আশ্বিনের মাঝামাঝি, উঠিল বাজনা বাজি
পুজোর সময় এল কাছে
মধু বিধু দুই ভাই ছুটাছুটি করে তাই
আনন্দে দুহাত তুলি নাচে।
পিতা বসি ছিল দ্বারে, দুজনে সুধালো তারে,
‘কী পোশাক আনিয়াছ কিনে’?…।
আমরা ভাই বোনেরা পুজোর আনন্দে বিধুই। কিন্তু মধুর মতো ফুলকাটা সাটিনের জামার বায়না করতাম না কেউ। যা পেয়েছি নতুন তাই ভাল। একবার, তখন আমি কলকাতায়। পিতামহর খুব অসুখ। পুজোর আগে জলের মতো টাকা গেছে বাবার। পুজোয় কিছুই হয়নি। চোখে জল। শেষ অবধি ফুটপাথ থেকে জামা, প্যান্ট আর রবারের হাওয়াই চটি কিনে দেওয়া হলো ষষ্ঠীর দিনে। দাম সর্ব মোট দশ টাকা। আমি গিয়েছিলাম সঙ্গে, মনে আছে তাই। কিন্তু তাতেই কী আনন্দ! উপরের বালক রেয়নের প্যান্ট পরেছে, টেরিলিনের শার্ট পরেছে, আমার সস্তার জামা প্যান্টের আনন্দ ম্লান হয়নি তাতে। বাল্যকালে খুব পছন্দের ছিল রবীন্দ্রনাথের ঐ কবিতা। আশ্বিনের মাঝামাঝি…। শেষ কয়টি পংক্তি এখনো মনে আছে,
আয় বিধু, আয় বুকে, চুমো খাই চাঁদ মুখে
তোর সাজ সবচেয়ে ভালো।
দরিদ্র ছেলের দেহে দরিদ্র বাপের স্নেহে
ছিটের জামাটি করে আলো।
পুজো আসে অনেকদিন ধরে। এই আনন্দের কোনো তুলনা হয় না। একদিনের দুদিনের বা চারদিনের নয় এই উৎসব। সেই রথযাত্রা থেকে আরম্ভ হয়ে বিজয়া দশমীতে শেষ। আনন্দ কেমন, না ইস্কুল চলছে, হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা চলছে, কিন্তু তার ভিতরেই দেবী গড়ে উঠছেন। একটু একটু করে আনন্দের দিন এগিয়ে আসে। মনে পড়ে দুর্গোৎসব একটা সময় ছিল সার্বিক আনন্দের উৎসব। কেমন তা বুঝিয়ে বলি। পুজোর গান আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। সেই গানের অপরূপ লিরিক লিখতেন কবি বিমলচন্দ্র ঘোষ, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল দত্তরা, সুর দিতেন, গাইতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা। গাইতেন লতা, সন্ধ্যা, আরতি, প্রতিমা, বনশ্রী সেনগুপ্তরা। পুজোর গানে পুজোর আনন্দ। সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত গাইলেন ‘পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি…।’ মুকুল দত্তর লিরিকে হেমন্ত সুর দিলেন ও গাইলেন, তারপর? তার আর পর নেই নেই কোনো ঠিকানা…। বুক ভরে যায় এখনো। পুজোর গানে ছিল পুজোর আনন্দ। পুজোর সিনেমা। উত্তম মাধবী অভিনীত প্রেমের ছবি শঙ্খবেলা। ‘চৌরঙ্গী’ মুক্তি পেল পুজোয়। ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ পুজোয়। দল বেঁধে চলো যাই গানে গানে ভরা বাংলা সিনেমা দেখতে। উত্তম, সৌমিত্রর ছবি মুক্তি পেয়েছে। আর তখন রঙ্গমঞ্চেরই বা কত প্রতাপ। পেশাদারি রঙ্গমঞ্চ যেমন, গ্রুপ থিয়েটার তেমন। সত্তর বা একাত্তর সালে রঙ্গনা থিয়েটার তৈরি হলো। পুজোর সময় নান্দীকার নিয়ে এল ভালো মানুষ, মঞ্জরী আমের মঞ্জরী, শের আফগান…। পুজোর আনন্দ নাটক দেখে। সপরিবারে দেখতে গেছি গিরিশ মঞ্চে, ‘মাধব মালঞ্চী কন্যে।’ এখন ছুটি থাকে সরকারি রঙ্গমঞ্চ। সুতরাং নাটক বন্ধ। বেসরকারি মঞ্চ প্রায় শেষ। পুজোয় এত বিকিকিনি, হল বন্ধ রেখে নাটক বন্ধ রেখে নাটকের কি ভালো হলো? আনন্দটা যে মুছে গেল।
বাল্যকালে ফিরি। পুজো বার্ষিকীতে পুজোর আনন্দ। ছোটদের বার্ষিকী একটা পেতাম। তার ভিতরে মা দুগ্গা তার ছেলেমেয়েকে পড়ে শোনাতেন হেমেন্দ্রকুমার রায়, আশাপূর্ণা দেবী, লীলা মজুমদার, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্যর লেখা। পরে সত্যজিৎ হয়েছিলেন প্রথম পাঠ্য, তখন কিশোরবেলা শেষ। সে কী আনন্দ পুজো বার্ষিকী পেয়ে। হ্যাঁ, দেব সাহিত্য কুটির ছিল এই বার্ষিকীতে অগ্রগণ্য। এই আনন্দ এখনো আছে। এখন ছোটদের কত ভালো ভালো পুজো বার্ষিকী। বড়দেরও। লিটল ম্যাগাজিনও। ভাল মন্দ দুরকম লেখা আগেও থাকত, এখনো থাকে। কিন্তু এইটা সত্য পুজো সংখ্যার আনন্দ কম নয়। সবই কৈলাস থেকে দেবীর নাইওরে আসার সঙ্গেই জড়িত। নাইওর পূর্ববঙ্গের রীতি। বিবাহিতা কন্যার বৎসরান্তে বাপের বাড়ি আসাই নাইওর। শচীন দেববর্মণের সেই গান স্মরণ করুন।
“কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া
আমার ভাইধনরে কইয়ো নাইওর নিত কইলা…।”
গাঙের ধারে দাঁড়িয়ে গ্রাম বধূটি (যে মা দুগগাই) ডাকছে বয়ে যাওয়া নৌকার মাঝিকে। মা দুগগা তো সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়িই আসেন। সঙ্গে অসুর ঠাকুর। দেবীর আগমন একেবারে আমাদের জীবনের নানা অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে। এ বড় আনন্দের। এ বড় সুখের। সারা বছর কত কষ্টে যায়, কত উদ্বেগে যায়, এই পুজোর কটা দিন আনন্দের দিন। আমাদের বাল্যকালে রেশন না তুলে উপায় ছিল না। লাইন দিতে হতো চাল, গম, চিনি কিনতে। পুজোর সপ্তাহে বরাদ্দ ডবল। তাতেই আনন্দ। চাল চিনি আক্রা। ১৯৬৫-৬৬-র কথা বলছি। খাদ্যের খুব অভাব হয়েছিল তখন। তবু পুজোয় ডবল চাল, চিনি, গম। সঙ্গে সুজি। তাতেই ভাল মন্দ রান্না করতেন সব সংসারের মা দুগ্গা। যার যেমন সাধ্য। সেই আনন্দ এখনো আছে। হত দরিদ্র ঘরেও ভাল মন্দ পাতে পরিবেশন করতে চান মা অন্নপূর্ণা। পুজোর আনন্দ এই। আরো আনন্দের ভিতরে পুজোয় সকলের হাতে কিছু অতিরিক্ত আসে। হ্যাঁ, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান – সকলের হাতে। পোশাক শিল্প এই সময় ফুলে ফেঁপে ওঠে, বড় কোম্পানি, বড় পোশাকের মল থেকে হাওড়া হাট, হরি সা হাটের হকার নৈমুদ্দিন আর নেপেন মণ্ডলও বেচা-কেনা করে অনেক লাভ করে। সব কিছু কেনা-বেচা হয় পুজোর কত আগে থেকে। সবাই প্রস্তুত হয় তার জন্য। কয়েক দশক আগেও পাড়ার দর্জিদের খুব দাম ছিল। ছোট ছোট পুঁজির দর্জি, তিন মাস আগে থেকে অর্ডার ধরত। অষ্টমী এমন কী নবমীতেও জামা, প্যান্ট, পাঞ্জাবী, ফ্রক ডেলিভারি দিত ছোট ছোট খদ্দেরকে। এখন তারা বিলুপ্ত প্রাণী। রেডিমেডের বাজার। তারা বড় বড় কারখানা করে নির্মাণ করছে বিপুল পরিমাণ পোশাক। সেখানে যারা সেলাই মেসিনের সামনে বসে আছে, তারা কর্মচারী। স্বাধীন ব্যবসায়ী নয়। পুজোর এই আনন্দ চলে গেছে। প্যাণ্ট বা শার্ট তৈরি করতে দিয়ে ট্রায়াল দেওয়াতেও সেই কিশোর কিংবা যুবকের আনন্দ ছিল, পুজোর আনন্দ নতুন জামায়। পুজোয় সবই নতুন। পুজো মানে নতুনের আনন্দ। পুজা বার্ষিকী প্রকাশের জন্য এই সময় ছাপাখানা, বাঁধাইখানায় খুব চাপ। এই সময় উপার্জন হয় অনেক। পুরনো পাওনা মেটাতে হয় প্রকাশককে। বাঁধাইখানার একটি বালককে দেখেছি কদিন আগে, বছর দশ। উদলা গা। বালকটি বই বাঁধাইখানার ভয়ানক গুমোটে সমস্তদিন মেসিনের চাকা ঘুরোচ্ছে বা ভাঁজ করা বইয়ের ফর্মা সাজাচ্ছে। সে পত্রিকার বান্ডিল কচি মাথায় বয়ে পত্রিকা অফিসে এল। কিছু পাবে। তিন বার এসে দশ টাকা তার অতিরিক্ত আয়। কী আনন্দময় হয়ে উঠল তার মুখখানি। সে তো মা অন্নপূর্ণার সন্তান। তার আনন্দে বিশ্বচরাচর হেসে উঠবে। পুজোর আনন্দ সকলের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া হোক। আর অতিরিক্ত বৈভব আর উল্লাস প্রদর্শন না করে দরিদ্র, নাচার মানুষকেও এই আনন্দের ভাগ দিন সদর মফস্বলের পুজো কমিটি।
জলের মতো স্বচ্ছ জলের মতো সরল নয় জল
জল আর জলপাই, খাসা জল, তোফা জল, মামাবাড়ি ঘুমড়ির জল, কলের জল, নদীর জল, ঝর্নার জল, পুকুরের জল, কুয়োর জল…। সুকুমার রায়ের অবাক জলপান নাটকে যে জলের লিস্টি আছে, বিষ্টির জল, ডাবের জল, নাকের জল, চোখের জল, জিভের জল, হুকোর জল… তালিকার শেষ নেই। জলের মতো স্বচ্ছ, জলের মতো সরল, সোজা কিন্তু নয় জল। জলই তো জীবন। জলের অভাব না হলে জীবনের এই চিহ্নটিকে বুঝবে কে? জলে না ডুবলে জলের অন্ধকার টের পাবে কে? বন্যায় না ভাসলে, জল যে কতখানি মৃত্যু বয়ে আনে তাই বা টের পাবে কে? এই খর রৌদ্রের দিনে, পুবের গাঁ থেকে পশ্চিমে হেঁটে এলে তেষ্টায় ছাতি ফাটবে যখন, জলের অপর নামটি মনে করাবে কে?