”তিন—ববের বডিটা লক্ষ করেছেন? বিশেষ করে ওর চোখদুটো। আচমকা তীব্র লাইট কারও চোখে পড়লে আইবলস ওইভাবে বিস্ফারিত হয়। এখানেও আপনি মিথ্যে বলেছেন। আসলে ঘটনা হল, ববের সঙ্গে আপনার ভালোমতোই বচসা হয়। তার প্রমাণ ভাঙা ফুলদানি। ঘরে প্রোব্যাবলি তখন লাইট জ্বলছিল। আপনি—ই সম্ভবত বেডসুইচ অফ করে লাইট নিবিয়ে দেন। বব সম্ভবত আপনার মাথার উপরের সুইচটা অন করতে যায়। আপনি বালিশের নিচ থেকে পাঁচব্যাটারির টর্চটা আচমকাই ওর চোখে মারেন। ববের চোখ বিস্ফারিত হয়। সে চমকে ওঠে। সেই মুহূর্তেই ফায়ার করেছিলেন আপনি। মনে রাখবেন মৃত্যুর পর মানুষের চোখের মণি স্থির হয়ে যায়। এবং সেই অবস্থাতেই থাকে। দু’হাত তফাত থেকে পাঁচব্যাটারির তীব্র আলো আচমকা চোখে না পড়লে কারওর চোখের মণির অবস্থা ওইরকম হয় না ম্যাম। টর্চটা বিছানাতেই পাওয়া গেছে। এবং আনফরচুনেটলি নিভু—নিভু অবস্থায়। ঘটনার আকস্মিকতায় নেবাতেও ভুলে গেছিলেন আপনি। যতই হোক, প্রফেশন্যাল তো নন। তবে হ্যাঁ, এই বয়সেও আপনার অ্যামবিডেক্সটিরিটির প্রশংসাই করতে হয়।”
”তোমার কল্পনাশক্তি আছে বটে। কিন্তু মিস্টার উন্নির কটেজে যে খুন হয়েছে সেটাতে আমাকে জড়াচ্ছ কীভাবে?”
”ঠিক। সে বিষয়েই আসছি।” বেশ আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলল রুদ্রাণী চক্রবর্তী, ”আপনি হয়তো শুনেছেন, অপরাধী যতই চালাক হোক না কেন, কোথাও না কোথাও একটা ভুল সে করে যাবেই। বব ডায়াজ যেমন করেছিল। জিদেক স্মালকির নাড়ি পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে কিনা সেটা নিশ্চিন্ত না হয়েই বেরিয়ে পড়েছিল। বাট, দ্য ফ্যাক্ট ওয়াজ—সে বেরিয়ে যাওয়ার পর কোনওভাবে সামান্য একটু চেতনা এসেছিল স্মালকির। তাতেই হত্যাকারী সম্বন্দে একটা হিন্ট রেখে যায় সে। কী জানেন?—একটা সিক্স—পয়েন্টেড স্টার। নিজের রক্ত দিয়েই মার্বেলের সাদা দেওয়ালে এঁকে দেয় সে। সত্যি বলতে চিহ্নটা প্রথমে আমাদের ভীষণ অদ্ভুত লেগেছিল। কিন্তু জাস্ট একটু আগে আপনিই আমাকে অন্ধকারের মধ্যে আলোর রেখাটা দেখালেন।” পকেট থেকে সেলোফেনে মোড়া নীল তারাটা নিয়ে দেখাল রুদ্রাণী।
”আমার বিশ্বাস, এটা আদৌ আপনার বালিশের নিচে ছিল না। ওটা ববের পকেট থেকেই পড়ে গিয়ে থাকবে। ফিংগারপ্রিন্ট নিলেই সেটা জানা যাবে। সে এসেছিল জিনিসটা আপনাকে ফেরত দিতে। —কেন? সেটা আপনিই ভালো বলতে পারবেন। জিনিসটা যে আপনার আগেই স্বীকার করে ফেলেছেন কিন্তু। নীল রংটা সম্ভবত নতুন। এটা কেন করা হয়েছিল বলবেন ম্যাম? কিংবা কেনই বা বব এটা পকেটে বয়ে বেড়াচ্ছিল?”
স্টেফানিয়া চুপ। বাকশক্তি হারিয়েছেন।
”আরও আছে।” পকেট থেকে ব্রেসলেটটা বের করেছে রুদ্রাণী, ”আমার অনুমান এটিও আপনার। ছ’মাস আগে লোকাল একটি দোকানে অর্ডার দিয়ে জিনিসটি আনিয়েছিলেন আপনি। গতকাল দোকানের মালিক আমায় ফোন করে বলে, একটি অল্পবয়সি ছেলে এটি বিক্রি করতে এসেছিল। সন্দেহ হওয়াতে তারা বলে দেয় হিরেগুলো আসল নয়। ছেলেটি চেঁচামেচি করে ফিরে যায়। —ছেলেটি যে বব তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। একটু আগে এটা ওর পকেট থেকেই পাওয়া গেছে। এবং ওটা যে হারিয়েছে বা চুরি গিয়েছে এমন কথাও এখনও আপনি বলেননি ম্যাম। তবে কি ধরে নেব ওটা আপনি জিদেক স্মালকিকে খুনের পারিশ্রমিক হিসাবে দিয়েছিলেন। এবং বুদ্ধু বব সেটা বিক্রি করতে গিয়ে আরও বোকা বনে যায়। নিডলেস টু সে, সেই জন্যেই মাঝরাতে প্রতিশোধ নিতে আসে এখানে। আমার বিশ্বাস যে অস্ত্রটি এখানে পাওয়া গিয়েছে সেটা দিয়েই সে স্মালকিকে খুন করেছিল। ফরেনসিক রিপোর্টে সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”
থামল রুদ্রাণী। স্টেফানিয়া ধীরে ধীরে বললেন, ”তোমার কোনও কথার উত্তর আমি দেব না। প্রতিবাদও করব না। কেবল একটা কথা বলি, স্টারটা কেন নীল রং করেছিলাম।”
”ম্যাম আপনাকে বলতে হবে না। আমাকেই শেষ করতে দিন। আমার কল্পনাশক্তি কী বলে শুনুন।” রুদ্রাণী শুরু করেছে আবার—’তবে আগে জিদেক স্মালকি নিয়ে একটু বলার আছে। ভাববেন না তার ইতিহাস ঘাঁটিনি আমরা। পোল্যান্ডের ক্রাকো শহরে থাকত সে। হিটলার যখন ইহুদি নিধন যজ্ঞ শুরু করে তখন একাধিক পোলিশ জিউকে সে নাৎসিবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলে। এইভাবে প্রচুর অর্থও সে রোজগার করে। পরে মিত্রশক্তির কাছে হিটলারের পতন হলে সে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। রাষ্ট্রপুঞ্জ তার নামে হুলিয়াও বের করেছিল। অস্ট্রিয়ায় নাম ভাঁড়িয়ে থাকাকালীন ধরাও পড়ে সে। কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবে শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়ে যায়। আমার কল্পনাশক্তি বলছে, আপনি নিজেও সম্ভবত এই লোকটির শিকার হয়েছিলেন। স্টারটিকে নীল রং করার কারণ লোকটিকে তার দুষ্কর্মের কথা স্মরণ করানো। সেসময় পোলিশ ইহুদিদের নীল রঙের তারা ঝুলিয়ে রাস্তায় বেরোতে হত। —আশা করি, ঠিক বলছি ম্যাম?’
স্টেফানিয়া কিছু শুনতে পাচ্ছিলেন না। তিনি বিড়বিড় করছিলেন, ”তখন আমার মাত্রই চোদ্দো বছর বয়স। ১৯৪৩ সাল। জিদেক আমাদের পরিবারের সকলের বন্ধু ছিল। সবাই ভালোবাসতাম ওকে। বাবার কাঠের দোকানেই সে কাজ করত। কিন্তু ভেড়ার ছদ্মবেশে সে যে একটি নেকড়ে ছিল, কে জানত! এস—এস আর্মি আর ব্লু—শার্টের দল যখন ক্রাকো শহরে ইহুদি ধরা শুরু করল, তখন আমরা পালাচ্ছিলাম। জিদেক—ই পথ দেখাচ্ছিল। কিন্তু ওর ভিতরের শয়তানটাকে চিনতে পারিনি। শহর থেকে দূরে একটা গোলাবাড়িতে আমাদের রেখে সে চলে যায় খাবার আনতে। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে এস—এস আর্মির কুত্তাগুলোকে নিয়ে। প্রথমে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ধরে নিয়ে চালান করে দেয় ওরা। রেখে দেয় মা আর আমাকে। তারপর শুরু হয় পাশবিক অত্যাচার। ভাবতে বমি পায়, জিদেকও ছিল সেই দলে। একসপ্তাহ ধরে লাগাতার অত্যাচারের পর আমাদের ঠাঁই হয় সব্যিবরের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। মা সেখানেই মারা যান। আমি কইমাছের প্রাণ নিয়ে কীভাবে যেন বেঁচে যাই। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনে কখনও সেই নরকের কীটের দেখা পেলে এই চরম অমানুষিকতার প্রতিশোধ নেব। মিস্টার উন্নিকৃষ্ণন আমার কাছে আসেন মাঝে—মধ্যে। যেদিন জানতে পারি কুত্তাটা ওঁরই কটেজে গেস্ট হয়ে উঠেছে, নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। প্রতিহিংসার আগুনে ছটফট করেছি। শরীরে সামর্থ্য থাকলে কাজটা আমিই করতাম।—তবে বিশ্বাস করো, ববকে আমি মারতে চাইনি। সে আমাকে ভুল বুঝেছিল।”