অচ্যুতের সঙ্গে প্রতীক ছিল৷ পরশুদিন সত্যবানস্যারের এরকম অদ্ভুত আচরণ ও নিজের চোখে দেখেছে৷ স্যার চলে যাওয়ার পর ও চাপা গলায় বলল, ‘যা-ই বল, স্যাটাস্যাট কিন্তু একেবারে চেঞ্জ হয়ে গেছে!’
অচ্যুত চুপ করে রইল৷ এই দেড় দিনে চুপ করে থাকাটা ওর দিব্যি অভ্যেস হয়ে গেছে৷
স্কুল ছুটির পর একটা বিচিত্র দৃশ্য অচ্যুতের চোখে পড়ল৷ ওরা যখন বেরোচ্ছে তখন দেখল সত্যবানস্যার মাঠের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বানজারার গোরু আর বাছুরকে আদর করছেন৷ ওদের গলার কাছে কুঁচি দেওয়া যে নরম চামড়া থাকে—যাকে গলকম্বল বলে—সেখানে হাত বোলাচ্ছেন৷ আর অবোলা জীব দুটো চুপটি করে দাঁড়িয়ে স্যারের আদর খাচ্ছে৷
গোরু-বাছুরকে আদর করা নিশ্চয়ই খারাপ নয়৷ কিন্তু সত্যবানস্যারকে আগে কখনও কেউ এরকম আদর করতে দ্যাখেনি৷
সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরার পথে নানান দুশ্চিন্তা অচ্যুতের মাথার ভেতরে ছোটাছুটি শুরু করে দিল৷
ঘণ্টাদুয়েক পর যখন ও সত্যবানস্যারের কোচিং-এ রওনা হল তখনও চিন্তাগুলো ওর মাথা থেকে যায়নি৷
আকাশ ঘোলাটে মেঘলা৷ ভেজা মেঘের আড়ালে আবছাভাবে চাঁদ দেখা যাচ্ছে৷ বেহিসেবি বাদলা হাওয়া কখনও-কখনও গাছগাছালির পাতা দুলিয়ে দিচ্ছে৷ ভাঙাচোরা রাস্তায় এখানে-ওখানে জল-কাদার নকশা৷ দোকানপাটে খদ্দেরের তেমন ভিড় নেই৷
পথচলতি সাইকেল রিকশা আর স্কুটারকে পাশ কাটিয়ে সাবধানে সাইকেল চালাচ্ছিল অচ্যুত৷ সত্যবানস্যারের কোচিং-এ স্কুলের পাশ দিয়েই যেতে হয়৷ যাওয়ার সময় দেখল, অন্ধকারে ভূতের মতো দোতলা স্কুল-বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে৷ শুধু বানজারার ঘরে আলো জ্বলছে৷
কোচিং-এ পৌঁছে প্রথম-প্রথম একটা ‘কী হয়, কী হয়’ ভাব থাকলেও শেষ পর্যন্ত কোচিং-এর সময়টা বেশ স্বাভাবিকভাবেই কাটল৷ গত সপ্তাহের মতো তুখোড় পেশাদার ঢঙেই পড়ালেন সত্যবানস্যার৷ অচ্যুতের অঙ্ক কষার কেরামতিকে তারিফ করলেন, ওর পিঠ চাপড়ে দিলেন৷ প্রতিটা অঙ্ক বেশ সহজ করে সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন৷ মনোযোগ দিয়ে খাতা দেখে দিলেন৷ সব মিলিয়ে কোথাও কোনও ছন্দপতন নেই৷
তবে একটা ব্যাপারে সামান্য খটকা লাগল অচ্যুতের৷
রাজীবের অঙ্কের অবস্থা প্রতীকের মতোই৷ তার ওপর রাজীবের আবার অঙ্ক নিয়ে আতঙ্ক আছে৷ অঙ্ক কষতে গিয়ে ও ঘন-ঘন আটকে যাচ্ছিল৷ সত্যবানস্যার অনেকক্ষণ ধরে ওকে লক্ষ করছিলেন৷ তারপর ওর কাছে গিয়ে আলতো করে ঘাড়ে হাত বোলাতে লাগলেন : ‘চেষ্টা কর, ঠিক পারবি৷ পৃথিবীতে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়—৷’
রাজীবকে আজ যেন স্যার বড্ড বেশি যত্ন নিয়ে অঙ্ক দেখাচ্ছেন৷ আগে কখনও এই যত্ন অচ্যুতের চোখে পড়েনি৷ তার ওপর ঘাড়ে যেরকম মোলায়েম করে হাত বোলাচ্ছেন তাতে বানজারার গোরু-বাছুরকে আদর করার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল৷
অচ্যুত মনে-মনে নিজেকে ধমক দিল৷ আজকাল ওর কী হয়েছে! সবকিছুতেই শুধু খটকা লাগছে! একজন স্যার কি হঠাৎই স্নেহপ্রবণ হতে পারেন না?
কিন্তু ধমক খেয়েও অচ্যুতের মন মানতে পারছিল না৷ বরং ভাবছিল, হঠাৎ করে কেউ যদি দেওয়াল বেয়ে হাঁটতে শুরু করে তা হলে তার আচমকা স্নেহপ্রবণ হয়ে উঠতে বাধা কী!
কোচিং শেষ করে ফেরার সময় রাজীব বলল, ‘অচ্যুত, আমি তোর সঙ্গে যাব৷ আমাকে পরেশদার কেকের দোকানে নামিয়ে দিবি৷’
রাজীবের সাইকেল নেই৷ অ্যাক্সিডেন্ট হবে এই ভয়ে বাবা-মা কিনে দেননি৷
কুলদীপ কোচিং ক্লাস চলার সময় অনেকবার অচ্যুতের দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে ইশারা করেছে৷ ঠোঁট উলটে মাথা নেড়েছে৷ অর্থাৎ, সন্দেহজনক কিছু নজরে পড়ছে না৷
অচ্যুত কোনও উত্তর দেয়নি৷
কোচিং-এর বাইরে বেরিয়ে অচ্যুতের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কুলদীপ বলল, ‘ধৈর্য চাই, ধৈর্য৷ সহজে এ-রহস্যের জট খুলবে না৷’
অচ্যুত ‘হুঁ—’ বলে সায় দিল৷
ওর সাইকেলে সামনের রডে বসার সময় রাজীব জিগ্যেস করল, ‘আমাকে ক্যারি করতে পারবি তো? এই জল-কাদায় যদি ফেলে দিস তা হলে জামা-প্যান্টের বারোটা বেজে যাবে৷ তারপর মাম্মির হাজারটা কোশ্চেন—৷’
‘তোর কোনও ভয় নেই৷ আমি তিনমাস ধরে ডাবল ক্যারি করছি৷’
ওকে বসিয়ে নিয়ে অচ্যুত সাবধানে সাইকেল চালাতে লাগল৷
এখন বৃষ্টি নেই৷ তবে কখন শুরু হবে কেউ বলতে পারে না৷ কাগজে লিখেছে কোথায় যেন নিম্নচাপ হয়েছে—তার জন্যই নাকি এরকম বাজে অবস্থা৷
একটু পরেই ওরা স্কুলের কাছাকাছি চলে এল৷
স্কুলের একরকম পাশেই এক প্রকাণ্ড পুকুর৷ তার ঢালু পাড়ে বড়-বড় মানকচু গাছ আর আগাছার ঝোপ৷ নাম-না-জানা লতানে গাছের দল আধো-অন্ধকারে সাপের মতো জড়াজড়ি করে রয়েছে৷
পুকুরপাড়ের বেড়ে ওঠা আগাছার রমরমাকে রুখে দিয়েছে ছোট-ছোট চার-পাঁচটা দোকান৷ দরমা, বাঁশ আর চাটাই দিয়ে ঘেরা চা-সিগারেট-পান-বিড়ির দোকান৷ সেখানে হ্যারিকেন বা কুপির আলো জ্বলছে৷
দোকানগুলোর ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে অন্ধকার আর কচু পাতার কালো ছায়া৷ সেখান থেকে নানান সুরে ভেসে আসছে ব্যাঙের ডাক৷
পুকুর পেরিয়ে স্কুলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গোরুর ‘হাম্বা’ ডাক অচ্যুতের কানে এল৷
অচ্যুত বলল, ‘স্যাটাস্যাট আজ তোকে ব্যাপক আদর করছিল৷’
‘হ্যাঁ রে, আমিও তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি৷ অন্যদিন কীরকম বকুনি দেয়! বলে, বাপিকে রিপোর্ট করবে…৷’