নাচাচ্ছে, নাচাচ্ছে, আমাকে নাচাচ্ছে। উফফ ভাবতেই কান গলা বেয়ে গরম ঢেউ, একটা রাগ আছড়ে পড়ে শিরায় শিরায়। মনে পড়ে যায় পুরনো অপমানগুলো। সেই যে সেবার, অস্মি বলে মেয়েটা। জাস্ট কিছুদিন ডেটিং করে কেটে গেল। জাস্ট নো সাড়া নো শব্দ। বুকের মধ্যে হাঁকপাঁক করে অপমান, রাতের ঘুমে হানা দেয় মেয়েটার তাগড়া শরীর আর ফিল্মসি জামাকাপড়। এভাবেই কষ্ট জমছে বুকের ভেতর। আর রাগ জমছে মাথার মধ্যে। শু্যট করে দেব…জাস্ট শু্যট হার। যেরকম স্বপ্নে দেখেছিল সেদিন…কাছে যাচ্ছে যত, দূরে দূরে সরে যাচ্ছে মেয়েটা…কে ছিল সেটা? অস্মি না সঞ্চিতা? সঞ্চিতাই বোধ হয়।
আর, বন্দুকটা, ওর দিকে তাক করতে করতেই, শু্যট! মাথার মধ্যে বলে ফেলল ওর পৌরুষ। অমনি স্বতোৎসার উঠে এল ফোয়ারায়, রাগের উৎসমুখ খুলে গেল, অনুরাগেরও। সবকিছুর মূলে, একেবারে গোড়ায়, সেই দপদপানি, সেই কষ্টটা আছে, যা ওকে করায় সবকিছু। ফলো করায় সঞ্চিতার মতো তিতলিদের…
ও আজ পকেটে মালটা নিয়েই বেরিয়েছে। শক্ত ধাতব ফিল। ওকে উত্তেজিত করে ফিলটা। অনুভূতি ভোঁতা হওয়ার আগেই কাজটা করে ফেলতে হবে। কার্গো প্যান্টটা, অনেকগুলো পকেটসুদ্ধু, খুব হালকা লাগে আজ। শরীরটাই হালকা লাগে যেন। উড়তে উড়তে কাফেতে ঢুকে যায়। হাসিমুখেই, কিচ্ছুটি না বুঝে, সরল চোখে সঞ্চিতা ওর দিকে মুখ ফেরাবে। যদিও ছেনাল মেয়েমানুষ, তবু সরল। না—বোঝা হরিণ চোখ। বোকা চোখ। সেই ওর সাদা চোখে আস্তে আস্তে বিস্ময়, তারপর বিস্ফারিত দুটি চোখে ধীরে ধীরে ভয়, ধীরে ধীরে বিভীষিকা…আহ, কী মজা!
মা যখন বাবাকে ছেড়ে চলে যায় বাবা বলেছিল, মেয়েমানুষ ছোঁবে না কখনও। তখন বোঝেনি ও। মানেটা কী। তারপর সুচিত্রাকাকিমা যখন এল, বাবাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল তুমি যে বলেছিলে, মহিলা ব্যাপারটাই একটা যাচ্ছেতাই জিনিস, মাউসট্র্যাপ, জীবনকে ভেতর থেকে ফোঁপরা করে দেয়? তখন ওর চোদ্দো। বাবার দিকে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে শেখেনি, অথচ ভেতরে ঘৃণা থরথর করত, বাবা যখন সুচিত্রাকাকিমাকে নিয়ে ফিরত বাড়ি, মাল খেত।
অনেক পরে ও অর্জি কথাটা শেখে। অথচ মেয়েরা ওকে চায় না। ও তাদের এমএমএস পাঠায়, অশ্লীল জোকস পাঠায়। তারা কিছুদিন ওর সঙ্গে মেশে, ওকে দেখে নেয়, মেপে নেয়, তারপর সরে যায়। তারা শুধু ওকে শুকনো শুকনো ইমোটিকন পাঠায়। তারপর একদিন চুপ মেরে যায়। একদিন শুধু ওর ইমেল গিয়ে গিয়ে তাদের মেলবক্সে জমে যায়, জমাট বেঁধে যায়। হয়তো সেই ইমেলগুলোকে না দেখেই সোজা ডিলিট করে বা স্প্যাম ফোল্ডারে পাঠিয়ে দেয়। একদিন হয়তো তারা ওকেই পুরো ব্লক করে দেয়। উফফফ।
মেনে নেওয়া যায় না এটা। একদম মেনে নেওয়া যায় না। একটা কিছু করতেই হবে।
দীঘল, কনফিডেন্ট পায়ে কাফের ভেতরটায় ঢোকে ও, তারপর একদম ক্লোজ রেঞ্জে এসে রিভলভারটা সটান তুলে ধরে প্রিয়, নীলরং জামা পরা, পাখি পাখি ছোট্ট চেহারার মেয়েটার দিকে। ব্যাং।
ব্যাং ব্যাং ব্যাং।
সঞ্চিতা লুটিয়ে পড়ে। চেয়ার উল্টে যায়।
নিলুপিসি, এক কাপ চা আর দুটো লেড়ো বিস্কুট নিয়ে বসে আছে। সঙ্গে তপন। ওর বন্ধু। দুজনেই অ্যালার্ট, কিন্তু অফ গড়িয়াহাট রোড, একটু ভেতরের এক কাফে কফি ডে আর তার উল্টোদিকের চায়ের দোকানের মুখটা এখনও ফাঁকা…ফাঁকা মানে, নাঃ, এখনও কোনও চিহ্ন দেখা যায়নি ঋদ্ধিমানের। ওর পুলিশ মামা দীপেন ঘোষ মোবাইলে বলেছেন, ঋদ্ধি বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। সবকিছু মিলে যাচ্ছে কিন্তু। উনিও উদ্বিগ্ন। রিভলভারটা মিসিং হওয়ার খবর উনিই বলেছিলেন, উইথ লট অফ ওয়ারি।…যেখান থেকে গেছে, সেটাও ঋদ্ধির নাগালে…কিন্তু যতটা পেরেছেন, ঋদ্ধির ঘর সার্চ করে পাওয়া যায়নি জিনিসটা। খোলাখুলি কিছু করতে বা বলতে সাহস পাননি উনি, কেননা ঋদ্ধি যথেষ্ট ডিস্টেবিলাইজড, ওকে সন্দেহ করা হচ্ছে জানলে বলা যায় না, সুইসাইডাল টেনডেন্সি হতে পারে।
বাড়িতেও নজর রাখছেন উনি। কিন্তু ঋদ্ধি বেরিয়ে পড়ার পরই, ওকে ফলো করছে একটা গাড়ি। আর, সঞ্চিতা যে কাফেতে বসেছে, অর্চির সঙ্গে মিট করবে বলে, সেখানে নজর রাখছে সঞ্চিতার পিসি।
ব্যাং ব্যাং ব্যাং। আচমকা পাড়াটাকে চিরে দিয়ে আওয়াজটা, চিৎকার তারপর, হইচই। তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল নিলুপিসি, প্রায় চায়ের কাপ উল্টে ফেলে তপনও। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে হতবাক, কেননা ঋদ্ধি, ঋদ্ধি তো এখনও বালিগঞ্জ ফাঁড়ি ক্রস করেনি, এখনই জানা গিয়েছে। জাস্ট দু সেকেন্ড আগেই।
কাফে থেকে লাফ দিয়ে বেরোচ্ছে এখন, সঞ্চিতাকে শু্যট করে, তার আততায়ী। গুলিটা মারার পরপর ও কী করবে, ভেবে পায়নি দু—চার মোমেন্ট। বিস্রস্ত কাফেটা, চারিদিকে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে লোকজন। মাতালের মতো ঘুরে গিয়েই হঠাৎ তিরবেগে দৌড়তে শুরু করে দিল অর্চি।
ততক্ষণে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দেওয়া সার্ভিস রিভলভারটা ধোঁওয়া ওঠার পর ঠান্ডা। একরাশ মানুষের স্থির দৃষ্টির সামনে। একমাত্র পাশের কিউবিকলের ওই চুমকি ঘোষ মেয়েটাই অর্চিকে ততটা টানত না…বেশ নিরাপদ রাশিয়ার মতো চেহারার মেয়েটা বাবার ড্রয়ার থেকে সার্ভিস রিভলভার এনে দিয়েছিল অর্চিকে।
রোজ এক কাপ কফির ফেভারের পরিবর্তে।