কিন্তু সপ্তাহখানেক ঘুরতে না ঘুরতেই বুঝলাম অশিক্ষা আর কুসংস্কারের আড়তের মধ্যে এসে পড়েছি ৷ আমাদের এনজিও এই গ্রামে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রাণপণ খাটছিল ৷ কিন্তু আখেরে কোনো লাভ হয়নি ৷ স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, রোগী নেই ৷ থাকবে কী করে? এখানে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তারের কাছে যায় না, বরং দৌড়য় জনৈক জংলিবাবার কাছে ৷ ডাক্তারবাবু একদিন আফসোস করে বলছিলেন—‘ কেন যে মরতে এখানে এলেন! কখনও কখনও আমারও সেই জোকটার মতো মনে হয় যে, নরক থেকে এখানে ফোন করলে নির্ঘাৎ লোক্যাল কলই হবে! আমি এখানে ট্রিটমেন্ট করার জন্য বসে আছি, কম্পাউন্ডার আছে, ওষুধ আছে, টেবিল- চেয়ার—সব আছে ৷ কিন্তু পেশেন্ট নেই’ ৷
‘কেন? পেশেন্ট থাকবে না কেন?’ অবাক হয়ে বলি— ‘ট্রিটমেন্ট তো ফ্রি-তে দেওয়া হচ্ছে! এমনকী ওষুধও ফ্রি! এক পয়সাও লাগবে না ৷ তাবে?’ ডাক্তারবাবু হাসলেন—‘ওই খানেই মার খা গিয়া ইন্ডিয়া! আমি শুধু ওষুধই দিতে পারি ৷ জংলিবাবার মতো হাত ঘুরিয়ে ‘‘নিম্বু’’ বা শূন্য থেকে ‘‘বিভূতি’’, আই মিন ছাই, তো আমদানি করতে পারি না!’
তাই তো! কঠিন সমস্যা! ডাক্তারবাবু ওষুধ দিতে পারেন, লেবু বা ছাই আমদানি করবেন কী করে! অতএব স্বাস্থ্যকেন্দ্র ফাঁকাই পড়ে থাকে ৷ কম্পাউন্ডার ও ডাক্তার সম্মিলিতভাবে মশা ও মাছি তাড়ান!
ডাক্তারবাবু আপনমনেই বিড়বিড় করে বলেন—‘এই তো! কিছুদিন আগেই একটা বাচ্চা মেয়ের জ্বর হয়েছিল! পুরো হলুদ হয়ে গিয়েছিল ৷ ক্লিয়ার কেস অব জন্ডিস! কিন্তু তাকে ডাক্তারখানায় আনা তো দূর, সবাই মিলে জংলিবাবার কাছে নিয়ে গেল! জংলিবাবা পরীক্ষা করে বললেন—‘‘ভূত ধরেছে’’ ৷ তারপর তিনদিন ঝাঁটাপেটা, লোহার ছ্যাঁকা দেওয়ার পর ভূত তো গেলই, মেয়েটার প্রাণও গেল! আমি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম…শুধু দেখলাম…!’
ওঁর হাহাকারের সান্ত্বনা আমার কাছে ছিল না! শুধু বুঝলাম, স্বাস্থ্যের এই হাল! আর শিক্ষার কথা বলতে গেলে কান্না পেয়ে যায় ৷ আমি নিজেই এখানে শিক্ষকতা করতে এসেছি ৷ আমাদের এনজিও আপাতত একটা মেটে বাড়িতে শ্রমিক-সন্তানদের জন্য অস্থায়ী স্কুল গড়ে তুলেছে ৷ সেখানে পড়ানোর জন্য একজন হেডস্যার ও আমাকে নিয়ে সর্বসাকুল্যে দুজন শিক্ষক উপস্থিত ৷ অফিস থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে এই মেটে বাড়িটা পাকা হবে কি না তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে ছাত্রসংখ্যার ওপরে! টার্গেট টাইম—দু বছর ৷ কিন্তু আমি এখনই হলফ করে বলতে পারি—জীবনেও হবে না! দশমাস আগে ছাত্রসংখ্যা ছিল শূন্য! এখনও তাই! তাও ভালো, জনগণনা মাইনাসে রান করে না! তাই বৎসরান্তে রিপোর্ট করার সময় ‘উন্নতি হয়নি’ বলতে পারব ৷ কিন্তু ‘অবনতি হয়েছে’ তা আমার অতিবড় শত্তুরও প্রমাণ করতে পারবে না!
‘আগের জন তিনমাসেই পালিয়েছিল’ ৷ হেডস্যার আবার লখনৌ-র মানুষ ৷ প্রথম সাক্ষাতেই চোস্ত হিন্দিতে বললেন—‘আপনি কবে পালাচ্ছেন, জনাব?’
প্রথম সম্ভাষণেই হকচকিয়ে গেলাম ৷ আমার বিস্ময় দেখে ভদ্রলোক হেসে ফেলেন—‘আপনি ‘‘কলকত্তার’’ লোক ৷ এখানকার হালচাল দেখলে দুদিনেই ‘‘পালাই পালাই’’ করবেন ৷ এদের পড়ানোর সাধ্যি স্বয়ং দেবী সরস্বতীরও নেই, তো আমরা কোথাকার খাঞ্জা খাঁ?’
স্কুলের হেডস্যার যদি প্রথমেই এমন একখানা আছোলা বাঁশ দিয়ে দেন, তবে শিক্ষক বেচারি যায় কোথায়? তবু ভাবলাম, এত সহজে ছাড়ব না ৷
‘প্রথম প্রথম অনেক চেষ্টা করেছি’ ৷ হেডস্যার নির্লিপ্ত মুখে জানালেন—‘কিন্তু বাচ্চাগুলো পড়বে কী! ওরাও তো বাপ-মায়ের সঙ্গে কাজে বেরোয় ৷ কেউ কয়লাখনিতে যায় ৷ কেউ জমিতে খাটার কাজ করে’ ৷
‘কিন্তু শিশুশ্রম তো বে-আইনি!’
‘আইন!’ এবার সজোরে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক—‘এখানে আইন কোথায়? ‘‘পুলিশ-ঠানে’’ একটা আছে ঠিকই, কিন্তু আইন নেই!’
বুঝলাম, ‘পুলিশ-ঠানে’ আসলে শালগ্রাম শিলারই নামান্তর! তবু হাল ছাড়িনি ৷ এই এনজিও-তে এটাই প্রথম আমার ‘বিগ ভেঞ্চার’ ৷ এতদিন বয়েস নিতান্তই কম বলে ছোটখাটো কাজই করতে হচ্ছিল ৷ নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ এই প্রথম ৷ মনে মনে ভাবলাম, এত সহজে ছাড়ব! চ্যালেঞ্জ নিয়েই দেখি না কী হয়! আমিও নজরুল, নেতাজি, ক্ষুদিরামের দেশের লোক ৷ ‘আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হব শান্ত…!’
অনেক উত্তপ্ত কবিতা মনে মনে আবৃত্তি করে অবশেষে মাঠে নেমেই পড়লাম ৷ মনে মনে বিদ্রোহী কবিতা আওড়ালেও বাহ্যিক ভাবটা একদম বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মতো! যেন দোরে দোরে গিয়ে ঝুলি পেতে বলছি—‘ভিক্ষাং দেহি’! কুড়িয়ে বাড়িয়ে যদি একটি ছাত্র বা ছাত্রী মিলে যায় তবেই একেবারে আগ্রা ফোর্ট জয় করে ফেলব! কিন্তু ‘অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়’ ৷ প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়িতেই চা, গুড়, মুড়ি পেলাম, সসম্মানে ‘মাস্টারজি’ অভিধাও জুটল, হাত পাখার মিঠে বাতাসও পেলাম—কিন্তু ছাত্রছাত্রী পাওয়া গেল না! ঘরে ঘরে শুধু বাটিটা পাততে বাকি রেখেছি ৷ কিন্তু ভবি ভোলবার নয় ৷ ঘরের শিশুদের ধানখেতে, কয়লা খনিতে, কিংবা কোনো লালার চাল-কলে, তেল-কলে খাটতে দিতে রাজি ওরা ৷ কিন্তু স্কুলে পড়তে পাঠালেই ‘সত্যনাশ’ ৷ বেশ কয়েকবার বোঝানোর চেষ্টাও করলাম ৷ সবার মুখেই এক কথা—‘আমার একার রোজগারে ‘‘গেরস্থী’’ চলে কী করে মাস্টারজি? একেই কাজের ঠিক নেই ৷ আজ আছে, কাল নেই ৷ বাঁচতে হলে তো সবাইকেই ‘‘মেহনত’’ করতে হবে ৷ আর আমাদের মতো মজুরদের ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে কোন ‘‘জজ-কালেক্টর’’ হবে! ওসব আপনাদের মতো বড় লোকদের ব্যাপার! মজদুরি খাটলে পয়সা আসবে, ‘‘সকুল’’ এ পড়ে কি দু বেলার ‘‘দাল-রোটি’’ জোগাড় করতে পারবে বাচ্চা?’