কী ভাবিতেছ?
কিছু না। আপনি বলুন, আমি শুনব।
বিদ্যাসাগর যেন খুশি হয়ে গায়ের চাদরটা এবার একেবারে ভালোভাবে জড়িয়ে নিলেন। কপালটা চাঁদের আলোয় চকচক করছে ওর। বেশ উঁচু, কিছুটা কামানো। ওটাই বোধহয় স্টাইল ছিল তখনকার দিনের পণ্ডিতদের। তবে চটি জুতোর ব্যাপারটা ওর নিজস্ব স্টাইল। অসাধারণ স্টাইলিস্ট ছিলেন।
শান্তনু কিছু জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও চুপ করে যায়। বিদ্যাসাগর জলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আনমনা মনটি যেন কথার খেই ধরতে চাইছে। গোপন কোনও দুঃখের কথা বলবার আগে প্রত্যেক মানুষ কিছুটা থম মেরে যায়। উনিও এখন সেইরকম রয়েছেন। খানিক পরে বললেন, তোমার সন্তান কয়টি?
দুই,—দুটোই মেয়ে।
তুমি দেখিতেছি বেশ ভাগ্যবান।
শান্তনু অবাক হয়ে বলল, সেকী? ভাগ্যবান বলছেন কেন? ছেলে নেই তাতে আমি আক্ষেপ করি না, তবে এ ব্যাপারে আমার স্ত্রী অবশ্যই দুঃখিত। কিন্তু এতে ভাগ্যবানের কী দেখলেন!
কেন বলিতেছি জানো? তোমার পুত্র থাকিলে কখনওই তোমার সদৃশ হইত না। ইহা হয় না। কখনও কখনও অবশ্য হয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপরীত হয়। সেক্ষেত্রে আক্ষেপ আর, দুঃখ করা ছাড়া কী—ই বা করিবার থাকে। যেমন আমি। লোকে বিদ্যাসাগর নাম দিয়াছে, অথচ আমার পুত্রটি…। শান্তনু এই ঘটনাটি জানে। তাই অন্যপ্রসঙ্গে চলে যাওয়ার জন্য আগের কথাটারই খেই ধরে বলে, আপনি সাংসারিক জনপ্রিয়তার কথা বলছিলেন।
হ্যাঁ, ঠিকই বলিয়াছ। জনপ্রিয়তা, অর্থাৎ সবাকার মনে তুমি ভেদ্য এবং হাঁ—বাচক থাকিবে, অথবা না বলিবে না। এমনভাবে চলিতে পারিলে তুমি জনপ্রিয় হইবে। ইহাতে তোমার নিদারুণ ক্ষতি হইলেও তোমার মাথাটি হ্যাঁ—র দিকে থাকিবে। যেমন মদীয় মস্তকটি যদি তোমাদিগের ভগবতীদেবীর বিরুদ্ধে লইতে পারিতাম তাহা হইলে আমার পুত্র কলিকাতাতেই থাকিত। শিক্ষা লাভ করিত। পিতার মৃত্যুর পর উইল লইয়া মামলা করিত না, বংশের নাম মসিলিপ্ত করিত না। তাহা আর হইল কোথায়।
শান্তনু বলল, এটা এমন কিছু দোষের হত না। এ ব্যাপারে আপনি যে একেবারে উদাসীন ছিলেন সেটা ভাবছেন না কেন?
বিদ্যাসাগর বাধা দিলেন, না—ইহা সত্য নয়। আমি চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু তখন আমার মাতৃভক্তি সুপরিচিত। সেই মোহ ভাঙিতে পারি নাই। একদিক রাখিতে হইলে অন্যদিক ছাড়িতে হয়। আমি জনপ্রিয়তাই গ্রহণ করিয়াছিলাম। সংসারে এবং জগৎসংসারে।
কিন্তু আপনার দয়ার কথা সর্বজনবিদিত, বাঙালি এখনও আপনার উদাহরণ দেয়। শুধু মধুসূদন নয়, আমরা সবাই। এটা নিছক জনপ্রিয়তার জন্য—তা তো নয়।
তুমি আবার লজ্জা দিতেছ।
সত্যি বলছি। আপনার বিধবা বিবাহ আইন ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সমাজসেবা। আমি আশ্চর্য হই আপনার সাহস দেখে। কত আধুনিক ছিলেন সেই যুগে। ভাবা যায় না। ব্যাপারটা মাথায় এল কীভাবে?
আসলে এক চৌদ্দবর্ষীয় বালিকার বৈধব্য আমাকে পীড়িত করিয়াছিল তাই হয়তো…
আপনি কি মার্কস—এ বিশ্বাস করেন?
কেন? একথা বলিতেছ কেন?
কারণ এটি হল তাঁর মতবাদ।
যদি বিষয়টি পরিষ্কার করিয়া বলো তবে বুঝিতে চেষ্টা করিব।
শান্তনু তার প্রিয় সাবজেক্ট পেয়ে খুশি হয়ে বলল, আপনি আগে বিধবার কষ্ট দেখেছিলেন তারপর তার প্রতিকার। এটি হল কার্ল মার্কসের একটি থিয়োরি, আগে বস্তু দেখি, তারপর মন তার উপর কাজ করে।
বিদ্যাসাগর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন, বললেন, কিন্তু কখনও কখনও মনও আগে কাজ করে। পরে কার্য সমাধা হয়। দুইটিই সমানভাবে মনুষ্যের উপর কাজ করিয়া থাকে। শান্তনু মাথা নাড়ে—হয়তো ঠিকই—আপনি বলছেন হেগেলও তাহলে সঠিক।
হ্যাঁ, আমি হেগেল পাঠ করিয়াছি তিনি যেমন অর্ধসত্য, তোমার কার্ল মার্কসও অর্ধমিথ্যা।
কিন্তু মার্কস তো বলেছিলেন হেগেলের থিয়োরি ঠিকই আছে। শুধু পা উপরে মাথা নীচে।
বিদ্যাসাগর হা—হা করে হাসলেন—আসলে দুইজনকেই পাশাপাশি রাখিতে হইবে। ঠোকাঠুকি করিলে চলিবে না। আমি একবার এই পাশাপাশি চিন্তা না করিয়া জীবনে এক বিশাল পাপ করিয়াছিলাম যাহা জীবনে কাহাকেও বলিতে পারি নই।
কীরকম?
তোমার নিশ্চয়ই আমার সেই বিখ্যাত গল্পটি মনে আছে।
কোনটা বলছেন? কারমাটারে ভুট্টা বিলিকরণ?
না—না, সেই যুবকটি—জ্ঞানদানের নিমিত্তে যাহার আমি বাক্স বহন করিয়াছিলাম।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওটা কে না জানে? ছোটবেলায় কতবার ট্রানস্লেশন করেছি। গল্পটায় আপনি ‘কুলি কুলি’ করে চিৎকার করে ওঠা যুবকের হাত থেকে বাক্স নিয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, ইতিহাস সেই অবধি জ্ঞাত রহিয়াছে, তাহার পরের ইতিহাস নাই। তাহার পরদিন সেই সময় স্টেশনে যাইতেই প্রায় অনাহার—ক্লিষ্ট এক বৃদ্ধ আমাকে চিৎকার করিয়া ভর্ৎসনা করিয়াছিল। আমি অপ্রস্তুত হইয়া জিজ্ঞাসা করিতেই সে বলিল, সেই রাত্রিতে সে ওই যুবকের বাক্সটি বহন করিতে পারিলে দুই আনা পয়সা পাইত, সে আসিবার আগেই আমি তাহার গ্রাস কাড়িয়াছিলাম। আমি বারংবার তাহাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াও পারি নাই। সেই রাত্রে তার পরিবারের কোনও খাবার জুটে নাই। তৎক্ষণাৎ তাহাকে চারি আনা পয়সা দান করিয়াছিলাম।
শান্তনু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে এর মধ্যে পাপের কী আছে? আপনি তো তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগর হাসলেন, বললেন, না আমি স্বনির্ভরতার শিক্ষা দিতে গিয়া প্রথমত একটি সর্বহারার রোজগারে ব্যাঘাত ঘটাইয়াছিলাম। কারণ, যে যুবক একটি ব্যাগ বহিবার জন্য দুই আনা দিতে রাজি সে নিশ্চয়ই প্রয়োজনের অপেক্ষা অধিক উপায় করে। সে কখনওই পরনির্ভর নহে। অতিরিক্ত উপায়ী। স্বনির্ভরতা শিক্ষা দিতে গিয়া একজন সত্যিকারের উপায়ী লোককে ভিখারি করিয়া ছাড়িয়াছি, ইহা শুধুমাত্র অন্যায় নহে সততই পাপ, যাহা এখনও ভুলিতে পারি নাই।