Site icon BnBoi.Com

চারটি রহস্য উপন্যাস – অনীশ দেব

চারটি রহস্য উপন্যাস

চারটি রহস্য উপন্যাস

 

আমি পিশাচ

৷৷এক৷৷

আমি একজন পিশাচ৷ এ ছাড়া অন্য কোনও পরিচয় আমার নেই৷ কবে কীভাবে আমার জন্ম তা জানি না৷ আমার বয়েস কত তাও জানা নেই৷ শুধু জানি, রক্ত আমার একমাত্র খাদ্য৷ রক্তের পিপাসা আমাকে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়৷ এখনও যে পথ চলছি সেও ওই রক্তের টানে৷ পিপাসায় বুক শুকিয়ে আসছে আমার৷

আমাকে কেমন দেখতে?

বলছি৷ তবে শুনে যেন অবাক হয়ে যেয়ো না৷

আমার কোনও নির্দিষ্ট চেহারা নেই৷ যখন যেখানে থাকি সেইরকম চেহারা নিয়ে পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিই৷ যেমন, যখন জঙ্গলে থাকি তখন গাছের পাতা কিংবা গাছের বাকল হয়ে যাই৷ পুকুরপাড়ে থাকলে ঘাস-পাতা, আগাছা, কিংবা মাটির চেহারা নিই৷ এটা ছদ্মবেশ যদি বলো তো তাই৷

ভিজে, স্যাঁতসেঁতে, নোংরা জায়গায় আমি থাকতে ভালোবাসি৷ তাই আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হল মানুষ বা পশুর শরীর৷ ওদের শরীরের ভেতরটা নরম, স্যাঁতসেঁতে, দুর্গন্ধময়, নোংরা—আবার একইসঙ্গে রক্তের তাপে উষ্ণ৷ ওদের শরীরে আমি নিশ্চিন্তে বহুদিন থাকতে পারি৷ আর ওদের দিয়ে আমার রক্তের তৃষ্ণা মেটাই৷ আমার ইচ্ছেয় ওরা অন্যের শরীরে ধারালো দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষে নেয়৷ ওরা বুঝতেও পারে না, ওরা আসলে আমার তেষ্টা মেটাচ্ছে৷ কারণ, ওদের শরীরে ঢুকে পড়ার পর থেকেই ওদের মস্তিষ্ক চলে আমার কথায়৷ অর্থাৎ, ওদের শরীর আর মন—দুই-ই দখল করে ফেলি আমি৷

তবে পশুর চেয়ে মানুষই আমার বেশি পছন্দ৷ কারণ, মানুষের রক্তের স্বাদ সবার সেরা৷ আর মানুষ শিকার করাও সহজ৷ তারপর, আমার হয়ে সেই মানুষ—কিংবা অমানুষ রক্তপিশাচ—যখন মানুষ শিকার করে, তখন তার কাজটাও সহজ হয়ে যায়৷

আঃ! ভাবতেই কত তৃপ্তি!

কিন্তু এ-কাজে বিপদও আছে৷

আমার দখলে থাকা অমানুষগুলো যখন ধরা পড়ে যায় তখন ওরা শাস্তি পায়৷ অন্যান্য সুস্থ মানুষ ওদের খতম করে৷ তখন আমাকে পালিয়ে বাঁচতে হয়৷ এক দেহের আশ্রয় ছেড়ে ছুটতে হয় অন্য আস্তানার খোঁজে৷

বুঝতেই পারছ, মানুষ-পিশাচগুলোর বিনাশ হলেও আমার বিনাশ নেই৷

তা হলে কি আমি অমর? কে জানে!

তবে আত্মা যদি অমর অবিনশ্বর হয় তা হলে প্রেতাত্মা কিংবা পিশাচের অমর হতে অসুবিধে কী!

পথ চলতে-চলতে যখন ভীষণ একঘেয়ে আর ক্লান্ত লাগছে ঠিক তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল৷ সকাল থেকেই মেঘের সাজ-সাজ রব চোখে পড়েছিল, দুপুর পেরোতেই তার কান্নাকাটি শুরু হল৷

চলতে আর ইচ্ছে করছিল না৷ তেষ্টায় আমার ভেতরটা ছটফট করছিল৷ তাই সামনের দোতলা বাড়িটায় ঢুকে পড়লাম৷

প্রকাণ্ড বাড়ি৷ তার লাগোয়া খেলার মাঠ আর বাগান৷ মাঠে বর্ষার সবুজ ঘাস৷ কোথাও-কোথাও জল জমে আছে৷ ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে৷ ওরা বোধহয় এই তুমুল বর্ষার জন্যেই অপেক্ষা করছিল৷ এখন খুশিতে টগবগে হয়ে কলরোল শুরু করে দিয়েছে৷

যাক, এবার আমার কাজ হল বিশ্রাম আর আরাম৷ আর তার জন্যে চাই একজন মানুষ—যার শরীরে আমি আশ্রয় নেব৷ তারপর…৷

.

৷৷দুই৷৷

সত্যবানস্যার বোর্ডে অঙ্ক করছিলেন৷ কালো বোর্ডের ওপরে ওঁর চক-ধরা আঙুল তাড়াহুড়ো করে আলপনা এঁকে চলেছে৷ অঙ্ক যেন স্যারের পোষা পাখি৷ কী সুন্দর স্যারের কথা শোনে! কোনও অঙ্কই স্যারের আটকায় না৷ ধরেই স্যাটাস্যাট করে দেন৷ সেইজন্যেই অচ্যুত, ঋদ্ধিমান, বাসব, সৌরভরা সত্যবানস্যারের নাম দিয়েছে ‘স্যাটাস্যাট’৷

স্যার বোর্ডে অঙ্ক করছিলেন৷ আর ক্লাস নাইনের ছেলেরা মাথা নীচু করে চুপচাপ সেটা খাতায় টুকে নিচ্ছিল৷ অচ্যুত অঙ্কে দারুণ—সবসময় একশোয় একশো পায়৷ কিন্তু বীজগণিতের এই অঙ্কটা ওরও আটকে গেছে৷ হল অ্যান্ড নাইটের ‘হায়ার অ্যালজেব্রা’ থেকে এই অঙ্কটা স্যার আগের দিন করতে দিয়েছিলেন৷

মাথা ঝুঁকিয়ে অঙ্ক টোকা শেষ হতেই কন্দর্প অচ্যুতকে আলতো করে খোঁচা মারল৷

অচ্যুত পাশে ফিরে তাকাতেই কন্দর্প ফিসফিস করে বলল, ‘অ্যাই, আমার ব্যাগ থেকে সাত টাকা চুরি গেছে৷’

অচ্যুত অবাক হল না৷ কারণ, গত সাত-আটদিন ধরে ওদের সেকশানে এই চুরির ব্যাপারটা শুরু হয়েছে৷

প্রথম যে-চুরিটা ওদের নজরে পড়েছিল সেটা ঋদ্ধিমানের ব্যাগ থেকে চার টাকা উধাও হওয়ার ঘটনা৷ সেটা ওরা কেউই খুব একটা আমল দেয়নি৷ ভেবেছে ঋদ্ধিমানের হয়তো ভুল হয়েছে৷ ভুল করে টাকাটা অন্য কোথাও রেখে এসেছে৷

কিন্তু তারপর, ওদের বন্ধু কুলদীপের ব্যাগ থেকে বারো টাকা উধাও হতেই অচ্যুতরা নড়েচড়ে বসেছে৷

ক্লাসে কুলদীপের গায়ের জোরই সবচেয়ে বেশি৷ ওর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে কেউ পারে না৷ তা ছাড়া ও রোজ ব্যায়াম করে, বক্সিং ক্লাবে বক্সিং শেখে৷

টাকা চুরি যেতেই কুলদীপ তো রেগে আগুন৷ ও সবাইকে শাসিয়ে বলল, ‘চোর ধরা পড়লে এক ঘুসিতে নাক ফাটিয়ে বারো টাকার শোধ নেব৷’

কিন্তু চুরির ব্যাপারটা থামল না৷ যেমন আজ কন্দর্পের টাকা চুরি গেছে৷ সুতরাং দুটো পিরিয়ডের ফাঁকে ওরা চার-পাঁচজন মিলে টিচার্স রুমে গিয়ে বাংলার অমিয়স্যারকে সব জানাল৷ স্যার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘হাতেনাতে তস্করকে না ধরা পর্যন্ত তো কোনও প্রমাণ নেই! যদি তোরা নক্তচরকে লাল হাতে ধরতে পারিস, তা হলে প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে আদ্যোপান্ত অবধান করিয়ে শাস্তি দেওয়ার একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে৷’

অচ্যুতরা আন্দাজ করতে পারল ‘তস্কর’ আর ‘নক্তচর’ মানে চোর৷ অমিয়স্যারকে নিয়ে এই এক মুশকিল! বাংলার স্যার বলে বড্ড বেশি বাংলায় কথা বলেন৷

পরদিন থেকে ওরা পাঁচজন—অচ্যুত, কুলদীপ, প্রতীক, বাসব, আর সৌরভ—চোর ধরার নানান মতলব আঁটতে লাগল৷

এসব ব্যাপারে কুলদীপ ওদের লিডার৷ আর প্রতীক কুলদীপের সর্বক্ষণের সাথী৷ মাঝে-মাঝে কুলদীপকে দুষ্টু বুদ্ধির জোগান দেয় বলে প্রতীকের একটু কুখ্যাতি আছে৷ বাসব ক্লাসের মনিটর, এন. সি. সি-র ক্যাডেট৷ ডিসিপ্লিন নিয়ে সবসময় মাথা ঘামায়৷ হাঁটা-চলা করে সৈনিকের ঢঙে—যেন লেফট-রাইট করে প্যারেড করছে৷ ক্লাসের অনেকেই ওর হাঁটার ঢং নকল করে ওকে ব্যঙ্গ করে—তবে আড়ালে৷ নইলে ও স্যারদের কাছে কমপ্নেন করে দেবে৷ আর যেহেতু সৌরভের ব্যাগ থেকে চবিবশ টাকা চুরি গিয়েছিল, তাই চোর ধরার মতলবে ও একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷

টিফিনের সময় স্কুলের লাগোয়া খেলার মাঠে জামগাছতলায় বসে ওদের প্ল্যান আঁটার কাজ শুরু হল৷

টিফিনের সময় অচ্যুতরা বেশির ভাগই ক্লাসরুম ছেড়ে খেলার মাঠে বেরিয়ে আসে৷ টিফিনটা কোনওরকমে নাকে-মুখে গুঁজে ওদের কলরোল খেলাধুলো শুরু হয়৷ ওদের চেঁচামেচিতে গাছে বসে থাকা বুলবুলি, শালিখ, বসন্তবৌরি আর দোয়েল পাখিরা উড়ে পালায়৷ আধঘণ্টা পর ক্লাস বসলে মাঠটা হঠাৎ আবার ফাঁকা নির্জন হয়ে যায়৷ তখন পাখিরা বোধহয় হাঁফ ছেড়ে ফিরে আসে৷

চুরির ঘটনাগুলো খতিয়ে বিচার করার পর প্রতীক বলল, ‘স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, টাকাটা যে নেয় সে টিফিনের সময় নেয়৷ ক্লাসে তখন যদি অন্যরা কেউ বসে থাকে তা হলে নেয় না৷ কিন্তু ফাঁক পেলেই ব্যাগ হাতড়ায়৷ টিফিনের সময় ক্লাসরুমটা ওয়াচ করতে হবে৷’

তখন ঠিক হল, রোজ টিফিনের সময় সৌরভ ওদের ক্লাসরুমে ডেস্কের নীচে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকবে৷ ক্লাসে কেউ ঢুকলে সৌরভগেক দেখতে পাবে না৷ ফলে চোরবাবাজি ধরা পড়বেই৷

যেমন মতলব তেমনি কাজ৷ এবং ফল পাওয়া গেল তিনদিনের মধ্যেই৷

সৌরভ ক্লাসরুমে লুকিয়ে ছিল৷ ওদের ক্লাসে দুটো করে ডেস্ক পাশাপাশি তক্তা দিয়ে জুড়ে দুজনের বসার মতো ব্যবস্থা করা আছে৷ সেই জোড়া ডেস্কগুলোকে আবার পাশাপাশি সাজিয়ে ডেস্কের সারি তৈরি করা হয়েছে৷ আর ক্লাসরুমের মাঝ-বরাবর রয়েছে যাতায়াতের প্যাসেজ৷

সৌরভ ক্লাসরুমের একেবারে শেষে এককোণে একটা জোড়া ডেস্কের নীচে লুকিয়ে ছিল৷ অত বড় ঘরে আর কেউ নেই৷ সব চুপচাপ৷ শুধু তিনটে সিলিং ফ্যান ঘোরার শব্দ হচ্ছে৷ ঘাড় গুঁজে বসে থাকতে সৌরভের বেশ কষ্ট হচ্ছিল৷ কিন্তু একটা জেদ ওকে দিয়ে এই কষ্ট সইয়ে নিচ্ছিল৷

আগের দু-দিন কোনও ঘটনা ঘটেনি৷ কিন্তু আজ ঘটল৷

মিনিটদশেক যেতে না যেতেই একজোড়া পা দেখতে পেল সৌরভ৷

খুব সাবধানে দুটো ডেস্কের পায়ার একচিলতে ফাঁক দিয়ে ও উঁকি মারল৷ দেখল, ওদেরই ক্লাসের রাজীব দাস প্রথম সারির ডেস্কের ব্যাগগুলো ব্যস্তভাবে হাতড়াচ্ছে৷ কোনও-কোনও ব্যাগের ভেতর থেকে কী যেন মুঠো করে নিয়ে পকেটে ঢোকাচ্ছে৷ আর মাঝে-মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে ক্লাসরুমের দরজার দিকে তাকাচ্ছে৷

মাত্র পাঁচমিনিট৷ তার মধ্যেই দুটো ডেস্কের সারির তল্লাশি চটপট সেরে ফেলল রাজীব৷ যা পেল পকেটে গুছিয়ে নিল৷ তারপর তাড়াহুড়ো করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল৷

না, সৌরভ ‘চোর, চোর’ বলে চেঁচায়নি৷ কারণ, সেইরকমই কথা ছিল৷ ও শুধু চুরির ঘটনাটা কুলদীপ, অচ্যুতদের জানিয়ে দিল৷ বলল, এই কুকীর্তি কার৷

এই খবরটা জানার পর কুলদীপরা চোর ধরার ফাঁদ পাতল৷ ওরা পাঁচজন টিফিনের সময় ক্লাসরুমের পাঁচ জায়গায় ডেস্কের নীচে ঘাপটি মেরে রইল৷

ওদের হতাশ হতে হল না৷ কারণ, চোর এল এবং চটপট কাজ সারতে লাগল৷

কুলদীপ সকলের আগে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল৷ ওর পিঠের ধাক্কায় একজোড়া ডেস্ক দড়াম করে মেঝেতে উলটে পড়ল৷

ও চিৎকার করে রাজীবকে জাপটে ধরল, ‘ব্যাটা চোর, রোজ বন্ধুদের টাকা চুরি করিস—লজ্জা করে না!’

ততক্ষণে সৌরভ, বাসব, প্রতীক আর অচ্যুত ওদের লুকোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ ওরা সবাই রাজীবকে ঘিরে ধরল৷ তারপর রাজীবকে টানতে-টানতে নিয়ে গেল টিচার্স রুমে৷

এখন টিফিনের সময়৷ একটা প্রকাণ্ড টেবিল ঘিরে স্যারেরা বসেছিলেন৷ কয়েকজন গল্পগুজব করছিলেন, কেউ-কেউ টিফিন সারছিলেন৷ বেয়ারা সেবকরাম একপাশে দাঁড়িয়ে চক-ডাস্টার গুছিয়ে রাখছিল৷

টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে কুলদীপরা চট করে ঘরের ভেতরটায় চোখ বুলিয়ে নিল৷ ওদের ক্লাসটিচার ভূগোলের কালীপদস্যারকে ওরা দেখতে পেল না৷ বোধহয় কোনও কাজে বাইরে বেরিয়েছেন৷ তবে অমিয়স্যার আর সত্যবানস্যার ছিলেন৷ সত্যবানস্যার টিফিন করছিলেন৷ আর অমিয়স্যার খবরের কাগজ পড়ছিলেন৷

টিচার্স রুমের দরজায় ওদের জটলা দেখে কেউ-কেউ অবাক হয়ে দেখছিলেন৷

বাসব অমিয়স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভেতরে আসব, স্যার?’

অমিয়স্যার কাগজ থেকে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকালেন৷ কুলদীপ, সৌরভ, বাসবদের দেখে বুঝলেন কিছু একটা গোলমাল হয়েছে৷ কারণ, কুলদীপ রাজীবের কবজি শক্ত করে চেপে ধরে ছিল৷

চেয়ার ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অমিয়স্যার৷ খবরের কাগজটা একটা ডাস্টার চাপা দিয়ে রেখে চটপট চলে এলেন দরজার কাছে৷

‘কী রে, কী হয়েছে!’

ওরা হাঁফাতে-হাঁফাতে রাজীব দাসের কীর্তির কথা বলল৷

অমিয়স্যার ধৈর্য ধরে সব শুনলেন৷ ব্যাপারটা ওঁর মনে পড়ে গেল৷ তিনিই ওদের বলেছিলেন চোরকে হাতেনাতে ধরার কথা৷

তিনি রাজীবকে বললেন, ‘তুই এখানে থাক৷’ তারপর অচ্যুতদের দিকে ফিরে : ‘তোরা শ্রেণিতে যা৷ আমি ব্যাপারটা দেখছি—৷’

এমন সময় সত্যবানস্যার ওদের পাশ দিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন৷ কিন্তু আশ্চর্য, ওদের জটলা নিয়ে কোনওরকম কৌতূহল দেখালেন না৷ একজন অচেনা মানুষের মতো পাশ দিয়ে চলে গেলেন৷ অথচ দু-তিনদিন আগেও অচ্যুতকে দেখলে হেসে বলতেন, ‘কী রে, দিনরাত শুধু ক্রিকেট নিয়ে পড়ে আছিস, নাকি অঙ্ক-টঙ্কও একটু-আধটু হচ্ছে? ভালো করে পড়৷ মাধ্যমিকে অঙ্কে একশোয় একশো পাওয়া চাই-ই চাই৷’

অচ্যুত বেশ অবাক হয়ে গেল৷ কয়েক সেকেন্ড ধরে ও সত্যবানস্যারের চলে যাওয়া দেখল৷

আর ঠিক তখনই টিফিন শেষ হওয়ার ঘণ্টা বেজে উঠল৷ ঢং-ঢং-ঢং-ঢং৷ স্কুলের দারোয়ান বানজারা পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল পিতলের ঘণ্টায় কাঠের হাতুড়ি দিয়ে তাল ঠুকে জানিয়ে দিচ্ছে টিফিনের আধঘণ্টা শেষ হয়েছে৷ এখন আবার ক্লাস শুরু হবে৷

ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ার সময় অচ্যুতের এরকম একটা পিতলের ঘণ্টা কেনার খুব শখ হয়েছিল৷ কিন্তু বাপি আর মা সেই শখের কথাটা শুনে হেসে এমন গড়িয়ে পড়েছিল যে, অচ্যুতের আর ঘণ্টা কেনা হয়ে ওঠেনি৷

স্কুলের চওড়া বারান্দা ধরে ওরা ক্লাসের দিকে ফিরে যাচ্ছিল৷ এখন দুপুর হলেও আকাশ মেঘলা৷ যখন-তখন বৃষ্টি হতে পারে৷ গত ক’দিন ধরেই ঝেঁপে বৃষ্টি চলছে৷ মাঝে-মাঝে এক-আধ-ঘণ্টার বিরতি৷ বৃষ্টিও বোধহয় তখন টিফিন করতে যায়—নয়তো ঘুমিয়ে পড়ে৷

স্কুলের মাঠটা বৃষ্টিতে যাচ্ছেতাই হয়ে থাকে বলে এখন টিফিনের সময়ে খেলার হুল্লোড় অনেকটা মিইয়ে গেছে৷ আর সবসময় মেঘলা থাকলে অচ্যুতের কেমন যেন মনখারাপ লাগে৷

ফিফথ পিরিয়ডের দশ-পনেরো মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পর রাজীব ক্লাসে এসে ঢুকল৷

রমেশস্যার তখন ইতিহাস পড়াচ্ছিলেন, আর ক্লাসের অর্ধেক ছেলে তন্দ্রার টানে ঢুলছিল৷ ঘন-ঘন হাই উঠছিল সকলের৷

কিন্তু রাজীব দাসকে দেখেই সবাই সোজা হয়ে বসল৷

রাজীবের রং টকটকে ফরসা৷ ঘি-মাখন খাওয়া গোলগাল নধর চেহারা৷ চোখে চশমা৷ সবসময় ফিটফাট থাকে৷ কিন্তু এখন ওর চুল উসকোখুসকো, চোখের জল চশমার ফাঁক দিয়ে গাল বেয়ে নেমে এসেছে, হেঁচকি তুলে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে৷

রমেশস্যার দাক্ষিণাত্যের সাতবাহন সাম্রাজ্যের সাতকাহন থামিয়ে অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কী ব্যাপার? তুই কোথায় গিয়েছিলি?’

প্রশ্নটা করে কুতকুতে তীক্ষ্ণ চোখে তিনি রাজীবকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিলেন৷

‘অমিয়স্যার আমাকে হেডস্যারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন৷’ ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল রাজীব৷

‘কেন রে? কী করেছিস তুই?’

রাজীব চুপ করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল৷

অচ্যুতের ভীষণ খারাপ লাগছিল৷ আহা রে! হেডস্যার মোহনলালবাবু নিশ্চয়ই ওকে বেত দিয়ে মেরেছেন৷ কিন্তু রাজীবই-বা টাকা চুরি করে কেন? ওরা তো বেশ বড়লোক! রেল স্টেশনের কাছে ওদের সুন্দর দোতলা বাড়ি৷ মারুতি জেন গাড়ি করে স্কুলে আসে৷

মনিটর বাসবকে ডেকে রমেশস্যার ব্যাপারটা জানতে চাইলেন৷ রাজীবকে বললেন, ‘তুই ডেস্কে গিয়ে বোস৷’

রাজীব মাথা নীচু করে ডেস্কের দিকে এগোল৷

অচ্যুতের ডেস্কের সারির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাজীব ওকে মিনমিনে গলায় বলল, ‘ছুটির পর তোকে অমিয়স্যার দেখা করতে বলেছেন৷’

অচ্যুত ঘাড় নেড়ে ‘আচ্ছা’ বলল৷

রমেশস্যার বাসবের কাছে গোটা গল্পটা শুনে তারপর আবার সাতবাহন রাজবংশের কাহিনি শুরু করলেন৷

রমেশস্যারের পিরিয়ড শেষ হতেই সবাই রাজীবকে ছেঁকে ধরল৷ কেউ-কেউ ওকে সান্ত্বনা দিল৷ আবার কেউ বলল, ‘ঠিক হয়েছে—অন্যায় করেছে তাই শাস্তি পেয়েছে৷’

কুলদীপ, সৌরভ, বাসবরা খুঁটিয়ে জানতে চাইল অমিয়স্যার ওকে হেডস্যারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর ঠিক কী-কী হয়েছে৷

রাজীব থতিয়ে-থতিয়ে বলছিল আর ফুঁপিয়ে উঠছিল৷ হেডস্যারের দশ ঘা বেতের বাড়ি খেয়ে ও সহ্য করেছে৷ কিন্তু হেডস্যার বলেছেন, কাল ওর বাবা-মাকে স্কুলে এসে দেখা করতে৷ এটা ওকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছে৷ বাপি-মাম্মি এসব ঘটনা জানতে পারলে ওকে হয়তো বাড়ি থেকেই বের করে দেবে৷ রাজীব তাই ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে সিঁটিয়ে গেছে৷

কুলদীপদের ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেল৷ ওরা রাজীবকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘দাঁড়া, দেখছি কী করা যায়৷ তুই চিন্তা করিস না৷’

সব শুনে অচ্যুত বলল, ‘অমিয়স্যার তো আমাকে ছুটির পর ডেকেছেন৷ তখন আমি স্যারকে বলব৷ হেডস্যারকে যেন রিকোয়েস্ট করেন—যাতে গার্জেন কল না হয়৷’

অচ্যুতের কথায় রাজীব তেমন ভরসা পেল বলে মনে হল না৷

চারটে বেজে দশমিনিটে বানজারা ছুটির ঘণ্টা বাজাল৷

বই-খাতা গুছিয়ে নিয়ে নানান ক্লাসের ছেলের দল পিলপিল করে বেরিয়ে এল ক্লাসরুমের বাইরে৷ তারপর স্কুল-বাড়ি ছেড়ে মাঠে নেমে এল ‘সাদা জামা কালো প্যান্টের’ ভিড়৷ সেখান থেকে সদরের লোহার গেট৷ আবার গেট পেরিয়ে রাস্তা৷

আকাশ মেঘে কালো হয়ে এসেছে৷ এখনই বোধহয় আবার বৃষ্টি নামবে৷

স্কুলের মাঠের একপাশে সারে-সারে দাঁড় করানো সাইকেল৷ এক ঝাঁক ছেলে হইহই করে ছুটল সাইকেলের দিকে৷ নীচু ক্লাসের কয়েকটা ছেলে জল-কাদাভরা মাঠে ছুটোছুটি করে খেলতে লাগল৷ মাঠের এখানে-ওখানে জমে থাকা জলের ওপর পা ফেলে দাপিয়ে ছুটে গিয়ে কাদা-জল ছিটকে দিতে লাগল চারপাশে৷

সদরের গেটের বাইরে বাবা-মায়েদের ভিড়৷ তাঁদের চোখ সাদা-কালো পোশাকের ভিড়ে নিজের-নিজের ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে৷

স্কুল ছুটির সময় এই ভাঙাচোরা সরু রাস্তাটা সাইকেল, সাইকেল রিকশা আর স্কুটারে ছয়লাপ হয়ে যায়৷ যানজট চলে অন্তত আধঘণ্টা৷ এখন, বর্ষার সময়, তাই অবস্থা একেবারে বেহাল৷

স্কুল ছুটি হয়ে গেলেও অচ্যুতরা কয়েকজন ক্লাস থেকে বেরোয়নি৷ অমিয়স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে রাজীবের ব্যাপারে অচ্যুত ঠিক কী কী বলবে তাই নিয়েই জল্পনা-কল্পনা চলছিল৷ রাজীব কুলদীপ-অচ্যুতদের হাত ধরে একেবারে কেঁদে পড়ল : ‘তোরা আমাকে যেভাবে হোক সেভ কর৷’ প্রায় আধঘণ্টা পর ওরা ক্লাসরুম থেকে বেরোল৷

কুলদীপরা সবাই চলে গেল৷ পিঠে বই-খাতার ব্যাগ ঝুলিয়ে অচ্যুত একা রওনা হল টিচার্স রুমের দিকে৷ যাওয়ার আগে ও কুলদীপকে বলল, ‘রাজীবের ব্যাপারে অমিয়স্যারের সঙ্গে কী কথা হল আমি তোকে রাতে ফোন করে জানাব৷ টা-টা!’

অচ্যুত খেয়াল করেনি কখন যেন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে৷ একটু আগের হুল্লোড় হইচই থেমে গিয়ে এখন সব একেবারে নিঝুম! শুধু বৃষ্টি ঝিরঝির করে পড়ছে৷ বাইরে কলাগাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটার টপটপ শব্দ হচ্ছে৷ দূর থেকে সাইকেল রিকশার ‘প্যাঁকপ্যাঁক’ ডাক শোনা যাচ্ছে৷ আর কখনও-কখনও মেঘের ‘গুডুম-গুডুম’৷

ছুটির পর স্কুল থেকে সবাই চলে যায়৷ তখন বানজারা স্কুলের সব ঘর ঘুরে-ঘুরে আলো আর পাখা অফ করে, দরজায়-দরজায় তালা দেয়৷ তারপর স্কুল বিল্ডিং-এর কোলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে নিজের ঘরে যায়৷ ওর ছোট্ট ঘর স্কুল-বাড়ির লাগোয়া, অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া৷ পাশেই একটা টিউবওয়েল৷ আর তাকে ঘিরে নানান গাছপালা৷ বর্ষায় সেগুলো সব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে৷

টিউবওয়েল থেকে একটু দূরেই একটা ছোট গোয়ালঘর৷ সেখানে বানজারার পোষা গোরু রামুয়া আর ছোট একটা বাছুর আছে৷ ওরা বেশির ভাগ সময়েই মাঠে ঘুরে বেড়ায়, ঘাস-পাতা খায়৷

বানজারা বউ নিয়ে থাকে৷ ওর বউ স্কুলের সুইপারের কাজ করে৷ সবসময় পান খায়, আর মাথায় ঘোমটা টেনে থাকে৷

টিচার্স রুমের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় অচ্যুতের বুটজুতোর খটখট শব্দ করিডরে কেমন যেন ফাঁপা প্রতিধ্বনি তুলছিল৷ একতলা থেকে দরজা বন্ধ করার শব্দ শোনা যাচ্ছিল৷ বানজারা ওর কাজ শুরু করে দিয়েছে৷

টিচার্স রুমের কাছে এসে অচ্যুত অবাক হয়ে গেল৷ ঘর খাঁ-খাঁ করছে৷ কেউ নেই৷

ঘরে আলো জ্বলছে, পাখা ঘুরছে৷ খোলা জানলা দিয়ে ঘোর কালো মেঘ, গাছপালা আর বৃষ্টি চোখে পড়ছে৷ দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের পাতা হাওয়ায় উড়ছে৷

তা হলে কি বৃষ্টি আসার ভয়ে অমিয়স্যার একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছেন?

এমন সময় একটা শব্দ অচ্যুতের কানে এল৷

মেঝেতে খুচরো পয়সা পড়ে যাওয়ার শব্দ৷

টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ সরু করে নজর ধারালো করল অচ্যুত৷ সামান্য কুঁজো হয়ে টেবিলের নীচ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল৷

খুচরো পয়সা কোথায় পড়ল? কার পকেট থেকে পড়ল?

ঝুঁকে পড়ে নীচু হতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল অচ্যুত৷

সত্যবানস্যার দেওয়ালের গায়ে টিকটিকির মতো হেঁটে বেড়াচ্ছেন!

মেঝে থেকে অন্তত হাতদুয়েক ওপরে মেঝের সঙ্গে সমান্তরালভাবে স্যারের শরীরটা আঠার মতো আটকে রয়েছে৷ ঠিক সাঁতার দেওয়ার ভঙ্গিতে তিনি এগিয়ে চলেছেন৷

এরকম একটা মজার দৃশ্য দেখে অচ্যুতের হাসি পাওয়ার কথা৷ কিন্তু ও ভয় পেল৷ ওর হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল, বুকের ভেতরে বাতাস আটকে গেল৷ কারণ, সত্যবানস্যারের মুখে এক অদ্ভুত নিষ্ঠুর উল্লাস৷ ঠোঁটজোড়া লাল টুকটুক করছে, চোখে এক অলৌকিক সবুজ আলো৷

আর ঠিক তখনই কড়-কড়-কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ল কোথাও৷ অচ্যুত চমকে উঠল৷ ওই অবস্থাতেও ও বুঝতে পারল খুচরো পয়সাগুলো স্যারের পকেট থেকেই পড়েছে৷

এরকম একটা বিচিত্র ভয়ংকর দৃশ্য অচ্যুতকে পাগল করে দিল৷ ও হেঁচকি তুলে শ্বাস টানল, বুক ভরে বাতাস নিতে চাইল৷ তারপরই ছুট লাগাল দোতলার বারান্দা ধরে৷ ওর বুটের শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল কোনও পাগলা ঘোড়া মৃত্যুভয়ে ছুটে পালাচ্ছে৷

অচ্যুত যদি পিছন ফিরে তাকাত তা হলে দেখতে পেত সত্যবানস্যার ওর হেঁচকির শব্দে দেওয়ালের গা থেকেই মুখ ফিরিয়ে তাকিয়েছেন৷ সবুজ আগুনভরা চোখে ওর ছুটে পালানো দেখছেন৷

আর স্যারের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রহস্যময় হাসি৷

.

৷৷তিন৷৷

পরদিন সাইকেল চালিয়ে স্কুলের গেটে পৌঁছে অচ্যুতের মনে হচ্ছিল গতকাল ও যা দেখেছে সবটাই স্বপ্ন—অথবা দুঃস্বপ্ন৷

রং-চটা সীমানা-পাঁচিলের গায়ে বসানো জং-ধরা লোহার গেটের একটা পাল্লা খোলা৷ অচ্যুত সাইকেল থেকে নেমে পড়ল৷ তারপর সাইকেলটা হাঁটিয়ে ভেতরে ঢুকল৷

মাঠের এখানে-সেখানে বৃষ্টির জল জমে রয়েছে৷ মাঝখানের খানিকটা ফাঁকা জায়গা বাদ দিলে মাঠের বাকি অংশে বড়-বড় ঘাস আর আগাছা৷ এ ছাড়া পাঁচিলের ধার ঘেঁষে কয়েকটা বট, অশ্বত্থ, কদম, কৃষ্ণচূড়া, দেবদারু গাছ৷ আর প্রকাণ্ড জামগাছটা আছে বানজারাদের ঘরের কাছাকাছি৷ গরমকালে পাকা জাম পড়ে-পড়ে গাছের নীচটা বেগুনি হয়ে থাকে৷ গাছটার নীচে বসার জন্য কয়েকটা সিমেন্টের বেদি আছে৷

বৃষ্টি না হলে এই মাঠেই স্কুলের প্রেয়ার হয়৷ আর বৃষ্টি হলে যার-যার ক্লাসরুমে৷

মাঠের বাঁদিকে একটা দোলনা আর স্লিপ—নীচু ক্লাসের ছেলেদের খেলার জন্য৷ আর তার পিছনেই সাইকেল রাখার জায়গা৷

সাইকেল রেখে অচ্যুত স্কুল-বাড়ির দিকে এগোল৷

বড় মাপের ছড়ানো দোতলা বাড়ি৷ তার পলেস্তারা-খসা রং-চটা চেহারার দিকে খুব খুঁটিয়ে নজর করলে বোঝা যায় একসময়ে বাড়িটার রং গোলাপি ছিল৷

স্কুল-বাড়ির একতলার দেওয়ালে তেল রঙে বড়-বড় করে আঁকা মনীষীদের রঙিন ছবি৷ বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিবেকানন্দ, রামমোহন, সবাই সেখানে হাজির৷ বৃষ্টির জলে ধোয়া ছবিগুলো ঝকঝক করছে৷

ওঁদের ছবির দিকে তাকিয়ে সত্যবানস্যারের ব্যাপারটা অচ্যুত কিছুতেই সত্যি বলে মেনে নিতে পারছিল না৷

গায়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তেই আকাশের দিকে তাকাল অচ্যুত৷ আবার শুরু হল৷ এবার পুজোয় বৃষ্টির পিছু ছাড়াতে পারলে হয়৷ ও একতলার বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির ধাপের দিকে এগোল৷

বানজারার ঘণ্টার পর ক্লাস শুরু হল বটে তবে অচ্যুত ভীষণ আনমনা হয়ে রইল৷ গতকালের ঘটনাটা ওর বুকের ভেতরে ঘুরপাক খেয়ে মাথা খুঁড়ে মরছিল৷

প্রথম পিরিয়ডের ঘণ্টা পড়তেই ও চমকে উঠল৷ কারণ, সেকেন্ড পিরিয়ডটা অঙ্কের—সত্যবানস্যারের ক্লাস৷

অচ্যুত কুলদীপের দিকে তাকাল৷ কুলদীপ দুটো সারি পিছনে বসে৷ ওর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই কুলদীপ ইশারা করল৷ যার অর্থ, এক্ষুনি স্যাটাস্যাট আসছেন৷

এখনও পর্যন্ত অচ্যুত শুধু কুলদীপকেই ঘটনাটা বলেছে৷ আর কাউকে নয়৷ এমনকী বাপি-মা-কেও নয়৷

সত্যবানস্যার ক্লাসে এসে ঢুকলেন৷

টকটকে ফরসা রং৷ পিছনদিকে টেনে আঁচড়ানো তেলচকচকে চুল৷ চোখে সরু কালো ফ্রেমের চশমা৷ গাল সামান্য ভাঙা—চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে রয়েছে৷ লম্বাটে নাকের নীচে সরু গোঁফ৷ গালে দাড়ির নীলচে আভা৷

সত্যবানস্যারের পরনে সাদা হাফশার্ট আর গাঢ় বাদামি প্যান্ট৷ চেহারা বেশ রোগা হওয়ায় প্যান্টটা ঢলঢল করছে৷ গতকাল স্যার এই পোশাকই পরেছিলেন৷

অচ্যুত খুব খুঁটিয়ে স্যারকে দেখছিল৷ অঙ্ক করতে-করতে মাঝে-মাঝেই কেমন আনমনা হয়ে যাচ্ছেন আর জিভ বের করে ঠোঁটজোড়া চেটে নিচ্ছেন৷ তেষ্টা পেলে মানুষ যেমন করে৷

কিন্তু এরপরই এক অবাক কাণ্ড হল৷

বীজগণিতের অনুপাত আর সমানুপাতের কুড়ি প্রশ্নমালার অঙ্কগুলো বোর্ডে স্যার বোঝাচ্ছিলেন৷ সেই অঙ্ক হঠাৎই আটকে গেল!

অচ্যুত যতদূর জানে সত্যবানস্যারের অঙ্ক কখনও আটকায়নি৷ কিন্তু আজ এ কী কাণ্ড!

সত্যবানস্যার বোর্ডের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে মাথা চুলকোতে লাগলেন৷ আঙুলে ধরা চকটা শূন্যে ঘুরিয়ে মনে-মনে যেন অঙ্কটা কষে ফেলতে চাইলেন৷

অচ্যুতের মনে পড়ে গেল গতকালের কথা৷ টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে সত্যবানসার একজন অচেনা মানুষের মতো ওদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন৷ তারপর স্কুল ছুটির পর টিচার্স রুমের দেওয়ালে ওই কাণ্ড! আর এখন, বরাবর যিনি স্যাটাস্যাট অঙ্ক করেন, তাঁর অঙ্ক গেছে আটকে!

স্যারের কি তা হলে কিছু হয়েছে?

সত্যবানস্যার অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর চেয়ারে বসে পড়লেন৷ অঙ্ক কষা নিয়ে এলোমেলো ধানাইপানাই করে চললেন৷ তারপর, ক্লাস শেষ করে চলে যাওয়ার সময়, কুলদীপকে বললেন, ‘কুলদীপ, তোরা কাল সন্ধেবেলা তো কোচিং-এ আসছিস, তখন ভালো করে এটা বুঝিয়ে দেব৷’

অচ্যুত, কুলদীপ, প্রতীক, রাজীব আর সৌরভ সত্যবানস্যারের কোচিং-এ একই ব্যাচে পড়ে৷ স্যারের বাড়ি নৈহাটি৷ তবে প্রতিদিন স্কুলের পর কোচিং সেরে রাতের ট্রেন ধরেন৷ তবে কখনও-কখনও রাত হয়ে গেলে কোচিং-এর ঘরটাতেই থেকে যান৷

পরের দুটো পিরিয়ড অচ্যুতের আর কাটতে চাইছিল না৷ ও ভাবছিল, কতক্ষণে টিফিন হবে আর ও কুলদীপকে নিয়ে আলোচনায় বসবে৷

গতকাল বাড়ি ফিরে পড়াশোনায় মন বসাতে পারেনি অচ্যুত৷ সত্যবানস্যারের দেওয়ালে হাঁটার দৃশ্যটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল৷ একটা লতানে গাছ যেন সাপের মতো এঁকেবেঁকে সড়সড় করে বেড়ে চলেছে৷

লেখাপড়ার চেষ্টা ছেড়ে টিভিতে ই. এস. পি. এন. আর স্টার স্পোর্টস চ্যানেল দেখতে বসে গিয়েছিল, কিন্তু স্যার টিভির পরদাতেও হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন৷

মা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ সরু করে ওকে দেখছিল৷ অনেকক্ষণ দেখার পর কাছে এসে জিগ্যেস করল, ‘তোর কী হয়েছে রে?’

‘কিচ্ছু না৷’ অচ্যুত মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারল না৷ শূন্য দৃষ্টিতে টিভির পরদার দিকে চেয়ে রইল৷

‘তখন থেকে দেখছি কেমন উসখুস করছিস?’

কোনও জবাব দিল না অচ্যুত৷

‘স্কুলে ঝগড়া-মারপিট করেছিস?’

‘না৷’ মাথা নাড়ল অচ্যুত৷ টিভির দিক থেকে চোখ সরাল না৷

মা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল৷ ছেলের মনের ভেতরটা বুঝতে চেষ্টা করল৷ তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরে গেল রান্না-ঘরের দিকে৷ ভাবল অচ্যুতের বাবা এলে ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলবে৷ ছেলে বড় হচ্ছে৷ স্কুলে কী সমস্যা বাধিয়ে এসেছে কে জানে!

অচ্যুতের বাবা এখন বাড়িতে নেই৷ অফিস থেকে ফিরে বটতলার মিষ্টির দোকানের কাছে তাসের আড্ডায় মেতে আছে৷ ফিরতে-ফিরতে রাত দশটা৷

অচ্যুত যখন টিভি, রেডিয়ো, ওয়াকম্যান, বারান্দা, এ-ঘর, ও-ঘর করে ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে গিয়ে পড়ার টেবিলে বসেছে, ঠিক তখনই কুলদীপের ফোন এল৷

অচ্যুত ফোন করেনি দেখে কুলদীপই ওকে ফোন করেছে৷

নীচুগলায় ওর সঙ্গে কথা বলল অচ্যুত৷

বলল, অমিয়স্যারের দেখা পায়নি৷ আর সত্যবানস্যারকে ওইরকম করতে দেখেছে৷

কুলদীপ ও-প্রান্তে শিস দিয়ে উঠল, বলল, ‘কীসব যা-তা বলছিস!’

অচ্যুত বলল, ‘মা-কালীর দিব্যি—৷’

কুলদীপ আবার চাপা শিস দিল৷ উত্তেজিত হয়ে উঠলে ও শিস দেয়৷ আর মেজাজ ভালো থাকলে শিস দিয়ে গান শোনায়৷

অচ্যুত এলোমেলোভাবে ওকে সব খুলে বলল৷ জট পাকানো হলেও গোটা গল্পটা বুঝতে কুলদীপের অসুবিধে হল না৷ সব শোনার পর ও বিড়বিড় করে শুধু বলল, ‘স্যাটস্যাট আগের জন্মে বোধহয় টিকটিকি ছিল…’

কুলদীপের রসিকতায় অচ্যুতের হাসি পেল না৷ ওর মনে পড়ল, টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ওর হাত-পা ঠকঠক করে কেঁপেছিল৷

টিফিনের ঘণ্টা পড়তেই অচ্যুতের চমক ভাঙল৷

ক্লাসের অন্যান্য ছেলে বই-খাতা ডেস্কে ঢুকিয়ে হুড়মুড় করে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে পড়ল৷ করিডরে ওদের হুটোপাটি ছুটোছুটিতে হুল্লোড় বেধে গেল৷ কার টিফিন বক্স ছিটকে পড়ল মেঝেতে৷ ঠং করে আওয়াজ হল৷ লুচি আর আলুভাজা ছড়িয়ে পড়ল৷ বুট পরা ছুটন্ত পা-গুলো নিমেষে সেগুলো মাড়িয়ে চলে গেল৷ কারও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই৷ কতক্ষণে নীচের মাঠে গিয়ে পৌঁছবে সেই চিন্তায় সব মশগুল৷

কুলদীপ আর অচ্যুত বেরোল সকলের শেষে৷ ওদের হাতে টিফিন বক্স৷

সিঁড়ি দিয়ে নামার মুখে রাজীব দাসের সঙ্গে ওদের দেখা হল৷ মুখ কালো করে এক পা এক পা করে নামছে৷

গতকাল অমিয়স্যারের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় হেডস্যারকে ম্যানেজ করার ব্যাপারটা ভেস্তে গেছে৷ অচ্যুত রাজীবকে সেটা বলতেই ও কাচুমাচু মুখ করে বলল, ‘আমি স্কুলে এসেই হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করেছি৷ বলেছি, আজ মাম্মি আর বাপি কলকাতায় গেছে, কাল এসে দেখা করবে৷ বিপদে পড়ে মিছে কথা বলতে হল৷ তোরা আমাকে সেভ কর৷ তোরা আজ অমিয়স্যারকে একটু বল—প্লিজ! আচ্ছা, মানুষের কি ভুল হয় না?’

রাজীবের চোখে জল এসে গেল৷

কুলদীপ বলল, ‘অ্যাই, বাংলা সিনেমার লাস্ট সিনের মতো কাঁদবি না৷ আজ তোর ব্যাপারটা ফয়সালা করে দেব৷ এখন টিফিন খেয়ে বল খেল গিয়ে৷’

অচ্যুত আর কুলদীপ জামগাছতলার সিমেন্ট বাঁধানো বেদির ওপরে গিয়ে বসল৷ প্রতীক ওদের কাছে বসতে এসেছিল, কিন্তু কুলদীপ ওকে বলল, ‘কিছু মনে করিস না—অচ্যুতের সঙ্গে আমার একটু প্রাইভেট টক আছে৷’

প্রতীক সন্দেহের চোখে কুলদীপকে দেখল৷ আজকাল ওকে মাঝে-মাঝেই ‘কমলাবালা গার্লস হাইস্কুল’-এর গেটের কাছে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে৷ সে-ব্যাপারে প্রাইভেট কথা কি না কে জানে!

কিছু না বলে প্রতীক ভুরু উঁচিয়ে ঘাড় নেড়ে চলে গেল৷

মিহি বরফের গুঁড়োর মতো বৃষ্টি পড়ছে৷ বাদলা হাওয়ায় সেই গুঁড়ো মুখে উড়ে এসে আরাম ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ মেঘের চাপা গুড়গুড় শোনা যাচ্ছে কখনও-কখনও৷ একটু দূরে, স্কুলের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে, বানজারার গোরু রামুয়া আর তার বাছুর আপনমনে ঘাস খাচ্ছে৷

দুজনের টিফিন মিলিয়ে-মিশিয়ে খেতে-খেতে কুলদীপ বলল, ‘স্ট্রেটকাট বল তো, স্যাটাস্যাটের এগেইনস্টে কী অ্যাকশন নিতে চাস?’

অচ্যুত কুলদীপের চোখে তাকাল : ‘অ্যাকশন নেব কী, ব্যাপারটা ঠিক কী, সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না৷’

‘স্যাটাস্যাটকে একটু ওয়াচ রাখতে হবে৷’

‘যদি আমাকে ধরে কিছু বলে?’ অচ্যুতের বুকের ভেতরে কেমন যেন শব্দ হচ্ছিল৷

‘ধুস, কী আর বলবে! বলবে যে, আমি দেওয়াল বেয়ে টিকটিকির মতো হাঁটছিলাম! তুমি কিছু মাইন্ড কোরো না৷…তা ছাড়া তোকে তো আর একা পাচ্ছে না যে বলবে!’

অচ্যুতের মুখ দেখে মনে হল না খুব ও একটা ভরসা পেয়েছে৷ ও চুপচাপ বসে বর্ষাভেজা প্রকৃতি দেখতে লাগল৷

কিছুক্ষণ পর কুলদীপ তাড়া লাগাল, ‘চল, অমিয়স্যারের সঙ্গে দেখা করে তারপর ক্লাসে যাব৷ রাজীবের ব্যাপারটা আগে বলা দরকার৷ নইলে ওর প্রবলেম হয়ে যাবে৷’

বেদি ছেড়ে ওঠার সময় অচ্যুত বলল, ‘সত্যবানস্যারের কেসটা কিন্তু কাউকে বলিস না৷’

কুলদীপ মাথা নেড়ে সায় দিল৷

মনিটর বাসব আর প্রতীককে সঙ্গে নিয়ে অচ্যুত আর কুলদীপ টিচার্স রুমে গেল৷ অমিয়স্যারকে অনেক করে বলে-কয়ে ওরা রাজীবের গার্জেনকল ঠেকাল৷ অমিয়স্যার অচ্যুতকে বললেন, ‘অ্যাই, তোর বাংলা খাতাটা আমার দেখা হয়ে গেছে৷ এত বানান ভুল করিস কেন রে? অভিধান অবলোকন করবি৷ ছুটির পর এসে খাতাটা নিয়ে যাস৷ কাল বর্ষণের জন্যে আমি একটু আথিবিথি বেরিয়ে গিয়েছিলাম৷’

আবার সেই ‘ছুটির পর’! তার ওপর আবার ‘আথিবিথি’! অমিয়স্যারের সঙ্গে পরিচয় না হলে অচ্যুত কোনওদিন জানতেই পারত না ওর মাতৃভাষায় এত মারপ্যাঁচ আছে৷

অচ্যুতের চোখ অনেকক্ষণ ধরেই চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছিল৷ স্যারদের বসার বিশাল টেবিলের শেষ প্রান্তে সত্যবানস্যার বসে আছেন৷ কী একটা বইয়ের পাতায় ডুবে আছেন৷ চারপাশের জগৎ সম্পর্কে কোনও হুঁশ নেই৷

অচ্যুত অমিয়স্যারের কথার ওপরে কথা বলতে পারল না৷ শুকনো মুখে ঘাড় নাড়ল৷ ছুটির পরই ও স্যারের সঙ্গে দেখা করতে আসবে৷

টিফিন শেষের ঘণ্টা একটু আগেই বেজেছে৷ ওরা চারজন তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ক্লাসে ফিরে চলল৷

অচ্যুতের মনে অশান্তির ঝড় দ্বিগুণ হয়ে গেল৷ ও কি স্যারের সঙ্গে দেখা করতে একা যাবে, নাকি কুলদীপ, বাসব, কিংবা সৌরভকে সঙ্গে নিয়ে যাবে? কিন্তু সঙ্গে কাউকে নিয়ে গেলে অমিয়স্যার বিরক্ত হতে পারেন৷ তা ছাড়া টিচার্স রুমে সত্যবানস্যার তো ওকে আর একা পাচ্ছেন না!

সুতরাং ছুটির ঘণ্টা পড়তে-না-পড়তেই অচ্যুত পা চালাল টিচার্স রুমের দিকে৷ দেরি করে গেলে টিচার্স রুম ফাঁকা হয়ে যেতে পারে৷ সেই ঝুঁকি অচ্যুত নিতে চায় না৷

টিচার্স রুমে গিয়ে দেখল অমিয়স্যার ছাড়া আরও অনেক স্যারই তখন সেখানে রয়েছেন৷ যদিও সত্যবানস্যারকে অচ্যুত দেখতে পেল না৷

অনুমতি নিয়ে অমিয়স্যারের কাছে গেল অচ্যুত৷ স্যারের কাছ থেকে খাতা নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে করিডর ধরে হাঁটা দিল৷

সিঁড়ি নামার সময় ওর কাঁধে কে যেন হাত রাখল৷

মুখ তুলে তাকাল অচ্যুত৷

সত্যবানস্যার৷ মুখে এক চিলতে হাসি৷ জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁট চাটছেন৷

আশেপাশে আরও কয়েকজন ছেলে সিঁড়ি বেয়ে নামছে৷ কিন্তু ওরা নিজেদের মধ্যে গল্প করতেই মশগুল৷

সত্যবানস্যার ওর সঙ্গে-সঙ্গে নামতে লাগলেন, আর চাপা গলায় কথা বলতে লাগলেন৷

‘জানিস তো, মানুষ অনেক সময় ভুল দ্যাখে! যেমন, তুই কাল বিকেলে যা দেখেছিস ভুল দেখেছিস৷ কারণ, তুই যা দেখেছিস সেটা প্রমাণ করতে পারবি না৷ আর প্রমাণ দিতে না পারলে কেউ তোর কথা বিশ্বাসও করবে না৷’ স্যার হিসহিস শব্দ করে হাসলেন : ‘এখন বিজ্ঞানের যুগ৷ সবাই শুধু প্রমাণ চায়৷’

গলা শুকিয়ে কাঠ৷ কাঁধের ওপরে স্যারের আঙুলের চাপে ব্যথা লাগছে৷ মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে৷ অচ্যুতের মনে হচ্ছিল এখুনি বুঝি ও অজ্ঞান হয়ে যাবে৷

একতলায় নেমে সত্যবানস্যার বাঁদিকে কয়েক পা হেঁটে গেলেন৷ ক্লাস ফাইভের বি সেকশানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন৷

অচ্যুত কাঠের পুতুলের মতো স্যারের পাশে-পাশে হাঁটছিল৷ স্যার থমকে দাঁড়াতেই ও-ও দাঁড়িয়ে পড়ল৷

এদিকের বারান্দাটা এর মধ্যেই ফাঁকা হয়ে গেছে৷ সুতরাং ওদের কথা শুনতে পাবে কাছাকাছি এমন কেউ নেই৷

ক্লাসরুমের দরজার কাছটায় অচ্যুতকে একরকম ঠেলেই নিয়ে গেলেন সত্যবানস্যার৷ চাপা গলায় বললেন, ‘শোন, কাউকে কোনও কথা বলবি না৷ অবশ্য বললেও কেউ আমল দেবে না৷ ওরে, মানুষের কি ভুল দেখার কোনও শেষ আছে! এই দ্যাখ—!’ বলেই স্যার অচ্যুতের চোখে তাকালেন৷

অচ্যুত দেখল, সেখানে ধকধক করছে দুটো সবুজ টুনি বালব৷ আর তার মধ্যে দুটো কালো ফুটকি হল চোখের মণি৷

‘এটাও তুই ভুল দেখছিস৷’ মিহি সুরেলা গলায় সত্যবানস্যার বললেন, ‘কারণ, তুই এটা প্রমাণ করতে পারবি না৷ সুতরাং তোর কথা কেউ বিশ্বাস করবে না৷’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সত্যবানস্যার৷ তার হিমেল ঝাপটা অচ্যুতের মুখ ছুঁয়ে গেল৷ অচ্যুতের গায়ে কাঁটা দিল৷

ও লক্ষ করল, স্যারের চোখের সবুজ রং ধীরে-ধীরে ফিকে হয়ে সাদাটে হয়ে গেল৷ তারপর সামান্য ছাই-রং হয়ে কটা চোখের চেহারা নিল৷ তারপর কালচে হয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল৷

সত্যবানস্যার হাসলেন, ‘তুই কাউকে কিচ্ছু বলবি না! কারণ, তুই আসলে কিছুই দেখিসনি৷ কাল সন্ধেবেলা কোচিং-এ আসবি, কামাই করবি না৷ ভাবিস না, তুই পালিয়ে বাঁচবি৷ আমাদের হাত থেকে পালানো যায় না—৷’

অচ্যুত ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিল৷ ওর মুখ থেকে কোনও শব্দ বেরোল না৷ কাঁধের ওপর স্যারের বাঁকানো আঙুলের চাপ যেন ছুরি বিঁধিয়ে দিচ্ছিল৷

‘এখন যা৷’ সত্যবানস্যার ওর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ওকে আলতো করে ঠেলে দিলেন : ‘তুই কিন্তু কিছুই দেখিসনি—৷’

অচ্যুত আর-একটু হলে টলে পড়ে যাচ্ছিল৷ কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ও মাঠে নামার সিঁড়ির ধাপের দিকে এগোল৷ ভয়ে পিছন ফিরে তাকাতে পারল না৷

জল-কাদা পেরিয়ে যখন ও সাইকেল-স্ট্যান্ডের কাছে পৌঁছল তখন প্রতীক ওকে পিছন থেকে ডাকল৷

অচ্যুত ফিরে তাকাতেই প্রতীক জিগ্যেস করল, ‘তোকে স্যাটাস্যাট ওরকম হাসতে-হাসতে কী বলছিল রে?’

‘কিছু না৷ কাল কোচিং-এর খাতা-বই ঠিকমতো নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিল৷’ অচ্যুতের গলা সামান্য কেঁপে গেল৷

‘তোকে স্যার হেভি ফেভার করে৷’ বেজার মুখে বলল প্রতীক, ‘অবশ্য ফেভার তো করবেই! তুই অঙ্কে একশোয় একশো পাস, আর আমার নম্বরটা চার কি পাঁচ দিয়ে গুণ করলে তবে একশো হয়৷ তবে অঙ্ককে আমি মোটেই ভয় পাই না৷ পারি-না-পারি, লড়ে যাই৷’

অচ্যুত হাসতে পারল না৷

কারণ, সত্যবানস্যারের একটা কথা বারবার ওর মনে কাঁটার মতো বিঁধছিল৷

বাড়ি ফিরেও ওর খচখচানিটা গেল না৷

স্যার বলেছেন, ‘…আমাদের হাত থেকে পালানো যায় না—৷’

এর মানে কী?

.

৷৷চার৷৷

অচ্যুত রাতে কুলদীপ আর সৌরভকে ফোন করল৷ পড়াশোনা নিয়ে কথা বলল, কোচিং নিয়ে কথা বলল, কিন্তু সত্যবানস্যারের কথা বলল না৷ বরং কুলদীপ উৎসাহ নিয়ে সত্যবানস্যারের রহস্য ভেদ করার ব্যাপারে নানান উদ্ভট পরামর্শ দিল৷ বলল, ‘স্যারকে ফলো করতে হবে, বুঝলি! সবসময় নজরে-নজরে রাখতে হবে৷ তা হলেই কেসটা বোঝা যাবে৷’

অচ্যুত তখন ভাবছিল, কুলদীপ তো আর স্যারের সবুজ চোখ দ্যাখেনি! দেখলে বোঝা যেত ওর এখনকার এত সাহস কতটা চুপসে যায়৷

রাতে বিছানায় শুয়ে অচ্যুত একরকম জেগেই রইল৷ ওর ভেতর থেকে ভয়টা কিছুতেই যেতে চাইছিল না৷ পরদিন স্কুলে যাওয়া নিয়ে সামান্য ভয় করলেও সেটা মা-বাপিকে বুঝতে দিল না৷ মনে-মনে ঠিক করল, স্কুলে কখনও ও আর একা থাকবে না৷ যেখানেই যাক, দু-একজন বন্ধুকে সঙ্গে নেবে৷ এমনকী টয়লেটে গেলেও৷

স্কুলের সময়টা শান্তিমতোই কেটে গেল৷ তবে একবার সত্যবান-স্যার করিডরে অচ্যুতের পাশ দিয়ে হেঁটে গেছেন—কিন্তু ওকে চিনতে পারেননি৷

অচ্যুতের সঙ্গে প্রতীক ছিল৷ পরশুদিন সত্যবানস্যারের এরকম অদ্ভুত আচরণ ও নিজের চোখে দেখেছে৷ স্যার চলে যাওয়ার পর ও চাপা গলায় বলল, ‘যা-ই বল, স্যাটাস্যাট কিন্তু একেবারে চেঞ্জ হয়ে গেছে!’

অচ্যুত চুপ করে রইল৷ এই দেড় দিনে চুপ করে থাকাটা ওর দিব্যি অভ্যেস হয়ে গেছে৷

স্কুল ছুটির পর একটা বিচিত্র দৃশ্য অচ্যুতের চোখে পড়ল৷ ওরা যখন বেরোচ্ছে তখন দেখল সত্যবানস্যার মাঠের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বানজারার গোরু আর বাছুরকে আদর করছেন৷ ওদের গলার কাছে কুঁচি দেওয়া যে নরম চামড়া থাকে—যাকে গলকম্বল বলে—সেখানে হাত বোলাচ্ছেন৷ আর অবোলা জীব দুটো চুপটি করে দাঁড়িয়ে স্যারের আদর খাচ্ছে৷

গোরু-বাছুরকে আদর করা নিশ্চয়ই খারাপ নয়৷ কিন্তু সত্যবানস্যারকে আগে কখনও কেউ এরকম আদর করতে দ্যাখেনি৷

সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরার পথে নানান দুশ্চিন্তা অচ্যুতের মাথার ভেতরে ছোটাছুটি শুরু করে দিল৷

ঘণ্টাদুয়েক পর যখন ও সত্যবানস্যারের কোচিং-এ রওনা হল তখনও চিন্তাগুলো ওর মাথা থেকে যায়নি৷

আকাশ ঘোলাটে মেঘলা৷ ভেজা মেঘের আড়ালে আবছাভাবে চাঁদ দেখা যাচ্ছে৷ বেহিসেবি বাদলা হাওয়া কখনও-কখনও গাছগাছালির পাতা দুলিয়ে দিচ্ছে৷ ভাঙাচোরা রাস্তায় এখানে-ওখানে জল-কাদার নকশা৷ দোকানপাটে খদ্দেরের তেমন ভিড় নেই৷

পথচলতি সাইকেল রিকশা আর স্কুটারকে পাশ কাটিয়ে সাবধানে সাইকেল চালাচ্ছিল অচ্যুত৷ সত্যবানস্যারের কোচিং-এ স্কুলের পাশ দিয়েই যেতে হয়৷ যাওয়ার সময় দেখল, অন্ধকারে ভূতের মতো দোতলা স্কুল-বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে৷ শুধু বানজারার ঘরে আলো জ্বলছে৷

কোচিং-এ পৌঁছে প্রথম-প্রথম একটা ‘কী হয়, কী হয়’ ভাব থাকলেও শেষ পর্যন্ত কোচিং-এর সময়টা বেশ স্বাভাবিকভাবেই কাটল৷ গত সপ্তাহের মতো তুখোড় পেশাদার ঢঙেই পড়ালেন সত্যবানস্যার৷ অচ্যুতের অঙ্ক কষার কেরামতিকে তারিফ করলেন, ওর পিঠ চাপড়ে দিলেন৷ প্রতিটা অঙ্ক বেশ সহজ করে সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন৷ মনোযোগ দিয়ে খাতা দেখে দিলেন৷ সব মিলিয়ে কোথাও কোনও ছন্দপতন নেই৷

তবে একটা ব্যাপারে সামান্য খটকা লাগল অচ্যুতের৷

রাজীবের অঙ্কের অবস্থা প্রতীকের মতোই৷ তার ওপর রাজীবের আবার অঙ্ক নিয়ে আতঙ্ক আছে৷ অঙ্ক কষতে গিয়ে ও ঘন-ঘন আটকে যাচ্ছিল৷ সত্যবানস্যার অনেকক্ষণ ধরে ওকে লক্ষ করছিলেন৷ তারপর ওর কাছে গিয়ে আলতো করে ঘাড়ে হাত বোলাতে লাগলেন : ‘চেষ্টা কর, ঠিক পারবি৷ পৃথিবীতে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়—৷’

রাজীবকে আজ যেন স্যার বড্ড বেশি যত্ন নিয়ে অঙ্ক দেখাচ্ছেন৷ আগে কখনও এই যত্ন অচ্যুতের চোখে পড়েনি৷ তার ওপর ঘাড়ে যেরকম মোলায়েম করে হাত বোলাচ্ছেন তাতে বানজারার গোরু-বাছুরকে আদর করার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল৷

অচ্যুত মনে-মনে নিজেকে ধমক দিল৷ আজকাল ওর কী হয়েছে! সবকিছুতেই শুধু খটকা লাগছে! একজন স্যার কি হঠাৎই স্নেহপ্রবণ হতে পারেন না?

কিন্তু ধমক খেয়েও অচ্যুতের মন মানতে পারছিল না৷ বরং ভাবছিল, হঠাৎ করে কেউ যদি দেওয়াল বেয়ে হাঁটতে শুরু করে তা হলে তার আচমকা স্নেহপ্রবণ হয়ে উঠতে বাধা কী!

কোচিং শেষ করে ফেরার সময় রাজীব বলল, ‘অচ্যুত, আমি তোর সঙ্গে যাব৷ আমাকে পরেশদার কেকের দোকানে নামিয়ে দিবি৷’

রাজীবের সাইকেল নেই৷ অ্যাক্সিডেন্ট হবে এই ভয়ে বাবা-মা কিনে দেননি৷

কুলদীপ কোচিং ক্লাস চলার সময় অনেকবার অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে ইশারা করেছে৷ ঠোঁট উলটে মাথা নেড়েছে৷ অর্থাৎ, সন্দেহজনক কিছু নজরে পড়ছে না৷

অচ্যুত কোনও উত্তর দেয়নি৷

কোচিং-এর বাইরে বেরিয়ে অচ্যুতের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কুলদীপ বলল, ‘ধৈর্য চাই, ধৈর্য৷ সহজে এ-রহস্যের জট খুলবে না৷’

অচ্যুত ‘হুঁ—’ বলে সায় দিল৷

ওর সাইকেলে সামনের রডে বসার সময় রাজীব জিগ্যেস করল, ‘আমাকে ক্যারি করতে পারবি তো? এই জল-কাদায় যদি ফেলে দিস তা হলে জামা-প্যান্টের বারোটা বেজে যাবে৷ তারপর মাম্মির হাজারটা কোশ্চেন—৷’

‘তোর কোনও ভয় নেই৷ আমি তিনমাস ধরে ডাবল ক্যারি করছি৷’

ওকে বসিয়ে নিয়ে অচ্যুত সাবধানে সাইকেল চালাতে লাগল৷

এখন বৃষ্টি নেই৷ তবে কখন শুরু হবে কেউ বলতে পারে না৷ কাগজে লিখেছে কোথায় যেন নিম্নচাপ হয়েছে—তার জন্যই নাকি এরকম বাজে অবস্থা৷

একটু পরেই ওরা স্কুলের কাছাকাছি চলে এল৷

স্কুলের একরকম পাশেই এক প্রকাণ্ড পুকুর৷ তার ঢালু পাড়ে বড়-বড় মানকচু গাছ আর আগাছার ঝোপ৷ নাম-না-জানা লতানে গাছের দল আধো-অন্ধকারে সাপের মতো জড়াজড়ি করে রয়েছে৷

পুকুরপাড়ের বেড়ে ওঠা আগাছার রমরমাকে রুখে দিয়েছে ছোট-ছোট চার-পাঁচটা দোকান৷ দরমা, বাঁশ আর চাটাই দিয়ে ঘেরা চা-সিগারেট-পান-বিড়ির দোকান৷ সেখানে হ্যারিকেন বা কুপির আলো জ্বলছে৷

দোকানগুলোর ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে অন্ধকার আর কচু পাতার কালো ছায়া৷ সেখান থেকে নানান সুরে ভেসে আসছে ব্যাঙের ডাক৷

পুকুর পেরিয়ে স্কুলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গোরুর ‘হাম্বা’ ডাক অচ্যুতের কানে এল৷

অচ্যুত বলল, ‘স্যাটাস্যাট আজ তোকে ব্যাপক আদর করছিল৷’

‘হ্যাঁ রে, আমিও তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি৷ অন্যদিন কীরকম বকুনি দেয়! বলে, বাপিকে রিপোর্ট করবে…৷’

‘এবার তুই অ্যানুয়ালে অঙ্কে এইট্টি পারসেন্ট পাবি৷’

‘ভ্যাট!’

‘দেখিস…৷’

পরেশদার কেকের দোকান এসে গিয়েছিল৷ অচ্যুত দোকানের কাছ ঘেঁষে সাইকেল থামাল৷ কাঁচা ড্রেনের ওপরে পাতা সিমেন্টের স্ল্যাবে ওর সামনের চাকা ঠেকে গিয়ে সামান্য ঝাঁকুনি লাগল৷

রাজীব সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াল : ‘কাল টিফিনের জন্যে কেক আর প্যাটিস কিনব৷’

অচ্যুত টিফিনে মায়ের হাতে তৈরি লুচি কিংবা পরোটা নিয়ে যায়—সঙ্গে আলুর তরকারি বা আলুভাজা৷ মাসে দু-একদিন কেক বা প্যাটিস৷ আর দু-তিন টাকা পকেটে থাকলে টিফিনের সময় স্কুলের দরজায় ভিড় করে দাঁড়ানো বিভিন্ন ‘ওলাদের’ কাছ থেকে ঝালমুড়ি, ঘুগনি বা বাদাম খায়৷

রাজীব হঠাৎ জিগ্যেস করল, ‘একটা সিগারেট টেস্ট করে দেখবি নাকি?’

‘না না—আমার ওসব ভালো লাগে না৷’

‘সেদিন কুলদীপ দু-চার টান দিয়েছিল৷ মন্দ নয়৷ জানিস তো, ও মাঝে-মাঝে স্মোক করে!’

‘জানি!’

রাজীব আবদারের গলায় বলল, ‘যাই বল, আজ এরকম বৃষ্টি-বাদলার দিন…একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছে৷ অচেনা দোকান থেকে কিনব৷ তারপর দুটো টফি খেয়ে বাড়ি যাব—কেউ গন্ধ পাবে না৷ তুই খাবি না—শিয়োর?’

অচ্যুত হেসে বলল, ‘না৷’

তারপর রাজীবকে টা-টা করে চলে গেল৷

রাজীব পরেশদার দোকানে ঢুকতে যাচ্ছে, এমন সময় পিছন থেকে কে যেন ওকে নাম ধরে ডাকল৷

ঘুরে তাকাল রাজীব৷

সত্যবানস্যার৷ সাইকেল পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ রাজীবের দিকে তাকিয়ে অল্প-অল্প হাসছেন৷

রাজীব স্যারের কাছে এগিয়ে গেল, ‘কিছু বলবেন, স্যার?’

‘হ্যাঁ৷ কী কিনবি কিনে নে, তারপর চল, যেতে-যেতে বলছি৷ তোর বাড়ি তো স্টেশনের দিকে৷ চল, তোকে বাড়ির কাছে নামিয়ে দেব৷’

‘সিগারেট খাওয়াটা ভোগে গেল’, মনে-মনে ভাবল রাজীব৷ স্যার যে পিছন-পিছন আসবেন তা ও কেমন করে জানবে! এরকম আগে কখনও হয়নি৷

কিন্তু রাজীব অবাক ভাবটা চেপে রাখল৷ ছোট্ট করে বলল, ‘একমিনিট ওয়েট করুন, স্যার, আমি এক্ষুনি আসছি৷’

তারপর ছুট্টে ঢুকে পড়ল পরেশদার দোকানে৷

পরদিন স্কুলে ঢুকে অচ্যুত দেখল বানজারার ঘরের সামনে অনেক ছাত্রের ভিড়৷ দু-একজন গার্জেন আর স্যারও দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে৷

সাইকেল জায়গামতো রেখে মাঠের কোণের দিকটায় ছুটে গেল অচ্যুত৷ ভিড় ঠেলে সরিয়ে ভেতরে ঢুকল৷

দৃশ্যটা দেখার আগেই বানজারার বউয়ের কান্না শুনতে পাচ্ছিল অচ্যুত৷ কাঁদছিল আর দেশোয়ালি ভাষায় বিলাপ করছিল৷ ওর কথার একটি বর্ণও অচ্যুত বুঝতে পারছিল না৷ শুধু ‘রামুয়া’ শব্দটা শুনতে পাচ্ছিল আর এটুকু বুঝতে পারছিল, ভালোবাসার কেউ মারা গেলে মানুষ এরকম বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে৷

বৃত্তের ভেতরে ঢুকে দৃশ্যটা দেখতে পেল অচ্যুত৷

রামুয়া আর ওর বাছুর মাটিতে পাশাপাশি পড়ে আছে৷ ওদের চোখ বোজা৷ বানজারার বউ ওদের ওপর শরীর এলিয়ে কাঁদছে৷

বানজারা একপাশে বেজার মুখে উবু হয়ে বসে ছিল৷ চোখ ছলছল৷ মাথাটা ডানহাতে ভর দিয়ে হেলানো৷

অচ্যুত অবাক হয়ে দেখল, রামুয়ার ধপধপে সাদা গলায় রক্তের দাগ৷ খানিকটা রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে৷ ওর বাছুরের দশাও তাই৷ ঠিক মনে হচ্ছে, কোনও হিংস্র জন্তু ওদের নরম গলায় কামড় দিয়েছে৷

কিন্তু এই সামান্য ক্ষত থেকে কি এতবড় মাপের একটা গোরু মরে যেতে পারে?

তা ছাড়া কোন জানোয়ারই-বা গোরুর গলায় এভাবে কামড়ায়? সাপ, নাকি কুকুর?

বানজারা এবং আশেপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের কথাবার্তার টুকরো জুড়ে গোটা গল্পটা মোটামুটি আঁচ করতে পারল অচ্যুত৷

আজ ভোর-রাতের দিকে গোয়ালঘর থেকে একটা ঝটাপটির শব্দ বানজারা শুনতে পায়৷ ব্যাপারটা কী বোঝার জন্য ও বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে৷ কিন্তু ততক্ষণে সব আবার চুপচাপ হয়ে গেছে৷ তখন বানজারা আর ঘর ছেড়ে বেরোয়নি৷ অনেক সময় রামুয়া আচমকা খেপে উঠে পা ছোড়াছুড়ি করে৷ ব্যাপারটা সেইরকম কিছু একটা ভেবে বানজারা আবার শুয়ে পড়ে৷ পাশে ঘুমিয়ে থাকা বউকেও আর ডাকেনি৷

সকালবেলা ঘর থেকে বেরিয়েই বানজারার বউ চিৎকার করে ওঠে৷ সেই চিংকার শুনে বানজারা ছুটে যায়৷ দ্যাখে রামুয়া গোয়ালঘরের বাইরে জলকাদার ওপরে কাত হয়ে পড়ে আছে—তখনও দেহ একেবারে অসাড় হয়ে যায়নি৷ আর ওর বকনা বাছুরটা গোয়ালঘরের ভেতরে চোখ কপালে তুলে শেষ৷

বানজারা আর ওর বউ মিলে বাছুরটার দেহ গোয়ালঘরের গুমোট অন্ধকার থেকে বাইরের খোলা হাওয়ায় নিয়ে আসে৷ তারপর ঘটির পর ঘটি জল ঢেলে মা-মেয়েকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু সবই বেকার৷ দুজনেরই দেহান্ত হয়ে যায়৷

অচ্যুতের দৃশ্যটা ভালো লাগছিল না৷ ও ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল৷

পিছন থেকে কুলদীপ ওর কাঁধে হাত দিল৷

অচ্যুত চমকে উঠল৷ কুলদীপ কখন এসেছে ও টের পায়নি৷

কুলদীপ হাতঘড়ি দেখে বলল, ‘চল, ক্লাস বসে যাবে৷ আজ তো আর ঘণ্টা পড়বে না৷’

‘ওই গোরু আর বাছুরটার কী করে এমন দশা হল বল তো!’

‘কী জানি!’ ঠোঁট ওলটাল কুলদীপ : ‘শোন, আজ সকালে মউলি ফোন করেছিল৷ ও আজ হিস্ট্রি কোচিং-এ যাবে না৷ তোর নোটটা নেক্সট উইকে ফেরত দেবে৷’

অচ্যুতরা কয়েকজন সুপারমার্কেটের কাছে ইতিহাস পড়তে যায়৷ ওখানে নগেনস্যারের কোচিং আছে৷ নগেনস্যার চিত্তরঞ্জন হাইস্কুলের টিচার ছিলেন—প্রায় বছরদশেক হল রিটায়ার করেছেন৷ নগেনস্যার যখন ইতিহাস পড়ান তখন অচ্যুতদের মনে হয় ওরা যেন সিনেমা দেখছে৷ ওদের চোখের সামনে চন্দ্রগুপ্ত, চাণক্য, মেগাস্থিনিস চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে৷

মউলি কমলাবালা গার্লস হাইস্কুলে পড়ে৷ অচ্যুতদের পাশের বাড়িতেই থাকে, অথচ সবসময় কুলদীপকে ফোন করে অচ্যুতকে খবর দেয়৷

মউলি খুব ছটফটে, শাড়ি পরতে ভালোবাসে না, বেণী দুলিয়ে হাঁটে৷ একদিন বিকেলে ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল অচ্যুত৷ খেয়াল করেনি যে, ওদের ছাদে দাঁড়িয়ে মউলি ওর ঘুড়ি ওড়ানোর হাস্যকর চেষ্টা দেখছে৷

‘যারা সবসময় লেখাপড়া করে তারা ঘুড়ি ওড়াতে গেলে এরকমই হয়—৷’

ঘুড়ি ওড়ানো থামিয়ে ফিরে তাকাল অচ্যুত৷ ওর ময়ূরপঙ্খী ঘুড়িটা গোঁত খেয়ে সামনের বাড়ির শিউলি গাছে আটকে গেল৷

তাই দেখে মউলি খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়েছিল৷

অচ্যুত বলল, ‘আমি মোটেই সবসময় লেখাপড়া করি না—তা হলে এখন ঘুড়ি ওড়াচ্ছি কী করে৷’

ঠোঁট বেঁকাল মউলি : ‘আজকের ব্যাপারটা তো একটা অ্যাক্সিডেন্ট৷ তুমি দিনরাত লেখাপড়া করো বলেই তো আমার পড়ায় মন বসে না—৷’

ধুত, যত্তসব উলটোপালটা কথা৷ ওর অভিযোগ হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল অচ্যুত৷ বলল, ‘এরকম আবার হয় নাকি!’

‘হয়৷ দেখবে, আজ আমার কী দারুণ পড়ায় মন বসবে৷ মাঝে-মাঝে এরকম অ্যাক্সিডেন্ট হলে বেশ হয়…তা হলে সব কাজে আমার মন বসবে৷’

অচ্যুত কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না৷ ও ছাদের পাঁচিলের কাছে এসে সাত-আট ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মউলিকে দেখছিল৷ মউলির মাথার পিছনে সূর্য অস্ত যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল৷

মাঝে-মাঝে এরকম অ্যাক্সিডেন্ট হলে বেশ হয়…৷ তার মানে?

মউলি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, ‘সকালে আর বিকেলে ছাদে এসে একটু ফ্রেশ বাতাস তো নিতে পারো৷ তা হলে দেখবে, ভালো হবে৷’

‘কার?’

‘দুজনেরই৷’

মউলির মুখে সূর্যের তেরছা আলো পিছলে গেল৷ ও চটপট ঘুরে দাঁড়িয়ে একরকম ছুটেই চলে গেল৷

সেদিন অচ্যুত ছাদে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেছিল৷ ঘুড়ি-লাটাই হাতে নিয়ে মউলির এলোমেলো কথার মানে বোঝার চেষ্টা করেছিল৷

তারপর থেকে অচ্যুত লক্ষ করেছে, মউলির কাজের কিছু বলার থাকলে ও কুলদীপের মারফত বলে পাঠায়৷ ইতিহাস কোচিং-এ যখন পড়তে যায় তখনও ও অচ্যুতের সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না৷ বরং ছাদে যখন দেখা হয় তখন অনেক সহজভাবে অনেক উলটোপালটা অকাজের কথা বলে৷ বলে, ‘তুমি ভিতু, তোমার মাথায় বুদ্ধি নেই৷ কী করে অঙ্কে একশোয় একশো পাও কে জানে!’

অচ্যুত জবাব না দিলেও ওর কথাগুলো নিয়ে চুপচাপ বসে ভাবে৷

এখন কুলদীপ যে-নোটটার কথা বলেছে সেটা মউলি চেয়ে পাঠিয়েছিল কুলদীপের মারফত৷ আবার সেটা ফেরতও আসবে কুলদীপের হাত দিয়ে৷ তা হলে তো মউলি কুলদীপের কাছ থেকেই নোটটা নিতে পারত! কারণ, নগেনস্যারের ডিকটেশান থেকে ওরা সবাই নোট নিয়েছিল৷ সেদিন মউলি আসেনি৷

আবার একদিন ছাদে দেখা হতে অচ্যুত এই অদ্ভুত ‘যোগাযোগ ব্যবস্থা’ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল৷ উত্তরে মউলি হেসে বলেছিল, ‘এতে একটা অন্যরকম মজা আছে—তুমি বুঝবে না৷’

ওর ভ্যাবাচ্যাকা মুখের দিকে তাকিয়ে একটু পরে মউলি বলেছে, ‘ঠিক আছে, আমি দুটো এক্স্যাম্পল দিয়ে তোমাকে বোঝাচ্ছি৷ সামনাসামনি কথা বলার চেয়ে টেলিফোনে কথা বললে কত ভালো লাগে৷ আবার সেই কথাগুলো চিঠি দিয়ে বলাবলি করলে…ওঃ, ফ্যান্টাস্টিক৷’

একটু চুপ করে থেকে অচ্যুতকে দেখল মউলি৷ তারপর জিগ্যেস করল, ‘কিছু বুঝলে?’

অচ্যুত মাথা নাড়ল৷ সত্যিই ও কিছু বোঝেনি৷

তাই এখন কুলদীপের কথায় ও শুধু ঘাড় হেলাল৷

তখনই ওর চোখ গেল স্কুলের দোতলার বারান্দার দিকে৷

সত্যবানস্যার বারান্দার রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে একমনে সিগারেট খাচ্ছেন৷ নীচে বানজারার ঘরের কাছে যে অত হইচই, ভিড়, সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপও নেই৷

হঠাৎই মাঠে একটা শোরগোল ব্যস্ততা শুরু হল৷ ছাত্রের দল প্রায় ছুটে চলে গেল স্কুল বিল্ডিং-এর কাছে৷ হুড়মুড় করে যার-যার ক্লাসরুমের দিকে রওনা হল৷

ওদের কথাবার্তার টুকরো শুনে অচ্যুতরা বুঝল হেডস্যার এসে গেছেন৷ পিছন ফিরে তাকাতেই ওরা হেডস্যারকে দেখতে পেল৷

হেডস্যার মোহনলাল পুরকায়স্থ রোগা শরীরটাকে টান-টান করে মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছেন৷ মাথায় টাক, চোখে চশমা, ভাঙা গাল, চোয়াল শক্ত৷ দেখলেই বোঝা যায় বেশ কড়া ধাতের মানুষ৷ সবসময় ডিসিপ্লিন বজায় রাখতে চান৷ কিন্তু আজ প্রেয়ার হবে কি না কে জানে! বানজারা ঘণ্টা বাজাতে পারেনি৷ তা ছাড়া অনেকটা দেরিও হয়ে গেছে৷

কিন্তু প্রেয়ারের ঘণ্টা বাজল—দেরিতে হলেও৷ হেডস্যার পরিস্থিতির দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন৷ এখন বানজারার গোরু-বাছুরের মৃতদেহের নিশ্চয়ই একটা গতি হবে৷ কিন্তু কোন প্রাণী ওদের গলার অমন হিংস্র কামড় বসিয়েছে সেটা জানা যাবে কী?

ক্লাস বসল৷ অচ্যুত ভালো করে পড়ায় মন দিতে পারছিল না৷ বারবার ভাবছিল, স্কুলে হঠাৎ এসব কী শুরু হল!

টিফিনের সময় প্রতীক ওকে জিগ্যেস করল, ‘কী রে, রাজীব আজ এল না?’

অচ্যুত বলল, ‘দেখছি তো আসেনি—৷’ একইসঙ্গে ওর মনে পড়ে গেল, রাজীব আজ টিফিনের জন্য কেক-প্যাটিস কিনতে পরেশদার দোকানে নেমেছিল৷

তা হলে কি হঠাৎ করে ওর জ্বর-টর হল!

চুরির ব্যাপারটা ধরা পড়ার পর থেকে রাজীব ওদের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে৷ নিজের অন্যায়ের জন্য বারবার ওদের কাছে দুঃখ করেছে, ক্ষমা চেয়েছে৷ অচ্যুত ভাবল, রাতে একবার ফোন করে রাজীবের খবর নেবে৷ কিন্তু তখনই খেয়াল হল, ওর কাছে তো রাজীবের ফোন নম্বর নেই৷ তখন ও প্রতীককে বলল ফোন করে রাজীবের খবর নিতে৷

টিফিনের সময় প্রতীক পকেট থেকে একটা পাতলা ক্যালকুলেটার বের করে অচ্যুতদের দেখাল : ‘আমার ছোটমামা পরশু আমেরিকা থেকে ফিরেছে—আমার জন্যে এটা নিয়ে এসেছে৷’

ওরা একে-একে ওটা হাতে নিয়ে বোতাম টিপে দেখতে লাগল৷

কুলদীপ বলল, ‘এই, তোরা ক্যালকুলেটর পরে দেখবি—আগে শোন৷ সামনের শনিবার দুটোর সময় ‘সি’ সেকশনের সঙ্গে আমাদের ফুটবল ম্যাচ ঠিক করেছি৷ আজ ছুটির পর টিম ফাইনাল করে ফেলতে হবে৷’

বাসব আর সৌরভ হইহই করে উঠল৷ ওরা দুজনে ফুট-বলের পোকা৷

তারপর ফুটবল নিয়ে জোরালো আলোচনা শুরু হয়ে গেল৷ কিছুক্ষণের জন্য বিপজ্জনক অশুভ ঘটনাগুলো মুছে গেল ওদের মন থেকে৷

সেদিন ছুটির পর অচ্যুত যখন সাইকেল করে বাড়ি ফিরছিল তখন ওর মনটা বেশ হালকা লাগছিল৷ আজ সাতটার সময় নগেনস্যারের কাছে পড়া আছে৷ মউলি আজ আসবে না৷ কুলদীপকে দিয়ে মউলি যেমন খবর পাঠায়, অচ্যুতেরও কি পালটা কোনও খবর পাঠানো উচিত? নাকি কাল বিকেলে ছাদে উঠে ওর জন্য অপেক্ষা করবে? যদি অ্যাক্সিডেন্ট হয়! মউলিকে সত্যবানস্যারের ব্যাপারটা একটুও বলা হয়নি৷ বলতে পারলে অচ্যুতের মন হালকা হত৷

ইতিহাসের কোচিং সেরে অচ্যুত বাড়ি ফিরল প্রায় পৌনে নটা নাগাদ৷ আর ফিরেই শুনল প্রতীক ওকে ফোন করেছিল৷ কোচিং থেকে ফিরলে ফোন করতে বলেছে৷ খুব জরুরি দরকার৷

বই-খাতা গুছিয়ে রেখে প্রতীককে ফোন করল অচ্যুত৷

একবার রিং বাজতে-না-বাজতেই প্রতীক রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বলল৷

‘আমি অচ্যুত—৷’

‘ওঃ, তোর ফোনের জন্যেই ওয়েট করছিলাম৷ এক্ষুনি রাজীবের বাড়িতে যেতে হবে৷’

‘কেন?’ অচ্যুত অবাক হয়ে গেল৷

‘সে অনেক ব্যাপার—গেলে সব জানতে পারবি৷ আমি কুলদীপকে ফোন করে দিচ্ছি, ও দশ মিনিটের মধ্যে রাজীবের বাড়ি পৌঁছে যাবে৷ তুইও চলে আয়৷’

অচ্যুতের বুকের ভেতরে একটা ধকধকানি শুরু হল৷ রাজীব কাল টিফিনের কেক-প্যাটিস কিনেছিল, কিন্তু আজ স্কুলে আসেনি! ওর কি কোনও বিপদ হয়েছে?

‘কী হয়েছে রাজীবের?’ অচ্যুতের গলার স্বরটা খসখসে হয়ে গেল৷

‘বললাম তো, গিয়ে সব শুনবি—৷’

ফোন রেখে দিল প্রতীক৷

অচ্যুত মায়ের কাছে গিয়ে বলল, ‘আমাকে এখুনি একবার সাইকেল নিয়ে বেরোতে হবে৷’

‘কেন রে, রাত নটার সময় কোথায় বেরোবি?’

অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে মিথ্যে কথা বলল অচ্যুত, ‘প্রতীকের কাছে আমার একটা নোট রয়ে গেছে৷ সেটা আজ রাতেই লাগবে—পড়তে হবে৷ বেশিক্ষণ লাগবে না—আমি দশটার মধ্যেই ফিরে আসব৷’

সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেরোল অচ্যুত৷ আকাশের দিকে একবার তাকাল৷ সেখানে ঘোলাটে লালচে মেঘ অপেক্ষা করছে৷

তখনই চোখ গেল মউলিদের বারান্দায়৷ একটা মেয়েলি ছায়া সেখানে দাঁড়িয়ে আছে—হাতে ধরা রেডিয়ো বাজছে৷

সাইকেল চালিয়ে রাজীবদের বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় অচ্যুত বেশ বুঝতে পারছিল ওর বুকের হালকা ভাবটা কখন যেন মিলিয়ে গেছে৷ তার বদলে মেঘলা আকাশটা চুপিচুপি সেখানে ঢুকে পড়েছে৷

.

৷৷পাঁচ৷৷

রাজীবদের বাড়িতে পৌঁছে দেখল কুলদীপ আর প্রতীক আগেই সেখানে হাজির৷ অল্প আসবাব দিয়ে ছিমছামভাবে সাজানো ড্রয়িং- ডাইনিং-এ ওরা বসে রয়েছে৷ ওদের সামনে আখরোট কাঠের কারুকাজ করা টেবিলে কমলা রঙের শরবতের গ্লাস৷ ঘরের এককোণে রঙিন টিভিতে ডিসকভারি চ্যানেল চলছে৷

অচ্যুত ঘরে ঢুকে একটা সোফায় বসতে-না-বসতেই দেখল, রাজীব আসছে৷

রাজীবের গায়ে একটা নীলরঙের চাদর জড়ানো৷ ওর মাম্মি ওকে ধরে-ধরে নিয়ে আসছেন৷

রাজীবের ফরসা মুখ বেশ ফ্যাকাশে৷ অচ্যুতদের দেখে মলিন হাসল৷

মাম্মি ওকে যত্ন করে সাবধানে একটা সোফায় বসালেন৷ অচ্যুতদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাল রাত থেকে হাই ফিভার—মাথা তুলতে পারছে না৷ ডক্টর দেখিয়ে আজ সন্ধের পর জ্বর একটু কমেছে৷ ওর ঘাড়ে পোকা-টোকা কী একটা কামড়েছে—তাই থেকেই হয়তো ইনফেকশান হয়েছে৷ এখানকার ড্রেনেজ সিস্টেমটা তো একেবারেই প্রিমিটিভ, নন-হাইজিনিক…সাফার করা ছাড়া আর তো কোনও উপায় নেই…৷’

রাজীবের মাম্মির সাজগোজ বেশ নজরে পড়ার মতো৷ ডানহাতের দু-আঙুলে দুটো পাথর বসানো সোনার আংটি৷

‘তোমাদের সঙ্গে রাজুর কী ইমপর্ট্যান্ট ডিসকাশন আছে—সেই সন্ধে থেকে ও একেবারে ছটফট করছে৷ তোমরা কথা বলো…’, অচ্যুতের দিকে ফিরে : ‘আমি তোমার শরবত পাঠিয়ে দিচ্ছি—৷’

চলে যেতে-যেতে রাজীবের দিকে ঘুরে তাকালেন মাম্মি : ‘রাজু, বেশি স্ট্রেইন কোরো না৷ ডক্টর ব্যানার্জি তোমাকে অ্যাবসলিউট রেস্ট নিতে বলেছেন…৷’

মাম্মি চলে যেতে রাজীব শব্দ করে হাঁফ ছাড়ল৷ তারপর ওদের তিনজনের চোখের দিকে পালা করে তাকিয়ে বলল, ‘আসল ব্যাপারটা আমি মাম্মি-বাপি কাউকে বলিনি৷ বললে শোরগোল করে থানা-পুলিশ ঘেঁটে একেবারে দুনিয়া মাথায় তুলবে৷ আমার বিপদের কথাটা ভাববে না৷’

‘কীসের বিপদ?’ এক চুমুকে শরবত শেষ করে কুলদীপ জানতে চাইল৷

‘বলছি৷’ ঢোঁক গিলল রাজীব৷ ওর মুখে একটা আলতো ভয়ের ছায়া নেমে এল৷ ও অচ্যুতের দিকে তাকাল : ‘তুই কাল আমাকে পরেশদার দোকানে নামিয়ে দেওয়ার পর স্যাটাস্যাটের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল…৷’

কুলদীপ চোখ বড়-বড় করে চাপা শিস দিয়ে উঠল৷

অচ্যুত অপেক্ষা করতে লাগল৷ প্রতীক গালে হাত দিয়ে কৌতূহলভরা মুখে রাজীবের দিকে তাকিয়ে রইল৷ আর মাঝে-মাঝে আনমনাভাবে শরবতের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল৷

‘সত্যবানস্যারের সঙ্গে সাইকেল ছিল৷ বললেন, আমার সঙ্গে কী কথা আছে…যেতে-যেতে বলবেন৷ আমি কেক-টেক কিনে ওঁর সাইকেলে উঠলাম—সামনে রডের ওপরে বসলাম৷ স্যারের চোখে-মুখে একটা চাপা ফুর্তি টের পাচ্ছিলাম৷ কিন্তু কেন সেটা বুঝতে পারিনি৷

‘…সাইকেল চালিয়ে যেতে-যেতে স্যাটাস্যাট অঙ্ক নিয়ে খুব জ্ঞান দিতে লাগল৷’ অচ্যুতের দিকে ইশারা করে রাজীব বলল, ‘তোর অঙ্কের মাথা নিয়ে খুব প্রেইজ করছিল৷ আর কথা বলতে-বলতে…৷’ রাজীবের চোখ সরু হয়ে এল : ‘আমার ঘাড়ের কাছে বারবার ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছিল৷ আমার বিরক্ত লাগছিল…কিন্তু কেমন একটা ঘোরের মধ্যে যেন পড়ে গিয়েছিলাম৷ স্যাটাস্যাটের জড়ানো গলায় কথা শুনতে-শুনতে আমার ঝিম ধরানো নেশা মতন হয়ে গেল৷ ততক্ষণে সাইকেল ঘোষদের বাগানবাড়ি ছাড়িয়ে পুকুরের পাশের অন্ধকার রাস্তায় চলে এসেছে৷ আমি বললাম, ‘‘স্যার, এ-রাস্তা দিয়ে এলেন কেন?’’ আমার মাথার পেছন থেকে স্যাটাস্যাট খিলখিল করে হাসল৷ তারপর বলল, ‘‘এটাই তো তোর বাড়ি যাওয়ার শর্টকাট রে বোকা!’’

‘আমি কিন্তু জানতাম যে, ওটা শর্টকাট নয়—তবুও কিছু বলতে পারলাম না৷ কেমন যেন হিপনোটাইজড হয়ে গিয়েছিলাম৷ নিজের ওপরে আর কোনও কন্ট্রোল ছিল না৷

‘স্যাটাস্যাট একটা বটগাছের তলায় ঝুপসি অন্ধকারে সাইকেলটা দাঁড় করাল৷ বটগাছের ঝুরির ফাঁক দিয়ে ঘোলাটে চাঁদ দেখা যাচ্ছিল৷ চারপাশে কেউ কোথাও নেই৷ পুকুরের দিক থেকে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছিল৷

‘আমার বেশ ভয় করছিল, কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারছিলাম না৷ গলার ভেতরে কেউ যেন খানিকটা তুলো গুঁজে দিয়েছে৷ এমন সময় পুকুরের কালো জলে কোনও মাছ বোধহয় ঘাই মারল—ছপাৎ করে শব্দ হল৷ আর সঙ্গে-সঙ্গে ঘাড়ে কাঁটা ফোটার মতো ব্যথা পেলাম৷ তারপরই জায়গাটা চিনচিন করতে লাগল৷ আমি…৷’

ডিসকভারি চ্যানেলে আচমকা বাঘের গর্জন শোনা গেল৷ ওরা চারজনেই সামান্য চমকে উঠল৷ এই গরমের মধ্যেও অচ্যুতের কেমন যেন শীত করছিল৷

ওরা টিভির দিকে তাকিয়েছিল৷ তখনই দেখল, একজন মহিলা একগ্লাস শরবত নিয়ে ঘরে ঢুকছেন৷

শরবতের গ্লাসটা টেবিলে রেখে তিনি চলে গেলেন৷ রাজীব গ্লাসটা তুলে নিয়ে অচ্যুতের হাতে দিল, ‘নে, শরবত খা৷’

অচ্যুত এক ঢোঁকে শরবতের গ্লাস অর্ধেকটা শেষ করে জানতে চাইল, ‘তারপর?’

রাজীব দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল :

‘…আমি অসাড় হয়ে সাইকেলের রডের ওপরে বসে রইলাম৷ নড়াচড়ার শক্তি নেই৷ স্যারও কোনও কথা বলছিলেন না৷ একটা ঘোরের মধ্যে সময় কেটে যেতে লাগল৷ চোখের সামনে থেকে চাঁদ মুছে গেল৷ ব্যাঙের ডাক আর শুনতে পাচ্ছিলাম না৷ শুধু চিনচিনে ব্যাপারটা টের পাচ্ছিলাম৷

‘…ওইভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না৷ একসময় আবার চাঁদ দেখতে পেলাম, ব্যাঙের ডাকও শুনতে পেলাম৷ শরীরটা খুব উইক লাগছিল৷ ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল৷ টের পেলাম, স্যার আমার ঘাড়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন৷ জামার কলারটা তুলে দিয়ে ঘাড়ের কাছটা ভালো করে ঢেকে দিতে চাইলেন৷ তারপর বললেন, ‘‘আমার দিকে একবার তাকা…৷’’ আমি অন্ধ ভক্তের মতো ওঁর হুকুম মেনে তাকালাম…৷’

রাজীব হঠাৎই শিউরে উঠল৷ পাশে বসে থাকা অচ্যুতের হাত খপ করে চেপে ধরল৷ কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘বাড়িতে এসব কথা একদম বলিনি৷ তোদের বলছি—৷’

‘তাকিয়ে কী দেখলি?’ প্রতীক জিগ্যেস করল৷

‘দেখলাম…৷’ চোখ গোল-গোল করে তাকাল রাজীব৷ ওর মুখ আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেল : ‘দেখলাম, স্যারের চোখ দুটো গাঢ় সবুজ—ধকধক করে জ্বলছে—আর তার মধ্যে দুটো কালো ফুটকি৷ ঠিক যেন বেড়াল বা চিতাবাঘের চোখ৷ চোখ তো নয়, মার্বেল পাথর বসানো! স্যার অদ্ভুতভাবে হেসে ভয়ানক গলায় বললেন, ‘‘কাউকে এসব বলবি না৷ তুই এখন আমার! আমার কথায় উঠবি, আমার কথায় বসবি, আমার কথায় চলবি৷ আমার ইশারা তোর কাছে আদেশ৷ এ-কথা মনে রাখিস৷’’

‘আশ্চর্য! বিশ্বাস কর, স্যারের ওপরে আমার একটুও রাগ হল না৷ ছুটে পালাতেও ইচ্ছে করল না৷ পাথরের স্ট্যাচুর মতো স্যারকে দেখছিলাম, স্যারের কথা শুনছিলাম৷

‘এরপর স্যার সাইকেল চালিয়ে আমাকে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দিলেন৷ কানের কাছে মুখ এনে সাপ-খেলানো সুরে অনেক কথা বললেন৷ কথাগুলো সব আমার মনে নেই৷ তবে একটা ঘোরের মধ্যে হেঁটে আমি বাড়ি এলাম৷ গলার পাশে, ঘাড়ের কাছটায় চুলকোচ্ছিল৷ হাত দিতেই কেমন চটচটে লাগল৷ দেখি রক্ত৷ তখনই আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেছি৷ তারপর বাপি-মাম্মির হইচই, ডাক্তার ডাকাডাকি, কত কী কাণ্ড!

‘বাড়িতে আমি ভয়ে কোনও কথা বলিনি৷ বলেছি, অন্ধকারে ওই পুকুরের কাছটায় কী একটা পোকা যেন কামড়ে দিয়েছে৷ কিন্তু তোদের সত্যি কথা বলছি, সত্যবানস্যারের ভয়ে আমি একেবারে কাঁটা হয়ে আছি৷ বারবার মনে হচ্ছে, কাল রাতের ব্যাপারটা পুরোপুরি স্বপ্ন—একবর্ণও সত্যি নয়৷ কিন্তু আসলে তো সত্যি! এখন তোরা আমাকে বাঁচা৷ কী করব বলে দে—৷’

রাজীবের কথা শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে রইল৷ কুলদীপ ওর কদমছাঁট চুলে হাত বোলাতে-বোলাতে টিভির দিকে তাকিয়ে রইল৷ প্রতীক বয়স্ক মানুষের মতো ভুরু কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে বসে৷ আর অচ্যুতের মনের ভেতরে তোলপাড় চলছিল৷

কী করা উচিত এখন?

প্রতীক বিড়বিড় করে বলল, ‘স্যাটাস্যাট আসলে ড্রাকুলা! আজকের যুগে এ তো বিশ্বাস করা মুশকিল!’

অচ্যুত ধীরে-ধীরে বলল, ‘বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও ব্যাপারটা বোধহয় মিথ্যে নয়৷ তা ছাড়া পিশাচের আবার যুগ আছে নাকি!’

কুলদীপ বলল, ‘আমি ওসব ভূত-টুতে বিশ্বাস করি না৷ রাজীব, তোর মনে হয় ভুল হয়েছে৷ তোকে সত্যি-সত্যিই কোনও পোকা-টোকা কামড়েছে৷’

রাজীব চোখ বড় করে জানতে চাইল, ‘তা হলে ওই সবুজ চোখ দুটোও ভুল?’

‘না, মোটেই ভুল নয়,’ জবাব দিল অচ্যুত, ‘আমিও ওই সবুজ চোখ দেখেছি৷ স্যারের মধ্যে যে কিছু একটা গণ্ডগোল আছে সেটা আঁচ করেছিলাম৷ কিন্তু সেটা যে এইরকম তা বুঝতে পারিনি৷ রাজীব, তুই এখন যা—শুয়ে পড় গিয়ে৷ কয়েকটা দিন রাস্তায় বেরোস না৷ আমরা একটু ভেবে দেখি, কী করা যায়৷ তোর ফোন নাম্বারটা আমাকে দে—৷’

রাজীব ফোন নম্বর বলল৷ অচ্যুত সেটা কয়েকবার বিড়বিড় করে আওড়ে মুখস্থ করে নিল৷

এমন সময় রাজীবের মাম্মি ঘরে ঢুকলেন৷ রাজীবকে লক্ষ করে বললেন, ‘রাজু, চলো, অনেকক্ষণ গল্প হয়েছে৷ এবারে ওষুধ লাগিয়ে রেস্ট নেবে৷ কাল ডক্টর ব্যানার্জি আবার চেক আপে আসবেন৷ তোমরা শরবত খেয়েছ তো?’

শেষ প্রশ্নটা অচ্যুতদের লক্ষ করে৷

প্রতীক আর অচ্যুত গ্লাসের বাকি শরবত শেষ করে উঠে দাঁড়াল৷

কুলদীপ হাঁ করে টিভিতে বাঘ আর বাইসনের লড়াই দেখছিল, অচ্যুত ওকে খোঁচা মারল৷ কুলদীপ ফিরে তাকাতেই ওকে উঠতে ইশারা করল৷

‘আসি, আন্টি৷’

রাজীবকে ‘টা-টা’ করে ওরা তিনজন দরজার দিকে এগোল৷ হঠাৎই প্রতীক ঘুরে দাঁড়িয়ে রাজীবকে বলল, ‘কাল তোকে ফোন করব—৷’ তারপর মাম্মিকে আড়াল করে এক চোখ টিপে হাতের ইশারায় বলতে চাইল, ‘কোনও ভয় নেই৷’

রাস্তায় বেরোতেই কুলদীপ অচ্যুতকে বলল, ‘কী রে, স্যাটাস্যাটের সবুজ চোখের ব্যাপারটা আমাদের বলিসনি তো!’

‘ভয়ে বলিনি৷ আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম৷’

প্রতীক বলল, ‘স্যাটাস্যাট হেভি ডেঞ্জারাস৷ কিন্তু কী করে হঠাৎ এরকম চেঞ্জ হয়ে গেল বল তো?’

‘হয়তো ওর ওপরে পিশাচ ভর করেছে৷’ অচ্যুত বলল, ‘রক্তপিশাচ ড্রাকুলা যেমন ভর করত—আমি টিভিতে দেখেছি৷’

প্রতীক কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘বানজারার গোরু-বাছুরকেও কি তা হলে পোকা কামড়েছে?’

কুলদীপ আর প্রতীকের দিকে তাকাল অচ্যুত৷ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘হ্যাঁ, স্যাটাস্যাট-পোকা৷’

ওর কথায় কেউ হাসল না৷

আর সঙ্গে-সঙ্গেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হল৷

ওরা তিনজন যে-যার সাইকেলে উঠে রওনা হয়ে পড়ল৷ যেতে-যেতে কুলদীপ চেঁচিয়ে বলে গেল, ‘কাল স্কুলে দেখা হবে—৷’

রাস্তার দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার আরও বেড়ে গেছে৷ সাইকেল রিকশা, স্কুটার, বা লোকজন চোখে পড়ে কি পড়ে না৷ অচ্যুত সাইকেল চালাচ্ছিল বটে, কিন্তু ওর মন রাস্তার দিকে ছিল না৷ দুটো ধকধকে ক্ষুধার্ত সবুজ চোখ ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল৷

ও মনে-মনে ঘটনাগুলো যতই চিন্তা করছিল ততই যেন সব জট পাকিয়ে যাচ্ছিল৷

পুলিশে খবর দেওয়ার কোনও মানে হয় না, কারণ, কেউ ওদের কথা বিশ্বাস করবে না৷

তা হলে কী করা যায়? সত্যবানস্যারকে ওরা দশ-পনেরোজন মিলে ঘিরে ধরে কোণঠাসা করবে? জবাবদিহি চাইবে? নাকি হেডস্যারের কাছে দলবেঁধে গিয়ে সত্যবানস্যারের নামে নালিশ করবে?

তখনই অমিয়স্যারের কথা মনে পড়ল৷

প্রমাণ চাই, প্রমাণ৷ স্যাটাস্যাটকে লাল হাতে ধরতে হবে৷ কিন্তু সেই সুযোগ কি কখনও পাওয়া যাবে?

এইসব এলোমেলো চিন্তা করতে-করতে অচ্যুত যখন বাড়ি ফিরল তখন দেখল মা একরাশ দুশ্চিন্তা মুখে নিয়ে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে৷

একইসঙ্গে ও চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল, মউলিদের বাড়ির দোতলার বারান্দায় সেই মেয়েলি ছায়াটা এখনও একইরকমভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে৷

মা বলল, ‘সেই কখন থেকে তোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি! একে রাত হয়েছে, তার ওপর বৃষ্টি—একটা বিপদ হলে তখন কী হবে বল তো!’

অচ্যুত সামান্য হাসল৷ সাইকেলটা হাঁটিয়ে নিয়ে মা-কে পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল৷ মা-কে ও বলতে পারল না, ‘বিপদ হলে তখন কী হবে’ নয়—এর মধ্যেই ও বিপদের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে৷ অভিমন্যুর মতো ওকে চক্রব্যূহ ভেদ করার চেষ্টা করতে হবে৷ যদি ভেদ করতে না পারে, তা হলে অভিমন্যুর মতোই হয়তো ওর…৷

অচ্যুত আর ভাবতে পারল না৷

রাজীবের ঘটনাটা ওর শিরদাঁড়ায় বরফ জমিয়ে দিয়েছে৷

.

৷৷ছয়৷৷

পরদিন স্কুলে গিয়ে অচ্যুতরা জোট পাকাতে শুরু করল৷

ও, কুলদীপ, প্রতীক, বাসব, সৌরভ সবাই বন্ধুদের রাজি করিয়ে কাছাকাছি ডেস্কে বসল৷ আর ক্লাসের মাঝে ফাঁক পেলেই ফিসফাস করে আলোচনা করতে লাগল৷

একটার পর একটা ক্লাস হয়ে যাচ্ছে, ওদের সেদিকে মন নেই৷ আনমনা হওয়ার জন্য বাসব ভূগোলের পিরিয়ডে কালীপদস্যারের কাছে বকুনিও খেল৷ কিন্তু সত্যবানস্যারের ব্যাপারটা এত সাঙ্ঘাতিক যে, ওরা কেউই পড়াশোনায় মন দিতে পারছিল না৷

টিফিনের ঘণ্টা যখন পড়ল তখনও ওরা ক্লাসে বসে রইল৷ যে দু-তিনজন ঘরে বসেই টিফিন খায়, কুলদীপ তাদের মাঠে যেতে বলল, ‘তোরা নীচে গিয়ে টিফিন খা৷ আমাদের একটু প্রাইভেট কথা আছে৷’

কুলদীপকে সবাই একটু সমীহ করে৷ তাই কেউই কথা বাড়াল না৷

অচ্যুতের কাছে সব শোনার পর বাসব আর সৌরভ তো একেবারে থ হয়ে গেল৷

প্রতীক বলল, ‘সেইজন্যেই তুই আর কুলদীপ অত গুজগুজ করতিস!’

কুলদীপ একটু হাসল৷ বলল, ‘চিন্তা করে দেখ, ব্যাপারটা কীরকম আজগুবি আর সিরিয়াস৷’

বাসব বলল, ‘কুলদীপ বলছে স্যাটাস্যাটকে চোখে-চোখে রাখতে—যদি হাতেনাতে ধরা যায়৷’

প্রতীক গম্ভীরভাবে ঘাড় নাড়ল : ‘হুঁ—প্রমাণ না পেলে কিছু করা মুশকিল…৷’

‘স্যাটাস্যাটও আমাকে এই কথা বলেছিল—সবুজ চোখ দেখানোর সময়৷ প্রমাণ না পেলে কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না৷’

সৌরভ উত্তেজিতভাবে বলল, ‘আমার ছোট একটা অটোমেটিক ক্যামেরা আছে৷ ফটো তুলে নিলে কেমন হয়৷ সেটাই তো সবচেয়ে বড় প্রমাণ—৷’

প্রতীক হাসল, ‘স্যাটাস্যাট কি তোর ক্যামেরার সামনে চোখ সবুজ করে পোজ দিয়ে দাঁড়াবে?’

‘কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে!’

বাসব হাতের ইশারায় সবাইকে চুপ করতে বলল৷ তারপর বলল, ‘আমাদের পাঁচজনের কাজ এখন একটাই—প্রমাণ খোঁজা৷ সৌরভ যদি ক্যামেরা নিয়ে কিছু করতে পারে তো করুক৷ আর আমরা সত্যবানস্যারের ওপরে কড়া নজর রাখব৷ শুধু স্কুলে নয়, স্কুলের বাইরেও৷ এই নজরদারির কাজে দরকার হলে আরও কয়েকজনকে দলে নেব৷’

বাসবের কথাটা কুলদীপের মনে ধরল৷ প্রতীকও মাথা নেড়ে সায় দিল৷ বলল, ‘স্যার একা—আর আমরা অনেক৷ আমাদের সুবিধে অনেক বেশি৷’

অচ্যুত বলল, ‘আমাদের গ্রুপের বাইরে কেউ যেন কিছু না জানতে পারে৷ ক্লাস টেনের দাদাদেরও কিছু বলার দরকার নেই৷ এখন সবকিছু সিক্রেট রাখাটা মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট৷’

‘তুই বাড়িতে কিছু বলিসনি?’ কুলদীপ জিগ্যেস করল৷

‘না, এখনও বলিনি৷ বললে পর হইচই বেধে যাবে—হয়তো এ-স্কুল ছাড়িয়ে দিয়ে অন্য স্কুলে ভরতি করে দেবে৷ আমার মা যা ভিতু!’

টিফিন শেষ হওয়ার ঘণ্টা না বাজা পর্যন্ত ওদের জল্পনা-কল্পনা চলল৷ স্কুল ছুটির পর মাঠের সাইকেল-স্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়ে ওরা না-ফুরোনো কথা বলছিল৷

কুলদীপ বলল, ‘আগামীকালের ম্যাচ বাতিল করতে হবে৷’

সৌরভ বলল, ওর ক্যামেরাটায় নতুন ফিল্ম ভরে ও তৈরি হবে৷

বাসব বলল, সত্যবানস্যারের ওপরে সবসময় নজর রাখার জন্য পাড়ার বন্ধুবান্ধবদেরও বলতে হবে৷ কারণ, বাসবরা যদি রাস্তাঘাটে, স্টেশনে, সব জায়গায় স্যারের পিছু নেয় তা হলে স্যার সহজেই গোলমালটা ধরে ফেলবেন৷

ওরা চারজন বাসবের কথায় সায় দিল৷

অচ্যুত আনমনা হয়ে কী ভাবছে দেখে প্রতীক ওকে ঠেলা মারল : ‘কী রে, কী ভাবছিস?’

‘ফটো তোলা যাবে কী করে তাই ভাবছি৷ সৌরভ, তোর ক্যামেরা যেন সোমবার থেকে রেডি থাকে—৷’

সৌরভ প্রবল উৎসাহে ঘাড় কাত করে বলল, ‘কোনও চিন্তা নেই৷ কালকেই ফিল্ম কিনে ক্যামেরা লোড করে নেব৷’

অচ্যুত বলল, ‘রাতে সবাই রাজীবকে ফোন করে একটু সাহস দিস…নইলে ওর ভয় কাটবে না৷ তা ছাড়া ওর শরীর কেমন আছে, সেটাও জানা দরকার৷’

কুলদীপ, প্রতীক আর সৌরভ ঘাড় নাড়ল৷ বাসবের বাড়িতে ফোন নেই৷

ছুটির পর ছেলের দল স্রোতের মতো মাঠ পেরিয়ে লোহার গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল৷ সেই স্রোত এখন একেবারে ফিকে হয়ে এসেছে৷

ওরা দেখল, সত্যবানস্যার আরও দুজন স্যারের সঙ্গে স্কুল থেকে বেরোচ্ছেন৷ ওঁদের সঙ্গে হেসে-হেসে কথা বলছেন৷ দেখে মনেই হয় না এতগুলো ভয়ংকর ঘটনা সত্যি৷

কুলদীপ হঠাৎই জিগ্যেস করল, ‘অ্যাই, নেক্সট উইকে স্যাটাস্যাটের কোচিং-এর কী হবে?’

অচ্যুত বলল, ‘আমরা যেমন যাই যাব৷ শুধু রাজীবকে যেতে বারণ করব৷ আর শোন, স্যার যদি কাউকে একা ডাকেন তা হলে কেউ যাবি না৷ স্কুলে অতটা ভয় নেই…বেশি ভয় বাইরে৷’

অচ্যুত লক্ষ করল, সত্যবানস্যার যেতে-যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের জটলার দিকে একবার তাকালেন৷ ছোট্ট করে হাসলেন বলেও মনে হল৷ অবজ্ঞার হাসি৷

একটু পরেই ওরা যার-যার বাড়ির দিকে রওনা হল৷

আকাশে মেঘ আছে, তবে তেমন ঘন নয়৷ বাতাস বইছে, এলোমেলো৷ অচ্যুতের চুল হাওয়ায় উড়ছিল৷ মাঠে-ঘাটে কাশফুল ফুটেছে৷ জানিয়ে দিচ্ছে পুজোর আর খুব দেরি নেই৷ কিন্তু বর্ষার যা ঢং এবার, মনে হয়, মা দুর্গাকে প্রণাম না করে সে বাড়ি ফিরবে না৷

দোকানপাটে ভিড় তেমন নেই৷ পুজোর বাজার এখনও লাগেনি৷ পুজো-পুজো গন্ধটাও অচ্যুতের নাকে আসছে না৷ অথচ আর কিছুদিন পরেই পুজোর ছুটি পড়বে৷ ওর বন্ধুদের অনেকেই বাইরে বেড়াতে যাবে৷ অচ্যুতরা খুব একটা যায় না৷ গতবারে শুধু দিঘা গিয়েছিল৷

পথে একটা চুড়িদারের দোকান দেখতে পেল অচ্যুত৷ সেখানে অনেক বাহারি রঙের চুড়িদার ঝুলছে৷ তার মধ্যে একটা ওকে মউলির কথা মনে পড়িয়ে দিল৷ মউলির ওইরকম রঙের একটা চুড়িদার আছে৷

কাল রাতে মউলি অতক্ষণ ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল কেন? অচ্যুত কখন ফেরে সেটা দেখার জন্য?

মউলিকে সত্যবানস্যারের ব্যাপারটা বলতে পারলে ভালো লাগত৷ কিন্তু অচ্যুত তো এখনও পর্যন্ত মা-বাপিকেও কিছু বলেনি৷

সময় আসুক, তখন বলবে৷

রবিবার সকালে একটা ভয়ানক খবর অচ্যুতদের এলাকাটাকে একেবারে ঝুঁটি ধরে নেড়ে দিল৷

ওদের বাড়ি থেকে প্রায় দু-কিলোমিটার দূরে একটা বড় ধানকল আছে৷ তার পাশেই প্রকাণ্ড মাঠ৷ জেলা চ্যাম্পিয়ানশিপের বড়-বড় খেলা সব এই মাঠে হয়৷ এলাকার লোকজন মাঠটাকে ধানকলের মাঠ বলে৷

সেই মাঠে ভোরবেলা দু-দুটো মৃতদেহ পাওয়া গেল৷

দুটো মৃতদেহই রক্তহীন, ফ্যাকাশে৷ তাদের ঘাড়ের পাশে গভীর দুটো দাঁতের দাগ৷

এরকম অদ্ভুত মৃতদেহ এলাকার কেউ কখনও দেখেনি৷

যারা নিজের চোখে মৃতদেহ দুটো দেখেছে, তারা বলল, ‘ঠিক মনে হবে ঘাড়ে পাইপ ঢুকিয়ে কোনও পিশাচ কোক কিংবা পেপসি খাওয়ার মতো রক্ত টেনে নিয়েছে৷’

অচ্যুত পাড়ার হারানদার মুদিখানা দোকানে গুঁড়ো হলুদ আর চিঁড়ে কিনতে গিয়েছিল৷ সেখানে খবরটা শুনেই ওর গা গুলিয়ে উঠল৷ রাজীবের কথাগুলো মনে পড়ে গেল পলকে৷

যারা মারা গেছে তারা বিহারি৷ ধানকলে কাজ করত, মাঝে-মাঝে ছুটি-ছাটায় দেশে যেত৷ দেশোয়ালি ভাইদের সঙ্গে জোট বেঁধে ধানকলের কাছাকাছি ঝুপড়িতে থাকত৷

কাল রাতে ওরা দুজনে হয়তো নেশা-টেশা করতে বেরিয়েছিল…তারপর রাত করে মাঠের ওপর দিয়ে ফেরার সময় ওইরকম মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে৷

বহু চেষ্টা করেও খুনের উদ্দেশ্য কেউ খুঁজে পেল না৷ নেশাগ্রস্ত দুজন গরিব দেহাতিকে কে খুন করতে চাইবে? তা ছাড়া ঘাড়ের পাশে ওইরকম বীভৎস একজোড়া গর্তই বা কে করবে?

অনেকেই ধরে নিল, এ কোনও অপদেবতার কাজ৷

পুলিশ ফাঁড়ির বড়বাবু স্থানীয় লোকজনকে মামুলি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে ডেডবডি চালান করে দিয়ে দায় সারলেন৷

অচ্যুত বাড়ি ফিরে মা-বাপিকে এই জোড়া-খুনের খরব দিল৷

মা তো ভয়েই সারা৷ বলল, ‘কোচিং থেকে ফেরার সময় একা-একা ফিরবি না৷ এরকম কাণ্ড জীবনে শুনিনি বাবা!’

বাপি বলল, ‘দ্যাখো গিয়ে, কারা হয়তো রক্তের ব্যাবসা করার জন্যে সিরিঞ্জ দিয়ে সব রক্ত টেনে নিয়েছে!’

অচ্যুত বলল, ‘তা হলে এক-একজনের ঘাড়ে দুটো করে সিরিঞ্জের ফুটো কেন?’

‘কেন আর, দুটো সিরিঞ্জে তাড়াতাড়ি রক্ত টানা যাবে—৷’

বাপির স্বভাব হচ্ছে যে-কোনও সমস্যাকে চটজলদি সমাধান করে দেওয়া৷ যেমন এখন৷ বাপি যুক্তি দিয়ে ঠিক বুঝিয়ে দেবে রক্তের চোরাব্যবসার জন্যই ওই দুজন মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে৷ যদি প্রত্যেকের ঘাড়ে পাঁচটা করেও ফুটো থাকত, তা হলেও বাপির ব্যাখ্যা করতে কোনওরকম অসুবিধে হত না৷

এই জোড়া খুনের ঘটনাটার কথা শুনে অচ্যুত বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল৷ ও ভেবেছিল, আজই স্কুলের ব্যাপারগুলো মা-বাপিকে খুলে বলবে৷ কিন্তু বাপির দায়সারা যুক্তি আর ব্যাখ্যা শুনে ও দমে গেল৷ কে জানে, ওর কথা শুনে বাপি হয়তো আজগুবি বলে হেসেই উড়িয়ে দেবে!

সত্যবানস্যার ঠিক বলেছিলেন৷ এখন বিজ্ঞানের যুগ৷ সবাই শুধু প্রমাণ চাইবে৷ প্রমাণ না দিতে পারলে অচ্যুতের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না৷ এমনকী মা-বাপিও হয়তো বিশ্বাস করবে না৷

কিছুক্ষণ কী ভাবল ও৷ তারপর ভেতরের ঘরে গিয়ে সৌরভকে ফোন করল৷

ফোন করতেই সৌরভ উত্তেজিতভাবে বলল, ‘জোড়া মার্ডারের খবর পেয়েছিস তো?’

‘হ্যাঁ—৷’

‘শোন, কুলদীপ আমাকে ফোন করেছিল, ওর পাড়ার দু-বন্ধুকে ও স্যাটাস্যাটের পেছনে লাগিয়ে দিয়েছিল৷ তারা স্যাটাস্যাটকে কাল রাতে ধানকলের মাঠে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে৷’

‘ক’টার সময়?’

‘এই ধর দশটা৷ মাঠের ধারে জঙ্গলের কাছটায় স্যাটাস্যাট ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়েছিল৷ ওর সঙ্গে আরও একজন ছিল—তবে সে অন্ধকারে গাছের আড়ালে থাকায় ওরা লোকটাকে দেখতে পায়নি৷ স্যাটাস্যাট লোকটার সঙ্গে নীচু গলায় কথা বলছিল৷ কুলদীপের বন্ধুরা কোনও কথা শুনতে পায়নি৷ তারপর…রাত বাড়ছিল বলে ওরা ভয়ে পালিয়ে এসেছে…৷’

তা হলে কি দুটো খুন দুজনের কীর্তি? স্যাটাস্যাট একা করেনি?

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর অচ্যুত বলল, ‘শোন, তোকে যে-জন্যে ফোন করেছি৷ তোর ক্যামেরাটা রেডি আছে তো?’

‘হ্যাঁ রেডি—৷’

‘কাল স্কুলের পর তোর বাংলা কোচিং আছে না?’

‘হ্যাঁ—তো কী হয়েছে?’

‘তুই কোচিং সেরে ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে আমাকে মিট করবি৷ পরেশদার কেকের দোকানের সামনে৷ সেখান থেকে আমরা স্যাটাস্যাটের কোচিং-এ যাব…শুধু তুই আর আমি…তার বেশি গেলে সব ভন্ডুল হয়ে যাবে৷’

সৌরভ বলল, ‘ও. কে.৷’

‘শোন, ক্যামেরা নিয়ে যে আমরা কোথায় যাচ্ছি সেটা আমাদের গ্রুপের বাইরে কাউকে বলবি না৷’

‘আচ্ছা৷’ একটু চুপ করে থেকে তারপর সৌরভ জানতে চাইল, ‘কাল স্যাটাস্যাটের ফটো তুলবি?’

‘হ্যাঁ৷ কাল তা হলে ঠিক সাতটায়…৷’ রিসিভার নামিয়ে রাখল অচ্যুত৷

তারপর পড়াশোনা নিয়ে বসল৷

বই-খাতা চোখের সামনে খোলা, অক্ষর কিংবা শব্দগুলো দিব্যি নজরে পড়ছে—কিন্তু মাথায় সেগুলোর কোনওরকম অর্থ তৈরি হচ্ছিল না৷ সেখানে মাইলের পর মাইল লম্বা ঘুড়ির সুতো যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছিল৷ আর জটের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে অচ্যুত হাঁসফাঁস করছিল৷

বারবার রাজীবের কথা মনে পড়ছিল৷ খুব কপালজোরে ও বেঁচে গেছে৷ নইলে ধানকলের মাঠের ঘটনার মতোই ওকে পুকুরপাড়ে আগাছার জঙ্গলে ভোরবেলা পাওয়া যেত৷

অচ্যুতের বুকের ভেতরে মেঘ ডেকে উঠল৷

রাজীবও নিশ্চয়ই ধানকলের মাঠের খবরটা শুনেছে! ছোট জায়গায় খবর ছড়াতে বেশি সময় লাগে না৷

এ খবর কানে গেলে রাজীব হয়তো আরও ভয় পেয়ে যাবে৷

নানান চিন্তায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই রাজীবকে ফোন করল অচ্যুত৷

‘হ্যালো—৷’

ওপাশ থেকে কোনও মহিলা ইংরেজিতে রাজীবদের ফোন নম্বরটা বললেন৷ গলা শুনে মনে হল রাজীবের মাম্মি৷

‘রাজীব আছে?’

‘হু ইজ স্পিকিং প্লিজ?’

‘আমি অচ্যুত—রাজীবের ক্লাসমেট…৷’

‘হ্যাঁ, ধরো—৷’

একটু পরেই রাজীব ফোনে কথা বলল, ‘অচ্যুত, খবরটা শুনেছিস?’

‘ধানকলের মাঠের কেসটা?’

‘হ্যাঁ৷’ রাজীবের গলায় চাপা উত্তেজনা৷

‘সেইজন্যেই তোকে ফোন করেছি৷ একটুও ভয় পাবি না—আমরা শিগগিরই যা-হোক কিছু একটা ব্যবস্থা করছি৷ স্যাটাস্যাটের কেসটা আমরা এসপার-ওসপার করে ছাড়ব৷’

‘শোন…একটা ব্যাপার…মানে…৷’ থতিয়ে থতিয়ে বলতে চাইল রাজীব৷

‘কী হয়েছে?’

‘স্যাটাস্যাট কাল রাতে আমাকে ফোন করেছিল…৷’

‘বলিস কী!…কী বলল?’ অচ্যুতের বুকের ভেতরে ড্রাম বাজতে শুরু করল৷

‘আমাকে ওর কোচিং-এ যাওয়ার কথা বলছিল৷’

‘সে কী! কাল তো কোচিং ছিল না৷’

‘সেইজন্যেই তো ডাকছিল৷ বলছিল, আমার সঙ্গে ওর একা-একা কী দরকার…তাই…৷’

‘খবরদার যাবি না!’ চেঁচিয়ে উঠল অচ্যুত৷

‘শেষ পর্যন্ত মাম্মির ধমক খেয়ে যাইনি৷ তবে…তবে ভীষণ যেতে ইচ্ছে করছিল…৷’ অপরাধীর সুরে বলল রাজীব, ‘তুই বিশ্বাস করবি না, স্যার কীরকম অদ্ভুত গলায় আমাকে ডাকছিলেন৷ ঠিক যেন নেশা ধরানো ঘুমপাড়ানি গান৷ অনেকটা গল্পের নিশির ডাকের মতো৷ বারবার বলছিলেন, ‘‘আসতে তোকে হবেই৷ আমার ডাক তুই ফিরিয়ে দিতে পারবি না৷ আজ না হয় কাল তোকে আসতেই হবে৷ আমার তেষ্টা তোর রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দেবে, তোকে পাগল করে দেবে৷ তোর আমার যে রক্তের সম্পর্ক, তাকে কখনও ছিন্ন করা যায় না৷ কখখনও না৷’’

‘…তুই বিশ্বাস কর, অচ্যুত—আমি তখন মাতালের মতো হয়ে গিয়েছিলাম৷ স্যার ছাড়া আমি আর তখন কিচ্ছু ভাবতে পারছিলাম না৷ মাথাটা হঠাৎ কেমন টলে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম৷ টেবিলের একটা কোনা ধরে সামলে নিলাম৷ মাম্মি একটু দূরে বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল৷ আমাকে টলে যেতে দেখেই ছুট্টে আমার কাছে এসে আমাকে ধরে ফেলল৷ তারপরই..৷’

‘তারপর কী?’

‘তারপর মাম্মির সঙ্গে আমার কী ঝামেলা! মাম্মি আমাকে কিছুতেই বাড়ি থেকে বেরোতে দেবে না, আর আমি বেরোবই! শেষ পর্যন্ত মাম্মির ধমক খেয়ে…৷’

রাজীব হঠাৎ ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল৷

অচ্যুত ওকে কী বলবে ভেবে পেল না৷ রাজীব কাঁদছে কেন সেটাও ঠিক বুঝে উঠতে পারল না৷

কান্না থামিয়ে ভাঙা গলায় রাজীব বলল, ‘কাল আমি খুব জোর বেঁচে গেছি, না রে?’

অচ্যুত অবাক হয়ে গেল, ‘কেন বল তো?’

‘আমি গেলাম না বলেই হয়তো ধানকলের মাঠের লোক দুটো খতম হয়ে গেল৷’

‘এসব তুই কী বলছিস!’

‘ঠিকই বলছি৷ স্যারের সেই ডাকের টান যে কী মারাত্মক সে তোকে আমি বলে বোঝাতে পারব না৷’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাজীব ধরা গলায় জানতে চাইল, ‘তোরা শেষ পর্যন্ত আমাকে ধরে রাখতে পারবি তো? তোদের ব্যাগ থেকে আর কখখনও আমি টাকা চুরি করব না…বিশ্বাস কর৷’ রাজীব আবার কাঁদতে শুরু করল৷

ওর কান্নাটা এমন যেন ও জেনে গেছে, ওর কপালে কেউ সুনিশ্চিতভাবে কাটা চিহ্ন এঁকে দিয়েছে৷

অচ্যুতের খুব কষ্ট হল৷ ও বলল, ‘তুই মিছিমিছি কাঁদছিস৷ তোর কোনও ভয় নেই৷ আমি এক্ষুনি কুলদীপ, প্রতীকদের ফোন করছি৷ আধঘণ্টার মধ্যে আমরা তোর বাড়িতে যাচ্ছি৷ আন্টিকে আমাদের জন্যে শরবত তৈরি করে রাখতে বল…৷’

ফোন ছেড়ে দিল অচ্যুত৷

ওর শরীরটা কেমন অবশ লাগছিল৷ দিশেহারাভাবে ও যে-কোনও একটা পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিল৷

.

৷৷সাত৷৷

সোমবার সন্ধে সাতটার সময় সৌরভ পরেশদার কেকের দোকানের সামনে এল৷

অচ্যুত আগে থেকে সাইকেল নিয়ে কেকের দোকানের পাশে একটা সাইকেল সারানোর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সৌরভকে দেখেই ওর দিকে এগিয়ে গেল৷ চাপা গলায় জিগ্যেস করল, ‘ক্যামেরা এনেছিস তো?’

সৌরভ মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল৷

‘চল যেতে-যেতে প্ল্যানটা বলছি…৷’

সাইকেলে উঠে পড়ল অচ্যুত৷ সৌরভও সাইকেল নিয়ে ওর পাশে-পাশে চলল৷

সরু রাস্তায় ওদের বেশ কসরত করে সাইকেল চালাতে হচ্ছিল৷ আজ সারাদিনে এক ফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি, তাই রাস্তা মোটামুটি শুকনো৷ তবে বাতাস থমকে গিয়ে একটা গুমোট গরম চেপে বসেছে৷

রাস্তায় মোটামুটি ভিড়৷ তারই মধ্যে দুটো সাইকেল-ভ্যান মাইক লাগিয়ে আগামী রবিবারে কী একটা মিটিং হবে বলে প্রচার চালাচ্ছে৷ ‘দলে-দলে যোগ দিন’ কথাটা বারবার ওদের কানে এসে ঝাপটা মারছিল৷

কোনওরকম যানজট কাটিয়ে সাইকেল-ভ্যানে দুটোকে পেরিয়ে গেল ওরা৷ তারপর জোরে প্যাডেল করতে শুরু করল৷

কাল বিকেলে অচ্যুত, প্রতীক, কুলদীপ আর বাসব রাজীবের বাড়িতে গিয়েছিল৷ ওকে যতটা সম্ভব ভরসা দিয়ে এসেছে৷ কিন্তু অচ্যুত বুঝতে পারছিল, একটা সাংঘাতিক ভয় রাজীবের মনে গেঁথে গেছে৷ ওর কাছে ঘণ্টাদেড়েক থেকে তারপর অচ্যুতরা যার-যার বাড়ি ফিরে গেছে৷

সাইকেল চালাতে-চালাতে সৌরভ আর অচ্যুত স্কুলের কাছে চলে এল৷ স্কুল পেরিয়ে, পুকুর পেরিয়ে, যতই এগোতে লাগল রাস্তার লোকজন ততই ফিকে হতে লাগল৷ সেই সঙ্গে আলোও৷

বর্ষার টইটম্বুর নালা থেকে ব্যাঙের দল ডাকছিল৷ তার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে ঝিঁঝির দল সঙ্গত করছিল৷ বড়-বড় গাছের মাথা আকাশের মেঘের সঙ্গে কখন যে মিশে গেছে সেটা ঠাহর করা যাচ্ছিল না৷ পথের এখানে-ওখানে কয়েকটা ঝুপড়ি-দোকানে পান-বিড়ি-সিগারেট আর চা বিক্রি হচ্ছে৷ তার টিমটিমে আলো দোকান ছাড়িয়ে রাস্তায় পৌঁছতে পারছে না৷

একটু পরেই সত্যবানস্যারের কোচিং-এ পৌঁছে গেল ওরা৷

দেড়খানা ঘর নিয়ে পলেস্তারা-খসা একটা একতলা বাড়ি৷ তার একপাশে টিনের চাল৷ বাড়ির ডানপাশে আর পিছনদিকে গাছ-আগাছার দল যেমন খুশি বেড়ে উঠেছে৷ আর বাঁ-দিকে একটা জং-ধরা ঘাড় কাত করা টিউবওয়েল৷

বাড়ির বাইরে আলো বলতে হাতদশেক দূরে ইলেকট্রিক পোস্টের মাথায় ঝোলানো একটা বালব৷

এই আস্তানাটা ভাড়া নিয়ে সত্যবানস্যার কোচিং চালান৷

বড় ঘরটার চারটে ছোট-ছোট জানলা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছিল৷ জানলাগুলো একটু উঁচুতে হাওয়ায় শুধু ঘরের ড্যাম্প ধরা দেওয়াল চোখে পড়ছে৷

কোচিং-এর ঘর থেকে একটু দূরে সাইকেল থামাল অচ্যুত আর সৌরভ৷ আগাছার জঙ্গলের ওপরে সাইকেল দুটো ওরা কাত করে শুইয়ে দিল৷ তারপর অচ্যুত নীচু গলায় সৌরভকে বলল, ‘তুই আস্তে- আস্তে পেছনদিকে চলে যা৷ সাবধানে জানলা দিয়ে উঁকি মারবি৷ যেই দেখবি স্যাটাস্যাট পিকিউলিয়ার কিছু করছে অমনি ফটো তুলে নিবি৷ শিয়োর হওয়ার জন্যে দরকার হয় দু-তিনটে শট নিবি৷ তারপর সোজা সাইকেল নিয়ে পালাবি—কোনওদিকে তাকাবি না৷ রাতে তোর সঙ্গে আমি ফোনে কথা বলে নেব৷’

সৌরভের মুখে আলো-ছায়া নড়ছিল৷ ওকে একটু যেন বিভ্রান্ত দেখাল৷ ও জিগ্যেস করল, ‘স্যাটাস্যাট হঠাৎ পিকিউলিয়ার কিছু করবে কেন?’

অচ্যুত কোচিং ক্লাসের দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ সেদিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই বলল, ‘সে-দায়িত্ব আমার৷ তুই যা—রেডি হয়ে থাক…৷’ সৌরভকে ঠেলা মারল অচ্যুত৷

সৌরভ পা টিপে-টিপে বাড়ির পিছনদিকে চলে গেল৷

আর অচ্যুত সটান হেঁটে গিয়ে কোচিং ক্লাসের ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল৷ ওর বুকের ভেতরে যে মেঘ গুড়গুড় করছিল সেটাকে ও জোর করে ভুলে যেতে চাইল৷

‘স্যার—৷’

অচ্যুতের ডাকে সত্যবানস্যার চোখ তুলে তাকালেন৷

ঘরে আর কেউ নেই৷ মেঝেতে পাতা শতরঞ্চির ওপরে বসে স্যার খাতা দেখছেন৷

খুব শিগগিরই স্কুলে কোনও পরীক্ষা হয়নি৷ এগুলো নিশ্চয়ই স্যারের কোচিং-এ নেওয়া পরীক্ষার খাতা৷

‘তুই হঠাৎ এসময়ে?’

‘স্যার, আপনার কথা আমি কাউকে বলিনি৷’

হাসলেন সত্যবানস্যার : ‘আয়, আয়—এখানে এসে বোস৷’

অচ্যুত দরজার কাছে চটি ছেড়ে শতরঞ্চির ওপরে গিয়ে বসল৷ চোখের আন্দাজে মেপে দেখল স্যারের কাছ থেকে ওর দূরত্ব মাত্র তিন হাত৷

স্যারকে লক্ষ করছিল অচ্যুত৷ তেলচকচকে চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো৷ কিন্তু মাথা ঝুঁকিয়ে থাকায় কয়েকগোছা চুল চশমার ওপরে ঝুলে পড়েছে৷ পাশ থেকে স্যারের নাকটাকে আরও খাড়া মনে হচ্ছে৷ আর গলার পাশে একটা শিরা ফুলে রয়েছে৷

শিরাটার ওপরে চোখ পড়তেই অচ্যুতের বুকের ভেতরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠল৷ ওর ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল৷ কিন্তু মনের জোরে ইচ্ছেটাকে ও রুখে দিল৷ রাজীবের কথা মনে করে ও চোয়াল শক্ত করল৷

সত্যবানস্যার আবার মাথা নীচু করে খাতা দেখছিলেন৷ সেই অবস্থাতেই জিগ্যেস করলেন, ‘তোর পড়াশোনা কেমন হচ্ছে? তুই আমার সবচেয়ে ফেভারিট স্টুডেন্ট…৷’

‘পড়াশোনায় একদম মন বসছে না, স্যার৷’ অনুযোগ করে বলল অচ্যুত৷

‘কেন রে?’ স্যার খাতার দিক থেকে চোখ সরালেন না৷

‘আপনার জন্যে৷’

চমকে চোখ তুলে তাকালেন : ‘তার মানে!’

‘আপনার…ইয়ে…ওইগুলো আমি এখনও…মানে…বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না৷ মনে হচ্ছে, আমি সত্যি-সত্যিই ভুলভাল দেখেছি৷ আপনি কী করে দেওয়ালে হাঁটবেন! কী করে আপনার চোখ সবুজ হবে! অসম্ভব!’ একদমে কথাগুলো বলে গেল অচ্যুত৷

‘ভুলভাল? অসম্ভব?’ হাতে ধরা লাল পেন ছেড়ে দিলেন সত্যবানস্যার৷ ওঁর টকটকে ফরসা গালে অপমানের রক্ত ছুটে এল৷ কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে কোমলভাবে হাসলেন : ‘যাকগে, ওসব কথা ছাড়৷ তুই কী দরকারে এসেছিল বল…৷’

‘আপনি রাগ করবেন না, স্যার৷ ওরকম অলৌকিক ব্যাপার…তাই সত্যি বলে মানতে কষ্ট হচ্ছে৷ আমি এরকম ভুল দেখলাম! আমি, স্যার, ঠিক বলে বোঝাতে পারছি না…৷’

সত্যবানস্যার স্নেহের হাসি হাসলেন৷ বললেন, ‘বুঝেছি…বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে তোর মেন্টাল ডিসটারবেন্স হচ্ছে৷ তা কী করলে তুই খুশি হবি? কী করলে তোর পড়ায় মন বসবে?’

কয়েকবার ঢোঁক গিলল অচ্যুত৷ তারপর দমকা হাওয়ার মতো বলে বসল, ‘আমাকে আর-একবার করে দেখাবেন, স্যার?’

অদ্ভুত হেসে সত্যবানস্যার উঠে দাঁড়ালেন৷ স্যারকে অনেক লম্বা দেখাচ্ছিল৷ অচ্যুতের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘ব্যস, এই?’

অচ্যুত দম বন্ধ করে ঘাড় নাড়ল৷ বলতে চাইল, ‘হ্যাঁ—এই৷’

স্যার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দিলেন৷ তারপর শূন্যে কয়েকবার হাত নেড়ে দরজার পাশের দেওয়ালে থাবা বসিয়ে দিলেন৷ এবং টিকটিকির মতো দেওয়ালে শরীরটাকে লেপটে সাঁতার কাটার ভঙ্গিতে এগোতে লাগলেন৷

অচ্যুতের শীত করতে লাগল৷ ওর মনে হল, একটা কদাকার সরীসৃপ দেওয়ালে কিলবিল করছে৷ একটা ভয়ের চিৎকার ওর গলা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল৷ প্রাণপণ চেষ্টায় অচ্যুত সেটাকে রুখে দিল৷ আর মনের জোরে শতরঞ্চির ওপরে স্থির হয়ে বসে রইল৷

মাথার ওপরে পুরোনো সিলিং পাখার খটখট আওয়াজ হচ্ছিল৷ কিন্তু তারই মধ্যে অচ্যুত যেন কয়েকবার অটোমেটিক ক্যামেরার ‘চিঁউ-চিঁউ’ শব্দ শুনতে পেল৷

স্যার দেওয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন৷ সেই অবস্থাতেই ঘাড় কাত করে হাসিমুখে অচ্যুতের দিকে তাকালেন : ‘কিছুদিন আগে যখন এই ক্ষমতাটা আবিষ্কার করি তখন খুব তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম, বুঝলি৷ তারপর খেয়াল করলাম, আমার মনের ভেতরে কেমন একটা তোলপাড় চলছে৷ কখনও অঙ্ক মনে থাকে, কখনও থাকে না৷ কখনও চেনা লোককে চিনতে পারি, কখনও পারি না৷ প্রথম-প্রথম একটু অসুবিধে হচ্ছিল, কিন্তু দু-একদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা সয়ে গেল৷ আর…৷’ স্যার সিলিং-এর দিকে বেয়ে উঠতে লাগলেন : ‘…আর অদ্ভুত একটা তেষ্টা শুরু হল৷ যখন তেষ্টা পায় তখন কোনও জ্ঞান থাকে না৷ তখন তো আর আমি আমি থাকি না! আবার যখন তেষ্টা পায় না তো পায় না৷ অ্যাই, রাজীব কেমন আছে রে?’

‘ভ-ভালো আছে৷’ চাপা শব্দের টুকরোগুলো অচ্যুতের ঠোঁট থেকে যেন ছিটকে বেরিয়ে এল৷

‘ওকে আমি খুব ভালোবাসি৷ অবশ্য তোকেও ভালোবাসি…৷’ স্যার দেওয়াল বেয়ে মেঝের দিকে নেমে আসতে লাগলেন : ‘তোকে ভালোবাসি তুই অঙ্কে চ্যাম্পিয়ান বলে৷ আর রাজীবকে…থাকগে, সে অন্য ব্যাপার৷’

সার্কাস শেষ করে সত্যবানস্যার শতরঞ্চির ওপরে নেমে এলেন৷ হাততালি দেওয়ার ভঙ্গিতে শব্দ করে হাত ঝাড়লেন৷ চশমাটা ঠিক করে নাকের ওপরে সেট করে বললেন, ‘কী রে, এবার তুই খুশি তো? এখন থেকে পড়ায় মন বসবে তো?’

অচ্যুত কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ঘাড় নাড়ল৷ বাতাসে ঘরের জানলার পাল্লা নড়ে উঠল৷ একটা জংলি গন্ধ ঘরে ঢুকে পড়ল যেন৷

‘সবুজ চোখ কী আর দেখতে চাস?’

অচ্যুত মাথা নাড়ল এপাশ-ওপাশ৷ না, ও দেখতে চায় না৷

‘আসলে কী জানিস, এখন বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যুগ৷ সবাই শুধু প্রমাণ চায়৷ তাই আমার এসব নিজের চোখে না দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না৷ প্রথম-প্রথম তো আমারই বিশ্বাস হতে চায়নি৷’ বলে মিহি গলায় খিলখিল করে হেসে উঠলেন সত্যবানস্যার৷

স্যারের গলাটা হঠাৎ বদলে যাওয়ায় অচ্যুত একটু চমকে গেল৷ দেখল, স্যার হাসতে-হাসতেই মাথাটা এপাশ-ওপাশ দোলাচ্ছেন৷ স্যারের চোখ দুটো নিজে থেকেই কেমন কটা রঙের হয়ে যাচ্ছে৷

স্যারের হাসিটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গোঙানির মতো হয়ে গেল৷ তিনি খপ করে অচ্যুতের ডান হাতের কবজি চেপে ধরলেন৷ তীব্র চোখে তাকালেন ওর দিকে৷

স্যারের হাতটা কী গরম! যেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে!

অচ্যুত ঝটকা মেরে হাতটা টেনে ছাড়াতে চেষ্টা করল৷ পারল না৷

কেমন যেন ভাঙা খনখনে গলায় সত্যবানস্যার বললেন, ‘বাঁচতে চাস তো এক্ষুনি পালা৷ তুই অঙ্কে চ্যাম্পিয়ান৷ তোর কোনও ক্ষতি হোক আমি চাই না৷’ ওর হাতটা ছেড়ে দিলেন স্যার৷ একরকম যেন ছুড়ে দিলেন অচ্যুতের কোলে : ‘পালা! পালা শিগগিরই!’

অচ্যুত লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল৷ একছুটে চলে গেল দরজার কাছে৷

সত্যবানস্যার তখন শরীরটাকে পিছনদিকে বেঁকিয়ে বুকে হাত বোলাচ্ছেন আর বুক-ফাটা তেষ্টায় চাপা শব্দ করছেন, ‘ওঃ! ওঃ!’

হঠাৎই নিজের ডানহাতে হিংস্র কামড় বসিয়ে দিলেন৷

অচ্যুতের মাথাটা যেন ঘুরে গেল, দরজা ধরে নিজেকে সামলে নিল৷

স্যারের চোখ দুটো গাঢ় সবুজ হয়ে গেল৷ হাত কামড়ে ধরা অবস্থাতেই তিনি অচ্যুতের দিকে মুখ তুলে তাকালেন৷ গোঙানির মতো শব্দ করে কিছু একটা বলতে চাইলেন৷ তারপর কামড়ে ধরা জায়গাটা প্রবল টানে শব্দ করে চুষতে লাগলেন৷

এতক্ষণ গলা টিপে ধরে রাখা চিৎকারটা এইবার অচ্যুতের গলা দিয়ে বেরিয়ে এল৷ একটানে দরজা খুলে ও ছিটকে চলে এল বাইরে৷ চোখ-মুখে অসহ্য তাপ৷ মাথা ঝিমঝিম করছে৷ কোনওরকমে ও ছুটে গেল শুইয়ে রাখা সাইকেলের কাছে৷ তারপর অচ্যুত নামের একটা রোবট অমানুষিক গতিতে সাইকেল ছুটিয়ে দিল৷

ঠিক তখনই ঝিরঝিরে বৃষ্টি নেমে পড়ল আকাশ থেকে৷

অচ্যুতের ভয় ক্রমশ কমছিল৷ কারণ, ও বোধহয় পালটে যাওয়া সত্যবানস্যারের ধরনধারণ এখন অনেকটা স্পষ্টভাবে আঁচ করতে পারছিল৷ বুঝতে পারছিল, সত্যবানস্যারের একটা ভয়ানক অসুখ হয়েছে৷ এ-অসুখ কখনও সারে কি না অচ্যুতের জানা নেই৷

মঙ্গলবার স্কুলের দিনটা বেশ উত্তেজনার মধ্যে কাটল৷ কারণ, পরদিনই ওরা সৌরভের তোলা ফটো দেখতে পাবে৷

অচ্যুত টিফিনের সময় সৌরভকে বলল, ‘তুই ফটোর দোকানে বলবি, ওগুলো আমাদের স্কুলের একটা নাটকের রিহার্সালের ফটো—এমার্জেন্সি প্রিন্ট দরকার৷’

প্রতীক বলল, ‘স্যাটাস্যাটকে যদি চিনে ফ্যালে?’

বাসব বলল, ‘তোদের কাছে যা শুনলাম তাতে মনে হয় স্যাটাস্যাটের মুখ ভালো করে দেখা যাবে না৷’

কুলদীপ চোখ পাকিয়ে বলল, ‘চিনতে পারল তো বয়েই গেল—৷’ তারপর বাসবের টিফিন বক্স থেকে আধখানা সন্দেশ নিয়ে মুখে পুরে দিল৷

সৌরভ বলল, ‘ফটোর প্রিন্ট হাতে এলে অমিয়স্যারকে ব্যাপারটা জানালে কেমন হয়?’

অচ্যুত বলল, ‘জানালে অমিয়স্যার হয়তো হেডস্যারকে জানাতে বলবেন৷ হেডুর সঙ্গে দেখা করতে আমার ভয় করে৷’

কুলদীপ বলল, ‘ভয়ের কী আছে! স্যাটাস্যাটের ফটো নিয়ে আমি তোর সঙ্গে হেডুর কাছে যাব৷’

‘ঠিক আছে প্রিন্টটা আগে হাতে আসুক…৷’

ওদের আলোচনা-পরিকল্পনার যেন কোনও শেষ নেই৷ স্কুলে যে-কথা শেষ হয় না সেগুলো রাতে টেলিফোনে চলতে থাকে৷

অচ্যুত যে ইদানীং ফোন বড্ড বেশি করছে সেটা ওর মায়ের নজরে পড়ল৷ এমনিতে ওরা খুব দরকার ছাড়া ফোন ব্যবহার করে না৷ কারণ, অচ্যুতের বাপিকে বেশ কষ্ট করেই ফোনের খরচ চালাতে হয়৷ তাই বাড়াবাড়িরকম ফোন করা নিয়ে মা অচ্যুতকে বারদুয়েক বকাবকি করল৷

‘মা যদি জানত কেন এত ফোন করতে হয়, তা হলে ভয়ে কেঁপে উঠত৷’ মনে-মনে ভাবল অচ্যুত৷

বুধবার সকালে ও ফোন করে রাজীবের খবর নিল৷ রাজীব এখন পুরোপুরি সেরে উঠেছে৷ তবে মনের জোর ততটা ফিরে পায়নি৷

সেদিন সন্ধেবেলা সত্যবানস্যারের কোচিং-এ সময়টা বেশ সহজ-স্বাভাবিকভাবেই কেটে গেল৷ স্যারকে দেখে কে বলবে, গত পরশু রাতে এই কোচিং-ঘরের দেওয়ালে তিনি বুকে হেঁটে বেড়িয়েছেন!

স্যার দু-তিনবার রাজীবের কথা জিগ্যেস করলেন৷ তারপর আচমকা মাথাটা পিছনদিকে হেলিয়ে বুকে কয়েকবার হাত বোলালেন৷

কোচিং-এর শেষে বাড়ি ফেরার সময় ওরা সৌরভের সঙ্গে ফটোর দোকানে গেল৷ ফটোগুলো ডেলিভারি নিয়ে ওরা একটু দূরে সরে গেল৷

ধীরে-ধীরে খাম থেকে প্রিন্টগুলো বের করল সৌরভ৷

ওরা সবাই হাঁ করে সত্যবানস্যারের ছবিগুলো গিলতে লাগল৷

অচ্যুত একটা প্রিন্ট নিজের কাছে রেখে দিল৷ মউলিকে ঘটনাগুলো যখন বলবে তখন ছবিটা দেখাবে৷

কুলদীপ বলল, ‘আমি বাসবকে একটা ফটো দেখিয়ে দেব৷’

প্রতীক বলল, ‘তোরা যদি বলিস, তা হলে রাজীবকেও দেখাব৷’

অচ্যুত বলল, ‘না, না—রাজীবকে এক্ষুনি দেখানোর দরকার নেই৷ ও আগে সেরে উঠুক, রেগুলার স্কুলে আসুক—তখন দেখানো যাবে৷’

তারপর ওরা যার-যার বাড়ির দিকে রওনা হল৷

রাজীবের কথা ভাবতে-ভাবতে অচ্যুত বাড়ি ফেরামাত্রই মা বলল, ‘একটু আগেই রাজীবের মা ফোন করেছিলেন৷ জানতে চাইছিলেন, রাজীব আমাদের বাড়িতে এসেছে কি না৷’

‘তার মানে!’ চমকে উঠল অচ্যুত৷

সঙ্গে-সঙ্গে ও রাজীবের বাড়িতে ফোন করল৷

‘হ্যালো, আন্টি, আমি অচ্যুত বলছি৷’

‘দ্যাখো না, রাজু আধঘণ্টা মতন আগে কাউকে না বলে কোথায় বেরিয়ে গেছে৷ আমি ওর ফোনবুক দেখে পসিবল সব জায়গায় ফোন করলাম৷ বাট নোবডি নোজ হোয়্যার হি ইজ৷ রাজু এখনও ভালো করে সেরে ওঠেনি—শরীর এখনও উইক…আমি যে এখন কী করি! ওর বাপি গতকাল ভাইজাগ গেছে—ফ্রাইডেতে ফিরবে…৷’ রাজীবের মাম্মির আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে গেছে৷ ওঁর গলা বেশ অসহায় শোনাচ্ছে৷

‘আচ্ছা, আজ সন্ধের পর রাজীবের কি কোনও ফোন এসেছিল?’ অচ্যুতের বুকের ভেতরে গুমগুম শব্দ শুরু হয়ে গেল৷ ও উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল৷

‘হ্যাঁ…কে একজন ফোন করেছিলেন৷ বলছিলেন, রাজুর স্যার…৷’

‘ক’টার সময় ফোনটা এসেছিল?’

‘অ্যাবাউট এইট থারটি…৷’

অচ্যুতদের কোচিং শেষ হয়েছে আটটা নাগাদ৷ তা হলে তার পরে সত্যবানস্যার রাজীবকে ফোন করে থাকতে পারেন৷

রবিবার রাজীবের সঙ্গে অচ্যুতের ফোনে কথা হয়েছিল৷ রাজীব তখন কান্নাকাটি করছিল৷ বলছিল, স্যাটাস্যাট ওকে অদ্ভুত গলায় ডাকছিল৷ ঠিক যেন নেশা ধরানো ঘুমপাড়ানি গান৷ অনেকটা নিশির ডাকের মতো৷

সেদিনটা ছিল শনিবার৷

তা হলে আজও কি সেইরকম কিছু হয়েছে? রাজীবের মাম্মি আজ আর ছেলেকে আটকাতে পারেননি৷

‘কী হল?’ রাজীবের মাম্মি ওপাশ থেকে জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি কিছু বলছ না কেন?’

অচ্যুত ঠোঁট কামড়াল৷ একপলক তাকিয়ে রইল ফাঁকা দেওয়ালের দিকে৷ তারপর বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না৷ আমি খোঁজ করে দেখছি৷ কোনও খবর পেলে আপনাকে ফোন করে জানিয়ে দেব৷’

‘তুমি একটু সিরিয়াসলি দ্যাখো, অচ্যুত৷ আমি ভীষণ উয়ারিড হয়ে আছি৷’

ওঁকে আবার আশ্বাস দিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল অচ্যুত৷

ওর মন বলল, সত্যবানস্যারের কোচিং-ঘরে গিয়ে একবার খোঁজ করা দরকার৷

ও চটপট কুলদীপ, প্রতীক আর সৌরভকে ফোন করল৷

প্রতীককে বাড়িতে পাওয়া গেল না৷ বাকি দুজনকে ও তৈরি হয়ে সত্যবানস্যারের কোচিং-এ আসতে বলল৷

তারপর শোওয়ার ঘরে গিয়ে বাপির বালিশের পাশ থেকে তিন ব্যাটারির টর্চটা তুলে নিল৷ একবার ‘অন’ করে দেখে নিল ঠিকঠাক জ্বলছে কি না৷

টর্চ হাতে নিয়ে বেরোনোর সময় রান্নাঘরের দিকে গলা বাড়িয়ে বলল, ‘মা, আমি একটু কুলদীপের বাড়ি যাচ্ছি৷ তাড়াতাড়ি ফিরে আসব৷ তুমি দরজাটা দিয়ে দাও৷’

মা তাড়াতাড়ি খুন্তি-কড়াই সামলে রান্নাঘর থেকে বেরোতে-বেরোতে অচ্যুত সাইকেল টেনে নিয়ে রাস্তায় চলে এসেছে৷

মা সদর দরজার কাছে যখন এল তখন অচ্যুতের সাইকেল অনেকটা দূরে চলে গেছে৷ মায়ের পিছুডাক ও শুনতে পেল না৷ দরজা বন্ধ করতে-করতে মা ভাবল, অচ্যুতের বাবার কী যে এক তাসের নেশা! সে বাড়িতে থাকলে যা-হোক করে ছেলেটাকে হয়তো আটকাতে পারত৷ এই বয়েসটা যে ভালো নয়, সেটা মানুষটা বুঝলে আর চিন্তা ছিল না৷ ছেলেটা এমন তাড়াহুড়ো করে কুলদীপের বাড়ি গেল কেন, কে জানে!

মায়ের জন্য অচ্যুতের খারাপ লাগছিল৷ কিন্তু আরও খারাপ লাগছিল রাজীবের জন্য৷

জোরে প্যাডেল করে দশমিনিটের মধ্যেই ও সত্যবানস্যারের কোচিং-এ পৌঁছে গেল৷ দেখল, কুলদীপ আর সৌরভ তখনও এসে পৌঁছয়নি৷

বাড়িটার কাছ থেকে একটু দূরে সাইকেল থামিয়ে দিল অচ্যুত৷ অবাক হয়ে দেখল, কোচিং-ঘরের জানলাগুলো খোলা, কিন্তু কোনও জানলাতেই আলো চোখে পড়ছে না৷

আলো নেভানো অথচ জানলা খোলা কেন?

সাইকেল থেকে নেমে পা টিপে-টিপে কোচিং-এর দরজার দিকে এগোল অচ্যুত৷ ডানহাতের শক্ত মুঠোয় টর্চটা ধরা রয়েছে৷

রাত সবে ন’টা পেরিয়েছে, কিন্তু এই অঞ্চলটা এমন যেন ঘড়ির কাঁটা তিন ঘণ্টা এগিয়ে গেছে৷ চারপাশে অন্ধকার গাছপালার মাঝে একতলা বেখাপ্পা বাড়িটাকে আরও অন্ধকার বলে মনে হচ্ছিল৷

কোচিং-এর দরজার কাছে পৌঁছে অচ্যুত একটা হাসির শব্দ শুনতে পেল৷

এ-হাসি ওর চেনা৷ মিহি খিলখিল হাসি৷

যতটা ভয় পাওয়ার কথা অচ্যুত ততটা ভয় পেল না৷ কারণ, সত্যবানস্যার নিজেই পরশুদিন বলেছেন, ‘তোর কোনও ক্ষতি হোক আমি চাই না…৷’

স্যার নিশ্চয়ই অচ্যুতের কোনও ক্ষতি করবেন না৷

কৌতূহল ওকে টানতে লাগল৷ ঘরের ভেতর থেকে হাসির আওয়াজ আসছে কেন? কুলদীপ, সৌরভ যখন আসে আসুক—ওর একবার দেখতে ইচ্ছে করছে ঘরের ভেতরের রহস্যটা কী৷

দরজায় আলতো করে চাপ দিল অচ্যুত৷ দরজা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে গেল৷

ভেতরটা গাঢ় অন্ধকার৷ তারই মধ্যে জ্বলছে দুটো সবুজ চোখ৷ বোধহয় দরজার শব্দ পেয়েই এদিকে তাকিয়েছে৷

সেদিকে তাক করে অচ্যুত টর্চ জ্বালল৷ এবং দৃশ্যটা ওকে পাথর করে দিল৷

রাজীব উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে৷ ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো ওর ওপরে হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকে রয়েছেন সত্যবানস্যার৷ স্যারের দাঁতের সারি চকচক করছে৷ ঠোঁটজোড়া টুকটুকে লাল৷ তার আশেপাশে কয়েক জায়গায় লিপস্টিকের মতো লালচে ছোপ৷ সবুজ চোখ দুটো তীব্রভাবে অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে৷

স্যার তখনও খিলখিল করে হাসছেন৷

অচ্যুত বুকফাটা চিৎকার করে উঠল৷ আর সঙ্গে-সঙ্গে ঝুঁকে পড়া নেকড়েটা সোজা হয়ে দাঁড়াল৷ এবং অচ্যুতকে তাক করে লাফিয়ে পড়ার জন্য সামান্য কুঁজো হল৷

অচ্যুত পাগলের মতো ছুট লাগাল৷ ওর হাতের টর্চ কোথায় যেন ছিটকে পড়ল৷ টর্চের আলোর বৃত্তটা পুরোনো বাড়ির দেওয়ালের গায়ে এপাশ-ওপাশ দুলে আগাছার জঙ্গলে কোথায় হারিয়ে গেল৷

ভয়ংকর মৃত্যু তেড়ে এলে মানুষ যেভাবে মরিয়া হয়ে পালিয়ে বাঁচতে চায়, ঠিক সেভাবে দৌড়ল অচ্যুত৷ হাঁকপাঁক করে পৌঁছে গেল সাইকেলের কাছে৷ সাইকেল টানতে-টানতেই একলাফে তাতে চড়ে বসল৷ তারপর শুরু হল একা-একা সাইকেল রেস৷

তারই মধ্যে পিছনে তাকিয়ে দেখল সত্যবানস্যার আর-একটা সাইকেলে চড়ে ছুটে আসছেন৷ অঙ্কে চ্যাম্পিয়ান হয়েও আজ আর অচ্যুতের রক্ষা নেই৷

প্যাডেল করতে-করতে ভয়ে কান্না পেয়ে গেল অচ্যুতের৷ মায়ের পিছুডাকটা না শুনে ও আজ মারাত্মক ভুল করেছে৷ পোষা সাইকেলটাকে ও মনে-মনে বলতে লাগল, ‘আজ আমাকে বাঁচাতেই হবে৷ নইলে আমাদের এতদিনের বন্ধুত্ব মিথ্যে৷ ছোট—ছোট…আরও জোরে ছোট…৷’

রাস্তার দু-চারজন লোক অচ্যুতের ছুটন্ত সাইকেল দেখে ভাবল, এক্ষুনি ছেলেটা অ্যাক্সিডেন্ট করবে৷ কয়েকটা সাইকেল রিকশা চটপট পাশে সরে গিয়ে ওর বেপরোয়া গতির সাইকেলকে পথ করে দিল৷

বাড়ির কাছে পৌঁছে সাইকেলে ব্রেক কষল অচ্যুত৷ একলাফে সাইকেল থেকে নেমে সাইকেলটা ঠেলে ফেলে দিল একপাশে৷ তারপর দুমদুম করে দরজায় ধাক্কা দিল আর একইসঙ্গে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘মা! মা! দরজা খোলো—জলদি৷’

বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অচ্যুত উসখুস করতে লাগল৷ গলা উঁচু করে দেখল, সত্যবানস্যার তিরবেগে সাইকেল চালিয়ে ছুটে আসছেন৷ ওঁর সবুজ চোখ এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে৷

দরজা তখনও খুলছে না দেখে একলাফে মউলিদের দরজায় চলে গেল অচ্যুত৷ ঠেলা মারতেই দরজা খুলে গেল৷ ভেতরে ঢুকে ঝটপট দরজায় খিল তুলে দিল৷ তারপর দরজায় পিঠ দিয়ে হাপরের মতো হাঁফাতে লাগল৷

.

৷৷আট৷৷

দরজা বন্ধ করার সময় দড়াম করে শব্দ হয়েছিল৷ খিল দেওয়ার সময়েও৷

অচ্যুত চোখ বুজে হাঁফাচ্ছিল৷ আর ভাবছিল, সত্যবানস্যার ওকে মউলিদের বাড়িতে ঢুকতে দেখেছেন কি না৷ মউলিদের বাড়িতে এর আগে কোনওদিন ও ঢোকেনি৷

এমন সময় দরজার কাছটায় একটা জোরালো আলো জ্বলে উঠল৷

‘এ কী, তুমি! এ সময়ে!’

মউলি৷

চোখ খুলল অচ্যুত৷ কয়েক হাত দূরেই চোখ বড়-বড় করে দাঁড়িয়ে মউলি৷ পরনে সাদা টপ, নীলচে স্কার্ট, কপালে টিপ, আর জোড়া বিনুনি৷

এই বিপদের মুহূর্তে মউলিকে সবচেয়ে বড় বন্ধু বলে মনে হল অচ্যুতের৷ ও হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, ‘শিগগির ওপরে চলো—৷’

‘কেন, কী হয়েছে?’

‘পরে বলব৷ আগে চলো, দোতলা থেকে উঁকি মেরে একটা জিনিস দেখতে হবে৷’

অচ্যুতের মুখ-চোখ দেখে মউলি আর কথা বাড়াল না৷ ওকে নিয়ে ওপরে উঠল৷ উঠতে-উঠতে বলল, ‘তুমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছ…৷’

অচ্যুত কোনও জবাব দিল না৷

দোতলায় উঠে মউলির মা-কে দেখতে পেল ও৷ মউলি মায়ের কাছে গিয়ে চাপা গলায় কী যেন বলল৷ তারপর অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে, ‘এসো৷’

একটা ঘরে ঢুকল ওরা৷ ঘরের লাগোয়া বারান্দা৷ সেখানে দাঁড়ালে রাস্তা দেখা যায়৷ গত বৃহস্পতিবার রাতে মউলি এই বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে ছিল৷

অচ্যুত চাপা গলায় মউলিকে বলল, ‘সাবধানে উঁকি মেরে দ্যাখো তো, আমাদের বাড়ির দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি না…৷’

ওকে বিছানার ওপরে বসতে বলে মউলি বারান্দায় গেল৷

অচ্যুত ঘরটা চোখ বুলিয়ে দেখল৷

দেওয়ালে তিনটে রঙিন পোস্টার৷ এক কোণে পড়ার টেবিল—বই- খাতায় ভরতি৷ তার পাশে বইয়ের
র‍্যাক৷ র‍্যাকের পাশে দড়িতে মউলির জামাকাপড় ঝুলছে৷

অচ্যুত তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিল৷ বুঝল, ও মউলির ঘরে বসে আছে৷

পড়ার টেবিলের পাশে মেঝেতে একটা জলের জগ ছিল৷ অচ্যুতের বুকটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছিল৷ জগটা দেখে তেষ্টাটা দ্বিগুণ হয়ে গেল৷ ও উঠে গিয়ে জগ থেকে ঢকঢক করে জল খেল৷

জগটা নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখল মউলি বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকছে৷

অচ্যুতের কাছে এসে মউলি বলল, ‘একজন ফরসা রোগামতন লোক তোমাদের দরজায় সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তোমার মায়ের সঙ্গে কীসব কথা বলছে৷ আর রাস্তায় পড়ে থাকা একটা সাইকেল দেখিয়ে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে—যেন কাউকে খুঁজছে৷’

‘লোকটার চোখে চশমা আছে?’

‘হ্যাঁ—৷’

‘রাস্তায় যে-সাইকেলটা পড়ে আছে, ওটা আমার—৷’

মউলি অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘লোকটা কে?’

‘আমাদের স্কুলের অঙ্কস্যার৷ ওর তাড়া খেয়েই তো আমি তোমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছি৷ মা দরজা খুলতে দেরি করছিল…৷’

মউলির মাথায় কিছুই ঢুকছিল না৷ ও হাঁ করে অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে রইল৷

অচ্যুত মউলিকে দেখছিল৷ ডিয়োডোর‍্যান্টের হালকা গন্ধ কোথা থেকে যেন ভেসে আসছিল৷

একটু পরে ও মউলিকে বলল, ‘দ্যাখো তো, লোকটা চলে গেছে কি না৷’

মউলি আবার বারান্দায় গেল৷

মিনিটপাঁচেক পর ও ফিরে এল, বলল, ‘চলে গেছে৷ তবে কাকিমা এখনও দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন৷’

‘আমি তা হলে এখন যাই৷ মা নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে৷’

‘তুমি আমাদের বাড়িতে আজ প্রথম এলে৷ চা-টা কিছুই…৷’

‘এটা আবার আসা না কি!’ হেসে বলল অচ্যুত, ‘এটা তো একটা অ্যাক্সিডেন্ট৷’

‘অ্যাক্সিডেন্ট?’ তারপর নীচু গলায় সেই পুরোনো কথাটাই বলল মউলি, ‘মাঝে-মাঝে এরকম অ্যাক্সিডেন্ট হলে বেশ হয়…৷’

‘আজ আসি৷ তুমি আমাদের বাড়িতে একদিন এসো৷’

অচ্যুত চলে যাচ্ছিল৷ মউলি ওকে পিছন থেকে জিগ্যেস করল, ‘তোমাদের ওই অঙ্কস্যার তোমাকে তাড়া করছিল কেন বললে না তো? অঙ্ক পারোনি?’

পিছন ফিরে তাকাল অচ্যুত, হাসল : ‘হ্যাঁ, খুব কমপ্লিকেটেড অঙ্ক৷ পরে সব বলব৷ অনেক সময় লাগবে৷’

অনেকটা জেদি ভঙ্গিতে মউলি অচ্যুতের কাছে এগিয়ে এল৷ খপ করে ওর হাত চেপে ধরল৷ তারপর বেশ চাপা গলায় বলল, ‘তুমি খুব ভয় পেয়ে গেছ৷ সেদিন রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম…দেখলাম, তুমি সাইকেল নিয়ে কোথায় বেরোলে…বেশ রাত করে ফিরলে৷ তারপর…তারপর…আজকে এইরকম…কী হয়েছে, অচ্যুত?’

অচ্যুত অবাক হয়ে মউলির মুখের দিকে তাকাল৷ ওর মুখে নিজের নামটা এই প্রথম শুনল…শুনে খারাপ লাগল না৷ সত্যি, এই মুহূর্তে মউলিকে সব বলতে পারলে খুব ভালো লাগত৷ ওর চোখে কী সাংঘাতিক আত্মবিশ্বাসের ছাপ! কী আশ্বাসে ভরা ওর দৃষ্টি!

অচ্যুত দোটানায় দুলছিল৷ মউলিকে সবকিছু খুলে বলবে? এখনই?

‘আমাকে তুমি সব বলবে না?’ মউলির গলায় একইসঙ্গে শাসন আর অভিমানের ছোঁওয়া৷

‘বলব৷ সত্যি বলছি, বলব৷ আজ নয়৷ এখন অনেক রাত হয়ে গেছে৷ মা চিন্তা করছে৷…আসি৷’ বলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল অচ্যুত৷

তরতর করে সিঁড়ি নামার সময় চেঁচিয়ে বলল, ‘কাকিমা, আমি যাচ্ছি—৷’

ওর মনে হল, মউলির ডিয়োডোর‍্যান্টের গন্ধটা ওর সঙ্গে যেন সদর দরজা পর্যন্ত এল৷

দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই বলতে গেলে মায়ের মুখোমুখি৷

অচ্যুতকে দেখামাত্রই মায়ের চোখে জল এসে গেল৷ অভিমানভরা চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে মা বলল, ‘কোথায় ছিলি তুই? আমি…৷’ আর বলতে পারল না…গলা ভেঙে গেল৷

‘ভেতরে চলো, সব বলছি—৷’

সাইকেলটা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে মায়ের সঙ্গে বাড়ির ভেতরে ঢুকল অচ্যুত৷ রাজীবের কথা ভেবে ও শিউরে উঠল৷

রাজীব বোধহয় আর…৷

রাজীবের কথাগুলো ওর মনে পড়ল, ‘তোরা শেষ পর্যন্ত আমাকে ধরে রাখতে পারবি তো?’

ঘরে এসে হাত-মুখ ধুয়ে গুছিয়ে বসতে-না-বসতেই মা আর বাপি এসে হাজির৷

মা বলল, ‘তলে-তলে তুই কী করছিস বল তো? আজ তোকে সব খুলে বলতেই হবে৷’

বাপি কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ নিশ্চয়ই ও-ঘরে বসে টিভি দেখছিল, মা জেদ করে ডেকে এনেছে৷ ছেলেকে শাসন করে না বলে দু-চার কথা হয়তো বাপিকে শুনিয়েও দিয়েছে৷

আমতা-আমতা করে বাপি বলল, ‘শেষকালে আবার কী-না-কী বিপদে পড়বি…৷’

অচ্যুত হাত নেড়ে বলল, ‘সব বলছি৷ শুধু তার আগে রাজীবের বাড়িতে একটা ফোন করতে দাও—৷’

অচ্যুতের কথায় কী যেন ছিল, মা-বাপি ওকে বাধা দিল না৷ ও রাজীবের বাড়িতে ফোন করে বলল, ‘অঙ্কস্যারের কোচিং-এ গিয়ে রাজীব বিপদে পড়েছে৷’

রাজীবের মাম্মি খবরটা শুনেই কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন৷ অচ্যুতকে হাজারটা প্রশ্ন করতে লাগলেন৷

অচ্যুত দিশেহারাভাবে বলল, ‘অ্যান্টি, আমি এর বেশি কিচ্ছু জানি না৷ আপনি শিগগিরই পুলিশে খবর দিন! দেরি করবেন না…এক্ষুনি…কে জানে, এখনও হয়তো সময় আছে!’

ফোন নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ হাঁফ ছাড়ল অচ্যুত৷ লক্ষ করল, মা-বাপি ওর দিকে এমন করে তাকিয়ে আছে যেন ও ভিনগ্রহের প্রাণী৷

একটু পরে আবার রিসিভার তুলল ও৷ একে-একে প্রতীক, সৌরভ আর কুলদীপকে খবর দিতে চাইল৷ সৌরভ আর কুলদীপকে বাড়িতে পেল না—তবে প্রতীক বাড়িতে ছিল৷ ওকে সংক্ষেপে রাজীবের বিপদের কথা জানাল অচ্যুত৷ বলল, ‘কাল স্কুলে জরুরি মিটিং করতে হবে৷’

ফোনের পালা শেষ হলে ও মা-কে বলল, ‘খুব খিদে পেয়েছে৷ খেতে দাও৷ খেতে-খেতে ব্যাপারটা বলছি…৷’

মা আর বাপি অবাক হয়ে অচ্যুতের কাছে গোটা গল্পটা শুনল৷

শুনে মায়ের মুখ ভয়ে বদলে গেল৷

বাপি বলল, ‘হাতে-পায়ে ফেভিকল লাগিয়ে তোর অঙ্কস্যার দেওয়ালে হেঁটে বেড়ায়নি তো! টিভিতে ফেভিকলের যেরকম বিজ্ঞাপন দেখায়!’

এত সমস্যার মধ্যেও অচ্যুত হেসে ফেলল৷ বলল, ‘না, একেবারে জেনুইন ম্যাজিক৷’

তারপর ফটোগ্রাফটা বের করে মা আর বাপিকে দেখাল৷

বাপিকে তার জায়গা থেকে নড়ানো মুশকিল৷ কারণ, ফটোটা অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখার পর বাপি বলল, ‘তুই ঠিক জানিস, তোদের স্যারের ব্লাড ব্যাঙ্ক টাইপের কোনও সাইড বিজনেস নেই!’

অচ্যুত মাথা নেড়ে ‘না’ বলল৷

‘এখন কী করবি?’ মা ভয়-পাওয়া গলায় জিগ্যেস করল৷

‘এই টাইপের ব্লাডসাকারদের আগুন ছাড়া খতম করা যায় না…৷’ বিড়বিড় করে বলল বাপি৷

মা বলল, ‘কাল থেকে তুই স্কুলে যাস না—৷’

‘কখখনও না!’ রুখে দাঁড়াল অচ্যুত : ‘এইজন্যেই তোমাদের কিছু বলতে নেই! ভুলে যেয়ো না, স্যার একা, আর আমরা অনেক! কাল স্কুলে গিয়ে ব্যাপারটা অন্য স্যারদেরও জানাব৷ রাজীবের যদি কিছু হয়…৷’

রাত বারোটার পর কুলদীপ অচ্যুতকে ফোন করে খবর দিল, রাজীব মারা গেছে৷

অচ্যুত ভেবেছিল, এইবার বুঝি সত্যবানস্যারকে নিয়ে পুলিশ টানাটানি করবে, হাজাররকম জিজ্ঞাসাবাদ করবে৷ কিন্তু তার কিছুই হল না৷

কারণ, রাজীবের মৃতদেহ পাওয়া গেল স্যারের কোচিং থেকে অন্তত বিশ হাত দূরে আগাছার ঝোপের ভেতরে৷ ফলে পুলিশের কাছে সমস্যাটা ধানকলের মাঠের জোড়া খুনের মতোই দাঁড়াল৷

এলাকায় খবরটা খুব তাড়াতাড়ি চাউর হয়ে গিয়েছিল৷ স্কুলে গিয়ে অচ্যুত শুনল ক্লাস হবে না৷ রাজীবের জন্য শোকপালন করে স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হবে৷

শোকসভায় দাঁড়িয়ে রাজীবের জন্য নীরবতা পালন করার সময় অচ্যুতের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল৷ একইসঙ্গে ভীষণ রাগ হল ওর৷ ওরা এতজন বন্ধু মিলে শেষ পর্যন্ত রাজীবকে ধরে রাখতে পারল না!

শোকপালন শেষ হলে অচ্যুত, কুলদীপ, বাসবরা জোট পাকাল৷

অচ্যুত গতকালের ঘটনাটা ওদের খুলে বলল৷

কুলদীপ জিগ্যেস করল, ‘রাজীবের বডিটা কোচিং-এর বাইরে গেল কী করে?’

‘হয়তো স্যারই ওটা বাইরে আগাছার ঝোপের মধ্যে ফেলে এসেছেন৷’

কুলদীপ শিস দিয়ে উঠল৷

বাসব অচ্যুতকে বলল, ‘এইবার পুলিশ তোকে হ্যারাস করবে৷’

‘সে করে করুক—যা সত্যি তাই বলব৷’

‘আমার মনে হয়, ব্যাপারটা এবার স্যারদের জানানো উচিত৷’

প্রতীক আর সৌরভও বাসবের কথায় সায় দিল৷

অনেক তর্কবিতর্কের পর ঠিক হল ওরা অমিয়স্যারকে পুরো ব্যাপারটা জানাবে৷

স্কুলের ভিড় ফিকে হয়ে এসেছিল৷ স্যাররাও অনেকে বাড়ি চলে যাচ্ছেন৷ হঠাৎই বাসবের নজরে পড়ল, একতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অমিয়স্যার দুজন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলছেন৷

বাসব বলল, ‘চল, এখনই যাই—স্যারকে গিয়ে বলি৷’

অচ্যুত আর প্রতীক ইতস্তত করছিল৷ কিন্তু কুলদীপও যেন খেপে গেল : ‘আর দেরি করলে হবে না, অচ্যুত৷ রাজীব গেছে, এরপর কার পালা কে জানে! যা করার এখনই করতে হবে৷ চল—৷’

ওরা পাঁচজন অমিয়স্যারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল৷

স্যার ওদের দিকে একবার জিজ্ঞাসার চোখে তাকিয়ে অন্য দুজন ছাত্রকে ছেড়ে দিলেন৷

‘কী ব্যাপার রে! রাজীবের জন্যে দুঃখ হয়৷ কী অরুন্তুদ ঘটনা বল তো!’ হাতের একটা ভঙ্গি করে মাথায় চুল ঠিক করলেন অমিয়স্যার৷

‘স্যার, রাজীবের ব্যাপারেই কয়েকটা কথা আমরা আপনাকে বলতে চাই৷’ মনিটর বাসব বলল৷

‘তার মানে!’ অমিয়স্যারের ভুরু কুঁচকে গেল৷

‘হ্যাঁ, স্যার৷’ অচ্যুতের দিকে আঙুল তুলে দেখাল বাসব : ‘ও আপনাকে সব বলবে৷ আপনাকে যে-করে-হোক একটা ব্যবস্থা করতেই হবে৷ নইলে আমাদের স্কুল ছারখার হয়ে যাবে৷’

‘বলিস কী রে! আমাদের স্কুল অবনমিত হয়ে যাবে!’

‘হ্যাঁ, স্যার—ভীষণ বিপদে পড়ে আপনাকে এসব কথা বলছি৷ প্লিজ, ওই জামগাছটার তলায় চলুন৷’ অচ্যুত অনুনয় করে বলল৷

অমিয়স্যার বেশ হকচকিয়ে গেলেন৷ কিন্তু পাঁচটা নিষ্পাপ মুখের আকাঙ্ক্ষায় তিনি জল ঢেলে দিতে পারলেন না৷ আলতো করে বললেন, ‘চল…৷’

আকাশ ঘোলাটে৷ বৃষ্টি হবে কি হবে না বোঝা যাচ্ছে না৷ কোথা থেকে যেন বুলবুলির ডাক ভেসে আসছিল৷ একটু দূরে ইলেকট্রিকের তারে একটা বাঁশপাতি পাখি পোকার আশায় বসে আছে৷ দুটো ছোট মাপের হলদে প্রজাপতি স্কুলের মাঠের ওপর দিয়ে এলোমেলোভাবে উড়ে যাচ্ছে৷

অচ্যুত ভাবছিল, প্রকৃতি আমাদের সুখ-দুঃখের কোনও খবর রাখে না৷ তাই এরকম বিপদের সময়েও উদাসীন হয়ে সেজেগুজে বসে আছে৷

ভিজে স্যাঁতসেঁতে ঘাসের ওপরে পা ফেলে ওরা সবাই জামগাছ-তলার বেদির কাছে গেল৷ স্যারকে বসিয়ে শুরু করল ওদের রোমাঞ্চকর কাহিনি৷

মনোযোগী ছাত্রের মতো অমিয়স্যার গোটা গল্পটা শুনলেন৷ তারপর ‘হুম’ শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷

‘সবাই বলবে, এ তোদের খপুষ্প কল্পনা৷ কোনও প্রমাণ কি তোদের কাছে আছে?’

এ-কথা বলামাত্রই তিনটে হাত ছিটকে এল অমিয়স্যারের চোখের সামনে৷ তিনটে হাতে ধরা রয়েছে তিনটে রঙিন ফটোগ্রাফ৷ সত্যবানস্যার দেওয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছেন৷

অমিয়স্যার অনেকক্ষণ কোনও কথা বলতে পারলেন না৷ তারপর ধীরে-ধীরে উচচারণ করলেন, ‘তোরা আজকালকার ছেলে—ভূত-প্রেত-পিশাচে তোদের তেমন বিশ্বাস নেই৷ এখন বুঝতে পারছিস তো, বিজ্ঞানটাই সব নয়, যুক্তি-প্রযুক্তিই সব নয়! তার বাইরেও একটা রহস্যময় অন্ধকার জগৎ আছে৷ তোদের কাছে যা শুনলাম তাতে…৷’ কিছুক্ষণ যেন চিন্তা করলেন অমিয়স্যার৷ তারপর : ‘মনে হয়…একমাত্র বীতিহোত্র ছাড়া এ-পিশাচকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়৷’

‘বীতিহোত্র! সেটা কি কোনও ফলের বীজ বা গাছের শিকড়?’ ভাবল অচ্যুত৷

কুলদীপ জিগ্যেস করল, ‘বীতিহোত্র কী, স্যার…কোনও মন্ত্র?’

অমিয়স্যার মোলায়েম হেসে কুলদীপের দিকে তাকালেন : ‘ওঃ, বীতিহোত্র জানিস না! বীতিহোত্র মানে আগুন!’

ওরা পাঁচজন লম্বা করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল৷ বাব্বাঃ, স্যার পারেনও বটে!

অচ্যুত বলল, ‘স্যার, আমার বাপিও তাই বলছিল…৷’

অমিয়স্যার সামান্য ঘাড় দোলালেন৷ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তারপর বললেন, ‘ব্যাপারটা স্কুলকে জড়িয়ে৷ আমার মনে হয়, ব্যাপারটা আগে পুরকায়স্থবাবুকে জানানো দরকার৷ তোরা আমার সঙ্গে চল, ওঁকে এখনই গিয়ে এইসব সান্নিপাতিক ঘটনাবলির কথা খুলে বলি৷’

ওরা স্যারের সঙ্গে স্কুল-বাড়ির দিকে হাঁটা দিচ্ছিল, দেখল সত্যবানস্যার হাসিমুখে ওদেরই দিকে এগিয়ে আসছেন৷

‘কীরে, তোরা সব কোথায় চললি? এখনও বাড়ি যাসনি? যা-যা, বাড়িতে গিয়ে পড়াশোনা কর৷’

এত স্বাভাবিক কথা বলার ঢং, এত সহজ পা ফেলার ভঙ্গি যে, অচ্যুতরা স্তম্ভিত হয়ে গেল৷

অমিয়স্যার অপছন্দের চোখে সত্যবানস্যারের দিকে তাকালেন৷ একটু বোধহয় ভয়ও পেলেন৷ কারণ, অমিয়স্যারের মোটাসোটা শরীরটা পলকের জন্য কেঁপে উঠল৷

অচ্যুত বেপরোয়া ঢঙে এক পা এগিয়ে গেল সত্যবানস্যারের দিকে৷ বেশ জোরালো গলায় বলল, ‘স্যার, শুনেছেন তো, রাজীব মারা গেছে!’

সত্যবানস্যার হাসলেন, ‘হ্যাঁ রে, শুনেছি৷ ভেরি স্যাড৷ তবে চিন্তার তো কিছু নেই! তোরা তো আছিস!’

কথাটা বলেই সত্যবানস্যার আচমকা ঘুরে চলে গেলেন৷

অমিয়স্যার রাগে ফেটে পড়লেন : ‘চোরের মায়ের বড় গলা! কী স্পর্ধা! কী আটোপটংকার! চল, এখনই হেডস্যারের কাছে চল!’

স্যারের কথায় ওরা পা বাড়াল৷

স্কুল এর মধ্যেই ফাঁকা হয়ে এসেছে৷ ওরা দেখল, বানজারা নীচের ক্লাসরুমগুলোর দরজা বন্ধ করে তালা লাগাচ্ছে৷

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে-উঠতে অমিয়স্যার বললেন, ‘পুরকায়স্থবাবুকে ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে বলব ভাবছি৷ উনি বোধহয় বিশ্বাস করতে চাইবেন না৷ হয়তো বলবেন…৷’

‘কেন, স্যার, ফটো তো আছে!’ বাসব বলল৷

‘হুঁ, তা আছে৷ আসলে কী জানিস, আমারই বিশ্বাস হতে চাইছে না৷ যদিও জানি, তোরা সব সত্যি কথাই বলছিস৷’

কথা বলতে-বলতে হেডস্যারের ঘরের দরজায় চলে এল ওরা৷

ঘরের বাইরে কালো কাঠের নেমপ্লেট—তার ওপরে সাদা হরফে নাম লেখা : মোহনলাল পুরকায়স্থ, এম. এসসি., এম. এড.৷

দরজায় খয়েরি রঙের ভারী পরদা ঝুলছে৷ পরদার পাশ দিয়ে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না৷

অমিয়স্যার একটু উসখুস করতে লাগলেন৷ বললেন, ‘এতজন একসঙ্গে ঢোকার দরকার নেই৷ উনি হয়তো কিছু মনে করবেন৷ বাসব আর অচ্যুত আমার সঙ্গে আয়৷’ হাতের ইশারায় ওদের কাছে ডাকলেন স্যার৷ প্রতীক, কুলদীপ, আর সৌরভকে লক্ষ করে বললেন, ‘তোরা বাইরে প্রতীক্ষমাণ হয়ে থাক৷ দরজা ছেড়ে কোথাও যাবি না, বুঝলি…৷’

ওরা তিনজন পরদা সরিয়ে হেডস্যারের ঘরে ঢুকে পড়ল৷

ছোট্ট ঘর৷ রং-খসা ড্যাম্প-ধরা দেওয়াল৷ সিলিং-এ কাঠের কড়িবরগা৷ শুধু জানলা-দরজার পরদাগুলোই যা বেমানানরকম আধুনিক৷

পুরোনো কাঠের চৌকো টেবিলের ওপারে বসে মোহনলালবাবু কী একটা ফাইল খুলে পড়ছিলেন৷ আঙুলের ফাঁকে সিগারেট৷

‘আসতে পারি, স্যার?’ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অমিয়স্যার কুণ্ঠিতভাবে জিগ্যেস করলেন৷

হেডস্যার মুখ তুলে তাকালেন৷ হেসে বললেন, ‘আসুন, আসুন—বসুন…৷’

তারপরই বাসব আর অচ্যুতকে দেখে বললেন, ‘আরে তোরা! কী ব্যাপার?’

‘ওরা আমার সঙ্গে এসেছে৷ ক্লাস নাইনের ‘‘এ’’ বিভাগের ছেলে—অচ্যুত আর বাসব৷’ ওদের পিঠে একে-একে হাত দিয়ে অমিয়স্যার বললেন, ‘ইস্কুলের ভয়ংকর বিপদ, স্যার…আপনাকে কিছু একটা করতে হবে৷ ওরা আপনাকে সব…৷’

‘কী, রাজীবের ব্যাপারে কিছু?’ হেডস্যার সিগারেটে টান দিলেন৷

‘হ্যাঁ, স্যার৷’ অচ্যুতের গলা কেঁপে গেল৷

‘ফাঁড়ি থেকে বড়বাবু আমাকে ফোন করেছিলেন৷ আমি বলেছি, আজ কনডোলেন্স-এর ব্যাপার আছে—স্কুল তাড়াতাড়ি ডিজলভ করে যাবে৷ কাল দুপুরে ওঁর সঙ্গে কথা বলব৷’

অমিয়স্যার বললেন, ‘মাত্র পাঁচ-দশমিনিট সময় নেব, স্যার৷ অচ্যুত, তুই বল—সংক্ষেপে বলবি৷’

অচ্যুত ঢোঁক গিলে বলতে শুরু করল৷ রাজীবের মায়া মাখানো করুণ মুখটা কল্পনা করে ও নিজেকে জেদ আর সাহস জোগাল৷

একটানা গল্পটা ও বলে গেল৷ আগ্রহ আর চাপা কৌতুক নিয়ে মোহনলালবাবু ওর সব কথা মন দিয়ে শুনে গেলেন৷

গল্প বলা শেষ হলে পকেট থেকে সত্যবানস্যারের ফটোগ্রাফটা বের করল অচ্যুত৷ ঘন-ঘন শ্বাস নিয়ে বলল, ‘যদি স্যার, আপনার বিশ্বাস না হয়, স্যার…তা হলে এটা দেখুন…সত্যবানস্যার দেওয়ালে হাঁটছেন…৷’ ফটোটা হেডস্যারের দিকে এগিয়ে দিল ও৷

অমিয়স্যার বললেন, ‘একেবারে অবিশ্বসনীয় ঘটনা, স্যার…৷’

‘অবিশ্বাসের কী আছে!’ টেবিলের অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝাড়লেন হেডস্যার৷ বললেন, ‘আপনারা কি আর আমার কাছে এসে মিথ্যে কথা বলবেন!’

‘আপনার অবাক লাগছে না?’

‘না, অবাক লাগবে কেন! পৃথিবীতে অবিশ্বাস্য কত কী আছে৷ সেগুলো কি মিথ্যে, বলুন?’

অমিয়স্যার থতমত খেয়ে চুপ করে রইলেন৷ মোহনলালবাবু নিশ্চয়ই ওঁদের সবাইকে পাগল ভাবছেন৷ মনস্তত্ত্ববিদরা যে-ঢঙে কথা বলেন উনি অনেকটা যেন সেই ঢঙে কথা বলছেন৷

‘দেওয়ালে সত্যবানবাবু ঠিক কেমন করে হাঁটছিল বল তো? এইরকম?’

ওরা অবাক হয়ে দেখল, হেডস্যার সিগারেটটা ঠোঁটে নিলেন৷ তারপর দু-হাত টান-টান করে পিছনের দেওয়ালের দিকে বাড়িয়ে দিলেন৷ হাতের পাতা দুটো চুম্বকের মতো দেওয়ালে সেঁটে গেল৷ তারপর ওঁর গোটা শরীরটা যেন বাতাসে ভেসে দেওয়ালে পৌঁছে গেল৷

ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট ধরা অবস্থায় তিনি টিকটিকির মতো দেওয়ালে হাঁটতে লাগলেন৷ তারপর সিগারেটটা ডানহাতে নিয়ে ঘাড় কাত করে তাকালেন অচ্যুতদের দিকে৷ খিলখিল করে হেসে বারবার জিগ্যেস করতে লাগলেন, ‘দ্যাখ তো, এইরকম?’

অমিয়স্যার চেয়ারে কাত হয়ে পড়লেন৷ ওঁর মুখ দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দ বেরোতে লাগল৷

বাসব অচ্যুতকে ভয়ে জাপটে ধরল৷ ফটো দেখা আর সামনাসামনি দেখায় অনেক তফাত আছে৷

অচ্যুত অবাক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ভয় ততটা পায়নি৷ এই কসরত দেখে-দেখে ওর গা-সওয়া হয়ে গেছে৷ সত্যবানস্যারের কথাটা ওর মনে পড়ল : ‘…আমাদের হাত থেকে পালানো যায় না…৷’ ‘আমাদের’ মানে তা হলে হেডস্যার আর সত্যবানস্যার! ধানকলের মাঠে কুলদীপের বন্ধুরা নিশ্চয়ই স্যাটাস্যাটের সঙ্গে হেডস্যারকেই দেখেছিল! আর তারপরই জোড়া খুন!

অচ্যুত আর ভাবতে পারছিল না৷

হেডস্যার তখন দেওয়াল থেকে সিলিং-এ চলে গেছেন৷ হাতের সিগারেটে টান দিতে-দিতে তিনি শরীরটাকে ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো ঝুলিয়ে দিলেন৷ পায়ের চেটো সিলিং-এ এঁটে আছে, মাথাটা নীচের দিকে৷

সেই অবস্থাতেই সিগারেটে টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন মোহনলালবাবু৷ ধোঁয়াটা ওঁর পায়ের দিকে যেতে শুরু করল৷

‘দ্যাখ তো, এইরকম সবুজ চোখ?’

অচ্যুত দেখল, কখন যেন হেডস্যারের চোখ স্যাটাস্যাটের মতো সবুজ হয়ে গেছে৷ ও সেই সবুজ চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল৷ একটা নেশার ঘোর ওকে ধীরে-ধীরে জড়িয়ে ধরছিল৷

‘আমি আর তোদের অঙ্কস্যার—আমরা অনেক কিছু পারি৷ আসলে আমরা কিন্তু আলাদা নই, বুঝলি…একই…৷’ মিহি খিলখিল হাসি৷ তারপর : ‘এ নিয়ে পাঁচকান করে কোনও লাভ নেই, শোরগোল কিংবা থানা-পুলিশ করেও কোনও লাভ নেই৷ এ পর্যন্ত যা-কিছু দেখেছিস, বা এখন দেখছিস—সবকিছু ভুলে যাওয়াই ভালো৷’

স্রেফ পায়ে হেঁটে সিলিং থেকে দেওয়ালে, এবং দেওয়াল থেকে মেঝেতে নেমে এলেন মোহনলালবাবু৷ টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে ছোট- হয়ে-যাওয়া সিগারেটটা গুঁজে দিলেন৷ তারপর ধীরেসুস্থে চেয়ারে গিয়ে বসলেন৷

অমিয়স্যার তখন থরথর করে কাঁপছেন৷ বাসব চোখ বুজে অচ্যুতকে জাপটে ধরে রয়েছে৷ অচ্যুত সোজা হয়ে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে—একটুও নড়াচড়া করতে পারছে না৷

ওর রাজীবের কথা মনে পড়ছিল, আর উলটোদিকের চেয়ারে বসা টাকমাথা, চশমা পরা লোকটাকে দেখে বমি পাচ্ছিল৷ ভাবছিল, কীভাবে এই একজোড়া রক্তপিশাচকে খতম করা যায়৷

মোহনলালবাবুর চোখ এখন কটা রং থেকে ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে আসছে৷ তিনি হাতছানি দিয়ে অচ্যুতকে কাছে ডাকলেন৷

ডাকটা অনেকটা নিশির ডাকের মতন৷ অচ্যুতের সেরকমই মনে হল৷

অতিকষ্টে বাসবের বাঁধন ছাড়িয়ে ও টেবিলের পাশ ঘুরে হেডস্যারের কাছে গেল৷ বাসব ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল৷

হেডস্যার ছোবল মারার মতো পলকে হাত বাড়িয়ে অচ্যুতের চুলের মুঠি ধরে এক হ্যাঁচকায় ওকে কাছে টেনে নিলেন৷ ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে দাঁত খিঁচিয়ে হিসহিস করে বললেন, ‘তুই-ই যত নষ্টের গোড়া! তোকে ছেড়ে রেখে আমরা ভুল করেছি৷ তোকে কতকগুলো জরুরি কথা বলার আছে…৷’ ওকে হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে গালে হাত বুলিয়ে আদর করলেন হেডস্যার৷ আচমকা পালটে গিয়ে স্নেহ আর ভালোবাসার হাসি ফুটিয়ে তুললেন মুখে৷ থুতনি নেড়ে দিয়ে বললেন, ‘তুই বড় দুরন্ত আর দুষ্টু৷ তবে লেখাপড়ায় ফার্স্টক্লাস৷ দেখবি, সামনের পরীক্ষায় তুই ফার্স্ট হবি—আমরা তোকে ফার্স্ট করাব৷ কোনও চিন্তা নেই৷ আজ রাত আটটার সময়ে ধানকলের মাঠে চলে আয় দেখি৷ আমি আর সত্যবানস্যার থাকব৷ তোর সঙ্গে আমাদের খুব জরুরি আলোচনা আছে৷ মনে করে আসবি কিন্তু৷’ অচ্যুতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন বারবার : ‘অবশ্য না এসে তুই পারবি না…আসতে তোকে হবেই…৷ আমি জানি তুই আসবি৷’

সম্মোহন করার ভঙ্গিতে একদৃষ্টে অচ্যুতের চোখে তাকিয়ে রইলেন হেডস্যার৷ আর সাপ-খেলানো সুরে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘লক্ষ্মী ছেলে…আসবি কিন্তু…লক্ষ্মী ছেলে…আসবি কিন্তু…আসতে তোকে হবেই…না এসে তুই পারবি না…৷’

অচ্যুতের কেমন ঘোরের মতো লাগছিল৷ ও ঘাড় হেলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, স্যার, যাব৷ যাব, যাব, যাব৷’

‘লক্ষ্মী ছেলে৷’ হেডস্যার আদরের গলায় বললেন, ‘তুই এখন যা৷ আর শোন, আমি এমন ব্যবস্থা করে দিচ্ছি যে, অমিয়বাবু আর বাসবের এসব কিছুই মনে থাকবে না৷ তবে তুই কিন্তু কাউকে কোনও কথা বলবি না৷’

অচ্যুত টেবিলের কাছ থেকে পায়ে-পায়ে সরে এল৷

হেডস্যার এবার অমিয়স্যার আর বাসবের দিকে পালা করে তাকালেন৷ ওঁর চোখ আবার সবুজ হয়ে গেল৷ অমিয়স্যার আর বাসব অপলকে হেডস্যারের দিকে তাকিয়ে রইল৷

অচ্যুতের মনে হল, কোনও অদৃশ্য রশ্মি যেন হেডস্যারের চোখ থেকে বেরিয়ে অমিয়স্যার আর বাসবের চোখ দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে৷

প্রায় একমিনিট পর হেডস্যারের চোখ আবার স্বাভাবিক হল৷ তিনি বেশ সহজ গলায় অমিয়স্যারকে বললেন, ‘ঠিক আছে, অমিয়বাবু… আপনারা তা হলে আসুন৷ ওই কথাই রইল…৷’

অমিয়স্যার ঘাড় নেড়ে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন৷ বাসবের হাত ধরে সাবধানে পা ফেলে ঘরের দরজার দিকে এগোলেন৷ অচ্যুত ওঁদের পাশে-পাশে হেঁটে চলল৷

বাসব আর অচ্যুতের দিকে পালা করে তাকিয়ে অমিয়স্যার যান্ত্রিক স্বরে মিনমিন করে বললেন, ‘তা হলে ওই কথাই রইল, বুঝলি?’

বাসব ফ্যালফ্যাল করে অমিয়স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷ অচ্যুতের মাথায় কিছুই ঢুকল না৷

ওর মনে শুধু পাগলাঘণ্টি বাজছিল : ধানকলের মাঠ, রাত আটটা…ধানকলের মাঠ, রাত আটটা…ধানকলের মাঠ, রাত…৷

ওরা তিনজন হেডস্যারের ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল৷

প্রতীক, কুলদীপ আর সৌরভ দেখল যে-তিনজন মানুষ হেডস্যারের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে তাদের মুখ-চোখ দেখে মনে হয় এইমাত্র ওরা সর্বস্বান্ত হয়েছে৷

প্রত্যেকেরই চোখে হতভম্ব শূন্য দৃষ্টি৷ যেন অন্য কোনও গ্রহ থেকে এসে সদ্য পা ফেলেছে পৃথিবীর মাটিতে৷

ওদের পাশাপাশি হেঁটে যেতে-যেতে একের পর এক প্রশ্ন করে চলল কুলদীপ৷

উত্তরে অচ্যুত অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করে কীসব বলে একরকম দৌড়ে চলে গেল ওর সাইকেলের দিকে৷

কুলদীপরা এবার বাসবকে ছেঁকে ধরল৷ কিন্তু বাসবও কোনও কথা বলতে পারল না৷ ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল৷ ও কাঁদতে শুরু করে দিল৷

সৌরভ একটু রুক্ষভাবেই অমিয়স্যারকে বলল, ‘স্যার, হেডস্যার কী বললেন? সত্যবানস্যারের ব্যাপারে উনি কি কোনও স্টেপ নিচ্ছেন?’

অমিয়স্যার সিঁড়ি নামতে-নামতে খোলা উঠোনের দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন চোখ খোলা থাকা সত্ত্বেও তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না৷ সেই অবস্থাতেই আলতো করে বললেন, ‘ওই কথাই রইল…ওই কথাই রইল৷…বীতিহোত্র, বীতিহোত্র…বীতিহোত্র ছাড়া নিস্তার নেই রে…নিস্তার নেই৷’

ওদের তিনজনকে বোকার মতো মাঠের ওপরে দাঁড় করিয়ে রেখে অমিয়স্যার চলে গেলেন৷ বাসবও ওঁর পিছন-পিছন ছুট লাগাল৷

কুলদীপরা বুঝল কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে৷ ওরা তিনজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল৷ তারপর একতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে জটলা শুরু করল৷

হঠাৎ ওরা দেখল, সত্যবানস্যার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছেন৷

প্রতীক আর সৌরভকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে কুলদীপ সত্যবানস্যারের পিছু নিল৷

দোতলায় এসে সত্যবানস্যার সটান এগিয়ে গেলেন হেডস্যারের ঘরের দিকে৷ এবং পরদা সরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন৷

কুলদীপও পা টিপে-টিপে পৌঁছে গেল হেডস্যারের ঘরের কাছে৷ তারপর ন্যায়-অন্যায় ভুলে গিয়ে দরজার পাশে আড়ি পাতল৷

কিছুক্ষণ সব চুপচাপ৷ তারপর ঘরের ভেতরে থেকে রক্ত-হিম-করা খিলখিল হাসি শোনা গেল৷

হেডস্যার বলছেন, ‘ছেলেটাকে আজ রাত আটটায় ধানকলের মাঠে আসতে বলেছি…৷’

সত্যবানস্যার বলছেন, ‘হ্যাঁ, অচ্যুতটা বড্ড ডিসটার্ব করছে৷ ভেবেছিলাম ওকে কিছু করব না…কিন্তু ও এমন শুরু করেছে যে, এখান থেকে হয়তো পাততাড়ি গোটাতে হবে৷’

হেডস্যার হেসে বললেন, ‘তোমার ছবি তুলেছে দেখলাম৷ তুমি দেওয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছ৷’

‘তাই! কখন তুলল কে জানে! অবশ্য ও-ছবি দেখিয়ে কোনওরকম সুবিধে করতে পারবে না৷ যদি পুলিশে গিয়ে জানায় তা হলে পুলিশও কোনও আমল দেবে না…৷’

‘কিন্তু বারবার যদি ও পুলিশকে বিরক্ত করতে থাকে তা হলে একসময় পুলিশও আমল দেবে৷ তখন…৷ প্র্যাকটিক্যালি সেইজন্যই একটা কড়া স্টেপ নিতে হল৷ তুমি সময়মতো গৌরী বস্ত্রালয়ের মোড়ে চলে এসো৷ দুজনে একসঙ্গে ধানকলের মাঠে যাব৷’

‘ওঃ…দারুণ হবে৷ একইসঙ্গে তেষ্টার তৃপ্তি, আর ছেলেটার হাত থেকে নিষ্কৃতি…৷’

‘তোমার দেখছি জিভে জল এসে গেছে৷’ খিলখিল করে হাসলেন হেডস্যার৷

‘আর তোমার আসেনি বুঝি!’ সত্যবানস্যারও খিলখিল করে হাসলেন৷

দুজনের হাসি যেন আর থামতেই চায় না৷ দুই পিশাচের রক্ত-হিম-করা হাসি৷

কুলদীপ বেড়ালের পায়ে ছুট লাগাল৷ ঘাম ফুটে বেরোল ওর কপালে৷ উত্তেজনায় ও চাপা সুরে শিস দিয়ে উঠল৷

দুদ্দাড় করে একতলায় নেমে এসেই ও সৌরভ আর প্রতীকের হাত ধরে টান মারল৷ দৌড়ে সাইকেল স্ট্যান্ডের দিকে যেতে-যেতে বলল, ‘শিগগিরই আয়…সামনে এখন অনেক কাজ…৷’

সাইকেল চালিয়ে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে ওরা মরিয়া হয়ে একটা সমাধান খুঁজতে লাগল৷

ভেতরে-ভেতরে ওরা ভয় পাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু আরও ভেতর থেকে কে যেন বলছিল, ‘কিছুতেই হার মানা চলবে না! কিছুতেই না!’

অমিয়স্যারের কথাগুলো কুলদীপের মনে পড়ছিল বারবার৷

.

৷৷নয়৷৷

চাঁদ মেঘে ঢাকা ছিল৷ হয়তো সেইজন্যই জোনাকির ঝাঁক বাড়াবাড়িরকম উড়ছিল৷

অচ্যুত যখন সাইকেল নিয়ে ধানকলের মাঠে পৌঁছল তখন উড়ন্ত আলোর বিন্দুগুলো ওর প্রথম চোখ টানল৷ একটা ঘোরের মধ্যে থাকলেও ও মুগ্ধ হয়ে জোনাকির খেলা দেখতে লাগল৷

আশপাশের অন্ধকারে আরও অন্ধকার গাছপালা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল৷ বাদলা বাতাস ওদের পাতায় ঝাপটা মারতেই ফিসফাস শুরু হল৷

অচ্যুতের মনে হল, ওরা বলেছে, ‘অচ্যুত এসে গেছে…অচ্যুত এসে গেছে…৷’

ঠিক সেইসময়ে ওর ঠিক পাশ থেকে ফিসফিস করে কে যেন বলে উঠল, ‘এসে গেছিস! গুড বয়৷ সাইকেল রেখে দিয়ে মাঠের মাঝে চল৷ হেডস্যার ওখানে অপেক্ষা করছেন…৷’

অচ্যুত মোটেই চমকে উঠল না৷ ধীরে-ধীরে পাশ ফিরে তাকাল৷

সত্যবানস্যার ওর খুব কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ ওঁর নিশ্বাস অচ্যুতের গায়ে এসে পড়ছে৷ ঠান্ডা নিশ্বাস৷ কিন্তু তাতেও অচ্যুত অবাক হল না৷ ওর মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি৷

বিকেলে দু-পশলা বৃষ্টি হয়েছিল৷ তারপর একটু রোদও দেখা গিয়েছিল—শরতের রোদ৷ তখন অচ্যুত একটা পুজো-পুজো গন্ধ টের পেয়েছিল৷

ওর ভীষণ মন খারাপ লাগছিল৷ মনের ভেতর থেকে ফিসফিস করে কেউ যেন বলছিল, ‘এ-পুজো আর দেখা হবে না৷’ তাই রোদ উঠতেই ও ছাদে গিয়েছিল বিকেলের শেষ রোদটা গায়ে মাখতে৷

‘এই যে, মিস্টার অ্যাক্সিডেন্ট!’

মউলি৷ হলুদরঙের একটা চুড়িদার পরেছে৷ ঝকঝক করছে৷ মনে হচ্ছে, বিকেলের রোদ দিয়ে তৈরি৷

অচ্যুত ওর দিকে তাকাল৷ কোনও কথা বলল না৷

‘কাল রাতে কী হয়েছিল? অঙ্কস্যারকে দেখে পালিয়েছিলে কেন বলো৷ তোমার মতো গুড বয়রা কখনও এমন পালায়! তুমি কিন্তু কথা দিয়েছ আমাকে সব বলবে৷ কখন বলবে বলো৷’

অচ্যুতের অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ও কিছুই বলতে পারল না৷ কয়েকবার ঠোঁট নড়ল শুধু৷

মউলি অপেক্ষা করতে লাগল৷

অনেকক্ষণ চেষ্টার পর শেষ পর্যন্ত অচ্যুত বিড়বিড় করে বলতে পারল, ‘বলব৷’

কিন্তু ওর হাবভাব দেখে মউলির ভুরু কুঁচকে গেল৷ পাঁচিলের কাছে এসে অচ্যুতদের ছাদের দিকে ঝুঁকে পড়ল৷ তারপর অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘অ্যাই, তোমার কী হয়েছে বলো তো?’

অচ্যুত সে-প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ‘পুজোয় তুমি নিশ্চয়ই খুব আনন্দ করবে?’

‘হ্যাঁ৷ তুমি করবে না?’

ডুবে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকাল অচ্যুত৷ সেদিকে আঙুল তুলে বলল, ‘ওটা কী আনন্দ?’

‘কী ব্যাপার! তোমার কী হয়েছে?’

অচ্যুতের চোখে জল এসে গেল৷ হাতের পিঠ দিয়ে মোছার চেষ্টা করে জড়ানো গলায় বলল, ‘কিচ্ছু না৷ তোমার কথা বলো৷’

‘হঠাৎ আমার কথা জানতে চাইছ?’ চোখ পাকিয়ে হাসল মউলি৷

‘আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে৷ পরে যদি আর জানতে না পারি…৷’

‘ও—৷ ঠিক আছে, বলছি৷’ স্বামী বিবেকানন্দের ভঙ্গিতে বুকের কাছে হাত জড়ো করে সোজা হয়ে দাঁড়াল মউলি৷ তারপর পড়া মুখস্থ বলার ঢঙে বলল, ‘আমার নাম মউলি মিত্র৷ তোমাদের পাশের বাড়িতে থাকি৷ পড়াশোনায় মন নেই৷ রোজ বিকেলে অ্যাক্সিডেন্টের লোভে ছাদে উঠে ঘোরাঘুরি করি৷ ব্যস! আপাতত এইটুকুই৷’

ঠিক এইসময় সিঁড়ির কাছ থেকে মা অচ্যুতকে ডাকল৷

অচ্যুত ঘাড় ঘুরিয়ে ছাদের দরজার দিকে একবার তাকাল৷ তারপর হাত নেড়ে মউলিকে ‘টা-টা’ করে বলল, ‘কাল যদি ছাদে দেখা হয় বেশ হবে…৷’

বলেই দৌড়ে চলে গেল ছাদ থেকে৷

মউলি অবাক বিষণ্ণ চোখে অচ্যুতের চলে যাওয়া দেখল৷ ও যেন কতকিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু বলতে পারল না৷

সত্যবানস্যারের গুড বয় কথাটা মউলিকে মনে পড়িয়ে দিয়েছিল৷ তাই আশপাশের অন্ধকার, জঙ্গলের গন্ধ, সব কিছু কেমন ভুলে গিয়েছিল অচ্যুত৷ ভুলে গিয়ে মউলির কথা ভাবতে শুরু করে দিয়েছিল৷

কিন্তু ঝিঁঝিপোকার কান্না, ব্যাঙের ডাক, জোনাকির আলো, সত্যবানস্যারের ঠান্ডা নিশ্বাস, অচ্যুতকে আচমকা ঝাঁপিয়ে ঘিরে ধরল৷

স্যারের হাত ধরে ও মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে চলল৷ বড়-বড় ঘাস কিংবা জল-কাদা টের পেল কি পেল না৷

বেশ কিছুটা যাওয়ার পর ও হেডস্যারের কালো ছায়াটা ঠাহর করতে পারল৷

ওকে দেখেই হেডস্যার দু-হাত শূন্যে তুলে নাচের ভঙ্গি করলেন৷

সত্যবানস্যার অচ্যুতের ঠিক পিছনে একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন৷ তারপর হিসহিস করে বললেন, ‘আজ আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক তৈরি হবে…তেষ্টার সম্পর্ক…রক্তের সম্পর্ক৷ তারপর…তারপর তুই মুক্তি পাবি৷’

অন্ধকারে হেডস্যারের ধূসর ছায়া খিলখিল করে হাসল৷

আকাশের তুলো-তুলো মেঘ জায়গায়-জায়গায় ছিঁড়ে গেছে৷ কয়েকটা দলছুট তারা চোখে পড়ছে৷ চোখে পড়ছে পালাই-পালাই চাঁদের একটা টুকরো৷

প্রবল বাতাসের ঝাপটা হঠাৎই ওদের ঘিরে পাক খেয়ে গেল৷

অচ্যুতের চুল উড়তে লাগল৷ মায়ের কথা মনে পড়ল৷ বাপির কথা মনে পড়ল৷ মউলির কথাও৷

আর ঠিক তখনই দুটো রক্তপিশাচ অচ্যুতকে ঘিরে নাচ শুরু করল৷

অন্ধকারের ওদের সিলুয়েট ছায়ামূর্তিগুলো কীরকম লম্বাটে দেখাচ্ছে৷ লিকলিকে হাতগুলো আকাশের দিকে তুলে আঙুলে নানারকম মুদ্রা ফুটিয়ে ওরা পাগলের মতো নাচছে…নাচছে৷

অচ্যুত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, ‘মা…মা…মাগো…৷’

ওর বুকের ভেতরটা ফেটে চৌচির হয়ে যেতে চাইল৷ ও উবু হয়ে ভিজে মাঠের ওপর বসে পড়ল৷

সাপ-খেলানো সুরে হেডস্যার তখন ফিসফিস করে বলছিলেন, ‘এ আমাদের বলির নাচ৷ তোর জীবন আমাদের তেষ্টা মেটাবে৷ আমাদের পরমায়ু বাড়িয়ে দেবে…৷’

অচ্যুত জড়ভরতের মতো ফ্যালফ্যাল করে ওঁদের নাচ দেখছিল৷ আর শেষ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল৷

একটু পরে ওঁরা অন্ধকার মাঠের ওপরে শুয়ে পড়লেন৷ সাপের মতো বুকে হেঁটে অচ্যুতকে ঘিরে পাক খেতে লাগলেন৷

একসময় হেডস্যার গলা উঁচু করে অচ্যুতের ঘাড়ে ঠোঁট ছোঁয়ালেন৷ অচ্যুত সাপের মুখে-পড়া ব্যাঙের মতো নিশ্চল হয়ে গেল৷

ঠিক তখনই ধানকলের মাঠের সীমানায় ফুলঝুরির মতো একটা সাদা আলো ফিনকি দিয়ে জ্বলে উঠল৷

প্রথমে একটা৷

তারপর আর-একটা৷

তারপর একে-একে অসংখ্য৷

সাদা, সবুজ, নীল, লাল—নানান রঙের রংমশাল জ্বলে উঠল মাঠের কিনারায়৷

কয়েক মিনিটের মধ্যেই মাঠ ঘিরে রংমশালের রঙিন আলোর এক বৃত্ত তৈরি হয়ে গেল৷

শ’য়ে শ’য়ে রংমশাল উদ্দাম ফুর্তিতে জ্বলছে৷ অন্ধকার মাঠে আলোর উৎসব শুরু হয়ে গেল যেন৷

‘দুর্গাপুজো কি এসে গেছে? নাকি কালীপুজো!’ ঝাপসাভাবে ভাবতে চেষ্টা করল অচ্যুত৷

ও চমকে তাকিয়েছিল আলোর দিকে৷ ঝলসানো আলোয় অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ছে অনেকগুলো মুখ৷ ঝাঁকে-ঝাঁকে ছেলের দল হাজারো রংমশাল জ্বেলে নতুন এক অকালবোধন শুরু করে দিয়েছে৷

সত্যবানস্যার আর হেডস্যারও থমকে গেলেন৷ ওঁরা চটপট সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন৷ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আলোর রেখার দিকে৷

রংমশালের আলোগুলো এবার তিরবেগে ছুটে আসতে শুরু করল ওঁদের দিকে৷ আলোর বৃত্তটা তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছোট হয়ে আসতে লাগল৷

অচ্যুত ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না৷ চোখ কচলে ও ছোট হয়ে আসা বৃত্তটাকে ভালো করে দেখতে লাগল৷

অসংখ্য ছেলে, তাদের হাতে জ্বলন্ত রংমশাল—চিৎকার করতে-করতে ছুটে আসছে ওদের দিকে৷

একটু পরে চিৎকারটা বুঝে উঠতে পারল অচ্যুত৷ জিহাদ মিছিলের স্লোগানের মতো ওরা গলায় গলা মিলিয়ে বারবার বলছে, ‘রক্তপিশাচ নিপাত যাক! রক্তপিশাচ নিপাত যাক!’

আনন্দে কান্না পেয়ে গেল অচ্যুতের৷ পুজোয় ও তা হলে মউলির মতো আনন্দ করতে পারবে!

ওই তো কুলদীপ! ওই তো সৌরভ! ওই তো বাসব!

সঙ্গে আরও অসংখ্য চেনা-অচেনা মুখ৷

হইহই চিৎকার এতক্ষণে একেবারে কাছে এসে গেছে৷ জায়গাটা আলোয় আলো হয়ে উঠেছে৷ সত্যবানস্যার আর হেডস্যার ফাঁদে পড়া নেংটি ইঁদুরের মতো ভয়ে এলোমেলো দৌড়চ্ছেন৷

অচ্যুত দৌড়ে গেল কুলদীপের কাছে৷

কুলদীপ রংমশাল একহাতে সামলে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল৷ অচ্যুত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল৷ এক অদ্ভুত আনন্দের ঢেউ ওর বুকের ভিতরে উথলে উঠে ওকে একেবারে ভাসিয়ে দিল৷

আর ঠিক তখনই কয়েকশো জ্বলন্ত রংমশাল ছুটন্ত সত্যবানস্যার আর হেডস্যারকে ছুঁয়ে ফেলল৷

রক্ত-হিম-করা এক ভয়ংকর আর্তনাদ ধানকলের মাঠের আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দিল৷ দপ করে জ্বলে উঠল দুই পিশাচের অভিশপ্ত শরীর৷ ওদের শরীরের ধুনি থেকে কালো ধোঁয়ার গাঢ় কুণ্ডলী পাক খেয়ে উঠতে লাগল আকাশের দিকে৷

সবাই মুখ তুলে সেই ধোঁয়ার দিকে দেখতে লাগল৷

রংমশালের আগুন নিভলে অন্ধকারে কয়েকটা টর্চ এদিক-ওদিক জ্বলে উঠল৷ দেখা গেল দুই পিশাচের তালগোল পাকানো মৃতদেহ জড়াজড়ি করে পড়ে আছে৷ দুটো সাপবাজির ট্যাবলেট পাশাপাশি পোড়ানোর পর যেরকম দশা হয় অনেকটা সেইরকম৷

আকাশে ভেসে যাওয়া কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী থেকে তখনও আর্তকান্না শোনা যাচ্ছে৷

সৌরভ, প্রতীক আর বাসব অচ্যুতকে একেবারে জাপটে ধরল৷

অচ্যুতের চোখের জল বাঁধ মানছিল না৷ কাঁদতে-কাঁদতেই ও বলল, ‘তোরা আমাকে এত ভালোবাসিস!’

কুলদীপ হাতের মাসল ফুলিয়ে বলল, ‘এসবের জন্যে কত কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে জানিস! রাজীবের মাম্মি পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন রংমশাল কেনার জন্যে৷ পাড়ার দোকানে পাওয়া যায়নি—তাই বাজির আড়তে যেতে হয়েছে৷’

আবেগে অচ্যুত কোনও কথা বলতে পারছিল না৷ ও কুলদীপের গালে একটা চুমু খেল৷

এমন সময় কে একজন ওদের কাছে এসে দাঁড়াল৷ বলল, ‘বলেছিলাম না, বীতিহোত্র!’

ওরা পাঁচজন অন্ধকারেই হেসে উঠল৷ তারপর কী ভেবে অমিয়স্যারকে ঢিপ-ঢিপ করে প্রণাম করে ফেলল৷

অমিয়স্যার অচ্যুতকে লক্ষ করে বললেন, ‘তুই শুধু যে ভালো ছেলে তা নয়—অসাধ্বসও বটে!’

বাসব জিগ্যেস করল, ‘অসাধ্বস মানে কী, স্যার?’

অমিয়স্যার হেসে বললেন, ‘এও জানিস না! অসাধ্বস মানে হল সাহসী, শঙ্কাহীন৷’

অচ্যুত চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল৷ ওর শরীরটা সামান্য কেঁপে-কেঁপে উঠছিল৷ অমিয়স্যারের ‘ভালো ছেলে’ কথাটা থেকে ওর ‘গুড বয়’ মনে পড়ল৷ তারপর ‘গুড বয়’ থেকে ‘অ্যাক্সিডেন্ট’৷ আর সবশেষে ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ থেকে একজনের কথা মনে পড়ে গেল৷

ওকে এবার সব খুলে বলতে হবে৷

.

৷৷দশ৷৷

আমি একজন পিশাচ৷ এ ছাড়া অন্য কোনও পরিচয় আমার নেই৷

এখন আমাকে আবার নতুন আশ্রয়ের খোঁজে বেরোতে হবে৷

আগেই তো বলেছি, আত্মা যদি অমর অবিনশ্বর হয় তা হলে আমার অমর হতে অসুবিধে কী! গীতার সাংখ্যযোগে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ৷’ অর্থাৎ, কোনও শস্ত্র এই আত্মাকে ছেদন করিতে পারে না৷ অগ্নি ইহাকে দহন করিতে পারে না৷

তা হলে আমাকে অগ্নি দহন করবে কেমন করে!

তাই আকাশে, বাতাসে, ধুলোয় মিশে আবার শুরু হোক আমার পথ চলা৷

চলতে-চলতে আবার আমাকে খুঁজতে হবে নতুন আশ্রয়৷ নিতে হবে আবার কোনও নতুন পরিচয়৷ তারপর আবার বিশ্রাম আর আরাম৷

নতুন জায়গায়, নতুন পরিবেশে, শুরু হবে আমার নতুন জীবন৷

আঃ, ভাবতেই কী তৃপ্তি!

সমাপ্ত

 

 

বজ্রগোলাপ

৷৷এক৷৷

ঘিয়া নদীর পাড়ে রাহুলের সঙ্গে কোকোর প্রথম দেখা হয়েছিল৷ ভিজে জামা-কাপড়ে একটা বটগাছের নীচে কোকো অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল৷

সেদিন আকাশে অনেক মেঘ ছিল৷ তাই বৃষ্টির আশায়-আশায় ছিল সবাই৷ কিন্তু সন্ধে পর্যন্ত বৃষ্টির দেখা মেলেনি৷ অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা থোকা-থোকা ঘন মেঘ মাথার ওপরে ঝুলছিল৷ আর তারই ফাঁকে-ফাঁকে বিদ্যুতের আলো ঝলসে উঠছিল৷ আলোর পরই গুড়-গুড়াম৷ মেঘের ডম্বরু বাজছিল৷

মোহনকুমার স্মৃতি চ্যালেঞ্জ শিল্ড-এর ফাইনাল ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়েছিল রাহুল৷ সঙ্গে তিন বন্ধু—গোপাল, নিধু, আর দীপায়ন৷ খেলাটা ছিল ওদের পাশের গ্রামে—যে-গ্রামটার নাম ভারী অদ্ভুত : তিনমাইল৷ এই নামটার কারণ বাপির কাছে জানতে চেয়েছিল রাহুল৷ সে বেশ কয়েকবছর আগে—যখন ও ক্লাস ফাইভে পড়ত৷ তখন বাপি বলেছিল, ‘সাত বছর আগেও গ্রামটার কোনও নাম ছিল না৷ সবাই বলত মণিমেলার পাশের গ্রাম৷ তারপর ঘিয়া নদীতে নতুন ব্রিজ তৈরি হল৷ সেটা থেকে ওই গ্রামটার দূরত্ব মোটামুটি তিনমাইল৷ লোকের মুখে-মুখে ওই তিনমাইল দূরত্বের ব্যাপারটা ঘুরতে-ঘুরতে তা থেকে শেষ পর্যন্ত ওটা গ্রামের নাম হয়ে গেছে৷’

তিনমাইলের ফুটবল খেলায় রাহুলরা কোনও দলের সাপোর্টার ছিল না৷ স্রেফ ফুটবল খেলার নেশাতেই ওরা চারজন ফাইনাল ম্যাচ দেখতে গিয়েছিল৷ ম্যাচ শেষ করে ফেরার সময় আকাশের অবস্থা ঠিক যেন বৃষ্টি হব-হব৷ তাই কখনও হেঁটে কখনও ছুটে ওরা মণিমেলার দিকে ফিরছিল৷

একটু পরেই ওরা ঘিয়া নদীর পাড়ে পৌঁছে গেল৷ এবার নদী পেরোলেই মণিমেলা৷ উঁচু পাড় থেকে মাটির ঢাল জলের দিকে নেমে গেছে৷ নদীতে জল এখন বেশি নেই৷ গত দু-সপ্তাহে দু-তিনদিন বৃষ্টি হলেও বর্ষা সেরকমভাবে এখনও শুরু হয়নি৷ তাই ঘিয়া এখন শান্ত, নিরীহ৷ বর্ষার দাপটে এই শান্তশিষ্ট নদীটার রূপ বদলে যায়৷ তখন ঘিয়ার এত স্রোত থাকে যে, সাঁতরে এপার-ওপার করতেও ভয় হয়৷

রাহুলরা নদীর পাড়ে যেখানটায় এসে দাঁড়াল সেখানে কোনও ব্রিজ নেই৷ তবে খেয়া পারাপারের ব্যবস্থা আছে৷ ছোট ডিঙিনৌকো—বড়জোর দশ-বারোজন দাঁড়াতে পারে৷ খেয়া পার হয়ে গেলে রাহুলদের বাড়িটা কাছাকাছি হয়৷ ব্রিজ দিয়ে ঘিয়া পেরোতে হলে অনেকটা ঘুরপথ হয়ে যায়৷

রাহুল-গোপালরা সবাই সাঁতার জানে৷ তাই বেশ সহজভাবে ওরা নৌকোর ওপরে দাঁড়িয়ে ছিল আর ফাইনাল খেলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল৷

কথা বলতে-বলতে রাহুল বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল৷ যদি বৃষ্টি নামে তা হলে আর রক্ষে নেই৷ না, বৃষ্টিতে ভেজার ভয় ও করছে না৷ আসলে স্কুল-লাইব্রেরির দুটো গল্পের বই ও টেবিলের খোলা জানলার কাছে রেখে এসেছে৷ ওগুলো যদি ভিজে যায়!

ঘিয়া পার হয়ে ওরা চারজন নদীর পাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল৷ ঠিক তখনই আচমকা ঝড় উঠল৷ ঠান্ডা বাতাস ওদের ঘিরে পাক খেতে লাগল আর কালো আকাশ থেকে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি টপাটপ করে পড়তে শুরু করল৷

নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকটা বড়-বড় গাছ ঝোড়ো বাতাসে হেলে পড়েছিল৷ ওদের ডালপালা-পাতা পতাকার মতো উড়ছিল৷

চোখে হাত চাপা দিয়ে রাহুল ধুলো আটকাচ্ছিল৷ সেই অবস্থায় পা হড়কে গিয়ে ও বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়ল৷ ততক্ষণে নিধু, গোপাল আর দীপায়ন নদীর ঢাল পেরিয়ে ওপরের কাঁচা রাস্তায় উঠে পড়েছে৷

নিধু একবার চেঁচিয়ে রাহুলকে ডাকল, ‘জলদি আয়৷ এখুনি জোরে বৃষ্টি আসবে…৷’

সেই চেষ্টাই করছিল রাহুল৷ এছাড়া খোলা জানলার কাছাকাছি রাখা বইগুলো ভিজে যাবে, এই ব্যাপারটাও মাথায় ছিল৷ তাই আরও জোরে পা চালাল৷ আর ঠিক সেই সময়েই সীসের মতো আকাশে নীলচে সাদা বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল৷ পলকের জন্য চারপাশটা আলোয় আলো হয়ে গেল৷ আর তখনই লোকটাকে দেখতে পেল ও৷ সঙ্গে-সঙ্গে বিকট শব্দে বাজ পড়ল৷

নদীর পাড়ে দাঁড়ানো ঝুরি-নামা একটা বটগাছের নীচে পড়ে আছে একটা মানুষ৷ রাহুলের কাছ থেকে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ ফুট দূরে৷ এই মেঘলা কমজোরি আলোয় লোকটাকে হয়তো চোখেই পড়ত না যদি না ওর শরীর থেকে চকচকে কিছু একটা বিদ্যুতের আলোয় ঝিলিক মেরে উঠত৷

রাহুলের পথ বেঁকে গেল৷ ও পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল লোকটার কাছে৷ ওর ওপরে ঝুঁকে পড়ল৷

বৃষ্টি এখনও না পড়ার মতন, অথচ মানুষটার জামা-প্যান্ট সব জলে ভিজে সপসপে৷ পায়ে জুতো নেই৷ গায়ের রং ফরসা৷ তাই শরীরের কাটা দাগগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ছে৷ ছুরির ডগা দিয়ে কেউ যেন ওর হাত-পায়ে দাগ কেটেছে৷ সেই চেরা জায়গাগুলো থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে৷

পাশ ফিরে মাটির দিকে মুখ ঘুরিয়ে অসাড়ভাবে পড়ে আছে লোকটা৷ বেঁচে আছে না মরে গেছে বোঝার উপায় নেই৷

যে-জিনিসটা বিদ্যুতের আলোয় ঝিলিক মেরে উঠেছিল এবার সেটার দিকে তাকাল রাহুল৷ গলায় আটকানো একটা মেটাল ব্যান্ড৷ অনেকটা কুকুরের বকলসের মতো৷ এক কি দেড় সেন্টিমিটার চওড়া৷

রাহুলের একবার মনে হল, লোকটা কি নেশা করে পড়ে আছে? আবার মনে হল, লোকটা ঘিয়া নদীর জলে ভেসে আসেনি তো? ও ঝুঁকে পড়ে লোকটাকে ডাকল : ‘এই যে, শুনছেন! এই যে—৷’

কোনও সাড়া নেই৷

লোকটা কি মরে গেছে? নাকি অজ্ঞান হয়ে গেছে?

কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে মরিয়া হয়ে লোকটাকে ঠেলা মারল রাহুল : ‘এই যে, শুনছেন!’

না, কোনও সাড়া নেই৷ শুধু বাতাসের সোঁ-সোঁ শব্দ আর গাছের পাতার ছটফটানির আওয়াজ৷

এদিকে রাহুলকে পিছনে দেখতে না পেয়ে নিধু-গোপালরা ফিরে আসছিল৷ রাহুলের নাম ধরে বারবার ডাকছিল৷

দু-হাতে লোকটার ডানকাঁধ ধরে টান মারল রাহুল৷ লোকটার শরীরটা আধপাক ঘুরে চিত হয়ে গেল৷

লোকটাকে ভালো করে দেখল রাহুল৷

বয়েস কত হবে, বড়জোর সাতাশ-আটাশ৷ মাথায় কদমছাঁট চুল৷ ছোট-ছোট চোখ৷ নাকটা সামান্য থ্যাবড়া৷ ঠোঁটজোড়া একটু ফাঁক হয়ে থাকায় দাঁত দেখা যাচ্ছিল৷

রাহুল লক্ষ করল, লোকটার দু-গালে নতুন দশ পয়সার মাপের তিনটে কালচে গোল দাগ৷ কেউ যেন কড়ে আঙুল দিয়ে কাজলের টিপ পরিয়ে দিয়েছে৷

লোকটার মুখে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল৷ একইসঙ্গে রাহুল ওকে ধাক্কা দিচ্ছিল, ডাকাডাকি করছিল৷

এমন সময় গোপালরা রাহুলের কাছে পৌঁছে গেল৷ লোকটাকে দেখে ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে দিল, তর্ক জুড়ে দিল৷ আর লোকটার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল৷ থুতনি ধরে এপাশ-ওপাশ নাড়তে লাগল৷ বুকে হাত দিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল৷

ওরা এটুকু বুঝল, জামা-প্যান্ট ভিজে থাকলেও লোকটার শরীরে তাপ আছে৷ বুকে কান পেতে ধরলে ধুকপুকুনি দিব্যি টের পাওয়া যাচ্ছে৷ লোকটা যে বেঁচে আছে তাদে কোনও সন্দেহ নেই৷ কিন্তু ওর শরীরের কাটা দাগগুলো এল কেমন করে? আর ওর গলার মেটাল ব্যান্ডটাই বা কী?

এর মধ্যেই ঝড় কিছুটা কমে গেছে৷ বৃষ্টি একটু জোরালো হয়েছে৷ গাছের পাতার খসখসানি শব্দও খানিকটা স্তিমিত৷ ওরা তখনও লোকটাকে জাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল৷

হয়তো বৃষ্টির জল মুখে পড়ার জন্যই হঠাৎ লোকটা চোখ খুলে তাকাল৷ চারটে মুখ ওর ওপরে ঝুঁকে রয়েছে দেখে ভয়ের একটা চাপা চিৎকার করে উঠল৷

নিধু ওকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘ভয় পেয়ো না৷ কোনও ভয় নেই৷’

দীপায়ন জিগ্যেস করল, ‘তুমি কে? নদীর পাড়ে এখানে কোত্থেকে এলে?’

লোকটা ভয়ের চোখে ওদের মুখগুলোর ওপরে একবার নজর বুলিয়ে নিল৷ তারপর ডানহাতটা শূন্যে তুলে নদীর দিকে দেখাল৷ যেদিক থেকে ঘিয়া নদী বয়ে আসছে সেদিকে৷ রাহুল লক্ষ করল, লোকটার হাত কাঁপছে৷

রাহুল তাকাল নদীর উজানের দিকে৷ তা হলে কি লোকটা নদীর জলে ভেসে এসেছে?

রাহুল জিগ্যেস করল, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’

লোকটা সরল চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল রাহুলের দিকে৷ তারপর দু-হাতের আঙুল এমনভাবে ঘোরাল যার মানে কোথায় যাবে ও জানে না৷

‘তোমার বাড়ি কোথায়?’ গোপাল জানতে চাইল৷

লোকটা কোনও উত্তর দিল না৷ শূন্য চোখে গোপালের দিকে তাকিয়ে রইল৷

‘আপনার সঙ্গে আর কেউ আছে?’ রাহুল জিগ্যেস করল৷

ভাঙা কর্কশ গলায় লোকটা টেনে-টেনে জবাব দিল, ‘কেউ…নেই৷’ মনে হচ্ছিল ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে৷

রাহুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই লোকটা একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল৷

‘কেউ…নেই৷ কেউ…নেই৷’ বলতে লাগল বারবার এবং হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল৷ রাহুলের পায়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ পাগলের মতো পায়ে মাথা ঘষতে লাগল আর কাঁদতে লাগল৷

রাহুল কোনওরকমে এক পা পিছিয়ে এল৷ সবাই মিলে ধরাধরি করে ওকে দাঁড় করাল৷ লোকটা তখনও মুখ বিকৃত করে কাঁদছে৷ গুঙিয়ে-গুঙিয়ে কী বলছে কিছু বোঝা যাচ্ছে না৷

রাহুল অবাক হয়ে লোকটার সরল কান্না-ভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷

দীপায়ন, নিধু আর গোপাল তখন নিজেদের মধ্যে কথাবলাবলি করতে লাগল৷

কী করা যায় লোকটাকে নিয়ে?

কেউ বলল, ‘ছাড় তো৷ ও এখানেই পড়ে থাক৷ পরে যেখানে যায় যাবে৷’

একজন বলল, ‘চল, আমরা গিয়ে থানায় খবর দিই…৷’

আর-একজন বলল, ‘দাদাদের ক্লাবে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলে হত৷’

‘না, তার চেয়ে বরং পার্টি অফিসে নিয়ে চল৷ ওরা থানা-পুলিশ যা করার করবে৷’

বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ এরকম এলোমেলো কথাবার্তা শোনার পর রাহুল ফস করে বলে উঠল, ‘আমি ওকে বাড়িতে নিয়ে যাব৷’

সঙ্গে-সঙ্গে নিধু, গোপাল আর দীপায়ন চুপ করে গেল৷ ওরা এমন চোখে রাহুলের দিকে তাকাল যেন রাহুলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে৷

রাহুল ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া আহত লোকটার দিকে তাকাল৷ হাত বাড়াল ওর দিকে৷ সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা এমনভাবে ওর হাতটা আঁকড়ে ধরল যেন এটা ছেড়ে দিলে ও আর বাঁচবে না৷ ভয়ের চোখে রাহুলের দিকে তাকাল৷

রাহুল চাপা গলায় ওকে বলল, ‘কোনও ভয় নেই৷’

নিধু, গোপাল আর দীপায়নের সঙ্গে তর্ক করতে-করতে রাহুল এগোল৷ ওর হাত আঁকড়ে ধরে মাথা নীচু করে লোকটাও এগোল৷

বৃষ্টি আরও বেড়ে গেছে৷ ওদের জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে৷ গাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ হচ্ছে৷ ভেজা মাটি থেকে বৃষ্টির অদ্ভুত গন্ধ উঠছে৷

দীপায়নদের নানান উপদেশ আর খোঁচার জবাবে রাহুল বলল, ‘আজ রাতটা তো ও আমাদের বাড়িতে থাক৷ কাল সকালে বাপি যা করার করবে…৷’

কাঁচা রাস্তায় বৃষ্টির জল পড়ে কাদা তৈরি হচ্ছিল৷ তার ওপরে ওরা ছপছপ শব্দে পা ফেলে এগোচ্ছিল৷ খালি পায়ে চলার জন্য লোকটার বেশ অসুবিধে হচ্ছিল৷ কারণ, পথের নানা জায়গায় ইট-পাথরের টুকরো, গাছের ভাঙা ডাল মাড়িয়ে চলতে হচ্ছিল৷ কিন্তু লোকটা মুখে টুঁ শব্দটিও করছিল না৷ সরল মুখে মাথা নীচু করে হাঁটছিল৷

একটা পুকুরের কাছে এসে রাহুলের পথ আলাদা হয়ে গেল৷ ও লোকটাকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরল৷ গোপালদের বলল যে, কাল কী হয় না হয় সেটা কাল ওদের জানাবে৷

রাহুল বৃষ্টিতে বেশ ভিজে গেছে৷ ও বাঁ-হাতের পাতা কপালের সামনে গাড়িবারান্দার মতো রেখে বৃষ্টির ছাট আটকাতে চেষ্টা করছিল৷ লক্ষ করল, এতটা পথ আসার সময় লোকটা একবারও বৃষ্টি আড়াল করার চেষ্টা করেনি৷ বরং এমনভাবে ও পথ চলছে যেন বৃষ্টি পড়ছেই না৷

রাহুল হঠাৎই ওকে জিগ্যেস করল, ‘তোমার নাম কী?’

লোকটা ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল৷ ভাবলেশহীন নিষ্পাপ মুখ৷ কোনও উত্তর দিল না৷

রাহুল আবার একই কথা জিগ্যেস করল৷

কোনও উত্তর নেই৷

তবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রাহুলের মনে হল, ও যেন তীব্রভাবে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করছে৷ হয়তো ওর নামটাই মনে করার চেষ্টা করছে৷

রাহুল হাল ছাড়ল না৷ তৃতীয়বার ওর নাম জানতে চাইল৷

এবার লোকটা ভাঙা কর্কশ গলায় টেনে-টেনে জবাব দিল, ‘কোকো৷ আমার নাম কোকো৷ কো-কো…৷’

কোকো! কী অদ্ভুত নাম! আপন-মনেই ভাবল রাহুল৷

কালচে আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল৷ তারপরই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল৷

বাড়ির সামনে এসে গিয়েছিল রাহুল৷ বাউন্ডারির গ্রিলের গেটের হুড়কো খুলে ভেতরে ঢুকল৷ ওর হাত আঁকড়ে থাকা কোকোও ঢুকে পড়ল ওর সঙ্গে৷

বাউন্ডারির গেট থেকে ইট-পাতা পথ চলে গেছে একতলা বাড়িটা পর্যন্ত৷ বাড়ির বাঁ-দিকটায় বেশ কয়েকটা গাছপালা৷ অযত্নে বেড়ে ওঠা বাগান৷ তার একটা ছোট অংশে অনেক ফুলগাছ৷ আর তার পাশে একটা টিউবওয়েল৷

ইট-পাতা পথ ধরে এগোতে-এগোতেই রাহুল চেঁচিয়ে মা-কে ডাকল, ‘মাম, শিগগির দরজা খোল৷ একেবারে ভিজে গেছি৷’

বাড়ির দরজায় পৌঁছে মা-কে আরও একবার ডাকল রাহুল৷ একইসঙ্গে কলিংবেল টিপল৷

দরজা খুলে গেল৷ মা দরজায় দাঁড়িয়ে৷ ওকে দেখেই চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘ঠিক জানতাম আজ তুই বৃষ্টিতে ভিজবি৷ তোর বাপিকে বলছিলাম…’ মায়ের কথা মাঝপথেই থেমে গেল, কারণ কোকোকে তিনি এইমাত্র খেয়াল করেছেন৷

রাহুলের মা গলা নামিয়ে ছেলেকে জিগ্যেস করলেন, ‘এ কাকে সঙ্গে এনেছিস?’

রাহুল বলল, ‘মাম, ওর নাম কোকো৷ ওর খুব বিপদ৷ ঘিয়ার পাড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল…৷’

৷৷দুই৷৷

পরদিনটা ছিল রবিবার৷ রবিবারটা সবসময়েই রাহুলের কাছে কেমন যেন অন্যরকম দিন বলে মনে হয়৷ সেদিন সকালে যে-সূর্যটা ওঠে সেটা অন্যরকম৷ সকালে যে-পাখিগুলো ডাকে তাদের ডাকগুলো আলাদা৷ ওদের বাগানে যে-ফুলগুলো ফোটে রবিবার তাদের একটু বেশি হাসিখুশি বলে মনে হয়৷

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে রাহুল সেই ‘অন্যরকম’ সকালটাকে অনুভব করল৷ তারপরই ওর মনে পড়ে গেল কোকোর কথা৷

জানলা দিয়ে আকাশ দেখল রাহুল৷ ছেঁড়া-ছেঁড়া ছাই-রঙা মেঘ৷ তার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ভোরের খবর পাঠাচ্ছে পৃথিবীতে৷ গাছের চকচকে সবুজ পাতায় সেই আলো ঠিকরে যাচ্ছে৷ কাল সন্ধের বৃষ্টিতে পাতাগুলো স্নান-টান সেরে আজ একেবারে ঝক-ঝকে হয়ে সেজে উঠেছে৷ তারই ফাঁকে-ফাঁকে ভেসে বেড়াচ্ছে পাখির ডাক৷

আজ সকালটাকে দেখে মনেই হয় না কাল সন্ধেয় ওরকম ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল৷

বিছানা ছেড়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল রাহুল৷ আর তখনই কোকোকে দেখতে পেল৷

বারান্দার ডানদিকে ফুলের বাগান৷ সেখানে অনেকগুলো সূর্যমুখী ফুলের গাছ৷ এখন দু-চারটে ফুল ফুটেছে—বাকি সব কুঁড়ি৷ তার পাশেই কয়েকটা বেলফুল আর গোলাপের গাছ৷ তাতে সাদা আর গোলাপি ফুল৷ নাকে না হলেও মনে-মনে ফুলের গন্ধ পেল রাহুল৷ নাক টেনে চোখ বুজল ও৷

চোখ খুলতেই কোকোকে দেখতে পেল৷ একটা জামগাছের আড়াল থেকে ছুটে বেরিয়ে এল৷ তারপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে নেচে-নেচে ছুটে বেড়াতে লাগল আর একই সঙ্গে হাততালি দিতে লাগল৷

ভালো করে খেয়াল করতেই রাহুল একটা হলদে-কালো প্রজাপতিকে দেখতে পেল৷ প্রজাপতিটা ফুলের বাগানে এলোমেলো উড়ে বেড়াচ্ছে আর কোকো তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওটার পিছন-পিছন ছুটছে৷

না, প্রজাপতিটা ধরার জন্য ও মোটেই ছুটছে না৷ বরং এক বিচিত্র উল্লাসে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ওটাকে অনুসরণ করছে৷

সাতাশ-আটাশ বছরের ছেলেটাকে একটা বাচ্চা ছেলে বলে মনে হল রাহুলের৷ সরল ভোলাভালা চোখ, শরীরের কাটা-ছেঁড়া সম্পর্কে উদাসীন, কোথা থেকে ও এসেছে, কোথায় যাবে, সে-সম্পর্কে ওর চিত্ত ভাবনাহীন৷

বারান্দার গ্রিলের দরজা ঠেলে সরিয়ে দু-ধাপ সিঁড়ি নামল রাহুল৷ পায়ে-পায়ে বাগানের দিকে এগোল৷

বাগানের মাটি ভেজা৷ কোথাও-কোথাও কাদা প্যাচপেচে হয়ে আছে৷

ফুলগাছগুলোর দিকে তাকাল রাহুল৷ হলদে-কালো প্রজাপতিটা ছাড়াও কয়েকটা ফড়িং ওড়াউড়ি করছে সেখানে৷ কিন্তু কোকোর যত আগ্রহ প্রজাপতিটাকে নিয়ে৷

রাহুলকে দেখতে পেয়েই খুশিতে উজ্জ্বল হল কোকোর মুখ৷ ও চেঁচিয়ে বলল, ‘এই…দ্যাখো৷ প্রজা…পতি৷ হলুদ…আর…কালো৷ প্রজা…পতি৷’

একইরকম কর্কশ স্বর আর টেনে-টেনে কথা বলা৷ যেন ঠান্ডা লেগে বরাবরের জন্য গলা ভেঙে গেছে৷

কোকোর উৎসাহ, খুশি, আর কথা বলার ঢং রাহুলের সমবয়েসি কোনও বন্ধুর মতন৷ কাল সন্ধে থেকেই ব্যাপারটা রাহুল লক্ষ করেছে৷ তাতে ও বেশ মজাও পেয়েছে৷

প্রথমটায় কোকোকে দেখে রাহুলের মাম আর বাপি খুব অবাক হয়েছিলেন৷ কোকোকে বাইরের ঘরে বসিয়ে ভেতরের ঘরে রাহুলকে ডেকে নিয়ে মাম ওকে অনেক প্রশ্নও করেছেন৷

সেসব কথা শুনতে পেয়ে বাড়ির ভেতর থেকে বাপিও সেখানে এসে হাজির হয়েছেন৷ দুজনের প্রশ্নের ঠেলায় রাহুলের তো অবস্থা কাহিল!

বাপি বললেন, ‘বোঝোই তো…দিন-কাল ভীষণ খারাপ৷ ওকে তুমি চেনো না, জানো না…৷’

সেইসঙ্গে মাম যোগ করলেন : ‘তা ছাড়া ওর গায়ে অত জায়গায় কাটা…রক্ত পড়ছে৷ কে জানে খুন-টুন করে পালিয়ে এসেছে কি না৷ তারপর থানা-পুলিশ হয়ে একেবারে কেলেংকারি হবে৷’

রাহুল অবাক হয়ে বলল, ‘তা হলে কোকো এখন কোথায় যাবে, মাম? ওর তো কেউ নেই! ও মনে হয় ঘিয়ার জলে ভেসে এসেছে৷ বললাম তো, ভিজে জামাকাপড়ে একটা গাছের তলায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল…৷’

বাপি কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, ‘কাল থেকে সবাই তো ওর কথা জিগ্যেস করবে৷ তখন কী জবাব দেব?’

‘কেন বাপি, যা সত্যি তাই বলবে!’ রাহুল সঙ্গে-সঙ্গে সমাধান জুগিয়ে দিল, ‘কোকো আমাদের কাছে থাকলে তাতে কার কী!’

‘এভাবে বলতে নেই, রাহুল৷’ মাম ওকে শাসনের গলায় বললেন, ‘তা ছাড়া তুমি তো জানো, এখন চার-পাশে যা চলছে তাতে কোনও অচেনা লোককে এভাবে শেলটার দেওয়া ঠিক নয়৷ কে বলতে পারে যে, লোকটা চোর কিংবা ডাকাত নয়! কাল বরং থানায়…৷’

‘আমি…চোর…না৷ আমি…ভালো৷’

এ-কথা শুনে তিনজনেই চমকে ঘুরে তাকিয়েছে৷

কোকো বাইরের ঘর ছেড়ে কখন যেন ঢুকে পড়েছে ভেতরের ঘরে৷ তারপর ওর ভাঙা গলায় নিজের ক্যারেকটার সার্টিফিকেট নিজেই প্রচার করে চলেছে৷

‘বিশ্বাস…করো৷ আমি…চোর…না৷ আমি…খুব…ভালো৷’

ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া সরল ছেলেটার মুখে এ-কথা শুনে বাপি হেসে ফেললেন৷

রাহুল ছুটে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরে বলল, ‘কোকো, তুমি খুব ভালো৷ গুড বয়৷’

কোকো হাসল : ‘আমি…গুড…বয়৷ আমি…গুড…বয়৷’

মাম কোকোর দিকে চেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ কী করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না৷

রাহুল মামের কাছে এল আবার৷ মামের হাত ধরে আবদারের গলায় বলল, ‘মাম, ওকে শিগগির শুকনো জামাকাপড় দাও৷ ওর যে ঠান্ডা লেগে যাবে!’

মাম চমকে উঠে ঘোর কাটিয়ে জেগে উঠলেন৷

বাপিও বললেন, ‘রাহুল ঠিক বলেছে৷ ওকে আগে শুকনো জামা-প্যান্ট দাও৷ রাহুলেরটা ওর গায়ে হবে না—আমার একটা পাজামা আর শার্ট দাও৷ তারপর ওর কাটা জায়গাগুলোয় লাল ওষুধ আর ব্যান্ড-এইড লাগিয়ে দিচ্ছি৷’

রাহুল কৃতজ্ঞতার চোখে বাপির দিকে তাকাল৷

বাপি বললেন, ‘শোন, ওকে আগে ড্রেস-ট্রেস দিয়ে ট্রিটমেন্ট করে কিছু খাওয়াই৷ বোধহয় বেচারা অনেকক্ষণ না খেয়ে আছে৷ তারপর…৷’

রাহুল অবাক চোখে বাপির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘তারপর কী?’

‘তারপর ওকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে৷ ওর হিস্ট্রিটা জানার চেষ্টা করতে হবে, বুঝলি?’

রাহুল কী বুঝল কে জানে! কিন্তু ও আলতো করে ঘাড় নাড়ল৷

কোকো রাহুলের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি…গুড… গুড…বয়…৷ ভেরি…গুড…বয়৷’

রাহুল হেসে বলল, ‘ভেরি গুড বয়৷’

সেই ‘ভেরি গুড বয়’ এখন বাপির একটা নীল হাফশার্ট আর পাজামা পরে বাগানে প্রজাপতির পিছনে ছুটছে৷

বাপি কাল রাতেই কোকোর ‘হিস্ট্রি’ জানার চেষ্টা করেছেন৷ যেটা নিয়ে বাপির বিশেষ কৌতূহল ছিল সেটা নিয়েও ওকে প্রশ্ন করেছেন৷ সেই জিনিসটা নিয়ে মাম আর রাহুলেরও ভীষণ কৌতূহল ছিল৷ তাই রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে ওরা তিনজনে কোকোকে নিয়ে বসেছে৷

কোকো বসবার ঘরের একটা চেয়ারে হাঁটু মুড়ে বাবু হয়ে বসেছিল৷ ও আরামের শব্দ করে কয়েকবার ঢেঁকুর তুলল৷ রাহুল, বাপি আর মামের মুখের দিকে একবার করে তাকাল৷

রাহুলরা তিনজন কোকোকে প্রায় ঘিরে বসেছিল৷ ওকে কিছুক্ষণ লক্ষ করার পর বাপি জিগ্যেস করলেন, ‘কোকো, তোমার গলায় ওটা কীসের ব্যান্ড?’

কোকো কোনও জবাব দিল না৷ ওর ডানহাতটা গলার কাছে চলে গেল৷ স্টিলের ব্যান্ডটার ওপরে ও আঙুল বোলাতে লাগল৷

বাপি আবার জিগ্যেস করলেন, ‘ওটা কীসের বেল্ট, কোকো? বলো—কোনও ভয় নেই৷ তুমি তো গুড বয়৷’

অল্প হাসল কোকো৷ অস্পষ্টভাবে বলল, ‘আমি তো…গুড বয়৷’

এবার রাহুল ওকে জিগ্যেস করল, তোমার গলার এই ব্যান্ডটা কীসের, কোকো?’

কোকো তেরছা চোখে সিলিং-এর দিকে তাকাল৷ একমনে কী যেন ভাবার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ৷ তারপর হঠাৎ খুশির সুরে বলে উঠল, ‘মনে…পড়েছে৷ এটা কন্ট্রোল…ব্যান্ড৷ আমি..গুড…বয়৷’

কন্ট্রোল ব্যান্ড! কীসের কন্ট্রোল ব্যান্ড? রাহুল অবাক চোখে কোকোর গলার ব্যান্ডটার দিকে তাকিয়ে রইল৷

জিনিসটা চেহারায় অনেকটা ঘড়ির ব্যান্ডের মতো৷ তবে মসৃণ গোল নয়৷ চার জায়গায় কবজার জোড় রয়েছে৷ আর ব্যান্ডটার ডানদিকে—মানে, কোকোর বাঁ-কানের ঠিক নীচে—একটা চ্যাপটা চৌকোনা মেটাল বক্স লাগানো রয়েছে৷ বক্সটার মাপ অনেকটা দেশলাইয়ের বাক্সের মতো৷ তবে মাত্র পাঁচ কি ছ’মিলিমিটার পুরু৷ সেই বাক্সের ওপরে চারটে খুদে এল. ই. ডি. ল্যাম্প৷ এখন নিভে আছে৷

‘এই কন্ট্রোল ব্যান্ডটা তুমি কী জন্যে গলায় পরে আছ?’ রাহুল জিগ্যেস করল, ‘কে তোমার গলায় এটা পরিয়ে দিয়েছে?’

আবার চিন্তায় পড়ে গেল কোকো৷ কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বলল, ‘মনে পড়েছে৷ এটা মাস্টারজি…পরিয়ে…দিয়েছে৷ মাস্টারজি…দিয়েছে৷’

‘কে মাস্টারজি?’ মাম জিগ্যেস করলেন৷

কোকো একগাল হেসে বলল, ‘মাস্টারজি৷ মাস্টারজি৷’

বাপি আর রাহুলও বারকয়েক একই প্রশ্ন করল কিন্তু কোকোর সেই একই উত্তর৷

তখন বাপি জিগ্যেস করলেন, ‘এটা তুমি গলায় পরেছ কেন?’

কোকো দু-পাশে মাথা নাড়ল৷ ও জানে না৷

‘এটার নাম কন্ট্রোল ব্যান্ড কে বলল?’

‘মাস্টারজি—’

‘মাস্টারজির নাম কী?’

‘মাস্টারজি৷’

‘মাস্টারজি কোথায় থাকেন?’

‘অনেক…দূরে৷ অনেক…দূরে৷’

বাপি কী মনে করে কোকোর গলার ব্যান্ডটার দিকে হাত বাড়ালেন : ‘তোমার ব্যান্ডটা একটু দেখি তো…৷’

সঙ্গে-সঙ্গে সাপের ছোবল খাওয়া মানুষের মতো পিছনে ছিটকে গেল কোকো৷ ভয় পাওয়া চোখে বাপির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না…না৷ এটায়…কেউ…হাত দেবে না৷ মাস্টারজির বারণ৷’

‘মাস্টারজির বারণ’ শব্দ দুটো বারবার আওড়াতে লাগল কোকো৷ ঠিক যেন পুজোর মন্ত্র পড়ছে৷

বাপি, মাম, আর রাহুল চোখ চাওয়াচাওয়ি করল৷ মাম চাপা গলায় বাপিকে বললেন, ‘ছেড়ে দাও৷ মনে হয় ব্যান্ডটা নিয়ে ওর কোনও মেন্টাল প্রবলেম আছে৷ পরে কখনও সুযোগ পেলে ওটা দেখো…৷’

বাপি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে সায় দিয়ে মাথা নাড়লেন৷

রাহুল কোকোর হাত-পায়ে লাগানো ব্যান্ড-এইডগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘তোমার হাতে-পায়ে কেটে গেল কী করে?’

রাহুলের কথায় আবার সোজা হয়ে বসল কোকো৷ পায়ের ভাঁজ খুলে মেঝের দিকে পা ঝুলিয়ে দিল৷ তারপর অবাক হয়ে নিজের হাতে আর পায়ে লাগানো ব্যান্ড-এইডগুলোর দিকে দেখল, সেগুলোর ওপরে আঙুল বোলাল৷ কিন্তু কোনও উত্তর দিল না৷

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রাহুল আবার একই প্রশ্ন করল৷

রাহুলের দিকে সরল চোখে তাকাল কোকো৷ ধীরে-ধীরে বলল, ‘মাস্টারজি মেরেছে৷ খুব…মেরেছে৷’

রাহুলের মনে কষ্ট হল৷ ও মাম আর বাপির দিকে তাকাল৷

মাম বললেন, ‘আহা রে, এভাবে কেউ মারে?’

বাপি বিড়বিড় করে বললেন, ‘ব্যাপারটা আমার তো খুব মিস্টিরিয়াস লাগছে৷ যাকে ও ‘‘মাস্টারজি’’ বলছে সে কোথাকার মাস্টার? স্কুল- কলেজের, না অন্য কিছুর?’

রাহুল এবার কোকোর গালের চাকা-চাকা দাগগুলোর দিকে দেখাল৷ আঙুল বাড়িয়ে একটা দাগ সামান্য ছুঁতেই কোকো ‘উঃ!’ করে উঠল৷

‘কোকো, এই দাগগুলো কী করে হয়েছে? এখানে ব্যথা নাকি?’

কোকো নিষ্পাপ সরল চোখে কয়েক মুহূর্ত রাহুলের দিকে তাকিয়ে রইল৷ তারপর কী বুঝল কে জানে! আলতো করে বলল, মাস্টারজি৷ সিগারেট খায়৷ সিগারেটের ডগায়…আগুন থাকে৷ সেই আগুন দিয়ে…ছ্যাঁকা দিয়েছে৷ ছ্যাঁকা৷ তিনবার৷ আরও দিত৷ আমি…আমি…৷’

‘‘‘আমি’’ কী?’ রাহুল ওকে কথা ধরিয়ে দিতে চাইল৷

‘আমি কেউ না৷ আমার…কেউ…নেই৷ মা…নেই৷ বাবা…নেই৷’

কোকো হঠাৎই কেমন উত্তেজিত হয়ে পড়ল৷ বড়-বড় শ্বাস ফেলতে লাগল৷

সেটা লক্ষ করে বাপি বললেন, ‘রাহুল, ওকে এবার রেস্ট নিতে দাও৷ আমার মনে হচ্ছে, ও বেশ ট্রাবলড৷ মেন্টালি আপসেট হয়ে আছে৷ তা ছাড়া ওর বুদ্ধির ব্যাপারটাও বোধহয় স্বাভাবিক নয়৷’

মাম বাপিকে বললেন, ‘ও ক’টা-দিন আমাদের কাছে থাকুক৷ একটু সেরে-টেরে উঠুক—তারপর পুলিশে খবর দিয়ে ওর বাড়ির খোঁজখবর করা যাবে৷ এখন ওকে থানা-পুলিশে দিলে ওকে পাগলদের হোমে পাঠিয়ে দেবে৷’

‘না, না, ওখানে কিছুতেই ওকে পাঠিয়ো না, বাপি!’ রাহুল প্রায় অনুনয়ের সুরে বলল৷

খবরের কাগজ আর টিভি দেখে রাহুল জানে ওই সব সরকারি হোমে আবাসিকদের কী দুরবস্থার মধ্যে রাখা হয়৷ কেউ চরম হেনস্থা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে, আর কেউ-বা ওই হোম থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়৷

বাপি রাহুলের পিঠে আশ্বাসের হাত রেখে বললেন, ‘তুই কি খেপেছিস? ওকে ওই নরকে পাঠাব! ওর বাড়ি আর রিলেটিভদের ঠিকঠাক খবর না পাওয়া পর্যন্ত কোকোকে আমরা ছাড়ছি না৷’

রাহুল বাপির হাতটা জড়িয়ে ধরল৷ ভাবল মনে-মনে, বাপি কী ভালো!

কোকো ধীরে-ধীরে শান্ত হয়ে আসছিল৷ রাহুল ওর দিকে লক্ষ রাখছিল৷ দেখল, ওর শ্বাস-প্রশ্বাস আবার স্বাভাবিক হয়ে আসছে৷ মুখটা যেন চার-পাঁচ বছরের কোনও শিশুর মুখ৷ সেই ফরসা টুকটুকে মুখে সিগারেটের ছ্যাঁকা! মাস্টারজির কাছে কী অন্যায় করেছিল কোকো যে ওকে এমন করে নৃশংসভাবে শাস্তি দিয়েছে? রাহুলের টিচাররা তো রাহুলকে কত ভালোবাসেন৷ ওঁদের সঙ্গে থাকতে রাহুলের কত ভালো লাগে!

কোকো হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমি টিভি দেখব৷’

এ-কথায় বাপি আর মাম হেসে উঠলেন৷ বাপি বললেন, ‘হ্যাঁ, ওকে এবার ছেড়ে দাও৷ একটু টিভি-ঠিভি দেখুক—রিল্যাক্স করুক৷ রাহুল—’ রাহুলের কাঁধে হাত রাখলেন বাপি : ‘ওকে নিয়ে টিভি দ্যাখো৷ ওর সঙ্গে থাকো৷ তবে বেশি রাত কোরো না…৷’

কাল রাতে কোকোর সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেছে রাহুল৷ ওর সঙ্গে টিভি দেখেছে৷ তারপর কয়েকটা রঙিন কমিকস-এর বই ওকে দেখতে দিয়েছে৷ শেষে ক্লান্ত হয়ে কোকো যখন হাই তুলছিল তখন ওরা শুয়ে পড়েছে৷

রাহুলের ঘরেই মাম কোকোর জন্য বিছানা পেতে দিয়েছিল৷ সেখানে গা এলিয়ে দেওয়ামাত্রই কোকো নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ অথচ কোকোর কথা ভেবে-ভেবে রাহুলের ঘুম এসেছে অনেক দেরিতে৷

এখন সেই শিশু-যুবক একগাল খুশি নিয়ে হলদে-কালো প্রজাপতির পিছনে নেচে-নেচে ছুটে বেড়াচ্ছে৷

রাহুলকে কাছে আসতে দেখে কোকো আবার বলে উঠল, ‘রাহুল, এই দ্যাখো…প্রজাপতি৷ প্রজা…পতি৷’

রাহুল হেসে ঘাড় নাড়ল, বলল, ‘হ্যাঁ, প্রজাপতি৷ প্রজাপতি…সুন্দর৷’

‘প্রজাপতি…সুন্দর৷’ রাহুলের কথার প্রতিধ্বনি তুলল কোকো৷

৷৷তিন৷৷

বাজারের থলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় বাপি রাহুলকে ডাকলেন৷

রাহুল ওর ঘরে কোকোকে নিয়ে বসেছিল৷ ওর বইপত্র, ক্রিকেটের ব্যাট-বল, এটা-সেটা কোকোকে দেখাচ্ছিল৷ সেই সময় বাপি দরজায় এসে হাজির হলেন৷

‘কী রে, রাহুল—আমার সঙ্গে বাজারে যাবি তো!’

প্রত্যেক রবিবারে রাহুল বাপির সঙ্গে বাজারে যায়৷ এমনিতে বাপির সঙ্গে ঘুরে-ঘুরে বাজার করতে রাহুলের ভালো লাগে৷ তা ছাড়া রবিবারে বাপি একটু বেশি করে বাজার করেন—যাতে পরের তিনদিন বাজারে না গেলেও চলে৷ সেইজন্য রবিবারে বাপি তিনটে থলে নিয়ে বেরোন৷ ফেরার সময় থলেগুলো বেশ ভারীও হয়৷ রাহুল সঙ্গে থাকলে সবচেয়ে কম ওজনের থলেটা বয়ে বাপিকে সাহায্য করে৷

রাহুল কোকোকে ছেড়ে চটপট উঠে পড়ল৷ হাতে তালি দিয়ে হাত ঝেড়ে নিয়ে বলল, ‘চলো, বাপি—’ দরজার দিকে এগোতে-এগোতে কোকোকে লক্ষ করে বলল, ‘কোকো, তুমি এগুলো নিয়ে খেলা করো, আমি বাপির সঙ্গে বাজার করে এক্ষুনি ফিরে আসছি৷’

কোকো কিন্তু ততক্ষণে মেঝে থেকে উঠে পড়েছে৷ রাহুলের দিকে তাকিয়ে কাতর গলায় বলে উঠেছে, ‘আমিও তোমার সঙ্গে যাব৷’

কোকো ওদের সঙ্গে গেলে রাস্তায় পাঁচজন পাঁচকথা জিগ্যেস করবে৷ সে-কথা ভেবেই রাহুল সাততাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, কোকো—এরকম জেদ করতে নেই৷ তুমি না গুড বয়?’

‘আমি…গুড…বয়৷ কিন্তু তোমাদের সঙ্গে…বাজারে…যাব৷’ গোমড়া মুখ করে কোকো বলে উঠল৷

বাপি এবার বললেন, ‘না, কোকো৷ গুড বয়রা কথা শোনে৷ তুমি এখানে থাকো—খেলা করো—আমরা এক্ষুনি ফিরে আসব৷’

কোকো পাঁচ বছরের বাচ্চার মতো অভিমানী মুখ করে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘আমি…বাজারে…যাব৷ আমি…বাজারে…যাব…৷’

রাহুলের মাথায় হঠাৎই একটা বুদ্ধি খেলে গেল৷ শেষ অস্ত্র হিসেবে সেটা প্রয়োগ করল ও৷

‘তোমার তো চটি-জুতো কিচ্ছু নেই—আমাদের সঙ্গে তুমি যাবে কেমন করে! বাজারে ভীষণ জল-কাদা…৷’

এ-কথা শোনামাত্রই কোকোর মুখে হাসি ফুটে উঠল৷ ও রাহুল আর রাহুলের বাপিকে অবাক করে দিয়ে ‘চটি…আছে! চটি…আছে!’ বলে গ্রিল দেওয়া বারান্দার দিকে ছুট লাগাল৷

রাহুল আর বাপিও ওর পিছন-পিছন এগোল৷

গ্রিল ঘেরা বারান্দার একপাশে রাহুলদের সবার চটি-জুতো থাকে৷ সেটা গতকালই বোধহয় কোকোর নজরে পড়েছে৷ রাহুলরা যখন বারান্দায় এসে পৌঁছল ততক্ষণে রাহুলের মায়ের একজোড়া চটি পায়ে দিয়ে কোকো একেবারে বাউন্ডারির গেটে পৌঁছে গেছে৷ সেখান থেকে কোকো দু-হাতে হাতছানি দিয়ে রাহুলকে ডাকছে : ‘এই তো চটি পরেছি! রাহুল, তাড়াতাড়ি এসো…তাড়াতাড়ি…৷ আমি… বাজারে…যাব৷ বাজারে…৷’

ওর কাণ্ড দেখে রাহুল হেসে ফেলল৷ বাপিও আর হাসি চেপে রাখতে পারলেন না৷ রাহুলের মা কখন যেন রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন৷ কোকোর কাণ্ড দেখে হেসে বললেন, ‘ওইটুকু বাচ্চা! ও কখনও বোঝে কোন চটিটা ছেলেদের আর কোনটা মেয়েদের!’

‘ওইটুকু বাচ্চা!’ বাপি অবাক হয়ে মামের দিকে তাকালেন : ‘কী বলছ তুমি? ওর বয়েস কম করেও পঁচিশ কি ছাবিবশ হবে৷’

মাম কেমন একটা অদ্ভুত গলায় বললেন, ‘সে হোক গে৷ ক্যালেন্ডার দিয়ে কি সবসময় বয়েস মাপা যায় নাকি! ও আসলে একটা বাচ্চা ছেলে…৷’

তো সেই পঁচিশ-ছাবিবশ বছরের ‘বাচ্চা’ ছেলেটা রাহুল আর বাপির সঙ্গে বাজারের পথ ধরল৷ রাহুল লক্ষ করল, চলার পথে কোকো অবাক হয়ে সব কিছু দেখছে৷ যেন ও সদ্য পৃথিবীতে এসে একের পর এক নতুন আবিষ্কার করে চলেছে৷ চকচকে উদগ্রীব চোখে ও দেখছে আকাশ, সূর্য, গাছপালা, ফুল, পাখি, সাইকেল রিকশা, গোরুর গাড়ি, সাইকেল, মোটরবাইক, ভ্যান-রিকশা, টালির দোচালা-চারচালা ঘর, জল-কাদা, ঘাস, মানুষজন—আরও কত কী!

কোকোর চোখের দিকে তাকিয়ে রাহুলের মনে অনেক প্রশ্ন জাগছিল৷ মাস্টারজি, সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ, হাত-পায়ের ক্ষতচিহ্ন, কন্ট্রোল ব্যান্ড, ঘিয়া নদীর জলে ভেসে আসা একটা মানুষ…আরও কত বিষয় ঘিরে প্রশ্নের পর প্রশ্ন৷ আবার একইসঙ্গে মনে পড়ছিল গতকালের সেই হাহাকার : ‘আমার…কেউ…নেই৷ মা…নেই৷ বাবা…নেই৷’ শিশু-যুবকটির তখনকার সর্বহারা অসহায় মুখের কথা মনে করে রাহুলের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল৷ ও তাকাল কোকোর দিকে৷ ওর মুখে এখন নতুন পৃথিবীর নতুন-নতুন জিনিস আবিষ্কারের আনন্দ৷

বাজারে পৌঁছে অন্যান্য রবিবারের মতো বাপি প্রথমে আনাজপাতি কিনতে শুরু করলেন৷ সরু-সরু বাঁশের ডগায় পলিথিনের ছাউনি খাটিয়ে দোকানিরা বসেছে৷ কেউ রাস্তার ধারে, কেউ-বা রাস্তার লাগোয়া মাঠে৷ চারদিকের নানারকম শব্দ বলে দিচ্ছিল এটা একটা ব্যস্ত জায়গা৷ লোকজনের কথাবার্তা, সাইকেলের ঘণ্টি, ভ্যান-রিকশার প্যাঁক-প্যাঁক, মোটরবাইকের আওয়াজ—কতরকমের শব্দ! তিন-চাররকম সবজি কেনা হতেই কোকো জেদ করে, বায়না করে, সেই থলেটা বাপির হাত থেকে নিয়ে নিল৷ বলল, বাজারের একটা থলে ও বইবে, কারণ, ওর গায়ে জোর আছে৷

এ-কথায় রাহুল যখন হেসে বলেছে, ‘তোমার গায়ে জোর আছে মানে?’

তখন কোকো জবাব দিয়েছে, ‘মাস্টারজি বলে৷ আমার…গায়ে খুব…জোর৷’

রাহুল তখন অবাক হয়ে কোকোর দিকে তাকিয়েছে শুধু—কোনও কথা বলেনি৷

ঘুরে-ঘুরে বাজার করার কাজ শেষ হল একসময়৷ বাপি, রাহুল আর কোকো বাড়ির পথ ধরল৷ অন্যান্য রবিবার রাহুল আর বাপি সাইকেল-রিকশায় ফেরেন৷ কিন্তু আজ কোকো সঙ্গে আছে—রিকশায় তিনজন আঁটবে না৷ তার ওপর তিন-তিনটে থলে৷

ফেরার পথে রাহুল আর কোকো গল্প করছিল৷ রাহুল বলছিল, কোকো অবাক হয়ে শুনছিল৷ আর মাঝে-মাঝে চারপাশটা দেখছিল৷

হঠাৎই দূরে একটা গোরুর গাড়ি দেখতে পেল রাহুল৷ অনেকগুলো বস্তা বোঝাই করে ধীরে-ধীরে এগিয়ে আসছে৷ রাস্তার খানাখন্দে পড়ে চাকাগুলো একবার ডানদিকে একবার বাঁ-দিকে হেলে যাচ্ছে৷

রাহুল আঙুল তুলে গোরুর গাড়িটা কোকোকে দেখাল, বলল, ‘ওই দ্যাখো, গোরুর গাড়ি…৷’

‘আমি…আগে…গোরুর গাড়ি…দেখেছি৷’ স্মৃতি খুঁজে পাওয়ার আনন্দে কোকোর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷

বাপি আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন৷ নীল আকাশে ছোট-ছোট মেঘ ভেসে আসছে সূর্যের কাছাকাছি৷ কয়েকটা লম্বা-লম্বা গাছ মাথা তুলে রয়েছে আকাশের দিকে৷ বাতাসে অল্প-অল্প নড়ছে৷

বাপি মুগ্ধ চোখে আকাশটাকে দেখছিলেন৷ রাহুল বুঝতে পারছিল বাপির এখনই রং-তুলি নিয়ে বসে পড়তে ইচ্ছে করছে৷ ছবি আঁকা বাপির একমাত্র শখ৷ সময় পেলেই জল রং আর তুলি নিয়ে বসে পড়েন৷ মাঠ, ঘাট, নদী, গাছপালা আঁকেন৷ বাপির কাছে রাহুল শুনেছে, এ ধরনের ছবিকে ল্যান্ডস্কেপ বলে৷

রাহুল একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল৷ হঠাৎই লোকজনের হইচই চিৎকারে ও চমকে উঠল৷ আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল সামনের দিকে৷

গোরুর গাড়িটার একটা চাকা আচমকা ভেঙে কাত হয়ে গেছে৷ ফলে বস্তা-বোঝাই গাড়িটা হেলে পড়েছে রাস্তার ধারের নালার দিকে৷ কয়েকটা বস্তা ধীরে-ধীরে গড়িয়ে পড়ছে নালার গর্তে৷ মাথায় গামছা জড়ানো গাড়োয়ান হাতের ছিপটি ছুড়ে ফেলে লাফ দিয়েছে রাস্তায়৷ বলদ দুটো ঘাড় কাত করে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে৷

লোকজন ছুটে যাচ্ছিল বিপজ্জনক-ভাবে হেলে পড়া গাড়িটার দিকে৷ মনে হচ্ছিল, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গোরুর গাড়িটা বস্তাসমেত নালায় গড়িয়ে পড়বে৷ গতকালের বৃষ্টির জল নালায় জমে আছে৷ এর মধ্যেই গড়িয়ে পড়া তিনটে বস্তা জলে ভিজে একসা৷ ভেজা বস্তা দেখে রাহুল বুঝল, বস্তায় আলু আছে৷

হাতের থলেটা রাস্তায় নামিয়ে রেখে কোকো কখন যেন ছুট লাগিয়েছিল৷

রাহুল পিছন থেকে ‘কোকো! কোকো!’ বলে চিৎকার করে ওকে ডাকতে লাগল৷ কিন্তু ছেলেটা শুনলে তো!

রাহুল দেখল, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কোকো হেলে পড়া গোরুর গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল৷ ঝুঁকে পড়ে গাড়িটার লম্বা বাঁশের কাঠামোর নীচে কাঁধ লাগিয়ে প্রাণপণে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল৷ ওর ফরসা মুখ লাল হয়ে গেল, চোখ-মুখ বিকৃত হয়ে গেল৷ মরিয়া হয়ে ও হেলে পড়া গাড়িটাকে চাগিয়ে তুলতে লাগল৷

রাস্তার একপাশে বাজারের থলে নামিয়ে রেখে বাপির দিকে একবার তাকিয়েই রাহুল ছুটতে শুরু করেছিল৷ ও যখন গোরুর গাড়িটার কাছে এসে পৌঁছল তখন গাড়ির হেলে পড়া দিকটা অনেকটা সোজা হয়ে গেছে৷ কোকোর হাতের শিরা ফুলে উঠেছে, গলার শিরা ফুলে উঠেছে৷ ও দম বন্ধ করে অবাক করা শক্তিতে গাড়িটাকে ঠেলে তুলে একটু-একটু করে সোজা করছে৷

ততক্ষণে রাস্তায় ভিড় জমে গেছে৷ লোকজন হইহই চিৎকার করে কোকোর এই অলৌকিক কাণ্ড দেখছে৷ বলদ দুটোর ঘাড়ের যন্ত্রণা কমে যাওয়ায় ওরা চিৎকার বন্ধ করেছে৷

ভিড়ের মধ্যে কে একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘সবাই কাঁধ লাগাও, ভাই—এসো!’

সঙ্গে-সঙ্গে শোরগোল উঠল৷ পাঁচ-ছ’জন মানুষ ছুটে গিয়ে কোকোর পাশাপাশি কাঁধ লাগাল৷ আওয়াজ তুলল, ‘মারো জোয়ান হেঁইয়ো…৷’

গাড়ির বিশাল চাকাটা নালার ঢালে কাত হয়ে পড়েছিল৷ কয়েকজন সেটা তুলে এনে গাড়ির পাশ থেকে বেরিয়ে থাকা রডে লাগিয়ে দিল৷ গোরুর গাড়িটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ওটার চাকার হুড়কোটা ভেঙে গিয়েছিল৷ তাই নতুন একটা লোহার হুড়কো জোগাড় করতে দুজন সাইকেল চেপে রওনা হয়ে গেল৷

কোকো গাড়িটা ছেড়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়েছিল৷ হাঁপাচ্ছিল আর গাড়িটার দিকে তাকিয়ে দু-হাত জামায় ঘষে-ঘষে মুছছিল৷

রাহুল চেঁচিয়ে ওকে ডাকল, ‘কোকো…এদিকে এসো…৷’

কোকো ফিরে তাকাল৷ রাহুলকে দেখতে পেল৷ হেসে হাত নাড়ল৷ তারপর রাহুলের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল৷

কিন্তু ও আসবে কী! লোকজন ওকে ঘিরে ধরে সাবাশ দিতে লাগল৷

‘বাব্বাঃ, তোমার গায়ে তো হেভি জোর!’

‘তুমি কে হে? তোমার নাম কী? তোমাকে তো এ এলাকায় আগে দেখিনি! তবে হ্যাঁ, তোমার হিম্মত আছে বটে!’

‘সাবাশ, ভাই! একটা দারুণ জিনিস দেখালে৷’

‘ওকে একটা প্রাইজ দেওয়া উচিত৷’

‘তোমার গলায় ওটা কী বলো তো? এরকম পিকিউলিয়ার হার তো আগে দেখিনি…৷’

রাহুল তাড়াতাড়ি জটলার মধ্যে ঢুকে পড়ে কোকোর হাত ধরল৷ ওকে টেনে নিয়ে এল বাইরে৷ জনতার মধ্যে থেকে উৎসাহী কয়েকজন হাত বাড়িয়ে কোকোর পিঠ চাপড়ে দিল৷

বাপি তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ওদের কাছাকাছি এসে পড়েছিলেন৷ রাহুলকে বললেন, ‘শিগগির বাজারের থলে দুটো তুলে নিয়ে চল৷ এক্ষুনি নানানজন এসে কোকোকে নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন করবে…তখন মুশকিল হবে…৷’

রাহুল আর কোকো চটপট ওদের থলে দুটো তুলে নিয়ে এল৷ তারপর ওরা তিনজনে জলদি পায়ে হাঁটা লাগাল বাড়ির দিকে৷

কিন্তু নিরাপদে বাড়ি পৌঁছনো হল না৷

গোরুর গাড়ির ঘটনার জায়গা ছেড়ে বিশ-পঁচিশ পা যেতে না যেতেই রথপতি গুপ্তর সঙ্গে দেখা৷ ভদ্রলোক একসময়ে পঞ্চায়েতের সদস্য ছিলেন৷ এখন আর নেই৷ রেডিমেড জামা-কাপড়ের ব্যবসা করেন৷ কলকাতার কয়েকটা নামী দোকানে ছেলেমেয়েদের শৌখিন পোশাক সাপ্লাই করেন৷

রাহুলের বাপির সঙ্গে রথপতির বেশ ভালোই আলাপ৷ ভদ্রলোক সবসময় পাড়াপড়শির হাঁড়ির খবরের খোঁজ করে বেড়ান৷ সেটা বিরক্তিকর হলেও লোকজনের সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়ান৷ বিপদে আন্তরিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন৷

রাহুলের বাপির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন রথপতি৷ হেসে জিগ্যেস করলেন, ‘কেমন আছেন, কল্যাণবাবু?’

‘ভালো৷ আপনি কেমন আছেন?’

‘চলে যাচ্ছে আর কী!’ কোকোর দিকে তাকালেন রথপতি৷ আঙুল নেড়ে বললেন, ‘এই ছেলেটির জন্যে আজ গর্বে বুক ফুলে উঠছে৷ আমি ওই রিকশা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সব দেখেছি৷ ওর সাহস আর শক্তির প্রশংসা করতে হয়৷ পরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া একটা বিশাল গুণ৷ কী নাম তোমার?’

কোকো কর্কশ গলায় বলল, ‘কোকো…৷’

‘সাবাশ, কোকো!’ কোকোর পিঠ চাপড়ে দিলেন রথপতি৷ তারপর চোখ সরু করে কল্যাণবাবুর দিকে তাকালেন : ‘কোকো আপনার কে হয়? ওকে তো আগে কখনও মণিমেলায়…মানে, আমাদের এ-গাঁয়ে দেখিনি—৷’

কল্যাণবাবু উত্তর দিতে একটুও দেরি করলেন না৷ গতকাল রাতে ভেবে-ভেবে তিনি গল্পটা তৈরি করে নিয়েছেন৷

‘ও আমার পিসতুতো দাদার ছেলে—শ্রীরামপুরে থাকে৷ ওর একটু সাইকিয়াট্রিক প্রবলেম আছে৷ ওখানে ডক্টরের ট্রিটমেন্টে আছে৷ তিনিই বলেছেন, কিছুদিন গ্রামের হাওয়া খেয়ে আসতে৷ মানে, গাছপালা মাঠঘাটের কাছাকাছি থাকলে ওর প্রবলেমটা তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে…৷’

‘কী প্রবলেম ওর?’

এতটা খোঁচানো কোশ্চেন রাহুলের বাপি আশা করেননি৷ তাই একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘এই…মানে…ওর মধ্যে একটা বাচ্চা-বাচ্চা ভাব আছে৷ যদিও ওর বয়েস প্রায় সাতাশ৷ তা ছাড়া গলাটা কেমন হোর্স… ধীরে-ধীরে কথা বলে…৷’

রথপতি গুপ্ত ভুরু কোঁচকালেন৷ আজব প্রাণী দেখার দৃষ্টিতে কোকোর দিকে তাকালেন : ‘ওর গলার ওই লোহার বালাটা কীসের?’

কল্যাণবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘ওটা একটা মেডিক্যাল ইলেকট্রনিক ব্যান্ড৷ ট্রিটমেন্টের জন্যে ওর ডক্টর দিয়েছেন৷’

‘বাব্বা! এসব তো বাপের জন্মে কখনও দেখিনি৷ এ আবার কী ধরনের রোগ?’

‘অ্যাকিউট মালটিপল সাইকো-প্যাথলজিক্যাল চাইল্ড সিনড্রোম৷ মানে, ওর সাইকিয়াট্রিস্ট তাই বলেছেন…৷’

এত লম্বা-চওড়া নামে রথপতি বেশ ঘাবড়ে গেলেন৷ আর কোনও প্রশ্ন করলেন না৷

কল্যাণ জানতেন যে, রথপতি বেশিদূর লেখাপড়া শেখেননি৷ তাই ওঁর অন্তর-খোঁচানো প্রশ্নমালা ঠেকানোর জন্য যা পেরেছেন বানিয়ে একটা খটমট রোগের নাম বলে দিয়েছেন৷ এ-নামে সত্যিই কোনও রোগ হয় কি না তিনি জানেন না৷

‘ও, আচ্ছা৷ তা ও তাড়াতাড়ি সেরে উঠুক৷’ আবার কোকোর পিঠ চাপড়ে দিলেন রথপতি : ‘তুমি বড় ভালো ছেলে, বাবা৷ তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো৷’

সামান্য হেসে রথপতি গুপ্ত চলে গেলেন৷

রাহুল বলল, ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো, বাপি৷ নইলে কোকোকে নিয়ে আরও সবাই প্রশ্ন করবে৷’

বাপি ‘হ্যাঁ—চল৷’ বলে তাড়াতাড়ি পা চালালেন বটে, কিন্তু ওঁর মনে উদ্বেগ থেকেই গেল৷

বাজারে কয়েকজন কোকোর কথা জিগ্যেস করেছে৷ তখন মোটামুটি এরকম সাফাই দিয়েই ম্যানেজ করেছেন কল্যাণ৷ কিন্তু ভেতরে-ভেতরে তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন, এই উত্তরে বেশিদিন চলবে না, কারণ, কোকোকে যে ঘিয়া নদীর পাড়ে পাওয়া গেছে এ-কথা আজ নয় কাল জানাজানি হবেই৷ তখন কী হবে?

বাপি আর ভাবতে পারছিলেন না৷ আনমনা ভাবে পা ফেলতে লাগলেন৷

রাহুল আর কোকো পাশাপাশি হাঁটছিল৷ কোকো হঠাৎই রাহুলকে লক্ষ করে বলল, ‘রাহুল আমার অ্যাকিউট…চাইল্ড হয়েছে৷ আমার সাইকিয়া…বলেছে৷’

ওর দিকে তাকিয়ে রাহুল আর বাপি দুজনেই হেসে ফেললেন৷

কোকো বাঁ-হাতটা পেটে দিয়ে বলল, ‘আমার খিদে পেয়েছে…৷’

‘হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি চলো, বাড়ি গিয়ে খাবে৷’ রাহুল বলল৷

কোকো খুশিতে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল : ‘কী মজা! আমি…বাড়ি…গিয়ে খাব…খাব৷’

৷৷চার৷৷

কোকোকে নিয়ে ভীষণ মুশকিলে পড়ে গেল রাহুল৷ ও কিছুতেই রাহুলকে কাছ-ছাড়া করতে চায় না৷ সোমবার রাহুল স্কুলে যাওয়া শুরু করতেই কোকোরও বায়না শুরু হয়ে গেল : ‘আমি রাহুলের সঙ্গে যাব৷ আমি…যাব৷’

শেষ পর্যন্ত ব্যাপার এমন দাঁড়াল যে, কোকো বাচ্চা ছেলের মতো কান্নাকাটি দাপাদাপি শুরু করে দিল৷

বাপি আগেই অফিসে বেরিয়ে গিয়েছিলেন৷ বেগতিক দেখে রাহুলের মা কল্যাণবাবুকে ফোন করলেন৷

সব শুনে বাপি বললেন, ‘ঠিক আছে, বায়না করছে যখন তুমি আর ও রাহুলের সঙ্গে যাও৷ রাহুলকে স্কুলে দিয়ে তোমরা আবার ফিরে এসো৷ কোকো তো আসলে বাচ্চা ছেলে৷ শুধু দেখতেই যা বড়সড়৷ ও কি অত বোঝে?’

অগত্যা তাই হল৷ মাম, কোকো আর রাহুল স্কুলের পথ ধরল৷

স্কুল বেশি দূরে নয়৷ হাঁটা পথে স্কুলে যেতে-যেতে রাহুল কোকোকে অনেক গল্প বলছিল৷ স্কুলের গল্প, ফুটবল খেলার গল্প, গাঁয়ের মেলার গল্প, দুর্গাপুজোর সময় যে বিশাল উৎসব হয় তার গল্প৷

কোকোর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ও অন্য কোনও গ্রহের প্রাণী৷ এসব ব্যাপার যেন ও প্রথম জানছে রাহুলের কাছে৷

রাহুলকে স্কুলে দিয়ে মাম কোকোকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন৷ কোকো বারবার জিগ্যেস করতে লাগল, রাহুল কখন ফিরবে৷ মাম ওকে কোনওরকমে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করলেন৷

কোকো কিন্তু বাড়িতে বসে-বসে সময় কাটাল না৷ রাহুলের মা-কে সাহায্য করার জন্য পাগল হয়ে উঠল৷ মামের কোনও বারণ শুনল না৷

টিউবওয়েল পাম্প করে-করে ও বালতি-বালতি জলের জোগান দিতে লাগল৷ কাচা জামাকাপড় দড়িতে ছড়াতে লাগল৷ ঘরোয়া ফাইফরমাশ খাটতে লাগল৷ এ ছাড়া বাকি সময়টা কোকো বাগানে ঘুরে কাটাল৷ কখনও ফুল দেখতে লাগল, আবার কখনও পাখির খোঁজে হাঁ করে গাছের ঘন পাতার দিকে চেয়ে রইল৷ বিকেলের দিকে ও বাগানের একপাশে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম সেরে নিল৷

রাহুলের মা কোকোর ‘কীর্তি’ দেখছিলেন৷

দেখছিলেন কত সহজে আর কত তাড়াতাড়ি ও টিউবওয়েল পাম্প করে জল তুলছে৷ ওর সহজ ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন ও একটা খেলনা টিউবওয়েল পাম্প করছে৷ এ ছাড়া ঘরের ভেতর থেকে কোকোর ব্যায়ামও দেখছিলেন৷ জামা খুলে খালি গায়ে ও দাঁড়িয়ে ছিল৷ তারিফ করার মতো ঝকঝকে স্বাস্থ্য—সিনেমায় যেমন দেখা যায়৷ শুধু ফরসা বুকে কয়েকটা সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ৷ মাম বুঝলেন, মাস্টারজি মানুষটি এই ভোলাভালা শিশু-যুবকের ওপরে কম অত্যাচার করেননি!

কোকো প্রথমে খালি হাতে ব্যায়াম শুরু করল৷ ডন-বৈঠক ইত্যাদি শেষ করার পর ও বাগানের পাঁচিলের পাশ থেকে শ্যাওলা পড়া দুটো থান ইট তুলে নিল৷ সেগুলোকে ডাম্বেলের মতো ব্যবহার করে ও আবার শরীরচর্চা শুরু করল৷ ওর সারা গা ঘেমে উঠল, শরীরটা চকচক করতে লাগল৷

রাহুল স্কুল থেকে ফেরার পর কোকো আবার ওর ল্যাংবোট হয়ে ঘুরতে শুরু করল৷ ওর সঙ্গে খেলার মাঠে গেল৷ তারপর ওর সঙ্গে পড়তে বসে গেল৷ রাহুল একটা খাতা দিয়ে ওকে ‘অ-আ-ক-খ’ লিখতে বলল৷ কোকো অনভ্যস্ত হাতে আঁকাবাঁকা রেখায় বর্ণগুলো লিখে চলল৷

কয়েকদিনের মধ্যেই কোকো রাহুলের স্কুল ভালোমতন চিনে নিল৷ এখন আর মামকে ওর সঙ্গে যেতে হয় না৷ কোকো যদি সুস্থ স্বাভাবিক হত তা হলে বলা যেত ও-ই রাহুলকে স্কুলে দিয়ে আসে, আবার ছুটির সময় নিয়ে আসে৷ রাহুলের সঙ্গে মাঠে ফুটবল খেলতে যায়, তারপর সন্ধেবেলা পড়তে বসে৷ ‘অ-আ-ক-খ’, ‘এ-বি-সি-ডি’ কিংবা ‘১ থেকে ১০০’ লিখতে শেখে৷ ওর লেখাপড়ার ধরন দেখে বোঝা যায়, কোকো কয়েক বছর স্কুলে গিয়েছিল৷ তারপর কোনও কারণে ওর পড়াশোনা থেমে যায়৷

কখনও-কখনও কোকো রাহুলের বাপি কিংবা মামের কাছেও পড়তে বসে৷ আবার বাপি যখন জল রং সাজিয়ে নিয়ে ছবি আঁকতে বসেন তখন কোকো বাপির পাশে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে৷ মুগ্ধ হয়ে ছবি আঁকা দ্যাখে৷

একদিন ছবি আঁকতে-আঁকতে বাপি ওকে জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি ছোটবেলায় ছবি আঁকতে?’

‘না…আমি…আঁকতাম না৷’

তুলি হাতে নিয়ে হ্যান্ডমেড পেপারে হালকা নীলের ওয়াশ টেনে বাপি বললেন, ‘তুমি ছবি ভালোবাসো?’

‘হ্যাঁ৷’ ঘাড় কাত করে কোকো বলল৷

‘তুমি ছবি আঁকা শিখবে?’

আবার ঘাড় কাত করল কোকো৷ হ্যাঁ, ও ছবি আঁকা শিখবে৷

‘গুড বয়৷ কাল থেকে তোমাকে আমি আঁকা শেখাব৷’

‘আমার…মা…আমাকে ছবি আঁকা…শেখাত৷ মা খুব সুন্দর ছবি…আঁকত৷ মা…আর…নেই৷’

বাপি অবাক হয়ে দেখলেন কোকোর চোখে জল৷

ওকে কাছে টেনে নিলেন কল্যাণবাবু৷ গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তোমার মা-কে মনে আছে?’

কোকো বিহ্বলভাবে মাথা নাড়ল৷ বলল, ‘না…মনে নেই৷ শুধু ছবি আঁকা…মনে আছে৷’

তারপরই কোকো চুপ করে গেল৷ গুম হয়ে বসে রইল৷ অনেক প্রশ্ন করেও কল্যাণবাবু ওর কাছ থেকে আর কোনও কথা বের করতে পারলেন না৷

এর আগেও কোকোকে ওর বাড়ির কথা, বাবা-মায়ের কথা অনেকবার জিগ্যেস করেছেন, কিন্তু কোনও স্পষ্ট উত্তর পাননি৷ রাহুল আর ওর মা-ও বহুবার সরাসরি অথবা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কোকোকে ওর বাড়ির কথা জিগ্যেস করেছেন, বাবা-মায়ের কথা জিগ্যেস করেছেন, কিন্তু কোনও জবাব পাননি৷

আজ প্রথম বাপি জানতে পারলেন, কোকোর মা ছবি আঁকতেন৷

হয় সবকিছু কোকোর ধীরে-ধীরে মনে পড়ছে, অথবা, ও ধীরে-ধীরে নিজেকে মেলে ধরছে৷ ঠিক যেভাবে একটা গোলাপ কুঁড়ি থেকে ধীরে-ধীরে পাপড়ি মেলে ধরে৷

রাহুলের বাপি আর মাম কোকোকে ওঁদের স্বাভাবিক জীবনে মিশিয়ে নিলেন৷ কেন জানি না, ওঁদের মনে হয়েছিল, এতে কোকো তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে৷ যদি কোনও পুরোনো স্মৃতি ওর হারিয়েও গিয়ে থাকে, তা হলে সেটা ফিরে আসবে৷

কোকো ওঁদের কথা শুনে চলত বটে তবে দুটি ব্যাপার ছাড়া৷ প্রথমটা হল, রাহুলের পাশে-পাশে ছায়ার মতো ঘোরা৷ আর দ্বিতীয়টা ঘরের নানান কাজে মাম এবং বাপিকে সাহায্য করা৷

একদিন রাহুলের সঙ্গে মাঠে খেলতে গিয়ে এক কাণ্ড হল৷

এমনিতে রোজ যে কোকো যায় ও কিন্তু খেলতে নামে না৷ মাঠের ধারে চুপচাপ বসে রাহুলদের ফুটবল খেলা দ্যাখে৷ আর গোল-টোল হলে হাততালি দেয়৷ হাত ছুড়ে চেঁচামেচি করে৷

কিন্তু সেদিন ওর কী খেয়াল চাপল, ও রাহুলের কাছে বায়না করে বসল৷

‘রাহুল, আমি…তোমার মতো…বল খেলব৷’

ওর বায়নার ধরন রাহুল জানে৷ একটা কিছু মাথায় ঢুকলে ও সেটাই ঘ্যানঘ্যান করে যাবে৷ তাই ও বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে কোকোকে নিজের দলে নিল৷ ও ভেবেছিল, মিনিট পাঁচ-দশ খেলানোর পর কোকোকে ঠান্ডা করে বসিয়ে দেবে৷ কিন্তু কাজে সেটা করা গেল না৷ কারণ, কোকোর খেলা রাহুলকে অবাক করে দিল৷

না, কোকো ফুটবল খেলতে জানে না৷ তবে কচ্চিৎ কখনও পায়ে বল পেয়ে গেলে ও যে-অসম্ভব জোরে শট মারছে তা দেখে সকলের চোখ ছানাবড়া৷

কোকোর একটা জোরালো শট কোমরে লেগে নিধু ছিটকে পড়ে গেল৷ পড়ে ছটফট করতে লাগল৷

রাহুলরা সবাই ছুটে গেল ওর তদারকি করতে৷

গোপাল, রাহুল বেশ অবাক হয়ে গেল৷ নিধু ফুটবল খেলে ভালো৷ চেহারাও গাঁট্টাগোঁট্টা, পেটানো, সহজে ওকে কেউ কাবু হতে দেখেনি৷ কিন্তু আজ ওর অবস্থা ভেজা তুলোর মতো৷

নিধুকে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল৷ কোকো একাই ওকে চাগিয়ে কাঁধে তুলে নিল৷ মাঠের ধারে ওকে শুইয়ে দিয়ে সবাই মিলে পরিচর্যা করতে লাগল৷

একটু পরে খেলা আবার শুরু হল৷

কোকো হঠাৎ পায়ে বল পেয়ে তিরবেগে ছুটতে শুরু করল৷ সেরকম অভ্যাস স্বাভাবিকভাবেই না থাকায় বল ওর পা থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু ও একছুটে বলের কাছে পৌঁছে গেল৷ এবং শট মারল৷

বলটা গোলে ঢুকল৷ শুধু ঢুকল নয়, একেবারে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল৷

গোলপোস্টের দশ-বারো হাত পিছনেই ছিল স্বদেশ মণ্ডলদের বাঁখারির বেড়া৷ জাল ছিঁড়ে বেরোনো বলের ধাক্কায় সেই বেড়াটাও কাত হয়ে গেল৷

গোলের আনন্দে রাহুলদের দলের সবাই হইহই করে উঠেছিল৷ কিন্তু দেখা গেল গোল খাওয়া দলের বন্ধুরাও স্তম্ভিত ভাবটা কাটিয়ে কোকোকে ঘিরে উৎসব শুরু করে দিল৷ কারণ, এরকম ভয়ংকর তীব্র শট মণিমেলায় আগে কেউ কখনও দেখেনি৷ মণিমেলায় শট মারার একটা প্লেয়ার পাওয়া গেল বটে! কোকো ফুটবল খেলতে না জানুক, শট তো মারতে পারে! ওকে রাহুলরা প্র্যাকটিস করিয়ে-করিয়ে খেলাটা একটু-আধটু রপ্ত করিয়ে দেবে৷ তারপর ও দু-চারটে শট মেরে বাজিমাত করবে৷ মণিমেলার ফুটবল টিমে ওকে খেলাতে হবেই৷

খেলার শেষে রাহুল, দীপায়ন আর কোকো বাড়ির দিকে ফিরছিল৷

মাঠ ছেড়ে ওরা পিচের রাস্তা ধরে যাচ্ছিল৷ হঠাৎই একটা বিশাল মোটর-বাইক গাঁক-গাঁক শব্দ তুলে ওদের পাশ দিয়ে ছুটে গেল৷ বাইকে তিনটে ছেলে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিল৷ তিনজনেরই গায়ে স্লিভলেস ভেস্ট, আর বারমুডা৷ কী এক উল্লাসে চিৎকার করছে৷

বাইকটা যেভাবে কাত করে-করে সাপের মতো এঁকেবেঁকে ওরা চালিয়ে গেল তাতে রাহুল ভয় পেয়ে গিয়েছিল৷ ওর মানে হল, এক্ষুনি বুঝি বাইকটা উলটে যাবে৷

দীপায়ন বলে উঠল, ‘কী রাফ চালাচ্ছে! আর-একটু হলেই অ্যাকসিডেন্ট করত৷’

রাহুল বলল, ‘মাকুর বাইক৷ বাইকে মাকু, ওর ভাই নেনে, আর বর্মনবাড়ির ছোটছেলেটা—কী নাম যেন—ওটা বসে আছে৷ মাকু তো এভাবেই বাইক চালায়—৷’

‘মাকু’ নামটা শোনামাত্রই দীপায়ন চুপ করে গেল৷ কোনও এলাকায় যে-নাম শোনামাত্র সবাই মুখে কুলুপ আঁটে ‘মাকু’ সেরকমই একটা নাম৷ ওর চ্যাংড়া ছোটলোক সাঙ্গোপাঙ্গদের সবাই এড়িয়ে চলে৷ বর্মনবাড়ির ছোটছেলেটা এ-দলে নতুন জুটেছে৷ ছেলেটা এখনও স্কুলে যায়, তবে চালচলন বড়লোকের বখাটে ছেলের মতন৷

রাহুল আর দীপায়ন নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় মাকুর সমালোচনা করছিল৷ তার সঙ্গে বলছিল নেনের কীর্তিকথা৷ ওরা খেয়াল করেনি, কোকো হাঁ করে ওদের কথাগুলো গিলছিল৷

বিকেল ফুরিয়ে এলেও আলো ফুরোয়নি৷ খেলা শেষ করে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়ির দিকে ফিরছে৷ নিজেদের মধ্যে ওরা যেরকম কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে সন্ধেবেলা বটগাছের আশ্রয়ে ফেরার পর পাখির ঝাঁক কিচিরমিচির করে ঝগড়া করছে৷

হঠাৎই মোটরবাইকটা আবার ফিরে এল৷ মনে হল, বাইকটা একই রাস্তা ধরে চক্কর কাটছে৷ সেই সাপের মতো আঁকাবাঁকা গতি৷ সঙ্গে হইহই চিৎকার৷

বাইকটার বিকট হর্ন বাজছিল৷

ওটা আচমকা এসে পড়ায় বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো দিশেহারা হয়ে যে যেদিকে পারল ছিটকে গেল৷ বাইকটার সর্পিল গতি ওদের ভয় পাইয়ে দিল৷ ওরা মিহি গলায় চিৎকার করতে লাগল৷

বাইকটা একটা বাচ্চা মেয়েকে প্রায় চাপা দিয়ে ফেলছিল৷ একেবারে শেষ মুহূর্তে মাকু ব্রেক কষে বাইকটাকে থামাল৷

বাচ্চা মেয়েটা ভয় পেয়ে টাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল৷ চিত হয়ে বাইকটার চাকার দিকে তাকিয়ে মেয়েটা ‘ভ্যাঁ’ করে কেঁদে ফেলল৷

বাচ্চাদের ভয় পেয়ে দৌড়োদৌড়ির কাণ্ড দেখে আর কান্না শুনে মাকুরা বোধহয় মজা পেল৷ ওরা তিনজনে বাইকে বসে-বসেই হাসতে শুরু করল৷ তারই মাঝে মাকু রাস্তায় পড়ে থাকা বাচ্চা মেয়েটাকে লক্ষ করে হাত নেড়ে বলে উঠল, ‘কাঁদে না, খুকু৷ তোমার কিচ্ছু হয়নি৷ তুমি মিছিমিছি কাঁদছ৷ এসো…হাত ধরো৷ উঠে পড়ো…৷’

বাচ্চা মেয়েটা ভ্যাবাচ্যাকা মুখে ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল৷ নিজের হাত-পা জামা ঝাড়তে লাগল৷

মাকুদের হাসি রাহুলের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল৷ ও তেমন করে কিছু না ভেবেই বাইকটার কাছে এগিয়ে গেল৷ মাকুকে লক্ষ করে জেহাদি প্রশ্ন ছুড়ে দিল৷

‘এসব কী হচ্ছে?’

‘তোর বাপের বিয়ে হচ্ছে৷’ বলেই বাইকে বসা অবস্থাতেই রাহুলের বুকে পা তুলে দিল মাকু৷ সজোরে এক ঠেলা মারল৷

লাথি খেয়ে রাহুল ছিটকে পড়ল রাস্তায়৷ মাথা ঠুকে গেল৷ যন্ত্রণার একটা চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে৷

রাহুল উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল৷ দীপায়ন তাড়াতাড়ি ওর কাছে গিয়ে ওকে হাত ধরে টেনে তুলতে লাগল৷

মাকুরা বাইকে বসে মজা দেখছিল৷ ওদের বাইকের ইঞ্জিন ভটভট শব্দ করছিল৷ রাহুল উঠে দাঁড়াতেই মাকু আর নেনে ওকে নোংরা ভাষায় গালাগাল দিল৷ তারপর মাকু বলল, ‘এই আজব ভেড়াটাকে মেপে রাখ৷ পরে একে কড়া পালিশ দেব৷ সালার এত হিম্মত যে, আমার সঙ্গে মুখ লাগাতে আসে!’

রাহুল হাত-পায়ের ধুলো ঝাড়ছিল আর ঘেন্না-মেশানো প্রতিবাদের চোখে মাকুর দিকে দেখছিল৷

সেটা লক্ষ করে ভাইয়ের দিকে ঘাড় ঘোরাল মাকু : ‘অ্যাই নেনে, নাম তো বাইক থেকে৷ দ্যাখ, ব্যাটা ড্যাবড্যাব করে কেমন তাকাচ্ছে! মালটাকে একটু পাঁচালি পড়ে দে…৷’

নেনে হাসল৷ হাসতে-হাসতেই বাইক থেকে নামল৷ তারপর রাহুলের দিকে পা বাড়াল৷

কোকো এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল৷ খানিকটা বিভ্রান্তভাবে সকলের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল৷ যেন কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না৷

কিন্তু নেনে রাহুলের দিকে আক্রমণের ভঙ্গিতে এগোতেই কোকো নড়েচড়ে উঠল৷ একছুটে নেনের সামনে গিয়ে ওর পথ আগলে দাঁড়াল৷ কর্কশ গলায় টেনে-টেনে বলল, ‘রাহুলকে…মারবে না৷’

‘তাই?’ বলে নেনে ডানহাতে সপাটে এক ঘুসি বসিয়ে দিল কোকোর মুখে৷

কোকো ঘুসির অভিঘাতটা নিল, কিন্তু জায়গা থেকে নড়ল না—দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মতো৷ ওর ঠোঁটের কোণ থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল৷

ও আবার বলল, ‘রাহুলকে…মারবে না৷’

রাহুল ‘কোকো! কোকো, চলে এসো—’ বলে অস্থিরভাবে ওকে ডাকছিল৷ কিন্তু কোকো তাতে এতটুকু কান দিল বলে মনে হল না৷

‘রাহুলকে…মারবে না৷’ একঘেয়েভাবে আবার বলল কোকো৷

ওর অদ্ভুত কথা বলার ঢঙে নেনে হেসে উঠল : ‘কে রে আমার তোতলা কাত্তিক?’ তারপর ভেংচিয়ে বলল, ‘রাহুলকে মাবব না, ছোনা?’

কথা বলতে-বলতেই নেনে হাত তুলেছিল, কিন্তু ওই পর্যন্তই৷

রাহুলরা অবাক হয়ে কোকোর কাণ্ড দেখতে লাগল৷

এক ঝটকায় নেনের কোমর জাপটে ধরল কোকো৷ তারপর অবলীলায় ওকে শূন্যে তুলে ফেলল৷

নেনে দাপাদাপি করছিল৷ কোকোকে কিল-চড়-ঘুসি মারছিল৷ কিন্তু কোকো সেসব গ্রাহ্য করছিল না৷ ও অনায়াস ভঙ্গিতে হেঁটে গেল রাস্তার কিনারায়৷ তারপর নেনেকে স্রেফ ছুড়ে দিল নালার ওপারে৷ নেনে গিয়ে আছড়ে পড়ল একটা পরিত্যক্ত জমিতে৷

বাইকে বসে মাকু গর্জন করে উঠল৷ সেইসঙ্গে গালাগালের ফোয়ারা ছোটাল৷ কিন্তু ও বাইক থেকে নামেনি৷ বোধহয় শত্রুর এইরকম ভয়ংকর শক্তির সঙ্গে মোকাবিলা করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে কি না সে-কথাই ভাবছিল৷ আর বাইকের পিছনে বসে থাকা বড়লোকের বখাটে ছেলেটা ভয়ের চোখে কোকোর দিকে তাকিয়ে ছিল৷

কোকো অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় মাকুর বাইকের সামনে এসে দাঁড়াল৷

মাকু গিয়ার বদল করে বাইক ছুটিয়ে দিল৷ ওর বোধহয় কোকোকে চাপা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল৷ কিন্তু সেটা হল না৷

কারণ, কোকো শক্ত দু-হাতে বাইকের হাতল চেপে ধরেছে৷ মাকুর হাতের পাশেই কোকোর নীল শিরা ওঠা দুটো হাত৷

বাইকটা গোঁ-গোঁ গর্জন করছিল, কিন্তু নড়তে পারছিল না৷ কোকো সামনে ঝুঁকে পড়ে চোয়ালে চোয়াল চেপে বাইকের অশ্বশক্তির টক্কর নিচ্ছিল৷ রাহুল আর দীপায়ন স্তম্ভিত হয়ে কোকোর কাণ্ড দেখছিল৷

রাস্তায় ভিড় জমছিল৷ বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো তো ছিলই, তার সঙ্গে জুটে গেল পথচারীরা৷ কেউ হেঁটে যাচ্ছিল, কেউ-বা সাইকেলে৷

বাইকটাকে ক্ষমতার শেষ সীমায় নিয়ে গেল মাকু৷ আকাশফাটানো গোঁ-গোঁ গর্জন৷ ধোঁয়া৷ পেট্রলের গন্ধ৷

কিন্তু কোকো অবিচল৷ সবার চোখের সামনে ও যেন এক রূপকথার সার্কাস দেখাচ্ছে৷

ও দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘বাইকের…স্টার্ট বন্ধ…করো৷ নইলে বাইক…উলটে…দেব…৷’

ওর কথায় বোধহয় ম্যাজিক ছিল, কারণ, মাকু কী একটা সুইচ ঘোরাতেই একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বাইকের ইঞ্জিন থেমে গেল৷ কোকো বাইকের হ্যান্ডেল ধরে হাঁপাতে লাগল৷

নেনে কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু নালা পেরিয়ে কোকোর আক্রমণের আওতায় আসতে ভয় পাচ্ছিল৷ আর বর্মনবাড়ির ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছিল এখুনি বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাবে৷

রাহুলই প্রথম সংবিৎ ফিরে পেল৷ ও ‘কোকো! কোকো!’ বলে চিৎকার করে ছুটে এল ওর ‘অলৌকিক’ বন্ধুর কাছে৷ ওকে পিছন থেকে একেবারে জাপটে ধরল৷

‘কোকো! কোকো!’ আবেগে রাহুলের চোখে জল এসে গেল৷

কোকো বাইক ছেড়ে দিয়ে রাহুলের দিকে ঘুরে দাঁড়াল৷ ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোমাকে যে মারবে…তাকে ছাড়ব না৷ ছাড়ব না৷’

কোকোকে অন্যমনস্ক দেখে নেনে সামান্য খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে নালা পেরোল৷ তারপর চট করে বাইকে উঠে বসল৷ সুযোগ বুঝে মাকুও বাইকে স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিল৷ তবে যাওয়ার আগে কোকো আর রাহুলকে লক্ষ করে গালাগাল দিয়ে গেল৷ চিৎকার করে বলে গেল, ‘ওয়েট কর—তোদের হিসেব হবে৷’

রাহুল আর কোকো মাকুদের চলে যাওয়া দেখল৷

রাস্তার লোকজন এতক্ষণ যেন রুদ্ধশ্বাসে কোনও সিনেমা দেখছিল৷ বাইকটা চলে যেতেই সবাই কোকোর কাছে ছুটে এল৷ আলোচনা করতে লাগল, হইচই করতে লাগল, কোকোর সাহস আর শক্তির তারিফ করতে লাগল৷

কোকোকে নিয়ে প্রশ্নও করতে লাগল কেউ-কেউ৷

‘একে তো এ-গাঁয়ে আগে দেখিনি!’

‘ছেলেটার গলায় ওটা কী?’

‘ও কাদের বাড়িতে এসেছে?’

‘ওর নাম কী?’

কোকো কোনও কথায় কর্ণপাত করছিল না৷ ও এমনভাবে রাহুলের একটা হাত জড়িয়ে ধরে ছিল যেন হাতটা ছেড়ে দিলেই ও হারিয়ে যাবে৷ দীপায়নও রাহুলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল৷ ও রাহুলকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য তাড়া লাগাচ্ছিল৷

রাহুল কোকোর দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘তুমি একেবারে ছেলেমানুষ, কোকো৷ ওই বাজে ছেলেগুলোর সঙ্গে ঝামেলায় জড়ালে কেন? জানো, ওরা গুন্ডা-মাস্তান?’

‘গুন্ডা কাকে বলে? মাস্তান…কী?’ সরল মুখে রাহুলের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল কোকো৷

রাহুল ওকে হাত ধরে টানল৷ হাঁটতে শুরু করল৷ পিছনে দীপায়ন৷

হাঁটতে-হাঁটতেই রাহুল বলল, ‘গুন্ডা৷ মাস্তান৷ ওদের সঙ্গে ছোরা থাকে, রিভলভার থাকে৷ ওরা খারাপ৷’

কোকো রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাস্টারজির কাছে…রিভলভার আছে৷ মাস্টারজি…খারাপ৷’

রাহুল অবাক হলেও কোনও কথা বলল না৷ ওকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে লাগল৷

দীপায়ন রাহুলকে জিগ্যেস করল, ‘মাস্টারজি আবার কে?’

ব্যাপারটা চাপা দেওয়ার জন্য রাহুল ঠোঁট উলটে বলল, ‘কী জানি! ও মাঝে-মাঝে ওরকম উলটোপালটা কথা বলে৷’

দীপায়ন বলল, ‘আমার তো চিন্তা হচ্ছে রে৷ মাকুরা সহজে ছাড়বে না৷’

চিন্তা রাহুলেরও হচ্ছিল৷ মাকু, নেনে ওরা মোটেই সুবিধের নয়৷ ওরা দোকানদারদের কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে তোলা আদায় করে৷ সুযোগ পেলে ছিনতাই করে, ওয়াগন ভাঙে৷ রেল-লাইনের ধারে ওদের আসল ঠেক৷ সেখানে রাতে ওরা নেশা-ভাং-এ চুর হয়ে হইহুল্লোড় করে৷

রাহুল আপনমনেই বলল, ‘আমিই ভুল করলাম৷ কেন যে প্রোটেস্ট করতে গেলাম!’

দীপায়ন বলল, ‘তুই লাথিটা খাওয়ার পর চেপে গেলেও হত৷’

‘আমি তো চেপেই গেছিলাম৷ এই যে কোকোটা!’ কোকোর দিকে আঙুল দেখিয়ে রাহুল কপট রাগের গলায় বলল, ‘কোকোটাই তো নেনের সঙ্গে ঝামেলা করল!’

কোকো নির্বিকার সুরে বলল, ‘ছেলেটা তোমাকে…মারতে যাচ্ছিল…৷’

দীপায়ন বলল, ‘হ্যাঁ—তা যাচ্ছিল৷ কিন্তু…৷’

দীপায়নের কথা শেষ হওয়ার আগেই কোকো বলে উঠল, ‘রাহুলকে যে…মারবে তাকে আমি…ছাড়ব না৷ কিছুতেই ছাড়ব না৷’

বিকেলের শেষ আলো এসে পড়েছিল কোকোর মুখে৷ ও এক অদ্ভুত মমতা মাখা সরল চোখে রাহুলের দিকে তাকিয়ে ছিল৷ একটা আন্তরিক টান টের পেল রাহুল৷ এই বোকা-হাবা ভোলাভালা ছেলেটা মাত্র দু-সপ্তাহে বিচিত্র এক আত্মীয়তার অদৃশ্য সুতোয় রাহুলদের কখন যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে৷

রাহুলের মনে হচ্ছিল, ঢলে পড়া সূর্যের আলো পড়ে নয়—কোকোর মুখটা এমনিই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে৷

৷৷পাঁচ৷৷

দু-সপ্তাহে কোকোর কথা গ্রামের যে-ক’জন জেনেছিল, মাকুদের সঙ্গে মোকাবিলার পর সেই সংখ্যাটা প্রায় পঞ্চাশ গুণ হয়ে গেল৷

যে-বাচ্চা মেয়েটা মাকুর বাইকের তলায় আর-একটু হলেই চাপা পড়ছিল, তার বাবা-মা ঘটনার পরদিন সন্ধেবেলা রাহুলদের বাড়িতে এলেন—সঙ্গে মেয়েটি৷ ওঁদের খুব সাধ জেগেছে রাহুল আর কোকোকে স্বচক্ষে একবার দেখেন৷ ঘোর কলিযুগে এখনও এমন লোক আছে যারা অচেনা-অজানা কাউকে বাঁচানোর তাগিদে প্রতিবাদ করে, ঝুঁকি নেয়!

ওঁদের সঙ্গে গল্প করে কোকো দারুণ খুশি৷ ওর কথাবার্তা শুনে রাহুল অবাক হল৷ ওর মনে হল, কোকো যেন প্রথমদিককার তুলনায় কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে৷

প্রতিদিন বিকেলে ফুটবল খেলতে-খেলতে কোকো রাহুলদের ক্লাবে নিয়মিত ফুটবল প্লেয়ার হয়ে উঠল৷ শুধু রাহুলরা ওকে অনেক করে অনুরোধ করেছে ও যেন জোরে শট না মারে৷ কারণ, রোজ-রোজ ফুটবল ফেটে গেলে ফুটবল কেনার পয়সা জোগাবে কে!

মাকুদের সঙ্গে এনকাউন্টারের ব্যাপারটা রাহুল ইচ্ছে করেই মাম কিংবা বাপিকে প্রথমে বলেনি৷ ভুল একটা যখন হয়ে গেছে তখন শুধু-শুধু ওঁদের টেনশান বাড়িয়ে লাভ কী! কিন্তু বাপি পরদিন সকালে খবরটা পেয়ে গিয়েছিলেন৷ ফলে সেদিন রাতে রাহুলকে মাম আর বাপির জেরার মুখে পড়তে হল৷

রাহুল লুকোচুরি না করে সব কথা খুলে বলল৷

শুনে বাপি ওকে বললেন, খুব সাবধানে চলাফেরা করতে৷ সবসময় কেউ না কেউ যেন সঙ্গে থাকে—একা-একা রাহুল যেন কোথাও না যায়—বিশেষ করে রেললাইনের দিকে৷

কোকো একবার বলে উঠল, ‘আমি তো রাহুলের সঙ্গে সবসময় থাকি…৷’

বাপি আর মাম স্নেহভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন৷ মাম বললেন, ‘তোমারও তো বিপদের ভয়, কোকো৷ রাহুল স্কুলে যাওয়ার সময় আর ফেরার সময় আমিও তোমাদের সঙ্গে থাকব৷ আর খেলার মাঠ থেকে ফেরার সময়—’ রাহুলের দিকে তাকালেন মাম : ‘দু-চারজন বন্ধু-বান্ধবকে সঙ্গে নিবি৷ বলবি একটু বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে৷’

কোকো কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু রাহুল হাত নেড়ে ওকে থামিয়ে দিল৷

এই নিয়মেই কয়েকদিন চলল৷ মাকু বা ওর দলের ছেলেদের সঙ্গে রাহুলদের দেখা হয়, কিন্তু ওরা কিছু বলে না৷ সাইকেল, বাইক নিয়ে রাহুলদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়৷ তবে আড়চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে৷

রাহুলের মনে হয়, কোকোর সুখ্যাতির জন্যই মাকুর দলবল ‘বদলা’ নেওয়ার ব্যাপারে পিছিয়ে পড়ছে৷

কোকোর কথা এখন মণিমেলার প্রায় সবাই জানে৷ তা ছাড়া মাকুদের কাজকর্ম কেউই পছন্দ করে না৷ ওদের ওপর সবাই বিরক্ত৷ সুতরাং এরকম পরিস্থিতিতে যদি কোকো বা রাহুলের গায়ে হাত পড়ে তা হলে মাকুদের বিপদ হতে পারে৷

এসব কথা ভেবেই মাকু অপেক্ষা করছিল৷ আর একইসঙ্গে সুযোগ খুঁজছিল৷

রাহুল কোকোর জন্য দুশ্চিন্তা করলেও কোকো একেবারে চিন্তাভাবনাহীন৷ ও ওর মতোই দিন কাটাতে লাগল৷ টিউবওয়েল পাম্প করে জল তোলা, বাগানে পাখি কিংবা প্রজাপতির পিছনে ছুটোছুটি, ব্যায়াম করা, রাহুলের স্কুলে যাওয়া-আসা, কখনও-কখনও বাপির সঙ্গে বাজারে যাওয়া, বিকেলে মাঠে গিয়ে খেলা, আর বাপির সময় হলেই বাপির কাছে বসে ছবি আঁকা শেখা৷

কোকোর দিকে তাকিয়ে মাম আর বাপি অবাক হয়ে ভাবেন৷ ছেলেটা কেমন শিশুর মতো নিশ্চিন্ত আরামে রয়েছে! ওকে দেখে মাঝে-মাঝে মনে হয়, ও যেন প্রকৃতিরই একটা অংশ৷

রাহুলরা বহুদিন ধরেই ভাবছিল ওদের ক্লাব থেকে একটা লাইব্রেরি তৈরি করবে৷ এবার ওরা একটা ঘরের সন্ধান পেয়েছে৷ মণিমেলার সবচেয়ে পুরোনো ডাক্তার ডক্টর পরমেশ হালদার ওঁর দোতলা বাড়ির একতলার একটা ঘর রাহুলদের ছেড়ে দিয়েছেন৷ সেখানে ওদের লাইব্রেরি হবে—‘মণিমেলা সাধারণ পাঠাগার’৷

ঘর হাতে পাওয়ার পর রাহুলরা চাঁদা তুলতে শুরু করেছে৷ তারপর সেই টাকায় ঘর সারানোর কাজেও হাত দিয়েছে৷ একইসঙ্গে রাহুলরা রবিবার বা ছুটির দিনে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে গল্পের বইয়ের খোঁজ করছে৷ বলছে, ‘আমাদের লাইব্রেরিতে গল্পের বই ডোনেট করুন৷’

ওদের উদ্যোগে বহু মানুষ সাড়া দিয়েছে৷ চাঁদার পাশাপাশি বইও পাওয়া যাচ্ছে অনেক৷

এসব কাজে রাহুলদের সঙ্গে কোকোও টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ ডোনেশানে পাওয়া বইয়ে থলে ভরতি করে দু-হাতে দুটো থলে ঝুলিয়ে ও রাহুলদের সঙ্গে এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি অক্লান্তভাবে হেঁটে চলেছে৷

এরকমই এক রবিবার৷ বেলা প্রায় একটা বাজে৷ মাথার ওপরে গনগনে সূর্য৷ চারপাশে গরম বাতাস বইছে৷ রাহুলরা দল বেঁধে বাড়ি-বাড়ি ঘুরছে৷ ওদের দলে রাহুল, নিধু, গোপাল আর কোকো ছাড়া ছিল ওদের ক্লাবের সেক্রেটারি ঝন্টুদা৷ ঝন্টুদা ওদের মধ্যে সবচেয়ে বড়৷ চাকরি করে৷

একসময় ক্লান্ত হয়ে ওরা ক্ষান্ত হল৷ একটা বটগাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে দাঁড়াল৷ কোকো হাতের ভারী থলে দুটো নামিয়ে রাখল মাটিতে৷ বটগাছের লাগোয়া একটা বড়-সড় পানের দোকান৷ দোকানের বাইরে থরে-থরে সাজানো কোল্ড ড্রিঙ্কের পেটি৷

ঝন্টুদা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘অ্যাই, তোরা সবাই একটা করে পেপসি খা৷ আমি খাওয়াচ্ছি৷’

রাহুলরা সবাই মিলে ‘ঝন্টুদা, জিন্দাবাদ’ বলে চেঁচিয়ে উঠল৷ তারপর দোকানদারের কাছ থেকে পাঁচটা ঠান্ডা পেপসি নিল৷ একটা বোতলে স্ট্র ঢুকিয়ে কোকোর হাতে দিল রাহুল : ‘নাও, পেপসি খাও—৷’

কোকো বোতলটা নিয়ে অনভ্যস্ত ঢঙে সিপ করতে শুরু করল৷

সবার আগে কোকোর পেপসি খাওয়া শেষ হল৷ পরপর দুটো ঢেঁকুর তুলল ও৷

রাহুলের কোল্ড ড্রিঙ্ক খাওয়া শেষ হলে কোকো বলল, ‘রাহুল… পেপসি…খেতে খুব ভালো৷ মিষ্টি৷ ভালো৷’

ঝন্টুদা ওকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি আর-একটা খাবে?’

কোকো মাথা হেলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ…খাব৷’

আর-একটা পেপসির বোতল নিয়ে কোকোর হাতে দিল রাহুল৷ কোকো পরম উৎসাহে স্ট্র মুখে চেপে ধরে পেপসি খাওয়ায় মন দিল৷ আর রাহুলরা লাইব্রেরির নানান পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল৷

এমন সময় মাকুর বাইক দেখা গেল৷ ভটভট আওয়াজ তুলে ধুলো উড়িয়ে আসছে৷

রাহুলদের কাছে এসে বাইকটা থামাল মাকু৷ ওর পিছনে বসে আছে নেনে৷ মাকুর গায়ে টি-শার্ট আর জিনসের প্যান্ট৷ আর নেনে একটা হলুদ শার্ট আর কালচে প্যান্ট পরে আছে৷

মাকু বাইকের স্টার্ট বন্ধ করেনি৷ বরং মাঝে-মাঝে হাতল ঘুরিয়ে ইঞ্জিন রেস করছে৷

নেনের আঙুলে সিগারেট ধরা ছিল৷ ঝন্টুদাকে দেখে ও উদ্ধত রুক্ষ ভঙ্গিতে সিগারেটে টান দিতে লাগল৷ ঝন্টুদা অস্বস্তিতে মুখটা ঘুরিয়ে নিল৷

নেনে বাইক থেকে নেমে পড়ল৷ চোখ সরু করে সিগারেটে টান মারতে-মারতে এগিয়ে এল রাহুলদের দিকে—অথবা পানের দোকানের দিকে৷

রাহুল চট করে তাকাল কোকোর দিকে৷ ওর বুক কেঁপে উঠল৷ যদি আগের দিনের মতো কিছু একটা হয়! রাহুলের ভয় হচ্ছিল, এই বুঝি নেনে ওর বুকের ভেতরে হওয়া ধড়াস-ধড়াস শব্দ শুনতে পাবে৷

ঝন্টুদা, নিধু, গোপাল পানের দোকানের সামনে থেকে পায়ে-পায়ে সরে যেতে লাগল৷ রাহুলও সেই চেষ্টাই করল৷ নেনের নজর এড়িয়ে কোকোর জামা ধরে চোরা টান মারল৷ কিন্তু কোকো সেটা টের পেলে তো! ও তখন পেপসি খেতে মশগুল৷ স্ট্র-এর টানে বোতলের তরলে চড়বড়-চড়বড় শব্দ হচ্ছে৷

নেনে ঝন্টুদার সামনে এসে দাঁড়াল৷ ওর বাঁ-হাতে সিগারেট, ডানহাতটা পকেটে গোঁজা৷

ঝন্টুদার মুখে পরপর দুবার ধোঁয়া ছুড়ে দিল নেনে৷ ঝন্টুদা মুখে কিছু বলল না—শুধু নাক টিপে এক ঝটকায় মুখটা পাশে ফেরাল৷

‘কী, সেক্রেটারিবাবু! শুনলাম, ডাক্তার হালদারের একতলার ঘরটা তোমরা লপকে নিয়েছ—লাইব্রেরি না কীসব করবে৷’

মুখটা ঘুরিয়ে রেখেই চাপা গলায় ঝন্টুদা জবাব দিল, ‘আমাদের গ্রামে একটা লাইব্রেরি হওয়া খুব দরকার৷ অনেকদিন ধরে সবাই বলছে…তাই ডক্টর হালদারের কাছে আমরা রিকোয়েস্ট করেছিলাম৷ লাইব্রেরিটার নাম হবে ‘‘মণিমেলা সাধারণ পাঠাগার’’৷ ডক্টর হালদার বলেছেন…৷’

‘ওসব ঢপের কেত্তন ছাড়ো!’ নেনে খিঁচিয়ে উঠল, ‘পাঠাগার হবে না কাঁচকলা হবে৷ ও-ঘরটা আমরা টার্গেট করেছিলাম…ক্লাবঘর করব৷ তো বুড়োটাকে তোমরা টুপি দিয়ে ঘরটা হড়কে নিলে?’

নিধু ভয় পেলেও মিনমিন করে পাশ থেকে বলল, ‘সত্যি বলছি—লাইব্রেরি হবে৷ এই তো—’ গাছতলায় রাখা বইভরতি থলে দুটো দেখাল : ‘আমরা সবার কাছ থেকে চেয়ে-চেয়ে গল্পের বই জোগাড় করছি…৷’

নেনে সিগারেট ফেলে দিয়ে বাঁ-হাতে খপ করে নিধুর কলার চেপে ধরল : ‘তুই কি সালা ঝন্টুর উকিল না কি?’

মাকু বাইকে গরগর আওয়াজ তুলে এগিয়ে এল নেনের কাছে৷ বাইক থামাল৷

নেনের কথায় রাহুলের গা জ্বালা করছিল৷ কিন্তু মাকুদের সঙ্গে ওদের লড়ার ক্ষমতা কতটুকু! তা ছাড়া মাম আর বাপি বলেছেন, এসব ঝামেলা এড়িয়ে থাকতে৷

রাহুল মারপিটকে ভয় পায়৷ তাই ভয়ে সিঁটিয়ে গেল৷ নেনেরা বোধহয় এক্ষুনি গায়ে পড়ে একটা গন্ডগোল তৈরি করবে৷

ও কোকোর দিকে তাকাল৷ নির্বিকারভাবে পেপসি খেয়ে চলেছে৷

নিধুকে কলার ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছিল নেনে৷ আর মাকু দাঁত বের করে হাসছিল৷

রাহুল ভয় পেলেও প্রতিবাদ না করে থাকতে পারল না৷

‘নিধুকে ছেড়ে দাও!’ ও চেঁচিয়ে বলল৷

সঙ্গে-সঙ্গে নিধুকে ছেড়ে দিল নেনে৷ এবং রাহুলের দিকে ঘুরল৷ কিন্তু রাহুলের দিকে এক পা এগিয়েই থেমে গেল ও৷ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কোকোর দিকে৷ ও তখন পেপসি খাওয়া শেষ করে খালি বোতলটা দোকানির হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছে৷

‘এই তোতলা কাত্তিক!’ বাজেভাবে হাত নেড়ে কোকোকে কাছে ডাকল নেনে৷ তারপর রাহুলকে লক্ষ করে বলল, ‘তোর গায়ে হাত তুললেই তো আবার ওই ক্যালানে কাত্তিক রুখতে আসবে৷ এলে আজ ওকে মজা দেখাব৷ সেদিন কিছু বলিনি…৷’

কোকো নেনের কাছে এগিয়ে আসছিল৷ তাই দেখে রাহুল আর থাকতে পারল না৷ ও নেনের হাত চেপে ধরে অনুনয় করে বলল, ‘ওকে কিছু বোলো না৷ ওর অসুখ আছে…৷’

‘সব অসুখ আজ ঝেড়ে সারিয়ে দেব৷’ ঠোঁট বেঁকিয়ে কথাটা বলে এক ঝটকায় রাহুলের হাত ছাড়িয়ে নিল৷ শব্দ করে হেসে উঠল : ‘সেদিন মওকা পেয়ে আমাকে হেভি বেইজ্জত করেছিস…৷’

মাকু বাইকে বসা অবস্থাতেই চেঁচিয়ে বলল, ‘মালকে একটু বাইক দিয়ে চেটে দেব নাকি?’

ঝন্টুদা নেনের কাছে এগিয়ে এল : ‘এসব কী হচ্ছে? কেন পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছ, ভাই? তোমাদের ক্লাবঘরের জন্যে অন্য আর-একটা ঘর…৷’

ঝন্টুদার মুখে থুতু ছুড়ে দিল নেনে৷ দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ধমকে উঠল, ‘ফোট সালা! কাঁঠালের আঠা মারতে এসেছে! এখুনি বডি নামিয়ে দেব৷ ফোট!’

ঝন্টুদার মুখ-চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল৷ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল৷ ঘৃণার চোখে নেনেকে দেখল৷ তারপর এক-পা পিছিয়ে এল৷

কোকোকে আদুরে গলায় কাছে ডাকল নেনে৷ ডানহাতটা পকেট থেকে বের করে নিল৷

সঙ্গে-সঙ্গে রাহুল ভয়ে কাঠ হয়ে গেল৷

নেনের হাতে প্রায় ছ’ইঞ্চি ফলার একটা চকচকে ছুরি৷ বাতাসে ফলাটা ধরে সাপের ফণার মতো নাচাচ্ছে৷

ছুরিটা দেখামাত্রই কোকো কেমন যেন হয়ে গেল৷ কাতর চোখে নেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার…সঙ্গে…আমি মারপিট করব না…৷’

‘কেন রে, তোতলা কাত্তিক? লড়বি না কেন?’

এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল কোকো : ‘আমি…আর কাউকে…মারব না৷ কাউকে…কষ্ট দেব না৷ আমি…আর মারপিট…করব না৷ কাউকে… কষ্ট…দেব না৷’

এ-কথায় মাকু আর নেনে হো-হো করে হেসে উঠল৷

রাহুল বিপন্ন মরিয়া চোখে চারপাশে তাকাচ্ছিল৷ যদি কারও কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যায়৷ কিন্তু এই দুপুরে পথে তেমন লোকজন নেই৷ আর যে-দু-একজন পথচারী চোখে পড়ছে তারা মাকুর মার্কামারা মোটরবাইক দেখেই সটকে পড়ছে৷ সেইসঙ্গে রাহুল এটাও লক্ষ করল যে, পানের দোকানের দোকানদার তার বসার জায়গা ছেড়ে মেঝেতে নেমে পড়েছে৷ ধীরে-ধীরে পা বাড়াচ্ছে দোকানের খিড়কি-দরজার দিকে৷ এই জায়গাটাকে সে আর নিরাপদ মনে করছে না৷

নেনে কোকোর দিকে আরও এক-পা এগিয়ে যেতেই কোকো দু-পা পিছিয়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠল : ‘আমি আর কাউকে…মারব না৷ কাউকে কষ্ট দেব না৷ মাস্টারজিকে আমি বলেছি৷ মারপিট করতে আমার ভালো লাগে না৷ আমি…বাড়ি…যাব৷’

অন্য সবার কাছে কোকোর কথাগুলো পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছিল৷ কিন্তু রাহুল যেন কিছু-কিছু বুঝতে পারছিল৷

কোকো পিছোতে-পিছোতে একটা গাছে গিয়ে ধাক্কা খেল৷ তারপর চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে গাছের গুঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল৷

মাকু আর নেনে এই পাগলামি দেখে আবার হেসে উঠল৷ আর রাহুলরা কোকোর কাণ্ড দেখে হতবাক হয়ে গেল৷

যে-ছেলেটার গায়ে এত শক্তি সে কি না এরকম ভয় পেয়ে গেছে!

রাহুল আন্দাজ করল, কোকোর ভয়টা আসলে নেনের হাতের ছুরিটার জন্য৷ এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়৷

কোকো তখন গাছের একটা ডালে বসে আপনমনে বলে চলেছে, ‘আমি আর লড়ব না৷ কাউকে মারব না৷ কষ্ট দেব…না৷ মারব…না৷’

নেনে হাতের ছুরিটা শূন্যে নাচিয়ে কোকোকে দু-চারবার নকল ভয় দেখাল৷ যেন এই ও কোকোর গায়ে ছুরি বসাল বলে৷ কোকো সেই ভয় দেখানোর তালে-তালে সিঁটিয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল৷ সেটা দেখে নেনে আর ওর দাদা বেশ মজা পাচ্ছিল৷

রাহুল কোকোর হেনস্থা আর সহ্য করতে না পেরে বলে উঠল, ‘ওকে শুধু-শুধু ভয় দেখাচ্ছ কেন? ছেড়ে দাও—৷’

সঙ্গে-সঙ্গে নেনের হাসিটা বদলে গেল হিংস্র কুটিল মান-চিত্রে৷ ও চট করে চলে এল রাহুলের কাছে৷ ছুরির ডগাটা ছুঁইয়ে দিল ওর গলায়৷ নোংরা গালাগাল দিয়ে বলল, ‘একদম চুপ৷ নইলে…৷’

নইলে কী হবে সেটা আর নেনের বলা হল না৷

কারণ, চোখের পলকে গাছ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমে পড়েছে কোকো৷ একটা ডিগবাজি খেয়ে শরীরটা গড়িয়ে নিয়ে এসেছে নেনের কাছে৷ দু-হাতে ওর দুটো পা ধরে প্রচণ্ড এক হ্যাঁচকা টান মেরেছে৷

নেনে উপুড় হয়ে উলটে পড়ল মাটিতে৷ কোকো একলাফে চড়ে বসল ওর শরীরের ওপরে৷ ছুরি-ধরা হাতটাকে মোচড় দিয়ে চেপে ধরল পিঠের দিকে৷ তারপর জোরে একটা ঝটকা দিল৷ ছুরি খসে পড়ল নেনের মুঠো থেকে৷ ও যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল৷

কোকো চিৎকার করে বলল, ‘রাহুলকে…মারবে না৷ যে মারবে তাকে আমি…মেরে ফেলব৷’

কথা শেষ করেই নেনের চুলের মুঠি খামচে ধরল ও৷ মাথাটা টেনে শূন্যে তুলল৷ তারপর ভয়ংকর জোরে ঠুকে দিল মাটিতে৷

নেনে গোঁ-গোঁ করতে লাগল৷ মাকু বাইকে বসে হতবুদ্ধি হয়ে ভাইয়ের করুণ অবস্থা দেখতে লাগল৷

‘রাহুলকে মারবে না৷ রাহুলকে…’ নেনের দিকে আগুন-ঝরা চোখে তাকিয়ে ছিল কোকো৷ নেনের চুলের মুঠিটা ওর হাতে ধরা ছিল৷ সেই অবস্থাতেই বিড়বিড় করে কথাগুলো বলছিল৷

রাহুল ছুটে গিয়ে কোকোর হাত চেপে ধরল : ‘কোকো! কোকো! কী করছ! ছাড়ো—ও যে মরে যাবে!’

রাহুলের দেখাদেখি ঝন্টুদা, নিধু, গোপাল ওরাও কোকোর কাছে ছুটে এসেছিল৷ কোকোকে থামাতে চেষ্টা করছিল, ওকে হাত ধরে টেনে সরানোর চেষ্টা করছিল৷

অনেক কষ্টে কোকোকে শান্ত করা গেল৷ নেনেকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও৷ তারপর রাহুলের একটা হাত চেপে ধরল৷ ভাবটা এমন যেন এই হাতটা ও আর ছাড়বে না৷

রাহুল ওকে নিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল৷

কোকো হাঁপাচ্ছিল৷ নেনের দিকে তাকিয়ে ছিল৷ ঝন্টুদারা তখন নেনেকে ধরে তুলে দাঁড় করাচ্ছে৷

নেনে বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল৷ ওর কপালে রক্ত৷ কোকোর দিকে ও এমনভাবে চেয়ে আছে যেন অন্য গ্রহের প্রাণী দেখছে৷

ঝন্টুদা পকেট থেকে রুমাল বের করে নেনের কপালের রক্ত মুছে দিল৷ বলল, ‘ফেরার পথে একটু ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ো—৷’

নেনে কোনও জবাব দিল না৷

ঝন্টুদারা নেনের জামাকাপড় হাত দিয়ে ঝেড়েঝুড়ে ওকে মাকুর বাইকের দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল৷

মাকু বাইক থেকে নামেনি৷ আগের দিনের মতো ও আর তর্জন-গর্জন করছিল না৷ নেনেও একেবারে চুপ৷ ভালো করে কারও দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত৷

ঝন্টুদা মাকুকে বলল, ‘মাকু, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে৷ কোকো তো অত বোঝে না৷ আসলে রাহুলকে ও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে৷ রাহুলকে কেউ কিছু করলে ও কেমন পাগলের মতো হয়ে যায়৷ যাকগে, তুমি ব্যাপারটা ভুলে যাও৷ আর একটা কথা : এটা নিয়ে থানা-পুলিশ কোরো না৷ আমরাও ব্যাপারটা আর মনে রাখব না৷’

মাকু ছোট্ট করে ঘাড় নাড়ল৷

ঝন্টুদা আর নিধু নেনেকে ধরে বাইকে বসাল৷ ঝন্টুদা মাকুর পিঠে হাত দিয়ে বলল, ‘তোমরা তো ক্লাব-ঘর করবে৷ আমি দেখছি—সুটেবল কোনও ঘর পাওয়া যায় কি না৷ আর শোনো…’ মাকু তাকাল ঝন্টুদার দিকে৷ ঝন্টুদা বলল, ‘আমরা তোমার শত্রু নই৷ প্লিজ, আজকের ব্যাপারটা ভুলে যেয়ো৷’

মাকু আর নেনে চলে গেল৷ ওদের ছুটন্ত বাইকের পিছনে ধুলোর মেঘ তৈরি হল৷

ঝন্টুদা, নিধু, গোপাল নিজেদের মধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল৷ আর রাহুল কোকোর হাত ধরা অবস্থায় ভাবছিল ওর অদ্ভুত আচরণের কথা৷ এই বলছে, ‘আমি আর লড়ব না৷ কাউকে মারব না৷ কষ্ট দেব…না৷ মারব…না৷’ আবার পরক্ষণেই রাহুলকে ‘রক্ষা’ করতে সে পেশাদার যোদ্ধার তৎপরতায় শত্রুকে ঘায়েল করছে!

কোকোর লড়াই দেখে রাহুলের মনে হচ্ছিল শুধু সিনেমায় এরকম লড়াই দেখা যায়৷ তা ছাড়া বহুদিন প্র্যাকটিস না করলে কারও পক্ষে এরকম দক্ষতায় পৌঁছনো সম্ভব নয়৷

বাড়ি ফেরার পথে রাহুল কোকোকে জিগ্যেস করল, ‘কোকো, এরকম ফাইটিং তুমি কোথায় শিখলে?’

‘শিখেছি ভগবতীপ্রসাদের কাছে৷’

‘কে ভগবতীপ্রসাদ?’

‘আমার ট্রেনার৷ আট বছর…আমি ট্রেনিং নিয়েছি৷ তারপর…৷’ হঠাৎ চুপ করে গেল কোকো৷ ওকে দেখে রাহুলের মনে হল, ও কী যেন ভাবছে৷ বোধহয় কোনও কিছু মনে করার চেষ্টা করছে৷

‘আট বছর ট্রেনিং নেওয়ার পর কী করেছ? তারপর কী?’

কোকো রাহুলের দিকে তাকাল৷ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘তারপর অনেক ফাইট করেছি৷ অনেক লড়াই…করেছি৷ অনেক জিতেছি৷ অনেক ফাইট করেছি…৷’

রাহুল অবাক হয়ে কোকোর দিকে তাকিয়ে রইল৷

৷৷ছয়৷৷

কয়েকদিন পর এক অদ্ভুত ঘটনায় মাঝরাতে রাহুলের ঘুম ভেঙে গেল৷

ও অদ্ভুত সব শব্দ শুনতে পাচ্ছিল৷ যন্ত্রণার শব্দ—তার সঙ্গে কথা৷

‘ওঃ! ওঃ! মাস্টারজি! ছেড়ে দাও! আমি…আর…করব না৷ আমাকে…ছেড়ে দাও৷ ওঃ…৷’

দু-হাতে চোখ ডলে অন্ধকার মেঝের দিকে তাকাল রাহুল৷ চাপা কর্কশ গলায় টুকরো কথাগুলো কে বলছে ও ভালোই বুঝতে পারল৷ কিন্তু ও অন্ধকারে কোকোর শরীরটা ভালো করে ঠাহর করতে পারছিল না৷

লাল আর সবুজ রঙের আলোর ঝিলিক চোখে পড়ল রাহুলের৷ ছোট-ছোট রঙিন আলোর বিন্দু জোনাকির মতো জ্বলছে-নিভছে৷

রাহুলের ঘুম ছুটে গেল৷ ভালো করে চোখ রগড়ে বিছানায় উঠে বসল ও৷ চাপা গলায় ডাকল, ‘কোকো! কোকো! কী হয়েছে?’

কোকোর কাছ থেকে কোনও উত্তর এল না৷ ওর যন্ত্রণার আর্তনাদ আর টুকরো কথা চলতেই লাগল৷

রাহুল এবার বিছানা থেকে নেমে পড়ল৷ বহুদিনের অভ্যাসে ওর ডানহাত সহজেই পৌঁছে গেল আলোর সুইচের কাছে৷ আলো জ্বালতেই কোকোকে দেখতে পেল ও৷

কোকোর দু-চোখ বোজা৷ শরীরটা মেঝের বিছানা থেকে গড়িয়ে চলে এসেছে বাইরে৷ গলার কন্ট্রোল ব্যান্ডটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরে ও ছটফট করছে, গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ কন্ট্রোল ব্যান্ডের গায়ে লাল আর সবুজ আলো দপদপ করে জ্বলছে৷ ইলেকট্রনিক খেলনায় যেমন ছোট-ছোট রঙিন বাতি থাকে সেইরকম৷

রাহুল ছুটে গেল কোকোর কাছে৷ ঝুঁকে পড়ে ওকে জোরে ধাক্কা দিল : ‘কোকো! কোকো!’

কয়েকবার ধাক্কা দিতেই কোকো চোখ খুলল৷ ওর ছটফটানি থেমে গেল৷ রাহুল দেখল, ও কুলকুল করে ঘামছে৷

কোকো উঠে বসল৷ বড়-বড় শ্বাস ফেলছে৷ চোখে-মুখে ভয়৷ কন্ট্রোল ব্যান্ডটা এখনও দু-হাতে আঁকড়ে ধরে আছে৷ ওটার লাল-সবুজ বাতি এখন নিভে গেছে৷

রাহুল বসে পড়ল ওর পাশে৷

‘কী হয়েছে, কোকো? কী হয়েছে?’ ওর ঘামে ভেজা গালে হাত বোলাতে-বোলাতে রাহুল বলল, ‘কোনও বাজে স্বপ্ন দেখেছ?’

কোকো ভয়ার্ত চোখে রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাস্টারজি… আসছে৷ কাছে…এসে গেছে৷’

‘তোমার গলার ওই ব্যান্ডটাতে আলো জ্বলছিল৷ লাল…সবুজ…৷’

কোকো ব্যান্ডটা ছেড়ে দিল৷ হাত দিয়ে মুখ মুছল৷ চাপা গলায় বলল, ‘মাস্টারজি…কাছে এসে গেলে ওরকম…আলো জ্বলে৷ আর…মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়…৷’

কোকোর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে রইল রাহুল৷ এই শিশু-যুবকের আতঙ্ক আর কষ্ট দেখে ওর মায়া হচ্ছিল৷ ‘মাস্টারজি…আসছে৷ কাছে…এসে গেছে৷’ এর মানে কী? মাস্টারজি কাছে এসে গেলে ওই লাল-সবুজ আলোগুলো জ্বলে, কোকোর মাথায় যন্ত্রণা হয়?

ভেবে-ভেবে কোনও থই পাচ্ছিল না রাহুল৷ ও উঠে গিয়ে জলের বোতল নিয়ে এল৷ ছিপি খুলে বোতলটা এগিয়ে দিল কোকোর হাতে : ‘নাও—জল খাও৷’

ঢকঢক করে অনেকটা জল খেল কোকো৷ তখনও ও অল্প-অল্প হাঁপাচ্ছে৷ বোধহয় মাস্টারজির আতঙ্কের রেশ এখনও কাটেনি৷

বেশ কিছুক্ষণ পর কোকো শান্ত-স্বাভাবিক হল৷ তখন রাহুল আলো নিভিয়ে আবার শুয়ে পড়ল৷

কোকো আপনমনে ছবি আঁকছিল৷ রাহুল ওর পাশে বসে ছবি আঁকা দেখছিল৷

যে-ছবিটা কোকো আঁকতে চেষ্টা করছিল সেটা রাহুলদের স্কুল৷ যদিও ছবিটা দেখে সেটা বোঝা খুব শক্ত৷ তবে রাহুল যে স্কুলটাকে একটু-একটু চিনতে পারছিল তার কারণ, ওদের স্কুল বিল্ডিং-এর পাশে চারটে বড়-বড় গাছ আছে৷ আর তার পাশ ঘেঁষেই একটা বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং৷ কোকোর ছবিতে—বিমূর্ত এবং বিকৃত চেহারায় হলেও—সেগুলো আঁকা আছে৷ যদি তারপরেও কারও বুঝতে অসুবিধে হয় সেইজন্য ছবির মাথায় আঁকাবাঁকা হরফে লেখা আছে : ‘রাহুলের ইশকুল৷’

রাহুলের আজ স্কুল ছুটি৷ স্কুলের ফাউন্ডেশান ডে৷ তাই দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর ও কোকোর সঙ্গে গল্প করতে বসেছে৷ ওর ইচ্ছে, কোকোর মাস্টারজি সম্পর্কে আরও কিছু খবর জেনে নেয়৷

কিছুক্ষণ এটা-সেটা নিয়ে কথা বলার পর কোকো ছবি আঁকার বায়না ধরল৷ তখন রাহুল ওকে জল রং আর কাগজ দিয়ে ছবি আঁকতে বসিয়েছে৷ আর ছবি আঁকা নিয়ে টুকটাক কথা বলার ফাঁকে মাস্টারজি সম্পর্কে দু-চারটে প্রশ্ন করেছে৷ কোকো ওর খেয়াল মতো কখনও প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, কখনও দিচ্ছে না৷ ও মেঝেতে ‘বাবু’ হয়ে বসে ঘাড় গুঁজে একমনে কাগজের ওপরে রং বুলিয়ে চলেছে৷

রাহুল ওর আঁকা ছবিটা দেখছিল৷ কোকোর আঁকা দেখে বোঝা অসম্ভব যে, ওর মা ভালো ছবি আঁকত৷

রাহুল বলল, ‘কোকো, লাল রংটায় আর-একটু জল মেশাও—হালকা করে নাও৷ মাস্টারজি কোথায় থাকে?’

‘অনেক দূরে৷ এখন…কাছে…এসে গেছে৷ এইখানটায় সবুজ রং দিই?’

রাহুল ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল৷ ওর মনে পড়ল, শুরু থেকে কোকো সবসময় বলে এসেছে মাস্টারজি দূরে থাকে৷ কিন্তু ইদানীং ও বলছে, মাস্টারজি কাছে এসে গেছে৷ সেই কাছে এসে যাওয়াটা কি কোকোর গলার কন্ট্রোল ব্যান্ডে ধরা পড়েছে?

‘না, না—নীল রং দিয়ো না৷ তুমি তো জানো গাছের পাতা সবুজ হয়৷’

কোকো ছবি থেকে মুখ তুলে তাকাল রাহুলের দিকে৷ হেসে বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ৷ গাছের…পাতা…সবুজ হয়৷ সবুজ…৷’

‘মাস্টারজির কাছে আর কে-কে আছে, কোকো?’

‘আকাশ তো নীল৷ তাই…না, রাহুল?’

‘হ্যাঁ, নীল৷ আর কে-কে আছে মাস্টারজির কাছে?’ রাহুল আবার জানতে চাইল৷

‘আকাশ নীল৷ আকাশ…নীল৷ রাহুল বলেছে৷’ আপনমনেই খুশি হয়ে মাথা নাড়ল৷ তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘সুলতানদা আছে৷ রামুদা…আছে৷ ময়না…আছে৷’

অবাক হল রাহুল৷ সুলতানদা, রামুদা, ময়না—এরা কারা?

বারবার প্রশ্ন করেও কোকোর কাছ থেকে আর কোনও সূত্র পাওয়া গেল না৷

‘এটা তো গাছের গুঁড়ি৷ এটা ব্রাউন রং দাও৷ বাদামি৷’

কোকো গাছের গুঁড়িতে সবুজ রং দিতে যাচ্ছিল৷ রাহুলের কথায় ও নতুন উৎসাহে বাদামি রং গুলতে শুরু করল৷

‘এই গাছের গুঁড়িটাও বাদামি রং হবে৷’ ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল রাহুল, ‘আচ্ছা কোকো, মাস্টারজি তো বলছ কাছে এসে গেছে৷ যদি তোমার একেবারে সামনে এসে পড়ে তা হলে কী হবে?’

ছবি আঁকা থামিয়ে দিল কোকো৷ চোখ বড়-বড় করে তাকাল রাহুলের দিকে : ‘আমার…তখন…খুব ভয় করবে৷’ বাঁ-হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিল ও৷ রাহুলের দুটো আঙুল চেপে ধরে আস্তে-আস্তে বলল, ‘কিন্তু…রাহুলকে ছেড়ে…আমি যাব না৷ মাস্টারজি ভয় দেখালেও… না৷ যাব না৷’

রাহুল কোকোর মুঠোর মধ্যে অদ্ভুত এক উষ্ণতা খুঁজে পেল৷ ও আঙুল দুটো ছাড়িয়ে নিল না৷ কোকোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷

কিছুক্ষণ পর রাহুলের হাত ছেড়ে দিল ও৷ আবার ছবি আঁকায় মন দিল৷

গত একসপ্তাহে চারবার কোকোর কন্ট্রোল ব্যান্ডের লাল-সবুজ এল. ই. ডি. বাতি জ্বলে উঠেছে৷ আর একইসঙ্গে কোন এক রহস্যময় যন্ত্রণায় কোকো ছটফটিয়ে উঠেছে৷ রাহুল ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না৷ কেনই বা আলো জ্বলছে, আর কেনই বা কোকো ছটফট করে উঠছে? মাস্টারজির সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্কই বা কী?

কোকো যে ধীরে-ধীরে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে সেটা রাহুল বেশ বুঝতে পারছিল৷ ঘিয়া নদীর পাড়ে কোকোকে প্রথম যখন রাহুল দেখেছিল তখন ওকে দিগভ্রান্ত, জড়বুদ্ধি, মানসিক রোগী বলে মনে হয়েছিল৷ এখন ও কত পালটে গেছে! সবসময় হাসিখুশি৷ হাসিমুখে কত না পরিশ্রমের কাজ করে ও! ওর গায়ের জোর গ্রামে একরকম কিংবদন্তী হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ গ্রামের সবাই কোকোকে ভালোবাসে৷ ঝন্টুদা দেখা হলেই কোকোকে আইসক্রিম কিংবা পেপসি খাওয়ায়৷ ঝন্টুদা লাইব্রেরির কোনও কাজের কথা বললেই কোকো একপায়ে খাড়া৷ তবে ওকে বুদ্ধির কাজ কেউ দেয় না—দেয় শক্তির কাজ৷

কোকো সবসময় রাহুলের পিছন-পিছন ঘোরে৷ রাহুলকে চোখের আড়াল হতে দেয় না৷ রাহুল কখনও বারণ করলেও ও শোনে না৷ রাহুলকে মাকু আর নেনের কথা বলে৷ বলে, ‘আমি সঙ্গে থাকলে… তোমাকে কেউ কিছু করবে না৷ আমার গায়ে…জোর আছে৷’

ওর কথায় রাহুল হাসে৷

এর মধ্যে বেশ কয়েকদিন নেনে আর মাকুর সঙ্গে ওদের দেখা হয়েছে৷ কিন্তু মাকুরা গায়ে পড়ে কোনও কথা বলেনি৷ চুপচাপ এড়িয়ে গেছে৷

কোকোকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে-ঘুরতে রাহুল একদিন চলে এসেছিল ঘিয়া নদীর পাড়ে৷

বর্ষা কবেই এসে গেছে৷ সেই বর্ষার জলে নদী ফুলে উঠেছে৷ দুপাশের গাছপালার দল সবুজে-সবুজে মাতোয়ারা৷

রাহুল কোকোকে নিয়ে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করল৷ নদীর ঘোলাটে জল ওদের পাশে-পাশে ছুটছে৷

রাহুল বলল, ‘কোকো, মনে পড়ে, এই নদীতে তুমি ভেসে এসেছিলে? ওই গাছটার নীচে—’ আঙুল তুলে গাছটা দেখাল রাহুল : ‘—তুমি পড়ে ছিলে৷’

কোকো নদী বরাবর তাকাল৷ অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল৷ তারপর আস্তে-আস্তে বলল, ‘মনে…আছে৷ আমি…সাঁতার…জানি…৷’

‘আমিও সাঁতার জানি৷’ বলল রাহুল, ‘তুমি কি মাস্টারজির কাছ থেকে পালিয়ে এসেছিলে?’

রাহুলের দিকে তাকাল কোকো৷ মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ৷

‘কেন, পালিয়ে এসেছ কেন?’

কোকো চুপ করে রইল৷ ওর শূন্য চোখ নদীর জলের দিকে তাকিয়ে রইল৷ কিন্তু রাহুল বুঝতে পারল ও নদীর জল দেখছে না—অন্য কিছু ভাবছে৷

আকাশ মেঘলা৷ বৃষ্টি নেই৷ কিন্তু শেষ বৃষ্টির জল এখনও মাটি ভিজিয়ে রেখেছে৷ গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে কোথায় যেন বুলবুলি আর দোয়েল ডাকছে৷ নদীর সঙ্গে বয়ে আসা এক অদ্ভুত হাওয়া রাহুলের মনখারাপ করে দিচ্ছিল৷

কোকো হঠাৎ নদীর পাড়ে বসে পড়ল৷ নদীর জলের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল৷

রাহুলও বসে পড়ল ওর পাশে৷ ওর পিঠে হাত রাখল : ‘কোকো, তুমি পালিয়ে এসেছিলে কেন?’

কোকো আলতো ফিসফিসে গলায় বলল, ‘মাস্টারজি…আমাকে…মারত৷ সিগারেটের…ছ্যাঁকা দিত৷ তাই নদীতে…ঝাঁপ দিয়ে…পালিয়ে এসেছি৷’

‘তোমাকে মারত কেন মাস্টারজি?’

‘আমি আর লড়তে চাইনি…তাই৷’ কথাটা বলে কোকো বড়-বড় শ্বাস ফেলতে লাগল৷

‘কার সঙ্গে লড়তে চাওনি?’ রাহুলের ভেতরে কৌতূহলের ঘূর্ণিপাক শুরু হয়ে গিয়েছিল৷

‘কারও সঙ্গে না৷ আমি বলেছি…আমি আর…লড়ব না৷ কাউকে…মারব না৷ কষ্ট…দেব না৷’

রাহুল আবার ওকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি কার সঙ্গে লড়তে চাওনি?’

কোকো কোনও জবাব দিল না৷ শুধু রাহুলের হাতটা পিঠ থেকে নামিয়ে জোরে আঁকড়ে ধরল৷ ফিসফিস করে বলল, ‘আমার মা নেই৷ বাবা নেই৷ কেউ…নেই৷’

একই কথা বারবার বলতে লাগল কোকো৷ বলতে-বলতে ও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল৷ রাহুলের দিকে আর্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না, রাহুল৷’

রাহুল ছোট বাচ্চাটাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল৷

কোকোকে নিয়ে রথের মেলায় গিয়েছিল রাহুল৷ রেললাইন পেরিয়ে আরও বেশ খানিকটা গেলে একটা বিশাল মাঠ৷ মাঠটার নাম ‘শকুন্তলার মাঠ’৷ কেন যে এরকম নাম কেউ জানে না৷ সেই মাঠে প্রতি বছরেই রথের মেলা বসে৷

মেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ দৈত্যের মতো নাগরদোলা৷ এ ছাড়া রয়েছে অনেক মণিহারী দোকান, খাবারের স্টল, খেলনাপাতির দোকান, পাঁপড়ভাজা আর তেলেভাজার দোকান৷ এসবের সঙ্গে এই মেলা উপলক্ষ্যেই থাকে পাখির হাট৷ নানান ধরনের রঙিন পাখির পসরা সাজিয়ে বসে দোকানিরা৷ টিয়া, চন্দনা, বদ্রিকা থেকে শুরু করে আরও কতরকম পাখি!

চারপাশে লোকজনের হইচই, হারিয়ে যাওয়া বাচ্চার কান্না, মাইকের হিন্দি গান, সবমিলিয়ে এক অদ্ভুত শব্দব্রহ্ম তৈরি হয়েছিল৷ তারই মধ্যে কোকো আর রাহুল মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছিল৷

বাপি আর মামের কাছে বায়না করে রাহুল কোকোকে নিয়ে মেলায় এসেছে৷ বাপিকে ও বোঝানোর চেষ্টা করেছে কোকো যত স্বাভাবিক জীবনে মিশবে তত তাড়াতাড়ি ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে৷ মেলায় আসার সময় বাপি রাহুলের হাতে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছেন৷

এখন সেই পঞ্চাশ টাকা ভাঙিয়েই ওরা মেলার আনন্দ কুড়োচ্ছিল৷ নাগরদোলায় চড়া, তেলেভাজা আর পাঁপড়ভাজা খাওয়া, তার সঙ্গে কোকোর প্রিয় পেপসি—একের পর এক চলছিল৷

একটা খেলার দোকানে বল ছুড়ে ন’টা কাঠের পুতুলকে কাত করে দেওয়ার কমপিটিশান হচ্ছিল৷ তিনবারের চেষ্টায় ন’টা পুতুলকে শুইয়ে দিতে পারলেই পাওয়া যাবে পুরস্কার—মাঝারি মাপের স্টেইনলেস স্টিলের একটা বাটি৷

রাহুল পাঁচ টাকা দিয়ে কমপিটিশানে নাম দিল৷ তিনবার বল ছুড়ে ও সাতটা পুতুলকে কাত করে দিল বটে কিন্তু পুরস্কার জিততে পারল না৷

রাহুল বল ছোড়ায় নাম দেওয়ার জন্য কোকোকে বলল৷ কিন্তু কোকো বারবার মাথা নেড়ে জানাল যে, ওর হাতে একদম টিপ নেই৷

এরপর ওরা এয়ারগান শুটিং-এর স্টলে গেল৷ দেওয়ালে লাগানো নানা রঙের বেলুন৷ তারই একপাশে বেলুন লাগানো চক্র ঘুরছে, সুতোয় বাঁধা প্লাস্টিকের বাঘ-সিংহ, এমনকি জ্বলন্ত মোমবাতি আর পেরেকও ঝুলছে৷

রাহুল পাঁচবার ফায়ার করে দুটো বেলুন ফাটাতে পারল৷ কিন্তু কোকো এবারেও রাজি হল না৷ মাথা নেড়ে বলল, ‘আমার…হাতে টিপ নেই৷’

মেলায় ঘুরতে-ঘুরতে কখন যেন সন্ধে নেমে এসেছে৷ চারপাশের খুঁটিতে লাগানো হ্যালোজেন আলো জ্বলে উঠেছে৷ স্টলে জ্বলে উঠেছে বালব আর টিউবলাইট৷ লোকের ভিড় আরও বাড়ছে৷ মাইকে মেলার কর্তৃপক্ষ কীসব যেন ঘোষণা করছে৷

একটা স্টলের সামনে বহু মানুষের ভিড় দেখে রাহুল দাঁড়িয়ে পড়ল৷ কোকোকেও হাত ধরে টেনে থামাল৷

ভিড় ঠেলে রাহুল আর কোকো কয়েকটা স্তর এগিয়ে গেল৷ দেখল, স্টলে একটা বিচিত্র কমপিটিশানের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷

স্টলের ঠিক মধ্যিখানে একটা পুরোনো টিউবওয়েল পোঁতা আছে৷ টিউবওয়েলের কলের মুখে একটা নীল রঙের প্লাস্টিকের বালতি বসানো৷ আর টিউবওয়েলের গায়ে, হাতলে, ফুলের মালা জড়ানো৷ স্টলের কাপড়ের দেওয়ালে বেশ কয়েকটা পোস্টার আঁটা৷ পোস্টারে যা লেখা আছে তার সারমর্ম হল : এই টিউবওয়েলটা পাম্প করে সহজে জল তোলা যায় না; যদি কেউ দশবার পাম্প করে তার মধ্যে এই কল থেকে জল বের করতে পারে তা হলে পুরস্কার একশো টাকা৷

প্রতিযোগিতায় নাম দেওয়ার এন্ট্রি ফি দশ টাকা৷

স্টলের মালিক চিৎকার করে চ্যালেঞ্জারকে আহ্বান জানাচ্ছিল : ‘আসুন, দেখিয়ে দিন আপনার গায়ে কত জোর! এই বেয়াদব টিপকলটাকে শায়েস্তা করুন—!’

রাহুল দেখল, গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারার অনেকেই বেশ আশা নিয়ে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে নামছে, কিন্তু হার মেনে ফিরে আসছে৷ কলের মুখ দিয়ে এক ফোঁটাও জল বেরোচ্ছে না৷

ভিড়ের মধ্যে থেকে কে একজন বলল, ‘তোমার এই টিপকল থেকে জল আদৌ বেরোয় তো?’

অমনি স্টলের মালিক তার পাশে দাঁড়ানো লোকজনের মধ্যে কাকে যেন ইশারা করল৷ স্যান্ডো গেঞ্জি পরা স্বাস্থ্যবান একটি ছেলে কলের সামনে এগিয়ে গেল৷ মালিকের নির্দেশে জোরালো হ্যাঁচকা দিয়ে টিউবওয়েলটা পাম্প করতে লাগল৷ আর মালিক চিৎকার করে এক থেকে দশ গুনতে লাগল৷ তার সঙ্গে-সঙ্গে পাবলিকও হইহই করে গলা মেলাল৷

আটবারের বার কলের মুখ থেকে সরু সুতোর মতো জল বেরোল৷ তারপরের দুবারে জলের ধারাটা লাঠির মতো মোটা হল৷

তারপর ছেলেটা থামল৷ জনতা চিৎকারে ফেটে পড়ল৷

রাহুল কোকোকে ঠেলা মারল : ‘কোকো নাও—এবার নাম দাও…৷’

কোকো কিন্তু মাথা নাড়ল৷ বলল, ‘না, রাহুল—না৷’

রাহুল ওকে ছাড়ল না৷ বলল, ‘কেন, ‘‘না’’ কেন? এবারে তো আর টিপের ব্যাপার না—গায়ের জোরের ব্যাপার৷ তুমি যে বল তোমার গায়ে অনেক জোর! তা হলে ‘‘না’’ বলছ কেন?’

‘না, সেজন্যে না—৷’ আলতো করে বলল কোকো৷

‘তা হলে কী জন্যে?’

‘দোকানদারের একশো টাকা…মার যাবে৷ তাই—৷’

রাহুল হেসে ফেলল৷ কোকোকে বোঝাল যে, দোকানদার ইতিমধ্যেই অনেক টাকা লাভ করেছে৷ এখন একশো টাকা গেলে তার কোনও ক্ষতি হবে না৷

রাহুল কোকোর হয়ে এন্ট্রি ফি জমা দিল৷ তারপর কোকোকে ঠেলে টিউবওয়েলটার দিকে এগিয়ে দিল৷

কোকো টিউবওয়েলের হাতলের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই পাবলিক হইহই করে উঠল৷ কোকো হাতলটা ধরে সামান্য ঝুঁকে পজিশন নিল৷

দোকানদার চিৎকার করে প্রতিযোগিতার ব্যাপারে নানান ঘোষণা করছিল৷ কোকো হাতলটা ধরে দাঁড়াতেই সে বলল, ‘আপনি রেডি? এ—ক৷’

কোকো টিউবওয়েল পাম্প করা শুরু করল, আর দোকানদারও গোনা শুরু করল৷

কোকো যেটা করছিল সেটা হাই স্পিড সিনেমার মতো৷ ওর তিন নম্বর পাম্পের সঙ্গে-সঙ্গে জল বেরোতে শুরু করল৷ কিন্তু কোকো না থেমে পাম্প করে চলল৷ ছ’নম্বর পাম্পে জলের ধারাটা ময়াল সাপের মতো মোটা হয়ে গেল৷

রাহুল চিৎকার করছিল, ‘কোকো৷ থামো! থামো!’ কিন্তু পাবলিকের হল্লায় ওর কথা চাপা পড়ে গেল৷

দোকানদার ব্যস্তভাবে কোকোর কাছে গিয়ে ওকে থামাল৷ ওকে শাবাশ দিয়ে একশো টাকা পুরস্কার তুলে দিল ওর হাতে৷ তারপর চেঁচিয়ে বলতে লাগল কোকোর কৃতিত্বের কথা : ‘এইমাত্র একজন পালোয়ান জিতে নিয়েছেন এ-ক-শো টাকা৷ ভাইসব, আমার এই কমপিটিশানে কোনও কারচুপি নেই, কোনও চিটিংবাজি নেই৷ আপনারা এগিয়ে আসুন…৷’

কোকো আর রাহুল ভিড় ঠেলে বাইরে এল৷ রাহুল কোকোর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘কনগ্র্যাচুলেশান, কোকো—শাবাশ!’

কোকো একশো টাকার নোটটা রাহুলের দিকে এগিয়ে দিল : ‘এটা রেখে দাও৷’

রাহুল টাকাটা পকেটে রেখে বলল, ‘এই টাকাটা মাম আর বাপিকে দেব৷ বলব, কী সহজে তুমি প্রাইজ জিতেছ—৷’

ওরা দুজনে গল্প করতে-করতে ‘শকুন্তলার মাঠ’ ছেড়ে বেরিয়ে এল৷

ফেরার পথে রেললাইনটা পেরোতেই ওরা মাকুদের দেখতে পেল৷ আগাছার ঝোপের পাশে একটা টালির ছাউনি দেওয়া ঘর৷ তার ভেতরে বসে মাকুরা তাস খেলছে৷ ঘরের ভেতর থেকে টিভির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে৷

‘তাড়াতাড়ি পা চালাও’ বলে রাহুল কোকোর হাত ধরে টানল৷ মাকুদের বিশ্বাস নেই৷ যখন-তখন ঝামেলা বাধাতে পারে৷

ওরা যখন বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে তখন কোকো হঠাৎই এক অদ্ভুত কাণ্ড করল৷

রাস্তার ওপরেই সদানন্দদার চায়ের দোকান৷ বেড়া আর খুঁটির মাথায় টিনের চাল৷ দোকানের সামনে দুপাশে দুটো বেঞ্চি৷ তাতে জনা-চারেক খদ্দের—খবরের কাগজ পড়ছে, চা খাচ্ছে৷

সদানন্দদার দোকানের পাশেই নীলুকাকুর লন্ড্রি৷ নীলুকাকুর চোখে হাই পাওয়ারের চশমা৷ রোগা দুর্বল চেহারা৷ গায়ে ফুলশার্ট আর পাজামা৷ ওর দোকানটার চেহারা ওর মতোই পুরোনো৷ শোকেসের কাঠ কালচে হয়ে গেছে৷ কাচের ওপরে বাদামি ছোপ পড়েছে৷ দোকানের শাটার রং চটা, জং ধরা৷

দোকান বন্ধ করার জন্য সেই শাটারটাই টেনে নামাতে চেষ্টা করছিল নীলুকাকু৷ কিন্তু পারছিল না৷ সেইজন্য চেঁচিয়ে সদানন্দদাকে ডাকছিল—যদি সে একটু হাত লাগিয়ে দেয়৷ কিন্তু সদানন্দদা চা তৈরিতে ব্যস্ত—নীলুকাকুর ডাকে সাড়া দিয়ে সে বারবার বলছিল, ‘একটু সবুর করো, কাকা—যাচ্ছি৷’

পথ চলতে-চলতে কোকো এসব দেখছিল, শুনছিল৷ হঠাৎই ও রাহুলের পাশ থেকে ছুট লাগল নীলুকাকুর লন্ড্রির দিকে৷ কর্কশ গলায় বলল, ‘সরে দাঁড়াও, কাকা৷ আমি…আমি শাটার নামিয়ে…দিচ্ছি৷’

কথাগুলো বলতে যতক্ষণ লাগল তার অনেক কম সময়ে শাটারের কাছে পৌঁছে গেল কোকো৷ বাঁ-হাতে শাটার ধরে অনায়াসে টান মারল৷ প্রতিবাদের ধাতব জিগির তুলে জং ধরা শাটার অটোমেটিক এলিভেটরের মতো নেমে এল৷ শাটারের ঘর্ঘর শব্দে চায়ের দোকানের খদ্দেররা মুখ ফিরিয়ে তাকাল৷

নীলুকাকু তখন কোকোর থুতনিতে আঙুল দিয়ে ওকে আহ্লাদ করছে৷ বলছে, ‘ও, তুই! তোকে আগে দেখতে পাইনি রে৷ পেলে তোকেই বলতাম৷ লক্ষ্মী ছেলে! তোর ভালো হোক৷’

কোকো হেসে ‘আসি’ বলল৷ তারপর ছুট্টে চলে এল রাহুলের কাছে৷

রাহুল বলল, ‘কোকো, তোমাকে নিয়ে আর পারি না! বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ ছুট লাগালে?’

‘নীলুকাকুর শাটারটা…খুব শক্ত৷ আগেও দু-দিন আমি…ওটা টেনে নামিয়ে দিয়েছি…৷’

রাহুল অবাক হয়ে কোকোর মুখের দিকে তাকাল৷

বেশ কিছুদিন ধরেই কোকো একা-একা রাস্তায় বেরোয়, মামের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মুদিখানার জিনিস কিনতে যায়৷ বলতে গেলে মণিমেলার সব রাস্তাই ও এখন চিনে গেছে৷ তা ছাড়া ওকে এলাকার সবাই ভালো করে চেনে, ভালোও বাসে৷

আবার রাহুলের পাশে-পাশে হাঁটতে লাগল কোকো৷ ওদের পাশ দিয়ে প্যাঁক-প্যাঁক হর্ন বাজিয়ে একটা সাইকেল রিকশা চলে গেল৷ একটা সাইকেল ভ্যান নানারকম শাকসবজি নিয়ে রাস্তার ধারের লাইটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার পাশেই একটা টাইমকল৷ তার সামনে ভিড়৷ জল নেওয়ার জন্য চার-পাঁচজন লোক কলসি, বালতি, জলের বোতল নিয়ে লাইন দিয়ে আছে৷ আকাশে মেঘের পাতলা ঝালর৷ তার আড়ালে অসম্পূর্ণ চাঁদ৷

আজ বিকেল থেকে গুমোট ভাব ছিল৷ এখন হঠাৎ যেন হাওয়ার সুড়সুড়ি টের পেল রাহুল৷ ওর মনটা খুশি-খুশি হয়ে উঠল৷ ও ভাবছিল, বাড়িতে ঢুকে বাপি আর মামকে ঠিক কীভাবে কোকোর টিউবওয়েল কমপিটিশান জেতার খবরটা জানাবে৷

ঠিক তখনই একটা অশ্বত্থগাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একটা ছায়া৷ কোকোর নাম ধরে ডাকল৷

‘অ্যাই, কোকো!’

রাহুল আর কোকো দুজনেই চমকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল সেদিকে৷

জায়গাটা অন্ধকার৷ রাস্তার আলো ভালো করে পৌঁছয়নি সেখানে৷ গাছের কালো গুঁড়ির পাশে অস্পষ্ট একটা কালো ছায়া৷

‘কোকো—’ আবার ডাকল সেই ছায়া৷

কোকো এগিয়ে গেল অশ্বত্থগাছটার কাছে৷ পিছনে রাহুল৷

ছায়াকে চিনতে পারল কোকো : ‘সুলতানদা! তুমি!’

‘হ্যাঁ—আমি৷’ বলে সুলতান ওকে জড়িয়ে ধরল : ‘তুই কেমন আছিস?’ ওকে ছেড়ে দিয়ে ওর মুখটা ভালো করে দেখতে লাগল সুলতান৷

‘ভালো…আছি৷’ কোকো বলল৷

‘শোন—তোর খুব বিপদ৷ মাস্টারজি তোকে খুঁজছে৷’

সঙ্গে-সঙ্গে কোকোর গলার কন্ট্রোল ব্যান্ডের লাল আর সবুজ আলো জ্বলে উঠল৷ এবং কোকো যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল৷ ব্যান্ডটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরে ও অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে লাগল৷ ছটফট করতে-করতে ওর শরীরটা মাটিতে পড়ে গেল৷ যন্ত্রণার টুকরো শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল ওর মুখ থেকে৷

৷৷সাত৷৷

সে-রাতটা রাহুলদের বলতে গেলে না ঘুমিয়েই কাটল৷ কারণ সুলতান যে-কাহিনি শোনাল তারপর রাহুল, ওর বাপি আর মামের দুশ্চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক৷

কোকোকে সামলে নিয়ে ধরে-ধরে বাড়ির দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল রাহুল—সঙ্গে সুলতান৷ যেতে-যেতে সুলতান রাহুলের সঙ্গে অল্প-অল্প কথা বলছিল৷

‘কোকো হারিয়ে যাওয়ার পর মাস্টারজি খেপে একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিল৷ তখন আমাদের পাঁচজনকে পাঁচদিকে খুঁজতে পাঠায়৷ সে তার রাগ কী! রেগে একেবারে আগুন৷ আমাকে বলে কি ‘‘জাহান্নম থেকে হলেও ওই মেড়াটাকে খুঁজে নিয়ে আয়৷’’ রাগে একদম গরগর করছিল৷’

‘এখন কী হবে?’ ভয় পেয়ে জিগ্যেস করল রাহুল৷

‘দেখি কী হয়৷’ চিন্তার সুরে বলল সুলতান৷ কোকোর কাঁধে আলতো চাপড় মেরে হাসল : ‘আসলে এই খোকাটাকে আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি৷ ও খুব ভালো ছেলে৷ কিন্তু ওই কন্ট্রোল ব্যান্ড…৷’

‘কন্ট্রোল ব্যান্ড কী?’

‘ওই…মাস্টারজির কন্ট্রোল৷’

ওরা ততক্ষণে রাহুলদের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিল৷

একটু পরে ওরা সবাই বসবার ঘরে গুছিয়ে বসল৷ কল্যাণবাবু বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে খিল লাগিয়ে দিলেন৷ রাস্তার দিকের জানালাগুলোও ভেজিয়ে দিলেন৷ তারপর সুলতানের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন৷ রাহুলের মাম স্বামীকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় ফিসফিস করে বললেন, ‘আমার তো বুক কাঁপছে৷ রাহুল এই লোকটাকে কোথা থেকে জুটিয়ে নিয়ে এল? কী হবে এখন? তুমি বরং পুলিশে খবর দাও—৷’

কল্যাণবাবু স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘এখন না৷ আগে এর সঙ্গে কথা বলে দেখি৷ লোকটা এমনিতে খারাপ না৷ কোকোকে খুব ভালোবাসে—’ স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে কল্যাণবাবু অনুরোধ করলেন, ‘আমাদের একটু চা-টা খাওয়াবে না?’

রাহুলের মাম ‘নিয়ে আসছি’ বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন৷

কল্যাণবাবু সুলতানের মুখোমুখি বসলেন৷ ভাবলেন, লোকটাকে দেখে তো শয়তান বলে মনে হচ্ছে না৷ একটু কথা বলে দেখা যাক না৷ কোকোকে সহজে আমরা ছাড়ব না৷

সুলতানের বয়েস চল্লিশ-বিয়াল্লিশ৷ চেহারা মাঝারি৷ রং ময়লা৷ গাল বসা৷ থুতনিতে কাঁচাপাকা দাড়ি৷ কথা বলার সময় মাঝে-মাঝেই ভুরুজোড়া ওপরদিকে তোলে৷ গায়ে হালকা সবুজ হাফশার্ট আর ময়লা হয়ে যাওয়া জিনসের প্যান্ট৷

একটু পরেই মাম চা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন৷ বাপিকে চা দিলেন৷ সুলতানকে দিলেন৷ নিজেও নিলেন৷ তারপর কোকোর পাশে গিয়ে বসলেন৷

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সুলতান মাস্টারজির কাহিনি বলতে শুরু করল৷

‘স্যার, কলকাতার কাছাকাছি খড়দায় মাস্টারজির একটা অনাথ আশ্রম আছে৷ ‘‘করুণাময়ী’’ নাম৷ সেখানে বাপ-মা মরা হ্যান্ডিক্যাপ ছেলেরা থাকে৷ মাস্টারজি ওদের দু-বেলা খেতে দেয়, থাকতে দেয়—আর কাজ শেখায়৷ কাজ তো সব নানারকমের : রাজমিস্ত্রির কাজ, ছুতোরমিস্ত্রির কাজ, লেদ কারখানার কাজ, গেঞ্জির কল চালানোর কাজ, আরও কতরকম৷

‘মাস্টারজির অনেক কলকারখানা আছে, ব্যবসা আছে, কলকাতার সল্টলেকে তিনতলা জমকালো একটা বাড়ি আছে৷ লোক বলে, মাস্টারজি বহুরকম দু-নম্বরি ব্যবসার সঙ্গে মিলেজুলে আছে৷ একবার জাল নোট মার্কেটে ছাড়তে গিয়ে গোয়েন্দা-পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল৷ তিনমাস জেলও খেটেছিল৷ তারপর জেল থেকে বেরিয়ে কীভাবে যেন পুলিশের সঙ্গে লাইন করে নিয়েছিল৷’

বাপি জিগ্যেস করলেন, ‘কোকো ওই ‘‘করুণাময়ী’’-তে গেল কীভাবে?’

‘কীভাবে আবার! ওর নসিব৷’ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল সুলতান৷ একটু উসখুস করল৷ তারপর : ‘মাস্টারজির দলে অনেক আড়কাঠি আছে—দালাল৷ ওরা সব হ্যান্ডিক্যাপ ছেলের খবর আনে৷ তারপর ওই আশ্রমে ওদের ভরতি করে মাস্টারজি কমসেকম একটা বছর ঠিকঠাক চালায়৷ দ্যাখে যে, কেউ ওই ছেলেগুলোর খোঁজখবর করতে আসছে কি না৷ মানে, বাবা, মা, রিলেটিভ কেউ আসছে কি না৷ তারপর কেউ না এলে তখন মাস্টারজি নিশ্চিন্ত হয়৷ নিজের মতো করে ওদের ট্রেনিং চালু করে৷’

‘কীসের ট্রেনিং?’ রাহুল জিগ্যেস করল৷

উত্তরে মলিন হাসল সুলতান৷ বলল, ‘ওই হরেকরকম কাজ শেখানোর ট্রেনিং৷ কলকারখানার কাজের ট্রেনিং৷ এ ছাড়া আছে ফাইটিং-এর ট্রেনিং…৷’

‘ফাইটিং-এর ট্রেনিং!’ মাম অবাক হয়ে বললেন৷

‘হ্যাঁ৷ অনাথ আশ্রমে মাস্টারজির একটা ইল্লিগাল ক্লাব আছে৷ নাম ‘‘ফাইট ক্লাব’’৷ এই ক্লাবের কথা অনেকে জানে৷ পুলিশও জানে৷ তবে ওই টাকাপয়সা দিয়ে সেখানে মাস্টারজি লাইন করে রেখেছে আর কী! তো ওই ক্লাবে সপ্তাহে দু-দিন কি তিনদিন ফাইট কমপিটিশান হয়৷ দুজন ফাইটার বাজি ধরে লড়াই করে৷ সে-লড়াই নিয়ে দর্শকরাও বাজি ধরে৷ লড়াইয়ের পর ফাইটারদের টাকা দেওয়া হয়৷ যে জেতে সে পায় বেশি৷ যে হারে সে পায় কম৷ তবে কম পেলেও সে-টাকা অনেক৷ এর লোভে অনেকেই লড়াইয়ে নাম দেয়৷

‘আশ্রমের ছেলেদের বাচ্চা বয়েস থেকেই মাস্টারজি ট্রেনিং করায়৷ রেগুলার ব্যায়াম শেখায়, মারপিটের হরেক টেকনিক শেখায়৷ একজন ট্রেনার তাই-কোন্ডো শেখায়৷ নাম ভগবতীপ্রসাদ৷ ব্ল্যাক বেল্ট৷ একবার শুনেছি এশিয়ার চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল৷ কোকো ওর খুব ফেবারিট ছাত্র৷ আট বছর ধরে কোকোকে লড়াই শেখাচ্ছে৷’

সুলতান একবার কোকোর দিকে তাকাল৷ কোকো শূন্য দৃষ্টি নিয়ে সরল মুখে বসে আছে৷ ওর চোখ সুলতানের দিকে৷

সুলতান আপনমনে মাথা ঝাঁকাল৷ সকলের মুখের ওপরে চোখ বুলিয়ে নিল৷ একটা বড় শ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করল৷

‘ট্রেনিং দেওয়া ছেলেগুলোর মধ্যে থেকে মাস্টারজি ‘‘ফাইটার বয়’’-দের বেছে নেয়৷ তারপর ওদের খালি হাতে লড়াইয়ের স্পেশাল ট্রেনিং করায়৷ তারপর…তারপর ওরা ওই ‘‘ফাইট ক্লাব’’-এর জুয়ায় নাম দেয়৷ সেখান থেকে মেলা টাকা ইনকাম করে৷ ওদের সামান্য হাতখরচা দিয়ে বাকি টাকা মাস্টারজি চোট করে দেয়৷ তাই ‘‘ফাইটার বয়’’-দের মাস্টারজি সহজে হাতছাড়া করে না৷

‘আর কোকো?’ কোকোর দিকে ইশারা করে আক্ষেপের হাসি হাসল সুলতান : ‘ও এ পর্যন্ত একটাও লড়াই হারেনি৷ ও হচ্ছে ‘‘ফাইটার বয়’’-দের মধ্যে গোল্ডেন বয়৷ জুয়েল৷ সুপার হিরো৷ ওকে লড়াইয়ে নামিয়ে মাস্টারজি লক্ষ-লক্ষ টাকা ইনকাম করেছে৷ তাই কোনও অবস্থাতেই ওকে হারাতে চায় না মাস্টারজি৷ ওর খোঁজে মাস্টারজি আমাদের পাঁচজনকে লড়িয়ে দিয়েছে৷ আমিই সবার আগে কোকোকে খুঁজে পেলাম…কিন্তু মাস্টারজিকে সে-কথা কেমন করে জানাব! এই ছেলেটাকে আমি যে বড় ভালোবাসি…৷’ কথা বলতে-বলতে কোকোর দিকে তাকাল সুলতান৷ ওর চোখে স্নেহ আর আদর ঝরে পড়ছিল৷

হঠাৎই মোবাইল ফোন বেজে উঠল৷ আচমকা এই সুরেলা আওয়াজে সবাই চমকে উঠল৷

সুলতান তড়িঘড়ি পকেটে হাত ঢোকাল, ফোন বের করল৷ ইনকামিং কলের নম্বরটা দেখার পর ও এমনভাবে ফোনটার দিকে তাকিয়ে রইল যেন হাতের মুঠোয় একটা ঝুমঝুমি সাপ ধরে আছে৷

ওর হাবভাব দেখে কারও আর বুঝতে বাকি রইল না যে, ফোনটা কে করেছে৷

বাপির মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল সুলতান৷ চোখে জিজ্ঞাসা : এখন কী করবে?

বাপি ইশারায় ওকে ফোনটা ধরতে বললেন৷

‘হ্যালো—৷’ ফোনটা ধরেই সুলতান লাউডস্পিকার অন করে দিল—যাতে সবাই ও-প্রান্তের কথা শুনতে পায়৷

‘কে, সুলতান? মেড়াটাকে খুঁজে পেলি?’ মাস্টারজির ক্ষিপ্ত গলা৷

‘না, মানে…এখনও পাইনি৷ খুঁজছি৷’ ইতস্তত করে বলল সুলতান৷

‘তুই এখন কোথায়?’

‘মণিমেলায়…৷’

ও-প্রান্ত কিছুক্ষণ চুপ৷ তারপর : ‘আমরা মণিমেলা থেকে বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার মতো দূরে আছি৷ আমার গাড়িতে একজন লোকাল লোককে তুলে নিয়েছি—লোকটা ঘিয়া নদীর আশপাশের গ্রামগুলো সব চেনে৷ তুই ভালো করে বিচ্ছুটাকে খোঁজ৷ ওটাকে পেলে আর লড়াব না৷ ‘‘করুণাময়ী’’-তে এনে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেব—যাতে আর কোনও ‘‘ফাইটার বয়’’ এরকম বেয়াদপি না করে৷’

মাস্টারজির শাস্তির কথাটা শুনে মামের মুখ থেকে ভয়ে একটা হেঁচকির শব্দ বেরিয়ে এল৷ সঙ্গে-সঙ্গে মাম মুখে হাত চাপা দিলেন—পাছে আবার কোনও শব্দ হয় এবং সেটা ফোনে শোনা যায়৷

সুলতানের মোবাইল সেটটা নিশ্চয়ই বেশ দামি, কারণ মাস্টারজি যে মামের চাপা আর্তনাদটা ফোনে শুনতে পেয়েছে সেটা পরের কথাতেই বোঝা গেল৷

‘সুলতান, তুই এখন কোথায়? কার বাড়িতে, উঁ?’ প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটু ব্যঙ্গের খোঁচা৷

‘না, না—কারও বাড়িতে নয়৷ একটা…চায়ের দোকানে…৷’

‘হুঁ—বুঝেছি৷’

ফোন ছেড়ে দিল মাস্টারজি৷

সুলতান ভয় পেয়ে গেল : ‘এখন কী হবে? মাস্টারজি যদি এখানে চলে আসে?’

মাম বললেন, ‘শিগগির পুলিশে খবর দাও৷’

‘দাঁড়াও৷’ হাতের ইশারা করলেন বাপি : ‘আমাকে একটু ভাবতে দাও—৷’

কোকো এবার কথা বলল : ‘না, আমি এ-বাড়ি ছেড়ে…কোথাও যাব না…৷’

বাপি ওর দিকে একবার তাকালেন শুধু—কোনও কথা বললেন না৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করলেন৷

মাম বললেন, ‘মণিমেলায় মাস্টারজি যদি আসেও আমাদের বাড়ি কেমন করে খুঁজে পাবে? কোকো এখানেই থাক৷ যদি কোনও বিপদ-আপদ হয় তখন বরং থানায় খবর দেওয়া যাবে৷’

সুলতান মাথা চুলকোচ্ছিল৷ কী যেন ভাবছিল৷

রাহুল এতক্ষণ চুপ করে ছিল৷ কোকোকে দেখছিল৷ ও বাপিকে লক্ষ করে বলে উঠল, ‘কোকোকে আমরা ছাড়ব না, বাপি৷ ও আমাদের কাছে থাকবে৷’

বাপি পায়চারি করতে-করতে থুতনিতে কয়েকবার আঙুল বোলালেন৷ থানা-পুলিশ করলে ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে ওরা কী করবে কে জানে! হয়তো জেলখানাতে রেখে দেবে৷ নয়তো ফাইল চালাচালি করে কোনও পাগলা-গারদেই পাঠিয়ে দেবে৷

বাপি আর ভাবতে পারছিলেন না৷

সুলতান বলল, ‘স্যার, আমি পাপী-তাপী মানুষ৷ মাস্টারজির পয়সা খেয়ে বেঁচে আছি৷ কিন্তু এই ছেলেটা বড় ভালো৷ মানে, ওকে আমার খুব ভালো লাগে৷ ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি৷ আপনারা ওকে কাছছাড়া করবেন না৷ মাস্টারজি এখানে আসে আসুক৷ তখন দেখা যাবে৷ যা হয় হবে…৷’

সুলতানের কথাটা সবার মনে ধরল৷ মামের মুখে হাসি ফুটে উঠল৷ রাহুলও ওর খুশির ভাবটা চেপে রাখতে পারছিল না৷

বাপি চেয়ারে বসে পড়লেন আবার৷ সুলতানকে বললেন, ‘আচ্ছা, ওই মাস্টারজি তো আমাদের বাড়িটা খুঁজে নাও পেতে পারে…৷’

মাথা নেড়ে হাসল সুলতান : ‘উঁহু—সেটা হওয়ার জো নেই৷ ওই যে, ওর গলার ওই কন্ট্রোল ব্যান্ড৷ মাস্টারজির কাছে একটা রিমোট আছে৷ ওটার রেঞ্জ প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার৷ ওই রিমোট দিয়ে কন্ট্রোল ব্যান্ডটাকে কন্ট্রোল করা যায়৷ ওই ব্যান্ডটা যদি কারও গলায় পরানো থাকে তা হলে ওই রিমোটের বোতাম টিপে বোঝা যায় লোকটা কত দূরে আছে৷ আর যার গলায় ওটা পরানো থাকে তাকে ওই রিমোটের বোতাম টিপে শায়েস্তা করা যায়…৷’

‘শায়েস্তা মানে?’ বাপি জিগ্যেস করলেন৷

‘মানে, রিমোটের বোতাম টিপলে কোকোর বডির ভেতর দিয়ে কীসব ওয়েভ যাবে৷ তাতে কোকোর যন্ত্রণা হবে, ও কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করবে৷ আর-একটা লাল রঙের বোতাম আছে—সেটা টিপলে মাথা ধরবে, মাথার যন্ত্রণা হবে, মাথা ঘুরবে৷ মাস্টারজি ফরেন থেকে এরকম মেশিন বেশি কয়েকটা আনিয়েছে৷ ‘‘ফাইটার বয়’’-দের মধ্যে যারা একটু বেয়াড়া, এই মেশিনগুলো তাদের জন্যে৷ গলার ওই ব্যান্ডগুলো এমন যে, রিমোটের ঠিকঠাক বোতাম না টিপে ওগুলো গলা থেকে খুলতে গেলে অসহ্য পেইন হবে৷ যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যাবে…৷’

রাহুলের মনে পড়ল, কোকো ওর গলার ওই ব্যান্ডটায় কাউকে কখনও হাত দিতে দেয় না৷ মরিয়া হয়ে বাধা দেয়৷

‘কোকোকে নিয়ে মাস্টারজির কি প্রবলেম হচ্ছিল যে, ওর গলায় কন্ট্রোল ব্যান্ড পরিয়ে দিয়েছে?’ মাম সুলতানকে জিগ্যেস করলেন৷

সায় দিয়ে মাথা নাড়ল সুলতান : ‘হ্যাঁ—প্রবলেম হচ্ছিল৷’ কোকোর দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ও৷ নরম গলায় বলল, ‘কোকো ‘‘ফাইট ক্লাব’’-এ আর লড়তে চাইছিল না৷ ও আমাকে আড়ালে বলত ওর মনের কথা৷ বলত, ‘‘আমি আর লড়ব না৷ কাউকে আর মারব না৷ কষ্ট দেব না৷’’ এইসব কথা বলত সবসময়…৷

‘একদিন ও বেঁকে বসল৷ বলল, কিছুতেই ও আর লড়বে না৷ মারপিট করতে ওর আর ভালো লাগে না৷ মাস্টারজির সামনে রুখে দাঁড়াল৷ সেদিন থেকেই মাস্টারজি ছেলেটার ওপরে টরচার শুরু করল৷ মারধোর…সিগারেটের ছ্যাঁকা…কী না সয়েছে এই ভোলাভালা ছেলেটা…৷’ কথা বলতে-বলতে উঠে দাঁড়াল সুলতান৷ কোকোর কাছে এগিয়ে গেল৷ ওর মাথায় হাত রাখল : ‘মাস্টারজির চামচেগিরি করে আমিও ওকে কম টরচার করেছি! কিন্তু আশ্রমে একদিন দেখি ছেলেটা আমার ঘরে ঢুকে আমার মায়ের ফটো বুকে জড়িয়ে কাঁদছে৷ আমার আম্মি বহুদিন আগেই মারা গেছে৷ কোকো সেটা জানত৷

তো আমি তাজ্জব হয়ে ওকে জিগ্যেস করলাম, ‘‘কী রে, কী ব্যাপার? আমার মায়ের ফটো নিয়ে কাঁদছিস কেন?’’

‘ছেলেটা…এই হ্যান্ডিক্যাপ পাগলটা…আমাকে কী বলল জানেন, স্যার? বলল, ‘‘সুলতানদা, আমার মা নেই৷ মায়ের কোনও ফটোও নেই৷ তাই তোমার মায়ের ফটোটা নিয়েছি…৷’’

‘সেইদিন থেকে…সেইদিন থেকে, স্যার…আমি ওকে আমার ‘‘ভাই’’ ডেকেছি৷’ সুলতান চোখে কিছু একটা পড়েছে এমন ভান করে চোখ মুছল৷ একটু বসা গলায় বলল, ‘জানেন স্যার, অনেকবার ভেবেছি মাস্টারজির দল ছেড়ে দেব৷ কোকোকে নিয়ে কোথাও চলে যাব—কিন্তু পারিনি৷ পাপী পেট কা সওয়াল৷ ক’টা টাকার লোভে মাস্টারজির দলে পড়ে থেকেছি৷ মাস্টারজির আর-পাঁচটা পোষা গুন্ডার মধ্যে আমিও একটা হয়ে গেছি৷ কোকোকে সেভ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি৷ ওর ব্যাপারে মাস্টারজি আমাকে সন্দেহ করত৷ তাই কোকো নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালানোর পর মাস্টারজি আমার সঙ্গে-সঙ্গে আরও চারজনকে কোকোর খোঁজে লড়িয়ে দিয়েছে৷’

মাম জিগ্যেস করলেন, ‘কোকো নদীতে ঝাঁপ দিল কেমন করে?’

সুলতান ফিরে এসে ওর চেয়ারে বসল৷ একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, ‘কয়েকজনের টিম নিয়ে মাস্টারজি বর্ধমানের একটা ফাইট কমপিটিশানে যাচ্ছিল৷ যারা গান-টান গায় তারা যেমন ফাংশান-টাংশান করতে যায় সেরকম মাস্টারজিও ‘‘ফাইট বয়’’-দের নিয়ে মাঝে-মাঝে গ্রামে-গঞ্জে যেত৷ বড়-বড় টাকার বাজি হত সেখানে৷ কোকো যেতে চায়নি, কিন্তু ওকে জোর করে গাড়িতে তুলেছিল মাস্টারজি৷ গাড়িতে আমিও ছিলাম৷ শিবাইচণ্ডীর কাছে—একটা নদীর ব্রিজ সবে পেরিয়েছি—আমাদের গাড়ির টায়ার পাংচার হল৷ তো আমরা কয়েকজন গাড়ি থেকে নেমে নদীর ধারে পায়চারি করছিলাম৷ আগের দিন রাতে মাস্টারজি আর ওর পোষা গুন্ডাগুলো কোকোকে কয়েকঘণ্টা ধরে টরচার করেছিল৷ কারণ সেই একই—ও আর লড়তে চাইছিল না৷ এমনি-এমনি কাউকে ও আর মারতে চাইছিল না৷

‘তো আমরা কয়েকজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম৷ মাস্টারজি গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে টায়ার পালটানো দেখছিল৷ তখন কোকো হঠাৎ নদীতে ঝাঁপ দেয়৷ সেটা খেয়াল করতেই আমরা চেঁচিয়ে উঠি৷ মাস্টারজি ছুটে আসে নদীর পাড়ে৷ তারপর দৌড়ে গিয়ে গাড়ি থেকে রিমোটটা নিয়ে আসে৷ পাগলের মতো এ-বোতাম সে-বোতাম টিপতে থাকে৷ কিন্তু কোনও লাভ হয়নি৷ কোকো ততক্ষণে নজরের বাইরে চলে গেছে৷

‘ওকে হারিয়ে আমি দুঃখ পেয়েছিলাম ঠিকই৷ দুশ্চিন্তাও হয়েছিল৷ কোথায় না কোথায় গিয়ে পড়বে হ্যান্ডিক্যাপ ছেলেটা! দু-বেলা কীভাবে ওর খাবার জুটবে! আবার খুশিও হয়েছিলাম, স্যার৷ যে মাস্টারজির হাত থেকে খোকাটা আজাদ হতে পেরেছে…৷’

সুলতান উঠে দাঁড়াল৷ চারপাশে তাকিয়ে হাত নেড়ে বলল, ‘এখানে দেখছি কোকো খুব ভালো আছে৷ আপনারা ওকে ঘরের একজন করে নিয়েছেন…৷’ কোকোর কাছে এগিয়ে গেল সুলতান৷ ওর গালে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, ‘কোকো, তুই এখানে থেকে যা৷ এখান থেকে আর কোথাও যাস না৷ এটা জন্নত৷’

কোকো হেসে বলল, ‘রাহুলকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না৷’

মাম উঠে দাঁড়ালেন৷ কোকোর মাথাটা মাতৃস্নেহে কাছে টেনে নিলেন৷ বললেন, ‘তোকে আমরা কিছুতেই ছাড়তে পারব না৷ তুই এত ভালো৷ এ-গ্রামের সবাই তোকে ভালোবাসে…৷’

কথায়-কথায় রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল৷ সুলতান হাতঘড়ি দেখে বলল, ‘স্যার, সব তো আপনাদের খুলে বললাম—এবারে বলুন আপনারা কী করবেন…৷ আমি কি চলে যাব—না আপনারা আমাকে পুলিশে দেবেন?’

মাম আর বাপি মুখচাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন৷

সুলতান আক্ষেপের গলায় বলল, ‘লাইফে অনেক পাপ করেছি৷ কিন্তু এই অনাথ ছেলেটার হেনস্থা আমার আর সহ্য হচ্ছে না৷ মাস্টারজি আমাকে পেলে হয়তো মার্ডারই করে ফেলবে৷ সে করুক৷ কিন্তু কোকোর…৷’

রাহুল আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘না, সুলতানদা, তুমি আমাদের সঙ্গে থাকো৷ মাস্টারজি এলে আমরা মাস্টারজিকে বোঝাব…বলো না, বাপি—৷’ বলে বাপির দিকে তাকাল রাহুল৷

বাপি বললেন, ‘হ্যাঁ—রাহুল ঠিকই বলেছে৷ মাস্টারজিকে আমরা বোঝাব…বলব যে…’, স্ত্রীর দিকে ফিরে তাকালেন : ‘বলব যে, কোকো আমাদের সঙ্গে থাকুক৷ দরকার হয় মাস্টারজিকে আমি টাকা অফার করব…৷’

মাম মাথা নেড়ে বাপির কথায় সায় দিলেন৷ বললেন, ‘মাস্টারজি আসা অবধি সুলতানভাইয়ের থাকা দরকার৷’ সুলতানের দিকে তাকিয়ে মাম বললেন, ‘আপনি আজকের রাতটা আমাদের কাছে থেকে যান—৷’

সুলতান হেসে বলল, ‘থ্যাংকস—৷’

রাহুল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই কোকো যন্ত্রণায় ছটফট করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল৷ ওর গলার ব্যান্ডের লাল আর সবুজ বাতি দপদপ করে জ্বলতে শুরু করেছে৷

বাপি আর মাম ওকে জাপটে ধরলেন৷ সামলাতে চেষ্টা করলেন৷ রাহুল অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল৷

সুলতান চাপা গলায় বলল, ‘মাস্টারজি মনে হয় আরও কাছে এসে গেছে৷’

সঙ্গে-সঙ্গে সুলতানের মোবাইল ফোন বাজতে শুরু করল৷

৷৷আট৷৷

গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন রাহুলকে জাগিয়ে দিল৷ তখন সবে রাতের আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে৷ আকাশে চাপ-চাপ মেঘ থাকায় জায়গায়-জায়গায় গাঢ় ছাই রং জমাট বেঁধে ছিল৷ তা ছাড়া বৃষ্টির শব্দ পাচ্ছিল রাহুল৷ পাশের বাড়ির টিনের চালে আর গাছের পাতায় একই বৃষ্টি দুরকমের আওয়াজ তুলছিল৷ ব্যাপারটা অনেকটা যুগল-বন্দির মতো শোনাচ্ছিল৷

কাল রাতে খাওয়া-দাওয়ার পাট সেরে রাহুলরা যখন বিছানায় শুয়েছে তখন রাত অনেক গড়িয়ে গেছে৷ তারপর অন্ধকার ঘরে টেনশানে জেগে ছিল তিনটি মানুষ : রাহুল, সুলতান, আর কোকো৷ কিছুতেই ওরা দু-চোখের পাতা এক করতে পারছিল না৷

পাশের ঘরে বাপি আর মামেরও একই অবস্থা৷ কোকোকে নিয়ে টানাপোড়েনের যন্ত্রণা ওঁদের দু-জনকেই কষ্ট দিচ্ছিল৷ কোকোকে হারানোর আতঙ্কে মাম ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন৷

রাহুল এখন শুধু ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনেনি, হেডলাইটের আলোও দেখতে পেয়েছিল৷ কারণ, খোলা জানলার পরদা ভেদ করে আলোর ছটা ঢুকে পড়েছিল ঘরের ভেতরে৷ তারপর গাড়ির চলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আলোর জ্যামিতিটা দেওয়ালে ধীরে-ধীরে সরে গিয়ে রাহুলের বুককেসের ওপরে থেমেছে৷ এবং পরক্ষণেই নিভে গেছে৷

রাহুলের বুকের ভেতরটা ধড়াস-ধড়াস করে উঠল৷ আবছা আলোয় ও তাকাল মেঝেতে শুয়ে থাকা সুলতান আর কোকোর দিকে৷ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে-থেকে ওরা এখন ঘুমোচ্ছে৷ বোধহয় ক্লান্তিতে আর জেগে থাকতে পারেনি৷ শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছে৷

ইঞ্জিনের শব্দটা বাড়ির কাছ ঘেঁষে এসে থামল৷

রাহুল বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল৷ বেশ টের পেল ওর হাত-পা কাঁপছে৷

ও সুলতানের কাছে গেল৷ ঝুঁকে পড়ে জোরে ঠেলা মরাল ওকে : ‘সুলতানদা! সুলতানদা! ওঠো—ওঠো!’

সুলতান ধড়মড়িয়ে জেগে উঠল৷ অন্ধকারে রাহুলকে ঠাহর করতে চেষ্টা করল৷

‘শ-শ-শ-শ’ শব্দ করে সুলতানকে চুপ করে থাকতে ইশারা করল রাহুল৷ তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘জানলা দিয়ে দ্যাখো তো৷ একটা গাড়ির আওয়াজ পেলাম—৷’

ঘুম কেটে গেল সুলতানের৷ ও চট করে উঠে দাঁড়াল৷ খুব সাবধানে জানলার কাছে গেল৷ দু-চোখে হাত ঘষে পরদা সরিয়ে উঁকি মারল৷

রাহুলদের বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটা কোয়ালিস গাড়ি৷ হালকা আলোয় গাড়ির রংটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না৷ তবে সাদা, কি ছাই, অথবা রুপোলি রঙের হতে পারে৷

বুকটা ধক করে উঠল সুলতানের৷ মাস্টারজির রুপোলি রঙের একটা কোয়ালিস গাড়ি আছে!

রাহুল সুলতানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল৷ দেখল, গাড়ির দরজা খুলে নেমে এল চারজন লোক৷ ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই ওরা ব্যস্ত-ভাবে রাহুলদের গ্রিলের গেট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল৷ চার-জনের মধ্যে একজনের হাঁটার ভঙ্গিটা কেমন যেন চেনা মনে হল রাহুলের৷

আর দেরি করল না রাহুল৷ ছুটে চলে গেল ঘরের দরজার কাছে৷ এক্ষুনি বাপি আর মামের ঘরে গিয়ে ডাকা দরকার৷

দরজা খুলতেই বাপি আর মামকে দেখতে পেল ও৷ লোহার গেটের শব্দে ওঁরা জেগে উঠেছেন৷ জানলা দিয়ে লোকগুলোকে দেখেওছেন৷

চাপা গলায় দ্রুত পরামর্শ করল সবাই৷ মাম বাপিকে বললেন, ‘কী হবে এখন? থানায় ফোন করবে?’

বাপি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু তার আগেই কলিংবেল বেজে উঠল৷

দু-তিন সেকেন্ড চুপ করে থেকে বাপি চোয়াল শক্ত করে বললেন, ‘আর কিছু করার নেই৷ মোকাবিলা করতে হবে৷’

কথাগুলো বলেই বাপি সুইচবোর্ডের কাছে গেলেন৷ আলোর সব ক’টা সুইচ জ্বেলে দিলেন৷ রাহুলকে বললেন, ‘বাড়ির সব আলো এক্ষুনি জ্বেলে দে৷ আর কোকো কোথায়?’

‘ঘুমোচ্ছে৷’

‘ওকে শিগগির ডেকে তোল—৷’

রাহুল ব্যস্তভাবে ছুট লাগাল৷ ওর সঙ্গে-সঙ্গে সুলতানও ছুটল৷

এর মধ্যেই কলিংবেল আরও তিনবার বেজে উঠেছে৷ বেল বাজানোর ঢঙেই বোঝা গেল যারা এসেছে তারা বেশ অধৈর্য হয়ে উঠেছে৷

এবার বন্ধ দরজায় ধাক্কা পড়ল—পরপর তিনবার৷

তার একটু পরেই রাহুলের নাম ধরে কে ডেকে উঠল : ‘রাহুল! রাহুল!’

রাহুল চমকে উঠল৷ চেনা গলা৷ কিন্তু কে যেন?

এর মধ্যেই ও কোকোকে ধাক্কা দিয়ে ডেকে ঘুম থেকে তুলেছে৷

সব আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য বাড়িটা আলোয় আলোময়৷ বন্ধ দরজা থেকে চার-পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল সবাই৷ যেন কোনও একটা মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য অপেক্ষা করছিল৷

আবার ধাক্কা৷ আবার ‘রাহুল৷ রাহুল৷’

কোকো ভয় পেয়ে রাহুলের হাত জড়িয়ে ধরল৷

বাপি কেমন যেন মরিয়া হয়ে উঠলেন৷ বললেন, ‘খুলে দিই৷ নইলে ওরা দরজা ভেঙে ফেলবে৷’

দরজা খুলতেই ওপিঠ থেকে জোরালো ধাক্কা মারল কেউ৷ একটা পাল্লা দেওয়ালে বাড়ি খেল৷ আর বাপি ছিটকে গেল একপাশে৷ একঝলক জোলো বাতাস ছুটে এল ভেতরে৷

বাপিকে তাচ্ছিল্যের ধাক্কায় সরিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ল চারজন৷

চারজনের শরীরই জলে ভেজা৷ তার মধ্যে শুধু প্রথমজনকে চিনতে পারল রাহুল৷ মাকু৷ ভিজে চুল কপালে নেমে এসেছে৷ মুখে-চোখে বৃষ্টির জল পড়লেও ঘুমের ছাপ এখনও মুছে যায়নি৷ ওর চোয়াল নড়ছে৷ কী যেন চিবোচ্ছে৷

দ্বিতীয় লোকটা টাকমাথা৷ বেঁটে৷ দাড়ি-গোঁফ কামানো৷ ময়লা রোগাটে চেহারা৷ কুতকুতে চোখ৷ কালো প্যান্টের ওপরে একটা ঢোলা খয়েরি শার্ট৷ শার্টটা জলে ভিজে গাঢ় রঙের দেখাচ্ছে৷ হাতে সোনালি ব্যান্ডের একটা ঘড়ি৷

লোকটার সামনের ওপরের পাটির দাঁতগুলো উঁচু৷ ফলে একটা খরগোশ-খরগোশ ভাব এসেছে৷ হঠাৎ করে দেখলে মজার কমেডিয়ান বলে মনে হয়৷

কিন্তু আসলে যে তা নয় সেটা ওর হাতের গাঢ় নীল পিস্তলটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷

মাকু দ্বিতীয় লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাস্টারজি—ওই যে রাহুল৷’ একইসঙ্গে রাহুলের দিকে চোখের ইশারা করল ও৷

মাস্টারজি কাশল দুবার৷ বাঁ-হাত দিয়ে বৃষ্টি-ভেজা মুখ মুছল৷ তারপর রাহুলদের দিকে চোখ রেখেই খেঁকিয়ে উঠে হুকুম দিল, ‘শিকলি, দরজাটা ভালো করে এঁটে দে৷ যেন পাবলিক ডিসটারবেন্স না হয়…৷’

হুকুমটা শোনামাত্রই সবচেয়ে পিছনে যে ছিল—শিকলি—সে দরজাটা বন্ধ করে খিল আর ছিটকিনি ভালো করে এঁটে দিল৷

মাস্টারজি ভেতরে ঢুকে এল৷ সুলতানের কাছে এসে দাঁতে দাঁত চেপে নীচু গলায় একটা গালাগাল দিল৷ তারপর ওর থুতনি ধরে নেড়ে দিয়ে চওড়া হেসে বলল, ‘সালা, এটা তোর চায়ের দোকান?’ পরক্ষণেই গলা মিহি করে সুলতানকে নাটুকে ঢঙে ভেংচাল : ‘কোকোকে এখনও পাইনি, মাস্টারজি—খুঁজছি৷’

একটু থেমে শাসানির গলায় মাস্টারজি বলল, ‘‘করুণাময়ী’’-তে চল—তোর হিসেব নিচ্ছি৷’

সুলতান কাঁচুমাচু মুখে হাতজোড় করে বলল, ‘মাস্টারজি, মাপ করে দিন৷ গলতি হয়ে গেছে৷ প্লিজ, মাস্টারজি…৷’

মাস্টারজি দাঁত বের করে হাসল, বলল, ‘মাপ করে দেব—অ্যাঁ? এতবড় গুস্তাকি মাপ করে দেব?’

চোখের পলকে হাতের পিস্তলটা সাঁ করে ঘুরিয়ে সুলতানের গালে বসিয়ে দিল মাস্টারজি৷

কালীপটকা ফাটার মতো শব্দ হল৷ সুলতানের গালে রক্তের রেখা দেখা দিল৷ সুলতান ‘ইয়া আল্লা’ বলে দু-হাতে মুখ চেপে মেঝেতে বসে পড়ল৷

মাম আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন৷ মাকুর চোখে-মুখে ভয়ের ছায়া৷ আর বাপি তো পাথর!

রাহুল স্পষ্ট টের পেল কোকোর হাতটা থরথর করে কাঁপছে৷ ও মনে-মনে চাইছিল, মামের চিৎকারটা যেন প্রতিবেশীদের কেউ শুনতে পায়, যেন তারা সাহায্যের জন্য ছুটে আসে৷

কিন্তু কাকভোরে এই বৃষ্টির মধ্যে কে আসবে!

মাস্টারজি পিস্তলটা কোমরে গুঁজে নিল৷ অস্ত্রটা ঢোলা শার্টের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল৷

পকেট থেকে সিগারেট আর দেশলাই বের করল হিংস্র লোকটা৷ ঘাড় কাত করে সিগারেট ধরাল৷ ‘উঁ-উঁ’ করে শব্দ করল মুখে৷ তারপর ধোঁয়া ছাড়ল৷ সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাইয়ের বাক্স পকেটে ভরে কয়েকবার হেঁচকি তুলে হাসল৷

হঠাৎই যেন মাকুর কথা মনে পড়ে গেছে এমন ভাব করে পিছনে তাকাল মাস্টারজি৷ তারপর ওর কাছে এগিয়ে গেল৷ যেতে-যেতে পিস্তলটা আবার বের করে নিল৷

সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে মাকুর পিঠ চাপড়ে দিল মাস্টারজি : ‘ভাগ্যিস রেললাইনের ধারে এই ছোঁড়াটার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল৷ ওরা বসে-বসে তাস পিটছিল…’ পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করল মাস্টারজি৷ ওটা মাকুর হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নাও, ভাই—তোমার প্রাইজ মানি৷ তাস খেলায় তুমি জিতছিলে—আমার সঙ্গে এসে তোমার তো লস হয়ে গেছে৷ তো এই নোটটা দিয়ে পুষিয়ে নিয়ো—কেমন?’

মাকু টাকাটা পকেটে ভরে কাঠ-কাঠভাবে হেসে ঘাড় কাত করল : ‘থ্যাংকস—৷’

শুরুতে মাস্টারজির পিস্তলটা দেখামাত্রই বাপি আর মাম ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন৷ ওঁদের ভয় হচ্ছিল, এই বুঝি মাস্টারজি রাহুল কিংবা কোকোকে লক্ষ্য করে গুলি করে বসবে৷

কিন্তু এতক্ষণে বোধহয় বাপি একটু সাহস জুগিয়ে উঠেছিলেন৷ কোনও-রকমে আমতা-আমতা করে বললেন, ‘মাস্টারজি, আসুন—ঘরে এসে বসুন…৷’

‘হ্যাঁ, যাব…যাব৷’ সিগারেটে টান দিল৷ তারপর কোকোর দিকে তাকিয়ে : ‘কী, কোকো, কেমন আছিস?’

‘ভালো৷’ রাহুলের হাতটা পেঁচিয়ে ধরে থাকা অবস্থাতেই কর্কশ গলায় বলল কোকো৷ অনুভবে রাহুলের মনে হল, কোকোর কাঁপুনিটা এখনও রয়েছে৷

কোকোর দিকে এগোতে শুরু করল মাস্টারজি৷ সুলতান তখনও মেঝেতে বসে গোঙাচ্ছিল৷ মাকু, শিকলি, আর নাম-না-জানা একজন শাগরেদ বন্ধ দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল৷

কোকোর গালে দুবার আদরের আলতো চাপড় মেরে মাস্টারজি বলল, ‘কোকো, মাই ডার্লিং৷ অ্যাদ্দিন পালিয়ে থেকে তোর কত লস হয়ে গেল বল তো! আমারও তো বহুত টাকা লোকসান হয়ে গেল৷ এখন চল, ওই লস পুষিয়ে দিবি…৷’

বাপি মাস্টারজির কাছে এসে অনুনয় করে বললেন, ‘আপনি প্লিজ ঘরে এসে বসুন৷ কোকোর ব্যাপারটা আপনাকে খুলে বলছি…৷’

কৌতুকের চোখে বাপির দিকে তাকাল : ‘কোকোর ব্যাপার খুলে বলবেন? আমাকে?’ শব্দ করে হাসিতে ফেটে পড়ল মাস্টারজি৷ সিগারেটে ঘন-ঘন টান মারল৷ সিগারেটের আগুনটা সেই টানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল৷

‘না, না, আমাকে কিছু খুলে বলতে হবে না৷ আমি শুধু কোকোকে নিয়ে যেতে এসেছি৷ ও আমার৷’

মাস্টারজির কথার শেষে ‘ও আমার’ শব্দ দুটো মাম আর বাপিকে ভীষণ ধাক্কা দিল৷ রাহুলকেও৷ একইসঙ্গে ওর হাতের ওপরে কোকোর হাতের চাপ যে বেড়ে উঠল সেটাও রাহুল টের পেল৷

মাম প্রায় কান্না-কান্না গলায় মাস্টারজিকে বললেন, ‘ঘরে একটু বসুন৷ কয়েকটা কথা আপনাকে বলতে চাই৷ কোকোর…৷’

হাতের ইশারায় মামকে থামিয়ে দিল মাস্টারজি৷ পিস্তলটা কোমরে গুঁজে নিয়ে বলল, ‘বুঝেছি কী বলবেন৷ চলুন, ঘরে বসছি৷ কিন্তু আমার তাড়া আছে৷ বেশিক্ষণ টাইম দিতে পারব না৷’

বসবার ঘরে এসে বসল মাস্টারজি৷ বাপি সিলিং পাখাটা অন করে মাস্টারজির মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলেন৷ মাম বাপির পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ রাহুল আর কোকো হাত-ধরাধরি করে ঘরে ঢুকল৷ দরজার কাছটিতে দাঁড়িয়ে রইল৷

খোলা দরজার দিকে একবার তাকাল মাস্টারজি৷ শিকলি, মাকু, সুলতান—ওদের দেখা যাচ্ছে৷ সুলতান এখনও বসে আছে, তবে গালে একটা রুমাল চেপে ধরেছে৷

জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরোটা ঘরের এককোণে ছুড়ে দিল মাস্টারজি৷ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘জলদি বলুন—কী বলবেন৷’

‘কোকো আমাদের কাছে এই তিনমাস হল…’ বাপি শুরু করলেন, ‘ওকে আমরা…মানে…৷’

‘থাক, আর বলতে হবে না৷ বুঝেছি৷’ জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল মাস্টারজি৷ একগোছা পাঁচশো টাকার নোট মুঠো করে বের করে নিয়ে এল৷

টাকাগুলো দেখেই বাপির মুখ লাল হয়ে উঠল৷ মাম ঘেন্নায় বলে উঠলেন, ‘ছিঃ! ছিঃ!’ তারপর আর সামলাতে পারলেন না—কেঁদে ফেললেন৷

বাপি এবার চোয়াল শক্ত করলেন৷ সুলতানের কাছ থেকে শোনা কথাগুলো এবার বোধহয় মাস্টারজিকে বলা দরকার৷ মাস্টারজির কাছে যতই পিস্তল থাকে, ‘করুণাময়ী’র ওই নরকে কোকো কিছুতেই ফিরে যাবে না৷

‘আপনি কোকোকে নিয়ে গিয়ে কী করবেন আমরা জানি…’ এইটুকু বলার পরই সুলতানের দিকে চোখ পড়ল বাপির৷ সুলতান তখন বাপিকে কিছু না বলার জন্য কাতরভাবে ইশারা করছে৷

মাস্টারজি মামের দিকে দেখছিল, তাই সুলতানের সূক্ষ্ম ইশারা খেয়াল করেনি৷ বিরক্তভাবে উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে : ‘এখন এসব সেন্টিমেন্টাল নাটক দেখার টাইম নেই৷’ হাতঘড়ির দিকে তাকাল৷ তারপর কোকোর দিকে : ‘অ্যাই! চল৷ ফালতু দেরি হচ্ছে—৷’

‘না, কোকো যাবে না৷’ রাহুলের মুখ দিয়ে কথাগুলো ফস করে বেরিয়ে এল৷

মাস্টারজি অবাক হয়ে রাহুলের দিকে তাকাল৷ সাপের মতো ঠান্ডা চোখে ওকে কিছুক্ষণ দেখল৷ তারপর ব্যঙ্গের সুরে বলল, ‘কোকো তোমার কে হয়, খোকা? বন্ধু? ওর সঙ্গে ভালোবাসা হয়েছে? লাভ স্টোরি?’ বলেই হো হো করে হেসে উঠল মাস্টারজি৷

সেই হাসি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই কোকো কর্কশ গলায় বলে উঠেছে, ‘আমি যাব না৷ রাহুলকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না—৷’

কোকোর কথায় মাস্টারজি হতবাক হয়ে গেল৷ চোখ গোল-গোল করে কোকোর দিকে তাকিয়ে রইল—যেন ভূত দেখছে৷

‘জানোয়ারটা দেখি কথা বলতে শিখে গেছে!’ চিবিয়ে-চিবিয়ে কথাগুলো বলল মাস্টারজি৷ নোটের গোছা আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখল৷ তারপর পায়ে-পায়ে কোকো আর রাহুলের দিকে এগোল৷

খোলা জানলা দিয়ে সকালের আলো দেখা যাচ্ছে৷ বৃষ্টি আগের চেয়ে অনেক জোরে পড়ছে৷ সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে হাওয়ার ঝাপটা৷ কোথাও একটা খোলা জানলার পাল্লা দেওয়ালে মাথা কুটছিল৷ বৃষ্টির জলের রেণু বাতাসের তোড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ছিল৷

রাহুলের কাছে এসে ওর মুখের খুব কাছে মুখ নিয়ে এল৷ রাহুল সিগারেটের কড়া গন্ধ পেল৷ সেইসঙ্গে মদের হালকা অপবাস৷

ও মুখ সরিয়ে নিতে গেল৷ তখন মাস্টারজি হিংস্র চাপা গলায় বলল, ‘কোকো আমার৷ ও আমার সঙ্গে যাবে৷ তুই ‘‘না’’ বলার কে রে?’

রাহুল একটুও দমল না৷ জেদি বাচ্চার মতো আবার বলল, ‘না, কোকো যাবে না!’

মাস্টারজি মাথা পিছিয়ে নিল৷ ভয়ংকর একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিল রাহুলের গালে৷

সাইকেলের টায়ার ফাটার মতো শব্দ হল৷ রাহুল কাত হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে৷

মাম চিৎকার করে উঠলেন৷ সেইসঙ্গে বাপিও৷

আর কোকোর হাত বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠল৷ পলকে মাস্টারজির টুঁটি চেপে ধরল৷ মাস্টারজি জলে তলিয়ে যাওয়া মানুষের মতো দু-হাত শূন্যে ছুড়ে খাবি খেতে লাগল৷

‘রাহুলকে মারবে না!’ কোকো পশুর মতো গর্জন করে উঠল৷

‘শিকলি! শিকলি!’ মাস্টারজি চেঁচিয়ে উঠতে চাইল : ‘রানা! রানা! জানোয়ারটাকে ধর!’

ব্যাঙের ডাকের মতো আওয়াজ বেরোল মাস্টারজির গলা থেকে৷ শিকলি আর তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা শাগরেদ ছুটে এল মাস্টারজির দিকে৷ শিকলির হাতে একটা লিকলিকে ফলার ছুরি ঝিকিয়ে উঠল৷

বাপি আর মাম ততক্ষণে রাহুলকে ধরে মেঝে থেকে তুলেছেন৷ রাহুলের ফরসা গালে পাঁচ আঙুলের লালচে দাগ বসে গেছে৷

শিকলি কোকোকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছিল বুলেটের মতো৷ আর কোকো মাস্টারজির টুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে ছিল৷ ও চকিতে একটা পা ভাঁজ করে শূন্যে তুলল—ঠিক একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারসের মতো৷ এবং পরমুহূর্তে সেই পা-টা ছুটে আসা শিকলিকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দিল৷

শিকলির শরীরটা আবার বুলেটের গতিতেই ছিটকে গেল পিছনদিকে৷ দেওয়ালে গিয়ে সপাটে বাড়ি খেল৷ তারপর খসে পড়ল মেঝেতে৷ ছুরিটা ওর হাত থেকে কোথায় যেন ঠিকরে পড়ল৷

রাহুল ওর স্তম্ভিত ভাবটা কাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করল৷ মাম তখন হাউহাউ করে কাঁদছেন আর কোকোর নাম ধরে ডাকছেন৷

রানা নামের পাবলিক বোধহয় নিজেকে একটু বেশি বুদ্ধিমান ভেবেছিল৷ কারণ, ও কোকোর দিকে ছুটে আসতে-আসতে আচমকা মেঝেতে শুয়ে পড়ল৷ ফলে ওর দেহটা মসৃণ মেঝেতে পড়ে কোকোর পা লক্ষ্য করে দ্রুতগতিতে পিছলে এল৷

সংঘর্ষটা যদি ঠিকঠাক হত তা হলে কোকো নির্ঘাত উলটে পড়ত৷

কিন্তু কোকোর তৎপরতায় সেটা ঠিকঠাক হল না৷

ও মাস্টারজিকে এক ধাক্কা দিয়ে পিছনে ফেলে দিল৷ এবং বেড়ালের ক্ষিপ্রতায় শূন্যে লাফিয়ে উঠল৷

যখন কোকো নীচে পড়ল তখন ওর পায়ের নীচে রানা৷ ঢেঁকির পাড় দেওয়ার মতো কোকোর পা রানার শরীরে বারবার আছড়ে পড়ল৷ তারপর ওকে চুলের মুঠি ধরে এক ঝটকায় কোকো দাঁড় করিয়ে দিল৷ নিজের মাথা ঠুকে দিল ওর মাথায়৷

পাথরে-পাথরে ঠোকাঠুকি হল যেন৷ একটা ‘আঁক’ শব্দ করে রানা গোড়াকাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল৷ বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেল৷

রাহুলরা অবাক হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রটা দেখছিল৷ মাস্টারজি, রানা আর শিকলি—তিনজন তিনদিকে পড়ে আছে৷ ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোকো লড়াকু সিংহের মতো ফোঁস-ফোঁস করে হাঁপাচ্ছে৷ ওর চোখমুখ লাল হয়ে গেছে৷ এক অদ্ভুত ভালোবাসার চোখে ও রাহুলের দিকে তাকিয়ে আছে৷

ওদিকে সুলতান এখনও মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে৷ মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ও যে কী করবে সেটা ঠিক ভেবে উঠতে পারছে না৷

মাকু নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে৷ ভাবলেশহীন মুখ৷ চোয়াল নড়ছে৷ চুয়িংগাম বা কিছু একটা চিবোচ্ছে৷ রাহুল আর কোকোর সর্বনাশ দেখার জন্য ও যেন অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারে৷

কোকো রাহুলের দিকে এক পা এগিয়ে এল৷ হাঁপাতে-হাঁপাতে জিগ্যেস করল : ‘রাহুল, তোমার লাগেনি তো? তোমাকে ছেড়ে আমি যাব না৷’

কথা শেষ হতে না হতেই কোকো যন্ত্রণায় লাফিয়ে উঠল৷ পাগলের মতো ছটফট করতে লাগল৷ ওর গলার কন্ট্রোল ব্যান্ডে লাল আর সবুজ আলো দপদপ করে জ্বলতে লাগল৷

রাহুল দেখল, মাস্টারজি কখন যেন উঠে বসেছে৷ বাঁ-হাতে একটা চেয়ার ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে৷ সোনালি ব্যান্ডের হাতঘড়িটা ছিটকে পড়ে আছে দূরে৷

কিন্তু রাহুলের নজর কাড়ল মাস্টারজির ডানহাতে ধরা জিনিসটা৷ একটা কালো রঙের রিমোট কন্ট্রোল ইউনিট৷ কোকোর দিকে তাক করে মাস্টারজি বোতাম টিপে ধরেছে৷ আর তাতেই কোকোর শরীরে বৈদ্যুতিক মরণযন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে৷

কোকো ছটফট করতে-করতে মেঝেতে পড়ে গেল৷ ওর শরীরটা এমনভাবে ঝটকা দিয়ে বেঁকেচুরে যাচ্ছিল যেন কেউ ওকে হাই ভোল্টেজ শক দিচ্ছে৷ একইসঙ্গে ও যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল৷ মনে হচ্ছিল, ও বোধহয় এখনই মরে যাবে৷

বাপি আর রাহুল কোকোর নাম ধরে বারবার ডাকছিল৷ মাম কোকোর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করতে চাইছিলেন৷ আর কোকোর শরীরটা ঘন-ঘন ঝটকা মেরে ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছিল৷

মাস্টারজি তখন হিংস্রভাবে হাসছে৷ পায়ে-পায়ে এগিয়ে এসেছে কোকোর কাছে৷ রিমোটটা স্থির লক্ষ্যে কোকোর দিকে তাক করা৷

রিমোটটা বাঁ-হাতে নিল মাস্টারজি৷ তারপর ডানহাত শার্টের নীচে ঢুকিয়ে পিস্তলটা বের করে নিল৷ কোকোর মাথার দিকে পিস্তলের নলটা তাক করে চাপা গর্জন করে উঠল : ‘সালা, পাগলা কুত্তা! তোকে আর রেখে লাভ নেই৷ বড্ড বাড় বেড়েছিস৷ এবার খতম!’

মাস্টারজি হয়তো ট্রিগার টিপতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না৷

বাইরে কোথাও বিকট শব্দে বাজ পড়ল৷ একইসঙ্গে মাম হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন৷ বাপি আর রাহুল ‘না! না!’ বলে চেঁচিয়ে উঠল৷ আর আহত সুলতান ছুটে এসে মাস্টারজির পা জড়িয়ে ধরল৷ কুকুরের মতো কাতর ‘কেঁউকেঁউ’ শব্দে কোকোর প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগল৷

মাকু পায়ে-পায়ে ঘরের দরজার কাছে এগিয়ে এসেছিল৷ ও অবাক হয়ে দেখছিল, একটা সহজ-সরল প্রতিবন্ধী ছেলেকে বাঁচানোর জন্য চার-চারটে মানুষ কেমন আকুলি-বিকুলি করছে৷ তার মধ্যে একটা আবার মুসলমান!

অথচ এই চারজন কোকোর কেউ নয়!

মাকু এই সমীকরণটা বুঝতে পারছিল না৷ রক্তের সম্পর্কের বাইরের সম্পর্কটা ওকে অবাক করে দিয়েছিল৷ ওর মনের ভেতরে অন্যরকম একটা ঝড় উঠেছিল৷

একটা টাকমাথা বেঁটে শয়তান আমাদের গ্রাম থেকে একজনকে এভাবে তুলে নিয়ে যাবে! নয়তো লাশ ফেলে দেবে বলছে! আর আমি চুড়ি পরে বসে থাকব! এটা না আমার গ্রাম! আমাদের গ্রাম!

এই কথাগুলো মনে-মনে ভাবল মাকু৷ একইসঙ্গে ওর মনে হল, এতক্ষণ ধরে ও ভেবেছে অনেক কিন্তু কিছু করেনি—এবার কিছু করা দরকার৷

মাকু যে-দৌড়টা শুরু করল সেটা বোধহয় ওর বাইককে হারানোর মতন৷ শূন্য গতিবেগ থেকে এক অদ্ভুত ত্বরণ তৈরি করল ও৷ এবং যখন ওর শরীরটা মাস্টারজির শরীরে গিয়ে ধাক্কা খেল তখন মাস্টারজির মনে হল একটা প্রকাণ্ড উল্কার সঙ্গে তার সংঘর্ষ হয়েছে৷

মাস্টারজির শরীরটা দেওয়াল ঘেঁষে রাখা একটা বুককেসে গিয়ে ধাক্কা খেল৷ ঝনঝন শব্দে বুককেসের কাচ ভেঙে পড়ল৷ মাস্টারজির হাতের পিস্তল আর রিমোট দু-দিকে ছিটকে পড়ল৷ আর মাকু হাত-পা মুড়ে কাত হয়ে পড়ে গেল চেয়ার-টেবিলের ওপরে৷

মাস্টারজির জীবনীশক্তির তারিফ করতে হয়৷ কারণ, ভাঙা কাচের ওপরে সে স্থির হয়ে পড়ে রইল মাত্র কয়েক সেকেন্ড৷ তারপরই দু-দিকে নজর চেলে দেখে নিল পিস্তল আর রিমোটটাকে৷ চট করে যে কোনও একটাকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে নেওয়া যায়৷ কিন্তু কোনটা?

পিস্তলটাই বেছে নিল মাস্টারজি৷ এবং সেখানেই ভুল হয়ে গেল৷

‘ফাইটার’ বয় কোকো এই কয়েক সেকেন্ড সময়ের মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়েছিল৷ মাস্টারজি যখন পিস্তল আর রিমোটের দিকে নজর চালিয়েছে তখনই ও মেঝেতে পড়ে থাকা রানাকে মাথার ওপরে তুলে নিয়েছে৷ মাস্টারজির হাত পিস্তলের দিকে এগোনোমাত্রই ও রানার দেহটা মাস্টারজিকে লক্ষ্য করে স্রেফ ছুড়ে দিয়েছে৷

সংঘর্ষের শব্দ হল৷ আর কোকো একইসঙ্গে লাফিয়ে পড়েছে মাস্টারজির ওপরে৷ রানার শরীরের নীচ থেকে মাস্টারজিকে টেনে বের করেছে৷ জামার কলার ধরে তার মুখটা তুলে এনেছে নিজের মুখের কাছে৷

হাপরের মতো হাঁপাতে-হাঁপাতে কোকো বলল, ‘রাহুলকে ছেড়ে আমি যাব না৷’ তারপর একটা ভয়ংকর হেডবাট৷ নিজের মাথাটা মাস্টারজির মাথায় ও সাংঘাতিক জোরে ঠুকে দিয়েছে৷

‘রাহুলকে ছেড়ে…আমি কোথাও যাব না৷’ আবার বলল কোকো৷

আবার হেডবাট৷

‘রাহুলকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না৷ কিছুতেই না৷’

আবার মাথায়-মাথায় সংঘর্ষ৷

কোকো যেন সত্যিই পাগল হয়ে গেছে৷ বারবার ও একই কথা বলছে আর ওর মাথাটা ঠুকছে মাস্টারজির টাকমাথায়৷ মাস্টারজির কপাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে৷

‘কোকো! কোকো, থামো!’ চেঁচিয়ে উঠল রাহুল৷ ছুটে গেল ওর কাছে৷ ওকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল৷

বাপি, মাম আর সুলতানও ওকে থামাতে চেষ্টা করল৷

কোকো মাস্টারজির শরীরটা ছেড়ে দিতেই সেটা জাপানি পাখার মতো ভাঁজ হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল৷

মাকু খোঁড়াতে-খোঁড়াতে ওদের কাছে এসে বলল, ‘আমি থানায় খবর দিচ্ছি—৷’

বাপি ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, ‘চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি—৷’

ঘর থেকে বেরোতে গিয়েও থমকে গেল মাকু৷ মেঝেতে পড়ে থাকা শিকলি, রানা আর মাস্টারজির দিকে দেখল৷ বলল, ‘আমরা দুজনেই যাব? এখানে যদি কিছু হয়?’

হাসলেন বাপি৷ কোকোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘কোনও ভয় নেই৷ কোকো আছে৷’

ওরা দরজা খুলে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেল৷

 

Exit mobile version