নয়না ঠিকই বলেছিল। খসখসে আদুরে গলা। কেমন যেন ফিসফিসে সুরে কথা বলছে।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে পেশাদারি ঢঙে কথা বলল সুপ্রতিম, ‘কাইন্ডলি আপনার পুরো নাম বলুন।’
ও-প্রান্তের কণ্ঠস্বর একটু ধাক্কা খেল: ‘আমায়…আমায় চিনতে পারছ না! আমি ঝুমুর চৌধুরি। কলকাতা চোদ্দো থেকে বলছি। কত কষ্ট করে তারপর তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারলাম।’
ওদের টেলিফোন-ব্যবস্থাটা এমন যে, সব কথাবার্তাই টিভির দর্শকরা শুনতে পান। সেইজন্যেই সুপ্রতিম বেশ বিব্রত হয়ে পড়ছিল। ও ভাবছিল, কন্ট্রোল প্যানেলের একটা সুইচ টিপে টেলিফোনের কথাবার্তা শোনানোর ব্যবস্থাটা অফ করে দেবে কি না। না কি রিসিভার নামিয়ে রেখে লাইন কেটে দেবে? কিন্তু পাগল মেয়েটা তো রোজ ফোন করার চেষ্টা করে জ্বালাতন করে মারবে!
এইসব ভাবতেই-ভাবতেই সুপ্রতিম কষ্ট করে পেশাদারি হাসি ফুটিয়ে তুলল মুখে। তারপর ওর নিজস্ব ঢঙে জানতে চাইল, ‘বলুন ম্যাডাম, কী আপনার সমস্যা? ”মুশকিল আসান” নিশ্চয়ই তার সমাধান বাতলে দেবে।’
‘আমার… আমার প্রবলেম তুমি। আমি তোমার সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে দেখা করব। যখন…যখন আর কেউ থাকবে না। বাড়িতে তিনবার ফোন করেছিলাম…তোমাকে পাইনি। কে ফোন ধরেছিল? তোমার…তোমার ওয়াইফ?’
শেষ প্রশ্নটা দর্শকরা শুনতে পাওয়ার আগেই কন্ট্রোল প্যানেলের সুইচ টিপে কথাবার্তা শোনানোর ব্যবস্থাটা অফ করে দিল সুপ্রতিম। কিন্তু রিসিভার নামিয়ে রাখল না। ঝুমুর চৌধুরি সম্পর্কে একটা কৌতূহল ওর মধ্যে মাথাচাড়া দিল।
‘হ্যাঁ— আমার বউ— নয়না। ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।’ কথাটা বলার সময় আড়চোখে মোনার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল সুপ্রতিম। ওকে হাত নেড়ে ইশারা করল প্রোগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
‘হঁঃ! জানতাম!’ বিরক্তি ফুটে উঠল ঝুমুরের গলায়। কিন্তু তারপরই ও কেমন অদ্ভুতভাবে হেসে উঠল। খসখসে আদুরে গলার হাসি?
একটু পরে হাসি থামিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘কাউকে আমি পরোয়া করি না। কেন জানো? কারণ, আমার ভালোবাসা অন্যরকম। এরকম ভালোবাসা তুমি জীবনে কখনও পাওনি। কবে তোমার বাড়িতে যাব বলো?’ শেষ প্রশ্নটায় যেন কোনো কিশোরীর মিনতি ঝরে পড়ল।
সুপ্রতিমের মন খুব দ্রুত চিন্তা করছিল।
মেয়েটি তো মনে হচ্ছে নিশ্চিত পাগল। ওর সঙ্গে দেখা করে সামনাসামনি বুঝিয়ে বললে কি ওর এই প্রেমের পাগলামি সারতে পারে? ওকে বলবে একবার বাড়িতে আসতে? কিন্তু নয়না যদি কিছু মাইন্ড করে!
প্রতি মঙ্গলবার সন্ধেবেলা নয়না কাছাকাছি একটা সেলাই-স্কুলে এমব্রয়ডারির কাজ শেখাতে যায়। ছ’টায় বেরোয়, দু-আড়াই ঘণ্টা পর ফেরে। ওর হাতের কাজ খুব ভালো। তা ছাড়া সূক্ষ্ম সেলাই নিয়ে সময় কাটাতে ওর বেশ লাগে। মঙ্গলবার সাড়ে ছ’টা-সাতটা নাগাদ তা হলে ঝুমুরকে আসতে বলবে সুপ্রতিম! তখন ফ্ল্যাট ফাঁকাই থাকবে। ঠিকে কাজের লোক বিমলামাসিও রোজ সন্ধেবেলা বাসন মেজে, ঘর মুছে ছ’টার মধ্যেই চলে যায়।
কিন্তু ফ্ল্যাটে ওকে একা পেয়ে মেয়েটা কোনো কাণ্ড বাধিয়ে বসবে না তো! দূর, কী আর করবে! সুপ্রতিম নিজে ঠিক থাকলে আর ভয় কীসের! কিন্তু মেয়েটার বয়েস কত? সতেরো, আঠেরো, কুড়ি হলে তো ইমোশনাল প্রবলেম হতে পারে।
সুপ্রতিম কেমন দিশেহারা হয়ে পড়ছিল। ঠিকমতো আর ভাবতে পারছিল না।
‘কবে যাব বলো?’ খসখসে আদুরে গলায় আবার জানতে চাইল ঝুমুর।
‘মঙ্গলবার সন্ধেবেলা। ঠিক সাতটায়।’ সুপ্রতিমের মুখ দিয়ে কেমন যেন আলতোভাবে খসে পড়ল কথাগুলো।
‘তোমাদের ফ্ল্যাটবাড়িটা আমি দেখে এসেছি। কাঁকুড়গাছিতে।’ সামান্য হাসল ঝুমুর। একটু থেমে তারপর বলল, ‘তোমার ফ্ল্যাটটা তো একতলায়…।’
পলকে ঘাম ফুটে উঠল সুপ্রতিমের কপালে। এর মধ্যেই ওর ঠিকানা বের করে বাড়িটা চিনে এসেছে মেয়েটা! মেয়েটাকে বাড়িতে ডেকে আবার কোনো বিপদ হবে না তো! তখন হয়তো সত্যি-সত্যিই থানা-পুলিশ করতে হবে। কিন্তু আর তো ফেরার পথ নেই! তির ছিটকে গেছে হাত থেকে।
‘মঙ্গলবার সন্ধেবেলায় যাব। ঠিক…সাতটায়…। দেখা হওয়ার আগে আর তা হলে ফোন করব না।’ একটু চুপচাপ। তারপর: ‘আমাকে একপলক দেখলেই তুমি বুঝবে কেন আমার ভালোবাসা অন্যরকম।’ চাপা গলায় কথাগুলো বলে অল্প হাসল ঝুমুরঃ ‘আই লাভ য়ু, লাভ। তুমি অপেক্ষা কোরো। ঠিক সাতটায়…।’
রিসিভার নামিয়ে রেখে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল সুপ্রতিম। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে স্মার্ট ঢঙে হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে গেল। তা সত্ত্বেও সুপ্রতিম মোনার সঙ্গে কথা বলে অনুষ্ঠানে সহজভাবে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করল।
‘মোনা, তুমি ভীষণ সেলফিশ।’
‘কেন?’ মোনা দুষ্টু হেসে তাকাল সুপ্রতিমের দিকে।
‘পাগলের প্রবলেমগুলো আমার ঘাড়ে চাপিয়ে নিজে দিব্যি মজায় আছ।’ তারপর দর্শকদের লক্ষ করে: ‘কী, আপনারাই বলুন—।’
মোনাও দর্শকদের দিকে তাকিয়ে মজার সুরে বলল, ‘যারা অন্যকে পাগল করে সেইসব পাগলের প্রবলেম তাদেরই সলভ করতে হবে। এটা আপনাদের সকলের প্রতি আমার উপদেশ। আশা করি ঠাট্টা করলাম বলে আপনারা কিছু মনে করবেন না।’ বড় করে হাসল মোনা। তারপর সুপ্রতিমের দিকে ফিরে বলল, ‘সুপ্রতিমদা, এবার সাক্ষাৎকার-পর্ব শুরু করুন। হাতে আর সময় বেশি নেই—।’