ঋতির উপহার – পিনাকী মুখোপাধ্যায় (মুখার্জী)
ঋতি যখন মণি মুখার্জি রোডের সাত নম্বর বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল তখন শীতের সন্ধ্যা আরও ঘন হয়েছে। ভীষণ নার্ভাস লাগছে তার। সে কোনো ভুল করছে না তো? তার কি একবার মনোজিৎকে ফোন করা উচিত ছিল? কালো রঙের বিশাল লোহার গেটটার সামনে দাঁড়িয়ে ঋতি ভাবছিল সে ফিরে যাবে কি না। তখনই বেজে উঠল মোবাইলটা।
একটু চমকে উঠল ঋতি। দেবযানীর ফোনটা রিসিভ করতে গিয়ে একটু যেন কেঁপে গেল গলাটা, ‘হ্যালো।’
‘কতদূরে?’
‘আপনাদের বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।’ আড়ষ্ট গলায় বলল ঋতি।
‘কেন? দাঁড়িয়ে আছ কেন? গেট খুলে চলে এসো ভেতরে। নীচে কলিংবেল বাজালেই রঘুদা দরজা খুলে দেবে।’
‘ঠিক আছে।’—ফোনটা ব্যাগে রেখে ধীরে ধীরে গেট খুলে ঢুকে আসে ঋতি। মোরাম বিছানো চওড়া পথের দুপাশে গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা আর গ্যাঁদার মিছিল। বারান্দায় উঠে কলিংবেলে হাত ছোঁয়াল ঋতি।
একটু পরেই একজন বয়স্ক লোক দরজা খুলে দিলেন। ইনিই বোধহয় রঘুদা। ঋতি কিছু বলার আগেই বলে উঠলেন, ‘বউদিমণি ওপরে আছেন। এ ঘরের পরেই সিঁড়ি পাবেন। উঠেই প্রথম ঘরটা।’
‘বউদিমণি’ কথাটা কি একটু জোর দিয়ে বললেন ভদ্রলোক? না কি ঋতির কানেই একটু বেশি জোরে বাজল শব্দবন্ধটা? বুঝতে পারল না ঋতি।
ক’টা মাত্র সিঁড়ি। অথচ পা দুটো যেন চলতেই চাইছে না। কেন যে রাজি হল ঋতি এখানে আসতে? সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই বিগড়ে ছিল মেজাজটা। সারা সপ্তাহের লাগামছাড়া ব্যস্ততার মাঝখানে রবিবারের চিলতে অবসরটা একটু ঢিলেঢালাভাবে কাটাতে ইচ্ছে করে ঋতির। ভেবেছিল একটু বেলা করে উঠবে। কিন্তু সাতটা বাজতে না বাজতেই দরজায় টোকা।
ঘুমচোখে দরজা খুলতেই বিরক্ত গলায় মা বলে উঠেছিলেন, ‘আজও বাজারে না যাওয়ার মতলব নাকি তোর? অন্ধ্রের রুই খেতে খেতে তো চড়া পড়ে গেল জিভে।’
‘সাতটাও তো বাজেনি মা। আটটার আগে তো ভালোভাবে বাজারই বসে না।’ হাই তুলতে তুলতে বলেছিল ঋতি।
‘সেটা আমিও জানি। কিন্তু মেকাপ নিয়ে রেডি হতেই তো তোমার ঘণ্টাখানেক লাগবে। কুসুম তো আর সারাদিন ধরে বসে থাকবে না। আর যদি ভেবে থাকো আজও ডালসেদ্ধ, আলুসেদ্ধ দিয়ে চালিয়ে পয়সা বাঁচাবে, তবে যাও। আবার শুয়ে পড়ো গিয়ে। তোমার তো ইচ্ছে ঘুম। চিন্তাভাবনা তো নেই কিছু।’
সবসময় সুরমা এইরকম ঠুকে ঠুকে কথা বলেন। সাধারণত চুপ করেই থাকে ঋতি। কিন্তু আজ হঠাৎই গরম হয়ে গেল মাথাটা। বলবে না বলবে না করেও বলে উঠল, ‘কীসে পয়সা বাঁচাতে দেখলে? যা বলছ তাই তো করা হচ্ছে। পয়সার জন্য কী আটকেছে তোমার?’
‘পাড়ার ডাক্তার দেখিয়ে আমার চিকিৎসা করানো পয়সা বাঁচানো ছাড়া কী? সুগার, প্রেসার নর্মাল থাকলেই মানুষ সুস্থ থাকে? হাঁটুর ব্যথাটা কবে থেকে ভোগাচ্ছে, একজন ভালো হাড়ের ডাক্তারকে দেখানোর কথা একবারও মনে হয়েছে তোর?’
‘ডক্টর সাধুখাঁ এম.ডি./মা। যথেষ্ট নামকরা ডাক্তার। উনি যে ব্যায়ামগুলো করতে বলেছিলেন একদিনও করেছ? ব্যায়াম না করলে ব্যথা এমনি এমনি কমবে? যাকেই দেখাও, ব্যায়ামই প্রেসক্রাইব করবেন।’
‘তুই তো সব জেনে বসে আছিস। বেশি জেনেই তো এই দশা। আইবুড়ো থেকে হাড় মাস জ্বালিয়ে খাচ্ছিস আমার। তোর দিদিদের বাড়ি গিয়ে দু’দিন যে জুড়িয়ে আসব সে উপায় অবধি নেই। জীবনভর মেয়ের হেঁশেল সামলাতে হবে।’
চুপ করে যায় ঋতি। মিথ্যে কথার কী জবাব দেবে সে? বড়দি, মেজদি কখনও মাকে নিজেদের কাছে নিয়ে রাখতে চায় না। যেহেতু ঋতি ভালো চাকরি করে এবং তার বিয়ে হয়নি, তাই মাকে দেখার দায়িত্বটা শুধুই যেন তার। সে কারণেই ছত্রিশ পেরনো ঋতির বিয়ের প্রসঙ্গ সযত্নে এড়িয়ে চলে সকলে। ঋতির হেঁশেল সামলায় রাতদিনের লোক কুসুম। কুটোটা নাড়তে হয় না মাকে। কথা বাড়াতে আর রুচি হল না ঋতির। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘কুসুমকে চা বসাতে বলো। আমি আসছি। আর আসছে সপ্তাহেই একজন অর্থপেডিককে দেখিয়ে আনব তোমায়।’
সুরমা কিছুতেই খুশি হল না। ওঁর কপালে বিরক্তির গভীর আঁচড়গুলো কিছুটা নরম দেখাল শুধু।
বাজার থেকে ফিরে সোফায় বসে তখন দ্বিতীয় দফার চা খাচ্ছিল ঋতি। চোখ বোলাচ্ছিল খবরের কাগজের হেডিংগুলোয়। অচেনা নম্বর থেকে ফোনটা তখনই এসেছিল। ভুরুতে হালকা ভাঁজ ফেলে ফোনটা ধরেছিল, ‘হ্যালো।’
‘হ্যালো! চিনতে পারছ?’—সুরেলা মহিলা কণ্ঠ মোটেই চেনা নয়। ঋতি যখন স্মৃতি হাতড়াচ্ছে, দূরভাষিণী বলে উঠেছিল, ‘আমি দেবযানী দত্ত বলছি।’
হাতে ধরা চায়ের কাপটা থেকে কিছুটা চা চলকে পড়েছিল ঋতির কামিজে। হৃৎপিণ্ডের গতি মুহূর্তেই কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কথা জোগাচ্ছিল না মুখে।
‘জানি, তুমি খুব অবাক হচ্ছ। হয়তো ভাবছ এটা আমার নতুন কোনো চাল। কিন্তু বিশ্বাস করো এর মধ্যে কোনো চালাকি নেই। সবকিছুর জন্যই তো একটা প্রস্তুতি লাগে তাই না? আমার হয়তো সময়টা একটু বেশিই লেগেছে। আল্টিমেটলি আই হ্যাভ ডিসাইডেড ঋতি। কিন্তু তার আগে একবার আমি দেখতে চাই তোমাকে। আজ একটিবার তুমি আসবে?’ আন্তরিক শুনিয়েছিল দেবযানীর কথাগুলো।
বিশ্বাস—অবিশ্বাসের দোলাচলে কেঁপে উঠেছিল ঋতি। হঠাৎই যেন অনেকখানি অক্সিজেন ঢুকে গিয়েছিল বুকের ভেতর। ঋতি নয়, যেন অন্য কেউ বলে উঠেছিল, ‘যাব…।’