- বইয়ের নামঃ বিপুলা পৃথিবী
- লেখকের নামঃ আনিসুজ্জামান
- প্রকাশনাঃ দৈনিক প্রথম আলো
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
বিপুলা পৃথিবী
নিবেদন
শেষের বারো পৃষ্ঠা ছাড়া এই লেখাটি ২৩ এপ্রিল ২০০৪ থেকে ৭ নভেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে প্রতি পক্ষে প্রায় নিয়মিত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। বই প্রকাশের সময়ে শেষাংশে কিছু ঘটনার কথা যোগ করে দিয়েছি। লেখাটি প্রথম প্রকাশের দিনে ভূমিকাস্বরূপ ‘পূর্বভাষ’ নামে যা বলা হয়েছিল, তা এরকম:
প্রথমে ভোরের কাগজে কয়েকমাস, তারপর প্রথম আলোয় কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে স্মৃতিকথা লিখেছিলাম কাল নিরবধিনামে। সংশোধিত হয়ে তা গ্রন্থাকারে বেরিয়ে গেছে গত বছর (২০০৩) বইমেলায়। ওটার শুরু হয়েছিল আমার পূর্বপুরুষের কথা দিয়ে, শেষ হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের ঘটনায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্মৃতিকথা লিখেছিলাম ভোরের কাগজে, ধারাবাহিকভাবে, ১৯৯৬ সালে। পরের বছর আমার একাত্তর বই হয়ে বেরিয়ে যায়। এখন প্রবৃত্ত হয়েছি ১৯৭২ থেকে পরবর্তী সময়ের যে-স্মৃতি আমার আছে, তার আলেখ্য রচনা করতে। বন্ধুবান্ধবেরা আমার কাছে দাবি করেছেন তেমন একটি লেখা, নিজের ইচ্ছাও কিছু কম নয়। কেউ কেউ অবশ্য সাবধান করে দিয়েছেন এই বলে যে, যত কাছাকাছি সময়ের কথা বলতে যাবো, তা নিয়ে তর্ক তত প্রবল হবে। এই সাবধানবাণীর সত্যতা আমিও মানি। বিতর্ক এড়াবার একমাত্র উপায় কিছু না-লেখা। না-লিখতে মনটা সায় দিলো না। নিজের সম্পর্কে জানানোটা জরুরি নয়, কিন্তু যা দেখেছি, যা শুনেছি, তার অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ।
আমার ডায়েরি লেখার অভ্যাস নেই, তাই স্মৃতিই আমার প্রধান পুঁজি। ভুল এড়াবার জন্যে বইপত্র দেখার চেষ্টা করবো, তারপরও যে ভুল হবে না, সেকথা বলতে পারিনে। পাঠক শুধরে দিলে ধন্যবাদ জানাবো। একই কারণে বর্ণিত ঘটনার কালক্রমের কিছু হেরফেরও হবে বলে আশঙ্কা করি। তার জন্যে পাঠকের কাছে আগাম ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।
এ-লেখা শুরু করতে যাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধকালীন শরণার্থী-জীবনের অন্তে স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন থেকে। আমার একাত্তরের শেষ কয়েক পৃষ্ঠায় তার বিবরণ আছে। ধারাবাহিকতার খাতিরে এখানে তার সারসংক্ষেপ হাজির করবো মাত্র। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির পরের ঘটনা এখানেই বিবৃত হবে। হয়তো অন্য প্রসঙ্গে কিছু কিছু কথা এর আগে কখনো কোথাও ব্যক্ত করেছি। এই সামান্য পুনরুক্তির জন্যে পাঠকদের প্রশ্রয় ভিক্ষা করি।
.
আমার ইচ্ছে ছিল, বিপুলা পৃথিবী শেষ করি ২০০৭এ এসে। বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করেও যখন দেখা গেল, পরিত্যক্ত সূত্র আর কুড়িয়ে নেওয়া যাচ্ছে না, তখন ঘটনাকালের সমাপ্তি ২০০০এই টানলাম। তার জন্যে যোগ করতে হলো কয়েকটি পৃষ্ঠামাত্র।
পত্রিকায় রচনাটির প্রকাশকালে সেখানে চিঠি লিখে কিংবা ব্যক্তিগতভাবে টেলিফোন করে আমার ভ্রান্তি অপনোদন অথবা আমার লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করার জন্যে আমি আবদুল মান্নান, আবু তাহের খান, আবুল হোসেন, এম সাইদুজ্জামান, গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া, গোলাম মুস্তাফা, নুরুল হক, ফজিলতুননেসা, মংসিংঞো, শামসুল হোসাইন, শাহেদা জাফর ও সৈয়দ আবুল মকসুদকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। মতিউর রহমান ও সাজ্জাদ শরিফের তাগাদায় গ্রন্থটি প্রকাশ পেতে যাচ্ছে। জাফর আহমদ রাশেদের সশ্রম সহযোগিতা ছাড়া বইটি বর্তমান রূপ পেতে পারতো না। এদের সকলকেই আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। ছবিগুলো নেওয়া হয়েছে নানা সূত্র থেকে, সেসব ক্ষেত্রে আমার ঋণ রয়ে গেল। নির্ঘন্ট তৈরি করেছেন আখতার হুসেন, তাঁকে ধন্যবাদ। প্রথমা প্রকাশনের কর্মী মো. ফারুক আহমেদ, মাসুম আহমেদ, এরফান উদ্দিন আহমদ, শতাব্দী কাদের, মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম ও হুমায়ূন কবীরের আন্তরিক সহযোগিতা অবিস্মরণীয়।
আনিসুজ্জামান
বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ফেব্রুয়ারি ২০১৫
নতুন যুগের ভোরে
১.
দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল–দিনকুড়ি আগরতলায় থেকে ডেরা বেঁধেছিলাম কলকাতায়। বাংলাদেশের মুক্তির ক্ষণ থেকেই দেশে ফিরতে মন চাইছে। পথঘাট এবং পরিস্থিতির বিবেচনায় দেরি করছি দু চারদিন। ২০ তারিখে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করে পরিকল্পনা-কমিশনের সদস্যপদ ত্যাগ করে লেখা আমার চিঠিটা তার হাতে সমর্পণ করলাম। তাতে লিখেছিলাম, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পূর্বপদে ফিরে যেতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য ঢাকায় ফিরে গেলেন ২২ ডিসেম্বরে। কয়েকদিন পর প্রধানমন্ত্রীর পুরোনো দপ্তরের সূত্রে খবর পেলাম, তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন ঢাকায়। ভারতীয় এক কর্মকর্তা ফোনে। জানালেন, পরদিন ঢাকাগামী বিমানে একটা আসন রাখা হয়েছে আমার জন্যে। কলকাতায় পরিবার ফেলে এতদিন পরে একলা দেশে ফিরতে ইচ্ছে হলো না। তাছাড়া ভয়ও ছিল মনে, একা ঢাকায় একবার এসে পড়লে কলকাতায় ফিরে পরিবার নিয়ে আসা অনিশ্চিত হয়ে যাবে; প্রশাসনে একবার জড়িয়ে গেলে তার জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসা কঠিন হবে। তাই মাফ চেয়ে নিলাম।
তার আগে ২৩ ডিসেম্বরে যশোরে গিয়েছিলাম। আমার গাড়িতে অনিল সরকার ও অনিরুদ্ধ রায়, আমার শ্যালক আজিজের গাড়িতে আবদুল আউয়াল ওরফে সুবা ভাই ও অনিরুদ্ধের ভাই চন্দন। সীমান্ত পেরোবার সময়ে কী যে রোমাঞ্চ আমাদের–স্বাধীন বাংলাদেশে পৌঁছে গেলাম! যশোর সার্কিট হাউজে সহজে জায়গা পাওয়া গেল, খাওয়াদাওয়ারও সুব্যবস্থা হলো। আমাদের অতিথিরা খুশি।