‘এবার তুই অ্যানুয়ালে অঙ্কে এইট্টি পারসেন্ট পাবি৷’
‘ভ্যাট!’
‘দেখিস…৷’
পরেশদার কেকের দোকান এসে গিয়েছিল৷ অচ্যুত দোকানের কাছ ঘেঁষে সাইকেল থামাল৷ কাঁচা ড্রেনের ওপরে পাতা সিমেন্টের স্ল্যাবে ওর সামনের চাকা ঠেকে গিয়ে সামান্য ঝাঁকুনি লাগল৷
রাজীব সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াল : ‘কাল টিফিনের জন্যে কেক আর প্যাটিস কিনব৷’
অচ্যুত টিফিনে মায়ের হাতে তৈরি লুচি কিংবা পরোটা নিয়ে যায়—সঙ্গে আলুর তরকারি বা আলুভাজা৷ মাসে দু-একদিন কেক বা প্যাটিস৷ আর দু-তিন টাকা পকেটে থাকলে টিফিনের সময় স্কুলের দরজায় ভিড় করে দাঁড়ানো বিভিন্ন ‘ওলাদের’ কাছ থেকে ঝালমুড়ি, ঘুগনি বা বাদাম খায়৷
রাজীব হঠাৎ জিগ্যেস করল, ‘একটা সিগারেট টেস্ট করে দেখবি নাকি?’
‘না না—আমার ওসব ভালো লাগে না৷’
‘সেদিন কুলদীপ দু-চার টান দিয়েছিল৷ মন্দ নয়৷ জানিস তো, ও মাঝে-মাঝে স্মোক করে!’
‘জানি!’
রাজীব আবদারের গলায় বলল, ‘যাই বল, আজ এরকম বৃষ্টি-বাদলার দিন…একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছে৷ অচেনা দোকান থেকে কিনব৷ তারপর দুটো টফি খেয়ে বাড়ি যাব—কেউ গন্ধ পাবে না৷ তুই খাবি না—শিয়োর?’
অচ্যুত হেসে বলল, ‘না৷’
তারপর রাজীবকে টা-টা করে চলে গেল৷
রাজীব পরেশদার দোকানে ঢুকতে যাচ্ছে, এমন সময় পিছন থেকে কে যেন ওকে নাম ধরে ডাকল৷
ঘুরে তাকাল রাজীব৷
সত্যবানস্যার৷ সাইকেল পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ রাজীবের দিকে তাকিয়ে অল্প-অল্প হাসছেন৷
রাজীব স্যারের কাছে এগিয়ে গেল, ‘কিছু বলবেন, স্যার?’
‘হ্যাঁ৷ কী কিনবি কিনে নে, তারপর চল, যেতে-যেতে বলছি৷ তোর বাড়ি তো স্টেশনের দিকে৷ চল, তোকে বাড়ির কাছে নামিয়ে দেব৷’
‘সিগারেট খাওয়াটা ভোগে গেল’, মনে-মনে ভাবল রাজীব৷ স্যার যে পিছন-পিছন আসবেন তা ও কেমন করে জানবে! এরকম আগে কখনও হয়নি৷
কিন্তু রাজীব অবাক ভাবটা চেপে রাখল৷ ছোট্ট করে বলল, ‘একমিনিট ওয়েট করুন, স্যার, আমি এক্ষুনি আসছি৷’
তারপর ছুট্টে ঢুকে পড়ল পরেশদার দোকানে৷
পরদিন স্কুলে ঢুকে অচ্যুত দেখল বানজারার ঘরের সামনে অনেক ছাত্রের ভিড়৷ দু-একজন গার্জেন আর স্যারও দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে৷
সাইকেল জায়গামতো রেখে মাঠের কোণের দিকটায় ছুটে গেল অচ্যুত৷ ভিড় ঠেলে সরিয়ে ভেতরে ঢুকল৷
দৃশ্যটা দেখার আগেই বানজারার বউয়ের কান্না শুনতে পাচ্ছিল অচ্যুত৷ কাঁদছিল আর দেশোয়ালি ভাষায় বিলাপ করছিল৷ ওর কথার একটি বর্ণও অচ্যুত বুঝতে পারছিল না৷ শুধু ‘রামুয়া’ শব্দটা শুনতে পাচ্ছিল আর এটুকু বুঝতে পারছিল, ভালোবাসার কেউ মারা গেলে মানুষ এরকম বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে৷
বৃত্তের ভেতরে ঢুকে দৃশ্যটা দেখতে পেল অচ্যুত৷
রামুয়া আর ওর বাছুর মাটিতে পাশাপাশি পড়ে আছে৷ ওদের চোখ বোজা৷ বানজারার বউ ওদের ওপর শরীর এলিয়ে কাঁদছে৷
বানজারা একপাশে বেজার মুখে উবু হয়ে বসে ছিল৷ চোখ ছলছল৷ মাথাটা ডানহাতে ভর দিয়ে হেলানো৷
অচ্যুত অবাক হয়ে দেখল, রামুয়ার ধপধপে সাদা গলায় রক্তের দাগ৷ খানিকটা রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে৷ ওর বাছুরের দশাও তাই৷ ঠিক মনে হচ্ছে, কোনও হিংস্র জন্তু ওদের নরম গলায় কামড় দিয়েছে৷
কিন্তু এই সামান্য ক্ষত থেকে কি এতবড় মাপের একটা গোরু মরে যেতে পারে?
তা ছাড়া কোন জানোয়ারই-বা গোরুর গলায় এভাবে কামড়ায়? সাপ, নাকি কুকুর?
বানজারা এবং আশেপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের কথাবার্তার টুকরো জুড়ে গোটা গল্পটা মোটামুটি আঁচ করতে পারল অচ্যুত৷
আজ ভোর-রাতের দিকে গোয়ালঘর থেকে একটা ঝটাপটির শব্দ বানজারা শুনতে পায়৷ ব্যাপারটা কী বোঝার জন্য ও বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে৷ কিন্তু ততক্ষণে সব আবার চুপচাপ হয়ে গেছে৷ তখন বানজারা আর ঘর ছেড়ে বেরোয়নি৷ অনেক সময় রামুয়া আচমকা খেপে উঠে পা ছোড়াছুড়ি করে৷ ব্যাপারটা সেইরকম কিছু একটা ভেবে বানজারা আবার শুয়ে পড়ে৷ পাশে ঘুমিয়ে থাকা বউকেও আর ডাকেনি৷
সকালবেলা ঘর থেকে বেরিয়েই বানজারার বউ চিৎকার করে ওঠে৷ সেই চিংকার শুনে বানজারা ছুটে যায়৷ দ্যাখে রামুয়া গোয়ালঘরের বাইরে জলকাদার ওপরে কাত হয়ে পড়ে আছে—তখনও দেহ একেবারে অসাড় হয়ে যায়নি৷ আর ওর বকনা বাছুরটা গোয়ালঘরের ভেতরে চোখ কপালে তুলে শেষ৷
বানজারা আর ওর বউ মিলে বাছুরটার দেহ গোয়ালঘরের গুমোট অন্ধকার থেকে বাইরের খোলা হাওয়ায় নিয়ে আসে৷ তারপর ঘটির পর ঘটি জল ঢেলে মা-মেয়েকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু সবই বেকার৷ দুজনেরই দেহান্ত হয়ে যায়৷
অচ্যুতের দৃশ্যটা ভালো লাগছিল না৷ ও ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল৷
পিছন থেকে কুলদীপ ওর কাঁধে হাত দিল৷
অচ্যুত চমকে উঠল৷ কুলদীপ কখন এসেছে ও টের পায়নি৷
কুলদীপ হাতঘড়ি দেখে বলল, ‘চল, ক্লাস বসে যাবে৷ আজ তো আর ঘণ্টা পড়বে না৷’
‘ওই গোরু আর বাছুরটার কী করে এমন দশা হল বল তো!’
‘কী জানি!’ ঠোঁট ওলটাল কুলদীপ : ‘শোন, আজ সকালে মউলি ফোন করেছিল৷ ও আজ হিস্ট্রি কোচিং-এ যাবে না৷ তোর নোটটা নেক্সট উইকে ফেরত দেবে৷’
অচ্যুতরা কয়েকজন সুপারমার্কেটের কাছে ইতিহাস পড়তে যায়৷ ওখানে নগেনস্যারের কোচিং আছে৷ নগেনস্যার চিত্তরঞ্জন হাইস্কুলের টিচার ছিলেন—প্রায় বছরদশেক হল রিটায়ার করেছেন৷ নগেনস্যার যখন ইতিহাস পড়ান তখন অচ্যুতদের মনে হয় ওরা যেন সিনেমা দেখছে৷ ওদের চোখের সামনে চন্দ্রগুপ্ত, চাণক্য, মেগাস্থিনিস চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে৷