বনোয়ারি সেদিন অসন্তুষ্ট মুখে চলে গিয়েছিল ৷ সম্ভবত উত্তরটা ওর পছন্দ হয়নি ৷ কিন্তু পিতৃ-মাতৃভক্তির ওষুধটা সত্যিই ধরেছিল ৷ একদিন খবর পেলাম বনোয়ারি বাপ-মাকে নিজের ঘরে এনে তুলেছে ৷ তাদের জোরদার সেবাও করছে!
সেদিন ভেবেছিলাম পরিবর্তনটা সাময়িক ৷ কিন্তু আজ বংশীলালকে মেরে বনোয়ারি প্রমাণ করে দিল—সত্যিই সে বদলে গিয়েছে!
তিন
‘আপনি তো মিরাকল করে দিলেন মশাই!’
ডাক্তারবাবু প্রশংসাসূচক দৃষ্টিতে তাকালেন—‘ওদের অস্ত্রে ওদেরই ঘায়েল করেছেন! রামদুলারিকে বনোয়ারি আর পেটায় না ৷ বংশীও ভাইয়ের ভয়ে সুখিয়ার গায়ে হাতটুকুও তোলে না! অতবড় একটা ট্র্যাজিক ঘটনা হয়ে যাওয়ার পরও সুখিয়াকে বেশি দোষারোপও করেনি! করলেন কীভাবে!’
ঘটনাটা সত্যিই ট্র্যাজিক! বংশীলালের সদ্যোজাত শিশুকন্যাটি দেখতে বড় চমৎকার হয়েছিল ৷ ওদের ঘরে অমন সুন্দর রাজকন্যার মতো মেয়ে জন্মায় না! বংশী আর বনোয়ারির ঝামেলা চুকেবুকে গিয়েছিল সেদিনই ৷ বনোয়ারি ছাড়া পেয়েই আমাকে ওর নতুন ভাইঝির ‘মুখ-দিখাই’ এর জন্য ‘নেওতা’ দিয়ে বসল ৷ প্রথামাফিক দেখতেও গিয়েছিলাম ৷ একজোড়া ছোট ছোট রুপোর বালা দিয়ে শিশুটিকে দেখেওছিলাম ৷ ভারী মায়াবী ৷ সবচেয়ে মায়াবী তার হাসি! বংশী গর্বিত কাকার মতো বলেছিল—‘এই হল আমাদের সীতা মাইয়া—নয়, মাস্টারজি?’
আমি হেসে মাথা নেড়েছিলাম ৷ বনোয়ারি তার সুন্দরী ভাইঝির গর্বে একেবারে কয়েক ইঞ্চি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল! এমনকী কাজ থেকেও তাড়াতাড়ি ফিরত শিশুকন্যাটির জন্য ৷ সবসময়ই হয় তাকে কোলে নিয়ে আদর করছে, নয়তো খেলছে!
কিন্তু একদিন ও বাড়িতে ফের কান্নার রোল উঠল! তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে দেখি, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে! বনোয়ারির অমন সুন্দরী শিশু সীতামাইয়াকে ভামে কিংবা শেয়ালে টেনে নিয়ে গিয়েছে ৷ এ ঘটনা অবশ্য নতুন নয়! ওদের চিরকালীন অভ্যাস গরমকালে বাড়ির বাইরে দাওয়ায় শোওয়া! এর আগেও বহু নবজাতক ভাম বা শিয়ালের হিংস্র লোলুপ দাঁতের শিকার হয়েছে ৷ হতভাগিনী ক্লান্ত মা শিশুকন্যাকে কোলের কাছে রেখে নিশ্ছিদ্র ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল ৷ কখন যে তার সন্তানকে বুক থেকে টেনে নিয়ে গিয়েছে সুযোগসন্ধানী জানোয়ারগুলো, টেরই পায়নি ৷
ওদের বাড়ি গিয়ে দেখি সে এক সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড! বংশী সুখিয়াকে যা নয় তাই বলে দোষারোপ করছে ৷ তার অবস্থা দেখে মনে হয় শোকের চেয়েও রাগ বেশি! তেলে পড়বে কি জলে পড়বে বুঝতে পারছে না!
আমি পৌঁছতেই গালিগালাজগুলোকে গিলে নিল বংশী ৷ সুখিয়া বেচারি শুধু কেঁদেই চলেছে ৷ ওর অবস্থা দেখে রাগ হল ৷ বললাম— ‘ওর কী দোষ? তুমিও তো বাপু পাশে ছিলে! তুমি টের পেয়েছ? না, মেয়ের দায়িত্ব একা মায়েরই?’
চুপ করে ভর্ৎসনাটা হজম করল ও ৷ মাথা হেঁট করে আমার কথাই মেনে নিল ৷ জোরালো গলায় বললাম—‘খালি কান্নাকাটি-গালিগালাজ করলেই চলবে? মেয়েটার খোঁজ করবে না? হয়তো এখনও জন্তুটা বেশি দূর যেতে পারেনি ৷ হয়তো এখনও আশা আছে…!’
আশা ছিল না! অনেক খোঁজাখুঁজির পর শুধু মেয়েটির পরনের ছোট্ট জামাটা মিলল ৷ তা ও ছেঁড়াখোঁড়া! সুখিয়া তিনদিন শুধু বুক ভাসিয়ে কাঁদল ৷ বনোয়ারি গুম হয়ে বসে রইল ৷ বংশী কয়েকদিন কাজে গেল না ৷ আসন্নপ্রসবা রামদুলারি ভারী শরীরটা নিয়ে শুকনো মুখে গোটা ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে রইল ৷ তার অনাগত সন্তানের অমঙ্গল আশঙ্কায় হয়তো কাঁদতেও পারল না!
তারপর আবার সব স্বাভাবিক! গরিবের ঘরে শোক বেশিদিন থাকে না ৷ বিশেষ করে যখন একটির মৃত্যুর শোক ভোলাবার জন্য ঘরে আরও তিনটি মজুত রয়েছে তখন দুঃখের ঠাঁই বেশিক্ষণ হয় না ৷ সুখিয়া চোখের জল মুছে কাজে লাগল ৷ বংশীও ফের কয়লাচুরির কাজে নেমে পড়ল ৷ ধাক্কাটা শুধু সামলাতে পারেনি বনোয়ারি ৷ তার হাবভাব এরপর থেকেই কেমন অস্বাভাবিক হয়ে গেল! বেশি কথা বলে না ৷ চুপচাপ বসে থাকে ৷ সারাদিন ধরে কী যে ভাবে ভগবানই জানে! জিজ্ঞাসা করলে শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে!
‘যে ভাবে এগোচ্ছেন, তাতে আপনার স্কুল হয়তো শীগগিরই ছাত্র-ছাত্রীতে ভরে উঠবে’ ৷ ডাক্তারবাবু বললেন—‘আপনাকে ওরা সবাই খুব মান্য করে ৷ পারলে আপনিই পারবেন ৷ অন্তত একটা লোককে তো কুসংস্কারের কবল থেকে টেনে বের করেছেন! আজ একজন বেরিয়েছে, কাল আরও দুজন বেরোবে ৷ এইভাবেই তো হয়…!’
বুকের কয়েক ইঞ্চি ফুলে উঠল ৷ অনেক সময় মানুষের ধারণা হয়, সে আসলে সাধারণ মানুষ নয়—যুগন্ধর! আমারও হঠাৎ তাই মনে হয়েছিল ৷ মনে হয়েছিল, এটা আসলে নিয়তি! আমি ওদের অন্ধত্ব দূরীকরণের জন্যই আসলে এসেছি! রামমোহন, বিদ্যাসাগর না হলেও আমি ছোটখাটো এক সমাজ সংস্কারক!
আত্মশ্লাঘা কখনওই স্বাস্থ্যকর জিনিস নয় ৷ কিন্তু তা সত্বেও একটু গর্বিত বোধ না করে পারলাম না ৷ অন্তত বনোয়ারিকে তো আলোয় টেনে আনতে পেরেছি ৷ যদিও পুরোপুরি নয় ৷ কারণ তিনবারের পরও তার শিক্ষা হয়নি ৷ রামদুলারির এখন-তখন অবস্থা ৷ যে-কোনো সময়ই চলে আসতে পারে নবজাতক ৷ এই পরিস্থিতিতে সে আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে জংলিবাবাকে দিয়ে ফের যজ্ঞ করাচ্ছে! আমি আপত্তি করেছিলাম ৷ সে শোনেনি ৷ বলেছে— ‘এইবার শেষ! এবার রামললা আসবেই!’