চুমকি ঘোষের মোটা, ফুলো মুখটা ফর্সা আর মেক আপ লাগানো, কিন্তু ভীষণ চওড়া, ওকে দেখলে ভারতের ম্যাপ না, সাইবেরিয়া, তুন্দ্রা, তাইগাসহ একটা চ্যাপটা রাশিয়ার ম্যাপ মনে পড়ে যায়। এক কান থেকে আর এক কান পর্যন্ত পৌঁছতে দু—দুটো সাদা ধবধবে মরুভূমির মতো গাল আর একটা প্রকাণ্ড নাক পেরোতে হবে…দূর, অতটা পাড়ি দেওয়ার ধক কার আছে?
উল্টোদিকে সঞ্চিতাকে দেখ, ছোট্ট একটা মুখ, ছোট্ট একটা দেশের মতো…না ভারতও নয়, ধানি লংকার শেপের শ্রীলংকা যেন, কুচুত করে দাঁতে কেটে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।
অর্চি কিছুটা রিপালসানের বশেই চুমকিকে না চটিয়ে দু কাপ কফি এনে নীরবে এক কাপ ওর ডেস্কে রাখে। চুমকি ওর স্থূল শরীরটা যথাসম্ভব পিছিয়ে নেয়, বেন্ডিং ব্যাকওয়ার্ডস যাকে বলে, ঘোরানো চেয়ারের পিঠের উপর ভর দিয়ে, নেকু নেকু গলায় বলে, থ্যাংক্যু সুইটি। নাউ টেল মি, ওয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?
মেনশন নট, লাজুক মুখে বলে, অর্চি কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে কাজে বসে যায়। ইয়ারফোনটা একটা ব্যারিয়ারের কাজ করবে এবার।
সংগোপনে স্কাইপে মেসেজ পাঠায় সঞ্চিতাকে, R u online?’
উত্তর আসে ইমোটিকনে। উত্থিত হাতের ছবি। মানে হ্যাঁ, আই অ্যাম অ্যাট মাই ডেস্ক।
অর্চি এবার লেখে, gr8!
৩
নিলুপিসি উল্টোদিকের রেস্তোরাঁয় বসে থেকে থেকে নজর রাখছে। সঞ্চিতা ঢুকে গেল ওই কাফেটায়। নিলুপিসি বসেছে। সস্তার রেস্তোরাঁয়। অর্চি আসবে। জেনেছে ওদের কনভার্সেশন থেকে, চ্যাটে। গতকাল সাইন আউট না করে কম্পিউটার থেকে উঠে গেছিল মেয়ে।
নীলুপিসি পুলিশগিরি করছে কোনও কৌতূহল থেকে নয়। স্রেফ সিকুউরিটি কনসার্ন থেকে। পরে, ঋদ্ধিমানের মামা, পুলিশ মামা, নিলুপিসিকে ইনপুট দিয়েছেন কিছু। আপাতত, নিলুপিসির ব্রিফ খুব পরিষ্কার। ঋদ্ধিমানের রিসেন্ট ডিপ্রেশনটা নিলুপিসিকে ভাবিয়েছে, প্লাস, একটা ফায়ার আর্ম মিসিং রিপোর্ট। এখন হাতে নাতে ধরতে হবে। যে কোনওদিন অবশ্য অ্যাটাক হতেই পারে, তবে আজকের চান্স খুব বেশি।
বেশ কিছুদিন ধরেই আসলে সঞ্চিতার আগের ফোন—এর কললিস্টের ভেতর থেকে দু—তিনটে কনট্যাক্ট নিলুকে খুব ভাবাচ্ছিল। ফোনটা এখন সঞ্চিতা ইউজই করে না। ওর সময় নেই এতগুলো ফোনের এতগুলো কনট্যাক্টের সঙ্গে সম্পর্ক মেনটেন করার। খাটের উপর ফেলে রাখতে রাখতে একদিন সঞ্চিতা ফোনটার কথা ভুলেই গেল। বাড়িতে পড়ে থাকা ফোনটা কিন্তু নিলুপিসিকে ভাবিয়ে চলেছিল। আর এভাবেই একদিন ঋদ্ধিমানের কলটা রিসিভ করে ফেলে নিলু।
পর পর সাত—আটদিন, ওই ফোনে ঋদ্ধিমানের প্রচুর মিসড কল ছিল।
দেখার পর নিলুপিসি গোপনে সিদ্ধান্তটা নেয়। ফোনটা রিসিভ করে। দায়িত্ব নিয়ে সঞ্চিতার মতো গলা করে কথা বলে। অবশ্য গলা চেঞ্জ না করলেও চলত, কারণ ঋদ্ধিমান সঞ্চিতাই ফোনটা ধরেছে ভেবে এতটাই এক্সাইটেড ছিল, প্রায় আনন্দে উন্মাদ, ও নোটিসই করত না নিলুপিসির গলাটার ডিফারেন্সটা। মুখের কাছে হাত চেপে কথা বলেছে নিলুপিসি। একদম হুঁ হাঁ দিয়ে চালিয়েছে, ঋদ্ধিমান বুঝতেই পারেনি, তাছাড়া ওর বোঝার মতো অবস্থাও ছিল না… হাউ হাউ করে চিৎকার করেছে শুধু।
তারপর থেকে বেশ কয়েকবার ওকে ফোন করে শোনার কাজটা করে গেছে নিলুপিসি।
ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক হয়ে গিয়েছে ঋদ্ধিমানের কমিউনিকেশন। ও এখন একতরফা কথা বলে যায়। কথা শুনতে শুনতে কান জ্বলে যায়, তবু শোনে নিলু। সঞ্চিতাকে ভালো রাখতে চায়, বোধ হয় ঋদ্ধিমানেরও ভালো চায়।
তুমি আমাকে কেন কিছু বলছ না, সঞ্চিতা। কেন বলে গেলে না, সেদিন ওফেলিয়া বার থেকে ওইভাবে উঠে চলে এসেছিলে, কেন? পরদিন কাফেতে তিনঘণ্টা বসেছিলাম… তোমাকে ফলো করে করে তোমার অফিস অবধি গেছিলাম, তুমি আমাকে দেখতেও পেলে না…
এরপর কিন্তু তোমার বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে পড়ব। ইউ নো, আই ক্যান কিল মাইসেলফ…কিন্তু আগে তোমাকে বলতে হবে তুমি কী চাও? বলো, বলো সঞ্চিতা…
উফফফ কেন এরকম করছ সঞ্চিতা…আমি ছ’দিন পর পর বাড়ি থেকে বেরোইনি, কিন্তু যেদিন বেরোব, দেখবে কী করি…আমি পাগল হয়ে যাব, আই হ্যাভ নোবডি টু টক টু…
তুমি সেদিন আবার গোলাপি জামাটা পরেছিলে আমি দেখেছিলাম…বাট হাউ ক্যান ইউ বি সো ইনডিফারেন্ট টু মি?
ঋদ্ধিমানের বাড়িটা খুঁজে বার করে ফেলেছে নিলু। ওর কথা ফলো করে করে, নিজে স্বল্প কথা গুনগুন করে বলে, ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করে, ক্লু ইউজ করে বার করে নিয়েছে ওর ঠিকানা। এখন ঋদ্ধির বাড়ির কাছে অনেকটা সময় কাটায় নিলুপিসি। সামনের লেডিস টেলারটাতে তিন—তিনবার ব্লাউজ বানাতে দিয়েছে, একবার সালোয়ার কামিজ। তাতেই কার্যসিদ্ধি। এখন ঋদ্ধির ছোটমামা, পুলিশের মাঝারি লেভেলের অফিসার, নিলুপিসির পকেটে, ওরই সঙ্গে দু—তিনবার ঋদ্ধিকে দেখেছিল এর আগে, উর্দি দেখে বুঝেছে লোকটা পুলিশ। সুতরাং এবার ভদ্রলোকের সঙ্গে মিট করা, মিসিং রিভলভারের খোঁজ, অনেক বেশি সাবধানতা, সাইকিয়াট্রিক হেল্প এর ব্যবস্থা রাখা, এবং আজ, এই এখন, কাফের সামনে বসে থাকা।
৪
তুমি কি আমাকে ভালোবাসো, সঞ্চিতা?
সঞ্চিতার ব্লু জামা পরা ছোট্ট চেহারাটা কাফের দরজা থেকে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কী ভীষণ সেক্সি, কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই ধরা দেবে না ওর কাছে, ঠিকই করে নিয়েছে যেন। দু—চারটে ফোনের পর একদিন সারাদিন ফোন আর রিসিভই করল না হয়তো। উইমসিকাল মেয়ে, না ইচ্ছে করে নাচাচ্ছে?