সুপ্রতিম শুয়ে-শুয়েই স্নো-পাউডারের গন্ধ পেল।
সুপ্রতিমের ঠোঁটে, মুখে, বুকে লিপস্টিক ঘষে দিল ঝুমুর। তারপর লিপস্টিক ছুড়ে ফেলে দিয়ে ওকে কষে চটকাতে লাগল, আর জড়ানো গলায় বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘আমি তোমায় বড় ভালোবাসি/তোমায় বড় ভালোবাসি…আমি তোমায় বড় ভালোবাসি…।’
সুপ্রতিম ভাবছিল, ও কি বেঁচে আছে? এই ঘটনাগুলো কি সত্যি? না কি দুঃস্বপ্ন!
‘বলো, তুমি আমায় ভালোবাসো। একবার বলো, আমায় ভালোবাসো। তুমি আমার— আর কারও নয়। শুধু একবার বলো…।’
অসুস্থ উন্মত্ত ছেলেটা সুপ্রতিমের জামা সরিয়ে দিয়ে খোলা বুকে মুখ ঘষছে। ঠোঁটে, গালে, চোখে যথেচ্ছ চুমু খাচ্ছে। হাতড়াচ্ছে যেখানে-সেখানে। আর অনর্গল ভালোবাসার কথা বলছে।
ঝুমুর ওর প্যান্টের বোতাম খোলা শুরু করতেই সুপ্রতিম চাপা চিৎকার করে উঠল।
‘কী, কষ্ট হচ্ছে?’ ঝুমুর নিষ্পাপ স্বরে জিগ্যেস করল, ‘তুমি শুধু একবার বলো, আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে…তা হলেই তোমার সব বাঁধন খুলে দেব। তুমি শুধু আমায় একটা চুমু খাও…একটা…তা হলেই আমি তোমার ক্রীতদাস হয়ে যাব।…শুধু একবার…।’
সুপ্রতিমের গলা দিয়ে বমি উঠে আসতে চাইছিল। কিন্তু গলা ফাঁক হয়ে যাওয়ার চেয়ে সেটা অনেক ভালো। ওর মনে হচ্ছিল, ও বোধহয় এখনই অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিছু একটা করা দরকার, কিছু একটা করা দরকার…।
দাঁতে দাঁত চেপে সুপ্রতিম কোনোরকমে বলল, ‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি, ঝুমুর।’
প্যান্টের জিপার খুলতে গিয়ে ঝুমুরের হাত থেমে গেল। ও আদুরে গলায় বলল, ‘কী বললে গো? আর-একবার বলো। প্লিজ…।’
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি। আরও ভালোবাসতে চাই।…আমার বাঁধনগুলো খুলে দাও, প্লিজ…।’ কথা বলতে গিয়ে সুপ্রতিমের দম আটকে যাচ্ছিল।
ছিলে-ছেঁড়া-ধনুকের মতো চট করে উঠে পড়ল ঝুমুর। হাঁফাতে-হাঁফাতে সুপ্রতিমের বাঁধন খুলতে শুরু করল। উত্তেজনায় ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।
বাঁধন খোলা হতেই সুপ্রতিমের কপালে হাত বুলিয়ে নরম সুরে ঝুমুর বলল, ‘নাও, এবার ওঠো।’
ক্লান্ত শরীর নিয়ে উঠে বসল সুপ্রতিম। কাটা জায়গাগুলো ভীষণ জ্বালা করছে।
ঝুমুরের আর তর সইছিল না। ও সুপ্রতিমের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে এল। ওর কোলে উঠে বসল একেবারে।
সুপ্রতিমের মনে হল একটা কোলাব্যাঙ ওর কোলে বসে আছে। কিন্তু বাঁচার তাগিদে ও ঝুমুরকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে-গালে চুমু খেল। বিড়বিড় করে বলল, ‘আই লাভ য়ু, ঝুমুর…।’
শরীরের ভেতর থেকে উঠে আসা বমির দমক রুখে দিয়ে সুপ্রতিম ভাবল, নয়না এখনও আসছে না কেন।
আর ঠিক তখনই ঝুমুরের নগ্ন কাঁধের ওপর দিয়ে সোফার ওপরে পড়ে থাকা ক্ষুরটা ও দেখতে পেল। হাতের প্রায় নাগাল রয়েছে ওটা।
ঝুমুরকে জড়িয়ে ধরে কোনোরকমে হাঁটুগেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সুপ্রতিম। পলকা ছেলেটা সুপ্রতিমের আশ্লেষে আনন্দে টইটম্বুর হয়ে ভালোবাসার প্রলাপ বকছে শুধু। আর সুপ্রতিম নিজের প্রাণ বাঁচাতে একের-পর-এক চুমু খেয়ে চলেছে ওর স্নো-পাউডার মাখা মুখে।
ক্ষুরটা এখন পুরোপুরি সুপ্রতিমের হাতের নাগালে।
ও মুঠো করে অস্ত্রটা ধরল। তারপর ঝুমুরকে আদর করতে-করতে ক্ষুরটা নিয়ে এল ওর গলার খাঁজের কাছে।
কতক্ষণ আর সুপ্রতিমের শক্তি থাকবে কে জানে! মাথা ঝিমঝিম করছে। রক্তে চটচট করছে হাত-পা-বুক।
চুলোয় যাক ভদ্রতা, সভ্যতা, নীতি, দয়া ইত্যাদি।
আত্মরক্ষা মানুষের একটা আদিম ধর্ম।
বাঁহাতে ঝুমুরের মাথাটা পিছনে ঠেলে দিয়েই ডান-হাতে ক্ষুর টেনে দিল সুপ্রতিম।
ঝুমুরের ভালোবাসার প্রলাপ মাঝপথেই থেমে গেল। তার বদলে ঘরঘর শব্দ বেরোতে লাগল মুখ আর গলা দিয়ে।
রক্তে মুখ-গলা-বুক ভেসে গেল সুপ্রতিমের। ওর মুখ দিয়ে একটা বিচিত্র শব্দ বেরিয়ে এল। আর সঙ্গে-সঙ্গেই ও জ্ঞান হারিয়ে কাত হয়ে পড়ল মেঝেতে। ঝুমুরের মৃতদেহ তখনও ওকে আঁকড়ে ধরে ছিল।
একটি অচেতন দেহ ও একটি মৃতদেহ অসাড় হয়ে নয়না অথবা আর কারও জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
রক্তের ধারা তখন মেঝেতে গড়িয়ে-গড়িয়ে সময়ের হিসেব রাখছিল।
আঁধারে সাপ চলে – বিমল সাহা
সাধারণত ছোটগল্পের কোনো ভূমিকা থাকে না ৷ সে নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বয়ংপ্রকাশ ৷ কিন্তু এ-কাহিনি কোনো তথাকথিত নিয়ন্ত্রিত আঙ্গিকে বাঁধা গল্প নয় ৷ তাই সামান্য দু-একটা কথা বলার দরকার ৷ বছর-দুই আগে দিল্লিতে মামাতো বোনের বাড়িতে বিনতা প্যাটেলের সঙ্গে আলাপ হয় ৷ এটি তারই জীবনের ঘটনা ৷ কিছু তার মুখে শোনা, কিছু তার ইংরেজিতে লেখা ডায়েরির মর্মানুসরণ ৷ সত্যি কথা বলতে গেলে, আমার ভূমিকা এই কাহিনিতে অনেকটা অনুলেখকের ৷— লেখক
৪ ডিসেম্বর
এ আমি কী ভাবছি? না, না, এ হতে পারে না ৷ তাড়াতাড়ি চোখ দুটো ভালো করে মুছে নিলাম ৷ আমি তো ঘুমিয়ে নেই ৷ তাহলে এ আমি কী ভাবছি? ভাবছি, না দেখছি? স্পষ্ট যেন আমার চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো কতগুলো ঘটনা ঘটে গেল ৷
অলকাও এখন কলকাতায়, ওর স্বামী ওখানে বড় ডাক্তার ৷ ওদের বিয়েতে বছর-দুয়েক আগে কলকাতায় গিয়েছিলাম ৷ দে আর হ্যাপিলি ম্যারেড ৷ তবে এ আমি কী ভাবছি! আমার মনে হঠাৎ ওদের কথাই বা ভাসছে কেন? ভালো লাগছে না ৷ তাড়াতাড়ি উঠে রেডিয়োটা চালিয়ে দিলাম ৷ আবার বন্ধ করলাম ৷ স্টিরিয়োটা চালু করলাম ৷ গমগম করে উঠল ঘর জ্যাজ-এর ঝমঝম আওয়াজে ৷ নিজেও একটু টিউনের সাথে নাচলাম ৷ ধুস! তবুও ছবিটা মন থেকে মুছছে না ৷