর কোনোটিতেই যেতে পারিনি। প্রথম সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে শাহরিয়ারের কাছ থেকে শুনে আমি একাত্মতা প্রকাশ করি। দ্বিতীয় সভায় গণ আদালত আহ্বানের জন্যে কমিটির নাম স্থির হয় ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। ‘নিমূল’ শব্দটি আমার পছন্দ হয়নি, সেকথাও আমি শাহরিয়ারকে জানিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন সর্বসম্মতিক্রমে নামটি গৃহীত হয়েছে, এখন আর তা পুনর্বিবেচনার সুযোগ নেই। এই দ্বিতীয় সভাতেই জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে ১০১ জন সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। তার মধ্যে আমাকেও রাখা হয়।
এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী আমাকে বলেন যে, তিনি এই উদযোগে সংশ্লিষ্ট হতে চান। আমি তাঁকে শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিই। এরপরই অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরীর উদযোগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চক্র প্রতিরোধ মঞ্চ’ গঠিত হয়, মান্নান চৌধুরী তার একজন নেতারূপে আত্মপ্রকাশ করেন। তারা আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ সমর্থনলাভ করেন। কয়েক দফা আলোচনার পর দুটি সংগঠন মিলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠিত হয় জাহানারা ইমামকেই আহ্বায়ক রেখে। পরে আবদুল মান্নান চৌধুরী হন এর সদস্য-সচিব। স্থির হয়, ২৬ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-আদালত প্রকাশ্যে বসবে এবং গোলাম। আযমের বিচার অনুষ্ঠিত হবে।
জাহানারা ইমাম আমার ছাত্রী ছিলেন। সেই দাবিতে তিনি বললেন, গণ আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আমাকেই অভিযোগ উত্থাপন করতে হবে। আমি তাকে বললাম, এতে আমার আপত্তি নেই, তবে যেহেতু ১৯৭১ সালে আমি দেশ ছেড়ে গিয়েছিলাম, তাই গোলাম আযমের তখনকার কার্যকলাপ সম্পর্কে আমার অভিযোগ হবে শোনা কথার সামিল। আমি বরঞ্চ ১৯৭২ সাল থেকে গোলাম আযম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যা যা করেছেন, সে-সম্পর্কে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে অভিযোগ আনবো। আর কেউ ১৯৭১ সালে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগ করুক।
আলোচনার পরে স্থির হলো, গণ-আদালতে অভিযোগকারী হবো আমরা তিনজন : বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গোলাম আযমের ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করবেন সৈয়দ শামসুল হক; মুক্তিযুদ্ধকালে তার ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করবে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর; আর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পৃথিবীর নানাদেশে তার বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকা সম্পর্কে অভিযোগ উত্থাপন করবো আমি।
গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিচার হবে–এমন একটি সংবাদ ছড়িয়ে পড়ামাত্র মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেল। ছাত্রেরা ছিল সামনের কাতারে। প্রজন্ম ‘৭১ ছিল খুব সক্রিয়। জাতীয় কবিতা উৎসবে উপস্থিত প্রায় সকলেই বিচারকার্যের সমর্থনে গণস্বাক্ষরে অংশগ্রহণ করলেন। ৩ মার্চে ঢাকায় সমন্বয় কমিটি-আহূত জনসভায় শেখ হাসিনা বললো, বাংলার মাটিতে গোলাম আযমসহ একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার হবেই।’ কয়েকদিন পরে ১০০ জন সংসদ-সদস্য গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিচার সমর্থন করে বিবৃতি দেন। ৫২ জন আলেম বিচারের উদ্যোগের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। কয়েকটি নারী-সংগঠনও একযোগে আমাদের সমর্থন করে। নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর নেতৃত্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসে।
জাহানারা ইমাম যেখানেই যান, সেখানেই মানুষ তাঁর কথা শুনতে ছুটে আসে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ তার সন্তান রুমীর সূত্রে তিনি শহীদ-জননী আখ্যা লাভ করেন। দেখতে দেখতে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত গণ আদালতের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন গড়ে ওঠে সাধারণ মানুষের মধ্যে। সরকার এতে বিচলিত হয়। এক পর্যায়ে জাহানারা ইমাম এবং সমন্বয় কমিটির নেতৃস্থানীয় কয়েকজনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠানো হয়। সরকার গণ আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলে। সমন্বয় কমিটি থেকে বলা হয়, ২৫ মার্চের মধ্যে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে গণ আদালত বসানোর প্রয়োজন হবে না। কোনো পক্ষই অপর পক্ষের প্রস্তাবে সম্মতি না হওয়ায় আলোচনা নিষ্ফল হয়।
জামায়াতে ইসলামী এবং তার সমর্থকেরাও নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। নানাভাবে গণ-আদালতের বিরুদ্ধে তারা প্রচার চালান। জাহানারা ইমামকে জাহান্নামের ইমাম ও ঘসেটি বেগম নামে অভিহিত করা হয়। পুরো উদ্যোগকে সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী বলে আখ্যা দেওয়া হয়। কোনো একটি রাজনৈতিক দল দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে লাভবান হতে চাইছে, একথাও বলা হয়। বায়তুল মোকাররমের খতিব খুব তীব্র ভাষায় সমগ্র প্রক্রিয়াকে আক্রমণ করেন।
১৭ মার্চ গোলাম আযমের প্রতি নির্দিষ্ট দিনে গণ-আদালতে হাজির হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সমন জারি করা হয়। ২০ মার্চ আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং বাম রাজনৈতিক দলগুলি গণ-আদালতের কর্মসূচি সফল করতে দেশবাসীকে আহ্বান জানায়। ২২ মার্চ লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, গোলাম আযম আইনের ঊর্ধ্বে নন, তবে গণ-আদালতে তার বিচার সমর্থনযোগ্য নয়। ২৩ মার্চ সরকার গোলাম আযমকে কারণ দর্শানোর একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠায়। তাতে বলা হয়, ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও কেন তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করছেন না এবং আইনভঙ্গ করে জামায়াতের আমিরের পদ গ্রহণ করায় কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তার ব্যাখ্যা করতে। একই দিনে সমন্বয় কমিটিকেও সরকার কারণ দর্শানোর বিজ্ঞপ্তি পাঠায়। গণ-আদালতের কার্যক্রম কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তাতে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। পরের দিন গোলাম আযমকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। জাহানারা ইমামকে গ্রেপ্তার করা হবে বলেও গুজব ছড়িয়ে যায়। সরকারি প্রচারমাধ্যমে গণ-আদালতে বিচার-প্রক্রিয়াকে আইন ও সংবিধান পরিপন্থী বলে অভিহিত করে তার অধিবেশন বন্ধ রাখার আহ্বান জানানো হয়। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় জাহানারা ইমাম আবার ঘোষণা করেন যে, পরদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-আদালত বসবে এবং গোলাম আযমের বিচার হবে।
২৫ মার্চ রাতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-আদালতের মঞ্চ নির্মাণ করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। সেখানে আনীত মাইক্রোফোনগুলি জব্দ করা হয়। চারুকলা ইনসটিটিউটের ছাত্রেরা ব্যানার নিয়ে সেখানে পৌঁছোলে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করতে উদ্যত হয় এবং তাড়া করে ইনসটিটিউট পর্যন্ত নিয়ে আসে। ২৬ মার্চ সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবদিকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এই অবস্থায় স্থির হয়, গণ-আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির কক্ষে আগে মিলিত হবেন। সেখানে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হলো। গাজীউল হক রায় লিখে নিয়ে এসেছিলেন। কিছু সংশোধনের পরে বিচারকেরা তাতে স্বাক্ষর দিলেন।
গণ-আদালতে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন জাহানারা ইমাম (চেয়ারম্যান), অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, অধ্যাপক আহমদ শরীফ, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, শিল্পী কলিম শরাফী, মওলানা আবদুল আউয়াল, কর্নেল (অব.) কাজী নূরউজ্জামান, কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী ও ব্যারিস্টার শওকত আলী খান। বিচারকমণ্ডলীতে বেগম সুফিয়া কামাল ও শওকত ওসমানের নাম ছিল। সরকার ২৬ মার্চ কী ধরনের ব্যবস্থা নেবে এবং ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে সুফিয়া কামাল তা কতটা মোকাবেলা করতে পারবেন, তা চিন্তা করে শেষ মুহূর্তে বিচারকমণ্ডলী থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়। শওকত ওসমান নির্দিষ্ট সময়ে এসে পৌঁছোতে পারেননি–তাকে যারা আনতে গিয়েছিলেন, তারা তাকে বাসায় পাননি, তাই তাকে বাদ দিয়ে সাক্ষীদের একজন, সাংবাদিক মওলানা আবদুল আউয়ালকে বিচারকের আসন দেওয়া হয়। তার জায়গায় সাক্ষী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন মওলানা ইয়াহিয়া মাহমুদ। অভিযোগকারীদের কৌসুলি ছিলেন অ্যাডভোকেট জেড আই পান্না, অ্যাডভোকেট শামসুদ্দীন বাবুল ও অ্যাডভোকেট কুলসুম রেখা। গণ আদালতের সমনের কোনো জবাব গোলাম আযম দেননি। তাঁর পক্ষসমর্থনের জন্যে গণ-আদালত অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ নজরুল ইসলামকে (আসিফ নজরুল নামে অধিকতর পরিচিত) নিযুক্ত করেন। আমাদের অভিযোগগুলোকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অপরাপর সাক্ষী ছিলেন ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, শাহরিয়ার কবির, মুশতারী শফী, সাইদুর রহমান, অমি কায়সার, ড. হামিদা বানু (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), মওলানা ইয়াহিয়া মাহমুদ, আলী যাকের ও ডা. মুশতাক হোসেন। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ গণ-আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন। তিনিও সুপ্রিম কোর্ট ভবনে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। তার অভিযোগ ছিল প্রধানত তার স্বামী শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদের হত্যায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে। তাঁকে বলা হলো, সাঈদীর বিচারের জন্যে আরেকটি গণ-আদালত বসবে, তখন তিনি হবেন সেই মামলার প্রথম সাক্ষী। তিনি এরপরও আমাদের সঙ্গে থাকেন এবং হেঁটে আসেন সুপ্রিম কোর্ট থেকে সোসাহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কুষ্টিয়া থেকে তিনজন বীরাঙ্গনা এসেছিলেন সাক্ষ্য দিতে। ওই পরিস্থিতিতে তাঁরা সাক্ষ্য দিতে পারেননি। তাঁদেরকে ঘিরে কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমেছিল উদ্যানে। জামায়াত-সমর্থক পত্রিকায় তাঁদের সম্পর্কে অমার্জিত কটাক্ষ করা হয়েছিল।
দশটা বাজতে না বাজতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মানুষ বিভিন্ন দিক দিয়ে। প্রবেশ করতে শুরু করে। নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ও তার কয়েকজন সঙ্গী দুটি ট্রাক সেখানে ঢুকিয়ে দেয়। তা জোড়া দিয়ে তৈরি হয় গণ-আদালতের মঞ্চ। সুপ্রিম কোর্ট ভবন থেকে আমরা হেঁটে যাই উদ্যানে সাড়ে এগারোটা থেকে। বারোটার মধ্যে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমরা যখন প্রবেশ করি, তখন লোকে লোকারণ্য। যদিও আমাদের পথ করে দেওয়া হচ্ছিল, তবু চলতে অসুবিধে হচ্ছিল। আমি একসময়ে পড়ে যাই–বোধহয় হোঁচট খেয়ে। আমার সঙ্গে যারা ছিলেন, তাঁরা ভয় পেয়ে গেলেন এবং আমাকে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিতে বাধ্য করলেন। ফলে আমি অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। বিচারকেরা ট্রাকে উঠেছেন, অন্য এত লোকে তাঁদের সঙ্গে উঠে পড়েছে যে আমরা অভিযোগকারীরা কাছে যেতে পারলাম না। এদিকে নতুন করে মাইক বসানোর চেষ্টা সফল হয়নি। জাহানারা ইমাম একটি ছোটো বক্তৃতা দিয়ে আবদুল মান্নান চৌধুরীকে রায় পড়ে শোনাতে। বলেন। কিন্তু তার আগেই কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেন–যদিও তার কোনো সুযোগ বা প্রয়োজন ছিল না।
গণ-আদালতের সাক্ষ্য ও দাখিলকৃত প্রদর্শনী বিবেচনা করে বিচারকেরা রায়ে বলেন, অভিযুক্ত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রতিটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করি এবং আনীত প্রতিটি অভিযোগের প্রত্যেক অপরাধে তাকে দোষী সাব্যস্ত করছি। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশে উপরোক্ত অপরাধ দৃষ্টান্তমূলক মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ।
‘যেহেতু গণ-আদালত কোনো দণ্ডাদেশ কার্যকর করে না, সেহেতু গোলাম আযমকে আমরা দোষী সাব্যস্ত করে তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে বাংলাদেশ সরকারের নিকট অনুরোধ জানাচ্ছি।’
একে মাইক্রোফোন নেই, তার ওপর জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাস, সর্বোপরি ট্রাকে দাঁড়ানো নেতাকর্মীদের কোলাহল–কেউ কিছু শুনতে পেলেন বলে মনে হলো না। কর্তাব্যক্তিরা স্থির করলেন, উদ্যান থেকে প্রেস ক্লাবে গিয়ে জাহানারা ইমাম সাংবাদিকদের কাছে বিচার-প্রক্রিয়া ও রায় ব্যাখ্যা করবেন। তাঁর সঙ্গে আবদুল মান্নান চৌধুরী, সৈয়দ হাসান ইমাম, সৈয়দ শামসুল হক, ফয়েজ আহমদ ও মওলানা আবদুল আউয়াল গেলেন, সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও জাসদের কয়েকজন নেতাও।
প্রেস ক্লাবে যাওয়ার পরে ধীরস্থির হয়ে বসার আগেই জাহানারা ইমামের কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চান, রায় কী হয়েছে। তিনি বলেন, গোলাম আযমের ফাঁসির আদেশ হয়েছে।
আমি পরে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি এ কথা বললেন কেন–রায়ে তো ফাঁসির কোনো কথা নেই। তিনি বলেন, উত্তেজনাবশত তিনি অমন বলে ফেলেছিলেন–তার ভুল হয়েছে।
আমি প্রেস ক্লাবে যাইনি, আমার যাওয়ার কথাও ছিল না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বেরিয়ে আমি ঢাকা ক্লাবে যাই। সেখানে অনেকে অপেক্ষা করছিলেন উদ্যানে কী হয়, তা জানার জন্যে। তেমন একজন ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের এককালীন সদস্য মফিজুর রহমান। তাঁর স্ত্রীও সঙ্গে ছিলেন। তিনি আমাকে জোর করে চা খাওয়ালেন। আমার কাছে রায়ের কপি আছে কি না জানতে চাইলেন। সেটা নেই শুনে আমার অভিযোগপত্রের কপি চাইলেন। আমার কাছে একটিমাত্র কপি ছিল, সেটা বের করে দিলাম। তাঁর স্ত্রীকে শোনাবার জন্যে অভিযোগপত্রটি তিনি জোরে জোরে পড়তে থাকলেন :
মাননীয় আদালত,
আমি, মরহুম ডা. এ টি এম মোয়াজ্জমের পুত্র এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অভিযোগ উত্থাপন করছি।
আমি অভিযোগ করছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে লাঞ্ছিত মায়েদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি হানাদার বাহিনী দ্বারা ধর্ষিত বোনদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসর আল বদর কর্তৃক নিহত বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি শত্রুর হাতে প্রাণদানকারী পিতামাতার অসহায় এতিম সন্তানদের পক্ষে; আমি অভিযোগ করছি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিকদের পক্ষে।
আমি অভিযোগ আনছি মরহুম মওলানা গোলাম কবিরের পুত্র গোলাম আযমের বিরুদ্ধে–ইনি একজন পাকিস্তানি নাগরিক, তবে বহুদিন ধরে বেআইনিভাবে বসবাস করে আসছেন ঢাকার রমনা থানার মগবাজার এলাকার ১১৯ নম্বর কাজী অফিস লেনে।
ইনি সেই গোলাম আযম–যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতিটি অন্যায়, বেআইনি, অমানবিক ও নিষ্ঠুর কাজ প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিলেন; যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দিয়ে তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করার আহ্বান জানিয়েছিলেন; যিনি আল বদর বাহিনী গড়ে তুলে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করার প্ররোচনা দিয়েছিলেন। গোলাম আযমের প্ররোচনায় নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আছেন আমার শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সন্তোষকুমার ভট্টাচার্য ও সিরাজুদ্দীন হোসেন, আমার অগ্রজপ্রতিম শহীদুল্লা কায়সার, আমার বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আহমদ, আমার সহকর্মী আবুল খায়ের, আনোয়ার পাশা, রাশীদুল হাসান ও মোহাম্মদ মোর্তজা, আমার ছাত্র আ ন ম গোলাম মোস্তফা ও সৈয়দ নজমুল হক–যাদের মৃত্যুতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত, শোকাহত ও ব্যথাতুর।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আমার বিশেষ অভিযোগ : তিনি সর্বদা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন এবং এখনো করছেন; বিশেষ করে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৮ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সশরীরে উপস্থিত থেকে, বক্তৃতা ও আলোচনার মাধ্যমে, স্মারকলিপি ও বিবৃতির দ্বারা, মুদ্রিত ও প্রকাশিত প্রচারপত্র ও প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে এবং সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করে নিজে এবং অপরের দ্বারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে দুর্বল ও সহায়হীন, বিচ্ছিন্ন ও বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেছেন। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
আমার অভিযোগের সমর্থনে গোলাম আযমের কিছু কার্যকলাপের পরিচয় এখানে তুলে ধরছি।
১. ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলে গোলাম আযম পাকিস্তানে বসে মাহমুদ আলী ও খাজা খয়েরউদ্দীনের মতো দেশদ্রোহীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি নামে একটি সংগঠনের সূচনা করেন এবং বিভিন্ন দেশে পূর্ব পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার আয়োজন করেন। তিনি এই উদ্দেশ্যে দীর্ঘকাল পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির বলে নিজের পরিচয় দিতেন।
২. ১৯৭২ সালে গোলাম আযম লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করেন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে আবার এই ভূখণ্ডকে পাকিস্তানের অংশে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করেন। ১৯৭৩ এ ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত ফেডারেশন অফ স্টুডেন্টস ইসলামিক সোসাইটিজের বার্ষিক সম্মেলনে এবং লেসটারে অনুষ্ঠিত ইউ কে ইসলামিক কমিশনের বার্ষিক সভায় তিনি বাংলাদেশবিরোধী বক্তৃতা দেন। ১৯৭৪-এ মাহমুদ আলীসহ কয়েকজন পাকিস্তানিকে নিয়ে তিনি পূর্ব লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির এক বৈঠক করেন। বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে দেখে এই সভায় স্থির হয় যে, তারা এখন থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের আন্দোলন করবেন। এই সভায় গোলাম আযম ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাংলাদেশে ফিরে অভ্যন্তর থেকে কাজ চালানোর প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করেন। ১৯৭৭-এ লন্ডনের হোলি ট্রিনিটি চার্চ কলেজে অনুষ্ঠিত একটি সভায় তিনি এ কথারই পুনরাবৃত্তি করেন এবং সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও বাংলাদেশি ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আগমন করেন।
৩. ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে গোলাম আযম রিয়াদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামি যুব সম্মেলনে যোগদান করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকল মুসলিম রাষ্ট্রের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত তিনি সাতবার সউদি বাদশাহ্র সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার আহ্বান জানান এবং কখনো তিনি বাদশাহকে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে ও কখনো বাংলাদেশকে আর্থিক বা বৈষয়িক সাহায্য না দিতে অনুরোধ করেন। ১৯৭৪ সালে রাবেতায়ে আলমে ইসলামির উদ্যোগে মক্কায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এবং ১৯৭৭ সালে কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত একটি সভায়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন।
৪. অনুরূপভাবে গোলাম আযম ১৯৭৩ সালে বেনগাজিতে অনুষ্ঠিত ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য লবিং করেন। একই বছরে ত্রিপলিতে অনুষ্ঠিত ইসলামি যুব সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে হানিকর বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
৫. ১৯৭৩ সালে গোলাম আযম মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম স্টুডেনটস অ্যাসোসিয়েশন অফ আমেরিকা অ্যান্ড কানাডার বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানভুক্ত করার জন্য সবাইকে কাজ করতে আহ্বান জানান।
৬. ১৯৭৭ সালে গোলাম আযম ইসতামবুলে অনুষ্ঠিত ইসলামিক ফেডারেশন অফ স্টুডেনটস অরগানাইজেশনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশবিরোধী বক্তৃতা করেন।
মাননীয় আদালত,
আমি গোলাম আযমের বিরুদ্ধে বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করছি। ইনি সেই গোলাম আযম-যাকে ফেরার ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নিজ এলাকার মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হতে নির্দেশ দেন; ১৯৭৩ সালের ১৮ই এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনবলে বাংলাদেশ সরকার যার নাগরিকত্ব বাতিল করে দেন; যিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও তিন মাসের ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালের ১১ই জুলাই বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যিনি বেআইনিভাবে এ দেশে রয়ে যান; ১৯৭৬, ১৯৭৭, ১৯৭৮, ১৯৭৯ ও ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করেও যিনি নাগরিকত্ব ফেরত পাননি; বাংলাদেশ সরকার যাকে ১৯৮৮ সালের ২০শে এপ্রিলের মধ্যে দেশত্যাগের নির্দেশ দিলেও যিনি বাংলাদেশে থেকে যান; যার নাগরিকত্ব ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা বাংলাদেশ সরকারের নেই বলে ১৯৮৮ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছেন; সেই গোলাম আযমের উপযুক্ত শাস্তি বিধানের জন্য এই গণ আদালতের কাছে আমি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করলাম।
২৪.
গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিচার সারাদেশে অভূতপূর্ব উদ্দীপনার সঞ্চার করে। মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের সম্পর্কে সরকার কিছু করুক আর নাই করুক, নাগরিক সমাজের কণ্ঠস্বর যে ধ্বনিত হয়েছে, এটাই বড়ো কথা। জাহানারা ইমামকে দেশবাসী অত্যন্ত অল্পসময়ে জাতীয় নেতার সম্মানে ভূষিত করে। অন্তত এই একটি বিষয়ে তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হতে তাদের ইচ্ছা ব্যক্ত করে। বিভিন্ন জায়গায় গণ-আদালতের রায় কার্যকর করতে সরকারকে আহ্বান জানানো হয়।
গণ-আদালতের সাফল্য, মনে হয়, সরকারকে ক্রুদ্ধ করে। গণ-আদালতের অধিবেশনে জনসমাবেশের বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়ে শেখ হাসিনা এক চিঠি লিখেছিল জাহানারা ইমামকে। তার একটা ফটোকপি জোগাড় করে সংবাদপত্রে ছেপে দেন কোনো সাংবাদিক। সরকার নিশ্চিত হয় যে, গণ-আন্দোলনের মূলে আছে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র।
পরে জানতে পারি, ২৮ মার্চে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া শাহরিয়ার কবির ও নাসিরউদ্দীন ইউসুফকে ডেকে পাঠিয়ে গণ-আদালতের বিষয়ে আলাপ করেন। এই আলোচনার বিবরণ শাহরিয়ার কবির লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর গণ আদালতের পটভূমি (ঢাকা, ১৯৯৩) গ্রন্থে। প্রধানমন্ত্রী তাদের কাছে জানতে চান, গোলাম আযমের বিষয়ে প্রচলিত আদালতে না গিয়ে কেন তারা গণ আদালত বসাতে গেলেন। তিনি অভিযোগ করেন, গণ-আদালত গঠন করে দেশের প্রচলিত আদালতকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। নির্বাচিত সরকার যখন দেশে গণতন্ত্র-প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে, তখন সেই সরকারকে বিব্রত করতে এই উদযোগ নেওয়া হয়েছে। গোলাম আযমকে গ্রেপ্তার করার পরেও এ-ধরনের উদযোগ নেওয়ায় দেশে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে, অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিয়েছে, ব্যাংকে এলসি খোলা কমে গেছে। আওয়ামী লীগ দেশের সৃষ্টিশীলতা নষ্ট করতে চায়, আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগের হাতে খেলছে। গণ আদালতের অনুষ্ঠান কোনোভাবেই অনুমোদনযোগ্য নয় এবং গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার জন্যে অবিলম্বে এই আন্দোলন বন্ধ করা দরকার।
শাহরিয়ার কবির ও নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু এসব অভিযোগের যথাযথ জবাব দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাদের কথায় সন্তুষ্ট হননি।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে শাহরিয়ার চলে যান কর্নেল নূরউজ্জামানের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন যে, গণ-আদালতের প্রশ্নে ২৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা বেরিয়েছে তার মধ্যে তিনিও আছেন। তখন তারা জাহানারা ইমামের বাড়িতে যান বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে।
সে-সময়ে আমি ঘরে বসে গল্প করছি। বন্ধু এ জেড এম আবদুল আলী আছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের গোলাম মুস্তাফা আছে, আছে আরো দু-একজন। এমন সময়ে টেলিফোন এলো এক সাংবাদিকের : একটু আগে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালত থেকে জাহানারা ইমাম ও আরো ২৩ জনের নামে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা বেরিয়েছে, তার মধ্যে আমার নামও আছে। দণ্ডবিধির ১২০, ১২১, ১২৪ (ক), ১৪৮, ৫০৪ এবং ৫০৫ (ক ও খ) ধারায় অভিযোগ আনীত হয়েছে। সাংবাদিক আমাকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য খবর দিচ্ছেন।
খবর শুনে আমি ফোন করলাম, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদকে। তাকে না। পেয়ে ফোন করলাম অ্যাডভোকেট মাহমুদুল ইসলামকে (পরে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি-জেনারেল)। তিনি বললেন, যেসব ধারায় অভিযোগ করা হয়েছে, তার মধ্যে কোনো কোনোটি জামিনের অযোগ্য। আজকের রাতটা বাড়িতে না থাকাই ভালো। কাল হাইকোর্ট থেকে জামিন নেওয়ার একটা চেষ্টা করা যেতে পারে।
জাহানারা ইমামের বাড়িতে ফোন করলাম, তিনি নেই। শাহরিয়ার কবিরের বাড়িতে ফোন করলাম, তিনি নেই। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের বাড়িতে ফোন করলাম, সেও নেই।
বুঝলাম, সকলেই খবর পেয়ে গেছেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছেন। মনে একটু ক্ষোভও জন্মালো-যারা খবরটা পেলেন, তাঁরা কেউ আমাকে কিছু জানাবার প্রয়োজন বোধ করলেন না!
গুলশানে আমার বন্ধু মসিহুর রহমানকে ফোন করে বললাম বাড়ির গেট খোলা রাখতে। একটা ব্যাগে সামান্য কিছু কাপড়, প্রয়োজনীয় জিনিস আর ওষুধ নিয়ে নিলাম। আবদুল আলীর গাড়িতে করে মসির বাড়ি এলাম। আমার হাতে ব্যাগ দেখে মসি বললো, ‘কিছু একটা ঝামেলা বাধিয়েছিস, বুঝতে পারছি।’
খানিক বাদে বাড়ি থেকে ফোন এলো। সমন্বয় কমিটির হয়ে কেউ ফোন করে জানিয়েছেন, কাল সকাল দশটায় যেন হাইকোর্টে উপস্থিত থাকি।
রাতটা মসির বাড়িতে কাটালাম। সকালে খবরের কাগজ এলেই দেখতে পেলাম, এটাই বিশাল শিরোনামযুক্ত প্রথম সংবাদ। আসামি ২৪ জন হলেন গণ আদালতের বিচারক জাহানারা ইমাম, গাজীউল হক, আহমদ শরীফ, মাজহারুল ইসলাম, শফিক আহমেদ, ফয়েজ আহমদ, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, মওলানা আবদুল আউয়াল, কর্নেল নূরউজ্জামান, কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী ও শওকত আলী খান; উভয় পক্ষের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, শামসুদ্দীন বাবুল, উম্মে কুলসুম রেখা ও নজরুল ইসলাম (আসিফ নজরুল); অভিযোগকারী আনিসুজ্জামান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও সৈয়দ শামসুল হক; গণ-আদালতে সাক্ষ্যদাতা শাহরিয়ার কবির, মওলানা ইয়াহিয়া মাহমুদ, আলী যাকের ও ডা. মোশতাক হোসেন; এবং সমন্বয় কমিটির সদস্য-সচিব আবদুল মান্নান চৌধুরী। যে-পাঁচজন সাক্ষী অভিযুক্ত হননি, তাঁরা হলেন মেঘনা গুহঠাকুরতা, মুশতারী শফী, সাইদুর রহমান, অমি কায়সার ও হামিদা বানু–এঁরা সকলেই শহীদ পরিবারের সদস্য। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেআইনি সমাবেশের, রাষ্ট্রদ্রোহিতার, সরকারের বিরুদ্ধে বৈরিতা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর, বিশৃঙ্খলাসৃষ্টির, জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করার, জনশৃঙ্খলার ক্ষতিসাধনের ইত্যাদি ইত্যাদি।
মসির গাড়িতে করে হাইকোর্টে এলাম। হাইকোর্টে যে কোথায় যাবো, তা জানা ছিল না। তবে বার অ্যাসোসিয়েশন ভবনে যেতেই কেউ না কেউ এদিকে এদিকে’ বলে আমাকে নিয়ে গেলেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির কক্ষে। আমার ব্যাগ রয়ে গেল মসির গাড়িতে। সে বললো, ‘যদি জেলে যাস, তাহলে সেখানে পৌঁছে দেবো। আর যদি বাড়ি ফিরে যেতে পারিস, তাহলে সেখানে দিয়ে আসবো। মসি ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে জেল খেটেছিল।
বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির কক্ষে অভিযুক্তদের অধিকাংশই ততক্ষণে জমা হয়েছেন। গাজীউল হক প্রস্তাব করলেন, অভিযুক্তেরা সবাই সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে মিছিল করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতের দিকে যাবেন। পথে যদি পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে তো তাই সই।
কথাটা আমার একেবারেই পছন্দ হলো না। তবু অন্যেরা কী বলেন, তা শুনতে চুপ করে রইলাম। কবীর চৌধুরীই প্রথমে মুখ খুললেন। বললেন, এমন সিদ্ধান্ত হবে হঠকারী। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত আইনি লড়াই চালানো।
আমি তাকে সমর্থন করলাম। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, কলিম শরাফী, জেড আই পান্নাও কবীর চৌধুরীর বক্তব্যের সঙ্গে মতৈক্য ঘোষণা করলেন। . প্রথমে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ এবং তারপরে ড. কামাল হোসেনের মত চাওয়া হলো। তারা বললেন, হাইকোর্ট বিভাগে জামিন চেয়ে আবেদন করা উচিত। তাঁরা দুজনেই আমাদের পক্ষে আবেদন পেশ করার আশ্বাস দিলেন।
খানিক বাদে ওই দুজনের পেছনে আমরা সবাই এবং অনেক আইনজীবী গিয়ে হাজির হলাম বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী ও বিচারপতি এম এ করিমের এজলাসে। সেখানে আমীর-উল ইসলাম ও সুধাংশুশেখর হালদারও এলেন। ইশতিয়াক আহমেদ ও কামাল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার! কামাল হোসেন সামান্য একটু বলতেই তিনি বললেন, আমি তো এদের চাই না। যে-আদালত এঁদের চান, আপনারা সেখানে যান। যে-আদালত পরওয়ানা জারি করেছেন, সেখানে আত্মসমর্থন করেই জামিন প্রার্থনা করা বিধেয়।
কামাল হোসেন বললেন, এই মামলাটি খুব ভিন্ন ধরনের, এদেশের ইতিহাসে এর কোনো নজির নেই। অভিযুক্তরা এদেশের অত্যন্ত মান্যগণ্য মানুষ। তাদের বিরুদ্ধে যে-ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে, তা তারা করেননি, তাঁদের পক্ষে করাও সম্ভবপর নয়। কষ্টকল্পিত অভিযোগের ভিত্তিতে নিম্নআদালত গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি করেছেন, সেখানে গিয়ে সুবিচার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই আমরা এই আদালতে এসেছি।
বিচারপতি টি এইচ খান–যার কাছে জগন্নাথ কলেজে আমি লজিক পড়েছি, তিনি–উঠে দাঁড়ালেন, কামাল হোসেনের বক্তব্যের বিরোধিতা করতে। তিনি বেশ উত্তেজিত ছিলেন। এক পর্যায়ে আদালতকে উদ্দেশ করে বাংলায় বললেন, ‘এরা তো আপনাকে মানে না, দেশের কোনো আদালতই মানে না, এরা নিজেদেরকে আদালত ঘোষণা করে বসে আছে। এরা এখানে এসেছে কেন?
বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী পালটা প্রশ্ন করলেন, আমাকে যদি না ই মানে, তবে আমার কাছে আসবে কেন? মানে বলেই তো এসেছে।
আমাদের পক্ষে ইশতিয়াক আহমেদ, কামাল হোসেন ও আমীর-উল ইসলাম কিছু নিবেদন করলেন।
টি এইচ খান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি-জেনারেল আবদুল ওদুদ ভূঁইয়া এবং আরো দু-একজন আইনজীবী সরকারের পক্ষ নিলেন। তাদের যুক্তিতর্কের মধ্যে। আদালত-কক্ষে প্রবেশ করলেন অ্যাটর্নি-জেনারেল আমিনুল হক। বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী তাঁকে দেখে বললেন, এই যে অ্যাটর্নি-জেনারেল এসে গেছেন। আমরা এখন তার কথা শুনি।
আমিনুল হক দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, এই মামলায় তিনি সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছেন না, এ-বিষয়ে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিচারপতি টি এইচ খানকে। সরকারের পক্ষে যা কিছু বলার, তিনিই বলবেন।
আমরা জানতাম, আমিনুল হক যখন অ্যাটর্নি-জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তাঁর ছিল অকৃত্রিম আনুগত্য। সেই বোধ থেকে তিনি আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে অস্বীকার করেছিলেন। এমন নীতিবোধের দৃষ্টান্ত সুলভ নয়।
বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরীর ভাষা ও ভঙ্গি ছিল খুবই চিত্তাকর্ষক। এক পর্যায়ে টি এইচ খান তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ডু ইউ সি মাই পয়েন্ট, মাই। লর্ড? তিনি জবাব দেন, অ্যাজ ক্লিয়ার অ্যাজ দি টুইঙ্কলিং স্টার।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে এবং সমাজে অভিযুক্তদের কয়েকজনের ভূমিকার উল্লেখ করে ইশতিয়াক আহমেদ বলেছিলেন, এই যাঁদের অবদান, তাঁরা। রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কোনো কাজে জড়িত হবেন, এ-কথা অবিশ্বাস্য। তাতে বিচারপতি চৌধুরী মন্তব্য করেন, অর্থাৎ আপনি বলতে চান, যারা সন্তানের জন্ম দিয়েছে, তারা তার ঘাতক হতে পারে না?
বেলা গড়িয়ে এলো। আদালত পরদিন পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করলেন এবং আদেশ দিলেন, শুনানির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আবেদনকারীদের কাউকে যেন গ্রেপ্তার না করা হয়।
এজলাস থেকে বেরিয়ে দেখি আমার মামাতো ভাই–কামরু ভাই–অপেক্ষা করছেন। সংবাদপত্রের খবর দেখে খোঁজখবর নিয়ে তিনি আদালতে এসেছেন এবং নীরবে ও না-খেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
কেবল তিনি নন, বহুজন সেদিন আদালত-প্রাঙ্গণে অপেক্ষা করেছিলেন আমাদের জামিন হয়েছে–এ খবরটি জেনে যাওয়ার জন্যে। যদিও সেদিন। জামিন হয়নি, তবু আমরা যে গ্রেপ্তার হইনি, তাতেই তারা খুশি হয়ে ফিরে যান।
আদালত থেকে আমরা তিন নেতার মাজারের পাশ দিয়ে বের হলাম। একটু এগিয়ে রিকশা পাওয়া গেল। কামরু ভাই ও আমি এক রিকশায় বাড়ি ফিরলাম। সেখানেও দেখি অনেক মানুষের ভিড়–আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীরা উদ্বেগের সঙ্গে অপেক্ষা করছেন কী হলো, তা জানার জন্যে।
পরে বেবীর কাছে শুনলাম, আমাদের বিরুদ্ধে মামলার খবর জেনে সমাজকল্যাণ ইনসটিটিউটের মুহাম্মদ সামাদের স্ত্রী রীমা তার সংসারখরচের বরাদ্দ থেকে দু হাজার টাকা নিয়ে বেবীর হাতে দিয়েছিল আমার পক্ষে মামলা চালানোর খরচ জোগাতে। টাকাটা বেবী নেয়নি প্রয়োজন হয়নি বলে, কিন্তু রীমার সহৃদয়তা তাকে ও আমাকে খুব স্পর্শ করেছিল।
সেদিন বিরোধী দলীয় নেতার বাসভবনে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বারোটি রাজনৈতিক দলের এক সভা হয়। সেখানে আমাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারির নিন্দা করা হয়। সারাদেশে রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে কোথাও মিছিল নিয়ে, কোথাও সভা করে, কোথাও বিবৃতি দিয়ে মামলা প্রত্যাহার করার দাবি জানানো হয়। আমাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি করায় মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালত অনির্দিষ্টকালের জন্যে বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতি।
৩০ মার্চে আবার হাইকোর্টে আমাদের জামিনের আবেদনের শুনানি হলো। সারাদিন কার্যক্রম চলার পরে আদালত আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মনজুর করেন। তবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিম্নআদালতে জামিনের আবেদন করতে আমাদের নির্দেশ দেন।
২৫.
হাইকোর্ট অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মনজুর করে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। নিম্নআদালতে যথাযথ জামিনের আবেদন করতে আমাদের নির্দেশ দেন। তবে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে আমরা যাইনি। কয়েকদিন পরে আমরা গিয়েছিলাম, যতদূর মনে পড়ে, ঢাকার অতিরিক্ত জেলা জজের আদালতে। সেদিন বোধহয় জেলা আইনজীবী সমিতির শ খানেক সদস্য আমাদের পক্ষে আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন। মামলা পরিচালনা করেছিলেন আমীর-উল ইসলামের নেতৃত্বে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।
আদালতে হাজির হয়ে আমরা দেখি, আসামীর কাঠগড়ায় জনাতিনেক দাঁড়িয়ে আছে কোমরে দড়ি পরে–তারা ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত। আইনজীবীরা। আমাদের বসতে বললেন তাদের জন্যে নির্ধারিত স্থানে আর স্থানাভাবে তারা অনেকে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরে বিচারক এসে আসন নিলেন (বিচারকের তো স্ত্রীলিঙ্গ হয় না, আর হলেও আমরা তা ব্যবহার করতাম না)। মামলা শুরু হতেই আসামীর কাঠগড়ার দিকে তাকিয়ে তিনি ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন, অভিযুক্তেরা কোথায়? আমীর-উল ইসলাম বললেন, তাঁরা সবাই আদালতে। হাজির আছেন। বিচারক আবারো কাঠগড়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি তো অভিযুক্তদের দেখতে পাচ্ছি না। আমীর-উল ইসলাম বললেন, সকলেই উপস্থিত, আপনি চাইলে একেক করে নাম ডেকে তাদের উঠে দাঁড়াতে বলতে পারি। আদালত বললেন, অভিযুক্তদের যথাস্থানে থাকতে হবে। এই কথায় সমবেত আইনজীবীরা একবাক্যে আপত্তি জানালেন–সেই কোলাহলে কে যে কী বললেন, তা শোনা গেল না। এই প্রতিবাদে বিচারক বিচলিত হলেন না। তিনি বললেন, অভিযুক্তেরা যেই হোন, আদালতে নির্দিষ্ট স্থানে তাদের দাঁড়াতে হবে–এই হলো রীতি। আমি গাজীউল হককে বললাম, চলুন, আমরা কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াই–তবে সেখানে সকলের জায়গা হবে কি না সন্দেহ। একজন আইনজীবী তা শুনে বললেন, না, আমরা কিছুতেই আপনাদের কাঠগড়ায় উঠতে দেবো না।’ আরেকজন ততক্ষণ বিচারককে বলছেন, অভিযুক্তদের পক্ষে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো বাধ্যতামূলক নয়–তাদেরকে আদালতে হাজির থাকতে হবে, এটাই আসল কথা। তারা যে আদালতে হাজির, এ-বিষয়ে আপনাকে সন্তুষ্ট হতে হবে। আমরা তাদেরকে একযোগে উপস্থিত করতে পারি, একজন-একজন করেও উপস্থিত করতে পারি–আপনি যেমনভাবে চান। অনুগ্রহ করে এঁদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বলবেন না। এ-কথা উপস্থিত আইনজীবীরা জোরেশোরে সমর্থন করলেন। তাদের উচ্চগ্রামের কথায় যথেষ্ট উন্মা প্রকাশ পেলো।
শেষ পর্যন্ত আদালত তাদের কথা মেনে নিলেন এবং সেদিনই আমাদের জামিন হলো।
মাস দু-আড়াই পরে কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারে আমার যোগদানের কথা। কানাডীয় হাই কমিশনের বাণিজ্য ও অর্থনীতি-বিষয়ক কাউনসেলরের সঙ্গে আমার বিলক্ষণ পরিচয় ছিল। আমি কাগজপত্রসমেত পাসপোর্টটা ভদ্রমহিলার হাতে দিয়ে বললাম, সাক্ষাৎকারের জন্যে আপনি যদি একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে দিতে পারেন, তবে উপকৃত হবো।
তখন ঢাকায় কানাডার ভিসা অফিস ছিল না। প্রতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে দিল্লির কানাডীয় হাই কমিশন থেকে দুজন ভিসা অফিসার ঢাকায় এসে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে ভিসা দিতেন বা দিতেন না।
কয়েকদিন পর বাণিজ্য ও অর্থনীতি-বিষয়ক কাউনসেলর ফোন করে আমাকে বললেন, আমি যেন হাই কমিশনে এসে বিশেষ একজন ভিসা অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সে-ভদ্রলোকের নাম বলতেই আমাকে সাদরে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। ভদ্রলোকের আচরণ খুবই সৌজন্যপূর্ণ। তিনি বললেন, আপনার কাছে একটা বিষয় জানার আছে। আপনার নামে কি কোনো ফৌজদারি মামলা আছে? প্রশ্নটা এমনই আকস্মিক যে আমার প্রথমে মনে পড়ল না, তারপরই বললাম, হ্যাঁ, একটা রাজনৈতিক বিষয়ে আমাদের কয়েকজনের নামে ফৌজদারি মামলা করেছে সরকার। তিনি জানতে চাইলেন আমি এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি কি না। জানালাম, মামলার কারণে আমি জামিনে আছি–তাছাড়া অন্য সব বিষয়ে আমার জীবনযাত্রা স্বাভাবিকভাবে চলছে। তিনি বললেন, দেখুন, কানাডার আইন-অনুযায়ী কারো বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা থাকলে তাকে ভিসা দেওয়া যায় না। আমি দুঃখিত। বললাম, এটাই যদি আপনাদের আইন হয়, তবে তো আমি ভিসার আশা করতে পারি না। তিনি একটু পরে বললেন, এ-কথাটা আমার আপনাকে জানাবার কথা নয়। আপনার বিরুদ্ধে যে ফৌজদারি মামলা আছে, তা আমাদের জানার কথাও নয়। তবে আপনাদের সরকার আমাদের কাছে আপনাদের নামের একটা তালিকা পাঠিয়েছে–খবর হিসেবে।
আমার পাসপোর্টে একটা ছোটো সিল নিয়ে ফিরে এলাম। এত বছর ধরে যখনই কোনো দেশের ভিসার জন্যে আবেদন করি, আমাকে লিখতে হয়, ১৯৯২ সালে কানাডার ভিসার জন্যে আবেদনপত্র প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তাতে অবশ্য অন্য দেশের ভিসা পেতে কখনো অসুবিধে হয়নি। তবে তারপর বহুদিন আর কানাডীয় ভিসার জন্যে আবেদন করিনি।
২০০৫ সালে যখন আবার আবেদন করি, কানাডীয় হাই কমিশন আমাকে ওই মামলার কাগজপত্র দেখাতে বলে। আমি জানাই, আমার কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো কাগজ নেই এবং কখনো ছিল না। হাই কমিশন বলে, কিছু একটা কাগজ দেখাও যে মামলা হয়েছিল এবং উঠে গেছে। আমি জাতীয় আর্কাইভস থেকে সংবাদপত্রের কিছু খবর ফটোকপি করে জমা দিই। তা দেখে ভিসা অফিসার অবাক হয়ে বলেন, শুধু এইজন্যে তোমার ভিসা হয়নি!
১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁদের মেয়াদের একেবারে শেষে জাহানারা ইমাম ও অপর ২৩ জনের বিরুদ্ধে সরকারের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে নেন। এতদিনে ঝামেলা থেকে মুক্ত হই।
ওদিকে ১৯৯২ সালের মার্চে গ্রেপ্তার হওয়ার পরে আটকাঁদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন গোলাম আযম। নিজের নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশের বিরুদ্ধেও তিনি আরেকটি মামলা করেন হাইকোর্টে। ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে হাইকোর্ট তাঁর আটকাঁদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। নাগরিকত্বের মামলার শুনানি হয় বিচারপতি ইসমাইলউদ্দীন সরকার ও বিচারপতি বদরুল ইসলাম চৌধুরীর আদালতে। তাঁরা দুজন দুরকম সিদ্ধান্ত দেন। ফলে মামলা যায় তৃতীয় বিচারকের কাছে। বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী–যিনি আমাদের ২৪ জনকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছিলেন–নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশ অবৈধ বলে রায় দেন। তারপর মামলাটি যায় আপিল বিভাগে। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি থাকার সময়ে গোলাম আযমের বিষয়সংশ্লিষ্ট কোনো নথিতে কোনো আদেশ দিয়েছিলেন। তাই তিনি আপিলটি শোনেন নি। আপিল বিভাগের বাকি চারজন বিচারক বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি এ টি এম আফজাল, বিচারপতি মোস্তাফা কামাল ও বিচারপতি লতিফুর রহমান ১৯৯৪ সালের জুন মাসে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। ততদিনে গোলাম আযম কারাগার থেকেও মুক্তি পেয়ে যান।
এ সময়ে কেউ কেউ আমাকে বলেন, গোলাম আযমের বিচারের জন্যে আমরা অমন তৎপর না হলে হয়তো নাগরিকত্বের প্রশ্নে তিনি মামলা করতেন না এবং তার বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধার হতো না। আমাদের আন্দোলনটি পরিণামে তাঁর পক্ষেই গেছে। আমি অবশ্য তা মনে করি না। গোলাম আযমের গণবিচারের বিষয়ে আমরা যা করেছি, তা যথার্থ ছিল। আমরা যে আরো অগ্রসর হতে পারিনি, তার জন্য দায়ী রাষ্ট্রীয় প্রতিকূলতা এবং আমাদের সাংগঠনিক তৎপরতার সীমাবদ্ধতা।
গণ-আদালতের রায়ের পর গোলাম আযমের বিচারের দাবি তুঙ্গে উঠেছিল। এ-নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় হয়–একাধিক দিন হরতাল পর্যন্ত হয়। জাহানারা ইমাম অসুস্থ শরীর নিয়ে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অসুস্থতা বৃদ্ধি পেলে তাঁর পক্ষে আর সক্রিয় থাকা সম্ভবপর হয়নি, চিকিৎসা নিতে তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে হয়। তার অনুপস্থিতিতে আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে।
আন্দোলন থেকে আমিও খানিকটা সরে আছি। আমি বলেছিলাম, আমরা গোলাম আযমের বিচার চাইবো, কিন্তু কোনো শাস্তি (যেমন, ফাঁসি) নির্দিষ্ট করে দাবি করবো না। শাস্তি দেবেন সাংবিধানিক আদালত, আমরা তা মেনে নেবো। আমার বক্তব্যের প্রতি তেমন সমর্থন মেলেনি। তবে সমন্বয় কমিটির জনসভা প্রভৃতিতে আমি তারপরও উপস্থিত থেকেছি। সুফিয়া কামালকে প্রধান করে যে তথ্য অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়, তার রিপোর্ট প্রদানের সময়েও আমি জনসমক্ষে হাজির ছিলাম।
একটি কাকতালীয় ঘটনা এই যে, গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার অব্যবহিত পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাহানারা ইমামের মৃত্যু হয়। মাঝখানে দিন চারেকের ব্যবধান ছিল, তখন তিনি সম্পূর্ণ চেতনও ছিলেন না। তাঁর মরদেহ ঢাকায় আনতে কয়েকদিন সময় লাগে। তার লাশ গ্রহণ করতে আমরা বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম, বহুসংখ্যক মানুষও সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে। ১৯৯৪ সালের ৫ জুলাই তিনি ঢাকায় সমাহিত হন।
২৬.
একটু আগের কথায় ফিরে যাই। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে আবুল খায়ের লিটু একদিন জানালো যে, চিকিৎসার জন্যে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে নেওয়া। দরকার সিঙ্গাপুরে, কিন্তু তিনি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, আমাকে সঙ্গে যেতে হবে। রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, লিটুর বুঝতে কোনো ভুল হয়নি। উপরন্তু সারের ইচ্ছে, আমিও যেন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করিয়ে আসি।
সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে যাত্রা। কলকাতায় যাত্রাবিরতি। সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে নেমে ভিসা সংগ্রহ। তারপর হলিডে ইনে ওঠা। সেখানে লিটু আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। সে অবশ্য ফিরে আসবে আগে। সারুকে সামলানো হবে আমার কাজ।
রাজ্জাক সাহেবের চিকিৎসকেরা তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে উপদেশ দিলেন। আমি এক অর্শ-বিশারদের শরণাপন্ন হলাম। আমার হৃদয়ঘটিত কাহিনি শুনে তিনি বললেন, অস্ত্রোপচারের আগে তাহলে হৃদ্রোগ-বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া দরকার। সার বললেন, ঝামেলা বাড়িয়ে কী হবে! আপনিও হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান।
আমরা দুজনেই গ্লেনইগলস হাসপাতালে ভর্তি হলাম। সার আর আমার কেবিন এক সারিতে, তবে কয়েকটা কেবিনের ব্যবধানে। ব্যবস্থা অতি উত্তম।
সেদিন বিকেলে এক নার্স এসে আমাকে বললেন, তোমার বন্ধু, মানে তোমার সঙ্গী, তিনি কি ইংরেজি জানেন?
নার্সকে সারের পরিচয় দেওয়া বাহুল্য। বললাম, জানেন বইকি!
তা শুনে তিনি মুখ আরো বেজার করে বললেন, আমি তাকে ওষুধ খাওয়ার বিষয়ে বলতে গিয়েছিলাম। তিনি হা-না কিছুই বললেন না। কথা শুনলেন কি না, বুঝলেন কি না, কিছুই ঠাহর করতে পারলাম না। তুমি কি অনুগ্রহ করে তাকে এই কথাগুলো বুঝিয়ে বলবে?–বলে সে ওষুধসংক্রান্ত একটা ফিরিস্তি দিয়ে গেল।
সারের কেবিনে এসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সার, নার্স আপনাকে ওষুধের বিষয়ে কী বলতে এসেছিল, শুনেছেন কি?
তিনি বললেন, ‘হ।’
‘তা আপনি তার কথার জবাব দেন নি কেন?’
‘হে বেডি তো যা কওনের কইয়া গেল। আমারে তো কিছু জিগগাস করে নাই। আমি কী কমু?’
‘একটা হ্যাঁ-না বলতে পারতেন।’
‘তার যা কওনের কইয়া গ্যাছে। আমি শুনছি। তার লগে তো আমার গল্প করার কথা নাই।’
আমি আর কী বলব!
সারের নানারকম পরীক্ষা চলতে থাকল।
আমার ইসিজি ইত্যাদি হলো। স্ট্রেস টেস্ট দেখে ডাক্তার খুশি হলেন না। বললেন, অ্যানজিওগ্রাম করতে হবে।
আমি রাজি হলাম না।
ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে সারের অবস্থা জানতে লিটু ফোন করেছে। সার তাঁকে আমার সংবাদ দিয়েছেন। সে ফোনে আমাকে বললো, ডাক্তার যা পরীক্ষা করতে চায়, আপনি তা করিয়ে আসবেন। অবশ্যই।
অ্যানজিওগ্রাম হলো। লন্ডনে যে-ধমনিতে ব্লক পাওয়া গিয়েছিল এবং যেটায় অ্যানজিওপ্লাস্টি করা হয়েছিল, দেড় বছরের ব্যবধানে সেটা আবার বন্ধ হয়ে এসেছে। অ্যানজিওপ্লাস্টির আগের অবস্থায় প্রায় ফিরে গেছে।
রিপোর্ট দেখে অর্শ-বিশেষজ্ঞ বললেন, তোমার অস্ত্রোপচার করা যাবে না। অর্শ থেকে যে-রক্তক্ষরণ হয়, হাজার হোক, তাতে তুমি মরবে না। কিন্তু অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে তোমার হৃদযন্ত্র যদি বন্ধ হয়ে যায়, সেটা ভালো কাজ হবে না।
অতএব, যেমন এসেছিলাম, তেমনি ফেরা। মাঝখানে ভেতর থেকে হাসপাতাল দেখা।
চিকিৎসকেরা সারুকে পরামর্শ দিলেন, ফুসফুসের জন্যে ইনহেলার ব্যবহার করতে আর কানের জন্যে হিয়ারিং এইড নিতে। ইনহেলার তিনি নিচ্ছিলেনই, এখন বেশি বেশি মাত্রায় নিতে হবে। হিয়ারিং এইড কেনা হলো, কিন্তু অস্বচ্ছন্দ বোধ করায় সিঙ্গাপুরে থাকতেই তার ব্যবহার বন্ধ করে দিলেন তিনি।
গ্লেনইগলস হাসপাতালের পাশেই চমৎকার উদ্যান। তাতে আমরা বেড়াই।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরে সমাজতত্ত্ব পড়ায় হাবিব খোন্দকার। সে রাজ্জাক সাহেবের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। তার সঙ্গে পরিচয় হলে জানতে। পারি, তার দু ভাইকে আমি চিনি। আমরা হাসপাতালে ঢোকার আগে সে আর তার স্ত্রী ঝোরা রেস্টুরেন্টে নিয়ে আমাদের খাওয়ায়। হাসপাতাল থেকে বেরোবার পর তার বাড়িতে যেতে হয় খেতে। তার বাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। সেখানকার বাঙালি শিক্ষক আরো কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। কিছুকাল আগে শেখ হাসিনা হাবিব খোন্দকারের এই বাড়িতে এসে থেকে গেছে। শেখ কামালের সঙ্গে হাবিবের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল।
বাংলাদেশ বিমানের আঞ্চলিক ম্যানেজার আসেন। আমরা ব্যাংকক হয়ে ঢাকা ফিরব। সেই যাত্রার ব্যবস্থা চূড়ান্ত করে দেন। দশ দিন সিঙ্গাপুর বাসের। পর আমরা ব্যাংকক পৌঁছাই।
সার বলেন, একটা দেশকে জানতে হলে যেতে হয় তার কাঁচাবাজারে আর বইয়ের দোকানে। কাঁচাবাজারে যেতে আমার উৎসাহের অভাব। পথের ধারে ফলের দোকান, তরকারির দোকান অজস্র। তারই কয়েকটায় সার থামেন, কিছু কেনাকাটা করেন। ঢাকায়ও কিছু ফলমূল আনবেন, সে-ব্যবস্থা হয়। বইয়ের দোকানে যাই আমরা। কিছু বই কিনি, নাড়াচাড়া করি তার চেয়ে বেশি। সেখানে অনেক সময় কাটে।
রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সময়ে একবার সার বললেন, আপনার যা পছন্দ, তা অর্ডার দেন। আমি একটু অবাক হই। আমার পছন্দসই বলেই তো বিফস্টেক আনতে বলেছি। পরে বুঝি, খাদ্য নয়, উনি পানীয়ের কথা বলছেন। গুরুবাক্য পালনে আমি তৎক্ষণাৎ তৎপর হই।
তিন দিনের মাথায় ঢাকায় ফেরা। বিমানে। আমরা বেশ নির্ভার। স্বদেশি যাত্রীদের হাতে ব্যাগ আর ব্যাগ। একজন দুহাতে ব্যাগ নিয়েছেন বলে বোর্ডিং কার্ডটা দাঁত দিয়ে ধরেছেন। বিমানের যিনি বোর্ডিং কার্ড নিচ্ছেন, তিনি হাত বাড়াতেই যাত্রী তাঁর মুখটা এগিয়ে দিলেন। উদ্ভাবনী প্রতিভা আর কাকে বলে!
২৭.
বাবরি মসজিদ নিয়ে ভারতে একটা সংকট ঘনিয়ে আসছিল অনেকদিন ধরে। হিন্দুত্ববাদীরা দাবি করে আসছিলেন যে, অযোধ্যায়–রামের জন্মভূমিতে-মন্দির ভেঙে ওই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল, এখন তারা মসজিদ ভেঙে মন্দির পুনর্নির্মাণ করবেন। ভারতের অনেক ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রবন্ধ লিখে ও বিবৃতি দিয়ে বলেন যে, এমন দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই এবং স্বয়ং রামেরই জন্ম কবির মনোভূমিতে। তাতে হিন্দুত্ববাদীদের ক্রোধ কেবল বৃদ্ধি পায় এবং জনশ্রুতি, লোকবিশ্বাস ও ইতিহাস একাকার হয়ে যায়। সারা ভারত থেকে স্বেচ্ছাসেবক অযোধ্যায় জড়ো হতে থাকে ধর্মযুদ্ধ করতে। ভারত সরকারের এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর তারা বাবরি মসজিদের আংশিক ধ্বংসসাধন করে।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে–এমন মিথ্যা খবরের ভিত্তিতে ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু-নির্যাতন ও মন্দির-ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছিল, সেকথা আগে বলেছি। সে-মসজিদ যখন সত্যিই ভাঙলো, বাংলাদেশে তার প্রতিক্রিয়া হলো তীব্র এবং সবটা ক্ষোভ গিয়ে পড়ল ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অসহায় ব্যক্তিদের এবং তাদের উপাসনালয়ের ওপর। বীর চট্টলায় বড়োরকম দুর্যোগ ঘটে, রাজধানী ঢাকাও পিছিয়ে থাকে না। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলায় বাংলাদেশ সরকার তীব্র নিন্দাজ্ঞাপন করে, কিন্তু নিজের নাগরিকদের রক্ষার ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয় না। সরকারের বাইরে অনেক রাজনৈতিক দল, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ব্যক্তি এই নির্যাতন রোধ করতে এগিয়ে আসে বটে, কিন্তু তা ঘটে অনেক অসংগঠিতভাবে এবং কম শক্তি নিয়ে। অন্যদিকে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদ করতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় নামধারী সংগঠনগুলি যেসব কর্মসূচি দেয়, তা ছিল বেশ জঙ্গি। সাধুভাষায় যাকে অগ্নিতে ঘৃতাহুতি বলে, এতে তাই হয়। শুনেছি, খুলনার ডেপুটি কমিশনার তখন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দলের নেতাদের ডেকে বলেছিলেন, আপনারা অনুগ্রহ করে প্রতিবাদ মিছিল করবেন না, শান্তি মিছিলও করবেন না, দুবৃত্তদের আমি সামলাতে পারবো-আপনারা পথে নামলে আমার কাজ অনেক কঠিন হয়ে যাবে। সে কর্মকর্তা সেখানে সত্যি সত্যি পরিস্থিতি সামাল দেন। সরকারের ভাবটা ছিল এমন যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, তাদের রক্ষার ভার আওয়ামী লীগই নিক। আওয়ামী লীগ মনে করে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের, সরকার সংখ্যালঘু-নির্যাতন বন্ধ করুক, নইলে ব্যর্থতার দায়ভার তার ওপরেই বর্তাবে। মাঝে পড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন অবর্ণনীয় কষ্ট ও অসম্মানের সম্মুখীন হয়। ক্ষেত্রবিশেষে বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানেরাও আক্রান্ত হয় এবং বৌদ্ধমন্দির ও গির্জায়ও হামলা চলে। যেখানে আমলারা ব্যক্তিগতভাবে দাঙ্গা বন্ধ করতে উদ্যোগী হন, সেখানে কিছুটা কাজ হয়।
ডিসেম্বরের ৭ তারিখে ঢাকায় আমরা নিষ্ফল দৌড়াদৌড়ি করেছি। ৮ তারিখেও কোনো শান্তি মিছিল করা সম্ভব হয়নি, সংগঠিত প্রতিরোধও নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা দাঙ্গাপ্রতিরোধে তেমন ভূমিকা এবার পালন করেনি–এ ছিল আমার বড়োরকম দুঃখ। ৯ তারিখে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে শান্তি সমাবেশ ও মিছিল করা হয়। সেদিন বিএনপিও একটা লোকদেখানো মিছিল করে। ১০ তারিখ থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। এ-কয়দিনে দেশের অন্যান্য জায়গায়ও গোলযোগ ছড়িয়ে পড়ে। বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। ক্ষুব্ধ হয়ে আমি ভোরের কাগজে একটি প্রবন্ধ লিখি ‘সাম্প্রদায়িকতার প্রত্যাবর্তন’ নামে, তাতে কারো কোনো লাভ হয় না। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বিজয়মেলা-উপলক্ষে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রচারণা চালায়, কিন্তু ততদিনে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এসেছে।
যেসব মূল্যবোধের জন্যে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়া, তার পরাজয়ের গ্লানি বুকে বড়ো বাজে।
তবে এরই প্রতিক্রিয়ায় বেরিয়ে এসেছিল শামসুর রাহমানের ‘সুধাংশু যাবে নার মতো অনবদ্য কবিতা এবং হাসনাত আবদুল হাইয়ের বাবুরের প্রার্থনা’র মতো গল্প। শফি আহমদ ও পূরবী বসুর সম্পাদনায় প্রকাশ পায় প্রবন্ধ-সংকলন এখনো গেল না আঁধার (ঢাকা, ১৯৯২) এবং বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের রচনা নিয়ে মফিদুল হক ও অরুণ সেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ধ্বংসস্তূপে আলো/বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিবাদ (ঢাকা ও কলকাতা, ১৯৯৩)। বহু অকীর্তির মধ্যেও এমনি করে ঘোষিত হয় মানুষের বিবেকের কণ্ঠস্বর, এই এক সান্ত্বনা। তসলিমা নাসরিনের লজ্জাও লেখা হয়েছিল এ সময়ে। বিষয়বস্তুর সাহসী উপস্থাপনা সত্ত্বেও উপন্যাস হিসেবে তা সার্থকতা লাভ করেনি, তবে নানাকারণে বইটি ব্যাপক আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়।
২৮.
১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে–ড. কামাল হোসেনের এই মন্তব্য শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগের কিছুসংখ্যক কর্মী প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কামাল হোসেনের কিছু কিছু মন্তব্যে আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বের তীব্র সমালোচনাও প্রকাশ পায়। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে, কামালের পক্ষে আওয়ামী লীগে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।
আওয়ামী লীগের অনেকের সঙ্গে কামাল হোসেন পরামর্শ করেন। তাঁরা অনেকে তাকে বিকল্প পথ সন্ধান করতে বলেন। তারা কামালকে এমন ধারণা দেন যে, তিনি কোনো বিকল্প সংগঠন গড়ে তুললে তারাও তাতে যোগ দেবেন। তেমন ইচ্ছে হয়তো এঁদের অনেকের আদৌ ছিল না, কামাল আওয়ামী লীগ ছাড়লে দলের মধ্যে নিজেদের গুরুত্ব আরো বাড়বে, এমন কথা হয়তো তাদের মনে ছিল। কামাল ধরে নেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে তার বড়োরকম সমর্থন আছে।
কামাল আমাকে যা বলেন, তাতে সেই মুহূর্তে তার রাজনৈতিক দল গড়ার অভিপ্রায় আছে বলে আমার মনে হয়নি। তিনি নাগরিক সমাজের একটি মঞ্চের কথা বলছিলেন। যারা রাজনীতি করেন, তাঁদের চেয়ে যারা রাজনীতি করেন না, এমন মানুষের কাছে তিনি বেশি যাচ্ছিলেন। যেমন, শিক্ষকদের মধ্যে খান সারওয়ার মুরশিদ, ফজলুল হালিম চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। এক পর্যায়ে কামালের কয়েকজন সহকর্মী–কম্যান্ডার আবদুর রউফ, গোলাম মরতুজা, শাহেদ আলী–আমাকে অনুরোধ করেন প্রস্তাবিত গণতান্ত্রিক ফোরামে যোগ দিতে। আমার অনিচ্ছার কথা তাদের জানালে কামাল একদিন এ-বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর চেম্বারে বসে প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনা হয়। আমি কামালকে বলি, তিনি রাজনীতিবিদ, আজ যে-অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলছেন, কাল তা রাজনৈতিক সংগঠনে রূপান্তরিত করতে তিনি ইচ্ছুক হবেন। তাঁর সহকর্মীরা সেদিকে তাঁকে টানবেন। যারা তাকে আওয়ামী লীগে চান না, তাঁরাও তাঁকে সেপথে ঠেলবেন। গণতান্ত্রিক ফোরাম রাজনৈতিক দল হলে তাতে আমি থাকতে পিরবো না। এখন যোগ দিয়ে পরে বেরিয়ে আসার চেয়ে বরঞ্চ গোড়া থেকেই আমার পক্ষে বাইরে থাকা ভালো। বাইরে থেকে আমার পক্ষে যতটুকু সাধ্য তার সঙ্গে সহযোগিতা করবো।
১৯৯৩ সালের আগস্ট মাসে গণতান্ত্রিক ফোরামের উদ্বোধন হলো। সে উপলক্ষে বড়ো সমাবেশ ঘটলো ঢাকায়। সুফিয়া কামাল, মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিশিষ্ট আরো কয়েকজনের সঙ্গে আমিও সে-সভায় কিছু বললাম। ধুমধাম করে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলো।
পরের মাসে আওয়ামী লীগ থেকে ড. কামাল হোসেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
২৯.
দিল্লির ইন্দিরা গান্ধি ন্যাশনাল সেন্টার ফর দি আর্টস থেকে আমন্ত্রণ এলো, ইউনেসকোর সহায়তায় দিল্লিতে তারা ইন্টারফেস অফ কালচারাল আইডেনটিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সভা করছেন ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে, তাতে প্রবন্ধ পড়তে হবে। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সেমিনারে উন্নয়ন-বিষয়ে যেসব আলোচনা হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই একটা প্রবন্ধ দাঁড় করালাম, নামটা ভারীই দিলাম, ইউনিভার্সালিটি, ইউনিফর্মিটি অ্যান্ড স্পেসিফিসিটি : এ ভিউ ফ্রম এ ডেভেলপিং কান্ট্রি’। এপ্রিলের ১৯ থেকে ২৩ পর্যন্ত আইজিএনসিএর ক্যাম্পাসেই সেমিনার হলো। আমি প্রবন্ধ পড়লাম, একটা অধিবেশনে সভাপতিত্বও করলাম। অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, নেপাল, মঙ্গোলিয়া ও শ্রীলঙ্কা থেকে প্রতিনিধি এসেছিলেন। ভারতের তো অনেকে ছিলেন–তাঁদের মধ্যে কপিলা বাৎস্যায়নের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ছিল একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। তার যেমন পাণ্ডিত্য, তেমনি বলবার ক্ষমতা। আমার সঙ্গে কিছু কিছু বাংলাও বললেন। বি এন [বৈদ্যনাথ সরস্বতী–সবটা আয়োজনের দায়িত্ব যার কাঁধে–তিনি সদাশিব মানুষ, খুবই পণ্ডিত, কিন্তু বিনয়ের আবরণে তা ঢেকে রাখেন। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছিলেন রবীন্দ্র জৈন, বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ আর মোমিন এবং নর্থ-ইস্ট হিল ইউনিভার্সিটি থেকে মৃণাল মিরি। ইউনেসকোর প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন ফ্রানসিস চাইল্ড–তাঁর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। প্যারিসে গেলে যেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি, এমন অনুরোধ তিনি করেছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েও সে অনুরোধ রাখতে পারিনি। আমার সঙ্গে ভালো আলাপ হয় তুরস্কের প্রবীণ নৃতত্ত্ববিদ বোজকুর্ট গুঁজেন্চ এবং ইরানের নবীন গবেষক ফাতেমা ফারাহানির। ফাতেমা ইরানের সরকার অনুমোদিত পোশাকে আচ্ছাদিত থাকতো। আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এই পোশাক সে স্বেচ্ছায় পরেছে, না তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে তার সরাসরি জবাব দেয়নি। বলেছিল, তার এমন পোশাক পরার ফলে সবার যদি কল্যাণ হয়, তবে সেটা অনেক বড়ো পাওয়া হবে।
এই সভা থেকে ইউনেসকো এবং ইউনেসকোর সদস্য-রাষ্ট্রসমূহের কাছে অনেকগুলো প্রস্তাব গিয়েছিল। তাতে কোনো কাজ হয়েছিল বলে আমার মনে হয় না।
এই সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধগুলো পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল : Baidyanath Saraswati (ed), Interface of Cultural Identity and Development (New Delhi, 1996).
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অনিল সরকারের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। সে এখন এশিয়াটিক সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ। তারই উদ্যোগে এশিয়াটিক সোসাইটি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ইন্দিরা গান্ধি স্মারক বক্তৃতা দিতে। সোসাইটি জানিয়েছে, এই স্মারক বক্তৃতা প্রবর্তিত হয় ১৯৮৫ সালে। এ পর্যন্ত যারা বক্তৃতা দিয়েছেন, তাঁরা হলেন, গোঁয়ার লেফটেন্যান্ট-গভর্নর ড. গোপাল সিং, বিচারপতি মুহম্মদ হিদায়েতউল্লাহ, সাহিত্যিক উমাশঙ্কর যোশী, রাজনীতিবিদ হীরেন মুখার্জি, সাংসদ ড. কিরীট যোশী, সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তী এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি ড. শঙ্করদয়াল শর্মা। এবারে আমাকে অনুরোধ করা হচ্ছে কালচারাল প্লুরালিজম’ সম্পর্কে বলতে। প্রলুব্ধ হলাম, ভীতও হলাম। শেষ অবধি দুরুদুরু বক্ষে লেখা। নিয়ে হাজির হলাম। ১৯৯৩ সালের ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর দুদিন বক্তৃতা দিলাম। এবং যথেষ্ট প্রশংসা পেলাম।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে বক্তৃতাটি ছেপে বের হলো। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ভাষণটি পুনর্মুদ্রিত হলো।
৩০.
নভেম্বরের শেষে শ্রীলঙ্কায় গেলাম আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের এক সম্মেলনে। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে আছি আমরা তিনজন। ডা. এ এইচ সাইদুর রহমান, অর্থনীতিবিদ ড. আবদুল গফুর ও আমি। অন্য কোনো কাজে আমি আগেই কলকাতায় পৌঁছেছিলাম। সেখান থেকে বাকি দুজনের সঙ্গে মাদ্রাজ হয়ে কলম্বো পৌঁছলাম। গিয়ে বুঝলাম, এটা ঠিক পথ নয়, এ-পথে বড়ো কষ্ট। মাদ্রাজ বিমানবন্দরে অপেক্ষা করা মানে ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়া। সে পরীক্ষায় প্রায় অসফল হই আর কী!
তবে কলম্বো পৌঁছোবার পর সব কষ্ট দূর হয়ে গেল। আয়োজকদের ব্যবস্থা চমৎকার। অনেক চেনাজানা মানুষের সঙ্গে পুনর্মিলন। নতুন পরিচয় যাদের সঙ্গে হলো, তাঁদের মধ্যে পাকিস্তানের ড. হারুন রশীদ এবং শ্রীলঙ্কার গামিনি কোরিয়া ও সুশীল সিরিবর্ধনা উল্লেখযোগ্য। ডা. হারুন রশীদ মনোচিকিৎসক। পাকিস্তানে নিতান্ত নিম্নশ্রেণির মানুষ নানাধরনের উৎপীড়নের শিকার হয়। হারুন তাদের চিকিৎসা করেন এবং এই ধরনের অজানা উৎপীড়ন সম্পর্কে অনেক তথ্য প্রকাশ করেন। গামিনি শ্রীলঙ্কায় খুব শ্রদ্ধেয়। সুশীল অকসফোর্ডে ডি ফিল করে গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করতে গিয়েছিল। এতে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। তাকে এক সময়ে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়। পরে আবার কারাগার থেকে বের করে শ্রীলঙ্কার স্কুল-শিক্ষাব্যবস্থার কিছু সংস্কারের কাজেও তাকে লাগানো হয়।
আমাদের সম্মেলনের মূল আয়োজক এ এম মারলিন খুব মজার মানুষ। এক অবসরে তিনি আমাদের অনেককে ক্যান্ডিতে নিয়ে গেলেন তাঁদের পারিবারিক আবাসে। সেখানে আমরা খাইদাই, ক্যান্ডি নাচ দেখি। মারলিনদের কয়েকপুরুষ মূল্যবান পাথরের ব্যবসা করেন। অতিথিদের অনুরোধে খাওয়াদাওয়ার শেষে কর্মচারীদের ডেকে দোকান খোলান মারলিন। অতিথিদের অনেকেই দামি পাথর কেনেন–তবে এটা মারলিনের উদ্দেশ্য ছিল না, তা হলফ করে বলতে পারি।
কলম্বোতে তখন শাব্বির আহমদ চৌধুরী থাকে। সে ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহকর্মী। একদিন শিক্ষকতা ছেড়ে সে চলে আসে শ্রীলঙ্কায়–ব্যবসায়ে অর্থ নিয়োগ করে এখানে রয়ে যায়। আমাদের আগমনবার্তা তাকে দিই। সে বলে, আপনাদের শ্রীলঙ্কা দেখাতে নিয়ে যাবো–দুদিন লাগবে। সম্মেলনের শেষে হোটেল ছেড়ে আমরা তার বাড়িতে উঠি। সে আমাকে রাত্রিবাস করতে পাঠায় আরেক স্বদেশি ড. আজহারুল হকের বাড়িতে, সেটা আরো আরামদায়ক বলে। আজহার পরে দেশে ফিরে ওয়াসার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
আমাদের শ্রীলঙ্কা ঘোরাতে হবে, অতএব শাব্বির তার গাড়ি বেচে বড়ো ধরনের জিপ কিনে ফেলে। আমরা তিনজন ছাড়া সে সঙ্গে নেয় এক শ্রীলঙ্কানকে। তিনি মাগরেব ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। শাব্বিরের ধারণা, এই গৃহযুদ্ধরত দেশে দূরে যেতে হলে একজন দেশীয় লোক থাকলে সুবিধে হবে।
আমরা পশ্চিম উপকূল ধরে উত্তরে যেতে থাকি। এক সময়ে নিরাপত্তাবাহিনী আর আমাদের যেতে দেয় না। আমরা পুবদিকে ঘুরি। শ্রীলঙ্কার প্রাচীন রাজধানী। অনুরাধাপুরে রাত্রিযাপন করি। তারপর ক্যান্ডির কাছ ঘেঁষে দেশের মধ্যভাগ ধরে ফিরে আসি কলম্বোয়। অত্যন্ত আরামদায়ক, উপভোগ্য, শিক্ষাদায়ক ভ্রমণ।
তারপর মাদ্রাজ হয়ে ফেরা। যে-ফ্লাইটে আমরা মাদ্রাজ থেকে কলকাতা ফিরি, সেটা নানা বিমানবন্দরে থামতে থামতে আসে। অনেক সময় লাগে। মাঝে একজন যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে জানা যায়, তিনি বাংলাদেশের মানুষ, মাদ্রাজে চিকিৎসা নিয়ে কলকাতা হয়ে দেশে ফেরার পরিকল্পনা করেছিলেন। উড্ডয়নকালে উচ্চতায় তার অসুবিধে হয়। উড়োজাহাজের ক্রুরা যাত্রীদের মধ্যে ডাক্তার খোঁজ করেন। একজনকে বোধহয় পাওয়া যায়। তিনি যান রোগীর পাশে, তবে তেমন কোনো সাহায্য করতে পারেন বলে মনে হয় না। পরের বিমানবন্দরে তাঁকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর মালপত্র খুঁজে বের। করে প্রত্যর্পণ করতে অনেক সময় লাগে।
পরে শ্রীলঙ্কায় যখনই গেছি, নিশ্চিত করে নিয়েছি, যাতে মাদ্রাজ হয়ে যেতে না হয়।
শ্রীলঙ্কায় সেবারে যে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেকথা বলা যাক।
আমরা দল বেঁধে সৌজন্য-সাক্ষাৎকার করতে গিয়েছিলাম শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের স্পিকারের সঙ্গে। তিনি প্রবীণ রাজনীতিবিদ। তাঁর জামাতা তখন বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার হাই কমিশনার। আমরা বাংলাদেশ থেকে গেছি শুনে স্পিকার একটু বাড়তি সমাদর করলেন। তাঁর কাছ থেকে জানা গেল, শ্রীলঙ্কার জনগণকে প্রথাগতভাবে তিনভাগে ভাগ করা হয়–সিংহলা, তামিল ও মুসলমান। দুটি গোষ্ঠীর পরিচয় নৃতাত্ত্বিক, অপরটির ধর্মীয় কেন, তার সদুত্তর পেলাম না। দেশব্যাপী সিংহলা-তামিলের বিরোধের পটভূমিকায় সিংহলা মুসলমান ও তামিল মুসলমান একযোগে তৃতীয় একটি পক্ষ, তা আশ্চর্যের বিষয়। পরে জানলাম, এ-কারণে অনেকে, বিশেষ করে সিংহলারা, মুসলমানদের সুবিধাবাদী বলে গণ্য করে। তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তখন সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত। এ-অবস্থায়ও সিংহলাদের কারো কারো মত এই যে, সলোমন বন্দরনায়েকের সরকার যদি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চাপের কাছে অতটা নতিস্বীকার না করতেন, অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম ও সিংহলি ভাষার অতটা পৃষ্ঠপোষকতা না করতেন, তাহলে হয়ত তামিলদের সঙ্গে সিংহলাদের দূরত্ব এই পর্যায়ে পৌঁছোতো না। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সমর্থন নিয়ে সলোমন বন্দরনায়েকে ক্ষমতায় এসেছিলেন বটে, তবে ভিক্ষুদের একদেশদর্শিতার সঙ্গে পেরে ওঠাও সম্ভবপর ছিল না তার। পক্ষে। পরিণামে তো বৌদ্ধ ভিক্ষুর হাতেই তাঁকে প্রাণ দিতে হলো কয়েক বছরের মধ্যে।
সলোমনের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন–পৃথিবীর প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। তিনি আরো এক দফা প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, কয়েক দফা বিরোদী দলীয় নেত্রী। কয়েক বছর আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন প্রেমাদাসার কাছে। আপসোর সম্মেলনে আগত সকল প্রতিনিধিকে তিনি মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করবেন পার্লামেন্টের রেস্টুরেন্টে। আমরা যথাসময়ে সেখানে পৌঁছে গেছি, কিন্তু শ্রীমাভো আসতে পারেননি–তার শরীর ভালো নেই। তার হয়ে আমন্ত্রণকর্তার ভূমিকা পালন। করলেন বিরোধী দলীয় উপনেতা। ভদ্রলোক বেশ হাসিখুশি ও লম্বা-চওড়া। বললেন, আমার নাম রানাতুঙ্গা। আমার ছেলে অর্জুন ক্রিকেট খেলে–আপনারা অনেকে হয়তো তাকে চিনবেন। মিসেস বন্দরনায়েকের শরীর একটু খারাপ, তাই তিনি আসতে পারেননি। তিনি আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। খাওয়াদাওয়ার পরে আপনারা যদি তাঁর বাড়ি যেতে সম্মত হন, তাহলে তিনি আপনাদের সঙ্গে কফি খেতে পারেন।
বেশির ভাগ অতিথি এই কষ্ট স্বীকার করতে চাইলেন না। আমরা কয়েকজন। মাত্র গেলাম।
শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের বাড়ি প্রাসাদোপম নয়, বরঞ্চ প্রত্যাশার তুলনায় ছোটোই বলা যেতে পারে। ড্রইং রুমটি সুসজ্জিত। তাতে শোভা পাচ্ছে সলোমন ও শ্রীমাভোর একটি ছবি এবং ইন্দিরা গান্ধির স্বাক্ষরযুক্ত একটি প্রতিকৃতি। আমরা ছবি দেখতে দেখতে শ্রীমাভো দেখা দিলেন। তার বয়স তখন ৭৭/৭৮। রাজনীতিতে থাকলেও সক্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়েছে–কন্যা চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে রাজনৈতিক মঞ্চে স্থান করে নিয়েছেন।
কথায় কথায় শ্রীমাভো বললেন, সলোমন একবার কলকাতায় গিয়েছিল লুকিয়ে। বোধহয় ১৯৪৬ সালে। কলকাতায় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কোনো একটি সভায় সে উপস্থিত ছিল নেহরুর আমন্ত্রণে–নেহরুর সঙ্গে তার খুব সখ্য ছিল।
সেদিন তিনি বিশ্বব্যাংকের প্রতি খুব ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। বললেন, বিশ্বব্যাংক কৃষিতে ভর্তুকি দিতে নিষেধ করছে আমাদের। এর ফল কী হবে জানেন? শ্রীলঙ্কায় অন্তত অনেকে চাষবাস ছেড়ে ছোটোখাটো ব্যবসা ধরবে বা দোকান খুলবে। তাতে তারা টিকে থাকতে পারবে, কিন্তু কৃষি-উৎপাদন অনেকখানি ব্যাহত হবে। বিশ্বব্যাংক এই নীতি প্রয়োগ করবে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায়। সবাই মিলে যদি তা প্রতিরোধ না করা যায় তাহলে আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার স্বপ্ন মিলিয়ে যাবে।
ওই বয়সেও শ্রীমাভোর কথাবার্তা স্পষ্ট এবং সৌজন্যবোধ অসাধারণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাঁর সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সেটা যথেষ্ট প্রীতিকর না হওয়ার সম্ভাবনায় আর তুললাম না।
৩১.
বাংলাদেশের এক সরকারি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের নেতা হয়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম ১৯৯৩ সালের মার্চে–সেকথাটাও বলা হয়নি। প্রতিনিধিদলে ছিল হুমায়ূন আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মনসুর মুসা, সেলিনা হোসেন, আরো অনেকে। ড. আশরাফ সিদ্দিকীও ছিলেন–প্রতিনিধিদলের নেতা হওয়া উচিত ছিল তাঁরই, কিন্তু সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় মনসুর মুসা আমার নাম প্রস্তাব করে ফেলায় আশরাফ সিদ্দিকী তা সমর্থন করে বসলেন। আমিও মজা পেলাম। তখন আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা ঝুলছে। এক মন্ত্রণালয় মামলা করছে, আরেক মন্ত্রণালয় প্রতিনিধি করে আমাকে বিদেশ পাঠাচ্ছে। সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জাহানারা বেগমের উদারতার কথা স্বীকার করতে হয়।
কলকাতায় নন্দনে একটা সভা হয়েছিল দুদেশের সাহিত্যিক ও সাহিত্যকর্মের আদানপ্রদান নিয়ে। সেখানে আনন্দ পাবলিশার্সের বাদল বসু বলেই বসলেন, বাংলাদেশের বই আমদানি করতে তারা আগ্রহী নন, বরঞ্চ যেসব বই ওদেশে চলবে বলে মনে করবেন, তারা তার ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশে আগ্রহী। পশ্চিমবঙ্গের বইয়ের জাল সংস্করণ যে বাংলাদেশে প্রকাশিত হচ্ছে এবং আমরা কিছু করছি না–এ-বিষয়েও তারা উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।
আশরাফ সিদ্দিকী সেবারে পরিচয় করিয়ে দিলেন জগদীশ বসাকের সঙ্গে। ঢাকার সন্তান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ বিল্ডিংয়ে তার বইয়ের দোকান, স্ত্রী ড. শীলা বসাক-লোকসংস্কৃতি-বিশেষজ্ঞ। পরে জগদীশ ঢাকায় আসায় তার সঙ্গে যোগাযোগটা ঝালিয়ে নেওয়া হয়। তারপরে এমনি হলো যে, তার বাড়িই হয়ে গেল আমার কলকাতার ঠিকানা।
ডিসেম্বরে আমি গেলাম হায়দরাবাদে–একটি মার্কিন সংগঠনের উদযোগে সাহিত্যের ইতিহাস-বিষয়ক এক সেমিনারে। সেমিনারের পরিচালক শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের ববরিনস্কয় অধ্যাপক শেলডন পোলক। শেলি আর আমি ছাড়া আর সকলেই ভারতীয়, তবে সংখ্যায় অল্প। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন সাহিত্য অকাঁদেমির সম্পাদক ইন্দ্রনাথ চৌধুরী। আমি হায়দরাবাদে পৌঁছে রাত জেগে প্রবন্ধ লিখেছিলাম, সেটা ভালো লেগেছিল শেলি ও ইন্দ্রনাথের এবং আরো কারো কারো।
হায়দরাবাদে সালার জঙ্গ জাদুঘর দেখবার মতো। নবাবের প্রাসাদের এক কোণে আলোছায়ায় ইতিহাস-বর্ণনাও খুব উপভোগ্য।
হায়দরাবাদ যাওয়ার পথে বেবী, শুচি ও আনন্দকে কলকাতায় জগদীশের বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। স্ত্রী শীলা ও মেয়ে মিলিকে সঙ্গে নিয়ে জগদীশ। বেবীদের পুরী বেড়াতে নিয়ে গেল। তারাও পুরী-ভ্রমণ খুব উপভোগ করেছিল।
৩২.
ভারত সরকারের উদ্যোগে ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতায় মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনসটিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর পরিচালক নিযুক্ত হন ড. বরুণ দে। ইনসটিটিউট-প্রতিষ্ঠার এবং বরুণ দের নিয়োগের পেছনে প্রবল সমর্থন ছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল অধ্যাপক সৈয়দ নূরুল হাসানের। ইনসটিটিউটের দ্বিতীয় কর্মকর্তা হিসেবে বরুণ নিয়ে আসেন রণবীর সমাদ্দারকে। রণবীর দুর্দান্ত ছাত্র ছিল, অত্যন্ত ভালো বক্তা, নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে কারাবাসও করে দীর্ঘকাল। কয়েকজন তরুণ গবেষক দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া নিয়ে সেখানে গবেষণাকর্মেও নিযুক্ত হয়।
১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমি যখন এশিয়াটিক সোসাইটিতে বক্তৃতা দিতে কলকাতায় যাই, তখনি বরুণ দে প্রস্তাব করেন, আমি যেন দু মাসের জন্যে তাঁদের ইনসটিটিউটে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে যোগ দিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। থেকে আমি এক বছরের সাবাটিকাল লিভ নিই এবং ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ওই ইনসটিটিউটের প্রথম ভিজিটিং ফেলোর দায়িত্বপালন করি। আমার থাকার ব্যবস্থা হয় গোল পার্কে রামকৃষ্ণ মিশনের ইনসটিটিউট অফ কালচারের অতিথি-ভবনে এবং বসার ব্যবস্থা হয় বেহালায় মওলানা আজাদ ইনসটিটিউটের দপ্তরে। আমাদের রাজনীতিবিদ অজয় রায়ের কন্যা পর্ণা তখন ওই অতিথি-ভবনে থেকে লেখাপড়া করছিল। তার সুবাদে আমি একদল তরুণ ছেলেমেয়ের কাকা হয়ে মহানন্দে থাকছিলাম। অতিথি-ভবনে খাওয়ার সময়ে আমার সঙ্গীর অভাব হতো না। একটি চমকপ্রদ ঘটনাও ঘটলো একদিন। অতিথি-ভবনের এক কর্মচারী আমাকে বললেন, আমাদের ল্যাংগুয়েজ প্রোগ্রামের হেড সরকার সাহেব আপনার খোঁজ করছিলেন। তার সঙ্গে দেখা করার সময় কি আপনার হবে?’ ‘সরকার সাহেব কে?’ ‘আজ্ঞে, বি এন সরকার। চিনতে পারলাম না, তবু গেলাম। গিয়ে দেখি, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল বি এন সরকার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন–প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। তাকে বললাম, আপনি যে জেনারেল সরকার, তা ওরা একবারও বললো না, সুতরাং আমি বুঝতেই পারিনি। তিনি মৃদু হেসে বললেন, সে তো গতজীবনের কথা। সামান্যত যা বললেন, তাতে বোঝা গেল, ব্যক্তিগত জীবনে তার ওপর দিয়ে বড়োরকম ঝড়ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে। সেই দুঃখশোক নিয়ে একরকম বৈরাগ্য গ্রহণ করেছিলেন, তারপর আবার মূলধারায় ফিরে এসে স্বেচ্ছাসেবা দিচ্ছেন এখানে বিদেশি ভাষাশিক্ষার কর্মসূচি দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিয়ে। ১৯৭১ সালে তিনি যাদের চিনতেন, তাঁদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। সুতরাং মাত্র দু-একজনের কুশল জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিবিষয়ে কি সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো কিছুই জানতে চাইলেন না।
মওলানা আজাদ ইনসটিটিউট থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে চারটি লিখিত বক্তৃতা দিতে বলা হয়েছিল আমাকে। কিছু মালমশলা আমি সঙ্গে নিয়ে যাই–তার বেশ খানিকটা সংগ্রহ করতে আমাকে সাহায্য করেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের গোলাম মুস্তাফা। বাকিটা সংগ্রহ করি মওলানা
আজাদ ইনসটিটিউট, রামকৃষ্ণ মিশন ইনসটিটিউট এবং কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনের গ্রন্থাগার থেকে। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারিক ছিলেন বেবীর সহপাঠী নূরুননাহার–তিনি যথাসাধ্য সহযোগিতা করেন। তার স্বামী নজীবর রহমান ছিলেন সরকারি কলেজের অধ্যাপক এবং তারও আগে আমার প্রথম জীবনের ছাত্র। নজীবর রহমান তখন অবসর নিয়ে কলকাতায় থাকেন–তাঁদের বাড়িতেও একদিন যাওয়া হয়।
ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮, ১৯, ২২ ও ২৩ তারিখে মওলানা আজাদ ইনসটিটিউটে লিখিত বক্তৃতা দিই। যেদিন আমার দ্বিতীয় বক্তৃতা সেদিন সকালেই বেবী ফোন করে জানালো, আমাদের বন্ধু চৌধুরী মহীউদ্দীনের একমাত্র পুত্র বাবু ঢাকায় বাড়ির আঙ্গিনায় গাড়ি-দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মারা গেছে। মহীউদ্দীন তখন মেদিনীপুরে পীরের উরসে। এ-মর্মান্তিক খবরে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম।
Tooteome facciata 1509: A Question of Identity, Religion and Politics, Looking Back at 1971 978 Looking Forward to What? বক্তৃতার সারাংশ শ্রোতাদের মধ্যে বিলি করা হয়। প্রশ্নোত্তর-পর্বের আলোকে বক্তৃতাগুলি সামান্য পুনর্লিখন করি। রণবীরের পরামর্শও কাজে লাগাই। ইনসটিটিউটের হয়ে পর বছর তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে নয়া উদ্যোগ–Identity, Religion and Recent History নামে। বইটির উৎসর্গপত্র Boy 4997: To those friends in India/who, in 1971, had shared/our dream of Bangladesh/and our drive for its realization. 0759157 সম্পর্কে হ্যাজলিটের একটা উক্তি উদ্ধৃত করেছিলাম : ‘We often forget our dreams so speedily : if we cannot catch them as they are passing at the door, we never set eyes on them again.’gency 44 spousta on 63– স্বপ্ন দেখেছিলাম, তার সম্পর্কে, আমার বিশ্বাস, কথাটা খুব প্রযোজ্য।
মার্চ মাসে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ এলো। সেখানকার স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ ডিভিশনের ড. সুখরঞ্জন চক্রবর্তী বাংলাদেশ সম্পর্কে দুদিনব্যাপী সেমিনার আয়োজন করেছেন। তিনি যখন জয়পুরে রাজস্থান ইউনিভার্সিটিতে ছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়। এখন তিনি আমাকে চান তাঁর সেমিনারে। মওলানা আজাদ ইনসটিটিউটে দেওয়া একটি বক্তৃতা খানিক অদল-বদল করে পড়ে দিয়ে এলাম Religion and Politics in Bangladesh নামে। এই সেমিনারে বাংলাদেশের অনেকে ছিলেন : অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমেদ, আবুল মাল আবদুল মুহিত, রঙ্গলাল সেন, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ইমতিয়াজ আহমদ ও আবদুর রব খান। মওলানা আজাদ ইনসটিটিউট থেকে রণবীর সমাদ্দার ও মোহাম্মদ তাজউদ্দীন গিয়েছিল, মনে হচ্ছে বরুণ দেও। তার বাইরে মুচকুন্দ দুবের মতো কূটনীতিক ছিলেন, কলিম বাহাদুর, অনিরুধ গুপ্ত, কান্তি বাজপেয়ী, ইন্দ্রনাথ মুখার্জী, ন্যান্সি জেটলি ও শ্যামলী ঘোষসহ আরো অনেক বিদ্বজ্জন যোগ দিয়েছিলেন। সেমিনারের প্রবন্ধগুলো S. R. Chakravarty (ed.) Society, Polity and Economy of Bangladesh Foreign Policy of Bangladesh নামে দু খণ্ডে নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত হয় (১৯৯৪)।
৩৩.
মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনসটিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজের ভিজিটিং ফেলো হিসেবে ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে আমি যখন কলকাতায় থাকি, তখন একদিন শুনতে পাই, অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব মাহমুদ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পি জি [প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অধ্যাপক এ ডব্লিউ মাহমুদ ওরফে বাচ্চু মিয়ার কথা এই রচনায় আগে বলেছি, সুতরাং তার পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন। রণবীর সমাদ্দার ও আমি তাকে দেখতে গেলাম হাসপাতালে, সঙ্গে আরো দু-একজন ছিলেন। হাসপাতালে ঢোকার মুখে তাঁদেরই কেউ যেন বললেন, ‘কল্পনা যোশীও আছেন এই হাসপাতালে, দেখতে যাবেন?’
কল্পনা যোশী আমাদের কাছে বহুদিন ধরে বহু শ্রদ্ধেয় এক নাম। ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম বিপ্লব সরকারি চাকুরে পরিবারের মেধাবী সন্তান কল্পনা দত্তকে এমনই উদ্দীপ্ত করে যে তিনি কলকাতায় অধ্যয়ন স্থগিত করে জন্মভূমি চট্টগ্রামে চলে এসে মাস্টারদা সূর্য সেনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ বিপ্লবীর সঙ্গে কয়েকটি দুঃসাহসিক অভিযানে অংশগ্রহণের পর তিনি গ্রেপ্তার হন। সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের সঙ্গেই তার বিচার হয়, তাতে তাঁর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয়, পরে তা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত হয়, তবে গান্ধির প্রচেষ্টায় ১৯৩৮ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন। তখন তিনি আবার পড়াশোনা শুরু করেন এবং একই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি (পূরণচাঁদ) যোশীকে তিনি বিয়ে করেন ১৯৪৩ সালে, তবে তারপরও অনেক বছর চট্টগ্রামেই রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালিয়ে যান এবং ১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে এখান থেকেই প্রার্থী হন। শুনেছি, পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠার পরেও তিনি কিছুকাল চট্টগ্রামে ছিলেন, পরে প্রথমে কলকাতা ও তারপর দিল্লিতে থেকে সার্বক্ষণিক রাজনীতি করতেন।
সুযোগ পেয়েও কল্পনা যোশীকে দেখতে যাব না, তা কেমন করে হয়? তবে না গেলেই বোধহয় ভালো হতো। তখন তাঁর বয়স আশি পেরিয়ে গেছে, শরীর ভেঙেছে, মানসিক বিপর্যয়ও ঘটেছে। পাছে পড়ে যান, তাই বিছানার চারপাশে রেলিং দেওয়া আছে। আমাদের দেখে তার কী আকুতি! আপনারা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন?’, ‘আপনারা আমার কাছে থাকবেন তো?’, ‘আমাকে ফেলে আপনারা চলে যাবেন না তো?’–সর্বক্ষণ এসব কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলতে থাকলেন। একবার তার ছেলের কথা বললেন, ছেলে যে তার কাছে নিশ্চিত আসবে সেকথাও জানালেন। তারপর আবার সেই আগের কথা। আমরা চলে যাওয়ার উপক্রম করতেই কান্নাভেজা গলায় আমাদের ডাকতে লাগলেন, তার কাছে থাকতে মিনতি করতে লাগলেন। আমরা একরকম পালিয়েই গেলাম।
অধ্যাপক মাহমুদকে দেখলাম খুব দুর্বল, কিন্তু তার মনোবল বরাবরের মতো। তবে তাঁর কথায়ও সেদিন মনোযোগ দিতে পারছিলাম না, কল্পনা দত্তের আর্তকণ্ঠ বারবার কানে বাজছিল। এঁদের কারো সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি। অধ্যাপক মাহমুদ বেঁচে ছিলেন আরো দু বছর, কল্পনা দত্তের জীবনাবসান হয় এক বছরের মধ্যেই।
যেদিন ওঁদের দেখে এলাম, তার পরদিনই বোধহয় জীবনানন্দ দাশের জন্মবার্ষিকী-উপলক্ষে তার কন্যা মঞ্জুশ্রী-আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম প্রধান অতিথিরূপে। এই অত্যাশ্চর্য ব্যাপারটি কীভাবে ঘটলো, তা আনুপূর্বিক বলা চলে।
আমি একদিন মঞ্জুশ্রী দাশের একটি চিঠি পাই। জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে গবেষণা করতে–তাঁর সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে তিনি বাংলাদেশে আসতে চান এক বছরের জন্যে। আমাকে অনুরোধ করেছেন, ওই সময়ের জন্যে তাকে একটা বৃত্তি জোগাড় করে দিতে। আমি তাকে জানিয়েছিলাম, এক বৎসরের জন্যে বৃত্তি পাওয়া দুরূহ, তবে তিনি যদি অল্প সময়ের জন্যে আসেন, তবে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশালে তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভবপর। তিনি আমাকে আর কিছু জানাননি।
এবারে রামকৃষ্ণ মিশন ইনসটিটিউটের অতিথিশালায় এক সকালে তিনি এসে হাজির। রিসেপশন থেকে আমার ঘরে ফোন করে জানাচ্ছেন, তিনি মঞ্জুশ্রী দাশ–আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
অভ্যাগতদের ঘরে গিয়ে দেখা করলাম। তাঁর চিঠির যে জবাব দিয়েছি, সেজন্যে ধন্যবাদ দিলেন। তারপর জানালেন, তিনি পিতার জন্মোৎসব করছেন, আমাকে তার প্রধান অতিথি হতে হবে। আমি যতই নিজের অযোগ্যতার কথা বলি, তিনি ততই বলেন, যে-বাংলাদেশ জীবনানন্দ দাশকে এত ভালোবাসে, সে-বাংলাদেশের প্রতিনিধিস্বরূপ আমাকেই প্রধান অতিথি থাকতে হবে। তাঁর ইচ্ছে, বাংলাদেশে জীবনানন্দ দাশকে সবাই কেমন ভালোবাসে, সে-কথাটা যেন আমি শ্রোতাদের জানিয়ে দিই।
তিনি আরেকদিন এলেন মুদ্রিত আমন্ত্রণপত্র পৌঁছোতে। সেদিন তিনি বললেন, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ক্লিন্টন বি সিলি যে আমার বন্ধু, তা তিনি জানেন। ক্লিন্টকে বলে আমি কি তাকে শিকাগো পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারিনে? নিশ্চয় পারি, ইচ্ছে করলেই পারি। ক্লিন্ট তো তার অচেনা নয়, বস্তুত সে তাদের পারিবারিক বন্ধুই, কিন্তু নিজের কথা তিনি কেমন করে ক্লিনকে বলবেন? আমি যদি বলি–বলা মানে সুপারিশ করা–তাহলে সবদিক রক্ষা হয়।
আমার মনে হলো, অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হওয়ার আসল যোগ্যতা আমার ক্লিন্টের বন্ধু হওয়া।
অনুষ্ঠানে গেলাম বরুণ দের সঙ্গে। তিনিও বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত। জীবনানন্দ দাশ তাঁর মেসোমশায়। বরুণও বলেছিলেন যে, আত্মীয়তা সত্ত্বেও জীবনানন্দ দাশের সম্পর্কে সভাস্থলে বক্তৃতা করবার যোগ্যতা বা অধিকার তার নেই, কিন্তু সেকথা মঞ্জুশ্রীর কাছে দায়িত্ব এড়ানোর প্রয়াস বলে অগ্রাহ্য হয়েছে।
আমাদের পৌঁছোতে একটু বিলম্ব হয়েছিল–সেদিন ইনসটিটিউটে আমার বক্তৃতা ছিল, সেটা শেষ করে তবে যেতে পেরেছিলাম–তবু আমরা সাদরে বৃত। হয়েছিলাম। বরুণ সংক্ষেপে যা বললেন, তা থেকে বোঝা গেল, জীবনানন্দ দাশের প্রশ্রয় তিনি পাননি, কেননা আত্মীয় হলেও কবি মিশুক মানুষ ছিলেন না, বরং একটু সন্দেহবাতিক ছিলেন। সভায় আমার সম্পর্কে খানিকটা কৌতূহলের উদ্রেক হয়েছিল। আমি সামান্য যা বলেছিলাম, তাকে প্রধান অতিথির ভাষণ বললে অনেক বাড়িয়ে বলা হয়।
পরে আমি ক্লিন্টকে মঞ্জুশ্রীর অনুরোধের কথা জানিয়েছিলাম। ক্লিন্ট বলেছিলেন, মঞ্জুশ্রী স্বয়ং এমন একটি লিখিত প্রস্তাব তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে-ইচ্ছাপূরণ ক্লিন্টের পক্ষে দুরূহ।
তারপর মঞ্জুশ্রীও খুব বেশিদিন বাঁচেননি।
সেবার কলকাতায় আমাকে আরো একটি বক্তৃতা দিতে হয়েছিল। অনুষ্টুপ আয়োজিত সমর সেন স্মারক বক্তৃতা। ৫ মার্চে স্টুডেন্টস হলে বিশ্বভারতীর উপাচার্য অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্য বক্তৃতা দেন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী : শ্রেণিচরিত্র ও রাজনীতি বিষয়ে। তারপর আমি বলি বাংলাদেশ : বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’ সম্পর্কে। দুটোই ছিল মৌখিক বক্তৃতা। ভাগ্যিস মৌখিক ছিল–লিখিত বক্তৃতা আবশ্যক হলে পেরে উঠতাম না।
৩৪.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড ও ওয়াশিংটন ডিসির প্রবাসী ও অভিবাসী বাংলাদেশিরা ১৯৯৪ সালে সাড়ম্বরে নজরুল-জয়ন্তী উদ্যাপন করতে মনস্থ করেন। তাতে আমন্ত্রিত হয়ে আমি যুক্তরাষ্ট্রে যাই ২৯ বছর পরে। সেই কবে শিকাগো ছেড়েছিলাম, তারপর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর দিয়ে গেছি, তার বিমানবন্দরে থেমেছি, কিন্তু দেশে ঢোকা হয়নি। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ইকবাল। বাহার চৌধুরী, তারই আতিথ্য উপভোগ করার ব্যবস্থা হয়েছে।
অনুষ্ঠানটি বেশ সুন্দর হলো। যুক্তরাষ্ট্রের নানা জায়গা থেকে শ্রোতা ও অংশগ্রহণকারীরা এসেছিলেন। প্রধান অতিথি ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রদূত সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবীর। হুমায়ূন কবীর ভালো বললেন, তবে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বক্তৃতা ছিল অতি চমঙ্কার। তিনি যে আশৈশব বাড়িতে নজরুলের কথা শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছেন, তার মাতামহ মাতামহীর সঙ্গে নজরুলের যে কী আন্তরিক সম্পর্ক ছিল, চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে নজরুলের লেখা চিত্ত-নামা তাদের সকলকে যে কী অসাধারণ আলোড়িত করেছিল–সেসব কথা খুব হৃদয়গ্রাহী করে বললেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে স্মৃতি থেকে নজরুলের কবিতাংশ উদ্ধৃত করেও তিনি সকলকে চমৎকৃত করেছিলেন।
তাঁর অপরিসীম সৌজন্যও উল্লেখযোগ্য। অনুষ্ঠানের পরে চা-পানের সময়ে তিনি আমাকে তাঁর বাসভবনে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি থাকতে পারছি না শুনে অনুযোগ করলেন, এত দূর থেকে এত কম সময় হাতে নিয়ে আসি কেন!
গোলাপের কাটার মতো এই অনুষ্ঠানেরও একটা অন্য দিক ছিল। নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠানস্থল ছিল মেরিল্যান্ডের একটি কলেজের মিলনায়তন। আমরা যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে দেখি পুলিশ আর পুলিশ এবং আমাদের প্রবেশ আপাতত নিষিদ্ধ। কী ব্যাপার? কেউ ফোন করে পুলিশকে বলেছে, মিলনায়তনে বোমা পাতা আছে। অতএব সবটা তল্লাশি করে নিশ্চিন্ত না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ কাউকে ঢুকতে দেবে না। বলা বাহুল্য, কিছুই পাওয়া যায়নি।
কাজটা যে কোনো উদ্যমী বাঙালির, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। সম্ভবত সেখানেও বাঙালিদের মধ্যে এ-পক্ষ ও-পক্ষ ছিল। যারা মিথ্যে খবর দিয়েছিলেন, তাঁরা অনুষ্ঠান বন্ধ করতে পারেন নি, তবে বিলম্বিত করেছিলেন।
সেবার ইকবালের জন্যে একটা অবাক-করা উপহার নিয়ে গিয়েছিলাম : নজরুল-পাণ্ডুলিপি। ১৯২৬ ও ১৯২৯ সালে নজরুল ইসলাম চট্টগ্রামে এসেছিলেন। মুহম্মদ হবীবুল্লাহ্ বাহারের আগ্রহাতিশয্যে। তিনি অতিথি ছিলেন বাহারের মাতামহ খান বাহাদুর আবদুল আজীজের তামাকুমুণ্ডি লেনের বাড়িতে। দুবারই একটি করে রুল-টানা খাতায় তিনি বেশ কিছু কবিতা ও গান লিখেছিলেন। প্রথম খাতার কবিতাগুলি মূলত গ্রন্থভুক্ত হয় সিন্ধু-হিল্লোল (১৯২৭) কাব্যে, দ্বিতীয় খাতার কবিতাগুলি প্রধানত চক্ৰবাকে (১৯২৯)। পাণ্ডুলিপি দুটি বাহারের কাছেই ছিল। তাঁর কন্যা সেলিনা বাহার জামান সেগুলো বাংলা একাডেমিকে প্রদান করলে নজরুলের হস্তলিপিতেই নজরুল-পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয় (১৯৯৪)। বইটির সম্পাদক সেলিনা বাহার জামান, উপদেশকমণ্ডলীর সদস্য আমি, মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ও আবদুল মান্নান সৈয়দ। মান্নান সৈয়দ পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত পাঠ মিলিয়ে পাঠভেদ নির্দেশ করেছিলেন। নজরুল-পাণ্ডুলিপি অত্যন্ত সুচারুভাবে মুদ্রিত হয় কাইয়ুম চৌধুরীর নির্দেশনায় এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদের আগ্রহে।
নজরুল-পাণ্ডুলিপি ছাপার আগে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেটা এর আগে কোথাও বলা হয়নি। বাংলা একাডেমিকে খাতা দুটি দেওয়ার আগে সেলিনা তার ফটোকপি করে রাখতে চেয়েছিলেন। ফটোকপি করতে যে নিয়ে গিয়েছিল, সে ফিরে এলে দেখা গেল, খাতার প্রত্যেকটি পাতা বাধাই থেকে এমনভাবে বিযুক্ত করে নিয়ে ফটোকপি করা হয়েছে যে, কোন পাতা কোন খাতার তা আর বোঝার উপায় নেই এবং পাতার ক্রমও হারিয়ে গেছে। উদ্ভ্রান্ত সেলিনা ওই অবস্থায় পাণ্ডুলিপি ও ফটোকপি এনে আমাকে দেন। আমি খানিকটা শ্রমস্বীকার করে। খাতার কালি ও কাগজ এবং মুদ্রিত কবিতা দেখে দেখে খাতাদুটি পুনর্বিন্যাস করি।
যুক্তরাষ্ট্র রওনা হওয়ার পূর্বমুহূর্তে দু কপি নজরুল-পাণ্ডুলিপি সেলিনা আমার হাতে দেন ইকবালকে পৌঁছোবার জন্যে। বই পেয়ে ইকবাল যে কী খুশি হয়েছিল, তা বর্ণনাতীত।
ইকবালের ব্যবস্থাপনায় দিনদশেক ভালোই কেটেছিল। মাসুমা খাতুন ওয়ালীউল্লাহ ফাহমীদের বাড়ি গেলাম–তারা তখন একটি বাংলা বেতারকেন্দ্র চালাতে ব্যস্ত। ভয়েস অফ আমেরিকার বাংলা বিভাগে যাওয়া এবং অনিবার্যভাবে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়া হলো। কামরু ভাই-ভাবি তখন মেরিল্যান্ডে থাকেন বড়ো ছেলে চন্দনের কাছে। সেখানে একরাত কাটানো গেল। আমার সঙ্গে সেখানে দেখা করতে নিউ জার্সি থেকে এলো আমার খালাতো ভাই ফজলে এবং মামাতো বোন রোখসানা। আমার সম্পর্কে-নাতি সৈয়দ আখতার মাহমুদের বাড়িতে একদিন চা-পর্ব সারলাম। তারপর সে আমাকে পৌঁছে দিল ওয়াশিংটন ডিসিতে এ কে এন আহমদের বাড়িতে। সেখানে আরেক দফা চা-পর্ব।
ফিরতি পথে লন্ডনে পাঁচ-ছদিন কাটিয়ে স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন।
৩৫.
ফ্রাঁস ভট্টাচার্য প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষা ও সভ্যতা বিষয়ক ইনসটিটিউটে (ইনালকো) বাংলা ভাষার অধ্যাপক। তিনি অনেকদিন ধরে চাইছিলেন, তাঁর ইনসটিটিউট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিনিময় কর্মসূচি নিয়ে একটা চুক্তি হোক। তাঁদের দিকে আনুষ্ঠানিকতা চুকিয়ে তিনি আমাকে লিখলেন এ-বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তৎপর করে তুলতে। আমাদের। উপাচার্য মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা ফরাসিপ্রেমী–তার নিজের ডিগ্রিও ফ্রান্সের। তাঁকে বলায় তিনি সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। ফ্রাঁস চুক্তির খসড়া পাঠালেন এবং কিছুদিন পর জানালেন, যদিও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো সাড়া পাননি, তবু আমার কথার ওপরে নির্ভর করে ঢাকায় আসছেন চুক্তি সই করতে। আমি উপাচার্যকে সতর্ক করতে গিয়ে জানতে পারলাম, আমাদের প্রান্তে সে-চুক্তি সম্পর্কে নথিতে দরকারি টীকা-টিপ্পনী রচিত হয়নি। তখনো–খসড়াটি নথিভুক্ত হয়ে আছে মাত্র। আমার কথায় তিনি সংশ্লিষ্ট শাখাকে তাগাদা দিলেন। এদিকে ফ্রস এসে পড়লেন, আমরা তখনো প্রস্তুত নেই। উপাচার্য এবারে জোরালো তাগাদা দিলেন। চুক্তি সই হলো। ফ্রস বুঝে গেলেন, তিনি চলে গেলে নথি আবার ঘুমিয়ে পড়বে। সুতরাং তিনি উপাচার্যকে বললেন, তার ইচ্ছা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই চুক্তির অধীনে আমাকে এক মাসের জন্যে তাঁর ইনসটিটিউটে পাঠাক। সকল আর্থিক দায় ইনসটিটিউটের, বিশ্ববিদ্যালয় কেবল আমাকে মনোনয়ন দেবে। পরের বছরে একজন ফরাসি বিদ্বানের শুধু স্থানীয় আতিথেয়তার ব্যবস্থা করবে বিশ্ববিদ্যালয়, তাঁর আসা যাওয়ার খরচও দিতে হবে না। উপাচার্য এ-প্রস্তাব গ্রহণ করলেন।
ফরাসি দূতাবাস থেকে টিকিট ও ভিসা সংগ্রহ করে ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসে উড়ে গেলাম প্যারিসে। পরদিনই একদিনের জন্যে লন্ডন গিয়েছিলাম কোচে-ডোভার দিয়ে। প্যারিসে তিন সপ্তাহ থাকবো। সোরবোনের অদূরে একটি অতিথিশালায় আমার থাকার চমৎকার ব্যবস্থা। সেখানে ঢুকেই অতিথিদের তালিকায় নাম দেখি অনিরুদ্ধ রায়ের, কিন্তু খোঁজ করে শুনি, দিন দুই আগে পাখি উড়ে গেছে স্বদেশে। প্যারিসে আমাকে দুটি বক্তৃতা দিতে হবে সি এন আর এসে, একটি সোরবোনে এবং দুটি ইনালকোতে। সি এন আর এসে তখনো আনোয়ার আবদেল-মালেক আছেন, ক্রিস্টিন কলপা তাঁর সঙ্গে না থাকলেও ওই বিদ্যাভবনে আছেন–উভয়েই খুব খুশি আমাকে দেখে। সিতেয় না থাকলেও হাসনাত জাহানও প্যারিসে আছে এবং আছে প্রলয় দুতা অর্থাৎ দত্ত। ফ্রাঁস তো আছেনই, উপরন্তু লোকনাথ ভট্টাচার্য এখন আছেন। অধিক আর কি চাই?
আগে প্যারিসে এসে বিবলিওথেক নাসিওনালে ওগুস্তে ওসার বাংলা-ফরাসি শব্দকোষের পাণ্ডুলিপি দেখে গিয়েছিলাম। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে চন্দননগরে সংকলিত বাংলা-ফরাসি শব্দের এই সর্বপ্রথম সংকলনটির একটি ফটোকপি সংগ্রহ করেছেন ফ্রস। প্রত্যেক সপ্তাহান্তে তার বাড়িতে বসে এর পাঠোদ্ধার করি, দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সারি, বিকেলে চা খেয়ে তবে তাঁর বাড়ি থেকে উঠি। লোকনাথ ভট্টাচার্য বেছে বেছে ওয়াইন সংগ্রহ করে রাখেন, তার সত্ত্বার হয়। ফ্রাঁস নিরামিষাশী, মদ্যমাংস স্পর্শ করেন না। আমি ঠাট্টা করলে বলেন, ভুলে যাবেন না, আমি ভাটপাড়ার পুত্রবধূ। আমি বলি, ভাটপাড়ার ঐতিহ্যরক্ষার দায়িত্ব পুত্রকে টপকে পুত্রবধূর ওপর বর্তালো কেমন করে? তিনি বলেন, আমার দায়িত্ব আমি পালন করছি, ওরটা ও বুঝে নেবে। সত্যি, খুব ভালো সময় কেটেছিল ওঁদের সান্নিধ্যে। বাজারে নতুন ওয়াইন ওঠার মোচ্ছব হয় সারা শহর জুড়ে। লোকনাথ আমাকে নিয়ে যাবেন সেখানে। কিন্তু তিনি গাড়ি চালান না। ফ্রাঁসই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন, যদিও তিনি আনন্দে শরিক হলেন না। শব্দকোষের কাজটিতেও মজা পাচ্ছিলাম। বাংলা শব্দের তালিকায় ফরাসি শব্দ ঢুকে গেছে–তা আমার পরিচিত নয়, ফ্রাঁস তা শনাক্ত করেন। আবার বাংলা বা ফরাসি শব্দের তালিকায় এমন শব্দ পাওয়া গেল, যা ফ্রাঁস বা আমি কেউ শনাক্ত করতে পারলাম না। পরে অভিধান ঘেঁটে ফ্রস বের করলেন, ওগুলো পর্তুগিজ শব্দ।
সোরবোনে তখন হেগিওগ্রাফি তথা সন্ত-জীবনী নিয়ে একটি বক্তৃতামালা চলছিল। ফ্রস তাতে আমার নাম ঢুকিয়ে দিলেন। আমি সপ্তদশ শতাব্দীর কবি সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়েছিলাম। নবীদের তালিকায় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও হরির নাম যে কবি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, এ-তথ্য জেনে শ্রোতারা খুব মজা পেয়েছিলেন এবং এর সাংস্কৃতিক তাৎপর্য নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল।
সিএনআরএসে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলাম বাংলাদেশে ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে। বক্তৃতার শেষে এক মহিলা এসে বললেন, আমার নাম আন-মারি ওয়ালীউল্লাহ্। আপনার বক্তৃতা আমার ভালো লেগেছে। আমার মনে হয়, এ বিষয়ে ওয়ালীউল্লাহ যদি বক্তৃতা দিতো, সে আপনার মতোই বলতো। বললাম, তিনি নিশ্চয় অনেক ভালো বলতেন। তারপর তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে, ১৯৬৯ সালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ও তিনি যখন চট্টগ্রামে আসেন, তখন সৈয়দ আলী আহসানের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে আমরা তাদের নৈশভোজে আপ্যায়িত করেছিলাম। আমাকে চিনতে না পারার জন্যে আন-মারি লজ্জিত হলেন। বললাম, লজ্জা পাওয়ার কোনো কারণ নেই, পরিচয় না দিলে আপনাকেও আমি চিনতে পারতাম না। ২৫ বছর আগে স্বল্পকালের জন্যে দেখা–এতদিন মনে থাকবে কী করে?
আন-মারি আশ্বস্ত হলেন। বললেন, আপনার সঙ্গে এ-যাত্রায় আরো দেখা। হবে আশা করি। আমরা টেলিফোন নম্বর বিনিময় করলাম। পরে চায়ের টেবিলে মিলিত হলাম। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে তাঁর প্রেমপূর্ণ কথাবার্তা শুনে আপ্লুত হলাম। তিনি বললেন, অচিরে তাঁর ঢাকায় যাওয়ার ইচ্ছে আছে; এলে অবশ্যই যোগাযোগ করবেন।
ইনালকোতে বাংলা ভাষা-শিক্ষার্থীদের কাছে বক্তৃতা দেওয়া ছিল অন্য ধরনের ব্যাপার। আমি ইচ্ছে করেই বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে প্রশ্ন ও উত্তর পর্বের জন্যে বেশি সময় রেখেছিলাম। সেটাই উপযুক্ত হয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরা অনেক কিছু জানতে চেয়েছিল, আমি সাধ্যমতো উত্তর দিয়েছিলাম।
এর মধ্যে ঢাকা থেকে খবর পেলাম, আমার বন্ধু টোনি স্টুয়ার্ট ফোন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে–সে আমাকে নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে দু মাসের জন্যে আমন্ত্রণ জানাতে চায়। আমি যথাসময়ে যেতে পারবো কি না, তাকে যেন জানিয়ে দিই। পরদিন ফোন করলাম টোনিকে। স্থির হলো, ফেব্রুয়ারিতে যাবো তাদের ওখানে।
আমার সর্বশেষ বক্তৃতা হয়ে যাওয়ার পরে ফ্রস আমাকে নিয়ে গেলেন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিদায় নিতে। সেখানে গিয়ে শুনলাম, থাইল্যান্ড থেকে। আগত আমার মতো এক অতিথি সেদিন সকালে ফিরতি টিকিট কিনতে এয়ারলাইনসের অফিসে যাচ্ছিলেন। পথে দুবৃত্তরা সব টাকাকড়ি ছিনিয়ে নিয়েছে। তার থেকে। উপস্থিত সকলে আমাকে সাবধানে থাকতে বললেন। আমি বললাম, আমি আছি আর দুদিনমাত্র, এতদিন যখন নিরাপদ ছিলাম, তখন আর দুটি দিন মনে হয় নিরাপদেই কাটিয়ে দিতে পারব।
সেই সন্ধ্যায় আমি একটু আয়েশ করার পরিকল্পনা করেছি। সঁজে-এলিসের দিকে যাবো। পথের ধারে কোনো টেবিলে কিছু সময় কাটাবো। সন্ধ্যা নামার পরে ভালো একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করবো। কাজে যাচ্ছি না বলে ধীরপদে চলছি। একটা মেট্রোতে লাইন বদলাতে হবে। আমি ট্রেন থেকে নেমে ধীরে ধীরে হেঁটে এসকেলেটরে উঠেছি। প্রায় শেষ প্রান্তে যখন এসেছি, তখন। পেছন থেকে ধাক্কা খেলাম। আমি লাফিয়ে সমান জায়গায় পড়লাম উপুড় হয়ে। পেছন থেকে লাফিয়ে এসে একজন আমার ঘাড়ের ওপর পড়ল। সামনে থেকে একজন এলো সাহায্য করতে–আমাকে নয়, আমার আক্রমণকারীকে। আমি সাহায্যের জন্যে চীৎকার করতেই একটা ঘুসি খেলাম। মুহূর্তের মধ্যে আমার ট্রাউজারের পেছনের পকেট থেকে মানিব্যাগ, শার্টের বুকপকেট থেকে আইডি, কলম, মেট্রোর টিকিট কার্ড এবং জ্যাকেটের পকেট থেকে অ্যাড্রেসবুক নিয়ে তারা চলে গেল–শুধু পকেট-চিরুনিটা দিয়ে গেল।
ভূমিশয্যা ত্যাগ করে সিঁড়ি বেয়ে প্ল্যাটফরমে উঠলাম। অপেক্ষমাণ যাত্রীদের কাছে অনুচ্চকণ্ঠে জানতে চাইলাম, কেউ ইংরেজি বলেন কি না। একজন উত্তর দেওয়ায় তাঁকে আমার অবস্থার কথা বললাম। ট্রাউজারের পেছনের পকেটটা আক্রমণকারী ছিঁড়ে ফেলেছিল-সেটা দেখালাম। বললাম, আমি ফেরত যাবো, কিন্তু বিনা টিকিটে ভ্রমণ করা কি ঠিক হবে? আমার কাছে টিকিটের মূল্য সাত ফ্রা কেন, একটি ফ্রাঁও নেই। ভদ্রলোক আমাকে দশ ফ্রা দিলেন। জানতে চাইলাম, কোথায় তার অর্থ ফেরত দেবো? তিনি বললেন, ফেরত দিতে হবে না, এমন আমারও ঘটতে পারতো। ভিক্ষার টাকায় টিকিট করে ঘরে ফিরে এসে ফ্রাঁসকে ফোন করলাম। তার কাছে খবর পেয়ে প্রলয় দত্ত এলো। আমাকে নিয়ে কাছাকাছি একটা ক্যাফেতে সে অনেকখানি সময় কাটালো। স্নায়বিক আঘাতে ভুগি কি না, সেটাই বোধহয় ছিল তার দুশ্চিন্তা।
পরদিন আনোয়ার আবদেল-মালেকের বাড়িতে আমার বিদায়ী নৈশভোজ। তাকে বললাম ঘটনাটা। তিনি জানতে চাইলেন, আক্রমণকারীরা দেখতে কেমন। বললাম, সামান্য যা দেখেছি, তাতে তো আরব মনে হলো।
তা শুনে তার ফরাসি বান্ধবী খুব একচোট হাসলেন।
প্যারিস থেকে লন্ডনে এলাম কোচে। আমাকে নিতে এলেন আমার ছাত্রী হাসিনা হক ও তাঁর স্বামী, লন্ডনের সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক, নাজমুল হক। উঠলাম পূর্ব লন্ডনে আমার ছাত্রী এবং আমার বড়ো মেয়ে রুচির ননদ মুনীরা ওরফে বিউটির কাউনসিল ফ্ল্যাটে। বিউটির স্বামী নাসিরুল হোসেন ওরফে জসীমও সোনালী ব্যাংকে কর্মরত। ওদের মেয়ে মালিহা নিতান্তই ছোটো–দৌড়ঝাঁপ করে বিউটিকে ব্যস্ত রাখে। বিউটিদের বাসায় থাকার সময়ে একদিন কেমব্রিজ থেকে আমার ছাত্র মহীবুল আজিজ ও তার স্ত্রী শামীমা সুলতানা ওরফে মিতু এলো দেখা করতে। তারা দুজনেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছে। মিতু এসেছে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচ ডি করতে। মহীবুল এসেছে তাকে সঙ্গ দিতে, হাতে যথেষ্ট সময় আছে বলে লাইব্রেরিতে বসে মনের সুখে পড়ছে। তাদেরকে পেয়ে দিনটা খুব ভালো কাটলো।
নাজমুল হকদের বাড়িতেও থাকা হলো। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় কাটালাম। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি, স্থান-পরিবর্তনের উদ্যোগ চলছে। তাদের জন্যে অন্য যে-ক্যাটালগটি করেছিলাম, মনে হলো, সেটা ছাপতে সময় নেবে।
৩৬.
দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো বটে, তবে তার চর্চা তেমন নেই। সরকার ও বিরোধী দলে বিরোধ ক্রমশ বাড়ছে। ১৯৯৩ সাল থেকে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার-প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে চলেছে। সেই দাবিতে সভা-সমাবেশ-মিছিল-হরতাল চলছে। সভা-সমাবেশ-মিছিলে সরকারের পুলিশ কিংবা দলীয় কর্মীরা প্রায়শই হামলা চালাচ্ছে।
১৯৯৪ সালের ২০ মার্চে মাগুরায় উপনির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থী কাজী সলিমুল হক কামাল নির্বাচিত হলেন। এই উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে বলে সকল বিরোধী দল অভিযোগ করলো। ভোটগ্রহণের দিনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মাগুরায় গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি অচিরেই ফিরে আসেন। কারো কারো মতে, তিনি ফিরে আসেন সেখানকার অব্যবস্থা দেখে অসহায় বোধ করে। যে-ধরনের ভ্রান্তির সুযোগে ট্রাজেডিতে নায়কের পতন ঘটে, সরকারের পক্ষে মাগুরা উপনির্বাচন ছিল তেমনি। অনেক কিছু করে সরকার পার পেয়ে গেছে, কিন্তু এবারে স্বেচ্ছাচারটা এত বড়োরকম হলো যে সবার ধৈর্যের বাধ ভালো। ফলে এখন থেকে সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি প্রবল হয়। এমনকী তথ্যমন্ত্রী নাজমুল হুদা পর্যন্ত বলে ফেলেন যে, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে বিদ্যমান সংকটের সমাধান হবে। ফলে তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, কিন্তু রাজনৈতিক সংঘাত প্রবলতর হতে থাকে। বিরোধী দল সংসদ বর্জন করে, বিরোধী দলীয় নেত্রী সরকারি বাসভবন ছেড়ে দেন এবং ডিসেম্বর মাসে সকল বিরোধী দলীয় সংসদ-সদস্য একযোগে পদত্যাগ করেন।
৩৭.
আমার বন্ধু টোনি কে. স্টুয়ার্ট নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ধর্ম ও দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা করে। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ও বাংলার লৌকিক ধর্ম তার অধ্যয়ন-অধ্যাপনার বিশেষ ক্ষেত্র। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক এবং তার শিক্ষকতুল্য এডওয়ার্ড সি. ডিমক জুনিয়রের সঙ্গে মিলে সে তখন কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত অনুবাদ করছিল ইংরেজিতে। টোনিই আমার জন্যে একদিকে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজের কাছে প্রস্তাব দিয়ে অর্থবরাদ্দ করিয়েছিল এবং অন্যদিকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে লিখে আমন্ত্রণ সংগ্রহ করেছিল।
লন্ডনে থামবার সুযোগ আমি সচরাচর ছাড়ি না। এবারে বিশেষ উৎসাহ জোগালেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বইয়ের দুটি তালিকা ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। তালিকাভুক্ত বইগুলি তার জন্যে যথাক্রমে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে লন্ডন পৌঁছোলাম। এবারে বোধহয় নাজমুল হকের বাড়িতে উঠি, পরে সিরাজুর রহমানের বাড়িতে বদলি হই। এর মধ্যে আবুল খায়ের লিটু লন্ডনে এসে উপস্থিত। পিকাডেলির কাছে এক রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করে সে জানতে চাইলো, ‘মাইজা আব্বা আমাকে বই আনতে দিয়েছেন কি না। আমি হাঁ বলায় সে বললো, ‘উনি নিশ্চয় আপনাকে কোনো টাকা-পয়সা দেননি।’ বললাম, ‘সে পরে দেখা যাবে। লিটু আমার হাতে তিন শ পাউন্ড ধরিয়ে দিয়ে বললো, রাজ্জাক সাহেবের পছন্দের বইয়ের দাম বেশি হওয়ারই কথা–এই টাকায় যা হয়, আমি যেন তাই কিনি, নিজের থেকে যেন খরচ না করি।
লন্ডনে সারের জন্যে বই খুঁজতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। অল্প যে-কটি বই কিনেছিলাম, তাতে দেড় শ পাউন্ডের অধিক খরচ হয়ে গিয়েছিল। সিপরি ইয়ারবুকের দামই ছিল পঞ্চাশ পাউন্ড। গোটা চারেক অ্যাটলাস কিনেছিলাম–প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক ও সাম্প্রতিক কালের। আরব ইতিহাসবিদদের সম্পর্কে একটি বই ছিল, একটি ছিল যান্ত্রিক উদ্ভাবন সম্পর্কে, আরেকটি ছিল ইংরেজদের খাদ্য বিষয়ে। এসব বই বাক্সবন্দি করে আমেরিকায় নিতে হবে, তারপরে ফেরার সময়ে দেশে। তালিকার বেশ কিছু বই ছাপা ছিল না। ভাগ্যিস ছিল না।
সিরাজুর রহমানের বাড়ি থেকে ট্যাকসিতে ভিক্টোরিয়া। সেখানে চেক-ইন করে ট্রেনে করে গ্যাটউইক। সেখান থেকে বিমানে করে রলে। যাত্রার শেষদিকে শরীরটা খারাপ লাগছিল–মাথা ঘুরছিল কেন জানি না। স্টুয়ার্ডকে বলতে সে সামনের কেবিনে নিয়ে বসালো। তাতে বিশেষ লাভ হলো না। খাওয়ার সময়ে আমি আর কিছু মুখে দিলাম না।
বিমানবন্দরে টোনি নিজেই এসেছে আমাকে নিতে। অ্যাভেন্ট ফেরি কমপ্লেক্স নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসন আছে। মূলত ছাত্রছাত্রীদের আবাস। তারই নিচতলায় একটি ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা। ঘরটি প্রশস্ত–একধারে মাইক্রোআভেন এবং হাঁড়িকুঁড়ি বাসনপত্র। লাগোয়া বাথরুম। ঘর পরিষ্কার করা, বিছানার চাদর ইত্যাদি বদলে দেওয়ার দায়িত্ব এদের। নিচতলায় লন্ড্রি আছে, পৃথক রান্নাঘর আছে।
জিনিসপত্র ঘরে রেখে টোনি আমাকে খাওয়াতে নিয়ে গেল। সে খেতে ভালোবাসে। ফলে শুধু সে-রাতে নয়, প্রায়ই আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ অথবা ডিনার খেতাম।
পরদিন টোনি এসে আমাকে তার বিভাগে নিয়ে গেল। একটা জয়েনিং রিপোর্ট লিখলাম–জুড়ি নামে সেক্রেটারি সেটা টাইপ করে দিলো। তারপর অনেকগুলো কাগজে সই নিলো আমার। যখন উঠে বেরিয়ে আসছি, সে বললো, তোমার পি সি ফেলে যাচ্ছ।
জিজ্ঞাসা করলাম, কিসের পি সি?
বললো, তোমার কম্পিউটার–ঘরে বসে কাজ করার জন্যে।
বললাম, আমি তো তার ব্যবহার জানি না।
এবারে টোনি হাল ধরলো, এটা বিভাগ থেকে তোমার নামে বরাদ্দ হয়েছে, ঘরে নিয়ে চলো। ব্যবহার জানো না তো শিখে নেবে। শিখতে দিন দুইয়ের বেশি লাগবে না।
টোনি আমাকে নিয়ে গেল আমার ঘরে টেলিফোন-সংযোগের ব্যবস্থা করতে। তারপর সুপারমার্কেটে। সে খাবারদাবার বাছাই করছে দেখে আমি বললাম, টোনি, আমি রাঁধতে পারবো না, বাইরে খাবো।
সে বললো, অর্ধেক রান্নাকরা খাবার কিনে নাও, মাইক্রোআভেনে গরম করে নিলেই হবে। অনর্থক বাইরে খেয়ে পয়সা নষ্ট করবে কেন? ব্রেকফাস্টটা অনায়াসে ঘরে সারতে পারবে, মাঝে মাঝে দুপুর বা রাতের খাবারটাও।
নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটির তিনটে ক্যাম্পাস–রলে, ডিউক ও চ্যাপেল হিল। একটার সঙ্গে যুক্ত হলে বাকি দুটোর সকল সুবিধে ভোগ করা যায়। একটা থেকে অন্যটায় যাবার বাসও আছে। রলেতে ইউনিভার্সিটির বাস সারা ক্যাম্পাস ঘোরে। উঠে পড়লেই হলো–টিকিট লাগে না। পরে বাস ড্রাইভারদের সঙ্গে চেনাজানা হয়ে গেলে তারা অনেক সময়ে নিময়ভঙ্গ করে আমার সুবিধামতো জায়গায় নামিয়ে দিয়েছে।
রলেতে পৌঁছোবার পরের দিন সন্ধ্যায় ইতিহাস বিভাগের ডেভিড গিলমার্টিন এসে আমাকে নিয়ে গেল ডিনারে। ডেভিড মজার লোক। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞাসা করে এক পাত্র পান করবে কি না, তার উত্তর হবে, যদি তুমি জোর করো-ইফ ইউ টুইস্ট মাই আর্ম। জোর করতে হতো না, একবার বলাই যথেষ্ট হতো।
প্রথম সপ্তাহান্তেই নিমন্ত্রণ কার্ল আর্নস্টের বাড়িতে। তিনি মস্ত বড়ো পণ্ডিত। টোনি ও তার স্ত্রীকে ডেকেছেন, সেই সঙ্গে আমাকেও। টোনি শহরের বাইরে থাকে, আর্নস্টরাও শহরের অন্য প্রান্তে। টোনির স্ত্রী জুলি বড় এক কোম্পানির একজিকিউটিভ–প্রায়ই তাকে বাইরে যেতে হয়। সে-ই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল।
রলের সামাজিক জীবনে আমাদের স্বদেশিদেরও ভূমিকা কম নয়। আমি পৌঁছোবার পরপরই টেলিফোন করে আমার বাসস্থানে এলো আশফাঁক ও মাহবুব। তারা আমাকে দিনে ক্যাম্পাসে দেখেছে। তারা যে সকল সময়ে সাহায্য করতে রাজি, সে কথা জানাতেই তাদের আসা। তারা সে কথা রেখেছিল। এছাড়া খুব উল্লেখযোগ্য ফারুক ও লোপার নাম। তারা দুজনেই প্রকৌশলী, বড়ো চাকরি করে। পরিচয় পাওয়ার পরে জানলাম, ফারুকের ভাইবোনেরা আমার অনেককালের চেনা। লোপা জানালো, শৈশবে সে একদিন তার খালু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমাদের বাড়ি গিয়েছিল। এরপর তাদের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া আমার নিত্যকর্ম হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
রলে থেকে অদূরে এলিজাবেথ সিটিতে অধ্যাপনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের পূর্বতন শিক্ষক ড. আবদুল লতিফ চৌধুরী, আর আমার পূর্বপরিচিত ড. আশরাফুল ইসলাম চৌধুরী। তারা একদিন রলেতে এলেন এবং একসঙ্গে আড্ডা দিয়ে–খেয়েদেয়ে দিনটা কাটালেন। আশরাফুলের আত্মীয়েরা আছেন রলেতে, সেইসূত্রে পরিচিতদের গণ্ডি আরো বাড়লো।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ২৫ মার্চে বাংলাদেশ সমিতি আয়োজন করলো অনুষ্ঠানের। অনিবার্যভাবে আমি সেখানে একজন বক্তা।
রলেতে আমার কাজ হালকা। এখানে একটা বক্তৃতা দিতে হবে মাত্র। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গোটা দুই-তিন বক্তৃতা, গোটা দুই সম্মেলনে যোগদান। নিজের মতো পড়াশোনা করাই আসল। এখানে বক্তৃতার জন্যে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের প্রাথমিক পর্ব সম্পর্কে গবেষণায় লেগে গেলাম।
এপ্রিল মাসে আমার কর্মসূচি দীর্ঘ। প্রথমে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ায় একটা বক্তৃতা–বাংলা সাহিত্যে নারী-বিষয়ে। সেখানকার বাংলা শিক্ষক ক্যারল সলোমন এর আয়োজক। তাছাড়া ক্যারল, টোনি ও আমি একটা সিম্পোজিয়ম করলাম একসঙ্গে। ক্যারলের কথা আগে জানতাম–লালনগীতির একনিষ্ঠ চর্চাকারী। এই প্রথম দেখা। সেইসঙ্গে পরিচয় হলো তার ছাত্রী সুফিয়া উদ্দীনের সঙ্গে। সুফিয়ার বাবা বাঙালি, মা পোর্টোরিকান, স্বামী মার্কিন ইহুদি। সে মূলত আরবি পড়ে। বাড়িতে সিলেটি উপভাষা শিখেছে, এখন ক্যারলের কাছে প্রমিত বাংলা শিখছে। আমার ভারী সুটকেস টানাটানির কাজ সে-ই করলো। তারপর এক দামি রেস্টুরেন্টে খাওয়ালো–টোনি, ক্যারল, আমি আর তার স্বামী সেখানে অতিথি। ইউ অফ পেনে দেখা হলো দীনার সঙ্গে–অধ্যাপক হাফিজ জি এ সিদ্দিকী ও নাজমা সিদ্দিকীর কন্যা। অতএব তার ও ডেভিডের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হলো ক্যারল, টোনি ও আমাকে।
ফিলাডেলফিয়া থেকে নেওয়ার্কে গেলাম একটা ছোটো প্লেনে। নজন বা দশজন যাত্রীর আসন, একজন ক্যাপ্টেন, একজন ক্রু। খুব নিচে দিয়ে যায় আর হরদম লাফায়। বেশ অস্বস্তিকর যাত্রা। নেওয়ার্কে নেমে এক যাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই বিমান কি সবসময়ে এমনই করে? তিনি বললেন, বলতে পারি না। এই আমার প্রথম যাত্রা, আশা করি, এই শেষ যাত্রাও।
নেওয়ার্কে এলাম আমার ছোটো শ্যালিকা সিমীনের পরিবারের সঙ্গে নিউ জার্সিতে দুদিন কাটাতে। মোবারক আমাকে এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে পরে নিউ ইয়র্কে পৌঁছে দিলো। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা-ইউ অফ পেনে যেটা দিয়েছিলাম, সেটারই পুনরাবৃত্তি। আগের সন্ধ্যায় জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু খাওয়ালো, পরের সন্ধ্যায় আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সাবিয়া। মুহিত।
এবারে এলাম ওয়াশিংটন ডি সিতে। সেখানে অ্যাসোসিয়েশন অফ এশিয়ান স্টাডিজের বার্ষিক সম্মেলন। প্রথমে উঠলাম ইকবাল বাহার চৌধুরীর বাড়িতে, পরে নির্ধারিত হোটেলে–বাড়িতে খাইয়ে সেখানে পৌঁছে দিলেন ওয়ালিউল্লাহ। ও মাসুমা ফাহমী। সম্মেলন চললো দুদিন ধরে। এখানে দেখা হলো ক্যারলের ইতিহাসবিদ স্বামী রিচার্ডের সঙ্গে। গেইল মিনোর সঙ্গে দেখা হলো অনেকদিন পরে-সম্মেলন ফাঁকি দিয়ে বাইরে বসে গল্প করে আমরা বিকেলটা পার করলাম। আর দেখা হলো কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষক, আমার বন্ধু, শেলি ফেল্ডম্যানের সঙ্গে। সম্মেলনের মধ্যেই এক সন্ধ্যায় গেলাম ভাইপো চন্দনের বাড়িতে।
ওয়াশিংটনে দেখা আবদুন নূরের সঙ্গে। কথাসাহিত্যিক এবং বিশ্বব্যাংকের গ্রন্থাগারিক। তাঁকে বললাম, রাজ্জাক সাহেবের জন্যে বিশ্বব্যাংকের কিছু প্রকাশনা কিনতে চাই। তিনি বললেন, আমাকে লিস্ট পাঠিয়ে দেবেন–আমি অনেক ডিসকাউন্টে কিনতে পারবো।’ শুধু তাই নয়, বইগুলো তিনি ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের অফিসে পাঠিয়ে দেওয়ার ভারও নিলেন। লন্ডনে এবং রলেতে সারের জন্যে যেসব বই কিনেছিলাম, সেগুলোও তাকে পাঠিয়ে দিলাম ডাকযোগে। সবসুদ্ধ তিনি পাঠালেন ঢাকা অফিসে। সেখানে সাহানা ইকবালের কাছ থেকে পরে সেগুলো বুঝে পেয়েছিলাম। আরো পরে জেনেছিলাম, এই সাহানা হলো লেখক ও শিল্পী সৈয়দ ইকবালের স্ত্রী।
এপ্রিল মাসের ২০-২২শে ডিউকে একটা বড়ো সেমিনারের আয়োজন হলো তিন দিন ধরে। সেখানে আমাকে বক্তৃতাটা দিতে হবে। নিজে কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারছি না–টোনিকে ধরে জুডিকে দিয়ে বক্তৃতা টাইপ করালাম। সেমিনারের আগেই টোনির জ্বর–সে যেতে পারছে না। ডেভিড নিয়ে গেল আমাকে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বক্তৃতা শেষ করতে পারলাম না। বাড়তি সময়ে বক্তৃতা দ্রুত পড়ে গেলাম–কেউ বুঝতে পারলো কি না সন্দেহ।
মাসের শেষে শিকাগোয়। সেখানে বেঙ্গল স্টাডিজ কনফারেন্স। জিল্লুর রহমান খান তার আয়োজক। রশীদুজ্জামানও এসেছে সেখানে। বঙ্গদেশ নিয়ে কাজ করে, এমন বিদ্বান অনেকেই এসেছেন। সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে মুখেই কিছু বললাম। অনেক পরে এক মার্কিন বিদ্বজ্জন আমাকে বলেছিল, আমার সেই বক্তৃতা থেকেই সে তার গবেষণার বিষয়ের সন্ধান পায়।
শিকাগোর খানিকটা দূরে বোলিংব্রুকে আমার বন্ধু আবদুল আলীর ভ্রাতুস্পুত্র মিল্টন থাকে সপরিবারে। সপরিবারে বললে ঠিক হয় না, সগোত্রে বললেই যথার্থ হয়। তার স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও বাপ-মা আছেন সেখানে। অবকাশে অনুজ টিটো গেছে তার কাছে। আমার বন্ধু মোহাম্মদ আলী ও বুড়ীও সেখানে গেছে। বেড়াতে। অতএব আমাকে যেতেই হবে। ইন্টারন্যাশনাল হাউজ থেকে আমাকে নিয়ে গেলেন আলা ভাই ও মিল্টন। এর মধ্যে মিল্টনের চাচাতো ভাই মাইকেল তার মার্কিন স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে হাজির। মিল্টনের বাড়িটা বড়ো–তার মধ্যেও এতজনের জায়গা কী করে হলো, সে এক বিস্ময়! তার স্ত্রী নিলির অসীম ধৈর্য আর বানু ভাবির স্বাভাবিক নৈপুণ্য!
শিকাগো থেকে ফিরে আমার প্রকৃতপক্ষে ছুটি। দেশে ফেরার প্রস্তুতি নেওয়া। গ্রীষ্মবকাশ শুরু হয়ে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। টোনি তার ছাত্রছাত্রীদের খাওয়াবার আয়োজন করেছে বাড়িতে। সেইসঙ্গে আমাকেও ডেকেছে। পার্টি শেষ না হতেই জুলি বিদায় নিলো। টোনি আমাকে বললো, প্রিয়া কামদার নামে। একটি ভারতীয় মেয়ে তোমাকে ঘরে পৌঁছে দেবে।
গাড়িতে আসতে আসতেই প্রিয়ার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল। নামার সময়ে আমি বললাম, চলো, একদিন ডিনার খাই একসঙ্গে। সে বললো, যখনই তোমার সুবিধে হয়।
এক সন্ধ্যায় সে এলো আমাকে নিতে। তারপর তার পছন্দসই একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম বেশ খানিকটা দূরে। আমাকে আবার যখন সে পৌঁছোতে এলো, তখন সে ঘরে আসবে কি না জিজ্ঞেস করতেই সে নেমে এলো এবং দরজা খুলতেই সটান আমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি বিছানার ধারে একটা চেয়ার টেনে এনে বসলাম এবং দুজনে গল্প করতে থাকলাম। তার মধ্যে। বেশির ভাগই তার নিজের এবং তার পরিবারের কথা।
খানিক বাদে সে উঠে পড়ল এবং বিদায় জানিয়ে চলে গেল। বছরখানেক পরে তার বিয়ের আমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলাম। তাতে দেওয়া বোম্বাইয়ের ঠিকানায় তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলাম, কিন্তু তার প্রাপ্তিস্বীকার পাইনি।
পরে টোনির কাছে তার খোঁজ করেছিলাম। টোনি তাকে ভালো মনে করতে পারলো না। না, সে তার কোনো খবর জানে না, তার বিয়ের কথাও জানে না।
রলে ছাড়ার আগে আমারও কর্তব্য সবাইকে আপ্যায়ন করা। কোথায় করবো? অ্যাভেন্ট ফেরি কমপ্লেসে তেমন কোনো জায়গা নেই। টোনি বললো, আমার বাড়িতেই পার্টিটা দাও। তুমি বাজার করে দিও, আমি রাঁধবো। বললাম, জুলির ওপর অত্যাচার হবে। টোনি বললো, তার সয়ে গেছে।
তাই হলো। টোনি খুব ভালো বিফস্টেক তৈরি করেছিল। জুলিও ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করেছিল। সবাই খুব উপভোগ করেছিল।
জুডি আসতে পারেনি। টোনির সঙ্গে তার বাড়িতে গিয়ে কয়েকটা গিফ্ট ভাউচার দিয়ে এলাম।
আসার আগে আমার বাঁধাবাঁধিতে অনেকে সাহায্য করলো–তার মধ্যে আশফাঁক ও মাহবুব ছিল। ওদেরকে কিছু খাদ্য ও অন্য সামগ্রী দিয়ে এলাম। সবশেষে ওস্তাদের মারের মতো হাত লাগালে টোনি। তারপর বিমানবন্দরে তুলে দিলো আমাকে। আবার লন্ডনে একদিন থেমে ঢাকায় ফিরলাম।
জুলির সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি। আমি চলে আসার অল্পকাল পরে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়।
৩৮.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ১৯৬৩ সালে আমরা যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ উদযাপন করেছিলাম, তা বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। বিশেষ করে হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের নির্বাচিত অংশের পাঠ, অভিনয় ও গান সকলে খুব উপভোগ করেছিলেন। বেতারে-টেলিভিশনে তখনই এর খানিকটা স্বতন্ত্রভাবে প্রচারিত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে নানা বিদ্যায়তনে এবং সাধারণ মঞ্চে হাজার বছরের বাংলা কবিতা বা গানের অনুষ্ঠান করার একটা ঝোঁক দেখা দিয়েছিল।
১৯৬৩ সালে নরেন বিশ্বাস ছিল আমাদের ছাত্র এবং পূর্বোক্ত অনুষ্ঠানের এক সফল অংশগ্রহণকারী। পুরো আয়োজনটা তার মনে গভীর রেখাপাত করে এবং সেও নানা সময়ে ওই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আশির দশকের শেষে নরেন স্থির করে যে, হাজার বছরের বাংলা কবিতা ও গান, গদ্য ও নাটকের অডিও ক্যাসেটের একটা সিরিজ প্রকাশ করবে ‘ঐতিহ্যের অঙ্গীকার’ নাম দিয়ে। এই পরিকল্পনায় সে আমাকে যুক্ত করে উপদেষ্টা হিসেবে। ‘ঐতিহ্যের অঙ্গীকার’ নামটি আমার পছন্দ ছিল না, কিন্তু ওই নামের প্রতি নরেনের দুর্বলতা ছিল এবং সে নামটি প্রচারও করে ফেলেছিল, সুতরাং তা মেনে নিতে হয়। আমার কাজ ছিল রচনা নির্বাচন করা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মুখবন্ধস্বরূপ কিছু বলা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নরেনের নির্বন্ধাতিশয্যে পাঠ করা। প্রথমে গোলাম মোর্শেদ ও আজিজুল হক চৌধুরী মানিক আর্থিক সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন, পরে এই কাজের অংশীদার হন ড. নারায়ণ বিশ্বাস ও ড. আখতার বানু। নরেন নির্দেশনা দেয়, আশরাফুল আলম আগাগোড়া গ্রন্থনার কাজটি করেন। দেশের বিশিষ্ট শিল্পী ও শিক্ষকেরা এতে অংশ নেন। শেষ পর্যন্ত বোধহয় ১৪টি ক্যাসেট প্রকাশ পেয়েছিল।
১৯৯৩ সালে কলকাতায় গৌরকিশোর ঘোষ একদিন আমার কাছে। ‘ঐতিহ্যের অঙ্গীকার’ সম্বন্ধে জানতে চান এবং এর কয়েকটি সেট কিনে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তখন পর্যন্ত বোধহয় আটটি ক্যাসেট বের হয়েছিল। পরেরবার আমি যখন কলকাতায় যাই, তখন তাঁকে কয়েকটি সেট উপহারস্বরূপ দিয়ে আসি। অচিরেই বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে পাই যে, আমাদের এই প্রয়াস আনন্দ পুরস্কার লাভ করতে যাচ্ছে।
আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী আনন্দ পুরস্কার প্রবর্তন করেন ১৯৫৮ সালে। তখন আনন্দবাজার পত্রিকার লোকান্তরিত সম্পাদক প্রফুল্লকুমার সরকার এবং এই গোষ্ঠীর পত্রিকাসমূহের সূচনাকারী ও বাংলায় লাইনো হরফের প্রবর্তক সুরেশচন্দ্র মজুমদারের স্মৃতিযুক্ত দুটি পুরস্কার প্রদানের উদযোগ নেওয়া হয়। পুরস্কার-দুটির প্রথম প্রাপক ছিলেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ও সমরেশ বসু। সৃষ্টিশীল সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে মননশীল সাহিত্যের জন্যেও এই পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কারের উদ্যোক্তা আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক অশোককুমার সরকারের মৃত্যুর পর ১৯৮৪ সালে তাঁর স্মৃতিযুক্ত তৃতীয় একটি আনন্দ পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা হয়। এই পুরস্কারের প্রথম প্রাপক ছিলেন সুকুমার সেন, সাগরময় ঘোষ ও বিমল মিত্র। পরে উইলিয়ম রাদিচে, নীরদচন্দ্র চৌধুরী, অমিতাভ ঘোষ ও ক্লিনটন বি সিলি এই পুরস্কার পান। ১৯৯৪ সালে নরেন ও আমাকে যুক্তভাবে অশোককুমার-স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমিকে আনন্দ পুরস্কার প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কার গ্রহণ সংগত হবে না বিবেচনা করে একাডেমি সে-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। সে-বছর তসলিমা নাসরিন (সুরেশচন্দ্র-স্মৃতি) আনন্দ পুরস্কার পায়। সেই প্রথম বাংলাদেশের কোনো সাহিত্যিক আনন্দ পুরস্কার পেল। ১৯৯৪ সালে প্রবন্ধসমগ্র গ্রন্থের জন্যে অন্নদাশঙ্কর রায় পান (সুরেশচন্দ্র-স্মৃতি) আনন্দ পুরস্কার, আকাশ আসবে নেমে কাব্যের জন্যে শামসুর রাহমান পান (প্রফুল্লকুমার-স্মৃতি) আনন্দ পুরস্কার, সেই সঙ্গে ‘ঐতিহ্যের অঙ্গীকারের জন্যে আমরা দুজনও পুরস্কৃত হই।
পুরস্কার নিতে শামসুর রাহমান, নরেন ও আমি সস্ত্রীক কলকাতায় যাই। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল চৌরঙ্গীর পিয়ারলেস ইনে। শামসুর রাহমানের কাছে অগুনতি অনুরাগী ও সাহিত্যিকের আনাগোনা। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বেহিসেবি পান করে শামসুর রাহমানকে বিব্রত করেছিলেন, কেননা বিলটা তাঁকেই সই করতে হয়েছিল। নরেনের এক ভাই কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা, আরো কিছু আত্মীয়স্বজন সেখানে আছেন। সুতরাং তার কাছেও ভিড় কম হয়নি।
পুরস্কার-প্রদান অনুষ্ঠানটিকে উদযোক্তারা অভিহিত করেন সাহিত্য-সমাবেশ বলে। এটি গ্র্যান্ড হোটেলের বলরুমে অনুষ্ঠিত হয়। সেবারের অনুষ্ঠানটির তারিখ ছিল ৩০ এপ্রিল ১৯৯৪। প্রধান অতিথি শিবনারায়ণ রায়ের হাত থেকে আমরা পুরস্কার গ্রহণ করি। শংসাবচন পাঠ করেন সাগরময় ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ঐতিহ্যের অঙ্গীকারে পরিবেশিত ‘শ্রুতি সংস্কৃতির উপদেশনার জন্য আমাকে এবং সমগ্র প্রকল্পের নির্বাহী নায়ক’ হিসেবে বাংলাভাষী মানুষের হাতে এমন একটি ঐতিহ্যময়, অথচ আধুনিক সাংস্কৃতিক উপহার তুলে দেওয়ার জন্য নরেনকে সম্মানিত করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়।
অপরিসীম আনন্দের মধ্যেও আমার জন্যে দুঃখের বিষয় ছিল যে, অসুস্থতার কারণে গৌরকিশোর ঘোষ এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেননি। বস্তুতপক্ষে সেই যে তিনি অসুস্থ হলেন, ২০০০ সালে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আর সুস্থ হননি। তবে তারই মতো আরেকজন শুভাকাঙ্ক্ষী আমি পেয়ে যাই। তিনি নিখিল সরকার। আমার মনে হয়, নিখিল সরকারের দৌত্যেই বোধহয় ১৯৯৬ থেকে আমি আনন্দ পুরস্কারের বিচারকমণ্ডলীর একজন সদস্য নির্বাচিত হই।
বিচারকমণ্ডলীর প্রথম সভায় আমি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা উপন্যাসটি বিবেচনার জন্যে প্রস্তাব করি এবং সর্বসম্মতিক্রমে বইটিকে পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইলিয়াস তখন কলকাতার এক ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন। সে ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং দু-একদিনের মধ্যেই অস্ত্রোপচার করে তার একটি পা কেটে ফেলতে হবে। বিচারকমণ্ডলীর সভা থেকে বেরিয়েই আমি ক্লিনিকে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলি। পুরস্কারগ্রহণের বিষয়ে ইলিয়াস দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। পুরস্কারলাভের সংবাদে সে প্রীত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর পুরস্কারগ্রহণ তার বামপন্থী ভাবমূর্তির সঙ্গে আদৌ সংগতিপূর্ণ হবে কি না, এ-বিষয়ে সে চিন্তিত ছিল। আমি বলি, এই পুরস্কারের সঙ্গে কোনো রাজনীতি জড়িত নেই, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো রাজনীতিমনস্ক সাহিত্যিকও এই পুরস্কার গ্রহণ করেছেন, তাছাড়া তার চিকিৎসার ব্যয়নির্বাহে পুরস্কারের অর্থ কাজে আসবে, এটাও সে বিবেচনা করতে পারে। ইলিয়াস শেষ পর্যন্ত সম্মত হয়। প্রশ্নের মুখে পরে সে কোথাও বলেও ছিল যে, আমার অনুরোধেই সে এটি গ্রহণ করে। এই উত্তর পুরস্কারদাতাদের জন্যে আনন্দদায়ক ছিল না। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতার তৃণমূল পত্রিকায় ইলিয়াসের ডায়েরির যে অংশ ছাপা হয়, তাতেও এমন কথা আছে। পুরস্কারলাভের পর ইলিয়াস এক বছরও বাঁচেনি।
‘ঐতিহ্যের অঙ্গীকারে’র আরো কয়েকটি ক্যাসেট প্রকাশ করে নরেন। বিশ্বাসেরও মৃত্যু হয় ১৯৯৮ সালে। তার মৃত্যুকালে নাটকের দুটি ক্যাসেট প্রক্রিয়াধীন ছিল–সে দুটি প্রকাশ করা যায়নি। অবশ্য তার আগে থেকেই আমি তাকে বলছিলাম যে, আমাদের প্রকল্পের পূর্ণতি টানা দরকার, কেননা ভালো কিছুরও শেষ আছে। কাকতালীয়ভাবে নিখিল সরকারও তা মনে করেছিলেন।
পরে আনন্দ পুরস্কার তিনটি মিলে একটি হয়ে যায়। তার প্রথম প্রাপক ছিল তসলিমা নাসরিন। সেটি তার পক্ষে ছিল দ্বিতীয়বার আনন্দ পুরস্কার পাওয়া।
৩৯.
ঠাটারিবাজারে পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে ১৯৮০ সালে আমার ভাগে যে-টাকা পেয়েছিলাম, তা দিয়ে রামপুরায় জমি কিনে একটা ছোটো বাড়ি বানিয়ে দেন বড়ো দুলাভাই। সেখানে আমার তিন বোন এবং মামাতো ভাই ও ফুফাতো ভাই পরস্পরসংলগ্ন জমি কিনেছিলেন। ফুফাতো ভাই তাঁর অংশ বিক্রি করতে চাওয়ায় সেটি আমার জন্যে কেনা হয়। ওই বাড়িতে আমার সত্য ও সৎ বোনেরা এবং মায়ের পক্ষের ছেলে বাস করতো। পরে আমার এই ভাইবোনদের বিয়ে হয়ে গেলে আম্মা তার ছেলের সঙ্গে থাকবেন বলে স্থির হয়। বড়োবু বাড়িটা বিক্রি করার আয়োজন করে যাতে আমি অন্যত্র নিজের মতো মাথা গোঁজার ঠাই। করে নিতে পারি। আমার মামাতো ভাই তার জমি বিক্রি করে দেন। একই জনের কাছে বড়োবুর জমি ও আমার বাড়ি বিক্রি করা হয়।
এই অবস্থায় আমার ভাগ্নে তৌহিদ একদিন বেবীকে নিয়ে যায় বনানীতে একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির ফ্ল্যাট দেখাতে। বেবী ফ্ল্যাটটি ভালো বলায় তৌহিদ নিজে থেকে একটি চেক লিখে ফ্ল্যাটটি বেবীর নামে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। তখনো রামপুরার বাড়ি বিক্রি হয়নি। ফ্ল্যাটের কিস্তি দিতে আমাকে ধার করতে হয়। আমাকে প্রথম ধার দিয়েছিল আমার মামাতো বোন হালিমা, তারপর ভায়রা হাসান। তারপর অন্য বন্ধুবান্ধব। পরে সকলের টাকা পরিশোধ করেছিলাম একজনেরটা ছাড়া। সে টাকা ফেরত নেয়নি।
১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে রূপসা টাওয়ারের ফ্ল্যাটের দখল পাওয়া যায়। ফ্ল্যাটটি ভাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করে আমি নর্থ ক্যারোলাইনা চলে যাই।
নর্থ ক্যারোলাইনা থেকে আমার ফিরে আসার পর ছোটোমেয়ে শুচির বিয়ের তোড়জোড় লেগে গেল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটেই বাস করতেন আমার শিক্ষক শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পরিবার। এই পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান তাসনিম হায়দার চৌধুরী ওরফে সুমন কালক্রমে অর্থনীতিতে এম এ পাশ করে। তার সঙ্গে শুচির মেলামেশার একটা সহজ ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে ভাবির অর্থাৎ সুমনের মায়ের মৃত্যুর পরে ও-বাড়িতে শুচির যাতায়াত বেড়ে যায়। শুচি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিল লোকপ্রশাসনে প্রথমে অনার্স ও পরে এম এ ক্লাসে। একসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসস্থানে শহীদ পরিবারের থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সুমনেরা দু ভাই গুলশানে তাদের পৈতৃক বাড়িতে উঠে আসে। আমার পিতৃবন্ধু সৈয়দ আজিজুল হক ওরফে নান্না মিয়া ছিলেন ভাবির মামা অর্থাৎ সুমনের নানা। তাঁর স্ত্রী বেগম আফিফা হক একদিন ফোন করে আমার কাছে জানতে চান শুচির বিয়ের বিষয়ে কিছু ভাবছি। কি না। আমি তাকে বলি, শুচির এম এ পরীক্ষাটা হয়ে গেলে এ-বিষয়ে ভাবা যাবে। যথাসময়ে তিনি আবার আমাকে ফোন করেন এবং তাঁর বড়ো ছেলে সৈয়দ মঈনুল হককে পাঠান সুমনের সঙ্গে শুচির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। মঈনু আমার অনুজপ্রতিম। তার সঙ্গে বিয়ের আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা বলার জন্যে আমার চতুর্থ ভায়রা ফজলে রাব্বি মোহাম্মদ হাসানকে অনুরোধ করে আমি ঘর থেকে উঠে যেতে চাই। মঈনু বাধা দিয়ে বলে, আপনার উঠে যাওয়ার দরকার নেই, কেননা আম্মা বলেছেন, আপনার মেয়ে, আপনি যে-শর্ত চাইবেন, সেই শর্তেই তার বিয়ে হবে। আমি এমন উদারতা আর কখনো দেখিনি।
১৯৯৫ সালের ২৫ আগস্ট শুচির বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল। রুচির মতো শুচির বিয়ের আসরও নির্ধারিত হয় নিউ ইস্কাটন রোডের সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারে। এ-বিয়েতেও চট্টগ্রাম থেকে আমার অনেক সহকর্মী এবং এ এফ রহমান হলের চতুর্থ শ্রেণির কয়েকজন কর্মী যোগ দিতে এসেছিলেন। এবারে মোহাম্মদ আলী না-থাকায় রান্নাবান্না তত্ত্বাবধানের ভার পড়েছিল আমার ভায়রা হাসানের ওপর। আয়োজন ভালোই হয়েছিল, তবে যতজন অতিথি ছিলেন, ততজনের খাওয়ার জন্যে মাশুল দেওয়া হয়নি। ফলে মাশুল ও জরিমানা ধার্য হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জরিমানা দিতে হয়নি, অতিরিক্ত মাশুল দিয়েই পার পেয়েছিলাম। সেই সময়ে আমার হাত একেবারে খালি। এই টাকাটা আমাকে ধার করতে হয়েছিল ড. কামাল হোসেনের কাছ থেকে। তিনি অবশ্য পরে টাকা ফেরত নেননি আমার অনুরোধ সত্ত্বেও।
ছেলেমেয়ে নিয়ে রুচি অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরত এসেছিল ১৯৯৪ সালেই। রায়হান রয়ে গিয়েছিল, তবে শুচির বিয়ের ঠিক আগে আগেই সেও চলে আসে। উপস্থিতির দিক থেকে তাই পারিবারিকভাবে কোনো অপূর্ণতা থাকেনি।
৪০.
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দলের আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠেছে। একাদিক্রমে ৩৬ ঘণ্টা কী তারও বেশি সময় ধরে হরতাল চলছে–জনজীবন বিপর্যস্ত। সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা ফেব্রুয়ারি মাসে। জানুয়ারি মাসেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বিরোধী দলীয় প্রার্থীরা। মাঠে রয়েছেন বিএনপির মনোনীত প্রার্থী, বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী, গুরুত্বহীন রাজনৈতিক দলের কিছু প্রার্থী, কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। প্রধানমন্ত্রী যেখানে যাচ্ছেন, সেখানেই বিক্ষোভ হচ্ছে, পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘাত ঘটছে। এরই মধ্যে, ১ ফেব্রুয়ারি একুশের বইমেলা উদ্বোধন করতে খালেদা জিয়া বাংলা একাডেমিতে আসবেন বলে ঘোষিত হলো। বিশ্ববিদ্যালয়-এলাকায়। প্রধানমন্ত্রীর আগমনের প্রতিবাদে ছাত্রেরা প্রবল বিক্ষোভ করে। এতে সরকারের রোষ ধাবিত হয় মূলত জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্রদের প্রতি। ওই হলে প্রবেশ করে পুলিশ দরজা-জানালা-আসবাবপত্র ভাঙে, ছাত্রদের প্রহার করে, তাদের বইখাতা নষ্ট করে, অনেককে ধরে নিয়ে যায়। ঘটনার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকেই জগন্নাথ হলের অবস্থা নিজের চোখে দেখতে যাই। যা দেখি এবং ছাত্রদের মুখ থেকে যা শুনি তাতে আমরা প্রত্যেকেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে আসি। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে আমরা এই ঘটনার প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নিই। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে। মিছিল করে আমরা বাংলা একাডেমির দিকে যেতে চাই ১ ফেব্রুয়ারিতে। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছোতেই পুলিশ আমাদের গতিরোধ করে। আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানেই রাস্তার ওপরে বসে পড়ি। তাতে কোনো কাজ হয় না। আমরা বসে, পুলিশ দাঁড়িয়ে–এমন সহাবস্থান। অনেকক্ষণ চলে। শেষ পর্যন্ত আমরা রণে ভঙ্গ দিয়ে কলাভবনে ফিরে আসি। পরে আমরা নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করি বইমেলা-উপলক্ষে আয়োজিত সাহিত্যসভা বর্জন করে।
সরকার ও বিরোধী দলের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে বিদেশি কূটনীতিকেরা কিছু চেষ্টা করেন। কমনওয়েলথের পক্ষ থেকে বিশেষ প্রয়াস নেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদিও প্রকাশ্যে বলে যে এ-বিরোধের মীমাংসা করার দায়িত্ব তাদের নয়, তবু ভেতরে-ভেতরে তারাও চেষ্টা করে। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফখরুদ্দীন আহমদ ও সাংবাদিক ফয়েজ আহমদকে নিয়ে গঠিত পাঁচ-সদস্যের এক প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রীর কাছে কয়েকদফা দৌড়াদৌড়ি করে। কিছুতেই কোনো ফল হয় না।
১৫ ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল। সরকার গঠনের উদ্যোগ শুরু হলো। বিরোধী দল দিলো অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা। জনসাধারণ তাতেই সাড়া দিলো। সচিবালয়েও বিক্ষোভ, মিছিল। সচিবালয়ের সামনে তোপখানা রোডে জনতার মঞ্চ নির্মিত হলো। সচিবালয়ের কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে সরকারের প্রতি অনাস্থা জানালেন। কর্মকর্তা সমিতির এক প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও সরকার সম্পর্কে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করলো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, মন্ত্রীরাই আর সচিবালয়ে যেতে। পারেন না।
এই সময়ে বিদ্যমান অবস্থা সম্পর্কে কোনো এক সাংবাদিক আমার মন্তব্য চান। আমি বলি, এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়, তবে সংকট-উত্তরণের একটা সুযোগও এতে দেখা দিয়েছে। ষষ্ঠ সংসদ যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন পাশ করে, তাহলে সেই অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যায় এবং তার অধীনে নতুন করে সাধারণ নির্বাচন হতে পারে। সংবাদপত্রে আমার বক্তব্য তেমন গুরুত্বের সঙ্গে মুদ্রিত হয়নি, কিন্তু আতাউস সামাদ খুব গুরুত্বসহকারে তা। বিবিসিতে পাঠান এবং বিবিসির বাংলা সংবাদেও তা খুব প্রাধান্য লাভ করে। কেউ কেউ অবশ্য এতে খুব ক্ষুব্ধ হন। আওয়ামী লীগ নেতা সালাহউদ্দীন ইউসুফ পরে আমাকে বলেছিলেন, এভাবে ষষ্ঠ সংসদকে বৈধতা দান করায় আমার প্রতি তিনি এতই ক্রুদ্ধ হন যে, রিকশাভাড়া করে আমার বাড়িতে এসে তিনি ঝগড়া করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফোন করে তিনি যখন জানতে পারেন যে, আমি দেশে নেই, তখন আর ঝগড়ার সুযোগটা তিনি নিতে পারেননি। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে, তারা ক্ষমতায় এলে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাতিল করবেন এবং ষষ্ঠ সংসদের অস্তিত্ব অস্বীকার করবেন। সালাহউদ্দীন ইউসুফ পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হলে আমি তাকে এই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলি যে, এ-বিষয়ে তো তারা কিছুই করেননি। তিনি প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান।
আমাকে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করে দৈনিক আজকের কাগজ। সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমদ স্বনামে কলাম লিখে ষষ্ঠ সংসদকে বৈধতাদানে আমার কূটকৌশলের নিন্দা জ্ঞাপন করেন। কলামের প্রথমে আমাকে উল্লেখ করা হয় ড. আনিসুজ্জামান বলে, তারপরে আনিসুজ্জামান এবং শেষকালে তা আনিসে নেমে আসে।
আন্দোলনের মুখে ৩০ মার্চ খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগ করে। তাঁর পরামর্শ-অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন এবং ষষ্ঠ সংসদে পাশ করা আইন (সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী)-অনুযায়ী। দেশের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে আহ্বান জানান।
তার একদিন পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে ভোরের কাগজের সম্পাদক মতিউর রহমান আমাকে বলে যে, বিচারপতি হাবিবুর রহমান আমাকে খুঁজছেন–আমি যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমার টেলিফোন বিকল থাকায় বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে অভিনন্দনও জানাতে পারিনি। আমি সেদিনই তার মিন্টো রোডের বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করি। বস্তুত আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা দায়ের হওয়ার পরে তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আমি এড়িয়ে চলছিলাম। এবারে তাঁর কাছে যেতেই তিনি বললেন, ‘তোমরা সব এমন মামলাবাজ হয়েছ। যে আমি অসুবিধায় পড়ে গেছি। আমি বললাম, মামলা তো আমি করিনি, আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
কারা উপদেষ্টা হচ্ছেন, এ-নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার কোনো আলাপ হয়নি। বাজারে হবু উপদেষ্টা হিসেবে অনেকের নাম ছড়িয়েছিল। তার মধ্যে সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের নামও ছিল। এক সন্ধ্যায় ইশতিয়াকের বাড়িতে তিনি আর আমি টেলিভিশন সেটের সামনে বসে গল্প করে এবং খবর শুনে কাটালাম। তাতে কিছু জানা গেল না। পরদিন তাঁর এবং আরো নজন উপদেষ্টার শপথ গ্রহণের সচিত্র সংবাদ দেখলাম টেলিভিশনে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কখনো বিচারপতির আহ্বানে কখনো নিজে থেকে তাঁর বাড়িতে গেছি। একবার দল বেঁধে আমরা তিনজন গিয়েছিলাম–জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সৈয়দ আলী কবির ও আমি। নানা বিষয়ে কথা বলেছি। নিজের জ্ঞানমতো সীমা মেনে চলেছি। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তো অতি বিবেচক মানুষ। এরপরও কোনো একটি দৈনিক পত্রিকায় বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে কটাক্ষ করে সম্পাদকীয় স্তম্ভে লেখা হয়েছিল, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও আনিসুজ্জামান যাঁর বন্ধু, তাঁর কাছ থেকে আর অধিক কী আশা করা যেতে পারে!
বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের সবচেয়ে উদ্বেগের ঘটনাটি ঘটে মে মাসের ২০ তারিখে। রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করলে নাসিম তা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। ঢাকার বাইরের তিন সেনা-অধিনায়ক তার পক্ষে সৈন্য নিয়ে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসেন। তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আরেক সেনা-অধিনায়ক ঢাকার উপকণ্ঠে এসব সেনাদলের গতিরোধ করার প্রস্তুতি নেন। এই শেষোক্ত সেনা-অধিনায়কের সৈন্যেরা ঢাকায় বেতার ও টেলিভিশন ভবন ঘিরে রাখে এবং কোথাও কোথাও দায়িত্বরত অসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। নাসিম ছাড়া আরও দুজন সেনা-কর্মকর্তাকে অবসর দেওয়া হয়েছিল। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে সেনাবাহিনীতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত এক ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা সেনাবাহিনীকে লক্ষ। করে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, তাঁরা মুখোমুখি কোনো রেষারেষির সঙ্গে জড়িয়ে পড়বেন না, যেন বড় দুঃখী এই বাংলাদেশের মাটি ভাইয়ের রক্তে কলঙ্কিত না হয়।’
সারাদিনের উত্তেজিত পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। সন্ধ্যাবেলায় ঢাকা ক্লাবে গিয়ে এ-সম্পর্কে শুনতে পাই। সেখানেই টেলিভিশনে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ শুনি। বিপদের আশঙ্কায় মন ভরে ওঠে। ক্লাব থেকে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসি। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ফোনে খবরাখবর বিনিময় করি। দু একদিনের মধ্যেই অবশ্য পরিস্থিতি শান্ত হয়ে থাকে। জেনারেল নাসিম কম্যান্ড ছেড়ে দিতে সম্মত হন। তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়। জেনারেল মাহবুবুর রহমান নতুন সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এই ঘটনা নিয়ে দশগুণ বলার দায়িত্ব নেয় যায়যায়দিন। পত্রিকাটি নানারকম তথ্য প্রকাশ করে–সবই তাদের আবিষ্কার। এর আগে পত্রিকাটি প্রধান উপদেষ্টার ডায়েরির অংশ বলে কিছু একটা মুদ্রণ করেছিল। তাতে কী ছিল, তা আমার জানা নেই, তবে সরকারিভাবে বলা হয়েছিল যে, ওটি প্রধান উপদেষ্টার ডায়েরি নয়। এবারে তারা কোনো কোনো সামরিক কর্মকর্তার টেলিফোন সংলাপ এবং আরও কিছু কিছু দলিল প্রকাশ করে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলো। যে, সমস্ত ব্যাপারটি ছিল আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের ফল–সেনা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় আসার ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র। পত্রিকায় এসব তথ্যপ্রকাশে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়, তবে পরে এর সত্যতায় সন্দেহ ঘনীভূত হয়। যাহোক, পরবর্তীকালে গৃহবন্দিদশা থেকে নাসিমকে মুক্তি দেওয়া হয়, সেই সঙ্গে আরও কয়েকজন সেনা-কর্মকর্তা মুক্ত হন। অবশ্য এসবই ঘটে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরে।
১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এই সংসদ ষষ্ঠ না সপ্তম, তা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করলেন না, আগের সংসদকে অবৈধ ঘোষণা করলেন না, তাদের তৈরি আইন মেনে নিতেও কুণ্ঠাবোধ করলেন না। আমি ভোট দিয়ে চলে যাই কুমিল্লায়–পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর নিভৃতে নিজের কাজ করতে। সেখানে বসেই টেলিভিশনে নির্বাচনের ফলাফল জানতে পারি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কোথাও কোথাও অনিয়ম হয়েছে বলে আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে, বিএনপি দাবি করে যে প্রায় এক শ আসনে কারচুপি হয়েছে, বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা বলেন যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।
বিএনপি বোরকম প্রতিবাদের পরিকল্পনা করেছিল–পরবর্তীকালে আমাকে তা জানিয়েছিলেন একজন হাই কমিশনার ও একজন অ্যামবাসাডর। তাঁদের দুজনের ভাষ্য ছিল হুবহু এক। আমার কাছে আষাঢ়ে গল্প ফাঁদার কোনো কারণ তাদের ছিল না। তারা বলেন যে, তাঁরা খবর পেয়েছিলেন, ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়া নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করতে যাচ্ছেন। তার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশে, বিশেষ করে রাজধানীতে, ব্যাপক গোলযোগের সৃষ্টি হবে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি কোনো চরম ব্যবস্থা নিয়ে ফেলবেন। এই খবর জানার পরে ব্রিটিশ হাই কমিশনারের অফিসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জাপানের রাষ্ট্রদূত এবং কানাডার হাই কমিশনার মিলিত হন। এবং পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বেগম জিয়াকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করতে সিদ্ধান্ত নেন। ব্রিটিশ হাই কমিশনারের দপ্তর থেকে ফোনে বেগম জিয়ার সঙ্গে ওই পাঁচজন দেখা করবেন বলে সময় চাওয়া হয়, কিন্তু তাদের বলা হয় যে, তিনি ব্যস্ত আছেন, পরদিন রাতে ছাড়া দেখা করতে পারবেন না। পরদিন বিকেলেই ছিল পরিকল্পিত সংবাদ-সম্মেলনের সময়। উপায়ান্তরবিহীন হয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জানান যে, তিনি তখনই মার্কিন প্রেসিডেন্টের একটি জরুরি বার্তা বেগম জিয়াকে পৌঁছাতে চান এবং তাঁর সঙ্গে দুজন রাষ্ট্রদূত ও দুজন হাই কমিশনার থাকবেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের সময় দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ে ওঁরা পাঁচজন খালেদা জিয়ার সামনে উপস্থিত হলে তিনি বিরক্ত হয়ে বাংলায় বলেন, এরা কেন এসেছে? এরা কিছু জানে না, বোঝে না, শুধু শুধু মাতব্বরি করতে চায়। বেগম জিয়ার দোভাষী ইংরেজিতে বলেন, আপনারা আসায় ম্যাডাম অত্যন্ত খুশি হয়েছেন এবং তিনি আপনাদের আন্তরিক স্বাগত জানাচ্ছেন। জাপানি রাষ্ট্রদূত বাংলা জানতেন, ফরাসি রাষ্ট্রদূত জানতেন জাপানি। ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে জাপানি রাষ্ট্রদূত খালেদা জিয়ার মন্তব্য তখনই জাপানিতে অনুবাদ করে শোনান। অনেকক্ষণ ধরে এই পাঁচজন কূটনীতিক বেগম জিয়াকে নির্বাচনের ফলাফল
মেনে নিতে অনুরোধ করেন, নইলে বাংলাদেশ নতুন করে সংকটে পড়বে বলেও তাঁরা সতর্ক করে দেন। বেগম জিয়া তাদের কথায় আনুষ্ঠানিক সম্মতি না জানালেও একসময়ে তারা উপলব্ধি করেন যে, তিনি নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করবেন না। তারা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে আসেন।
৪১.
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার জুন মাসের শেষে–সম্ভবত তাদের শেষ কার্যদিবসে–জাহানারা ইমাম ও অপর ২৩ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। সংবাদপত্রে পড়ার আগে এ বিষয়ে আমি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি। ফৌজদারি অভিযোগ মাথায় নিয়ে চলা যে কী দায়, ততদিনে তা বেশ বুঝতে পেরেছি। সুতরাং প্রধান উপদেষ্টার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা বোধ করেছি। সঙ্গে সঙ্গে জেনে গেছি, সকলে এটা ভালোভাবে নেয়নি; কেউ কেউ মনে করেছেন, এতে তার ব্যক্তিগত কিংবা রাজনৈতিক পক্ষপাত প্রকাশ পেয়েছে, হয়তো বা দুইই।
আপাতত আমি আছি হৃষ্টচিত্তে। সেই প্রফুল্লতা নিয়েই আগস্টের গোড়ার দিকে জার্মানি রওনা হলাম। বার্লিনে আয়োজিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে দুদিনের আলোচনা-সভা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাচ্ছেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য দিলীপকুমার সিংহ, বিশ্বভারতীর দুই প্রাক্তন উপাচার্য নিমাইসাধন বসু ও অম্লান দত্ত এবং বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্রদের শিরোমণি অমিতাভ চৌধুরী। ঢাকা থেকে নিমন্ত্রিত সজীদা খাতুন ও আমি। যাত্রাপথ সরল নয়। আমাদের দুজনকে যেতে হবে ঢাকা থেকে কলকাতা, তারপর বাকি চারজনের সঙ্গে সেখান থেকে এরোফ্লোতে দিল্লি ও মস্কো হয়ে বার্লিন। এরোফ্লোতের কলকাতা-দিল্লি ফ্লাইট। বেশ বাজে। উড়োজাহাজে কিছুই পাওয়া যায় না, সৌজন্যও নয়। দিল্লি বিমানবন্দরে নিজের পয়সায় তৃষ্ণা নিবারণ করা গেল। দিল্লি-মস্কো-বার্লিন ফ্লাইট বরঞ্চ সহনীয়।
বার্লিনে মামুন নামে এক বাংলাদেশি তরুণের বাড়িতে সন্জীদা খাতুন ও আমার থাকার ব্যবস্থা। তার স্ত্রী বা বান্ধবী এলিজাবেথ জার্মান। ভদ্রমহিলা কিঞ্চিৎ বয়স্কা, পূর্ববিবাহের সূত্রে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়গামী এক কন্যা আছে–মেয়েটির ঝোঁক যন্ত্রসংগীতে, পরে তার সঙ্গেও একদিন দেখা হয়েছিল। গৃহকত্রী ইংরেজি খুব সামান্য জানেন, সবার সামনে তা বলতে সংকোচ বোধ করেন, তবে সর্বদা হাসিমুখ এবং আমাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়ে তীক্ষ্ণ নজর রাখেন। মামুন বেশ কিছুকাল এদেশে আছে, চাকরি করে লুটহাসায়, প্রয়োজনের অধিক সমাদর করে। মামুনরা থাকতো পূর্বতন পূর্ব বার্লিনে–পশ্চিমের চেয়ে তা খানিকটা মলিন, ভাঙা জার্মানি জোড়া লাগার পাঁচ ছ বছর পরেও সে-পার্থক্যের চিহ্ন সুস্পষ্ট।
আমরা পৌঁছবার খানিক পরে মামুন জানালো, তসলিমা নাসরিন আমার। খোঁজে ফোন করেছিল, আমি এসে তার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলি–এই। অনুরোধ জানিয়ে রেখেছে। এটা খানিকটা প্রত্যাশিত ছিল। তসলিমার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও ভালোই পরিচয় ছিল। পরিচয় হয়েছিল শামসুর রাহমানের মারফত, সাগর পাবলিশার্সে। আমার বাড়িতে ৩১ জন নাগরিকের সভা শেষ করে শামসুর রাহমানের প্রয়োজনে সেখানে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম। তসলিমা তখন শান্তিনগর বাজারের কাছে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের একটি ফ্ল্যাটে থাকে। সে খুব চাইছিল শামসুর রাহমানকে সেখানে নিয়ে যেতে। শামসুর রাহমান সেই সন্ধ্যায় তার বাড়ি যেতে চাইছিলেন না, কিছুটা হয়তো আমি তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে। পরে তসলিমার সঙ্গে আমার অনেকবার যোগাযোগ হয়েছে। আমার এক বন্ধু-দম্পতি তার সঙ্গে আলাপ করতে খুব আগ্রহী ছিল। আমার অনুরোধে তসলিমা তাদের আতিথ্যগ্রহণে সম্মত হয়, আমিই তার ফ্ল্যাট থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাই এবং ফিরিয়ে আনি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়-আবাসে সে কয়েকবার এসেছে, একাধিকবার সবান্ধব। পরে একবার কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রসঙ্গত বলেছিলাম, আমি তসলিমার কবিতা ও কলামের গুণগ্রাহী, তবে তার উপন্যাসের নই। ঢাকায় ফিরে আসতে-না-আসতে তসলিমার ফোন পেলাম–তার উপন্যাস কেন ভালো লাগে না তার কারণ দর্শাতে। ধর্মান্ধ ব্যক্তির দল যখন তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে, তখন অনেকের সঙ্গে আমিও তার লেখার ও ভাবপ্রকাশের অধিকারের সমর্থনে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছি।
বার্লিনে তসলিমাকে ফোন করায় সে জানতে চাইলে তার বিরুদ্ধে মামলা সম্পর্কে কোনো খবর আছে কি না। আমি বললাম, শামসুর রাহমান তাকে জানাতে বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তসলিমার মামলা নিয়ে শামসুর রাহমান নিজেই কথা বলেছেন। শেখ হাসিনা তাঁকে বলেছেন, তসলিমা দেশে ফিরে মামলার মুখোমুখি হোক। সরকার তেমন জোরের সঙ্গে মামলা লড়বে না, ফলে তসলিমা ছাড়া পেয়ে যাবে। তবে সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক কারণেই তসলিমার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করা সম্ভবপর নয়।
আমার কথা শুনে তসলিমা বেশ বিমর্ষ হলো। সে আশা করেছিল, সরকার মামলা তুলে নেবে–এমন একটা প্রতিশ্রুতির খবর আমি তাকে দেবো। সে বললো, মামলা মাথায় নিয়ে সে দেশে ফিরবে না, ফিরলে যে-কোনো সময়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। যে-সরকার রাজনৈতিক কারণে মামলা তুলতে সাহস করে না, রাজনৈতিক কারণেই হয়তো সে-সরকার মত বদলে তার বিরুদ্ধে শক্ত ভূমিকা নিতে পারে। আমি বললাম, সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে, তবে সরকারের বৈরিতার কোনো কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি না। সে বললো, সরকারের ওপর সে ভরসা রাখতে পারছে না। সুতরাং সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত সে দেশে ফিরবে না।
তসলিমাকে আমি আর কী বলতে পারি! জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার সঙ্গে কি দেখা হবে? সে বললো, ‘বোধহয় না।’ আমি তার কাছ থেকে টেলিফোনেই বিদায় নিলাম।
একদিন পর তসলিমা আবার ফোন করলো। বললো, অম্লান দত্ত তার বাড়ি যাচ্ছেন। আমি যদি একই সময়ে সেখানে যাই, সে খুশি হবে। আগের বারের কথোপকথনের শেষটা আমার মনে পড়ল। বললাম, আমি পেরে উঠব না।
বার্লিনে আর যাদের সঙ্গে পরিচয় হলো, তাঁদের মধ্যে সুনীল দাশগুপ্তের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। তখনই তাঁর বয়স হয়েছে। তিনি ভারতীয় নাগরিক, বিয়ে করেছেন জার্মান, কিন্তু জন্মভূমি বরিশালকে ভোলেননি। সেই সূত্রে বাংলাদেশের সকলের সঙ্গে তাঁর বেজায় ভাব। দীর্ঘকাল কমিউনিস্ট রাজনীতি করেছেন, এখন আর রাজনীতিতে নেই। সৈয়দ মুজতবা আলীর চাচাকাহিনীর মূল চরিত্র, শুনেছি, তাঁরই পিতৃব্যের আদলে আঁকা। সুনীলদার স্ত্রী বারবারা ভালো বাংলা বলেন, বাংলা সাহিত্যের অনুবাদও করেছেন জার্মান ভাষায়।
শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের স্ত্রী উটাও জার্মান–তাদের দুটি সন্তান। ওয়াকিল স্বল্পভাষী, কিছুটা লাজুক প্রকৃতির, তবে খুবই সহৃদয় মানুষ।
আমাদের সফরসঙ্গীদের মধ্যে অম্লান দত্তের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘকালের। তিনি যেমন পণ্ডিত, তেমনি সজ্জন। নিমাইসাধন বসুর সঙ্গে আগে ঢাকায় পরিচয় হয়েছিল, দেখলাম তিনি তা ভোলেননি। দিলীপকুমার সিংহ গণিতের অধ্যাপক, কথা কম বলেন, রবীন্দ্রসংগীত গান বেশি। অবাক হয়ে লক্ষ করি শান্তিনিকেতনের সঙ্গে দীর্ঘকাল সংসবের পরেও অমিতাভ চৌধুরীর কথায় সিলেটি টান রয়ে গেছে। তিনি জানতে চান, আমি মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে চিনতাম কি না। বললাম, জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি তার ছাত্র ছিলাম, উপরন্তু তার বড়ো ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আমার ছোটো মেয়ের। অমিতাভ চৌধুরী এক ঝটকায় আপনি থেকে তুমিতে চলে এলেন, তাহলে তো তুমি আমার বেয়াই। অনতিবিলম্ব দিলীপ সিংহকে আক্রমণ : ‘দিলীপ, তুমি আমার বেয়াইকে বিশ্বভারতীতে নিয়ে আসছ না কেন?’ দিলীপ সিংহ হতভম্ব, কে যে অমিতাভ চৌধুরীর বেয়াই, তা তিনি ঠাহর করে উঠতে পারেন না। পরদিন আবার দিলীপ সিংহের প্রতি অমিতাভ চৌধুরী : ‘এই যে দিলীপ, আমার বেয়াইকে বিশ্বভারতীতে আনছ কবে?’ নিরুপায় উপাচার্য আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয় আনবো। আপনি অনুগ্রহ করে আপনার একটা সিভি আমাকে পাঠিয়ে দেবেন?’ আমি বলি, ‘অবশ্যই’, যদিও জানি পাঠাবো না, কেননা এমন কথার ভিত্তিতে কোনো উপাচার্যকে জীবনবৃত্তান্ত পাঠানো তাঁকে বিব্রত করা এবং নিজে বিব্রত হওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
আলোচনা-সভা ভালোই হলো। আলোচনার মাধ্যম ইংরেজি। নারীপুরুষ মিলে আট-দশজন জার্মান বিদ্বান রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখে এনেছেন। নিমাইসাধন বসু, দিলীপ সিংহ, সজীদা খাতুন ও আমিও লিখিত বক্তব্য নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার প্রবন্ধটি সদ্য লেখা–’টেগোর অ্যান্ড দি ওয়েস্ট’। মনে হলো, একেবারে মন্দ হয়নি। কোনো এক জার্মান অংশগ্রহণকারীর বক্তব্যের খানিক বিরূপ সমালোচনা করেছিলাম আমি। আরেক জার্মান বিদ্বান পরে। আমাকে বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন, তবে অতটা মোলায়েম করে না। বললেও পারতেন। জার্মানির একত্রীকরণের এই ফল হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য লোকও বিশ্ববিদ্যালয়ে উঁচু পদ পেয়ে যাচ্ছে যোগ্যকে বঞ্চিত করে। দুই জার্মানি এক হয়েছে বটে, তবে ক্ষমতাসীনরা লক্ষ রাখছেন যাতে পূর্ব জার্মানির লোকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল না করতে পারে। যিনি এ-কথা বললেন, তিনি পূর্ব জার্মানির এবং কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের, এটুকু নিঃসন্দেহে বোঝা গেল।
আমার ছাত্র এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মী আবদুল্লাহ আল ফারুক জার্মান বেতার ডয়েশভেলের বাংলা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। সে প্রথম থেকেই কোলনে যাওয়ার তাগাদা দিচ্ছে। যাবো বলে কথা দিলাম, কিন্তু তার আগে আমাদের একটা সমস্যাপূরণের প্রয়োজন ছিল।
আমরা যেভাবে এসেছি, ফিরতেও হবে ওভাবে। কিন্তু ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনে দু-পথের ট্রানজিট ভিসার আবেদন করেও পেয়েছি এক পথের ভিসা, অথচ এর আগে অনেকবার দু-পথের ট্রানজিট ভিসা লাভ করেছিলাম। ভারতীয় হাই কমিশনে যখন জিজ্ঞাসা করলাম, ভিসা নিয়ে বার্লিন পৌঁছাবো ঠিকই, কিন্তু ফিরব কেমন করে, তারা বললেন, বার্লিনে ভারতীয় দূতাবাসে আবেদন করলে ফিরতি ট্রানজিট ভিসা পাওয়া যাবে। সৰ্জীদা খাতুন ও আমি বার্লিনে ভারতীয় দূতাবাসের অফিসে গিয়ে আবেদন করলাম। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জাবেদ আশরাফ দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব। তিনি বারবার জানতে চাইলেন, কেন আমাদের দু পথের ট্রানজিট ভিসা দেওয়া হলো না? সদুত্তর দিতে পারলাম না, তারপরও ভিসা পাওয়া গেল। তবে দুদিন দুবেলা সময় নষ্ট হলো তার পেছনে ছুটে। আমি পরিকল্পনা করলাম লন্ডন যাওয়ার। বার্লিনে এরোফ্লোত অফিসে গিয়ে সামান্য চেষ্টায় বার্লিন-কলকাতার টিকিটটা লন্ডন-কলকাতার টিকিটে রূপান্তর করা গেল। অতঃপর ট্রেনে করে কোলন-যাত্রা। এলিজাবেথ ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে ফারুককে ফোনে জানিয়ে দিলেন আমি কখন পৌঁছাবো। ফারুক স্টেশনে যথাসময়ে উপস্থিত থেকে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো এবং তার বাড়ি নিয়ে গেল। তার স্ত্রী মালা হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শিক্ষকতার কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত। বিনয়ী, স্বল্পভাষী, অতিথিপরায়ণ।
পরের দিন ডয়েশভেলে গিয়ে একটা সাক্ষাৎকার রেকর্ড করলাম। তারপর ফারুকের অফিসে বসে আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময়ে নাজমুননেসা ওরফে পিয়ারী সে-ঘরে ঢুকতে গিয়ে আমাকে দেখে দোরগোড়াতেই চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে গেল। পিয়ারী এককালে আমার ভাগ্নে মামুনের বন্ধুবৃত্তে ছিল, তখন সে আমাকে মামা বলতো। শহীদ কাদরীর সঙ্গে বিয়ের পরে আমি ভাই হয়ে যাই এবং সেই সম্বোধন এখনো অটুট আছে। পিয়ারী আমার আসার খবর একেবারেই জানতো না, ফলে তার বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। ওদের অফিস থেকে বেরিয়ে পথে-পথে সে ও আমি অনেক হাঁটলাম, অনেক গল্প করলাম, হাতে যে আরো সময় নেই সেজন্য দুঃখ করলাম। তারপর যখন আর না-ফিরলেই-নয়, তখন ফিরে এলাম। বেতারভবনে।
পরদিন আমি বন থেকে ট্রেনে যাত্রা করলাম লন্ডনের পথে। খুবই আরামদায়ক ভ্রমণ। তার ওপর, ট্রেনটা যাবে ইংলিশ চ্যানেলের নিচ দিয়ে। সেটা চাঞ্চল্যকর। বস্তুত চ্যানেল-টানেল আসার আগে ট্রেনের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে জানান দেওয়া হয়, কিছু কিছু পালনীয় নির্দেশ থাকে। যাত্রাটা আমার খুব ভালো লেগেছিল।
সেই ভালো-লাগা কিছুটা ম্লান হয়ে গেল লন্ডনের ওয়াটারলু রেলওয়ে স্টেশনে শুল্ক-সংগ্রাহকদের বাড়াবাড়িতে। মনে হয়, র্যানডম স্যাম্পলিংয়ের শিকার হয়েছিলাম আমি। সুতরাং আমার স্যুটকেস খুলতে হলো। ওয়াকিলুর রহমান আর্ট গ্যালারি দেখাতে নিয়ে গিয়ে ছবির একটা প্রিন্ট কিনে আমাকে উপহার দিয়েছিল। সেটি ছিল একটা পিজবোর্ডের চোঙার মধ্যে, ফলে তা। সন্দেহের উদ্রেক করে। সন্দেহভঞ্জন হলো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু কাস্টমসের তরুণী বেশ একটা উচ্চমন্যতার সঙ্গে যখন জিজ্ঞাসা করলো আগে কখনো লন্ডনে এসেছি কি না, তখন যথেষ্ট খারাপ বোধ করলাম। রূঢ়ভাবে বললাম, ‘বহুবার। এবারে প্রশ্ন, কবে?’ বললাম, ‘প্রথম এসেছিলাম তোমার জন্মের আগে–তারপর আরো অনেকবার এসেছি। দেখলাম, রূঢ়তায় ফল ফলে।
লন্ডনে সেবার কী করেছিলাম, তা আর এখন মনে পড়ে না। আমার সেই তালিকাগ্রন্থটি প্রকাশিত হবে কি না তার খোঁজ নিতে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম। গ্রাহাম শ এখন বিভাগীয় কর্তা। তিনি মুখে বলছেন হবে, কিন্তু তার শরীরের ভাষা সেটা সমর্থন করছে বলে মনে হলো না।
এরোফ্লোতের লন্ডন-মস্কো ফ্লাইট বেশ ভালো। আমার পাশে মস্কোযাত্রী যে রুশ তরুণী বসেছিল, সেও বেশ বন্ধুভাবাপন্ন। মস্কো-দিল্লি অংশের ফ্লাইট সহনীয়। দিল্লি-কলকাতা আবার বেশ খারাপ।
৪২.
সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি-পদে মনোনয়ন দিলো বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে। তাঁর মতো একজন নির্দলীয় ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার এ-সিদ্ধান্ত বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়। অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
তার আগেই, ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে সৃজনশীলতা, গতিময়তা, জবাবদিহিতা ও শৃঙ্খলা আনয়ন এবং এ দুটি প্রতিষ্ঠানের অধিকতর স্বায়ত্তশাসন প্রদানের নীতিমালা সংক্রান্ত বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সরকার একটি কমিশন গঠন করে। অবসরপ্রাপ্ত সচিব, সংগীতশিল্পী ও ক্রীড়াবিদ মোহাম্মদ আসাফউদ্দৌলাহ এই কমিশনের চেয়ারম্যান এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (জালালউদ্দিন আহামেদ) তার সদস্য-সচিব নিযুক্ত হন। এর সদস্য নিযুক্ত হন ড, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ড. আ আ স ম আরেফিন সিদ্দিক, ড. আনিসুজ্জামান, আসাদুজ্জামান নূর, সৈয়দ হাসান ইমাম, জামালউদ্দীন হোসেন, কে জি মুস্তাফা, কলিম শরাফী, রামেন্দু মজুমদার এবং পদাধিকারবলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (ম. নজরুল ইসলাম সিদ্দিকী, পরে শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল), বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক (শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল, পরে সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী), বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক (এম আই চৌধুরী), অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের যুগ্ম-সচিব (এম নূরুন নবী) ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (আবদুল মতিন খান)।
কমিশনের চেয়ারম্যান আসাফউদ্দৌলাহ্ আওয়ামী লীগের না হলেও শেখ হাসিনার কাছের মানুষ ছিলেন। তাঁদের দুই পরিবারের মধ্যে বিলক্ষণ সৌহার্দ্য ছিল। আসাউদ্দৌলার বোন মরিয়ম বেগম আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভ করে সদ্য সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন মহিলাদের সংরক্ষিত আসনে। তা সত্ত্বেও আসাউদ্দৌলাহ্ গোড়া থেকেই কমিশনকে সরকারি আওতার বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তার ধারণা ছিল–এবং আমরাও তাঁর সঙ্গে একমত ছিলাম যে–স্বাধীনভাবে চলতে হলে কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা থাকতে হবে। তিনি এককভাবে ইউএনডিপির সঙ্গে কথা বলে কমিশনের কাজের জন্যে প্রায় ৮০ লাখ টাকার অনুদান সংগ্রহ করেন। অনুদানটি অবশ্য দেওয়া হয় তথ্য মন্ত্রণালয়কে, তবে স্পষ্টই নির্ধারণ করে দেওয়া হয় যে, এই অর্থ ব্যয়িত হবে বেতার-টেলিভিশন স্বায়ত্তশাসন কমিশনের কাজে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। কমিশন যে তথ্য মন্ত্রণালয়ের মুখাপেক্ষী হয়ে রইল না, এতে বোধহয় তিনি খুশি হননি। শুরুতেই কমিশনের সঙ্গে–আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাঁর সংঘাত লেগে গেল। তিনি চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ সচিবালয়ে, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে, কমিশনের উদৃবোধন হোক এবং সেই উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান বেতার টেলিভিশনে প্রচারিত হোক–তাতে হয়তো সরকারের সুনাম হবে। আমরা হোটেল পূর্বাণীর একটি কক্ষে আমাদের প্রথম অধিবেশনের আয়োজন করলাম এবং উদ্বোধনের কোনো আনুষ্ঠানিকতা রাখলাম না। পরবর্তী অধিবেশনগুলোও সেখানেই হলো। এর জন্যে অল্পস্বল্প যে-ব্যয় হয়, তা বহনের সামর্থ্য তো আমাদের হয়েই গিয়েছিল। মোটকথা, তথ্য মন্ত্রণালয়ের বলয়ের বাইরে থেকে আমরা কাজ করতে মনস্থ করলাম। প্রতিমন্ত্রী তা পছন্দ করেছিলেন বলে মনে হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার দপ্তরে কমিশনের আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হয় অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে। তার সঙ্গে কথা বলে আমাদের মনে হয়েছিল, সে বাস্তবিকই বেতার-টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন চায়। হাসিনা বারবারই বলছিল যে, স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টা তার দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অন্তর্গত। সে প্রতিশ্রুতিপালনে সে আমাদের সহায়তা চায়। তবে কমিশনের বৈঠকে স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে ইতিমধ্যে আমরা যে-ধারণা করেছি, তার সঙ্গে তার ধারণার পার্থক্য আছে, একথাও আমাদের মনে হয়েছিল। অবশ্য সে-ব্যবধান দুরতিক্রম্য বলে মনে হয়নি।
কমিশনে একপর্যায়ে কথা উঠলো, অন্য কোথাও প্রচারমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসন কীভাবে কার্যকর হয়েছে, সেটা একবার সরেজমিনে দেখতে পারলে ভালো হয়। এ-প্রসঙ্গে বিবিসির নাম যে উঠবে, তা খুব স্বাভাবিক। ভারত পাকিস্তানের কথা উঠলো এবং ফিলিপাইনসের কথাও উঠলো। এসব দেশে বেতার-টেলিভিশন কিছুকাল আগেও সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে ছিল, এখন তারা স্বাধীনতা ভোগ করছে। স্থির হলো, আমাদের এক দল যাবে ইংল্যান্ডে, এক দল ভারত-পাকিস্তানে এবং আরেক দল ফিলিপাইনসে।
ইংল্যান্ডে গেলেন আসাফউদ্দৌলাহ, কলিম শরাফী, এম আই চৌধুরী, নূরুন নবী ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব আঞ্জু মনোয়ারা–কমিশনের কাজে সহায়তা করার দায়িত্ব তাঁকে অর্পণ করা হয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তানে গেলেন আসাফউদ্দৌলাহ্, কে জি মুস্তাফা, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার নওয়াজেশ আলী খান। ফিলিপাইনসে গেলাম তথ্যসচিব কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, আরেফিন সিদ্দিক, সৈয়দ হাসান ইমাম, জামালউদ্দীন হোসেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব এম এ কাদের, ঢাকা বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক টি এইচ শিকদার ও আমি।
আমাদের এই বিদেশ-সফর নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছিল, এখনো হয়। সমালোচনার যে কিছু ছিল না, তা নয়। তবে গরিব করদাতাদের পয়সায় আমরা বিলাস-ভ্রমণ করে এসেছি, এমন মন্তব্য তথ্যনিষ্ঠ নয়। ইউএনডিপি আমাদের খরচ জোগায়, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আমাদের জন্যে কোনো ব্যয় হয়নি। আমাদের অনুদান দেওয়ায় ইউএনডিপি যে রাষ্ট্রকে কিছু কম দিয়েছে, তাও নয়।
১৯৯৭ সালের ১ জুন আমরা ঢাকা থেকে ব্যাংকক গেলাম। থাই এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনায় সেখানে রাতটা হোটেলে কাটিয়ে পরদিন ম্যানিলা পৌঁছলাম। ব্যাংককের হোটেলটি খারাপ ছিল না, তবে ঘর পেতে একটু দেরি হয়েছিল, এই যা।
ম্যানিলা বিমানবন্দরে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের দূতাবাসের দুজন কর্মকর্তা। তারা আমাদের নিয়ে গেলেন একটা মাঝারি ধরনের হোটেলে, মনে হলো শহরের একপ্রান্তে। হোটেলটা তারাই বাছাই করেছেন, সম্ভবত আমাদের দৈনিক ভাতার আনুপাতিক হিসেবে। ম্যানিলায় আমি আগেও এসেছি, সুতরাং নূতনত্বের কোনো আকর্ষণ ছিল না। তবে ফিলিপাইনস সরকারের অকৃপণ আতিথ্য আমরা সর্বক্ষণ উপভোগ করেছি। পথপ্রদর্শক ও দোভাষী, যানবাহন ও প্রহরার যে-আয়োজন তারা করেছিল, তাতে নিজেদের রাষ্ট্রীয় অতিথি বলেই মনে হয়েছিল। আমাদের সম্মানে ফিলিপাইনসের তথ্য মন্ত্রণালয় যে-ভোজ দিয়েছিল, তাতে প্রেসিডেন্ট রামোস যোগ দিয়েছিলেন। এই বিরল। সম্মানলাভের একটা কারণ বোধহয় এই ছিল যে, অল্পকাল আগে প্রেসিডেন্ট রামোস বাংলাদেশ সফর করে খুশি হয়ে ফিরেছিলেন।
চারদিনে ম্যানিলায় যা দেখার, তা দেখলাম। যা দেখার নয়, তাও দেখলাম। এক সরকারি দপ্তরের এক কক্ষে দেখি ফিল্মের ক্যাসেট বোঝাই করা। আমাদের কৌতূহলী দৃষ্টি লক্ষ করে এক সামরিক কর্মকর্তা বললেন, এগুলো বাজেয়াপ্ত করা পর্নো ছবি। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আমাদের সেনারা যেখানে যুদ্ধ করছে সেখানে পাঠাই তাদের বিনোদনের জন্যে। তোমাদের চাই নাকি?
৭ তারিখে ম্যানিলা থেকে ব্যাংকক। হোটেলে এক রাত কাটিয়ে পরদিন ঢাকা।
তারপর কমিশনে বসে অভিজ্ঞতা-বিনিময়, নানারকম কথা, রিপোর্ট লেখা। রিপোর্ট মাজাঘষা করতে কয়েকজন এক সন্ধ্যায় আমার বাসায়ও বসলাম। রিপোর্ট ছাপা হলো। নির্ধারিত দিনে সেটা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিতে আমরা তার দপ্তরে গেলাম।
বসে আছি, বসে আছি। প্রধানমন্ত্রী আর আসে না। শুনতে পেলাম, তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক চলছে। অনেকক্ষণ পর প্রধানমন্ত্রী এলো, সঙ্গে তথ্য প্রতিমন্ত্রী। তথ্য প্রতিমন্ত্রী ঢুকেই বললেন, এখানে আমি এসে কী করবো! আমার তো কিছু করার নেই এখানে!’ প্রধানমন্ত্রী তাকে থাকতে বললো। একপর্যায়ে আমিও বললাম, আপনি থাকুন। যদিও সেখানে তাঁকে থাকতে বলার কোনো অধিকার আমার ছিল না, কিছু একটা না বললে ভালো দেখাচ্ছে না বলেই বললাম।
সভার শুরুতে কমিশনের চেয়ারম্যান কথা বলতে উঠলেন। তিনি দু তিনজনের নাম করে বললেন, কমিশনের সৌভাগ্য যে, এর কাজে এমন সব ব্যক্তির সহায়তা পাওয়া গেছে। শেখ হাসিনা সঙ্গে সঙ্গে বললো, তাদেরও সৌভাগ্য যে এমন জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন কাজের দায়িত্ব তাদেরকে অর্পণ করা হয়েছে। আসাফউদ্দৌলাহর মতো বাকপটু মানুষও তাতে থমকে গেলেন।
বাকি কথাবার্তা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললো। প্রধানমন্ত্রীর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে রিপোর্ট তুলে দেওয়ার পরে আমাদের সবাইকে রিপোর্টের কপি দেওয়া হলো। রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল আঞ্জু মনোয়ারার দায়িত্বে। কাজেই তিনিই সবাইকে রিপোর্টের কপি দিচ্ছিলেন। প্রতিমন্ত্রী তাকে ধমক দিয়ে বললেন, সবাইকে কপি দিচ্ছেন কেন? কত কপি ছাপা হয়েছে? ভদ্রমহিলা খুব অপ্রস্তুত হলেন। তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘১০০ কপি, সার্।’ প্রতিমন্ত্রী জানতে চাইলেন, ‘১০০ কপি কেন? আমি তো ৫০ কপি ছাপতে বলেছিলাম। কমিশনের চেয়ারম্যানের দিকে ইঙ্গিত করে আঞ্জু মনোয়ারা বললেন, ‘সাক্ ১০০ কপি ছাপতে বলেছিলেন।
আমরা তড়িঘড়ি চা খেয়ে বিদায় নিলাম। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের চা খুব সুস্বাদু মনে হয়নি। ওঠার সময়ে আমরা সকলেই রিপোর্টের কপি টেবিলে রেখে চলে এসেছিলাম।
পরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা সেসব কপি আমাদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেন। আর আঞ্জু মনোয়ারা কয়েকদিনের মধ্যে বদলি হয়ে যান টাঙ্গাইলে।
রিপোর্টে আমরা একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন-প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলাম। এর চেয়ারম্যান ও সদস্যেরা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। এই কমিশন জবাবদিহি করবে তথ্যসম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে সংসদের কাছে। মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্তৃত্ব এর ওপর থাকবে না। বেতার ও টেলিভিশন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানরূপে এর তত্ত্বাবধানে কাজ করবে। সেখানেও মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ থাকবে না।
করদাতার টাকা যেখানে খরচ হবে, করদাতাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সেখানে নাক গলাবেন না–এমন একটা পরিস্থিতি অনেকের পছন্দ হয়নি। তারা বেতার-টেলিভিশনকে স্বায়ত্তশাসন দিতে চেয়েছিলেন মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব বজায় রেখে।
ওই রিপোর্ট সম্পর্কে এবং বেতার-টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে তারপর আমরা আর কিছু শুনিনি।
৪৩.
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়লাভের পঁচিশ বছরপূর্তি উপলক্ষে ড. রওনক জাহান ফোর্ড ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আন্তর্জাতিক আলোচনা-সভার আয়োজন করে। তাতে যোগ দিতে রেহমান সোবহান (সিপিডি), আবু আবদুল্লাহ ও বিনায়ক সেন (বিআইডিএস), জরিনা রহমান খান ও আমি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), মহিউদ্দীন আহমদ (ইউপিএল) ও সারা হোসেন (আইনজীবী) ২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের লন্ডনগামী ফ্লাইটে উঠে বসলাম। উড়োজাহাজের দরজা বন্ধ হলো, কিন্তু টার্মিনাল ভবনের গেট ছাড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। আমরা অস্থির। এয়ার হোস্টেসদের বললাম কিছু পানীয় সরবরাহ করতে। তারা বললেন, উড়োজাহাজ ওড়ামাত্র তারা খেতে দেবেন। তারপর টার্মিনাল ভবন ছেড়ে বিমানটি কিছুদূর এগোলো, কিন্তু কিছুদূরমাত্রই। অবশেষে ক্যাপ্টেনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল : ছোটো একটি যন্ত্রাংশ পাল্টাতে হবে; সেটা আমাদের কাছে নেই, অন্য একটি এয়ারলাইনসের ভাঁড়ারে আছে। তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ডেকে পাঠিয়েছে। সে এলেই ওটা পাওয়া যাবে এবং আমরা উড়তে পারবো। একসময়ে জানানো হলো, যন্ত্রাংশটি পাওয়া গেছে। তারপর জানা গেল, যন্ত্রাংশটি লাগানো হয়েছে। তারপর : আমরা দুঃখিত। যে যন্ত্রাংশটি লাগানো হয়েছে, সেটি বোয়িংয়ের নয়, তাই আটলান্টার বোয়িং কর্তৃপক্ষ সেটা নিয়ে ওড়ার অনুমতি দিচ্ছে না। এদিকে এতক্ষণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র চালু থাকায় জ্বালানিও অনেক খরচ হয়ে গেছে। ক্রুদের কাজ করার যে-সময়সীমা, তারও অনেকখানি ব্যয় হয়ে গেছে। এ-অবস্থায় আজ আর এই ফ্লাইট ছাড়া সম্ভবপর নয়। আপনাদের রাতের খাবার এখন সরবরাহ করা। হচ্ছে। এরপর টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। সেখানে গিয়ে আপনারা নিজেদের মালপত্র সংগ্রহ করবেন। তারপর এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনায় আপনাদের হোটেলে নিয়ে যাওয়া হবে। আগামীকাল একই সময়ে আপনাদের নিয়ে আমরা উড়ে যাবো।
তখন আর খাওয়ার ইচ্ছেও থাকলো না। টার্মিনালে পৌঁছে দেখি একেবারেই বিশৃঙ্খল অবস্থা। মালপত্র খুঁজে নিয়ে নিজেদেরই টানাটানি করতে হচ্ছে। যে বাসে হোটেলে যাওয়ার কথা, তাতে সবার স্থানসংকুলান হবে না। সুতরাং তাতে ওঠার জন্যে ভয়ংকররকম প্রতিযোগিতা। কোনোমতে গন্তব্য জানা গেল : গুলশানের হোটেল মিডটাউন। আমরা কয়েকজন একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে সেখানে এলাম। আনন্দকে ফোন করে সেখানে গাড়ি নিয়ে আসতে বললাম। সেই গাড়িতে সারাকে বাড়ি পৌঁছে নিজের জায়গায় ফিরে এলাম।
পরদিন প্লেনে উঠে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের পক্ষ থেকে দুঃখপ্রকাশ করে লেখা চিঠি পাওয়া গেল। আর পাওয়া গেল নব্বই পাউন্ডের একটা ভাউচার-পরবর্তী কোনো যাত্রায় কাজে লাগবে।
হিথরোতে পৌঁছে আমাদের ইমিগ্রেশনের কাজ সারতে হবে। কেননা আমরা বিমানবন্দরেই একটি হোটেলে থাকবো এয়ারলাইনসের ব্যবস্থায়। অনেক যাত্রীর যুক্তরাজ্যের ভিসা নেই। তাদের জন্যে অনুমতি সংগ্রহ করতে অনেকক্ষণ লাগলো। আমাদের যাদের ভিসা আছে, তাদেরও অপেক্ষা করতে হলে সবার জন্যে। ফলে যখন আমরা টার্মিনাল ছাড়লাম, তখন মনে হলো, আর কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়েই আমরা নিউ ইয়র্ক রওনা হতে পারতাম।
হোটেলটি ভালো, তবে ঘুমোবার সময় তেমন পাওয়া গেল না। প্রাতিক্কালে উঠেই রওনা দিতে হলো–কেউ ব্রেকফাস্ট করলো, কেউ করলো না। আমাদের সহযাত্রীদের কাউকে অকারণ হয়রানি করলো ইমিগ্রেশন। এতকিছুর পর আটলান্টিক পার হওয়া।
নিউ ইয়র্কে আমাদের থাকার ব্যবস্থা কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনে। ঘরগুলো ছোটো, কিন্তু ব্যবস্থা অত্যাধুনিক। এতই অত্যাধুনিক যে ম্যানুয়াল হাতে করে বাথরুমে ঢুকে মুদ্রিত নির্দেশ অনুসরণ করে করে শাওয়ার খুলতে হলো। ব্রেকফাস্টের সময়ে জানতে পারলাম যে, মহিউদ্দীন আহমদ নির্দেশাবলির খেই হারিয়ে ফেলে গোসল সারতে পারেননি। টেলিফোন ব্যবহার করতেও প্রায় একইরকমের ঝামেলা।
সেমিনারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিলেন আমার দুই বন্ধু–আজিজুর রহমান খান (ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) ও শেলী ফেল্ডম্যান (কর্নেল) এবং হ্যারি ব্লেয়ার (বাকনেল) ও স্ট্যানলি কোচানেক (পেনসিলভ্যানিয়া); আমস্টারডাম থেকে ভিলেম ভ্যান শ্যান্ডেল এবং কোপেনহেগেন থেকে কানে ওয়েস্টারগার্ড। মওদুদ আহমদ ও মঈন খানও খবর পেয়ে এসেছিলেন–মঈন। যদিও শ্রোতাই ছিলেন, মওদুদ কথা না বলে পারেননি।
সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধগুলি পরে রওনক জাহানের সম্পাদনায় Bangladesh Promise and Performance (ঢাকা : ইউপিএল, ২০০০) নামে প্রকাশিত হয়েছিল।
সেমিনারের বাইরে আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল সুগত বসু (রাজনীতিবিদ শরৎচন্দ্র বসুর পৌত্র) এবং তার পাকিস্তানি বান্ধবী ও পণ্ডিত আয়েশা জালালের সঙ্গে। সুগত আমার পূর্বপরিচিত–তখন টাক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছে। আয়েশা কলাম্বিয়া ছাড়তে যাচ্ছে। আয়েশার বাড়িতে এক সন্ধ্যায় খানাপিনা হলো। তার অনুরোধে পরে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু ও ফারসি পাণ্ডুলিপির তালিকা পাঠিয়েছিলাম। সে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল।
৪৪.
ড. ক্যারল সলোমান পেনসিলভিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছেড়ে সিয়াটলে চলে এসেছে। সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে তার স্বামী রিচার্ড সলোমান ইতিহাসের অধ্যাপক। ক্যারল আপাতত পড়াচ্ছে না, নিজের লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত। আমি কলাম্বিয়াতে আসছি জেনে সে খবর পাঠালো, সিয়াটলে যেতে হবে এবং ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে বক্তৃতা দিতে হবে, নিউ ইয়র্ক থেকে সিয়াটলে আসা-যাওয়ার বিমানভাড়া তারাই দেবে। আমি জানালাম, কলাম্বিয়ার জন্যে প্রবন্ধ লিখতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি, আবার সিয়াটলের জন্যে লিখব কখন? ক্যারল লিখলো, ওই প্রবন্ধটাই সিয়াটলে পড়লে চলবে–এখানকার শ্রোতাদের কেউ তো আর কলাম্বিয়ার সেমিনারে উপস্থিত থাকছে না। সমাধান। এত সহজ যে দ্বিরুক্তির অবকাশ নেই।
সেইমতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্তে চলে এলাম। বিমানবন্দরে রিচার্ড এবং ক্যারল উভয়েই উপস্থিত। আমার ভারী সুটকেসটা টানাটানির ভার রিচার্ড নিয়েছেন দেখে লজ্জা পেলাম। টার্মিনাল ভবন থেকে শাটল ট্রেনে করে গাড়ি পার্কিংয়ের এলাকায় পৌঁছোনো গেল। রিচার্ডই গাড়ি চালিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। সেখানেই আমার থাকার ব্যবস্থা। ক্যারলদের দোতলা বাড়ি–আমার জন্যে বরাদ্দ কক্ষটা ওপরতলায়। রিচার্ড সেখানেই আমার সুটকেস পৌঁছে দিলেন।
পরদিন ক্যারল আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়-এলাকা ঘুরিয়ে দেখালো। শিক্ষকদের ক্লাবে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা। সেখানে আমাদের শিকাগো-যুগের বন্ধু ফ্র্যাংকের সঙ্গে দেখা। সে আমার আসবার খবর জানতো, তাই আমাকে দেখে অবাক হয়নি। তবে তার ভালুকোচিত আলিঙ্গনের উষ্ণতায় আমি একটু অবাক হলাম বইকি! ফ্র্যাংক বললো ক্যারলকে, জানো, আনিস আমাকে ডোনার কাবাব খাওয়া শিখিয়েছে! আমি একটু বিস্মিত হয়েই প্রশ্ন করি, সে কবে? ফ্র্যাংক বলে, তোমার কিছু মনে নেই-লন্ডনে, ১৯৭৯ সালে।
খেতে খেতে কাঁচের দেওয়াল দিয়ে বাইরে তাকাই। ক্লাব-ভবনের গা ঘেঁষেই চমৎকার একটি লেক। লেকের অন্য প্রান্তে মনোরম একটি বাড়ি। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ফ্র্যাংক বলে, বাড়িটা কার জানো? বিল গেটসের। আমি বলি, তাহলে আমরা এখানে বসে মিছেমিছি সময় নষ্ট করছি কেন? ভিক্ষা দাও গো বলে ওই বাড়ির দরজায় করাঘাত করা যাক।
ফ্র্যাংক বললো, লোকটা আসলে মন্দ নয়। যদি সত্যি সত্যি ওর সামনে গিয়ে হাত পাততে পারো, তাহলে হয়তো খালি হাতে ফিরতে হবে না। তবে তার সামনে যাওয়াটাই সমস্যা। সেজন্যে শক্তিসঞ্চয় করতে হলে আরো এক পাত্র পান করতে হবে।
ক্যারল তার বাড়িতে রাতে খেতে ডেকেছে আরো কয়েকজনকে। তাদের মধ্যে আছে নন্দিনী এবং তার স্বামী ফাহাদ। নন্দিনী ঢাকা বেতারের এককালীন অধিকর্তা জায়নুল আবেদীন এবং আমাদের অনেককালের নূরু আপার কন্যা। ফাহাদ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানের পুত্র। খাওয়া দাওয়ার পরে ওরা দুজন আমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হলো। সিয়াটল পার্বত্য এলাকা। এদিক-ওদিকে বৈদ্যুতিক আলোগুলো জ্বলছে তারার মতো–তবে একই তলে নয়, উঁচুনিচুতে–তাই নক্ষত্রখচিত আকাশের চেয়ে চারপাশটা মনোরম দেখাচ্ছে।
পরদিন আমার প্রবন্ধপাঠ। প্রবন্ধের শিরোনাম বোধহয় ছিল Identity and Politics in Bangladesh-এই প্রবন্ধটাই কলাম্বিয়ায় পড়েছিলাম (রওনক জাহান-সম্পাদিত বইতে শিরোনাম খানিকটা বদলে দেওয়া হয়েছে, আমার নামের আগেও একটা অনাবশ্যক এম’ এসে জুটেছে)। কলাম্বিয়ার শ্রোতারা ছিলেন দক্ষিণ এশীয় বিদ্যার শিক্ষক ও ছাত্র–আমার বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে বেশ খানিকটা পরিচিত। সিয়াটলে নানা বিদ্যার লোক এসেছেন। ছাত্রদের কেউ কেউ অতি সরল প্রশ্ন করে বসলো, এক স্বনামধন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আমার সঙ্গে তর্ক জুড়ে বসলেন–আমার পক্ষপাত উদ্ঘাটন করাই তার লক্ষ্য বলে মনে হলো। ফেরার পথে রিচার্ডকে বললাম, আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি। রিচার্ড সারাক্ষণই চুপচাপ ছিলেন। এবারে মুখ খুললেন, তুমি কি এমন কাউকে জানো যে ওঁকে খুশি করতে পেরেছে?
সিয়াটল থেকে পরদিন নিউ ইয়র্কে ফিরলাম। জে এফ কে থেকেই টার্মিনাল ভবন বদলে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ধরে স্বদেশযাত্রা। লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি, দেখা হয়ে গেল মাহফুজ আনামের সঙ্গে। কলাম্বিয়ার সেমিনারে যোগ দিতে মাহফুজ নিউ ইয়র্কে এসেছিল আমাদের পরে–এখন ফিরে যাচ্ছে। আমরা একই বিমানের যাত্রী।
ঢাকায় ক্লাস নেওয়ার তাগাদা থাকায় এবারে লন্ডনে থামছি না। হিথরো বিমানবন্দরে অনেকক্ষণ বসে থাকতে তাই বেশি খারাপ লাগছিল। আরো একটা ফ্যাকড়া আছে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ আমাদের ঢাকা পর্যন্ত নেবে না–ফেলে যাবে দুবাইতে। সেখান থেকে ঢাকায় ফিরতে হবে এমিরেট্সে, তবে দুবাই বিমানবন্দরে থাকতে হবে প্রায় সাত ঘণ্টা।
এতক্ষণ সময় কী করা যায়? আয়েশ করে মুখহাত ধোওয়া হলো, জানলা দিয়ে দোকানের জিনিসপত্র দেখা হলো, কিছু চকোলেটও কেনা হলো। তারপর? মাহফুজ বললো, ‘চলেন, কিছু খেয়ে নেওয়া যাক্।
বললাম, ‘প্লেনে উঠলেই তো খেতে দেবে।’
মাহফুজের যুক্তি, ‘তার তো অনেক দেরি।’
চীনা খাদ্য দিয়ে নৈশভোজ সারা হলো। খাবার যা আনা হয়েছিল, তার সবটা খাওয়া যায়নি।
খেয়েদেয়ে যথাসময়ে বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহ করা হলো। তার অনেকক্ষণ পরে যখন উড়োজাহাজে উঠতে যাচ্ছি, এমিরেটসের এক কর্মী ‘একটু অপেক্ষা করো। বলে মাহফুজ আর আমার বোর্ডিং কার্ড নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। ফিরে এলো একজিকিউটিভ ক্লাসের দুটো বোর্ডিং কার্ড নিয়ে এবং মাথা ঝুঁকিয়ে তা আমাদের হাতে সমর্পণ করলো।
জানতে চাইলাম, আমাদের কোন সুকৃতির ফলে এই সমাদর? তরুণটি মাথা ঝুঁকিয়ে জবাব দিলো, এটা এমিরেটসের সেবার ধরন। তারপর বললো, দেখা যাচ্ছে, তোমরা নিউ ইয়র্ক থেকে আসছ অনেক পথ পাড়ি দিয়ে। বাকি পথটা একটু আরামে যেতে তোমাদের নিশ্চয় ভালো লাগবে।
আমি বললাম, তুমি তো জানো না আমি সিয়াল থেকে আসছি আরো বেশি পথ পেরিয়ে। জানলে বোধহয় আমাকে ফার্স্ট ক্লাসে বসাতে। তাই না?
৪৫.
নিউ ইয়র্কেই সুগত বসু বলে রেখেছিল, ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে কলকাতায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মশতবার্ষিক অনুষ্ঠানে আমাকে যোগ দিতে হবে–লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন আবশ্যিক নয়, মুখে বললেই চলবে। ঢাকায়। ফিরে আসার পরপরই নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পাওয়া গেল সুগতর বাবা ডা. শিশিরকুমার বসুর স্বাক্ষরে।
শিশিরকুমার বসু খুব নামজাদা শিশুরোগ-বিশেষজ্ঞ। ১৯৪১ সালে যখন তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, তখন সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তর্ধানের ঘটনাটি ঘটে। শিশির বসুই এলগিন রোডের বাড়ি থেকে গাড়ি চালিয়ে ছদ্মবেশী সুভাষ বসুকে বিহারের গোমো রেলস্টেশনে পৌঁছে দেন-সুভাষ চলে যান পেশোয়ারে এবং সেখান থেকে কাবুল হয়ে মস্কোয়। পুলিশ শিশির বসুকে গ্রেপ্তার করে দিল্লির লাল কেল্লা ও লাহোর দুর্গে দুবছর বন্দি করে রাখে। মুক্তিলাভের পর তিনি কলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে ভিয়েনায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ২০ বছর ধরে কলকাতার ইনসটিটিউট অফ চাইল্ড হেলথের ডিরেক্টর ছিলেন এবং ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিসের একজন প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি অনেক কাজ করেছিলেন। আশির দশকে কংগ্রেসপ্রার্থীরূপে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। পিতা ও পিতৃব্য এবং তাঁদের কাল সম্পর্কে ইংরেজি ও বাংলায় তিনি কয়েকটি বই লিখেছেন, আরো কয়েকটি সম্পাদনা করেছেন। তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা বসুও সুভাষ সম্পর্কে অনেক লিখেছেন। তিনি প্রথমে কংগ্রেস দলের ও পরে তৃণমূল কংগ্রেসের মনোনয়ন লাভ করে লোকসভার সদস্য হন।
সুগত নিজেও কলকাতায় এসেছিল সুভাষ-জন্মশতবার্ষিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তার সুবাদে ডা. বসু ও কৃষ্ণা বসু আমাকে যথেষ্ট সমাদর করেন। ১৯৭১ সালে শিশির বসুর সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ হয়েছিল, সে কথা তাঁকে মনে করিয়ে দিই। তিনি যে তা মনে রাখেননি, তার জন্যে যথেষ্ট লজ্জিত হয়েছিলেন, যদিও অত সামান্য আলাপ মনে রাখার কোনো কারণ ছিল না।
সুভাষের জন্মশতবার্ষিক অনুষ্ঠানে আলোচনার বিষয় সুভাষ ও তার সময়ের রাজনীতিতেই কেবল সীমাবদ্ধ ছিল না, সমকালীন ভারতীয় পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছিল। কাশ্মিরের হুররিয়াত কনফারেন্সের তিন প্রতিনিধি এসেছিলেন আবদুল গনি লোনের নেতৃত্বে–তাঁরা কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্ৰাধিকার দাবি করেছিলেন এবং সেখানে মানবাধিকার-পরিস্থিতির অবনতির কথা বলেছিলেন। অনেক নামিদামি ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা–তিনি ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সমস্যা সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আমাদের কালের পরিপ্রেক্ষিত থেকে আমি সুভাষ বসু সম্পর্কে দু চার কথা বলেছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছিলাম প্রেসিডেন্সি কলেজে সুভাষের সহপাঠী কাজী আবদুল ওদুদের সুভাষচন্দ্র’ কবিতাটির কথা। দেখলাম, কাজী আবদুল ওদুদের নাম জানলেও তিনি যে সুভাষের সহপাঠী ছিলেন, সে কথা উপস্থিত কেউ জানতেন না এবং তাঁর ওই কবিতাটিও কেউ পড়েননি। শিশির বসুর অনুরোধে পরে তাকে আমি কবিতাটি পাঠিয়ে দিই। তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র বসুর বক্তৃতা ও রচনার দুটি সংকলন।
সেবারের অনুষ্ঠানে জগজিৎ সিং অরোরার সঙ্গে আমার খুব সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেল। অনুষ্ঠানের সকল অংশগ্রহণকারীকে শিশির বসু ক্যালকাটা ক্লাবে নৈশভোজে আপ্যায়িত করেছিলেন। পুরো সময়টা জেনারেল অরোরা এবং আমি এক সোফায় বসে গল্প করে কাটিয়েছিলাম। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, ১৯৭১ সম্পর্কে তিনি কিছু লিখলেন না কেন? তিনি মৃদু হেসে বললেন, যুদ্ধে জয়লাভ করলে সে-সাফল্য অনেকে দাবি করে, কিন্তু পরাজিত হলে তার দায় কেউ নিতে চায় না। ১৯৭১ সম্পর্কে অনেকেই তো লিখেছে, আমি আর ভিড় বাড়াই কেন? আমার আমার একাত্তর বইটি তখন প্রকাশের পথে। ১৫-১৬ ডিসেম্বরের কিছু ঘটনা সম্পর্কে আমি তাঁর কাছে জানতে চাই, তিনিও অকপটে উত্তর দেন। কিছুকাল আগে ফুয়াদ চৌধুরীকে জেনারেল অরোরা ক্যামেরায় যে-সাক্ষাৎকার দেন, ফুয়াদ তা আমাকে দেখিয়েছিল। সেখানে তিনি তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। আমি সে-প্রসঙ্গ উত্থাপন করি। জেনারেল অরোরা আবার তাজউদ্দীনের নানা গুণের কথা বললেন এবং তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে শোকপ্রকাশ করলেন। তিনি যে লোকসভার নির্বাচনে একবার প্রার্থী হয়েছিলেন, সে-বিষয়ে প্রশ্ন করায় জেনারেল বললেন, আমার কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না। তবে ইন্দিরা গান্ধির দুর্ভাগ্যজনক হত্যাকাণ্ডের পরে শিখেরা যেভাবে সর্বত্র নিগৃহীত হয়, তার প্রতিবাদে ওই সম্প্রদায়ের একজন হিসেবে একটা ভূমিকা নিতে চেয়েছিলাম। ওই মুহূর্তে নির্বাচনপ্রার্থী হওয়াই তার একটা উপায় বলে মনে হয়েছিল। বিদায় নেওয়ার সময়ে তিনি বেশ আবেগের সঙ্গে আমাকে তার দিল্লির বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন।
সুতরাং এর কয়েক মাস পর যখন দিল্লি যাই, তখন জেনারেল অরোরাকে ফোন করি। নাম বলতেই তিনি চিনতে পারলেন এবং তাঁর বাড়িতে যেতে বললেন। তিনি থাকতেন দিল্লির ফ্রেন্ডস কলোনি ইস্টে। নির্ধারিত সময়ে তাঁর ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে দেখি, তিনি পানীয় সাজিয়ে বসে আছেন। তাঁর স্ত্রী অল্পকাল আগে মারা গেছেন, একটিমাত্র মেয়ে নিজের সংসারে থাকে। এসব। বিষয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা হলো। ১৯৭১-এর পর তিনি আর বাংলাদেশে যাননি। ১৯৯৬ সালের বিজয় দিবস বেশ জমকালো করে পালিত হয়েছে, অনেক বিদেশি অতিথি তাতে যোগ দিয়েছিলেন–এসব কথা তিনি শুনেছেন। বাংলাদেশে যে তিনি কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিমন্ত্রিত হননি, তার জন্যে একটু দুঃখবোধ হয়তো তার মধ্যে ছিল, কিন্তু আত্মসম্মানজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি যেমন এ ধরনের বোধ নিজের মধ্যেই রেখে দেন, তিনিও সম্ভবত তাই করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জেনারেল অরোরাকে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণ জানাবার কথা ভাবছিলেন এর ট্রাস্টিরা। তাঁদের কথায় আমি ঢাকা থেকে তাঁকে ফোন করি। আমার অনুরোধ তিনি সঙ্গে সঙ্গেই গ্রহণ করলেন। ১৯৯৮ সালের মার্চ মাসের সম্ভবত ১৯ তারিখে তিনি ঢাকায় এলেন। অন্যদের সঙ্গে আমিও বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানালাম। তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয় হোটেল শেরাটনে। রাতে সেখানে আমরা একত্রে খেলাম। ২১ তারিখে জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিক বক্তৃতা। সেখানে লোকে লোকারণ্য। রেহমান সোবহান সভাপতি, আমি স্বাগত ভাষক, জেনারেল অরোরা মূল বক্তা। তিনি বলেছিলেন, ভারতের সাহায্য ছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচেষ্টায়, তবে তাতে সময় লাগত, অনেক বেশি রক্তক্ষয় হতো। জেনারেল অরোরার সঙ্গে আমি গেলাম সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেখানে তার কাছে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছিল, সেখানে। তিনি সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানালেন, সাভারে রক্ষিত দর্শক বইতে মন্তব্য লিপিবদ্ধ করলেন।
জেনারেল অরোরা একটি সরকারি আমন্ত্রণের প্রত্যাশা করছিলেন। তিনি আমাকে খোলাখুলিই বলেন যে, কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়মে তার একটা নিমন্ত্রণ আছে। তবে ২৬ মার্চ যদি ঢাকায় সরকারি অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত হন, তাহলে তিনি আর সেখানে যাবেন না। আমার মনে হলো, আমাদের স্বাধীনতা দিবসের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাঁকে নিমন্ত্রণ করা হবে না। আমি বললাম, আপনার কর্মসূচি আপনি ঠিক রাখুন, এখানে কিছু হলে পরে দেখা যাবে।
অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ তাঁকে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ করেছিলেন রাষ্ট্রীয় অতিথি-ভবনে। সেখানে অনেকে এসেছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসতে দেরি হয়েছিল, তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী যথাসময়ে উপস্থিত ছিলেন। পৌঁছোবার পরও মধ্যাহ্নভোেজ শুরু করতে মন্ত্রী দেরি করছিলেন–কারণ তিনি অপেক্ষা করছিলেন শেরে খাজার কন্যার জন্যে। মেয়েটি কমবয়সী ও চঞ্চল, ওই অনুষ্ঠানের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিল বলে মনে হয় না। মন্ত্রীকে অপেক্ষা করতে দেখে প্রতিমন্ত্রীও বিরক্ত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মেয়েটি উপস্থিত হওয়ার আগেই ভোজ শুরু হয়েছিল।
একটি নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। দলমতনির্বিশেষে তারা এসেছিলেন। ঢাকায় উপস্থিত সকল সেক্টর কমান্ডার হাজির ছিলেন। রাষ্ট্রদূত আশরাফ-উদ্-দৌলার মতো আহত মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। এই সন্ধ্যার স্বতঃস্ফূর্ততা জেনারেল অরোরার হৃদয় স্পর্শ করেছিল, তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল।
শেষ পর্যন্ত ২৫ মার্চ তারিখে জেনারেল অরোরা দিল্লি ফিরে গেলেন। আরেকবার দিল্লিতে গেলাম খুশী কবিরের ব্যবস্থাপনায়–সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী একটি সম্মেলনে। রথ দেখা কলা বেচার মতো তখন নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করালাম। সেবারেও জেনারেল অরোরার বাড়িতে যাই, তিনি বলেন, যদি ডা. ত্রিহানকে দেখাই তবে আমি যেন তাঁর উল্লেখ করি।
এর পরে আবার যখন দিল্লি যাই, তখন তার স্বাস্থ্যের গুরুতর অবনতি হয়েছে। টেলিফোনে কথা শুনতে পাচ্ছেন না বললেন; আমার মনে হলো, তিনি। আমাকে চিনতে পারছেন না। তার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি।
৪৬.
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মৃত্যুর পরে–১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে–তার স্মরণে কলকাতায় একটি সভা হয়। প্রকৃতপক্ষে সেই সভার আয়োজন করেছিল শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত। তাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন পবিত্র সরকার। সেই সময়ে আমি কলকাতায় থাকায় সভায় কিছু বলতে আমাকে আমন্ত্রণ করা হয়। সভায় জনসমাগম ভালো হয়েছিল। শ্রোতাদের অধিকাংশই যে ইলিয়াসের রচনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, তাতে সন্দেহ ছিল না। আলোচনাও বেশ হৃদ্য হয়েছিল।
সেই সভার পরে রণবীর সমাদ্দার আমাকে নিয়ে যায় ঢাকুরিয়ার কাছে এক বাড়িতে। সেখানে পরিচয় হয় তপন বোস আর দেবযানী দত্তের সঙ্গে। তপন একসময়ে চলচ্চিত্রজগতের সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন কাঠমান্ডু-ভিত্তিক সাউথ এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটসের (সাফর) অধিকর্তা। কাশ্মিরের। আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে সে অনেক বলেছে এবং সভা-সমিতি-জনমত গঠনের প্রয়াস চালিয়েছে। দেবযানী একসময়ে বামপন্থী ছাত্র-আন্দোলনে নিবেদিত ছিল, এখন বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকে কিছু সামাজিক কাজ করছে এবং ঘর সংসার করছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা বারীন দত্ত এবং শিক্ষক ও মহিলা আন্দোলনের নেতা হেনা দাস তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আমার বিষয়ে তপনের সঙ্গে রণবীরের আগেই কথা হয়ে থাকবে–তারা অনেককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তপন সেই রাতেই আমাকে আমন্ত্রণ জানালো সাফরের উদ্যোগে পরের মাসে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠেয় সভায় যোগ দিতে। জানলাম, ঢাকায় বেসরকারি সংগঠন অধিকারের সঙ্গে সাফরের একটি যোগসূত্র আছে এবং সেই সুবাদে অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান তাদের খানিক দৌত্য করে।
ঢাকায় ফিরে আসার পরে জানতে পারলাম, আদিলুর রহমান যাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে, তার মধ্যে আমার শালাজ ফাহমিদা রহমান ওয়াহাব ওরফে ঝিনুকও আছে। সে তখন সিরডাপে কর্মরত। আমি আনন্দিত হলাম। এপ্রিলের ২১ তারিখে আমরা ঢাকা থেকে ব্যাংককে পৌঁছোলাম। সেখানে তখন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্ কর্মরত। এর আগে একবার তাকে কথা দিয়েছিলাম, ব্যাংকক যাওয়া হলে তাঁর বাড়ি যাবো। ঝিনুককেও রাজি করালাম বিমানবন্দরের বাইরে যেতে। আমাদের সহযাত্রী এনায়েতউল্লাহ খান ওরফে মিন্টু আর ভাইয়ের কাছে যাওয়ার তাড়না অনুভব করলেন না। সেন্টু ভাইকে ফোন করে একটা ট্যাসি নিয়ে ঝিনুক আর আমি রওনা হলাম। পৌঁছোতে একটু বেশি সময়ই লাগল।
মণি ভাবি ঝিনুককে নিয়ে বাজারে বের হলেন। সেন্টু ভাই আর আমি বসে গল্প। করতে থাকলাম। পুরোনো দিন ও বন্ধুদের কথা উঠলো, বর্তমান সময়ের কথা হলো। তবে তিনি বৃহত্তর পারিবারিক পরিস্থিতি নিয়ে সেদিন অনেক কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে শহীদুল্লাহ খান বাদলের প্রশংসা ছিল। বলেছিলেন, বাদল ছোটো ভাই হয়েও বড়োর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
ব্যাংকক থেকে রাতে রওনা দিয়ে মাঝরাতে কলম্বো পৌঁছোলাম। সেখানে এক হোটেলে রাত্রিযাপন করা গেল। ব্রেকফাস্টের পর হোটেল ছেড়ে শহরের উপকণ্ঠে অন্য একটি হোটেলে আশ্রয় নিতে হলো। সেখানেই আমাদের আলোচনা-সভা অনুষ্ঠিত হবে। সবই ভালো, কেবল হোটেলকক্ষ ভাগ করে নিতে হবে আরেকজনের সঙ্গে। আমি রণবীরের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। দেশীয় সুসন্তানদের সংসর্গ পরিহার করে কেন আমি এক ভারতীয়ের সঙ্গে থাকতে চাইলাম, তা নিয়ে আমাদের বন্ধুবান্ধবেরা কিঞ্চিৎ গবেষণা করলেন। ঝিনুক ঘর ভাগ করেছিল কলকাতার পলা ব্যানার্জীর সঙ্গে। সেক্ষেত্রে অবশ্য ভ্রু কুঞ্চিত হয়নি। কেননা অতিথিদের মধ্যে তৃতীয় কোনো মহিলা ছিলেন না।
প্রারম্ভিক একটি অধিবেশনে রণবীরের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার এক তরুণীর বেজায় তর্ক লেগে গেল। মেয়েটি ছদ্ম-বিনয়ের সঙ্গে বললো, উনি কী বললেন, তা আমি বুঝতে পারিনি, বস্তুত ওঁর ভাষাই আমার পক্ষে দুর্বোধ্য। তিনি যদি একটু সহজ করে বলেন, তাহলে আমার মতো অল্পশিক্ষিতের পক্ষে সুবিধা হয়। উত্তর-আধুনিকতার প্রতি এই শ্লেষ নিক্ষিপ্ত হওয়ায় রণবীর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের মতো বলে গেল, তাহলে তাঁকে এই ভাষা শিখে নিতে হবে। বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে উনবিংশ শতাব্দীর ভাষায় সমাজ-বিশ্লেষণ করা সংগত হয় না। তরুণীর অগ্রজও ওই আলোচনা-সভায় উপস্থিত ছিলেন। আমার মনে হলো, ভাইবোনদুটি এলটিটিইর সমর্থক। পরে অন্য এক শ্রীলঙ্কান বলেছিলেন, আমার অনুমান যথার্থ, তবে আমি কী করে তা বুঝলাম, তা ভেবে তিনি অবাক হচ্ছেন।
আমি যে-অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলাম, তাতে বোমা ফাটালেন। আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আফতাব আহমাদ। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রসঙ্গে তিনি সেখানকার অধিবাসীদের আদিবাসী বলতে অস্বীকার করলেন এই যুক্তিতে যে, আমাদের অঞ্চলে তাদের প্রবেশ ঘটেছে বহু জাতির পরে। নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু হিসেবে যে তাদের স্বাতন্ত্র্য আছে এবং সে-স্বাতন্ত্র্য রক্ষার অধিকার যে তাদের আছে, সেটাও তিনি ঠিক স্বীকার করতে চাইলেন না। পেশোয়ার থেকে আগত এক পাকিস্তানি প্রতিনিধি এতে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি উচ্চৈঃস্বরে জানতে চান, বাংলাদেশের বন্ধুরা পার্বত্য অধিবাসীদের আদিবাসী বলে স্বীকার করেন কি না এবং তাদের স্বতন্ত্র অধিকাররক্ষার পক্ষপাতী কি না। আরো দু-একজন একইসঙ্গে কিছু বলার চেষ্টা করলেন। রণবীরের সঙ্গে পরামর্শ। করে আমি চা-বিরতি ঘোষণা করলাম।
তপন বোস খবর পেয়ে এলো। সে আদিলুর রহমানকে বললো, তুমি এই প্রতিনিধি (আফতাব আহমাদ) নিয়ে এসেছ, তার কারণে যে-পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা তুমিই সামলাও। আদিলুর রহমান আমাকে এসে বললো, আফতাব সাহেব আর কথা বলবেন না, এখন অবস্থা আপনি সামলে দিন। বিলম্বিত বিরতির পর অধিবেশন শুরু হলে আমি বললাম, নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের। আদিবাসী বলার বিষয়ে আমাদের দেশে মতভেদ আছে। কে কখন দেশের কোন খণ্ডে প্রবেশ করেছে, তা হিসাব করতে গেলে দেখা যাবে, আদম ও হাওয়া ছাড়া আমরা সকলেই কোথাও না কোথাও থেকে এসেছি। এমনকী, আদম-হাওয়াও পৃথিবীতে এসেছেন স্বর্গোদ্যান থেকে। আদিবাসী অর্থে কেবল বসতিস্থাপনের সনতারিখ বোঝায় না, তাদের কতকগুলি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য থাকে, জোর দেওয়া হয় তার ওপরে। আমরা যারা পাকিস্তান-আমলে বাঙালির স্বাধিকারের দাবি করেছি, তাদের পক্ষে দেশবাসীর যে-অংশ বাঙালি নয় তাদের নিজস্ব অধিকারের পক্ষাবলম্বন করা অবশ্যকর্তব্য। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে-রক্তপাত ঘটেছে, তা ঘটা উচিত ছিল না। আশা করি, আমরা এতদিনে বুঝতে পেরেছি। যে, রাজনৈতিক সমস্যার সামরিক সমাধান কোথাও হয়নি, হতেও পারে না। অতএব আমাদের যে-সমস্যা তার সমাধান খুঁজতে হবে সকলের সমান অধিকারের ভিত্তিতে, আলোচনার মাধ্যমে।
৪৭.
আমি যখন এসব কথা বলেছিলাম, তার কয়েকমাসের মধ্যে, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে। রাঙামাটিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শান্তি বাহিনীর সদস্যেরা অস্ত্র সমর্পণ করে। সমতলবাসী ও পাহাড়িদের অনেকে এ চুক্তি সমর্থন করেনি। এক পক্ষ ভেবেছে, পাহাড়িদের অনেক বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে; অন্যপক্ষ ভেবেছে, পাহাড়িরা ঠকে গেছে। অস্ত্রসমর্পণ-অনুষ্ঠানে বিক্ষোভ হতে পারে ভেবে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট সজাগ ছিল। কিন্তু কালো ওড়না পরে পাহাড়ি মেয়েদের আসা বন্ধ করা যায়নি। তাদের। অনেকে সেই ওড়নাকে কালো পতাকার মতো ব্যবহার করেছিল। বিএনপি ও জামায়াত শান্তিচুক্তির প্রবল বিরোধিতা করে। চুক্তিকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে তারা ক্ষান্ত ছিলেন না, জুন মাসে এই চুক্তির বিরুদ্ধে ঢাকা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত তারা লং মার্চ করেন। বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, এই চুক্তির ফলে ফেনী পর্যন্ত ভারতের সীমানাভুক্ত হয়ে যাবে। তবে তাঁরা যখন লং মার্চ করেছিলেন, তখন ফেনীর ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত যেতে তাদের পাসপোর্ট-ভিসা লাগেনি। লং মার্চে অংশগ্রহণকারীদের স্ব-উদ্যোগে। পানি খাইয়েছিলেন চট্টগ্রামের মেয়র। বেশ কিছুসংখ্যক বিশিষ্ট নাগরিক রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছিলেন এই চুক্তির কার্যকরতা বন্ধ করতে তাঁর ভূমিকাঁপালনের দাবিতে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তাঁদের বলেছিলেন, জাতীয় স্বার্থে এমন একটি চুক্তির প্রয়োজন ছিল। এই চুক্তি সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি একটি আলোচনা-সভার আয়োজন করেন। তাতে যোগ দিতে ঢাকা থেকে গিয়েছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা, আমিও গিয়েছিলাম। মনিরুজ্জামান মিঞা চুক্তিটি সংবিধানসম্মত নয় বলে মতপ্রকাশ করেন। তারপর তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, তার জন্যে সংবিধান সংশোধিত হবে, কিন্তু চুক্তিটি অপরিবর্তিত থাকবে। তার উত্তরে আমি বলেছিলাম, সংবিধান সংশোধন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা সরকারি দলের নেই। তবে কি সংবিধান সংশোধন করতে বিএনপি-দলীয় সদস্যেরা সরকারকে সাহায্য করবেন বলে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞার কাছে খবর আছে?
সরকার উদযোগী হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষককে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখতে নিয়ে যান দুভাগে। একভাগে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক পারভীন হাসান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শওকত আরা হোসেন, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ ও আমি ছিলাম। আমাদের ভ্রমণে তত্ত্বাবধান করেন ঢাকায় কর্নেল ফজলে এলাহী (মেজর জেনারেল পদ থেকে অবসরপ্রাপ্ত, পরে বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত)। চট্টগ্রামের জিওসি তখন মেজর জেনারেল আবদুল মতিন (পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা)। আমরা বিমানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাই। চট্টগ্রামে জিওসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে আমরা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি যাই এবং রামগড়, থানচি, সাজিক প্রভৃতি জায়গায় অল্পসময়ে অবস্থান করি। তিন জেলা শহরেই আমরা স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে আলোচনা করতে বসি।
আমরা লক্ষ করি, ১৯৭০ সাল পর্যন্ত যেসব বাঙালি পার্বত্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে, তাদের সঙ্গে পাহাড়িদের কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে–পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক অভিযানের কালে–যেসব সমতলবাসীকে সেখানে সরকারি উদ্যোগে বসানো হয়েছে, তাদের সঙ্গে পাহাড়িদের দ্বন্দ্ব প্রবল। খাগড়াছড়িতে আলোচনা-সভায় উপস্থিত ছিলেন হংসধ্বজ চাকমা। শান্তি-আলোচনায় তিনি একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার দৌত্যেই পাহাড়ি নেতারা অজ্ঞাতস্থান থেকে আলোচনাস্থলে আসা-যাওয়া করেছিলেন। হালে বসতিস্থাপনকারী একজন বেশ চীৎকার করে বাঙালিদের ওপর পাহাড়িদের অত্যাচারের বিবরণ দিচ্ছিলেন। হংসধ্বজ তাঁকে থামাবার চেষ্টা করতে গিয়ে বললেন, ‘থামেন, থামেন। আপনি যে আমার ঘরে আগুন দিয়েছিলেন, সেকথা কি আমি কাউকে বলেছি?’ অভিযোগকারী একথা শুনে সত্যিই থেমে গেলেন।
খাগড়াছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমাকে পৃথকভাবে বললেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-পদ যদি পাহাড়িদের জন্যে উন্মুক্ত থাকে, তাহলে বাঙালিরা তা মেনে নেবে না। আমি বললাম, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যদি ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হয়, তাহলে কি চেয়ারম্যান-পদ কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর জন্যে সংরক্ষিত রাখা সম্ভবপর?
ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনকারী পাহাড়িদের প্রধান অভিযোগ ছিল এই যে, তারা নিজেদের বাড়িঘরে ফিরতে পারেনি–সেসবই দখল হয়ে গেছে এবং তাদের জমি বা পাহাড়ও তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। প্রশাসন তাদের ভূমিস্বত্বের কাগজ দেখতে চায়, কিন্তু তাদের কাছে তো কোনোকালে কোনো কাগজ ছিল না। কারবারিরা (মোড়ল) জানে, কোন জমি কার, কোন পাহাড়ে চাষ করার অধিকার কার। কিন্তু প্রশাসন বলে, কারবারির মুখের কথায় হবে না, দলিল চাই। দলিল কোথায় পাবে তারা?
বান্দরবনে মারমা সম্প্রদায়ের এক প্রতিনিধি নিম্নকণ্ঠে বললেন, স্বায়ত্তশাসন পেলে চাকমাদের লাভ হবে–তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর, রাজনৈতিকভাবে সচেতন। কিন্তু পাহাড়িদের অন্য সম্প্রদায়ের তেমন লাভ হবে না। এখন তারা বাঙালিদের অধীন, তখন তারা চাকমাদের অধীন হবে।
রাঙামাটিতে স্থানীয় অধিবাসীদের সভায় নব্য বসতিস্থাপনকারীরাই উচ্চকণ্ঠে কথা বললেন। একজন বললেন, পাহাড়িরা অস্ত্র ধরেছে বলে সরকার তাদের সুবিধা দিচ্ছে। আমরাও অস্ত্র ধরতে জানি। এই অবস্থা চললে আমরাও অস্ত্র ধরবো।
রাঙামাটিতে আমি সামরিক বাহিনীর জিপে করে চলেছি, দেখি, উলটো দিক থেকে রিকশায় আসছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নৃতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক, আমার বিশেষ স্নেহভাজন প্রশান্ত ত্রিপুরা। আমি জিপ থামিয়ে দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরলাম। একরাশ বিস্ময় নিয়ে সে বললো, ‘আপনি, সার্!’ আমার মনে হলো, জুলিয়াস সিজার নাটকে ব্রুটাসের ছুরিকাঘাতে আহত সিজারের উক্তি, তুমিও ব্রুটাস, যেন আবার ধ্বনিত হলো। প্রশান্তকে বললাম, সার্কিট হাউজে আছি। সন্ধ্যার পর এসো। অনেক কথা আছে। প্রশান্ত আসেনি। সামরিক বাহিনীর জিপে আমাকে দেখার পর হয়তো তার আর আমার কাছে আসতে ইচ্ছে হয়নি।
আমার এক প্রশ্নের উত্তরে সাজিকে এক সামরিক কর্মকর্তা বলেছিলেন, এরা আমাদের প্রচণ্ড ঘৃণা করতো। একবার এক অসুস্থ বুড়িকে রক্ত দেওয়ার। প্রয়োজন হয়। আমাদের নিয়মানুযায়ী ওই গ্রুপের রক্ত যাদের, সেসব সৈন্য রক্ত দিতে দাঁড়িয়ে যায় লাইন করে। এক বৃদ্ধা পাহাড়িকে বাঁচাতে বাঙালি সৈন্যেরা রক্ত দিচ্ছে–এটা এরা ভাবতে পারেনি। রক্ত-দেওয়া দেখতে পাহাড়িদের লাইন লেগে গেল। ওই একটিমাত্র ঘটনা এদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বদলে দেয় সম্পূর্ণভাবে।’
আমরা যখন হেলিকপ্টারে চট্টগ্রামে ফিরে আসি, তখন সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত বেশ কয়েকজন জওয়ানকে আমাদের সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হলো। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে তাদের চিকিৎসা হবে। এমন অনেক আছে। হেলিকপ্টার যদি আসে, তবেই তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্যে চট্টগ্রামে পাঠানো যায়। নচেৎ যে যেখানে, সেখানেই পড়ে থাকে।
চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ফিরে এলাম। জেনারেল মতিন আবার অভ্যর্থনা জানালেন। আমি তার কাছে কল্পনা চাকমার খোঁজ করলাম। তিনি বললেন, ‘আমরা তার খোঁজ পাইনি। ওই নামে সত্যিই কেউ ছিল কি না, সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।
ঢাকায় ফিরে আসার পরে একদিন আমরা দল বেঁধে সেনাপ্রধান জেনারেল মাহবুবুর রহমানের কাছে আমাদের অভিজ্ঞতার সার জানিয়ে এলাম। তিনি খুব সৌজন্য প্রকাশ করলেন।
দূরে পার্বত্য চট্টগ্রামে আরো অনেক কিছুর মতো পারস্পরিক সৌজন্যপ্রকাশের বড়ো অভাব।
৪৮.
১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার আমাকে নজরুল-ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি নিযুক্ত করে। বোধহয় এটি ছিল আমাকে দেওয়া শেখ হাসিনার গুরুদক্ষিণা।
নজরুল ইন্সটিটিউটের সঙ্গে আমার প্রাতিষ্ঠানিক সংযোগ ঘটে ১৯৯১ সালে। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা-উপদেষ্টা ছিলেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সংস্কৃতির বিষয়টা ছিল তাঁরই মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তিনি আমাকে ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মনোনীত করেন। বিএনপি সরকারের আমলে সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ছিলেন জাহানারা বেগম। তিনি আমার সদস্যপদের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছিলেন। তাঁর পিতামাতাকে চিনতাম, বোধহয় সে জন্যে কেবল নয়, মানুষ হিসেবেই তিনি শিষ্টাচারে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি পূর্বাপর আমার সঙ্গে খুব সৌজন্যপূর্ণ আচরণ করেন। সরকারের গ্রন্থনীতি-প্রণয়ন কমিটিতে সদস্য হিসেবে তিনি আমাকে অন্তর্ভুক্ত করেন; তাছাড়া, আগেই লিখেছি, আমার নেতৃত্বে কলকাতায় একটি লেখক-প্রতিনিধি দলও পাঠান।
ইন্সটিটিউটের সদস্য হয়ে আমি যখন যোগ দিই, তখন তার সদ্য নির্বাহী পরিচালক হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান এবং সভাপতিরূপে সপ্তম বর্ষে পদার্পণ করেছেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। শারীরিক সামর্থ্যের অভাব না ঘটলে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় অবশ্যই আসতেন এবং ইন্সটিটিউটের অন্যান্য অনুষ্ঠানেও যোগ দিতেন। ট্রাস্টি বোর্ডের সভায় এলে তিনি চাইতেন আমি যেন তাঁর পাশে বসি এবং প্রয়োজনমতো আলোচনার বিষয়বস্তু তাকে বুঝিয়ে বলি, কেননা তখন তিনি কানে কম শুনতেন। সভায় আসতে না পারলে তিনি বলে পাঠাতেন আমি যেন সেখানে সভাপতিত্ব করি। সেটা সবসময়ে ভালো শোনাতো না। সদস্য হিসেবে আমাকে পেয়ে মনিরুজ্জামানও খুশি হয়েছিল।
প্রায় একই সময়ে বাংলা একাডেমী আবদুল কাদির-সম্পাদিত পাঁচ খণ্ড নজরুল-রচনাবলীর (১৯৬৬-৮৪) একটি নতুন সংস্করণ-প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। তার জন্যে সরকারের বিশেষ অর্থ-মনজুরি পাওয়া গিয়েছিল। একাডেমীর মহাপরিচালক মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ নতুন সংস্করণের জন্যে যে সম্পাদনা-পরিষদ গঠন করেছিলেন, তা এ রকম: সভাপতি–আনিসুজ্জামান; সদস্য–মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মনিরুজ্জামান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, করুণাময়। গোস্বামী; সদস্য-সচিব–সেলিনা হোসেন। বৎসরাধিক পরিশ্রম করে আমরা চার খণ্ডে এই নতুন সংস্করণ প্রকাশ (১৯৯৩) করতে সমর্থ হই। এই সংস্করণে কবির প্রকাশিত বইগুলি কালানুক্রমিকভাবে বিন্যস্ত হয়। কবির সুস্থাবস্থায়। প্রকাশিত বইপত্রের সর্বশেষ সংস্করণের পাঠ অনুসৃত হয় এবং কবির অসুস্থাবস্থায় প্রকাশিত বইগুলির প্রথম সংস্করণের পাঠ গৃহীত হয়। গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত নজরুলের কিছু রচনা নানা গুচ্ছ করে আবদুল কাদিরের দেওয়া ভিন্ন। ভিন্ন নামে রচনাবলীতে সংকলিত হয়েছিল। সেসব নামে এবং সেসব লেখা নিয়ে কখনো কোনো বই প্রকাশিত হয়নি বলে আমরা গ্রন্থনাম বাদ দিয়ে সেসব লেখা। ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনার অন্তর্ভুক্ত করি। নজরুলের গানের ক্ষেত্রে আমরা
অনুসরণ করি মুদ্রিত পাঠ, রেকর্ডে ধারণকৃত বা স্বরলিপিতে বিধৃত গানের পাঠে ভেদ থাকলে আমরা তা নির্দেশ করিনি, কেননা তা করতে গেলে বহু সময়। লাগতো। নজরুলের অসুস্থাবস্থায় প্রকাশিত যেসব গ্রন্থে তার অন্যান্য প্রকাশিত গ্রন্থের কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, আমরা সেসবের পুনরাবৃত্তি বর্জন করি, তবে এ-সংক্রান্ত তথ্য গ্রন্থপরিচয়ে উল্লেখ করি। আবদুল কাদির-প্রদত্ত গ্রন্থপরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখে আমরা ‘পুনশ্চ’ শিরোনামে অতিরিক্ত তথ্য সন্নিবেশ করি। আমরা সাধারণভাবে আধুনিক বানানপদ্ধতি অনুসরণ করি, তবে নজরুলের গ্রন্থনামের বানান এবং যেসব ক্ষেত্রে বানানের কোনো বিশেষত্ব রক্ষা করা অপরিহার্য বিবেচিত হয়, সেসব ক্ষেত্রে মূলের বানান অপরিবর্তিত রাখি। আবদুল কাদিরের নিষ্ঠা ও শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ সম্পাদনা-পরিষদের নামের ওপরে। আমরা ‘আবদুল কাদির-সম্পাদিত নজরুল-রচনাবলী’ কথাগুলো লিপিবদ্ধ করি।
বইটি প্রকাশের পরে প্রায় সকলেই এটাকে প্রামাণ্য এবং অপেক্ষাকৃত উন্নত সংস্করণ বলে গ্রহণ করেছিলেন। বাংলা একাডেমী থেকে এটির পুনর্মুদ্রণও হয়, কিন্তু তারপর বইটি নিয়ে আমি এমন অশিষ্টাচারের সম্মুখীন হই, যার কথা এখানে বলে ফেলাই ভালো।
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ তখন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া একটি চিঠিতে জানা গেল যে, একাডেমী নজরুল্ল রচনাবলীর একটি পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ করতে ইচ্ছুক এবং সেই উদ্দেশে তাঁর দপ্তরে আহূত একটি সভায় আমি আমন্ত্রিত। বস্তুত ওই রচনাবলীর একটি নতুনতর সংস্করণ প্রকাশের আবশ্যকতা ছিল। ১৯৯৩ সালের পরে নজরুলের আরো কিছু লেখা উদ্ধার করা গিয়েছিল, আমাদের সংস্করণের এক-আধটি পুনরাবৃত্তি বর্জনের অপেক্ষায় ছিল। সুতরাং চিঠি পেয়ে খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু সভা-অনুষ্ঠানের একদিন আগে একাডেমীর একজন কর্মকর্তা ফোন করে বললেন যে, মহাপরিচালক ওই সভা স্থগিত করেছেন, পুনর্নির্ধারিত সভার স্থানকাল পরে জানানো হবে। এ-বিষয়ে একাডেমী থেকে কেউ আর কিছু জানাননি। অনেক পরে অন্য সূত্রে জানতে পারি, নজরুল-রচনাবলীর সম্পাদনা পরিষদ পুনর্গঠিত হয়েছে এবং তাতে আগের সম্পাদনা-পরিষদের যে পাঁচজনকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আমি একজন, আর নতুন যে-দুজন যুক্ত হয়েছেন, তার মধ্যে আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ একজন। সম্পাদনা পরিষদ পুনর্গঠনের অধিকার তো একাডেমীর আছেই, তবে তা নিয়ে লুকোচুরি খেলতে হবে কেন?
নজরুল ইন্সটিটিউটের কথায় ফিরে যাই। দু-বছর কার্যকাল শেষ করে মনিরুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলে ১৯৯৩ সালে নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালকরূপে আবার যোগ দেন মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। ১৯৮৫ সালে ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদেই নিযুক্ত ছিলেন। তিনি চাইলেন কবির ছবির একটা অ্যালবাম প্রকাশ করতে এবং এর জন্যে সরকারের বিশেষ অনুদানও পেয়ে গেলেন। নজরুল-অ্যালবাম প্রকাশের জন্যে তিনি একটি কমিটি গঠন করলেন আমাকে আহ্বায়ক করে। ট্রাস্টি বোর্ডের তিনজন সদস্য-ওয়াকিল আহমদ, রফিকুল ইসলাম এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব তাজুল ইসলাম–থাকলেন এই কমিটির সদস্য, আর মাহফুজুউল্লাহ্ হলেন তার সদস্য-সচিব। ছবি সংগ্রহ করতে এবং বাছাই করতে কিছু সময় লেগেছিল। চারটি ছবি আমি জোগাড় করে দিই–বন্ধু আবদুল আলীর বড়ো ভাবি বেগম এ জেড এম আব্দুল আলিমের কাছ থেকে তিনটি আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ইরশাদ কামালের কাছ থেকে একটি। নজরুল-অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। অ্যালবামের শিল্প-নির্দেশনা দিয়েছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। আমি এর মুখবন্ধ লিখেছিলাম, তা পড়ে মাহফুজউল্লাহ্ বলেছিলেন, আপনি কবিতা লিখলে পারতেন!’ তবে তা বোধহয় কেবল বন্ধুত্বের অনুরোধে।
১৯৯৪ সালের মে মাসে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ইন্তেকাল করেন। নজরুল ইন্সটিটিউটে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ওবায়েদ-উল-হক। ওদিকে মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ্র কার্যকাল শেষ হলে মুহম্মদ নুরুল হুদা সে-জায়গায় এলো ১৯৯৬ সালে। সে প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে শুরু করলো এবং খুব জোর দিলো প্রকাশনার বিষয়ে। পর বছর সভাপতির কার্যকালও শেষ হয়ে যায়। ওবায়েদ-উল-হকের শরীরও খুব ভালো যাচ্ছিল না, তাঁর পক্ষে সভায় যোগদান করাও একটু কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। এই অবস্থায় তার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সংস্কৃতি-সচিব সৈয়দ ইউসুফ হোসেন আমার কাছে প্রস্তাব করে। আমি তেমন আগ্রহ প্রকাশ না করায় সংস্কৃতি-প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের টেলিফোনে আমার কাছে একই অনুরোধ জ্ঞাপন করে। সে বলে, পর বছর থেকে নজরুল জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের সূচনা হবে এবং তার খুবই ইচ্ছা যে, এই উদ্যাগে আমি নেতৃত্ব দিই। নিজের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থেকেও শেষ পর্যন্ত আমি সে-অনুরোধ রক্ষা করি। দায়িত্ব নেওয়ার কিছুকাল পরে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে, আমি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আবারো ওবায়দুল কাঁদেরের আন্তরিক ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে পদত্যাগপত্র পাঠানো থেকে বিরত হই।
যথাসময়ে নজরুল-জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করে জাতীয় কমিটি গঠিত হলো। পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় জাতীয় সংসদের স্পিকার, সাত-আটজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, বিরোধী দলের উপনেতা (ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী), চার মহানগরের মেয়রসহ
আরো আঠারোজন যুক্ত হলেন। বেগম সুফিয়া কামাল সভাপতি, ওবায়দুল কাদের। নির্বাহী সভাপতি। শেখ হাসিনার তিন শিক্ষক–রফিকুল ইসলাম, আমি ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সহ-সভাপতি। ২০১ জনকে নিয়ে কমিটি করার কথা ভাবা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তা ২০৫ জনে গিয়ে দাঁড়ালো। কমিটি বড়ো হয়ে যাওয়ায়। একটি স্টিয়ারিং কমিটি বা কর্মপরিচালনা-পরিষদ গঠনের আবশ্যকতা দেখা দিলো। জাতীয় কমিটির নির্বাহী সভাপতিই তার সভাপতি, তিন সহ-সভাপতি বিরাজমান, শিল্পী-সাহিত্যিক-অধ্যাপক এবং সরকারি-আধাসরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মিলে মোট ৩৩ জন। জাতীয় কমিটির সদস্য-সচিব মুহম্মদ নুরুল হুদা এখানেও সদস্য-সচিব। তার আগ্রহে সবার অতিরিক্ত দুজন প্রতিবেদক এতে যুক্ত হলেন। জাতীয় কমিটির সভায় লোকজন বেশি হয় না; অসুস্থ সভাপতি তেমন আসতে পারেন না, কর্মব্যস্ত নির্বাহী সভাপতিও সাধারণত সময় দিতে পারেন না। সভাপতির আসন গ্রহণ করে রফিকুল ইসলাম দোর্দণ্ডপ্রতাপে সভা চালিয়ে যান। তিনি যা বলেন, নুরুল হুদা তাতে সায় দেন। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বেশি কিছু বলেন না, আমি প্রায় নীরবেই থাকি। তাতে শবনম মুশতারী কোনো এক পত্রিকায় লিখেছিল, জাতীয় কমিটিতে আমার ভূমিকা মৃত সৈনিকের। আমি যে তাতে অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম, তা নয়।
কবির জন্মশতবর্ষ-উপলক্ষে নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে অন্তত শখানেক বই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিল নুরুল হুদা। যেসব বিষয়ে ফরমায়েশি বই লেখানো হবে, তারও একটা তালিকা সে করেছিল। আলাপ-আলোচনার পর ট্রাস্টি বোর্ডে স্থির হলো যে, এ-ধরনের বই লেখানোর জন্যে কয়েক মাসের বৃত্তি দিয়ে কয়েকজন তরুণকে নিযুক্ত করা হবে এবং যারা তাদের কাজ তত্ত্বাবধায়ন করবেন, তাঁরাও উপযুক্ত সম্মানী পাবেন। এই লক্ষ্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে আবেদনপত্র। আহ্বান করা হলো, প্রার্থী বাছাই করতে একটি নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হলো, আমিও তাতে–সদস্য কিংবা সভাপতি হিসেবেই–থাকলাম। প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের সময়ে এক পণ্ডিত একজন প্রার্থীকে এত বেশি নম্বর দিলেন যে, আমরা বাকিরা পরস্পরের দিকে তাকাতে থাকলাম এবং সকল শিষ্টাচার ভঙ্গ করে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম যে, সত্যিই তিনি ওই প্রার্থীকে অত নম্বর পাওয়ার উপযুক্ত বিবেচনা করেন কি না। সত্যি সত্যি উপযুক্ত মনে করলে ভদ্রলোকের উচিত হতো আমার কথার প্রতিবাদ করা। তা না করে তিনি শান্তভাবেই বললেন যে, নিজের বিবেচনামতোই নম্বর তিনি দিয়েছেন। বাকিরা সেই প্রার্থীকে কম নম্বর দিলেও যোগফলে সে-ই অগ্রাধিকার পেলো।
আমার তত্ত্বাবধানে দুজন কাজ করেছিল। নজরুলের চিকিৎসা বিষয়ে ডা. গৌতম দত্ত এবং নজরুল-সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক বিচার সম্পর্কে সালাহউদ্দীন। আইয়ুব। আর যারা এই গবেষণা-প্রকল্পে কাজ করে বই লিখেছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিল শাহনাজ মুন্নী–এখন প্রথিতযশা টেলিভিশন-সাংবাদিক ও ছোটো গল্পকার।
শতবর্ষ-উপলক্ষে নজরুলের বইপত্রের অনেকরকম পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে। মুদ্রাকরেরা স্বনামে-বেনামে টেন্ডার দিয়ে কূল পাচ্ছিল না। ইন্সটিটিউটের গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিল। নুরুল হুদার ব্যস্ততা ও উৎসাহেরও সীমা ছিল না। উৎসাহবশত সে এমন একটি কাজ করে বসলো যা আমি সংগত বিবেচনা করিনি, কিন্তু বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগও পাইনি। সে একটা মস্ত বড়ো সারণি তৈরি করে দেখাল যে, জন্মদিন ও জন্মবার্ষিকী আলাদা। যেদিন কেউ জন্ম নেয়, সেদিনই তার প্রথম জন্মদিন, আর পরের বছর ওই তারিখ হচ্ছে তার প্রথম জন্মবার্ষিকী। বাংলায় জন্মদিন কথাটা ইংরেজি বার্থডের অনুবাদ। বার্থডের মুখ্য অর্থই জন্মবার্ষিকী, নিতান্ত গৌণ অর্থেই যেদিন জন্মায় তা সূচিত করে। যেদিন জন্মায় সেদিন বোঝাতে ডেট অফ বার্থ কথাটাই ব্যবহৃত হয়। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালে, তাই ১৯৬১ সালেই বিশ্বব্যাপী তাঁর জন্মশতবর্ষ পালিত হয়েছিল। কিন্তু নুরুল হুদার সারণিতে ১৮৯৯ সালে নজরুলের প্রথম জন্মদিন, ১৯০০ সালে প্রথম জন্মবার্ষিকী। অতএব ১৯৯৯ সালে–যখন কবির শতবর্ষ পালিত হওয়ার কথা–তখন তার ৯৯তম জন্মবার্ষিকী এবং ২০০০ সালে শততম জন্মবার্ষিকী। এমনিতেই ভাবা হয়েছিল, নজরুল জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান ১৯৯৮তে শুরু হয়ে ১৯৯৯ পর্যন্ত চলবে। নুরুল হুদার গণনায় ২০০০ সালে শতবার্ষিকী পালনীয় হয়ে গেল। অতএব, শতবর্ষ উদ্যাপন চলল ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল অবধি।
নজরুল-জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানমালা শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ২৫ মে (১৪০৫ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) সকালে, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে। মূল অনুষ্ঠান ছিল তিন দিনের। ঢাকার সঙ্গে সঙ্গে ত্রিশাল, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামেও তিন দিনের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ঢাকায় যখন অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা, আমাদের ভাগ্যদোষে তার একটু আগেই বিদ্যুৎ-সরবরাহে বিঘ্ন ঘটল। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি–তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মকর্তারা। অনুষ্ঠানস্থলে বিদ্যুৎ-সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তাকে ঘর থেকে রওনা হতে দিলেন না। বিদ্যুৎ এলো, শেখ হাসিনা এলো আরো পরে। শিল্পীরা এবং অতিথিরা ঘর্মাক্তকলেবর হয়ে অতিষ্ঠ। তবে অনুষ্ঠান ভালো হয়েছিল। সুফিয়া কামাল আসতে পারেননি, তাঁর লিখিত সভাপতির ভাষণ অন্য কেউ পড়ে দিয়েছিল। সংস্কৃতি-সচিব ড. শামসুজ্জামান মজুমদার স্বাগত ভাষণ দেন লিখিত আকারে, রফিকুল ইসলামের নজরুল-জন্মশতবর্ষ বক্তৃতাও ছিল লিখিত। প্রধান অতিথির উদৃবোধনী ভাষণ এবং ওবায়দুল কাদের, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও আমার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা ছিল মৌখিক। নৃত্যগীতবাদ্যআবৃত্তি মানসম্মত হয়েছিল। বেতারে-টেলিভিশনে-সংবাদপত্রে প্রচারও হয়েছিল ভালো।
পরের বছরে, যথার্থ শতবর্ষে, অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল ১৭ বৈশাখ থেকে ১১ জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত। কী হিসাবে, তা আর এখন মনে নেই। প্রথম দিনে জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে সম্মেলনমালা’ উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। পদাধিকারবলে বক্তাদের মধ্যে কিছু যোগবিয়োগ ঘটেছিল। আমার নতুন পদবি জুটেছিল নজরুল-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আহ্বায়ক বলে। প্রধান অতিথির আগে আমরা জনাদশেক বক্তৃতা দিয়েছিলাম, তার পরে সভাপতির ভাষণ দিয়েছিল ওবায়দুল কাদের। অনুষ্ঠান ভালো হলেও এবারে প্রচার ভালো হয়নি। সেদিন ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশ হারিয়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়েকে। সব প্রচারমাধ্যমে সে-খবরই প্রাধান্য পেয়েছিল। তবে ১১ জ্যৈষ্ঠে ওসমানী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় মূল অনুষ্ঠান। তাতে প্রধান অতিথি ছিলেন শেখ হাসিনা। সে-অনুষ্ঠানের প্রচার মন্দ হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্মেলন তেমন আন্তর্জাতিক না হওয়ায় তাকে বলা হয়েছিল প্রস্তুতি পর্ব। এর একটি অধিবেশন হয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে, বাকি তিনটি নজরুল ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে। অধিবেশনগুলোতে সভাপতিত্ব করেন যথাক্রমে খান সারওয়ার মুরশিদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবু রুশদ ও কবীর চৌধুরী।
জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের সমাপ্তি ঘটে ২০০০ সালে ২৫ থেকে ২৭ মে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। প্রায় প্রথমবারের পুনরাবৃত্তি। তবে লোকজনের উৎসাহ ছিল প্রচুর। শিল্পীরা পূর্বাপর মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছিলেন। ঢাকার বাইরে সেবারও অনেক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ততদিনে নজরুল ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতির দায়িত্বপালন আমার শেষ হয়েছে।
৪৯.
শিকাগো থেকে বন্ধু রালফ নিকোলাসের চিঠি। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা স্বতন্ত্রভাবে একটি এশীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে যাচ্ছে। তার সম্পাদকমণ্ডলীতে থাকতে আমার সম্মতি আছে কি না জানতে চায়। ১৯৭০ সালে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় লেখার সুযোগ পেয়েও পরিস্থিতির কারণে তা হারানোর দুঃখ আমার মনে ছিল। কালবিলম্ব না করে র্যালফকে জানালাম, আমি রাজি। তার পরপরই আনুষ্ঠানিক চিঠি এলো শিকাগোতে ওই বিশ্বকোষের সদর দপ্তর থেকে। সেটা ১৯৯৮ সালের কথা।
সম্পাদকমণ্ডলী গঠিত হয়েছিল ভারত থেকে বিশিষ্ট পণ্ডিত কপিলা বাৎস্যায়ন, ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার, ভূগোলবিদ সত্যেশ চক্রবর্তী ও এক বিজ্ঞানী, পাকিস্তান থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক রফিক মুঘল, শ্রীলঙ্কা থেকে পেরোনিয়া ইউনিভার্সিটির ভাইস-চান্সেলর ইতিহাসবিদ লেসলি গুণারত্নে, বাংলাদেশ থেকে আমাকে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে রালফ নিকোলাস এবং আরো একজন সমাজবিজ্ঞানী নিয়ে। দিল্লিতেই সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠক হতো। সে-সময়ে ব্রিটানিকার সদর দপ্তর থেকে একজন সম্পাদক নিয়মিত যোগদান করতেন। আবাসিক সম্পাদক ছিল ইন্দু রামচন্দ্রানী। সে যে কোনো বিশেষ ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ, তা নয়, তবে প্রকাশনা-সংস্থায় সম্পাদক হিসেবে তাঁর দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা আছে।
ব্রিটানিকার ব্যবস্থাপনা ছিল খুব উল্লেখযোগ্য। বিমানে আমাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল বিজনেস ক্লাসে। দিল্লিতে থাকা ইন্ডিয়ান হ্যাঁবিটাট সেন্টারে। স্থানীয়ভাবে চলাফেরা দিল্লি অফিসের সৌজন্যে ভাড়া-করা সার্বক্ষণিক গাড়িতে। সম্পাদকীয় বৈঠক হতো দু দিন ধরে।
বাংলাদেশের নানান দিক নিয়ে লেখা সংগ্রহ ও সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল আমার। অনেকের লেখা পেয়েছিলাম। সংগৃহীত রচনার লেখক-তালিকাকে র্যালফ তুলনা করেছিল ‘হুজহু’র সঙ্গে। দুটো লেখার ভার ছিল আমার ওপরে। তার একটি বাংলা ভাষা সম্পর্কে। সেটি জমা দেওয়ার পরে ব্রিটানিকা জুনিয়র এনসাইক্লোপিডিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। অপর লেখাটি বাংলাদেশের সাহিত্য-বিষয়ে–সেটা শেষ পর্যন্ত লেখা হয়নি।
কিছুকাল পরে একটা সমস্যা দেখা দিলো। লেসলি হয়ে গেল শ্রীলঙ্কার শিক্ষামন্ত্রী, ফলে তার পক্ষে আর সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় যোগ দেওয়া সম্ভবপর হলো না। ওদিকে ভারতীয় ভিসা পেতে প্রায়ই রফিক মুঘলের অসুবিধে হচ্ছিল। তিনিও আর আমাদের বৈঠকে নিয়মিত আসতে পারছিলেন না। ইন্দু রামচন্দ্রানীর কাজেকর্মে অসন্তুষ্ট হয়ে সত্যেশ চক্রবর্তী একদিন পদত্যাগের হুমকি দিলেন, অবশ্য তাঁকে নিরস্ত করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি।
ইন্দুর সঙ্গে আমার সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল খুব ভালো। আমাদের প্রথম সম্পাদকীয় সভারও আগে আমি দিল্লিতে গিয়েছিলাম একবার–বোধহয় খুশী কবিরের উদযোগে সহমতের সভায় খুশী আর চিত্রনির্মাতা শামীম আখতারের সঙ্গে–ছিলাম ইন্ডিয়া হ্যাঁবিটাট সেন্টারে। খবর জেনে ইন্দু এসে সেখানেই আমাকে লাঞ্চ খাওয়ালো এবং হোটেল থেকে আমি আমাদের হাই কমিশনের প্রেস কাউনসিলর আতিকুর রহমানের বাড়িতে স্থানান্তরিত হবো জেনে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তার গাড়িতে সেখানে সে আমাকে পৌঁছে দিল। তার গাড়িতে আমি কোট ফেলে যাওয়ায় সে-বাড়িতে সে দ্বিতীয়বারও এলো কোনোরকম বিরক্তি প্রকাশ না করে। তারপর তো কয়েকটি সম্পাদকীয় বৈঠকে দেখাসাক্ষাৎ। ইন্দু এবারে ঢাকায় এলো এবং আমাকে অনুরোধ করলো এখানে তার থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। ব্যবস্থা করলাম শেরাটনে, ডিসকাউন্টও পাওয়া গেল। ঢাকায় ইন্দুকে কে যেন বললো, ওই পয়সায় সে সোনারগাঁও হোটেলেই থাকতে পারতো। তাতে আমার প্রতি সে একটু বিমুখ হলো। তার কোনো পরিচিত ভদ্রলোক তাকে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করবেন কস্তুরীতে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে কস্তুরীতে হাজির। দেখি, কেউ নেই। খানিক পরে ফোন করে জানলাম, ওরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে নিমন্ত্রণকর্তার মতিঝিল অফিসে, সেখানেই নাকি সবার মিলিত হওয়ার কথা ছিল। আমার তো সেকথা কিছুতেই মনে পড়ল না। আমি যতই বলি, দেখো, আমার তো ইউনিভার্সিটি থেকে আসার কথা–আমি কেন পুরানা পল্টন ছেড়ে মতিঝিলে গিয়ে সবার সঙ্গে আবার কস্তুরীতে আসতে চাইব, তাতে কোনো কাজ হলো না। ইন্দু ভাবল, আমি যথেষ্ট গুরুত্ব দিইনি তাকে। পরে দিল্লিতে একদিন সে বলছিল, অটলবিহারী বাজপেয়ী ছিলেন জওহরলাল নেহরুর মন্ত্রিসভার সদস্য। আমি বললাম, কথাটা ঠিক নয়। এ নিয়ে তর্ক, তার মুখ ভার। তারপর একদিন সে আমার সংগৃহীত একটি লেখা হারিয়ে ফেললো–আমি তাকে বললাম, ভদ্রলোকের কাছে আরেকবার লেখা চাইতে আমার খুব খারাপ লাগবে, তিনিই বা কী ভাববেন! তাতে সে মন খারাপ করলো। ওদিকে ব্রিটানিকা জুনিয়র এনসাইক্লোপিডিয়ায় আমার লেখা ছাপা হয়ে গেছে, সে আমাকে একসেট বই দিতে গড়িমসি করছে, তাতে আমি তার প্রতি বিরক্ত। এই অবস্থায় আমাকে না জানিয়ে বাংলাদেশ থেকে সে একজনের লেখা চাওয়ায় আমি ঠিক করলাম, আর এই প্রকল্পের সঙ্গে আমি যুক্ত থাকব না। সে অবশ্য বললো, সে আমাকে ই-মেইল করে ব্যাপারটা জানিয়েছিল, আমার উত্তর না পেয়ে ধরে নিয়েছে, আমার সম্মতি আছে।
মাঝে আমি র্যালফকে একবার বলেছিলাম, ইন্দুর সঙ্গে কাজ করতে আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করছি না। র্যালফ ভালোমানুষ, সে বলে, ইন্দু অনেক চাপের মধ্যে কাজ করে, তাই সবসময়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না–তুমি নিজগুণে ক্ষমা করে দিও। এবারে র্যালফকে কিছু না বলে আমি সরাসরি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলাম শিকাগোতে, ব্রিটানিকার সদর দপ্তরে মনে হয় ২০০০ সালে। লিখলাম, আমার মনে হয়, ইন্দু আর আমি পরস্পরকে ঠিকমতো বুঝতে পারিনে। আবাসিক সম্পাদক হিসেবে তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে–সুতরাং সম্পাদকমণ্ডলী থেকে আমার নামটা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।
সত্যেশদা আমায় বললেন, তুমি পদত্যাগ করে ঠিক করোনি, পদত্যাগের ভয় দেখালেই পারতে। পরে রমিলা আমাকে জানিয়েছিল, ইন্দুর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে সে-ও ওই প্রকল্পের সঙ্গে তার সম্পর্ক রাখেনি। আরো পরে জানলাম, প্রকল্পটা বাতিল করা হয়েছে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনের দ্বিতীয় সুযোগটাও এভাবে নষ্ট হলো।
৫০.
যেবার সহমতের সম্মেলনে গিয়েছিলাম, সেবারই নিজের হৃদয়ঘটিত সমস্যার কারণে দিল্লির এসকর্ট হাসপাতালের দ্বারস্থ হলাম। এমনই দুর্ভাগ্য যে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগের দিনই ডলারের ওয়ালেটটা হারিয়ে ফেললাম। খবর শুনে মিসেস মুলে আমার চিকিৎসার ব্যয়নির্বাহের জন্যে প্রায় চাঁদা তোলারই আয়োজন করেছিলেন, অতি কষ্টে তাঁকে নিবৃত্ত করা গেল এই কথা বলে যে, আমার ভায়রা হাসান এই মুহূর্তে এসকর্টেই আছে। সে বের হলে আমি ঢুকব। আমার চিকিৎসার খরচ আপাতত তার কাছ থেকেই নেওয়া যাবে। মিসেস মুলের আরেক পরিচয়, তিনি খ্যাতনামা অভিনেতা সুহাসিনী মুলের মা। তাঁদের সঙ্গে আমার আলাপ হয় তার আগের বছর–সেকথা পরে বলছি।
প্রাথমিক পরীক্ষার পর সাব্যস্ত হয় যে, আমার অ্যানজিওগ্রাম করতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় টাকাপয়সা জমা দেওয়ার পরই ক্যাশিয়ার মেয়েটি জানালো, এখানে জায়গা নেই, কাল সকাল বেলায় হাসপাতালে আমি হাজির হলে চলবে। আমার ভায়রা হাসান বললো, তাহলে তোমরা হাসপাতালে থাকার যে খরচটা নিয়েছ, সেটা ফেরত দাও, সেই পয়সা দিয়ে উনি কোনো হোটেলে থাকবেন। মেয়েটি বললো, পয়সা ফেরত দেওয়ার নিয়ম নেই, তোমাদের ব্যবস্থা তোমাদেরই করতে হবে। অগত্যা আতিকুর রহমানের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়া।
খুব সকালে হাসপাতালে এসে ওয়েটিং রুমের মতো একটি জায়গায় অনেকক্ষণ বসে থাকা। তারপর কাপড় বদলিয়ে ট্রলিতে করে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া, বিছানায় শোয়ানো। তখনই কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম : কী সার, আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছেন!’ আরে, এ তো ঢাকায় আমার কার্ডিওলজিস্ট ডা. সোহরাবউজ্জামানের গলা। বললাম, এক মাস ধরে আপনাকে খুঁজে পেলাম না, আর আপনি এখানে!’ তিনি জানালেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফেলোশিপ নিয়ে তিনি এখানে এসেছেন কিছুকালের জন্যে, আমার অ্যানজিওগ্রাম করার দায়িত্ব তারই। ভালোই হলো।
অ্যানজিওগ্রাম হয়ে গেল। এবারে একটা ট্রলিতেই আমাকে শুইয়ে রাখা হলো বারান্দায়। বহুক্ষণ পরে দুই শয্যাবিশিষ্ট কেবিনের একটিতে আমাকে আশ্রয় দেওয়া হলো–বোধহয় ঘণ্টাখানেকের জন্যে। রিপোর্ট যা পাওয়া গেল, তার মর্ম এই যে, আমার ধমনীতে ব্লক আছে, তবে এখনই কিছু করার দরকার নেই।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আবার আতিকুর রহমানের বাড়ি।
আতিকুর রহমানের দিল্লির বাড়িতে আমি একাধিকবার থেকেছি। তারা স্বামী-স্ত্রী সজ্জন মানুষ, খুবই অতিথিপরায়ণ। আমাকে যথেষ্ট যত্নে রেখেছিলেন। ১৯৭১এ আতিক কাজ করতেন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়। আমার ছাত্র চৌধুরী মঈনুদ্দীন ছিল তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মী। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মঈনুদ্দীন আতিকের ঠিকানা চেয়েছিল। এটা স্বাভাবিক মনে না হওয়ায় আতিক তাকে অন্য একটা ঠিকানা দিয়েছিলেন। কয়েকদিন পরে সেই ভুল ঠিকানায় আল বদর বাহিনী হানা দিয়েছিল আতিকের খোঁজে। আমার ছাত্র মঈনুদ্দীন, পরে জানা যায়, তখন ছিল ওই বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ। তার এবং আমার শিক্ষক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে সে-ই ধরে নিয়ে যায়, তিনি আর কখনো ফিরে আসেননি।
এবার মুলেদের কথা বলি।
আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু তপন বোস ভাগ্যবান মানুষ। একাদিক্রমে তিনবার বিয়ে করেছে। তার প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত কন্যার বিয়েতে যোগ দিতে দিল্লি গিয়েছিলাম। তপন চিত্রনির্মাতাও। বিয়েতে অতিথিদের মধ্যে দুই বিখ্যাত তারকা নাসিরউদ্দীন শাহ্ ও সুহাসিনী মুলেকে দেখে তাই অবাক হইনি। খানিক পরে জানতে পারি, সুহাসিনী ছিল তপনের দ্বিতীয় স্ত্রী, বিয়েবাড়িতে তার মাও উপস্থিত ছিলেন। বনফুলের কাহিনি-অবলম্বনে মৃণাল সেনের বিখ্যাত ছবি ভুবন সোমে সুহাসিনীর অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছিল। নাসিরউদ্দীন শাহ ও মিসেস মুলের সঙ্গে আলাপ করলাম বটে, তবে বেশি সময় দিলাম সুহাসিনীকে–তাতে কোনো বাধাও অনুভব করলাম না। মিসেস মুলেও আমাকে বেশ সহৃদয়তার সঙ্গে গ্রহণ করলেন।
সুহাসিনীর সঙ্গে আমার ভাব এমনই জমে গেল যে, পরেরবার দিল্লিতে দেখা হলে আমরা আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলাম। সে খুব গল্প করতো সত্যজিৎ রায়ের সহকারী হিসেবে তার কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে। সে বলতো, রোজ সকালে কলকাতায় স্টুডিও যাওয়ার পথে একটা মিষ্টির দোকান পার হতে হতো তাকে–সেখানে ওই সকালেই সদ্য তৈরি সন্দেশ সে খুব উপভোগ করতো–এমন দিন ছিল না যেদিন সে তা খায়নি। আমাকে বললো, ‘ঢাকা থেকে আবার যখন আসবে, আমার জন্যে কাঁচা সন্দেশ নিয়ে এসো।’
আমি যেবার তার কথা রাখতে পারলাম, সেবার সে বুম্বাই গিয়েছিল। সন্দেশ অন্য কাউকে দিয়ে এসেছিলাম। তারপর বেশ কিছুদিন বাদে আবার দিল্লি গেছি–সুহাসিনীর হাতে এবার সন্দেশ দিতে পারলাম। তবে বেশ বুঝতে পারলাম, ততদিনে সে আমাকে ভুলে গেছে।
৫১.
১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে কলকাতা বইমেলা উদবোধন করলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে গেল বিরাট এক দল–লেখক, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক, আমলা। কলকাতায় আমাদের ডেপুটি হাই কমিশনার তখন জালাল আহমেদ। ষাটের দশকের শেষদিকে তিনি যখন টোকিওতে দৈনিক ইত্তেফারে প্রতিনিধি, তখন থেকে তাঁকে চিনি। তার স্ত্রী আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রী ছিল। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি তাদের দুজনকে এতই অভিভূত করেছিল যে, অন্য কোনোদিকে নজর দেওয়ার অবস্থা তাদের কারো ছিল না। ফলে, প্রধানমন্ত্রীর সহচর ছাড়া, বাকিদের থাকা-খাওয়া চলা-ফেরায় বেশ অসুবিধে হয়েছিল। সাংবাদিকেরা এই অব্যবস্থায় যথেষ্ট ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং এ-সম্পর্কে কাগজে লিখতে দ্বিধা করেননি।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন বইমেলায় উপস্থাপনের জন্যে মূল প্রবন্ধ লিখতে। বই এবং বইমেলা সম্পর্কে প্রবন্ধ একটা সঙ্গে নিয়েছিলাম, কিন্তু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেটা উপস্থাপনের কোনো সুযোগই হয়নি। উদ্ববাধনী অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা উদ্ববাধক, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। সভাপতি, আরো কয়েকজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অংশগ্রহণকারী। তার কর্মসূচিতে কোনো প্রবন্ধ-উপস্থাপনের সুযোগ ছিল না। আমি বিষয়টা মেনেও নিলাম, কিন্তু আমাদের কয়েকজন বন্ধু এ-নিয়ে ভয়ানক আপত্তি তুললেন। ফলে একটা অধিবেশনের ব্যবস্থা হলো এবং আমি প্রবন্ধ পড়লাম।
এর চেয়ে বেশি বিপত্তি ঘটল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ঘোষণা নিয়ে। সঞ্চালক শেখ হাসিনার পরিচয় দিলেন বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রী বলে। আমাদের সকলেই বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। এ-নিয়ে দেশে বিরোধী দল বেশ কথা বলার সুযোগ পেয়ে গেল। তাদের নেত্রী বললেন, ‘উনি ভারতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, ফিরলেন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে।’ পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ-নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করেছিল, ভারত সরকারও নাকি দুঃখ প্রকাশ করেছিল।
মেলার শেষে শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে গিয়েছিল চুরুলিয়া ও শান্তিনিকেতনে। নজরুলের উদ্দেশে সম্মান জানিয়ে এসেছিল রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানাতে। বিশ্বভারতী তাকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে।
শেখ হাসিনার প্রসঙ্গে আরেকটি কথা দিয়ে শেষ করি। সেই বইমেলার কয়েক মাস পরে জাতীয় জাদুঘরে তার সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল এক অনুষ্ঠানে। তারই সৌজন্যে তার পাশেই বসেছিলাম। একটা বিরতির সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কোনো কর্তাব্যক্তি তার কাছে এসে সংগোপনে কিছু বলে গেলেন। তিনি চলে গেলে হাসিনা আমাকে বললো, প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদত্যাগ করেছেন, আমি জানার আগেই সাংবাদিকদের তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ছে।
কিছুদিন ধরেই সরকারদলীয় ব্যক্তিরা মোহাম্মদ আবু হেনার সমালোচনায় নানা কথা বলছিলেন। আবু হেনাও ছুটি নিয়ে অনেকদিন বিদেশে থেকে এলেন। আমার ধারণা হয়েছিল, সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল। না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল আমরা একসঙ্গেই শিক্ষকতা করেছি। আমি তাঁকে জানি একজন সজ্জন ও বিবেচক মানুষ হিসেবে। ১৯৯৬ সালে নির্বাচন পরিচালনায় তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন এবং বিরোধী দলের অন্যায় সমালোচনার মুখে পড়েন। তাতে অবশ্য তিনি অবিচলিত ছিলেন। এখন তাঁর ‘অসুস্থতাজনিত’ পদত্যাগের ঘটনা এমনভাবে ঘটলো যে, এটা আর পুনর্বিবেচনার সুযোগ রইল না।
শেখ হাসিনাকে আমি বললাম, ‘তুমি বিরোধী দলের নেত্রীকে আমন্ত্রণ জানাও পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রশ্নে আলাপ করতে।’
হাসিনা বললো, ‘উনি আসবেন না।’
আমি বললাম, সেক্ষেত্রে তুমি বলতে পারবে, এ-বিষয়ে একমত হওয়ার চেষ্টা তুমি করেছিলে। যদি উনি আসেন এবং তোমরা একমত হতে পারো, তাহলে সকলেই স্বস্তি পাবে। যদি উনি না আসেন কিংবা একমত না হন, তখন নিয়োগের ব্যাপারটা তোমার হাতেই রয়ে যাবে।’
সামান্য একটু ভেবে নিয়ে হাসিনা কথাটা মানলো। তার দপ্তরের একজন কর্মকর্তাকে ডেকে বললো, নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিষয়ে পরামর্শের জন্যে বিরোধী দলের নেত্রীকে একটা সময় দিয়ে আমন্ত্রণ পাঠিয়ে দিন।
শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে আমি এই একবারই তাকে অযাচিত পরামর্শ দিয়েছিলাম এবং সেটা সে গ্রহণ করেছিল। পরে আরেকবার তাকে কিছু বলেছিলাম, কিন্তু কথাটা তার মনঃপূত হয়নি।
বিরোধী দলের নেত্রী অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। প্রধানমন্ত্রী তখন নিজের অভিপ্রায়-অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছিলেন।
৫২.
২০০০ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলার সময়ে হুমায়ূন আহমেদ জানালো, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংকট নিয়ে সে পরিবারের লোকজনসমেত সেখানে একদিনের প্রতীকী অনশন ধর্মঘট করতে যাচ্ছে।
শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবালের নেতৃত্বে জাহানারা ইমামের নামে সদ্যনির্মিত একটি আবাসিক হলের নামকরণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এ-নিয়ে তারা উগ্রপন্থীদের আক্রমণের শিকার হন এবং তার প্রতিবাদে তারা অবিরাম ধর্মঘট করতে শুরু করেন। আক্রান্ত শিক্ষকদের দাবির সমর্থনে হুমায়ূন অনশনের চিন্তা করে।
হুমায়ূনের কথা শুনে আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, ‘যদি পরিবারের বাইরের লোকজন সঙ্গে নাও, তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে যেতে পারি।’
হুমায়ূন বললো, ‘আপনি গেলে খুব খুশি হবো। আপনাকে আমি পরিবারের বাইরে ভাবি না।’
২৫ মার্চ রাতের ট্রেনে আমরা সিলেটে রওনা হলাম। হুমায়ূনের দলে অনেক মানুষ, বেশিরভাগ ওর পরিবারের বাইরে। অন্যদিরে সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম আছে সদলবলে, অনেক তরুণ-তরুণীও যোগ দিয়েছে। ট্রেনের কয়েকটা কামরা রিজার্ভ করা হয়েছে, কমলাপুর স্টেশনে নিরাপত্তার বিশাল ব্যবস্থা।
সিলেটে পৌঁছে দেখা গেল, সেখানেও নিরাপত্তার আয়োজন খুব বিশাল। বাংলা একাডেমির ওবায়দুল ইসলাম–আমার ছাত্র-আমাকে নিয়ে গেল তার শ্বশুরবাড়িতে মুখহাত ধুয়ে নাশতা খাওয়ার জন্যে। হোটেলে অবশ্য থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল, তবে ওবায়েদের কথামতো আগে ওর সঙ্গে গেলাম, পরে এলাম হোটেলে।
হুমায়ূন শাহজালালের মাজার জিয়ারত করে তার কর্মসূচির সূচনা করলো। আমরা অনেকে সরাসরি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলাম। সেখানে এবং সারা পথেই পুলিশ প্রহরা। অনশনকারীরা একরকম পুলিশ প্রহরায়।
হুমায়ূনের সঙ্গে ওর ভাইবোনেরা আছে, ওর মাও। মাজহারের সঙ্গে একদল। হায়াৎ মামুদ ও প্রকাশক আলমগীর রহমান একসঙ্গে। ওবায়েদের সঙ্গে আমি।
আমরা বসে থাকতে থাকতে উপাচার্য অধ্যাপক হাবিবুর রহমান এলেন। তিনি ভালোমানুষ, কেউ কেউ অবশ্য তাকে ভুল বুঝছে।
বেতার-টেলিভিশন-সংবাদপত্রের সংবাদদাতাদেরও বিরাট বাহিনী। পুলিশের পাহারা সত্ত্বেও কৌতূহলী মানুষেরও ভিড় কম নয়। কেউ কেউ নজর রাখছেন অনশনকারীরা লুকিয়ে কিছু খেয়ে ফেলছে কি না তা দেখতে। সামনের একটা বাড়িতে অনেকে যাচ্ছিল টয়লেট ব্যবহার করতে। সেটা খানিকটা সন্দেহের উদ্রেক করে।
হুমায়ূন একটা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাঠ করেছিল। তাতে জানানো হয়েছিল, ‘শাহজাল বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার জন্য’ এই অনশন।
অনশনের সময় শেষ হলে সবাই হুড়মুড় করে হোটেলে ফিরে গেল। আমি একা পড়ে থাকলাম। পুলিশের এক কর্মকর্তা আমাকে লক্ষ করে ফেরার ব্যবস্থা করে দিলেন।
সেই রাতেই আমরা ট্রেনে ঢাকার পথে রওনা হলাম।
তার কয়েকদিন পর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঢাকায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসে এলেন। তিনি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন, হুমায়ূনকে বুঝিয়ে আন্দোলনের ইতি টানার। নইলে, তার আশঙ্কা, বড়ো ধরনের গোলযোগ হবে এবং তা সামলানো তাঁর পক্ষে অসাধ্য হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়বে।
আমি হুমায়ূনকে কথাগুলো জানালাম। হুমায়ূন এই সংকট নিয়ে আর কোনো কর্মসূচি হাতে নেয়নি।
৫২.
২০০০ সালে আমার তিনটি বই প্রকাশিত হয় : অন্যপ্রকাশ থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ, শিখা প্রকাশনী থেকে পূর্বগামী এবং সাহিত্য প্রকাশ থেকে বাঙালি নারী : সাহিত্যে ও সমাজে। এর আগের বছর অন্যপ্রকাশ থেকে বের হয় আমার চোখে এবং আগামী প্রকাশনী থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর। আমার লেখা বই বছরে একটা প্রকাশ পায় কি না সন্দেহ (১৯৯৭তে সাহিত্য প্রকাশ থেকে বেরিয়েছিল আমার একাত্তর, ১৯৯৮তে কোনো বই বের হয়নি)। সেখানে পর পর দু বছরে একাধিক বই বেরোনো আমার জন্যে ঘটনা বই কি!
বিশ্ববিদ্যালয়ে যথারীতি পাঠদান চলে। ১৯৯৫ সালে বিভাগীয় সভাপতি হওয়ার নিয়োগপত্র পেলে ওই দায়িত্বগ্রহণে অপারগতা জানাই। তাতেও কিছু কটু কথা শুনতে হয় তাদের কাছ থেকে যারা এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ফিরে আসার বিরোধিতা করেছিল। পরে যখন ফিরে আসি, তখনো তা যথাসম্ভব বিলম্বিত করতে অনেকেই তৎপর ছিলেন, যাতে আমার অন্য কয়েকজন সহকর্মী অধ্যাপক পদলাভের জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার কাল পূর্ণ করতে পারেন। হয়তো এসবের মূলে ছিল আমার বিভাগীয় প্রধান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। ওই আসনে না বসাই ভালো বলে মনে হয়েছিল। নির্ঝঞ্ঝাট শিক্ষকতা করি আর মাঝে-মধ্যে এদেশ-সেদেশে সভাসমিতিতে যোগ দিতে যাই।
এই সভাসমিতিতে আমার যোগ দেওয়ার ব্যাপারটা অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের খুব অপছন্দ ছিল। উনি বলতেন, আপনি লেখালিখি করবেন নিজের প্ল্যান-অনুযায়ী, নিজের পছন্দের বিষয়ে। অন্যেরা সেমিনার-কনফারেনস করে, তাদের ফরমাইশ আপনি খাটতে যাবেন কেন? সারের এই তিরস্কার সত্ত্বেও বাইরে যাই। অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়, অনেক বিষয়ে জানতে পারি, অভিজ্ঞতা বাড়ে, দৃষ্টিভঙ্গির কিছু উন্নতি হয়।
প্রবন্ধ পড়া বা বক্তৃতা করা ব্যতিরেকে বিদেশভ্রমণের সুযোগ হলো ২০০০ সালের এপ্রিলে। জার্মানির হ্যাঁনোফার শহরে এক্সপো ২০০০ অনুষ্ঠিত হবে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর উদ্যোগে বাংলাদেশের এক প্রতিনিধিদল গেল সেখানে। বাণিজ্য-সচিব গোলাম রহমান তার নেতা। বুয়েটের স্থাপত্যবিদ্যার অধ্যাপক সামসুল ওয়ারেস, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক ফরিদুল হাসান ও আমি তার সদস্য। বার্লিনের এক স্থপতির সহযোগিতায় সামসুল ওয়ারেস এক্সপোতে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন নির্মাণের নকশা করে দিয়েছিলেন, আর সেখানে বাংলাদেশ-বিষয়ে যে-পুস্তিকা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেটার পাঠ দেখে দিয়েছিলাম আমি। দুর্ভাগ্যবশত পুস্তিকায় প্রকাশিত লেখাটি যেভাবে আমি সংশোধন করে দিয়েছিলাম, আমার এবং ব্যুরোর অজ্ঞাতেই শেষ পর্যন্ত তা উপেক্ষিত হয়। ফলে পুস্তিকাটির বক্তব্য যে-রূপ নেয়, তা স্পষ্টতই সরকারি নীতির সঙ্গে–এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ধারণার সঙ্গে–মেলেনি। ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়ে জার্মানিতে আমাদের রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল মাসুদের কাছে। তিনি হ্যাঁনোফারে আমাদের প্রতিনিধিদলে এসে যোগ দিয়েছিলেন। তিনিই এ-বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ব্যুরোর কাছে সরকার কৈফিয়ত চায় এবং আমি ফিরে আসার পরে ব্যুরোর বিপন্ন প্রধান। এ বি চৌধুরী আমার শরণাপন্ন হন। আমি লিখিতভাবে এই ভ্রান্তির দায়িত্ব স্বীকার করি, তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, মনে হয়, বিষয়টা সেখানেই থামিয়ে দেন।
তবে এক্সপো ২০০০ বেশ উপভোগ্য হয়েছিল আমাদের জন্যে। বেশ স্বাধীনভাবে আসা-যাওয়া, ঘোরা-ফেরা। গোলাম রহমান অতি সজ্জন ব্যক্তি, তার সৌজন্যের শেষ ছিল না। হ্যাঁনোফারের পালা শেষ করে আমরা এলাম। বার্লিনে। সেখানে আমাদের রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে অকৃপণ আপ্যায়ন এবং আমার পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখাশোনার অপরিমিত সুযোগ। বার্লিন থেকে লন্ডন হয়ে। আমাদের স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন।
লন্ডনে সেবারও আমি ছিলাম সিরাজুর রহমানের বাড়িতে। ততদিনে তিনি প্রবলভাবে আওয়ামী লীগ-বিরোধী। তার বাড়িতে আমার থাকা নিয়ে কেউ কেউ বিস্মিত ও সমালোচনামুখর এবং ঢাকায় সরকারের উচ্চমহলে তা জ্ঞাপনের কষ্টস্বীকারে প্রবৃত্ত। এ-নিয়ে আমাকে কেউ কিছু বলেননি বটে, তবে সরকারপ্রধানের নাম করে একটা কটু কথা মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল।
আমাকে ঘর-সংসার দেখতে হয় না, বলা যায়। সে-দায়িত্ব বেবী নিজের কাঁধেই নিয়েছে। মেয়েরা যার যার মতো সংসার করছে। রুচির দুই সন্তান : অরণি আর অলয়–একজন দশ, একজন নয় বছর বয়সী। শুচির একটাই ছেলে, সবে এক বছর পেরিয়েছে। আনন্দেরও বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। পাত্রী শারমিন রশীদ, ডাক নাম ইলোরা, ডা. রশীদ আহমদের ছোটো মেয়ে। ওঁরা লালমাটিয়ায় থাকেন, চাঁদপুরের শাহরাস্তি গ্রামের আদি বাসিন্দা। আনন্দের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আগস্ট মাসে যেদিন ডা. রশীদের বাড়ি যাওয়া হয়, হুমায়ূন আহমেদের পীড়াপীড়িতে তার আগের দিন সকালে বেবী ও আমি গিয়েছিলাম নুহাশপল্লীতে। হুমায়ূন এবং মাজহার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যথাসময়ে আমাদের ফিরে আসার ব্যবস্থা করে দেবে। ওরা যথাসাধ্য কথা রাখতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পথের মধ্যে গাড়ি বিকল হয়ে যায়। আরেক গাড়ি এসে আমাদের উদ্ধার করে আনতে আনতে অত্যধিক দেরি হয়ে গেল। যারা প্রস্তাব নিয়ে যাবেন, পাত্রের বাপ-মার এমন দায়িত্বহীন আচরণে তারা অত্যন্ত বিরক্ত হন। যথাসময়ে তাদের যেতে না পারার দায়টা আমারই। অবশ্য অক্টোবরে বিয়ের কথা পাকাপাকি হলো যখন, তখন দায়িত্বপালনে শৈথিল্য ঘটেনি। ঠিক হলো, বিয়ে হবে ২০০১-এর জানুয়ারিতে।
আরো নিকটজনকে হারালাম এরই মধ্যে। আমার শ্বশুর লোকান্তরিত হলেন ১৯৯৪ সালের ১৫ জুলাইতে। তিনি হাসপাতালে ছিলেন মাত্র কয়েকদিন। তখন শিল্পী সফিউদ্দীন আহমদের চিকিৎসাও চলছিল ওই হাসপাতালে, ওঁর পাশের কেবিনেই। প্রেস ক্লাবে আমার শ্বশুরের জানাজায় অনেক জনসমাগম হয়েছিল। আমার মামাতো বোন হালিমাকে হাসপাতালে দেখে আমি গেলাম কলকাতায়। ফিরে এসে শুনি ১৯৯৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়েছে। কী যেন সে বলতে চেয়েছিল আমাকে তার মৃত্যুর আগে, তা আর জানা হলো না। ১৯৭৫ সালের পরে, বিশেষ করে জীবনের শেষদিকে, দেশ সম্পর্কে তার উদ্বেগ অনেক বেড়ে যায়, কবিতায় তা সে প্রকাশ করার চেষ্টা করে। তার কয়েকটায় সুর দিয়ে গানের একটা সিডিও বেরিয়েছিল। এরপর বড়োবু। এক্ষেত্রেও আমি কলকাতায় ছিলাম। ফিরে এসে বিমানবন্দর থেকে সোজা গেলাম হাসপাতালে। তাকে আর পেলাম না। আমার ভাগ্নে-ভাগ্নিদের ইচ্ছায় লাশের সঙ্গে আমিই এলাম তার বাড়িতে–১৯৯৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। আমার জীবনের খুব বড়ো একটা বন্ধন কেটে গেল। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৯৯ সালের ৬ মে হাসপাতালে জীবনাবসান ঘটল আমার বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেনের। আমরা একসঙ্গে স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম। তার পরবর্তী পঞ্চাশ বছর একটা অচ্ছেদ্যবন্ধনে আমরা জড়িত ছিলাম। তার মৃত্যু আমাদের বন্ধুমহলে সত্যি সত্যি শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল।
কথা ফুরোয় না, সময় ফুরিয়ে যায়। লেখায় ছেদ টানা যায়, জীবন কিন্তু প্রবহমান। জীবন ক্রমাগত সামনের দিকে চলে। আমাদের পথচলা এক সময়ে থেমে যায়, জীবন থামে না।