বা-ব্বা! বাঁচলাম ৷ ডক্টর ভর্মাকে একবার দেখলেই আমার সব ভাবনা মিথ্যে হয়ে যাবে ৷ আমিও নিরুদ্বেগ মন নিয়ে দিল্লি ফিরে যাব ৷ সত্যি কথা বলতে গেলে, এইজন্যেই তো কলকাতায় আসা ৷
ভদ্রলোকের নাম মণিকুন্তল সেন ৷ বাঙালি ৷ ওকেও আজ ডিনারে নেমন্তন্ন করেছে অলকা ৷ তবে অবশ্য কথা দিয়েছে, আমার এইসব বাজে ভাবনার কথা কিছু বলবে না ৷ দেখা যাক ৷
১৬ ডিসেম্বর : রাত আটটা
এই অংশটি অনেক পরে ডায়েরিতে লেখা হয়েছিল
ডাইনিং হলে ঢুকতে যাওয়ার আগে অপরিচিত গলার আওয়াজে থমকে দাঁড়ালাম ৷ মাঝের ঘরের ঝোলানো পরদার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতেই দেখি মণিকুন্তল সেন আর অলকা পাশাপাশি চেয়ারে বসে ৷ টেবিলের ওপর আমাদের তিনজনের প্লেট, কাঁটা-চামচ, খাবার সাজানো ৷ শুধু আমি গিয়ে বসলেই ‘ডিনার’ শুরু করা যাবে ৷ মণিকুন্তলবাবু অলকার কাঁধে হাত রেখে বলছে, তুমি ভয় পেয়েছ নাকি? এসব কখনও হয়? আমাকে তোমার বন্ধু জীবনে দেখেনি, সে কী করে আমার মুখ দেখল স্বপ্নে?
না, না, স্বপ্ন নয় ৷— অলকার স্বরে আতঙ্ক ৷ বলল, বিনতা জেগে-জেগেই চোখের সামনে দেখেছে ডক্টর ভর্মার খুনের দৃশ্য ৷ আমি তো সত্যিই সেদিন নাইটগাউন পরে তোমাকে জড়িয়ে ছিলাম ৷ তোমার চেহারা, এমনকী তোমার ডান গালে জুলপির নীচে জড়ুলটার কথাও বলেছে! আমার ভীষণ ভয় করছে ৷ শেষকালে ধরা পড়ে ফাঁসি হবে না তো?— বলতে বলতে অলকা নিবিড় হয়ে গেল মণিকুন্তলের কাছে ৷
তোমারও দেখছি মাথা খারাপ হল! আমি যে খুন করেছি, তা প্রমাণ করতে হবে না? কোন পাগলে এসে কী বলল, তাই বুঝি আইন অমনিই মেনে নেয়? তার ওপর এ-কেস তো পুলিশ সুইসাউড কেস ধরে নিয়ে ইতিমধ্যেই ক্লোজ করেছে ৷ তবে, তোমার বন্ধুকে যাতে আর ফিরতে না হয়, তার ব্যবস্থাও আজ করব ৷ এই দ্যাখো ৷— বলেই মণিকুন্তল সাইলেন্সার লাগানো রিভলভারটি দেখাল ৷
আর একমুহূর্তও নয় ৷ পা থেকে মাথা অবধি গা-শিরশির করে উঠল ৷ কপাল, চোখ-মুখ ঘেমে নেয়ে উঠল ৷ তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে এসে কিছু টাকা আর দু-একটা জরুরি জিনিস নিয়ে ওদের শোওয়ার ঘরে ঢুকলাম ৷ ওই তো টেলিফোন ৷ পাশেই টেলিফোন গাইড ৷ টেলিফোনের রিসিভার তুললাম লালবাজার হেড কোয়ার্টার্সে ফোন করার জন্যে ৷ এ কী! কোনোরকম ‘রিঙিং টোন’ই তো বাজছে না! তবে? নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি, টেলিফোনের তার কাটা ৷ তবে? এখন কী করব? কী করে ঘরের বাইরে যাব? ফ্ল্যাট থেকে বাইরে যাওয়ার একটাই তো পথ!
স্পষ্ট বুঝতে পারছি অলকা-মণিকুন্তল দুজনে মিলে সমস্ত প্ল্যানই তৈরি করে ফেলেছে ৷ ওরা কোনো দায়িত্ব নিতে চায় না ৷ ডক্টর ভর্মার খুনের একমাত্র মানসিক সাক্ষীকে চিরতরেই ওরা সরিয়ে দেবে ৷ তারপর আমার লাশ গুম করে দিলেই সব শেষ! আসার সময়ে বাড়ির কাউকে অলকার ঠিকানাও দিয়ে আসিনি ৷ না, না, যে করেই হোক, পালাতে হবে৷
বিনতা! বি…ন…তা!— অলকা ডাকছে ৷
পাগলের মতো ঘরের মধ্যেই ছুটোছুটি করতে লাগলাম ৷ ডাইনিং হলে ওরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে ৷ হঠাৎ বারান্দার এককোণে লাইটের মেন সুইচটা নজরে পড়ল ৷ ভগবানের নাম নিয়ে দিলাম সুইচটা অফ করে! সঙ্গে-সঙ্গে গোটা বাড়ি অন্ধকার ৷ ভালুক-অন্ধকার ৷ পা টিপে-টিপে মেন দরজার কাছে এসে গোদরেজের ল্যাচটা আস্তে-আস্তে খুলেই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে এলাম সদর রাস্তায় ৷ কানে বাজতে লাগল অলকা-মণিকুন্তলের ছুটোছুটি আর আমার নাম ধরে ডাকাডাকি ৷
.
এরপরের ঘটনা জলের মতো সহজ গতিতে এগিয়ে গেছে ৷ লালবাজারে বিনতা প্যাটেলের পরিচিতি আর সমস্ত ঘটনার আদ্যোপান্ত বিবরণ নথিভুক্ত হল ৷ পুলিশি তদন্তে শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হল, মণিকুন্তল সেন-ই ডক্টর ভর্মার হত্যাকারী! আর সেই নৃশংস ব্যাপারে সাহায্য করেছে নিহত ডক্টরেরই সহধর্মিণী অলকা ভর্মা ৷
কিন্তু এই ঘটনার আসল জিজ্ঞাসা হল, তবে কি মানুষের সাধারণ জ্ঞানের বাইরেও মানসিক জগতের বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া রয়েছে? চেতনের গভীরে অবচেতনের আঁধারে কোনো-কোনো ইচ্ছা মানুষের মনকে ছোবল মারে বিষাক্ত সাপের মতো ৷ সেই ইচ্ছাই হয়তো তার মানসিক পটে চলচ্চিত্রের জীবন্ত ছায়া হয়ে অজানা জগতের এক নতুন ইশারা দেয় ৷
আততায়ী – যশোধরা রায়চৌধুরী
একটা স্ট্রবেরি রঙের আকাশ, এক কোনায় মেঘ জমে আছে ডিপ চকলেট রঙের। যেন তুলতুলে স্ট্রবেরিটার উপরে জমাট, লোভনীয় ক্রাস্টের মতো ঠান্ডা, শক্ত চকলেট, ভেঙে ফেললেই গড়িয়ে পড়বে রসের মতো আলোমাখামাখি ভোর।
দিবাস্বপ্ন দেখছিল সঞ্চিতা, বারান্দায় বসে। ভোর ফুটে গেছে অনেকক্ষণ। জগিং সেরে এসে ওটস খেয়ে এখন ফেসিয়ালে বসেছে। ওর ছোট্ট নুক, দড়ির দোলনায়।
.
দুলতে দুলতে সমস্ত অ্যাটমসফিয়ার দুলছিল যেন। আকাশের ফ্রেমটাও।
মামপি, শোন।
চটকা ভাঙল।
নিলুপিসি, তুমি ডাকছিলে?
বারান্দা থেকে ঘরের দিকে মুখ বাড়াল সঞ্চিতা। ওর নিটোল ডিমের মতো মুখ। টাটকা ক্রিমিশ ত্বক আপাতত সাদা ধবধবে আস্তরণের তলায়।
—সারা মুখে কী মেখেছিস এসব? অফিসে বেরোনোর আগে, বাবা, পারিসও বটে।
—ধ্যাত, ছাড়ো তো। বলো না কী বলছিলে। সঞ্চিতা হাসল। ফেসিয়াল মাখা মুখ, যেন মুখোশের আড়ালে ঢাকা। কিছুটা ক্লাউন যেন।
—আরে কতবার করে তোর ফোনটা বাজছিল। রিংটোনে এমন একটা ঝাঁঝালো গান লাগিয়েছিস, শুনলেই পিত্তি জ্বলে যায়। এটা তোর কত নম্বর ফোন?