”ইয়েজ। এখন মনে হচ্ছে, আমি চিনি ওকে। —বব। বব ডায়াজ। হোয়াট অ্যান আয়রনি! আমারই চা—বাগানে কাজ করত!” ধীরে ধীরে বললেন স্টেফানিয়া। ছেলেটাকে চেনেন না বলাটা ডাহা মিথ্যে হয়ে যাবে। আরও কিছু বলতেন, হঠাৎই জিনিসটা চোখে পড়ল তাঁর। খাটের পায়ার কাছে পড়ে আছে সেই তারাটা। নীল পেইন্টটা নিজেই লাগিয়েছিলেন। হতভাগা পরশু ফেরত দেয়নি। বলেছিল, বাড়িতে ফেলে এসেছে। কে জানে, কী মতলব ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে সঙ্গেই ছিল। জ্যাকেটের পকেট থেকে বেরিয়ে গিয়ে থাকবে। তিনি এগিয়ে যাচ্ছিলেন তারাটা তুলতে।
”উহু, কোনও জিনিসে হাত দেবেন না।” রুদ্রাণী বলে উঠেছে। চটপট একটা সেলোফিনে তারাটা সাবধানে মুড়ে পকেটস্থ করে ফেলল।
স্টেফানিয়া বললেন, ”কী আশ্চর্য! ওটার সঙ্গে এই ঘটনার কোনও সম্পর্ক নেই। স্টারটা আমার বালিশের নিচেই ছিল। এসব হামলায় পড়ে গিয়ে থাকবে। আপনি হয়তো জানেন না, আমি ইহুদি। দিজ ইজ স্টার অফ ডেভিড। আমাদের ধর্মের প্রতীক।”
রুদ্রাণী যেন শুনলই না। অন্যদিকে মন। পাশে এসে বলল, ”ম্যাম, এই ফুল আপনি কোথায় পেলেন?”
”কোন ফুল?”
”এই তো, মনে হচ্ছে ফ্লাওয়ার ভাসে ছিল।”
”প্লিজ সামনে আসুন। আই হ্যাভ অ্যাকিউট গ্লুকোমা।” বলতে হল স্টেফানিয়াকে। সাইডভিশন অনেকদিন আগেই হারিয়েছেন।
”গ্লুকোমা!—স্যরি ম্যাম, আই ডিডন’ট নো।” বলে রুদ্রাণী সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে সেই নীল ফানেলশেপ ফুলটা। নাম কুরিঞ্জি। অনেকে নীলা কুরিঞ্জিও বলে থাকে। বব এনেছিল কোত্থেকে। কে জানে, উন্নিকৃষ্ণনের বাড়ি থেকেই কিনা! সে নানা উপায়ে ফুলটুল চাষ করে থাকে। মনে হচ্ছে ফুলটা না নেওয়াই উচিত ছিল। রুদ্রাণী যদিও একটু অন্যমনস্ক হঠাৎ। গালে তর্জনি ঠেকিয়ে কী ভাবল একটু। বলল, ”ম্যাম আমি ভেবেছিলাম আপনি পোলিশ। গ্লিনস্কি টাইটেলটা পোলিশ বলে জানতাম।”
”ঠিক—ই। আমরা পোলিশ জিউ। কোনো এক সময়ে আমরা পোল্যান্ডে থাকতাম বটে।”
”আচ্ছা ম্যাম একটা প্রশ্ন—বিছানায় আপনি কোনদিকে মাথা দিয়ে শুয়েছিলেন?” মেয়েটির আচমকা বেখাপ্পা প্রশ্নের শেষ নেই।
”কেন? বালিশ যে দিকে রয়েছে, সেখানেই।” বললেন স্টেফানিয়া। মেয়েটির মনের গতি—প্রকৃতি বুঝতে পারছেন না।
এবার সে বলল, ”চলুন ম্যাম। আমরা পাশের রুমে বসি। কথা আছে। ইটস ভেরি ইম্পট্যান্ট।”
উপরে দুটিই ঘর। পাশেরটি হ্যাজবোল্ট আঁটা ছিল। রুদ্রাণী চক্রবর্তী নিজেই খুলে ভিতরে ঢুকে লাইট জ্বালিয়েছে। এ ঘরটা মূলত স্টাডি। বইপত্রে ঠাসা। দু—তিনটি চেয়ার আর ছোট একটা বিছানা রাখা আছে। স্টেফানিয়া সোজা গিয়ে বিছানায় বসে পড়লেন।
”ম্যাম একটা কথা জানতে চাই, জিদেক স্মালকি নামে কাউকে চেনেন আপনি?” রুদ্রাণী একটা বেতের চেয়ার টেনে বসেছে একদম মুখোমুখি।
প্রশ্নটা আসতে পারে এমন একটা আশঙ্কা ছিলই। এই মেয়েটির বাড়ি কলকাতায়। সর্বভারতীয় পরীক্ষা দিয়ে এসেছে চাকরি নিয়ে। খুব শার্প। আসলে ঘরছাড়া মানুষেরা সবসময়—ই এমন হয়। একটু ভাবলেন স্টেফানিয়া। তারপর মাথা নাড়লেন, ”না তো।”
”আর ইউ সিওর?” মোবাইল বের করে একটা ফোটো সিলেক্ট করে ধরল সে। স্টেফানিয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেখলেন। সেই কুমড়োর মতো মুখ। ঢুলুঢুলু চোখ। গালের বাঁ—দিকে গভীর ক্ষতচিহ্ন। বয়সের ভারে সেটা অনেকটা বুজে এলেও ওটা দেখেই ক্রিস্টমাসের পার্টিতে চিনতে পেরেছিলেন জানোয়ারটাকে। সে কি চিনেছিল? নিশ্চয় না। তাহলে কখন লেজ তুলে পালাত। যা হোক, এখন অবশ্য না—চেনার—ই অভিনয় করতে হবে।
রুদ্রাণী বলল, ”ম্যাম, দিজ ইজ মিস্টার স্মালকি। ইনিই উন্নিকৃষ্ণনের কটেজে পরশু সন্ধেয় খুন হয়েছিলেন। ইনসিডেন্টালি ইনিও পোলিশ। আপনার দেশের লোক।”
”বুঝলাম। কিন্তু এটা জেনে আমি কী করব?”
”কিছুই না। আপনি তো যা করার করেছেন। উননব্বুই বছরের জিদেক স্মালকিকে খুন করার পিছনে বব ডায়াজের তো কোনও মোটিভ থাকতে পারে না, টাকার লোভ ছাড়া। — যে লোভটা আপনিই দেখিয়েছিলেন!”
স্টেফানিয়ার বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল। এমন একটা কিছু আন্দাজ করেছিলেন। সুতরাং নার্ভাস হলেন না। মুখে কোনও বিস্ময় বা ভয়ের রেখাই ফুটল না তাঁর। তিরাশি বছরের দীর্ঘ জীবনের শুরুটাই এমন ছিল যে অ্যাড্রিনালিন গ্রন্থি সিক্রেশন করে করে কবেই শুকিয়ে হেজে গিয়েছে। হাই তুললেন একটা। বালিশ নিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ব্যঙ্গের সুরে বললেন, ”দ্যাখো ভাই, তোমার কমিশনার আমার বন্ধুস্থানীয়। আমাকে শ্রদ্ধা করেন। একজন সিনিয়র সিটিজেনের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, আশা করি জানা আছে তোমার।”
”অবশ্যই ম্যাম। আদারওয়াইজ আপনি এখন থানায় থাকতেন।” গলায় বেশ পুলিশি টোন এনে বলল রুদ্রাণী।
”আপনার বক্তব্যের অসঙ্গতিগুলিই আমি পয়েন্ট—আউট করছি। এক, ফুলদানিতে যে ফুল পাওয়া গেছে, সেটা কুরিঞ্জি। আপনার নিশ্চয় জানা আছে, বারো বছর অন্তর এই ফুল ফোটে এখানে। আমি যতদূর জানি এই মুহূর্তে এ তল্লাটে মিস্টার উন্নিকৃষ্ণনের কটেজেই এই ফুল ফুটেছে। ফুলটা যে ওখানকার—ই সেটা আমরা পরীক্ষা করলেই জানতে পারব। সম্ভবত বব—ই ওটা এনেছে এখানে।”
”দুই, আপনার অ্যাকিউট গ্লুকোমা। যে জন্যে সাইড—ভিশন আপনার নেই বললেই চলে। একটু আগেই তার প্রমাণ পেয়েছি আমি। কথা হল, তাই যদি হয় তবে অন্ধকারে ববের চেস্টের ড্রয়ার হাতড়ান দেখলেন কী করে? চেস্টটা কিন্তু বিছানার একদম ডানদিকের দেওয়ালে।”