শান্তনু আশ্চর্য হয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। কী অদ্ভুত সৎ হলে এসব কথা বলা যায়। আত্মবিশ্লেষণের কী অসাধারণ প্রচেষ্টা! এর নাম বিদ্যাসাগর।
ধীরে ধীরে নিস্তব্ধতা জায়গা নিয়ে নেয় দুজনের মাঝখানে। কেউ কোনও কথা বলে না আর।
শান্তনুর মনের মধ্যে নিদারুণ এক লজ্জাবোধ চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরতে শুরু করছে। এতদিনকার সব অহংকার যেন তালগোল পাকিয়ে গলার ভিতর থেকে উগলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জীবন বড়ই ভয়ানক নাটক। কত স্মৃতি—বিস্মৃতি দিয়ে তৈরি এই মানবজীবন। কত কথা মনের কুঠুরিতে আটকে থাকে। কাউকে বলা যায় না। কতবার স্ত্রীকে, সুমন্তকে বলতে চেষ্টা করেছে ও। পারেনি। পারা যায় না।
তখন কত বয়স হবে? বারো—তেরো—মেজদার গল্প লেখার খাতা থেকে দশ—বারো পাতা ছিঁড়ে কুচো কুচো করে নর্দমায় ফেলে দিয়েছিল ও। কেউ জানতে পারেনি কার কাজ। পরদিন গল্প জমা দেবার শেষ তারিখ। মেজদা সারারাত কেঁদেছিল। তিনদিন পর শান্তনু প্রাইজ পেল। প্রথম পুরস্কার। মেজদা হাসতে হাসতে বলেছিল ভালোই হল বল, আমি তো প্রত্যেক বারই পাই এবার তুই পেলি।
এক—একটি স্মৃতি সিনেমার ছবির মতো এক—এক করে উঠতে শুরু করছে চোখের সামনে—উনিশশো সত্তর সাল। প্রবীর বাগবাজার থেকে গভীর রাতে দেখা করতে এসেছিল অশোকনগরে। ছেঁড়া জামা, চুলগুলো অবিন্যস্ত। কাঁধে একটি ঝোলা। দরজার কড়া নাড়তেই বুক কেঁপে উঠেছিল। আবার হয়তো এনকাউন্টারের খবর। হয়তো আবার কেউ নেই। বুকের ভিতর হাতুড়ির শব্দ অনুভব করতে করতে খুলে দিয়েছে দরজাটা।
অন্ধকার ঘরে নিঃশব্দে ঢুকেছিল প্রবীর। দেশলাই জ্বালিয়ে, হ্যারিকেনটার খোঁজ করতে যেতেই হাত দিয়ে আটকে দিয়েছিল প্রবীর।
থাক আলো জ্বালাস না। সময় নেই। খবর আছে।
শান্তনু বালিশের তলায় সিগারেটের প্যাকেট হাতড়ায়। একটা প্রবীরকে দেয়। আবার দেশলাই জ্বালিয়ে দেখে নেয় প্রবীর কিনা। গত চারমাস কোনও খোঁজখবর নেই। বাঁকুড়ায় এক প্রত্যন্ত গ্রামে সংগঠনের কাজে ছিল।
দেশলাইয়ের আলোতে ওর গালে কাটা একটা দাগ দেখে শান্তনু।
শান্তনু বলে, আয় খাটে এসে বোস। গালে কীসের দাগ?
প্রবীর পাত্তা দেয় না কথাটার। সিগারেটে দু—চারটে জোরে টান মেরে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বলে খেতে দে কিছু, খিদে পেয়েছে।
অন্ধকারে প্রবীরের উপস্থিতি প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ফেলেছিল শান্তনুকে। খাটের তলা হাতড়ে দুটো রুটি আর গুড়ের ঢেলা হাতে করে দিল ওকে। গোগ্রাসে গিলে ফেলল ও। ওর খাওয়ার মধ্যে এমন একটা আদিমতা ছিল যে শান্তনু ভয়ানক ভয় পেয়ে যায়। যেন প্রবীর এরপর ওকেই খাবে। অন্ধকারে চোখ দুটো ওর জ্বলছিল।
জল খেয়ে আবার সিগারেট চায় প্রবীর। কয়েক মিনিট নীরবতা। যে—কোনও মুহূর্তে কোনও সাংঘাতিক সংবাদ বেরিয়ে আসতে পারে ওর মুখ থেকে। তাই হল। হিসহিস শব্দে বেরিয়ে এল…প্রদীপ…।
শান্তনু স্নায়ুতে ধাক্কা খেল জোর।
কী হয়েছে?
বেলেঘাটার এনকাউন্টারে শেষ…
শান্তনুর সমস্ত হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে গলা অবধি উঠে এল। কোনওরকমে হাত দিয়ে গলা চেপে ধরল ও।
প্রবীর খাটে এসে বসল। হাত দুটো শান্তনুর হাতে রেখে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ব্যাড লাক। তুই যদি খবরটা ঠিকসময় পৌঁছোতে পারতিস…
কিন্তু আমি…
জানি—সেদিন অশোকনগর রেড হয়েছিল, তুই পালাতে পারিসনি।
এক লাফ দিয়ে প্রবীর নেমে কোমর থেকে বার করে রিভলভারটা। হাতে দেয় শান্তনুর। এটা দীপঙ্করের। শেষ দেখা হওয়ার সময় তোকে দিয়ে গিয়েছিল। ওর লাস্ট প্রেজেন্ট। তোকে খুব ভালোবাসত।
আর একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে প্রবীর বেরিয়ে গিয়েছিল দরজা খুলে।
শান্তনু খাটে বসে রিভলভারটা নিয়ে হাউহাউ করে কেঁদেছে সেদিন। সত্যি কথাটা কেউ জানে না। প্রবীরকে বলা যায়ানি। সেই রাতেই প্রবীরের দেহটা লাইনের ধারে পড়েছিল। সত্যি কথা কেউ জানবে না। কাউকে বলা হয়নি। দীপঙ্করের সেই রিভলভারটা গুলি ভর্তি এখনও শান্তনুর কাছে আছে। মাঝে মধ্যেই রাতে একা ছাদে চলে যায় শান্তনু। যখন ঘুম আসে না। যন্ত্রটায় হাত বুলোয়। এইখানে ঘুমিয়ে আছে প্রবীর, প্রদীপ, দীপঙ্কর। একসময় বুকে ঠেকিয়ে ইচ্ছে হয় ট্রিগারে চাপ দিতে। পারে না শান্তনু। চিৎকার করে কী যেন বলে দিতে ইচ্ছে হয়। আপন মনে আউড়ে যায়, অল মাই কনসেন্স হ্যাজ থাউজেন্ডস অব লেগস…।
তুমি শেক্সপিয়র খুব ভালোভাবে পড়িয়াছ বোধহয়?
চমকে ওঠে শান্তনু—এ আমি কোথায়! কলেজ স্কোয়ারের জলের ধারে কুড়ি বছর পর।
সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। বিদ্যাসাগর স্মিত হেসে সন্তর্পণে জায়গা ছেড়ে উঠলেন। গায়ের চাদরটা ঠিক চির পরিচিত ভঙ্গিতে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
শান্তনু অনুনয় করল—আপনি বসুন। আমার কিছু কথা আছে।
বিদ্যাসাগর জোরে হেসে হাঁটতে শুরু করলেন। বললেন, অব্যক্ত কথা?
হ্যাঁ, আপনাকে শুনতে হবে। আমি কুড়ি বছর ধরে মনের মধ্যে জমিয়ে রেখেছি। আজ বলব। আপনি বসুন প্লিজ। শান্তনু এবার যেন আদেশ করল…
বিদ্যাসাগর মাথাটা ধীরে নাড়তে নাড়তে এগিয়ে গেলেন বেদিটার দিকে—না, অদ্য নহে। পরে বলিও।
শান্তনু চিৎকার করে ওঠে, না আজ, টু নাইট। আমার মনের কথা সব বলতে দিন। প্লিজ, দশ মিনিট।