মানালির ফোন বাজছিল। ফোন বের করে মানালি দেখল ধ্রুব বাগচী ফোন করছেন।
ধরল, “বলুন স্যার।”
ধ্রুব বাগচী বললেন, “খানিকক্ষণ আগে ঈপ্সিতা এসেছে। আপনি ইচ্ছা করলে আসতে পারেন। ও আপনার সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে চায়।”
ফোনটা কেটে গেল।
মানালি মাথায় হাত দিয়ে কয়েক সেকেন্ড বসে থেকে বলল, “চলুন।”
দীপ অবাক হয়ে বলল, “কোথায়?”
মানালি বলল, “আপনার জীবনে এক্সাইটমেন্ট কমে যাচ্ছে। চলুন, আমার তুমুল ঝাড় খাওয়া দেখবেন। আপনি এত কিছু বললেন, আমারও মনে হল আপনি একটা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আছেন যেখানে মানুষের প্রেমটাই সব। আর কোনও সমস্যাই নেই। দেখবেন নাহয় সেটাই।”
দীপ হতভম্ব হয়ে মানালির দিকে তাকিয়ে রইল।
৩৮
কলিং বেলের সুইচ টেপার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঈপ্সিতা দরজা খুললেন। মানালি সারা রাস্তা ধরে শুধু এটাই ভেবে এসেছে ঈপ্সিতার মুখোমুখি হলে সে কী করবে। খানিকটা ঝোঁকের মাথাতেই চলে এসেছে সে। বিশ্বরূপদাকেও জানায়নি সে ধ্রুবর এখানে আসবে।
দীপ একবারই জিজ্ঞেস করেছিল এখানে সে এলে কোনও সমস্যা হবে নাকি। মানালি বলেছে, চলুন চুপচাপ থাকবেন, কী আর হবে।
ঈপ্সিতাকে দেখে মানালি কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, “ভালো আছেন?”
ঈপ্সিতা দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন, “আসুন।”
তারা ভিতরে ঢুকল।
অন্যান্য দিন ফ্ল্যাটের সব জানলা বন্ধ থাকে, এখন জানলাগুলো সব খোলা। রোদ এসে পড়ছে জানলা দিয়ে। ধ্রুব বসেই ছিলেন ড্রয়িং রুমে। তাদের দেখে বললেন, “বসুন। আজকের ফটোগ্রাফারটি নতুন মনে হচ্ছে?”
মানালি বলল, “উনি ফটোগ্রাফার নন, বন্ধু বলতে পারেন।”
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে বললেন, “বিশেষ বন্ধু?”
মানালি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “না না। বরং একটু কম বন্ধু বলতে পারেন। এখনও বন্ধু হয়ে উঠতে পারেননি।”
ধ্রুব বললেন, “ওহ। নো প্রবলেম। সরি ফর আস্কিং পিসি মাসি টাইপস অফ কোশ্চেন। একটা ছেলে আর মেয়ে একসঙ্গে দেখলেই তারা একগাদা অ্যাসাম্পশনস করে ফ্যালে। আপনার নাম কী?” ধ্রুব দীপের দিকে তাকাল।
দীপ অন্যমনস্কভাবে ঘরের অন্যান্য আসবাবপত্র দেখতে দেখতে বলল, “দীপ গাঙ্গুলি।”
ধ্রুব বললেন, “আপনি বুঝতে পারছেন আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
দীপ কয়েক সেকেন্ড ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ বুঝতে পারছি। ওর ধারণা আপনারা ওকে খুব ঝাড়বেন, তাই আমাকে নিয়ে এসেছেন যাতে ঝাড়টা কম খেতে হয়।”
ধ্রুব আর ঈপ্সিতা দুজনেই হেসে ফেললেন। মানালিও হাসল।
দীপ বলল, “আমি কি ভুল কিছু বললাম?”
ধ্রুব বললেন, “একেবারেই না। তবে মানালি কিংবা আপনি যা ভাবছেন তা ভুল। ঈপ্সিতা আর আমি আসলে মানালিকে একটা গল্প শোনাতে ডেকেছি। কেন জানি না মনে হল, গল্পটা মানালির জানা দরকার। তার আগে একটু স্যান্ডউইচ খাওয়া যাক?”
মানালি মাথা নাড়ল, “না না, আমার খিদে নেই। আপনি বলুন।”
দীপ বলল, “চিকেন না ভেজ? ভেজ হলে খাব না।”
ধ্রুব বললেন, “চিকেন। চিন্তা নেই।”
ধ্রুব উঠতে যাচ্ছিলেন। ঈপ্সিতা বললেন, “আমি এনে দিচ্ছি। তুমি বোসো।”
দীপ মানালির দিকে তাকাল, “কিছু মনে করবেন না, আমার মাথা ঠিক কাজ করছে না কদিন ধরে। ব্যাপারটা কি হ্যাংলামি হয়ে গেল?”
মানালি বলল, “না না, তা কেন মনে হবে?”
ধ্রুব বললেন, “হ্যাংলা হওয়া ভালো। পেটে খিদে মুখে লাজ হওয়াটা কোনও কাজের কথা না। অথচ দেখবেন আমাদের এটাই শেখানো হয়। ভদ্রতা করো। এই এক ভদ্রতা শব্দটাই আমাদের সব কিছু নষ্ট করে রেখে দিয়েছে।”
দীপ বলল, “ঠিক বলেছেন। এই যে কথাটা আপনি বললেন, পেটে খিদে মুখে লাজ। এর থেকে বাজে জিনিস আর কিছু হয় না। আমি একটা উদাহরণ দি…” দীপ উদভ্রান্তের মতো মানালির দিকে তাকাল, “আমি কি বেশি কথা বলছি?”
ধ্রুব সিগারেট ধরালেন, “একেবারেই না। বেশি কথা বলছেন না। পেটে খিদে রাখবেন না, যা বলার বলে ফেলুন।”
দীপ উৎসাহ পেল, “আমি মনে করি বেশিরভাগ প্রেমিক প্রেমিকাই চায় পরস্পরের কাছে আসতে। কিন্তু চারদিকের পিউরিটান সমাজ তাদের পেছন থেকে টেনে রাখে। জাস্ট ভাবুন, এরা প্রেম করে অথচ শারীরিক সম্পর্কটাকে নিয়ে কত রকম কিছু ভেবে ফ্যালে। এগুলো হিপোক্রেসি নয়?”
ঈপ্সিতা স্যান্ডউইচের প্লেটটা দীপের দিকে এগিয়ে দিলেন। ধ্রুব বললেন, “অবশ্যই। আমরা যখন প্রেম করেছি, সেই সময়টাতেও এসব নিয়ে আমাদের কোনও রকম শুচিবাই ছিল না।”
দীপ স্যান্ডউইচে কামড় দিল।
মানালি ধ্রুবর দিকে তাকাল, “অ্যাকচুয়ালি দীপ ওর সব কিছু নিয়ে ভীষণভাবে ডিস্টার্বড। আপনি বরং আপনাদের গল্পটা…”
ধ্রুব বলল, “হুঁ। দ্যাট ড্যাম স্টোরি। কিংবা গল্প হলেও সত্যি। একটা ধূসর নস্টালজিক সময় কল্পনা করুন মানালি। অত্যন্ত মেধাবী এক ছাত্রী। এক ভবঘুরে ইন্টেলেকচুয়াল সাজতে চাওয়া চালচুলোহীন যুবক। প্রেমে পড়ে গেল। প্রেম মানে যে সে প্রেম নয়। প্রেম মানে সে ভয়াবহ প্রেম। একে অপরকে আঁচড়ে কামড়ে দেওয়া প্রেম। আমরা শুরুতে কখনোই ঘর বাঁধার কথা ভাবতেও পারিনি। কিন্তু হঠাৎই একটা অ্যাড এজেন্সিতে আমার চাকরি পেয়ে যাওয়া, কিছু হঠাৎ জেগে ওঠা আবেগ আমাদের বিয়ে করিয়ে দিল। এ বাড়ি ও বাড়ি কোনও বাড়িই মানেনি সে বিয়ে যদিও।”
মানালি ঈপ্সিতার দিকে তাকাল। ঈপ্সিতা জানলার বাইরে তাকিয়ে আছেন।