চুপ করলেন স্টেফানিয়া। আর মিথ্যে বলতে চান না। একটা ঢাকতে দশটা বলতে হচ্ছে। দিক এরা, যা শাস্তি দেয় দিক।
রুদ্রাণী বলল, ”আমি জানি ম্যাম। সেটা আইনের উপরেই ছেড়ে দিন।”
হন্তারক – উল্লাস মল্লিক
আজ বিজুকে মার্ডার করব ৷ তারপর ওর মুণ্ডুটা ছিঁড়ে লম্বা একটা হাই কিক মেরে পাঠিয়ে দেব পার্কের ওদিকে ৷
আমার পকেটে ন’ইঞ্চি ফলার একটা ছুরি ৷ কোমরে গোঁজা ওয়ান শটার ৷ আগে কোনোদিন মেশিন চালাইনি ৷ ক্ষুর-টুর দু-একবার চালিয়েছি বটে, কিন্তু মেশিন এই প্রথম ৷ বিজুকে দিয়েই বউনি হবে ৷ ফার্স্ট বুকে নল ঠেকিয়ে দানা ভরে দেব ৷ দানা খেয়ে ওর চোখমুখ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাবে, বুক ধরে ঝুঁকে পড়বে সামনে; তখন চকচকে ফলাটা পেটে ঢুকিয়ে এদিক থেকে ওদিকে টেনে দেব একবার ৷
পার্কের এই কোণে ক’টা ঝাঁকড়া ঝাউগাছ ৷ সামনে পোস্টের মাথায় একটা বাল্ব ঝুলছিল ৷ একটু আগেই ইট মেরে সেটার গতি করে দিয়েছি ৷ ফলে জায়গাটা অন্ধকার গুহার মতো ৷ সন্ধে থেকে সেই গুহার মধ্যে পজিশন নিয়ে বসে আছি ৷ সঙ্গে একটা ডাবল এক্সের নিপ আর কাগজে মোড়া চানাচুর ৷ চন্নোমেত্ত খাওয়ার মতো অল্প অল্প চুমুক দিচ্ছি ৷ নেশা লেগে গেলে চলবে না ৷ খুব বিউটিফুল একটা হাওয়া দিচ্ছে ৷ এইরকম হাওয়ায় চড়ে যাওয়ার চান্স থাকে ৷ আজ কিন্তু হাত পা মাথা ঠিক রাখা খুব দরকার ৷
সামনে একটা ফাঁকা ঘাস-জমি ৷ বাচ্চারা খেলে খেলে টাক ফেলে দিয়েছে ৷ শেষ প্রান্তে দুটো স্লিপ আর দোলনা ৷ ধারে ধারে ক’টা সিমেন্টের বেঞ্চ ধৈর্য ধরে ওয়েট করছে ৷ বাতিকগ্রস্ত কয়েকটা বুড়ো হাঁটাহাঁটি করছে ফাঁকা জমিটায় ৷ ওদের কেটে পড়ার সময় হয়ে গিয়েছে ৷ একটা, দুটো করে হাজির হচ্ছে রাধাকেষ্টর দল ৷ এরপর পার্কটা ওদের আন্ডারে চলে যাবে ৷ মোটামুটি শান্তিপূর্ণ বখরা ৷ বিকেলটা বাচ্চা আর মায়েদের, সন্ধেটা বুড়ো-বুড়িদের, সন্ধের পর থেকে রাত আটটা-সাড়ে আটটা পর্যন্ত কুঞ্জবন ৷ তারপর রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জুড়ে বসে আমার মতো কিছু হরিপদ মাল ৷ জলটল খায়, গাঁজা টানে ৷
আমাদের এই ছন্নছাড়া এলাকায় পার্কটা ঝি-এর নাকে হিরের নাকছাবির মতো ৷ অনেকদিন ভেস্টেড হয়ে পড়ে ছিল জমিটা ৷ বনতুলসী, গাবজ্যারেন্ডা আর কুলেকাঁটার জঙ্গল ৷ সেকেন্ড ব্রিজটা হতে কলকাতা শহর হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল আর সঙ্গদোষে বখে গেল আমাদের এলাকাটা ৷ বড় বড় বাড়ি উঠল আর ফ্যামিলিগুলো সব ছোট ছোট হয়ে গেল ৷ ঘরে ঘরে ঢুকে গেল হট ছবি আর কোল্ড ড্রিংক্স ৷ ফিরিওলার মতো চার পাশে ছোঁক ছোঁক করে প্রোমোটারের দল ৷ সবুজ মাঠগুলোয় এখন ঝকঝকে ফ্ল্যাটবাড়ি ৷ পাড়ার কয়েকপিস মাথা একটা মালদার প্রোমোটারকে ধরে এই পার্কটা বাগিয়ে নিয়েছে ৷
একটা ছেলে আমার সামনে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে ৷ এগুলো ফেকু পার্টি, এই সময় জোটে ৷ বেঞ্চে কোনো জোড়ের পাশে বসে উদাস মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে কিংবা বারবার ওদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায় ৷ ভাবখানা এই, যেন হাওয়া খাচ্ছে ৷ বিজুও এই দলে ৷ শালা ভদ্দরলোক ৷ মাল খাই না, গাঁজা টানি না, কিন্তু কেউ প্রেম করলে লুকিয়ে কথা শুনি ৷ আমরা মালখোর, আমাদের মন পরিষ্কার ৷ কাউকে ঝাড়ার হলে সামনা সামনি ঝাড়ব ৷ আর বিজু হারামির বাচ্চা পিছন থেকে বাম্বু গুঁজবে ৷
আমার পিছন দিকে কিছুটা রেলিং কেউ হাওয়া করে দিয়েছে ৷ সেই ফাঁক গলে একটা কুকুর ঢুকে পড়েছে ৷ আমার সামনে দাঁড়িয়ে ল্যাজ নাড়ছে কুকুরটা ৷ বিজুও মানিকবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে এমনি করে ল্যাজ নাড়ত ৷ আমি দুটো চানাচুর ছুড়ে দিই কুত্তাটার দিকে ৷
মানিকবাবুর মারুতি ভ্যান রোডে ভাড়া খাটে ৷ আমিই চালাতুম গাড়িটা ৷ মানিকবাবু সরল-সিধে আদমি ছিল ৷ হারামির বাচ্চাটা নাগাড়ে চুকলি কেটে বিষিয়ে দিয়েছে ওকে ৷ চাকা এক কিলোমিটার গড়ালে মালিকের সাত টাকা চাই ৷ কেউ পার্টির সঙ্গে বেশি রফা করলে সেটা তার ৷ মালিককে তার হক বুঝিয়ে দিলেই হল ৷ এটাই লাইনের নিয়ম ৷ বিজু শুয়ারটা প্রথম থেকে মানিকবাবুর কান ভারী করত ৷ এ লাইনে কোন শালা দু নম্বরি করে না, বুকে হাত দিয়ে বলুক দেখি৷
বিজুকে অনেকবার সাবধান করে দিয়েছি ৷ তবু শালা কথা শুনল না ৷ মরণ নেহাতই ওর কপালে আছে ৷ সবারই পয়সার দরকার ৷ তোর পেট আছে, আমার নেই? কবজির জোর থাকলে কাজ জুটিয়ে নে ৷ অপরের আহার ছিনিয়ে নিতে গেলে সে থাবা মারবেই ৷
দুটো বুড়ো সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ৷ একজন তেড়ে নিন্দে করছে ছেলের বউয়ের ৷ উল্টো দিক থেকে আসছে একজোড়া লায়লা-মজনু ৷ মেয়েটা মাথা হেঁট করে ওড়নার খুঁট আঙুলে জড়াচ্ছে ৷ ছেলেটা হাত-পা নেড়ে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে মেয়েটাকে ৷ দেখেই বোঝা যায় নতুন তুলেছে ৷ কাছে আসতে দেখি মেয়েটার সাইড ফেসটা অনেকটা চুমকির মতো ৷ চুমকির কথা মনে পড়তেই মাথার মধ্যে রাগটা চড়াক করে ওঠে ৷ বোতল থেকে একসঙ্গে অনেকটা গলায় ঢেলে দিই ৷
চুমকি ছিল আমার শান্তির জায়গা ৷ সারাদিন গাড়ি চালিয়ে, ইঞ্জিনের হিটে শরীর সেঁকে, প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে খিটিমিটি করে সন্ধেবেলা চুমকির কাছে যেতুম ৷ ব্যস, তখন সব কিছু ভ্যানিশ ৷ চুমকির কাছাকাছি থাকলে কী শান্তি! কিন্তু খুব বেশি কাছে যেতে দিত না ও ৷ আসলে হেভি নীতিবাগীশ তো ৷ তা ছাড়া ওকে তো আমার মনের কথাটা জানানোই হয়নি ৷ এই সিচুয়েশনে কোনো মেয়েই বেশি অ্যালাও করবে না ৷ ওরা ইনসিওরেন্সের মতো নিরাপত্তার গ্যারান্টি চায় ৷ চুমকিকে বহুবার বলতে গিয়েও খেই হারিয়ে ফেলেছি ৷ আসল কথাটা জানানো হয়নি ৷ কীভাবে শুরু করব? আমি তোমাকে ভালোবাসি ৷ পেয়ার করি ৷ লাভ করি! নাঃ, হচ্ছে না ৷ যাই বলি না কেন কেমন যেন পাতি হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা৷ শালা, আমার মতো ছেলে, কত লোককে চমকাচ্ছে, কত খিস্তি ছোটাচ্ছে, সে এই সামান্য কথাটা বলতে পারছে না ৷