সুতরাং ছুটির ঘণ্টা পড়তে-না-পড়তেই অচ্যুত পা চালাল টিচার্স রুমের দিকে৷ দেরি করে গেলে টিচার্স রুম ফাঁকা হয়ে যেতে পারে৷ সেই ঝুঁকি অচ্যুত নিতে চায় না৷
টিচার্স রুমে গিয়ে দেখল অমিয়স্যার ছাড়া আরও অনেক স্যারই তখন সেখানে রয়েছেন৷ যদিও সত্যবানস্যারকে অচ্যুত দেখতে পেল না৷
অনুমতি নিয়ে অমিয়স্যারের কাছে গেল অচ্যুত৷ স্যারের কাছ থেকে খাতা নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে করিডর ধরে হাঁটা দিল৷
সিঁড়ি নামার সময় ওর কাঁধে কে যেন হাত রাখল৷
মুখ তুলে তাকাল অচ্যুত৷
সত্যবানস্যার৷ মুখে এক চিলতে হাসি৷ জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁট চাটছেন৷
আশেপাশে আরও কয়েকজন ছেলে সিঁড়ি বেয়ে নামছে৷ কিন্তু ওরা নিজেদের মধ্যে গল্প করতেই মশগুল৷
সত্যবানস্যার ওর সঙ্গে-সঙ্গে নামতে লাগলেন, আর চাপা গলায় কথা বলতে লাগলেন৷
‘জানিস তো, মানুষ অনেক সময় ভুল দ্যাখে! যেমন, তুই কাল বিকেলে যা দেখেছিস ভুল দেখেছিস৷ কারণ, তুই যা দেখেছিস সেটা প্রমাণ করতে পারবি না৷ আর প্রমাণ দিতে না পারলে কেউ তোর কথা বিশ্বাসও করবে না৷’ স্যার হিসহিস শব্দ করে হাসলেন : ‘এখন বিজ্ঞানের যুগ৷ সবাই শুধু প্রমাণ চায়৷’
গলা শুকিয়ে কাঠ৷ কাঁধের ওপরে স্যারের আঙুলের চাপে ব্যথা লাগছে৷ মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে৷ অচ্যুতের মনে হচ্ছিল এখুনি বুঝি ও অজ্ঞান হয়ে যাবে৷
একতলায় নেমে সত্যবানস্যার বাঁদিকে কয়েক পা হেঁটে গেলেন৷ ক্লাস ফাইভের বি সেকশানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন৷
অচ্যুত কাঠের পুতুলের মতো স্যারের পাশে-পাশে হাঁটছিল৷ স্যার থমকে দাঁড়াতেই ও-ও দাঁড়িয়ে পড়ল৷
এদিকের বারান্দাটা এর মধ্যেই ফাঁকা হয়ে গেছে৷ সুতরাং ওদের কথা শুনতে পাবে কাছাকাছি এমন কেউ নেই৷
ক্লাসরুমের দরজার কাছটায় অচ্যুতকে একরকম ঠেলেই নিয়ে গেলেন সত্যবানস্যার৷ চাপা গলায় বললেন, ‘শোন, কাউকে কোনও কথা বলবি না৷ অবশ্য বললেও কেউ আমল দেবে না৷ ওরে, মানুষের কি ভুল দেখার কোনও শেষ আছে! এই দ্যাখ—!’ বলেই স্যার অচ্যুতের চোখে তাকালেন৷
অচ্যুত দেখল, সেখানে ধকধক করছে দুটো সবুজ টুনি বালব৷ আর তার মধ্যে দুটো কালো ফুটকি হল চোখের মণি৷
‘এটাও তুই ভুল দেখছিস৷’ মিহি সুরেলা গলায় সত্যবানস্যার বললেন, ‘কারণ, তুই এটা প্রমাণ করতে পারবি না৷ সুতরাং তোর কথা কেউ বিশ্বাস করবে না৷’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সত্যবানস্যার৷ তার হিমেল ঝাপটা অচ্যুতের মুখ ছুঁয়ে গেল৷ অচ্যুতের গায়ে কাঁটা দিল৷
ও লক্ষ করল, স্যারের চোখের সবুজ রং ধীরে-ধীরে ফিকে হয়ে সাদাটে হয়ে গেল৷ তারপর সামান্য ছাই-রং হয়ে কটা চোখের চেহারা নিল৷ তারপর কালচে হয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল৷
সত্যবানস্যার হাসলেন, ‘তুই কাউকে কিচ্ছু বলবি না! কারণ, তুই আসলে কিছুই দেখিসনি৷ কাল সন্ধেবেলা কোচিং-এ আসবি, কামাই করবি না৷ ভাবিস না, তুই পালিয়ে বাঁচবি৷ আমাদের হাত থেকে পালানো যায় না—৷’
অচ্যুত ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিল৷ ওর মুখ থেকে কোনও শব্দ বেরোল না৷ কাঁধের ওপর স্যারের বাঁকানো আঙুলের চাপ যেন ছুরি বিঁধিয়ে দিচ্ছিল৷
‘এখন যা৷’ সত্যবানস্যার ওর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ওকে আলতো করে ঠেলে দিলেন : ‘তুই কিন্তু কিছুই দেখিসনি—৷’
অচ্যুত আর-একটু হলে টলে পড়ে যাচ্ছিল৷ কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ও মাঠে নামার সিঁড়ির ধাপের দিকে এগোল৷ ভয়ে পিছন ফিরে তাকাতে পারল না৷
জল-কাদা পেরিয়ে যখন ও সাইকেল-স্ট্যান্ডের কাছে পৌঁছল তখন প্রতীক ওকে পিছন থেকে ডাকল৷
অচ্যুত ফিরে তাকাতেই প্রতীক জিগ্যেস করল, ‘তোকে স্যাটাস্যাট ওরকম হাসতে-হাসতে কী বলছিল রে?’
‘কিছু না৷ কাল কোচিং-এর খাতা-বই ঠিকমতো নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিল৷’ অচ্যুতের গলা সামান্য কেঁপে গেল৷
‘তোকে স্যার হেভি ফেভার করে৷’ বেজার মুখে বলল প্রতীক, ‘অবশ্য ফেভার তো করবেই! তুই অঙ্কে একশোয় একশো পাস, আর আমার নম্বরটা চার কি পাঁচ দিয়ে গুণ করলে তবে একশো হয়৷ তবে অঙ্ককে আমি মোটেই ভয় পাই না৷ পারি-না-পারি, লড়ে যাই৷’
অচ্যুত হাসতে পারল না৷
কারণ, সত্যবানস্যারের একটা কথা বারবার ওর মনে কাঁটার মতো বিঁধছিল৷
বাড়ি ফিরেও ওর খচখচানিটা গেল না৷
স্যার বলেছেন, ‘…আমাদের হাত থেকে পালানো যায় না—৷’
এর মানে কী?
.
৷৷চার৷৷
অচ্যুত রাতে কুলদীপ আর সৌরভকে ফোন করল৷ পড়াশোনা নিয়ে কথা বলল, কোচিং নিয়ে কথা বলল, কিন্তু সত্যবানস্যারের কথা বলল না৷ বরং কুলদীপ উৎসাহ নিয়ে সত্যবানস্যারের রহস্য ভেদ করার ব্যাপারে নানান উদ্ভট পরামর্শ দিল৷ বলল, ‘স্যারকে ফলো করতে হবে, বুঝলি! সবসময় নজরে-নজরে রাখতে হবে৷ তা হলেই কেসটা বোঝা যাবে৷’
অচ্যুত তখন ভাবছিল, কুলদীপ তো আর স্যারের সবুজ চোখ দ্যাখেনি! দেখলে বোঝা যেত ওর এখনকার এত সাহস কতটা চুপসে যায়৷
রাতে বিছানায় শুয়ে অচ্যুত একরকম জেগেই রইল৷ ওর ভেতর থেকে ভয়টা কিছুতেই যেতে চাইছিল না৷ পরদিন স্কুলে যাওয়া নিয়ে সামান্য ভয় করলেও সেটা মা-বাপিকে বুঝতে দিল না৷ মনে-মনে ঠিক করল, স্কুলে কখনও ও আর একা থাকবে না৷ যেখানেই যাক, দু-একজন বন্ধুকে সঙ্গে নেবে৷ এমনকী টয়লেটে গেলেও৷
স্কুলের সময়টা শান্তিমতোই কেটে গেল৷ তবে একবার সত্যবান-স্যার করিডরে অচ্যুতের পাশ দিয়ে হেঁটে গেছেন—কিন্তু ওকে চিনতে পারেননি৷