বাসটায় খুব বেশি ভিড় ছিল না। মানালি বসার জায়গা পেল। শুনতে পেল তার সামনের সিটেই কমবয়সি দুজন ছেলে বেশ উত্তেজিত ভাবে চাপা গলায় ধ্রুব বাগচীর ব্যাপারে আলোচনা করছে।
একজন বলছে, “ভাই, আমি ভাবতাম আর যাই হোক, এই লোকটা অন্তত সাদা কাপড়ের লোক। এ তো দেখছি আরও এক কাঠি সরেস। কেচ্ছাটা জানতামই না ভাই?”
পাশের জন বলছে, “যাই বল, শ্রীপর্ণা ঘোষালের মধ্যে একটা অ্যাপিল আছে। এই বয়সেও ভদ্রমহিলা নিজেকে যা তা লেভেল মেন্টেন করেছে। ধ্রুব বাগচীর আর দোষ কী! ফাঁকা ফ্ল্যাট পেত। চলে যেত।”
দুজনেই উদ্দেশ্যপূর্ণ হাসল। প্রথমজন বলল, “আমাদের কপাল দেখ, পরকীয়া করব কী, নিজেরটা করার মতো পাবলিক জোটাতেই প্যান্ট হলুদ হয়ে যাচ্ছে।”
পাশের জন বলল, “থাম, ওই লেভেলটায় গেলে সবার হয়। কোথায় ঝাঁসির রানি আর কোথায় বিছনায় মুতুনি।”
প্রথমজন রেগে গেল, “কেন বে? দাঁড়া না, চাকরিটা পেতে দে, দেখবি সামনে পিছনে দুটো করে মামণি নিয়ে ঘুরব। তুই দেখবি আর জ্বলবি, সি এফ এলের মতো ফুলবি।”
মানালির হাসি পাচ্ছিল। সে দেখতে পেল তার পাশে বসা গম্ভীর ভদ্রলোকও ছেলেদুটোর কথায় মুচকি মুচকি হাসছেন। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ওঠার আলাদা মজা আছে। মাঝে মাঝে এমন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া যায়, যা মনের ভারকে অনেকটাই লাঘব করে দেয়।
ফোনটা একবার অন করল মানালি। একগাদা এস এম এস এসেছে। বেশি কিছু ভাবতে পারল না সে। ফোনটা অফ করে দিল।
হাইল্যান্ড পার্কে বাস থেকে নেমে গেল সে। সবে মলের দোকানগুলো খুলছে। খুব বেশি লোক আসেনি। বিগ বাজারে একা একা ঘুরল। এসকেলেটরে করে উপর নিচ করল। খানিকক্ষণ এদিক ওদিক করে হঠাৎই তার চোখ পড়ল দীপের ওপরে। একা একা দাঁড়িয়ে কাচের ফাঁক দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে।
মানালি এগিয়ে গেল, “কী ব্যাপার? অ্যাপো আছে নাকি?”
দীপ খানিকটা চমকে তাকে দেখে বলল, “ওহ আপনি! না না, ওসব কিছু নেই। অফিসের জন্যই বেরিয়েছিলাম। মাঝরাস্তায় এসে এখানে চলে এলাম কিছু না ভেবেই।”
মানালি অবাক চোখে দীপের দিকে তাকিয়ে বলল, “সেম হিয়ার। আমিও অফিস বাঙ্ক করেছি। মনে হচ্ছে না আর কোনও দিন অফিসে যেতে পারব বলে। আচ্ছা, আপনার চোখ মুখ এরকম বসা বসা লাগছে কেন?”
দীপ খানিকটা সচেতন হয়ে বলল, “ওহ, একটু স্ট্রেস যাচ্ছে আর কি!”
মানালি বলল, “আমারও তো। আজ সময়ের কণ্ঠস্বর পড়েছেন? দ্যাট বিগ ব্রেকিং নিউজ?”
দীপ অপ্রস্তুত হল, “না, মানে আজ আর কাগজ পড়ার মতো অবস্থায় ছিলাম না। কী ব্রেকিং নিউজ বলুন তো!”
মানালি বলল, “ধ্রুব বাগচীকে চেনেন?”
দীপ বলল, “না! কে সে? নামটা একটু শোনা শোনা লাগছে।”
মানালি বলল, “আপনি বাংলা সিনেমা দেখেন না?”
দীপ বলল, “সেরকম দেখা হয় না। সময় কোথায়? শেষ মনে হয় হলে গিয়ে দেখেছিলাম কয়েক বছর আগে। এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে। ইন্টারভ্যালের বেশি টিকতে পারিনি। গান শুনি অবশ্য।”
মানালি হাসল, “ওহ, তাহলে আপনি ধ্রুব বাগচীকে চিনতে পারবেন না। উনি এই সময়ের একজন বিখ্যাত পরিচালক। ওঁর একটা কেচ্ছা ফাঁস করেছি আমি আজকে।”
দীপ বলল, “তাহলে তো আপনার ভালো খবর! এর জন্য এত স্ট্রেস নিচ্ছেন কেন?”
মানালি মাথা নাড়ল, “মোটেও ভালো খবর নয়। খুব ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোক। আমার কপালে দুঃখ আছে। আর এই নিউজটা আমার এডিটর খানিকটা জোর করেই করালেন। তবে সেসব না, কোথাও গিয়ে একটা এথিক্সে লাগছে আমার।”
দীপ অন্যমনস্ক হয়ে ছিল। মানালির কথা শুনছিল না। ওভাবেই বলল, “ও।”
মানালি বলল, “ধ্রুব বাগচীর ওয়াইফ ঈপ্সিতা খুব ভালো মানুষ। আমি হয়তো ওঁর জীবনটাকে আর-একটু কঠিন করে দিলাম।”
দীপ বলল, “আচ্ছা।”
মানালি বলল, “বাদ দিন। ভাবতে চাইছি না এসব নিয়ে। আপনি বলুন, আপনার লাভ লাইফ কেমন চলছে?”
দীপ বলল, “ভয়াবহ।”
মানালি অবাক হল, “মানে?”
দীপ বলল, “আমার কোনও লাভ লাইফ নেই। যেটুকু ছিল কাল রাতেই সব ভেসে গেছে।”
মানালি জিভ কেটে বলল, “এ বাবা, তাই জন্য আপনিও আমার মতো এভাবে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন?”
দীপ বলল, “হ্যাঁ। জীবনের ট্রাজেডি কী জানেন?”
মানালি বলল, “কী?”
দীপ বলল, “যখন জীবনে মেয়ে আসে না, তখন কেউ আসে না, যখন আসে, তখন ঠিক আর-একজনকে সাথে নিয়ে আসে। অন্তত আমার জীবনে এসেছিল।”
মানালি বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
দীপ বলল, “না বোঝারই কথা, বিশেষ করে আমার সম্পর্কে যখন আপনি কিছুই জানেন না।”
মানালি বলল, “বলতে পারেন। আমারও বিশেষ কাজ নেই আজকে পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া।”
দীপ বলল, “কী বলব বলুন! নিজেকে ভিলেন দেখিয়ে পৃথিবীতে কটা লোক গল্প বলেছে আজ অবধি?”
মানালি বলল, “আপনি বলুন। সে হিসেবে দেখতে গেলে আমিও তো ভিলেনই আজ। এথিক্স ভেঙেছি, বস যা বলেছে তাই করেছি, নিজের মেরুদণ্ড সোজা পর্যন্ত রাখতে পারিনি। আপনি বলতে পারেন। আমার তেমন পিএনপিসি করার মতো কেউ নেই। আপনার তথ্য সুরক্ষিত থাকবে।”
দীপ শূন্য দৃষ্টিতে কাচের জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, “সম্প্রতি এক বিয়েবাড়িতে এক মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমারও তাকে পছন্দ ছিল। তারও আমাকে। ফোন করা হল। যেভাবে সব কিছু চমৎকার ভাবে শুরু হয়, আমারও তেমনভাবেই শুরু হয়েছিল। সম্পর্কটা একটু এগোতেই আমি ব্যাপারটাতে নিজেকে তেমনভাবে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ঠিক এই সময় আর-একজনের সঙ্গে আলাপ। একদিনের আলাপেই…”