শান্তনু থতমত খেয়ে যায়। মানে আপনার ছবি দেখেছি…
উহা তো বক্ষ অবধি। আসলে আমি আমার এই আকৃতির জন্য চিরকালই হীনম্মন্যতায় ভুগিয়াছি। আইস জলের কিনারে বসি।
শান্তনু উঠে দাঁড়ায়।
নির্জন কলেজ স্কোয়ার। আকাশে চাঁদ। জলে তার ছায়া পড়ে চকচক করছে। অদ্ভুত একটা দৃশ্যপট। নিঃশব্দ চরাচর। পাশে বসে আছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ। একেবারে বন্ধুর মতো। জমি থেকে ঘাস তুলে ছিঁড়ছেন আঙুল দিয়ে। যে মানুষটা রূঢ়, স্পষ্ট কথার জন্য বিখ্যাত ছিলেন, আজ যেন কেমন বিষণ্ণ। মনের ভিতরে কেমন যেন অব্যক্ত অবসন্নতার ছোঁয়া। বিদ্যাসাগর একটি ঢিল ছুড়ে মারলেন জলে, টুপ করে আওয়াজ হল। জলের চাঁদ নড়ে উঠে আবার ধীরে ধীরে স্থির হল।
আমি জলে ইস্টক ছুড়িলাম কেন বলো দেখি? শান্তনু না বুঝে মাথা নাড়ে, ওটা হয়তো স্বভাব। জলের কাছে এলেই ঢিল ছুড়তে ইচ্ছে হয়। আপনিও দেখছি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন।
—না, আমি কোনওদিনই ব্যতিক্রম ছিলাম না। খানিকটা দৃঢ়চেতা হওয়াই কি ব্যতিক্রম?
শান্তনুর গা থেকে যেন আগুন বেরোচ্ছে গরমে। ঠান্ডা জলে স্নান করে নিলে ভালো লাগত। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, স্নান করবেন?
বিদ্যাসাগর যেন সংকুচিত হয়ে উঠলেন—না—না, আমি সন্তরণ জানি না।
শান্তনু চমকে ওঠে। ঠাট্টা করছেন বোধহয়। বাঙালি সাঁতারের অনুপ্রেরণা তো আপনার কাছ থেকেই পেয়েছে। সেই বিখ্যাত গল্প! মা—মা বলে দামোদর পেরোনো সাঁতরে? এটা কোন লোকে না জানে?
বিদ্যাসাগর যেন লজ্জিত হলেন, বললেন,—না, ওটি সর্ব্বৈব মিথ্যা। আমি সত্যিই সন্তরণ জানি না।
তা হলে ওই গল্পটা?
ওটি রটনা। সাহেব আমাকে ছুটি দিলেন না। আমার ভ্রাতার বিবাহের পত্র পাইয়া ছুটি চাহিয়াছিলাম।
শান্তনু একেবারে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সন্দেহে মুখে ভাঁজ পড়ল ওর। চাঁদের আলোয় বিদ্যাসাগর যেন সেটা লক্ষ করলেন, বললেন, আসলে দামোদর সেইসময় শুষ্ক। অর্থাৎ যখন আমার ভ্রাতার বিবাহ হয়, তখন জ্যৈষ্ঠ মাস। গবাদিপশুরা হাঁটিয়া পার হয়। আমি তাহাই করিয়াছিলাম…।
শান্তনু বাধা দিয়ে বলে, কেন? আপনি মায়ের আদেশ তো কখনওই অমান্য করেননি। তাঁর ডাকে সেই ভয়াল নদীতে ঝাঁপ দেননি?
না, কখনওই নহে। আর একটা কথা…
বিদ্যাসাগর চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ।
আমি কেন সেইরাতে বাড়ি আসিয়াছিলাম—জানি শুধুই আমি। আর কেহ নহে। তবে একজন বুঝিতে পারিয়াছিলেন, তিনি মুখে কিছুই বলেন নাই। বিদ্যাসাগর আবার চুপ করে গেলেন।
বলতে কি আপত্তি আছে? তাহলে থাক। শান্তনু প্রসঙ্গ পালটাতে চেষ্টা করে। একটা কথায় আটকে রাখলে চলবে না। যতটা পারা যায় জেনে নেওয়া যাক। এই সুযোগ আর আসবে না। রাত অনেক হল। প্রায় মধ্যরাত তো বটেই।
বিদ্যাসাগর ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে সোজাসুজি শান্তনুর চোখের দিকে তাকালেন তারপর হঠাৎ আনমনে বলেন, তুমি যাহা দেখিতেছ তাহা ঠিক নহে। তুমি যা দেখিতে চাও তাহাই হয়তো ঠিক। আমি সেই রাত্রে মায়ের ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম বলিলে ঊনবিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ মিথ্যাটি রচনা হইবে। সত্যটি হইল তখন নতুন বিবাহিত জীবন। গিয়েছিলাম নববধূর অব্যক্ত ডাকে, মায়ের ডাকে নহে।
এই অবধি বলেই বিদ্যাসাগর একটা ঢিল খুঁজে নিয়ে আবার ছুড়ে মারলেন জলে। জলের চাঁদ আর একবার নড়ে উঠল। বিদ্যাসাগর বললেন, আমি তখন এবং এই মুহূর্তে কেন ইস্টকখণ্ড ছুড়িলাম জানো? কারণ, এই জল যতদিন থাকিবে ততদিন ইহার ভিতর চাঁদ দেখা যাইবে। কিন্তু ইহা—তো আসল চাঁদ নহে। চাঁদের প্রতিবিম্ব। দেখিতে অবিকল হইলেও সত্য চাঁদ দেখিতে হইলে স্কন্ধ উপরের দিকে তুলিয়া দেখিতে হইবে। সত্যের দিকে তাকানো এক্ষণে স্কন্ধ ভারাক্রান্ত করা। মানুষমাত্রেই ইহার অবহেলা করে। তাই নকল চাঁদে ইস্টক ছুড়িয়া আমার মোহমুক্তি ঘটাইতেছিলাম। যেমন আজ তোমাকে পাইয়া এতদিনকার মোহমুক্তি ঘটানো গেল।
শান্তনু অবাক হয়ে বলে, কিন্তু এই মিথ্যেটা প্রায় এক শতাব্দী ধরে সত্যি হিসেবে চলে আসছে।
বিদ্যাসাগর হাসলেন। প্রগাঢ় হাসি। জ্ঞানী লোকের অবজ্ঞা নেই সেই হাসিতে। মনের মধ্যে জমে থাকা গভীর দুঃখের একটুকরো ঝলক যেন হাসি হয়ে ঝরল, বললেন, দেখো, শতাব্দীর সব রটনাই তো সত্য নহে। সত্য হইলে পৃথিবীটা আরও অর্থপূর্ণ হইত। তুমি কি জানো, চলিয়া যাওয়া সময়ের অনেকটাই ফাঁকির মধ্যে নিমজ্জমান। ইহার অধিকাংশটাই অসত্য অথবা সত্যের অপলাপ?
শান্তনুর অপ্রস্তুত ভাবটা এখনও কাটেনি। এই মহান ব্যক্তিত্ব কত যুগ ধরে ঘরে ঘরে মহামানব হয়ে আছেন। তাঁর এই অদ্ভুত স্বীকারোক্তি!
বিদ্যাসাগর শান্তনুর অবাক হওয়াটা যেন ধরে ফেললেন। কাপড়ের খুঁটটি জড়িয়ে বাবু হয়ে বসলেন, বললেন, তুমি সংকুচিত হইও না। এসকল কথা কেহই জানে না। আমার জীবনের আরও কয়েকটি অসত্য আজ উদ্ঘাটিত হইতে পারিত কিন্তু তোমার চিত্তবৈকল্য দেখিয়া বুঝিতে পারিতেছি না সকল কথা তুমি কেমনভাবে লইবে।
শান্তনু হঠাৎই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। নিজের জীবনের একরাশ অব্যক্ত কথা যেন ওর চারপাশ ঘিরে নাচতে শুরু করেছে, যে কথা কাউকে বলা হয়নি। হবেও না বোধহয়। দেড় শতাব্দী পরে এমনভাবে বলার সুযোগ পাবে কি ও! চমক ভাঙল বিদ্যাসাগরের ডাকে।