মাঠের বাঁদিকে একটা দোলনা আর স্লিপ—নীচু ক্লাসের ছেলেদের খেলার জন্য৷ আর তার পিছনেই সাইকেল রাখার জায়গা৷
সাইকেল রেখে অচ্যুত স্কুল-বাড়ির দিকে এগোল৷
বড় মাপের ছড়ানো দোতলা বাড়ি৷ তার পলেস্তারা-খসা রং-চটা চেহারার দিকে খুব খুঁটিয়ে নজর করলে বোঝা যায় একসময়ে বাড়িটার রং গোলাপি ছিল৷
স্কুল-বাড়ির একতলার দেওয়ালে তেল রঙে বড়-বড় করে আঁকা মনীষীদের রঙিন ছবি৷ বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিবেকানন্দ, রামমোহন, সবাই সেখানে হাজির৷ বৃষ্টির জলে ধোয়া ছবিগুলো ঝকঝক করছে৷
ওঁদের ছবির দিকে তাকিয়ে সত্যবানস্যারের ব্যাপারটা অচ্যুত কিছুতেই সত্যি বলে মেনে নিতে পারছিল না৷
গায়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তেই আকাশের দিকে তাকাল অচ্যুত৷ আবার শুরু হল৷ এবার পুজোয় বৃষ্টির পিছু ছাড়াতে পারলে হয়৷ ও একতলার বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির ধাপের দিকে এগোল৷
বানজারার ঘণ্টার পর ক্লাস শুরু হল বটে তবে অচ্যুত ভীষণ আনমনা হয়ে রইল৷ গতকালের ঘটনাটা ওর বুকের ভেতরে ঘুরপাক খেয়ে মাথা খুঁড়ে মরছিল৷
প্রথম পিরিয়ডের ঘণ্টা পড়তেই ও চমকে উঠল৷ কারণ, সেকেন্ড পিরিয়ডটা অঙ্কের—সত্যবানস্যারের ক্লাস৷
অচ্যুত কুলদীপের দিকে তাকাল৷ কুলদীপ দুটো সারি পিছনে বসে৷ ওর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই কুলদীপ ইশারা করল৷ যার অর্থ, এক্ষুনি স্যাটাস্যাট আসছেন৷
এখনও পর্যন্ত অচ্যুত শুধু কুলদীপকেই ঘটনাটা বলেছে৷ আর কাউকে নয়৷ এমনকী বাপি-মা-কেও নয়৷
সত্যবানস্যার ক্লাসে এসে ঢুকলেন৷
টকটকে ফরসা রং৷ পিছনদিকে টেনে আঁচড়ানো তেলচকচকে চুল৷ চোখে সরু কালো ফ্রেমের চশমা৷ গাল সামান্য ভাঙা—চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে রয়েছে৷ লম্বাটে নাকের নীচে সরু গোঁফ৷ গালে দাড়ির নীলচে আভা৷
সত্যবানস্যারের পরনে সাদা হাফশার্ট আর গাঢ় বাদামি প্যান্ট৷ চেহারা বেশ রোগা হওয়ায় প্যান্টটা ঢলঢল করছে৷ গতকাল স্যার এই পোশাকই পরেছিলেন৷
অচ্যুত খুব খুঁটিয়ে স্যারকে দেখছিল৷ অঙ্ক করতে-করতে মাঝে-মাঝেই কেমন আনমনা হয়ে যাচ্ছেন আর জিভ বের করে ঠোঁটজোড়া চেটে নিচ্ছেন৷ তেষ্টা পেলে মানুষ যেমন করে৷
কিন্তু এরপরই এক অবাক কাণ্ড হল৷
বীজগণিতের অনুপাত আর সমানুপাতের কুড়ি প্রশ্নমালার অঙ্কগুলো বোর্ডে স্যার বোঝাচ্ছিলেন৷ সেই অঙ্ক হঠাৎই আটকে গেল!
অচ্যুত যতদূর জানে সত্যবানস্যারের অঙ্ক কখনও আটকায়নি৷ কিন্তু আজ এ কী কাণ্ড!
সত্যবানস্যার বোর্ডের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে মাথা চুলকোতে লাগলেন৷ আঙুলে ধরা চকটা শূন্যে ঘুরিয়ে মনে-মনে যেন অঙ্কটা কষে ফেলতে চাইলেন৷
অচ্যুতের মনে পড়ে গেল গতকালের কথা৷ টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে সত্যবানসার একজন অচেনা মানুষের মতো ওদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন৷ তারপর স্কুল ছুটির পর টিচার্স রুমের দেওয়ালে ওই কাণ্ড! আর এখন, বরাবর যিনি স্যাটাস্যাট অঙ্ক করেন, তাঁর অঙ্ক গেছে আটকে!
স্যারের কি তা হলে কিছু হয়েছে?
সত্যবানস্যার অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর চেয়ারে বসে পড়লেন৷ অঙ্ক কষা নিয়ে এলোমেলো ধানাইপানাই করে চললেন৷ তারপর, ক্লাস শেষ করে চলে যাওয়ার সময়, কুলদীপকে বললেন, ‘কুলদীপ, তোরা কাল সন্ধেবেলা তো কোচিং-এ আসছিস, তখন ভালো করে এটা বুঝিয়ে দেব৷’
অচ্যুত, কুলদীপ, প্রতীক, রাজীব আর সৌরভ সত্যবানস্যারের কোচিং-এ একই ব্যাচে পড়ে৷ স্যারের বাড়ি নৈহাটি৷ তবে প্রতিদিন স্কুলের পর কোচিং সেরে রাতের ট্রেন ধরেন৷ তবে কখনও-কখনও রাত হয়ে গেলে কোচিং-এর ঘরটাতেই থেকে যান৷
পরের দুটো পিরিয়ড অচ্যুতের আর কাটতে চাইছিল না৷ ও ভাবছিল, কতক্ষণে টিফিন হবে আর ও কুলদীপকে নিয়ে আলোচনায় বসবে৷
গতকাল বাড়ি ফিরে পড়াশোনায় মন বসাতে পারেনি অচ্যুত৷ সত্যবানস্যারের দেওয়ালে হাঁটার দৃশ্যটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল৷ একটা লতানে গাছ যেন সাপের মতো এঁকেবেঁকে সড়সড় করে বেড়ে চলেছে৷
লেখাপড়ার চেষ্টা ছেড়ে টিভিতে ই. এস. পি. এন. আর স্টার স্পোর্টস চ্যানেল দেখতে বসে গিয়েছিল, কিন্তু স্যার টিভির পরদাতেও হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন৷
মা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে চোখ সরু করে ওকে দেখছিল৷ অনেকক্ষণ দেখার পর কাছে এসে জিগ্যেস করল, ‘তোর কী হয়েছে রে?’
‘কিচ্ছু না৷’ অচ্যুত মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারল না৷ শূন্য দৃষ্টিতে টিভির পরদার দিকে চেয়ে রইল৷
‘তখন থেকে দেখছি কেমন উসখুস করছিস?’
কোনও জবাব দিল না অচ্যুত৷
‘স্কুলে ঝগড়া-মারপিট করেছিস?’
‘না৷’ মাথা নাড়ল অচ্যুত৷ টিভির দিক থেকে চোখ সরাল না৷
মা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল৷ ছেলের মনের ভেতরটা বুঝতে চেষ্টা করল৷ তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরে গেল রান্না-ঘরের দিকে৷ ভাবল অচ্যুতের বাবা এলে ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলবে৷ ছেলে বড় হচ্ছে৷ স্কুলে কী সমস্যা বাধিয়ে এসেছে কে জানে!
অচ্যুতের বাবা এখন বাড়িতে নেই৷ অফিস থেকে ফিরে বটতলার মিষ্টির দোকানের কাছে তাসের আড্ডায় মেতে আছে৷ ফিরতে-ফিরতে রাত দশটা৷
অচ্যুত যখন টিভি, রেডিয়ো, ওয়াকম্যান, বারান্দা, এ-ঘর, ও-ঘর করে ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে গিয়ে পড়ার টেবিলে বসেছে, ঠিক তখনই কুলদীপের ফোন এল৷
অচ্যুত ফোন করেনি দেখে কুলদীপই ওকে ফোন করেছে৷