‘যদি না আসে?’
সে একটু চুপ করে থেকে বলল—‘তবে আর কোশিশই করব না!’
আমি চুপ করে ওদের ঝুপড়ির দিকেই তাকিয়েছিলাম! কালো ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে আকাশের দিকে উড়ছে! ওই জংলীবাবা কীসব পোড়াচ্ছে কে জানে! যত্তসব ভড়ং! যজ্ঞ, তুকতাকের নামে কত লোকের শেষ সম্বলটুকুও গিলেছে শয়তানটা! আমার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে ৷ ওটাকেও দেখে নেব একদিন ৷ যেদিন আমার সময় আসবে, সেদিন…!
আর কিছু ভাবার আগেই আচমকা মনে হল মাথাটা ঘুরছে! এ কী! … চতুর্দিকটা এভাবে পাক খাচ্ছে কেন? টের পেলাম পায়ের নীচে মাটিটাও আন্দোলন শুরু করেছে! যেন রামদুলারির মতোই প্রসব বেদনা উঠেছে তারও! … চোখের সামনে দেখতে পেলাম গাছগুলো কাঁপছে … কেউ যেন ধরে ঝাঁকাচ্ছে … ঝুপঝাপ করে ঝুপড়িগুলো খসে পড়ছে! … কী সর্বনাশ! ভূমিকম্প!
পড়িমরি করে দৌড়লাম শ্রমিকদের ঝুপড়ি লক্ষ্য করে ৷ পায়ের নীচে মাটি কাঁপছে… মনে হচ্ছে টাল খেয়ে পড়ে যাব … তবু দৌড়লাম … ওদের এখনই সাবধান করে দিতে হবে … বাইরে বেরিয়ে আসতে বলতে হবে! আর রামদুলারি! তার কী অবস্থা কে জানে …! ঝুপড়ির নীচে চাপা পড়েনি তো…!
টলতে টলতে কোনো মতে হাজির হয়েছি বনোয়ারিদের বাড়ির সামনে! বংশী আর সুখিয়া ততক্ষণে কোনোমতে ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে এসেছে যন্ত্রণাকাতর রামদুলারিকে ৷ মেয়েরা মিলে কোনোমতে পরনের শাড়ি, গামছা দিয়ে আড়াল করেছে তাকে ৷ ধাই-মা উপস্থিত! যজ্ঞ লন্ডভন্ড! ঝুপড়িগুলো মৃত সৈনিকের মতো মাটিতে এলিয়ে পড়েছে!…
‘আ গয়ি! আ গ … য়ি!’
এই অবস্থায় একটা উচ্ছ্বসিত, আনন্দ-উদ্বেলিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠি! কী আশ্চর্য! বনোয়ারিলাল অমন উন্মত্তের মতো দু-হাত তুলে নাচছে কেন? ও কি পাগল হয়ে গেল! শোকে দুঃখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে?
‘সীতামাইয়া আ গয়ি মাস্টারজি!’ সে আমাকে আনন্দের চোটে জড়িয়ে ধরেছে—‘কলিকালেও সীতা মাইয়া মাটির বুক চিরে প্রকট হয়েছেন! ওই দেখুন!’
তার অঙ্গুলিনির্দেশ লক্ষ করে যা দেখলাম তাতে মনে হল আদৌ ভূমিকম্পটা মাটিতে হচ্ছে না! আমার শরীরে হচ্ছে! প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম … মনে হল, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না … শুনতে পাচ্ছি না … ! … বংশী আর সুখিয়া স্তম্ভিত, বিহ্বলের মতো সেদিকেই দেখছে … আর আমি …!
ভূমিকম্পের তীব্রতায় উঠোনের মাটি কোথাও ধসে পড়েছে! কোথাও লম্বালম্বি বিরাট চিড় ধরেছে ৷ সেই চিড়ের ফাঁক দিয়েই উদ্ধত প্রশ্নের মতো একটা শিশুহাতের কঙ্কাল উঁকি মারছে! হাতে এখনও আমার দেওয়া রুপোর বালা! শিশুহাতটার তর্জনি নিবদ্ধ বনোয়ারিলালের দিকেই! কী যেন ইঙ্গিত করছে…! তার মানে … ওকে কোনো ভাম বা শেয়াল নেয়নি …!
আমি কোনোমতে বললাম—‘বনোয়ারি! এ—কী!’
বনোয়ারি নাচতে নাচতেই বলল—‘সিয়া মা! ধরতি ফুঁড়ে উঠে এসেছে! আমি জানতাম! আমি জানতাম কলিকাল হলেও আমার সিয়া মা পুনর্জন্ম নিয়ে ধরতীর বুক থেকে ঠিক আসবেনই! এবার তো রামলালা আমার ঘরে আসবেই! সবাই জয়-জয়কার করো ৷ শাঁখ বাজাও! সীতা মাইয়া এসেছেন! রামও আসছেন! জয় সিয়ারাম, জয় জানকি রাঘব, জয় সিয়ারাম…!’
হে রা—ম!
স্টার অফ ডেভিড – রাজেশ বসু
আদিগন্ত সবুজ পাহাড়ের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ উপত্যকা। কোথাও চায়ের খেত। কোথাও বা মশলার। দূর দৃশ্যপটে উঁকি দিচ্ছে আনাইমুদি শৃঙ্গ। অসংখ্য ঝরনার কাটাকুটি গোটা অঞ্চল জুড়ে। এরই মধ্যে নির্জন সবুজের মধ্যে লালটালিওলা একটি বাংলো। সবুজ রং করা কাঠের বেড়ায় ফুটদেড়েকের সাইনবোর্ড—”হেভেন’স অ্যাবোড”। এখনও বিকেলের আলো নিভে আসেনি। বিশ—ত্রিশগজ তফাত থেকেও লেখাটা পড়তে পারল বব। ভালো নাম দিয়েছে বটে উন্নিবুড়ো। হাসি পেল ওর। ওইসব স্বর্গ—নরকের কনসেপ্টে নেই সে। কয়েকঘণ্টা পর ওই নামটাই খোরাক হয়ে যাবে। হেভেন হয়ে যাবে হেল। লালমুখোরা আর আসছে না। কেস খাবে বুড়ো। খাক শালা! দরকার ছিল খুব। সামান্য সরকারি আমলা হয়ে কম তো কামায়নি। এই মুন্নারেই এরকম গোটা তিনেক বাংলো নাবিয়েছে শালা। পোনমুড়িতেও বানাচ্ছে একটা। সেখানেই আছে এখন। কাল ফিরবে। টাকা কামিয়ে আশ মিটছে না বুড়ো শকুনের। কাজটা নিত না বব, উন্নিবুড়ো সিনে আছে জেনে আর না করেনি। তাছাড়া টাকার অঙ্কটা যথেষ্টই বেশি। গোটা একটা চা বাগান কিনে ফেলা যায়।
থুতু ফেলল বব। চারিপাশটা দেখে নিল ভালো করে। ঘর—ফিরতি পাখির দল ছাড়া প্রাণের স্পন্দন নেই কোথাও। এমনিতেই এদিকটা খুব নির্জন। তা—ও আবার বছরের শেষ দিন। তিন ‘ম’ নিয়ে ফুর্তি করার দিন। কয়েকটা বুড়োহাবড়া যা পড়ে আছে ঘরের মধ্যে। দিন গুনছে পরপারে যাওয়ার। এই শীতে টিকে গেলে নেক্সট সিজনের শুরুতেই টসকাবে। একটু চিন্তা করল সে। উন্নিবুড়োর অতিথিটিও এই গোয়ালের। ক’দিন পরে এমনিই পটল তুলত। বেকার সময়টাকে এগিয়ে আনার কী ছিল কে জানে! আসলে সব—ই বিজনেস। উন্নির মুখে কালি লেপতে চান ম্যাম। রাইভ্যাল রাখতে চান না। —সত্যি মাইরি! পাত্তি কী চিজ! বুড়ি থুত্থুড়ি হয়ে মরতে চললি, এখনও মাল্লুর ধান্দা। সাদা চামড়ার জাতটাই আসলে এরকম, লাইফে লেনদেন ছাড়া কিছু বোঝে না। এ দেশেও সেই বীজ বুনে দিচ্ছে।