হলুদ শিখা অনেকটা সাহস ফিরিয়ে দিয়েছে। মোমবাতি কোথায় আছে? মনে পড়ছে না।
পিপিং…পিপিং…। ল্যান্ড ফোনটা বাজতে শুরু করেছে। এত রাতে কে করল? বাজুক গে। তুলবেন না। উহুঁ, ইলেকট্রিক সাপ্লাই থেকে হতে পারে। নতুন কী একটা যন্ত্র বসিয়ে দিয়ে গেছে। সেই সিস্টেমে হয়তো পাওয়ার ফেলিওর ধরা পড়েছে।
মহীতোষ চেনা পথে ফোনের দিকে এগোলেন। একহাতে জ্বলন্ত লাইটার।
‘হ্যালো।’
‘দাদা! ভালো আছ?’
গলাটা চেনা—চেনা। একটু ফ্যাঁসফেসে।
‘ক—কে?’
‘সে কী দাদা! ছোটভাইকে এর মধ্যেই ভুলে গেলে?’
‘ম—মানে? ক—কে আপনি?’
‘তোমার ছোট ভাই। মনোতোষ।’
‘কী! বাজে কথা বোলো না। আমার কোনও ছোটভাই নেই।’ মহীতোষের গলা কেঁপে যাচ্ছে।
‘এখন নেই। কিন্তু ছিল তো! এখানে একা—একা বড্ড কষ্টে আছি দাদা। তোমার কাছে আসছি।…ধরো না, এসেই গেছি। আজ তোমায় নিয়ে যাব দাদা।’
ফোন কেটে গেল।
মহীতোষ ধপ করে বিছানায় বসে পড়েছেন। শরীর থরথর করছে। দরদর করে ঘাম বেরোচ্ছে। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে চেপে থাকা লাইটারটা পড়ে গেল। ডান হাতের রিসিভারটাও টলটল করছে।
ঠিক তখনই খট—খট…খটাখট…খট….খট…। বাথরুমের ভেতর থেকে বিশ্রী আওয়াজ। হঠাৎ কারা ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে।
মনোতোষ! ওকে নিয়ে যেতে সদলবলে এসে গেছে?
মহীতোষ বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে। বুকের বাঁ দিকে চিনচিনে ব্যথা।
একটানা মিনিটখানেক চলার পরে অপার্থিব আওয়াজ থেমে গেল। মনোতোষ ঢুকে আসবে?
মহীতোষের চক্ষু বিস্ফারিত। একফোঁটা শক্তি নেই। চিনচিনে ব্যথা লাফিয়ে—লাফিয়ে বাড়ছে, ঠোঁট শুকনো, জিভ অসাড়।
বাথরুমের ভিতরে এবার কল—কল—কল—কল। কেউ জলের কল খুলে দিয়েছে। কী চায় মনোতোষ?
জলের শব্দ বন্ধ হয়েছে। মহীতোষ উঠে বসার চেষ্টা করলেন। পারলেন না।
আচমকা আবার! আবার সেই ভয়ানক ধপাধপ…ধপাধপ। পুরো বাথরুমটা সেই শব্দে কাঁপছে।
বুকের বাঁ দিকটা খিমচে ধরলেন মহীতোষ সান্যাল। উঃ! অসহ্য!
.
‘প্রিয়তোষবাবু, নমস্কার। ভেতরে আসব?’
‘আপনি!’
‘কিরণকুমার। ডি.ডি. ইনসপেক্টর, লালবাজার।’
‘আসুন। কিন্তু আমি ঠিক…লালবাজার…’
‘মহীতোষ সান্যাল আপনার জ্যাঠামশাই তো?’
‘হ্যাঁ। কাল রাতে জ্যাঠাবাবু ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে…আজ সকালে দরজা ভেঙে ওনাকে… তখনই ফ্যামিলি ফিজিসিয়ানকে খবর দিয়েছি…কিন্তু…পুলিশ…কেন?’
‘সোজাসুজি বলতে গেলে তদন্ত করতে।’
‘তদন্ত!’
‘ইয়েস প্রিয়তোষবাবু। সকালে জয়েন্ট সিপি সায়েবের ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি আমায় ছুটে আসতে হয়েছে। ও.সি.—ও একটু পরে আসছেন।’
‘জয়েন্ট কমিশনার!’
‘হ্যাঁ। মহিমা বাগচীকে চেনেন নিশ্চয়ই?’
‘নিশ্চয়ই। আমার বোন। জ্যাঠাবাবুর একমাত্র মেয়ে। বিয়ের বছর পাঁচেক পরে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যায়। ঘণ্টাখানেক আগে আমিই ওকে খবরটা জানিয়েছি।’
‘ঠিক। ম্যাডামের হাসব্যান্ড জয়েন্ট সিপির বাল্যবন্ধু। সেই কানেকশানেই সাহেবকে ওনারা জানিয়েছেন, মহীতোষবাবুর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। দে ওয়ান্ট পোলিস ইনভেস্টিগেশন।’
‘মাই গড! মহিমা আমায় তো কিছু বলল না! স্ট্রেঞ্জ! ও বিদেশে চলে যাওয়ার পর থেকে জ্যাঠাবাবুকে আমরা—আই মিন আমার ফ্যামিলিই দেখাশোনা করে আসছে। আমায় ছেলের থেকেও বেশি ভালোবাসতেন। এমনকী জ্যাঠাবাবুর ব্যবসা—কারখানা সবকিছুই আমায় সুপারভাইস করতে হয়! ওনার বয়েস হয়েছিল সেভেনটি প্লাস।’
‘জানি মিস্টার সান্যাল। আসতে—আসতে আমি কিছু ইনফরমেশন ইন—পুট নিয়ে এসেছি। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, আমি হেলপলেস। হাই লেভেলের অর্ডার…।’
‘আমি টেরিবলি শকড মিস্টার কুমার। মহিমা কি আমায় সন্দেহ করছে?’
‘না। তেমন কিছু অবশ্য শুনিনি।…আপনার জ্যাঠা কি একাই থাকতেন?’
‘মহিমার বিয়ের পর পাঁচবছর একাই ছিলেন। একা মানে উনি আর কাজের লোকজন। জেঠিমা অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। আমি শ্যামবাজারের ফ্ল্যাটে থাকতাম। একদিন নিজে থেকেই বললেন, বউমাকে নিয়ে তুই এখানেই চলে আয়। এত বড় বাড়ি, ফাঁকা পড়ে আছে। আমরা তবু আসতে চাইনি। শেষে খুব জোরজার করাতে বউ—ছেলে নিয়ে চলে আসি। সেও প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। আমার ছেলে তো দাদাইয়ের খুব ন্যাওটা।…উঃ, কিছুই বুঝতে পারছি না। মহিমা বলছে…’
‘কুল ডাউন মিস্টার সান্যাল। আপনি বললেন, দরজা ভেঙে ঢুকেছেন। দ্যাট মিনস, কালকে রাতে আপনারা এ বাড়িতে ছিলেন না?’
‘না। অ্যানুয়ালের পরে ছেলের ছুটি। মামার বাড়ি যাওয়ার বায়না করছিল। তাই পাঁচদিন হল, বউ—ছেলেকে হাতিবাগানে শ্বশুরবাড়ি রেখে এসেছি। কাল রাতে আমায় শাশুড়ি মা খেতে ডেকেছিলেন। তাই আমিও সেখানে যাই। হঠাৎ ভোর ছ’টা নাগাদ সন্ধ্যা ফোন করে জানাল, দরজা বন্ধ। কলিংবেল বাজিয়ে, ধাক্কাতেও জ্যাঠাবাবু সাড়া দিচ্ছেন না। তখন এক কাপড়ে ছুটে আসি।’
‘ওকে। সন্ধ্যা কি কাজের মহিলা?’
‘হ্যাঁ। রাত দিন থাকে। কাল ওর ছেলের শরীর খারাপ খবর পেয়ে রাতটুকুর জন্যে গেছিল। জ্যাঠাবাবু নিজেই ওকে ছুটি দিয়েছিলেন।’
‘অন্য কাজের লোকজন? একা সন্ধ্যাই বাড়ির সব কাজ করত?’
‘না। একমাত্র সন্ধ্যা রাতদিন থাকত। আমরা এ বাড়িতে আসার পর থেকে অন্যরা পার্ট টাইম। কেউ রান্না, কেউ ঘরদোর সাফ, বাসন মাজা, বাজারঘাট…ফ্যামিলির দিকটা আমার স্ত্রী দেখতেন।’