না বৎস তাহা হইতে পারে না।
কেন? কেন হতে পারে না? আমি কত বছর ধরে জমিয়ে রেখেছি আজ অন্তত বলতে দিন—অন্তত একজনকে বলে দেব আমি—
বিদ্যাসাগর হা—হা করে হাসতে হাসতে বেদিটার উপর উঠে বললেন, দেড় শত বৎসর ধরিয়া ভাবিও, আমার মতো—যে তুমি ঠিক না…ভুল, কুড়ি বৎসর যথেষ্ট কি?
শান্তনু বিকট চিৎকার করে এগিয়ে যায় বেদিটার দিকে। বিদ্যাসাগর নড়তে নড়তে স্থির হয়ে গেলেন।
শান্তনু সমানে চিৎকার করে যায়, প্লিজ বিদ্যাসাগর, প্লিজ ঈশ্বরচন্দ্র—প্লিজ আমি আর কাউকে বলতে পারব না…পারিনি…
খানিকক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে আসে ওর। পাথরের মূর্তিটাকে জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে একসময় ক্লান্ত হয় শরীরটা। ধীরে ধীরে নেমে আসে বেদিটা থেকে।
চিৎকার করে মূর্তিটাকে বারবার বলে — আমাকে বলতেই হবে। এইবারেই বলতে হবে।
পেটের ভিতরে একরাশ গ্লানি পুষে রয়েছে কত বছর। শান্তনু গলায় আঙুল ঢুকিয়ে যেন বের করে দিতে চায়। হড়হড় করে বমি বেরোয়। মাথাটা ভোঁ করে ঘুরতে থাকে। কাঁপতে কাঁপতে জলের দিকে এগিয়ে যায় ও। মার কথা মনে পড়ে বিপন্নতায়। মা বলতেন, রাতে জলের কাছে পাপের কথা বলতে হয়। পাপ দূর হয়।
শান্তনু জলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। চিৎকার করে বলে—শোনো সেদিন অশোকনগরে আমি ছিলাম না। আমি জয়ার কাছে গিয়েছিলাম। জয়াদের বাড়িতে কেউ ছিল না। সারারাত গান শুনে শেষরাতে একসঙ্গে শুয়েছিলাম। ও এখন আমার স্ত্রী। সেদিন প্রেমিকা ছিল। এক বিছানায় আমি যখন সম্ভোগে উত্তাল তখন প্রদীপ, দীপঙ্কর ওরা মরে পড়ে আছে রাস্তার ধারে। ইচ্ছে করলে প্রয়োজনীয় সংবাদ পৌঁছোতে পারতাম আমি। যাইনি।
জলের ভিতর থেকে কে যেন হা—হা শব্দে হেসে উঠল। চমকে উঠল শান্তনু। জলে চাঁদটা নেই। ঝুঁকে পড়ে আবার দেখার চেষ্টা করল ও। নেই। অথচ আলো চকচক করছে। ঘাবড়ে গিয়ে আকাশের দিকে তাকায় শান্তনু। পুব আকাশে তখন সূর্য উঠে গেছে। প্রথম আলো কলেজ স্কোয়ারের জলে চকচক করে রাত্রির মৃত্যু ঘটিয়েছে।
হল না। রাতের জলের কাছে বলা হল না। ডুকরে কেঁদে ওঠে শান্তনু। সূর্যের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে, তুমিও বিশ্বাসঘাতক—আমারই মতো…।
অর্ধেক পুরুষ – অনীশ দেব
সুপ্রতিম একটা ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওর মন বলছিল, ফোনটা আসবে। যদিও স্টুডিয়োতে লাইন পাওয়া বেশ ঝকমারি, তবুও ওর মনে হচ্ছিল সেই মেয়েটি যেরকম নাছোড়বান্দা তাতে লাইন ও পাবেই।
সন্ধে ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টা— এই আধঘণ্টা ধরে ‘সাইবার চ্যানেল’-এর ‘মুশকিল আসান’ অনুষ্ঠান টিভিতে দেখানো হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করে সুপ্রতিম আর ওর অনুষ্ঠান-সঙ্গিনী মোনা। দর্শকদের নানান ধরনের সমস্যার সমাধান বাতলে দেওয়া হয় এই অনুষ্ঠানে। মাত্র চারমাসেই ‘মুশকিল আসান’ সকলের মন কেড়ে নিয়েছে।
দর্শকরা নানান প্রশ্ন পাঠান সুপ্রতিমদের কাছে। সুপ্রতিম আর মোনা পালা করে সেসবের উত্তর দেয়। এ ছাড়া অনুষ্ঠান চলার সময় বহু ফোনও আসে ওদের স্টুডিয়োতে। কেউ-কেউ অনুষ্ঠানের প্রশংসা করেন, আর কেউ-বা নিজের কোনো সমস্যা তুলে ধরেন ওদের কাছে।
চিঠিপত্রের উত্তরগুলো ‘সাইবার চ্যানেল’-এর অফিসে কয়েকজন বসে ঠিক করেন। সেখানে সুপ্রতিম আর মোনাও থাকে। তবে টেলিফোনে পাওয়া সমস্যাগুলোর সমাধান সুপ্রতিম বা মোনাকেই চটজলদি করে সঙ্গে-সঙ্গে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জানিয়ে দিতে হয়। এর জন্য যে-বুদ্ধি এবং স্মার্টনেস দরকার, সেটা সুপ্রতিম আর মোনা দুজনেরই আছে।
সুপ্রতিমের চেহারা বেশ সুন্দর। ওর সৌন্দর্যে কীরকম যেন একটা বনেদি ঢং আছে। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা। ফরসা। স্বাস্থ্য মাঝারি। মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা। দাড়ি সুন্দর করে কামানো হলেও ফরসা গালে, থুতনিতে, নীলচে আভা থেকে গেছে। ঠোঁটের ওপরে কালো গোঁফ যেন তুলি দিয়ে আঁকা। বয়েস পঁয়তিরিশ হলেও অনেক কম দেখায়।
সুপ্রতিম যত না সুন্দর তার চেয়েও অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারে। ওকে ঘিরে অনেক দর্শকেরই কৌতূহল— বিশেষ করে মেয়েদের। অনেকেই ওকে ভালোবাসা জানিয়ে চিঠি দেয়। আবার কেউ-কেউ ওকে নানান ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চায়। সেইসব প্রশ্নের পাশকাটানো মজার উত্তর দেয় সুপ্রতিম।
ওর ডান ভুরুর ওপরে একটা কাটা দাগ আছে। সেটা নিয়ে এক তরুণী জিগ্যেস করেছিল, ‘আপনার ডান ভুরুর ওপরে ওই লাভলি কাটা দাগটা হল কেমন করে?’
সুপ্রতিম জবাব দিয়েছিল, ‘ছোটবেলায় এভারেস্ট থেকে পড়ে গিয়ে।’
একজন কিশোরী চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, ‘আপনার নামটা দারুণ। ভীষণ এক্সাইটিং।’
জবাবে সুপ্রতিম বলেছিল, ‘মোটেই তা নয়। সুপ্রতিম মানে হচ্ছে ভালোর মতো— কিন্তু পুরোপুরি ভালো নয়।’
একজন পুরুষের কৌতূহল: ‘আপনি কি বিয়ে করেছেন?’
সুপ্রতিমের উত্তর: ‘করিনি বললে আমার ছ’জন ওয়াইফ রেগে আগুন হয়ে যাবেন। আর বিয়ে করেছি বললে অনেক দর্শক দুঃখ পাবেন। তাই এই সাঙ্ঘাতিক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না।’
আসল ঘটনা হল সুপ্রতিম বিয়ে করেছে। স্ত্রী নয়নার সঙ্গে ওর পরিচয় সাত বছরের। তার মধ্যে প্রথম তিনবছর ওর সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেছে, আর বাকি চারবছর চুটিয়ে সংসার করেছে। এখনও করছে। সুপ্রতিম যা-কিছুই করে, সবসময় চুটিয়ে করতে চায়। তাই নিয়ে নয়নার সঙ্গে মাঝে-মাঝে বেশ ঝামেলাও হয়।