এই ‘ঘর-ঘর’ ক্যাম্পেনিং-এর সময়ই দেখা হল বনোয়ারিলালের সঙ্গে! ওর দাদা বংশীলাল এবং বনোয়ারির বাড়িতেও গিয়েছিলাম ছাত্র-ছাত্রীর খোঁজে ৷ কিন্তু গিয়ে যা দেখলাম তাতে চক্ষু চড়কগাছ! বনোয়ারি তখন ওর বউ রামদুলারিকে পেটাতে ব্যস্ত ছিল ৷ উঠোনে পা দিয়েই বুঝলাম—টাইমিঙে ভুল হয়েছে! সামনে এক ক্ষীণদেহী, বিবর্ণ-শুকনো-ক্ষয়াটে চেহারার নারী ঘুঁষি-লাথি খেয়ে কঁকিয়ে যাচ্ছে, আর এক পুরুষ তাকে মেরে মেরে পাট পাট করছে ৷ গালি দিচ্ছে—‘কালমুহি, করমজলি! আজ তোকে মেরেই না ফেলেছি!’…
.
‘মাস্টারজি…!’
.
মুহূর্তের মধ্যে চিন্তাসূত্রটা ছিঁড়ে গেল ৷ কিন্তু সেই দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে! সামনেই ক্লান্ত ধ্বস্ত চেহারার সুখিয়া দাঁড়িয়েছিল ৷ ক্লান্ত হওয়াই স্বাভাবিক ৷ তিনদিন আগেই সে একটি সন্তান প্রসব করেছে ৷ এ গ্রামের সকলেই জেনে গিয়েছে আমি ‘ছাত্রবিহীন মাস্টারজি’— অর্থাৎ ‘মিনিস্টার উইদ আউট পোর্টফোলিও’! কিন্তু পড়াশোনা জানি বলে গাঁয়ের অনেকেই আমার কাছে সমস্যা সমাধানের আর্জি নিয়ে আসে ৷ আজ বনোয়ারিলালের হাজতবাসের খবর নিয়ে এসেছে ভগ্নদূত নিরুপায় সুখিয়া!
মনে মনে ভাবছিলাম— ‘পুলিশ-ঠানে’ নামক শালগ্রাম শিলাটি হঠাৎ নড়ে চড়ে বসল কেন? এতদিনে কি তবে কয়লা চুরির অপরাধ ধরা পড়ল? না আচম্বিতে রামদুলারির মাথায় কোনো দিব্য শক্তি ভর করে ফোর নাইন্টি এইটের পাঠ পড়িয়েছে! রামদুলারিও তো গর্ভবতী! নাকি গর্ভবতী বউটা মার খেতে খেতে মরেই গেল বলে খুনের অভিযোগে ধরেছে পুলিশ? যদি তাই হয়ে থাকে, তবে বেশ হয়েছে ৷ অনেক আগেই ওর শাস্তি হওয়া উচিত ছিল!
নির্বিকারভাবে জানতে চাই— ‘পুলিশ ধরেছে কেন? কয়লা চুরি করেছে? না বউটাকে খুন করেছে?’
সুখিয়া ছলছল চোখে বলল— ‘না মাস্টারজি ৷ বনোয়ারি রামদুলারিকে পেটায়নি’ ৷ একটু থেমে সজল চোখে জানায় সে— ‘ও বংশী…মানে আমার মরদটাকে পিটিয়েছে! পিটিয়ে নাক মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে ৷ ও ‘‘ঠানে’’ তে বনোয়ারির নামে ‘‘রপট’’ লিখিয়েছে হুজুর! এদিকে রামদুলারিরও পেট হয়েছে ৷ সকাল থেকে কিছু খায়নি সে ৷ খালি কাঁদছে ৷ এখন আপনি কিছু করুন ৷ নয়তো পুলিশ বনোয়ারিকে ছাড়বে না! রামদুলারি কেঁদে কেঁদে জান দিয়ে দেবে ৷’
যাঃ কলা! এ তো উলটপুরাণ! মাথায় আস্ত আকাশ ভেঙে পড়লেও বোধহয় এত আশ্চর্য হতাম না! শেষ পর্যন্ত বনোয়ারি রামদুলারিকে নয়, বংশীলালকে পেটানোর অপরাধে জেলে গেল! ভাবা যায় না! কবিগুরু এই পরিস্থিতিতে থাকলে নির্ঘাত একটা আপ্তবাক্য লিখে ফেলতেন—
‘বউ ঠ্যাঙাইলে নিস্তার আছে, ভাই ঠ্যাঙাইলে নাই!’
দুই
‘আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন, মাস্টারজি?’ একমুখ জর্দা পানের পিক ফেলে বললেন দারোগা—‘এ তো ওদের ‘‘নিজি’’ মামলা ৷ এক ভাই আরেক ভাইকে পিটিয়েছে ৷ পুলিশে ‘‘রপট’’ লিখিয়েছে ৷ এরপর দেখবেন একটু পরেই দুই ভাই গলা জড়াজড়ি করে কান্নাকাটি করবে ৷ ‘‘মাফি’’ চাইবে ৷ তারপর নালিশ তুলে নিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বাড়ি চলে যাবে ৷ বংশী আর বনোয়ারি— দুটোই সমান ‘‘নৌটঙ্কিবাজ’’!’
‘নিজি’ মামলা আর পারিবারিক ‘নৌটঙ্কি’র মধ্যে পুলিশ কেন মাথা ঘামাচ্ছে তা বুঝতে অবশ্য বাকি ছিল না ৷ বংশীলাল চোরাই কয়লার দামের ‘হিস্যা’ দারোগা সাহেবকে দেয় ৷ অতএব সেই কড়ক নোটের সুগন্ধ শালগ্রাম শিলাতেও প্রাণসঞ্চার করেছে ৷ আমি একঝলক বনোয়ারিলালের দিকে দেখলাম ৷ লোহার গরাদের পিছনে সে বিস্রস্ত, অবিন্যস্ত হয়ে বসে আছে ৷ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে ৷ চুল উসকোখুসকো ৷
গরাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি— ‘বংশীকে পেটালি কেন?’
সে বলল— ‘বংশী ভাবিকে পেটাচ্ছিল ৷ তাই আমিও দিয়েছি কয়েক ঘা!’
এবার আর আকাশ নয়, গোটা ব্রহ্মাণ্ডটাই বুঝি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল মাথায়! এ কী কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে! যে নিজেই বউপেটানোয় ওস্তাদ, সে কি না বউদির গায়ে হাত তুলেছে বলে নিজের দাদাকেই পিটিয়েছে! এ চৈতন্য হল কবে ওর?
আমার হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে বনোয়ারি যেন অনুচ্চারিত প্রশ্নটা বুঝে নিল ৷ আস্তে আস্তে বলল— ‘ভাবি আবার লড়কি পয়দা করেছে ৷ তাই দাদা পেটাচ্ছিল! ম্যায়নে ভি দিয়া রখকে!’ সে ভাসাভাসা চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে—‘আপনিই তো বলেছিলেন মাস্টারজি, যে লড়কি লছমীজির অংশ হয়! সীতার জাত লড়কি! তবে সীতা-মাইয়ার অপমান কী করে হতে দিই?
এ কী! এ যে পুরো সীতাভক্ত হনুমান! এই ভাবান্তর হল কী করে? কবেই বা হল! বনোয়ারি ভিতরে ভিতরে এতটা পাল্টেছে, টেরই পাইনি! এ কী আদৌ সেই বনোয়ারিলাল…!
.
…সেদিন বনোয়ারি একটা আস্ত বাঁশ দিয়ে এলোপাথাড়ি পেটাচ্ছিল বউটাকে! অসহায় রামদুলারি মাটিতে পড়ে প্রাণপণ চেঁচাচ্ছিল আর কাঁদছিল! বংশী আর সুখিয়া নীরব দর্শক! দৃশ্যটা দেখে আর বৌদ্ধ ভিক্ষুর ইমেজ বজায় রাখতে পারলাম না ৷ বাঁশটা ফের বিপজ্জনকভাবে তুলেছিল বনোয়ারি ৷ আমি লাফ মেরে এগিয়ে গিয়ে খপ করে তার হাত চেপে ধরি ৷
বনোয়ারি রক্তচক্ষু তুলে আমার দিকে তাকায় ৷ একটু অনুতাপও নেই ওর মুখে ৷ বরং পারলে যেন বাঁশটা রামদুলারির মাথায় না বসিয়ে আমার মাথাতেই বসায়! কিন্তু অত সহজ নয় ৷ আমার হাত খেটে খাওয়া মজুরের না হলেও কলেজ লেভেলে চ্যাম্পিয়ান বক্সারের কড়া হাত ৷ বনোয়ারি সেটা বুঝতে পেরেছিল ৷ প্রথমে রাগ, পরে বিস্ময় ছাপ ফেলল ওর মুখে ৷ রাগে গর গর করে বলল— ‘কে আপনি? আমাদের ঘরের ব্যাপারে দখলদারি করছেন কেন?’