জিনিয়া ঘাড় নাড়ল। উদ্দালক বই রেখে বলল, “আমি এবার ঘুমিয়ে পড়ব। আপনি কি এখানেই বসে থাকবেন?”
জিনিয়া বলল, “না, ঠিক আছে। আমি ও ঘরে যাচ্ছি।”
উদ্দালক বলল, “এখানে কোনও ভয়ের ব্যাপার নেই। দরজা জানলা খুলে শুলেও কেউ আসবে না। নিরুপদ্রব জায়গা। নিশ্চিন্তে থাকুন।”
উদ্দালক তক্তপোশে টান হয়ে শুয়ে পড়ল।
জিনিয়া উঠে বেডরুমে গিয়ে ছিটকিনি দিল। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। সৌপ্তিকের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ ধরে। খাটে শুয়ে ছটফট করল কিছুক্ষণ। জানলা খুলে বাইরের দিকে তাকাল। রাস্তাঘাট শুনশান। বাড়ির বাইরে রাস্তায় স্ট্রিটলাইট জ্বলছে। তাদের পাড়ার কুকুরটার মতো একটা কুকুর শুয়ে আছে রাস্তার উপরে।
বেডরুমে একটা টিভি আছে। জিনিয়া টিভি চালাল কম ভলিউমে। কিছুক্ষণ দেখে বন্ধ করে দিল। টিভির নিচে একটা ডায়েরি রাখা। ডায়েরিটা খুলে দেখল একটা হিসেব করেছে উদ্দালক, হিসেবটা এক বছর আগের। এরকম লেখা—
১২-৩-২০১৯
পল্টুদের দোকান থেকে আনা হয়েছে
১ কিলো চাউল, না না চাউল না, চাল
৫০০ গ্রাম মুগ ডাল।
১ কিলো আলু।
১ কিলো পেঁয়াজ।
হলুদের প্যাকেট।
পোস্তর প্যাকেট।
এক প্যাকেট সিগারেট (সিগারেট ছেড়ে দিতে হবে। সিগারেট খেলে ক্যান্সার হয়)
তারপরের দিন আর কোনও হিসেব লেখা নেই। পরপর কয়েকটা লাইন লেখা
বৃষ্টি হবে
আকাশ পাতাল
বৃষ্টি ভেজা
শুকনো বাতাস।
আমের পরশ পাতায় পাতায়…
(আমের পরশ পাতায় পাতায়? ধুস, আমার দ্বারা কবিতা হবে না)
তার পরের পাতায় উদ্দালক লিখেছে—
ক্লাস সেভেন বি-তে পড়াতে হবে। জীবনে আমার একটাই দুঃস্বপ্ন ছিল। সেভেন বি। সে স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। এরপর আমি একে একে সব ক্লাসের বি বা সি সেকশন পড়াব। কোনও ছাত্র আমার কথা শুনবে না। হেডস্যার আমায় বকা দেবেন। জীবন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠবে। ঠিক আছে। এই ডায়েরিতে আর কিছু লিখব না। এলোমেলো লেখা হয়ে যাচ্ছে।
এরপরে ডায়েরিতে আর কিছু লেখা নেই। জিনিয়ার কৌতূহল হল। উদ্দালকের আর কোনও ডায়েরি আছে? ঘরে কোনও ডায়েরি দেখতে পেল না সে।
৫
সৌপ্তিকদের বাড়ির তালা খুলে জিনিয়া বলল, “কদিন এলাম না। নোংরা হয়ে গেছে।”
উদ্দালক বলল, “বাগানটা কিন্তু ভারী সুন্দর। অযত্নে গাছগুলো মরে যাচ্ছে। আগাছাও হয়েছে। এখানে কিছু গাছ লাগানো যেতে পারে।”
জিনিয়া ঝাঁটা বের করে ঘর ঝাঁট দিতে শুরু করল।
উদ্দালক ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখতে লাগল। জিনিয়া একটা ঘর দেখিয়ে বলল, “এটা সৌপ্তিকের ঘর। খাটের ওপর অ্যালবাম রাখা আছে। দেখুন।”
উদ্দালক সৌপ্তিকের ঘরে ঢুকল।
ঘরে সৌপ্তিকের একটা বাঁধানো ছবি রাখা। সে একটা ন্যাকড়া জোগাড় করে ছবিটা মুছে দিল। জিনিয়া সেটা দেখে কিছু বলল না। বলল, “লাঞ্চে কী খাবেন? রান্না করব?”
উদ্দালক বলল, “কী দরকার আছে? খাবার আনিয়ে নেওয়া যাবে। আমি বই নিয়ে এসেছি। পড়ছি, আপনি সময় নিন।”
জিনিয়া বলল, “ঠিক আছে।”
উদ্দালক ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে বই পড়তে শুরু করল।
জিনিয়ার ঝাঁট দেওয়া হয়ে গেছিল। সে সৌপ্তিকের অ্যালবাম দেখতে বসল।
উদ্দালকের ফোন বাজছিল। দেখল মা ফোন করছে। ধরল, “বলো।”
মা বলল, “কী খবর তোর? কী করছিস?”
উদ্দালক বলল, “কলকাতা এসেছি।”
মা বলল, “কী করতে?”
উদ্দালক বলল, “ওর অফিসের কিছু কাজ ছিল। সেগুলো মিটিয়ে নিয়ে ফিরব।”
মা বলল, “হুঁ। সংসার কিছু করছিস, না আগের মতোই করে যাচ্ছিস?”
উদ্দালক বলল, “কেন সংসার করব না? বিয়ে দিয়েছ তো সংসার করার জন্যই। দারুণ সংসার করছি।”
মা বলল, “আমি দেখতে যাব?”
উদ্দালক বলল, “কেন আসবে না? অবশ্যই আসবে। তুমি আসতে চেয়েছ আর আমি আটকেছি, কোনও দিন হয়েছে?”
মা বলল, “দেখ বাবু, আমি তোর কিছুই বুঝতে পারিনি। তুই আমার ছেলে, কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় তুই অনেক দূরের কেউ। তুই এই মেয়েকে নিয়ে সুখে থাকতে পারবি?”
উদ্দালক বলল, “না পারার তো কোনও কারণ নেই।”
মা বলল, “তোকে ওর আগের প্রেমিকটার কথা কিছু বলেছে?”
উদ্দালক আড়চোখে দেখল জিনিয়া মন দিয়ে সৌপ্তিকের অ্যালবাম ঝাড়পোঁছ করছে। সে বলল, “হ্যাঁ, সব তো বলেনি। বলেছে কিছুটা। এরকম অনেকেরই থাকে। এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন?”
মা বলল, “আমি মাথা ঘামাব না তো কে ঘামাবে? আমাকেই তো মাথা ঘামাতে হবে! অদ্ভুত জেদ করে বিয়েটা করলি জোর করে। সব কথা আমাকে খুলেও বলিস না। তুই কি আমাকে শত্রু মনে করিস?”
উদ্দালক বলল, “তা না মা। এখানে শত্রু মিত্রর কোনও ব্যাপার নেই। অহেতুক রিঅ্যাক্ট করছ তুমি।”
মা বলল, “জিনিয়ার বাবা বলছিলেন দুই ফ্যামিলি একসঙ্গে কোথাও একটা ঘুরতে গেলে ভালো হয়। যাবি?”
উদ্দালক বলল, “আমার তো স্কুল আছে। তোমরা ঘুরে এসো।”
মা ধমক দিল, “যখনই কোনও কাজের কথা বলি, তুই স্কুল দেখিয়ে দিস। গরমের ছুটিতে তো যেতে পারবি। যাবি কি না বল, তাহলে টিকেট কাটতে দেব।”
উদ্দালক বলল, “ঠিক আছে, আমি দেখি ওর অফিস ছুটি পাবে নাকি, তাহলে জানাব।”
মা গজগজ করতে লাগল, “আর-এক নতুন ঝামেলা শুরু হয়েছে। আমরা কিছু ঠিকও করতে পারব না?”
উদ্দালক বলল, “কেন করতে পারবে না? আমি কি না বলে দিয়েছি? আমি বললাম কথা বলে জানাব। রাগ করছ কেন? প্রেশারের ওষুধ খেয়েছ?”