এক প্রচণ্ড অস্থিরতা পেয়ে বসেছিল বিনতা প্যাটেলকে ৷ আসল কথা, হঠাৎ একটা ফ্ল্যাশ, অর্থাৎ, বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো যে-ঘটনা ওর মানসিক পরদায় ছায়া ফেলেছিল, তাই ওকে অস্থির করে তুলছিল ৷
আশ্চর্য! ডক্টর ভর্মা ইজিচেয়ারে শুয়ে নিজের ঘরে কাগজ পড়ছেন, পাশেই বসে অলকা ৷ হালকা নাইটগাউন পরা৷ চুলগুলো এলোমেলো ৷ হঠাৎ একটানে ডক্টরের হাত থেকে কাগজটা কেড়ে নিয়ে কী যেন বলতে লাগল ৷ এমন সময়ে ঘরে এল সুন্দর, ফিটফাট চেহারার এক ভদ্রলোক ৷ এসেই অলকার হাত ধরে কাছে টেনে তার স্বামীর সামনেই সজোরে আলিঙ্গন করল ৷ ডক্টর উঠে কী যেন বলতে গেলেন ৷ হঠাৎ তিনি পড়ে গেলেন উপুড় হয়ে ৷ তারপরই মেঝে ভেসে গেল লাল রক্তে ৷ খুন! খুন!
চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, পাশের ঘর থেকে মা ছুটে এলেন ৷ বললেন, কী হয়েছে বিনী?
কিছু না মা, স্বপ্ন দেখছিলাম ৷
মা তো অবাক ৷ দিনেরবেলায় জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখছে মেয়ে! বললেন, কীরে, আজ স্কুলে যাবি না? তুই তো একদিন না গেলেই তোর টিচার-ব্রাদাররা দল বেঁধে এসে হাজির হবে!
ঠিক বলেছ, মা ৷ ক’টা বাজে?
৫ ডিসেম্বর
এ-ব্যাপারটা কাল স্কুলে কাউকে কিছুই বলিনি ৷ শুনলে একদল হাসবে ৷ আবার লতিকা, জহিরা, সুমনারা শুনলে বলবে, আমার বোধহয় মেন্টাল ডিজঅর্ডার হতে চলেছে ৷
কী যে করি! আজও ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না ৷ বিশেষ করে অলকার ঘরে আসা ওই আগন্তুক লোকটার কথা ৷ তার চোখ-মুখ-চাউনি এত তীব্রভাবে মনে পড়ছে যে, আমি যদি শিল্পী হতাম তবে এক্ষুনি তার ছবি এঁকে ফেলতে পারতাম ৷
চওড়া কপাল, ফরসা সুন্দর রং, উজ্জ্বল চোখ, কেবল ডান গালে জুলপির নীচে বেশ বড় একটা জড়ুল ৷ ওই লোকটি কে? ওই কি খুন করল অলকার স্বামীকে? অলকাই বা ও- লোকটার কাছে অত ঘনিষ্ঠ হয়েছিল কেন?
এ তো মহা জ্বালা! অলকা এখন কত দূরে ৷ হয়তো সব ব্যাপারটাই একটা মিথ্যে কল্পনা ৷ সত্যিই তো, মানুষ তার নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেই, এ-ধরনের হ্যালিউসিনেশন দ্যাখে ৷ তবে কি আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি?
৬ ডিসেম্বর
কতদিন অলকাদের খবর রাখি না ৷ কী করব, ওদের একটা টেলিগ্রাম করে দিই— ‘কেমন আছ তোমরা?’ সে-ই ভালো ৷
আজ এখানে প্রচণ্ড শীত ৷ তারই ভিতর আবার টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে ৷ গ্রেটার কৈলাস এলাকায় বোধহয় আমিই এত সকালে উঠেছি ৷ চারদিক কেমন ধোঁয়াটে ৷ সূর্যের আলোর কোনো আভাসই নেই ৷ এ-সময়টা কলকাতাকে মনে হয় সুইজারল্যান্ড ৷ ইউনেস্কোর ট্রেনিং-এ তিনমাস ছিলাম সুইজারল্যান্ডে ৷ তখন ওখানে গ্রীষ্মকাল ৷ ঠিক যেন কলকাতার ডিসেম্বর ৷
এই সুযোগে অলকার খোঁজ নিতে কলকাতায় গেলে কেমন হয়?
মা শুনলে বলবে, নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে ৷ কিন্তু কী করব! আমি যে খেতে পারছি না, ঘুমোতে পারছি না৷ মনের ভিতর একটা যন্ত্রণার ঢেউ উথাল-পাথাল ৷ অকারণে গা-শিরশির ভয়! বিশেষ করে ওই আগন্তুকের চেহারাটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না
আজই অলকাকে টেলিগ্রাম করব ৷
৯ ডিসেম্বর
‘আমরা সবাই ভালো আছি ৷ তুই একবার এখানে আয় ৷’
একইসঙ্গে উদ্বেগের অবসান আর কলকাতা দেখার নিমন্ত্রণ ৷ টেলিগ্রামে অলকার জবাব পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম ৷ অলকা কোনোদিনই আমার ‘মোস্ট ইন্টিমেট ফ্রেন্ড’ ছিল না, তবে অনেকের মধ্যেই একজন বিশিষ্টা ৷ দু-বছর পরে তার খবর পেয়ে আনন্দ হওয়ার চেয়ে আমার ওই উদ্বেগটা যে কেটে গেল, তাতেই আনন্দ হচ্ছে বেশি ৷ আজই স্কুলে দু-একজনকে সব বলেছি ৷ তারা তো হেসেই আকুল ৷ বলল, তুই তো বেশি মিস্টিক, সুপারন্যাচারাল বই পড়িস, তাই যত সব বাজে ভাবনা এসে ভিড় করে ৷
বাথরুমে ঢুকে কোনোদিন যা করিনি, আজ তাই করলাম ৷ আনন্দে শাওয়ারের নীচে দু-একবার ‘শেক’ নাচলাম ৷ অকারণেই সাবানটা নিয়ে খানিকটা লোফালুফি করলাম ৷ আর দু-দিন পরেই স্কুল ছুটি হচ্ছে ৷ আজই টেলিগ্রাম করে দেব : ‘কলকাতায় যাচ্ছি!’
মনের সমস্ত মেঘ কেটে গেছে মনে হয়েছিল বিনতার ৷ কিন্তু আশ্চর্য, কলকাতায় যাওয়ার আগের দিন থেকে আবার সেই কল্পনায় দেখা লোকটার চেহারা মনের পরদায় ভেসে উঠল ৷ মনে পড়তে লাগল অলকার লোকটাকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য ৷ ওর ডাক্তার স্বামী মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে ৷ রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা ঘরের মেঝে!
বুকের ভেতরটা মাঝে-মাঝে ফাঁকা হয়ে যেতে লাগল ৷ একটা করুণ নিশ্বাস কেঁদে-কেঁদে গলে যাচ্ছে বর্ষার মতো৷ আর তারই সাথে ভয়, ভয়, ভয়, ভয় ৷ কীসের ভয়? মনকে শক্ত করার চেষ্টা করে বিনতা ৷ কন্টিনেন্ট- ঘোরা মেয়ে! একলা-একলা কত দেশ ঘুরেছে সে ৷ আজ এ কী এক বিশ্রী ভয়ের চাবুক তাকে এমন করে মারছে?
না ৷ কলকাতায় তাকে যেতেই হবে ৷ রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকিট কাটা হয়ে গেছে ৷ আর পেছুলে চলবে না ৷ কাল বিকেল পাঁচটায় গাড়িতে উঠলে পরদিন বেলা এগারোটা নাগাদ হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যাবে ৷ অলকা আসবে স্টেশনে গাড়ি নিয়ে ৷
অতএব আর কোনো ভাবনা নয় ৷ কালই বিনতা রওনা হবে কলকাতা ৷
১৩ ডিসেম্বর
আমার সিটটা জানলার ধার ঘেঁষে ৷ পাশের পর-পর দুটো সিটেই এসে বসলেন দুজন গুজরাটি ভদ্রমহিলা ৷ কে একজন বলল, ফিল্ম স্টার সঞ্জীবকুমারের আত্মীয় ৷ মনে-মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! কারণ রাজধানী এক্সপ্রেসে এই এক মজা ৷ পাশে হয়তো কালো হোঁতকা কোনো দুর্গন্ধওয়ালা জাঁদরেল লোক এসে বসলেও করার কিছু নেই! ঠিক আমার পেছনের সারিটায় মাত্র একজন মাদ্রাজি ভদ্রলোক ৷ গাড়ি চলতে শুরু করল, সুন্দর স্বাগত সম্ভাষণ দিয়ে লাইট মিউজিক বাজতে লাগল ৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই চা সার্ভ করল ৷ দু-একটা ম্যাগাজিন কিনে সামনে রেখে দিলাম ৷ তারপর সামনের খাওয়ার ট্রে-টা টেনে তার ওপর রেখে ডায়েরির পাতা লিখছি, হঠাৎ বেশ একটু গম্ভীর গলায় ইংরেজিতে পেছন থেকে আওয়াজ এল ৷ অনুরোধ : ‘আপনার ‘‘ফেমিনা’’টা একটু পেতে পারি?’ পেছন দিকে একবার না তাকিয়েই বাঁ-হাতে ‘ফেমিনা’টা ভদ্রলোককে দিলাম ৷