রামদুলারির দিকে তাকালাম ৷ ওর চোখে জল ৷ দু হাত জোড় করে অসহায় মিনতিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ৷ দেখেই বুঝলাম, মেয়েটি এই প্রথম মার খাচ্ছে না ৷ আগের মারের দাগগুলো এখনও তার মুখ থেকে অবলুপ্ত হয়নি ৷
আমার মাথার ভেতরটা দপ করে জ্বলে উঠল ৷ বললাম— ‘লজ্জা করে না! নিজের বউকে এমন অমানুষের মতো পেটাচ্ছ! তোমাকে আমি পুলিশে দেব ৷’
‘পুলিশ!’ বনোয়ারি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে— ‘কী অপরাধ করেছি আমি?’
‘স্ত্রীকে পেটানো আইনত অপরাধ ৷’ দাঁতে দাঁত পিষে বললাম— ‘এই অপরাধে তোমার জেলযাত্রা কেউ আটকাতে পারবে না! এটা ভারতীয় কানুন ৷’
‘ছ্যাঃ’ বনোয়ারি হাতের বাঁশটা ফেলে দিয়ে বলল— ‘আপনিও দেখছি আগের ‘‘নাকচড়ি’’ মাস্টারনিটার মতো কথা বলছেন! আমি পাপ করেছি? ওই শালিকে জিজ্ঞাসা করুন— ও কী করেছে? তিন বছর ধরে আমার ঘরে ‘‘লড়কি’’ পয়দা করছে!’
‘লড়কি পয়দা করেছে তো কী? মেয়েরা মানুষ নয়?’
‘ওসব আমি জানি না ৷’ তেড়িয়া ভঙ্গিতে জানায় সে— ‘জংলিবাবা বলেছে আমার ঘরে ‘‘রামললা’’র অবতার আসবে ৷ রামললা জংলিবাবার স্বপ্নে দেখা দিয়ে জানিয়েছেন যে তিনি আমার ঘরে আসবেন! আমার কিসমত চমকাবে ৷ তার জন্য ঘরে যা ছিল সব বেচেবুচে প্রতিবছর ছেলের জন্য যজ্ঞ করাচ্ছি জংলিবাবাকে দিয়ে! আর এই ‘‘করমজলি’’ খালি লড়কির পর লড়কিই পয়দা করেছে ৷ এটা পাপ নয়?’
বলতে বলতেই সে ফের তেড়ে গেল মেয়েটির দিকে— ‘শালি, মেরেই ফেলব আজ তোকে!’
রামদুলারি ভয়ে চিৎকার করে ওঠে ৷ আমার মাথাতেও খুন চেপে গেল! এতদিন ধরে কুসংস্কারের সঙ্গে লড়তে লড়তে আমারও ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল ৷ অন্ধত্বেরও একটা সীমা আছে ৷ সপাটে এক ঘুঁষি বসিয়ে দিলাম ওর মুখে ৷ বক্সারের ঘুঁষি! সামলাতে না পেরে পড়ে গেল বনোয়ারি!
‘তোর জংলিবাবার এইসি কি তেইসি! যজ্ঞ করলে ঘরে রাম আসবে?’ রাগে অন্ধ হয়ে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে গিয়েছিল ৷ কী বলছি, কী করছি খেয়াল ছিল না ৷ আঙুল তুলে বললাম—‘জীবনেও আসবে না! কারণ রাম নারায়ণের অংশ! আর নারায়ণ লক্ষ্মীকে ছাড়া কখনও একা আসেন না! লক্ষ্মীর অংশ হলেন রাধা, সীতা ৷ মেয়ে নন ওঁরা? তোরা যখন রামনাম করিস, তখন কার নাম আগে বলিস? যখন ডাকাডাকি করিস তখন সীতা-রাম, রাধে-শাম বলিস, আর এটাও বুঝিস না রাম বলার আগে সীতার নাম আসে? শামের আগে রাধা? কাউকে আজ পর্যন্ত রাম-সীতা বলতে শুনেছিস, রাঘব-জানকী বলতে শুনেছিস? সবসময় সীতা রামের আগে থাকে, জানকী-রাঘব বলা হয় ৷ শামের আগে রাধা, নারায়ণের আগে লক্ষ্মী! আর ‘‘লড়কি’’ লক্ষ্মীর অংশ হয় শুয়োরের বাচ্চা! যেখানে লক্ষ্মীর এমন হেলাফেলা, যেখানে সীতার জাতের ‘‘মোল’’, ‘‘ইজ্জত’’ নেই— সেখানে রাম কোনোদিন আসে না! আসবেও না! আর রইল তোর জংলিবাবা? তাকেও দেখে নেব আমি!’
কথাগুলো ছুড়ে দিয়েই হনহন করে চলে এসেছিলাম ৷ এরকম নাটকীয় ভাষণ আগে কখনও দিইনি ৷ রক্তারক্তি কাণ্ডও হয়ে যেতে পারত! কিন্তু আসার আগে দেখেছিলাম বনোয়ারি কেমন যেন হতবাক হয়ে বসে আছে ৷ পালটা মার দেওয়া তো দূর, সে যেন একেবারে শক্তিহীন হয়ে মূঢ়ের মতো এলিয়ে পড়েছে উঠোনে!
এই ঘটনা রাষ্ট্র হতে বেশি সময় নেয়নি ৷ দাবানলের মতো খবরটা ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে ৷ হেডমাস্টারমশাই এবং ডাক্তারবাবু আশঙ্কা প্রকাশ করলেন ৷ বললেন— ‘সর্বনাশ! সত্যিই কি আপনি জংলিবাবার বিরুদ্ধে স্টেপ নেবেন?’
আমার গরম রক্ত তখন টগবগিয়ে ফুটছে—‘নিশ্চয়ই ৷ ওই ভণ্ডবাবাই হল সব নষ্টের গোড়া! ওকে তো আমি…’ ৷
হেডমাস্টারমশাই সভয়ে বললেন—‘ওসব করার কথা মনেও আনবেন না ৷ ওই জংলিবাবা ডেঞ্জারাস লোক ৷ আপনার আগে যে দুজন টিচার এসেছিল, তারাও ওই লোকটার এগেনস্টে স্টেপ নিতে চেয়েছিল ৷ অমনি গ্রামবাসীদের জংলিবাবা বোঝালেন যে ওরা নাকি শয়তানের দূত! ওদের পুড়িয়ে মারলে স্বর্গের দরজা খুলে যাবে ৷ অনেক পুণ্য হবে ৷ ব্যস, গ্রামবাসীরা একদিন রাতে এসে ওদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল!’
শুনতে শুনতে রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল ৷ শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলি—‘তারপর?’
ভদ্রলোক হাসলেন—‘দুজনেরই বরাত ভালো ছিল ৷ কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে বাড়ির বাইরে চলে আসতে পেরেছিলেন ৷ তারপরই কালক্ষেপ না করে সিধা চম্পট! আপনাদের কলকাতা অফিস এই ঘটনা জানে ৷ সেইজন্যই প্রথম দিন জানতে চাইছিলাম—কবে পালাচ্ছেন?’
এবার পুরো ছবিটা পরিষ্কার হল ৷ সম্ভবত আমার অন্য কোলিগরা এই ঘটনা জানে বলেই কেউ আসতে রাজি হয়নি ৷ যেহেতু আমি তখন নতুন জয়েন করেছি, কিছু জানতাম না, তাই বাড় খেয়ে শহিদ হওয়ার জন্য আমাকেই এখানে পাঠিয়েছে অফিস ৷ আমি যোগ্যতর বলে নয়!
ডাক্তারবাবু জানান—‘পৃথিবী উলটে যাক, কিন্তু জংলিবাবার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলবেন না ৷ একটু সাবধানেও থাকবেন ৷ এ ব্যাটারা দল বেঁধে মারপিট করতে এক্সপার্ট ৷’
আমি হেসে জানাই—‘অত সহজ নয় ৷ দল বেঁধে মারতে এলে আগে কয়েকটাকে মেরেই মরব ৷ সে ক্ষমতা আছে’ ৷
ডাক্তারবাবু বিড়বিড় করেন— ‘তবু হাতের কাছে একটা লাঠি রাখবেন ৷ বলা যায় না…!’
ডাক্তারবাবুর সামনে ব্যাপারটাকে হেসে উড়িয়ে দিলেও মনে কিন্তু একটা ভয় থেকেই গেল ৷ এরপর সচরাচর রাতে বাইরে বোরোতাম না ৷ একটা প্রমাণ সাইজের লাঠি ঘরে মজুত রাখলাম ৷ রাত্রে ঘুম হত না! কী জানি! যদি বনোয়ারিলাল দলবল নিয়ে এসে হাজির হয়…! যদি জংলিবাবার নির্দেশে ‘গৃহদাহ’ কেস করে দেয়…!