টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াল বব। বুকের মধ্যে এরোপ্লেন ছুটছে এবার। বুড়োর তাগদ আছে বটে। তবুও উঠে বসার চেষ্টা করছে। চোখের নীল মণিদুটো থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে। বব আবার চাকু তাক করল। হাত কাঁপছে খুব। চারহাত তফাতেও লোকটার বুকটা নিশানায় ধরতে পারছে না। যা থাকে কপালে, প্রায় আন্দাজেই লাফিয়ে পড়ল সে। লোকটা চিত হয়ে পড়ল এবার। চাকু বুকের বাঁ—দিক ঘেঁষেই গেঁথে গিয়েছে। একটানে তুলে ফেলল সেটা। চাপকলের মতো রক্ত বেরিয়ে আসছে শরীর থেকে। গা ঘুলিয়ে উঠল ববের। মানুষের শরীরে কত রক্ত থাকে মাইরি! জলহস্তী তবুও ঘসটে ঘসটে দেওয়ালের দিকে এগোচ্ছে। পাগলের মতো আর একবার চাকু চালাল বব। মুচড়ে উঠল অতবড় শরীরটা। এতক্ষণে দম শেষ। একটা হাত দেওয়ালে রেখে পুরো পাথর।
চাকু গুটিয়ে পকেটে চালান করল বব। এবার নিজেই দম নিতে পারছে না। সত্যিই একটা মানুষকে খুন করে ফেলল সে! আচমকাই পিছনে প্রবল কাঁপুনি। চমকে উঠেছিল বব। দুঃ শালা! মোবাইল বাজছে। ফোনটা হাতে নিল বব। কী কপাল মাইরি—পদ্মিনী কলিং! ওয়েট হানি। একঘণ্টার মধ্যেই আসছি। লাইনটা কাটল না। নট আনসারড দেখাক। বলবে বাইক চালাচ্ছিল, শুনতে পায়নি। টিভিটা অফ করে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল এবার। দরজার হ্যাজবোল্টটা টেনে দিল বাইরে থেকে। চারিদিক শান্ত নিঝুম। কে বলবে এইমাত্র একটা সাংঘাতিক কাণ্ড হয়ে গেল। দরজা পেরিয়ে কাঠের গেটের মুখে থোকা থোকা নীল ফুলের বেড। উন্নিবুড়ো লাইট দিয়ে ডেকরেট করে রেখেছে। ঢোকার সময় নজর করেনি। এখন পাতাসুদ্ধু কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে ফেলল বব। পদ্মিনী ফুল ভালোবাসে। একঘণ্টার মধ্যেই ফুলটা ওর চুলে গুঁজে দেবে সে।
২
টিভি চালিয়ে বসেছিলেন স্টেফানিয়া। রাত এখন ঠিক বারোটা। গোটা উপত্যকা ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনিই কেবল জেগে আছেন। সারাদিন ধরে একটাই খবর ব্রেকিং নিউজ করে দেখিয়ে যাচ্ছে চ্যানেলগুলো। পরশু সন্ধেবেলায় কে পি উন্নিকৃষ্ণনের প্রাইভেট কটেজে একজন বিদেশি ট্যুরিস্ট মার্ডার হয়েছেন। এমন ঘটনা এ তল্লাটে এই প্রথম। স্বভাবতই পুলিশ সিরিয়াসলি বিষয়টা নিয়ে পড়েছে। রুদ্রাণী চক্রবর্তী নামে একজন মহিলা পুলিশ অফিসারের চার্জে মনে হয় কেসটা। অল্পবয়সি মেয়েটি খুব কেতা নিয়ে বলছিল, এক সপ্তাহের মধ্যে নাকি কালপ্রিটকে ধরে ফেলবে। হাসি পাচ্ছিল স্টেফানিয়ার। পুলিশের দৌড় কদ্দূর ভালোরকম জানা আছে তাঁর। ক্লান্ত হয়ে এইমাত্র চ্যানেল বদলেছেন। লোকাল একটা রোমান্টিক মুভি হচ্ছে। থিম সেই একই। বড়লোকের মেয়ে। ফুটপাথের ছেলে। ভিলেন বাবা। স্নেহশীলা মা। সর্বত্যাগী বন্ধু। ন্যায়পরায়ণ পুলিশ। আর হার্ডকোর ভিলেন। অন্যদিন ফিরেও তাকান না। ঘুম আসছে না বলে একটু আগে ওটাতেই স্থির হয়েছেন। ভাষার অসুবিধা নেই। বিদেশি হলেও মালয়ালাম ভাষাটা আয়ত্ব করেছেন বহুকাল আগে। চল্লিশ বছরের উপর এ দেশে আছেন। এসেছিলেন নান হয়ে। কনভেন্টে পড়াতেন। মনে অন্য জিদ ছিল। ক্রমে কনভেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে এতবড় বিজনেস দাঁড় করিয়েছেন। চা—বাগান। রেস্তোরাঁ, পার্লার। কী না! এবং পুরোটাই নিজের পায়ে। একলা হাতে। স্টেফিম্যাম বলতে মুন্নারের সবাই চেনে তাঁকে। এখন অবশ্য সব গুটিয়ে নিচ্ছেন ধীরে ধীরে। বিয়ে করেননি। স্থানীয় একটি ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলেন। সে এখন পূর্ণ যুবক। বিদেশের পাঠ শেষ করে কয়েকদিনের মধ্যেই দেশে ফেরার কথা।
ধপ করে একটা শব্দ হল কাছেই। কেউ যেন ব্যালকনিতে লাফিয়ে পড়ল। বালিশের নিচে রাখা পিস্তলে হাত রাখলেন স্টেফানিয়া। টর্চও আছে সঙ্গে। সেটাও নিলেন অন্যহাতে। কে জানে, মনটা কু ডাকছে খুব। আসলে বাঘ একবার রক্তের স্বাদ পেয়ে গেলে মুশকিল।
দুড়ুম করে খুলে গেল দরজাটা। পিস্তল রেখে মাথার উপরের সুইচ বোর্ড টিপে পরপর সবক’টা লাইট জ্বালিয়ে দিলেন স্টেফানিয়া। নরম আলোতে ভরে গেল গোটা ঘর। প্রথমে আগন্তুকের মুখটা স্পষ্ট হচ্ছিল না। পায়ে পায়ে হেঁটে মুখোমুখি দাঁড়াতে দেখতে পেলেন এবার। বাঘ না হলেও বাঘের বাচ্চচা তো বটেই। বব ডায়াজ। রবার্টের ছেলে। লোকটা স্মাগলিং করত। স্টেফানিয়া সোজা পথে এনেছিলেন। গতবছর হঠাৎই কী একটা জ্বরে ভুগে চলে গেল। ছেলেটা খুব ন্যাওটা ছিল তাঁর। ম্যাম বলতে অজ্ঞান। লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুই হল না। রক্তের দোষ আর কি।
”ম্যাম, কাজটা ঠিক করলেন না আপনি!” ধমকের স্বরে বলল বব।
”এতরাতে এভাবে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকেছ এই কথাটা বলতে?” পাল্টা ধমক দিলেন স্টেফানিয়া।
”মালটা ফেক। সব কাচ।” ব্রেসলেটটা জ্যাকেটের পকেট থেকে তুলে ধরে দেখাল বব। জিনিসটা পরশু সকালে নিজে হাতে দিয়েছিলেন ছেলেটিকে। বলেছিলেন, তোর গার্লফ্রেন্ডকে দিস। হতভাগা নিশ্চয় বিক্রি করতে গিয়েছিল। কিন্তু একলাখ পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে কেনা জিনিসটা নকল নাকি! সত্যি দেশ বটে এই ভারতবর্ষ! এখানে পয়সা ফেললেও খাঁটি জিনিসটি পাওয়া মুশকিল।
”তুমি ভুল করছ বব। ওটা যদি সত্যিই নকল হয়, সেটা আমিও জানতাম না। তাছাড়া ওটা তোমার বান্ধবীকে দিয়েছি। বিক্রির জন্যে দিইনি। তার জন্যে ভালো অ্যামাউন্টের অ্যাডভ্যান্স পেয়েছ তুমি। পুরোটা পেতে ধৈর্য ধরতে হবে।” ঠান্ডা স্বরে বললেন স্টেফানিয়া। এতক্ষণ ঘুম পাচ্ছিল না। হঠাৎই যেন দু’চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। বুকের বাঁ দিকে টিসটিস ব্যথাটাও সময় বুঝে জানান দিচ্ছে।