সামাদ সাহেবের ছেলে বাবু এগিয়ে এলেন। বললেন, চাচা, আপনি দেয়াল টপকে আসছেন কেন? কারফিউ তো এখন উইথড্র করেছে। চারটা পর্যন্ত কারফিউ থাকবে না। তারপর আবার কারফিউ।
খোকা বললেন, ভাবিদের খোঁজে এসেছি।
ওনারা আমাদের বাসায় আছেন। আসেন। বাবু শার্টের বোতাম ঠিক করতে করতে বললেন।
ভাবিরা এই বাসায় আছে! খোকার ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল। তিনি এগিয়ে গেলেন।
আকাশ গুমোট। গাছগাছড়ায় বাড়ির নিচতলা অন্ধকার। বাইরের ঘরেই বসে আছেন রেনু, জামাল, রাসেল।
খোকাকে দেখেই রেনু হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন, ভাইডি, তুই আসছিস!
রেনুর কান্না আর থামে না। ভাইডি, কত যে গোলাগুলি করল বাড়িতে, তোর মিয়া ভাইকে ধরে নিয়ে গেল!
জামাল বললেন, এই বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না।
রেনু বললেন, ভাইডি। আমরা কোথায় যাব?
খোকা বললেন, কারফিউ তুলে নিয়েছে চারটা পর্যন্ত। আমি তাহলে আমার গাড়িটা আনি। আপনাদের নিয়ে যাই।
জামাল বললেন, কই নিয়ে যাবেন। আপনার বাসাও নিরাপদ হবে না। রেডিওতে শুনলাম, সারা দেশে মিলিটারি পাগলা কুকুরের মতো মানুষ মারছে। সবাইকে অ্যারেস্ট করছে। আপনার বাড়িতেও মিলিটারি হামলা করবে।
খোকা বললেন, গাড়ি নিয়ে আসি। জাকি ভাইয়ের বাড়িতে আমার গাড়ি আছে। আমি যখন এসে গেছি, আর কোনো চিন্তা করিস না।
খোকা উঠলেন। দ্রুতপায়ে হেঁটে ৩২ নম্বরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। রিকশা-বেবিট্যাক্সি কিছুই নেই।
এই সময় রাস্তায় একটা গাড়ি দেখা গেল। গাড়িটা এদিকেই আসছে। খোকার সামনে এসে গাড়িটা ভটভট শব্দ তুলে থামল। ড্রাইভিং সিটের পাশের জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিলেন তারেক। খোকা চিনতে পারলেন গাড়ির চালককে, শেখ কামালের বন্ধু। তিনি বললেন, চাচা, কোথায় যাবেন? চলেন আমি নামিয়ে দিয়ে আসি।
তারেক। জামাল, রাসেল, ভাবি আছে। তাদেরকে নিয়ে চলো তো একটু ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডের দিকে যাই।
আচ্ছা। চলেন।
খোকা দৌড়ে ডা. সামাদ সাহেবের বাড়ির ভেতরে গেলেন। বললেন, ভাবি, একটা গাড়ি পাওয়া গেছে। আসেন আসেন। তাড়াতাড়ি আসেন।
রেনু, জামাল, রাসেল বসল গাড়ির পেছনে। সামনে তারেকের পাশে বসলেন খোকা। বললেন, ২ নম্বরের দিকে চলো।
খোকার চিন্তাটা হলো, ২ নম্বরে তার বন্ধু ও আত্মীয় মোরশেদ মাহমুদের বাসা। সেখানে যাওয়া যেতে পারে।
তারেক ধানমন্ডি ২ নম্বর সড়কে মোরশেদ মাহমুদের বাসার সামনে তাঁদের নামিয়ে দিয়ে সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
খোকা বাড়ির দোরঘণ্টি বাজালেন।
মোরশেদ মাহমুদ দরজা খুললেন। তারা ভেতরে ঢুকে দেখলেন, সবাই বাক্সপেটরা বাধছে। ঢাকা ছেড়ে চলে যাবে।
রেনু অসহায়ের মতো তাকালেন খোকার দিকে। এরা নিজেরাই তো চলে যাচ্ছে। আমরা কী করে থাকব, ভাইডি।
খোকা বললেন, আপনারা এই বাসাতেই একটু বসেন। আমি আমার গাড়িটা আনি।
খোকা গাড়ি আনতে গেলেন। রেনুর মনে দুশ্চিন্তা কত রকমের। হাসুর আব্বা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কেউ জানে না। হাসু-রেহানাই-বা কোথায় আছে, কী করছে! কামাল রাতের বেলা একবার এসেছিল। ২৭ মার্চ ভোর রাতের দিকে। এ-বাড়ি ও-বাড়ির দেয়াল টপকে, মানুষের বাড়ির পেছন দিয়ে, বাগানের গাছগাছালির ভেতর দিয়ে সে প্রথমে নিজেদের বাড়িতে গিয়েছিল। গিয়ে যখন সে দেখতে পেয়েছিল, বাড়িতে কেউ নেই, তখন বুদ্ধি করে সে চলে এসেছিল ডাক্তার সাহেবের বাসায়। সেখানে গিয়ে সে মা, জামাল আর রাসেলের দেখা পেয়েছিল।
এরপর একসময় কামাল বলেছিল, মা, বাসায় কিছু জরুরি জিনিসপত্র আছে। আমি একটু আমার ঘরে যাই। জিনিসপত্রগুলো নিয়ে আসি।
তখন কারফিউ চলছে। কামাল দেয়াল টপকে ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে ঢুকেছিল। তার পরপরই বাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। বাইরে পাকিস্তানি মিলিটারির বহর পাহারা দিচ্ছিল। বাড়ির ভেতরে মানুষের নড়াচড়া টের পেয়ে তারা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে দিয়েছিল।
রেনু তখন ডাক্তার সাহেবের বাড়িতে জায়নামাজে বসে আল্লাহকে ডাকছেন, হে আল্লাহ, কামালকে রক্ষা করো। হে আল্লাহ, কামালকে রক্ষা করো। কিছুক্ষণ পরে গোলাগুলি থেমে গিয়েছিল।
জামাল আর সঙ্গী কিশোর বয়সী গৃহপরিচারক আবদুল ডাক্তার সাহেবদের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল। বোঝার চেষ্টা করছিল মিলিটারি আছে কি নেই। আবদুলের সাহস বেশি। দেখতেও সে ছোটখাটো। সে আরেকটু সামনে এগিয়েছিল। একটা বকুল ফুলের ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে এদিক-ওদিকে তাকিয়ে সে বলেছিল, না, সামনে কেউ নেই। মিলিটারিরা চলে গেছে। জামাল গুলির খোসা কুড়াচ্ছিলেন।
রেনু বলেছিলেন, এই জামাল, কী করিস। ঘরের ভেতরে আয়।
জামাল বলেছিলেন, কত গুলি যে করেছে। ঝরাপাতার মতো আমাদের বাড়ির চারদিকে গুলির খোসা পড়ে আছে। কিছু কুড়ায়া রাখি।
রেনু বলেছিলেন, পাগল নাকি। কখন আর্মি এসে পড়ে। ঘরে আয়।
জামাল বলেছিলেন, আর্মির গাড়ি চলে গেছে। শুধু দূরে গার্লস স্কুলের ছাদে এলএমজি ফিট করে রেখেছে।
রেনু বলেছিলেন, তাইলে আমি একটু বাসায় ঢুকব। কামাল জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য বাসার দিকে যে গেল, তারপরেই তো গুলি শুরু হলো। জানি
সে বাইচে আছে নাকি মারা গেছে। কথাটা বলতে গিয়ে তার বুকটা কেঁপে উঠেছিল, গলায় কান্না চলে এসে দলা পাকাচ্ছিল। কী ভয়াবহ উকণ্ঠাভরা মুহূর্ত একেকটা। তপ্ত লোহা গলে গলে পড়ে যেমন করে, তেমনি করে যেন একেকটা সেকেন্ড তার মনের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। কামাল ওই বাসায়, আর গগনবিদারী শব্দ করে গুলির এসে বিদ্ধ করছে তাদেরই সেই বাসার দেয়াল, ভেঙে পড়ছে কাঁচের জানালা। সেলাই মেশিনের সুইয়ের মতো গুলি এফেঁড়-ওফোড় করছে তাদের বাড়ির দেয়াল, দরজা, জানালা, ছাদবারান্দা।