জাফর তাঁর স্টুয়ার্ডকে বললেন, উপহারগুলো আনো। একটা বড় ঝোলা ব্যাগ এল। জাফর দুটো পাইপ আর একটা জায়নামাজ তুলে দিলেন মুজিবের হাতে। বললেন, এই ফ্লাইট একটা ঐতিহাসিক ফ্লাইট। আমি জাফর কত ফ্লাই করেছি। আমার নাম তো ইতিহাসে কোথাও থাকবে না। কিন্তু আজকের এই ফ্লাইটের কারণে ইতিহাসে আমার নামটা থেকে যেতেও পারে। আমি একটা দেশের মহান নেতাকে এই ফ্লাইটে মুক্তির বন্দরে নামিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের পিআইএর পক্ষ থেকে এই ক্ষুদ্র উপহারটা গ্রহণ করুন।
শেখ মুজিব হাসিমুখে জিনিসগুলো হাতে নিলেন। বললেন, আমি এই জায়নামাজে নামাজ পড়ব আর আপনাদের জন্য দোয়া করব। এয়ার মার্শাল, আপনি কিন্তু এটা নিশ্চিত করবেন যে আমাকে নিতে যেন ফরেন সার্ভিসের অফিসাররা বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকে।
.
আজিজ আহমেদ, যিনি শেখ মুজিবের বিদায়ের আয়োজনের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি ভুট্টোর নির্দেশে বেশ কিছু ডলার জাফরের হাতে দিয়ে দিয়েছেন। আর দিয়েছেন স্যুট, কোট-প্যান্ট ও প্রিন্স কোট।
বিমান লন্ডনের আকাশে। মুজিব কোট পরে নিলেন। মাফলার জড়ালেন গলায় এবং একটা ওভারকোট রেডি রাখলেন। ৮ জানুয়ারি ভোরবেলা লন্ডনের শীত ভীষণ তীব্র হবে, তাতে মুজিবের সন্দেহ নেই।
৬টা ৩৬ মিনিটে বিমান যখন হিথরোর রানওয়েতে চাকা রাখছে, তখন কুয়াশার চাদর ভেদ করে ভোরের আলো পৃথিবীকে চুম্বন করছে।
প্লেনের চাকা থামল। প্রধান টার্মিনাল থেকে খানিকটা দূরেই। প্লেনে এসে উঠল বিমানবন্দরের কিছু কর্মচারী।
জাফর বললেন, স্যার, চলুন। আমরা ভিআইপি লাউঞ্জে যাব।
মুজিব বললেন, যারা এসেছেন, তাঁরা কি ফরেন অফিসের লোক?
না স্যার। এরা এয়ারপোর্টের লোক। তবে ভিআইপি এলেই এরা কেবল তাদের টেক কেয়ার করে। ফরেন অফিসের লোকেরা থাকবে ভিআইপি লাউঞ্জে।
শেখ মুজিব ড. কামালকে বললেন, কামাল। কী করবা? নামবা, না বসে থাকবা?
মুজিব ভাই, চলুন। প্লেনের মধ্যে ফরেন অফিসাররা তো আসবেন না। তারা টার্মিনালের ভেতরেই থাকবেন। আমরা এগোতে থাকি।
শেখ মুজিব ওভারকোটটা পরে নিলেন। ড. কামালও। হামিদা হোসেন উলের স্কার্ফ জড়িয়ে নিলেন। মেয়ে দুটোকে হাতমোজা পরালেন।
তারা ধীরে ধীরে নেমে এলেন সিঁড়ি বেয়ে।
ক্যাপ্টেন জাফর, তাঁর সহকর্মীরা এবং হিথরো বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা শেখ মুজিব ও তাঁর সহযাত্রীদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ভিআইপি লাউঞ্জের দিকে। ঠান্ডা বাতাসে বঙ্গবন্ধুর হাতের পাইপ নিভে গেল।
ভিআইপি লাউঞ্জের গেটে একজন ব্রিটিশ পুলিশ। তিনি হঠাৎই বলে উঠলেন, স্যার, স্যার, উই হ্যাভ বিন প্রেয়িং ফর ইউ, স্যার।
শেখ মুজিব কামালের দিকে তাকালেন। বাংলার মানুষ তাকে ভালোবাসে, তার মুক্তির জন্য তারা প্রার্থনা, সংগ্রাম, চেষ্টা করে যাচ্ছে–এটা তিনি নিশ্চিত। কিন্তু একজন ব্রিটিশ পুলিশ সদস্যও তার জন্য প্রার্থনা করেছেন, তাঁর মঙ্গল কামনায় চোখের জল ফেলছেন, ব্যাপারটা বেশ মর্মস্পর্শী।
তারা ভিআইপি রুমে গিয়ে বসলেন সোফায়। কক্ষের টেলিফোন বেজে উঠল। একজন অফিসার ফোন তুললেন, রিসিভার হাতে নিয়ে বললেন, মি. রহমান, ইটস ইয়োর কল।
মুজিব বললেন, কামাল, ধরো তো। দ্যাখো কে?
কামাল বললেন, হ্যালো…
গুড মর্নিং! অ্যাম আই টকিং টু মি. শেখ মুজিবুর রহমান, স্যার?
গুড মর্নিং। দিস ইজ কামাল হোসেন, হিজ কলিগ!
আমি আয়ান সাদারল্যান্ড বলছি। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে।
মি. সাদারল্যান্ড। আমরা ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় সাক্ষাৎ করেছি।
মিস্টার শেখ মুজিবুর রহমান এসেছেন?
হ্যাঁ। আমরা এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে আছি।
ও মাই গড। আমি এখনি আসছি। মাত্র এক ঘণ্টা আগে আমাদের অফিসকে জানানো হয়েছে যে মিস্টার রহমান আসছেন। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাকে রিসিভ করার জন্য। আমাকে বলা হয়েছিল আরও ঘণ্টা চারেক পরে আপনারা আসবেন। আমি আপনাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা আর আপনাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আমাকে দশ মিনিট সময় দিন, আমি আসছি।
শেখ মুজিব বললেন, আবু সাঈদ চৌধুরীর ফোন নম্বর নাও। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করো।
আবু সাঈদ চৌধুরীকে কি খবর দেওয়া যায়? কামাল বললেন ফোনে।
তিনি তো গতকালই লন্ডন ছেড়েছেন। এখন বাংলাদেশের পক্ষে সিনিয়র আছেন রেজাউল করিম। পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে তিনি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করছেন। আমরা তাঁকে বলছি আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
আমাকে তার নম্বরটি দিতে বলুন। ড. কামাল বললেন।
রেজাউল করিম তখন ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁর শিয়রের কাছে ফোন বেজে উঠল। তিনি ঘুমজড়িত কণ্ঠে বললেন, হ্যালো। রেজাউল করিম স্পিকিং।
হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে বলছি। নিন, কথা বলুন।
কামাল হোসেন ফোন দিলেন বঙ্গবন্ধুকে, ফিসফিসিয়ে বললেন, বাংলাদেশের ফরেন অফিসার রেজাউল করিম।
শেখ মুজিব ফোন ধরে বললেন, রেজাউল করিম। আমি শেখ মুজিব বলছি।
আপনি কেমন আছেন? রেজাউল করিম উত্তেজনায় কথা বলতে পারছেন না।
আছি ভালোই।
স্যার। আপনি পাঁচ মিনিট সময় দিন। আমি আসছি।
.
রেজাউল করিম তার ফোর্ড করটিনা গাড়ি বের করে ছুটছেন হিথরোর দিকে। এত স্পিডে গাড়ি তিনি জীবনেও চালাননি। সাদারল্যান্ড ছুটছেন আরেকটা গাড়িতে। গাড়িতে বিবিসি রেডিও বলছে, বাংলাদেশের মুক্তিদাতা শেখ মুজিবুর রহমান এখন হিথরো বিমানবন্দরে…খবর পেয়ে হিথরোর দিকে ছুটছেন আরও দুজন বাঙালি কূটনীতিক–মহিউদ্দীন আহমদ আর মহিউদ্দীন আহমদ জায়গীরদার।