নাঃ, ওদের হাতে মারা যাওয়ার আগে প্রিয়াংকা ওই ভাঙা টেলিফোনটা নিয়ে একটা মরিয়া চেষ্টা করে দেখবে৷ মরার আগে কিছুতেই ও মরবে না৷
অনেক ডাকাডাকি করেও ঘুম প্রিয়াংকার কাছে আসেনি৷ ও চোখে হাত চাপা দিয়ে আলো আড়াল করে শুয়ে ছিল৷ আর মাঝে-মাঝেই মাসির দিকে দেখছিল৷
একসময় ও মাসির নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেল৷ তখন ধীরে-ধীরে উঠে বসল বিছানায়৷ তারপর খুব সাবধানে পা টিপে-টিপে চলে গেল টেবিলের নীচে রাখা টেলিফোনটার কাছে৷ খোলা তারটা প্লাগে গুঁজে দিয়ে যন্ত্রটা নিয়ে কারিকুরি করতে লাগল৷ একবার ডায়াফ্রামটা খুলে ইলেকট্রোম্যাগনেটটা চেক করল৷ তারপর রিসিভারটা কানে দিয়ে অন্যান্য তার, লিভার, জয়েন্ট নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল৷ ডায়ালটোনের বদলে একটা কড়কড় শব্দ কাটা-কাটাভাবে শোনা গেল৷
কিছুক্ষণ চেষ্টার পর প্রিয়াংকা হতাশ হয়ে বিছানায় ফিরে এল৷ ওর ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা কোনও কাজে লাগাতে পারল না দেখে নিজের ওপর বিরক্ত হল৷ কিন্তু হাল ছাড়লে তো চলবে না৷
সারা রাত ধরে বেশ কয়েকবার টেলিফোন-অভিযান চালাল৷ একবার চেষ্টা করে, তারপর বিছানায় ফিরে এসে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নেয়৷ তারপর আবার চেষ্টা চালায়…৷
এইভাবে যখন ও ভীষণ হতাশ এবং ক্লান্ত, তখনই কী করে যেন ও হঠাৎ করে ডায়ালটোনের শব্দ শুনতে পেল৷ ওর হাত- ঘড়িতে তখন সাড়ে ছ’টা বাজে৷ জানলা বন্ধ থাকায় ভোরের আলো চোখে পড়ার উপায় নেই৷ কিন্তু পাখির ডাক কানে আসছে৷ কয়েকটা ডাক চিনতে পারল প্রিয়াংকা৷ বউ কথা কও, বুলবুলি, কোকিল—আর কাক তো আছেই৷
ডায়ালটোন পাওয়ামাত্রই প্রিয়াংকার বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে উঠল৷ ও কাঁপা হাতে বাপির মোবাইল নম্বরটা ডায়াল করল৷
একটু পরেই অবাক হয়ে শুনল, ওপাশে রিং বাজছে৷
একজন পুরুষের গলা ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই প্রিয়াংকা উদভ্রান্ত স্বরে বলে উঠল, ‘কে, বাপি? আমি পিয়া বলছি—৷’
‘বাপি?’ ও-প্রান্ত থেকে অচেনা গলায় কে যেন বলে উঠল, ‘সরি, রং নাম্বার…৷’
৷৷পাঁচ৷৷
মিমোর চেনা সেই অফিসারের নাম অনুজ দাশগুপ্ত৷
ডিউটি অফিসার পালচৌধুরীর বক্তব্য শোনার পর তিনি মিমো আর বাবলির কথা ধৈর্য ধরে শুনলেন৷ তারপর পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে পরপর চার-পাঁচটা ফোন করলেন৷ তার মধ্যে প্রথম ফোনটা যে মানিকতলা থানার ও.সি-কে করলেন সেটা ওঁর কথাবার্তা শুনেই মিমো বুঝতে পারল৷
দাশগুপ্ত ডিউটি অফিসারকে বললেন, ‘ইমপরট্যান্ট ডেটাগুলো একটা ডায়েরিতে টুকে নিয়ে মহেন্দ্র শর্মাকে বলুন প্লেন ড্রেসে তৈরি হয়ে নিতে৷ ডেটাগুলোর একটা কপি মহেন্দ্রকে দিয়ে দিন৷—আমাদের পাঁচমিনিটের মধ্যে বেরোতে হবে৷ দেরি করলে মেয়েটাকে হয়তো বাঁচানো যাবে না৷’
পালচৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন৷
দাশগুপ্ত ওঁর টেবিলের কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন৷ ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে মিমোকে বললেন, ‘মিমো, তোমার মোবাইলটা আমাদের সঙ্গে থাকা দরকার—কারণ, প্রিয়াংকার টেলিফোনটা গোলমেলে থাকায় ও আর কারও ফোনে কানেক্ট করতে পারছে না—শুধু তোমার ফোনেই লাইন লাগছে…কী যে করি!’
মিমোর মনে একটা সাধ ডানা মেলে দিল৷ ও অনেকসময় ভেবেছে, ও বড় হয়ে পুলিশ হবে—কিন্তু ভয়ে কখনও কথাটা মাকে বলেনি৷ এখন সাহস করে সেই সাধটা উগরে দিল৷
‘আমাকে আপনার সঙ্গে নেবেন, স্যার?’
অনুজ মুখ ফিরিয়ে মিমোকে দেখলেন৷ বয়েস সতেরো কি আঠারো হবে৷ গোঁফের রেখা সবে জানান দিচ্ছে৷ চোখে চকচক করছে প্রত্যাশা, আর পুলিশি অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দীপনা৷ এ-বয়েসটা এরকমই৷
প্রিয়াংকা মেয়েটা সকাল থেকে মিমোর সঙ্গেই কথা বলেছে৷ মাঝে একবার শুধু ডিউটি অফিসার পালচৌধুরীর সঙ্গে৷ মিমোর সঙ্গে মেয়েটা হয়তো সহজভাবে কথা বলতে পারবে৷ ও গাড়িতে সঙ্গে থাকলে মন্দ কী!
কপালে ভাঁজ ফেলে কিছুক্ষণ কী চিন্তা করার পর দাশগুপ্ত বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি আমার সঙ্গে চলো—৷’
কথাটা বলামাত্রই মিমো আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল, ‘থ্যাংক য়ু, স্যার৷ থ্যাংক য়ু, স্যার৷’
আর বাবলি দাশগুপ্তর পায়ের কাছে হাতজোড় করে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল৷ কাতর গলায় বলল, ‘আমাকে বাদ দেবেন না, স্যার৷ সক্কাল থেকে আমি ওর সঙ্গে আছি, স্যার৷ দয়া করুন, স্যার, দয়া করুন—প্লিজ!’
‘আরে, কী করছ! ওঠো, ওঠো—’ বাবলিকে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন দাশগুপ্ত৷ আপনমনেই বললেন, ‘কাজটা বেআইনি৷ তবে তোমাদের দুজনকে উইটনেস হিসেবে রেকর্ডে দেখিয়ে দেব৷’ তারপর একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললেন, ‘চলো, দুজনেই চলো৷ তবে কাজটায় কিন্তু রিসক আছে৷ যা অর্ডার করব অক্ষরে-অক্ষরে শুনবে৷ কোনও জায়গায় এনকাউন্টারের পসিবিলিটি থাকলে যেখানে দাঁড়িয়ে ওয়েট করতে বলব সেখানেই স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে—৷’
দাশগুপ্তর কথায় মিমো আর বাবলি এতবার করে ঘাড় কাত করতে লাগল যে, দাশগুপ্তর হাসি পেয়ে গেল৷
এরপর বাকি ছিল মিমো আর বাবলির বাড়িতে খবর দেওয়া৷
মিমো ওর মাকে ফোন করল৷ লাইন পেতেই দাশগুপ্ত ওর মায়ের সঙ্গে কথা বললেন৷
‘…না, না, আপনি কোনও চিন্তা করবেন না৷ একটা ইমপরট্যান্ট আইডেন্টিফিকেশানের কাজে ওকে সঙ্গে নিচ্ছি৷ কোনও ভয় নেই৷ সেফ অ্যান্ড সাউন্ড৷ ও আমাদের সঙ্গেই থাকবে৷ আমাদের সঙ্গেই খাওয়াদাওয়া করবে৷…হ্যাঁ, হ্যাঁ—সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরে আসবে৷ মাঝে-মাঝে ফোনে আপনার সঙ্গে কথা বলবে…৷’