চুমকির বাবা-মা আমাকে ঠিক গিলতে পারছিল না ৷ আমি নেহাত মস্তান টাইপ, যেখানে- সেখানে ঝাড়পিট করে বেড়াই, তাই মুখের উপর কিছু বলতে পারেনি ৷ বাপটা তো হেঁপু রুগি, সারাদিন ফুসফুসে বাড়তি একটু বাতাস নেওয়ার জন্যে খাবি খাচ্ছে ৷ একদিন আমাকে ধরল,— তা তুমি কী ঠিক করলে, গাড়িই চালাবে? বলতে বলতে কাশির দমক এসে গেল ৷ একটু সামলে নিয়ে ফের শুরু করে,— আসলে লাইনটা তো ঠিক… ৷ এই পর্যন্ত বলে ফের কাশে ৷ মনে হল এবার ইচ্ছা করে কাশছে ৷ বলতে চাইছে— লাইন তো ঠিক ভদ্দরলোকের নয় ৷
আমি বললুম, দেখি কী করা যায় ৷
দেখো, দেখো ৷ এখন কত ভালো ভালো লাইন বেরোচ্ছে ৷ তা তুমি কম্পিউটার শেখো না কেন! চারদিকে তো দেখছি সবাই খুব কম্পিউটার শিখছে ৷
পার্কে এখন বুড়ো-বুড়ো কেউ আর নেই ৷ কংক্রিটের বেঞ্চগুলো নওজোয়ানদের পেয়ে চনমনে হয়ে উঠেছে ৷ ওদিকে ছাতিম গাছটার নীচে দু’পিস এসে বসেছে ৷ পুরনো পাপী ৷ প্রায়ই দেখি এখানে ৷ মনে হচ্ছে জোর খিচাইন লেগেছে ওদের ৷ কথা শুনতে পাচ্ছি না, কিন্তু হাত-পা নাড়া দেখে বুঝতে পারছি মেয়েটা খুব তোড় করছে ছেলেটাকে ৷ ছেলেটা একটু ভেবলু টাইপের ৷ কেসটা হ্যান্ডেল করতে পারছে না ৷ চুমকি একদিন একটা ব্যাপারে এমনই খচে গিয়েছিল আমার উপর ৷ কিন্তু আমিও শালা ওস্তাদ ড্রাইভার ৷ ঠিক পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলুম ৷ আধ ঘণ্টার মধ্যে চুমকি গলে জল৷ বলল, সরি ৷
আমি বললুম, ঠিক আছে, আমি কিছু মাইন্ড করিনি ৷
চুমকি বলল, সত্যি বলছ!
বললুম, মা কালীর দিব্যি ৷ তোমার উপর রাগ করতে পারি না ৷
কেন, রাগ করতে পারো না কেন?
নিখুঁত পাস দিয়েছে চুমকি ৷ বলটা শুধু ফাঁকা গোলে ঠেলে দেওয়া ৷ কিন্তু ক্যালাস স্ট্রাইকারের মতো অমন সুযোগটা উড়িয়ে দিলুম ৷ কোনওরকমে তুতলে মুতলে বললুম, আসলে আমি তোমাকে খুব…
চুমকি খুব আগ্রহ নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল—আমাকে খুব কী!
তখন ঘাবড়ে গিয়ে আমি কথা হারিয়ে ফেলেছি ৷ এদিকে চুমকি বার বার তাগাদা দিচ্ছে, কী হল বলবে তো!
শেষে মরিয়া হয়ে বলে ফেলি, আমি তোমাকে একদিন গাড়ি করে বেড়াতে নিয়ে যাব ৷
চুমকি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে ৷ ক্রমশ থমথমে হয়ে ওঠে ওর চোখমুখ ৷ একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, যদি কোনোদিন তোমার নিজের গাড়ি কেনার মুরোদ হয় তো চাপব ৷
বিজু যে পিছনে লেগেছে বুঝতে পারি মাসখানেক আগে ৷ সেদিন হোল-ডে প্যাসেঞ্জার নেই ৷ সারাদিন গাড়ির মধ্যে বসে ভেপে যাচ্ছি ৷ এদিকে সন্ধেবেলা আমার চুমকির সঙ্গে প্রোগ্রাম; ‘ম্যায় হুঁ না’ দেখতে যাব ৷ তারপর ‘নিরালা’ রেস্টুরেন্টে মোগলাই চিকেন কষা খাব ৷ চুমকিকে বলে দিতে হবে কথাটা ৷ আর ফেলে রাখা ঠিক হবে না ৷ শুনছি দেবু লাইন লাগিয়েছে চুমকির পিছনে ৷ সত্যদা পার্টির ঘ্যাম নেতা ৷ সেই সত্যদার পাতা চাটে দেবু ৷ কোনো প্রোমোটারই সত্যদার পারমিশন ছাড়া এলাকায় ঢুকতে পারে না ৷ দিন দিন লাল হয়ে যাচ্ছে সত্যদা ৷ সেইসঙ্গে দেবুর গায়েও লাল না হোক গোলাপি আভা লাগছে ৷ দেবুর গায়ে পার্টির স্ট্যাম্প আছে, দেবুর বাড়িতে এক্সট্রা ঘর আছে, দেবুর ঝকঝকে মোটর সাইকেল আছে ৷ আমার বাড়িতে বাতের ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে ঠাকুরের নাম নেওয়া মা, সিন্থেটিক শাড়ি পরে পাড়ার কে জি ইস্কুলে ‘ব্যা ব্যা ব্ল্যাক শিপ’ শেখাতে যাওয়া বোন, আর পোলিও-পা নিয়ে ল্যাকপ্যাক করা ভাই ৷ এসব ভাবলেই টেনশন বাড়ে ৷ ঠিক করেছি, যা থাকে কপালে, বলেই দেব ৷ আর চুমকিকেও বলি, সবই তো বুঝিস! তবু মুখ দিয়ে বলাবে ৷ শুনে কী শান্তি কে জানে! তো সেদিন বসে বসে দু’বান্ডিল বিড়ির ছাদ্দ করে সন্ধেবেলা মানিকবাবুকে গিয়ে বললুম, টাকা দিন, ব্রেক-শুগুলো নষ্ট হয়ে গেসল, নতুন লাগিয়েছি ৷
মানিকবাবু বলল, দেখি পুরনোগুলো ৷
আন্দাজ করেছিলুম মানিকবাবু চাইতে পারে ৷ ব্যবস্থা করাই ছিল, গ্যারেজ থেকে জোগাড় করা পুরনো মাল গছিয়ে দিলুম ৷
মানিকবাবু ভুরু কুঁচকে একটু দেখল ৷ শালা বমকে গেছে ৷ কিন্তু টাকাও দিল না ৷ বলল, কাল টাকা নিয়ে যাস ৷
পরে শুনি বিজু রাত্তিরবেলা গ্যারেজে গাড়ি নিয়ে গিয়ে ব্রেক-শু-গুলো টেস্ট করিয়েছিল ৷
মানিকবাবুকে ভালো বলতে হয়; এর পরও আমাকে গাড়ি চালাতে দিয়েছে ৷ কিন্তু সেদিন পুরো প্ল্যানটা ধসে গেল৷ হেভি গোঁসা খেয়ে গেল চুমকি ৷ স্ট্রেট জানিয়ে দিল ঠ্যালাচালক, রিকশাচালক, মারুতিচালক সব একই ক্যাটাগরির ৷
হঠাৎ দেখি বিজু পার্কে ঢুকছে ৷ শিরদাঁড়া টান টান করে বসি ৷ কিন্তু সঙ্গে ওটা কে! হ্যাঁ ঠিকই দেখেছি; একটা মেয়ে ৷ শুনেছিলুম বটে বিজু নাকি একটা মাল তুলেছে ৷ খবরটা তাহলে সত্যি ৷ মেয়েটা না কি একটা উকিলের মেয়ে, পাড়ায় নতুন আমদানি ৷ মেয়েটাকে দেখে মাথার মধ্যে রাগটা ফের চড়াক করে ধাক্কা দেয় ৷ বোতল থেকে বেশ বড় একটা চুমুক মারি ৷
বিজু মেয়েটাকে নিয়ে পার্কের শেষ প্রান্তে একটা বেঞ্চের উপর বসেছে ৷ ওদের পিছনে দেবদারু গাছের সারি ৷ কচি কলাপাতা রঙের নতুন পাতায় আলো পড়ে ঝলমল করছে ৷ বিজু আজ খুব ফ্যাশান মেরে জিন্স আর গেঞ্জি পরেছে ৷ হাতে পয়সা এসেছে, এখন মাঞ্জা তো দেবেই ৷ দাঁড়া শালা, তোর ফ্যাশান ফুটিয়ে দিচ্ছি ৷ কিন্তু মেয়েটা জুটে তো মহা ফ্যাসাদ হল দেখছি! শালা হল্লা মচালেই কেস কেলো হয়ে যাবে ৷ যাকগে, ফার্স্ট চেষ্টা করব মেয়েটাকে ভাগিয়ে দিতে, গড়বড় করলে দুটোকেই ঝেড়ে দেব ৷