মুজিবের মনের মধ্যে চলচ্চিত্রের মন্তাজের মতো এক হাজার বছরের দৃশ্য, মুজিবের চোখের সামনে টাইম ডাইলুশন, এক সেকেন্ডে মহাকাল যেন ঝলকে উঠল তাঁর মনের পর্দায়, আহা, হাজার বছর আগে চর্যাপদের কবি মহিত্তাপদ গায়ে উত্তরীয় জড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে গনগনে সূর্যের নিচে দুই হাত প্রসারিত করে বলছেন :
পাপ-পুণ্য বেণি তিড়িঅ সিকল মোড়িঅ খম্ভা ঠাণা।
গঅণ টাকলি লাগি রে চিত্তা পইঠ ণিবানা।
পাপ-পুণ্যে বানানো শেকল ছিঁড়ে, ভেঙে স্তম্ভ-স্থান
গগন শিখরে উঠে চিত্ত প্রবেশিল নির্বাণ।
যেন রঙ্গলাল সেন এখনি গেয়ে উঠবেন :
স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়।
যেন নজরুল বলছেন, বলো বীর, বলো চির-উন্নত মম শির, যেন। জীবনানন্দ দাশ বলছেন, তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব, যেন রবীন্দ্রনাথ বলছেন, চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত…যেন সন্ন্যাসী বিদ্রোহীরা ঘিরে ধরছে গোরা সৈনিকদের, যেন ফকিররা ছুটছে গাদা সাদা ঘোড়ার খুরে ধূলি উড়িয়ে, যেন কৈবর্তরা লগি-বইঠা হাতে ছুটে চলেছে বিদ্রোহ করতে, যেন নীলকরদের বিরুদ্ধে জোট বেঁধে লাঠি সড়কি হাতে ছুটে যাচ্ছে প্রজারা, যেন বারভূঁইয়ারা সমতটে সমবেত হচ্ছে। মোগলশক্তির বিরুদ্ধে, যেন বাঁশের কেল্লায় মরিয়া সমাবেশ ঘটাচ্ছেন তিতুমীর, যেন এইমাত্র মাস্টারদা সূর্য সেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করলেন, আর প্রীতিলতার হাত থেকে বিষের শিশিটা কেড়ে নিলেন, যেন এইমাত্র ফাঁসির দড়ি গলা থেকে ছিঁড়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসছে ক্ষুদিরাম, যেন সোহরাওয়ার্দী সাহেব, শরৎ বসু শেষবারের মতো মোলাকাত সেরে নিলেন, যেন আজিমপুর কবরে শহীদ বরকত, শফিউর, রফিক, জব্বাররা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বলে নক্ষত্রের গায়ে গায়ে বর্ণমালা বসিয়ে দিচ্ছে…স্বাধীনতা, আহা স্বাধীনতা..
মুজিব বললেন, না। আমি আর কিছু জানতে চাই না। আমার জন্য এই কথাই যথেষ্ট যে আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমি জানতাম, আমার মানুষ পারবে। আমি জানতাম, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন পারবে। আমি জানতাম আমরা যখন মরতে শিখেছি কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। মুজিব কাঁদতে লাগলেন। অবিরল জলধারা গড়াতে লাগল তার দুচোখ বেয়ে। কান্নার ভেতর থেকেই তিনি হাসছেন। কাঁদতে কাঁদতে হাসছেন তিনি, হাসতে হাসতে কাঁদছেন!
তিনি হাবিবকে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন।
তার দেশের মানুষের কথা মনে পড়তে লাগল! আমার দেশবাসী ভালো আছে তো? তখন আবার তাঁর আব্বার মুখটা মনে পড়ছে। আব্বা বলেছেন, অনেস্টি অব দ্য পারপাজ, সিনসিয়ারিটি অব দ্য পারপাজ।
তার মায়ের মুখ মনে পড়তেই মনে হলো, টুঙ্গিপাড়ায় বাইগার খালের ধারে বটের একটা গাছ ছিল, তাতে লাল লাল ফল ধরত, পাখিরা সারাক্ষণ কূজন করত বটের ডালে ডালে, নিচে বসলে কী মধুর হাওয়া এসে শরীর মনে শান্তির পরশ বোলাত, তাকাও তুমি দিগন্তের দিকে, ধানের খেতে বাতাসের ঢেউ…বাড়ির পেছনে একসার আমগাছ…আমগাছে বসন্তকালে মুকুল ধরত। সেই মুকুলের কী যে মাদকতাময় গন্ধ, বসন্তের বাতাসে উড়ে এসে নাকে লাগত।
তিনি গুনগুন করতে লাগলেন :
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে–
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো–
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে–
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দুই চোখ বেয়ে উষ্ণ জল গড়াতেই থাকল!
আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
১২৩
দমদম বিমানবন্দরে হেলিকপ্টার প্রস্তুত। সকাল থেকেই কলকাতার আকাশ ঢেকে রেখেছে সাদা কুয়াশার চাদর। সূর্য উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে। হেলিকপ্টার উড়বে রোদ ওঠার পর। আবার অন্ধকার নামার আগেই সেটাকে পৌঁছাতে হবে ঢাকায়। ২২ ডিসেম্বরের দুপুরবেলা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান আর খন্দকার মোশতাক এসে পৌঁছালেন কলকাতা বিমানবন্দরে। সবাই আবেগপ্রবণ। একদিন, প্রায় ৯ মাস আগে, যে যার মতো করে ঘর ছেড়েছিলেন অজানার উদ্দেশে, অনিকেত ঝোড়ো পাখির মতো, জানতেন না তারা যে তাঁদের গন্তব্য কী, নিয়তিতে কী লেখা আছে। সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় মনে হয়েছিল, আর কি কখনো ফিরে আসতে পারবেন জন্মভূমিতে–গন্তব্য অনিশ্চিত, পথ অজানা, কিন্তু লক্ষ্য ছিল স্থির, অর্জুনের মতোই তারা দেখতে পেয়েছিলেন পাখির চোখ–বাংলাদেশের স্বাধীনতা! আজ বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে, স্বদেশের রাজধানীতে ফিরে যাচ্ছেন তারা! আবেগাপ্লুত হওয়ার মতোই একটা সন্ধিক্ষণ বটে। তাজউদ্দীনের মনে পড়ে, এপ্রিলে সীমান্তের দিকে যাওয়ার সময় তার মনে পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের লিপিকার বাণী, এ পথ যে চলার পথ, ফেরার পথ নয়। তাজউদ্দীন চেয়েছিলেন, এই যাওয়ার পথ যেন ফেরার পথটাকে তৈরি করে নেয়।