টেবিলের ওপাশে সাদা য়ুনিফর্ম পরে একজন পুলিশ অফিসার বসে আছেন। বয়স বড়জোর পঁয়তিরিশ। ছোট করে ছাঁটা চুল। মুখে উদাসীন বিরক্ত ভাব।
টেবিলে রাখা কাঠের নেমপ্লেট পড়ে জানা গেল অফিসারের নাম টি. দাস, সাব-ইন্সপেক্টর।
সুপ্রতিম আর নয়না বসল।
দাসবাবু সপ্রশ্ন নজরে ওদের দিকে তাকালেন।
একটু ইতস্তত করে সুপ্রতিম বলল, ‘আমি…আমি…একটা ডায়েরি করতে চাই।’
কথা বলতে-বলতে ও চারপাশে দেখছিল। দু-একজন লোক এদিক-ওদিক যাতায়াত করছে। তাদের চোখেমুখে ব্যস্তসমস্ত ভাব।
সুপ্রতিমের মনে হল, দাসবাবু ছাড়া আর কেউ ওদের কথা শুনতে পাবে না। তাই দাসবাবু যখন ডায়েরি-বইz নিয়ে ডটপেট বাগিয়ে বললেন, ‘বলুন—।’, তখন ও প্রথমে নিজের পরিচয় দিল, তারপর সহজভাবেই ঝুমুরের ব্যাপারটা বলে গেল। টেবিলের আড়ালে নয়না ওর একটা আঙুল ছুঁয়ে ওকে সাহস জোগাচ্ছিল। ও টের পেল, সুপ্রতিমের আঙুল কাঁপছে।
কিছু লেখার আগে দাসবাবু ব্যাপারটা শুনে নিচ্ছিলেন। মাঝে-মাঝে ছোটখাটো শব্দ করছিলেন, আর ডটপেনটা ডায়েরি-বইয়ের পাতায় ঠুকছিলেন।
শুনতে-শুনতে একসময় তাঁর মুখে মজা পাওয়ার ছাপ ফুটে উঠল। চাপা গলায় বললেন, ‘ভেরি ইন্টারেস্টিং!’
হঠাৎই একজন সাদা-পোশাকের অফিসার সিগারেট টানতে-টানতে এগিয়ে এলেন। ধপ করে বসে পড়লেন দাসবাবুরপাশের চেয়ারটায়। আড়চোখে নয়নার সৌন্দর্য চেটে নিয়ে ভাঙা গলায় বললেন, ‘কী কেস, দাস?’
‘হোমো কেস।’ দাস মুচকি হেসে বললেন।
নয়না আর সুপ্রতিম ‘হোমো’ শব্দটা শুনে কেমন যেন সিঁটিয়ে গেল।
‘বলুন, তারপর কী হল—’ সুপ্রতিমকে তাড়া দিলেন দাস।
খুঁড়িয়ে চলা ছ্যাকড়াগাড়ির মতো থতিয়ে-থতিয়ে কথা শেষ করল সুপ্রতিম। টের পেল, ওর ঘাড়ে, গলায়, কপালে ঘাম জমছে।
ওর কথা শেষ হওয়ামাত্রই সাদা-পোশাকের অফিসারটি বলে উঠলেন, ‘এ-ডায়েরি নিয়ো না, দাস— এই ভদ্রলোক ফেঁসে যাবেন।’
দাসবাবু ওঁর কথায় সায় দিয়ে বললেন, ‘ঠিকই বলেছেন, শঙ্করদা।’
নয়না অবাক চোখে জানতে চাইল, ‘কেন? ডায়েরি নেবেন না কেন? লোকটা আমাদের লাইফ হেল করে দিচ্ছে…।’
‘সবুর, ম্যাডাম, সবুর…।’ সিগারেটে জোরালো টান দিয়ে সাদা-পোশাকের অফিসারটি বললেন, ‘একটু মাথা খাটান, তা হলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। একটা ইয়াং ছেলে আপনার হাজব্যান্ডকে ”আমি তোমাকে ভালোবাসি” বলে জাপটে ধরে চুমু খেয়েছে। মানছি, অন্যায় করেছে। কিন্তু তার বদলে আপনার হ্যাজব্যান্ড কী করেছেন? না ছেলেটাকে তুলোধোনা করে মুখ-মাথা ফাটিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে দিয়েছেন। কী, ঠিক বলছি তো?’ শেষের প্রশ্নটা সুপ্রতিমকে লক্ষ্য করে।
সুপ্রতিম কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল। নয়নাও ঠিক কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না।
সাদা-পোশাকের অফিসারের কথার খেই ধরে দাস সুপ্রতিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওই ছেলেটা যদি থানায় এসে আপনার নামে ডায়েরি করে তা হলে তো আপনি ভেতরে ঢুকে যাবেন। তখন বিচ্ছিরিরকম স্ক্যান্ডাল হবে, লোকজানাজানি হবে— একটা কেলো হয়ে যাবে।’ একটু সময় দিলেন ওদের। তারপর: ‘তার চেয়ে বরং বাড়ি যান। ছেলেটা আবার এলে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে টাকাপয়সা দিয়ে ম্যানেজ করে নিন। ওর সঙ্গে মিউচুয়াল করে নেওয়া ছাড়া আর তো কোনো ওয়ে আউট দেখছি না। শঙ্করদা কী বলেন?’ সাদা-পোশাকের দিকে ফিরে জানতে চাইলেন দাস।
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে টুকরোটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিতে-দিতে শঙ্করবাবু বললেন, ‘এ ছাড়া কোনো পথ নেই। এসব হোমো কেস নিয়ে ক্যাচাল যত কম হয় আপনাদের পক্ষে ততই ভালো। তবে এরপর কী হয়-না-হয় সেটা আমাদের ইনফর্ম করতে পারেন। সিরিয়াস কোনো টার্ন নিলে তখন…।’
সুপ্রতিম আর নয়না ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। অফিসাররা যে ঠিক কথাই বলছেন, সে নিয়ে ওদের মনে কোনোরকম সন্দেহ ছিল না।
এক অদ্ভুত আতঙ্কে অবশ হয়ে শোলার পায়ে ওরা বাড়ি ফিরে এল। নয়না মনে-মনে ভাবছিল, কেমন দেখতে এই ঝুমুর চৌধুরিকে?
সুপ্রতিম যখন ফ্ল্যাটের দরজায় নাইট ল্যাচের চাবি ঘোরাচ্ছে তখন শুনতে পেল ঘরের ভেতরে টেলিফোন বাজছে।
দরজা খুলে তাড়াহুড়ো করে ফোন ধরল সুপ্রতিম।
‘হ্যালো—।’
‘সুপ্রতিম…মাই লাভ…আই লাভ য়ু…।’
নয়না স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। দেখল ওর মুখটা চোখের পলকে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। নয়না বুঝতে পারল, সুপ্রতিমকে কে ফোন করেছে।
ঝুমুরের টেলিফোনের উৎপাত চলতেই থাকল, কিন্তু সুপ্রতিম কিছুতেই আর বিরক্ত হল না। থানার দুই অফিসারের কথা ওর মনে ছিল। তাই ও মোলায়েমভাবে কথা বলে ঝুমুরকে নিরস্ত করতে চাইল। ওকে অনুনয় করে বলল, ‘তুমি যেরকম ভালোবাসা চাও আমার মধ্যে সেরকম ভালোবাসা নেই। তুমি ভুল করছ—।’
ওকে বাধা দিয়ে আদুরে ঢঙে ঝুমুর বলল, ‘না, না, ভুল নয়। তুমি আমার কাছে ধরা দিলেই বুঝবে আমি ভুল করিনি। আমি মনের মতো মনের মানুষ পেয়েছি।’
সুপ্রতিম অনেক চেষ্টা করেও গা-ঘিনঘিন-করা ভাবটা চেপে রাখতে পারেনি। এবং টেলিফোন রেখে দিয়েছে।
কিন্তু পরে আবার ঝুমুরের ফোন এসেছে।
সুপ্রতিম প্রতিবারই ওকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। টাকা দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। ফোনের ও-প্রান্তে ঝুমুর কেঁদে ভাসিয়েছে। আত্মহত্যা করবে বলে ওকে ভয় দেখিয়েছে। কখনও বলেছে, গঙ্গায় ঝাঁপ দেবে। কখনও বলেছে, ট্রেনের তলায় মাথা দেবে। আবার কখনও-বা বলেছে, গলায় দড়ি দেবে।