বনোয়ারি অবশ্য এল ৷ কিন্তু দলবল নিয়ে নয় ৷ একদিন ভোররাতে দরজায় জোরালো নকের আওয়াজ শুনে লাফিয়ে উঠলাম ৷ পোক্ত লাঠিটা বিছানার পাশেই ছিল ৷ শক্ত করে চেপে ধরে বলি— ‘কে?’
উলটো দিক থেকে ভেজা ভেজা গলার স্বর ভেসে এল—‘মাস্টারজি, আমি বনোয়ারি!’
নামটা শুনেই আমার হাতের মুঠো আরও শক্ত করে লাঠিটাকে চেপে ধরল—‘কী চাও’?
‘থোড়া বাতচিৎ করতে চাই মাস্টারজি’ ৷
কথা বলার সুরটা অবশ্য যথেষ্টই নরম ছিল ৷ তবু সন্দিগ্ধ স্বরে বলি—‘বাতচিৎ করতে এসেছ, না দলবল নিয়ে মারপিট করতে?’
অন্যপ্রান্ত থেকে বনোয়ারির বিব্রত কণ্ঠস্বর শোনা গেল—‘রামললা’-র কীরে বাবু ৷ স্রেফ কয়েকটা কথা বলতে এসেছি ৷ আমি একা ৷ আর কেউ নেই!’
কথা শুনে মনে হল সত্যি কথাই বলছে ৷ তবু সাবধানের মার নেই ৷ একহাতে লাঠি বাগিয়ে ধরে অন্যহাতে হুড়কো খুলে দিলাম!
তারপর যা ঘটল, তা অবিশ্বাস্য! বনোয়ারি কথা নেই বার্তা নেই, হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠে আমার দু-পা জড়িয়ে ধরল! কান্নাবিকৃত স্বরে বলল—‘আপনি ঠিকই বলেছিলেন হুজুর! আমি পাপী! না বুঝে অনেক পাপ করেছি ৷ সিয়া-মা’র জাতকে দূরছাই করেছি! তাই রামলালা আমার কাছে আসছেন না! জংলিবাবাও বলল—আগে সিয়া, পরে রাম! সীতা না এলে রাম আসে না! যেখানে সীতা-মাইয়া নেই, সেখানে রামজি থাকবেন কী ভাবে?’
মনে হল বোধহয় সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’ গল্পের মতো আমারও নাম কেউ ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ রেখে দিয়েছে, অথবা ও ফরাসি ভাষায় কথা বলছে! ঘটনা যে এমন ট্র্যাপিজের খেলের মতো ডিগবাজি খাবে স্বপ্নেও ভাবিনি ৷ কোনমতে প্রাণপণে পা ছাড়িয়ে নিয়ে বলি—‘আরে ঠিক আছে……ঠিক আছে ৷’
‘না মাস্টারজি!’ সে নাছোড়বান্দা ৷ ফের পা জড়িয়ে ধরেছে— ‘ওই লাঠিটা আপনি আমার পিঠে ভাঙুন! আমি পাপী৷ মহাপাপী! আমি সীতা-মা কে অবহেলা করেছি ৷ রামললাও তাই গুসসা করে আমার ঘরে আসছেন না! মারুন মাস্টারজি!’
.
শুরু হয়েছিল মারপিট দিয়ে ৷ কিন্তু কিছুদিন গড়াতে না গড়াতেই বন্ধুত্ব জমে গেল ৷ বনোয়ারিলাল নিয়ম করে বিকেলবেলায় নানারকম ‘ভাজি-পুরী’ নিয়ে এসে হাজির হত ৷ অনেক বারণ করেছিলাম ৷ ও শোনেনি ৷ রোজ এসে ঘণ্টা- দেড় ঘণ্টা ধরে গল্প করত, সুখ-দুঃখের কথা বলত ৷ ওর বৃদ্ধ-বাপ মা এখনও বেঁচে আছেন ৷ কিন্তু বংশী বা বনোয়ারি, কেউই ওদের দেখে না ৷ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এই গ্রামেই ওর বোন আর বেহনোই-এর সঙ্গে থাকেন ৷ বংশী আর বনোয়ারির একটাই দুঃখ ৷ মা ষষ্ঠীর কৃপায় বংশীর চার সন্তান ৷ আর বনোয়ারির তিন ৷ কিন্তু কারোরই পুত্রসন্তান নেই ৷ সবই কন্যাসন্তান ৷
‘মাস্টারজি, বেটা না থাকলে যে নরকেও ঠাঁই হবে না!’ অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে জানিয়েছিল বনোয়ারি—‘ছেলের হাতের জল না পেলে যে আত্মার শান্তিও হবে না! লড়কি তো সুখের পায়রা ৷ আজ এখানে বকম বকম করছে, অন্য বাড়িতে দানাপানি পেলে সেখানেই উড়ে চলে যাবে ৷ বুড়ো বয়েসে তবে দেখবে কে?’
ভয়ংকর হাসি পেল ৷ কোনোমতে হাসি চেপে বললাম—‘তাই? তা তোর বাপ-মায়ের তো দু-দুটো বেটা! বুড়ো বয়েসে ওদের কে দেখছে? বেটা না বেটি?’
বনোয়ারি একটু থমকাল ৷ কী বুঝল কে জানে! কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে তারপর বলল—‘কিন্তু বেটার হাতের জল না পেলে যে স্বর্গ নসিব হয় না! পরজন্মে মানবজন্মও মেলে না!’
মৃদু হেসে জানাই—‘ভাই, আমি শুধু এইটুকু জানি যে এ জন্মে যদি বেঁচে থাকতে ভাত-জল, সন্তানের আদর-যত্ন না পাই, তো মরার পরে ওই মশা মারার ধূপ আর পিণ্ড দিয়ে আমার কাঁচকলা হবে! না খেতে পেয়েই যদি মরি, তবে যম শিং নিয়ে তাড়া করুক, কি মেনকা সামনে এসে ধেইধেই করে নৃত্যই করুক—কী আসে যায়! তোদের রামললাও তো শুধু বাপের এক কথায় বনবাসে চলে গিয়েছিলেন ৷ বাপ-মাকে কতটা ভক্তি করলে এমন করা যায় ভাব তো!’
সে চুপ করে আমার কথা শুনছিল ৷ বুঝলাম ওষুধ ধরছে! ওরা যে ভাষা, যে জাতীয় যুক্তি বোঝে— সেই যুক্তি দিয়েই গজচক্র করতে হবে ব্যাটাকে! বললাম — ‘তাছাড়া রামললা আসবেই বা কেন? তোরা সব নিরক্ষর! রামজির বাপ-মা কত শিক্ষিত ছিলেন জানিস? ভগবান রামজি নিজেও কত শিক্ষিত ছিলেন ৷ সব বিদ্যা জানতেন! তোদের ঘরে এলে তো বেচারিকে ক অক্ষর গোমাংস হয়েই থাকতে হবে! হয় কারোর খেতে কাজ করতে হবে, নয়তো কয়লাচুরি করতে পাঠাবি ৷ কোনো দেব-দেবী এসব করে?’
বনোয়ারি কী বুঝল কে জানে! কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফের আস্তে আস্তে বলল — ‘সও টাকা কি বাত, মাস্টারজি ৷ কথা দিচ্ছি বেটা ঘরে এলে তাকে আমাদের মতো ‘আনপড়, গওঁয়ার’ বানাব না! আপনার সকুলেই পড়াব ছেলেকে! অনেকগুলো পাশ দেওয়াব…!’
এরপরও ও অনেকবার আমার কাছে এসেছে ৷ দেখলাম, রামকে ছেড়ে ও এখন সীতাকে নিয়ে পড়েছে ৷ সীতা-মাইয়াকে নিয়ে ওর অপরিসীম কৌতূহল ৷ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সীতার জন্মবৃত্তান্ত জানল ৷ তারপর কী যেন ভেবে বলল—‘আচ্ছা মাস্টারজি, সীতা মাইয়া তো তবে ধরতী মায়ের পুত্রী ৷ মিট্টিতে জন্ম ৷ তবে তিনি কোনো ঔরতের পেট থেকে আসবেন কী করে?’
ওর প্রশ্নটা শুনে চমৎকৃত হয়েছিলাম ৷ একটা অশিক্ষিত, মজুর মানুষের মাথায়ও এমন প্রশ্ন আসে! সীতার জন্ম যে মনুষ্য-যোনি থেকে হয়নি, হতে পারে না, তা একদম ঠিকঠাক বুঝে গিয়েছে ৷ আমি মৃদু হেসে বলি—‘এটা কলিকাল বনোয়ারি ৷ এখন আর সীতা মাটি ভেদ করে আসেন না! আগে যজ্ঞ করে রাজরাজড়ারা ছেলে-মেয়ে পেতেন ৷ এখন হয়? তুইও তো তিন-তিনবার ঘর বাঁধা দিয়ে, রামদুলারির গয়না বেচে জংলিবাবাকে দিয়ে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করালি ৷ হল?’