মাসি বলল, ‘খেয়ে নাও—খাবার এনেছি…৷’
মাসির ইশারা মতো তাকাল প্রিয়াংকা৷ ওর বিছানার কাছেই মেঝেতে স্টিলের থালা আর গ্লাস৷ থালায় চারখানা রুটি৷ তার সঙ্গে কী একটা ভাজা আর সবজি৷
খাবারের চেহারা দেখে গা গুলিয়ে উঠল ওর৷ এইরকম খাবার ও জীবনে কখনও খায়নি৷ কিন্তু এখন তো আর কোনও বিকল্প নেই!
প্রিয়াংকা খাওয়া শুরু করতেই মাসি দেওয়ালের কাছে নিজের জায়গায় ফিরে গেল৷ সেখানে প্রাণহীন স্ট্যাচুর ভঙ্গিতে বসে নিজের খাওয়া শুরু করল৷ আর মরা মাছের চোখে প্রিয়াংকাকে দেখতে লাগল৷
প্রিয়াংকার খাওয়া শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আগের লোকটা আবার এসে ঘরে ঢুকল৷ সঙ্গে-সঙ্গে মাসি অ্যাটেনশানের ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল৷ প্রিয়াংকা বিছানায় বসে ছিল, বসেই রইল৷
লোকটা মাসির দিকে তাকালই না৷ সোজা প্রিয়াংকার কাছে এসে বলল, ‘ক্যাসেটটা কোথায় রেখেছ মনে পড়েছে?’
প্রিয়াংকা চোয়াল শক্ত করে অন্যদিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইল৷
লোকটা আবার একই কথা জিগ্যেস করল৷
প্রিয়াংকা কাঠ-কাঠ গলায় বলল, ‘মনে পড়েনি—মনে পড়বে না৷’
লোকটা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল—কী যেন ভাবতে লাগল৷ তারপর পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বের করে বোতাম টিপে কার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল৷
‘হ্যালো—৷’
…
‘না, এখনও গোঁ ধরে রয়েছে৷ কোনও চেঞ্জ নেই৷’
…
‘হ্যাঁ—সেটা ঠিক৷ ও ছাড়া আর কেউ জানে না ক্যাসেটটা কোথায়৷ তা হলে একে খালাস করে দিলে আর কোনও প্রবলেম নেই৷ ক্যাসেটটা আর কেউ হাতে পাবে না৷ এটা ছাড়া আর কোনও…হ্যাঁ, হ্যাঁ—দিচ্ছি—৷’
মোবাইল ফোনটা প্রিয়াংকার দিকে এগিয়ে দিল লোকটা৷ চাপা গলায় বলল, ‘নাও, বসের সঙ্গে কথা বলো…৷’
একটু ইতস্তত করে প্রিয়াংকা ফোনটা নিল৷ ‘হ্যালো’ বলল৷
সঙ্গে-সঙ্গে ওপাশ থেকে একটা মিহি গলা কথা বলতে শুরু করল৷ প্রিয়াংকার মনে হল, কেউ যেন ইচ্ছে করে গলাটাকে মেয়েলি করে কথা বলছে৷ যাতে ও আসল গলার স্বরটাকে চিনতে না পারে৷
সেই গলা তখন বলছে,
‘প্রিয়াংকা, তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি বলে মার্জনা চাইছি…৷’
প্রিয়াংকার মনে হল, জীবনে কখনও ও এত মোলায়েম স্নেহমাখানো কথা শোনেনি৷ কোনও জাদুকর কাউকে হিপনোটাইজ করার সময় যেভাবে ধীরে-ধীরে কথা বলে, এই কথাগুলোর ঢং ঠিক সেইরকম৷
‘…কিন্তু কী করব বলো, আমার যে আর কোনও কর্মপন্থা জানা নেই৷ তুমি কি চাও, একটা হিরে-চোরকে বিনাশ করার জন্যে আমার সাজা হোক? আমি জানি, তুমি সেটা চাও না৷ লক্ষ্মীসোনা মেয়ে, এরকম গোঁয়ার্তুমি করে না৷ এতে কী লাভ বলো? তোমার মতো একটা সুন্দরী ফুটফুটে মেয়েকে অপচয় করতে আমার যথেষ্ট মনোকষ্ট হবে৷ তুমি অকপটে প্রকাশ করে দাও কোথায় আছে সেই মাইক্রো-ক্যাসেটটা৷ বলে ফ্যালো, সোনা মেয়ে আমার, প্লিজ, বলে ফ্যালো…৷’
প্রিয়াংকা যেন একটা ঘোরের মধ্যে এই মিষ্টি-মিষ্টি কথাগুলো শুনছিল৷ ওর মনে হচ্ছিল, ওর কানে কে যেন মধু ঢালছে৷ স্নেহ আর মমতা ঝরে পড়ছে লোকটার গলায়৷ অথচ এই লোকটাই বস!
প্রিয়াংকা বলল, ‘আমাকে একটু ভাবার সময় দিন, প্লিজ…৷’
মিহি গলা হেসে উঠল : ‘এই তো আমার লক্ষ্মী মেয়ে৷ আমি সবাইকে বলে দিচ্ছি, কেউ আর তোমাকে উত্ত্যক্ত করবে না৷ তুমি প্রশান্ত মনে বিশ্রাম নাও, কেমন? এবার ফোনটা আমার লোকের হাতে প্রত্যর্পণ করো…৷’
‘প্রত্যর্পণ করো’! তখন থেকে কীসব অদ্ভুত-অদ্ভুত শব্দ মিশিয়ে কথা বলছে এই বস লোকটা! ‘মার্জনা’, ‘কর্মপন্থা’, ‘বিনাশ’, ‘অপচয়’, ‘মনোকষ্ট’—আরও কত কী!
প্রিয়াংকা মোবাইলটা লোকটার হাতে ফিরিয়ে দিল৷
লোকটা ফোন কানে দিয়ে কিছুক্ষণ কী শুনল৷ তারপর ছোট্ট করে ‘ও. কে., বস,’ বলে বোতাম টিপে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল৷
‘এখন ঘুমোও—কাল সকালে তোমার ব্যাপারে ডিসিশান জানা যাবে৷ গুড নাইট৷’
লোকটা চটপট পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ মাসি পা টেনে-টেনে দরজা পর্যন্ত গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল৷ তারপর প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে ‘শুয়ে পড়ো—’ বলে দেওয়ালের কাছে গিয়ে নিজের বিছানা পাতার কাজ শুরু করল৷
একটু পরেই মাসি কয়েকবার হাই তুলে শুয়ে পড়ল৷ প্রিয়াংকা বুঝল, ঘরের আলো জ্বালাই থাকবে—কারণ, তাতে মাসির নজরদারির সুবিধে হবে৷ তবে এটা একদিক থেকে ভালোই হল৷ প্রিয়াংকা মাঝরাতে সুযোগমতো উঠে ওই ভাঙা টেলিফোনটা নিয়ে খুটুরখুটুর করতে পারবে৷ যদি কপালজোরে বাপিকে একটা ফোন করতে পারে৷ একবার যোগাযোগ করতে পারলেই…৷
বেডকভারটা গায়ের ওপর টেনে নিয়ে প্রিয়াংকা চুপচাপ শুয়ে পড়ল৷ আলোর দিকে পিছন ফিরে ওর সাইডব্যাগটাকে আঁকড়ে ধরে ঘুমোনোর চেষ্টা করল৷ কিন্তু ঘুম কি সহজে আসে! ওর শরীর ক্লান্ত হলেও একটা চাপা উত্তেজনার ঢেউ বুকের ভেতরে দপদপ করতে লাগল৷
*
প্লেন উড়ে যাওয়ার শব্দ পেল প্রিয়াংকা৷ ওর ইচ্ছে ছিল, পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নিয়ে বিদেশে যাবে৷ কত নতুন-নতুন দেশে ঘুরে বেড়াবে৷ এখন মনে হচ্ছে, স্বপ্ন স্বপ্নই৷ কাল সকালে এরা হয়তো ওকে খতমই করে দেবে৷ কিন্তু ক্যাসেটটা কোথায় লুকোনো আছে সেটা বলে দিলেই কি এরা ওকে ছেড়ে দেবে? মনে হয়, না৷ ক্যাসেটটা হাতে পাওয়ার জন্য এরা এখন এইসব কথা বলছে৷ পরে উলটো কাজ করবে৷ খবরের কাগজে এইরকম বহু ঘটনার কথা পড়েছে ও৷ সিনেমাতেও দেখেছে৷