রুমকি মেসেজ করেছে। তাড়াতাড়ি ফেরে যেন। অনেক কথা আছে।
আদিত্য দেখল শুধু৷ উত্তর দিল না। কোনও কোনও ঘটনায় জড়াতে না চাইলেও জড়িয়ে যেতে যেতে একসময় এমন অবস্থা হয় যে বেরোনোর পথ থাকে না। রিন্টুর নাম রুবেল, এটা জানার পর ঝুমকি যেমন বেরোতে চেয়েছিল।
আদিত্য ভাবল, সত্যিই তো! ভালোবেসে বেরোতে চেয়েছিল, কেন বেরোতে চাইবে? পরক্ষণে মনে হল একটা সম্পর্কে প্রবেশের আগে অপর পক্ষকে নিজের খুঁটিনাটি জানানোটাও সম্পর্কের প্রধান শর্ত হওয়া উচিত৷ ভালোবাসাটা যদি মোক্ষ হত, তবে ভালোবেসেই রিন্টু ঝুমকিকে অনায়াসে জয় করতে পারত। ঝুমকির পালিয়ে আসার প্রয়োজন পড়ত না। জোর করা কেন? নিজের ধর্মে আর-একজন মানুষ বাড়িয়ে কী হবে? আদিত্য বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
এখন কি আবার ক্রুসেডের সময় আসছে? সেই মধ্যযুগই ফিরে আসবে? মানুষের থেকে ধর্ম বড়ো হয়ে যাচ্ছে?
চা বিস্বাদ লাগছিল তার। ফেলে দিল। সুশোভনের জিপ থেকে নেমে চায়ের দোকানেই এলেন। তাকে দেখে বললেন, “কী ব্যাপার? গৃহে শান্তি নেই?”
আদিত্য কাঁধ ঝাঁকাল। সুশোভন সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “চ ভেতরে গিয়ে বসি।”
দুজনে মিলে হাঁটতে হাঁটতে পুলিশ কমপ্লেক্সে ঢুকল। আর পাঁচটা কমপ্লেক্সের মতোই। প্রায় সব কোয়ার্টার থেকেই সিরিয়ালের গান ভেসে আসছে।
সুশোভন বললেন, “তোকে দেখে আজকাল মনে হয় বিয়ে না করে বেঁচে গেছি। মানে কতরকম জ্বালা ভাব মানুষের৷ বিয়ে করে এক জ্বালা। শ্বশুরবাড়ির পরিবারকে রক্ষা করলে এক জ্বালা। না করলে আর-এক। মানে যা তা মাইরি!”
দরজা খুললেন সুশোভন। আদিত্য বিরক্ত গলায় বলল, “ঝুমকি আমার নিজের বোন হলে কান ধরে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মারতাম। পাকা মেয়ে কোথাকার!”
সুশোভন সোফায় বসে জুতো খুলে জুতোজোড়া সোফার তলায় ঠেলে দিয়ে বললেন, “ভুল করছিস। পাকামির কিছু নেই। ভুলের থেকেও বড়ো কথা, ভিকটিম ব্লেমিং করছিস। এটা যে-কোনো রেপের পর পলিটিক্যাল লিডাররা করে৷ যে রেপড হয়েছে, দোষটা যেন তারই। ঝুমকির দোষ খুঁজছিস তোরা। অথচ আমরাই নিঃশর্ত এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসা খুঁজি।”
আদিত্য গুম হয়ে বসল। সুশোভন সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে বললেন, “দিস র্যাকেট ইজ ইনক্রিজিং। লাভ জিহাদ অ্যান্ড অল। কনভার্ট অ্যান্ড দেন ম্যারেজ অর ভাইস ভার্সা। অনেকটা স্লিপার সেলের মতো কাজ করে ব্যাপারটা। হুইসপার ক্যামপেনিং, অ্যাজ ইফ অন্য ধর্মের মেয়ে বিয়ে করাটা বিরাট কৃতিত্ব।”
আদিত্য বলল, “আমি কী করব সেটা বল। কাল থেকে অফিস জয়েন করব? রুমকিরা প্ল্যান করছে ঝুমকিকে দূরে কোথায় পাঠাবে।”
সুশোভন হাসলেন, “দূরে মানে? আউটসাইড কান্ট্রি?”
আদিত্য মাথা নাড়ল, “না আউটসাইড স্টেট।”
সুশোভন বললেন, “ধুস, এদের নেটওয়ার্ক কতটা তোদের কোনও ধারণা নেই বলে বলছিস। যেদিন খুঁজে পাবে পাতি খুন করে দেবে।”
আদিত্য শিউরে সুশোভনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন কী করার আছে?”
সুশোভন তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমিও অন্ধকারে৷ জাস্ট ভেবে যাচ্ছি কী করা যেতে পারে। তুই অফিস জয়েন কর। আর রুমকিকে বল এখন চুপ করে থাকতে।”
আদিত্য বলল, “ওটাই তো ওদের সমস্যা। চুপ করে থাকলে তো হয়েই যেত!”
সুশোভন বললেন, “ওকে, চল আমি যাব তোর বাড়ি। আমি বললে যদি কিছু হয়।”
৪৩
সুশোভনকে নিয়ে আদিত্য বেরোতে গিয়ে রাস্তাতেই বাধা পেল। মিছিল বেরিয়েছে৷
সুশোভন বললেন, “মিছিলটা শান্তই, তবে মিছিলের মধ্যে কয়েকজনের বডি ল্যাংগুয়েজ সুবিধের লাগছে না। এনআরসি বিরোধী মিছিল মানেই এখন রেড অ্যালার্ট থাকছে।”
আদিত্য বিরক্ত মুখে বলল, “চারদিকে সমস্যা। বাড়িতে সমস্যা, বাইরে সমস্যা। এত সমস্যা হলে তো পাগল হয়ে যাব রে।”
সুশোভন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সময়টাই বড্ড খারাপ যাচ্ছে বুঝলি। মানুষজনও কনফিউজড হয়ে যাচ্ছে। কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ বুঝতে পারছে না। ইভেন আমিও জানি না এনআরসি করে কী লাভটা হবে। তবে এই এক শ্রেণির মানুষকে যে তাতানো হচ্ছে মারাত্মক পরিমাণে, সেটা বুঝতে পারছি। এই যে জ্যামে আটকা পড়ে আছিস এদের জন্য, এই বিশেষ পোশাক পরিহিত মানুষজনকে, যাদের সারাবছর তেমন চোখেই পড়ে না রেড রোডে নামাজের সময়গুলো বাদ দিয়ে, তোর মনে হচ্ছে না একটা বন্দুক নিয়ে সবাইকে শেষ করে দিই? আদতে, সমস্যার গভীরে গেলে দেখতে পাবি তোর থেকে এরাও খুব একটা আলাদা আনন্দে নেই। এরাও কষ্টে আছে, সমস্যায় আছে। পেটের সমস্যা আছে। সময় বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রায়োরিটি চেঞ্জ হওয়া প্রয়োজন ছিল। দুর্ভাগ্যবশত সেটা হয়নি। মধ্যযুগেও ব্যাপারটা ধর্মে আবদ্ধ ছিল, ব্রিটিশ আমলেও। তুই জাস্ট ভাব, একটা জাত আমাদের দুশো বছর শাসন করল। কোথায় তাদের তাড়ানোটা আমাদের কাছে প্রাধান্য পাবে তা নয়, সুকৌশলে তারা আমাদের দুভাগ করে দুটো দেশে ভাগ করে দিয়ে চলে গেল। বাঙালির মেরুদণ্ডটাই ভেঙে দিয়ে চলে গেল। এতদিন পরে কোথায় সেই ক্ষত নিরাময়ের চেষ্টা করব আমরা তা নয়, এখনও সেই ধর্মটাই আমাদের কাছে প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে।”
আদিত্য বলল, “তুই আমাকে একটা কথা বল, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হল। তাহলে পাকিস্তান মুসলমানদের হল আর ভারত কেন ধর্মনিরপেক্ষ হল? হিন্দুরা আলাদা হল না কেন?”