নীচুগলায় ওর সঙ্গে কথা বলল অচ্যুত৷
বলল, অমিয়স্যারের দেখা পায়নি৷ আর সত্যবানস্যারকে ওইরকম করতে দেখেছে৷
কুলদীপ ও-প্রান্তে শিস দিয়ে উঠল, বলল, ‘কীসব যা-তা বলছিস!’
অচ্যুত বলল, ‘মা-কালীর দিব্যি—৷’
কুলদীপ আবার চাপা শিস দিল৷ উত্তেজিত হয়ে উঠলে ও শিস দেয়৷ আর মেজাজ ভালো থাকলে শিস দিয়ে গান শোনায়৷
অচ্যুত এলোমেলোভাবে ওকে সব খুলে বলল৷ জট পাকানো হলেও গোটা গল্পটা বুঝতে কুলদীপের অসুবিধে হল না৷ সব শোনার পর ও বিড়বিড় করে শুধু বলল, ‘স্যাটস্যাট আগের জন্মে বোধহয় টিকটিকি ছিল…’
কুলদীপের রসিকতায় অচ্যুতের হাসি পেল না৷ ওর মনে পড়ল, টিচার্স রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ওর হাত-পা ঠকঠক করে কেঁপেছিল৷
টিফিনের ঘণ্টা পড়তেই অচ্যুতের চমক ভাঙল৷
ক্লাসের অন্যান্য ছেলে বই-খাতা ডেস্কে ঢুকিয়ে হুড়মুড় করে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে পড়ল৷ করিডরে ওদের হুটোপাটি ছুটোছুটিতে হুল্লোড় বেধে গেল৷ কার টিফিন বক্স ছিটকে পড়ল মেঝেতে৷ ঠং করে আওয়াজ হল৷ লুচি আর আলুভাজা ছড়িয়ে পড়ল৷ বুট পরা ছুটন্ত পা-গুলো নিমেষে সেগুলো মাড়িয়ে চলে গেল৷ কারও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই৷ কতক্ষণে নীচের মাঠে গিয়ে পৌঁছবে সেই চিন্তায় সব মশগুল৷
কুলদীপ আর অচ্যুত বেরোল সকলের শেষে৷ ওদের হাতে টিফিন বক্স৷
সিঁড়ি দিয়ে নামার মুখে রাজীব দাসের সঙ্গে ওদের দেখা হল৷ মুখ কালো করে এক পা এক পা করে নামছে৷
গতকাল অমিয়স্যারের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় হেডস্যারকে ম্যানেজ করার ব্যাপারটা ভেস্তে গেছে৷ অচ্যুত রাজীবকে সেটা বলতেই ও কাচুমাচু মুখ করে বলল, ‘আমি স্কুলে এসেই হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করেছি৷ বলেছি, আজ মাম্মি আর বাপি কলকাতায় গেছে, কাল এসে দেখা করবে৷ বিপদে পড়ে মিছে কথা বলতে হল৷ তোরা আমাকে সেভ কর৷ তোরা আজ অমিয়স্যারকে একটু বল—প্লিজ! আচ্ছা, মানুষের কি ভুল হয় না?’
রাজীবের চোখে জল এসে গেল৷
কুলদীপ বলল, ‘অ্যাই, বাংলা সিনেমার লাস্ট সিনের মতো কাঁদবি না৷ আজ তোর ব্যাপারটা ফয়সালা করে দেব৷ এখন টিফিন খেয়ে বল খেল গিয়ে৷’
অচ্যুত আর কুলদীপ জামগাছতলার সিমেন্ট বাঁধানো বেদির ওপরে গিয়ে বসল৷ প্রতীক ওদের কাছে বসতে এসেছিল, কিন্তু কুলদীপ ওকে বলল, ‘কিছু মনে করিস না—অচ্যুতের সঙ্গে আমার একটু প্রাইভেট টক আছে৷’
প্রতীক সন্দেহের চোখে কুলদীপকে দেখল৷ আজকাল ওকে মাঝে-মাঝেই ‘কমলাবালা গার্লস হাইস্কুল’-এর গেটের কাছে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে৷ সে-ব্যাপারে প্রাইভেট কথা কি না কে জানে!
কিছু না বলে প্রতীক ভুরু উঁচিয়ে ঘাড় নেড়ে চলে গেল৷
মিহি বরফের গুঁড়োর মতো বৃষ্টি পড়ছে৷ বাদলা হাওয়ায় সেই গুঁড়ো মুখে উড়ে এসে আরাম ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ মেঘের চাপা গুড়গুড় শোনা যাচ্ছে কখনও-কখনও৷ একটু দূরে, স্কুলের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে, বানজারার গোরু রামুয়া আর তার বাছুর আপনমনে ঘাস খাচ্ছে৷
দুজনের টিফিন মিলিয়ে-মিশিয়ে খেতে-খেতে কুলদীপ বলল, ‘স্ট্রেটকাট বল তো, স্যাটাস্যাটের এগেইনস্টে কী অ্যাকশন নিতে চাস?’
অচ্যুত কুলদীপের চোখে তাকাল : ‘অ্যাকশন নেব কী, ব্যাপারটা ঠিক কী, সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না৷’
‘স্যাটাস্যাটকে একটু ওয়াচ রাখতে হবে৷’
‘যদি আমাকে ধরে কিছু বলে?’ অচ্যুতের বুকের ভেতরে কেমন যেন শব্দ হচ্ছিল৷
‘ধুস, কী আর বলবে! বলবে যে, আমি দেওয়াল বেয়ে টিকটিকির মতো হাঁটছিলাম! তুমি কিছু মাইন্ড কোরো না৷…তা ছাড়া তোকে তো আর একা পাচ্ছে না যে বলবে!’
অচ্যুতের মুখ দেখে মনে হল না খুব ও একটা ভরসা পেয়েছে৷ ও চুপচাপ বসে বর্ষাভেজা প্রকৃতি দেখতে লাগল৷
কিছুক্ষণ পর কুলদীপ তাড়া লাগাল, ‘চল, অমিয়স্যারের সঙ্গে দেখা করে তারপর ক্লাসে যাব৷ রাজীবের ব্যাপারটা আগে বলা দরকার৷ নইলে ওর প্রবলেম হয়ে যাবে৷’
বেদি ছেড়ে ওঠার সময় অচ্যুত বলল, ‘সত্যবানস্যারের কেসটা কিন্তু কাউকে বলিস না৷’
কুলদীপ মাথা নেড়ে সায় দিল৷
মনিটর বাসব আর প্রতীককে সঙ্গে নিয়ে অচ্যুত আর কুলদীপ টিচার্স রুমে গেল৷ অমিয়স্যারকে অনেক করে বলে-কয়ে ওরা রাজীবের গার্জেনকল ঠেকাল৷ অমিয়স্যার অচ্যুতকে বললেন, ‘অ্যাই, তোর বাংলা খাতাটা আমার দেখা হয়ে গেছে৷ এত বানান ভুল করিস কেন রে? অভিধান অবলোকন করবি৷ ছুটির পর এসে খাতাটা নিয়ে যাস৷ কাল বর্ষণের জন্যে আমি একটু আথিবিথি বেরিয়ে গিয়েছিলাম৷’
আবার সেই ‘ছুটির পর’! তার ওপর আবার ‘আথিবিথি’! অমিয়স্যারের সঙ্গে পরিচয় না হলে অচ্যুত কোনওদিন জানতেই পারত না ওর মাতৃভাষায় এত মারপ্যাঁচ আছে৷
অচ্যুতের চোখ অনেকক্ষণ ধরেই চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছিল৷ স্যারদের বসার বিশাল টেবিলের শেষ প্রান্তে সত্যবানস্যার বসে আছেন৷ কী একটা বইয়ের পাতায় ডুবে আছেন৷ চারপাশের জগৎ সম্পর্কে কোনও হুঁশ নেই৷
অচ্যুত অমিয়স্যারের কথার ওপরে কথা বলতে পারল না৷ শুকনো মুখে ঘাড় নাড়ল৷ ছুটির পরই ও স্যারের সঙ্গে দেখা করতে আসবে৷
টিফিন শেষের ঘণ্টা একটু আগেই বেজেছে৷ ওরা চারজন তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ক্লাসে ফিরে চলল৷
অচ্যুতের মনে অশান্তির ঝড় দ্বিগুণ হয়ে গেল৷ ও কি স্যারের সঙ্গে দেখা করতে একা যাবে, নাকি কুলদীপ, বাসব, কিংবা সৌরভকে সঙ্গে নিয়ে যাবে? কিন্তু সঙ্গে কাউকে নিয়ে গেলে অমিয়স্যার বিরক্ত হতে পারেন৷ তা ছাড়া টিচার্স রুমে সত্যবানস্যার তো ওকে আর একা পাচ্ছেন না!