বাবলি বলল যে, ওর বাড়িতে ফোন-টোন নেই৷ বরং জিমে একটা মেসেজ দিয়ে রাখলেই হবে যে, ও একজন বন্ধুর বাড়িতে গেছে৷ মা কিংবা বাবা যদি জিমে খোঁজ করতে আসে তা হলে পঞ্চাদা যা বলার বলে দেবে৷
দাশগুপ্ত ওদের ‘একমিনিট—আসছি’, বলে চলে গেলেন৷
একটু পরেই সাদা পোশাকে তৈরি হয়ে ফিরে এলেন৷ ডান হাতে ধরা একটা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন ডাবল অ্যাকশান ০.৩৮ ক্যালিবারের চিফস স্পেশাল রিভলভার৷ সেটা জামা তুলে কোমরের কাছে গুঁজে নিলেন৷
মহেন্দ্র শর্মা নামের একজন অফিসার মিমো আর বাবলির কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন৷ দোহারা ফরসা চেহারা৷ মাথায় লম্বা-লম্বা চুল৷ ধারালো চোখ-মুখ৷ পানের রসে ঠোঁট রঙিন৷
দাশগুপ্ত ওঁকে জিগ্যেস করলেন, ‘আর্মস নিয়েছ তো?’
মহেন্দ্র মাথা নেড়ে জানালেন, হ্যাঁ, নিয়েছেন৷
‘চলো—’ বলে অনুজ থানার গেটের দিকে এগোলেন৷
থানার বাইরে বাঁ-দিক ঘেঁষে একটা লাল রঙের টাটা সুমো দাঁড়িয়ে ছিল৷ মিমো দেখল, সেটার গায়ে ‘পুলিশ’ লেখা নেই৷ সেটা করে ওরা সবাই রওনা হল৷ দাশগুপ্ত মিমোকে ড্রাইভারের পাশে বসালেন, তারপর নিজে জানলা ঘেঁষে বসলেন৷ বাবলি আর মহেন্দ্র বসলেন ওঁদের ঠিক পিছনের সিটে৷
গাড়ি খালপাড়ের রাস্তা ধরে রওনা হতেই দাশগুপ্ত ড্রাইভারকে বললেন, ‘এয়ারপোর্টের দিকে চলো—৷’
কিছুক্ষণ পর দাশগুপ্তর মোবাইল ফোন বেজে উঠল৷ তিনি ফোন ধরে কথা বলতে লাগলেন৷ মিমো কান খাড়া করে কথাবার্তাগুলো শুনতে লাগল৷
কথা শেষ হলে মিমো আর কৌতূহল চাপতে পারল না৷ সরাসরি জিগ্যেস করে বসল, ‘স্যার, আর কোনও খবর পাওয়া গেল?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাশগুপ্ত বললেন, ‘নাঃ, সেরকম কোনও খবর নেই৷ প্রিয়াংকার বাড়ির ঠিকানা তো তুমি জানো…কনভেন্ট রোডে…মানে, এন্টালি থানা এলাকায়৷ সেখানে খবর দিয়েছিলাম৷ ওঁরা প্রিয়াংকার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন৷ ওর বাবার হাই কানেকশান থাকায় লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টও ব্যাপারটার মধ্যে ঢুকে পড়েছে৷ এখন ওরা মিস্টার মজুমদারের মোবাইল ফোন ট্যাপ করে কনভারসেশান টেপ করার জন্যে মোবাইল ফোন সার্ভিস প্রোভাইডারের সঙ্গে কথা বলছে৷ হয়তো আর আধঘণ্টা কি এক ঘণ্টার মধ্যে টেপ করার কাজটা শুরু হয়ে যাবে৷ দেখি, তখন যদি নতুন কিছু জানা যায়…৷’
ওদের গাড়ি ততক্ষণে উলটোডাঙ্গার আন্ডারপাসে এসে পড়েছে৷ অফিসটাইমের জ্যাম ভালোমতোই জাঁকিয়ে বসেছে৷ বাস, প্রাইভেট কার, অটো সব একেবারে জট পাকিয়ে গেছে৷ অকারণেই গাড়িগুলো হর্ন দিচ্ছে৷
দাশগুপ্ত বারবার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন৷ আর মিমো মনে-মনে প্রিয়াংকার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিল৷ একইসঙ্গে ও টের পাচ্ছিল, খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে৷ কিন্তু লজ্জায় মুখ ফুটে সে-কথা অনুজ দাশগুপ্তকে বলতে পারছিল না৷
জ্যামজট ছাড়িয়ে উলটোডাঙ্গা-ভি. আই. পি-র মোড়ে আসতে প্রায় মিনিট-পনেরো লেগে গেল৷ তারপরই বাঁ-দিকে ঘুরে বেশ ফাঁকা রাস্তা৷ রাস্তায় গাড়ি থাকলেও গতি আছে৷ দাশগুপ্ত চাপা গলায় পাইলটকে বললেন, ‘ধনিয়া, থোড়া তেজ চালাও…৷’
বাবলি হঠাৎ পিছনের সিট থেকে মিমোর কাঁধে চাপ দিল৷ মিমো ফিরে তাকাতেই ও মাথা ঝুঁকিয়ে মিমোর কানের কাছে মুখ এনে খুব চাপা গলায় বলল, ‘বস, পেটে চুঁহা দৌড়চ্ছে৷ আর পারছি না৷ তুই স্যারকে বল৷’
অনুজ দাশগুপ্ত মিমোর দিকে ফিরে জিগ্যেস করলেন, ‘কী ব্যাপার?’
মিমো আমতা-আমতা করে বলল, ‘সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি—৷’
‘ওঃ হো!’ একটু লজ্জা পেয়ে দাশগুপ্ত বললেন, ‘ধনিয়া, একটা খাবারের দোকান দেখে গাড়ি লাগাও…৷’
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই টাটা সুমোটা লেক টাউনের মোড়ে এসে গেল৷ ধনিয়া বাঁ-দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে কয়েকটা খাবারের দোকানের সামনে এসে গাড়িটা দাঁড় করাল৷
আর ঠিক তখনই মিমোর মোবাইল বাজতে শুরু করল৷ মিমো মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকাল৷
প্রিয়াংকা৷
দাশগুপ্তর দিকে তাকিয়ে ‘প্রিয়াংকা’ বলে মিমো ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলল৷
‘ওঃ, অনেক কষ্টে আবার লাইন পেয়েছি৷’ ওপাশ থেকে প্রিয়াংকা চাপা গলায় বলল৷ ‘যা বলছি, ভালো করে শুনুন…৷’
‘হ্যাঁ, বলুন…৷’
‘তিনটে লোক কলেজের কাছ থেকে আমাকে তুলে নিয়ে এসেছে৷ তার মধ্যে একজন ড্রাইভার৷ পথে গাড়ি চেঞ্জ করেছে৷ আমার চোখে পটি বেঁধে এখানে নিয়ে এসেছে৷ আমি একটা গোডাউনের মতো ঘরে রয়েছি৷ একতলায়৷ ঘরে সিমেন্ট, বালি, স্টোনচিপের বস্তা৷ একজন মাসি আমাকে পাহারা দিচ্ছে৷ এখন মাসি ঘরে নেই৷ ট্রাই করতে-করতে লাইনটা হঠাৎ পেয়ে গেছি৷ এই জায়গাটা এয়ারপোর্টের কাছে৷ খুব ফ্রিকোয়েন্টলি প্লেন ওঠা-নামা করছে৷ তা ছাড়া একটু আগেই টয়লেটে যাওয়ার নাম করে আমি ঘরের বাইরে বেরিয়েছিলাম৷ দিনের বেলা এই ফার্স্ট টাইম৷ যা-যা দেখেছি বলছি—ভালো করে শুনুন…৷’
‘শুনছি, বলুন…৷’ মিমো রুদ্ধশ্বাসে বলল৷
‘বাড়িটার সঙ্গে একটা বাগান মতো আছে৷ এ ছাড়া ইস্টের দিকে—মানে, সূর্য এখন যেদিকে—সেদিকে তাকিয়ে একটা সবুজ রঙের তিনতলা ফ্ল্যাটবাড়ি—মানে, বাড়ির পেছনদিকটা—দেখতে পেয়েছি৷ বাড়িটার ছাদের ওপর একটা টাওয়ার—লাল আর সাদা রঙের৷ মানে, মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার যেমন হয়৷ আর এদের একজন বস আছে৷ আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে৷ আমার কাছে একটা মাইক্রো-ক্যাসেট চাইছে—হ্যান্ডিক্যামের মাইক্রো-ক্যাসেট৷ সেটা কোথায় আছে বলছি না বলে আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে৷ শুনছি, আজ সকালে আমার ব্যাপারে ফাইনাল ডিসিশান নেবে৷ যা করার জলদি করুন—৷’