বিজুর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়তুম ৷ খেলাধুলো, মেয়ে-ইস্কুলের সামনে জটলা করা, প্রথম সিগারেট টানা— সবই একসঙ্গে ৷ সেই বিজু এত বড় গদ্দারি করবে ভাবতে পারিনি ৷ সমানে পিন মেরে গিয়েছে মানিকবাবুকে ৷ হপ্তাখানেক আগে সেদিন দুটো লং ট্রিপ মেরেছি ৷ ভালোই কামানি হয়েছে ৷ চাঁদুর ঠেকে গিয়ে দু’পেগ চাপিয়েও নিয়েছি ৷ বাড়ি ফিরছিলুম বেশ মুড নিয়ে ৷ ক’দিন ধরেই ভাবছি চুমকিকে একটা সিটি গোল্ডের হার দেব ৷ চৌরাস্তার মোড়ে একটা ভাড়া পেলুম ৷ দুটো লোক, সঙ্গে একটা মেয়েছেলে; সন্তোষপুর যাবে ৷ তখন আমার পকেট গরম ৷ অন্য সময় হলে সিওর কাটিয়ে দিতুম ৷ কিন্তু এখন আমার পয়সার দরকার ৷ চুমকির ব্যাপারটা ফেলে রাখা যাবে না ৷ দেবু স্ট্রেট লাইনে ঢুকে পড়েছে ৷ কিন্তু আমি সিওর, চুমকিকে শুধু বলার অপেক্ষা ৷ বললেই ও রাজি হয়ে যাবে ৷ চুমকি শুধু আমার মুখ থেকে শুনতে চায় ৷ কিন্তু ওকে তুলব কোথায়! একটা ঘরে সাতজন মেম্বারের সঙ্গে পোলট্রির মুরগির মতো গাদাগাদি করে থাকি৷ ইমিডিয়েট একটা ঘর তুলতে হবে ৷ তো সেদিন মেয়েছেলে দেখে বুঝলুম ভালো খেঁচে নেওয়া যাবে ৷ বেশ চড়িয়ে রেট বললুম ৷ পার্টিও রাজি হয়ে গেল ৷
সন্তোষপুরের দিকে গাড়িটা ছুটছিল ৷ দু’পাশে অন্ধকার মাঠ ৷ হঠাৎ পিছন থেকে গলায় ছুরি ধরে গাড়ি থামাতে বলল ৷ তারপর আমাকে পুরো ছেঁকে নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল তিনজন ৷ ফিরে এসে মানিকবাবুকে সব বললুম ৷ মানিকবাবু গম্ভীর মুখে শুনল ৷ শেষে বলল, ঠিক আছে দেখছি, তুই গাড়ি গ্যারেজ কর ৷
পরদিন সকালে গিয়ে দেখি গ্যারেজ ফাঁকা ৷ মানিকবাবু বলে দিল, তোকে আর গাড়ি চালাতে হবে না ৷
সেই গাড়ি এখন বিজু চালাচ্ছে ৷ বহুত স্ক্যানডাল ছড়িয়েছে আমার নামে ৷ আমি আর গাড়ি পাচ্ছি না ৷ মা আমার দিকে আজকাল কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় ৷ বোন সেদিন বলল, দাদা তোর নামে কী সব বিচ্ছিরি কথা শুনছি ৷
চুমকির কাছে গেলুম একদিন ৷ ও সেজেগুজে কোথায় একটা যাচ্ছে ৷ খুব ব্যস্ত ৷ কথা বলার সময়ই হল না ৷
কাজের ধাক্কায় চারদিকে ঘুরি ৷ দেখি দেবুর মোটর সাইকেলের পিছনে চুমকি ৷ ঝড়ের মতো আমার পাশ দিয়ে চলে যায় ৷ চুমকিকে বলাই হল না কথাটা ৷ মনে মনে খিস্তি পাড়ি নিজেকে ৷
এখান থেকে দেখছি খুব লেকচার দিচ্ছে বিজু ৷ শালা কথার মাস্টার! মেয়ে পটাতে ওস্তাদ ৷ নে, যত পারিস বাতেলা ঝেড়ে নে, একটু পরেই তো ফুটে যাবি ৷
ফের একটা চুমুক মেরে নিজেকে চাঙ্গা করি ৷ চুমকির জন্য দুঃখটা বুকের মধ্যে ঘাই মারে ৷ চুমকিও আমাকে ভুল বুঝল ৷ চুমকি, তোমার দিব্যি, টাকাটা সেদিন সত্যিই চোট হয়ে গেসল ৷ আমাকে আর একটু সময় দিলে পারতে ৷ তোমাকে ছুঁয়ে বলছি, তোমাকে আমি খুব… ৷
যাঃ শালা, মাতাল হয়ে গেলুম নাকি! ফালতু চিন্তা ঝেড়ে ফেলে সোজা হয়ে বসি ৷ রাত বাড়ছে, একটা-দুটো করে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে বেঞ্চগুলো ৷
বিজু এখনও মেয়েটাকে নিয়ে বসে আছে ৷ অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে আসি আমি ৷ এখান থেকে সোজা দেখা যাচ্ছে ওদের ৷ ঝলমলে ঝাউপাতার ব্যাকগ্রাউন্ডে বসে আছে দুজন ৷ পকেটে হাত ঢুকিয়ে মেশিনটা একবার ছুঁয়ে দেখি ৷
আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বিজু ৷ মর্নিং ওয়াকে আসা মানুষজন ভিড় জমিয়েছে লাশটাকে ঘিরে ৷ চারপাশে চাপ চাপ রক্ত ৷ মুখটা হাঁ, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ৷ মুখের ওপর ভন ভন করছে মাছি ৷
নাহ, আর সময় নেওয়া ঠিক হবে না ৷ একটু পরেই রাজ্যের মাতাল আর গেঁজেল এসে জুটবে ৷ আমি কায়দা করে পাশ কাটিয়ে পিছনের দিকে চলে যাই ৷ তারপর বেড়ালের পায়ে এগোতে থাকি ওদের দিকে ৷ এখনও দুজনে খুব মুডে গল্প করে যাচ্ছে ৷
ওদের পিছনে একটা খুব মোটা গাছ আড়াল করে আমি এগোই ৷ তারপর গুঁড়িটার গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি৷
হঠাৎ শুনতে পাই বিজু বলছে, আমি তোমাকে খুব…
মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে, খুব কী?
বিজু তোতলাচ্ছে, আসলে খুব… কী বলব…
আমি আর এগোতে পারি না ৷ পা দুটো পাথরের মতো ভারী হয়ে গেছে ৷ ছুরিটা শক্ত করে ধরে গাছের গুঁড়িতে ফলাটা ঠেকাই ৷ আমার ঠোঁটগুলো আর বশে নেই, বিড় বিড় করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে ৷
কানে আসছে মেয়েটার হাসি আর বিজুর তোতলামি, আমি তোমাকে…
প্রচণ্ড চাপে ছুরির ফলাটা বেঁকে যাচ্ছে আর আমার অবাধ্য ঠোঁটদুটো বলছে, বলে ফেল নারে শালা, বল, তাড়াতাড়ি বল, দেরি হয়ে যাচ্ছে ৷
হিসেবে কিছু ভুল ছিল – ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়
জুতোজোড়া প্রথমে সজীব হয়ে নড়ে উঠল, তারপর গটগট করে বিছানার কাছে গিয়ে থেমে পড়ল।…
মহীতোষবাবুর গায়ে কাঁটা দিল। হেমেন রায়ের রহস্যরোমাঞ্চ সমগ্র বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। নাহ, আজ থাক। বাকিটা কাল সকালে পড়বেন।
ঘড়িতে এগারোটা পঞ্চাশ। কনকনে শীতের রাত। চারিদিক নিশুতি। মহীতোষবাবুর মনে পড়ে গেল, আজ হেরম্ব দাস লেনে প্রকাণ্ড বাড়িতে তিনি একেবারে একা।
করিডরের আলোগুলো জ্বালিয়ে দিলেন। জ্বলুক সারারাত। বেডরুমেও আজ আলো নেভাবেন না।
হঠাৎ য—যা! আলো নিভে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। লোডশেডিং? শনিবারের রাতে!
পাঞ্জাবির পকেট হাঁটকে লাইটারটা বের করলেন। বুকের ভিতর ধপ—ধপ শব্দ।