বাবা কথাটা এমনভাবে বলল যেভাবে ব্র্যাডম্যান বলেছিলেন সচিন অনেকটা আমার মতো খেলে।
দাদা পানসে মুখে বলল, “তোমাদের কী? তোমাদের তো আর বউ সামলাতে হবে না! আমাকে সামলাতে হবে। রাতে কী কপালে নাচছে কে জানে!”
বাবা বলল, “হেসে ফেলবি না। তাহলেই হবে। হেসে ফেললেই কেলো। তোর মার সামনে একবার কী একটা সিরিয়াস কেস খেয়ে হেসে ফেলেছিলাম। বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল আমার। মনে রাখবি একটাই টিপস, চুপচাপ ঝাড় খেয়ে যাবি। হেসে ফেলবি না।”
দাদা গজগজ করে যেতে লাগল।
বউদি গম্ভীর মুখে এসে ভাত বাড়তে শুরু করল।
বাবা বলল, “বউমা তুমিও বসে যাও। আবার পরে খাবে কেন?”
বউদি বলল, “আমার খিদে নেই বাবা।”
বাবা বলল, “খিদে না থাকা মোটেও ভালো জিনিস না মা। গ্যাস হয়নি তো? কারবোভেজ খেতে পারো।”
বাবা কদিন হল কোমর বেঁধে হোমিওপ্যাথি চর্চা করছে। বই কিনে এনেছে মোটা একটা। সেটা সারাদিন মুখস্থ করে যাচ্ছে।
বউদি কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল।
দাদা ভালো মানুষের মতো বলল, “বাবা যখন বলছে তখন বসে গেলেই পারো।”
বউদি শব্দ করে চেয়ার টেনে বসে পড়ে বলল, “কোথাকার না কোথাকার মেয়ে! কী করে কে জানে! ঘরে নিয়ে এসে তুলবে।”
দাদা পা দিয়ে আমার পা ঠেলে ইশারা করে বলল, “কী রে অমু, কোথাকার মেয়ে? কী করে?”
আমি বললাম, “অঙ্কের টিচার। খুব ভালো মেয়ে।”
বাবা গম্ভীর গলায় বলল, “অঙ্ক? ওরে বাবা! অমু, তোর ডিফারেন্সিয়ালটা তো এখনও কাঁচা আছে, শিখে নিস ভালো করে।”
বউদি আমার দিকে কটমট করে তাকাল। আমি ভাতে নজর দিলাম।
দাদা বলল, “অঙ্কের টিচার তো ভালো। ভালো মানে খুবই ভালো। বাড়ির হিসেব-টিসেব মেলাবে! কী বলো বাবা?”
বউদি জোরে জোরে ভাত মাখছে। কোনও কথা বলল না। দাদা অনন্যার মাংসের বাটি থেকে খানিকটা মাংস আমার পাতে আর খানিকটা নিজের পাতে নিয়ে বলল, “মাংসের কালারটা হেবি হয়েছে তো! তোমার রান্নার হাত দিন দিন স্বর্গীয় লেভেলে চলে যাচ্ছে। চিনিও দাওনি দেখছি। অনন্যা এ মাংস খেলে তো দু লিটার জল খেয়ে নিত, ওর কাছে এ তো মাংস না, লংকার দোকান!”
বউদি দাদার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল, “রাস্তায় রাস্তায় দেখা না করে মেয়েটার বাড়ির সঙ্গে কথা বললে ভালো হয়। মা নেই, আমাকেই তো সব করতে হবে এখন।”
দাদা বলল, “আমাদের অফিসের শম্ভুদার ভাই আইটি ইঞ্জিনিয়ার। অনন্যার জন্য দেখব নাকি?”
বাবা আর আমি একসঙ্গে বিষম খেলাম।
কী করে হল কে জানে!
১৩ জীমূতবাহন
একটা ভিডিও দেখেছিলাম কোন একটা মলের। মানুষ গিজগিজ করছে। মানুষের চাপ সহ্য করতে না পেরে লোক সুদ্ধ সে মল ভেঙে পড়েছিল।
এ শহরের সেই অবস্থা হবে নির্ঘাত যে-কোনো দিন।
মানুষের চাপ আসতে আসতে ভয়াবহ অবস্থা হয়ে গেছে।
আমার অবশ্য বউ বাপের বাড়ি চলে গেছে। এসব দার্শনিক কথা না ভাবলেও চলবে। কিন্তু ভোর সাড়ে ছটাতেই চায়ের দোকানে গিজগিজে লোক দেখে এ কথা ছাড়া আর কী মনে আসবে?
বেঞ্চিগুলোতে বয়স্ক লোকেরা বসে আছেন। মর্নিং ওয়াকে গেছিলেন, এখন ফেরার পথে চা খেয়ে বাড়ি ফিরবেন। রাজনীতির কচকচিই চলছে। আমি সাইড দেখে বসতে এক কাপ দুধ চা এল। সঙ্গে একটা বিস্কুট। বিস্কুটটা নিশ্চয়ই ফ্রি না, টাকা নিয়ে ছাড়বে। তা নিক।
আমার কী? আইনি ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে আমায় এবার। কী বাঁচা বেঁচে গেছি সেটাই ভাবছি। এ মেয়ে গলায় জুড়লে অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। এরকম পচা ঘচা বাংলা সিরিয়ালের মতো বিয়ে হবে সেটাও তো কোনও দিন ভাবিনি।
পাশের দুটো বুড়ো বিরাট আলোচনা শুরু করেছে। হনোলুলু থেকে নিউ জার্সি, ট্রাম্প থেকে তারিণী ঘোষ, কাউকে বাদ দিচ্ছে না। চায়ের মধ্যে তর্ক করার যে তীব্র জীবনীশক্তি থাকে, তা মনে হয় আর কোনও কিছুতে থাকে না। বাংলা মদেও না।
চা-টা ভালো। বিস্কুটটা চায়ে চুবিয়ে খেতে ভালো লাগছে। বিস্কুটের মধ্যে বাদাম আছে। এরকম বিস্কুট খেতে বড্ড ভালো। এগুলো লোকাল বেকারির বিস্কুট। বড়োলোকের “বিস্কিট” না।
বিস্কুটটা খেয়ে আর-একটা চাইতে হল। চাও আর-এক কাপ খেতে হবে। সকালে উঠিয়ে দিয়েছে। এখন মাথা কাজ করছে না। আমার এই এক সমস্যা। ভোরে উঠলে মাথা কাজ করে না। এই লোকগুলো ভোরে উঠে হেঁটে এসেছে।
হাঁটলে হার্ট ভালো থাকে। সুগার প্রেশারের সমস্যা কমে যায়।
এত বেঁচে থাকার চাহিদা হবে কেন মানুষের? কী হবে বেঁচে থেকে? তাও এই বুড়োদের? সারাজীবন তো কেটেছে। চাকরি করেছে, ছেলেপুলে মানুষ করেছে। এখন মরে গেলেই তো হয়। বাঁচার কী তীব্র ইচ্ছা!
আমার তো বিয়ের পর থেকেই মরে যেতে হচ্ছে করছে।
লজ্জার ব্যাপার হবে। অফিসে সবাই জেনেও গেছে। এখন আবার বলব কাকা কেঁচে গণ্ডূষ হয়েছে? থুথুক্কি, সব ভুলে যাও? কী করে বলব? বললেও তো চাপ হয়ে যাবে!
অবশ্য মা বেঁচে গেল। পছন্দের সিরিয়ালে হাত পড়লে নিরীহ মহিলারাও ঝাঁসি কি রানি হয়ে যায়, এরকম কেস আমি স্বচক্ষে দেখেছি। বাবা রিমোট হাতে বিশ্বকাপ দেখব বলে মিনমিন করায় আমার আপাত নিরীহ মা এমন দৃষ্টি দিয়েছিল একবার, যে, ত্রেতা যুগ হলে বাবার ভস্ম পেতাম খালি। বাকি শরীরটা স্রেফ হাওয়ায় ভেসে যেত।
কিছু বললে মা একটাই কথা বলে, “সারাদিন এত কাজ করি, সন্ধেটা টিভি দেখব তাতেও তোদের আপত্তি? কদিন আর বাঁচব?”